পাকদণ্ডী – ১.২৫

॥ ২৫ ॥

সতেরো বছর বয়স আমার। জীবনের মাধুর্যের দিকটা চোখের সামনে একটু একটু করে ফুটে উঠছিল। সদাই উদ্গ্রীব হয়ে থাকতাম, এই বুঝি রোমাঞ্চময়, কিছু ঘটবে। ছোট জ্যাঠামশায়ের বড় মেয়ে, আমাদের ‘বুলুদিও সে সময়ে হাজারিবাগে মেজদির বাড়িতে ছিল। সেই ছিল রোমাঞ্চের কেন্দ্রবিন্দু। তার মধ্যে ভারি একটা চমৎকারিত্বের সম্ভাবনা দেখতাম। আমার চাইতে সাত বছরের বড়, বি এ পাশ করেছে কোন কালে, ফর্সা রঙ, কোঁকড়া চুল, ভারি উজ্জ্বল উচ্ছল স্বভাব। তার অনেক ভক্ত ছিল। তারা ওকে গোলাপ ফুল, চকোলেট, হল্ কেনের ইংরিজি উপন্যাস উপহার দিত। অন্ততঃ ও আমাদের আগ্রহপূর্ণ ইচ্ছুক কানে এই সব বলত। ও নাকি তাদের মনে খুব আঘাত হানে। কখনো একটা ভালো কথা বলে না। উপহারগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাহলে নাকি ভক্তদের কাছে আদর বাড়ে।—এই অবধি শুনে আমরা প্রবল আপত্তি করেছিলাম। সে না হয় হল, কিন্তু অমন ভালো ভালো জিনিস ফেলে দেওয়া কি বুদ্ধির কাজ? বুলুদি আমাদের বুদ্ধির দৌড় দেখে কাষ্ঠ হেসে বলল, “তোরা তো দেখছি ভারি বোকা! সত্যি কি আর ফেলে দিই? ওরা হতাশ হয়ে চলে গেলে পর পাতির মাকে পাঠিয়ে জিনিসগুলো তুলিয়ে এনে ফুলদানিতে ফুল রাখি, বইগুলো পড়ি, চকোলেটগুলো খেয়ে ফেলি।” আমি বললাম, “সামনা-সামনি নিলে কি হয়?” বুলুদি বলল, “ছিঃ! বাইরের ছেলেদের দেওয়া উপহার কক্ষনো নিতে হয় না!”

কথাটা বোধহয় ঠিক। কারণ মা-মাসিরও সেই মত। তবে দিদিকে আমাকে দেখে কারো ফুল বা চকোলেট দিতে বোধহয় ইচ্ছা করত না। করলেও হয়তো বাবার ভয়ে কেউ দিতে সাহস পেত না। এক বুলাদা ছাড়া। এই মানুষটি যে আমাদের বাড়িসুদ্ধ সকলের হৃদয়ের কতখানি জুড়ে ছিল, ৬৩ বছর বয়সে ওর মৃত্যুর পর পদে পদে সে কথা বুঝেছিলাম। ও ছিল বুলুদির সব ভক্তদের মধ্যে সব চাইতে নীরব। বুলাদার কথা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়, নইলে এর ওপর অবিচার করা হবে। কবে থেকে যে ও আমাদের বাড়ির একজন হয়ে গেছিল মনে পড়ে না। কালো, লম্বা মানুষটির চেহারার মধ্যে একটা আকর্ষণীয় কিছু ছিল। চমৎকার বাঁশী বাজাত, ভারি সুরেলা গলা ছিল, কিন্তু গানটান বড় একটা গাইত না, খালি গুণ্গুণ্ করত। ছবি আঁকার হাত ছিল। মেদিনীর মতো হৃদয় ছিল। লোকের সাহায্য করতে পারলেই কৃতার্থ। যার যত দায় ও খুশি হয়ে এগিয়ে এসে নিজের ঘাড়ে তুলে নিত। আমি ওর মতো কাউকে দেখিনি। স্বনামধন্য প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ছোট ভাই; চৌরঙ্গীতে ওদের গ্রামোফোনের ও খেলার সরঞ্জামের দোকান ছিল নাম করা একটা সামাজিক মিলনস্থল। দোকানে বুলাদাই ছিল তার বাবার ডান হাত। ওর সঙ্গে কবে কিভাবে প্রথম দেখা হয়েছিল মনে নেই। সম্ভবতঃ শিলং থেকে কলকাতায় এসেই, গড়পারের বাড়িতে।

প্রশান্তদা ছিলেন বড়দার বন্ধু, বুলাদা ছিল তাঁর ভক্ত। ভারি চমৎকার শিল্পী মন ছিল তার। চেনা-জানা কারো বাড়িতে বিয়ে-থা হলে, ওকে ডেকে নিয়ে যেত ফুল সাজিয়ে দেবার জন্য। কোনো প্রশিক্ষণ পাওয়া শিল্পীরও এমন সৌন্দর্য-বোধ ছিল না। আমার তখন হয়তো ১৩ বছর বয়স, বেঁটে, বেজায় রোগা, বড্ড কথা বলি—মোট কথা আমার মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু ছিল বলে মনে হয় না। দিদি আমার চেয়ে বড় সাইজের ছিল, কম কথা বলত; কিন্তু ও-ও যে খুব আকর্ষণীয় ছিল মনে হয় না। তবু বুলাদা আমাদের রাশি রাশি আবদার সহ্য করত, ফাই ফরমায়েস খেটে দিত। তখন আমরা রবীন্দ্রনাথের বেজায় ভক্ত। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এলে বুলাদা তাঁকে এখানে-ওখানে নিয়ে যায়। রোজ দেখা হয়। আমি এক টাকা দিয়ে দু ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি, কালো চামড়া দিয়ে বাঁধানো একটা অটোগ্রাফ্ খাতা কিনে বুলাদাকে বললাম, “রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে আনো; পুরনো জিনিস না, নতুন কবিতা যেন হয়।” বুলাদা দু-তিনদিন বাদে খাতাটা দিয়ে গেল। তাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “নামের আখর কেন লিখিস্ আপন সকল কাজে? পারিস্ যদি প্রেমের আখর রাখিস্ জীবন মাঝে।”

যখন হাজারিবাগ গেছি তখন আমার বয়স সতেরো, বুলুদির চব্বিশ, বুলাদার সাতাশ। ততদিনে আমরা মেনে নিয়েছি যে বুলাদা হল বুলুদির ভক্ত, তাই আমাদের ওপর ওর অত টান। আসলে কিন্তু বিশ্ব-প্রেমিক যদি কেউ থেকে থাকে, সে হল বুলাদা। তাই বলে অবিশ্যি বুলুদির অন্য ভক্তদের ও খুব সুনজরে দেখত না। মুখে কিছু বলত না। বিশেষ করে ফর্সা, মোটা, গুণী, ভালো চাকরে এক পাণিপ্রার্থী ছিলেন, তাঁকে দেখলেই বুলাদার মুখ গম্ভীর হয়ে যেত। আমরা ছিলাম বুলাদার দলে। ওকে এই বলে আশ্বাস দিতে ইচ্ছা করত যে বুলুদি বলেছে সেই লোকটি পাঁউরুটির মতো দেখতে, কাজেই ওঁর কাছ থেকে কোনো আশঙ্কার কারণ নেই। দুঃখের বিষয় এত পক্ষপাতিত্ব সত্ত্বেও কিছু বলতে সাহস পাইনি, কারণ ছোটবেলা থেকেই, আমাকে মুখ তুলতে দেখলেই বড়রা বলতেন, “মুখ বন্ধ।” সে যাইহোক আমরা হাজারিবাগে থাকতে থাকতে বুলাদা বার দুই মটর-সাইকেলে করে ঘুরে গেছিল। আমাদের মনে হত সীতাদেবী-শান্তাদের কোনো রোমাঞ্চময় উপন্যাসের ঠিক মধ্যিখানে রয়েছি। বুলুদির মনের ভাব বোঝা দায় ছিল। এত বেশি কথা বলে এত কম তথ্য প্রকাশ করতে আর কাউকে দেখিনি। এর মধ্যে আসলে একটু বেদনার ইতিহাস ছিল। বুলুদির দাদা বুলাদার এক নিকট আত্মীয়াকে বিয়ে করবে বলে বিলেত গিয়ে মেম এনেছিল বলে, বুলুদির মনে ভারি একটা অপরাধ বোধ ছিল। তাই বোধ হয় বুলাদাকে দেখলেই ওর মেজাজ বিগড়ে যেত। তাছাড়া সব উপন্যাসেই দেখতাম প্রেমের পথ খুব সহজ নয়। সে যাইহোক এর পরেই ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্স লাটে উঠেছিল; বাড়ির বাসিন্দারা এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল; মেজজ্যাঠাইমা সুন্দর জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে উঠে, কয়েক মাসের মধ্যেই মারা গেলেন; এসব কথা আগেই অন্য প্রসঙ্গে বলেছি। বুলুদি আমাদের বাড়িতে এসেছিল। ১৯২৮ সালে বুলাদার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বলা বাহুল্য বুলুদির সমস্ত আত্মীয়স্বজনরা এতে আহ্লাদে আটখানা হয়েছিলেন। বিশেষ করে আমার মা, বাবা, পরে আমার বিয়ের সময়ে বাবা যতখানি ক্ষুণ্ণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, বুলুদির বিয়েতে সেই রকম আনন্দিত হয়েছিলেন।

হাজারিবাগে মাসিমা হঠাৎ বললেন, “তোদের বাবার এত উন্নতি হল, নিজ গুণে ইম্পিরিয়েল সার্ভিস হয়ে গেল, কই তোরা তো কিছু বলছিস্ না।” শুনে আমরা অবাক্! বাবার যে উন্নতি হয়েছে এই প্রথম শুনলাম। ঐ রকম ছিলেন আমার বাবা। নিজের কিম্বা ছেলে-মেয়েদের সাফল্যে এতটকু উল্লাস প্রকাশ করতেন না। সময়কালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলাম, তখনো আমাকে সোনার গয়না দেওয়া বা ভোজের আয়োজন করা দূরে থাকুক, একবারও মুখে বলেননি, “আমি খুশি হয়েছি।” কিন্তু খুশি নিশ্চয়ই হতেন। অথচ অখুশির বেলা সে-কথা পঞ্চমুখে প্রকাশ করতেন। এখনো ভাবি ঐ কটি কথা বললেই তো আমার মন ভরে যেত। কি এক কড়া ইস্কুলের ছাত্র ছিলেন বাবা যে কিছুতেই মুখে প্রসন্নতার কথা আনতেন না। এখনো ভাবলে দুঃখ হয়। তখন খুশি হলেন কি না তাও বুঝতে পারতাম না। তবে বুলুদির বিয়েতে নিঃসন্দেহে খুশি হয়ে, দু-হাতে টাকা-কড়ি খরচ করেছিলেন।

মাসিমার ও-কথায় মাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বাবার ততদিনে ছুটি ফুরিয়ে গেছিল, উনি কলকাতায় ফিরে গেছিলেন। মা আরো বললেন, কলকাতায় ফিরে আমরা আর ঐ ছোট ফ্ল্যাটে উঠব না। গড়পারের সংসার উঠে যাচ্ছে। মণিদা, নান্কুদা, বুলুদি আমাদের বাড়িতে আসবে। ছোট-জ্যাঠামশাই আর মেজ-জ্যাঠাইমা সুন্দর-জ্যাঠার বাড়িতে যাবেন। মেজ-বৌদি, বড়-বৌদি তখনকার মতো বাপের বাড়ি যাবেন। কি আর বলব, শুনে বুকটা হু-হু করে উঠেছিল। কত স্বপ্নের কত আশার ঐ ১০০নং গড়পার রোডের বাড়ি। আজ পর্যন্ত প্রেসের ঝম-ঝম শব্দ কানে বাজে, ছাপার কালির গন্ধ নাকে আসে। কখনো কোনো ছাপা-খানায়, প্রকাশালয়ে কিম্বা বইয়ের দোকানে পা দিলেই মনের মধ্যে কে যেন বলে এই আমি বাপের বাড়ি এলাম। ইচ্ছে করে নতুন ছাপা বইতে নাক ডুবিয়ে সারা দিন বসে থাকি।

জানতাম ওদের সম্পত্তির কিছুই রাখা যাবে না। শুধু মানিক নাবালক ছেলে বলে বাপের ভাগটুকু পাবে আর সামান্য একটা মাসোহারা। মায়ের কথায় চোখের সামনে মায়ার প্রাসাদ ঝুর-ঝুর করে ভেঙে পড়ল। আমরা নাকি জাস্টিস চন্দ্রমাধব রোডে একটা বড় তিনতলা বাড়িতে উঠে যাব। সেখানে সকলের জায়গা হবে। বাবা এখন থেকে বাড়ি-ভাড়া বাবদ মোটা টাকা পাবেন। বাবাই বাড়ি ঠিক করে, আমাদের সামান্য যা আসবাব জিনিসপত্র ছিল, সব নতুন বাড়িতে তুললেন। আপিসের চাপরাশী, চৌকিদার, বাড়ির চাকররা আর বাবার বন্ধুরা সাহায্য করলেন। মাকে কোনো মতামত প্রকাশ করতে শুনিনি। বাবা যা ব্যবস্থা করতেন, মা তাতেই খুশি থাকতেন। এক্ষেত্রে কলকাতায় ফিরে দেখলাম রাস্তাটা ভালো, বাড়ির সামনে খুদে এক তে-কোণা ঘাসজমিতে মস্ত একটা কৃষ্ণচুড়ো গাছ লালে লাল হয়ে আছে। বড় বড় ঘর, বড় বড় জানলা, তিন পাশে একতলা বাড়ি, খোলা-মেলা, তিনতলায় আমাদের শোবার ঘরের পাশে জাল দিয়ে ঘেরা সুন্দর একটি বারান্দা। সেখান থেকে অর্ধেক ভবানীপুর দেখা যায়। ঐ বারান্দায় কয়েক বছর ধরে কত যে কবিতা পড়েছি, স্বপ্ন দেখেছি, পরীক্ষার পড়া তৈরি করেছি, পাঁচজনে মিলে কত গল্প করেছি, তার ঠিক নেই।

হাজারিবাগেও বড় আনন্দে ছিলাম। বাড়ির পেছনে একটা মাঠ। মাঠের ওপারে পোস্টঅফিস, সেখানে জানলা দিয়ে রোজ বেলা এগারোটা থেকে চিঠি-পত্র বিলি হত। পোস্টাপিসের পাশে বুথ্ সায়েবের বাড়ি। তাঁর দশটা মেয়ে, কেউই খুব কালো নয়, দেখতেও মন্দ নয়। পোস্টাপিসের সামনে পুলিশ সার্জেণ্টদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র। শুনলাম কচি কচি সার্জেণ্ট ধরে সায়েব এর আগেই নটা মেয়েকে পার করেছেন; এবার দশ নম্বরের মহড়া দেওয়া হচ্ছে। আমরা থাকতে থাকতেই পোস্টাপিস থেকে চিঠি আনতে গিয়ে কে যেন শুনে এল দশ নম্বরও বাগ্দত্তা হয়েছে।

মেজদি ভারি রসিক মানুষ ছিলেন আর যেমন রান্নায়, তেমনি কারু-সেলাইতে দক্ষ। মেজ-জ্যাঠাইমার হাতে যতগুলি মেয়ে মানুষ হয়েছিল, সবকটি বেজায় ভালো রাঁধিয়ে। শুধু ঘরোয়া রান্নায় সিদ্ধহস্ত নয়, পান্তুয়া, রসগোল্লা, কেক, পুডিং, রোস্ট থেকে শুরু করে পেশাদার ময়রার হাতের খাজার মতো খাজা পর্যন্ত। শেষেরটিতে আমার বড়দি, সুলেখিকা সুখলতা সব চাইতে পারদর্শী ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এঁরা লেখা-পড়া গান-বাজনাও শিখেছিলেন! খালি মায়ের গলায় গান আসত না, দিদির আমারও যেমন আসে না। ছবি আঁকতেও সব ওস্তাদ আর এঁদের স্বামী সেবা দেখে অবাক হতাম। বড়দির একটু মেজাজ ছিল; মাকে কিম্বা মেজদিকে কখনো প্রকাশ্যে স্বামীর সঙ্গে তর্ক করতেও শুনিনি। অবিশ্যি সে ব্যবস্থার আমি খুব প্রশংসা করতে পারছি না। কারণ কিঞ্চিৎ ন্যায্য কথা না শোনালে পুরুষদের বড্ড বাড় বেড়ে যায়। যতই ফেরবার সময় কাছে আসে, আমাদের ভ্রমণের নেশা ততই বাড়ে। শহরের ভেতরটা দেখতে কিছু বাকি রাখা হয়নি, কানহারি পাহাড়, লেক, কলাম্বাস কলেজ ইত্যাদি দেখা হয়ে গেছিল। এর মধ্যে দাদামশায়ের এক শিষ্যবাড়ি থেকে কি করে আমাদের পরিচয় পেয়ে, নেমন্তন্ন করে নিয়ে গেল। কি ভালো লোক তাঁরা সে আর কি বলব। দাদামশাই ১৯০২ সালে কাশীতে মারা যান, আমি বলছি ১৯২৫ সালের কথা। ইতিমধ্যে তাঁর প্রকৃত শিষ্যরা সবাই পরলোকে গেছেন; তবে তাঁদের ছেলে-বৌরা আছেন। তাঁদের কেউ কেউ দাদামশাইকে চাক্ষুষ দেখেছিলেন। কিছু বই-পত্র ছিল তাঁদের কাছে, কি বই তা আর খুলে দেখাননি। একটা আসন, তা সে বাঘ-ছাল না হরিণের চামড়া মনে করতে পারছি না। আর একটা মস্ত বড় চীনে-মাটির পেয়ালা। তাতে করে দাদামশাই চা খেতেন। এত বড় পেয়ালা আজ পর্যন্ত আর দেখিনি। তবে অবনীন্দ্রনাথের কোনো বইতে পড়েছি যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও মস্ত এক পেয়ালায় চা খেতেন। একবার কে যেন সে পেয়ালাটি ভেঙে ফেলাতে, মহর্ষির বড় নাতি দীপু ঠাকুর সমস্ত চীনা বাজার ঢুঁড়ে, তবে একটি পেয়েছিলেন। তাও বোধহয় বুড়ো ভদ্রলোকের খুব পছন্দ হয়নি। আমার সেদিন ঐ পেয়ালাতে হাত বোলাতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু ওঁরা যেমন আলগোছে ধরে দেখাচ্ছিলেন যে ঠিক সাহস পাইনি। দাদামশায়ের ব্যবহার করা কোনো জিনিস আমি চোখে দেখিনি। মায়ের কাছে একখানি চিঠি পর্যন্ত ছিল না। দাদামশায়ের মৃত্যুর পর তাঁর সামান্য যা কিছু সংসার জীবনের সম্পত্তি ছিল, ওঁর শিষ্যরা কেউ কেউ সেগুলি ওঁর প্রতিষ্ঠিত ছোট আশ্রমটির জন্য দাবি করেছিলেন। তখন বড়-মাসিমার বিয়ে হয়ে গেছিল। মেসোমশাই অনাথা শ্যালীদের সম্পত্তি যাতে অপরে না নেয়, তাই কেস্ করেছিলেন। ঐ কেস্‌টি বেশ মনোজ্ঞ। বিচারপতি রায় দিয়েছিলেন যে ঐ সম্পত্তির ওপর আশ্রমের কোনো দাবি থাকতে পারে না। যে মুহূর্তে নিজের শ্রাদ্ধ করে কেউ সন্ন্যাসী হল, সেই মুহূর্তে সংসারের কাছে সে মৃত। মৃতের সম্পত্তি তখনি তার ন্যায্য ওয়ারিশদের হয়ে যায়। সে সময় আশ্রমের অস্তিত্ব ছিল না, ন্যায্য ওয়ারিশ হলেন দাদামশায়ের তিন মেয়ে। মায়ের কাছে শুনেছি তাঁর মন এই ব্যাপারে এতই বিরূপ হয়ে উঠছিল যে সেই ১৬-১৭ বছর বয়সেই তিনি তাঁর ভাগটি জ্যাঠামশাইকে বলে ব্রাহ্মসমাজের দরিদ্র-ভাণ্ডারে আমার দিদিমার নামে দান করেছিলেন। দুঃখের বিষয় মা-মাসিদের পরিচয়ের প্রমাণস্বরূপ দাদামশায়ের লেখা যাবতীয় চিঠিপত্র আদালতে উপস্থাপিত করতে হয়েছিল। সেগুলি তাঁরা আর ফেরত পাননি। উকীল বলেছিলেন নাকি হারিয়ে গেছে। এই নিয়ে মাকে আক্ষেপ করর্তে শুনেছি। বিশেষতঃ সবার শেষে লেখা চিঠিখানিতে দাদামশাই মাকে বলেছিলেন, “তোমার এন্ট্রান্স পরীক্ষা হয়ে গেলে, তোমাকে কিছু দিনের জন্য আমার কাছে নিয়ে আসব।” আমরা মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “দাদামশাই ডাকলে তুমি এঁদের ছেড়ে চলে যেতে?” মা অবাক হয়ে বলেছিলেন, “সেই মুহূর্তেই চলে যেতাম। যদিও এঁরাই আমাকে মানুষ করেছিলেন।” ঐ পেয়ালার কথায় এত কথা মনে পড়ছে।

একটা আনন্দের বিষয় হল শ্রীউমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহে আর প্রকাশক মিত্র ঘোষের চেষ্টায়, ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় ১৯০০-১৯০১ সালে ‘হিমারণ্য’ নামে দাদামশায়ের লেখা কৈলাস ও মানসসরোবর ভ্রমণের যে কাহিনী ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি সংগ্রহ হয়েছে। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী সহকারে মিত্র ঘোষ সেটি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছেন। দাদামশায়ের সেই আসন আর পেয়ালা দেখে শুধু আমিই যে অভিভূত হয়েছিলাম তা নয়, মা-মাসির চোখে জল দেখেছিলাম।

কলকাতায় ফিরে আসার কিছুদিন আগে আমাদের ভগ্নীপতি অরুণনাথ চক্রবর্তী হঠাৎ এসে বললেন, “কাল সারা দিনের জন্য কে কে ছিন্নমস্তার মন্দির দেখতে যাবে? জায়গাটার ভারি কুখ্যাতি, যারাই যায় তাদের একটা না একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়, কে কে যাবে বল।” মাসিমা বললেন, “নোটন আর আমি যাব না। অন্যদেরও যাবার কি দরকার আছে?” অরুণবাবু বললেন, “আমাকে একটা তদন্তে যেতেই হবে। তিনটে গাড়ি আসবে, যতজন ধরে যেতে পারে।” অমনি সবাই ঝুলে পড়ল, সবাই যাবে! শেষ পর্যন্ত লতিকা আর যতির সর্দি-কাশির জন্য ওরা গেল না; মা তো সবে রোগ থেকে সেরে উঠেছেন, মা গেলেন না। মাসিমা নোটন গেলেন না। মেজদির জায়গা হল না। বাকিরা গাদাগাদি করে গাড়িতে চেপে বসলাম। আমরা ৬ ভাইবোন, অশোক, অরুণবাবু, ওঁদের বাড়ির পাঁচটা ছেলেমেয়ে। আর দুই ড্রাইভার। আমরা কেউই সাধারণতঃ যথেষ্ট খাদ্যাদি না নিয়ে এক পা নড়তাম না। কিন্তু অরুণবাবু বললেন, “যাদের গাড়ি তারা প্রচুর খাওয়াবে, জল পর্যন্ত নেবার দরকার নেই।”

অমনি রওনা হয়ে গেলাম। রামগড় হয়ে, ডাইনে চুটুপালুর রাস্তা, বাঁয়ে আমাদের পথ। কিছুদূর গিয়ে একটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম। সেখান থেকে এক স্থানীয় ভদ্রলোক সঙ্গে একটা আধ-ময়লা ন্যাকড়ায় বাঁধা একটা থালা আর এক পেতলের কলসী জল নিয়ে উঠলেন। উনিই নাকি মালিক। আঞ্চলিক ভাষা ছাড়া কিছু বলেন না। অরুণবাবুও আঞ্চলিক ভাষা বলতেন। মালিক বললেন ওতে নাস্তা আছে। নাস্তা মানে জলখাবার। আমাদের বয়স ১৮ থেকে ৮, সেই সকালে চা-রুটি খেয়ে বেরিয়েছি। নাস্তার পরিমাণ দেখে মুষড়ে পড়লাম।

তারপর ভেড়া নদী যেখানে দামোদরের সঙ্গে মিশেছে, সেখানে পৌঁছলাম। গাড়ি তখন আর যেত না। হেঁটে ভেড়ানদী পার হলাম। গ্রীষ্মকালে নদীতে হাঁটু জলও ছিল না। ওপারে উঠে একটা অন্য রাজ্যে পৌঁছলাম। সেখানকার আবহাওয়া থমথমে ভয়াবহ। খানিকটা বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে, দুই নদীর সঙ্গমস্থলে ছিন্নমস্তার মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছলাম। মনে হল মন্দিরটির আবহাওয়া সমস্ত পরিবেশটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পাথরের মধ্যে দিয়ে বয়ে এসে ভেড়ানদী দামোদরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেখানে একটি জলপ্রপাত, নিচে ঘূর্ণির মতো স্রোত পাক খাচ্ছে। সেখানে নাকি কত লোকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মরেছে। আগে এখানে নরবলি হত। কয়েকটা কালো লম্বা লোক মন্দিরের পাশে পাথরের ওপর বসেছিল। আমাদের দেখে উঠে গেল। মন্দিরের দরজা বন্ধ। বাইরে লাল মাথা কুচকুচে কালো বড় বড় গিরগিটি চলে বেড়াচ্ছিল। আমাদের গা শিরশির করতে লাগল।

মালিক আমাদের ডেকে ভেড়া নদীর জলে হাত-পা মুখ ধুতে বললেন। তারপর পোঁটলা খুলে নাস্তা বের করলেন। গোল গোল খাস্তা গজা। খুব ভালো কিন্তু খুব শুকনো। আর আঁজলা ভরে ভেড়া নদীর জল। সেই কলসীটার কি হল বুঝলাম না। তারপরেই দেখি অরুণবাবু হাত-ঘড়ি দেখছেন। নাকি এখনি ফিরতে হবে। সন্ধ্যার আগে ঐ এলাকা ছেড়ে যেতে হবে। ওখানে সে সময় কিছু গোলমাল হচ্ছিল। নিঃশব্দে গিয়ে সবাই ভেড়ানদী পার হয়ে গাড়িতে উঠলাম। মালিক ড্রাইভারদের তাড়াতাড়ি চালাতে বললেন। দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল; সেই গাঁয়ে গিয়ে গাড়ি থামল। দুপুরে যে নাস্তা ছাড়া কিছু খাওয়া হয়নি, একথা কারো মনে ছিল না। এতক্ষণ পর বেজায় খিদে পেল।

মালিকের অতিথিশালা ছোট্ট দোতলা মাটির বাড়ি, মাটির সিঁড়ি, খড়ের চাল। বাড়ির চারদিকে সীতাহার গাছের বাহার। দোতলার ছাদটা এত নিচু যে আমিও সোজা দাঁড়াতে পারছিলাম না। বড় বড় দুটো তক্তাপোষ ছাড়া আসবাব নেই। চাকররা প্রকাণ্ড খুঞ্চিপোষে করে রাশি রাশি পুরী; একটা পাথরের থালায় ১২ রকম আচার; আরেকটাতে ক্ষীরের সন্দেশের পাহাড় এনে দিল। আচার বেজায় টক, বেজায় ঝাল। আলু চচ্চড়ি দিলে পারত। খেয়ে উঠে সকলের গলা শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু জল কোথায়? মালিক হেসে বললেন, “এখানকার বড় কুয়োর জলের বড় খ্যাতি। সেই জল আনতে পাঠিয়েছি, একটু সবুর করুন।”, আমরা যে যার বসে রইলাম। আধ ঘণ্টা পরে কলসী ভরে ঠাণ্ডা মিষ্টি জল এল। পেট ভরে জল খেয়ে, অরুণবাবু মালিককে আমাদের সকলের হয়ে ধন্যবাদ জানালেন। মালিক থেকে গেলেন, আমরা রওনা হলাম।

গাড়ি ছাড়তেই মনে হল মাথার ওপর থেকে একটা কালো মেঘ উঠে গেল, আমরা গান করে গল্প করে এগোতে লাগলাম। অরুণবাবুকে কে যেন জিজ্ঞাসা করল, “কই? অ্যাক্সিডেণ্ট তো হল না?” সঙ্গে সঙ্গে সে গাড়ির একটা টায়ার ফাটল। দেখা গেল কোনো গাড়ির বাড়তি টায়ার নেই।ওটা মেরামত করতে হবে। চোদ্দবার ঐ গাড়ির টায়ার ফাটার পর, পথের ধারে ওটাকে ত্যাগ করে বাকি দুটোতে সবাইকে ভাগাভাগি করে নেওয়া হল। দেখা গেল জখম গাড়ির চালকও এসে আমাদের গাড়িতে উঠে বসেছে। এ পথে নাকি বাঘ বেরোয়। মোট কথা বাঘ বেরোয়নি, অন্তত আমরা দেখিনি। রাত এগারোটায় হাজারিবাগ পৌঁছে যে যার বিছানা নিলাম। রাতে লুচি মাংস হয়েছিল, সে খাবারেও কারো উৎসাহ ছিল না। অথচ শিলং-এ পিকনিকে গেলে আমরা দৌড়-ঝাঁপ করে একাকার করতাম। এই পাঁচ বছরে কি আমরাই বদলে গেলাম? নাকি জায়গাটা কেমন যেন?

॥ ২৬ ॥

আবার সকলে দলেবলে কলকাতায় ফিরে এলাম। মেজদি তাঁর দুই মেয়ে কল্যাণী আর নলিনীকে নিয়ে শেষবারের মতো গড়পারে উঠলেন। শুনেছিলাম বাড়ি যে কোনো সময় ছেড়ে দিতে হবে। খালি বাড়ি নিলাম হবে। সেকালে স্ত্রীধনের নিয়ম ছিল, তাই বৌদিদিদের গয়নাগাঁটি, বাপের বাড়ি থেকে বিয়ের সময় আনা খাট-পালঙ্ক বেঁচে যাবে। জ্যাঠামশায়ের আঁকা সুন্দর সুন্দর তেল-রঙের ছবি ছিল। তার মধ্যে যেগুলি একে ওকে দান করে গেছিলেন সেগুলিও বেঁচে গেল। কিন্তু রাশি রাশি ছবি, পাণ্ডুলিপি, দুষ্প্রাপ্য বই, বহুমূল্য টেলিস্কোপ, ক্যামেরা, প্রেসের যাবতীয় সরঞ্জাম, সব যাবে। মেজদিরা, বুলুদি, নানকুদা সেই পরিবেশের মধ্যে গিয়ে উঠলেন।

আমরা নতুন বাড়িতে উঠলাম। দেখলাম একতলার একটা বড় ঘর খালি রাখা হয়েছে; গড়পারের যেসব বাক্স-প্যাঁটরা আসবাবপত্র নিলেম হবে না, কিছুদিনের জন্য সেখানে রাখা হবে। মাসিমা নোটন কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে থেকে গেলেন। মা মহা খুশি। বোন দুটি মায়ের প্রাণ; নিজের বলতে আর কেউ ছিল না। ছিল না বলাও উচিত নয়, কারণ ছিল অনেকেই, কোতরঙের অচলানন্দের বাড়িতে অনেকেই ছিলেন। তবে তাঁদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এর অনেক বছর পরে, আমার বিয়েরও কয়েক বছর পরে, আমার শ্বশুরবাড়ির পুরোহিত-বংশের একজনের কোতরঙের দিকে বাড়ি ছিল। তিনি চার-পাঁচজনের খবর এনে, বলেছিলেন মা যদি যেতে চান, তিনিই নিয়ে যাবেন। মাকে সারাজীবনে ২-৩ বারের বেশি কাঁদতে দেখিনি। সেদিন ঐ কথা শুনে দুহাতে মুখ ঢেকে বলেছিলেন, “আর হয় না।”

সে যাইহোক গে, জাস্টিস চন্দ্ৰমাধব রোডের নতুন ভাড়াবাড়ি দেখে মাসিমা খুব খুশি হলেন। তবে পাশের একতলা বাড়িতে নাট্যজগতের বিখ্যাত নরেশ মিত্রের সপরিবারে বাস করাটা খুব একটা অনুমোদন করতে পারলেন না। আমরা কিন্তু খবর পেয়ে রোমাঞ্চিত। তারপর ৫২ বছর কেটে গেছে, সব কথা ভালো করে মনে নেই; শুধু মনে আছে নিরিবিলি শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা ছিল ওঁদের। নাট্যজগতের হট্টগোল ওবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছত না। নরেশ মিত্রের স্ত্রীকে মনে পড়ে হাসিখুশি, ফর্সা, গিন্নিবান্নি মানুষটি। আর যাঁরা ছিলেন তাঁরা সম্ভবত ওঁর ভাই, ভাই-বৌ ইত্যাদি হবেন। একটা দোলের দিনের কথা মনে পড়ে। ছেলেমানুষের মতো ওঁরা দোল খেললেন। বিস্ময়ে, আহ্লাদে, হিংসায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। ওঁদের বাড়িতে কোনো ছোট ছেলেমেয়ে দেখিনি। সেদিন ওঁরাই ছোট ছেলেমেয়ে হয়ে গেলেন। দুই দল হল। একদিকে পুরুষরা, একদিকে মেয়েরা। আমরা তিনতলার বারান্দা থেকে সপ্রশংস দর্শক। মেয়েরা মেয়েদের দিকে, ছেলেরা পুরুষদের দিকে। বলা বাহুল্য বড়রা অনুপস্থিত এবং আমাদের এই কুৎসিত কৌতূহল দেখে বিরক্ত।

মোট কথা ওঁদের বাড়িতে কখনো পুরুষরা জেতে, কখনো মেয়েরা, গেরিলাযুদ্ধে যেমন হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে “ট্রুস্” হচ্ছিল। রঙ মেখে ভূত হয়ে গিন্নিরা বড় কেৎলিতে চা করে পেয়ালায় ঢেলে, সিঙ্গাড়া সন্দেশ প্লেটে দিয়ে ছোকরা চাকরের হাতে বার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। পুরুষরা চা জলখাবার খেয়ে, সিগারেট ধরিয়ে সবে দুটো সুখটান দিয়েছেন, অমনি গিন্নিরা একেকজন একেকটা জানলা দিয়ে পি-ই-চ্ করে পিচ্কিরি দিয়ে রঙ ছুটিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ট্রুস্ ভঙ্গ হল। ওঁরা ধুপধাপ করে বেরিয়ে এলেন। গিন্নিরা সবাই দৌড়ে উঠোনের কোণের স্নানের ঘরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাড়িটা দো-মহলা, মধ্যিখানে উঠোন। রাস্তার দিকে বৈঠকখানা ঘর, মধ্যিখানে মস্ত উঠোন, অন্যদিকে শোবার ঘর। উঠোনে কল, বালতি ইত্যাদির অভাব ছিল না। ঘরের ছাদ ছিল না। উভয় পক্ষের কারসাজি আমাদের উৎসুক চোখের সামনে প্রকট। পুরুষরা বার-বাড়িতে বারান্দায় ভূতের মতো চেহারা নিয়ে সংক্ষিপ্ত এক সামরিক মন্ত্রণা-সভা করে নিয়ে, একেকজন একেকটা বালতিতে প্রচুর রঙ গুলে, নিঃশব্দে অগ্রসর হলেন। তারপর কলঘরের ন্যাড়া দেয়ালের ওপর দিয়ে হু-স্ করে ৬/৭টা বড় বালতি ভরা রঙ ঢেলে দেওয়া হল। ঠিক মনে হল সেই রঙের স্রোতে গিন্নিরা ভেসে বেরিয়ে এলেন।

এদিকে আমাদের খাবার সময় হয়ে গেছিল, বড়দের ডাকাডাকির চোটে আনিচ্ছুকভাবে প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে যেতে হল। কিন্তু সেই একদিনের ঘটনায় বুঝতে পেরেছিলাম আধা-বয়সী গম্ভীর চেহারার নরেশ মিত্র একটি ফূর্তিবাজ কিশোর ছাড়া কিছু ছিলেন না। ওঁদের তখনকার বয়স জানি না, আমরা ভাবতাম আমাদের চাইতে অনেক বড়। পাশের বাড়ি গিয়ে আলাপ করার জো ছিল না। বলেছি তো ব্রাহ্মরা সেকালে থিয়েটারের ছায়া মাড়াত না। মন্দ ব্রাহ্মদের মুখে গল্প শুনেছি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রকে একজন অচেনা লোক স্টার থিয়েটারের পথ জিজ্ঞাসা করেছিল। উনি বিরক্ত হয়ে “জানি না।” বলে বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবার পর মনে হল যে থিয়েটার যত খারাপই হক না কেন, মিথ্যাকথা তার চাইতেও ঢের খারাপ। অমনি ঘুরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “ও মশাই, শুনুন, শুনুন।” লোকটি ভাবল তবে বোধহয় পথটা মনে পড়েছে। সে ছুটে কাছে এসে বলল, “জানেন তাহলে পথটা?” হেরম্ব মৈত্র বললেন, “জানি, কিন্তু বলব না।” এই বলে আবার হন্‌-হন্‌ করে হাঁটা দিলেন।

মাসিমা নোটন হয়তো সেবার ৫-৬ দিন ছিলেন। তারই মধ্যে ওঁদের পুরনো বাবুর্চি সকুর এসে বলল, “মা চলুন। আমি তো সায়েবকে সামলাতে পারছি না। এই গরমে রোজ দুবেলা খিচুড়ি খাচ্ছেন। কিছুতেই কথা শুনছেন না।” পরে এই প্রসঙ্গে মেসোমশাই বলেছিলেন, “তোমার মাসিমাকে বুঝে উঠতে পারলাম না। দুপুরে খিচুড়ি মাছ ভাজা খাই, রাতে খিচুড়ি মাংস কষা খাই, তাতে দোষটা কি হল বল তো?”

নতুন বাড়িতে এসে আমরাও অনেকখানি সচল হলাম। সমবয়সী আত্মীয়স্বজনরা, ভাইবোন, ভাইপো ইত্যাদি এসে জটলা করত, সারাদিন থেকে যেত, কখনো রাত কাটাত। এত বড় পরিবার আমাদের যে বাইরের লোকের অভাববোধ করতাম না। নিজেদের নিকট আত্মীয়দের গণ্ডিটিও খানিকটা বেড়ে গেছিল। মেজ-জ্যাঠাকে পুষ্যি নিয়েছিলেন তাঁর দূর সম্পর্কের কাকা হরিকিশোর। তার ফলে হরিকিশোরের নিজের ছেলে ও মেয়েরাও আমাদের নিকট আত্মীয় হয়ে গেছিলেন। খেলার মাঠে স্বনামধন্য বেচু দত্তরায়, প্রেমা দত্তরায় হরিকিশোরের দৌহিত্র। ছোটবেলা থেকে তাদেরও আমাদের পিসতুতো ভাই বলেই জেনে এসেছি। আজ পর্যন্ত নিকট আত্মীয় বললেই তাদের কথাও মনে পড়ে।

তাই বলে সব আত্মীয়ের সঙ্গে সমান ভাব হয় না। নিকটতর বলেই যে তার সঙ্গে বেশি মতে মিলবে, তার কোনো মানে নেই। এই সময় আমাদের মনের আরেক দিকেও প্রসার হওয়াতে, এত দিন যে অন্তরঙ্গতা শুধু বোনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা আরো বিস্তৃত হল। সেই যে অনেক দিন আগে একবার ইডেন গার্ডেনে ক্রিকেট খেলা দেখতে গেছিলাম, সেই সময় থেকেই আমাদের উৎসাহ বেড়ে গেছিল। ক্রিকেট জিনিসটাতেই আমাদের কেমন একটা স্বত্বাধিকার বোধ ছিল। বড়-জ্যাঠামশাইকে সায়েবরা সুদ্ধু ডব্লু-জি-গ্রেস্ অফ্ ইণ্ডিয়া বলত ভেবে আমাদের ভারি গর্ব হত। কোনো পত্রিকায় একবার পাশাপাশি দুজনার ছবি বেরিয়েছিল। সাদৃশ্যও যে ছিল তাতে সন্দেহ নেই। তবে বড়-জ্যাঠামশায়ের মধ্যে আরেকটা মানুষও ছিল যে ফতুয়া আর খাটো করে ধুতি পরে, হাতের গামছায় ভিজে কাপড় বেঁধে, রোজ হেঁটে গঙ্গার ঘাট থেকে স্নান সেরে ফিরত। আশ্চর্যের বিষয় হল দুটির মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। আমাদের সমস্ত পরিবারের আর পরিবারের দৌহিত্র বংশের অনেকের মধ্যে এই যে ক্রিকেট-প্রীতি, এর মূলে ছিলেন বড়জ্যাঠামশাই। এমন একটা পৌরুষের প্রতিমূর্তির প্রভাব কারো পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বেচুদারা, সোনাপিসির আর সুন্দর জ্যাঠার বাড়ির ছেলেরা স্পোর্টিং ইউনিয়নে খেলত। বাবা জ্যাঠামশাইরা টাউন ক্লাবের পুরনো সদস্য। আমরা আগে টাউন ক্লাবেরই গল্প শুনতাম, তবে তাদের কোনো খেলা দেখিনি। অনেকের ধারণা যাঁরা টাউন ক্লাব পত্তন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রণী সারদারঞ্জন। কথাটা ঠিক নয়। আঠারো শতকের একেবারে শেষের দিকে নাটোরের মহারাজা, ভূকৈলাসের রাজা এবং আরো কয়েকজন উৎসাহী যুবকের চেষ্টায় টাউন ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, এ তথ্য বেচুদার কাছে পেয়েছি। এখন যেটাকে লোকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ বলে জানে, আগে সেইখানেই টাউন ক্লাব খেলত। কেন এ মাঠ ছাড়তে হল বলতে পারি না। পরে পাশের একটা মাঠ টাউন ক্লাব পেয়েছিল এবং এখনো সেখানেই খেলা হয়। যতদূর জানি ফুটবল, হকি, ক্রিকেট সবই খেলা হত। বড়জ্যাঠামশাই কলকাতায় এসেই, ভাইদের নিয়ে এই ক্লাবে যোগ দিলেন।

সে সময় এই ক্লাব ছাড়া আর মাত্র এক জায়গায়, ভবানীপুরের ‘ডায়ানা’ ক্লাবে, ক্রিকেট খেলা হত। প্রফেসার বিপিনবিহারী গুপ্তের সহযোগিতায় দেখতে দেখতে ছেলেরা দলে দলে এসে খেলার মাঠে নামতে লাগল। টাউন ক্লাব এঁদের চেষ্টায় অনেক উন্নতি লাভ করল। সারদারঞ্জনকেও কলকাতার ক্রীড়ামোদীরা চিনে নিল। নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথের নিজের দল ছিল। বড়জ্যাঠামশাই, ছোটজ্যাঠামশাই তাতে খেলতেন। শুধু এতেই জ্যাঠামশাই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বুঝেছিলেন ব্যাপকভাবে ছেলেদের খেলার মাঠে নামাতে হলে, কলেজে কলেজে ক্রীড়া বিভাগ গড়া ছাড়া উপায় নেই। বিদ্যাসাগর কলেজে তিনি ক্রীড়া বিভাগ আর তার জন্য আলাদা তহবিলের ব্যবস্থা করলেন। শুনেছি তিনি ছেলেদের খেলায় যোগ দিতে একরকম বাধ্য করতেন আর নিজেও শুধু উপস্থিত থাকতেন না, খেলতেনও। ছাত্রদের আর প্রফেসারদের নিয়ে আলিগড়ে গিয়ে তাঁরা জিতে ফিরেছিলেন। টিমের খ্যাতি বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে কলকাতায় অনেক ক্রিকেট ক্লাব অনেক প্রশংসা অর্জন করেছে, কিন্তু খেলার প্রবর্তন করেছিল টাউন ক্লাব, একথা ভুলে গেলে চলবে না। বেচুদার মতে ক্রিকেট খেলার প্রবর্তক হলেও, উন্নতির ক্ষেত্রে এ ক্লাবের অবদান সে রকম উল্লেখযোগ্য নয়। তবে সেটা খুবই স্বাভাবিক। উন্নতি তো আর একদিনে হয় না; ক্রমে ক্রমে যত অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে, দক্ষতাও তেমনি বাড়ে। মান-ও উঁচু হয়।

মোটকথা আমাদের পরিবারের ছেলেরা ছিল স্পোর্টিং ইউনিয়নের সদস্য। স্পোর্টিং ইউনিয়ন-ও নেহাৎ দুদিনের প্রতিষ্ঠান নয়। শুনেছি ১৯০০ সালের আগে কয়েকজন উৎসাহী ব্রাহ্ম যুবকের চেষ্টায় ব্রাহ্ম বয়জ্‌ স্পোর্টিং নামে একটা ছোট দল উত্তর কলকাতার পান্তির মাঠে ক্রিকেট খেলা শুরু করে। পরে দ্বিজেন সেন, এইচ্ বসু আর সারদারঞ্জনের উৎসাহে এর বদলে একটা নতুন দল গড়ে ওঠে, তারি নাম স্পোর্টিং ইউনিয়ন। তারা খেলত মার্কাস স্কোয়ারে। সেখানে আমিও অনেকবার আমার সোনা-পিসি, অর্থাৎ এইচ্ বসুর স্ত্রী, আর তাঁর মেয়েদের সঙ্গে খেলা দেখেছি।

১৯২৫ সালে আমাদের পরিবারের অনেকগুলো ছেলে ক্রিকেটে নাম করেছিল। সবাই বলত তাদের দিয়েই একটা খুব ভালো টিম তৈরি হয়ে যায়। শুনে বেজায় গর্ব হত। একেক রকম খেলা কারো রক্তে থাকে কি না জানি না, বরং মনে হয় পরিবেশের জন্য খেলোয়াড় তৈরি হয়। বড়জ্যাঠামশাই যে মন্ত্র দিয়েছিলেন, তারই জোরে অনেকগুলি প্রথম শ্রেণীর খেলোয়াড় তৈরি হয়ে গেল। সব চাইতে আশ্চর্যের বিষয় হল যে তাঁর ভাইদের মধ্যে ছোট-জ্যাঠামশাই আর বাবা পাক্কা খেলোয়াড় তৈরি হলেন। সুন্দর জ্যাঠা অথাৎ মুক্তিদারঞ্জন হলেন বিস্ময়কর অ্যাথ্লীট, তার একটা ভালো বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাচ্ছি না কিন্তু তাঁর নিজের চার ছেলের মধ্যে কেউই খেলাধুলোর দিকে গেলেন না। গেল মুক্তিদারঞ্জনের ছেলেরা। তাদের বিষয়ে আরেকটু বলা দরকার, কারণ খ্যাতির এমনি বিড়ম্বনা যে আজ ঘরে ঘরে যাদের নাম, কুড়ি বছর বাদে তাদের কেউ মনেও করে না। তখন নব নব নায়ক অবতীর্ণ হয়ে মঞ্চ দখল করেছে। সেটাই অবশ্য বাঞ্ছনীয়, কিন্তু বর্তমান জন্ম নেয় অতীতের কোলে। বিগত দিনের খেলোয়াড়রা খেলার গতি যেদিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আজকের উন্নতি অনেকখানি তারি ওপর নির্ভর করে আছে। সেকালে মাইকেল তাঁর মেঘনাদ বধের চতুর্থ সর্গের আরম্ভে বাল্মীকি ইত্যাদিকে মনে করে লিখেছিলেন⋯⋯“তব পদচিহ্ন ধ্যান করি দিবানিশি, পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে, ‘অমর⋯”

স্পোর্টিং ইউনিয়নের খেলায় মুক্তিদারঞ্জনের ছেলে শৈলজাকে অনেকবার ক্যাপ্টেন হতে দেখেছি। বলিষ্ঠ শরীর, প্রথম যৌবন পার হয়ে গেছে, একটা পা পুরনো একটা দুর্ঘটনার ফলে কিঞ্চিৎ খোঁড়া। কিন্তু খেলার জাদুকর। আসল কথা হল যে কোনো ক্ষেত্রেই জাদুই বলা যাক, কিম্বা প্রতিভাই বলা যাক, তার জন্ম শুধু হাতে কিম্বা পায়ে নয়, বরং মস্তিষ্কে এবং হৃদয়ে, তবে হাত-পায়ের কেরামতি না থাকলে, প্রতিভাই বা দাঁড়াবে কোথায়?

শৈলজারঞ্জন বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। আশির ওপর বয়স, এখনো বেঁচে আছেন। তাঁর ছোট হৈমজা ছিলেন এঞ্জিনিয়ার। হকি, ক্রিকেট দুই-ই ভালো খেলতেন। তিনি নেই। তাঁর ছোট নীরজা ছিলেন আশ্চর্য গুণী খেলোয়াড়, শুধু যে ক্রিকেট খেলতেন তা নয়, খেলোয়াড় তৈরি করতেন। আমি কয়েকজন দক্ষ ক্রিকেটারকে শুনেছি নীরজাকে ‘গুরু’ বলে উল্লেখ করতে। তাঁর ছোট ইন্দুজা লম্বাবলিষ্ঠ মানুষটি। একে আমরা বলরামদা বলে ডাকি। সেকালে একে দিয়েই পিসিমার ছেলেরা ওদের বদমেজাজী কুমীর পালালে, তাকে ধরাত। ভয়-ডর বলে ওর কিছু ছিল না , দড়ির ফাঁস দিয়ে অত বড় কুমীরটাকে ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে আসত। বলরামের ছোট দুই ভাই ক্ষীরজা আর নৃপজাও ক্রিকেট খেলত।

সোনাপিসিমার তিন ছেলে গণেশদা, কার্তিকদা আর বাপি রূপে-গুণে বিখ্যাত ছিল। শুধু খেলার মাঠে বল পিটিয়ে ওদের খেলার শখ মিটত না। আমহার্স্ট স্ট্রীটে ওদের বাড়ির ঘাস জমিতে কোনোদিন ফুলবাগান হল না। তার বদলে হল একটা ২২ গজি ক্রিকেট পিচ্। সেখানে কত যে অল্পবয়সী অজ্ঞাতকুলশীল সম্ভাব্য ক্রিকেটারকে উৎসাহ আর প্রশিক্ষণ দেওয়া হত তার ঠিক নেই। স্বনামধন্য পঙ্কজ গুপ্তের কাছে শুনেছি ও-বাড়ি থেকে তিনি যা লাভ করেছিলেন তার মূল্য হয় না। বেচুদা, প্রেমাদা এবং ওদের ছোট ভাই আরেক গণেশও ওখানে গিয়ে আলোচনার আর অভ্যাসের ফলে দক্ষ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিল।

বেচুদার কথাও বলতে হয়। খেলা এক জিনিস আর পরিচালনা আরেক জিনিস। দুটিতেই দক্ষ হওয়া বড় সহজ কাজ নয়। ১৯২০ সালে শিলং থেকে আমরা যখন কলকাতায় এলাম তখন আমার বয়স ১২, বেচুদার হয়তো ২১। তখনো ওর নাম হয়নি, ওর মধ্যে এতখানি ক্ষমতা আছে বোঝা যায়নি। তাছাড়া ও একটু পিছনে সরে থাকত। সোনা পিসিমার চটকদার ছেলেদের যত ভক্ত ছিল, বেচুদার ছিল না। ওর প্রতিভা তো আর শুধু চোখেলাগা ছিল না, তার পরিচয় পেতে আরো গভীরে নামা দরকার। তাছাড়া তার প্রশিক্ষণ হয় হাতে কলমে এবং অনেক বছর ধরে। গণেশদা, কার্তিকদা যখন ভাবল ওদের খেলার বয়স অতিবাহিত হয়েছে, বেচুদার প্রতিভা তখনো খুলছে। বেচুদা হকি ফুটবলেও সমান উৎসাহী।

বেচুদাকে সবাই এম দত্তরায় বলে জানে। আজ পর্যন্ত আশির কাছাকাছি পোঁছেও তার বিচারবুদ্ধি ম্লান হয়নি। ১৯৩৮ সাল থেকে ২৭ বছর আই-এফ্-এর সেক্রেটারি। অল ইণ্ডিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস্ প্রেসিডেণ্ট ৯ বছর, প্রেসিডেণ্ট ১৪ বছর। ১৯৪৬ থেকে ভারতের ক্রিকেট কনট্রোল বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত। আরো বহু উচ্চপদ বেচুদা দক্ষতা ও প্রশংসার সঙ্গে ভূষিত করেছে। সম্প্রতি ওলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস্ প্রেসিডেণ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। মেয়েদের ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে বেচুদার মতো উৎসাহী কম লোক আছে। আমার উৎসাহটা স্রেফ মানসিক বলে সে আমার সম্বন্ধে হতাশ হয়েছে। তাছাড়া বেচুদা, প্রেমাদা দুজনেই স্বাধীনতা সংগ্রামী, জেল-খাটা ছেলে। অনেকদিন বাড়িতেও অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল। সমালোচকও আছে অনেক এম দত্তরায়ের। যারাই দীর্ঘকাল ধরে কাজ করে যায়, তাদেরই সমালোচক থাকতে বাধ্য। আপাতত সেকথা ছেড়ে দিয়ে প্রেমাদার বিষয়ে একটা ছোট গল্প বলি, যার সত্য-মিথ্যা সম্বন্ধে হলপ্ করে বলতে পারব না। ঘটনার দিবস সন্ধ্যাবেলায় নীরজাদার কাছে শোনা। সম্ভবতঃ সত্যিই।

ইডেন গার্ডেনে বোধহয় স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে ক্যালকাটা ক্লাবের খেলা হচ্ছে। প্রেমাদা ব্যাট করছে। সেদিন বেশ ফুর্তিতে আছে, সবাই আশা করছে বেশ কিছু তুলবে এমন সময় পিচের মধ্যিখানে থেমে মাটি থেকে কি একটা কুড়োতে গিয়ে আউট্ হয়ে গেল। খেলার ফলাফল মনে নেই, ছোট-জ্যাঠা বলতেন “ফলাফল আবার কি? ভালো খেলা হল ভালো খেলা, তা যে দলই খেলুক।” ক্লাবে এসে অন্য সকলে ওকে চেপে ধরল। “কি কুড়োলে?” প্রেমাদা বলল, পান। পকেট থেকে পড়ে গেছিল। “পান পড়ে গেছিল তো গেছিল, তার জন্য রান ছেড়ে দিলে?” প্রেমাদা বলল, “গুণ্ডি আছিল।” শৈলদা বেজায় চটে গেল, “সায়েবরা পাছে গুণ্ডি দেখে তাই এত ভয়? ছি! ছি!” প্রেমাদা বলল, “সায়েবরা না, বড়-মামাও আছিলেন যে।” বড়-মামা অর্থাৎ সারদারঞ্জন। তক্ষুনি সবাই ওকে ক্ষমা করে দিল।

ওদের বাড়ির একটা ভূতের গল্প শুনেছি। ফ্ল্যাটবাড়ি, পাঁচতলার ছাদে সবাই কাচা কাপড় শুকোত। একদিন কাপড় তুলতে ভুলে গেছিল বলে রাতে ছোকরা চাকরকে ছাদে পাঠানো হল। সে সঙ্গে সঙ্গে নেমে এসে বলল, “ছাদে বাছুরের মতো বড় কুকুর আছে।” বেজায় অবাক হয়ে ধুপধাপ করে জনা পাঁচেক ছাদে ছুটল। গিয়ে দেখে সত্যি সত্যি বাছুরের মতো বড়, কুচকুচে কালো একটা কুকুর! ওদের দেখেই কুকুরটা আকাশের দিকে মুখ করে বিকট স্বরে ঘৌ- ঘৌ করে ডেকে, এক লাফে আকাশে উঠে, তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে গেল। দর্শকদের চক্ষুস্থির। বলা বাহুল্য এটাও শোনা গল্প, সত্যি কিনা সন্দেহ হয়। তাতে কি খুব এসে যায়? যারা মাছ ধরে, তাদের সব গল্পই কি বর্ণে বর্ণে সত্যি?

॥ ২৭ ॥

মনে হয় বিধাতা যাকে যতখানি গুণ দেন, তার সবটুকুই দান করে দিতে হয়। দান করতে হলে অনুশীলন চাই, সাধনা চাই। অর্থাৎ নিজেকেও অনেকখানি দান করতে হয়। নইলে গুণ থেকেও, নেই। আমার পিসিমার গুণী ছেলেমেয়েদের দেখে বারে বারে সেই কথাই মনে হত। বড় ছেলে জিতেনদা রূপেগুণে মানুষের মন জয় করে নেবার মতো ছিল। মৌলবী রেখে আরবি-ফারসি শিখল। ওমর খৈয়মের মূল রুবাইতের সুন্দর বাংলা অনুবাদ করল। কবি কান্তি ঘোষের মিষ্টি অনুবাদ মূল রুবাইত্ থেকে করা হয়নি, হুবহু ফিট্স্‌জেরাল্ডের ইংরিজির অতি মধুর বাংলা। কিন্তু ওমর খৈয়ামের রাৎ থেকে তার মেজাজই আলাদা। তবে কানে ঝম্ ঝম করে; চোখে ফুলঝুরি দেখায়; পাঠকদের বেশির ভাগ তাই চায়। কান্তি ঘোষকে সবাই চেনে, হিতেন বসুর নাম-ও শোনেনি। কি করে শুনবে? কোনো প্রকাশকের হাতে বই দিল না জিতেনদা। এত বিদ্যে সত্ত্বেও আর কিছু করেছে বলে জানতে পারলাম না। ছবি আঁকত সুন্দর। কিন্তু ঘরের কোণে বসে, সযত্নে বাইরের লোকের চোখ এড়িয়ে।

নীতিন আর মুকুল বসু সামাজিক জীবন পরিহার করে চলতে পারেনি, কারণ চলচ্চিত্র জগতে যে একবার নিজেকে জড়িয়েছে তার আর সে উপায় থাকে না। পিসিমার বড় মেয়ে মালতী ঘোষালকেও সবাই চেনে। যেমন গলা, তেমনি সাধনা। গোপেশ্বরবাবুর ছাত্রী ছিল। আজ পর্যন্ত গানের সাধনা অক্লান্তভাবে করে চলেছে। বেচুদা যেমন ক্রীড়ার সাধনা করে চলেছে। এসব মানুষ কখনো বুড়ো হয় না। মালতীদি বা বেচুদাও হয়নি। কিন্তু আমি বলছিলাম, অন্য ভাইবোনগুলির কথা। গণেশদা, কার্তিকদার আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো হওয়া উচিত ছিল। বাপিকে কজন চেনে? মালতীদির আরো তিনটে গুণী বোন আছে। কে তাদের খবর রাখে? ময়নার গলা অনেকে বলত মালতীদির চেয়েও ভালো; কিন্তু সে সাধনা কোথায়? নমিতা অদ্ভুত ভালো গায়। অরুণা চমৎকার ছবি আঁকত। আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে শিখেওছিল অনেকদিন। কিন্তু কোথায় সেই সাধনা যা দিয়ে মানুষ শিল্পীত্ব পায়? একটা সুরের একটুখানি রেশ একবার কানে গেলেই হল। অমনি শেখা হয়ে গেল; গলায় এসে গেল; কে কবে, কি-রকম, সব জানা হয়ে গেল। কতটুকু প্রতিভা নিয়ে কত লোক বিশ্ববরেণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আর এদের বিধাতা দু-হাত ভরে দান করেছিলেন, তবু সবাই ওদের নামও জানে না। তবে ওদের সান্নিধ্য আর ভালোবাসা পেয়ে আমার জীবন আনন্দে ভরে গেছিল।

তারই মধ্যে দেখতাম দুটো দল আছে, একটা বুড়োদের একটা ছোটদের। বাবা, ছোট-জ্যাঠা স্পোর্টিং ইউনিয়নের নতুন খেলোয়াড়দের সমালোচনা করতেন এবং ভালো মনে করেই করতেন। তাঁদের মতে এরা নিয়মকানুন মেনে চলে না। গণেশদারা কিছু বলা হল কি না হল, অমনি ফোঁশ করে উঠত। তাদের মতে বুড়োরা সেকেলে; টেক্‌নিকের কিছু বোঝে না। আমরা পড়ে যেতাম মাঝখানে। তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না যে দুই পক্ষের মধ্যেই কিঞ্চিৎ নাবালকত্ব প্রকাশ পেত। এরা ক্যাচ্‌ ফেলে দেয়। এই নিয়ে যে এত উষ্ণতা জমে উঠতে পারে সে নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করা যায় না। হয়তো খেলাটাকে ততটা গুরুত্ব দিতে পারিনি বলেই একথা বলছি।

সন্ধ্যে সাতটা বাজলেই আমি তিন তলায় নিজের ঘরে পড়তে চলে যেতাম। পাশাপাশি দুটি ঘর একটি দিদির, একটি আমার। মধ্যিখানে একটা দরজা, সেটিকে কখনো বন্ধ দেখিনি। আমার ঘরে একটি সরু খাট, একটি পড়ার টেবিল, একটি বুককেস্। দিদির ঘরটা একটু ছোট, তাতে শুধু একটি খাট। আমার বিয়ের আগে কখনো ড্রেসিং টেবিলের মালিক হইনি। বাড়িতে একটা কাপড় ছাড়ার ঘরও ছিল, মেয়েদের সার্বজনীন আলনা, দেরাজ আর দেরাজের ওপর একটা আয়না ছিল। দুটো কাঠের আলমারি ছিল। তার একটার দরজায় মস্ত আয়না ছিল। প্রসাধনী জিনিস বলতে মাথার জন্য নারকেল তেল, সাবান, ট্যাল্‌কাম পাউডার। শীতকালে ১/৩ গ্লিসারিন, ১/৩, লেবুর রস, ১/৩ জল মিশিয়ে শিশিতে ভরে রাখা হত। রাতে শোবার সময় হাতে, পায়ে, মুখে মাখা হত। একশোবার বলব আজকালকার কোনো বৈজ্ঞানিক, সুগন্ধী প্রলেপ তার কাছে লাগে না। চামড়া হয়ে যেত স্যাটিন। যে কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারে। একটিমাত্র বিলাসিতার কথা বলতে হয়। এইচ বসু কোম্পানির তৈরি কি যে সব চমৎকার নামওয়ালা সুগন্ধ দ্রব্য তৈরি হয় সে আর কি বলব। নামগুলোও যেমন রোমাঞ্চময়, গন্ধগুলোও তেমনি মৃদু মধুর। একটার নাম ‘ওয়াইণ্ড গ্রাস্, শুকনো ঘাসের মধুর গন্ধ; নাকে এলেই ছোটবেলাটাও হুড়মুড় করে ফিরে আসত। আরেকটার নাম ‘মিশরী’, ধূপধুনোর গন্ধ। আজকালকার কৃত্রিম ধুনোর গন্ধ নয়; শিলং-এর সরল গাছের বনের আঠায় ভরা ধূপকাঠের গন্ধ। পিসিমার মেজ ছেলে আসানদা আমাদের কোল ভরে পারফিউম আর হেয়ার লোশন এনে দিত। ভাবি এমন জিনিস আর তো দেখলাম না। অথচ ব্যবসাটাকে পর্যন্ত এরা রক্ষা করতে পারল না।

সে যাইহোক, তারি মধ্যে আমার আই এ পরীক্ষা এসে গেল। সেই পুরনো অঙ্গীকারটা মনে পড়ল; কিছুতেই ১২তম কি ১৩তম হব না। নম্বর তোলা তিনটি বিষয় ছিল আমার হাতে: লজিক, বটেনি, অঙ্ক। প্রথম দুটো মনে হত বেজায় সহজ। কোনো জিনিস দুবার মন দিয়ে পড়লেই বেশ শেখা হয়ে যেত। বইগুলো একেবারে পাখি-পড়া হয়ে গেল। অঙ্কের সব বইয়ের সব অঙ্ক কষে তৈরি করে ফেললাম। এ বিষয়ে আমার মস্ত একটা অবলম্বন ছিল দাদা। দাদার মতো আশ্চর্য অঙ্কের মাথা আমি আর দেখেছি বলে মনে হয় না। ম্যাট্রিকে পুরো নম্বর, আই এস-সিতে পুরো নম্বর পরে বি এস-সি-তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে, হার্শেল সুবর্ণ পদক পেয়ে, জুবিলি স্কলার হয়ে, শেষটা কি হল? না, কর্তৃপক্ষের কাউকে চটিয়ে এম এস-সি-তে তাঁর পেপার নাকোচ্‌ হয়ে, থার্ড ক্লাস পেয়ে, পৃষ্ঠভঙ্গ দিল। এমন পরাজয় আমি ভাবতে পারি না। আমি হলে পিওর ম্যাথেম্যাটিক্স নিয়ে, প্রথম হয়ে, দেখিয়ে দিতাম! দেখতে দেখতে পরীক্ষা হয়ে গেল। তার কয়েকদিন আগে বুলাদার ছোট বোন বাব্‌লির সঙ্গে অধ্যাপক সুশোভনচন্দ্র সরকারের বিয়ে হল; ব্রাহ্মমতে, কিন্তু এ বিয়েও রেজিস্টার হল না। বাবা কোনো উচ্চবাচ্যও করলেন না, গেলেনও না, আমাদের যাওয়াতে কোনো আপত্তিও করলেন না। প্রশান্ত মহলানবিশ তখন কিছুদিনের জন্য আলিপুরের হাওয়া আপিসের অধ্যক্ষের কাজ করছিলেন। চাঁদনি রাত। ফাল্গুন মাস। শোনা গেল বাগানে বিয়ের সভা বসবে, মাথার ওপর চাঁদোয়া থাকবে না, ফুল দিয়ে বেদী সাজানো হবে—বলাবাহুল্য বুলাদা সাজাবে—কিন্তু কোনো আলোর ব্যবস্থা থাকবে না, কারণ কৃত্রিম আলোর এমন বদভ্যাস আমাদের যে প্রকৃতির দেওয়া চাঁদের আলো উপভোগ করতে ভুলে গেছি। মন্তব্যটা যে প্রশান্তদার সে বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। যাইহোক, বিয়েতে পৌরোহিত্য করবেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিবাহস্থলে এসেই বললেন, “আমি লিখিত পদ্ধতি অনুসারে পৌরোহিত্য করব,আলো না হলে আমার চলবে না।”

তখন আলোর ব্যবস্থা করার সময় নেই; কয়েকটি মটরগাড়ি অকুস্থলে এনে, তাদের হেডলাইটের আলোকে বিয়ে হল। এমন বিয়ে কখনো কোথাও হয়েছে বলে শুনিনি। বিয়ের পর উৎকৃষ্ট জলযোগের সময় রোগা লম্বা একটা অচেনা ছেলে এসে আমাকে আসন্ন ইংরিজি পরীক্ষার দুটো প্রশ্ন বলে দিয়ে গেল। এবং পরে দেখলাম ঠিক তাই না হলেও, সেই বিষয়েই দুটি প্রশ্ন এল! যদি প্রশান্তদা ভেবে থাকেন যে ঐভাবে হিন্দু বিবাহানুষ্ঠানের মতো ব্রাহ্ম বিয়ে থেকেও রেজিস্ট্রির অমর্যাদা তুলে দেবেন, তিনি নিশ্চয় হতাশ হয়েছিলেন। কারণ সেটা হওয়া দূরে থাকুক, উল্টে এখন হিন্দু বিয়েও রেজিস্ট্রি হচ্ছে বলে শুনতে পাই।

পরীক্ষা হয়ে গেল। যথা সময়ে ফলও বেরুল। প্রেসিডেন্সি কলেজের সুনীতকুমার ইন্দ্র প্রথম এবং আমি দ্বিতীয় হয়েছি। আশ্চর্যের বিষয় ম্যাট্রিকে যারা প্রথম দশজনের মধ্যে হয়েছিল, তাদের প্রায় কারো নামই দেখতে পেলাম না। এই প্রসঙ্গে আমার অনেক সময় মনে হয়, একটা পরীক্ষায় কে দৈবাৎ প্রথম, কে বা দ্বিতীয় কি তৃতীয় কি নবম বা দশম হল, তাই দিয়ে তাদের যোগ্যতা বিচার করার নিয়মে অনেক খুঁৎ আছে। সাধারণত দেখা যায় দুজন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১, কি ২ বা ৩ নম্বরের তফাৎ হয়, তাও সামগ্রিক সংখ্যায়। পরীক্ষকও একজন নন। একজনের কাছে যে ছাত্র ১০ পেল, আরেকজনের কাছে সে-ই হয়তো ৭ পেত, বা ১৫ পেত। তাহলে আর যোগ্যতা বিচার থাকে কোথায়? এ বিষয়ে একটা গল্প না বলে পারছি না।

আমার ছোট-জ্যাঠামশাই কুলদারঞ্জন ম্যাট্রিকের বাংলার পরীক্ষক ছিলেন, সেকথা আগেও বলেছি। এ-ও তাঁর কাছেই শোনা। তখন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন উপাচার্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একরকম তাঁর সৃষ্টি বলা যেত, কাজেই প্রবেশিকা পরীক্ষার ওপরেও যে তাঁর সযত্ন দৃষ্টি থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কি? ওপরে আমি যে মন্তব্যগুলি করেছি, তিনিও সেই ধরনের যুক্তি প্রয়োগ করে, পরীক্ষকদের সবাইকে ডেকে একটা প্রশ্নপত্রের উত্তরে তাঁদের বিচারমতো নম্বর দিতে বললেন। নম্বর অবশ্য উত্তরের গায়ে লেখা হবে না। শেষে দেখা গেল ঐ পেপারে কেউ দিয়েছেন একশোতে ৭০, কেউ বা দিয়েছেন ৪০! তাহলে ন্যায্য বিচার কোথায় হল? অবিশ্যি একথাও সত্যি যে ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত ভালো নম্বরই পেয়ে থাকে; অপ্রত্যাশিত রকম বেশি বা সামান্য কম হতে পারে, কিন্তু খুব তফাৎ কদাচিৎ হয়। এক যদি না পরীক্ষার্থী কোনো গোলমাল করে ফেলে থাকে। সেকালে যে বছর ২০ হাজার পরীক্ষার্থী বসত, সবাই বলত, বাবা! এত ছেলের মধ্যে সুবিচার হওয়া শক্ত! তাও সে সময় সমস্ত পশ্চিম বাংলা এবং এখন যাকে বাংলাদেশ বলা হয় সে জায়গা, এই বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে পরীক্ষার্থী আসত। জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষারও কত বিস্তার ঘটেছে বলতে হবে। কাজেই গুণ বিচারের কাজও আরো কত জটিল হয়ে উঠেছে, সে কথা সহজেই অনুমান করা যায়।

এই সব কারণে পরীক্ষার ফলকে আমি খুব বেশি প্রাধান্য দিই না। আরেকটা কথাও আছে। কতবার দেখেছি পরীক্ষায় যারা উচ্চ সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হল, পরে কর্মক্ষেত্রে তারা ততখানি দক্ষতা দেখাতে পারল না। আবার কত কর্মী সাধারণভাবে পরীক্ষায় পাস্ করে, কর্মজীবনে আশ্চর্য গুণ দেখিয়েছেন। আসলে কতকগুলো অন্য লোকের চিন্তায়-ভরা বই গিলে, কাগজে সেগুলি উদ্‌গীরণ করা ছাড়া আরো কিছু সামর্থ্যের দরকার থাকে। অনেকে তো স্রেফ উচ্চাকাঙক্ষার জোরেই অনেকদূর এগিয়ে যায়।

আই এ পড়বার সময় আমার তিনটি গুণী বন্ধু লাভ হয়েছিল। এদের সঙ্গে কলেজে চার বছর পড়েছিলাম। আই এ পরীক্ষায় এদের মধ্যেও দুজন বৃত্তি পেয়ে, ইংরিজিতে অনার্স নিয়ে আমার সঙ্গে পড়তে লাগল। ওদের তিনজনের মধ্যে ভারি ভাব ছিল। দুঃখের বিষয় কেউ বেশিদিন বাঁচেনি। একজনের নাম সুধা ঘোষ, বিধানচন্দ্র রায়ের কি রকম ভাগ্নী; একজন নীতা মুখার্জি, ডঃ পি কে রায়ের নাতনি, দেশকর্মী রেণুকা রায়ের ছোট বোন; একজনের নাম লিলি সেন, আশ্চর্য রকম গুণী মেয়ে ছিল সে। এখন ভেবে দুঃখ হয় এদের অসুখা জীবন এবং অকাল মৃত্যুতে কত গুণ বৃথা নষ্ট হয়ে গেল। যাইহোক, তখন আমাদের ফুর্তি দেখে কে! ছাত্রজীবন যে কত মধুর হতে পারে, ভেবে ভালো লাগে।

এখন মনে হয় কলেজের ঐ প্রথম দুটি বছর বড় ভালো ছিল। বড় হওয়ার বছর। আপনা থেকে সাবালিকা হবার বয়স। ১৮-তে আই এ পাস্ করলাম। তার আগে কলকাতার অতুলনীয় সাংস্কৃতিক জীবনের একটা দিকের আস্বাদ পেলাম। দেখলাম সাহিত্য উপভোগের একটা সামাজিক দিকও আছে। শুধু বই পড়ে যে-আনন্দ পাওয়া যায়, সেটাই সব নয়। পাঁচজন সাহিত্যিক আর সাহিত্যানুরাগীর সঙ্গে মিশে আরেক রকম রস পাওয়া যায়। তাতে এক দিকে যেমন আমার সাবালকত্ব পাওয়ার ভারি সুবিধে হয়েছিল, অন্যদিকে নিজের চিন্তাগুলোকে একটু যাচাই করার অভ্যাসও অল্পে অল্পে রপ্ত হয়েছিল। অন্তত শুরু হয়েছিল। দুটি মানুষের সংস্পর্শে এসে এটি সম্ভব হয়েছিল। তাঁরা হলেন ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী আর তাঁর স্বামী প্রমথনাথ চৌধুরী। এঁদের নতুন করে পরিচয় দেবার দরকার না থাকলেও, আমার জীবনে যখন তাঁরা নবাগত হয়ে প্রবেশ করলেন, মনের মধ্যে নতুন একটা সাড়া জেগেছিল। একটা সচেতনতা, নিজেকে প্রকাশ করার একটা ইচ্ছা, একটা পরিচ্ছন্নতার প্রয়াস। এমন মানুষ আমি আগে দেখিনি। কোথাও এতটুকু ছেলেমানুষি ছিল না তাঁদের। সারা জীবন যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত নির্মল রসের মধ্যে ডুবে থেকেছি, এ তার থেকে আলাদা। এর জন্য মনে হত অনেকদিন ধরে নিজেদের তৈরি করতে হয়েছিল, জন্মগত ক্ষমতাগুলোকে কঠোর শাসনে রাখতে হয়েছিল; ভারি একটা সুশ্রী শালীনতার গণ্ডির মধ্যে নিজেদের বেঁধে রাখতে হয়েছিল। ফলে যা লাভ হয়েছিল, তাতে বৈদগ্ধ্য ছিল, সুরুচি ছিল, আত্মসচেতন শিল্পবোধ ছিল, তীক্ষ্ণ মেধা ছিল; সঙ্গে সঙ্গে একরকম আড়ষ্টতাও ছিল, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করে ফেলার একটা ভীতি ছিল। শেষ পর্যন্ত দুজনার মধ্যে কেউ একবারের জন্যেও মনের ঘোড়ার বল্গা ছেড়ে দেননি। ঝরঝরে সুন্দর গান, গল্প, সুর, স্বরলিপি তৈরি হয়েছিল। ভারি যত্নে লালিত, অত্যন্ত পরিপাটি পরিচ্ছন্ন সৃষ্টি সব; কিন্তু বড় বেশি প্রশিক্ষণ পাওয়া, সভ্যভব্য। তার মধ্যে অসামাজিক কিছুর প্রবেশ করা অসম্ভব ছিল, এক যদি না কথাগুলো চতুর সরস বাক্যবিন্যাসের ফাঁকে ফাঁকে নীললোহিতের কিম্বা চার ইয়ারের বাক্যবাণের সঙ্গে সঙ্গে তার একটুখানি ঝল্‌কানি ঢুকে পড়ত। এসব হল গিয়ে আমার অনেক বছরের চেনা-জানার পরের কথা, এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা হলেও, নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন। তবে একেবারে অবান্তর নয়। শিল্পসৃষ্টি করতে হলে এই সচেতনতা আর সযত্ন প্রয়াসেরও দরকার আছে। শুধু খচ্খচ্ করে যা মনে এল তাই লিখে গেলেই যথেষ্ট হল না। মনকেও সাবালক হতে হয়। নাবালকদের জন্য যারা গল্প লেখে, তাদের মনকেও। কাঁচা মন দিয়ে খুব বেশি কাজ হয় না। ঐ দুটি মানুষের কাছাকাছি এসে এই শিক্ষা আমার হয়েছিল। তবে দড়ি-দড়া বেঁধে দিলে আমি এক লাইন্-ও লিখতে পারি না। ওঁদের যখন প্রথম দেখেছিলাম, তখন আমার ১৭ বছর বয়স। স্কুলের দুটি অন্তরঙ্গ বন্ধুর কারণে। তারা ছিল দুই বোন, অলকা চৌধুরী ও পূর্ণিমা চৌধুরী, আমার আজীবনের বন্ধু। পরে অলকার মামার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়াতে সম্বন্ধটা আরো গভীর হয়েছিল, সে সময়ে ওরা ছিল নিতান্ত স্কুলের বন্ধু, যাকে বলে বেস্ট ফ্রেণ্ড। একটা সুবিধা হয়ে গেল যে কথাচ্ছলে বেরিয়ে পড়ল অলকার মা বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের মেয়ে। শুনে মা ভারি খুশি, অলকার মা তাঁর কলেজের সহপাঠিনী, দুই বাড়িতে যাওয়া-আসাও ছিল। কাজেই অলকাদের বাড়িতে দিদির আমার অবাধ যাওয়া-আসার অনুমতি হল। সেকালের সামাজিক জীবনের এই সতর্কতার দিকটার হয়তো দরকার ছিল, কারণ মেয়েদের স্বাধীনতার তখনো তেমন প্রচলন হয়নি। স্কুলের বন্ধুদের মা-বাবাদের কাউকে আমাদের মা-বাবা বা মাসি-পিসি না চিনলে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার অসুবিধা ছিল। পূর্ণিমা অলকার খুড়তুতো বোন।

অলকার বাবা বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও বাঘ-শিকারী কুমুদনাথ চৌধুরী, প্রমথ চৌধুরীর বড় ভাই এবং যে কথা অনেকেই জানে না, নিজেও কম গুণী লেখক ছিলেন না। সম্প্রতি নাথ পাবলিশিং হাউস তাঁর ইংরিজিতে লেখা ‘স্পোর্ট ইন ঝিল অ্যাণ্ড জাংগ্ল্’-এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। আমার বন্ধু অলকাই তার বাবার বইয়ের অনুবাদ করে দিয়েছে। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন প্রমথ চৌধুরী আর ইন্দিরাদেবীও মে-ফেয়ারের অলকাদের চমৎকার করে সাজানো যদিও বড় বেশি মরা জন্তুর দেহাংশ দিয়ে ভরা, বাগান দিয়ে ঘেরা বাড়িতে, কিছুদিন ছিলেন। সেইখানে আমার সঙ্গে পরিচয়। অবিশ্যি সবুজপত্রের সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীকে সে সময়ে কে না জানত? আমরা তাঁর বেজায় ভক্ত ছিলাম। তাঁর গল্পে ভারি একটা সভ্য-ভব্য রোমাঞ্চ ছিল আর তাঁর ঝরঝরে মধুর ‘বাঙ্গালী’ বাংলার প্রবল আকর্ষণ কে অস্বীকার করতে পারত? ভাবতাম আমিও ঐ রকম বাংলা লিখতে চাই। লিখিনি অবিশ্যি। এখন মনে হয় চমৎকার ভাষা বটে, তবু এত বেশি আত্মসচেতন যে একটুখানি কৃত্রিমতার ভাব এসে গেছে। কেউ ওভাবে চিন্তাও করে না, কথাও কয় না।

তবু বলব এমন মানুষের জুড়ি দেখিনি; এত গুণী, এমন গুণগ্রাহী। অন্য লোকের মধ্যে এতটুকু গুণ দেখলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে, তাকে পাঁচজনের কাছে পরিচিত করার চেষ্টা করতেন। তাঁদের আয়োজিত পূর্ণিমা সম্মেলনের কথা পরে বলব। মুশকিল হল ওঁদের অন্য একটা দিক নিয়ে; বিশেষ করে ইন্দিরাদেবীর। সঙ্গীত ছিল ওঁদের প্রাণ, ওঁদের বুকের নিশ্বাস, শিরার রক্ত। ইন্দিরাদেবীর সঙ্গীতে পারদর্শিতার কথা অনেকেই জানে; রবীন্দ্রসঙ্গীতের তিনি একজন কর্ণধার এবং শ্রেষ্ঠ কর্ণধার। তাঁর ‘রবিকা’ একরকম তাঁকে হাতে করে তৈরি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি যতখানি বুঝতেন, তেমন আর কেউ বুঝত বলে মনে হয় না। ভারতের প্রথম সিবিলিয়ান রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের একমাত্র মেয়ে, সুরেন ঠাকুরের ছোট বোন; অল্প বয়সে বিলেত ঘুরে এসেছেন; লোরেটো স্কুলে কলেজে পড়েছেন, ইংরিজি বাংলা ফরাসী, তিন ভাষায় পণ্ডিত। এসবই মেনে নিতে পেরেছিলাম। বিপদ হল যখন তখন অর্গ্যানের সামনে বসে, আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা একটা সুর ধরে বলতেন, “গাও দিকিনি!” আমাদের তো চক্ষুস্থির! অথচ অলকা, পূর্ণিমা তাঁর প্রভাবে মানুষ, সঙ্গে সঙ্গে তারা গান ধরত! শ্রদ্ধা ভক্তিতে মন ভরে যেত।

এই প্রসঙ্গে কুমুদনাথের কাছে শোনা একটা গল্প না বলে পারছি না। প্রমথনাথ তাঁর চাইতে মাত্র ১ বছরের ছোট; ইন্দিরাদেবী আরো ৩-৪ বছরের ছোট হবেন; তবে ঠিক কত বছর তা বলতে পারছি না। তাঁদের বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরে, যখন সকলে কুমুদনাথের বিয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছিল, তখন তিনি নিজের চেয়ে প্রায় ২০ বছরের ছোট আমার পরমাসুন্দরী জ্যাঠতুতো ননদ রাধারানীকে বিয়ে করেন। মোট কথা প্রমথ চৌধুরীর বিয়ের পরেও অনেকদিন কুমুদনাথ ব্যাচেলার। একবার কোথাও পাশাপাশি দুই ঘরে দুজনের বাস। রাতে শোয়া অবধি কুমুদনাথ মধ্যিখানের দরজা ভেদ করে শুনতে পাচ্ছিলেন ভাই ভাদ্দর-বৌয়ের মধ্যে আলাপ চলছে। একটু পরে মনে হল প্রেমালাপের পক্ষে গলাদুটি যেন বড় চড়া এবং উষ্ম। আর থাকতে না পেরে, দরজায় কান দিয়ে শুনলেন প্রেমালাপ নয়, বাখ্ আর বেঠোফেনের তুলনামূলক সমালোচনা হচ্ছে; দুই বক্তাই বেশ গরম।

তারপর হয়তো কুমুদনাথ ঘুমিয়ে পড়ে থাকবেন। ভোরে ঘুম ভাঙতেই অবাক হয়ে শুনলেন তখনো পাশের ঘরে আলাপ চলছে। আবার দরজায় কান লাগিয়ে শুনলেন তখনো বাখ্ আর বেঠোফেনের তুলনামূলক সমালোচনা চলেছে ও বক্তারা যেন আগের চেয়েও গরম। তবে মধ্যিখানে ঘুমের বিরতি নেওয়া হয়েছিল কি না বোঝা গেল না।

॥ ২৮ ॥

১৯২৬ – ২৭ সাল; দেশ স্বাধীন হতে তখনো ২০ বছর বাকি। এখনকার ছেলেমেয়েরা পরাধীনতার গ্লানি কাকে বলে তাও জানে না, আবার স্বাধীনতা-সংগ্রামের গৌরব কাকে বলে তাও জানে না। ‘ফরেন’ সাবান, এসেন্স, পেণ্টেলুনের কাপড় কিনে দেমাক করে বেড়ায়। আমার যখন ১৭-১৮ বছর বয়স, তখন বাঙালী ছেলেমেয়েদের কারো যদি বিদেশী কিছু থাকত তো হয় সেগুলো ফেলে দিত, জ্বালিয়ে দিত, নয়তো লুকিয়ে রাখত। মোট কথা গায়ে দিত না। এসব কথা আগেও বলেছি। খদ্দর সকলে না পরলেও, দেশের মিলের মোটা কাপড় পরত। বিদেশী সুতো ব্যবহার করা হয় বলে তাঁতের কাপড়ও অনেকে পরত না। এতদিন পর্যন্ত বাইরে থেকে এইটুকুই দেখা যেত। ভিতরে ভিতরে যে আগুন জ্বলত বাইরে থেকে তার সামান্যই বোঝা যেত। আবার উল্টো দলও ছিল। তারা বলত এত বড় দেশ শাসন করবার ক্ষমতা আমাদের নেই, এখন স্বাধীনতা পেলেও আমরা রাখতে পারব না; শুধু খদ্দর পরে গরম গরম বক্তৃতা করে আর পুলিসের লাঠি খেয়ে দেশ শাসন করবার ক্ষমতা গজায় না। আমার একজন নিকট আত্মীয়াকে এতদূর বলতে শুনেছিলাম যে ব্রিটিশরা এ-দেশ ছেড়ে চলে গেলে, আমরাও সঙ্গে সঙ্গে চলে যাব। আমাদের বয়সী অনেকেই এমন কথা শুনলে চটে যেত। কিন্তু আজ ৫০ বছর পরে, ত্রিশ বছর স্বাধীনতা উপভোগ করে, মাঝে মাঝেই মনে হয় আজ পর্যন্ত কি আমাদের সে বুদ্ধি গজিয়েছে? আর শুধু আমরাই না, গোটা পৃথিবীসুদ্ধ সব দেশ দিনে দিনে ক্রমে নাবালকত্ব প্রাপ্ত হচ্ছে না তো? সে যাইহোক, তখনো চোখে আদর্শবাদের ঘোর লেগে ছিল, ভাবতাম একবার দেশটা স্বাধীন হলেই সকলের সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। এসব বিষয়ে আমাদের সেই ভাইপো অশোক, যাকে মা-বাবা মানুষ করেছিলেন, সে আমাদের মস্ত সহায় ছিল। খদ্দরের জামায় ফুল তোলা হবে, তাকে দিয়ে রঙ মিলিয়ে সুতো কিনতে বলা হলে, সে বলে বসল, “ঐ সব এম্‌ব্রয়ডারি সুতো বিদেশ থেকে আসে, ও আমি কিনতে পারব না।” কি মুশ্কিল! তাকে যত বলা হয় এগুলো ইংল্যান্ডের জিনিস নয়, এসব ফ্রান্স থেকে আসে, অশোক ততই বলে, “ঐ একই হল। সব সায়েবই একরকম।” এই বলে ম্যাড়ম্যাড়ে রঙের দিশী সুতো কোত্থেকে এনে দিল। তা সে ছুঁচে পরিয়ে ফোঁড় তুলতে গেলে সুতো ফেঁসে যায়! অশোক কিছুতেই বিদেশী সুতো আনবে না, তাতে নাকি খদ্দরের অপমান হয়। সেই সময় মুগার আর গরদের এম্‌ব্রয়ডারি সুতো ওঠাতে সমস্যা ভঞ্জন হল।

তবে মজার ব্যাপারও হত। ভারি গুণী এক বাঙালী মেয়ে, আই সি এসের কন্যা, বিলেত থেকে পাস্-টাস্ করে দেশে ফিরে খদ্দর পরা ধরল, কংগ্রেসের সভায় বক্তৃতা দিতে শুরু করল। একজন আই সি এস্ পাত্রের সঙ্গে তার বিয়েও স্থির হল। অশোক আই সি এসদের যেমন ঘৃণা করত—বলত সায়েবদের শেয়াল—খদ্দরধারীদের তেমনি ভক্তি করত। এবার সে দোটানায় পড়ে গেল। তার ওপর কে যেন বলে গেল ঐ বিয়েতে দিশীমতে অনুষ্ঠান ছাড়াও একদিন আগে কি পরে ফ্যাশানেব্‌ল্‌ বন্ধুদের জন্য—তাদের মধ্যে প্রচুর সায়েব থাকবে—কক্‌টেল পার্টির ব্যবস্থা হয়েছে। বলাবাহুল্য তাতে বিলিতী পানীয় পরিবেশন করা হবে। অবিশ্যি ইচ্ছা থাকলেও দিশী কড়া পানীয় দিতে পারত না, কারণ তাড়ি আর ধেনো ইত্যাদি ছাড়া দিশী মদ পাওয়া যেত না। অশোক তখন এই রকম খদ্দরধারী কক্‌টেল-আমোদীদের প্রতি তিক্ত শ্লেষবাক্য প্রয়োগ করতে লাগল। আমিও যে একটু হকচকিয়ে যাইনি তা নয়। পরে এরকম বহু তথা-কথিত দেশকর্মীদের মধ্যে এই অসংগতি লক্ষ্য করেছিলাম। কিন্তু সত্যের খাতিরে এ কথা বলতে বাধ্য হলাম যে ঐ দুটি মানুষ, ঐ মহিলা ও তার আই সি এস স্বামী সারা জীবন অক্লান্তভাবে ব্যক্তিগত বিলাসিতা ত্যাগ করে দেশের জন্য কাজ করে করে বুড়ো হয়ে গেছেন। দেশ-সেবা আসলে কক্‌টেল পার্টির চাইতে অনেক বড় জিনিস।

ততদিনে বি এ ক্লাস্ শুরু হয়ে গেছে। ইংরিজিতে অনার্স নিয়েছি—নইলে বাংলা লিখব কি করে? আর অঙ্ক ইকনমিক্স নিয়েছি। ফাঁকি দিয়ে নম্বর তুলব ভেবেছিলাম। কিন্তু আবার সেই ফাঁদে পড়ে গেলাম। অঙ্ক দেখলে আর না কষে থাকতে পারতাম না। ছ’টা বইয়ের সব অঙ্ক কষেছিলাম। অবিশ্যি তার জন্য প্রায়ই দাদার দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। এই একটা রহস্যের আজ পর্যন্ত মীমাংসা করতে পারলাম না। সত্যি বলছি অঙ্ক কষতে আমার ভালো লাগত না, অথচ না কষেও থাকতে পারতাম না। যখন কাল্পনিক সংখ্যার পর্যায়ে উঠলাম, অ্যাস্ট্রনমি পড়তে গিয়ে অসীমের মোকাবিলা করতে হল, তখন কেবলি মনে হত এইবার সৃষ্টির রহস্য বুঝি আমার হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা দেবে, কিন্তু কেবলি সে আমার উৎসুক মুঠি এড়িয়ে যেত। দিদিকে ব্যাপারটা বলবার চেষ্টা করতেই, সে অবাক হয়ে বলল, “দূর! তা কেন!” রইল ঐ পর্যন্ত। ভালো নম্বর পেয়ে বি এ পাস্ করবার পর আর একবারো অ্যাস্ট্রনমির বই খুলিনি।

ইকনমিক্স ছিল অন্য ব্যাপার। আধবুড়ি মেম মিস্ রাইট আমাদের পলিটিকেল ফিলসফি পড়াতেন, তখনো এটি একটা আলাদা বিষয় হয়নি। বেজায় ভালো লাগত। আর জেনারেল ইকনমিক্স আর ইণ্ডিয়ান ইকনমিক্স পড়াতেন জ্যোতিশচন্দ্র ঘটক। তিনি ছিলেন সুলেখক সতীশচন্দ্র ঘটকের ছোট ভাই। কালো, মোটা, হেঁড়ে গলা, বদ-রসিক। ডবল এম্-এ, ভারি বিদ্বান, কিন্তু বদ্-রসিক। মাঝে মাঝে ওঁর তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর সংস্কৃত ছাত্রীরা মূল সংস্কৃত শ্লোকের ওঁর অ-প্রচ্ছন্ন ব্যাখ্যানা শুনে মুখটুখ লাল করে বলত, “জলের মতো করে বুঝিয়ে দিলেন বটে, কিন্ত ভাই লোকটা ভারি অসভ্য!”

তবে ইকনমিক্স ক্লাসে সে-সবের সুযোগ ছিল না। প্রথম দিনই ইকনমিক্সের বিষয়-বস্তুর ব্যাখ্যা করে বললেন যে অ্যাডাম স্মিথের মতে ইকনমিক্স হল প্রাত্যহিক কাজ-কর্মে রত মানুষের অনুশীলন। আর ঐ প্রাত্যহিক কাজকর্মটি হল নাকি বেচা-কেনা। সস্তায় কিনে, বেশি দামে বেচা। শুনে আমি আর আমার সহপাঠী বন্ধু লিলি সেন রেগে টং! দুজনেই ইংরিজি সাহিত্যের ছাত্রী, এসব কথা মানব কেন? তৃতীয় ছাত্রী হলেন মিস্ ল্যাজারাস্ বলে একজন দক্ষিণ ভারতীয় মহিলা। আমাদের চাইতে অনেক বড়। অনেক বছর স্কুলে পড়িয়ে টাকা জমিয়ে, চাকরির উন্নতিকল্পে বি এ পড়তে এসেছেন। কারো সঙ্গে মিশতেন না। তবে আমি চেষ্টা-চরিত্তির করে ভাব করে ফেললাম। ওঁকে ‘লেজু’ বলে ডাকতাম। লিলি বলেছিল রেগে যাবেন, কিন্তু ‘লেজু’ দেখলাম খুশি হলেন। চমৎকার মানুষ। পাস্ করে আর যোগাযোগ রাখিনি বলে দুঃখ হয়।

সে যাইহোক। সপ্তাহে পাঁচদিন কলেজ বসত, শনি, রবি বন্ধ থাকত। ঐ পাঁচদিনের মধ্যে তিনদিন ইকনমিক্স লেকচার থাকত, একদিন অধীত বিষয় নিয়ে লিখতে হত। প্রশ্ন আগেই বলা থাকত, তৈরি করে এসে, ক্লাসে বসে লিখতে হত। তাতে A, B, C, D নম্বর দেওয়া হত। লেজু প্রশ্ন নিয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে খেটেখুটে উত্তর তৈরি করে, সেটি শিখে নিতেন। লিলি আর আমি পাঠ্য-পুস্তকে যেটুকু বস্তু পেতাম সেটি শিখে সাজিয়ে-গুছিয়ে, তার থেকে ডালপালা বের করে, ফলাও করে লিখতাম। মিঃ ঘটক আমাদের সর্বদা A দিতেন আর লেজুকে B দিতেন। লেজু বড় দুঃখ পেতেন। তাছাড়া ন্যায়-অন্যায় বলেও তো একটা কথা আছে। শেষটা আর থাকতে না পেরে, ক্লাসের মধ্যেই প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হলেন। উঠে, মুখ লাল করে, নরম গলায় বললেন, “আপনি সর্বদা আমাকে B দেন আর ওদের A দেন, অথচ আমি কত খেটে বিষয়টা তৈরি করি। আর ওরা? দে নো নাথিং।”

মিঃ ঘটক এক গাল হেসে বললেন, “ইয়েস্, বাট্ দে রাইট দ্যাট্ নাথিং ইন্ সাচ্ বিউটিফুল ল্যাঙ্গোয়েজ্!!” শুনে আমরা হাসব না কাঁদব ভেবে পেলাম না আর লেজু একেবারে থ’! বলবার মতো কিছু ভেবে পেলেন না! অবিশ্যি ফাইনাল পরীক্ষায় নিশ্চয় আমাদের চাইতে অনেক বেশি নম্বর পেয়ে এইসব ক্ষোভের ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন।

পুজোর পর কলেজের বার্ষিক উৎসব হত। বক্তৃতা, ভোজ, নাটক। আমরা তেল দিয়ে কাঠ-কয়লা দিয়ে গোঁপটোপ এঁকে কেউ কেউ পুরুষ সাজতাম। চমৎকার দেখাত। মালকোঁচা দিয়ে বেনারসি শাড়ি পরতাম, মাথায় কার্ডবোর্ডের ওপর সোনালী কাগজ সেঁটে শিরস্ত্রাণ বানাতাম, কাঠের তলোয়ার হাতে নিয়ে, সে এক ভয়াবহ কাণ্ড করে তুলতাম। তবে সেই তেল-কাঠকয়লার গোঁফের দাগ তুলতে এক মাস লাগত, সে তো আগেও বলেছি। নাটক হত সর্বদা দ্বিজেন্দ্রলালের। সেই সময় লক্ষ্য করেছিলাম একমাত্র “সীতা”-র সংলাপ আগাগোড়া কাব্যে। সে সময় ডায়োসেসান কলেজের সব মেয়েদের নখাগ্রে থাকতেন দ্বিজেন্দ্রলাল। সে-ও তো কম লাভ নয়।

সে বছরও “সাজাহান” মঞ্চস্থ করা হবে বলে মহড়া আরম্ভ হয়েছিল, এমন সময় দিদির, আমার, দুজনারই পা ফুলতে শুরু করল। তখন কলকাতায় সংক্রামকভাবে বেরি-বেরি হচ্ছিল। আসলে বেরি-বেরি নয়, ও-রোগকে বলে এপিডেমিক ড্রপ্‌সি। সেই হল। বহুলোক মরেও গেল। এমনি কোনো লক্ষণ নেই, শুধু অল্প অল্প পা-ফোলা, তারপর যখন-তখন হৃৎ-পিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ঝপাঝপ কত লোক যে মরল তার ঠিক নেই। ডাক্তাররা হকচকিয়ে গেলেন। এ ধরনের মহামারির কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না তাঁদের। কেউ বলল সরষের তেল খেলে হয়, কেউ বলল চাল খেলে হয়। প্রথমে একেক বাড়ির সকলের, তারপর গোটা-গোটা পাড়ার। আমাদের বাড়িতেও ডাক্তার এলেন, চিত্তরঞ্জন দাশের আত্মীয় খগেন ঘোষ। পরীক্ষা করে বললেন, সেজভাই অমিয়র আর অশোকের ছাড়া সক্কলের বেরি-বেরি। এক্ষুনি কলকাতার বাইরে চলে যেতে হবে, দীর্ঘকালের জন্য। সরষের তেল বন্ধ, ভাত বন্ধ। যে-ই এই নিয়ম মেনে চলছে, সে-ই নাকি ৭ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় না একজন লোকের কাছ থেকে আরেকজনের রোগ সংক্রমণ হয়। এ নিশ্চয় খাওয়া-দাওয়া থাকার ব্যাপার।

তাই স্থির হল। আমি থাকব বাবার আপিসের আমাদের সেই প্রফুল্লকাকাবাবুর কাছে, অশোক থাকবে সুন্দর জ্যাঠামশায়ের বাড়ি। বাড়ির ওপর তলায় তালাচাবি দেওয়া হবে। এক তলায় দুজন চাকর থাকবে। রাঁধবার লোকেরও পা ফুলছে, সে আমাদের সঙ্গে চেঞ্জে যাবে। কিন্তু যাওয়া হবে কোথায়? ঠিক হল যাব গিরিডিতে। সেখানকার হাওয়া গায়ে লাগলেই রোগ পালায়, কুঁয়োর জল খেলেই বেজায় খিদে হয়, এক টাকায় দশটা মুরগি পাওয়া যায়। সেখানে গেলে মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে ওঠে। এই ধরনের সব কথা গগনদাদামশাই বাবাকে বলেছিলেন। তাঁর বাড়ি আছে গিরিডিতে, সে-বাড়ি যেন বাবা নিজের বাড়ি মনে করেন। এই বলে একগোছ চাবি বাবার হাতে তুলে দিলেন।

বাবা অবাক হয়ে বলেছিলেন, “মামা, অনেকে কিন্তু এ রোগকে ভয় পায়, বলে ছোয়াঁচে!” গগনদাদামশাই কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, “তাই না আরো কিছু! সরষের তেল খেলে হয়। তোরা ওখানে থাকগে, শীত পড়লে গিন্নি আর আমিও যাব। একটা ঘর বন্ধ থাকে, তোদের অসুবিধা হবে না তো?” এই রকম মানুষ ছিলেন অমল হোমের বাবা গগনচন্দ্র হোম এবং তাঁর স্ত্রী। তাঁদের হৃদয় এবং বাড়ির দরজা অনাত্মীয়ের জন্য খোলা থাকত। অবিশ্যি গগনদাদামশাই নিজেকে এক মুহুর্তের জন্যেও অনাত্মীয় ভাবতেন না। এর আগেও বলেছি মৃত্যুকালে বাবাকে আর ছোট-জ্যাঠামশাইকে তাঁর জন্য হবিষ্যি করতে বলে গেছিলেন এবং বাবারা তাই করেছিলেন।

বারগাণ্ডায় তাঁদের বাড়িটি চোখের সামনে ভাসে। সামনে বারান্দা, পেছনে বাঁধানো উঠোন, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ছিঁচকে চোরের ভয়ে। বড় গরীব ছিল ওখানকার লোক। আতাগাছ, পেয়ারাগাছ। খরখরে শুকনো, কিন্তু কেমন একটা হাসিখুশি ভাব। ঘিয়ে আর তিলের তেলে রান্না হত, তাতে কোনো অসুবিধা হত না। অসুবিধা হত ভাতের বদলে আটার রুটি খেতে হত বলে। বেজায় খারাপ লাগত। অন্য জিনিস যা হয় তাতেই আমি খুশি থাকতাম, কিন্তু দুপুরে একটু ঝোল-ভাত না হলেই নয়। নিরামিষ ঝোলেও আপত্তি নেই, তার সঙ্গে চারটি আতপ চালের ভাত চাই। আর সেই জিনিসটিই বন্ধ! তবে মিষ্টিওয়ালা আসত ক্ষীরের পুর দেওয়া রসগোল্লা আর বড় বড় প্যাঁড়া নিয়ে। কিন্তু ভাতের দুঃখ না যাওয়া পর্যন্ত, কোনো সুখকেই সুখ মনে হত না। সুখের বিষয় ১০ দিন বাদে ঢেঁকি-ছাঁটা চালের ভাত খাবার অনুমতি পাওয়া গেল। লাল লাল, একটু মোটা, একটু কর্কশ ঢেঁকি-ছাঁটা চালের ভাত। স্বাদের আর পুষ্টির দিক দিয়ে তার তুলনা হয় না। খেতাম হয়তো ১ ছটাক, কিন্তু তাতেই সারা দিনের মেজাজ গেল বদলে।

সেকালে সাঁওতাল পরগনার এইসব জায়গার কত আদর ছিল। কি সুন্দর জায়গা; চারদিকে শালবন, ছোট ছোট টিলা, উশ্রী নদী, ফলের বাগান, ঠাণ্ডা শুকনো হাওয়া। তবে গরমের সময় নাকি বেজায় গরম। দূরে দূরে অভ্রের খনি, কয়লার খনি। মোটর রাস্তা ছিল, বন্ধুবান্ধবের যাওয়া-আসা ছিল। বারগাণ্ডাকে একটা ব্রাহ্ম পাড়া বলা যেত। ও-বাড়ির সামনে বুলাদার জ্যাঠামশাই সুবোধচন্দ্র মহলানবিশের বাড়ি, তার এদিকে প্রখ্যাত শিশু-সাহিত্যিক যোগীন সরকারের বাড়ি, তার আকার আবার গোল, নামও গোল-কুঠি কি ঐ ধরনের কিছু। ছুটিতে বারগাণ্ডা গমগম করত। আমরা যখন গেছিলাম তখন বেশি লোক ছিল না।

তবে অনতিদূরে মাকাটপুরে আমার সোনাপিসিমাদের বাড়ি ‘রোজ-ভিলা’। তার একটা বড় বৈশিষ্ট্য যে একটিও গোলাপ-গাছ ছিল না। গোলাপ-গাছ না থাকলেও পিসিমা ছিলেন, ছোট ছেলে-মেয়েরা কয়েকজন ছিল আর ছিল মুকুলদা এবং তার মটর সাইকেল। মুকুলদার কথা আগেও বলেছি, আজ পর্যন্ত সবাই মুকুল বসুকে চেনে, ৭৭বছর বয়সেও সে সিনেমার ছবি-তোলার কাজে অক্লান্তভাবে খেটে যাচ্ছে। ছবি তোলার রাজা সে। মজারও বটে। এক ঘর রুগ্ন ভাইবোনকে নিয়ে জাঁকিয়ে বসত।

ওদের বাড়িতে একটা মস্ত কামরাঙা গাছ ছিল, তাতে ফল পেকে মিষ্টি রসে টৈটম্বুর হয়েছিল। অথচ পিসিমা বলতেন কামরাঙা খেলে জ্বর হয়। ওদের ও-জিনিস খাওয়া বারণ ছিল। কিন্তু আমাদের তো আর বারণ ছিল না, রাশি রাশি কামরাঙা বাড়ি নিয়ে আসা হত। তার ওপর মুকুলদা বলল, “আশা করি তোরা তোদের পাড়ার মুকুন্দ ডাক্তারকে ডাকছিস্ না?” “কেন, ডাকব না কেন?” “মানে, বিশেষ কিছু না, উনি একটু পাগল হয়ে গেছেন কি না। সেদিন দূর থেকে ওঁর স্ত্রী দেখেন তাঁর কোলের ছেলেটার মুণ্ডু ধরে বাপ তাকে এক কলসি সরষের তেলে নামাচ্ছেন! ও কি করছ! ও কি করছ! বলে ছুটে যেতেই, মুকুন্দ ডাক্তার স্ত্রীকে এক হাতে সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘থাক্! আচার হক!’ ওঁকে না ডাকাই ভালো। তাছাড়া দ্বিজেনবাবুর স্ত্রীকে হঠাৎ কামড়েও দিয়েছেন!” ওর গল্পের কতখানি বিশ্বাসযোগ্য ভেবে পেতাম না। কিন্তু মানুষকে সুখী করার ক্ষমতা ওর ছিল। স্রেফ স্নেহ দিয়ে আমাদের বশ করে রেখেছিল। আমি একটু ভালো হলে ওর মটর সাইকেলের সাইড-কারে আমাকে চাপিয়ে পচম্বা ইত্যাদি জায়গায় ঘুরিয়ে আনত। বলত একদিন উশ্রী ফল্‌স্ দেখাবে, সে আর হয়ে ওঠেনি। সে আমার অ-দেখাই রইল।

আমাদের একজন জল তোলার লোক ছিল, তার দুই বৌ ছিল। দুজনকেই ও ভয় পেত। এদিকে আমার ছোটভাই বোনকে খুব তাড়া দিত। একদিন নিচু হয়ে কুয়ো থেকে জল তুলছে, এমন সময় ছোট বৌ ছুটে এসে এক হাত কাচের চুড়ি ওর পিঠে ভাঙল, পিঠ রক্তারক্তি। তারপর আবার ঝড়ের মতো ছুটে চলে গেল। মা বললেন, “কি ব্যাপার?” ঝগড়ু বলল, “বড়-বৌকে হাট থেকে চুড়ি কিনে দিয়েছি কি না। বলেছি এ হাটে ওকেও দেব। তা কে শোনে!” মা বললেন, “দুজনায় ঝগড়া বুঝি?” ঝগডু বলল, “তা হলে তো ভালোই হত, মা। দুজনায় বড্ড বেশি ভাব। এক সঙ্গে জোট করে আমাকে জ্বালায়! ও দুটোকে আপনি যাবার সময় কলকাতায় নিয়ে যান। কি রকম হাতের জোর দেখছেন তো, পিঠটার আর কিছু রাখেনি!”

এ গল্পের শেষ হল যেদিন আমরা সত্যি সত্যি সেরে উঠে কলকাতায় ফিরে এলাম। ভোর-বেলায় ঝগডুর দুই বৌ মায়ের কাছে এসে কেঁদে পড়ল, “মা, বুড়োকে কলকাতায় নিয়ে যান, দেখেছেন তো কেমন খাটতে পারে! ওর মাইনেটা আমাদের পাঠিয়ে দেবেন আর ওকে কখনো ছুটি দেবেন না।”

সত্যি কথা বলতে কি, বড় আনন্দে কেটেছিল আমার গিরিডি প্রবাস। দেখতে দেখতে তিনটে মাস কেটে গেছিল। জানুয়ারির গোড়ার দিকে বড় দিনের ছুটি ফুরোলে, আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম। এসে দেখি একতলার সামনের একটা ঘরে বড় তালা ঝুলছে। ভিতরে গড়পারের বৌদিদিদের আসবাব বাক্স-প্যাঁটরা ভরা। গড়পারের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সেই সপ্তাহেই নানকুদা, মণিদা, বুলুদি আর মানিক আমাদের বাড়িতে চলে এল।

॥ ২৯ ॥

মানিক হল বড়দার ছেলে সত্যজিৎ। তার তখন বছর পাঁচেক বয়স। তার দিদিমার মর্মান্তিক অসুখ, বড়-বৌঠান সেখানে গিয়ে নিজের মায়ের সেবা করছেন। মানিক আমাদের বাড়িতে কয়েক মাস ছিল। ওর দিদিমার মৃত্যুর পর বড়-বৌঠান ওকে নিয়ে গেলেন, ও মামার বাড়িতেই মানুষ হল। আমাদের বাড়িতে খুব

কাছে থেকে দেখেও ভবিষ্যৎ গৌরবের আভাস পাইনি। আসলে তখন নিজের কলেজ জীবন নিয়েই ব্যস্ত, কাজেই অসাধারণত্ব খুঁজিওনি। মনে পড়ে বাবা একবার আমাদের কোথায় যেন নিয়ে গিয়ে আইস্‌ক্রীম খাওয়ালেন আর মানিক ‘গরম করে দাও! গরম করে দাও!’ বলে চেঁচাতে লাগল। বুলুদি ওর দেখাশুনো করত, খুব আদরেই রাখত, আমাদের কাউকে কিছু করে দিতে দিত না। তাতে আমাদের একটু দুঃখ হত।

তাছাড়া মণিদা নান্কুদার কথাও বলতে হয়। ওদের বাবা আমার মাকে মানুষ করেছিলেন; ওরা মায়ের ভাসুরপো হলেও, ছোট ভাইয়ের মতো। মা ওদের বড্ড ভালোবাসতেন। মণিদার ডাইবিটিস্ ছিল বলে রোজ দেখতাম নিজের হাতে বাড়িতে ছানা কেটে, ছানাটিকে প্রায় কাঁচা রেখে একেক দিন একেক রকম করে তৈরি করে দিতেন। নানা রকম রান্না জানতেন মা, প্রায় সবই মণিদার মায়ের কাছে শেখা। ভেবে কষ্ট হয় এই মণিদার পরম দুঃখের সময়, তার জন্য যতখানি করতে পারতাম তার কিছুই করিনি। খালি এন্তার তর্ক করেছি, কারণ মতের অমিল ছিল। মণিদা ছিল গোঁড়া ব্রাহ্ম, তাই বলে একটুও স্নেহশূন্য ছিল না। কিন্তু আমার মনে হত ওর উচিত অনুচিত বিচার বড় অনুদার। বাইরের মতটার নিচে হৃদয়বান মানুষটাকে দেখতাম না। ভারি রসিক ছিল; সেটি খুব উপভোগ করতাম এবং শ্রদ্ধাও করতাম। মণিদার ভালো নাম ছিল সুবিনয়। পাতলা, প্রায় ছয় ফুট লম্বা, ফর্সা মানুষটি; মুখ-চোখ সুন্দর, চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছিল। গানের গলা ছিল; সুন্দর জিনিসের চোখ ছিল; ছোটদের জন্য খুব ভালো লিখত। সব কিছু তলায় তলায় কৌতুকের স্রোত বয়ে যেত। সেটি ছিল তার মনের গুণ। নইলে সাংসারিক দিক থেকে দেখতে গেলে, কি এমন ছিল তার জীবনে যাকে কৌতুকের সামগ্রী বলা যায়, এক হৃদয়টি ছাড়া।

তখন কারো চল্লিশ বছর বয়স হয়েছে শুনলেই মনে হত বুড়ো হতে আর বাকি নেই। মণিদার হয়তো ৩৩-৩৪ বছর বয়স হয়েছিল। ভাবতাম আধ-বুড়ো। আমাদের চাইতে মা-বাবার দলে। অথচ কেবলি আমাদের সঙ্গ খুঁজত। এখন বুঝি মনের কি নিদারুণ নৈরাশ্য নিয়ে ওর দিন কাটত। ব্যবসা লাটে উঠেছে; বাড়িও নিলাম হবে; দেশের জমিজমা আগেই বিক্রি হয়ে গেছে; ডাইবিটিসে শরীর ভেঙে পড়েছে; বৌদিদি ছেলে নিয়ে বাপের বাড়িতে; মামলা চুকবে, মণিদা কোথাও চাকরি পাবে, তবে ভাঙা পরিবার আবার একসঙ্গে হবে। মনের পিছনে এই বোঝা নিয়ে মণিদা আমাদের হাসি তামাশায় যোগ দিত। তার ওপর ব্যবসা ফেল করার জন্য আত্মীয়-বন্ধু কেউ কেউ ওকে দায়ী করতেন। অথচ ওর কোনো দোষ ছিল না, সর্বনাশটিকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল।

আমরা কলেজে চলে যেতাম, খুব কাছেই ডায়োসেসান কলেজ, হেঁটেই যাওয়া-আসা করতাম, আজকাল আর সঙ্গে চাকরও দেওয়া হত না। নান্‌কুদাও সকাল সকাল স্নান করে খেয়ে সিটি স্কুলে পড়াতে যেত। ওর কথায় মনে হত বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় একটা লম্বা কৌতুক নাটক শুরু হয়ে যায়, আর সন্ধ্যায় বাড়িতে আবার পা দেওয়া পর্যন্তও শেষ হয় না। মণিদার দায়িত্ব এবং দুশ্চিন্তার অংশীদার ছিল না নান্‌কুদা। সে কোনো দিনই ইউ রায় এণ্ড সন্সের কর্মী হয়নি। দুশ্চিন্তার অংশীদার না হলেও ব্যবসার দায়িত্বের অংশীদার ছিল বৈকি। কিন্তু কি আশ্চর্য সহজভাবে সেটা সে ঘাড় থেকে ফেলে দিত দেখে অবাক হতাম। মণিদা সমস্ত ভাবনা-চিন্তা একা বয়ে বেড়াত, নান্‌কুদাকে কখনো উদ্বিগ্ন হতে দিত না। তবে একবার নান্‌কুদা ফাঁদে পড়েছিল।

সারাদিন মণিদা উকিল-আদালত করত, মামলা তখনো চলছিল, দেউলে হবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সন্ধ্যের আগে মণিদা বাড়ি ফিরত না। নান্‌কুদার সেদিন কোনো কারণে টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেছিল। আমরা কলেজের পর ব্যাডমিন্টন খেলে বাড়ি এসে দেখলাম মা বিশেষ চিন্তিত। দুজন লোক নাকি কি একটা কাগজ নিয়ে এসে, সেই যে বেলা দুটোয় নান্‌কুদাকে কোথায় নিয়ে গেছে, এখনো তার দেখা নেই। মণিদা বেচারি আদালত থেকে শ্রান্ত মুখে ফিরে, একথা শুনেই বাড়ির চাকরদের জিজ্ঞাসা করল, দরজা খোলার সময় তারা কি বলেছিল। চাকররা বলল, “বলেছিল ওয়ারেন্ট আছে, লালবাজার যেতে হবে। দাদাবাবু বললেন, ভেতরে বলে যাই, কাপড় ছেড়ে আসি। তা ওনারা শুনলেন না।”

সঙ্গে সঙ্গে এক পেয়ালা দুধ খেয়ে মণিদা আবার উকিলবাড়ি চলে গেল। অনেক রাতে খবর আনল বে-আইনী ভাবে নান্‌কুদাকে হাজতে বন্ধ করেছে। ওরা পাওনাদার। এরা দেউলে হলে কিছুই পাবে না বলে রাগ হয়েছে। কাল ভোরের আগে ছাড়ানো যাবে না।

নান্‌কুদা এক রাত হাজত-বাস করে হাসতে হাসতে ফিরে এসে বলল। “ওদের খরচে রাতে ফল আর তিন রকম সন্দেশ খেয়েছি। আজ সকালে মাতঙ্গী-মুদ্রা করলাম, নাক দিয়ে জল টেনে মুখ দিয়ে বের করলাম। তাই দেখে হাজত সুদ্ধ সকলের ভারি ভক্তি হয়েছে। আসার সময় বড় জমাদার পর্যন্ত পায়ের ধুলো নিয়ে আবার যেতে বলে দিয়েছে।” সব থেকে মজার কথা হল নান্‌কুদারও দেখলাম আরেকবার যাবার খুব ইচ্ছে! বলাবাহুল্য সে ইচ্ছা সফল হয়নি।

কত মজা করত মণিদা। আমার জন্মদিনে আমি কলেজ থেকে ফিরতেই নিজে একটা সেলাইয়ের বাক্স উপহার দিয়ে আবার একটা চিরকুটও দিল। তাতে লেখা ছিল, স্নেহের লীলা, আজ তোমার জন্মদিনে গরীব পিসিমার এই সামান্য উপহারটি গ্রহণ করে আমাকে সুখী করবে। ইতি। আঃ তোমার নিস্তারিণীপিসিমা।

এখন আমার নিস্তরিণী পিসীমা বলে কেউ নেইও, তাঁর উপহার দেবার সম্ভাবনাও নেই, তবু আমি বললাম, “যে এনেছে এ চিঠি সে কোথায়?” অশোক বলল, “ব্যাটাকে ভাগিয়ে দিয়েছি। কিন্তু উপহারটা কোথায় গেল?” আমি আবার বললাম, “চিঠি আনল আর তাকে ভাগিয়ে দিলে?” অশোক বলল, “মণিকাকা বলল।” মণিদা বলল, “গেছে ব্যাটা! কিন্তু উপহারটা কোথায়?” যেই না টের পেলাম ওরা আমাকে দিয়ে উপহার খোঁজাতে চায়, অমনি বুঝলাম এ সমস্তই মণিদার কাণ্ড! দিদিকে বললাম, “সব বানানো। ঠিক কি না বল?”

দিদি হাসি হাসি মুখে বলল, “মানে-ইয়ে—” ওকে তো মেরে ফেললেও মুখ। দিয়ে মিছে কথা বেরোবে না; ঠাট্টার সময়ও না। সকলের কি দুঃখ! এত করে শিখিয়ে পড়িয়ে শেষটা সব ফাঁস করে দিল!

সে বছর পুজোর ছুটিতে আমার মেসোমশাই সুরেন মৈত্র আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। তিনি তখন ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ; রমনায় এক সুন্দর বাড়িতে থাকেন। দিন কুড়ি ছিলাম। একটা কারণে ঐ ছুটিটি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। ওখানে সত্যেন বসু আর জ্ঞান ঘোষ বলে দুজন আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল। আর বুদ্ধদেব বসু বলে একজনের নাম শুনলাম। সে আমার সমবয়সী। বছর ১৮-১৯ বয়স। মেসোমশাই বললেন, “ছেলেটির আশ্চর্য সাহিত্য প্রতিভা। একদিন নাম করবে।” অমনি তাকে দেখবার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সে হবার উপায় ছিল না। আমার মাসিমারা বোধ হয় একটু উন্নাসিক ছিলেন। অজ্ঞাতকুলশীল ছোকরা লেখকদের যে বাড়িতে ডাকবেন, বা তারা যেখানে বিচরণ করে সেখানে আমাকে নিয়ে যাবেন, সে আশা নেই বলে আর মুখে কিছু বলিনি। মনে মনে ভেবেছি যে একে আর কিছুদিন আগে প্রবাসীতে পড়া দুটি আশ্চর্য গল্পের লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্রকে দেখতেই হবে। এর অনেক অনেক বছর পরে এরা দুজনেই আমার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। ঢাকার স্মৃতির সঙ্গে তাঁদের নাম জড়িয়ে আছে।

এমন একটা বন্ধ আবহাওয়ার মধ্যে থেকেও আমি কি করে বহির্মুখী হলাম, এর মধ্যে কোনো রহস্যই নেই। বহির্মুখী না হলে কেউ গল্প কবিতা লেখে না; গান রচনা করে না; ছবি আঁকে না; মূর্তি গড়ে না। মনের কথা মনের মধ্যে বন্ধ করে না রেখে স্থানকাল-পাত্র নির্বিশেষে বৃষ্টির জলের মতো তারা ঝরিয়ে দেয় বলেই তাদের দিয়ে ঐ সব কাজ হয়। আবহাওয়া দিয়ে কারো মানসলোক রচনা হয়, এ আমার মনে হয় না। তবে লোকের কাছে বড় বেশি ধরা দিলে মাঝে মাঝে দুঃখ পেতে হয়। আমি যখন অনেক পরে আকাশবাণীতে প্রযোজনার কাজ করতাম, তখন আমার তরুণবন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী এই কথা বলে আমাকে বারবার সাবধান করে দিত। কিন্তু তখন আর উপায় ছিল না; বড় বেশি প্রগলভতার অভ্যাস হয়ে গেছিল; অন্য লোকের গোপন কথা ছাড়া মনে কিছু রাখতে পারি না; নিজের তো গোপন কথা বলে কিছু নেই। কোন জিনিস সম্বন্ধে আমার কি মতামত, কাকে আমার ভালো লাগে আর কাকে তেমন ভালো লাগে না, চিরকাল সব বলে টলে একাকার করি। ওটি আমার নিজের প্রতি নিজের এক ধরনের সততা। তবে খুব বুদ্ধির কাজ বলে মনে হয় না। গুপ্তচরের চাকরি নিলে নির্ঘাৎ আমাকে তাড়িয়ে দিত।

একটা বড় দুর্বলতা ছিল, কেবলি ইচ্ছা করত সকলের আমাকে ভালো লাগুক। কেন যে লাগবে তা জানতাম না; কিন্তু যখনি শুনতাম কেউ অকারণে আমার সম্বন্ধে কটু মন্তব্য করেছে, অমনি ভারি কষ্ট হত। আমার নিজের প্রায় সকলকেই ভালো লাগত; যেই শুনতাম কেউ আমার নিন্দে করেছে, চেনা লোক হলে মনের দুঃখে আর তার ধারেকাছে যেতাম না; কিন্তু যদি সে অচেনা লোক হত, মনে মনে সঙ্কল্প করতাম, এর সঙ্গে ভাব না করে ছাড়ব না। আগে আগে ভালো মন্দ বিচার করতাম; ক্রমে ক্রমে বুঝলাম ভালো-মন্দর সঙ্গে আসলে ভালোলাগার কোনো সম্বন্ধ নেই। ভালোবাসা তো আর ইস্কুলের প্রাইজ নয় যে যে যত ভালো তাকে তত বেশি ভালোবাসব। সারা জীবনে কত লোককে ভালোবাসলাম, কত লোকের ভালোবাসা পেলাম, কিন্তু এই সন্ধ্যাবেলাতেও বুঝে উঠলাম না কি দিয়ে ভালোবাসা হয়। শুধু জানি এর তুলনা নেই ত্রিভুবনে । দুঃখের বিষয় কৈশোরে আর প্রথম যৌবনে ভালোবাসার এই না-বোঝার বিদ্যেটা আয়ত্ত হয়নি।

এত কথা বললাম কারণ বুলুদি থেকে থেকেই বলত, “এই তোদের সবুজ জামার হাতা অত ছোট করে কেটেছিস্‌ কেন? পিসিমার বাড়িতে সবাই নিন্দে করছে!” অমনি মন খারাপ হয়ে যেত। কিম্বা হয়ত বলল, “বীণার বিয়ের সময় ঐ অল্প চেনা ছোকরা তোর মুখের সামনে যখন দেশলাই জ্বেলে ধরেছিল, ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিয়েছিলি কেন? খুব খারাপ দেখিয়েছিল।” নাচার হয়ে হয়তো বললাম, “তাহলে কি করা উচিত ছিল?” “সেখান থেকে উঠে চলে যাওয়া উচিত ছিল নিশ্চয়। ওরকম করলে আত্মসম্মান থাকে না। ওটা অসামাজিক।” সেই তখন থেকেই ‘সামাজিকে’র ওপর ঘেন্না ধরে গেছিল। এখনো মনে হয়। লোকের মনে কষ্ট দিয়ে সামাজিক হতে হবে কেন আর যেখানে কিছু নেই সেখানে ‘কু ভাবলেই বা আত্ম-সম্মান রক্ষা হবে কি করে। তবু ভাবতাম হয়তো। দোষ হয়ে গেছে, মনটা খারাপ হয়ে যেত। মাকে কিছু বলতাম না, তাঁকে বিব্রত করা কেন?

এখনো মনে পড়ে কবি কামিনী রায়ের সেই পঙ্গু ছেলের সঙ্গে আমাদের সকলের ভারি ভাব হয়ে গেছিল। সে মাঝে মাঝে ছুটির দিনে এসে ভাইদের সঙ্গে ক্যারম খেলত, আমাদের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে তর্কাতর্কি করত। সকলেই তাকে পছন্দ করতাম। এর মধ্যে আমার জন্মদিনে সে আমাকে এক গোছা বাছাই করা ইংরিজি বই উপহার দিয়ে গেল। সেকালে দেড় টাকা দু টাকা দিয়ে বিখ্যাত বইয়ের সুলভ সংস্করণ পাওয়া যেত। সবগুলি মিলে হয়তো ৭-৮ টাকা খরচ হয়েছিল আর আমি বেজায় খুশি হয়ে মনাদাকে পায়েস, সিঙ্গাড়া খাইয়ে দিয়েছিলাম। তখন আর বন্ধুবান্ধব ডেকে জন্মদিন করা হত না। যে আসত তাকে একটু মিষ্টিমুখ করানো হত।

ইতিমধ্যে বুলাদার সঙ্গে বুলুদির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিল; বুলুদিকে মাঝে-মাঝে বুলাদার জ্যাঠাইমা নেমন্তন্ন করতেন। একদিন ফিরে এসে বলল, “তুমি অনাত্মীয় ইয়ং ম্যানের কাছ থেকে উপহার নিয়েছ বলে মনার বড় ভাই ওদের বাড়ি গিয়ে তোমার নিন্দে করেছে!” মা তো শুনে ভারি দুঃখিত। কথাটা মনাদার কানে গেল। সে বাড়ি গিয়ে দাদার সঙ্গে ঝগড়া করল। দাদা রেগেমেগে বলল, “মোটেই আমি কিছু বলিনি!” এক কথায় ইংরিজিতে যাকে বলে ‘চায়ের পেয়ালায় ঝঞা’, তাই শুরু হয়ে গেল। আবার ঝড়ের মতো থেমেও গেল। এখন ভাবি যে-জিনিস একেবারে উপেক্ষা করা উচিত ছিল, তাই নিয়ে এত উষ্ণতা কেন। মনে হয় দাদাটি বলেছিল নিশ্চয় কিছু। মেয়েদের ছোট জিনিস নিয়ে জীবন কাটে বলে দেখি অকিঞ্চিৎকরকে প্রাধান্য দেয়। তবে তার জ্বালা খুব কম নয়।

মণিদাও সবই শুনেছিল, কানও দেয়নি। ও ছিল অন্যরকম মানুষ। একটা সফল প্রকাশনালয়ের সম্পাদক ও প্রকাশক হবার জন্য ও জন্মেছিল। কিন্তু ভাগ্যদোষে তা হয়নি। ছোটদের জন্য কি সুন্দর সর তথ্যমূলক সরস প্রবন্ধ লিখত, মজার মজার গল্প লিখত। লেখে তো অনেকেই, ভালোই লেখে। কিন্তু তাদের মধ্যে গুণগ্রাহী কজন হয়? কেউ ভালো আঁকতে পারে বা লিখতে পারে বুঝতে পারলেই মণিদা তাকে কি ভাবে সাহায্য করা যায় তাই ভাবতে বসত। ইউ রায় এণ্ড সন্সের মতো একটা কার্যালয় থেকে ভ্রষ্ট হয়ে ওর নিজের গুণগুলো ঠিক ফুর্তি পাচ্ছিল না। তবে কত লোক যে ওর গুণ সম্বন্ধে সচেতন ছিল তার ঠিক নেই। একবার দেব-সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকীর সম্পাদনা করেছিল। সে বইয়ের তুলনা হয় না। রামধনুর সম্পাদক সেদিন বলছিলেন, “ঐ মানুষটির কাছে যে আমি কত ভাবে ঋণী সে আর কি বলব! সম্পাদনার কোনো সমস্যা হলেই ওঁর কাছে ছুটে যেতাম। কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না।”

আমিও মণিদার কাছে গভীরভাবে ঋণী। ইউ রায় এণ্ড সন্স উঠে যাবার বছর দুই পরে, নতুন মালিকরা আবার সন্দেশ পত্রিকা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক হন। সুবিনয় রায়ের মতো ভালো সম্পাদক আর কোথায় পাওয়া যাবে? মণিদাও আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। আমাদের সকলেরও কি আনন্দ। মনে হল হারানো সাম্রাজ্যের সবটাই তাহলে ধ্বংস হয়নি। বছরটা মনে নেই। আমি হয় চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীতে পড়ি, নয় বি-এ পরীক্ষা দেব দেব করছি। মণিদা জিওলজিকেল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়াতে ভালো চাকরি পেয়ে, নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাটে উঠে গেছে। ছেলে নিয়ে বৌদিদিও এসেছেন। মাঝে মাঝে তাঁর উৎকৃষ্ট রান্না খেয়ে আসি। এমন সময় মণিদা এসে বলল, সন্দেশের জন্য গল্প না দিলে চলবে না।

কি আর বলব, প্রাণটা পক্ষিরাজের মতো খানিক তড়বড় করেই, ডানা মেলে আকাশে উড়ে পড়ল। মণিদা বলল, “দিন দশেকের মধ্যে দিস্।” সেই আমার দিন-দুপুরে’ গল্পটি লেখা হল। সেই যে ১৯২২ সালে বড়দার কথায় ‘লক্ষ্মী ছেলে’ লিখে আমার নিজের কাজ সম্বন্ধে চৈতন্য হওয়া; তারপর আর কখনো গল্প লিখে ছোটদের কোনো পত্রিকায় দেবার কথা মনেও আনিনি। ইতিমধ্যে আমার সমবয়সী বুদ্ধদেব বসু একজন নামকরা লেখক হয়ে উঠেছেন। আরো কতজন খ্যাতি লাভ করেছেন। সন্দেশ নেই; আমার কোথাও গল্প পাঠাতে ইচ্ছে করত না। মণিদার কথায় হাতে স্বর্গ পেয়েছিলাম। দশ দিন পরে মণিদা গল্প নিয়ে গেল। পড়ে কোনো মন্তব্য করল না। আমি দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করে রইলাম।

পরদিন মণিদা এসে মাকে বলে গেল, “গল্পের জন্য ছবি চাই।” বুঝলাম গল্প উৎরেছে। আঁকলাম ছবি। চাইনিজ ইংক দিয়ে। ছবিটা নিজের খুব পছন্দ হল না। মজার বটে, কিন্তু লাইন আরো বলিষ্ঠ হওয়া দরকার। তবু সে গল্প, সে ছবি, পাঠকদের পছন্দ হল। আর আমাকে পায় কে! তখন থেকে শুরু করে যতদিন এম এ পাস করে, নিজে ইচ্ছা করে পুরনো জীবনের পালা বদলালাম, ২-১ মাস পরে পরেই একটা করে সচিত্র গল্প ‘সন্দেশে’ দিয়েছি। অবনীন্দ্রনাথের মতো আমারো মনে হল অন্তরের একটা বাধা সরে গেছে। আমি নির্ভয়ে একটার পর একটা ছোটদের গল্প লিখে গেছি। সবগুলি সমান উৎরোয়নি। কোনোটা বেশি ভালো, কোনোটা কম ভালো আর কোনোটা আমার মতে ভালোই না। যেগুলি আপনা থেকে মনের মাটিতে ফুল হয়ে ফুটেছে সেগুলি সব চাইতে ভালো। আর যেগুলো দায় পড়ে ফরমাসী লেখা সেগুলো যথেষ্ট ভালো নয়। তার বেশির ভাগই আমি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। যাতে কোনো ভবিষ্যৎ প্রকাশকের আমার ‘অপ্রকাশিত’ রচনা প্রকাশ করার সম্ভাবনা না থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *