পাকদণ্ডী – ২.১

॥ ১ ॥

আমাদের বিয়ের একটা যেমন-তেমন ন্যাড়া বিবরণী দিই শোন। আমাদের বিয়ের দিন দারুণ বৃষ্টি পড়েছিল। ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি, বৃষ্টি পড়ার কোন কারণ ছিল না। পথ-ঘাট ভেসে গেল, সন্ধ্যার আগে গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সুখের বিষয়, ঘণ্টা দুয়ের মধ্যে জল থেমেও গেল। পরে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তর মেম স্ত্রী নেলী বললেন, এরকম হওয়া ভালো। আমাদের দেশে বলে, এর ফলে ‘বিবাহিত জীবনে ঝগড়া-ঝাঁটি হয় না।’ তা জানি না, কিন্তু গত ঊনপঞ্চাশ বছরে আমাদের যথেষ্ট ঝগড়া-ঝাঁটি হয়েছে। সে যাক্গে।

মোট কথা, আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় লেগেছিল পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট। পৌর অ্যাক্ট নতুন চালু হয়েছিল, নাম সই করে বিয়ে। তার তিন-চার জন সাক্ষী, আবার সেই সাক্ষীদের আরো তিন-চার জন সাক্ষী সই হয়ে গেলেই চুকে গেল। রেজিস্ট্রারের অফিসে এক কপি, আমাদের কাছে এক কপি। তা সেই কপিটা আনা হয়নি শেষ পর্যন্ত। কি লেখা ছিল, তা-ও মনে নেই। তবে একথা মনে আছে, আমার সোনা পিসিমার ছেলে মুকুল বসু, (আমার মুকুল দা) শুধু আমার পক্ষের সাক্ষী হয়নি, ওর নিজের গাড়ি করে আমাকে অকুস্থলে নিয়ে গিয়েছিল পর্যন্ত। সেজন্য এক বছর বাবার কাছ থেকে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছিল।

অবিশ্যি এর মূলে ছিলেন আমার পিসিমা। বাবাকে কব্জা করতে না পেরে, আমার দরকারের সময়ে এইভাবে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। মা-মাসি-পিসি-খুড়ি-জেঠির মতো কে-বা আছে। ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে পিসিমার ঝগড়া, বাবা নাকি গায়ের জোরে জিততেন।

আসল ব্যাপার হল যে, বাবার অমতে বিয়ে হয়েছিল। সে এক বছর-জোড়া লোমহর্ষণ কাহিনী। পাত্রকে বাবা আগে চিনতেন এবং খুবই পছন্দ। সেই হল মজা। হিন্দু পাত্র। যদি ব্রাহ্ম মতে বিয়ে করে তো আপত্তি ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি, বাবা নিজেও ছিলেন হিন্দু পাত্র, তবে ব্রাহ্ম মতে বিয়ে করেছিলেন। আমাদের বেলা তাও নয়। ফলে যা হবার তাই হল। আমাদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হল না। ভাবো একবার, না আশীর্বাদ, না অধিবাসের তত্ত্ব, (পূর্ব বাংলায় যাকে অধিবাস বলে, এদিকে তাকে গায়ে-হলুদ বলে) না রসুনচৌকি, না বরযাত্রীদের শোভাযাত্রা, এমন কি, না পুরুত-আচার্য, মন্ত্র-গান, না কিচ্ছু।

তবে কি করে ভালো স্ত্রী হতে হয়, সে বিষয়ে দু-চারটি চোখা-চোখা কথা বলতে রেজিস্ট্রারমশাই ছাড়েন নি। কে-না জানে এম্-এ পাস করা, কলেজের মাস্টারনী এবং প্রায় পঁচিশ বছর বয়সের মেয়েদের পক্ষে ভালো স্ত্রী হওয়া কি কঠিন ব্যাপার।

আমার বন্ধু অলকা মালা বদল করাল, আমার আঙুলে প্লেন সোনার একটা তিন সাইজ বড় আংটি পরানো হল। বিয়ের বর অলকার মামা, বিয়ে হচ্ছে অলকার বাবা বাঘ-শিকারী কুমুদনাথ চৌধুরীর মে-ফেয়ারের বাড়িতে এবং তিনি নিজেও একজন সাক্ষী। কাজেই আমার চেয়ে দেড় বছরের বড় অলকা একরকম কন্যা-কর্ত্রী হয়ে বসল।

দু-পুরুষের জানা-শুনো পরিবার। অলকার মা-মাসিরা আমার মা-মাসিদের বেথুনের সহপাঠিনী। বিয়েটাই বলা যেতে পারে অলকার একা-হাতের চক্রান্তে সম্ভব হয়েছিল। তবে পাত্রটিকে মনে ধরেছিল বলে আমিও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলাম। বাড়িতে এত গঞ্জনা, এত অশান্তি সত্ত্বেও মত বদলাইনি। তবে সত্যি কথাই বলব, যদি মনে হত, মা এতে দুঃখ পাবেন, তাহলে কতখানি সাহস পেতাম জানি না। মায়ের নীরব সমবেদনা থাকলেও বাবার একটি কথার প্রতিবাদ করেননি। এই রকম ছিল তাঁর কর্তব্যবোধ। ভাই-বোনেরা সকলে আমার পক্ষাবলম্বী। যদিও প্রায় সবাই তখন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী। দিদি এম-এ বিটি পাস করে, গোখ্লেতে সামান্য মাইনেয় পড়ায়। সে আমাকে বেনারসি শাড়ি আর কিংখাবের ব্লাউজ আর তার জমানো এক হাজার টাকা দিয়েছিল।

সে এক বিয়ে বটে। কনের বয়স প্রায় পঁচিশ, অনেকেরই মতে বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে। অবিশ্যি দেখে মনে হত আঠারো-উনিশ। রোগা শ্যামা, মাথা-ভরা কোমর অবধি লম্বা চুল, দেখতে খারাপ না হলেও, কোনোমতেই রূপসী বলা চলে না। চলেছি ছত্রিশ বছর বয়সের—দেখে মনে হতো ছেচল্লিশ, কারণ কুড়ির আগেই চুলে পাক ধরেছিল—সদ্য আমেরিকা ফেরত, ছ-ফুট লম্বা, সুদর্শন, সংস্কৃত জানা, সাহিত্য সঙ্গীত-রসিক, দাঁতের ডাক্তার পাত্রকে বিয়ে করতে। আমার না ছিল বিশেষ রূপ, না ছিল এক কানা কড়ি যৌতুক। ওদের বন্ধু বান্ধব আত্মীয়-স্বজনরা আড়ালে কি মন্তব্য করেছিলেন খানিকটা আঁচ করা যায়।

তবে আমার ভক্তরা আর আশুতোষ কলেজের ছাত্রীরা হতাশ! আড়াল থেকে দেখে, তাদের চোখে জল! লীলাদির বাবা কি নিষ্ঠুর! অমন গুণের মেয়েকে কি-না বুড়ো বরের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন! অনেকটা অন্ধদের হাতি দেখার ব্যাপার! তবে এ বিষয়ে কারো কোনো কথায় আমাদের বিন্দুমাত্র এলে যেত না। অনেক চিন্তা করে মন ঠিক করে ফেলেছিলাম, তার আর নড়চড় হয়নি। এখন মনে হয়, বাবা যদি রাগমাগ না করে, বেদনা-আবেগের শরণাপন্ন হতেন, তাহলে মন ঠিক করাটা আরো শক্ত হত। ভাগ্যিস্ আমার সঙ্গে কনসাল্‌ট করেননি!

সে যাক গে। সেই সন্ধ্যায় কলকাতার পথে এক হাঁটু জল দাঁড়িয়েছিল। আধঘণ্টার বৃষ্টিতে। যারা বলে পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতার রাস্তায় বেশি জল দাঁড়াত না, তারা কিছু জানে না। তবে খানিকটা স্নেহের বশে আর বেশিটা কৌতূহলের জন্যে ঐ জল ভেঙে সাড়ে সাতশো অতিথি আমাদের বিয়ের ভোজ খেয়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। অবিশ্যি খাননি। সেকালে গাড়িও উঁচু উচু হত। তাই আসতে পারলেন। রবীন্দ্রনাথের নিজের নকশায়, নিজের হাতের তৈরি ছোট একটি চামড়ার হ্যাণ্ডব্যাগ উপহার দিয়েছিলেন। সেটি আমার কাছে এখনো আছে।

মে-ফেয়ারে রেজিস্ট্রির পর আমরা জল ঝড় মাথায় করে উত্তর কলকাতায় কারবালা ট্যাংক লেনে আমার শয্যাশায়ী সাতাত্তর বছর বয়সের শ্বশুর মশাইকে প্রণাম করে এলাম। তিনি আমার হাতে সোনা-বাঁধানো লোহা পরিয়ে আশীর্বাদ করলেন। আহ্নিক না করে জলস্পর্শ করতেন না, কিন্তু আমাকে আদর করে নিয়েছিলেন। আমার মা ব্রাহ্মণের মেয়ে, বাবা কায়স্থ, আমরা ব্রাহ্ম—এ সব তুচ্ছ ব্যাপার তিনি গ্রাহ্যই করলেন না। আমাকে বললেন, ‘মুরগি খাওয়াটা যদি ছাড়তে পার, আমি সেরে উঠে তোমার কাছে থাকব, তোমার রান্না খাব।’ মনে হয়েছিল এই উদার মানুষটির জন্য সব ছাড়তে পারি। কিছুই ছাড়তে হয়নি অবিশ্যি, উনি আর সেরে ওঠেননি। লিভারের অ্যাবসেস হলে তখন কেউ বাঁচত না, উনিও পাঁচ মাস না কাটতেই স্বর্গে গেলেন। রেখে গেলেন আমার মনের মধ্যে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকদের জন্যে একটি কোমল উষ্ণ জায়গা। ছোট বেলায় অনেক শুনেছিলাম, হিন্দুরা বড় অনুদার। কাজের বেলায় ঠিক তার উল্টোটি দেখলাম। হিন্দু পরিবারে বিয়ে হয়ে আমি খুব সুখী হয়েছি। আমি ঠাকুর পুজো করি না, জাত মানি না। তাছাড়া কোন তফাৎ দেখি না। বহু হিন্দু বন্ধুরাও ওসব করেন না। অনুষ্ঠিত ধর্মের ওপর চিরকালই আমার বিরাগ।

যাই হোক, কারবালা ট্যাংক থেকে ফেরবার পথে দেখলাম সার্কুলার রোডে জল বেড়েছে। আমার স্বামীর বুইক গাড়ি সন্তর্পণে তারি উপর দিয়ে যখন থিয়েটার রোডে আমার জ্যাঠতুতো ভাসুর খগেন্দ্রনাথ মজুমদারের বাড়ির সামনে দাঁড়াল, দেখলাম লোকজনে, আলোয়, আনন্দ-কোলাহলে বাড়ি গমগম করছে। ঐখানে আমাদের বিয়ের ভোজ হল। সাড়েসাতশো লোক চিংড়িমাছের মালাই কারি, রাবড়ি, ইত্যাদি ভালো ভালো জিনিস খেয়ে আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে অনেক রাতে বাড়ি গেল। দুঃখের বিষয় আমার মনের অবস্থা এমন ছিল না যে ঐসব উপভোগ করি।

সেই উনিশে ফেব্রুয়ারী, উনিশশো তেত্রিশ থেকে আমার নতুন জীবন শুরু হল। বলেছি তো সবই হল উল্টোরকম! বিয়ের ভোজ হল বরের বাড়িতে। এমন কথা কেউ শুনেছে? সেই সন্ধ্যায় যাদের সঙ্গে দেখা হল, তারাই হয়ে দাঁড়াল আমার সারা জীবনের সঙ্গী। তাই বলে পুরনো বন্ধুরা কেউ আমাকে ছেড়ে যায়নি। যাবেই বা কেন, তারা তো প্রায় সবাই হিন্দু। বিয়ের নেমন্তন্ন হয়েছিল আমার আত্মীয়-স্বজনদেরো। এসেছিলেন সবাই। বাবা এবং মা, ভাইবোনরা ছাড়া। দাদা একবার জিজ্ঞেস করেছিল, বলেছিলাম ‘অশান্তি বাড়িও না।’

আমার বড়দি সুখলতা রাও এ-রকম শুধু নাম-সই করা বিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অনেকগুলো কড়া কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি আর আমার ভগ্নীপতি ডাঃ জয়ন্ত রাও-ও এসেছিলেন। এঁরা আমার স্বামীর পুরনো পেশেন্ট ও বন্ধুজন। সেকালের ঐসব বিরোধের কথা ভাবতে এখন আশ্চর্য লাগে। এত তিক্ততা, উষ্ণতার কিন্তু আদৌ হৃদয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ মতামতের ব্যাপার। তবু এত ধোঁয়া, এত আগুন কেন, বোঝা যায় না।

খালি বাবা আমাকে ত্যাগ করলেন। পরদিন সকালে সব কথা ভুলে, দুজনে গেলাম বাবাকে প্রণাম করতে। তিনি আমাদের দেখেই ঘর থেকে উঠে চলে গেলেন। শুধু ঘর থেকেই নয়, আমার জীবন থেকেই সরে পড়লেন। তারপর আঠারো বছর বেঁচে ছিলেন, কখনো আমার বা আমার ছেলে মেয়ের দিকে ফিরে চাননি। আমি তবু দু-চার দিন পরপর ওঁদের বাড়িতে গিয়েছি। মা ভাই-বোনদের অজস্র আদর পেয়েছি, বাবা আর আমার সঙ্গে কথা বলেননি। তিলে-তিলে আমার মনেরো নিশ্চয় পরিবর্তন হয়েছিল। আঠারো বছর পরে যখন তিনি চোখ বুজলেন, আমি এতটুকু ব্যক্তিগত অভাব বোধ করিনি। যে অভাব, যে বেদনা ছিল, ঐ সময়ের মধ্যে তার মৃত্যু হয়েছে, টের পেলাম। শিউরে উঠেছিলাম। সবাইকে বলেছি, ‘এমন কাজও কর না। ভালোবাসার উপরে মতামতকে স্থান দিও না।’ ভাবি যদি জঘন্য কোনো অন্যায় কাজ করতাম, তাহলে আমাকে এর বেশি কি শাস্তি দিতে পারতেন? ভালোবাসা আর মতামত। দুইয়ের মধ্যে আসলে কোনো সম্বন্ধ নেই। তাছাড়া মতামত বড় সাংঘাতিক জিনিস। আমারো যেমন নিজস্ব মতামতের অধিকার আছে, আমার বুদ্ধিমান বয়স্ক সন্তানদেরো সমান অধিকার আছে। সবচেয়ে মজার কথা হল, এটা বাবার কাছেই শিখেছিলাম। যখন বুঝলাম যা হবার নয়, তা হবার নয়, তখন ঐ অধ্যায়টা খরচের খাতায় লিখে নতুন জীবন শুরু করলাম।

নিতান্ত আঘাটায় পড়িনি। আমার স্বামীর নিজের বাপ, দাদা, দিদি বৌদিকে না চিনলেও, আমার বন্ধু অলকার কারণে সমবয়সী ভাসুরপো-ভাসুরঝি, মায়ের বয়সী ভাসুর, জা, দেওর, ভাগ্নে-ভাগ্নী অনেককেই বহুদিন ধরে জানতাম। বিয়ের রাতে লাইন দিয়ে বয়েসে বড়রা অনেকে এসে প্রণাম করল। আমি তো কোন দিকে তাকাব ভেবে পাইনে।

একজন বলিষ্ঠ, কালো, প্রায় সমবয়সী ছেলে এসে বলল, ‘তুমি আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট, কিন্তু সম্পর্কে মামীমা হও, তাই প্রণাম করতে এলাম।’ তার নাম ছিল রবীন্দ্রলাল রায়। ছোটদের জন্য গল্প, প্রবন্ধ লেখায়, আর ক্যারিকেচার করাতে তার জুড়ি ছিল না। সে আমার নতুন জীবনের প্রথম বন্ধু। বছর দুই আগে তার মৃত্যু পর্যন্ত সে বন্ধুত্বে এতটুকু ছেদ পড়েনি। অধ্যাপক নীরেন রায়ের সঙ্গে চেনা হল। তখন তিনি পরিচয় পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। ইংরিজি সাহিত্যে দক্ষ, ঘোর কমিউনিস্ট। ওঁর কল্যাণে মার্কস্‌বাদ সম্বন্ধে কিছু পড়তে বাকি রাখিনি। তবু কেন দলে ভিড়ছি না বলে চটে যেতেন। আমাকে দিয়ে ‘পরিচয়ের’ জন্য সমালোচনা লিখিয়ে নিতেন। মতে না মিললে রেগে-মেগে ফেরৎ দিয়ে যেতেন। শানানো সব কথা বলতেন! মাঝে মাঝে উৎকৃষ্ট চকোলেট খাওয়াতেন। কবি সুধীন দত্তকে আগের বছর শান্তিনিকেতনে দেখে তাঁর রূপে হাঁ হয়ে গেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ তখুনি বললেন, ‘মনে রেখো, ও বিবাহিত এবং খটমট কাব্য রচনা করে।’ এবার তাঁকে বন্ধুভাবে পাওয়া গেল। পরে আমাদের বাড়িতে অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছিলেন। চৌকস্ কইয়ে-বলিয়ে মানুষ। ভালো ইংরিজি বলতেন। একদিন কফি খেতে খেতে বললেন, কফি কেমন হওয়া উচিৎ বলব—‘ডার্ক অ্যাজ দ্য ডেভিল, হট অ্যাজ হেল, অ্যাণ্ড সুইট অ্যাজ সিন।’

একটা মজার গল্প বলি। আমাদের সেই বিয়ের রাতে অনেকের জুতো চুরি গেছিল। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন সুধীন্দ্রনাথ। খালি পায়ে সুন্দর মানুষটি অনেকক্ষণ তাঁর নতুন ভালো পাম্শু জোড়া খুঁজে খুঁজে হয়রাণ হয়ে, খালি পায়ে গাড়ি চেপে বাড়ি চলে গেলেন। পরে আমাদের কাছে গল্প করলেন, ‘শুধু যে জুতো হারাল তাই নয়, চোরটাকে দেখেও কিছু করতে পারলাম না এই দুঃখ।’

আমরা বললাম, ‘কেমন চোর?’ ‘ভদ্রলোকের মতো দেখতে, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পরা, একটা ফিকে গেরুয়া উড়নি কাঁধে ফেলা, রোগা, লম্বা, ফর্সা, কুচকুচে কালো দাড়ি। আরেকবার দেখলেই চিনতে পারব। সকলের পায়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দেখেই বুঝলাম প্রফেশনাল, সঙ্গে দল আছে, তাদের কাছে আমার জুতো পাচার করেছে।’ আমি তো শক্ড্। ‘আরে ও যে আমার নান্কুদা, উপেন্দ্রকিশোরের ছোট ছেলে সুবিমল। ওর-ও নতুন জুতো সেদিন খোয়া গেছিল, তাই সকলের পা দেখছিল, কেউ যদি ভুল করে পরে থাকে।’ সুধীন্দ্রনাথ ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘ওঁকে যেন আবার আমার কথা বলা না হয়।’

হার্ডিং বলে এক ছোকরা সাহেবের সঙ্গে চেনা হল। আমার স্বামীর বন্ধু; মরিস মোটর্সে চাকরি করত, ইংরেজ। ওরা মা ম্যাডেলিন হার্ডিং রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্ত ছিলেন, বই টইও লিখেছেন। হার্ডিং এ দেশ আর এ দেশীয়দের ভালোবাসত। নানারকম দোষ ধরে দিত, আমরা তেড়ে তর্ক করতাম। গাড়ি নিয়ে বাংলার গাঁয়ে, বনে জঙ্গলে বেড়াবার শখ ছিল। আমরাও কতবার সঙ্গে গেছি। বাড়ির ছেলের মতো হয়ে গেছিল। দেশ স্বাধীন হলে ওদের আপিস গুটিয়ে আনা হল। ও-ও উগাণ্ডা চলে গেল। যাবার আগে একটি চঞ্চলা আইরিশ মেয়ে বিয়ে করেছিল। এখন তাদের কোনো খবরই জানি না।

সেই দিন থেকেই একটা নতুন পরিবেশে নতুন জীবন আরম্ভ হয়ে গেল। পুরনো চেনা লোকরাও নতুন চেহারা ধরল। এতকাল যাকে যা বলে ডেকে এসেছি, অনেক জায়গায় সে ডাক বদলাতে হল। আমার শ্বশুর ছিলেন বাপের সবার ছোট ছেলে। আমার স্বামী তাঁর ছোট ছেলে, আমি তাঁর চেয়ে এগারো বছরের ছোট। হঠাৎ কেমন বড় হয়ে গেলাম। আমার বড় ভাসুর ডাক্তার জে এন মজুমদারের মেজো ছেলে ডাঃ জ্ঞান মজুমদার আমার কলেজ জীবন থেকে চেনা, আমার চেয়ে বছর দুইয়ের বড়। সে আমার ভাসুর-পো হয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করল। দেখাদেখি তার বড় ভাই ডাঃ প্রতুল মজুমদার-ও করল। দিলীপ কুমার রায়ের ছোট বোন মায়া হল সুরেন্দ্রনাথ বাঁড়ুজ্জের পুত্রবধূ, আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়, আমার ভাগ্নী। কাজেই সে-ও প্রণাম করল।

তার চেয়েও খারাপ হল আমার বন্ধু অলকার মা-মাসিরা আমার মা-মাসিদের সহপাঠিনী, আধ-বুড়ি গিন্নি-বান্নি সব। তাঁরা এক দিনেই আমার সমবয়সী হয়ে গিয়ে মনের কথা প্রাণের কথা বলতে শুরু করে দিলেন। খালি অলকা, বুবু, আমার নিজের আত্মীয়রা যেমন ছিল তেমনি রইল।

আসলে আমিও আর আমাতে ছিলাম না। কেমন যেন হকচকিয়ে গেছিলাম। আগে অধ্যাপক সুশোভন সরকার, কালিদাস নাগ, হিরণকুমার সান্যাল ও তাঁদের সমবয়সীদের বেশ কিছু বড় মনে হত। হঠাৎ আমিও বড় হয়ে তাঁদের সমান হয়ে গেলাম। জীবনের খুঁটিগুলো নড়বড় করতে লাগল। ভাবলাম এ আবার কি, পুরনো কাপড়চোপড়, জিনিসপত্রের বেশির ভাগের যেমন বিল বন্দোবস্ত করে এসেছি, এ-ও কি তাই নাকি। সব কিছুকে অবাস্তব আর অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হতে লাগল।

রাত জাগতে পারতাম না কোনো দিনই। পরীক্ষার আগেও দশটায় শুতে যেতাম, ভোরে উঠে পড়তাম। দেয়ালে ঝোলানো বড় ঘড়িতে দেখলাম কোন কালে এগারোটা বেজে গেছে। পরে আমার স্বামীকে বলতে শুনেছি ‘দ্য ইভিনিং স্টার্টস্ এ্যাট টেন।’ শুনে আমার মনের অবস্থা ভাবা যায় না!

তারপর এক সময় সব চুকে বুকে গেল। অতিথিরা বিদায় নিলেন একে একে। বাড়ির লোকদেরো খাওয়া-দাওয়া সারা হল। ঠিক বিয়ে বাড়ি তো আর নয়, বাসর-ঘরের বালাই ছিল না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল সবাই ক্লান্ত, শুতে পারলে সবাই বাঁচে।

আমরা ওখানে রাতে থাকব না। এল্‌গিন রোডে, হাসপাতালের সামনে। আমরা একটা চারতলা বাড়ির দোতলায়, ফ্ল্যাট্ নিয়েছি। সেটাকে মহাফুর্তি করে সবাই মিলে সাজিয়েছি। হয়তো রাত দেড়টার সময় অলকারা জনা পাঁচ ছয় আমাদের নিয়ে সেইখানে গেল।

অমনি খুঁটিগুলো আবার যে যার পুরনো জায়গায় বসে পড়ল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। দেখি কোনো সময়ে, অলকারা এসে ঘরে ঘরে সুন্দর ফুলদানিতে গোলাপ ফুল সাজিয়ে গেছে। মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। এই তাহলে আমার নিজের জায়গা। কোথাও যাইনি আমি, সবই আছে আমার। সবাই আছে।

এই পাড়ায় আমার কৈশোর কেটেছে। এই এল্‌গিন রোড দিয়ে হেঁটে স্কুলে গেছি, মোড়ে ট্রাম ধরে এম-এ ক্লাস করতে গেছি। এখান থেকে সাত মিনিটের হাঁটা পথ দূরে আমার মা বাবা ভাই বোন এখন নিশ্চয় গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে কাদা। এর পর আর আমি কখনো বাপের বাড়ি রাত কাটাইনি। প্রায়ই গিয়ে দেখা করে এসেছি। পরে ভাই বোনদের নিজেদের আলাদা ঘর-বাড়ি হলে সেখানে ছুটি কাটিয়েছি। ওরাও আমাদের কাছে থেকেছে, সর্বদা যাওয়া-আসা করেছে। মা-ও প্রায়ই এসেছেন, খেয়েছেন, কিন্তু রাতে থাকেননি। এই ভাবে আমি বাপের বাড়ি থেকে খসে পড়লাম, কিন্তু কাছ-ছাড়া হলাম না। মনকে বোঝালাম যে পৃথিবীতে কম ভালো জিনিসই বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। আমার বিয়ের দিনে সুখ দুঃখের বোধ ছিল না।

ফ্ল্যাট খুব ছোট ছিল না। চারটি মাঝারি ঘর, দুটি চানের ঘর, একটা বড় ভাঁড়ারের আলমারিসুদ্ধ রান্নাঘর, তাতে গ্যাসের উনুন, ওভেন, কল ব্যাস্। একটা খোপ না, টং না, বারান্দা না। নিচে একটা গ্যারাজ আর গুদোম। একশো টাকা ভাড়া। পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম খোলা। বাড়ির মালিক আমার জ্যাঠ্তুতো ননদাই, হোমিওপ্যাথ্ ডাঃ নগেন চৌধুরী। ভারি দক্ষ ডাক্তার, স্নেহশীল মানুষ। চার বছর ঐখানে ওঁর পাখ্নার তলায় পরম নিরাপদে কাটিয়েছিলাম। সেই চার বছরে অনেক সাংসারিক অভিজ্ঞতা জমেছিল, অনেক লেখক, প্রকাশক, সম্পাদককে কাছের থেকে দেখেছিলাম; বেশ কিছু সমালোচনা আর প্রবন্ধ লিখেছিলাম, পড়েওছিলাম রাশি রাশি বই। কিন্তু গল্প উপন্যাস মনে আসেনি। তার জন্যে যে মনের নির্জনতা চাই, তখনো তা পাইনি।

বাড়িটার একটু বদনাম ছিল। নাকি একতলার একটা ফ্ল্যাটে এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা এসে উঠেছিল। প্রেমিকার বেরসিক স্বামী এক দিন রাতে এসে দুজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। তার কি হয়েছিল আমাদের বেয়ারা নারাণ বলতে পারল না, কিন্তু ব্যাপারটা স্বয়ং নগেনদার খাস বেয়ারা মঙ্গলের কাছে শোনা। বাড়িটা নাকি ভালো না। নতুন হলেও, নানা রকম অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, খালি ফ্ল্যাটে আলো দেখা যায়। মোট কথা নারাণের ইচ্ছা আমরা আর কোথাও উঠে যাই। মিছিমিছি তো আর ৬টা ফ্ল্যাট্ ৫ বছর খালি পড়ে নেই। বাসিন্দার মধ্যে চারতলার দুটি ফ্ল্যাট জুড়ে নগেনদার নিজের সংসার, দোতলায় দক্ষিণের ফ্ল্যাটে আমরা। বাকি সব খালি। তবে আমরা নিরাপদে আছি দেখে, এক বছরের মধ্যে সব ফ্ল্যাট্ ভাড়া হয়ে গেল। মালকিন্ বললেন ‘তোদের পয় আছে।’

আমার ইচ্ছে করত যে সময় ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে এবং আমার কাছে দু-তিন জন লোক আছে, সেই সময়ে একটা অলৌকিক কিছু হোক। বলাবাহুল্য কিছুই হয়নি। তবে একবার ফ্ল্যাটে একা রাত কাটিয়েছিলাম। সব ঘরে আলো জ্বেলেও ঘুম হয়নি।

আগেই বলেছি অবশ দেহমনে, বিয়ের সেই রাতে বাড়ি এসে দেখি ঘরে ঘরে গোলাপ ফুল, নতুন টেবিল-ল্যাম্পে কোমল আলো জ্বলছে। ফ্লাস্কে ঠাণ্ডা জল ভরা, বিছানা পাতা। সব ঘর যেমন সুন্দর করে আগের দিন সবাই মিলে সাজিয়ে গেছিলাম, তেমনি সাজানো। খালি বাড়ি নয়, ভূতুড়ে বাড়ি নয়, মানুষ থাকার। বাড়ি। মনে সাহস এসেছিল; ভেবেছিলাম এখানে সংসারের কাজ শেখার অসুবিধা হবে না। সব কিছু তক্‌তক্ করছিল, খালি স্নানের ঘরের হাত ধোবার বেসিনটা কুচকুচে কালো। ঐ একটি জিনিস সাফ করানোর ভার যিনি নিয়েছিলেন, তিনি মানুষের অনির্ভরযোগ্যতা দেখে অবাক হলেন। আমিও নিঃশব্দে সেই মুহূর্ত থেকে সংসারের সব ভার মনে মনে তুলে নিয়েছিলাম, এই ঊনপঞ্চাশ বছরেও আর নামাইনি। অলকার ছোট বোন করুণা নিজের রুমাল দিয়ে বেসিন পরিষ্কার করে দিয়েছিল।

দুটি শোবার ঘর, খাবার ঘর, বসবার ঘর, ছিমছাম সাদাসিধে সুন্দর করে সাজানো। দেয়ালে ছবি, দরজা জানলায় নীল পর্দা। শোবার ঘরের কোণে রাখা আমার মেজো ভাসুরের দেওয়া সেলাই-কলে তিন দিন ধরে সেলাই করে রেখেছিলাম। বাসন-পত্র, কাঁটা-চামচ, গালচে, দেয়ালের ছবি, সবই স্নেহময় আত্মীয় বন্ধুদের উপহার।

এমনি করে আমার ঘরকন্না শুরু হয়েছিল। এতদিন পড়াশোনা করে কাটিয়েছি, শখ করে আঁকা, সেলাই, এমব্রয়ডারি শিখেছি। রান্নাও শখের জিনিস ছিল, কিন্তু দু-বেলা আটপৌরে কাজ চালাতে হলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত। তাছাড়া বাড়ির আসবাব করতেই আমি দেউলে, রান্নার বাসন কিনতে একমাস অপেক্ষা করতে হবে। আমার স্বামী বললেন, ‘কিচ্ছু ভেবো না, আমার সব আছে।’ সব আছে মানে তেড়া বাঁকা, পুড়ে কালো, ঢাকনি-বিহীন কটা ডেক্চি, ফ্রাই প্যান, আর হাঁড়িমুখো, জঘন্য নোংরা, তাল ঢ্যাঙা এক নেপালী বাবুর্চি। মোদো মাতাল, কিন্তু রান্নায় সাক্ষাৎ দ্রৌপদী। অর্থাৎ বিলিতী রান্নায়। দিশী রান্নাকে সে ঘৃণা করত। তবে নারাণ সব ঘাটতি পূরণ করত। তারপর আমার মায়ের বয়সী বিধবা ননদ এসে দেড় মাসে আমাকে কাজ চালাবার মতো শিখিয়ে গেলেন। এই সময়কার সব কথা আমার গুলিয়ে গেছে। কারণ আমি আর পায়ের তলায় মাটি পাচ্ছিলাম না। খালি মনে হত আমাকে বিয়ে করে আমার স্বামী আমাকে ছাড়া আর কিছুই পেলেন না, সেই আমি যেন তাঁকে নিরাশ না করি। সুখের বিষয় কোনো দাবিই করতেন না; কিসে যে খুশি হবেন, কিসে বিরক্ত হবেন, সব সময়ে ভেবে উঠতে পারতাম না।

বিয়ের দু-দিন পরে মা এসে ঘরদোর দেখে ভারি খুশি, কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে মুখ গম্ভীর হল। আমিও শক্ড্। দেখলাম বাবুর্চি রান্নার যাবতীয় বাসন একে একে ব্যবহার করে, কলতলায় নামিয়ে রেখেছে। আ-ধোয়া অবস্থায়। সবকিছুতে সবুজ রঙ ধরেছে। অম্লান বদনে যা বলল, তার মানে হল রোজ বাসন ধোয়ার বড় বেশি ঝামেলা। তাই সব বর্তন খরচা হয়ে গেলে সে একটা গ্র্যাণ্ড ওয়াশিং ডে পালন করে!

মা খাবার ঘরে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘রান্নাঘরটা সব সময় গিন্নির হাতে থাকা ভালো।’ আসলে ঐ বাবুর্চিকে কিছু বললে সে শুনতে পেল কি না বোঝা যেত না। দু-দিন পরে সকালে আশুতোষ কলেজের মহিলা বিভাগ ছুটি হলে পর বাড়িতে এসে দেখি আমার খাবার ঘরের টেবিল বোঝাই চকচকে নতুন ক্রাউন এলুমিনিয়মের বাসন নিয়ে, হাসিমুখে মা বসে আছেন। আমাকে দেখেই বললেন, ‘তোর দাদা দিদির কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনেছি।’ সাধারণ সংসারে যা কিছু বাসন দরকার সবই ওর মধ্যে ছিল। এসব কিছু লেখিকা-জীবনের কথা নয়, কিন্তু এই সব দিয়েই লেখিকাদের মূলধন তৈরি হয়। টুকরো টুকরো অকিঞ্চিৎকর জিনিস, যার দামের হিসাব করা যায় না। রোজ রাতে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে নেমন্তন্ন হত, বাড়িতে হাঁড়ি চড়ত না। আমি সবাইকে বলি জন্মাবার সময় একটা সম্পূর্ণ মানুষ জন্মায় না। রক্ত কণিকায় যা আনল তা আনল, তার ওপর যা দেখে, যা শোনে, যা বলে যা করে, তাই দিয়ে মানুষ হয়। আমার ঐ পঁচিশ বছর বয়সে আমি আরো অনেকখানি মানুষ হয়ে গেলাম।

পাশের বাড়িতে ছোটদিদিমারা থাকতেন, খুব ভালো করে চিনতাম না। একশো নং গড়পারে মেজ-জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে দেখেছিলাম। ছোটদাদামশাই হলেন জ্যাঠামশাইয়ের মামাশ্বশুর। কাদম্বিনী-গাঙ্গুলীর ছোট ভাই। ছোটদিদিমা খ্রীশ্চান মেয়ে। তিনি আমার আত্মীয়-স্বজনের কাছে গল্প করলেন, ‘ওমা! জানলা দিয়ে দেখলাম, খুব ঘটা করে গোঁড়া হিন্দু মতে আবার বিয়ে হল।’ অথচ কিছুই হয়নি। শুনে আমি অবাক হলাম।

ক্রমে ক্রমে সংসারের সঙ্গে আরো পরিচয় হল। একদিন আমার স্বামী চেম্বারে চলে যাবার পর সদর দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুললেই বসবার ঘর, হল্ টল্ ছিল না। খুলে দিতেই হাসিমুখে এক আধবয়সী ভদ্রলোক বাইরে থেকেই বললেন, ‘আমি বাড়িওলার লোক। আপনাদের সব পাখাগুলো খুলে নিয়ে যাব, অয়েলিং ক্লিনিং করতে। বাড়িওলার এই রকম নিয়ম।’ আমি বললাম, ‘আমরা সব নতুন পাখা কিনেছি, কিছু করবার দরকার নেই।’ তিনি বললেন, ‘আহা, আমার কথা বুঝলেন না, পয়সাকড়ি দিতে হবে না। সে আমি বাড়িওলার কাছে পাই।’ আমি বললাম, ‘তা হতে পারে, কিন্তু নতুন পাখার ও সব দরকার নেই।’ তাঁকে আমি একটুও সন্দেহ করিনি, অমায়িক প্যাটার্নের ভদ্রলোক। দরজা বন্ধ করে দিলাম। পরে শুনলাম বাড়িওলার ওরকম কোনো লোক নেই। স্রেফ পাখা সরাতে এসেছিল।

সেকালে এত বেশি অসৎ লোক ছিল না; হয়তো এত বেশি আর এত গরীবও ছিল না। জিনিসও সস্তা ছিল। মনে আছে আমার স্বামী বাবুর্চিকে রোজ দু-টাকা বাজার খরচা দিতেন। তাই দিয়ে ডেলি নিয়মে আমাদের সংসার চলত। এই ছিল, ওঁর ব্যাচেলর সংসারের নিয়ম। রোজকার রসদ রোজ আসত, মায় চাল, ডাল, তেল, ঘি সব। আমার মা-র খুব আপত্তি। এতে আমার বরং সুবিধা হত। ভোরে উঠেই উনি যেতেন রোয়িং ক্লাবে নৌকো বাইতে, আমাকে নামিয়ে দিতেন আশুতোষ কলেজের পুরনো বাড়িতে। এখন সে সব সেবা-সদনের এলাকার মধ্যে পড়েছে। বাড়ি ফিরতে বেলা হত। এসে দেখতাম রাঁধাবাড়া সারা। বাবুর্চিকে কিছু বলবার সাহসও ছিল না। তাছাড়া বাড়ির হালচাল শিখে নিতেও সময় লেগেছিল। বলাবাহুল্য মৌলিক লেখা এক লাইনও লিখিনি। মনের যে নিরবচ্ছিন্ন নিরিবিলিতে কথার বীজের শেকড় গজায় সেটা পাচ্ছিলাম না। এমন কি সেটা যে আমার দরকার, তাও টের পাচ্ছিলাম না।

তখন চোরটোর তেমন ছিল না। ও বাড়িতে জানলায় শিক ছিল না। জানলার পাশেই বৃষ্টির জল নামবার পাইপ। অচেনা বাবুর্চি, অচেনা নারাণ। খুব সুখেই ছিলাম। একদিন সন্ধ্যায় এক ফিরিঙ্গি যুবক এল। এক্সাইজের লোক। তাদের নাকি খবর যে এই ঠিকানায় ডাঃ এস্ কে মজুমদারের বাড়িতে বে-আইনি মদ চোলাই হয়। বাড়ি তল্লাসী করবে।

আমি নারাণকে বললাম, ‘সব দেখিয়ে দাও।’ আমাদের চারটে ছিমছাম ঘরে মাছি ঢুকলে মাছি দেখা যেত। তল্লাসী করতে বেশি সময় লাগল না। তখন সায়েব জিজ্ঞাসা করল ‘গো-ডাউন নেই?’ নারাণ তাকে নিচে নিয়ে গিয়ে গ্যারাজ আর বাবুর্চির ঘর দেখিয়ে দিল। সব ভোঁ-ভাঁ, কোথাও কিছু নেই। ফিরে এসে সায়েব ক্ষমা চেয়ে গেল। ‘কত রকম উড়ো খবর আসে ম্যাডাম, প্রত্যেকটার তদন্ত করা আমাদের কর্তব্য, কিছু মনে করবেন না।’ আমি তাকে অকপট চিত্তে ক্ষমা করলাম। সন্ধ্যায় আমার স্বামী ফিরলে হাসতে হাসতে সমস্ত ব্যাপারটা তাঁকে বললাম। তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। এমন সময় নারাণ কি কাজ করতে করতে বলে বসল, ‘হ্যাঁ, ভাগ্যিস খবর পেয়ে চোলাইয়ের জিনিসগুলো সরিয়ে ফেলেছিলাম।’ আমরা শুনে হাঁ!

পুরনো বন্ধুরা কেউ আমাদের ছাড়েনি। শান্তিনিকেতন থেকে ডঃ টাকার, টিম্বার্স, আরিয়মদা, ধীরেনদা, তনয়দা, উপহার নিয়ে বিয়ের দিন এসেছিলেন, ছবির মতো দেখেছিলাম। কলকাতায় এলেই তাঁরা শান্তিনিকেতনের নানান্ সরস গল্প করে যেতেন। এঁদের অনেকে আমার স্বামীর পুরনো রুগী, আমাদের আজীবনের বন্ধু হয়ে গেলেন। কয়েক বছরের মধ্যে তনয়দা ছাড়া সবাই শান্তিনিকেতন ছেড়ে অন্য কর্মক্ষেত্রে চলেও গেলেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম শান্তিনিকেতন কেমন তাদের গা-ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে, দিব্যি সুন্দর আপন চালে চলতে লাগল! তেমনি ততদিনে আবার সেখানে আরেকটি সুন্দর মানুষ জুটেছেন! তাঁর নাম অনিলকুমার চন্দ। অল্প ক-দিনেই কেমব্রিজ-ফেরত এই সুদর্শন কালো মানুষটিকেও শান্তিনিকেতন আপন করে নিয়েছিল। যে যায়, আশ্রম তাকে ঝেড়ে ফেলে, যে আসে তাকে আপন করে নেয়। নদী থেকে ঘটি করে জল তুলে ফেললেও জল কমে না।

কয়েক দিন পরে যখন রবীন্দ্রনাথের নিমন্ত্রণে দুই-তিন দিনের জন্য অলকাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা শান্তিনিকেতনে গেলাম, দেখলাম আমাকেও আশ্রম বিদায় দিয়েছে, আমাকে দিয়েও আর তার কোনো দরকার নেই। আশ্রমবাসীরা খুবই আদর করেছিলেন। উত্তরায়ণে ডেকে কবি কত আপ্যায়ন করলেন। ক্ষিতিমোহনবাবু, নন্দবাবু, তনয়দা, ধীরেনদা, বীরেনদা, টাকার, টিম্বার্স আর অতুলনীয় সঙ্গীত রসিক বাকে দম্পতি, কারো বন্ধুত্ব এতটুকু টস্কায়নি। এঁদের সঙ্গে আমাদের চিরকালের আত্মীয়তা। তনয়দা আগে আমার স্বামীকে চিনতেন না, এখন থেকে তাঁর অকালমৃত্যু পর্যন্ত তিনি আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে ছিলেন। মুখে মাঝে মাঝে কটু কথা বলতেন বটে, বুক ভরা ছিল শুধু সেন। দুজনে সিগার খেতেন আর রাজ্যের গল্প করতেন। এমন খাঁটি মানুষ আর দেখলাম না।

আমার বুড়ো শ্বশুরমশাই আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। শাশুড়ি এর আঠারো বছর আগেই মারা গেছিলেন। শুনেছি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি মাথায়, চওড়া কাঁধ, মাথা ভরা কালো কোঁকড়া চুল। চমৎকার হাতের কাজ করতে পারতেন, কাঁথা সেলাই, নরুণ দিয়ে পাথর কুঁদে অপূর্ব সব সূক্ষ্ম নক্সা তুলে ছাঁচ বানাতেন। তাছাড়া রাঁধিয়ে বলে পাঁচটা গ্রামে খ্যাতি ছিল। ব্যাপার বাড়িতে, পর্ব-তে তাঁর ডাক পড়ত। সেকালের মেয়েরা নেহাৎ অকেজো ছিলেন না। আমার শ্বশুর পোস্টেল ইন্‌সপেক্টর ছিলেন। আই-এ পাস করে, অধ্যাপকদের সঙ্গে যখন কিছু নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল, পড়াশুনো ছেড়ে চাকরিতে ঢুকলেন।

কলেজের অধ্যক্ষ স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশাই। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘নাঃ, তোর আর কিছুই হবে না!’ বিয়ের কয়েক দিন পর শয্যাশায়ী অবস্থায় আমাকে শ্বশুরমশাই একথা বলেছিলেন। তার পর একটু হেসে বললেন, ‘হলও না কিছু। মহাপুরুষদের বাণী কি আর মিথ্যে হয়। এতদিনে সে দুঃখ গেল। আমার বৌমা ইংরিজিতে এম্-এ, ফাস্ট ক্লাস্ ফার্স্ট! তাঁকে দেখাতে পারলাম না।’

এ কথা শুনে আমার মনটাও ভরে গেছিল। এই মানুষ আহ্নিক না করে জলস্পর্শ করতেন না, অব্রাহ্মণের ছোঁয়া খেতেন না। কিন্তু আমাকে বলেছিলেন, ‘এখন মধুপুর যাচ্ছি, ফিরে এসে তোমার কাছে থাকতে চাই। তুমি আমাকে রেঁধে খাইও।’ আমার বিধবা ননদ তাঁর দেখাশুনো করতেন, তিনি বললেন, ‘আপনি তো আর ব্রাহ্ম মেয়ের হাতের রান্না খাবেন না। তাহলে আমাকেও সঙ্গে যেতে হবে।’ এক গাল হেসে বললেন, ‘ও মুরগি খাওয়া ছাড়লেই, ওর হাতে খাব। কি! বল মা?’ আমি তখুনি রাজি। কিন্তু সে আর হয়নি। চার মাস পরেই তাঁর ডাক এসেছিল।

॥ ২ ॥

বলেছি তো, পঞ্চাশ বছর আগের কথা মনে করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। আমার এই কাহিনীতেও এন্তার ভুল আছে। নাম গুলিয়ে গেছে। আগের কথা পরে, পরের কথা আগে বলা হয়েছে। তবে ঘটনাগুলো সত্যি। তা-ও নির্ভেজাল সত্যি কি করে বলি? কত কথা বাস্তবিক ঘটেছে, কতক খালি ভেবেছি, কত স্বপ্নে দেখেছি, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তবে কয়েকটা দুঃখ তেমনি আছে। তা হল তিনটি মানুষকে না দেখার দুঃখ। অথচ বছরের পর বছর একই জায়গায় বাস করেছি, হয়তো একই শব্দ শুনেছি, একই দৃশ্য দেখেছি। এই তিনজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম মানুষটিকে চোখেও দেখিনি। অন্য দুজনের মধ্যে শরৎচন্দ্রকে মাত্র একবার বাঘ-শিকারী কুমুদনাথ চৌধুরীর বাড়িতে একটা ছোটখাটো গানের আসরে দেখেছিলাম। হয়তো সেই আসরে শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের দিলীপকুমার রায় গান গেয়েছিলেন। ‘বৃন্দাবন কি লীলা অভিরাম’,—ঐ রকম কিছু। সালটা মনে হয় উনিশশো ছত্রিশ হতে পারে। দিলীপ কলকাতায় এসেছিলেন, ওঁরই অনুরোধে শরৎচন্দ্র গান শুনতে এসেছিলেন। সে সময় তাঁর শরীর খুব ভালো যাচ্ছিল না।

কুমুদনাথ তখন বেঁচে নেই। তাঁর বড় ছেলে, আমার সমবয়সী ভাগ্নে কল্যাণের কাঁধে ভর দিয়ে শরৎবাবু এসে বসেছিলেন। কেমন জানি মনে হচ্ছিল অপার্থিব বস্তু দিয়ে গড়া একটি মূর্তি। মুখখানি সুন্দর ছিল, তাতে সূক্ষ্মতা আর কেমন একটা তীব্রতা ছিল। কল্যাণদের সেই বসবার ঘরে রাখা হাতির দাঁতে খোদাই করা লক্ষ্মী-সরস্বতীর বড় বড় মূর্তির সঙ্গে সাদৃশ্য লাগছিল। কোন কথা বলতে শুনিনি। দূর থেকে শুধু দেখেছিলাম। কেউ আলাপও করিয়ে দেয়নি। আমি তখন অখ্যাত, শুধু সাহিত্যলোকের স্বপ্ন দেখি, বয়স আটাশ হতে বাকি নেই। অবনীন্দ্রনাথকেও জোড়াসাঁকোয় দূর থেকে দেখেছি। গলার আওয়াজও শুনতে পাইনি।

আরেকটি মানুষ মাঝে মাঝে আমাদের এল্গিন রোডের ফ্ল্যাটে ও পরে রায় স্ট্রীটের ভাড়া বাড়িতে আসতেন, তাঁর চেহারার সঙ্গে শরৎচন্দ্রের চেহারার একটু আদল আসত। যদিও ইনি ছিলেন বড় বেশি কোমল, বিনয়ী, বিনম্র। শরৎচন্দ্রের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, জোরালো ব্যক্তিত্ব খুব বেশি লোকের ছিল না। এঁর নাম ছিল অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়। কেউ কেউ বলত ‘ছোট শরৎবাবু’, একথা ওঁর কাছেই শুনেছি। শেষ বয়সে উনি শরৎচন্দ্রের নিত্য সঙ্গী ছিলেন। ‘শরৎচন্দ্রের সঙ্গে’ বলে একটি অন্তরঙ্গ বইও লিখেছিলেন। তাঁর সাহিত্যগুণ বেশি না থাকলেও, শরৎচন্দ্রের চরিত্রের আর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও মনোভাবের ওপর এমন সরল ও সততাপূর্ণ মন্তব্য আর দেখিনি। বইটি এখন দুষ্প্রাপ্য আর অমূল্য।

আমাকে এক কপি উপহার দিয়েছিলেন। আরো ক-খানি গল্পের বই দিয়েছিলেন; ‘সকলি গরল ভেল’, ‘থার্ড ক্লাস’, ‘মাটির স্বর্গ’, আরো কি কি। রবীন্দ্রনাথ ‘মাটির স্বর্গে’র বড় বেশি বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন বলে নিরীহ মানুষটি মর্মাহত হয়েছিলেন।

অনেক বছর পর, ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে অসমঞ্জবাবু আমাদের বাড়িতে শেষবার এসেছিলেন। তখন তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়েছে, সুন্দর চেহারা কালি হয়েছে, সাজ-সজ্জার সে পারিপাট্যও নেই। বোধহয় অবস্থাও খুব ভালো নয়। এই মানুষটির কথা মনে হলেই মন কেমন করে। আসতেন, গল্প করতেন, চা খেতেন, চলে যেতেন। এর বেশি কিছু বলতেন না। এমন কি শরৎচন্দ্রের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা নিয়েও গর্ব করতেন না। তবে মাঝে মাঝে ওঁদের ‘রসচক্র’ নামক আসরের গল্প করতেন। তাঁরা যে ওঁকে শরৎবাবুর প্ররোচনায় সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন, তা-ও তাঁর বই পড়ে জেনেছি। আরেকজন লোকও আসতেন, তাঁর নাম হারিৎকৃষ্ণ দেব। লম্বা কোঁকড়া চুল, কাগজের মতো পাতলা শরীর, মুখে কেমন একটা তীব্রতা। ইনি অত নিরীহ ছিলেন না, চোখে-মুখে কথা বলতেন। মনে হয় ‘পরিচয়’ গোষ্ঠীর কোনো বন্ধুর সঙ্গে প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। মনে আছে আফ্রিকার কথা বলেছিলেন। ওঁর কোনো নিকট আত্মীয় সেখানে মারা যান। হারিৎকৃষ্ণ তাঁর শোকার্ত পরিবারকে নিয়ে আসতে সেখানে গেছিলেন। দেশ দেখার সময় বা মনের অবস্থা ছিল না। কথাগুলো কেন জানি আমার মনে লেগেছিল। এঁরা হয়তো বাংলার সাহিত্যসম্ভারে সে রকম মূল্যবান কিছু দিয়ে যাননি, কিন্তু সে সময়কার বাংলার বাঙালীত্বের অনেকখানি এই রকম মানুষরাই বহন করতেন।

আমার বিয়ের আগেও লেখক দেখেছিলাম। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই কাছের থেকে দেখেছিলাম। প্রমথ চৌধুরী আর ইন্দিরাদেবীর বাড়িতে পূর্ণিমা সম্মেলনী হতো। চাঁদের হাট বসত। সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখেছিলাম। নরেন দেবের সঙ্গে তখন থেকেই একটা স্নেহের সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল। হিরণকুমার সান্যাল, গিরিজাপতি ভট্টাচার্য, সুশোভন সরকার প্রমুখকেও দেখেছিলাম। এমন কি একদিন সুশোভন এসে বললেন, ‘তোমার বোধহয় ছোটদের জন্য আজগুবি গল্প লেখা বন্ধ করতে হবে। গিরিজাবাবু বলেছিলেন—ভদ্রমহিলাকে কাগজ নষ্ট করতে বারণ কর! কিন্তু যে কামারশালায় নতুন দিনের বাংলা সাহিত্যের লোহা পিটিয়ে শক্ত করা হচ্ছিল, দূর থেকে তার একটু স্ফুলিঙ্গ দেখা ছাড়া আর কিছুর সুযোগ পাইনি। অথচ বুদ্ধদেব বসু আমার সমবয়সী।

গতানুগতিকের পথে লেখাপড়া শিখেছি। সম্পাদকরা বাড়িতে এসে লেখা চেয়ে নিয়ে গেছেন, কোনো সাহিত্যচক্রে যোগ দেবার কথা ভাবতেও পারতাম না। তবে পেছনে একটা সাহিত্যের পটভূমিকা ছিল, হোক সে শিশু সাহিত্য। একটা জোরালো গঠনশীল আবহাওয়ায় মানুষ। জ্যাঠামশায়ের বাড়ি ছিল আমাদের অনুপ্রেরণা আর কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। সিঁড়িতে হাফটোন ব্লকে ছাপা ছবির নানা রঙের প্রুফ পড়ে থাকত। নিচে প্রেস চলত। আর বড় দাদারা লম্বা লম্বা প্রুফের কাগজে নাক ডুবিয়ে কলম হাতে বসে থাকতেন। কথা বলতে গেলে বিরক্ত হতেন। দপ্তুরিরা আসত। ডাকে বই যেত। দাদামশাই, বড়-জ্যাঠামশাই নামকরা পণ্ডিত মানুষ। এ তো কোনো অচেনা জগতের কথা নয়, তবু খাপছাড়া হয়ে থাকি। বাড়ির সেই সাহিত্যের অন্দরমহলের সঙ্গে বাইরের পোশকি এবং মজলিশি জগৎ মিল খেত না। এদিকে ‘কল্লোল’ যুগ কবে শুরু হয়ে গেছে। সমবয়সী লেখক বুদ্ধদেব, অজিত দত্ত এবং সামান্য বড় প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার নাম করে ফেলেছে। ‘পরিচয়’ আর ‘পি-ই-এনে’র মতো শৌখিন বৈঠকখানার সাহিত্য সভা ছাড়া কখনো কোনো সাহিত্য সভায় যোগ দিইনি। এখন নিন্দুকরা যাই বলুক, ওগুলো নেহাৎ ফেলনা ছিল না। বন্ধুজনের বাড়িতে উৎকৃষ্ট জলযোগ করলেই সাহিত্যালোচনা খেলো হয়ে যায় না। তেমনি কেৎলির চা আর জিলিপি খেয়েও সাহিত্য কিছু পুষ্ট হয় না। সাহিত্য তৈরি হয় অন্য কর্মশালায়। তাছাড়া, সত্যি কথাই বলব, ঐ আসরগুলোর জন্য মন কেমন করে। চারু দত্তের বাড়িতে শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষকে প্রথম দেখলাম। আমার মেসোমশাই সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের বাড়িতে সোফিয়া ওয়াডিয়াকে, অন্নদাশংকরকেও বোধহয়, আর মনে হয় প্রেমেন্দ্র মিত্রকে আর তাঁর স্ত্রী বীণাকে। তাঁদের বড় ভালোবেসেছি। এরা সবাই নিশ্চয়ই একটু একটু করে আমার চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল, কিন্তু আমার ত্রিশ বছর বয়স অবধি আমি ভাবতাম আমার নিজের লোকরা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র—এই তিনটি মহামানবের কাছেই আমি ঋণী।

কথাটা ভুল। প্রত্যেক পরিবারেরি নিজস্ব একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ থাকে। ঐ বংশে ছেলেমেয়েরা নিজেদের অজান্তেই তাতে পুষ্ট হয়। সেইজন্য দেখা যায় পণ্ডিতের ঘরে পাণ্ডিত্যের, সাংগীতিকদের ঘরে গান-বাজনার, শিল্পীদের ঘরে শিল্পচর্চার, লেখকদের ঘরে সাহিত্য রচনার একটা জন্মগত প্রবণতা নিয়ে ছেলেমেয়েরা বড় হয়। হয়তো জন্মগত প্রবণতাও নয়, সবটাই পরিবেশ থেকে পাওয়া। আমিও একদিকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের, রবীন্দ্রনাথের, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতি একটা শ্রদ্ধা, আমাদের পারিবারিক কাজকর্মে আস্থা, আমার অদেখা দাদামশাই রামানন্দ ভারতীর প্রতি ভক্তি নিয়ে বড় হয়েছিলাম। সেটাকেই স্বাভাবিক মনে হতো। তাঁদের বুঝতাম, তাঁদের প্রতি সহানুভূতি ছিল। এই মনোভাবটা যে অনুদার, তা-ও জানতাম না।

বিয়ের পর দেখি এ-বাড়ির অন্যরকম চিন্তা, অন্য রকম আদর্শ, অন্যরকম কাজকর্ম। আরো আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তার পাশে আমার মনোভাবেরো যথেষ্ট জায়গা আছে। অবিশ্যি এটা আমার উদার মনের স্বামীর জন্যেই সম্ভব হয়েছিল। এদের বাড়িতে উচ্চাংগ সংগীতের আদর ও চর্চা ছিল। দ্বিজেন্দ্রলালের নাটক, গান, কাব্যের আদর ছিল। তার মধ্যে একটা স্বজনপোষণের গন্ধ থাকলেও থাকতে পারে। যদিও দ্বিজেন্দ্রলালের অসাধারণ অবদান যথেষ্ট স্বীকৃতি পায়নি। এ-কথা আমি বিশ্বাস করি।

কিন্তু এই দ্বিজেন্দ্রপ্রীতির সঙ্গে একটা রবীন্দ্রবিদ্বেষ মেশানো ছিল। রবীন্দ্রসংগীতকে এঁরা সে সময়ে গান বলেই মানতেন না। দ্বিজেন্দ্রলালের ভাইপো আরেক রবীন্দ্রলাল নিজে মধুর গাইয়ে ছিলেন, সংগীতবিদ্যাবিশারদও ছিলেন, পরে গানের স্কুল করেছিলেন। ইনি আমার চাইতে অল্প বড় ছিলেন, আমার সঙ্গে ভাব ছিল। মাঝে মাঝে গল্প করে যেতেন। তার মধ্যে আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রসংগীতকে গান বল না, মামিমা।’ আমি তো অবাক!

‘গান নয় বুঝি? তবে কি?’ ‘ওগুলো হলো সুর দেওয়া কবিতা।’ নিজের অবিদ্যার কথা মনে করে গানেতে আর সুর দেওয়া কাব্যেতে তফাৎটা কোথায়, জেনে নেওয়া হয়নি।

এই মানুষটি পরে শান্তিনিকেতনের সংগীতভবনে কয়েক বছর উচ্চাঙ্গসংগীতের অধ্যাপক ছিলেন। এঁরই অসাধারণ মেয়ের নাম মালবিকা কানন। সে, রূপে-গুণে-আচরণে অদ্বিতীয়া।

তবে মালবিকার দিদিমা স্নেহলতা মৈত্রের কাছে, আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-কুটুম্বরা কেউ দাঁড়াতে পারত না। অসাধারণ কাকে বলে তাঁকে দেখলে বোঝা যেত। তাঁর কথা এর আগেও কিছু কিছু বলেছি, মালবিকার কাছেও গল্পের ঝুড়ি আছে। সে যাই হোক, এঁরা কেউ রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রকাব্য, রবীন্দ্র-শিল্প, বা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে উৎসাহী ছিলেন না। আমার বিয়ের পর এঁদের মধ্যে প্রচলিত নানা আশ্চর্য ও অলীক গল্প শুনে আমি অবাক হয়ে যেতাম। রবীন্দ্রনাথের কোনো রকম রচনাই এঁরা কেউ পড়েন নি, পড়তেন না। পড়বেন বলেও কোন আশা ছিল না। আমার স্বামী গোড়ায় বলতেন, রবীন্দ্রসংগীত শুনলে তাঁর ঘুম পায়! শুনে তাজ্জব বনে যেতাম! ওঁদের এক উচ্চাঙ্গসংগীতের ‘আসর’ ছিল। তিমির বরণের দাদা মিহির বরণ তার কর্ণধার। সমস্ত ভারতবর্ষ ঢুঁড়ে ভালো ভালো গুণী নিয়ে আসতেন। সামান্য প্রণামী নিয়ে তাঁরা একেকজন একেকদিন গান গেয়ে যেতেন। মনে আছে একদিন ওস্তাদ রতন জঙ্কারকেও দেখেছিলাম।

আসর বসত চৌরঙ্গীতে, আমার স্বামীর চেম্বারে। তিনি ছিলেন সেক্রেটারি। এত ভালো গানের আসর সে সময়ে খুব বেশি ছিল না। ছোট, অথচ নিখুঁৎ। কিন্তু দশটার পর থেকে আমার জেগে থাকা মুশকিল হতো। আর আমার স্বামীর কিনা তিন থেকে পাঁচ মিনিট ব্যাপী রবীন্দ্রসংগীত শুনলে ঘুম আসত! তবে পরে সুচিত্রা মিত্র, পঙ্কজ মল্লিক ইত্যাদির গান শুনে মুগ্ধ হতেও দেখেছি।

মানুষটির সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। দেখতে ভালো, প্রায় ছয় ফুট মাথায়, এককালে সাঁতরে গঙ্গা এ-পার ও-পার করতেন, তখনো লেক ক্লাবে নৌকো চালান, এন্তার পড়াশুনো, আমেরিকায় গিয়ে দাঁতের ডাক্তারি পড়ার আগে প্রাচীন ইতিহাসের কৃতী ছাত্র ছিলেন। প্রথম বিভাগে বি এ অনার্স পাস করে, এম এ-র শেষ বছরে পড়তে পড়তে ইতিহাস ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে চার বছরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে, বস্টনের ফরসাইট্ ডেন্টাল হাসপাতালে তিন বছর চাকরি করবার পর দেশে ফিরে এলেন উনিশশো সাতাশ সালে। এসে চৌরঙ্গীতে ফ্ল্যাট ভাড়া করে প্র্যাক্টিস শুরু করলেন। এবং পাঁচ বছরের মধ্যে ডাক্তারি মহলে নাম করে ফেললেন। হেনকালে আমার সঙ্গে পরিচয়। বাপ ছিলেন পোস্টেল ইন্সপেকটর, বেশি টাকা কড়ির বালাই ছিল না। তবু সমবয়সী ভাগ্নে দিলীপকুমার রায়ের প্ররোচনায় এবং জ্যাঠতুতো দাদা। জিতেন্দ্রনাথের সাহায্যে, কপর্দকশূন্য অজ্ঞাতকুলশীলের পক্ষে আমেরিকা যাওয়ার মতো অসম সাহসিক কাজটি করে ফেলেছিলেন। সেখানকার জীবনযাত্রা সম্বন্ধে তাঁর কাছে অনেক আশ্চর্য আর মজার গল্প শুনেছি। কখনো হোটেলে, রেস্তোরাঁয়, ডেয়ারিতে, এমনকি মেয়েদের হস্টেলে চাকরি করে ঐ স্বনামধন্য কলেজের খরচ চালিয়েছিলেন। যেমন আরো অনেক ঐ-দেশী আর কিছু বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীরাও চালাত।

বড় ভালো ব্যবহার পেয়েছিলেন। ঐদেশে মন বসে গিয়েছিল। ভেবেছিলেন নাগরিকত্ব নিয়ে, ঐখানেই বিয়ে থা করে থেকে যাবেন। তা আর হলো কই? তিন বছরের বড় মেজদা ছিলেন। দুই ভাইয়ে বড় ভাব। মেজদাও আমেরিকা গিয়ে পড়বেন বলে সব ঠিক, এমন সময় তিনি মারা গেলেন। মা আগেই গেছিলেন। বুড়ো বাবা এবার ভেঙে পড়লেন। তাঁর জন্যেই ফিরে আসা। তার ওপর যে দিলীপ আট বছর আগে যাবার জন্য উৎসাহ দিয়েছিল, সে-ই এখন ফিরবার জন্য তাগাদা দিতে লাগল। সব ছেড়েছুড়ে চলে এলেন। মানুষটার মধ্যে এই ছেড়ে দেবার গুণটি দেখে অবাক হতাম।

ফিরে এলেন মনের ওপর আট বছরের আমেরিকা বাসের ছাপ নিয়ে। দেখলাম শুধু ওঁর নিজের আত্মীয়-স্বজনদের থেকে নয়, আমার চেনা-জানা সবার থেকেও আলাদরকম চিন্তা করেন। এত বছর পরেও গভীর ভাবে বাঙালী কিন্তু কোনো রকম গোঁড়ামি নেই। না দিশী, না মার্কিন।

আমার মনে হয় মানুষের মন শৈশবে যে রূপ পায়, সেটি কাটিয়ে ওঠা খুব শক্ত। আমার ছোটবেলা কেটেছিল বন-পাহাড়-নদী-ঝরনার মধ্যিখানে, লেখাপড়া শুরু হয়েছিল মেমদের হাতে। সেই নির্মল প্রবল আদর্শ আমার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে। সব ছোটদের শৈশব কাটা উচিত শহরের বাইরে, প্রকৃতির কাছাকাছি। তা সে যেখানেই হোক।

ওঁর ছোটবেলা কেটেছিল নদে জেলার গোরাই নদীর ধারে, কুষ্টিয়ার কাছে, চাপড়া গ্রামে। সেখানে চারশো বছর আগে ওঁদের এক পূর্বপুরুষ নাকি স্বপ্নে আদেশ পেয়ে কাশী কি প্রয়াগ থেকে কষ্টিপাথরের অপূর্ব সুন্দর জনার্দন মূর্তি। নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওখানকার জমি জমা সব দেবোত্তর ছিল। পালা করে দেব সেবা হতো। সে মূর্তি কলকাতায় এক শরিকের বাড়িতে দেখে এসেছি। সেই বুড়ো ঠাকুরদাদের ঠাকুরদা তাকে কাপড় দিয়ে বুকে বেঁধে পায়ে হেঁটে সেই দীর্ঘ পথ পার হয়েছিলেন। ফল-মূল খেয়ে, রাতে প্রায় না ঘুমিয়ে—মূর্তি যদি মাটি পায় তাহলে সেইখানেই প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে এই ভয়ে—দেবতা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এ সব গল্প আমার ননদ, জা-দের মুখে শুনেছিলাম। সবাই বৈষ্ণব। পুজোতে চালকুমড়ো বলি পর্যন্ত হতো না। সন্দেশ আর ফলমূল নিবেদন করা হতো।

পরিবারটার মধ্যেও এক ধরনের উদারতা দেখতে পেতাম। যাঁদের অবস্থা ভালো তাঁরাও হাল ফ্যাশানের ধার ধারতেন না। আমার জ্যাঠশ্বশুর মেয়েদের কাউকে কাউকে কলেজে পড়িয়েছিলেন, বাকি সব মেয়েরা সামান্য লেখাপড়া জানতেন। পুরুষ মেয়ে সবার লম্বা-চওড়া গড়ন, জোরালো গলা, মতামত প্রকাশ করতে আপত্তি নেই, আবার স্নেহশীলও বটে। আমি তাঁদের কাছে যেমন আদর পেয়েছিলাম, তেমনি অজস্র পারিবারিক গল্পও শুনেছিলাম।

সে যাই হোক, ঐ চাপড়া গ্রামে মাটির ঘরে আমার স্বামীর শৈশব কেটেছিল। বাবার বদলির চাকরি, মা এই ছোট ছেলে আর তার চেয়ে সাত বছরের বড় ছোট। মেয়ে নিয়ে অনেক সময়ে গ্রামে থাকতেন। লেখাপড়া জানতেন না, কিন্তু যেমনি সুন্দরী তেমনি বুদ্ধিমতী। তাঁর প্ররোচনায় তিন ছেলেই লেখাপড়ায় ভালো হয়েছিলেন। বড়ছেলে কলকাতায়, মেজ ময়মনসিংহে আত্মীয়-স্বজনের কাছে থেকে পড়তেন। ছোট গ্রামের স্কুলে।

মুশকিল হলো যে সেকালের হেডমাস্টার মশাই শুধু ক্লাসের পড়ার ব্যবস্থা করেই থামতেন না। ছেলেদের ওপর সর্বদা কড়া দৃষ্টি। একবার মিশনারি সায়েব-মেমরা গ্রামের কাছেই তাঁবু করেছিলেন। তাঁরা যেমন গ্রামের পুজোও দেখে যেতেন, তেমনি ছোট ছেলে-মেয়েদের হাতে যীশুর আর তাঁর সন্তদের সুন্দর সুন্দর ছবিও দিতেন। একথা হেডমাস্টার মশাইয়ের কানে যেতেই তিনি ঐ সব অযোগ্য হিন্দু সন্তানদের ধরে বেতিয়ে পরধর্ম-লোভের ব্যামোর চিকিৎসা করেছিলেন।

আরেকবার ছোট ছেলেদের সঙ্গে আমার স্বামীও স্কুলে যাচ্ছেন। বয়স ছয়। এমন সময় ভোলা গয়লা বাঁকে করে দই নিয়ে কোনো ব্যাপারবাড়িতে জোগান দিতে যাচ্ছে। বন্ধুরা বলল, ‘আঙুল ডুবিয়ে একটু চেখে দ্যাখ্ কি ভালো দই। তুই বামুনের ছেলে, তুই খেলে দোষ হয় না।’ যেমন বলা তেমনি কাজ। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে আঙুল ডুবিয়ে দই তুলে মুখে পুরে দিল! দইওয়ালাও তাকে ধরে নিয়ে গেল হেড মাস্টার মশাই-এর কাছে। হেড মাস্টার মশাইও তাঁর জানা সেই একই ওষুধ দিয়ে এ ব্যামোও ছাড়ালেন।

ছেলে বড় দুরন্ত। শেষ পর্যন্ত জমির বলে এক মুসলমান রক্ষী রাখা হলো। সে সারাদিন ছেলে আগলায়। এই জমিরদা এমন এক চরিত্র যে তাকে ভোলা যায় না। এদিকে একা হাতে সংসারটাকে মাথায় করে রাখত, ওদিকে বিস্ময়কর ওঝাগিরি জানত। কাউকে ভূতে পেলে, কি সাপে কাটলে ওর ডাক পড়ত। ও নাকি প্রায়-মরাকেও সারিয়ে তুলত। একবার ওঁদের হাঁসের ঘরে পরপর দু-দিন দুটো হাঁস সাপের কামড়ে মারা গেল। জমিরদা সবাইকে তফাতে থাকতে বলে কি একটা শুকনো শিকড়ের মতো জিনিস নিয়ে হাঁসের ঘরে ঢুকল। কিছুক্ষণ পরেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে এক মস্ত কেউটে তার পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল।

বাইরে এসে জমিরদা ঝুলি থেকে একটা মরার হাড় বের করে সাপের চারদিকে চকিতে একটা গোল দাগ কেটে, নিজে তার বাইরে দাঁড়াল। ওঁর কাছে শুনেছি সেই সাপ গর্জাতে গর্জাতে দাগ অবধি এসেই, মাথা নুইয়ে পেছিয়ে যায়। কিছুতেই দাগ পার হতে না পেরে নিজের গায়ে ছোবল মেরে, নিজের বিষে মরল। তখন তার শরীরটা পুড়িয়ে ফেলা হল।

বাংলার মফঃস্বলের চেহারা কিছু জানতে বাকি রইল না। মাঝে মাঝে বাবার কর্মস্থলেও যেতেন। উত্তর বাংলার চলনবিল, কলমগ্রাম চোখে দেখা হল। বর্ষায় সব জলে-জল, খালি টিলার ওপরকার বাড়িঘর যেন দ্বীপের ওপর জেগে থাকত। নৌকো করে এ বাড়ি ওবাড়ি যাওয়া-আসা। কই মাছরা কানকোয় ভর দিয়ে জল ছেড়ে দলে দলে টিলার গা বেয়ে উঠছে।

ছেলে আরো বড় হলে জামতাড়ার বিখ্যাত কেশব হাজারীর স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস্ করলে, কলকাতার স্কটিস চার্চ কলেজে আই এ পড়ল, তারপর ইতিহাসে অনার্স নিয়ে প্রথম বিভাগে বি এ পাস্। তারপর এম এ পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে আমেরিকায় যাওয়া।

এত কথা এক দিনে জানিনি, একটু একটু করে অনেক বছর লেগেছিল। ততদিনে এই অন্যরকম পরিবারটার ওপর গভীর মায়া পড়ে গেছিল। স্মৃতিকথা লিখতে গেলে সাংসারিক জীবন আর লেখিকার জীবন আলাদা করা যায় না। দুটো একসঙ্গে জড়িয়ে থাকে। লেখিকামন সংসারের কাজে বাধা ঘটায়। পদে পদে ভুল করায়। যে সব মেয়ে সংসার-গত প্রাণ, তাদের মতো চৌকোস্ গিন্নি হতে দেয় না।

আবার এর উল্টো দিকটাও আছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সংসারের কর্তব্য পালন করতে গেলে ঐকান্তিক ও একাগ্রভাবে সাহিত্য-সাধনা করা যায় না। আর শুধু সাহিত্য-সাধনাই বা কেন, সঙ্গীত-শিল্প জ্ঞান-বিজ্ঞান কোনো সাধনাই সমস্ত হৃদয় মন দিয়ে করা যায় না। অথচ কোন্ মেয়েই বা নিজের স্বামী-সন্তান-সংসারের অযত্ন করতে চায়? নারীত্বকে অস্বীকার করে, কোন্ নারী?

এই একটি কারণেই দুনিয়ার সব কালে, সব দেশে, সব বিষয়ে, সমান প্রতিভা সমান দক্ষতার অধিকারী হয়েও মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে এক পা পেছিয়ে থাকে। অবিশ্যি সব নিয়মের মতো এরও দু-একটি যুগান্তকারী ব্যতিক্রম আছে। তবে হয়তো সে-রকম ব্যতিক্রমও নয়। সে সব ক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল স্বামী কি অন্য আত্মীয় ঐ মেয়েদের কাঁধ থেকে সংসারের কর্তব্যের বোঝা নামিয়ে নিতে পেরেছেন। হয়তো মিসেস্ ব্রাউনিং, মাদাম কুরি, খনা-লীলাবতী-গার্গী ইত্যাদির সেই সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে মাঝে মাঝে কোন কিছুর অপেক্ষা না রেখে নিজের অন্তরে ছোট একটি ফুল যদি ফোটে, তাকেও অস্বীকার করা যায় না।

এত কথা বলছি কারণ আমাকেও ঐরকম আতান্তরে পড়তে হয়েছিল। চমক লাগানো প্রতিভার অধিকারিণী না হয়েও, সংসারের কাজে নিজেকে অভ্যস্ত করার মাঝে মাঝে তীব্র একটা খেদ সমস্ত মনপ্রাণকে পেয়ে বসত। মনে হত যে জন্যে এসেছিলাম তার কিছুই করা হলো না। শুভানুধ্যায়ী বন্ধু-বান্ধব, এমন কি মাঝে মাঝে আমার স্বামী পর্যন্ত দুঃখ করতেন, ‘অমুক এত লিখছে, তমুক এত নাম করছে, তুমি কি লেখা-টেখা ছেড়ে দেবে নাকি?’ আমার অন্তরের নিদারুণ ব্যর্থতা বোধ খুলে বলতে বাধো-বাধো লাগত। জানতাম বললে কেউ বুঝবে না। আমার স্বামী মাঝে মাঝে খানিকটা আঁচ করে বলতেন, ‘একজন ফিরিঙ্গি হাউস-কীপার রেখে দিই না কেন? সে তোমার চেয়েও ভালো করে সংসার চালাবে আর তুমিও লিখবার অনেক সময় পাবে।’

শুনে পিত্তি জ্বলে যেত। কি করে বোঝাই যে বিঘ্নটা কাজের তাড়ায় বা সময়ের অভাবে নয়, বিঘ্ন আমার মনে। কি একটা আছে আমার মধ্যে যে আমাকে আমার সংসার থেকে অব্যাহতিও দেয় না। আবার যে-কাজ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে, সেটা করতে পারছি না বলে সব ব্যর্থ মনে হচ্ছে। হঠাৎ যদি হাতে এন্তার সময় পেয়ে কলম ধরে বসি, তবুও সে আমাকে পড়বার মতো কিছু লিখতে দেবে না। এমন সময় মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা ছোট গল্প একেবারে তৈরি হয়ে, আমার কলমের আগায় ছাড়া পাবার জন্য আঁকু-পাঁকু করত। তখুনি সান্ত্বনা পেতাম। বুঝতাম সব নষ্ট হয়ে যায়নি। বয়স ত্রিশের দিকে এগিয়ে চলেছে।

বলাবাহুল্য, সময় থেমে থাকেনি। পরের বছর আমার ছেলে রঞ্জন জন্মেছিল। আরো চার বছর পরে মেয়ে কমলা। তাতে আমার জীবনে এমন একটা পরিপূর্ণতা এসেছিল যে ক্ষোভের কিম্বা খেদের খুব জায়গা ছিল না। অনেক লেখক সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপও হয়েছিল। জীবনের ক্ষেত্রটাও বেড়েছিল।

ততদিনে এল্‌গিন রোডের বাস তুলে আমরা চার নম্বর রায় স্ট্রীটের এক তলায় উঠে এসেছিলাম। চারদিকে মস্ত ঘাস জমি, বাগান, আম-জামের গাছ। কোনো কোনো বাড়ি শুধু ইঁট-কাঠ, চুন-সুরকি, টাকা-কড়ি দিয়ে তৈরি হয়। তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। এল্‌গিন রোডের ঐ চারতলা বাড়িটা ঐ রকম ছিল। আগেও কেউ থাকত না, আমরা চলে এলে আমাদেরও ওখানে প্রায় চার বছর কাটাবার কোনো চিহ্ন রেখে এলাম না। তবে ততদিনে বাড়ির প্রত্যেকটি ফ্ল্যাট গম্গম্ করত। তার মধ্যে একতলার সামনের দিকের ফ্ল্যাটটিতে বসন্ত লাহিড়ী বলে জীবনের হাতে পোড়-খাওয়া একজন দুঃখী মানুষ, তাঁর গুটি পাঁচেক অনাদৃত ছেলে নিয়ে এসে উঠলেন। সবার ছোট জিতু লাহিড়ী তখনো স্কুলে পড়ে। আমার ছোটবোনের সমবয়সী। ন্যায়ভাবেই হোক, কি অন্যায় ভাবেই হোক, দণ্ডিত বাপের ছেলে। তা বংশ যত অভিজাতই হোক না কেন, এক কালে ধন-মান কিছুরই অভাব ছিল না। এখন সুনামটুকু পর্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়ে ভগ্নদেহে একতলার ঐ ফ্ল্যাটটিতে এসে উঠলেন। এঁরা আমার স্বামীর দূর সম্পর্কের আত্মীয়।

আগের দিন বিকেলে আমার স্বামী বললেন, কাল দুপুরে বসন্ত-দাদের ছয়-সাত জনের মতো খাবার পাঠাতে পারবে?’ তখন তাঁর কাছে ওদের সব কথা শুনলাম।

দুঃখীকে আমার স্বামী কিছুতেই ছাড়তে পারেন না। সত্যিকার দুঃখী না হলেও নয়। এঁরা সব হারিয়ে এসেছেন। গিয়ে দেখলাম বাইরের ঘরে পুরনো একটা চেয়ারে বসে আছেন। ছেলেরা ঘর গুছোতে ব্যস্ত। দেখে মনে হলো ভগ্নদেহ বটে, কিন্তু ভগ্ন মন নয়। মুখ তুলে তাকালেন যখন, সিংহের কথা মনে হল। বললাম, ‘আমি কিন্তু আপনাদের জন্য রান্না করেছি। বারোটার সময় পাঠিয়ে দেব।’ দেখলাম চোখে জল। ভীষণ কষ্ট হল।

ছেলেগুলোকে ডাকলেন। সেই মুহূর্তে আমার ভালোবাসার মানুষের দল অনেকখানি বেড়ে গেল। জিতু বলে ঐ ছোটটি আমার পরম স্নেহের পাত্র হয়ে উঠল। আমার কাছে ইংরিজি, অংক পড়তে আসত। পরে বি এ, এম এ পাস্ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সাধারণ সৈনিক হয়ে ঢুকে, যতদূর সম্ভব উন্নতি করেছিল। পৌরুষের প্রতিমূর্তি ছিল। অকালে ক্যান্সার রোগে চলে গেল। তবে খুব কম বয়সে যায়নি। বিয়ে করেছিল জাত ভেঙে, আমারই আশুতোষ কলেজের এক ছাত্রীকে। তার নাম ফুলরানী ঘোষ। সে-ও এম এ পাস্ করেছিল। আজ পর্যন্ত সমস্ত পরিবারটার জন্য আমার হৃদয়ে একটা কোমল উষ্ণ স্থান রয়েছে।

সাঁইত্রিশ সালে আমরা চার নম্বর রায় স্ট্রীটে উঠে এলাম। এসেই টের পেলাম এ-বাড়িকে কেউ প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছে। দেড়-বিঘে জমির মধ্যে লাল রঙের বাড়ি। ছড়ানো, খোলামেলা, বড় বড় বারান্দা। আমার চেনা বাড়ি, অনেক দিনের পছন্দের বাড়ি। কলেজ জীবনে জাস্টিস চন্দ্রমাধব রোডের ভাড়া বাড়ির তিন তলা থেকে এ বাড়ির পূবের বারান্দা দেখতে পেতাম। সায়েব ভাড়াটেরা ওখানে ব্রেক্ফাস্ট খেত। সামনে বড় বড় পাম-গাছ। বড় ভালো লাগত। কখনো ভাবিনি ওখানে আমিও একদিন বসতে পাব।

শ্রীনাথ দত্ত সেকালের নামকরা ব্রাহ্ম ছিলেন। তাঁর স্ত্রী বাগানটাকে নিজের হাতে গড়েছিলেন। শুনেছি ফার্ণগাছের, পাম-গাছের পাতায় ধুলো জমে বলে সপ্তাহে একবার করে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে নিজের হাতে মুছে দিতেন। গাছরা ভালবাসা বোঝে। কি সুন্দর আবহাওয়া ছিল ঐ বাড়ির আর বাগানের। বাছাই করা আমগাছ, বড় বড় জামরুল—তাদের বুকের ভিতরটা লাল। চমৎকার পেয়ারা-গাছ, রাঙা তেঁতুলের গাছ, নারকেল গাছ, কুরচি ফুলের গাছ, আর সবচেয়ে আশ্চর্য গাছ ছিল গাড়িবারান্দার দক্ষিণে দুটি দুর্মূল্য পান্থ পাদপের গাছ। ফটক দিয়ে ঢুকলেই গাছ দুটি সকলের চোখে পড়বেই।

দোতলায় শ্রীনাথ দত্তের বিধবা মেয়ে, সেকালের তেজী ব্যারিস্টার বসুধাকান্ত নাগের বিধবা স্ত্রী, তাঁর চারটি নাবালক ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন। মেয়ে দুটি আমার ছোটবোন লতিকার বাল্যবন্ধু। সবাই আমার আপনজন হয়ে গেল। একদিন লতিকা একটা ছোরা নিয়ে বলল, ‘মজা দেখবে?’ বলে ছোরাটা পান্থ-পাদপের সবুজ গায়ে বসিয়ে দিল। ছোরা টেনে বের করার সঙ্গে সঙ্গে টলটলে পরিষ্কার জলের স্রোত ঐ ক্ষত থেকে গলগল করে বেরিয়ে এল। সে জল দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমনি ভালো। মরুভূমির গাছ নাকি। এ মিষ্টি জল দিয়ে যাত্রীদের প্রাণ বাঁচায়।

এই বাড়িতে আমি নিজেকে আবার ফিরে পেলাম। এতদিন শুধু ছোটদের কয়েকটি গল্প আর নানা পত্র-পত্রিকায় প্রধানত সাহিত্য বিষয়ক সমালোচনাই লিখেছি। মৌলিক কিছুতে হাত দিইনি। তবে এ কাজও বৃথা যায়নি। কলমে ক্রমে জোর পেয়েছি। আত্মপ্রত্যয় আরো বলিষ্ঠ হয়েছে।

একদিন অধ্যাপক নীরেন রায় পণ্ডিচেরীর দিলীপকুমার রায়ের একখানি উপন্যাস এনে দিয়ে বললেন, ‘নাও, ‘পরিচয়ে’র জন্য এটার সমালোচনা লিখে দিতে হবে।’ কোন বই ভালো করে মনে নেই, হয় ‘মনের পরশ’, কিম্বা ‘রঙের পরশ’।

বইটি দিয়ে, নীরেনবাবু চুটিয়ে তার নিন্দে করলেন। একটু অবাক না হয়ে পারলাম না। দিলীপ আমার স্বামীর জ্যাঠতুতো দিদির ছেলে, সমবয়সী এবং অন্তরঙ্গ। নীরেনবাবুরো বাল্যবন্ধু। এতগুলো কড়া কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘আমি কিন্তু আমার নিজের মতামতটাই লিখব, আপনার গুলো নয়।’ বললেন, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়, যার এতটুকু বুদ্ধি আছে সেই আমাকে সমর্থন করবে।’ বই পড়ে বুঝলাম নীরেনবাবুর মতের সঙ্গে লেখকের মত মেলেনি বলে এতখানি উষ্মা। বইয়ের অনেক গুণ, যদিও পড়ে মনে হয়েছিল কয়েকটি বিশ্বাস এবং মতামত জোর করে পাঠকের ওপর চাপাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু দিলীপের লেখা যত বই পড়েছি সবগুলির সততা এবং নির্ভীকতা দেখে যেমন খুশি না হয়ে পারিনি, এতেও তাই। ফলে ‘পরিচয়ে’ ঐ সমালোচনা ছাপা হল না। সে সময়ে কে সম্পাদক ছিলেন মনে নেই, সমালোচনার বিভাগটি নীরেনবাবুর হাতে ছিল। ব্যাপারটাতে একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। সেই সময়ে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার খুব নাম ডাক। তার সম্পাদক ডঃ সুশীল মিত্র আমার স্বামীর কাছে লেখাটি চাইলেন। ‘পরিচয়’ কিন্তু সরাসরি লেখা ফেরত দেয়নি, ‘জায়গা নেই’ ইত্যাদি বলে ছাপছিল না। আমি আমাদের প্রিয় বন্ধু সুশোভন সরকারকে বলে সমালোচনাটি আনিয়ে, সুশীলবাবুকে পাঠিয়ে দিলাম। বিচিত্রা’য় ছেপে বেরুল।

সাধারণ পাঠকরা খুশি হলেও, নীরেনবাবু, কিম্বা দিলীপ নিজে, কেউই সন্তুষ্ট হননি। সত্যি বলতে কি, কদাচিং আমি নিজের থেকে সমালোচনার কাজে হাত দিয়েছি। সর্বদা অনুরোধে পড়ে করেছি। সেরকম সুখও পাইনি।

সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ সাল মনের সুখে ও শারীরিক অসুস্থতায় কেটেছিল। আটত্রিশের ফেব্রুয়ারিতে আমার মেয়ে কমলা জন্মাল, নভেম্বরে ডাঃ সুবোধ দত্ত আমার গল্-ব্লাডারটি তিনটি পাথরসুদ্ধ কেটে বাদ দিলেন। ক্রমে আমার শরীর সেরে উঠল। নতুন উদ্যমে একটা অন্যরকম কর্মময় জীবন শুরু করলাম। উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে এক বছর বিদ্যাসাগর কলেজে রোজ এক ঘণ্টা ইংরিজি পড়িয়ে আসতাম। সেখানে চেনা লোক ছিল। আমার সেজ জ্যাঠার বড় ছেলে বিখ্যাত খেলোয়াড় শৈলজারঞ্জন গণিতের অধ্যাপক, আমার বাল্যবন্ধু মীরা দত্তগুপ্ত মহিলা বিভাগের অধ্যক্ষ। এঁদের সস্নেহ উৎসাহে এক বছর কাজ করলাম। একশো টাকা মাইনে। অত হাসবার কিছু নেই। সেই একশো এখনকার এক হাজারের বেশি। পারতাম না, নানা সাংসারিক বাধা পড়ত। প্রথম কনট্রাক্ট শেষ হলে আরেকটা করার আগ্রহ ওঁদের বা আমার কারো ছিল না। তারপর আর অধ্যাপনা করিনি।

এর আগের বছর পণ্ডিচেরীতে একাদিক্রমে দশ বছর বাস করার পর দিলীপ রায় কলকাতায় এসেছিলেন। এবার আবার এসে থিয়েটার রোডে মামার বাড়িতে উঠে তাঁর যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি শ্রীঅরবিন্দর আশ্রমকে দানপত্র করে দিয়েছিলেন। মাঝখান থেকে আমিও একজন অসাধারণ মানুষকে অন্তরঙ্গভাবে দেখবার সুযোগ পেয়ে গেলাম।

রোজ ভোরে থিয়েটার রোড থেকে হেঁটে দিলীপ আমাদের বাড়িতে এসে ‘ব্রেক্ফাস্ট’ করতেন। আমিও এক নতুন জগতের আস্বাদ পেতাম। এতখানি জ্ঞান, বিদ্যা, প্রতিভা, ত্যাগ, মাধুর্য, উদারতা এবং অনুদারতার সংমিশ্রণ আর দেখিনি। অন্তত ভারতে কখনো জন্মেছে বলে মনে হয় না। আমার স্বামীর পরম ভালবাসার পাত্র ও কৈশোর যৌবনের প্রিয় সহচর বলে দিলীপের প্রাক্-পণ্ডিচেরী জীবনের কিছুটা জানতাম। দিলীপের স্মৃতি আমার স্মৃতিভাণ্ডারের ও হৃদয়ের বেশ খানিকটা জুড়ে আছে বলে তাঁকে বাদ দিয়ে এ বই লেখাও যায় না।

পরনে গেরুয়া, গলায় রুদ্রাক্ষ, কপালে চন্দন। তেইশ নং রায় স্ট্রীটে দিলীপের কেমব্রিজের বন্ধু গগনবিহারীলাল মেটা থাকতেন। একদিন তিনি কথায় কথায় আমার স্বামীকে বললেন, ‘আই অফেন সী এ সাধু পাসিং দিস ওয়ে লুকিং লাইক দিলীপ রয়।’ দিলীপকে এ কথা বলাতে হো-হো করে হেসে বললেন, ‘ওকে বলো, নো, নো, ইট ইজ্ ওনলি দিলীপ রয় পাসিং দিস ওয়ে লুকিং লাইক এ সাধু।’ এই রকম ফুর্তিবাজ ছিল তাঁর বাইরের রূপ। ভিতরের গভীরতার তল পাওয়া যেত না। শুধু এইটুকু বোঝা যেত বৈষয়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো মূল্য নেই তাঁর কাছে। এক রকম সৌকুমার্য ছিল ওঁর স্বভাবে, যার জন্য লোকের মুখের কথা বড় বেশি বিশ্বাস করতেন। যাঁরা নিজেরা কখনো মিথ্যা বলেন না, তাঁদের মধ্যে এই দুর্বলতা প্রায়ই দেখি। অন্যরা যে মিথ্যা বলতে পারে, এঁরা ভাবতে পারেন না। পুরনো বন্ধু ও আত্মীয়ের সঙ্গে সস্নেহ ব্যবহার করলেও, খুব বেশি ব্যক্তিগত টান ছিল বলে আমার মনে হতো না। তাতে অনেকে মনে কষ্ট পেতেন। আমি কিছু আশা করতাম না। আগেকার কোন দাবি ছিল না। আমার স্বামী দিলীপের কাছে অনেক স্নেহ, সাহচর্য, সহায়তা পেয়েছিলেন, তাতেই তাঁর মন কানায় কানায় ভরা ছিল। কাজেই তিনিও কিছু আশা করতেন না। তবে কখনো যদি কানে আসত, ‘অমুক দিলীপকে তোমাদের বিষয়ে এই-এই বলেছে, তোমরা শ্রীঅরবিন্দের নিন্দা কর ইত্যাদি।’ এবং তার ফলে দিলীপ কিছুদিন আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন না, তখন আমার স্বামী মুখে কিছু না বললেও, মনে দুঃখ পেতেন। আমি তা-ও পেতাম না। কিন্তু খানিকটা রাগ হতো যে এমন মহৎ মানুষ কেন অযোগ্য লোকের কথায় কান দেন। অমনি মনে পড়ে যেত রবীন্দ্রনাথও দিতেন। হয়তো একই কারণে। মিথ্যা কথাকে চিনতে পারতেন না বলে। এক রকম বালসুলভ সরলতা ছিল দুজনার। ভারি রসবোধও ছিল।

ভারি গুণগ্রাহী ছিলেন দিলীপ। গুণ দেখলেই উচ্চকণ্ঠে গুণের ও তার অধিকারীর প্রশংসা করতেন এবং মাথায় তুলে নাচতেন। তারপর আরো গুণ না পেলে দুম করে মাথা থেকে ফেলে দিতেন। মনের মধ্যে দিলীপের কেমন একটা ঔদাসীন্য ছিল। ব্যক্তিগত বন্ধন তিনি স্বীকার করতেন না। যিনি সংসারত্যাগী, তিনি করবেনই-বা কেন? তবে প্রকৃত বন্ধু আর অলীক বন্ধুর তফাৎ বুঝতেন না, এই যা দুঃখ। শিবের মধ্যে যে-সব গুণের ও দুর্বলতার কথা শোনা যায়, এ তো আর তার চেয়ে মন্দ নয়।

আমি দিলীপকে মহাপুরুষ বলি। যেমন গান-বাজনায়, কাব্য-রচনায়, জ্ঞান-বিদ্যায় তেমনি ভগবৎ প্রেমে তিনি সাধারণ মানুষের চেয়ে এতটা উপরে ছিলেন যে তাঁকে কম লোকই বুঝত। আমি তো নয়ই। যেটুকু দেখেছি তাতে যেমন মনে হয়েছে, তাই বললাম।

আমার স্বামীর কাছে দিলীপের শৈশবের কথা শুনেছি। অসাধারণ বাপ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একমাত্র ছেলে। শৈশবে মাকে হারিয়ে, পনেরো বছর বয়স অবধি বাপের আদরে মানুষ হয়েছিলেন। তারপর বাপও চোখ বুজলেন। দিলীপ আর তাঁর চেয়ে এক বছরের ছোট বোন মায়া, মামার বাড়িতে দিদিমার কাছে অতিরিক্ত আদরে মানুষ হয়েছিলেন। দিলীপ কিন্তু সংসারের মাটিতে কোনো দিনই শিকড় গাড়েননি। ধনী বাপের গুণী ছেলে, দেখতে অপূর্ব সুন্দর, কুড়ি বছর বয়স থেকে ভালো ভালো বিয়ের সম্বন্ধ আসত। সব সম্বন্ধেই দিলীপ নারাজ। তবে তার মধ্যে বাছাই করা দুটো একটাকে আমার স্বামীর ঘাড়ে চাপাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। বলতেন, ‘না কেন? অনেক টাকা-কড়ি আর সুন্দরী মেয়ে পাবি!’ আমার মতে সাংসারিক জীবনের জন্য তৈরি হননি দিলীপ। আমার অনেকবার মনে হয়েছে সংসারী লোকদের উনি একটু ঘৃণা করতেন। হয়তো ভুল বুঝতাম।

দিলীপের জন্য বহু গাইয়ে-বাজিয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। অশেষ আনন্দ পেয়েছিলাম। দিলীপ কলকাতায় এলেই আমাদের বাড়িতে ভালো ভালো গাইয়ে এনে আসর করতেন। এইভাবে ভীষ্মদেব, পাহাড়ি সান্যাল, সায়গল, জ্ঞান ঘোষ প্রমুখকে অতিথিরূপে পেয়েছিলাম। একবার আসরের আগের দিন বলে পাঠালেন, ‘গানের পর পনেরোজন খাবে কিন্তু।’ আমি খুশি হয়ে কুড়ি জনের মতো হাটবাজার করিয়ে রাঁধা-বাড়া শুরু করলাম। পাঁচ জন বাড়তি হবেই জানতাম। বাবুর্চির আবার জ্বর।

বেলা বারোটায় দিলীপের এক তরুণ ভক্ত এসে বলল, ‘পনেরো নয়, মণ্টুদা বললেন, জনা পঁচিশ হবে।’ আমার প্রায় ফিট্ হবার জোগাড়। তখন সে দয়া করে বলল, ‘তবে কিনা মামিমা, তুমি যদি আমাকে নেমন্তন্ন কর, তাহলে ঐ বাড়তি দশ জনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিষ্টি করে খাওয়াটা রদ করি।’ আমি বললাম, ‘কি মিথ্যা কথা বলবে?’ সে জিব কেটে বলল, ‘মিথ্যা নয়, মিথ্যা নয়। তোমার তো গল্‌স্টোন আছে, তুমি শেষ মুহূর্তে অতটা পারবে কেন?’ তাই হলো, কেউ কিছু মনে করল না। এমনকি দিলীপও অম্লান বদনে বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার শরীর ভালো না, অত লোককে শেষ মুহূর্তে বলতে চাওয়াটা ভারি অন্যায়। ও ঠিক করেছে।’

॥ ৩ ॥

বাড়ির তো আর প্রাণ থাকে না, কিন্তু যারা বেশিদিন এক বাড়িতে বাস করে, তারা হয়তো তাদের সুখ-দুঃখ ভাবনা-ভালোবাসার খানিকটা বাড়ির গায়ে রেখে যায়। শুনেছিলাম বাড়ির মালিক পার্বতীনাথ দাশের স্ত্রী একটা ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে টবে সাজানো বেঁটে বেঁটে পামগাছগুলোর পাতা মুছে দিতেন। শেষ বয়সে দেখেও ছিলাম তাঁকে, থান পরা বিধবা, মুখে গভীর শান্তি। দুঃখও কম পাননি; ছোট ছেলের হল কুষ্ঠ রোগ, এক মাত্র মেয়ে হলেন অল্প বয়সে বিধবা। এই সব ব্যথা-বেদনার সঙ্গে ঐ বাড়িতে যে একটা গভীর শান্তি রেখে গেছেন, সেটা আমি টের পেতাম। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছিলেন।

তখন ওঁদের অবস্থা পড়ে গেছিল, বাড়ি মেরামত হত না, জানলায় গরাদ ছিল না। এক তলায় থাকব, ভয় হল, তাই আমার কথায় শিক লাগানো হল। ওপরে বিধবা মেয়ে ঊষা মাসিমা আর তাঁর নাবালক ছেলেমেয়েরা। নিচে আমরা দুজন, আমাদের তিন বছরের ছেলে রঞ্জন আর আমার বিধবা ননদ। তিনি যেমন গোঁড়া হিন্দু—মাজা বাসনে জল ছিটিয়ে ঘরে তোলেন—আবার তেমনি উদার মন। আমার মা বামুনের মেয়ে, বাপ কায়স্থ, নিজে ব্রাহ্ম, ঠাকুর পুজো করি না। তবু আমাকে তিনি একেবারে হৃদয়ে স্থান দিলেন। মেয়ের মতো করে যত রাজ্যের রান্নাবান্না কাঁথা সেলাই, আচার তৈরি শেখালেন। ছোড়দি বলে ডাকতাম। তাঁর কাছেই কুষ্ঠিয়ার চাপড়া বলে আমার শ্বশুর বাড়ির গ্রামের এত অজস্র গল্প শুনেছি যে মনে হয় আমিও সেখানে বছরের পর বছর বাস করেছি।

এ বাড়িও আমার বাপের বাড়ির খুব কাছে, নিত্য যাওয়া আসা। তবে বাপের বাড়িতে আর কখনো রাত কাটাইনি। আমার মা-র সঙ্গে ছোড়দির স্নেহের সম্পর্ক গড়ে উঠল। তাঁকে মা বলেই ডাকতেন, যদিও মা হয় তো মাত্র বছর পাঁচেকের বেশি বড় ছিলেন না। বাইবেলে আছে, ‘দি লর্ড হাথ সেট মাই পাথ্স্ ইন প্লেজাণ্ট প্লেসেস।’

আমারো ঠিক তাই হল। বাড়িটার অবস্থা আসলে খুব ভালো ছিল না, লাল মেঝেতে ফাটল, শ্বেত পাথর নড়বড়ে, দেয়ালে নোনা, ছবি টানালে ছ্যাৎলা পড়ে, দেয়াল আলমারিতে ব্যাঙের ছাতা গজায়, সব জায়গায় একটু সোঁদা সোঁদা গন্ধ, বড় খাবার ঘরে, ভাঁড়ার ঘরে কখনো রোদ ঢোকে না, গুদামে হিন্দুস্থানী গয়লা বড় বড় গরু রাখে। সব জায়গায় মস্ত মস্ত মশা। এত বড় যে তাদের গায়ে ডোরা কাটা দেখতে পেতাম। বেশি কামড়ালে পেকে ওঠে। ঊষা মাসিমার গোটা পাঁচেক বিরাটাকার বিলিতী মুরগি আর একটা প্রায় পাঁঠার সমান বড় সাদা মোরগ। সকলেরি এত বয়স হয়েছে যে বাগানের নরম মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সারা দিন রোদ পোয়াত, সন্ধ্যা হতেই একটা খালি গ্যারাজে ঘুমোত। একবার একটা কালো মুরগি উঠে যেতেই রঞ্জন তার গর্তে একটা লালচে বড় ডিম পেল। আহ্লাদে আটখানা হয়ে প্রায় খাড়া বেয়ারাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গিয়ে, সেটি ঊষামাসিমাকে দিল। তিনিও ওকে আদর করে, ডিমটি ভেজে খাওয়ালেন।

ওতেই মুরগিদের কাল হল। তাদের আরামে রোদ পোয়ানো শিকেয় উঠল। তাদের বসতে দেখলেই ঠেলেঠুলে তুলে দিয়ে রঞ্জন ডিম খুঁজত! শেষটা বেচারিরা বেগতিক দেখে পাঁচিলে চড়ে, ডানায় মুখ গুঁজে ঘুমের চেষ্টা করত। খালি সাদা মোরগ জায়গা ছাড়েনি। মোরগে ডিম দেয় না শুনে রঞ্জন যেমনি অবাক তেমনি বিরক্ত। ঠুকরেও দিত মোরগটা। ঊষামাসিমার বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে আমরা ভাগ পেতাম।

কি সুখে-শান্তিতে আমাদের দিন কাটত, ভাবলে আশ্চর্য লাগে। এদিকে দুনিয়াকে অন্ধকার করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সম্ভাবনা ক্রমে পাকিয়ে উঠছিল। গয়লা তখনো টাকায় সাড়ে চার সের দুধ সামনে দুয়ে দেয়। কয়লাওয়ালা মাসে দেড় টাকা হারে যত লাগে কয়লা যোগায়। ডিমওয়ালা টাকায় ৩২টি ডিম দিয়ে যায়। বুড়ি তাঁতিনী জোরজার করে সুন্দর সুন্দর গঙ্গা যমুনা বা ভোমরা পাড়ের তাঁতের শাড়ি জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে রেখে যায়। তার দাম সাড়ে তিন টাকা থেকে পাঁচ টাকার মধ্যে। রামকৃষ্ণ মিশনের ছেলেমানুষ ব্রহ্মচারীরা প্রতি রবিবার মুষ্টিভিক্ষা নিতে আসেন আর রঞ্জন তাদের দিয়ে মটর গাড়ির ছবি আঁকায়। ঘরে বসে কেক প্যাস্ট্রি কিনি, সূক্ষ্ম কারুকার্য করা চীনে টেবিলের চাদর কিনি। দক্ষিণভারত থেকে এক বুড়ো এসে জলের দরে নিখুঁৎ হাতে বোনা লেস্ বিক্রি করে যায়। ওদিকে আমার স্বামীর পেশায় সুনাম হচ্ছে। আমার শরীরের ব্যথা-যন্ত্রণা, অপারেশনের কষ্ট ক্যালকাটা নার্সিং হোমের দেবতুল্য ডাক্তার ক্যাপ্টেন মিত্রের আর আর.জি.করের স্বনামধন্য ডাক্তার ডাঃ সুবোধ দত্তের যত্নে ও দক্ষতায় দূর হয়ে যায়। দীর্ঘ দিন বেদনার শয্যায় শুয়ে থেকে মনের মধ্যে একটা নতুন রকম মুক্তির আস্বাদ পাই। এক কথায় ঐ বাড়িতে যে চার বছর ছিলাম, তার মধ্যে আমার নিজের সঙ্গে চেনাজানা হয়েছিল। তাই বলে কেউ যেন মনে না করেন যে স্বামীর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে আমার দিন কাটত। মোটেই তা নয়। মাঝে মাঝে বেজায় মতভেদ ঝগড়াঝাঁটিও হত। তবে চ্যাঁচামেচি করা কারো অভ্যাস ছিল না। আমার ভালো ভালো যুক্তিগুলোকেও উনি কেমন স্বচ্ছন্দে ডিঙিয়ে যেতেন দেখে অবাক না হয়ে পারতাম না। অনেক দিনের অভিজ্ঞতার ফলে পরে বুঝেছিলাম সব পুরুষমানুষরাই একটু অদ্ভুত হয়। আমার স্বামীর তো কল্পনাশক্তির যেটুকু ঘাটতি ছিল যুক্তিযৌক্তিকতা আর পরিসংখ্যান দিয়ে তার শুধু পূরণ হত না, উপচে পড়ত। এই জাতের সঙ্গে কেউ তর্ক করতে বসে?

সে যাই হোক, বোধ হয় ১৯৩৯-এ দিলীপ যখন আবার কলকাতায় এলেন, এক দিন হঠাৎ আমাকে বললেন, কই, তোমাদের বাড়িতে তো কখনো বুদ্ধদেব বোসকে দেখি না। ওকে কি তোমাদের ভালো লাগে না? চোখেই দেখিনি তা ভালো লাগালাগির কথা ওঠে কি করে। ওর প্রবন্ধ, ওর কবিতা খুব ভালো লাগে।

ওর উপন্যাস নিয়ে নানা লোকে নানা সমালোচনা করতেন। কেউ কেউ অসামাজিক বিষয়ের গন্ধ পেতেন। শুনেছি বেচারির যখন একটা ভালো চাকরির নিতান্ত দরকার ছিল, তখন নাকি সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও সেই অধ্যাপনার কাজটি ওকে দেওয়া হয়নি। এসব কথা ভাবলেও এখন হাসি পায়। তাহলে তো ইংরিজি সাহিত্যের তিন চতুর্থাংশ এবং শেক্সপীয়রের দশ ভাগের সাত ভাগ বাতিল করতে হয়।

সে যাই হোক, দিলীপ যখন বললেন, আমার ইচ্ছা তুমি ওকে নেমন্তন্ন কর, গাড়ি পাঠিয়ে আনার ব্যবস্থা কর আর তোমার বাবুর্চিকে দিয়ে ভালো ভালো বিলিতী পদ রাঁধাও। মহা খুশি হয়ে সবই করা হল। মনে আছে, বাগান থেকে বাছাই করা ফুল তুলে ঘর সাজানো হল। ‘ফ্যানি ফামার্স কুক’ বুক দেখে চমৎকার ফলের পানীয় বানিয়ে, সুন্দর সুন্দর ডাঁটি দেওয়া গেলাসে পরিবেশন করা হল। নানা রকম সুস্বাদু খাবার ও শেষে একটা মোক্ষম পুডিং খাওয়ানো হল। দিলীপ আর আমরা মিলে যত দূর পারি আদর-আপ্যায়ন করে রাতে ওকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হল।

ভালো লেগেছিল ওকে। আমার সমবয়সী, ছোট্টখাট্টো মানুষটির একটু যেন আত্মপ্রত্যয়ের অভাব, আবার সেই সঙ্গে একটু উন্নাসিক ভাব মনে হয়েছিল। কিন্তু চমৎকার আলাপ, কোমল ব্যবহার; একটু আন্তরিকতার স্বাদও যেন পেয়েছিলাম। মোট কথা খুশি মনে শুতে গেছিলাম। ভেবেছিলাম সব কষ্ট সার্থক হয়েছে, কারণ ওর ভালো লেগেছে। কাজেই যখন দিন দুই বাদে আমাদের আত্মীয় এবং বন্ধু শিশুসাহিত্যিক রবীন্দ্রলাল রায় এসে বলল, ‘তোমরা নাকি বুদ্ধদেবকে বাড়িতে ডেকে খুব চাল দিয়েছ, বড়মানুষি দেখিয়েছ? সে খুব বিরক্ত হয়েছে।’ তখন যে কি কষ্ট হয়েছিল সে আর কি বলব। মনে আছে সে রাতে আমার ঘুম হয়নি। একটু রাগও হচ্ছিল। পরে অবিশ্যি বুঝেছিলাম বুদ্ধদেব যে মন্তব্যই করে থাকুক বিরক্তও হয়নি এবং সম্ভবত আদরকে সে চাল বলে ভুলও করেনি। ভারি বুদ্ধিমান ছিল বুদ্ধদেব; তাকে বন্ধু বলতে পেরে আমি গর্বিত। ওকে বুঝতে পেরেছিলাম যখন এর কিছু দিন পরেই ওর কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম, তাতে লেখা ১লা বৈশাখ ও ‘বৈশাখী’ বলে একটা বার্ষিক প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছে, তার জন্য একটা গল্প লিখে দিতে হবে। বার্ষিকটি বড়দের জন্য।

চিঠি পড়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা! সর্বনাশ, বড়দের জন্য সমালোচনা প্রবন্ধ লিখি বটে, কিন্তু গল্প লিখব আবার কি! ও আমি পারব না। তা বুদ্ধদেবও কিছুতেই ছাড়বে না। ছোটদের জন্য লেখেন আর বড়দের জন্য পারবেন না, এ একটা কথা হল। ও আমি শুনব না। অমুক তারিখের মধ্যে চাই। আলোচনাটা মুখে হয়েছিল, না টেলিফোনে, না চিঠিতে কিছুই মনে নেই। খালি মনে আছে মনের মধ্যে কেমন করে জানি না একটা ছোট গল্প জন্ম নিল। ভূতের গল্প। তার নাম সোনালি রূপোলি। বুদ্ধদেব সেটা ছেপে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও বড়দের গল্পলেখক হয়ে গেলাম।

সম্পাদকমশাইরা কেবলি গল্প চাইতে লাগলেন। সেই থেকে আমিও আজ পর্যন্ত অজস্র বড়দের ছোট গল্প লিখেছি। তার মধ্যে নিজেই বিলিতী প্রভাব দেখতে পাই। কাটা ছাঁটা, একমুখী, সরস। তবে আমার কাছে ছোটদের গল্পেরি স্থান প্রথম। সেটা ভালো। বড়দের জন্য বহু ভালো লেখক আছেন, ছোটদের জন্য অনেক কম। তখন পর্যন্ত কিন্তু আমার ছোটদের গল্পের একখানিও বই বেরোয়নি। যা লিখেছি পত্রিকায় বেরিয়েছে। লোকে পড়েছে, ভালোমন্দ বলেছে, তাতেই আমি খুশি ছিলাম। পরিচয়ের বন্ধু গিরিজা ভট্টাচার্য নাকি একজনকে বলেছিলেন, ভদ্রমহিলাকে কাগজ নষ্ট করতে বারণ কর। আরেকজন বলেছিলেন, ছোটদের গল্প লেখার আগে ওর মস্তিষ্কের চিকিৎসা করানো উচিত। তাতেও ক্ষুব্ধ হইনি।

আমার তখন তিরিশ বছর বয়স। সমবয়সীদের মধ্যে বুদ্ধদেব, অজিত দত্ত, চার বছরের বড় প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার—সকলেই বেশ নাম করে ফেলেছেন। কিন্তু আমি তখনো তৈরিই হইনি। পড়ি, দেখি, শুনি, মন থেকে তাগাদা এলে একটা গল্প হয়তো লিখে ফেললাম। বই ছাপার কথা ভাবতেও পারি না। কুড়িয়ে বাড়িয়ে হয় তো একটা গল্পের বই, একটা রম্য-রচনা হতে পারে। ফূর্তি পাই না। ফুর্তি না পেলে কিছুই করতে পারি না। অনেকে বলতেন, এত ভালো কেরিয়ার করলে, একটা ডক্টরেট নাও না কেন? ঐ, ফুর্তি পাই না। অধ্যাপনা কেমন এক ঘেয়ে লাগে। সেদিক মাড়াই না।

চেনা-জানার দল বাড়ে। দিলীপ যাঁদের নিয়ে আসতেন, তাঁদের সঙ্গে তা না হলে আলাপই হত না। গাইয়ে-বাজিয়ে মানুষ সব। উদার; হয় তো কিঞ্চিৎ অসামাজিক কেউ কেউ; সাধু-ভক্ত-ও কেউ; কেউ অভিনয় করেন, কেউ নাচেন। লীলা দেশাইকে একদিন গানের আসরে আনলেন। সে অপূর্ব নাচ দেখাল, রঞ্জন ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে দেখল না বলে দুঃখ হচ্ছিল। সকালে সে বলল, ‘খুব ভালো নাচল মাসি।’ আরো এস, এমনি গল্প করতে। ভালো লাগত তাকে। কিছু কাল পর আর দেখা হয় না। এর প্রায় আঠারো বছর পর যখন আকাশবাণীতে প্রযোজক হয়েছিলাম তখন কারো কারো সঙ্গে আবার দেখা হল, আবার নতুন করে ভালো লাগল। বেঁচে থাকলে কি লাভের অংকটি খুব কম হয়?

একবার পণ্ডিচেরী থেকে দিলীপ লিখে পাঠালেন, আমার এক ফরাসী বন্ধুকে পাঠাচ্ছি। তোমাদের বাড়িতে কিছু দিন অতিথি করে রেখো। এলেন জাঁ এরবের বলে চমৎকার একজন মানুষ।

ছয় ফুটের ওপর মাথায়, বয়স মনে হত বছর ৪০, যেমন আমুদে তেমনি গম্ভীর। পৃথিবীর নানা ধর্ম সম্বন্ধে গবেষণা করছেন, বিবেকানন্দের ভক্ত। দিনের পর দিন সকাল থেকে বিকেল বেলুড়ে কাটান। নানান গভীর বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। একদিন ধুতি পাঞ্জাবী পরলেন। পাঞ্জাবীতে সুন্দর রূপোর বোতাম পরানো। জাঁ একটা আসন পেতে তাতে বসে, প্রসন্নমুখে আমাদের দিকে তাকালেন। আমাদের বিস্ময় দেখে বললেন, এই বোতাম আর এই আসন হল বিবেকানন্দের ব্যবহার করা জিনিস। প্যারিসে কোনো ধর্মীয় সংগ্রহ-শালায় রাখা হবে। মনে আছে, এমন জিনিস দেশ ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেছিল।

জাঁ অনেক দেশ ভ্রমণ করেছিলেন, চীন, তিব্বত ও নানা দুর্গম জায়গায়। তিব্বতের বিষয়ে একটা মজার গল্পও বলেছিলেন। সেখানকার কোনো বড় গুম্ফায় কাজকর্ম সেরে, ভারতে ফিরে আসার কথা ভাবছেন, এমন সময় ওঁর গাইড্ এবং দোভাষী বলল, তা হয় না। আমাদের নাইট্-লাইফ্ না দেখে ফিরে গেলে অন্যায় হবে।

অগত্যা গেলেন তার সঙ্গে। নাইট্-লাইফ্ মানে পানালয়ে সান্ধ্য সমাবেশ। মস্ত ঘর, ভদ্র আবহাওয়া, মেলা লোকজন নিচু গলায় গল্পগুজব করছে। গাইড্ বলল, ‘সবাই পরিবার নিয়ে এসেছে দেখেছেন?’

দেখেননি জাঁ; দেখলেও কাউকে পরিবার বলে চিনতে পারেননি। সব এক চেহারা, এক পোশাক। কে পুরুষ কে মেয়ে বুঝবার জো নেই। ক্রমে সন্ধ্যা বাড়তে লাগল; যারা সপরিবারে এসেছিল তারা আস্তে আস্তে বিদায় নিল। তারা গেলেই আবহাওয়াটা একটু করে বদলাতে আরম্ভ করল। ক্রমে উঁচু গলা, কর্কশ স্বর, তর্কাতর্কি শোনা যেতে লাগল। আরো রাত বাড়ল। মাথা আরো গরম হয়ে উঠল। তারপর তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতিতে দাঁড়াতে বেশি দেরি হল না। তখন জনসাধারণের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা যেতে লাগল। জাঁও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু গাইড্ বলল, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, এখুনি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আপনাদের দেশে এই রকম হলে, ষণ্ডা চেহারার চাকারআউট্‌রা গোলমালকারীদের ধরে বের করে দেয়, এ আমি নিজে দেখে এসেছি। আমাদেরো চাকার-আউট্ আছে। ঐ দেখুন!’

বলতে বলতে ভীষণ ষণ্ডা একটা লোক ভেতর থেকে ছুটে এসে, যে-দুজন মারামারি করছিল, তাদের জোববার ঘাড় ধরে, দেখতে দেখতে সামনের দরজা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিয়ে, হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ফিরে এল! পাশ দিয়ে যাবার সময় জাঁ দেখলেন চাকার-আউট্ হলেও, কিঞ্চিৎ তফাৎ আছে। ইনি মহিলা! স্ত্রী-স্বাধীনতা আর কাকে বলে!

খুব ভাব হয়ে গেছিল এই মানুষটির সঙ্গে। নিরামিষ খেতেন। ঝাল না দিলে আমাদের দিশী রান্নাই পছন্দ করতেন।

একবার সঙ্গে ওঁর স্ত্রী লিজেল্ও এসেছিলেন। তাঁকেও ভালো লেগেছিল। তারপর কবে যে তাঁদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল কিছুই মনে নেই। এমনি করে কত অস্থায়ী সম্বন্ধ পাতা হল, আবার আপনি খসে পড়ল। তবু মনে হয় যা দেখা যায়, শোনা যায়, সে চলে গেলেও কিছু রেখে যায়। অর্থাৎ এইভাবে ক্রমে আমার মন তৈরি হতে লাগল।

সন তারিখ বলতে পারব না, বুদ্ধদেব ইতিমধ্যে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ সকলের অজানিতে শুরু করে দিল। সে কাজ বলতে কোনো আশ্চর্য রচনার কথা ভাবছি না। এ তার চেয়েও বড় কাজ। বুদ্ধদেব নানা ভাবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়া পত্তন করে দিয়ে গেছে। আমাকে বহু তরুণ কবি বলেছেন, বুদ্ধদেবের কাছেই তাঁরা প্রথম উৎসাহ এবং সহযোগিতা পেয়েছেন। এঁদের জন্যেই হয়তো লোকসান দিয়েও বুদ্ধদেব বহু কাল তার কবিতা পত্রিকা চালিয়েছিল। ক্রমে সেই সব অখ্যাত কবিরা পাঠকদের কাছে পরিচিত ও প্রিয় হয়ে উঠলেন। ‘এক পয়সায় একটি’-র কথাও মনে পড়ে, সাল মনে নেই। হলদে হাতে তৈরি কাগজের মলাটের মধ্যেখানে পরিপাটি করে ছাপানো যোলটি কবিতা। দাম চার আনা, সেকালের ষোল পয়সা। আমাকে দিয়েও দুটি বড়দের গল্প লিখিয়ে ঐভাবে ছেপেছিল। গল্প দুটির নাম ‘মন্দাকিনীর প্রেম’ আর ‘বিপাশা’। আমি সর্বদাই বলি আমার লেখক হয়ে ওঠার মূলে আমার বন্ধু বুদ্ধদেবের হাতও আছে। কত জায়গায় সে আমার শিশুসাহিত্য সাধনা, আমার বাংলা ভাষা বিষয়ে সহানুভূতিশীল মন্তব্য করেছে, এ সব কথা ভুলবার নয়। এখন সে আমার আগেই চলে গেছে। এখন কেবলি মনে হয় এ কথাটা তাকে বলা হল না, সে কথাটা তাকে বলা হল না। তার সঙ্গে কখনো সে রকম অন্তরঙ্গতা হয়নি, দুজনার রুচি ও স্বভাব আলাদা, কিন্তু সাহিত্য জগতে তার মতো বন্ধুও কম পেয়েছি। আমি যখন বেশ দেরি করে লিখতে শুরু করলাম, তার আগেই আমার প্রথম গুরুদের অনেকেই চলে গেছেন। উপেন্দ্র কিশোর যখন যান, আমার ৭ বছর বয়স। সুকুমার যখন যান তখন ১৫। কিন্তু এঁরাই যে আমার পথনির্দেশ করে দিয়েছিলেন?

সে কথা আর কেউ না বুঝলেও আমি তো জানি। তবু কাজ করতে গিয়ে আরো বন্ধুর দরকার হয়। অন্ততঃ আমার হয়। যাদের কাছে মনের কথা বলা যায়, যাদের প্রকৃত মতামত শোনা যায়। ছোটবেলা থেকেই এমন বন্ধু অনেক পেয়েছিলাম। কারণ আমার ভাই-বোনরা ছিল বেজায় বুদ্ধিমান ও স্পষ্টবক্তা। শুধু প্রশংসা পাওয়াতে খুব সাহায্য হয় না। বরং তার উল্টো। আমাদের বন্ধু অধ্যাপক নীরেন রায় একটা বিষয়ে খুব তৎপর ছিলেন। আমার কোনো প্রবন্ধ বা গল্প প্রকাশিত হলে—হয়তো পাছে আমার বেশি আত্মপ্রসাদ গজায় তাই—খুব কড়া ভঙ্গিতে ভাব ও ভাষার তিক্ত সমালোচনা করতেন। আবার বলতেন, এসব শুধু আমার মত নয়, আমার মা-ও এ-কথা বলেন এবং আরো বহু বিদ্বান-বুদ্ধিমান যাঁরা আমার মতো স্পষ্টবক্তা নন। তবে এইটুকু বলে দিলাম লিন্ ইউটাং-এর মতো লিখতে না পারলে আমি আপনাকে লেখকই বলি না। এতে হতাশ হবার কোনো কারণও দেখতাম না। তাছাড়া মনে মনে জানতাম বড়দের জন্য লেখা। আমার বিলাস, ছোটদের জন্য লেখা আমার জীবন। অবিশ্যি গোটা কতক মোক্ষম মোক্ষম প্রবন্ধ লেখার শখ আমার তখনো ছিল, এখনো আছে। কতখানি হয়ে উঠবে তা জানি না।

অন্যরকম সমালোচকও ছিল। শিশুসাহিত্যিক রবীন্দ্রলাল রায় আমার চেয়ে বছর ২-৩-এর বড়। এখন যাকে সকলে শিশু চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ বলে জানে, সেই ডাঃ ননীগোপাল মজুমদার এই রকম আরো কিছু। রবির সব লেখার আমি প্রথম সমালোচক। দুঃখের বিষয় আমার সব লেখা ওর বড্ড বেশি ভালো লাগত। তবে অজস্র লেখার সামগ্রী জোগাত। বুদ্ধিমান, উদার, কিঞ্চিৎ বাতিকগ্রস্ত। ননীগোপালের কথা আলাদা। আমার চেয়ে বছর তিন-চারের ছোট, আমার ছোট ভাইদের বন্ধু। ওর বাবা ছিলেন বালিগঞ্জ গবর্ণমেন্ট স্কুলের অধ্যম এবং খুব কড়া। তার ফলে ননীগোপাল খুব একটা খ্যাপাটে হয়ে উঠবার সুযোগ পায়নি। সরস, কল্পনাপ্রবণ, ওদিকে ঘোড়ার রাশ শক্ত হাতে ধরা। ও যে দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প লিখবে তাতে আশ্চর্য কি? ওর প্রথম বই ‘রত্ননেশা’ তার প্রমাণ। আরো অনেক ভালো বই লিখেছে। অনেক দিন ধরে শিশু সাহিত্য পরিষদের পরিচালনার একটা দায়িত্বপূর্ণ অংশ বহন করছে, শিশু-স্বাস্থ্যের বিশেষ পত্রিকার সম্পাদনা করে।

আমাদের আজীবনের বন্ধু ননীগোপালের রোজ-রোজ আমাদের বাড়িতে এসে সাহিত্যালোচনা করাকে কিন্তু নিষ্কাম সাহিত্য প্রেম মনে করলে ভুল হবে, এই রকম আমার একটা সন্দেহ আছে। আসল ব্যাপার হল যে আমার ননদ ওর প্রতি একটু বেশি মাত্রায় স্নেহাসক্ত থাকায়, রোজ যা কিছু বড়ি-বড়া-পায়েস-পিঠে তৈরি করতেন, তার একটা বড় অংশ ননীর জন্য গোপনে তুলে রাখতেন। সে সব খাদ্যদ্রব্য কোন কালে পরিপক্ক হয়ে ননীগোপালের চুলগুলোকে এই ঊনসত্তর বছর বয়স অবধি কুচকুচে কালো এবং শরীরের বয়স দশ বছর কম করে রাখলেও ওর ঐ পিঠে প্রবণতার পৈষ্টুকতার ফলটাতে শিশুসাহিত্য উপকৃত হয়েছে এতে সন্দেহ নেই।

এদিকে আস্তে আস্তে শরীর থেকে অপারেশনের দুর্বলতা দূর হয়ে যেতে লাগল। এপ্রিল মাসে দার্জিলিং-এ একটি ফ্ল্যাট নিয়ে আড়াই মাসে অনেকের মতে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবতী হয়ে ফিরে এসেই কাজে লেগে গেলাম। রবীন্দ্রলাল ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য নামে একজনকে ধরে নিয়ে এল। হাসি-খুশি, মাথায় খুব লম্বা নয়, কোথাও অধ্যাপনা করে; বয়সে আমার চেয়ে এক বছরের ছোট; বিজ্ঞান নিয়ে অনেক পড়াশুনো করেছে; তার চেয়েও বড় কথা ‘রামধনু’ পত্রিকার সম্পাদক এবং সবচেয়ে বড় কথা ওদের একটি প্রকাশনালয় আছে, যেখান থেকে আমার একটি ছোটদের গল্পসংগ্রহ প্রকাশ করা যেতে পারে। মনে আছে, এ-কথা শুনেই আমি গলে জল। সন্দেশে দু-চারটে অন্য কাগজে আমার নিজের আঁকা অপটু কিন্তু সরস ছবিসহ কটি গল্প বেরিয়েছিল, তাই দিয়ে ছোটখাটো একটি বই করা হবে ঠিক হল। তার মলাট আঁকবেন একজন অল্পখ্যাত শিল্পী, ক্ষিতীনেরি সমবয়সী। তাঁর নাম শৈল চক্রবর্তী। ব্যস্ কথাবার্তা হয়ে গেল, এর বেশি কিছুর দরকার আছে কারো মনে হল না। কিছুকাল পরে সত্যি-সত্যি বই বেরুল। ক্ষিতীন আমাকে পঁচিশ কপি দিয়ে গেল। গোলাপী মলাট, মলাটের ওপর পণ্ডিতমশাই সেই সাংঘাতিক পান খাচ্ছেন, যার প্রভাবে একটু পরেই বাঁদর বনে যাবেন। বইয়ের নাম ‘বদ্যিনাথের বড়ি’। মলাট দেখে আমার নিজেরই গা শির-শির করতে লাগল। শৈলও এখন আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।

সে যাই হোক। বইয়ের কোনো বিজ্ঞাপন বা সমালোচনা বেরুল না। অখ্যাত লেখক, অখ্যাত শিল্পী, অপরিণত প্রকাশক, যতদূর মনে হয় দাম ছিল আট আনা। আমি কিছু টাকাকড়ি পাইনি। ক্ষিতীনেরো এক পয়সা লাভ হয়েছিল মনে হয় না। পয়সা না পেলেও, আমার লাভ হয়েছিল, আমার আত্মপ্রত্যয় দশগুণ বেড়ে গেছিল। ঐ পঁচিশটির বেশি বই-ও ক্ষিতীন দেয়নি। মনের আনন্দে যথেচ্ছ বিলিয়ে শেষ কপিটি খুইয়ে দেখতে দেখতে দেউলে হয়ে গেছিলাম। ক্ষিতীন আমাকে ওর প্রেস কপিটি দেবে বলেছে। সেই আশাতে আছি। ক্ষিতীনের বোধহয় মাঝে মাঝে বিবেক দংশন করত।

আমাকে বলত রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটা ভূমিকা লিখিয়ে আনলে বোধ হয় বই বাজারে বিকোবে। গল্পের জন্যে বিকোবে না, ভূমিকার জন্য বিকোবে, কথাটা আমার পছন্দ হয়নি তবু একবার বন্ধু অনিল চন্দের কাছে কথাটা পাড়লাম। সে তখন কবির সেক্রেটারির পদে ছিল। বছরটা ১৯৩৯ যতদূর মনে পড়ে। কবির শরীর ভেঙে পড়েছিল। চোখে ভালো দেখেন না, কানে ভালো শোনেন না, খালি মনের তেজ মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো জ্বলে।

অনিল রেগে গেল। কবির শরীরের এই অবস্থা এই কি ভূমিকা লিখে দেবার সময়? খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। ভূমিকা টুমিকা লেখা হয়নি, বইও বিক্রি হয়নি, লোকে ভুলেও যেতে শুরু করেছিল। খালি আমি নিজে হতাশ হইনি।

অনিল চন্দ—রানী চন্দকে বাদ দিলে চলে না। ওদের আমি বড়ই ভালোবাসি। ভাবি অনিল বেঁচে থাকলে পৃথিবীর যে কোনো টুকুতে আমরা বাস করি, সেটা আরো আনন্দময় হয়ে উঠত। ঐ চার নং রায় স্ট্রীটে বাস করার সময় একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। এখন ভাবলে হাসি পায়। এটা আমার বই ছাপার কিছু আগের ঘটনা হবে। লোকে বলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলালের বিরোধ ছিল। সমর্থনের জন্য পত্রিকায় ছাপা তাঁদের তর্কাতর্কির উল্লেখ করে। কিন্তু যাঁরা ভিতরের কথা জানেন, তাঁরা জানেন যে তর্ক থাকলেই বিরোধ ছিল, এ-কথা প্রমাণ হয় না। তর্ক হল মতের ব্যাপার, বিরোধ মনের। দ্বিজেন্দ্রলাল অকালে মারা যাওয়াতে দুজনের মধ্যে যে প্রীতি ও সৌহার্দ্য থাকতে পারত তা গড়ে ওঠেনি। আমি নিজেও লক্ষ্য করেছিলাম যে দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে কবির মনে একটা বেদনাবোধ ছিল। তাঁর বোধহয় বড় ইচ্ছা ছিল দিলীপের সঙ্গে একটা স্নেহের সম্বন্ধ গড়ে উঠুক। এই নিয়ে দুজনার মধ্যে কিছু চিঠি লেখালেখি হয়ে থাকবে। তবে সেটা আমি যখনকার কথা বলছি তার আগেই ঘটে গেছিল। দিলীপও খুশি হয়ে কবিকে চিঠি লিখেছিলেন, তাঁর মনে কোনো ক্ষোভের কারণ ছিল না এ কথা তিনি নিজে আমাদের বলেছিলেন।

এখন মুস্কিল হল দিলীপের পরম ভক্তরাও তাঁর হস্তলিপির পাঠোদ্ধার করতে কষ্ট পেত। আর বুড়ো কবি তো আরো বেশি। এই বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করে থাকবেন। দিলীপের কানে কথাটা গেলে তিনি ধরে ধরে ভালো করে একটি চিঠি লিখেন, শেষে এই মন্তব্য করেছিলেন, আশাকরি এটি পড়তে কবির আর আয়ুক্ষয় হবে না। নিতান্তই রসের কথা। অন্য কিছু মনে করে তিনি লেখেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আশে পাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এর অন্য মানে করে, অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ফলে প্রীতির সম্পর্কে ব্যাঘাত পড়েছিল। এ ব্যাপারের পরে কিছু দিন কেটে গেছিল। এতক্ষণ যা লিখলাম তা দিলীপের মুখেই শোনা।

সে যাই হোক, দিলীপ কলকাতায় এসেছেন শুনে কবি তাঁকে একখানি চিঠি লিখে, অনিলের হাতে পাঠিয়ে দিলেন। অনিল আমাদের ফোন করে যখন শুনল দিলীপ রোজ সকালে ৮টায় আমাদের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খান, সে বলল সে-ও ঐ সময়ে আসবে। পর দিন দিলীপকে সে-কথা বলাতে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি উঠে চলে গেলেন, অনিল আসার আগেই। অনিল ভারি দুঃখিত হয়ে চিঠিখানি রেখে চলে গেল। পরদিন চিঠি পড়ে কিন্তু দিলীপের মন গলে জল। তারপর কি হয়েছিল তার আমি প্রত্যক্ষদর্শী নই বলে বলতে পারলাম না। অনিলকেও জিজ্ঞাসা করিনি।

১৯৩৯-৪০ থেকে আমার সামাজিক সেবাকর্ম বেড়ে গেল। সে যে কি হাস্যকর ও অন্তঃসারশূন্য ব্যাপার সে আর কি বলব। দেখতে দেখতে বেশ কটা সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। বেশ মজাও লাগত। বহু বছর ধরে কয়েকটার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারিনি, কতকটা জায়গায় আর সত্যি কথা বলতে কি তার চেয়েও বেশি, তাদের সঙ্গে পেরে উঠিনি বলে। সকলেরি উদ্দেশ্য মহৎ এবং হাতে গোনা কয়েকটি বাদে, সকলেরি প্রচেষ্টা বিফল। ছোট একটার কথা বলি। ঐ সময়ের ব্যাপার। ঠিক তারিখ মনে নেই। নাম ধাম যুক্তিযুক্ত কারণে বললাম না। তা এম-এ ক্লাসের ছাত্রীদের থাকার ভালো জায়গা নেই দেখে, কোনো বিশিষ্ট নারী প্রতিষ্ঠান রাসবিহারী এভেনিউয়ের কাছে একটা ভালো ভাড়া বাড়িতে একটি হস্টেল খুললেন। কর্ত্রীপক্ষের একজন আমাকে বললেন পরিচালক সমিতির সদস্যা হতে। খুব উৎসাহ না থাকলেও ‘না’ বলতে পারলাম না।

বেশ হস্টেলটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আধাবয়সী অধ্যক্ষার রূপ ফেটে পড়ছে, ভালো মানুষ চেহারা, দুঃখী ভাব। শুনলাম বড়লোকের মেয়ে, স্বামী বড় চাকরি করতেন, অকালে মারা গেছেন। এ-সব মহিলাদেরি সুযোগ দেওয়া উচিত, এটাই ছিল তার পক্ষে প্রবলতম যুক্তি। থান-পরা, ক্ষীণ চেহারা দেখে প্রথম দিন থেকেই মায়া হচ্ছিল।

মনে হল চমৎকার ব্যবস্থা। জনা চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটি বাসিন্দা, সবাই সাড়ে দশটা-এগারোটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে কলেজ চলে যায়, বিকেল সাড়ে চারটে-পাঁচটায় ফেরে। সমস্ত ব্যাপার সুষ্ঠু, যুক্তিসঙ্গত, স্বাস্থ্যসম্মত নিয়মে চলে। খাওয়া দাওয়ার নিখুঁত এবং মস্ত একটা চার্ট খাবার-ঘরে ঝোলানো থাকে। তাতে সোম থেকে রবি কবে কখন কি রান্না হবে সব লেখা। কারো কিছু বলার নেই। অধ্যক্ষার ব্যক্তিগত স্বার্থ ইত্যাদির কথাই উঠতে পারে না। দ্বিতীয় মিটিং-এ চার্ট নিয়েই হুলুস্থুল ব্যাপার। সমিতির সভানেত্রী আমাকে ফোন করলেন যে একটা গুরুতর পরিস্থিতি সংঘটিত, মিটিং-এ যেন অতি অবশ্য যাই। গিয়ে দেখলাম সদস্যরা সকলে গরম হয়ে আছেন। নাকি এভাবে হস্টেল চালানো যায় না। তার চেয়ে তুলে দেওয়া উচিত। এ হেন উদ্ধত ছাত্রীদের সঙ্গে কোনো ভদ্রলোকের মেয়ে কি করে কারবার করতে পারে ইত্যাদি।

কি ব্যাপার? না বেচারি মিসেস্ চৌধুরীকে ডাকা হোক। তিনি নিজের কানে শুনে যান এ রকম অপমান সম্বন্ধে আমাদের মতামত। এলেন তিনি। কেঁদে কেঁদে দুই চোখ লাল, চুল উস্কোখুস্কো, কথা বলতে ঠোঁট কাঁপছে। বগলে খাদ্য তালিকার চার্ট। আমি তো অবাক! কম্পিত হস্তে চার্টখানি টেবিলের উপর ফেলে চোখে রুমাল দিতেই, সভানেত্রী বললেন, ‘দেখ একবার বাড়াবাড়ি দূরে যেতে পারে। অথচ এরা সব ভদ্রঘরের শিক্ষিত মেয়ে।’

চেয়ে দেখি বুধবার বিকেলের খাদ্য তালিকায় লেখা ছিল, ‘মুড়ি নারকেল।’ সেটি কেউ কলম দিয়ে কেটে পরিপাটি করে পাশে লিখে রেখেছ ‘লুচি ডিমের-ডালনা।’ শুধু তাই নয়, ছাত্রীদের এতদূর অধঃপতন ঘটেছে যে আগে থেকেই বলে রেখেছে মুড়ি-নারিকেল তারা খাবে না। মনে আছে বেজায় মজা লেগেছিল। সভানেত্রী মানুষটির কল্পনা শক্তি না থাকলেও, লোক খুবই ভালো ছিলেন। বাস্তবিক অবাক হয়ে বললেন, এর মানে কি? এ নিশ্চয় শুধু মিসেস্ চৌধুরীকে অপমান করার চেষ্টা। ওরা বি-এ পাস, উনি তা নন্, তাই।’

অপেক্ষাকৃত কমবয়সী আমরা বারবার ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলাম, মোটেই তা নয়। ওদের ঐ সময় সারাদিন ধকলের পর খিদে পায়, তা মুড়ি-নারকেলে বাগ মানানো যায় না। বড়দিদি বললেন, ‘খিদে পায়? ওদের খিদে বুঝি না, আমাদের বাড়িতে রোজ মাংস হয়। এক পোয়া কেনা হয়। আমরা তিন জন বয়স্ক মানুষ খেয়ে চাকরটার জন্যও একটু থাকে। আর এরা বলে যে দিন মাংস হবে মাথা পিছু যেন আধপোয়া ধরা হয়। তার জন্যে যদি দুদিনের বদলে এক দিন মাংস হয়, সে-ও ভালো। এর কোনো মানে হয়?’ কি আর বলি, আমাদের বাড়িতেও মাংস হলে বড়দের মাথা পিছু আধ পোয়া আর ছোটদের তিনজনে এক পোয়া হিসাব ধরা হত। সেকালে পাঁঠার মাংস আট আনায় আর ফার্স্ট ক্লাস্ মটন বারো আনায় এক সের পাওয়া যেত।

অমি সতীর্থদের শান্তিনিকেতনের একটা অবিকল এক রকম গল্প বলে, কিছুদিন পরে সদস্যপদ ত্যাগ করলাম।

শান্তিনিকেতনের গল্পটি আরেকবার বলি। বছরটা ১৯৩১, আমি সবে এম-এ পাস্ করে, বিশ্বভারতীতে ইংরেজির অধ্যাপক হয়ে গেছি। স্কুলে-কলেজে দুটোতেই পড়াই। একদিন সকালে উত্তরায়ণে রবীন্দ্রনাথ অধ্যাপক সভা ডাকলেন। একতলার দক্ষিণ-দিকের বড় ঘরে সভা বসল। রবীন্দ্রনাথ আরাম চেয়ারে বসে, আমরা সকলে নিচে শতরঞ্চির ওপর।

রান্নাঘরের অধ্যক্ষার কিছু গুরুতর নালিশ ছিল। যা শুনে স্বয়ং গুরুদেব বড়ই উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তার আগের দিন বিকেলে খেলাধুলোর পর স্কুল-কলেজের ছেলেরা হাতমুখ ধুয়ে নিয়ম-মাফিক উপাসনায় বসেছিল। উপাসনার পর পড়ার ঘণ্টা পড়তে কয়েক মিনিট দেরি ছিল। সেই অবসরে সদ্য মুখে ভগবানের নাম নিয়ে, একদল দশম শ্রেণী ও ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেরা রান্নাঘরে ঢুকে বামুনঠাকুরদের কোলপাঁজা করে বের করে দিয়ে, উনুনে বসানো ফুটন্ত কড়াই থেকে ৭২টা ডিম চুরি করে সবাই মিলে ভাগ করে খেয়েছিল। ফলে রাতের খাওয়ার ডিমের ডালনার বদলে আলুর ডালনা পরিবেশন হয়েছিল। এই হল সেই গুরুতর অপরাধ।

অবশ্যি কবি বুঝিয়ে বললেন, ডিম খাওয়াটা কিছু বড় অপরাধ নয়। অপরাধ হল কর্তব্যরত পরিজনের ওপর হামলা, অসংযম, অবাধ্যতা। ওর মধ্যে এই সব দোষের পরিচয় পাওয়া যায়। তারপর আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এরা তো কেউ অসভ্য অশিক্ষিত ছেলে নয়, অনেক দিন ধরে আমাদের বিদ্যালয়ের আদর্শে মানুষ হচ্ছে। তাহলে কেন এমন করল?’ দেখলাম তিনি সত্যিই ব্যথিত। আমার যা মনে হল তাই বললাম, ‘ওদের খিদে পেয়েছিল বলে। দুপুর সাড়ে এগারোটায় ভাত খেয়েছিল, সাড়ে চারটায় ছোট এক বাটি শসা আর ফুটি, ব্যাস্ আর কিছু নয়। তারপর খেলাধুলো করেছে, রাতে খেতে দেরি আছে, খুব খিদে পেয়েছিল।’ মনে আছে আমার কথায় রান্নাঘরের অধ্যক্ষা খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কবি চিন্তিত ভাবে বলেছিলেন, ‘তাই যদি হয়, তাহলে তো সবটা ভেবে দেখতে হয়।’ এর ফল কিছু আমি দেখে আসিনি। কিন্তু কিঞ্চিৎ বকাঝকা ছাড়া ছেলেদের কোনো সাজা দেওয়া হয়েছিল বলেও মনে পড়ছে না। বকাঝকাটি অবশ্য ওদের প্রাপ্য ছিল। ন্যায্য অভিযোগের অধিকার থাকলেও তো আর তাদের জোর খাটিয়ে কেড়ে খাবার অধিকার ছিল না।

আজ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে, কলকাতায়, সমস্ত দেশে দেখি ছাত্রদের আর অধ্যক্ষদের—অধ্যাপকদের মধ্যিখানে দুস্তর ব্যবধান। কেউ কারো ন্যায্য যুক্তিতে কানও দেন না। ছাত্ররাও না, গুরুরাও না। এর একমাত্র কারণ মনে হয় কল্পনা শক্তির অভাব। একে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিটা মনে মনে কল্পনা করতেও অপরাগ এবং অনিচ্ছুক। যাক্গে, প্রসঙ্গক্রমে কিছু অবান্তর কথা বলে ফেললাম। তবে ঐ কল্পনা শক্তিই এর একমাত্র ওষুধ।

এমনি করে আমার বিয়ের পর পাঁচ বছর কেটে গেছিল। মনের মধ্যে কত যে আশ্চর্য ঘটনার পুঁজি জমা হয়েছিল সে আর কি বলব। কতক চোখে দেখা, কতক শুধু কানে শোনা।

॥ ৪ ॥

আমার স্বামীর চেয়ে আমার ভাসুর প্রায় বারো বছরের বড় ছিলেন, কিন্তু গল্প জমত আমার সঙ্গে। ব্রাহ্মদের ওপর উনি খুব একটা প্রসন্ন ছিলেন না। হেরম্বচন্দ্র মৈত্র ওঁদের কি রকম আত্মীয় হতেন। তাঁর ব্রাহ্মত্ব আমার ভাসুর বরদাস্ত করতে পারতেন না। নানা রকম সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য সরস গল্প বলে প্রমাণ করতে চাইতেন যে লোকটি পণ্ডিত হলেও অত্যন্ত হাস্যকর রকম সঙ্কীর্ণমনা। মনে মনে একটু চটতাম, তবে সন্দেহ হত সেটাই বোধ হয় ওঁর আসল উদ্দেশ্য। তাই রাগটা চেপে যেতাম। ভারি বুদ্ধিমান ছিলেন। একদিন বললেন, ‘তুমি যে বল ব্রাহ্ম সমাজের কাছে বাঙালী সমাজ অনেকখানি ঋণী—স্ত্রী শিক্ষা, স্ত্রী স্বাধীনতা, কিছু সামাজিক দুর্নীতি দূর করা ইত্যাদির ক্ষেত্রে—বেশ, সবই আমি মেনে নিলাম। তা এখন সে সব চেষ্টা সফল হয়েছে তো? রামমোহন রায় যা যা চেয়েছিলেন এখনকার শিক্ষিত হিন্দু সমাজ তার প্রায় সবই মেনে নিয়েছে তো? শুনে আমি মহা খুশি হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। ভাসুর বললেন, ‘তাহলে ব্রাহ্ম সমাজের টিকে থাকার আর কোনো দরকারই নেই বোঝা যাচ্ছে। এভাবে বাঙালী সমাজকে মিছিমিছি খণ্ডিত করে না রেখে, তুলে দেওয়া হচ্ছে না কেন?’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হইনি। প্রত্যেক রবিবার সকালে এসে সারাদিন আমাদের বাড়িতে কাটিয়ে যেতেন। কত যে সারা জীবনের দুঃখ ব্যর্থতা বিফলতার গল্প করতেন। বুঝতে পারতাম তাতে ওঁর মনটা একটু হাল্কা হত। ৬৮ বছর বয়সে, ১৯৫৫ সালে যখন মারা গেলেন, আমি একজন প্রকৃত বন্ধু হারালাম। আরেকজন অসাধারণ লোকের কথাও বলতে হয়। তাঁর নাম ছিল কেশব হাজারি। জামতাড়ার যে আবাসিক হাই স্কুল থেকে আমার স্বামী ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন, ইনি তার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক। এঁর অসাধারণ অনুপ্রেরণায় বাংলায় কত যে কৃতি-সন্তান তৈরি হয়েছিলেন ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। তাঁদের মধ্যে নামকরা ডাক্তার আছেন—ফণীভূষণ মুখোপাধ্যায়, শচীন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী। আরো অনেকে ছিলেন, যেমন সরস্বতী প্রেসের শ্রীশৈলেন্দ্রনাথ গুহ রায় প্রমুখ। এঁরা সকলে মিলে স্থির করলেন কেশব হাজারির কাছে তাঁর হাতে তৈরি কৃতজ্ঞ ছাত্ররা যে কি গভীর ভাবে ঋণী এই সত্যটাকে রূপ দিতে হবে তাঁকে এক দিন কলকাতায় এনে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

উৎসব অনুষ্ঠিত হল আমাদের বাড়ির বাগানে। শৈলেনবাবু বিনা খরচে সুন্দর স্মারক গ্রন্থ ছেপে দিলেন। তাতে নানান জনের শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় তার কপিটি কোথায় হারিয়ে গেছে। জলযোগ হয়েছিল। সন্ধ্যা অবধি বাড়িতে একটা আনন্দের হাওয়া বইছিল। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল আমি কখনো এমন শিক্ষক পাইনি যিনি আমার ব্যক্তিত্বের ওপর কোনো গভীর ছাপ রেখে গেছেন। ভালো মাস্টারমশাই, ভালো শিক্ষিকা পেয়েছি। কিন্তু গুরু পাইনি। আমার গুরু আমার দাদামশায়ের স্মৃতি আর আমার মা, বাবা, জ্যাঠামশাই ও দাদারা। এ-কথা আমি বারবার বলি। রবীন্দ্রনাথকে ও বিবেকানন্দ স্বামীকে যখন ভালো করে বুঝতে শিখলাম, তখন আমার কৈশোর কবে পার হয়ে গেছে।

কেশব হাজারি শুধু মাস্টারমশাই ছিলেন না, গুরুও ছিলেন। ছেলেদের শুধু ম্যাট্রিক পাশ করাতেন না, তাদের চরিত্রও তৈরি করে দিতেন। বলিষ্ঠ, সৎ, সৎকর্মে ব্ৰতী। তাঁর বিদ্যালয়টির কথা ভাবলে আশ্চর্য হই। সত্তর বছরের বেশি আগে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটার মধ্যে এক ধরনের চির-আধুনিকতা ছিল। এখন পর্যন্ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবার পর দেশে-বিদেশে নানান বড় বড় আবাসিক বিদ্যালয় যে নিয়মে চলে, উনিও সেকালে অনেকটা সেই নিয়মেই স্কুলের পত্তন করেছিলেন। তার মধ্যে একটা স্বাবলম্বী ভাব ছিল। বিরাট অট্টালিকা ফাঁদার পয়সা ছিল না তাঁর। হয়তো অনেকটা সেই কারণেই একটা একটু বড় স্কুলবাড়িতে ক্লাস হত, কিন্তু ছেলেরা থাকত ছোট ছোট আলাদা ভাড়া বাড়িতে। একজন করে মাস্টারমশাই আর দু-একজন বড় ছেলের হেপাজতে প্রত্যেক বাড়ির আলাদা রান্নাঘর এদের যত্নে সুষ্ঠু ভাবে চলত। একেক ক্লাসের ছেলে একেকটা আলাদা বাড়িতে না থেকে, ছোট বড় ছেলেরা মিলেমিশে থাকত। বড়রা ছোটদের দেখাশুনো করতে পারত, যেমন নিজেদের পরিবারে সবাই করে থাকে। যে-সব ছেলেদের অবস্থা ভালো নয়, তাদের কাছ থেকে মাইনে নেওয়া হত না। তার বদলে তারা কিছু কিছু তদারকির কাজ করে দিত। খেলাধুলো ও শরীর গঠনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হত। পড়াশুনোর উপর তো বটেই। কেশব হাজারি নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমস্ত ব্যবস্থা দেখে আসতেন। গরম জায়গা, দুপুরে সবাই যাতে বিশ্রাম করে, শরীর খারাপ হলে যাতে তখুনি ওষুধ পায়; এ-সব দিকে তাঁর চোখ ছিল। ঐ মস্ত প্রতিষ্ঠানকে তিনি বাপের মতো লালন করতেন। তার ফলও পেয়েছিলেন আশাতীত রকমের। অনেক সময় ভাবি মনুষ্যত্বই না থাকে যদি, তাহলে কতকগুলো দক্ষতা-বিদ্যা ইত্যাদি দিয়ে কতটুকুই বা এগোনো যায়। স্কুলটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠে গেল।

আমার আরো অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আনন্দমেলা বলে কলকাতায় একটা সংস্থা ছিল। তাদের কাজই ছিল স্কুলের মেয়েদের মধ্যে খেলাধুলোর প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা ও স্কুলে স্কুলে খেলার অভ্যাসকে উৎসাহ দেওয়া। সুবল মুখুজ্জে বলে একজন রোগা মানুষ ছিলেন এদের কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে উৎসাহী। খেলাধুলো ছিল তাঁর প্রাণ। যদিও নিজে কিছু খেলোয়াড় ছিলেন না এবং সর্বদা পিছনে থেকে কাজ করতে চাইতেন, প্রাধান্য খুঁজতেন না। লোকের উপকার করতে পারলেই মহাখুশি। কার কোথায় তেল দরকার, চাল দরকার, চেঞ্জে যাবে বলে, ভাড়া বাড়ি দরকার কিম্বা সঙ্গী দরকার, বাড়ি বদল করবে বলে ট্রাক দরকার, কার ছেলেকে ফ্রি-তে হাসপাতালে বা স্কুলে ভরতি করতে হবে—সুবলকে বললেই হল। ওর বন্ধু ছিলেন নীহার মুখুজ্জে, চেহারাটি ঠিক উল্টো, অবস্থাও ভালো, কিন্তু ঐ রকম লোক-হিতৈষী। এ-সব মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়াও লাভের বিষয়। বেজায় তর্কাতর্কি করত না যে তা-ও নয়, কিন্তু কাজের বেলা ঠিক ছিল।

ঐ আনন্দমেলায় বহু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, যাদের সঙ্গে দেখাশুনো হবার খুব কম সম্ভাবনা ছিল। সকলের ঐ এক চিন্তা। কি করে আমাদের মেয়েদের শক্ত-পোক্ত করে তোলা যায়। খেলাধুলোর প্রতিযোগিতা যে একেবারেই হত না, তা-ও নয়। সেটা ছিল ব্রিটিশ রাজের যুগ। শিক্ষা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা অনেকেই ছিলেন ইংরেজ। তাঁরাও সহযোগিতা করতেন, কিন্তু তাঁদের উৎসাহের মূল কোথায় সে বিষয়ে আমার খুবই সন্দেহ ছিল। অথচ তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কলকাতার বড় বড় মেয়েদের স্কুলের সহযোগিতা পাবার সম্ভাবনা ছিল না। বিশেষ করে মিশনারি স্কুলগুলোর আর শিক্ষাবিভাগের অধীনের ফিরিঙ্গি স্কুলের। আনন্দমেলার পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য পদে কবে যে বসলাম তা-ও মনে নেই। ঐ সব মিটিং-এ শিক্ষা-বিভাগের আর শরীর-চর্চা বিভাগের মেম পরিচালিকার পৃষ্ঠপোষকসুলভ কৃপাদৃষ্টির কথা মনে করলে এখনো রাগ হয়। সে যাই হোক, তাঁদের দয়ায় মেয়েদের খেলাধুলোর আন্দোলন ক্রমে জোর পেতে লাগল, একথা সত্যি। শেষে কলকাতার প্রায় সব দেশী-বিলিতী স্কুলই প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে লাগল। এবং সত্যি কথাই বলব, ফিরিঙ্গি মেয়েদের সঙ্গে কোনো দিক্ দিয়েই আমাদের মেয়েরা পারত না। দু-চারজন জবরদস্ত মেয়ে হয়তো কায়ক্লেশে তৃতীয় পুরস্কার পেয়ে যেত। তার বেশি নয়। শরীর চর্চার দিক দিয়ে বাঙালী মেয়েদের আজকের কুশলতার কাহিনী কিন্তু প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার ঐ সব ছোটখাটো প্রয়াস থেতে শুরু। শুনে লোকের হাসি পাবে আনন্দমেলার সভাপতি ছিলেন একজন ভারতে বসবাসকারী ইংরেজ। তাঁর নাম ছিল ব্রুস পীক। কলকাতার কোনো বড় বিলিতী কোম্পানিতে ভালো কাজ করতেন। মনে হয় তখন তাঁর ষাটের ওপর বয়স। বাপের আমল থেকে এ দেশে বাস করলেও তিনি ছিলেন খাঁটি ইংরেজ। এবং সেই রকম জোরালো আর ন্যায়-পরায়ণ। তাঁর স্ত্রী ছিলেন ফিরিঙ্গি। এক কালে নার্সিং করতেন যতদূর মনে হয়। তাঁর মতামতগুলোকে অতটা উদার মনে হত না। মেয়েদের খেলাধুলোর প্রগতির জন্য পীক-সাহেবের কাছেও ঋণ স্বীকার করতে হয়। মাঝে মাঝে কর্তৃপক্ষের অন্ধতার বিরুদ্ধে তাঁকে জোর গলায় প্রতিবাদ করতেও শুনেছি। তিনি এখন নেই। তাঁর স্ত্রীও আছেন কি না জানি না। ছেলেরা অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। আমাদের দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে মস্ত একটা কায়েমী ফিরিঙ্গি সমাজের ভিত নড়ে গেছিল। সরকারের স্নেহদৃষ্টি ছাড়া তাদের এখানকার পরিবেশে বাস করা অসম্ভব হল। এখন আমরা যাঁদের ফিরিঙ্গি বলি, তাঁদের অধিকাংশই দেশী খ্রীশ্চান সমাজের সঙ্গে অনেকখানি মিশে গেছেন।

আনন্দমেলার প্রচেষ্টা যদি কলকাতার বড় বড় বাঙালী স্কুলের পরিচালকদের সমর্থন না পেত, তাহলে এত অল্প সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কড়ি পাওয়া আমাদের মেয়েদের সম্ভব হত না। মহিলাদের বহু সমাজসেবার প্রতিষ্ঠান যোগ দেওয়াতে ব্যাপারটা যোগ্য মর্যাদা পেয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে সব দিক দিয়ে উন্নতিও দেখা গেল। সেজন্য সরিষার রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী গণেশানন্দকে মনে করতে হয়। তিনি দেখলেন প্রতি বছর বাঙালী মেয়েরা প্রতিযোগিতায় ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে পারে না, অথচ বলিষ্ঠতায়, উৎসাহে, কর্মকুশলতায় কেউ কম যায় না। এর একমাত্র কারণ হল আমাদের মেয়েদের শৈশব পেরুতে না পেরুতেই শাড়ি-পরিয়ে মাঠে নামানো হয়। খাটো করে কাপড় পরে কোমরে আঁচল জড়িয়েও, হাঁটুর ওপরে স্পোর্টস্স্কার্ট, কি শট্ পরা মেয়েদের সঙ্গে তারা পারবে কেন?

অধিকাংশ স্কুলের শিক্ষিকাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে গণেশানন্দ তাঁর স্কুলের মেয়েদের ছেলেদের মতো শার্ট আর হাফ্-প্যান্ট পরিয়ে ট্রাকে নামিয়ে দিলেন। মনে আছে সে বছর ঐ মেয়েরা অনেকগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করল! তার পরের বছর আর দেখতে হল না। সব বাঙালী স্কুলের মেয়েরা হাফ্ প্যান্ট পরে মাঠে এল এবং তাদের জয়-জয়কার!

অনেক সময় আমাদের ফুল গাছে ঘেরা ঘাসজমিতে আনন্দমেলার কর্মীরা মিটিং করতেন। তাঁদের একটা নীল-সাদা এনামেল করা বিশাল কেৎলি আমাদের ভাঁড়ার ঘরের তাকে ঠাঁই পেল। তাতে ৩২ পেয়ালা চা ধরত। অন্য সময় ৩২টা পেয়ালা তার মধ্যে ভরে রাখা হত। ৩২টা প্লেটে জলখাবার দেওয়া হত। খুব ভালো জলখাবার হত, খুব সস্তা দরে। ভালো দার্জিলিং চা কেনা হত ১১/২ টাকা পাউণ্ডে। কন্‌ডেন্সড্ মিল্ক বোধহয় সাত আনা টিন। চিনিও বোধহয় চার পাঁচ আনা সের!

নীহার মুখুজ্জের কাছে সামগ্রিক চা-তৈরি শিখলাম। আমাদের বড় ডেকচিতে জল ফুটিয়ে কেৎলিতে ঢালা হত। তাতে কন্‌ডেন্সড্ মিল্কের দুটো টিনের মুখ কেটে দুধ ঢালা হত। চিনি কম লাগত, মাপটা ভুলে গেছি। ন্যাকড়ায় বেঁধে এক পেয়ালা চা-পাতা দিয়ে ঢাকা চাপা দিয়ে রাখা হত। মিনিট ৫-৭ বাদে, চায়ের পুঁটলিটা তুলে ফেলতাম। ব্যস্, অতি উপাদেয় চা রেডি! যেদিন বেশি লোক হত, সেদিন ঐ নিয়মেই আরেকবার চা হত। তার আস্বাদ এখনো আমার মধুর স্মৃতিগুলোর সঙ্গে মুখে লেগে রয়েছে।

ঐ ঘাসজমিটুকুতে কত আনন্দের ব্যাপার ঘটেছিল তার ঠিক নেই। ঐখানে ছেলেমেয়ের জন্মদিন করা হয়েছে। জায়গা সাজাবার দরকারই ছিল না। ফুলের গাছে ফলের গাছে ঝলমল করত। ঘাসের ওপর আনন্দমেলার মস্ত শতরঞ্চি পেতে দিলেই হল। ঘরে লুচি আলুরদম চাটনি হত। ন্যাশনাল হোটেল বলে উত্তর কলকাতায় একটা পরীদের যোগ্য হোটেল ছিল, তাদের কাছ থেকে বিশাল বিশাল চপ কেনা হত। দ্বারিকের দোকান থেকে মিষ্টি আসত। ক্ষীরের বরফি, গুজিয়া। মনে হয় যেন সেদিনের কথা। দোতলা থেকে ঊষা মাসিমা ডেকে আমার মেয়ে কমলিকে বলতেন,—‘কে আমার বাগান আলো করে বসে আছে?’ আর কমলি খিলখিল করে হাসত, সে এখনো শুনতে পাই।

আমরা ঐ বাড়িতে থাকতেই রথীন্দ্রনাথের মেয়ে পুপের বিয়ে হল। কমলির প্রায় দু বছর বয়স, আমার শরীর আবার আগের মতো সুস্থ হয়েছে। গেলাম চলে শান্তিনিকেতনে নিশ্চিন্ত মনে। আমি জানতাম আয়াতে আর আমার ননদেতে চমৎকার চালিয়ে নেবেন। বিয়ের দিন সকালের গাড়িতে হাজার হাজার বিয়েবাড়ি-যাত্রীদের সঙ্গে গিয়ে হাজির হলাম। কোন সময় মনে নেই, তবে চমৎকার দিন ছিল মনে আছে। তখনো বোলপুরে রিক্শর চল হয়নি। অনেকে গান গাইতে গাইতে হেঁটেই রওনা দিল। আমাদের বন্ধু অনিল চন্দ মহিলাদের কয়েকজনকে বিশ্বভারতীর গাড়িতে চাপিয়ে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে তুলল। সেখানে সাহেদ সুরাওয়ার্দি, অনিলের দাদা অপূর্বকুমার চন্দ, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি মিলে চাঁদের হাট বসিয়েছিল। অনিল-রানীর মতো অতিথিপরায়ণ মানুষ আর দেখলাম না।

সকাল থেকেই বিয়ের উৎসব লেগে গেছিল। আমি নিজের হাতে নক্সা তুলে সামান্য একটা সুতির জামার কাপড় নিয়ে গেছিলাম। সেটিও দেখলাম যত্ন করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আশ্রমের চেহারা বদলে গেছে। অতিথি আপ্যায়নের ঢালাও ব্যবস্থা। আশ্রমের রান্নাঘরে কুলোবে কেন? এখানে ওখানে বড় বড় তাঁবু পড়েছে। তার নিচে শালপাতার পাতে সারি সারি বসে পদ-মান-নির্বিশেষে সবাই খাওয়াদাওয়া করছে। কি যে ভালো লেগেছিল সে আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না।

সন্ধ্যায় উদয়ন বাড়ির পূবের বারান্দায় রবীন্দ্রনাথ নাতনির বিয়ে দিলেন। বর হল সিন্ধী, অতি ধনী পরিবারের ছেলে। বিয়ে কি মতে হল সে আমি বলতে পারব না। তবে যজ্ঞ হল। যজ্ঞের আগুনে কবির মুখের অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। মানুষ এত সুন্দরও হয়!

দূর-দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জ থেকেও অতিথি এসেছিলেন। সাদা-সিধে বেশবাস, মুখে বেশি কথা নেই। মনে আছে চলচ্চিত্র দেখাবার ব্যবস্থা হয়েছিল। তার মধ্যে ‘গোরা’ ছবিটি দেখেছিলাম। আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু গ্রামের লোকরা হাঁ করে বাইস্কোপ দেখেছিল। তাদের যে কত ভালো লাগছিল সে আর বলে দিতে হবে না।

বিয়ের পরদিন বিকেলের গাড়িতে বাড়ি ফিরে গেলাম। শুনেছি অপূর্ব চন্দ উৎসবের অনেক দৃশ্যের ছবি তাঁর সচল ক্যামেরায় তুলে রেখেছিলেন। সেগুলি এখনো রবীন্দ্র-ভবনে রাখা আছে। কেউ কেউ দেখে এসেছে। আমি দেখিনি। ও-সব ছবি আমার মনের পটেও সচল হয়ে রয়েছে। সেকালের জমিদারি আতিথেয়তার সুন্দর একখানি ছবি। যার মধ্যমণি বর-কন্যা নয়, তাদের মা-বাবাও নয়, প্রায় আশী বছরের পিতামহ। অনেকখানি ঝুঁকে পড়েছেন, কানে কম শোনেন, চোখে কম দেখেন কিন্তু মনের দীপ্তিতে ধ্রুবতারার মতো জ্বলেন।

মনে আছে ফিরবার সময় বিকেলের ট্রেনে শরীরের ক্লান্তির জন্য আচ্ছন্নের মতো একই ভাবে সারা রাস্তা বসে ছিলাম। চার ঘন্টা কেটেছিল চার মিনিটের মতো। কেবলি মনে হচ্ছিল এইখানে একটা যুগের অবসান হয়ে যাচ্ছে। বোধ হয় তাই হচ্ছিলও, লোকে লক্ষ করেনি। এর অল্প দিন পরেই আমরা জিনিসপত্র বাক্সবন্দী করে, নীহার মুখুজ্জের ট্রাকে তারি তদারকিতে চার নং রায় স্ট্রীট ছেড়ে হাজরা রোডের দক্ষিণ মাথায় একটা রোদ-হাওয়া ভরা দোতলার ফ্ল্যাটে উঠে এলাম। এর আগে পর্যন্ত কোনো বাড়ি ছেড়ে আসতে আমার এত কষ্ট হয়নি। ভাবি, বাড়ি আবার কি? যেখানে প্রিয়জন নিয়ে সুখে শান্তিতে বাস করা যায়, সেটাই বাড়ি। তার অসুবিধাগুলো যতটা পারা যায় শুধরিয়ে নিতে হয়। তাহলেই হল। তাছাড়া পরের ছেলেকে ভালোবাসার যেমন অনেক দুঃখ, তেমনি পরের বাড়িকে ভালোবাসারও দুঃখ আছে। তবে কোনো জিনিস অধিকার করতে চাওয়াটার মধ্যেই দুঃখ, ভালোবাসায় দুঃখ নেই। ভালোবাসার জিনিস চিরকালের মতো চলে গেলেও, মনের গভীরে দেখি ভালোবাসাটুকুকে রেখে গেছে, চিরকালের পাথেয় করে।

শেষ পর্যন্ত প্রায় চার বছর পরে বাড়িটাকে যে ছাড়তে হয়েছিল তার একমাত্র কারণ বাড়িটি ভাগের মা, গঙ্গা পেত না। ক্রমে তার জীর্ণ দশা বাড়তে লাগল। অসমান মেঝেতে ফাটল ধরল, দেয়ালের নিচে থেকে একটা ভিজে ভাব উঠে, ওপর থেকে নেমে আসা আরেকটা ভিজে ভাবের সঙ্গে মিলে যাবার চেষ্টা করতে লাগল। সব ঘরে একটা ব্যাঙের ছাতা প্যাটার্ণের গন্ধ পাওয়া যেত। নিভৃত আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতা গজাত পর্যন্ত। দেয়ালে ঝোলানো একটা তালগাছের অপূর্ব ছবিতে ছ্যাৎলা পড়ে একেবারে নষ্ট হয়ে যাওয়াতে আমার যে কি দুঃখ হয়েছিল সে আর কি বলব! ঐ ছবি আমাদের বিয়েতে শিল্পী নিশিকান্ত রায়চৌধুরী দিয়েছিল। জলরঙা ছবি। শান্তিনিকেতনের দৃশ্য। শুকনো লাল মাটিতে পাঁচ-ছয়টি ঘন সবুজ তালগাছ যেন তাদের বলিষ্ঠতার জয়গান গাইছে। নিশিকান্তর চেহারাটি যেমনি অসুন্দর ছিল, শিল্পীমনটি ছিল তেমনি অপূর্ব। গান রচনা করতে, সুর দিতে, কবিতা লিখতে আর ছবি আঁকতে অমন আর কাউকে দেখলাম না। শেষ জীবনটা পণ্ডিচেরীতে কেটেছিল। আমার সমবয়সী, খেতে ভালোবাসত, ভারি রসিক, সব রকম আমোদ প্রমোদে উৎসাহী, নাচে গানে নাটকে। রাঁধত, টোমাটো সস্ বানাত, বিলি করত। শান্তিনিকেতনে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, মনে হয়েছিল ফুর্তির প্রতিমূর্তি। কিন্তু ক্রমে যখন ওর সঙ্গে চেনাজানা হল, তখন মনে হত ওর মনের মধ্যে দুঃখের ঝরণাও আছে, হাসি দিয়ে চাপা দেওয়া। এ-সব কথা কৃত্রিম শোনালেও, ওর বেলায় সত্যি। সাধক-ও ছিল নিশ্চয়, তাই পণ্ডিচেরিতে একটুখানি জায়গা পেয়েছিল। সেখানে অসীম প্রতিভা নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে অকালে মরেও গেল। ওর কথা খুব বেশি লোক জানতেও পারল না। দিলীপ ওকে ভালবাসতেন। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন ‘ওর শরীর ভালো না, আদর-যত্ন দরকার। তোমার কাছে এনে মাস দুই রাখলে পার।’ পারিনি রাখতে। তখন আমার নিজেরি শরীর ভালো না।

এর অনেক বছর পরে, ১৯৪৯ সালে আমার ছেলে ম্যাট্রিক দিল। তারপর ওকে নিয়ে দক্ষিণ ভারত ঘুরে এলাম। সব দেখে ফেরার পথে পণ্ডিচেরিতে দিলীপের বাড়িতে সাত দিন কাটিয়েছিলাম। তখন নিশিকান্তকে আবার দেখলাম। মোটাসোটা শরীর আধখানা হয়ে গেছে, কেমন যেন চাপা হয়ে গেছে, আগেকার সেই উচ্ছল মানুষটিকে খুঁজে পেলাম না। কিন্তু চোখের দীপ্তি অম্লান। আমার জন্য ওর ছবির প্রদর্শনী করল। আমি ওর ছবি ভালবাসতাম বলে। হেসে বলল, ‘এ-সব আমি আশ্রমকে দিয়ে দিয়েছি, তাই তোকে কিছু দিতে পারলাম না।’ ও সমবয়সী সবাইকে তুই-তোকারি করত। আর দেখিনি নিশিকান্তকে। তার কথা মনের মধ্যে জমা করে রেখেছি। ঐসব ছবিগুলোতে একটুও সবুজের ছোঁয়া ছিল না। সব ধূসর, গেরুয়া, ছাই, অপূর্ব সুন্দর, কিন্তু এ-জগতের নয়। তারপর এক দিন সত্যি সত্যি অন্য বাড়িতে সংসার পাতলাম। চেনা আসবাবগুলোকে অচেনা ঘরে সাজালাম। পুরনো পরদা অন্য দরজায় ঝুলোলাম। প্রিয় ছবি নতুন রং করা দেয়ালে শোভা পেতে লাগল।

আমার লেখার কি হল? কি আবার হবে? যখনি কিছু মনে হত, তখনি লিখে ফেলতাম না। মনের মধ্যে জমা করে রাখতাম। কোনো সম্পাদক না চাইলে আজ অবধি কাউকে লেখা দিইনি। প্রকাশকরা আগ্রহ দেখালে তবে বই দিই। আছে এরো ব্যতিক্রম, যেমন আমাদের নিজেদের সন্দেশ এবং দু-একজন প্রিয় প্রকাশক। কারণটা অহংকার নয়, বরং তার উল্টোটি। গোড়ায় ছিল বোধ হয় একটু আত্মপ্রত্যয়ের অভাব। আমার প্রাণের জিনিসটি যদি ‘হয়নি’ বলে ফিরিয়ে দেয়! লেখকরা বড়ই স্পর্শকাতর হয়। আমিও তাই ছিলাম। পরে ওটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল।

আরেকটা কারণও ছিল। বেশি লেখা হয়ে উঠত না। আমার মতো মেয়েরা নানা রকম সাংসারিক দায়িত্বে জড়িয়ে পড়ে। সেগুলোর অযত্ন করলে বিবেক ও দংশন করে, আবার বাড়ির কেউ-ও খুশি হয় না। খানিকটা দায়মুক্ত না হলে মেয়েদের পক্ষে কোনো সৃজনশীল কাজ করার পথে অনেক বাধা। বহু সম্ভাব্য প্রতিভাকে নষ্ট হয়ে যেতে দেখেছি। সব চাইতে দুঃখের কথা হল যাঁরা—মেয়েদের মধ্যে এত কম প্রতিভা দেখা যায়, কেন?—ইত্যাদি বলে আত্মতৃপ্ত আক্ষেপ করেন—তাঁদের সংসারের গিন্নিরাই যদি রান্নাঘরে যথেষ্ট তদারকি না করে ছবি আঁকতে, কি কবিতা লিখতে বসে তাহলে উক্ত মন্তব্যকারীরাই সবচেয়ে বেশি চটেন। এ-সব মেয়েলী দুঃখের কথা কাকে জানাই। তার ওপর আবার রান্নাঘরকে এবং ছেলেমেয়েদের আদর যত্নকে আমি সর্বদা গুরুত্ব দিই। আমার স্বামীর মন উদার এবং যথেষ্ট সহানুভূতিশীল হলেও, ঘরের অযত্ন করে নিজের লেখার যত্ন কোনোদিনই করতে পারিনি। বিবেক দেয়নি।

এই জন্যেই সাধারণত মেয়েদের প্রতিভার পূর্ণ স্ফূরণ হয় একটু দেরিতে। ছেলেমেয়ে অপেক্ষাকৃত বড় হলে পর। সেই সঙ্গে স্বামীর অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি হলে তো কথাই নেই। আজকালকার সাহসী মেয়েরা সংসারের অকুলানো মেটাচ্ছে নিজেরা চাকরি করে। সেই একই মন্তব্যও শুনতে হচ্ছে। সংসারের খানিকটা সুবিধা হলেও, ছেলেমেয়ের অযত্ন হচ্ছে। হচ্ছে বৈ কি। এবং যতদিন না সংসার ব্যবস্থা বদলাবে, তাই হবেও। তবু বলি, নিন্দার ভাগী হয়ে বাণীদেবীর সাধনা করছে এমন মেয়ে এখনো বিরল। সংসারটা বাস্তবিক একটু ইয়ে!

মোট কথা আমার সমবয়সী পুরুষরা ১৯৪০ সালের মধ্যে বেশ নাম করে ফেলেছিলেন আর আমার ঐ একটি বিফল প্রকাশন। বিফলই বা বলি কি করে? এখনো বুঝতে পারি না ঐ সামগ্রী দিয়েই (তারি সঙ্গে একই মানের আরো কিছু জুড়ে দিয়ে) আট বছর পরে যখন সিগনেট্ প্রেস ‘দিন-দুপুরে’ ছেপে বের করলেন, তখন সকলে কেন তাকে বলল সার্থক বই হয়েছে! ঐ একটি বই দিয়েই চিরকালের মতো বাংলা সাহিত্যের বিপদ্সঙ্কুল পাথুরে পথে সেই যে একটুখানি দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে গেলাম, তার থেকে আর নামিনি।

ভাবি কি দিয়ে বই হয়? দিন দুপুরের ছবি এঁকেছিল আমার গুণী ভাইপো সত্যজিৎ। তখনো সে নিতান্ত ছেলেমানুষ। চেহারা দিয়েছিল অতুলনীয় প্রকাশক দিলীপ গুপ্ত। বিক্রি করেছিল সিগ্‌নেট প্রেস্ প্রকাশনালয়। তবে কি বই তৈরির ব্যাপারে পাঠ্যাংশ রচনার চেয়ে বাইরের এই সব জিনিসের গুরুত্ব বেশি? এখন পর্যন্ত ভাবলে মনে মনে ব্যথিত হয়ে উঠি।

অনেকের কাছে হয়তো এ-সব অবান্তর কথা, কিন্তু আমার কাছে নয়। সারা জীবনে ঐ একটি সাধনাই করেছি, বই-পড়া, বই-লেখা, বিশেষ করে ছোটদের বই লেখা, ছোটদের পত্রিকা সম্পাদনা করা, কি করলে ছোটদের বই পত্রিকা আরো ভালো হয়, কি করলে ছোটরা স্কুলপাঠ্যের বাইরে এ-সব বই থেকে সব চেয়ে বেশি আনন্দ ও শিক্ষা পায়—এই সব চিন্তা ছাড়া, বলতে গেলে কাজের কাজ কিছু করিনি। আর সব চিন্তা আমার কাছে গৌণ হয়ে গেছে। কিন্তু জীবনের ৩২-৩৩ বছর কেটে গেছিল নিজেকে তৈরি করতেই, নিজেকে জানতেই।

আগেও বলেছি বাংলায় আমি কাঁচা ছিলাম। বানান বিষয়ে কিঞ্চিৎ অনিশ্চয়তা ছিল, ব্যাকরণের দুর্বলতাহেতু। বুদ্ধদেব একবার বিরক্ত হয়ে কটু মন্তব্য করেছিল। সেই ইস্তক পড়ার টেবিলে, কি ডেস্কের মাথায় সারি সারি ইংরিজি বাংলা অভিধান রাখি। খট্কা লাগলেই দেখে নিই। আজ পর্যন্ত। ইতিমধ্যে (এই শব্দটা আমি এবং আরো হাজার হাজার লেখক নিত্যি ব্যবহার করলেও ব্যাকরণের সমর্থন নেই, এ-কথা কোনো পণ্ডিত আমাকে বলেছিলেন। আসলে ইতোমধ্যে হবে। তবে পছন্দ-অপছন্দ বলেও তো একটা জিনিস আছে!) সে যাই হোক—আমরা কায়েমী হয়ে হাজরা রোডের ফ্ল্যাটে বসেছি।

নিচের তলায় শিল্পী অতুল বসুর শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন। শ্বশুর মশাইটিকে সবাই যোত্দা বলে ডাকে। ভারি সুরসিক। শান্তিনিকেতনে থাকাকালে চারু দত্তের অশেষ স্নেহ পেয়েছিলাম। তিনি অপূর্ব চন্দর শ্বশুর, স্বদেশী আন্দোলনে সহানুভূতির কারণে আই-সি-এস থেকে অবসর নিতে হয়েছিল—এই রকম কানাঘুষো শুনেছিলাম। সুরসিক, সুসাহিত্যিক, চিন্তাশীল আর অসম্ভব আমুদে। শান্তিনিকেতন ছেড়ে এসে অবধি তাঁর জন্য অনেক সময় মন কেমন করত। অবিশ্যি ততদিনে তিনিও চলে এসেছিলেন এবং তাঁর কলকাতার বাড়ি আমাদের এই নতুন পাড়াতেই। তিনি আবার যোত্‌দার পুরনো বন্ধু। যোত্‌দার ভালো নাম বোধ হয় যতীন বসু কি ঐ রকম কিছু। হপ্তায় দু-তিন দিন চারুবাবু যোত্‌দার বাড়িতে সকালের দিকে গল্প করতে আসতেন, আমার ছেলে রঞ্জন এসে খবর দিল। সে-ও যোত্‌দার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। চারুবাবুকে ফিরে পেয়ে কি যে আনন্দ হয়েছিল বলতে পারি না।

তাঁদের কথা শুনে বুদ্ধদেব উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। তাহলে তো ওঁদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য চেনা-জানা লেখকদের একদিন ডাকা উচিত। একদিন মানে একটা রবিবার বিকেলে। বুদ্ধদেব লোক ডাকার সব ভার নিল। আমাকে কিছুই করতে হল না। খাওয়া দাওয়ার কথা বলতে সে বলল, ‘স্রেফ চা আর পান। ব্যস আর কিছু নয়। সবাই গল্প শুনতে আসবে, খেতে নয়।’ তখনো আমি মনের সরলতা হারাইনি। সেই ব্যবস্থাই হল। আমাদের বসবার ঘরে যোত্‌দার সুন্দর মস্ত গালচে পাতা হল। অতিথিরা সবাই এল। ঘর আলো হয়ে গেল। অনেক রসের গল্প-ও হল। তবু একশো বার বলব ঐ আমার বাড়িতে প্রথম সাহিত্যিক সম্মেলন একটা ‘মিজারেব্‌ল ফেলিওর’ হল। তার একমাত্র কারণ ভালো জলখাবারের কোনো আয়োজন করিনি। একে-একে যখন অতিথিরা উঠে যাবার উপক্রম করছে, আমাদের প্রধান অতিথিদের একজন, অর্থাৎ যোত্‌দা উঠে গিয়ে পাঁচ মিনিট বাদে পায়ে ঘুঙুর পরে, হাতে একতারা নিয়ে ফিরে এলেন। যোত্‌দার বেয়ারা বাঁয়া-তবলা এনে হাজির করল। যোত্‌দা বাঈজী নাচ থেকে শুরু করে কি যে না দেখালেন, তার ঠিক নেই। প্রায় ন-টা পর্যন্ত কেউ উঠবার নাম করেনি। কবে চলে গেছেন যোত্‌দা, চারুবাবু, বুদ্ধদেব নিজেও নিতান্ত অকালে—কিন্তু ঐ সন্ধ্যাটি আমার মনে অক্ষয় অমর হয়ে আছে। চিরকালের আনন্দের সামগ্রী।

ও-বাড়ির সব স্মৃতি সমান মধুর নয়। ১৯৪১ সালের বর্ষাকাল। কিছু দিন থেকেই সবাই বলছে, কাগজেও দেখছি, রবীন্দ্রনাথ বড়ই অসুস্থ। কলকাতায় আসছেন অপারেশন করাতে সব কাজ-কর্মের মধ্যে বারেবারে শান্তিনিকেতনের এক বছরের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছিল। আসলে মনটা তৈরি হয়েই ছিল। ছোট ছোট টুকরো স্মৃতি। কোথায় একদিন বসে ছিলেন, কাছে গেলে হেসে মুখ তুলে চেয়েছিলেন। কোন দিন উত্তরায়ণের বারান্দায় ছেলেমেয়েদের শেলির স্কাইলার্ক পড়িয়েছিলেন। উত্তরায়ণের আমবাগানে আম গাছের তলায় কবে চা খাওয়া হয়েছিল। কবে নাটকের মহড়া দিতে দিতে কোন কথা বলেছিলেন। তখন কোনো গুরুত্ব দিইনি, অন্য লোককে বলা ঐ সব কথাকে, আজ তারা অমূল্য হয়ে বারবার আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে লাগল।

আমার স্বামীকে সেদিন বাটানগর হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। এমন সময় জোড়াসাঁকো থেকে কে যেন ফোন্ করল, ‘কবিকে যদি দেখতে চান এখনি আসুন।’ যাই কি করে? গাড়ি তো বাটানগরে। ভাবলাম বিকেলে না হয় যাব। তাছাড়া এখন রোগক্লিষ্ট চেহারা দেখে কি হবে? তাঁর অপরূপ রূপ তো আমার মানসপটেই আঁকা আছে। ভাবলাম যাব না। আরো কিছু পরে আমার বালবন্ধু পূর্ণিমা (যে আমার সঙ্গে ঐ এক বছর শান্তিনিকেতনেও ছিল, সুরেন ঠাকুরের পুত্রবধূ) সে ফোন করল, ‘একবার এসে দেখে যা কি সুন্দর।’ অমনি মনে হল। আর না গিয়ে উপায় নেই! যোত্‌দার বাড়িতে গিয়ে যোত্‌দার স্ত্রী উমামাসিমাকে বললাম, ‘গাড়ি কোথায় পাব?’ তখনি উঠে পড়ে বললেন, ‘সরলাদিদির গাড়ি আছে, ড্রাইভার ওঁর বাড়িতে থাকে। সে গাড়ি পাওয়া যেতে পারে। চল আমার সঙ্গে।’

সরলাদিদি হলেন সরলা মিত্র, শিক্ষা বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে অবসর নিয়েছেন। উমামাসিমার মাসতুতো বোন। বাল বিধবা। খ্রীশ্চান হয়েছিলেন। বিলিতী ডিগ্রি ছিল। শিক্ষিত মেয়েরা চাকরিবাকরি না করলে শিক্ষার অপচয় হয়, এ-কথা তাঁকে বলতে শুনেছিলাম। আমাকে বকতেন। বলতেন ‘তোমার মতো যারা লেখাপড়া শিখে কাজকর্ম করে না, তাদের আমি স্বামীদের ‘কেপ্ট্ উওম্যান’ বলি! তবু আজ এক কথাতেই রাজি। খালি বললেন, ‘কিন্তু তাহলে উমাকে আর আমাকেও নিয়ে যেতে হবে।’

তাই নিয়ে গেলাম। বললাম, আমি নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু সেখানে নিশ্চয় এতক্ষণে হুলস্থূল ব্যাপার আরম্ভ হয়ে গেছে। কাকে ভেতরে যেতে দেবে কাকে দেবে না কে জানে। ওঁরা তাতেই রাজি। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন বেলা বেড়ে গেছে। খবরটা চারদিকে ছড়ায়নি, ভিড় তখনো জমেনি। খালি আত্মীয়স্বজন ভক্ত বন্ধুরা আমাদেরি মতো ছুটে গেছেন, যদি একবার শেষ দেখা দেখতে পান।

মহর্ষি ভবনের যে ঘর আজ তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে সেখানে তিনি শুয়ে ছিলেন। ঘরের দু-দিকের দরজা বন্ধ। সামনের দিকের বারান্দায় কয়েকজন চেনাজানা লোক ছিলেন। কে যেন আমাদের তার পাশের ঘরে বসালেন। সে ঘরের আসবাব বের করে নেওয়া হয়েছিল। ঘর জোড়া শতরঞ্চি পাতা। তার ওপর হয়তো ৫০-৬০ জন মহিলা বসে। সকলের শোকার্ত মুখ, চেনা প্রায় সবাই। শান্তিনিকেতনের আর কলকাতার আত্মীয় বন্ধু। তাঁদের মধ্যে সুন্দরী রাণু মুখোপাধ্যায়কেও দেখলাম। চোখের নিচে গভীর কালি। কবি তাঁকে কত ভালবাসতেন। কারো মুখে কথা নেই।

সরলাদিদি আর উমামাসিমা চুপ করে বসে রইলেন। এরই মধ্যে কে যেন আমাকে ডেকে নিয়ে গেল, ‘যদি শেষ দেখা দেখতে চাও তো এসো।’ দিকের বারান্দা দিয়ে পাশের ঘরে গেলাম। ঘরের মধ্যিখানে লম্বা নিচু একটা খাটে রবীন্দ্রনাথ শুয়ে। চোখ বোঁজা, মুখে গভীর শান্তি, বেদনার কোনো চিহ্ন নেই, প্রাণেরও কোনো সাড়া নেই, শ্বেত-পাথরে খোদাই করা মূর্তি যেন। খালি বুকটা উঠছে পড়ছে। পাশে নিচু টুলে বসা ডাক্তারের এক হাতে অক্সিজেনের টিউব, অন্য হাত তাঁর নাড়ির ওপর।

আমি পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম, কি সুন্দর, কি শান্ত। হঠাৎ ডাক্তার অক্সিজেনের নল নামিয়ে রেখে, নাড়ি থেকে হাত তুলে, দু-হাতে নিজের মুখ ঢাকলেন। চেয়ে দেখি বুকটা আর উঠছে-পড়ছে না। তিনি চলে গেছেন।

কেউ ঘরের দু দিকের দরজাগুলো খুলে দিল। আমি তখুনি এ-ঘরে চলে এসে উমামাসিমাকে বললাম, ‘তিনি নেই। ভিড় হবার আগে দরজা দিয়ে একবার মুখখানি দেখে আসুন। এর পর গাড়ি চলাচল কষ্টকর হবে।’ তাঁরা উঠে পড়লেন। তার অল্প পরেই আমরা নিচে নেমে দেখি ভেতরে যাবার লোহার গ্রিল্ টেনে দেওয়া হচ্ছে, নইলে ভিড় ঠেকানো যাবে না। নিঃশব্দে চলে এসেছিলাম। তারপর কৌতূহলী জনতা যে বেদনাময় ভূমিকা নিয়েছিল, তার কিছুই দেখতে হয়নি বলে আমি কৃতজ্ঞ।

এমনি করে একটা যুগের অবসান হয়েছিল। এবার যাঁরা দেশের চিন্তার হাল ধরলেন, তাঁরা প্রায় সবাই রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারার উত্তরাধিকারী, তাই যুগপরিবর্তনটা এত স্বাভাবিক ও সহজভাবে হয়েছিল যে বোঝাই যায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *