॥ ৫ ॥
১৯১৪ সাল, ছয় বছর বয়স। পড়ি কিণ্ডারগার্টেনে; ইংরিজি, অঙ্ক, ছবি আঁকা, নেচার স্টাডি আর রঙীন রেশমী সুতো দিয়ে কার্ডবোর্ডে আঁকা ছবি সেলাই, হলদে কেট্লি, গোলাপী টিকটিকি, এইসব। ভয়ানক ভালো লাগত। আস্তে আস্তে স্কুল অভ্যাস হয়ে গেল, সকাল নটা থেকে বেলা তিনটে, মধ্যিখানে বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা টিপিনের ছুটি, তখন ক্লাসে বসে থাকা বারণ। পড়ার নিয়ম ভালোই বলতে হবে। দিদিকে আমাকে আলাদা বসিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে ইংরিজিতে রপ্ত করে দিল। বছর শেষে হবার আগেই আমরা গড়গড় করে ইংরিজি বলতাম। বছরের শেষে আমাদের একটা ক্লাস্ ডিঙিয়ে স্ট্যাণ্ডার্ড ওয়ানে তুলে দিল। তখন আর আলদা বসানো নয়।
ততদিনে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব জুটেছিল। আরো কটি বাঙ্গালী মেয়ে জুটেছিল, প্রায় সবাই আমাদের চেনা। দশ বছরের নিচে ছেলেরাও পড়ত, বোর্ডিং-এও থাকত। তারা প্রায় সবাই খুব ভালো ছিল। মেয়েগুলোর মধ্যে কেউ কেউ আমাদের নেটিভ্, নিগার বলত, ব্ল্যাকি বলত। টিচারদের মধ্যেও কেউ কেউ নিগার না বললেও, ভারি অসম্মানজনক ব্যবহার করতেন। রাগে আমার গা জ্বলে যেত। মাকে জিজ্ঞাসা করলে বললেন, “নেটিভ তো খারাপ কথা নয়। নেটিভ মানে এই দেশে যাদের জন্ম।” মানেটা ভালো হতে পারে, কিন্তু ঘৃণাটা চিনতে একটুও দেরি লাগত না। খানিকটা হিংসার ব্যাপার ছিল এর মধ্যে, কারণ বাঙ্গালী মেয়েরাই সব ক্লাসে প্রথম স্থান, দ্বিতীয় স্থান নিত।
আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম পাকা মেমরা ভালো আর আমাদের ঘৃণা করে যত ফিরিঙ্গী টিচাররা। ঐটুকু বয়সে এই নিয়ে আমার মনে যে কত তিক্ততা জমে ছিল, এখন ভাবলে নিজেরি আশ্চর্য লাগে। আমিও ফিরিঙ্গীদের কম ঘেন্না করতাম না। ভারি লোভী ছিল ওরা। কারো কাছে কোনো ভালো জিনিস রিবন, ক্লিপ, পুঁতির মালা, পেনসিল, যাই হক না, দেখলেই বলত, “দাও, দাও, আমাকে দাও। যীশুর কাছে একটা পাপ স্বীকার করে, আমাকে ওটা দিলেই তোমার পাপ ক্ষমা হয়ে যাবে। যীশু বড় দয়ালু।” তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু যীশু দয়ালু বলে তোকে আমার জিনিস দেব কেন, সেইটে বুঝতে পারতাম না। তাছাড়া সেরকম পাপটাপের কথা মনেও পড়ত না। বাবা পাপের জায়গা রাখলে তবে তো, কিছু করলাম কি না করলাম, এক চড়ে ভূত ভাগিয়ে দিতেন। মেয়েগুলো জিনিস আদায় করতে না পারলে চটে গিয়ে আমাদের টুপি, বই, শ্লেট লুকিয়ে রেখে দিত। তখন আমার বেজায় কান্না পেত। ঐ একটা শিক্ষা হয়ে গেছিল, লোককে ঘৃণা করা। আবার বেজায় ভালো সব ছেলে-মেয়েও ছিল। একদিন মিছিমিছি ড্রইং ক্লাসে বকুনি খেয়েছি, কিছুতেই কাঁদব না, গলার ভিতরে ব্যথা করছে। এমন সময় ওলাম সিং নামের একজন ছেলে, সে নাকি খাসিয়া রাজার ছেলে, আমার হাতে ছোট্ট একটা পেতলের ক্রুশ গুঁজে দিয়ে বলল, “তোমার রবারটা দিয়ে এই দাগটা একটু মুছছি, কেমন?” ওর দিকে চেয়েই বুঝলাম আমার জন্য ওর দুঃখ হয়েছে বলে ক্রুশটা দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, দুজনার মধ্যে কেউ খ্রীশ্চান ছিলাম না।
খ্রীশ্চান না হলেও বেজায় যীশু-ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম দিদি আর আমি। রোমান ক্যাথলিকরা ধর্ম জিনিসটাকে রূপ-রস দিয়ে এমন সুন্দর করে ঘিরে রাখে যে ভক্ত না হয়ে উপায় ছিল না। ফিরিঙ্গী মেয়েরা গলায় চওড়া নীল রিবনে সেন্টদের নাম লেখা দস্তার মেডেল, পেতলের ক্রুশ ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখত। আমাদেরো বড্ড ইচ্ছা করত, কিন্তু বাড়িতে যে ওসব চলবে না, সেটা ভালো করেই জানতাম। চমৎকার সব সোনালী পাড় দেওয়া ছবি রাখত মেয়েরা, ওদের প্রেয়ারবুকের পাতায় পাতায়। আমি আর প্রেয়ারবুক কোথায় পাব, একটা বিস্কুটের টিনে অনেক ছবি জমিয়েছিলাম। কি সুন্দর যীশুর মায়ের মুখ, তাঁর দুঃখে আমাদের বুক ফেটে যেত। কত যে চমৎকার সব গল্প বলতেন নান্রা, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ভগবানের জন্য কত বেদনা সয়েছিলেন সেন্টরা, কিন্তু মা মেরীর মতো কেউ নয়। আজ পর্যন্ত যীশুর প্রেমের মন্ত্রের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। মাদার মার্গারিটা একদিন বাইবেল থেকে বলেছিলেন, “চাইলেই, লাভ করবে। খুঁজলেই, পাবে। দরজায় ঘা দিলেই দরজা খুলে যাবে।” কি যে ভাল লেগেছিল। কথাগুলো বলতে পারি না। তার ওপর স্কুলবাড়ি আর বোর্ডিং-এর মধ্যিখানে। কতকগুলি ঘর ছিল তাতে নান্রা থাকতেন। তারি পাশে ছিল চ্যাপেল, প্রার্থনার ঘর। সেখানে খ্রীশ্চান অ-খ্রীশ্চানের অবাধ গতি। সে যে কি চমৎকার জায়গা সে আর কি বলব। মেঝের ওপর পুরু গালচে, চারদিকে সুন্দর সব মূর্তি, ছাদ থেকে ঝাড়বাতি ঝুলছে, বেদীর ওপর সোনালী-রূপোলী সব সামগ্রী, যেদিকে চোখ ফেরানো যায় কেবলি যীশুর মুখ। মায়ের কোলে ছোট্ট যীশু, পণ্ডিত সমাজে কিশোর যীশু, শেষ রাতে শিষ্যদের নিয়ে টেবিলে বসে আছেন যীশু আর সব চাইতে বেদনাময় কাঁটার মুকুট পরে ক্রুশ কাঁধে যীশু, তারপর ক্রুশবিদ্ধ যীশু। কি যেন একটা সুগভীর ভাবে আকণ্ঠ ভরে যেত। ছোট বড় ফুলদানিতে ফুলের গোছা, ধূপ-ধুনোর গন্ধ। নান্দের দীক্ষার দিনে তাঁদের জন্য প্রার্থনা হত, আমরা ফুল নিয়ে যেতাম, তাঁদের দেবার জন্য। বলতেন, “যাও, চ্যাপেলে গিয়ে দিয়ে এসো, তবেই সব চাইতে ভালো হবে।” চ্যাপেলের দরজা বন্ধ থাকত, কিন্তু ঠেললেই নিঃশব্দে খুলে যেত। একজন নান্ অমনি এগিয়ে আসতেন, তাঁর হাতে ফুল দিতাম, তিনি আমাদের কপালে এক ফোঁটা জর্দান নদীর জল ছুঁয়ে দিতেন। মন ভরে যেত।
মাঘোৎসবের সময় ব্রাহ্মদের শুধু ফুল দিয়ে সাজানো ন্যাড়া মন্দিরটাতে আকর্ষণীয় কিছু পেতাম না। কলকাতি-পাড়ায় দুর্গাপুজোর সময় ঠাকুরকে ঘিরে ঢাক-ঢোল পেটানোর মধ্যে রঙ-রস থাকলেও, চ্যাপেলের সেই নিবিড় শান্তির লেশমাত্র পেতাম না। অথচ যীশুকে ঈশ্বরের পুত্র বলে মন মানত না। আজ পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্ম আমার মনে স্থান পায় না। শুধু মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের গানের সেই কথাগুলি মনে হয়, “এসো আমার ঘরে এসো, এসো আমার ঘরে, বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে।” আমাদের ক্লাসের দেয়ালে একটা মস্ত রঙীন ছবি ঝোলানো ছিল। ছোট্ট একটা ছেলে পুকুরের জলের ওপর বড্ড বেশি ঝুঁকছে আর তার পিছনে দাঁড়িয়ে তার গার্ডিয়ান এঞ্জেল তাকে ধরবার জন্য তৈরি হয়ে আছে। নান্রা বলতেন সক্কলের একজন করে গার্ডিয়ান এঞ্জেল থাকে, তাকে বাঁচাবার জন্য, সৎপথে রাখার জন্য। ভাবতাম তাহলে গার্জিয়ান এঞ্জেলরা সবাই নিশ্চয় সমান দক্ষ নয়। এইভাবে সে বছরটা শেষ হয়ে ১৯১৫ সাল শুরু হয়ে গেল। বাড়িতে মা-মাসির মুখে মাঝেমাঝে শুনতাম ইউরোপে যুদ্ধ হচ্ছে। আমাদের নতুন আয়া ইল্বন প্রায়ই বলত, “আমার ভাই ফ্রাং-এ গেছে লড়াই করতে, আমার ছেলে হেড্রিক্সনের বাপ ফ্রাং-এ গেছে, এখন আর তার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।” আমাদের গায়ে লাগত, এ যুদ্ধ রামায়ণ-মহাভারতের যুদ্ধের মতো অনেক দূরের জিনিস। তারপর একদিন স্কুলের পাশে বড় গির্জাতে যুদ্ধে যারা প্রাণ দিচ্ছে তাদের জন্য উপাসনা হল। যুদ্ধটা যেন একটু কাছে সরে এল। আজকাল আমাদের সেলাই ক্লাসে উলবোনা শেখানো হত। শুনলাম সোল্জারদের জন্য গলা-বন্ধ বোনা হবে, ফ্রান্সে লড়াই হচ্ছে, সেখানে বড্ড শীত।
আরো শুনলাম মেমরা, অর্থাৎ আমাদের ফিরিঙ্গী সহপাঠিনীরা বুনবে সায়েব সোলজারদের জন্য, স্কুল থেকে তাদের খাঁকি উল্ দেওয়া হল। মাদার হায়াসিন্থ্ নিজে ফরাসী মেয়ে, তিনি আমাদের সেলাই শেখাতেন, এমন চমৎকার সেলাইয়ের হাত কম দেখেছি। তিনি বলতেন, “তোমরা ইণ্ডিয়ান সোল্জারদের জন্য বুনবে। বাড়ি থেকে উল্ কিনে নিয়ে এসো।” বাবা তখন ট্যুরে, যামিনীদা উল কিনে এনে দিল। সে আমাদের রান্নার লোক হলেও, বাবা-মার পরেই তার প্রাধান্য ছিল। আমাদের দেশের গ্রামেই বাড়ি, হয়তো ঠাকুমা ওকে দিয়েছিলেন। অন্ততঃ হাবভাব দেখে তাই মনে হত। যামিনীদাকে খাঁকি উলের নমুনা দেওয়া সত্ত্বেও, গাঢ় লাল উল্ এনে দিল। এবং বদলে আনতে অস্বীকার করল। ভয়ে ভয়ে মাদার হায়াসিন্থকে উল্ দেখালাম। তিনি বললেন, “ঠিক আছে। সব রঙ-ই সমান গরম।” তাই বোনা হল, সাদা কালো মেমের মেয়েরা বুনল সায়েবদের জন্য খাঁকি গলাবন্ধ আর আমরা বুনলাম আমাদের দেশভাইদের জন্য লাল, নীল, হলদে, সবুজ, যার যেমন ইচ্ছে, কিম্বা যামিনীদাদের যেমন ইচ্ছে। এই ব্যাপারে অনেকদিন পর্যন্ত মনে একটা খট্কা থেকে গেছিল। বলেছি তো যা দেখা যায়, শোনা যায়, ভাবা যায়, সব মিশে একেকটা মানুষ তৈরি হয়। তবু যুদ্ধটা দূরেই থেকে গেল। দূরেই থেকে গেল, যতদিন না মিস্ লেভেন্স এসে আমাদের সেলাইয়ের ক্লাস নিতে আরম্ভ করলেন। এই মানুষটিকে কিছুতেই ভুলতে পারি না। বয়স হয়তো বছর কুড়ি, অদ্ভুত ফ্যাকাশে রঙ, ফিকে সোনালী চুল, তাতে এতটুকু জেল্লা নেই, পালকের মতো পাতলা শরীর, চোখ দেখে মনে হত সর্বদা জলে ভরে আছে। ক্লাসের বেকুফ্ মেয়েগুলো বলল, “বেল্জিয়াম থেকে এসেছে। জর্মানরা ওর চোখের সামনে ওর বাপ ভাইদের মেরে ফেলেছে, বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিচ্ছু নেই ওর। রেড্ ক্রসের লোকরা ওকে পাঠিয়েছে। ওর কাপড়চোপড়গুলো পর্যন্ত অন্য লোকে দয়া করে কিনে দিয়েছে।”
আমরা শুনে স্তম্ভিত! ঐ মানুষটিকে মেয়েগুলো এমনি জ্বালাত যে কতবার সে কেঁদে ক্লাস ছেড়ে চলে গেছিল। শেষে একদিন শুনলাম সে চলে গেছে। মেয়েগুলোর কি হাসি! “টিকতে পারলে তো থাকবে!!” আবার মাদার হায়াসিন্থ ক্লাস নিতে লাগলেন। এর মধ্যে বুড়ি মাদার জোসেফ্ মারা গেলেন। স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আমরা ফুল নিয়ে চ্যাপেলে গিয়ে দেখলাম, চমৎকার একটা কাঠের বাক্সে, সুন্দর বিছানায় মাদার জোসেফ চোখ বুজে শুয়ে আছেন। মাথার কাছে, পায়ের কাছে, প্রকাণ্ড সব মোমবাতি জ্বলছে। মনে হল মৃত্যু তাহলে এমনি। সুন্দর! কিন্তু যুদ্ধে যারা মরে, তাদের কি হয়?
আসলে দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছিলাম। ছোটদের জন্য যত বাংলা বই বেরুত, সব বোধ হয় আমাদের বাড়িতে আসত। যোগীন সরকারের শিশুপাঠ্য গ্রন্থাবলী, ছোটজ্যাঠামশায়ের নতুন নতুন অনুবাদের বই। গল্পে ঠাসা হয়ে থাকত জীবনটা। আমাদের খাসিয়া আয়ারা বিকট দুঃখের সব গল্প বলত, তাতে মজার কথা একটাও থাকত না। বেশির ভাগই হিংস্র জন্তু, শত্রু, ভূতপ্রেতের অত্যাচারের গল্প। অসহায় মানুষের ওপর অবুঝ দেবতার প্রকোপ। ভীষণ খারাপ লাগত, কিন্তু খারাপ লাগার চাইতেও সে গল্পের মোহিনী শক্তিটা বেশি ছিল। মাসিমাও জন্তুজানোয়ারের বিষয় বলতেন। আপিস্ ফেরত আমাদের বাড়িতে এক আধ ঘণ্টা বসে পাতানো মামারা, কাকারা নানা রকম গল্প বলে যেতেন। এমনি করে জুল ভার্নের অনেক গল্প শুনেছিলাম। স্কুলের বইগুলিও সংখ্যায় কম হলেও, সুন্দর সুন্দর গল্প কবিতায় ভরা ছিল। শেষটা আর থাকতে না পেরে ছোট্ট একটা খাতা বানিয়ে ইংরিজিতে জন্তুজানোয়ারের গল্প লিখতে শুরু করে দিলাম। আর ভাইবোনদের বানিয়ে বানিয়ে অজস্র গল্প বলতে লাগলাম। দেখলাম গল্পের কি আশ্চর্য ক্ষমতা। আমার শ্রোতারা গল্প শুনবার লোভে আমি যা বলতাম তাই করত। একমাত্র দাদা মাঝেমাঝে খুঁৎ ধরত, বাকিরা আমি যা বলতাম হাঁ করে শুনত। সামালোচনা করার কথা ওদের মনেও হত না। বেপরোয়াভাবে সত্যি, মিথ্যা, খানিকটা শোনা কথা বদলে, একটার পর একটা গল্প বলতাম। বাজে গল্প সব, এখন তার কিছুই ভালো করে মনেও করতে পারি না। তবু এইটুকু জানলাম যে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে মানুষকে বশ করা যায়। বাকিরা আমার অন্ধ ভক্ত, শুধু দাদাই মাঝে মাঝে জ্ঞান দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, গল্পের খুঁটি নাড়িয়ে দিত। তাসের বাড়ির মতো গল্প ভেঙে পড়ত। সুখের বিষয় আমার কাঁচা শ্রোতারা সব সময় সেটা টের পেত না।
এর মধ্যে একদিন একটা গোলাপী টেলিগ্রাম এল। মা সেটি হাতে নিয়ে এতক্ষণ পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইলেন যে আমরা কেঁদেকেটে একাকার। জ্যাঠামশাই নাকি মারা গেছেন। জ্যাঠামশাই মানে আমার মেজ-জ্যাঠামশাই উপেন্দ্রকিশোর। মা বললেন, “আমার মা যখন মারা গেলেন, বাবা সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেলেন, তখন আমার তিন বছর বয়স। পাশের বাড়িতে থাকতেন তোদের জ্যাঠামশাই, জ্যেঠিমা আর তাঁদের একটি মেয়ে, সুখলতা। তাঁরা আমাকে নিয়ে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছিলেন। দাদাবাবুর মুখে আমি ভালোবাসার কথা ছাড়া কখনো কিছু শুনিনি। পরে নিজের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমার বাবাও বেঁচে নেই।”
মার মুখে এইরকম সাংঘাতিক কথা শুনে আমাদের গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেছিল। মা না থাকলেও মানুষ বাঁচে, তা জানতাম না। মা বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই বাঁচে, ভগবান বাঁচান। বাঁচাবার জন্য লোক পাঠিয়ে দেন। তোদের ছোট-মাসিকে শিবনাথ শাস্ত্রী নিয়ে গিয়ে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছিলেন। সে এগারো বছর বয়স পর্যন্ত জানতও না ওঁরা ওর নিজের মা-বাবা নন্। আমাকে দাদাবাবু নিয়ে গেলেন। খালি তোদের বড়মাসিকে কেউ নিল না। সে সারা জীবন বোর্ডিং-এ মানুষ হল। তার খরচপত্র দিতেন আমার বাবার শিষ্য প্রফুল্ল ঠাকুর। দাদাবাবু আমার বাবার মতো ছিলেন।” কাঁদেননি মা। পাথরের মতো হয়ে গেছিলেন। ভালো করে মনে পড়ে না, তবে আমার ধারণা, সেই সময় বড়মাসি কাছে থাকতে মা মনে জোর পেয়েছিলেন। ছোটবেলায় যখন কাছাকাছি থেকেছি, বড়মাসিকে ঠিক বুঝিনি। কিন্তু যতই আমার বয়স বেড়েছে, ততই তাঁর সঙ্গে সহানুভূতি হয়েছে। সেদিন থেকে দাদামশাই সম্বন্ধে অশেষ কৌতূহল জন্মেছিল। বড়মাসিমা বলেছিলেন, “ছোটবেলায় বাবার ওপর বেজায় রাগ ছিল। ছোট ছোট তিনটি মেয়ের যেই না মা মরে গেল, অমনি তাদের বিলিয়ে দিয়ে দিব্যি ভগবানকে খুঁজতে চলে গেলেন! ভাবতাম এরকম লোকরা ভগবানকে পায় না। কারো কাছে একটু আদর পাইনি সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে। শাস্তি পেয়েছি ঢের। বেজায় ঢ্যাঙা হয়ে গেছিলাম শেষ পর্যন্ত। কিছুতেই বেগুন খাব না। অথচ বোর্ডিং-এর নিয়ম সব খেতে হবে। বারবার বললাম, ও আমাকে দিও না, ওর বদলে আমি কিচ্ছু চাই না, শুধু ওটি দিও না!” লাবণ্যদিদি ছিলেন বোর্ডিং-এর কর্ত্রী। ইনি ছিলেন স্যার জগদীশ বসুর বোন। তিনি বললেন, “না, খেতেই হবে, অবাধ্য হলে চলবে না।” দিল আমার পাতে, দেবামাত্র তুলে মাটিতে ফেলে দিলাম। শাস্তি হল সাত দিন নুনভাত। সাতদিন দুবেলা নুনভাত খেলাম। তারপর আবার আমার পাতে বেগুন দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে আবার তুলে মাটিতে ফেলে, লাবণ্যদিদির মুখের দিকে চাইলাম। আশ্চর্য হয়ে একটু চেয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “থাক, ওকে মাছ দাও।’ এমনি লড়াই করে করে বড় হয়েছি বলে কাউকে আদর করতে জানি না।” কথাটা ঠিক নয়। আদর করতে জানতেন বৈ কি, কিন্তু সেটাকে বাইরে দেখাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমরাও ছোটমাসির গলা জড়িয়ে ঝুলতাম, মন্না বলে ডাকতাম, কিন্তু বড়মাসিমাকে কখনো আদর করেছি বলে মনে পড়ে না। এখন বড় খেদ হয়। ১৯৫২ সালে আমার মা মারা যান ৬৭ বছর বয়সে, বড়মাসিমা গেলেন তার পরের বছর, ৭০ বছর বয়সে। শোকে ক্লিষ্ট, সঙ্গীহীনা। একেকটা মানুষ বোধহয় কষ্ট পেতেই জন্মায়, কিন্তু বড়মাসিমার মুখে কোনো দুর্বলতার চিহ্ন দেখা যেত না। কেমন একটা প্রসন্ন গম্ভীরতা, দেখে লোকের শ্রদ্ধা হত। কখনো কারো নিন্দা করতেন না, গুণগ্রাহী, সত্যিকার ইন্টেলেক্চুয়েল । কিন্তু সে দিকটাও প্রকাশ পেত না।
বুড়ো বয়সে আমাকে বলেছিলেন, “একবার বোর্ডিং থেকে বলল, ‘তোমার বাবাকে লেখ তোমার জন্য কম্বল পাঠাতে । সব জিনিস কি অন্য লোকে দেবে নাকি? তাতে আমার আঁতে ঘা লেগেছিল, বাবাকে খুব রাগ আর দুঃখ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। বাবা খুব দামী কম্বল পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কোনো শিষ্যের উপহার।’ সেই শিষ্যই কম্বল দিয়ে যাবার সময় বলেছিলেন, ‘তোমার চিঠি পেয়ে স্বামীজি কেঁদেছিলেন।’ তখন কিছু মনে হয়নি। এখন ভেবে বুক ফেটে যায়। এত বোকা ছিলাম যে এ-ও জানতাম না ডাক এলে আর থাকা যায় না।” সবাই তাঁকে বলত রামানন্দ ভারতী । বিধিমত নিজের শ্রাদ্ধ করে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। নাম ছিল রামকুমার ভট্টাচার্য। পণ্ডিত মানুষ ছিলেন, বিদ্যারত্নমশাই বলে লোকে জানত। মাইকেলের শেষ বয়সে, চন্দননগরে যে কজন পণ্ডিতকে রেখেছিলেন, দাদামশাই তাঁদের একজন ছিলেন, এ খবর সম্প্রতি আমি শ্রদ্ধেয় শ্রীরাধারমণ মিত্র মশায়ের কাছে শুনেছি। মাইকেলের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছিল, অথচ সুরাপান ছাড়ছিলেন না। বন্ধুবান্ধবরা দাদামশাইকে বলেছিলেন, “ওঁকে বুঝিয়ে বলুন। আপনাকে ভালোবাসেন, হয়তো আপনার কথা শুনবেন।” বলেওছিলেন দাদামশাই। মাইকেল নাকি মুখ গম্ভীর করে বলেছিলেন, “আপনাকে যতই ভালোবাসি না কেন, পণ্ডিতমশাই, ও-কথা বললে আপনার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবে।” সকলেই জানেন যে মাইকেল আর সেরে ওঠেননি।
কাশীতে আশ্রম ছিল দাদামশায়ের । কালীভক্ত ছিলেন, তন্ত্রসাধনা করতেন। কোতরঙের অচলানন্দের জামাই, কিন্তু পরে তাঁর সঙ্গে মুখ দেখাদেখি ছিল না। কারণ দাদামশাই কিছুদিনের জন্য ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করে, প্রচারকার্য করতেন । রাগে দুঃখে অচলানন্দ মেয়েকে আটকে রেখেছিলেন। বন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রীকে নিয়ে একটা থার্ড ক্লাস্ ঠিকে গাড়ি করে, দাদামশাই স্ত্রীকে উদ্ধার করে এনেছিলেন। মায়ের কাছে শুনেছি কিছু দূরে ঠিকে গাড়ি ও শিবনাথকে দাঁড় করিয়ে রেখে, দাদামশাই বাড়ির খিড়কি-পুকুরের ধারে গেলেন। দিদিমার সতেরো বছর বয়স, পরমাসুন্দরী। পুকুর ঘাট আলো করে বাসন মাজছিলেন। ওঁদের বাড়িতে রান্না-খাওয়ার জিনিস চাকর-বাকর ছুঁত না । দাদামশাই গিয়ে বললেন, “যাবে। আমার সঙ্গে? তোমাকে নিতে এসেছি।” দিদিমা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই এঁটো কাপড়ে যাব?” দাদামশাই বললেন “আমি ও-সব মানি না।” ব্যস্, আর ভাবনা কিসের? দিদিমা হাত ধুয়ে ঠিকা গাড়িতে গিয়ে বসলেন। বাসন পড়ে রইল । আমার মনে হয় শিবনাথকে ওপরে গাড়োয়ানের পাশে বসতে হয়েছিল। গেলেন তো গেলেন দিদিমা, আর কখনো বাপের বাড়ির লোকদের চোখে দেখলেন না। এর নয় বছর পরে ঠোঁটের ওপর ব্রণ বিষিয়ে, তিনটি মেয়ে রেখে, দিদিমা ২৬ বছর বয়সে মারা গেলেন। মায়ের কাছে শুনেছি দাদামশাই কাছে ছিলেন না। মেদিনীপুরে বন্যা হয়েছিল, স্বেচ্ছাসেবীর দল নিয়ে সেখানে গেছিলেন। সেবার দিদিমা কেন জানি আপত্তি করেছিলেন, রাগ করে বলেছিলেন, “যাচ্ছ, যাও । ফিরে এসে আমার মরা মুখ দেখবে।” তাও বোধহয় দেখতে পাননি দাদামশাই। অচলানন্দ তবু মেয়েকে ক্ষমা করেননি। দাদামশাই সন্ন্যাস নিলে, অনাথা মেয়ে তিনটিকে আনবার জন্য দিদিমার মা নাকি কেঁদে আকুল হতেন; তবু তাঁর মন গলেনি। আমরা এসব দুঃখের কাহিনী শুনে রেগে বলতাম, “কেন বল ভগবান দয়ালু । দয়ালু হলে এসব হতে দিতেন না।” মায়ের মনে অপরিসীম ভক্তি। কেবলি বলতেন, “ওরে সব অবলম্বন খসে গেলে তিনি নিজে এসে ভার নেন।”
বড় হয়ে দাদামশাইকে আমার বড় ভালো লাগত; বড় নিজের, বড় আপনার বলে মনে হত । তাঁর একটা পুরনো ফটো ছিল মায়ের কাছে, ফিকে, বিবর্ণ। সন্ন্যাসীর বেশে পুজোয় বসেছেন। সেটি দেখে আমি ক্রেয়ন দিয়ে বড় করে এঁকে মাকে দিয়েছিলাম । আমার তখন ১৫ বছর বয়স। জানতাম যে আমি জন্মাবার আট বছর আগে পিঠে কারবাঙ্ক্ল্ হয়ে কাশীতে তিনি দেহ রেখেছিলেন । সন্ন্যাসীদের পোড়াবার নিয়ম নেই আমাদের দেশে, তাই তাঁর দেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন তাঁর ৬২ বছর বয়স। তবু মনে হত তাঁকে খুব কাছে পাচ্ছি । ঐ রকম সময়ই তাঁর শিষ্যরা তাঁর একখানি জীবনী প্রকাশ করেছিলেন, সেটি পড়ে অনেক ছোটখাটো তথ্য আর তাঁর হিমালয় ভ্রমণের কথা, পায়ে হেঁটে মানসসরোবর যাবার কথা জেনেছিলাম। তবু সবখানি পাইনি। সেকালে বিদ্যাসাগর মশায়ের দৌহিত্র সুরেশ সমাজপতি ‘সাহিত্য’ বলে একটি পত্রিকা সম্পাদন করতেন। তাতে ‘হিমারণ্য’ নাম দিয়ে দাদামশাই তাঁর মানসসরোবর ভ্রমণের কথা লিখেছিলেন। সে বড় অপূর্ব কাহিনী । দুঃখ এই যে শিষ্যরা কয়েক অধ্যায়মাত্র উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। অনেক পরে কালিদাস নাগ মহাশয় আমাকে বলেছিলেন উনিশ শতকের একেবারে শেষ বছরে, কি তার এক-আধ বছর পরের ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সংখ্যাগুলি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে কিম্বা চৈতন্য লাইব্রেরিতে থাকলেও থাকতে পারে। এই আমার একটা আর্ষঋণ থেকে গেছে, যার জন্য একটা কিছু করতেই হবে। দাদামশায়ের জীবনীর একটিমাত্র কপি আমার কাছে আছে। সেটিরও সামান্য সংশোধন ও সংযোজন করে পুনঃপ্রকাশ হওয়া উচিত। আশ্চর্য আধুনিক দাদামশায়ের চিন্তাধারা আর বাচনভঙ্গী । এতকাল আগের রচনা সহজে বিশ্বাস হয় না।
আসতেন মাঝে মাঝে আমার জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে মাকে দেখতে । উপেন্দ্রকিশোরের ছোট ছেলে, সুবিমল, আমার নানকুদার কাছে শুনেছি, এসে তিনি মাটিতে বসতেন আর আমার মা তাঁর পাশে বসে পাখার হাওয়া করতেন আর শাড়ির আঁচল দিয়ে তাঁর গায়ের ঘাম মুছিয়ে দিতেন। নানকুদা মাকে বেজায় ভালোবাসত, মান্তু বলে ডাকত। তার কেবলি ভয় হত বুড়ো যদি মান্তুকে ধরে নিয়ে যায় ! মান্তু নিশ্চয়ই চলে যাবে ! যাতে যেতে না পারে, তাই নানকুদা তার মান্তুর শাড়ির একটা কোণা আঙুলে জড়িয়ে রাখত।
॥ ৬ ॥
১৯১৫ সালে জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর একটা কারণ শুনেছিলাম যে যুদ্ধের জন্য বিলেত থেকে ওষুধপত্র আসা বন্ধ হয়েছিল। দেশে তখন বিশেষ ওষুধপত্র তৈরি হত না । আর শুধু ওষুধ কেন সাবান, এসেন্স, ক্রীমও খুব কমই তৈরি হত। তাই পিসেমশাই যখন এইচ্ বোস, পারফিউমার বলে প্রসাধনী জিনিস, পানের মশলা ইত্যাদির কারখানা ও দোকান খুলেছিলেন লোকে ধন্য ধন্য করেছিল। মাথার তেল কুন্তলীনের কি সুখ্যাতি । অতকাল আগেও পিসেমশাই বিজ্ঞাপন দেবার গুরুত্ব বুঝতেন । কুন্তলীন পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ছোট গল্পের প্রতিযোগিতা। সব চাইতে ভালো গল্পগুলি খুদে এক বই হয়ে বেরুত। বইয়ের নাম-ও ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ । যতদূর জানি দুটি মাত্র নিয়ম ছিল : গল্প মৌলিক হওয়া চাই আর কোথাও না কোথাও কুন্তলীন বা দেলখোসের উল্লেখ থাকা চাই। আরেকটু বড় হয়েই পড়তে শুরু করেছিলাম বইটাকে। বেজায় ভালো লাগত। কিন্তু যুদ্ধের জন্য প্রসাধনী ব্যবসার সুবিধা হলেও, জ্যাঠামশায়ের অমূল্য জীবন ৫২ বছর বয়সে শেষ হয়ে গেল।
পরে শুনেছিলাম তাঁর মৃত্যু বড় সুন্দর । কোনো ক্ষোভ অভিযোগ ছিল না ; শান্ত প্রসন্নভাবে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। তাঁর লেখা একটি গান আছে… “হাত ধরে তুমি নিয়ে চল, সখা, আমি তো পথ চিনি না…।” তবে আর ভাবনা কিসের? মৃত্যুর দিন ভোরে একটা ছোট্ট পাখি এসে ঘরের জানলায় বসে ডাকছিল । মনে হচ্ছিল বলছে, “পথ পা ! পথ পা !” জ্যাঠামশাই জ্যাঠাইমাকে বলেছিলেন, “ঐ শোন, আমার ডাক এসেছে!” তারপর স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, সোনার সংসার, কত আশা নিয়ে কত কষ্টে গড়ে তোলা ‘ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্স’, সব ফেলে রেখে দিব্যি নিশ্চিন্ত মনে স্বর্গে চলে গেলেন। আমার বড়দা, সুকুমারের বয়স তখন ২৮ বছর।
শিলং-এ আমরা ছোটরা এ-সবের কিছুই বুঝতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে কি, ব্যক্তিগতভাবে জ্যাঠামশায়ের অভাব আমাদের স্পর্শ করেনি। আমাদের জীবন যেমন চলছিল তেমনি চলতে লাগল । শুধু মায়ের মুখখানিকে বড়ই ম্লান দেখাত। বোধ হয় কলকাতায় এসে সকলের সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করত । কিন্তু ছয়টি ছেলেমেয়ে নিয়ে সে তো চাট্টিখানি কথা নয়। বলতেন, ‘ঐ আমি সত্যিকার বাপকে হারিয়ে ছিলাম। নিজের মা-বাপের কাছ-ছাড়া হলাম যখন তখনো জ্ঞানচক্ষু ফোটেনি।’ নিজের মায়ের কথা মার মনে পড়ত না, খালি মনে হত একটা বন্ধ দরজা ওপর থেকে শিকলি তোলা। তার বাইরে মা আর বড়-মাসিমা দাঁড়িয়ে আর বড় মাসিমা মাকে বলছেন, “ঐ ঘরে মা আছে। ওরা আমাদের মার কাছে যেতে দিচ্ছে না !” লাফিয়ে লাফিয়ে কেবলি শিকলি খোলার চেষ্টা করে, কেঁদে মাকে বলছেন, “ওরে তুই কাঁদছিস না কেন? তুই ছোট, তুই কাঁদলে ওরা নিশ্চয়ই দরজা খুলে দেবে ! আমি যে বড় হয়ে গেছি।” বড়-মাসিমার বয়স তখন পাঁচ বছর। এখন ভাবি ঐ মা-মাসির মেয়ে হয়ে সারা জীবন ছোটদের জন্য বই লেখা ছাড়া আমার উপায় কি ছিল?
আমাদের কাছে জ্যাঠামশাই ছিলেন একটা সুন্দর ছবির মতো। এই বই দেখছেন, এই বেহালা বাজাচ্ছেন, এই ঈজেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকছেন। চমৎকার তেল-রঙের ছবিও আঁকতেন, প্রাকৃতিক দৃশ্যেরি বেশির ভাগ । আমার কাছে তাঁর আঁকা উশ্রী নদীর ছোট একটি তেল-রঙের ছবি আছে। তার সঙ্গে কত কথা জড়িয়ে আছে। বিয়ে হয়ে মা বাবার সঙ্গে দেরাদুন চলে যাচ্ছেন। জ্যাঠামশাই একাধারে বর-কর্তা, কন্যা-কর্তা। বিদায় দেবার সময় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কি দেব তোমায়?” মা বলেছিলেন, “ছোট একখানি ছবি । বড় হলে নিয়ে যেতে অসুবিধা হবে।” এই সেই ছবি।
ছবির মতো হলেও, দিনে দিনে বুঝতে পারি আমার মন তাঁর হাতেই গড়া হয়েছিল। তাঁর পুরনো লেখা পড়তে গিয়ে কত সময় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। দেখেছি যে-ভাষাকে আমি নিতান্ত আমার নিজের মৌলিক ভাষা বলে অনেক দিন ভেবে এসেছি, তাও জ্যাঠামশায়ের দেওয়া। তিনি যাকে ভালো বলেছেন, আমারো তাকে ভালো লাগে। তিনি যাতে মজা পেয়েছেন, আমিও পাই ।
এদিকে প্রথম মহাযুদ্ধ তখনো চলেছিল। ১৯১৫ সালের শেষে স্কুলের পুরস্কার বিতরণের দিন আমাদের সকলকে ছবির বই, খেলনা, পুতুল না দিয়ে, বড় বড় কার্ড দেওয়া হল। তাতে ইউরোপের ম্যাপ আঁকা। ম্যাপের মধ্যিখানে ইউনিয়ন জ্যাক্ কাঁধে নিয়ে একজন স্কুলের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুনলাম আমাদের পুরস্কারের টাকা সোল্জারদের সাহায্যে গেছে। বড়রা কেউ কেউ বললেন, “নেটিভ সোল্জারদের সাহায্যে নয়” নিশ্চয়ই মনের মধ্যে খচ্ করে লেগেছিল। তাই যদি সত্যি হয়? এর মধ্যে এক সময় বাবা বলে বসলেন, “যুদ্ধে যাব।” আমরা তো রোমাঞ্চিত ! আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে বাবার বিপত্তির কথা একবারো মনে হল না, বাবা খাকি পোশাক পরে বন্দুক ঘাড়ে লড়াই করতে যাবেন ভেবেও আমাদের সে কি উত্তেজনা। বন্দুক বাবার একটা ছিলই। বেঘো বনে কাজ করতে হত, বন্দুক ছাড়া চলবে কেন? সেটাকে বাবা মাঝে-মাঝে তেল দিয়ে, ন্যাকড়া দিয়ে পরিষ্কারও করতেন। তুলে দেখেছি বেজায় ভারি। এখন বাঘ না মেরে বন্দুক তুলে বাবা গুডুম-গুডুম করে দুষ্টু জার্মান মারবেন ভেবেও গা শির-শির করে উঠত। প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন বাবা। আপিসের ছোট সায়েবরা দুজন চলেও গেল। তবু বাবাকে নিল না। বাবার রাগ দেখে কে! ঐ সায়েবগুলো কুঁড়ে, মদ খায়, কোনো কাজ জানে না, ওদের নিল আর বাবাকে বাদ দিল । কই দাঁড়াক তো ওরা বাবার পাশে খেলার মাঠে, বন্দুক তাগ্ করুক তো বাবার মতো, দেখা যাক্ তো কার শরীর বেশি শক্ত।
বলা বাহুল্য হম্বিতম্বি করে কোনো ফল হল না। বড় সায়েব ডেকে বললেন, “আমিও তো যাচ্ছি না। আমাদের হল গিয়ে এসেন্শিয়েল সার্ভিস। ম্যাপ তৈরিও যুদ্ধের কাজে লাগে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে একদিন এ দিকেও আসবে না, কে বলেছে?” তবু বাবা বাড়িতে গজ্ গজ্ করতেন। আমরা শুনতাম। কাজে খুব সুনাম ছিল বাবার। আগে রায় সাহেব, পরে রায় বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন। তাই নিয়ে ভারি লজ্জিত ছিলেন ; কেউ খেতাবটা লিখলে বা বললে বেজায় চটে যেতেন। কোনো বড়-সায়েবের বাড়ি যেতেন না, ভেট পাঠাতেন না। স্রেফ ভালো কাজ করে অবসর নেবার কয়েক বছর আগে ইম্পিরিয়েল সার্ভিসে উন্নতিলাভ করেছিলেন। খোশামোদ দেখতে পারতেন না, কিন্তু এক দিক দিয়ে ইংরেজদের ভারি ভক্ত ছিলেন। বলতেন, “ওরা পরিশ্রমী, ওরা সময়-নিষ্ঠ, ওরা কথা দিলে কথা রাখে, ওরা আমাদের চাইতে সৎ !” আমার কথাগুলো খুব ভালো না লাগলেও, বুঝতাম ওর মধ্যে অনেকখানি সত্যি আছে । এ-সব অনেক পরের কথা। ১৯১৫ সালে এ-সবের ধার ধারতাম না। ছোটবেলার কথা বলা বড় শক্ত, কারণ তার কতখানি বাস্তব আর কতখানি মন-গড়া, কিম্বা বড়দের মুখে শোনা, তা বলা শক্ত। আমার তো আরো বড় হবার পরের ঘটনা সম্বন্ধেও কিছু অনিশ্চয়তা আছে। যদিও আমার স্মরণ-শক্তি বেশ তীক্ষ্ণ, তবু সাল তারিখ গুলিয়ে যায়, ঘটনার পারম্পর্য ঠিক থাকে না, লোকের নাম ভুলে যাই, উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে চাপাই আর সব চাইতে বড় অসুবিধা হল যে যে-কথা আমি শুধু নিজের মনে ভেবেছি, অনেক দিন পরে তাকেই সত্যি বলে মনে হয়। কোনো ডাইরি রাখিনি কখনো, নিজের কল্পনার পায়ে বেড়ি পরাবার কোনো চেষ্টাই করিনি। আমার পাথেয় শুধু আমার স্মৃতিশক্তি আর আমার সততা। কত ছবি পর্যন্ত এখন দরকারের সময় খুঁজে পাচ্ছি না। তখন অত ছবি তোলার রেওয়াজও ছিল না। ছোট প্রফুল্ল কাকাবাবুর একখানি ছবি থাকলে বেশ হত। নাম ছিল বোধ হয় প্রফুল্লচন্দ্র সেন।
এঁকে বাবাদের আপিসের বড় প্রফুল্ল কাকাবাবুর সঙ্গে ভুল করলে চলবে না। ইনি বোধ হয় সেক্রেটেরিয়াটে কাজ করতেন, বয়স নিশ্চয় খুব কম ছিল। ছোট-খাটো পাতলা মানুষটি, ধব্ধবে ফরসা রঙ। বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের বাড়িতে আসতেন মাঝে-মাঝে। আমরা অমনি ছুটে গিয়ে তাঁর কোলে-পিঠে চড়ে, পকেটে হাত পুরে দিয়ে, নানা রকম মজার কথা লেখা পেপার-মিন্ট লজেঞ্চুষ বের করতাম। তাই দেখে বড় মাসিমা শক্ড্ ! আমার সাত বছরের জন্মদিনের আগের দিন এসেছেন, আমিও অভ্যাসমতো ময়লা পায়ে কাকাবাবুর কোলে চড়ে বসে, পকেটে হাত পুরেছি। এই বড় একটা পেপারমিন্ট পেলাম। তাতে লেখা ছিল ‘চ্যাটারবক্স’ ! সকলের কি হাসি ! এমন সময় মাসিমা বললেন, “ও কি ! ময়লা পায়ে কাকাবাবুর কোলে উঠেছ, দেখ ওঁর কাপড়-চোপড় ময়লা হয়ে যাচ্ছে !” তাকিয়ে দেখি, ওমা, সত্যি তো ! আমার পায়ের ধুলো ওঁর কালো প্যান্টে লেগে গেছে। ভারি লজ্জা পেলাম । কি করব ভবে না পেয়ে, দুহাতে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম, “কাল আমার জন্মদিন, তুমি বিকেলে নেমন্তন্ন খেতে এসো !”
কাকাবাবু চলে গেলে বড়রা সবাই মিলে আমাকে সে কি বকুনি ! “তুমি ভালো করেই জান বড়দের বলা হচ্ছে না, তবু কেন ওঁকে নেমন্তন্ন করলে?” কেন করলাম সেটা কেউ বুঝছে না দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। ওঁর গায়ে ধূলো লাগিয়েছি, তবু নেমন্তন্ন করব না? সে আবার কি ! যাই হক, প্রফুল্লকাকাবাবু খুশি হয়ে চলে গেলেন। তার পর দিন আপিস থেকে ফেরার পথে নিশ্চয়ই জামাতুল্লার দোকান থেকে আমার জন্য চমৎকার একটা পেয়ালা-পিরিচ কিনে নিয়ে এলেন : এমন সুন্দর জিনিস তার আগে কেউ আমাকে কখনো দেয়নি। চারকোণা মতো আকার, সোনালী পাড় দেওয়া, নীলেতে, গোলাপীতে সোনালীতে ফুলের তোড়া আঁকা। এমন কি ভিতরেও এক গোছা ফুল এমন জায়গায় আঁকা ছিল যে হাতল ধরে চুমুক দিয়ে দুধ খাবার সময়, একটু আড়চোখে চাইলেই আমি ফুলগুলোকে দেখতে পেতাম। মনটা ভরে যেত।
কালামানিকেরো ছবি রাখা উচিত ছিল। কালামানিক বাবার টাট্টুঘোড়া, বাবার সঙ্গে বনে বনে ঘুরত। কুচকুচে কালো রঙ, কপালে একটা সাদা রুহিতনের মতো দাগ । কি যে ভালোবাসতাম ওকে । “আমাদের দূর থেকে দেখতে পেলেই নাক দিয়ে ফড়র-ফড়র শব্দ করে ডাকত। দানা দেবার দেরি হলে যে চিঁহি করে ডাকত, এ ডাক তার থেকে একেবারে আলাদা। বাবা মাঝে মাঝে কুমড়ো-পাতায় করে ওকে করকচ নুন খাওয়াতেন। বলতেন ওটা ওদের দরকার। কুমড়োপাতাটাও ও খেয়ে ফেলত। আমাদের বড্ড ইচ্ছা করত একদিন আমরাও খাওয়াই। হঠাৎ সেই সুযোগ পাওয়া গেল। দৈবাৎ আস্তাবলের দরজা খোলা পেয়ে কল্যাণ এক মুঠো করচক নুন সরাল। তারপর যখন কেউ দেখছে না, ওর হাতের লেখার খাতার পাতায় করে কালামানিককে নুন খাওয়ালাম । কি খুশি সে ! কিন্তু নুন খাওয়া হয়ে গেলে পর কিছুতেই কাগজটাকে ছাড়ল না। বড় বড় চারকোণা দাঁত বের করতে লাগল। শেষটা কাগজটাও চিবিয়ে গিলে ফেলল। বুঝলাম কাজটা ভালো হয়নি, তাই কাউকে বলিনি।
সন্ধ্যেবেলায় তেলের বাতির আলোয় আমরা পড়তে বসেছি এমন সময় সইস্ ছুটতে ছুটতে এসে বাবাকে যেন কি বলল । বাবাও ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরে ফিরে এসে রেগে বললেন, “কে কালামানিককে কাগজ খাইয়েছে? এখন কাগজ বেরুচ্ছে !!” আমরা চুপ, একেবারে কাঠ ! শেষে বাবা নিজেই বললেন, “বোধ হয় কেউ খাওয়ায়নি। ও নিজেই দুর্বোঘাসের সঙ্গে খেয়ে ফেলেছে। তোমরা যেখানে-সেখানে কাগজ ফেলো না।”
আমাদের বাড়ির পাশের বাড়িতে পাইন মাউন্ট স্কুলের মেমরা থাকত। চমৎকার টেনিস্ কোর্ট ছিল ওদের। বিকেলে টেনিস্ খেলা হত, অনেক সাহেব-মেম আসত। সারি সারি টেবিলে চা কেক্ স্যাণ্ডউইচের ব্যবস্থা হত। আমরা সারি সারি দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। মা-মাসিমা খুব বিরক্ত হতেন। এর চাইতে শৌখীন জীবন আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না।
শিলং-এ সেকালে বায়োস্কোপ দেখিনি, থিয়েটার তো ব্রাহ্মরা দেখে না বলেই জানতাম, তার অভাব-ও বোধ করতাম না। বছরে একবার ফুলের প্রদর্শনী হত, সে এক এলাহি কাণ্ড। কত রকম বিলিতী ফুল ফুটত ওখানে তার লেখা-জোখা নেই । মায়ের বড় ফুলের শখ ছিল। তাই আমাদের বাড়িতে চমৎকার সুইট-পী হত, ঝাউ-গাছের গোড়া উঁচু করে মাটি ফেলে ভায়োলেট ফুল লাগানো হয়েছিল। এদের যেমন রঙ, তেমনি গন্ধ। এর চাইতে সুন্দর কিছু হতে পারে আমি ভাবতে পারি না। একেকটা গন্ধের সঙ্গে একেকটা জায়গায়, একেকটা মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। সেই মা চলে গেছেন ২৫ বছর হয়ে গেল, কিছুদিন আগে পাটনায় একজনদের পুরনো বাড়ির পুরনো বাগান দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় যেতে গিয়ে হঠাৎ মার কথা, মায়ের ভায়োলেট ফুলের কথা মনে পড়ে গেল। পরদিন ভোরে খুঁজে দেখি, সেখানে অযত্নে আগাছার তলায় রাশি রাশি ভায়োলেট ফুল ফুটে রয়েছে। কে কবে শখ করে লাগিয়েছিল। তাদের মৃদু সুগন্ধে শ্যাওলা ধরা পথটি ভরে আছে।
রূপে রসে দিনগুলো এমনি ভরে থাকত যে বায়োস্কোপ থিয়েটারের অভাব টের পেতাম না। তবে একেবারে যে নাটক হত না, তা-ও নয়। আমাদের স্কুলেই একেকটি বিশেষ ধর্মোৎসবের দিনে সাধু-সন্তদের জীবন নিয়ে নাটক হত। তার কি চমৎকার সাজসজ্জা। মঞ্চ সাজানো হত কি সুন্দর করে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কার্ডবোর্ডের স্ক্রীনে দৃশ্যপট আঁকা হত। শিক্ষিকাদের সঙ্গে মেয়েরা সে-সব আঁকত। এই রকম ব্যবস্থাপনার যে রোমাঞ্চ, তার তুলনা নেই। তারপর চারপাশের গাছপালাগুলোই বা কম কি। আমাদের তিনটি ন্যাসপাতি গাছের কথা অনেকবার বলেছি। শীতের আগে সব পাতা শুকিয়ে পড়ে যেত। ন্যাড়া ডাল আকাশের ওপর উঠে থাকত । ভালো করে দেখলে মনে হত ছোট্ট ছোট্ট কেঠো গুটি ধরে রয়েছে। তবে সে এতই উঁচুতে যে নাগাল পাওয়া যেত না। নীল আকাশের গায়ে ন্যাসপাতির ডালের কঙ্কাল দেখতে ভারি অদ্ভুত লাগত। তারপর যেই না শীত কাটল, মার্চ মাসের হাওয়া বইল, অমনি দেখি রাতারাতি সাদা ফুলে ন্যাসপাতি গাছের ডাল ভরে গেছে, মোমের মতো সুন্দর ফুল, তার মিহি একটু মিষ্টি গন্ধ। দেখে দেখে চোখ ফেরাতে পারতাম না। একটা পীচ্ গাছ ছিল, তার গোলাপী ফুল ; প্লামের সাদা ফুলও সুন্দর ; কিন্তু ন্যাসপাতির ফুলের কাছে কেউ লাগত না। মনে হত গাছ-তলায় কে সাদা সুগন্ধী গাল্চে পেতে রেখেছে, রোজ রাশি রাশি পাপড়ি ঝরে পড়ত। শেষটা একদিন সব ফুল ঝরে যেত, গাছের ডালে ছোট্ট ছোট্ট ফলের গুটিগুলো ন্যাড়া হয়ে দেখা দিত । সঙ্গে সঙ্গে সারা শীত ঘুমিয়ে থাকা পাতার কুঁড়িও ফুটে গিয়ে, কচি ফলের মাথায় চাঁদোয়া বানিয়ে তাদের ঠাণ্ডা হাওয়া, হঠাৎ ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা করত। ফলগুলো কিন্তু বেজায় শক্ত, কষা, বিশ্রী। গাছে চড়ে কামড়ে খেয়ে দেখেছিলাম। সেই ফল পাকতে ভাদ্র মাস পড়ে যেত। তখন কমলালেবুর চাইতে বড়, নিটোল সোনালী ফলের ভারে ডালগুলি নেমে আসত মাটির কাছাকাছি । আমি, নোটন, সরোজ এরাও পেড়ে খেত। সোনালীর ওপর সাদা সাদা খুদে ফুটকি, রসে ভরপূর, খেতে মধু। একটু ক্যাচ্-ক্যাচ্ করত বটে, কিন্তু নিখুঁত জিনিস পৃথিবীতে কোথায়ই বা আছে?
বাড়ির চারদিকে ঝোপের বেড়া ছিল, মে-ফ্লাওয়ারের ঝোপ। সে-ও বসন্তকালে ফুটত, সাদা, থোপা-থোপা। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকত ছাড়া ছাড়া গোলাপ-লতার ফুল। একেকটি বোঁটায় সাতটি করে ফুল। এখনো যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। বাড়ির সামনে তিনটি গন্ধরাজ লেবুর গাছ ছিল। তাদের মধ্যি-খানে লালমাথা সবুজ গা বড় বড় মাকড়সারা শক্ত মজবুত জাল বুনে রাখত। তাতে প্রজাপতি পড়ত, ড্রাগন-ফ্লাই পড়ত। সময় মতো দেখতে পেলে, আমরা কাঠি দিয়ে ছাড়িয়ে দিতাম। মনে হত প্রজাপতি ছাড়া পেয়েও উড়তে কষ্ট হচ্ছে। আশ্চর্য জিনিস ঐ প্রজাপতি, ধরেছি মাঝে মাঝে। দুটি ডানা একসঙ্গে তুলে ফুলের ওপর যখন বসে থাকে, তখন পিছন থেকে চুপি-চুপি এসে ধরা যায়। ধরেই ছেড়ে দিতাম, হাতে ওদের ডানা থেকে রঙীন গুঁড়ো লেগে থাকত। দাদা বলত গুঁড়ো উঠে গেলে ওরা আর উড়তে পারে না। তখন বেজায় কষ্ট হত। একবার ঝাউগাছের মগডালে প্রকাণ্ড ফুটবলের মতো চাক বেঁধেছিল বোলতারা। কাকে কাকে যেন হূলও ফুটিয়েছিল। শেষটা একদিন রাতে সুমপারিং গ্রামের লোকরা এসে, বাঁশের আগায় মশাল জ্বালিয়ে, চাকে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুনের গোলার মতো জ্বলতে জ্বলতে মোমে ভরা চাকটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। আর গ্রামের লোকরা অমনি তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, আধ-পোড়া শুক-কীটগুলোকে টপাটপ খেতে লাগল। ইলবন বলল,বড় বোলতাদের ডানা পুড়ে তারা মাটিতে পড়ে মরে গেছে। কয়েকটা অন্ধের মতো উড়ছিল, দাদা বলল, “ওরা রাতে দেখতে পায় না।” মনে আছে এসব দেখে আমার গা-বমি করেছিল। দিদি বোধ হয় কেঁদে নিয়েছিল। কাঁদবার সুযোগ ও কখনো ছাড়ত না।
ছোটবেলায় আনন্দ করবার কিম্বা দুঃখ করবার খুব বেশি উপকরণের দরকার হত না। যখন আমার বছর পাঁচেক বয়স হবে তখন একবার মাঘোৎসবের সময় ব্রাহ্ম-মন্দিরে গিয়ে দেখি একজন লোক হার্মোনিয়ম বাজাচ্ছে, একজন তবলা বাজাচ্ছে আর বাকিরা করতাল বাজিয়ে, গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে গান গাইছে, “প্রেম-সলিলে স্নান করিলে পাপের জ্বালা দূরে যায়।” হঠাৎ কল্যাণ আমাদের দল ছেড়ে গাইয়েদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তারস্বরে গান ধরল, “প্রেম-সলিলে স্নান করিলে পেটের জ্বালা দূরে যায় !” বড়রা ওকে বকবে কি, নিজেরাই হেসে কুটোপাটি। সেই কয়েক মুহূর্তের জন্য মাঘোৎসবের গাম্ভীর্য দূর হয়েছিল, ভগবান বোধ হয় সেটা বেশ উপভোগই করেছিলেন । নইলে পৃথিবীতে এত দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে এত মজার জিনিস ঠুসে দেবেন কেন?
দুঃখের ব্যাপারও হত । গুরুচরণ নামে একজন দপ্তরি ছিল, সে বোধ হয় ব্রাহ্ম ছিল। ঠিক বলতে পারি না। তার গোবিন্দ বলে একটি ছেলে ছিল। আমার চাইতে কিছু ছোট হবে। গোবিন্দর মা ছিল না। ছিল সৎমা। সৎমার কয়েকটা ছেলেমেয়ে ছিল। গোবিন্দ তাদের কোলে পিঠে নিয়ে বেড়াত । একবার একটাকে ফেলে দিয়েছিল বলে, ওর মা গোবিন্দর গালে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়েছিল। গোবিন্দ গালে পোড়া-ঘা নিয়ে ব্রাহ্মসমাজের সাণ্ডে- স্কুলে এসেছিল। তাই দেখে বড়রা ওর বাবাকে ডেকে খুব ধমকে দিয়েছিলেন। গোবিন্দর সেই গাল-পোড়া চোখ ছল-ছল মুখটা আমার এখনো মনে পড়ে। আশা করি পরে সে সুখী হয়েছিল। পরে যখন বইতে পড়েছি রবীন্দ্রনাথ বলতেন প্রকৃতির বুকের মধ্যে ছেলে-মেয়েরা মানুষ হক, তখনি আমার মনে হয়েছে আমরা তাই হয়েছিলাম। কৃত্রিম জিনিস খুব কম ছিল আমাদের বাড়িতে, লোক-দেখানি জিনিস একেবারেই না। সাদা-সিধা কাপড়-চোপড় পরতাম, শীতকালে গরম মোজা, উলের সোয়েটার, মোটা মোটা ওভারকোট। বাড়িতে ঠনঠনের চটি পরতাম, একটা লোক বাঁকে করে ঝুলিয়ে বেচতে আসত। সত্যি কথা বলতে কি, আমার চোখে ওগুলোকে বেশ সুন্দর লাগত, বিশেষত নতুন অবস্থায়। কেমন কুচ্কুচে চক্চকে। দুঃখের বিষয় এক মাসে তাদের চেহারা বদলে যেত। মাকে বড় জোর গরদের শাড়ি পরতে দেখেছি। বাবা আপিসে কোট প্যান্ট পরে, টাই বেঁধে গেলেও, বাড়ি ফিরেই চটি, সাদা পাজামা, গরম জোব্বাপ্যাটার্নের একটা কোট। ভাত খেয়ে উঠে পান খাওয়া চাই—ফ্যাশানেব্ল্ হব কি করে? তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ থাকত না, যদি না কলকাতা থেকে বেড়াতে গিয়ে আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা আমাদের সাজ-পোশাকের বহর দেখে নাক সিঁটকাত !
আমরা গল্প শুনতে পেলেই খুশি। অতুলভূষণ সরকার বলে একজন ফরসা, টাক-পড়া, দাড়িওয়ালা মানুষ আসতেন। আমরা তাঁকে বড়মামা বলতাম। কেন বলতাম তা জানি না। শুনেছিলাম ওঁর বেশি টাকাকড়ি ছিল না, বুড়ি মা আর রুগ্ন বোন ছিল। বোধ হয় সেক্রেটেরিয়াটেই কাজ করতেন। কিন্তু মানুষটা গল্পের জাহাজ ছিলেন। কত বিখ্যাত ইংরিজি বইয়ের গল্প যে ঐ বয়সে ওঁর কাছে শুনেছিলাম, কাউন্ট-অফ-মণ্টেক্রিস্টো, ড্রপ্ড্ ফ্ম দি ক্লাউড্স, টোয়েন্টি থাউজ্যাণ্ড লীগ্স্ আণ্ডার দি সী, রবিন্সন ক্রুসো, ট্রেজার-আইল্যাণ্ড, কিড্ন্যাপড্, টেল-অফ-টু সিটিজ, ইত্যাদি অজস্র বই। কি ধৈর্য, কি অপরিসীম স্নেহের সঙ্গে যে তিনি এই কয়েকটা অপোগণ্ড ছেলেমেয়েকে দিনের পর দিন ঘন্টার পর ঘন্টা, গল্প বলে যেতেন, এখন ভেবে অবাক হই। ভাবি মানুষের কাছে ঋণের জালে জড়িয়ে আছি। একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। শীতকাল, বড়মামা আমাদের গল্প বলছেন, এমন সময় আমাদের ধোপা সোনেলাল একটা গরম কোট গায়ে দিয়ে জোগান নিয়ে এল। বড় মামাকে সে লক্ষ্য করেনি। মাকে কাপড় গুণে দিচ্ছে, হঠাৎ বড়মামা বললেন, “আরে সোনেলাল, তুমি যে হামারা কোট পিন্কে আয়া !” আর বলা কওয়া নেই, দুমদাম করে সোনেলাল ভাগল। পর দিন জোগান নিয়ে যাবার জন্য আবার এসে অম্লানদবদনে বলল, “না, না, ওটা আমারি কোট, ঠিক ওঁর কোটের মতো দেখতে।” আমরা মোটেই বিশ্বাস করলাম না, বললাম, “তবে পালালে কেন?” সোনেলাল ফিক্ করে হেসে বলল, “শরম লাগা!” আমাদের ভারি মজার লেগেছিল। বড়মামাও পরে খুব হেসেছিলেন!
॥ ৭ ॥
১৯১৬ সালে কলকাতা থেকে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি শিলং গেছিলেন। সাল-তারিখের এক-আধ বছর আগে পরেও হতে পারে, মোট কথা বড়মাসিমারা তখনো শিলং-এ ছিলেন। প্রথমে গরমের ছুটিতে নান্কুদা, পান্কুদা গেছিল। দুজনে দুটি গল্পের ঝুড়ি। তাছাড়া একগাদা বাংলা গল্পের বই নিয়ে গেছিল। তাতে প্রকাশকের নাম দেখেছিলাম, ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্স আর সিটি বুক সোসাইটি। এরা দুজন আসাতে মা যে কি খুশি সে আর কি বলব । এক বাড়িতে মানুষ, এরা যত না ভাসুরপো, তার চাইতে ছোট ভাইয়ের মতো। ওরাও মাকে বেজায় ভালোবাসত। মান্তু বলে দুজনেই ডাকত, নান্কুদার দেওয়া নাম । নান্কুদা হ’ল উপেন্দ্রকিশোরের ছোট ছেলে সুবিমল আর পান্কুদা কুলদারঞ্জনের একমাত্র ছেলে, পড়াশুনোয় ভারি ভালো, তার ওপর কায়দাদুরস্ত, ছোটবেলায় মা-মরা, কেমন একটু চাপা স্বভাবের ছিল, বেশি আজে-বাজে বকত না। নান্কুদা আর আমরা যেমন বকতাম।
এদের কথা বলবার আগে আমাদের সমবয়সীদের কথাও কিছু বলা দরকার ; তারা আমাদের সুখ-দুঃখের গল্প শোনার সঙ্গী হত। নরেস্কে হরিচরণরা থাকত, তার পরের বাড়িতে কাঞ্জিলাল জ্যাঠামশাই থাকতেন। তাঁর দুই নাতি সতু আর দুখু। সতু আমাদের বয়সী, দুখু বছর দুই-তিনের ছোট। ওর বোধ হয় মা ছিল না। বেজায় রোগা । দাদা, কল্যাণ, সতু ওখানকার সরকারি হাইস্কুলে ভরতি হল, কিন্তু দুখুর কথা মনে করতে পারি না। তবে একদিন সে একটা গোটা তামার পয়সা গিলে, খাবি খেতে লাগল, একথা মনে আছে। মুখ লাল, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, খালি আঁক্ আঁক্ করছে আর নাল পড়ছে। আমরা সবাই থ।
এমন সময় বড় প্রফুল্ল-কাকিমা ছুটে এসে দুখুর ঠ্যাং ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে, পশ্চাদ্ভাগে এমনি জোরে এক থাবড়া মারলেন যে তার চোটেই পয়সাটা ঠক্ করে মাটিতে পড়ল আর দুখু এতক্ষণ পরে বিকট চেঁচিয়ে উঠল ! আমার তো ব্যাপার দেখে হাত-পা ঠাণ্ডা ! জ্যাঠামশাই জ্যাঠাইমা বড় ভালো ছিলেন। ওঁদের বাড়ির দরজায় বড় বড় পুঁতির মালার পরদা ছিল। এমন আর কখনো দেখিনি, শুধু বইতেই পড়েছি। জ্যাঠামশাই বন-বিভাগে কাজ করতেন। ওঁরা বোধহয় বেশ গোঁড়া ছিলেন । মা একদিন বললেন, “তোরা যে ওঁদের বাড়ির সব ঘরে ছুটোছুটি করিস্, তাই বলে যেন ওঁদের রান্নাঘরে যাস্নি।” আমরা বললাম, “কেন?” মা বললেন, “তোমরা গেলে ওঁদের খাওয়া নষ্ট হয়ে যাবে।” এমনি অবাক হয়েছিলাম যে কি বলব । আমরা গেলে কারো খাওয়া নষ্ট হবে ভেবেও বেজায় কষ্ট হয়েছিল। মা আরো বলেছিলেন, “তোমরা যে ব্রাহ্ম । গোঁড়া হিন্দুরা ব্রাহ্মদের সঙ্গে খায় না।” কিন্তু পাড়ার বন্ধুরা তো সবাই হিন্দু ছিল, কই ওরা তো আমাদের সঙ্গে খেত-টেত। সতু দুখুও তো খেত। মনে আছে ভারি গোলমাল লেগেছিল। পরে বহু গোঁড়া হিন্দুদের ভালোবাসায় আমার জীবন কেটেছে।
সেবার হরিচরণরা শীতের সময় কলকাতায় গিয়ে, সে-বছর আর ফিরল না। অমরকাকাবাবুকে হয়তো অন্য কোথাও পাঠানো হয়েছিল। ‘নরেস্ক’ বাড়ি খালি রইল। তারপর হঠাৎ একদিন সতু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, “নরেস্কে বাংলার বাঘ এসেছে। চল, দেখে আসি।” আর যায় কোথা ! আমরা সবে স্কুল থেকে এসে হাতমুখ ধুয়ে ভাত খেতে বসেছি। বড্ড সকালে স্কুল বসত, তাই ডিম রুটি খেয়ে, টিপিন নিয়ে চলে যেতাম, বিকেলে ভাত খেতাম, রাতে কিছু জলখাবার খেতাম। গরম গরম লুচি দিয়ে লাল চিনি দিয়ে কি ছক্কা দিয়ে। সেদিন খাওয়াই হল না, যে যার দুদ্দাড় করে উঠে পড়ে, সতুর সঙ্গে ছুটলাম। বড়মাসিমা রাগ করতে লাগলেন, তা কে কার কথা শোনে !
নরেস্কের গেটের বাইরে থেকে দেখতে পেলাম বারান্দায় একটা জল-চৌকিতে একজন ঝুলো-গোঁফ ভয়ঙ্কর মোটা বুড়ো-মতো মানুষ বসে আছেন, গায়ে একটা গেঞ্জি, সেটার পিঠের দিকটা তুলে একটা লোক দলাই-মলাই করে দিচ্ছে ! ঐ নাকি বাংলার বাঘ। আমাদের রাগ দেখে কে! ছোটবেলা থেকে সন্দেশে জীবজন্তুর গল্প পড়েছি আর বাঘ চিনব না ! রেগেমেগে সতুর দিকে ফিরতেই, সে আমতা আমতা করে বলল, “তবে যে দাদু বললেন,…”
আমরা সবাই হাঁসের আক্রমণের কথা ভুলে গজ্গজ্ করতে করতে বাড়ি ফিরলাম। শেষের দিকে দৌড়তে হল, কারণ আমরা ভুললেও হাঁসরা ভোলেনি। মা মাসিমাকে সব কথা বলতেই উল্টো ফল হল। “বলিস কি রে? উনি যে দেবতুল্য মানুষ ! চল, প্রণাম করে আসি।” আশু মুখুজ্জেকে ঐ একবার কাছে থেকে দেখেছিলাম। অন্য দিন মা আমাদের নানান্ ইংরিজি বই থেকে গল্প বলতেন, সতুও বসে শুনত। সেদিন আশু মুখুজ্জের তেজের গল্প বললেন। কেমন রেড রোড বলে কলকাতায় একটা রাস্তা আছে, আগে সেখান দিয়ে কোনো ভারতীয়কে যেতে দিত না। আশু মুখুজ্জে তখন হাইকোর্টের জজ, তিনি নিয়ম অমান্য করে তবু গেলেন। ব্রিটিশ সার্জেন্ট জজ সাহেবকে চিনতে না পেরে, তাঁর নামে মামলা করতে গিয়ে কি হয়রাণ হয়েছিল, সে গল্পও শুনলাম। সেই সঙ্গে বিদ্যাসাগর মশায়ের আত্মসম্মান সম্বন্ধে নানা রকম গল্প শুনে আমরা তাজ্জব বনে গেলাম। আমরা যে পরাধীন, এ-কথা এতদিন ঠিক জানতাম না। পরাধীন কথাটার মানেই ভালো বুঝতাম না। এর আগেই দেশের জন্য কতজন প্রাণ দিয়েছিল, দ্বীপান্তরে গিয়েছিল, সব বললেন মা সেদিন। ক্ষুদিরামদের উল্লাসকর দত্তদের বাড়ির সঙ্গে বোধ হয় জ্যাঠামশাইদের যাওয়া-আসা ছিল ! মার চোখে জল দেখেছিলাম।
ঐ ঘরে আমাদের আর কুলোচ্ছিল না। ১৯১৬ সালে আমাদের সবার ছোট ভাই যতির জন্ম হয়। জীবনে বড় দুঃখ পেয়ে ৪৯ বছর বয়সে যতির মৃত্যু হয়। দেখতে বড় সুন্দর ছিল। মনে আছে ওকে টেনে নিয়ে বেড়ালে আমার কালো হওয়ার দুঃখ ঘুচে যেত। সে যাই হক, আরেকটি ঘর না হলে চলছিল না।
বাড়ির মালিক চন্দ্রনাথ রায় বললেন, “আপনারা বাড়ি ছেড়ে যাবেন না । আমি আরেকটা ঘর করে দিচ্ছি।” লম্বা একহারা বাংলোর পশিচম দিকের শোবার ঘরের লাগোয়া আরেকখানি ঘর হল, সামনের বারান্দার জায়গায় একটি খুদে পড়ার ঘর হল, তাতে বই রাখবার তাক হল। পিছনে একটি স্নানের ঘরও হল। আমাদের সে কি উত্তেজনা ! বাড়ির ভিৎ খোঁড়া হচ্ছে, এদিকে বড়মামা আপিস ফেরৎ এসে, ট্রেজার আইল্যাণ্ড শেষ করে, গালিভারের ভ্রমণবৃত্তান্ত একটু একটু করে বলে যাচ্ছিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এতখানি মাটি খোঁড়া হচ্ছে, নিশ্চয়ই হয় মোহরের কলসিতে ঠুং করে কোদাল লাগবে, নয়তো পিল-পিল করে চার ইঞ্চি লম্বা মানুষেরা বেরিয়ে আসবে।
বেরুল একটা পিঁপড়ের বাসা। সে-ও এক আশ্চর্য জিনিস। বেশ বড় বড় পিঁপড়ে। তাদের বাসার সামনে থেকে এক চাক্লা মাটি কেটে নিতেই, ওদের ঘর-গেরস্থালি বেরিয়ে পড়ল। সে কি হৈ-চৈ ! ডিম নিয়ে ছুটোছুটি লেগে গেল। পিঁপড়ের বাসার এমন সুন্দর ব্যবস্থা হতে পারে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
নতুন ঘর হল, ঘরে বইয়ের তাক হল। মায়ের বাক্স থেকে অনেকগুলি বই বেরুল, সেগুলি ঐ তাকে সাজিয়ে রাখা হল। তার মধ্যে পাতলা মলাটের একটা সরু বই ছিল, তার নাম ‘খেয়া’। শুনলাম রবিবাবুর লেখা বই । তখন সবাই বলত রবিবাবু, কেউ তাঁর কথা বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথ বলে উল্লেখ করত না। তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেও, সব বাঙ্গালীর মধ্যে একজন ছিলেন, তাই তাঁকে বলা হত রবিবাবু, যেমন বলা হত বঙ্কিমবাবু, দ্বিজুবাবু। এ-সব ডাকের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গতা ছিল।
যাই হক রবিবাবু বলে কাউকে আমি চিনতাম না। স্কুলে বাঙলা পড়ানো হত না, বাড়িতে বিদ্যাসাগর মশায়ের ১ম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, কথামালা শেষ করে, আখ্যানমঞ্জরী ধরে যেমন কষ্ট পাচ্ছি, তেমনি আনন্দও পাচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কি রবিবাবুর লেখা কিছু আমি পড়িনি। মা ঐ বইটা আমাকে দিয়ে বললেন, “এটা তোমার।” পড়বার চেষ্টাও করেছিলাম, একবর্ণ মানে বুঝিনি। বই তাকে তোলা থাকল । পরে আচার রাখবার জন্য পরিষ্কার কাগজের দরকার হলে, ওর একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়েছিলাম। তাই নিয়ে আমাকে যথেষ্ট ‘হেনস্থা’ হতে হয়েছিল। আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম। তাও সব পাতাটা নিইনি, খানিকটা ছিঁড়েছিলাম মাত্র ।
সেই সময় আমাদের বাড়িতে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ বলে একজন লম্বা সুন্দর মানুষ এসে কয়েক দিন থেকে গেলেন। মাসিমা তাঁর কাছে ঐ পাতা ছেঁড়ার গল্প করলেন। তিনি আমাকে বললেন, “এখন বুঝতে পারছ না রবীন্দ্রনাথ কত বড় কবি, কিন্তু পরে বুঝতে পারবে। কেউ তোমাদের ওঁর কবিতা পড়ে শোনায়নি?” আমরা মাথা নাড়লাম। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি তাঁর সুটকেস থেকে দুটি চটি বই বের করে আমাদের রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে শোনালেন। আগে ঘরের বড় তেলের ল্যাম্প নিবিয়ে, চারটে মোমবাতি জ্বাললেন। সেই মোমবাতির আলোয় কবিতা পড়লেন। সত্যি বলব, কিচ্ছু বুঝিনি। তবে আসলে যা বোঝাতে চেয়েছিলেন সে-কথাটি ঠিকই ধরেছিলাম। রবিবাবু আর সব মানুষ থেকে আলাদা। সেই শীতের সন্ধ্যার সেই দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসে।
তবে যে কারণে প্রশান্তদাকে আরো বেশি করে মনে পড়ে, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো সম্পর্ক ছিল না। উনি বোধ হয় সম্প্রতি কেমব্রিজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছিলেন, তাই সেখানকার নানা রকম মজার গল্প বলে নিজেও ভারি মজা পেতেন। এর পর আরো ৫৫—৫৬ বছর ধরে তাঁকে নানান্ সময় দেখেছিলাম, কিন্তু শিলং-এর সেই আমুদে মানুষটিকে আর খুঁজে পাইনি। তবে তাঁর রবীন্দ্র-ভক্তির যে একটুখানি আভাস দেখেছিলাম, তার পরিপূর্ণ রূপটি অনেকবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।
সেই কবিতা-গল্পের রবীন্দ্রনাথ শিলং-এ বেড়াতে এলেন। শহরসুদ্ধ সব বাঙালী তাঁকে দেখবার জন্য ভেঙে পড়ল। কেঞ্চেস ট্রেসে আধা বনের পরিবেশ। সেইখানে ব্রুক্লাইড বলে এক বাড়িতে এসে অনেকজন উঠলেন। কারা কারা তা বলতে পারব না। ওঁর পত্রাবলী থেকে মনে হয় রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমাদেবীও সঙ্গে ছিলেন। আমার যাঁকে মনে পড়ে তিনি হলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমন মোটা মানুষ আগে কখনো দেখিনি। পরেও দেখেছি বলে মনে হয় না। বড়মাসিমাকে দেখে কি খুশি ! ‘সুষমাদি !’ বলে ঐ অত বড় শরীর নিয়ে ছুটে এলেন। গান গেয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ, বাজের মতো গম্গম্ করেছিল সুর, গলার মধ্যে। এখন পুরনো রেকর্ডে সেই কণ্ঠ শুনলে কষ্ট হয়, কারণ তার কিছুই ধরা যায়নি। কোথায় সমুদ্রের নিনাদ আর কোথায় টিনের ভেঁপু। রবীন্দ্রনাথ “পুরাতন ভৃত্য” আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বাঙলা ভাষা যে কি আশ্চর্য জিনিস হঠাৎ বুঝতে পেরেছিলাম। সেদিন থেকে তাঁর ভক্ত চ্যালা হয়ে গেছিলাম।
রবীন্দ্রনাথের সুন্দর চেহারা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। আমার মনে হয় এমন সুন্দর মানুষ পৃথিবীতে কম জন্মেছে। ঠাকুরবাড়ির লোকেরা নাকি বলত, “আমাদের রবি কালো।” ওঁর মা ছোটবেলায় ছুটির দিনে তাঁর কালো ছেলেটিকে জলচৌকিতে বসিয়ে গায়ের ময়লা তুলে, ‘রূপটান’ মাখিয়ে স্নান করাতেন। তার ফলেই অমন উজ্জ্বল মসৃণ গা হয়েছিল কি না কে জানে। ‘রূপটান’ তৈরি করতে নাকি ৬৪ রকম উপকরণ লাগে এবং গায়ে মেখে স্নান করতে দু ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু ফল ভালোই হয়েছিল বলতে হবে । অবিশ্যি রূপটানের কথাটা আমি বিশ্বাস করি না। ওপর থেকে কোনো প্রলেপ লাগিয়ে, ভিতর থেকে অমন আলো ফোটানো যায় কখনো? কি সুন্দর মুখ, কি গলা, কি উদ্ভাসিত দৃষ্টি। এর পর থেকে খুঁজে খুঁজে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তে আরম্ভ করেছিলাম। ক্রমে তার রসে মন ডুবে যেতে লাগল। ওদিকে আখ্যানমঞ্জরী ১ম, ২য় ভাগ শেষ করে ৩য় ভাগ ধরেছি । কিন্তু ব্যাকরণ বলে কোনো জিনিসের ধার ধারতাম না। মনে আছে স্কুলে ইংরিজি গ্রামার কত সহজে শিখে ফেলেছিলাম। ওরা গ্র্যামারের কোনো আলাদা বই পড়াত না, কিন্তু রোজ ক্লাসে যেটুকু পদ্য কি গদ্য পড়ানো হত, তার মধ্যে দিয়েই যা কিছু শিক্ষণীয় সব শিখিয়ে দিত। আমরা টের-ও পাইনি যে জটিল কিছুতে জড়াচ্ছি।
আর বইগুলিও কি চমৎকার, স্টেপ্স্ টু লিটারেচার, তাতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গল্প স্থান পেয়েছিল। রামায়ণের গল্পও ছিল। তার নাম ছিল, দি স্টরি অফ রামা। ‘রামা’ শুনে বেজায় হাসি পেয়েছিল। কিন্তু বইটি যে চমৎকার সেটুকু তখনি বুঝেছিলাম । ইতিহাসের বই ছিল, গেটওয়েজ্ টু হিস্টরি । নানান্ ঐতিহাসিক গল্প । ভারতের কথাও নিশ্চয় ছিল, কিন্তু খুব বেশি থাকলে মনে পড়ত। এইভাবে গল্পের নেশা ক্রমে বেড়েই চলেছিল। জীব-বিদ্যা পড়ানো হত, চার্ট দিয়ে, বোর্ডে রঙীন খড়ি দিয়ে ফুল, বীজের অঙ্কুরিত হওয়া, প্রজাপতি, পোকা-মাকড়ের চমৎকার ছবি এঁকে। বই-টই ছিল না। এভাবে জীব-বিদ্যা শেখার মোহ আজ অবধি আমার মনে লেগে আছে। ভূগোল আর অঙ্ক, এ দুটি খুব ভালো পড়ানো হত না। তবে বাড়িতে বাবার যত্নে ও তাড়নায় অঙ্কে সবাই দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম।
বাবা চমৎকার অঙ্ক শেখাতেন। যখন আরেকটু বড় হলাম, জিওমেট্রি ধরলাম, মনে আছে বাবা আমাদের বিন্দু, রেখা ইত্যাদি বোঝাতে বসলেন। সে এক মনোজ্ঞ ব্যাপার। বাবা বললেন, বিন্দুর একটা অধিষ্ঠান আছে, কিন্তু মাপ নেই। রেখার দৈর্ঘ্য আছে কিন্তু প্রস্থ নেই। বলা বাহুল্য কথাগুলো ইংরিজিতে বলা হয়েছিল, কারণ ও-সব তখন ইংরিজিতেই হত। বাবা যা বললেন আমরা মেনে নিলাম । দাদা, দিদি, আমি, আবার কল্যাণকেও ডেকে নিলেন। আমাদের বয়স তখন ১১, ১০, ৯ আর ৮ । বাবা তবু ছাড়েন না। বললেন, “কই দেখাওতো কিছু যার লম্বাত্ব আছে, কিন্তু চওড়াত্ব নেই।” আমরা বোকা বনে গেলাম। একটা সুতো দেখিয়েছিল দাদা । বাবা বললেন, “ওটা লাল রঙের, ওর খুব সরু একটু প্রস্থ আছে। খালি চোখে দেখতে পাচ্ছ না, ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখতে পাবে।” যন্ত্রপাতি বাক্স থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস এনে দেখালেনও।
বাবা শেষ পর্যন্ত নীল ড্রইং বুকের ওপর লাল অঙ্কের বইটা ফেলে দিয়ে বললেন, “লাইন দেখতে পাচ্ছ?” আমরা দুটোর মাঝখানের লাইনটা দেখালাম। বললেন, “কত লম্বা?” দাদা মেপে বলল, “৭ ইঞ্চি।” বাবা বললেন, “কি রঙের?” আমরা তাজ্জব বনে গেলাম। লাল কি? না তো, লাল নয়। তবে কি নীল? না, তাও নয়। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। বাবা বললেন, “রঙ থাকলে তো বলবে। ওর চওড়াই নেই তো রঙ লাগবে কিসে?” কিন্তু শিক্ষাটা অতটা নাটুকে ছিল না। যতদূর মনে পড়ছে দুটো মিহি সুতোকে একটার ওপর অন্যটা আড়ভাবে বসিয়ে বললেন, “কোথায় ক্রস করেছে?” আমরা দেখলাম ঠিক অবস্থানটি । বললেন, “এবার সুতো দুটো তুলে নিলে, যা থাকবে সেইটেই বিন্দু। অবস্থান আছে মাপ টাপ নেই।” এখন সে রকম প্রত্যয়জনক মনে না হলেও বিন্দুর স্বভাবটি ঠিক বুঝেছিলাম ।
এমনি করে ১৯১৬, ১৯১৭ এগিয়ে চলতে লাগল। আবার পুরস্কার বিতরণের সময় ঠিক সেই একই রকম মস্ত কার্ড পেলাম। পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিলাম, সর্বদা প্রথম হতাম। তবে গোড়া থেকেই গুরুজনরা একটা ভুল করেছিলেন। দিদিকে আমাকে এক সঙ্গে অক্ষর পরিচয় করিয়ে দিয়ে, একই ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। দিদিও পড়ায় ভালো ছিল, কিন্তু আমার নিচে হত। কখনো তৃতীয়, কখনো চতুর্থ। সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় হল যে তাতে আমার এতটুকু অহঙ্কার কিম্বা ওর এতটুকু ক্ষোভ দেখা যেত না। ওর ভাবখানা ছিল তুই বেশি চালাক, তাই তুই তো প্রথম হবি-ই। আর আমি ওকে ছোটবেলা থেকে ধমক-ধামক করতাম, পেটাতাম পর্যন্ত, কিন্তু আর কেউ কিছু বললে বেগে চতুর্ভুজ হয়ে যেতাম । ও যে কত ভালো, সে আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না। হিংসে নেই, অহঙ্কার নেই, লোভ নেই। কিন্তু কোনো উচ্চাশাও কোনো দিন দেখিনি। কর্তব্যপরায়ণ, নির্বিকার। রাগমাগ করত না। আমাকে খুব ক্বচিৎ উল্টে মারত। আর যদি বা আমার ওপর অসন্তুষ্ট হল, গল্প বলে বশ করতাম। স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের বেশির ভাগ লাবানে থাকত, আজীবনের বন্ধু সব, আজ পর্যন্ত তাদের কথা মনে পড়লে মনের মধ্যে একটা কোমল উষ্ম ভাব টের পাই । কত খেলা, কত ঝগড়া, কত চড়িভাতি, কত জন্মদিনের নেমন্তন্ন। সাদাসিদে পোশাক সবার, দু-এক টাকার উপহার আদান-প্রদান। তারি মধ্যে কত স্নেহের স্মৃতি। তবে দুজন আই-সি-এসের মেয়েও পড়ত, তারা সাহেবপাড়ায়, ফ্যাশানেব্ল্ বাড়িতে থাকত । কি চমৎকার কাপড়-চোপড় পরে স্কুলে আসত। একজন একটি জামা পরে এসেছিল একদিন, সাদা রেশমের, তাতে নকল মুক্তোর বোতাম দেওয়া। ঠিক করেছিলাম বড়লোক হয়ে ঐ রকম একটা জামা কিনব। কাউকে কিছু বলিনি। এখনো জামাটার কথা মনে আছে, কিন্তু শখটা কবে চলে, গেছে।
একটা বিষয় তখন অত কিছু মনে হত না, এখন ভেবে আশ্চর্য লাগে । আসামের পাহাড়ী শহর, সেখানে বাঙালী বাসিন্দারা সকলেই বহিরাগত, অথচ নিজেদের মধ্যে মিলে মিশে থাকতেন না। অনেক সিলেটী ছিলেন শিলং-এ, সিলেট তো আর খুব দূরে ছিল না। শুনতাম শিলং-পীক থেকে নাকি সিলেটের পাহাড় দেখা যেত। আমাদের লুমপারিং নদীর ওপারে, যেখানে দিদিমারা থাকতেন, সেটাকে সিলেটী-পাড়া বলত । আরো উঁচুতে কলকাতী-পাড়া ছিল। সেখানে দুর্গোপুজো হত, মহিলা-সমিতির মিটিং হত। আর পুলিনবাবু বলে একজন খুব ভালো ডাক্তার ছিলেন, তাঁদের বাড়ির ছেলেরা সাণ্ডে স্কুলে আসত। প্রকাশদা, প্রাণেশদা, প্রফুল্লদা। প্রত্যেক রবিবার সকালে সাণ্ডে স্কুল বসত, নানা রকম গল্প বলা হত, গান হত, কবিতা বলা হত। মাঘোৎসবের সময় বালক-বালিকা সম্মেলন হত, তখন নানান প্রতিযোগিতা হত । আমি একবার ইংরিজি কবিতা বলার জন্য পুরস্কার পেয়ে বেজায় অবাক হয়ে গেছিলাম। কারণ শেষের দিকে আর থাকতে না পেরে ফিক্ করে হেসে ফেলেছিলাম আর সবাই বলেছিল, “ছিঃ, হেসে ফেলে সব মাটি করে ফেললে !” আর দুটি পুরস্কার ছিল সব চাইতে ভালো মেয়ের আর সব চাইতে ভালো ছেলের। আমরা সক্কলে প্রাণেশদাকে ভোট দিতাম। তাকে আমাদের বড্ড ভালো লাগত। শিলং ছেড়ে আসার পর আর তাদের কোনো খবর রাখিনি।
লাবানবাসী আর কটি মানুষের কথা না বললে এ-কাহিনী সম্পূর্ণ হয় না। তাদের দুজনের কথা বলি। তারা বড় ভালো। আমরা তাদের ডাকতাম সুতুদি আর অমলদা। আমার ছোটমেসোমশায়ের প্রথম স্ত্রীর ছেলে-মেয়ে, ছোটবেলা থেকে মা-মরা, জ্যাঠা-জ্যাঠির কাছে মানুষ। এরা দেখতেও যেমন ভালো ছিল, তেমনি স্নেহশীল ব্যবহারও ছিল। বিশেষ করে অমলদা । আমার মনে হয়, সারাজীবনে যত ভালো লোক দেখা যায়, তারা সবাই মনের ওপর একটুখানি ছাপ রেখে যায়, প্রজাপতির ডানা যেমন একটুখানি রঙ রেখে যায় ।
সুতুদিদের বাড়ির কাছে থাকতেন বড়দার, অর্থাৎ সুকুমারের, খুড়শ্বশুর কৈলাস-জ্যাঠামশাই, তাঁর নয়-দশটি ছেলে ছিল । আর সবার শেষে দুটি মেয়ে। ওদের বাড়িটা খুসিতে ঠাসা ছিল, যদিও বড়খুকু বলে আমার সমবয়সী ছেলেটা আমাকে মহা জ্বালাত। নিজে বেজায় দুষ্টু, আবার আমাকে দুষ্টু বলত । লাবান পাহাড়ের আরো উঁচুতে থাকত শিউলী-বেলিরা তাদের সঙ্গে আমাদের কুটুম্বিতাও ছিল, ভালোবাসাও ছিল।
তবে এদের সকলকে ছাপিয়ে যে দুটি মানুষের স্মৃতি আমার মনকে উদ্ভাসিত করে রাখে,তাঁদের নাম ছিল মিঃ স্টিভেন ও মিসেস্ স্টিভেন। মিশনারি সাহেব-মেম, বয়স হয়ে গেছিল, ছেলেমেয়েরা বিলেত থেকে কেবলি চিঠি লিখত, “আর কতদিন থাকবে? এসো, দেশে আমাদের কাছে ফিরে এসো। শেষ জীবন আমাদের কাছে কাটাও?” কিন্তু কি করে যান তাঁরা, গরীব মুখ্যু পাহাড়ীদের স্কুল কে চালাবে, ছোট্ট হাসপাতাল কে দেখবে, কে ওদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিচ্ছন্নতা শেখাবে, খুদে গির্জায় কে ভগবানের নামগান করবে? আর যাওয়া হয় না।”
শেষটা যখন বুড়ো-বুড়ির শরীর ভাঙল, তারা জোরজার করে তাঁদের ধরে নিয়ে গেল। স্কুলের ভার কয়েকজন পাড়ার লোক নিল ; হাসপাতাল দেখবে বলে কেউ কথা দিল ; জিনিসপত্র, ঘরের সামান্য আসবাব সব বিলিয়ে দিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে তাঁরা চলে গেলেন।
এক বছরও গেল না। একদিন হঠাৎ শুনলাম মিঃ আর মিসেস স্টিভেন ফিরে এসেছেন। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বন্ধুবান্ধব তাঁদের বাড়ি খুলিয়ে, পুরনো জিনিসপত্রগুলি ফিরিয়ে এনে, যেখানকার যেটা সাজিয়ে দিলেন। মিসেস স্টিভেন অমনি স্কুল নিয়ে মেতে উঠলেন, মিঃ স্টিভেন গির্জা আর হাসপাতাল নিয়ে। বললেন, “কোথায় যাব? এই আমাদের মনের নিবাস, এ ছেড়ে কি থাকতে পারি?” জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওঁরা ঐখানে ছিলেন। তাঁদের কথা মনে করে একটা ছোট কালো মেয়ের বুক যে ভরে উঠত, সেকথা তাঁরা ভাবতেও পারেননি।
॥ ৮ ॥
দেখতে দেখতে ১৯১৮ এসে পড়ল। সেবার আমাদের বাড়িতে গরমের সময় চাঁদের হাট বসেছিল। মাসিমা নোটন বোধহয় তার আগেই কলকাতায় ফিরে গেছিলেন। তাঁদের আসাটা স্পষ্ট মনে পড়ে, অথচ ফিরে যাওয়ার কথা মনে নেই। বড় বড় মোটর-বাসে করে কলকাতার দল এসে পৌঁছল । আমরা সকলে মিলে মোটর অপিসে গেলাম, বড়দা, বৌঠান, ছোটজ্যাঠামশায়ের দুই মেয়ে তুতুদি আর বুলুদি। পাঁচ বছর আগে যখন কলকাতায় গেছিলাম ওরা আমাদের ওপর কি দৌরাত্ম্যই না করেছিল। আমাদের চাইতে ৫/৭ বছরের বড় ; ওদের শাসনের চোটে আমরা তটস্থ। কাঁদলে বলত, ‘ছিঁচকাদুনির নাকে ঘা !’ নালিশ করলে বলত, ‘নালিশ করলে বালিশ পায় !’ দু চক্ষে দেখতে পারতাম না ওদের। এবার কিন্তু যখন নীল, গোলাপী শাড়ি পরে মোটর থেকে নামল, মাথায় এই বড় বড় খোঁপা বাঁধা, গলায় সোনার মটর-মালা, তাই দেখে দিদি আমি মুগ্ধ ! তার ওপর নান্কুদা তো ছিলই। তার গল্প আগের চাইতেও ক্ষুরধার হয়ে উঠেছিল। একটিমাত্র নিয়ম হল বড়দের কিছু বলতে পাবে না। অবিশ্যি বড়দের নিয়েই যখন বেশির ভাগ গল্প, এমনিতেও কিছু বলতাম না। আমার মাকে আর ওর নিজের মাকে ছাড়া সক্কলকে নিয়ে গল্প ! আর সে কি গল্প । বড়রা যে এরকম কাণ্ড করতে পারে তা আমরা ভাবতেও পারতাম না। বলা বাহুল্য সব বানানো গল্প এবং সেটা আমরা খুব ভালো করেই জানতাম, তবু বেজায় উপভোগ করতাম। অদ্ভুত এক ভাষা ছিল ওর, ‘কিউল’ মানে ইয়ং লেডি, ‘স্ট্রাক্’ মানে তাকে ভালো লাগল, ‘হিঁক্’ মানে তার সঙ্গে প্রেমে পড়ল। প্রেমের ব্যাপার আমাদের জানতে বাকি ছিল না। স্কুলের ফিরিঙ্গি সহপাঠিনীরা আয়াদের হাতে করে কাছেই সেন্ট এডমণ্ড্স্ স্কুলে তাদের বয়ফ্রেণ্ড্দের যে প্রেম-পত্র পাঠাত, সেকথা তারা আমাদের কাছে গর্ব করে বলত। আমরা হাঁ করে শুনতাম। কৌতূহলও হত কম নয়। ই কি রে বাবা ! এমন তো কখনো দেখিনি ! বাড়িতে কিছু বলতাম না। সে যাক্ গে, কোত্থেকে ঐ-সব ভাষা সংগ্রহ করত নান্কুদা তা জানি না। মাঝে মাঝে সংস্কৃত ধরনের কথাও বলত, “দীপ্যমান” মানে সুন্দর দেখতে। কিন্তু সুন্দর দৃশ্য বোঝাতে হলে বলতে হবে ‘অক্ষট’ দৃশ্য ! এই খামখেয়ালী ভাব ওর বাড়তে বাড়তে শেষে আশ্চর্য সব খেয়ালরসে ভরপুর গল্প লিখিয়ে ছেড়েছিল। সে-রকম গল্প বাংলায় আর নেই। আমি যেমন গল্প বলে ভাই-বোনদের বশ করতাম, নান্কুদাও তেমনি আমাকে সুদ্ধ বশ করেছিল । ও খালি বলত, ‘কাউকে বললে আর গল্প বলব না।’ কাউকে মানে বড়দের কাউকে । ওর নিজের তখন বছর কুড়ি বয়স হবে, কিন্তু ও নিজেকে বড়দের দল থেকে আলাদা করে রাখত। এটা আগেরবার একদিন বলেছি, “ও পারেতে যেও না ভাই, ফটিং টিঙের ভয় ! তিন মিন্সের মাথা কাটা পায়ে কথা কয় !”
আমরা বললাম, “জানি, জানি, আমাদের ছড়ার বইতে আছে।” নান্কুদা চোখ পাকিয়ে বলেছিল, “তা জানতে পার, কিন্তু আমি নিজের চোখে ও-সব দেখে এসেছি। কলকাতার কাছেই, গঙ্গার ওপারে । স্টীমারে করে যাওয়া যায় !” আমরা বিশ্বাস করব কি না ভেবে পাইনি। এবার অন্য ধরনের গল্প বলত, তার বেশিরভাগই অদ্ভুত মজার।
সবাই মিলে বেশ জমিয়ে তুলেছিল। বড়দা, বৌঠান সব সময় আমাদের বাড়িতে থাকতেন না, ওঁদের আরো আত্মীয়রা এসেছিলেন। বৌঠানের ছোট ভাই টুটুদা যার বাড়িতে যেদিন ভালো মাছ আসত, সেদিনটা তার বাড়িতে কাটাত। আমাদের বাড়িতেও কে জানে কোথা থেকে নোনা ইলিশ আসত, চিংড়ি-মাছ আসত। সম্ভবতঃ অনেক দাম দিয়ে আনানো হত । বৌঠান যেমন চমৎকার গান গাইতেন, তেমনি রাঁধতেন। ঐ-সব মাছ বৌঠান রেঁধে খাওয়াতেন। এত ভালো হত যে স্কুল থেকে ফিরে একেক দিন দেখতাম আমাদের জন্য একটুও বাকি নেই ! ভীষণ রেগে যেতাম।
আর বড়দার কথা, কি করে বলি । ছোটবেলা থেকে মায়ের মুখে বড়দি অর্থাৎ সুখলতাদি আর বড়দার গল্প শুনে এসেছি। দুজনেই বড় ভালো, কিন্তু বড়দি বেজায় ভীতু, আর বড়দা বেজায় মজা করতে ভালোবাসত। বড়দাকে দেখলাম মোটাসোটা, কোঁকড়া-চুল, হাসিখুশি মানুষ। তবে নান্কুদার মতো আমাদের নিয়ে জমাতেন না। একটি দিনের অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়। বৌঠানের আত্মীয় অবিনাশবাবু মস্ত এক পিক্নিক্ দিলেন। শহরের উপকণ্ঠে পল্টনের চাঁদমারি। সেখানে মাঝে-মাঝেই সেপাইরা নিশানা করতে শেখে। সে এক মজার ব্যাপার। দূরে পাহাড়ের গায়ে চাকা দেওয়া দুটি বাক্স রেলের ওপর চলে ফেরে। তাদের গায়ে বড় করে দুটি টারগেট্ আঁকা । গোল গোল দাগ কাটা চাকতি, মধ্যিখানে একটা চোখ। দূর থেকে বন্দুকের নিশানা ঠিক করে ঐ চোখটাকে মারতে হবে । ঠিক জায়গায় লাগলে চাকতিসুদ্ধ গাড়িটা রেলের ওপর গড়িয়ে সরে যেত । আড়াল থেকে বোধহয় টেনে নেওয়া হত। গোল দাগের ওপর লাগারও সঙ্কেত ছিল। আর বাইরে লাগলে গাড়ি নড়ত না। অনেকক্ষণ ধরে এই ব্যাপার দেখতাম আমরা, ভারি আশ্চর্য লাগত।
জায়গাটার নামই হয়ে গেছিল চাঁদমারি। খানিকটা বন, বনের পর খানিকটা ঘাসজমি, তার ওপর দিয়ে এঁকে-বেঁকে একটা নদী চলে গেছে। কিছু দূরে একটা ঝরণা ; ঝরণার নাম পরী-তলা। বড় সুন্দর জায়গা। কিন্তু সেখানে একটা ঘূর্ণি-জল ছিল, মাঝে মাঝে অসাবধান ছেলেরা পরীতলায় স্নান করতে নেমে, ঘূর্ণি-জলে পড়ে আর উঠতে পারত না। পরী-তলার চেহারা মনে করতে পারি না ।
ঐ চাঁদমারিতে মাঘোৎসবের সময় ব্রাহ্মরা এবং তাঁদের বহু হিন্দু বন্ধু-বান্ধবরা দল বেঁধে চাঁদা করে চড়ি-ভাতি করতেন। উপাসনা হত, গান হত, গাছতলায় সারি সারি বসে খিচুড়ি, আলুর দম, কপি ভাজা, টোমাটোর চাটনি, দই, বোঁদে খাওয়া হত । ঢালু জমির ওপর পাত পড়ত, দই গড়িয়ে যেত, খিচুড়ি দিয়ে বাঁধ দিতে হত। চাঁদমারি আমাদের চেনা ব্যাপার।
এবার গিয়ে দেখলাম জায়গাটার ভোল বদলে গেছে। সাদা পোশাক পরা বয় বেয়ারারা সবাইকে চা, স্যাণ্ডউইচ্, ‘মোরেলো’র দোকানের কেক দিচ্ছে। গাছতলায় মস্ত ফরাস পাতা হয়েছে, তার ওপর গোল হয়ে উৎসুকভাবে সবাই বসে আছেন। এক ধারে বড়দা দাঁড়িয়েছেন, হাতে একটা খাতা, সবার চোখ তাঁর ওপর। অদূরে মধ্যাহ্ন-ভোজের জন্য পোলাও মাংস রান্না হচ্ছে, তার একটু একটু গন্ধ ভেসে আসছে । মাথার ওপর গাঢ় নীল আকাশ ; পাশ দিয়ে কলকল করে নদী বয়ে যাচ্ছে। বড়দা হাসিমুখে চারদিকে একবার তাকিয়ে একটু গলা খাঁকরে ‘ভাবুক-সভা’ পড়তে শুরু করলেন।
‘ভাবুক-সভা’ বড়দার ২০/২১ বছর বয়সে লেখা বোধহয় সন্দেশে বেরিয়ে থাকবে, আমাদের পড়া জিনিস। কিন্তু পড়া যে এমন রঙ্গ-রসে ভরা হতে পারে এ আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। সে কি মুখ-ভঙ্গি, সে কি হাত পা নাড়া, কথার মধ্যিখানে সে কি রস। সাজ নেই, দৃশ্যপট নেই, প্রকৃতির সেই দৃশ্যপটের মধ্যিখানে এ কি রসের ধারা? কি একটা বাক্যাতীত ভাবে আকণ্ঠ ভরে গেছিল, হাসতে ভুলে গেছিলাম। পড়া শেষ হলে সকলে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে, এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল। একটা মানুষের গলার এমন সমারোহ যে হতে পারে কেউ জানত না। সম্বিৎ ফিরে এলে সব খুশিতে ফেটে পড়ল।
তখন কি আর কেউ বড়দাকে ছাড়ে? ‘চলচ্চিত্ত-চঞ্চরি’ পড়তে হল । আবার সেই সম্মোহিত ভাব । এখন মনে হয় একটা পর্যায়ে পৌঁছবার পর আর হাসি দিয়ে হর্ষ প্রকাশ করা যায় না । শুধু কথাগুলি নয়, মানুষটাও পড়ার মধ্যে নিজের অন্তরের অনেকখানি দিয়ে দিতেন। এমন আর শুনিনি। কলকাতায় ওঁদের নন্সেন্স ক্লাব ছিল, মণ্ডে ক্লাব ছিল, সেখানে রসের কৃষি কাজ হত। তেমনি সব সাকরেদ জুটেছিল বড়দার ; প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। হ্যাঁ, আমাদের মাস্টারমশাই সুনীতিকুমার। তিনি যখন পি-আর-এস্ হলেন, ক্লাবের বন্ধুরা তাঁর ঘাড় ভেঙে ভুরি-ভোজন করেছিলেন। সাড়ে সতেরো টাকা খরচ পড়েছিল, পুরনো খাতায় দেখেছি। এতকাল পরে সেই সুনীতিকুমার-ও রঙ্গ-মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। বলা বাহুল্য আমরা এ-সমস্ত থেকে বাদ পড়েছিলাম। প্রথম কথা, আমরা অকুস্থলে ছিলাম না। দ্বিতীয় কথা, আমরা থাকলেও নিঃসন্দেহে আমাদের তিনতলায় নান্কুদার ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হত। যে-দিনের কথা বললাম, সেদিন আমি ধারণা করতে পারিনি একটি মানুষের হৃদয় এত রসের উৎস হতে পারে।
এর পর থেকে বড়দার প্রতি আমাদের ভক্তি শতগুণ বেড়ে গেল। সন্দেশে প্রকাশিত বড়দার কবিতাগুলো সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আগাগোড়া মুখস্থ হয়ে যেত । নাটকগুলিও তাই বড়রা অনেক সময় বিরক্ত হতেন। কেউ কেউ বলতেন, “একই কথা রোজ-রোজ একই ভাবে উচ্চারণ করে, তোরা কি এত হাসির খোরাক পাস্?” হাসির কারণ বাত্লানো যায় কখনো? যার স্থান মস্তিষ্কে তার কারণ থাকে আর যার স্থান হৃদয়ে তার আবার কি কারণ থাকতে পারে। তবে ইংরিজিতে ‘ফানিবোন্’ বলে একটা কাল্পনিক হাড্ডির কথা আছে, সেটাই নাকি হাসির কারণ। মোট কথা, বড়দা আমাদের প্রথম ও শেষ হাসির পাঠ দিয়েছিলেন। জ্যাঠামশায়ের লেখায় যথেষ্ট সরসতা ছিল, কিন্তু সে-সব হল প্রাসঙ্গিক হাসি, আর বড়দার বেলায় হাসিটাই ছিল প্রসঙ্গ। সেই হাসি ধরিয়ে দিলেন বড়দা। নিজে যখন চলে গেলেন, তাঁর বয়স ছত্রিশ, আমার বয়স পনেরো, তবু সে রসটুকু আজ পর্যন্ত মনের মধ্যে লেগে রইল। তখন থেকে নাটক লেখার শখ হয়েছিল, কিন্তু সে তো আর চাট্টিখানি কথা নয়।
রবীন্দ্রনাথের সেই যে কড়া সেজদা, যাঁর জ্বালায় স্কুল থেকে রেহাই পেয়েও তিনি পড়া থেকে রেহাই পাননি, সেই হেমেন্দ্রনাথের মেয়ে মনীষাদেবী তাঁর রুগ্ন স্বামীকে নিয়ে শিলং-এর কেঞ্চেস্ ট্রেসে থাকতেন। দিদি, আমি তাঁর কাছে গান শিখতে যেতাম। দুঃখের বিষয় গলায় আর সুর নামল না ! হেমেন্দ্রনাথ বেশি দিন বাঁচেননি । মনীষাদেবীরা কয় ভাইবোন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের হেপাজতে জোড়াসাঁকোতে মানুষ হয়ে, সেখানকার সংস্কৃতির ধারা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। রুগ্ন স্বামীর সেবা তাঁকে নিরুৎসাহ করতে পারেনি । মনীষাদেবীর দিদিরা নাম-করা মেয়ে ; লেডি প্রতিভা চৌধুরী, ‘আমিষ ও নিরামিষ রন্ধনে’র রচয়িতা প্রজ্ঞাদেবী, অভিজ্ঞাদেবী।
এই সময় তাঁদের বাড়িতে “লক্ষ্মীর পরীক্ষা” অভিনয় করা হল। সম্ভাব্য সব মেয়েদের সংগ্রহ করা হল। বুলুদি কলকাতায় ব্রাহ্ম-বালিকা-শিক্ষালয়ের পুরস্কার বিতরণ উৎসবে ক্ষীরির পার্ট করে প্রশংসা পেয়ে এসেছিল, তাকেই ক্ষীরি করা হল । তুতুদি হল লক্ষ্মী। আমরা কিনি-বিনির দলে। মনীষাদেবীর বাড়ির হলঘরে কাঠের মঞ্চ বেঁধে অভিনয় হল। সঙ্গে আরো গানটান হল। তাঁদের বাড়ির সকলে সঙ্গীত-বিলাসী, গাইয়ের অভাব হল না। যে যার বাড়ি থেকে রঙীন শাড়ি, গিল্টি গয়না, পুঁতির মালা এনে দিল।
মনে হচ্ছে এর মধ্যে বড়দা, বৌঠান কলকাতায় ফিরে গেছিলেন, কারণ ঐ উৎসবে তাঁদের উপস্থিতি মনে পড়ছে না। এককথায় অপূর্ব অভিনয় হয়েছিল। সকলে বুলুদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ক্ষীরি নয়তো সত্যিকার ঝি !! সে কি অঙ্গভঙ্গি, মুখ-বিকৃতি ! বড়দা নাকি কলকাতায় সব শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকে বড়দার নাটকের শখ। যেখানে যা দেখে আসতেন, বাড়িতে করে দেখাতেন। নিজেও বানিয়ে বানিয়ে লিখতেন, তখন তাঁর বয়স তেরো-চোদ্দর বেশি নয়। একটা খেলাই ছিল কে কত ভালো ভেংচি কাটতে পারে। ভেংচি কাটায় বড়দার মেজবোন পুণ্যলতা চক্রবর্তী ৮০ বছর বয়সেও কম দক্ষ ছিলেন না। এই একটা আক্ষেপ থেকে গেল। ছোটদের জন্য বাংলায় কেউ তেমন হাসির নাটক লিখল না। নাটক বলতে আমি মঞ্চ-সজ্জা আর আবহ-সঙ্গীত ইত্যাদি বুঝি ! নাটকের একমাত্র উপজীব্য হবে তার রস। এমন নাটক যা পড়লেই মজা লাগবে, যেমন বড়দার লক্ষ্মণের শক্তিশেল, শব্দকল্পদ্রুম। আমার সেই ছেলেবেলার স্বপ্ন কার্যে পরিণত করে উঠিনি। আরো জনা-কতকের মতো মাত্র গোটা তিনেক লিখেছি। তার শতগুণ দরকার। আবিলতা কাটবার জন্য এমন জিনিস আর কি আছে? আমাকে দিয়ে তো বিশেষ কিছু হল না। অন্যরা করবে এই আশা নিয়ে বসে আছি। ভাবতে ভারি আশ্চর্য লাগে এই ষাট বছরের মধ্যেও কেউ কিছু তৈরি করে সকলকে তাক্ লাগিয়ে দিল না কেন?
গরমের ছুটিও শেষ হয়ে এল, অতিথিরাও সকলে বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে বিদায় নিল। জীবনটা একটু নীরস মনে হতে লাগল। তুতুদি বুলুদি রোজ দুবেলা ওদের ঢাকাই শাড়ি, টাঙাইল শাড়ি, পাড় লাগানো রেশমী শাড়ি খাটের ওপর সাজিয়ে, কোন জামার সঙ্গে কোনটা পরবে ঠিক করছে না ! এ-সব আগে আমাদের জানা ছিল না। মা যে জামা করিয়ে দিতেন তাতেই আমরা খুশি । আমার জন্মদিনের জন্য হাতে গলায় কুঁচি দেওয়া, গোলাপী একটা ফ্রক্ করে দিয়েছিলেন মা, আমার সেটি ভারি পছন্দ। গর্ব করে বের করে দেখাতেই তুতুদি নাক সিটকে বলেছিল, “এমা ! এইরকম সূতির জামা আমাকে দিলে আমি ফেলে দিতাম!” আমি তো শক্ড্। অন্তরালে গিয়ে জামাটাকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখেছিলাম এবং তবু ভালো লেগেছিল। অন্যদের মতামতে কোনোদিনই বেশি কান দিতাম না। সবাই আমাকে দুষ্টু মেয়ে বলত। পড়ায় ভালো হলে কি হবে।
দুষ্টু মেয়ে বলতে মনে হল, যখন আমার বছর আষ্টেক বয়স তখন একদিন বাবার চাপরাশীর সঙ্গে দিদি আমি স্কুল থেকে ফিরছি। দিদি তার ছাতাটি চাপরাশীর হাতে দিয়ে, সভ্যভব্য হয়ে চলেছে, যেমন সর্বদাই চলত। আমি কিছুতেই ছাতা ছাড়িনি। সেটি ধরে ঠুক ঠুক করে চলেছি। চাপরাশী কেবলি সেটা টেনে নেবার চেষ্টা করতে লাগল, অত ঠুকলে আগার মুট্কিটা খুলে আসবে। ওর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য, ছাতা হাতে, পথ ছেড়ে, পাহাড়ের পাড়ির ওপর উঠলাম। খানিকটা বাঁধের মতো করা, তার ওপারে নালা দিয়ে বর্ষার সময় বৃষ্টির জল বয়ে যেত। সে সময় নালা শুকনো । আমি পাড়ির ওপর দিয়ে ছাতা ঠুকতে ঠুকতে চললাম । ভুলেই গেছিলাম যে পাহাড়টার ওপরেই বাবাদের আপিস ।
চাপরাশী বেশ চটেছিল। আমার নাগাল না পেয়ে বলল, “বড় মিসিবাবা ভারি ভদ্দরলোক।” থমকে দাঁড়ালাম। ব্যাটা বলতে চায় কি? আমি ভদ্দরলোক নই, এই তো ! রেগেমেগে রাস্তায় নেমে, চাপরাশীর পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলাম। কি করে লোকটাকে জব্দ করা যায়? হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল। ছাতাটা উল্টে ধরে, বাঁকা বাঁটটি চাপরাশীর রোগা ঠ্যাং-এ লটকে দিয়ে, মারলাম জোরসে এক টান। দুঃখের বিষয় এই পড়ি-ওই পড়ি করেও ব্যাটা সামলে নিল। দিদি পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, “আঃ! এ-সব কি হচ্ছে?” আমি কি আর সেখানে থাকি? এক দৌড়ে বাড়ি।
দিদি কিম্বা চাপরাশী কেউ কিছু বলেনি। মাকে বললেও কিছু এসে যেত না, বড় জোর একটা ধমক দিতেন। বাবা না জানলেই হল। বাবা যখন বাড়ি এলেন, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ; দিদি, আমি, দাদা, কল্যাণ ঘরে বসে ক্যারাম খেলছি। প্রশান্তদা সেবার কলকাতায় ফিরেই ক্যারামের সেট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চা খেতে খেতে বাবা হঠাৎ বললেন, “লোকটা তো বড় দুষ্টু, মা, কিছুতেই পড়ল না?” আমি তো থ ! চেয়ে দেখি বাবা মুচকি হাসছেন। মা, মাসিমা, জানতে চাইলেন কি ব্যাপার? বাবা বললেন, “প্রফুল্ল হঠাৎ ডেকে বলল, দেখুন দাদা, আপনার বাঁদর মেয়ের কাণ্ড !” গিয়ে দেখি এত কায়দা করা সত্ত্বেও লোকটা কিছুতেই পড়ছে না। এ ভারি অন্যায় ! এইরকম ছিলেন আমার বাবা। মজা লাগল তো সাত খুন মাপ। আর অন্যায় ভাবলেন তো কোনো যুক্তি শুনবেন না। এমন মানুষটার সঙ্গে আমার চিরকালের মতো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল । কি আর করা। আবার যদি ঐ রকম পরিস্থিতি হত, নিঃসন্দেহে বলতে পারি, তার আবার ঐ পরিণামই হত। তবু বলি আমার বাবার মতো সৎ, সত্যবাদী, সৎসাহসী ও সেই সঙ্গে সরস মানুষ আর দেখিনি।
ক্রমে ১৯১৮ শেষ হয়ে এল। এমন সময় একটা সাংঘাতিক বিপর্যয় ঘটে গেল। কাঞ্জিলাল জ্যাঠামশাইরা বাড়ি ছেড়ে, শিলং ছেড়ে চলে গেলেন। ওঁর বদলে ঐ বাড়িতে একজন অচেনা লোক এলেন। তবে ওঁরা যাবার বেশ কিছু আগে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল, সেটি আমরা ভারি উপভোগ করেছিলাম। একদিন ভোরে উঠে দেখি, বসবার ঘরে কাঞ্জিলাল জ্যাঠাইমা বসে আছেন। আমরা মুরগি খেতাম বলে উনি আমাদের খাবার ঘরে ঢুকতেন না। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। ওঁদের বাড়িতে পয়সা আর বাতাসার হরির লুট হত ; সত্যনারায়ণের পুজো হত ; আমরা কখনো বাদ পড়তাম না। যদিও ঠেলাঠেলি করে পয়সা কুড়োতে আমার কেমন অপমান লাগত। একটা পয়সাও কখনো পেতাম না। যাই হোক, জ্যাঠাইমাকে আমরা ভালোবাসতাম।
আমাদের দেখেই তিনি বললেন, “আজ তোদের মায়ের খোকা হবে, তাই এ-বাড়ির হাওয়া লাগিয়ে যেতে এসেছি। পর পর চারটি ছেলে হওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমার এই বৌমার খালি মেয়ে হয়। দেখি, এখানকার হাওয়া লেগে যদি কিছু হয়।”
ঠিক সেই সময় লেডি ডাক্তার মিস্ জোন্স্ এসে দিদিকে আমাকে বললেন, “বোন হয়েছে। খুশি হওনি? যাও গিয়ে দেখে এসো !” আমরা বোন দেখতে ছুটলাম, কি জ্যাঠাইমা আর এক মুহূর্তও বসলেন না, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। সুখের বিষয়, এত প্রতিবন্ধক সত্ত্বেও তাঁর বৌমার ছেলে হয়েছিল। আমরা আটকুড়েতে গিয়ে বাঁশের কঞ্চি পিটিয়ে, ভাজাভুজি আর মিষ্টি খেয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম এবং হাঁসরা সেদিনও আমাদের তাড়া করেছিল।
সেই জ্যাঠাইমারা সত্যি সত্যি যখন জিনিসপত্র বেঁধে, পরদা নামিয়ে, গোরু বেচে, পাড়া অন্ধকার করে চলে গেলেন, কি যে কান্না পেয়েছিল কি বলব।
॥ ৯ ॥
১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার দশ বছর পূর্ণ হল। হাইউইণ্ড্স্-এ আমরা এত দিন এত আরামে বাস করেছিলাম যে অন্য কোনোরকম জীবনের কথা ভাবতেও পারতাম না। কিন্তু কলকাতার কথা মনে করলেই মনটা চঞ্চল হয়ে উঠত। আর ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রের ধারে আমাদের দেশের কথা। যামিনীদার কাছে কেবলি জিজ্ঞাসা করতাম। যামিনীদার সঙ্গে আমাদের খুব সদ্ভাব ছিল না এ-কথা আগেও বলেছি। রান্নাঘরটি আলাদা একটা বাড়িতে, তার পাশে ছোট্ট জল-গরমের ঘর । সেখানে তিনটি বড় বড় পাথর বসিয়ে উনুন তৈরি করা হয়েছিল। তাতে কাঠের জ্বালে কেরোসিনের টিন বসিয়ে আমাদের সংসারের স্নানের জল গরম করা হত। কাঁচা কাঠ থেকে প্রচুর ধোঁয়া আর মিষ্টি একটা গন্ধ বেরুত। ছুটির দিন দুপুরে ঐখানে আমাদের আড্ডা বসত। রান্নাঘরে ঢুকবার উপায় ছিল না। খাওয়া-দাওয়া হলে, ঘরের শিকল তুলে তালা দিয়ে, যামিনীদা নিজের ঘরে শুতে চলে যেত। সে বেশ খানিকটা দূরে, একেবারে বাড়ির শেষ সীমানার কাছে, নদীর উঁচু পাড়ে । তারি এক ধারে ঘোড়ার আস্তাবল, আস্তাবলের গা ঘেঁষে ঘোড়া-নিমের গাছ, মার্চ এপ্রিল মাসে তার নীল ফুল পড়ে গাছতলাতে গাল্চে বানিয়ে রাখত। যামিনীদা ঘোড়া, কিম্বা সইস, কিম্বা নিমগাছ, কোনোটাই পছন্দ করত না। কিন্তু অনেক গল্প জানত।
যাই হোক যামিনীদা ঘরে গেলে আমরা বুনো আপেল পোড়াবার জন্য গরম-জলের ঘরে ঢুকতাম । বুনো-আপেলের গাছটা আবার রান্নাঘরের গা ঘেষে হয়েছিল। ফলগুলো মগ্ডালের কাছে ঝুলে থাকত। খুঁচিয়ে পাড়ার মতো লম্বা। বাঁশ কোথায় পাব? আমরা ঢিল ছুঁড়ে ফল পাড়তাম। ঢিলগুলো অনেক সময় রান্নাঘরের ছাদে পড়ত। ছাদের তলায় কাঠের উনুনের ঝুল-কালি জমে থাকত ; উনুনে বড় কড়াইতে দুধ বসানো থাকত। ঢিল পড়লেই ঝুল-কালির খানিকটা খসে দুধের ওপর পড়ত। যামিনীদা তাই নিয়ে বেজায় অশান্তি করত । কিন্তু সে তো বিকেলের আগে নয়। দুপুরে আমরা জল-গরমের উনুনের গরম ছাইতে বুনো-আপেল পুড়িয়ে খেতাম । তার মিষ্টি গন্ধ এখনো নাকে লেগে আছে।
সরলগাছের হাওয়া নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে বেজায় ভালো। এমনিতে আমাদের স্বাস্থ্য ভালো না হয়ে উপায় ছিল না। সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু জায়গায়। পরিষ্কার বাতাস, টাকায় সাত-আট সের দুধ, চার পয়সা ডিম, প্রচুর ফল, তরকারি ; রোজ দু-বেলা দেড় মাইল হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসা, সময় মতো খাওয়া-শোয়া। স্বাস্থ্য ভালো হবে না তো কি? ওখানকার প্রধান শত্রু ছিল শীত। শীতে আমাদের কি করতে পারত? লম্বা হাতা উঁচু গলা খাঁটি পশমের সোয়েটার পরতাম, লম্বা লম্বা গরম মোজা পরতাম, জুতো ভিজলেই জুতো বদলাতাম। বেশী শীতের সময় রোজ সকালে বড় চিমনিতে আগুন দেওয়া হত। অনেক সময় বিকেলে আরেকবার চিমনি জ্বলত । কাঁচা পাথর কয়লার চাংড়া অনেকক্ষণ ধরে জ্বলত ; তার ভিতর থেকে লাল নীল আলো বেরোত,। সামনে বসে কত অগ্নিকাণ্ড, কত যুদ্ধ-ক্ষেত্র কল্পনা করা যেত।
ভালো স্বাস্থ্যের এত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও দাদা আর আমি টন্সিল ব্যথায় ভুগতাম। এমনি টন্সিল ফুলে যেত যে গিলতে কষ্ট হত। সরকারি হাসপাতালের সুশীল ডাক্তার আমাদের ওষুধপত্র দিতেন। তিনিই আমাদের টন্সিল কেটে দিলেন। সে অপারেশনের কথা ভাবতে বেশ মজা লাগে। বাবার সঙ্গে মাইল দুই হেঁটে আমরা মোটর আপিসের কাছে হাসপাতালের আউট ডোরে গেলাম। প্রথমে দাদাকে একটা টুলে বসিয়ে হাঁ করতে বলা হল। দাদা হাঁ করল। একটা তুলিতে কোকেন লাগিয়ে টন্সিলে মাখানো হল। দাদা তারপর মুখ বন্ধ করে দু মিনিট বসে রইল। তারপর আবার হাঁ করতে বলা হল। দাদা হাঁ করতেই সুশীলবাবু মজার একটা যন্ত্র গলায় ঢুকিয়ে কুচ্-কুচ্ করে দুপাশের টন্সিল দুটি কেটে, কিড্নি বোলে ফেলে, আমাকে বললেন, “এসো, এবার তোমার পালা!”
দেখলাম দাদার চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল । কিন্তু টু শব্দ না করে টুল থেকে উঠে বাবার পাশে এসে দাঁড়াল। কিড্নি বোলে লাল মাংসের টুকরো দুটো দেখে আমার বমি পাচ্ছিল। কিন্তু বাবাকে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। টুলে বসে হাঁ করলাম। গলায় কোকেন লাগাবার পরেই মনে হল গলায় মস্ত একটা কি আট্কে আছে। হাঁ করেই রইলাম। সুশীলবাবু সেই যন্ত্রটাকে ওষুধ দিয়ে ধুয়ে আমার গলায় ঢুকিয়ে কুচ্ কুচ্ করে দু-পাশ থেকে দু-চাকলা কেটে কিড্নি বোলে ফেলে বললেন, “বড্ড বড় টন্সিল সবটা ধরা গেল না। দেখি আরেকবার।” বলে আবার আমাকে হাঁ করিয়ে আরো দু-চাকলা কেটে আনলেন। রক্ত গিলে গিলে আমার অবস্থা কাহিল। ভয়ের চোটে কাঁদতে পারছিলাম না। ডাক্তার যেই বললেন, “আরেকটু আছে।” বাবা হঠাৎ ছুটে এসে, আমাকে জড়িয়ে ধরে কি রকম অন্য রকম গলায় বললেন, “থাক, ঢের হয়েছে। মেরে ফেলবেন নাকি ।”
ডাক্তার ভারি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “সত্যি এই যন্ত্রটা দিয়ে ধরতে পারছি না.। এক উপায় ক্লরোফর্ম করে তবে কাটা ।” শেষ পর্যন্ত তাই করা হল। যেমন ছিলাম, জুতো খুলে একটা খাটে শুলাম। ক্লরোফর্ম করে টন্সিল কাটা হল । সুশীলবাবুর টমটম গাড়ি করে বাড়ি ফিরলাম। কয়েক দিনেই সেরে গেলাম, কোনো কু-ফল হল না, কিছু না। খালি এখন পর্যন্ত থেকে থেকে নেই-টন্সিলে বেজায় ব্যথা হয়। কারণ তার গোড়াটা থেকে গেছে। সেকালে আজকালকার মতো গোড়াসুদ্ধ উপড়ে আনা হত না। তাই হয়তো পাঁচ ফুটের বেশি মাথায় লম্বা হলাম না। টন্সিল কাটলে নাকি সবাই সঙ্গে সঙ্গে পা ছেড়ে দেয়।
শিলং-এর একেকটা গন্ধ আজো আমার নাকে লেগে আছে। একটি হল বনের গন্ধ। সে বড় সুগন্ধ। বাবা আমাদের ওখানকার সংরক্ষিত বন দেখতে নিয়ে যেতেন। মধ্যিখান দিয়ে সরু পথ চলে গেছে, দু ধারে বন। মাটির কাছটি অনেকখানি ফাঁকা, উচুতে ডালে ডালে জড়িয়ে চাঁদোয়া তৈরি করে রেখেছে, তার ভিতর দিয়ে অতিকষ্টে টুকরো টুকরো রোদ ঢুকে পায়ের নিচে জমে থাকা সরলগাছের শুকনো পাতার ওপর পড়ে। তার ওপর হাঁটা মুশ্কিল, বেজায় পিছল। কিন্তু তার ধূপ-ধুনোর মতো গন্ধটি বড় মিষ্টি। বুড়ো গাছের গায়ে কোথাও অর্কিড, আবার কোথাও লাইকেন বলে পরগাছা। তারো কেমন একটা শুকনো পাতার মতো গন্ধ।
হাতে করে তুলে দেখেছি, ফিকে সবুজ রঙ, ধরতে বড় শক্ত। আমরা বলতাম, বুড়ির চুল’, কিম্বা ‘বুড়োর দাড়ি’। এখনো হয়তো হয় ওখানকার গাছে আঠাশ বছর পরে একবার দেখতে গেছিলাম। সংরক্ষিত বনে যেতে এখন অনুমতি-পত্র লাগে। বাইরে থেকে দেখলাম। এক জায়গায় একটিও সরলগাছ নেই, তার বদলে ত্রিশ ফুট উঁচু ঝাউ-গাছ, সোজা সোজা, সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে । সে-বন আপনি হয়েছিল, সরলগাছের গুটি থেকে পাখনাওয়ালা বিচি পড়ে আর এ-গাছ লাগিয়েছে দড়ি দিয়ে মেপে সমান দূরে দূরে, বন বিভাগের কর্মীরা। সেই আমাদের একান্ত আপনার বনটিকে আর খুঁজে পেলাম
একটুখানি শীতের ছোঁয়া লাগতেই চির-শ্যামল সরল আর ঝাউ ছাড়া প্রায় সব গাছের রঙ বদলাত, সবুজের বদলে হলুদ, লাল, পাটকিলে, কালচে। তারপর পাতা খসে পড়ে, শীতের বাতাসে উড়ে বেড়াত । মালি তার লম্বা কাঁটা দিয়ে সেগুলিকে এখানে ওখানে জড়ো করত। একেক দিন সন্ধ্যেবেলায় পাতার ঢিপিতে আগুন লাগানো হত। আমরা তার চারদিকে জড়ো হতাম। সামনের দিকটা আগুনে গরম হয়ে যেত, চোখ-মুখ লাল দেখাত, পিঠটি কনকনে ঠাণ্ডা। মাথার চুলে, সারা গায়ে পোড়া পাতার গন্ধ লেগে থাকত। আমার কাছে ঐ-সব হল শৈশবের গন্ধ ; শুকনো ঘাসের, ঝরা পাতার, পোড়া পাতার, ধূপকাঠের গন্ধ।
বছরটা ক্রমে শেষ হয়ে এল। শুনতাম যুদ্ধও নাকি শেষ হয়ে আসছে। সেই প্রথম মহাযুদ্ধ কোনো দিনই আমাদের খুব কাছে আসতে পারেনি। জিনিসপত্রের দাম কিছু বেড়ে থাকতে পারে, আমরা টের পাইনি। শৌখীন জিনিস আমদানী বন্ধ হয়েছিল বটে তবে তার সঙ্গে আমাদের কি? একটি জিনিস মাত্র মনে লেগেছিল, সেটি হল বিলেত থেকে ওষুধ আসেনি বলে জ্যাঠামশাই মারা গেলেন আর মা তারপর কত দিন ভালো করে হাসেননি, গল্প করেননি। পরে অবিশ্যি জ্যাঠামশায়ের অপরিসীম স্নেহের কথা অনেক বলেছিলেন। হয়তো একবার যদি এসে তিনি মায়ের কাছে কয়েকদিন থেকে যেতেন, তাহলে মায়ের অত কষ্ট হত না।
আরেকটি মানুষকে ভুলতে পারি না, সে আমাদের আয়া ইল্বন। অন্যান্য খাসিয়া মেয়েদের থেকে সে একটু আলাদা রকমের ছিল। তারা ‘উদ্খারে’র বাড়িতে খেতও না, শুতও না। উদ্খার হল খাসিয়া ছাড়া আর সবাই। কিন্তু ইল্বন আমাদের বাড়িতে খেত, রাতে আমাদের ঘরে বিছানা করে শুয়ে থাকত। অন্য খাসিয়ারা ডাকুর ভয়ে সূর্য ডোবার পর বাড়ির বার হত না। ইল্বন দিব্যি সুন্দর ঘুরে বেড়াত। বলত, “ডাকুরা আমার নিজের লোক।” বিকট সব গল্প বলত আমাদের, কিন্তু কাউকে ভালোবাসার কিম্বা আদর করার ধার দিয়েও যেত বলত, “আমার ছেলে হেড্রিক্সন তোমাদের চেয়ে ঢের ভালো।” তবে হেড্রিক্সনকে দেখাতে পারত না। কারণ, সে নাকি তার ঠাকুমার কাছে থাকত, তার বাবা ফ্রাং-এ গিয়ে নিখোঁজ। ঠাকুমা ইল্বন বাড়িতে ঢুকতে দিত না। এখন মনে করলে এর মধ্যে একটা গভীর ট্র্যাজেডির আভাস পাই, তখন কিছু মনে হয়নি। তার প্রধান কারণ ইল্বন কখনো কোনো কোমলতা দুর্বলতা প্রকাশ করত না। শেষটা কি একটা সামান্য কারণে খুব মেজাজ দেখিয়ে, গট্গট্ করে হেঁটে চলে গেছিল। আর কোনোদিন-ও আমাদের খোঁজ নেয়নি।
১৯১৮ সালে স্কুলে প্রাইজের বদলে সেই মস্ত কার্ড দেওয়া হল, তবে এই ছিল শেষ বার। শীতকালে শহরটা খালি হয়ে যেত। সব স্কুল আড়াই মাসের জন্য বন্ধ হয়ে যেত। বাড়ির সামনের পাইন-মাউণ্ট স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য মস্ত মস্ত মোটর আসত, আসলে আমরা যাকে বাস্ বলি তাই ; তবে বাস্ কথাটির তখনো চল হয়নি। জিনিসপত্র নিয়ে মহা হৈ-চৈ করতে করতে তারা দলে দলে সমতল ভূমিতে নেমে যেত। অত বড় স্কুলবাড়ি যেন ঘুমিয়ে পড়ত। তাই বলে হাঁস পেরুরা কোথাও যেত না এবং আমাদের প্রতি তাদের বিদ্বেষও একটুও কমত না। ওরা যে কি হিংস্র জানোয়ার কম লোকেই জানে। সে বছর শহরটিকে আরো বেশি ফাঁকা মনে হতে লাগল । শুনলাম কেউ কেউ শীতের পর নাকি ফিরবে না। যতদূর মনে হয় তাদের মধ্যে সুতুদি অমলদা ছিল। ওদের মতো মিষ্টি স্বভাবের স্নেহশীল মানুষ খুব বেশি হয় না। ওরা আমার ছোটমেসোমশায়ের প্রথম পক্ষের ছেলে-মেয়ে, শিলং-এ ওদের জ্যাঠামশায়ের কাছে থেকে পড়ত। মেসোমশাই রাঁচীতে, পাটনাতে নানান্ জায়গায় চাকরি করতেন। যেমন সুন্দর চেহারা মেসোমশায়ের, তেমনি সুতুদি অমলদার। ফর্সা রঙ, কাটা কাটা মুখ চোখ । সুতুদি অমলদা আমাদের চাইতে ভালো দেখতে বলে আমার কোনো আপত্তি ছিল না, ঐ মেসোমশাইকে নিয়েই একদিন গোল বেধেছিল। তখন হয়তো আমার আট বছর বয়স । অমলদা হয়তো দশ, সুতুদি এগারো । অমলদা বলেছিল, “তোমার বাবার চেয়ে আমার বাবা ফর্সা।” এ আমি কি করে সহ্য করি? আমি বললাম, “না, কক্ষণো না। আমার বাবা তোমার বাবার চেয়ে ঢের বেশি ফর্সা।” এ হেন অযথা কথা অমলদা মানতে চাইল না ; বলল, “আমি তো দেখি আমার বাবাই বেশি ফর্সা।” আমি চটে গেলাম, বেশ চড়া গলায় বললাম, “কক্ষণো না। আমার বাবা শিলং-এ সকলের চেয়ে বেশি ফর্সা।” আমার আত্ম-প্রত্যয় দেখে অমলদা হক-চকিয়ে গিয়ে থাকবে, নরম গলায় বলেছিল, “আমি ভেবেছিলাম আমার বাবাই বুঝি ফর্সা, হতে পারে তা নয়।” এই অবধি শুনে আর সইতে না পেরে, পাশের ঘর থেকে মা বেরিয়ে এসে বললেন, “বাজে বকিস্নে। তুই বাবাকে বেশি ভালোবাসতে পারিস্, কিন্তু তোর মেসোমশাই অনেক বেশি ফর্সা।” এখনো মনে আছে তাই শুনে উল্লাস করা দূরে থাকুক, অমলদা আমার দিকে সহানুভূতির সঙ্গে চেয়ে ছিল। বলেছি না, বড় ভালো ছিল ওরা। সারা জীবন ধরে একটুও বদলায়নি।
সত্যি সত্যিই পুরনো দলটাতে চিড় ধরেছিল। শুনলাম সুতুদি এখন বড় হয়েছে, তার পড়াশুনোর সুবিধার জন্য ওরা দুজনে শিলং ছেড়ে চলে যাবে। আরো বন্ধু-বান্ধব ছিল, তাদেরও কেউ কেউ চলে যাবে। সেই যে হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে মনীষাদেবী ছিলেন, যাঁর বাড়িতে অত আনন্দ করে লক্ষ্মীর পরীক্ষা অভিনয় হয়েছিল, এর মধ্যে তাঁর রুগ্ন স্বামী মারা গেছিলেন। বাগানের মধ্যিখানে একটা জালের দেয়াল দেওয়া ঘরে তিনি সারাদিন শুয়ে থাকতেন, রাতে হয়তো ঘরে আনা হত, যে-রকম শীতের দেশ। সেই মানুষটি মারা গেলেন, কয়েকদিন পরে গিয়ে দেখলাম জালের ঘর খালি পড়ে রয়েছে । মনটা খারাপ হয়ে গেল। বড় মেয়েকে আমরা সরস্বতীদি বলে ডাকতাম, আমরা ওঁদের বাড়ি গেলেই তিনি আমাদের নিজের হাতে তৈরি বিস্কুট খাওয়াতেন। বড় স্নেহশীল মানুষ ছিলেন । ওঁরা সকলেও নাকি শিলং ছেড়ে চলে যাবেন সরস্বতীদির নাকি বিয়ে হবে । তাঁর। ছোট দুই ভাই, দুই বোন। ছোটবোনটির নাম দীপ্তি, সে আমাদের বয়সী। ছোট ভাইটিকে সবাই ‘বাবু’ বলে ডাকত, ভারি মিষ্টি গলা ছিল, বয়সে আমার সেজভাই অমিয়র সমান। সরস্বতীদি আর দীপ্তি ছাড়া, এরা সকলেই অকালে চলে গেছে।
শুনলাম শিউলি বেলিরাও নাকি এক বছর পরে চলে যাবে, ওদের বাবা বোধহয় বদলি হয়ে গেলেন, তবে সেটা ঠিক মনে পড়ছে না। ছোটবেলায় যাদের সঙ্গে চিরকাল খেলাধুলো করেছি, সব স্মৃতির সঙ্গে যারা জড়ানো, তাদের সঙ্গে চিরকালের মতো ছাড়াছাড়ির কথা মনে করেও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। হরিচরণরা, নাড়ূ-নীলুরা অবিশ্যি আসত যেত। কাকাবাবুরা বাবার আপিসে কাজ করেন, যাবেনই বা কতটুকু দূরে ওঁরা। তবে মাঝে মাঝে নরেস্ক বাড়িটা খালি পড়ে থাকত। রান্নাঘরের চোঙা থেকে ধোঁয়া উঠছে না দেখে কষ্ট হত। ওদের শ্যাম বলে এক রান্নার লোক ছিল, সে ভারি গপ্পে। আগে নাকি বর্মায় থাকত। তার ওপর পাড়ার লোক খুশি ছিল না, নাকি সে এসে অবধি অন্য লোকের পোষা মুরগি ওদের বাড়িতে একবার ঢুকলে আর বেরুত না। বাঁশ কাটতে গিয়ে শ্যামের আঙুল থেকে বড় এক চাক্লা কেটে এল, ব্যথার চোটে সে যায় আর কি! পাড়ার লোকে বলল, “এবার মুরগি চালান বেরুচ্ছে !” হরিচরণরা যখন থাকত না পাড়াটা কেমন খালি-খালি মনে হত । খুড়িমা যত্ন করে বিলিতী ফুলের গাছ লাগাতেন, এখানে সব বিলিতী ফুল হত! ওঁরা চলে গেলে ফুলগাছ মরে যেত, আবার হয়তো দেড় বছর পরে ফিরে এসে নতুন করে লাগাতেন। সেবার বেশ কিছুদিন বাড়ি খালি পড়ে থাকার পর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই ছেলে সুধী ঠাকুর আর অরু ঠাকুর কতকগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে এলেন। আমাদের একটা যাবার জায়গা হল । সুধী ঠাকুর সৌম্যেন্দ্রনাথের বাবা, ভারি বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তাঁর কথা ভালো করে মনে পড়ে না। তাঁর ছোট ছেলে নেপু ছিল আমাদের বয়সী, তার সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়ে গেল। ভারি আদুরে ছিল নেপু, তার সঙ্গে সঙ্গে সর্বদা একটা চাকর ঘুরত। নেপু কিচ্ছু করত না, নিজের পাজামার দড়ি পর্যন্ত বাঁধত না, সব চাকরটা করে দিত। দেখে আমরা অবাক হতাম। কারণ আমাদের বাবার কাছে ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছিলাম, “মিছিমিছি কারো সেবা নেবে না, মাইনে করা চাকরদেরও না। কেন, নিজের জুতোয় নিজেরা রঙ দিতে পার না? একটা গরীব মুখ্যু লোকে যা পারে, তোমরা তা-ও পারবে না?” নিজে সর্বদা নিজের জুতো পালিশ করতেন। পরে যখন কলকাতায় ডেপুটি সার্ভেয়ার জেনারেল হয়েছিলেন, তখনো। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি দর্পহারী ভগবান বাবার মতো মানুষকেও পেড়ে ফেলেছিলেন। ৭৪ বছর বয়সে দু’ পায়ের জোর একেবারে চলে গেছিল, সব কাজের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হত। কথা বলতেও কষ্ট হত, দরকার হলেও কাউকে ডাকতেন না, মাঝেমাঝে চোখের কোণে দু’ ফোঁটা জল জমে থাকত। তাই দেখেই বোঝা যেত আমাদের সেই প্রচণ্ড রাগী ভয়ঙ্কর বলিষ্ঠ বাবার মনের মধ্যে কি হচ্ছে !
অরু ঠাকুরের নাম অরুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি ভারি আমুদে লোক ছিলেন। ছোট বড় সবার সঙ্গে মিশতেন। শিলং-এর ব্রাহ্মরা বড্ড গোঁড়া ছিলেন ; তার একটা কারণ হয়তো তাঁদের বেশিরভাগই হিন্দু-সমাজের ছেলে, ব্রাহ্ম হয়েছিলেন বলে অনেক নির্যাতন সইতে হয়েছিল। তাই নিজেদের চারদিকে গোঁড়ামির একটা বর্ম পরে থাকতেন। আমার মাসিমা অনেক বিষয়ে উদার হলেও, সিঁদূর পরতেন না, লোহা পরতেন না, পুজো দেখতে যেতেন না, মদ শব্দ উচ্চারণ করতেন না। কিন্তু মজার কথা হল যে মেসোমশায়ের মৃত্যুর পর থান পরলেন, হাত খালি করলেন, বাকি জীবনটা নিরামিষ খেয়ে কাটালেন। আসলে এ-সব নীতির ব্যাপার ছিল না, একেবারে আবেগের ব্যাপার। মা-মাসিমার তো হিন্দু সমাজের ওপর অভিমান থাকাই স্বাভাবিক। দিদিমা মারা গেলেন, দাদামশাই আবার হিন্দু হয়ে সন্ন্যাস নিলে, কোনো হিন্দু আত্মীয়স্বজন অনাথা মেয়ে তিনটির ভার নিলেন না, যদিও তাঁদের দাদামশাই দিদিমা ঠাকুমা ইত্যাদি অনেকেই বেঁচে ছিলেন। তাঁদের মানুষ করলেন অনাত্মীয় ব্রাহ্মরা। এ দুঃখ খুব সহজে ভুলবার নয়। কাজেই তাঁরা যখন হিন্দুদের গোঁড়ামি সম্বন্ধে কিছু বলতেন, কিন্তু ব্রাহ্মদের গোঁড়ামি সম্বন্ধে কিছু বলতেন না, আমরা বেজায় তর্ক করতাম, কিন্তু ভিতরে ভিতরে এ মনোভাবের কারণ বুঝতাম। আমি প্রায়ই বলতাম, “ব্রাহ্মরাও হিন্দু ছাড়া কিছু নয়। উপনিষদের মন্ত্র আওড়ায় !” তাঁরা ব্যথা পেতেন।
সে যাই হোক আমি ব্রাহ্ম সমাজের লোকদের শিলং-এর ব্রাহ্মরা বোধহয় পুরোপুরি ব্রাহ্ম মনে করতেন না। তার ওপর অরু ঠাকুর নাকি সুরাপান করতেন। কে না জানত ব্রাহ্মরা সুরাপান করে না। আমাদের তাঁকে বেজায় ভালো লাগত ; সুরাপান করতে দেখিওনি কখনো। একদিন অরু ঠাকুর জোব্বা গায়ে দিয়ে, হাত দুটি জোব্বার বুকে গুঁজে, আমাদের বাড়ির কাছেই কো-অপারেটিভ স্টোর্স থেকে বেরুচ্ছেন, এমন সময় একজন লোক বাইরে দাঁড়িয়েছিল, সে একটু মুচ্কি হাসল । তাই দেখে অরু ঠাকুর থমকে দাঁড়ালেন। সবাই জানত ঐ দোকানে জোলাপ থেকে হুইস্কি, এমন কোনো জিনিস ছিল না, যা পাওয়া যেত না। অরু ঠাকুর মাথা নেড়ে একগাল হেসে, সেই অচেনা। লোকটিকে বললেন, “উহু ! যা ভেবেছ তা নয়,—বিস্কুট !” বলে বুকের ভিতর থেকে হাণ্ট্লি পাকারের বিস্কুটের টিন বের করে দেখালেন !