পাকদণ্ডী – ১.১৫

॥ ১৫ ॥

চক্ৰবেড়ের বাড়িতে থাকতে থাকতে হঠাৎ একজন দূরের মানুষ খুব কাছে এসে পড়লেন। তাঁর নাম ছিল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, তিনি আমার বড় মেসোমশাই। বড় মেসোমশাইয়ের কথা আগে বললেও, তাঁকে আগে কখনো ভাল করে দেখিনি, কথাবার্তা তো বলিইনি। এই সময় তিনি শিবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তাঁর অনুশীলনের বিষয় ছিল ফিজিক্স, পদার্থবিদ্যা। সে বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি থাকলেও, এমন সাহিত্যানুরাগী মানুষ আমি কম দেখেছি। তার ওপর অপূর্ব গানের গলা ছিল, সঙ্গীত সাধনাও করেছিলেন। মনে হত ফিজিক্স তাঁর জীবিকা আর শিল্প তাঁর জীবন। এমন গুণগ্রাহী মানুষও খুব বেশি হয় না।

মাথায় খুব লম্বা ছিলেন না, রঙ ছিল শামলা, মাথায় মস্ত টাক, পুরু কাচের চশমা না পরলে ভালো করে দেখতে পেতেন না, অনুভূতি ছিল গভীর, দৃষ্টি ছিল কবির। নিজেকে কখনো লোকের দৃষ্টিগোচর করতে চাইতেন না। প্রবাসী ভারতবর্ষে তাঁর সুন্দর সুন্দর কবিতা বেরোত, রচয়িতার নাম থাকত সুরেশ্বর শর্মা। একবার ঐ রকম একটা কবিতা পড়ে বড্ড ভালো লেগেছিল। রচয়িতা কে তখনো জানি না, কথায় কথায় মেসোমশাইকে কবিতা ভালো লাগার কথা বলেছিলাম। তাঁর চোখ দুটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল, কি যে খুশি হয়েছিলেন সে আর কি বলব। গভীর সুরে বলেছিলেন, “তাকে চেনো না! সে যে তোমার মেসোমশাই।” নিজের মেয়ে নোটন ছিল তাঁর অন্তরের ধন, কিন্তু পরের মেয়েকে যতখানি ভালোবাসা যায়, মেসোমশাই আমাকে তার চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন। খালি খালি বলতেন, “তুমি যদি আমার মেয়ে হতে আমি যে কত সুখী হতাম।” আমিও মেসোমশাইকে খুবই ভালোবাসতাম, কিন্তু সর্বদা টের পেতাম আমার ঐ রাগী বাবা ছাড়া কেউ আমার বাবা হতে পারত না। আমার শিরার মধ্যে দিয়ে আজ পর্যন্ত আমার বাপের বংশের রক্ত প্রবল বেগে ছোটে। অথচ সারা জীবন তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে কাটিয়েছিলাম।

মেসোমশাইয়ের সেই প্রথম আমাদের বাড়িতে আসার কথা বেশ মনে আছে। একটা শনিবার, বিকেলের দিকে, ঘেমে ঝোল হয়ে মেসোমশাই দু বাক্স পেলিটির কেক নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন। নাকি অনেক খুঁজতে হয়েছিল। পরে বুঝেছিলাম কোনো জিনিস খুঁজতে ওঁর কোনো দিনই আপত্তি ছিল না। পেলে অবিশ্যি অনেক সময় হারিয়ে ফেলতেন। বড় মাসিমা যখন শিলং-এ ছিলেন, মেসোমশাই তখন বিলেতে। যতদূর মনে হয় ১৯১৭ সালে আই-ই-এস হয়ে ফিরে, প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। মাসিমা তাঁকে আমার ছোটবেলাকার গল্প বলার কথা বলে থাকবেন। মেসোমশাই সেই দিনই আমাকে বলেছিলেন, “তুমি নাকি গল্প বলে সবাইকে বশ কর? আমাকেও কর না।” কোনো দিনও তাঁকে গল্প বলেছি বলে মনে হয় না, তবে তাঁদের বাড়িতে অনেক ছুটি কাটিয়েছি, ইংরিজি বাংলা বই সম্বন্ধে অনেক গল্প করেছি। চমৎকার অনুবাদ করতেন, ইংরিজি থেকে বাংলায়। তাঁর ‘ব্রাউনিং পঞ্চাশিকা’, ‘জাপানী ঝিনুক’ ইত্যাদি গ্রন্থ অতি উঁচুদরের লেখা। যতদূর মনে হয় নিজে খরচ করে ছাপতেন। দুঃখের বিষয় কাব্য রচনায় যতটা দক্ষ ছিলেন, বই বিক্রিতে ততটা ছিলেন না। তাঁদের বাড়িতে মেসোমশায়ের ভাল ভাল বই পড়ে থাকতে দেখেছি। কিন্তু তাঁর ভক্তের অভাব ছিল না, যে কাছে আসত সে-ই তাঁর গুণমুগ্ধ বন্ধু হয়ে পড়ত। এঁদের দলটি নেহাৎ হালকা ছিল না; সে সময়কার বিদ্বৎ-জনদের অনেকেই কোনো না কোনো সময় মেসোমশায়ের বাড়িতে দেখেছি।

তাঁদের মধ্যে অনেক তাঁর অধ্যাপক জীবনের শুরুতে তাঁর ছাত্র ছিলেন, পরে আজীবনের বন্ধু হয়ে গেছিলেন। অনেকেই বিজ্ঞানের সাহিত্যানুরাগী ছাত্র, অনেকে খাঁটি বৈজ্ঞানিক, আবার অনেকে বিজ্ঞানের ধার ধারতেন না, খাঁটি সাহিত্যিক ছিলেন। স্বনামধন্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞান ঘোষ, মেঘনাদ সাহা, কালিদাস নাগ, দিলীপকুমার রায়, হিরণকুমার সান্যাল ইত্যাদি এই দলে ছিলেন। আরো অগুনতি অখ্যাত তরুণ তাঁর কাছে আসত, একটু উৎসাহ, উদ্দীপনার জন্য।

বেশির ভাগ অধ্যাপক প্রগলভ্ হন, মেসোমশাই নিজের মনের মানুষদের মধ্যিখানে ছাড়া বেশি কথা বলতেন না, কিন্তু সকলের কথা উপভোগ করতেন। চোখদুটি কৌতুকে মিটমিট করত, চাপা ঠোঁটে একটা বঙ্কিম রেখা দেখা যেত। পি-ই-এনের আড্ডায় যেতেন, পরিচয় গোষ্ঠির সঙ্গে মিশতেন। পরে তাঁদেরই কারো কারো স্মৃতিকথা পড়ে বুঝেছি এই সুগভীর কিন্তু চাপা মানুষটিকে হৃদয়ঙ্গম করবার ক্ষমতা তাঁদের অনেকের ছিল না।

দরকার হলে মেসোমশাই ধারালো একটা সোনার ছুরি। একবার মাসিমার সঙ্গে ট্রেনে কোথাও যাবার পরিকল্পনা করতে গিয়ে বললেন, “ঐটুকু খোলা মোটরে গেলেই হবে, চাঁদনি রাত, চমৎকার বনভূমি—।” আমরা শুনে কিছু বলার সাহস পাইনি হয়তো পরস্পরের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে থাকতে পারি। কিন্তু সেটি মেসোমশায়ের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি অমনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেছিলেন,”কি? কথাটা শুনে হাসি পেল বুঝি? মনে হচ্ছে বুঝি আধ বুড়োদের শখ দেখ! চাঁদের আলো উপভোগ করতে চায়! ওরে, চাঁদের আলো উপভোগ করতে হলে তার পেছনে আজন্মের অভিজ্ঞতার অনুরণন চাই। তোদের আনন্দ তো বালি-পোরা বেহালার সুরের মতো ঢপ-ঢপ করে। চাঁদের আলো উপভোগ করিস, নাকি তার আনুষঙ্গিকগুলোকে উপভোগ করিস?”

তখনি বুঝেছিলাম কথাটা ঠিক; কিন্তু মেসোমশায়ের মুখে এত কড়া মন্তব্য আশা করিনি। কেউ কোনো উত্তর দিলাম না দেখে, মেসোমশাই একটু আহত হয়ে, অন্য কথা পাড়লেন।

১৯২০-২২ সালে মেসোমশাই শিবপুরে থাকতেন। প্রথমে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট বাড়ির একতলায়, পরে তার পাশের বড় বাড়িতে। ছোটবাড়ির দোতলায় স্যার কে-জি গুপ্তর ছেলে বীরেন গুপ্ত থাকতেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন অ্যামেরিকান; তাঁদের তিনটি লাবণ্যময়ী মেয়ে ছিল। তারা বাংলা-টাংলা বলত না। কিন্তু ভারি মিশুকে আর ফুর্তিবাজ ছিল। আমাদের সঙ্গেও বেশ ভাব হয়ে গেছিল।

ওদের মা ভারি সুগৃহিণী ছিলেন। আমার মা-মাসিকে মাঝে মাঝে সাংসারিক উপদেশ দিতেন। বয়সে বোধহয় তাঁদের সমান-সমানই ছিলেন। আমার তো জ্যাঠামি করার কুখ্যাতি ছিলই, বড়দের কথা ভারি উপভোগ করতাম। তাছাড়া বারো-তেরো বছরের মেয়েরা না-ছোটো না-বড়ো হয়। তারা অনেক কথাই বুঝতে পারে। এবং বড়দের কথায় অশেষ আনন্দ পায়। মনে আছে একবার মিসেস্ গুপ্তকে মা-মাসীমাকে বলতে শুনেছিলাম, “সম্পূর্ণ সুখী হতে হলে স্বামীর সঙ্গে কক্ষনো তর্ক কর না। কে না জানে পুরুষরা কিছু বোঝে না, কেবল বাজে কথা বলে। কখনো তর্ক কর না আর কাজের বেলায় নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতেও ছেড়ো না। ওরা কিছুতেই এসব করে না। তর্ক করতে গেলেই ওদিকে নজর যায়।” এ-যে কি চমৎকার বাস্তব বুদ্ধি, অনেক বছর পরে, আমি সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম। আমার মা অবিশ্যি বাবার সঙ্গে তর্ক করা, কিম্বা তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। তাই বলে নিজের মতটাও সহজে বদলাতেন না। কথা না বললেই কি আর মত বদলায়?

মেসোমশায়ের কাছে আমি উদারতার শিক্ষা পেয়েছিলাম। তাঁর আলমারিতে কত রকম বই ছিল তার ঠিক নেই। তাঁর ভাবখানা ছিল যে সকলের বক্তব্যটা শোনই না, কাজের বেলা নিজের বিচার-বুদ্ধি অনুসারে কর। আমার মাসিমা অতটা উদার ছিলেন না। মনে আছে দিদির জন্মদিনে আমাদের বুলাদা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ উপহার দিয়েছিল। মাসিমা এক্কেবারে শক্ড্। একজন ইয়ং ম্যান কি বলে অনাত্মীয়া অল্পবয়সী মেয়েদের এ-ধরনের বই দেয়! কথাটা মাকে না বলেও পারলেন না। মাসিমা মাকে সব কথা বলতেন। মা শুধু তাঁর ছোট বোন ছিলেন না, অন্তরঙ্গ বন্ধুও ছিলেন, যাকে সব মনের কথা বলা যায়।

মা পড়ে গেলেন মুশকিলে। আমাদের পরিবারের সবাই জানত বুলাদা অন্য ইয়ং ম্যানদের মতো নয়, ওর সঙ্গে আমাদের আলাদা সম্বন্ধ। এক দিন ও আমাদের ছোট জ্যাঠামশায়ের জামাই হবে। কিন্তু কথাটা তখনো প্রকাশ্য নয়। মাসিমাকে মা কি বলেছিলেন জানি না, তবে মাসিমা ও বিষয়ে আর কিছু বলেন নি। অন্য বিষয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। গল্পগুচ্ছের সব গল্প ছোটদের যোগ্য নয়। মা একটু হেসে বললেন, “তেমন ছোট আর কোথায়, তেরো চোদ্দ বয়স হল। ওরা তো সব পড়ে, শরৎবাবুর বই-ও।” মাসিমা প্রায় মুচ্ছো যান আর কি! শেষটা কিছু না বলে দিদির নতুন বইগুলির গোটা আষ্টেক গল্পের পাশে ছোট ছোট দাগ দিয়ে নোটনকে বললেন, “তুমি এগুলো পড়বে না।” নোটনের বাংলা বই পড়ার কোনো আগ্রহই ছিল না, কিন্তু দিদি আর আমি সেই গল্প-গুলোকে খুঁটিয়ে পড়েও আপত্তিকর কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি।

এই প্রসঙ্গে এর প্রায় ত্রিশ বছর পরের একটা ঘটনা না বলে পারছি না। আমার কন্যার তখন এগারো বছর বয়স। একদিন দেখি স্কুলের লাইব্রেরি থেকে একটা রঙচঙে বই নিয়ে এসেছে। আমি দূর থেকে দেখে জিজ্ঞাসা করাতে বলল, “এটার নাম শ্রীকান্ত।” আমি একটু আশ্চর্য হয়ে বললাম, “প্রথম খণ্ড আশা করি?” মেয়ে বলল, “না, না, তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড।”

আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছি না, এমন সময় মেয়ে বলল, “তোমার কোনো ভয় নেই, মা, এতে খারাপ কিছু থাকলেও আমি বুঝতে পারব না, কারণ এটা হিন্দীতে লেখা!” আমি সেখান থেকে সরে পড়লাম। মনে পড়ল মা বলতেন, “সব বই সবাই পড়ুক। নোংরা বই বাড়িতে এনোই না।”

আমাদের দুই পিসির কথাও বলতে হয়। দুজন একেবারে দু রকমের। বড় পিসিমা মোটা বেঁটে, থান পরা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, চুল ছাঁটা, কড়া গলা, কড়া মেজাজ, লেখা-পড়া বিশেষ জানতেন না, কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল আর ভারি স্পষ্ট বক্তা ছিলেন। তার ওপর গায়ে বেজায় জোর ছিল এবং দরকার মনে করলে ছেলেপুলেদের ওপর সেটা প্রয়োগ করতে একটুও আপত্তি ছিল না। সব্বাই তাঁকে ভয় করত। এক বড় জ্যাঠামশাই ছাড়া। পিঠো-পিঠি দুজন পরস্পরকে বুদ্ধি করে সমীহ করেই চলতেন। ছোটবেলায় বাবাদের ধরে বেজায় পেটাতেন।

ছোটপিসিকে আমরা ডাকতাম সোনা-পিসিমা। সেকালে ময়মনসিংহের ডাকগুলো বড় মিষ্টি ছিল। বাড়ির বড়দা হলেন ঠাকুরদা, মেজদা হলেন ছোট্-ঠাকুরদা, সেজদা হলেন সুন্দরদা, তারপর রাঙ্গাদা, ধনদা, ফুলদা, ইত্যাদি। মিষ্টি মিষ্টি আদরের ডাক। আমাদের সময়ে আমাদের কলকাতাবাসী পরিবারের ডাকগুলোর অনেকটা অদলবদল হয়েছিল। ঠাকুরদা, ছোট-ঠাকুরদা ধোপে টেকেনি; কিন্তু বাকিগুলোর কিছু কিছু টিকে গেছিল। বড় পিসিমার মেয়ে ছিলেন কালো, লম্বা, বেশ ষণ্ডাগোছের আর তাঁকে আমরা বলতাম সুন্দরদি। চেহারা যাই হক, মানুষটি বড় সুন্দর ছিলেন। বড়-পিসিমা, সোনা-পিসিমা, সুন্দরদি—সকলেরি ভারি রসবোধ ছিল। কেউ কোনো জন্মে স্কুলে যাননি। কিন্তু শিল্প ও সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁদের মতামত শুনে বারেবারে আশ্চর্য হতাম। শিল্পী হেমেন মজুমদার আমাদের আত্মীয়। ঠাকুমার বোনের নাতিটাতি হবেন। সে-সময় তাঁর ভারি জনপ্রিয়তা; অনেক মাসিকপত্রে তাঁর আঁকা ছবি বেরুত। খুব ভালো আঁকতেন, কিন্তু অনেক ছবিতেই দেখা যেত সুন্দরীরা হয় পুকুরে নেমেছেন, নয়তো জল থেকে উঠে ঘাটে দাঁড়িয়েছেন, কিম্বা ঐ ধরনের কিছু। বড় পিসিমা কালি কলম দিয়ে সেই মেয়েগুলোকে ব্লাউজ পরাতেন। একবার বড় জ্যাঠাইমশায়ের বাড়িতে কোনো বিয়ে-টিয়ে উপলক্ষ্যে হেমেন মজুমদার এসেছেন। বড়-পিসিমাকে দেখেই এক গাল হেসে বললেন, “আপনি নাকি আমার মেয়েদের ব্লাউজ পরান?”

বড়-পিসিমা তেরিয়া হয়ে বললেন,”ভগবান তোকে এত বড় ক্ষমতা দিছেন তো ওগুলানরে জলে চুবাইয়া খাড়া করস্ ক্যারে?”

হেমেন মজুমদার একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “আমরা হলাম শিল্পী, লোকের যেমন রুচি—” বড়-পিসিমা তাতে আরো রেগে বললেন,”শিল্পীর কাম লোকের মন্দ রুচি অনুসরণ করণ, নাকি রুচি তৈরি করে দেওন?” সারা জীবন পূর্ব-বঙ্গের পাড়াগাঁয়ে কেটেছিল, সেরকম লেখাপড়া শেখেননি, বাল-বিধবা, অথচ এই ধরনের একেকটা কথা বলতেন। মাসে মাসে বাবাকে একখানি পোস্ট কার্ড লিখতেন, তার সম্বোধন ছিল ‘প্রাণাধিক শম্ভু’। আমরা তাই নিয়ে হাসাহাসি করতাম, কিন্তু এখন মনে পড়ে চিঠিতে কখনো একটি বানান ভুল থাকত না। বই ছাড়া বড়-পিসিমার এক দিনও চলত না, রামায়ণ মহাভারত তো ছিলই, তাছাড়া ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্স থেকে প্রকাশিত যাবতীয় বই বোধহয় পড়তেন। একবার তাঁর পড়বার চশমাটি নিখোঁজ হয়ে গেল। বড় পিসিমা পড়লেন মহা মুস্কিলে, বাড়িসুদ্ধ সকলে তটস্থ। পরদিন সকালবেলায় ময়মনসিংহ শহর থেকে বড় স্যাকরা পিসিমার সোনা বাঁধানো চশমাখানি নিয়ে এসে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বড়খোকা এইটি বন্ধক দিয়ে দশ টাকা নিয়ে কলকাতা গেলেন।” বড়খোকা হল পিসিমার মা-বাপ-মরা বড় নাতি। তার সে দিন মামার বাড়িতে যাবার কথা ছিল। তাই কেউ খোঁজ করেনি। তার উপর রাগ করা পিসিমার পক্ষে ছেলেকে খুঁজে পেতেও বিশেষ অসুবিধে হয়নি। মোল্লার দৌড় তো মসজিদ্ পর্যন্ত। সে-ও শিয়ালদা স্টেশনে নেমে গুটি গুটি রাজা দিনেন্দ্র স্ট্রীটে আমার সুন্দর জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে উঠেছিল। তাকে চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, নিউ-মার্কেট, বায়োস্কোপ দেখিয়ে দিয়ে কার সঙ্গে যেন আবার দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

দেশ। আমাদের বাড়ির সবাই ময়মনসিংহকেই দেশ বলত। আমরা জন্মেছিলাম কলকাতায়, জীবনে কখনো ময়মনসিংহে যাইনি, তবু দেশ বলতেই আম-কাঁঠালের বনে ঘেরা, বড়বড় পুকুর-ওয়ালা একটা গ্রামের কথা মনে হত। শেষ পর্যন্ত সেখানে যাওয়া হয়নি। তবে মা-বাবার আর জ্যাঠাদের কাছে আর পরে বড়-পিসিমার আরেক নাতি, অশোকের কাছে এত গল্প শুনেছি যে আজ অবধি বিশ্বাস করা কঠিন যে সেখানে কখনো যাইনি।

বাবারা নিজেদের মধ্যে বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। বড়-জ্যাঠামশায়ের, সুন্দর জ্যাঠামশায়ের বাড়ির ছেলেমেয়েরাও তাই বলত। যে-বাড়ির মায়েরা এ-দিককার মেয়ে তারা বলত না। তবু আমাদের সকলের কথার মধ্যে দুটো-একটা লাগসই বাঙাল শব্দ ঢুকে যেত। যদিও পূর্ব-বঙ্গীয় টান একটুও ছিল না। সুন্দর দেখতে জিনিস হল ‘বাঁক্কা,’ বোধ হয় বঙ্কিম থেকে। লাগসই হল ‘যুইৎ’, বোধহয় যুৎ সই থেকে। ‘যুইৎ’ পাচ্ছি না মানে ‘সুবিধে পাচ্ছি না;। ‘বেবাক’ কথার তো সব জায়গায় চল আছে। অনেক আরবি ফারসি শব্দ পূর্ববঙ্গের ঘরোয়া ভাষায় চলে গেছে। বড় সরস মিষ্টি ময়মনসিঙ্গি কথা।

আমরা চক্ৰবেড়ে রোডের বাড়িতে থাকতে থাকতে একদিন ছোট জ্যাঠামশাই এসে বললেন, ঠাকুমা এসেছেন, বড়-জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে উঠেছেন, আমাদের দেখতে চেয়েছেন। এর আগে ঠাকুমাকে যদি দেখেও থাকি তো মনে নেই। তবে আমাদের বাড়িতে ঠাকুমার একটা বড় ফটো ছিল, সেটির মধ্যে আমি নিজের সঙ্গে আদল খুঁজে পেতাম। এবার বড় জ্যাঠামশায়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে ভালো করে দেখলাম। দোতলার চওড়া বারান্দায় একটি মোড়ার ওপর থান পরে, পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে বসে ছিলেন। সামনে আরেকটা মোড়ায়, লম্বা হাতা আদ্দির জামা আর তসরের থান পরে সোনা-পিসিমা বসে ছিলেন। ঠাকুমা থেকে থেকে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল আর কাউকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। সোনা-পিসিমার বয়স তখন বছর চল্লিশ হবে, সদ্য বিধবা হয়েছেন। ঠাকুমা হয়তো মেয়েকে থান-পরা অবস্থায় দেখেননি। এই মেয়ের যখন বছর দেড়েক বয়স, ঠাকুমাও বিধবা হয়েছিলেন। বড় জ্যাঠামশায়ের হয়তো বছর বাইশ বয়স ছিল, বিয়ে হয়েছিল, গণিতে ও সংস্কৃতে ডবল এম্-এ, অধ্যাপনা করেন। তিনিই তখন বাড়ির কর্তা। বাবা আর সোনা-পিসিমা বাপকে মনে করতে পারতেন না। স্নেহে এবং কড়া শাসনে বড় জ্যাঠামশাই একাই একশো ছিলেন। তবে তাঁকে কর্মস্থলে থাকতে হত। দেশের বাড়িতে বাবার আর সোনা-পিসিমার শৈশব কেটেছিল, পরস্পরের সঙ্গে মারামারি করে। বাবা দেখতে মোটা-সোটা ছিলেন বলে, তাঁকে দাদা বলে না ডেকে,.সোনা-পিসিমা বলতেন ‘লাউয়া’ আর পেট্নাই খেতেন। তাঁর বিয়ে হয়েছিল বিখ্যাত ‘কুন্তলীন’ প্রস্তুতকারক হেমেন্দ্রমোহন বসুর সঙ্গে। তাঁর ছেলে নীতিন বসু, মুকুল বসু, সিনেমা জগতে স্বনামধন্য। গণেশ বোস্, কার্তিক বোস, ক্রিকেটের মাঠের রত্ন। তাঁর মেয়ে মালতী ঘোষাল আর ললিতা দাস সুগায়িকা।

কিন্তু সেদিন বিকেলে দেখলাম ছোট মেয়েটি হয়ে মায়ের হাঁটুর কছে বসে আছেন। পাৎলা ছিপছিপে চেহারা, নিটোল গড়ন, এক মাথা ঘন কালো চুল। কে বলবে চোদ্দটি সন্তানের জননী। চমৎকার ছবি আঁকার হাত ছিল সোনা-পিসিমার। পরে অনেক আদর পেয়েছি তাঁর কছে। তবু সেদিন মনে হয়েছিল আমরা কেউ কিছু না। ঠাকুমাকে পিসিমাকে প্রণাম করা হল, মাদুর পাতা ছিল, তাতে বসা হল। ঠাকুমা দেশ থেকে ক্ষীরের নাড়ু, নারকেলের ইচা-মুড়া ইত্যাদি এনেছিলেন। সে-সব খাওয়া হল, পুঁটলি বেঁধে নেওয়া হল। আমসি নেওয়া হল। কিন্তু ঠাকুমা কোনো দিন আমাদের গায়ে হাত দিয়ে আদর করেছেন বলে মনে পড়ে না। কখনো আলাদা করে আমাদের সঙ্গে বোধ হয় কথাও বলেননি। পরের বছর ৮০ বছর বয়সে মারা গেছিলেন। জ্যাঠামশায়ের ঐ বাড়িতে এসে। অনেক দিন থেকে পেটের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। মায়ের কাছে শুনেছি বড় জ্যাঠাইমা আর সুন্দর জ্যাঠাইমা ছাড়া, বাকি তিন বৌকে নিয়ে ঠাকুমা ভারি বিব্রত হয়ে পড়তেন। তিনজনেই বামুনের মেয়ে। তাদের প্রণাম নিলে যদি পাপ হয়। তবে তিনজনের মধ্যে মায়ের স্থান একটু আলাদা ছিল। মায়ের মা মারা গেলে, বাপ সন্ন্যাসী হলেন। উপেন্দ্রকিশোর তাঁর বন্ধু ছিলেন, পাশের ঘরে থাকতেন। তিনিই মাকে মানুষ করার ভার নিলেন। অন্য দুই বোন দুই জায়গায় গেল। ছোটবেলায় কোনো সময় চুল কামানো হয়েছিল বলে মায়ের ডাকনাম ছিল ন্যাড়া। সুন্দর জ্যাঠামশাই, ছোট জ্যাঠামশাই চিরকাল তাঁকে ঐ নামে ডেকে গেছেন। তুই ছাড়া তুমি বলেননি। ভাসুর হয়েও না। ঠাকুমাও মায়ের প্রণাম নিতেন।

বড় জ্যাঠামশায়ের আমহার্স্ট রো-র ঐ চক মেলানো পুরনো ভাড়া বাড়িটাতে যে ভূতের উপদ্রব ছিল, সে কথা আমাদের সমবয়সী দিদিরা, ভাইপোরা প্রায়ই বলত। তবে তাতে বোধ হয় জ্যাঠামশায়ের কিছু এসে যেত না। অন্য কারো কিছু ক্ষতি হয়েছিল বলে শুনিনি। মাঝখান থেকে আমরা যথেষ্ট রোমাঞ্চ উপভোগ করেছি।

বড় জ্যাঠামশায়ের চার ছেলে ছিলেন, মনোরঞ্জন, রোহিণীরঞ্জন, সুধীরঞ্জন, কুমুদরঞ্জন। এঁদের মধ্যে একমাত্র কুমুদরঞ্জন তাঁর সংস্কৃত বিদ্যা, বিশেষ করে তাঁর আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। এঁরা কেউ নেই, তবে এঁদের ছেলেমেয়েরা আছে। বড় জ্যাঠামশায়ের চার কন্যাও ছিলেন। তিনজন এখনো আছেন। কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি, তখন বড় জ্যাঠামশায়ের বাড়ি, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, আত্মীয়-অনাত্মীয়, আহুত-অনাহুতে গমাগম করত। পিড়ি পেতে খাওয়া হত, মাদুরের ওপর বিছানা পেতে অনেকে শুত। সকলের এক ব্যবস্থা ছিল, ব্যবহারের তারতম্য ছিল না। জ্যাঠাইমাও অসাধারণ মেয়ে ছিলেন।

॥ ১৬ ॥

ঐ যেমন বললাম, দুই পিসিমা, গিরিবালা আর মৃণালিনী, দুজনার চেহারায় ও স্বভাবে কোনো মিল ছিল না। কিন্তু সাদৃশ্যও যথেষ্ট ছিল। দুজনের সমান রন্ধন-পটুত্ব, সমান মেজাজ, সমান রসবোধ। সোনা-পিসীমা নিজে নিজে ইংরিজি শিখেছিলেন। কলকাতায় তাঁর জীবন কেটেছিল। বয়সে ছিলেন বড়-পিসিমার একমাত্র মেয়ে বিদ্যুল্লতার সমান। বিদ্যুল্লতাই আমাদের সুন্দরদি। তফাৎ আরো ছিল। বড় জ্যাঠামশাই আর বড় পিসিমা গোঁড়া হিন্দু। সোনা-পিসিমার হিন্দুমতে বিয়ে হলেও, পিসেমশাই হলেন আনন্দমোহন বসুর ভাইপো এবং নিজেও ব্রাহ্ম-ঘেঁষা। পরে এঁদের ছেলেমেয়েদেরো ব্রাহ্মমতে বিয়ে হয়েছিল। একবার বড়-পিসিমারা যখন দল বেঁধে পুরী-ভুবনেশ্বরে তীর্থ করতে গেলেন সোনা-পিসিমাও ওঁদের সঙ্গে ঝুলে পড়লেন। তবে সেটা জগন্নাথ দর্শনের আকর্ষণে, নাকি সমুদ্র দেখার আকর্ষণে, সেটা বলতে পারলাম না। সমুদ্র-স্নানে সোনাপিসি যে খুব আগ্রহী ছিলেন, তা মনে হত না। কারণ একটা ঘটি নিয়ে সমুদ্র-স্নানে যেতেন। এবং যেখানে বালির ওপর ঢেউ আছড়ে পড়ে, তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে বসে পড়তেন। থেকে থেকে ঢেউয়ের স্রোত এসে তাঁকে ঘুরিয়ে, সারা গায়ে বালি মাখিয়ে দিত। পিসিমা অমনি দু ঘটি বালি সুদ্ধ জল মাথায় ঢেলে উঠে পড়তেন। তারপর বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ ধরে তোলা জলে স্নান করতেন। কিন্তু হাজার হক শিল্পী মন ছিল, সাগর দেখেই সুখ।

ঐখানেই হাঙ্গামার শেষ নয়। বড়-পিসিমা অনেক টাকা খরচ করে পুজো দিয়ে মহাপ্রসাদ নিয়ে এলেন। এই মহাপ্রসাদ কালীভক্তদের মহাপ্রসাদ নয়। এ প্রসাদে একশো রকম মিষ্টি থাকে শুনেছি। সোনা-পিসিমা তাই দেখে মহা খুশি হলেন। রাতে দু-হাত পেতে একটি মাত্র মিষ্টি নিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন। তারপর ভোর থেকে মহা বিপদ। দৌড়োদৗড়ি। নাড়ি ছেড়ে যায় আর কি। ডাক্তাররে! ওষুধরে! সন্ধ্যেবেলায় সোনা পিসিমা একটু সুস্থ হয়ে উঠে বসলে পর, বড় পিসিমা ফোঁস্ করে নাক দিয়ে ছোট একটা নিশ্বাস ছেড়ে কাষ্ঠ হেসে বললেন, “আমি আগেই জানি, ভগবানের প্রসাদ ব্রাইম্মের প্যাটে সইব না’।

বড় পিসিমা গোঁড়া হিন্দু হলেও, আমাদের বাড়িতে এসে মাঝে মাঝেই থেকে যেতেন। গোড়ায় নিজে রেঁধে খেতেন। পরে আমার মায়ের হাতেও খেতে আপত্তি করতেন না। বলতেন, ‘বামুনের মেয়ের হাতে খাব না তো কার হাতে খাব।’ অবিশ্যি ঠাকুমা কিম্বা দেশের অন্য আত্মীয়রা কলকাতায় এলে, বড় জ্যাঠামশায়ের বাড়িতেই সাধারণত উঠতেন।

তখন মনে হত বড় জাঠামশাই বেজায় বুড়ো। এখন বুঝি সে রকম কিছুই বয়স হয়নি। বড় জোর ৬৩ মতো হবেন। কিন্তু এমনি গম্ভীর প্রকৃতির আর কড়া মেজাজের মানুষ যে বয়সের তফাৎটাকে অলঙ্ঘেয় বলে মনে হত। মাথায় বাবার চাইতে খানিকটা বেঁটে, এক মুখ সাদা দাড়ি-গোঁফ। বলিষ্ঠ শরীর, পেশীগুলো লোহার মতো শক্ত। প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, আমহার্স্ট রো থেকে হেঁটে গঙ্গার ওপর জগন্নাথ ঘাটে গিয়ে স্নান করে আসতেন। আমরা গড়পারে থাকতে একটা সোমবার, ছোট জ্যাঠামশাই আমাকে সুকিয়া স্ট্রীট দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে ট্রাম ধরা হবে। দিদির জ্বর, আমি একাই বোর্ডিং-এ ফিরছি। মাঝপথে ফতুয়া গায়ে, হাতে ছোট্ট একটা পেতলের কমণ্ডলু ধরা, এক বুড়োর সঙ্গে দেখা।

বুড়ো বললেন, ‘কার পুঁড়ি? ছোট জ্যাঠা বললেন, ‘শম্ভুয়ার’। তারপর আমাকে বললেন ‘প্রণাম কর। উনি বড় জ্যাঠামশাই’। বড় জ্যাঠামশাই বললেন, ‘থাক, থাক, গঙ্গাস্নান করে এসেছি। এর চেয়ে ওঁর আরো কাছে যাবার সাহস পাইনি। কিন্তু মনে মনে ওঁর নানা-গুণ নিয়ে ভারি গর্ব ছিল। যত না তাঁর জ্ঞানবিদ্যের খেলাধূলার ব্যুৎপত্তির জন্য, তার চাইতেও তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার জন্যে।

‘অলৌকিক ক্ষমতা’ কথাটা শুনলে তিনি হয়তো অবাক হয়ে যেতেন, আমরা কিন্তু ওঁর ছেলেমেয়েদের কাছে আশ্চর্য সব গল্প শুনতাম। জ্যাঠামশাই যখন গণিতে এম্-এ পরীক্ষা দেবেন, প্রথম দিনের আগে হল বেজায় জ্বর। কদিনের মধ্যে একবারো বইখাতা ছুঁতে পারলেন না। ঠিক আগের দিন রাতে তাই মন খারাপ করে শুতে গেছেন। রাতে স্বপ্নে দেখলেন যেন সেকালের সেনেট হাউসের একটা বড় থামের পাশে একটা থান ইঁট পড়ে আছে। তারি পাশে ওঁর সীট। উনি যেন সীটে বসে ভাবছেন, “শরীর দুর্বল, ক দিন বই ছুঁইনি, কেমন লিখব কে জানে!” এমন সময় একজন ঝোলা-গোঁফ লোক এসে প্রশ্ন-পত্র বিলি করল। উনি সেটি খুলে প্রশ্নগুলির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল।

কিন্তু এমনি প্রখর ছিল তাঁর স্মৃতি-শক্তি যে ঘুম ভেঙেও প্রশ্নগুলি তাঁর স্পষ্ট মনে ছিল। জ্যাঠামশাই আর ঘুমোলেন না; তখনি উঠে পড়ে প্রশ্নের উত্তরগুলি ভালো করে ঝালিয়ে নিলেন। পর দিন সেনেট হাউসে ঢুকেই, দেখতে পেলেন থামের পাশে ইঁট, ইঁটের পাশে তাঁর সীট। একটু পরেই সেই ঝোলা-গোঁফ লোকটি এসে প্রশ্নপত্র বিলি করে গেল। বলা-বাহুল্য তাতে স্বপ্নে-দেখা সেই প্রশ্নগুলি। জ্যাঠামশাই অনায়াসে সবগুলোর সুষ্ঠু উত্তর দিলেন। অবিশ্যি অন্য দিনের অন্য পরীক্ষাগুলোরও সমান ভালোই উত্তর দিয়েছিলেন। ঐ স্বপ্নের ব্যাপারটার কোনো বাস্তব ব্যাখ্যানা দেবার চেষ্টা করব না। এই রকম একটি অতি-প্রাকৃত ক্ষমতা আমাদের বংশের কারো কারো মধ্যে দেখা গিয়েছে। বাবা জ্যাঠামশাইদের ঠাকুরদাদা লোকনাথ রায়ের ৩৩ বছর বয়সে ইচ্ছা-মৃত্যু হয়েছিল। আমি এসব কাহিনী যাঁদের কাছে শুনেছি তাঁদের অবিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

বড় জ্যাঠামশায়ের নানান্ গুণের মধ্যে সঙ্গীত-প্রীতি ছিল না। বাড়ির ছেলে-মেয়েদের কারো কারো গানের শখ ছিল, কিন্তু তাঁর সামনে গাইবার সাহস ছিল না। শুনেছি একবার দেশ থেকে বাবাদের এক ভাগ্নে এসে, গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। ঠিক সেই সময় জ্যাঠামশাইও কলেজ থেকে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন। তাঁকে দেখেই ছোকরার গান বন্ধ হয়ে গেল, সে পাশ কাটিয়ে নেমে গিয়ে চোঁ-চাঁ দৌড় দিল।

জ্যাঠামশাই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ওপরে উঠে, জ্যাঠাইমাকে বললেন, “বীরুটার বোধ হয় দারুণ পেট ব্যথা। গোঙাতে গোঙাতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল; আমাকে দেখে, বোধ হয় ওষুধের ভয়ে পালাল। তুমি বার্লির ব্যবস্থা কর।”

বড় জ্যাঠামশায়ের প্রকৃত চেহারা দেখতে হলে খেলার মাঠে যেতে হত। এত কড়া মানুষ যে খেলাধুলোয় এত উৎসাহী হতে পারে, এ-কথা তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস হত না। তিনি বাস্তবিকই বিশ্বাস করতেন ক্লাস-রুমে সব মানুষটা তৈরি হয় না; অর্ধেকটা হয় খেলার মাঠে। আমাদের গোটা পরিবারকে তিনি কি গভীরভাবে এ বিষয়ে প্রভাবিত করেছিলেন, সে প্রসঙ্গে পরে আসব। তাঁর হাতে তৈরি দুটি মানুষের কথা বলেছি, ছোট জ্যাঠামশাই আর বাবা। আরেকজন ছিলেন আমার সুন্দর জ্যাঠামশাই, মুক্তিদারঞ্জন। ইনি এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। বিদ্যাসাগর কলেজের গণিতের অধ্যাপক। এটুকু বললে কিছুই বলা হল না। গণিত ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। আমরা যেমন অবসর বিনোদনের জন্য গল্প কবিতা পড়ি, আমার সুন্দর জ্যাঠামশাই তেমনি শক্ত শক্ত অঙ্ক কষে মন ভালো করতেন। নতুন নতুন নিয়ম উদ্ভাবন করতেন। একবার সেই রকম কিছু উৎকৃষ্ট নিয়ম বিলেতের কোনো বিখ্যাত গণিত-বিশারদকে পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি চিঠির একটা মামুলি উত্তর দিয়ে, নিজের বইয়ের নতুন সংস্করণে সুন্দর জ্যাঠামশায়ের নাম উল্লেখ না করেই, নিয়মগুলি ছেপে দিয়েছিলেন। যেন তাঁর উদ্ভাবন। দয়া করে জ্যাঠমশাইকে বইয়ের একটা কপি পাঠিয়েছিলেন। জ্যাঠামশাই কোনো উচ্চবাচ্য করেননি।

অসম্ভব গয়ের জোর ছিল সুন্দর জ্যাঠার। বাবার কাছে শুনেছি, কোনো জিম্‌নেসিয়ামে বাবাকে আর ছোট জ্যাঠাকে নিয়ে সুন্দর জ্যাঠামশাই অভ্যাস করতে যেতেন। তাঁর প্যারালাল বারের খেলা দেখে বাবারা স্তম্ভিত হয়ে যেতেন। রিং ধরে ঝুলে শরীরটাকে হাতের দৈর্ঘের ওপর তুলে ফেলতেন। তারপর মাঝে মাঝে বাবাদের ডেকে বলতেন, “কুইল্যা, শম্ভুয়া, ঝুইল্যা পড়।” অমনি বাবা আর ছোট জ্যাঠামশাই তাঁর দুই ঠ্যাং ধরে শূন্যে ঝুলে পড়তেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে টেনে এক ইঞ্চিও নামাতে পারতেন না।

এই মানুষটিকে আরো কাছে পেয়েছিলাম, যখন আমরা মাস দুই পরে চক্ৰবেড়ে রোডের বাড়ি ছেড়ে রসা রোড আর জাস্টিস চন্দ্র মাধব রোডের মোড়ের একটা বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে উঠে এলাম। বাড়িতে এক টুকরোও আসবাব ছিল না। আমরা মাদুরে বিছানা পেতে শুতাম; আসনে বসে খেতাম; হেঁটে স্কুলে যেতাম। দাদা রোজ হেয়ার স্কুলে যেত; বাকিরা বাড়ির কাছেই এল্-এম্-এস্ স্কুলে ভরতি হল। অনেকে বলত ওটা নাকি দুষ্টু ছেলেদের স্কুল কিন্তু আমার সে-রকম ধারণা হয়নি। দুষ্টু ছেলে কোথায় নেই? তেমনি আবার ঐ স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন সেকালের বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড়, বিদগ্ধ সুধীর চ্যাটার্জি। ওখানে খেলাধূলা, ব্যায়াম, বয়-স্কাউট শিক্ষায়, ছবি আঁকায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। এগুলি আমার মনকে আকৃষ্ট করত।

গরমের ছুটিতে বাবা কলকাতায় বদলি হয়ে এলেন। এসেই ছাদে পাখা ঝোলালেন; টেবিল চেয়ার খাট আলমারি কিনে ফেললেন। ফাঁকা বাড়িটা ভরপূর হয়ে উঠল। কথায় কথায় বকা-বকি সত্ত্বেও, বাবা এসে পৌঁছলে মনে হল এবার আমাদের বাড়ির ফাঁকগুলি ভরে গেল। জীবনের দুঃখ ব্যর্থতা সব মেনে নিয়েও বুঝতে পারি এমন পরিপূর্ণ শৈশব লাভ করা কত বড় সৌভাগ্য। সব সময় মনে হয়েছে আমাদের পায়ের নিচে শক্ত মাটি, মাথার ওপর সস্নেহ প্রহরা, আমরা বড় নিরাপদ। একে একে যখন ছোটবেলাকার অবলম্বনগুলো কালের নিয়মে বিলীন হল, তখনো মনে হয়েছে পায়ের নিচে মাটি থেকে জোর পাচ্ছি।

আমাদের চক্ৰবেড়ের বাড়িতে আবার সকলে নিজেদের একটা ছাদের তলায় মিলিত হয়ে, আমাদের ছোটবেলার যামিনীদার হাতের রান্না খেয়ে, চেনা বাসন-পত্র দেখেই আমরা খুশি ছিলাম। এবার বাবা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের আসা-যাওয়া অনেকখানি বেড়ে গেল। এমন কি একটা ছুটির দিনে স্বয়ং বড় জ্যাঠামশাই আমদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। বাবার ফুর্তি দেখে কে! তাঁর এই বড়-দাদাটি ছিলেন বাপের মতো। বয়সে হয়তো ১৭-১৮ বছরের বড়, ঠাকুরদা মারা যাবার সময় বাবার বয়স বছর পাঁচেক। সারা জীবন এই দাদার স্নেহে ও কড়া শাসনে বাবা মানুষ হয়েছিলেন। আমার গোঁড়া হিন্দু বড় জ্যাঠামশাই ব্রাহ্মদের ওপর খুব প্রসন্ন না থাকলেও, কড়া নিয়মে গোঁড়া ব্রাহ্মদের চাইতে কম যেতেন না। হুঁকো কলকে চলতে পারে, পান চলতে পারে। কিন্তু সিগারেট কখনো না। থিয়েটার কখনো না, বাই নাচ, গানের আসর চিন্তার বাইরে, পরে বায়োস্কোপকে পর্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখতেন। যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাবে,পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে, পড়াশুনো করবে, প্রার্থীকে সর্বদা সাহায্য করবে, খেলাধূলা করবে, হাঁটবে, সাঁতার কাটবে, সম্ভব হলে গাছে ও ঘোড়ায়—চড়বে। আবার কি চাই? এ দিক থেকে বাবাকে নিয়ে বোধ হয় তিনি খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন। ঐ রকম জবরদস্ত ডানপিটে ছেলে কম দেখা যেত, উপরন্তু পড়াশুনোতেও বেশ ভালোই ছিলেন। অঙ্কে বেজায় ভালো। ছবি আঁকতেন চমৎকার। জ্যাঠামশাই আনন্দের সঙ্গে বাবাকে শিবপুর এঞ্জিনীয়ারিং কলেজে পাঠিয়েছিলেন।

সেকালে সেটি ছিল ডানপিটেদের আড়ৎ। বাবার কথায় মনে হত তাদের সঙ্গে তিনি স্বাভাবিক ভাবে মিশে গেছিলেন। বট্যানিকেল গার্ডেনে একবার বাইরের লোক এসে লিচু চুরি করল। সেখানকার কর্তা এক লালমুখো সাহেব এসে কলেজের অধ্যক্ষ আরেক লালমুখো সাহেবকে যা-নয় তাই বলে গেলেন। অধ্যক্ষ ছেলেদের ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তোমরা লিচু খেয়েছ?”

তারা অস্বীকার করাতে বাগানের কর্তাকে বলেছিলেন, “থানায় বল, তারা চোর ধরুক।” কর্তা তবু রাগারাগি করে চলে গেলেন, ভাবখানা যে তুমি সুদ্ধ চোরের সহায় হলে কি করা যায়!

ব্যাপার দেখে ছেলেরা গেল চটে। তাদের জনপ্রিয় অধ্যক্ষের অপমানের উপযুক্ত শোধ নিতে হবে। বাছাই করা কয়েকজন ডানপিটে ছেলেকে নেওয়া হল। যারা গাছেটাছে চড়তে পারে, চালাক-চতুর, বিপদ হলে বিভ্রান্ত হয় না। মন্দ দৃষ্টান্ত দেবার ভয়ে বাবা সে-কথা স্বীকার না করলেও আমরা সর্বদা সন্দেহ করতাম যে বাবাও ঐ দলে ছিলেন। এমন যোগ্য স্বেচ্ছাসেবক কোথায় পাওয়া যাবে? সে যাই হক, মাঝরাতের পরে যখন ঘুম সব চাইতে গাঢ় হয়, সেই সময় গেঞ্জি গায়ে, মাল-কোঁচা দিয়ে ধুতি পরে, খালি পায়ে, কোমরে একটা করে গামছা বেঁধে একদল বে-পরোয়া ছেলে বাগানের উঁচু পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে, নিঃশব্দে, তারার আলোয়, সব লিচু গাছের সব লিচু পেড়ে, গামছায় বেঁধে নেমে এল। গাছে একটিও ফল রইল না। তারপর নিঃশব্দে গঙ্গার তীর ধরে এক মাইল দূরে গিয়ে লিচু-গুলোকে সাবাড় করে, কোথাও একটি আঁটি বা এক কুচি খোসা না ফেলে, সেগুলোকে গঙ্গার জলে ফেলে দিল। ভাঁটার স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ভেসে কোথায় চলে গেল। তারপর প্রসন্ন চিত্তে হস্টেলে ফিরে, হাত-পা থেকে কাদার শেষ চিহ্ন মুছে, গামছা কেচে অন্য ছেলেদের গামছার সঙ্গে মেলে দিয়ে, যে-যার শুতে গেল।

পরদিন সকাল না হতেই মহা সোরগোল। বাগানের সায়েব এসে চ্যাঁচামেচি করতে লাগলেন, “এবার আর কোনো সন্দেহ নেই। এ তোমার ছেলেদের কাজ। ওদের জেলে দেওয়া উচিত।”

কলেজের অধ্যক্ষও কম যান না। তিনি বললেন, “আমার কলেজ তল্লাশী করতে পার, ছেলেদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পার। কিন্তু তুমি কি বলতে চাও যে পঁচিশ ত্রিশটা লিচু-গাছের সব লিচু আমার ছেলেরা তো খেয়ে ফেলেইছে উপরন্তু অতগুলো খোসা বিচিও চিবিয়ে খেয়েছে?” শেষ পর্যন্ত সাহেবকে চলে যেতে হল। অধ্যক্ষ সমবেত ছাত্রদের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন, “ক্লাসে যাও।” এ গল্প নিশ্চয়ই বড় জ্যাঠামশায়ের কানেও গেছিল, তিনিও নিশ্চয় আর কিছু বলেননি।

আরেকবার বাবা শনিবার বিকেলে হস্টেল থেকে বাড়ি এসে দেখলেন শিব-নারায়ণ দাস লেনে বড় জ্যাঠামশাই যে নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন, সেটি বেশ ভালো। বড় জ্যাঠাইমা অবিশ্যি বললেন, “সব ভালো, খালি ঐ ভূতের উপদ্রব ছাড়া।” “ভূতের উপদ্রব, আবার কি?” “সন্ধ্যায় আমি একা থাকি, তখন ভূতে থান-ইঁট ছোঁড়ে।” বড় জ্যাঠাইমা বাবাদের ছোট বেলাকার খেলার সাথী। বেশ কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল; ঠাকুমা ছিলেন ভারি উদার ও স্নেহশীলা। ফলে বৌটি দেওরদের সঙ্গে বাতাবি-লেবু চুরি করে খেত। সে সময় লোকের বিশ্বাস ছিল কামরাঙা কিম্বা বাতাবি খেলে জ্বর হয়। বাতাবিকে আমাদের দেশে বলত ‘জাম্‌বুরা’। এদিকে গাছ ভরা রস-টুসটুসে বাতাবি। দেওররা পাড়ত, বৌঠান নূন লঙ্কা মেখে নির্দিষ্ট নির্জন স্থানে কলা-পাতায় করে লুকিয়ে রাখত। সুবিধে বুঝে নিজে এবং দেওররা গিয়ে খেত। মোড়ের মাথায় একটা নতুন বাড়ি হচ্ছিল। সন্ধ্যেবেলায় বাবাকে ছোকরা চাকরটার সঙ্গে এক গাদা থান ইঁট নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠতে দেখে, বড় জ্যঠাইমা বললেন, “কি করস্, শম্ভুয়া?”

বাবা বললেন, “ভূতের সমাদর।”

আরেকটু রাত হলে রোজ যে দিক থেকে থান ইঁট আসত, সেই দিকে বাবা এগারোটা থান ইঁট ছুঁড়লেন। তার আওয়াজে কানে তালা লাগে। কিন্তু সেই এগারোটা ইঁটেই ভূত পালাল। আর কখনো কোনো উৎপাত করেনি। এ-কথাটাও জ্যাঠামশায়ের কানে গেলে, তিনি শুধু বললেন, “ভূত ভেগেছে সত্যি, কিন্তু যদি নির্দোষ লোকের মাথায় পড়ত?” বাবা মুচকি হাসলেন। নির্দোষ লোক কোথায়? ওদিকে একটা বদমায়েসদের আড্ডা ছিল; বাবার লক্ষ্য অব্যর্থ।

আসলে ডানপিটেমিকে ওঁরা বড় অপরাধ মনে করতেন না। অবাধ্যতা, বেয়াদবি, অসততা, দুর্নীতি সইতে পারতেন না। বাবা যখন জাত ভেঙে, ব্রাহ্ম মতে, আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন, ঠাকুমা আর বড় জ্যাঠামশাই মত দিয়েছিলেন, কিন্তু নিশ্চয় খুব দুঃখিত হয়েছিলেন। তবে বাবার সুখটাই তাঁদের কাছে বড় ছিল। কিন্তু এ-সব ঘটনার প্রায় ত্রিশ বছর পরে আমি যখন আমার হিন্দু স্বামীকে গৌর অ্যাক্ট অনুসারে রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে করেছিলাম, বাবার সম্মতি বা আর্শীবাদ, বা ক্ষমা পাইনি।

সে-সব পুরনো ব্যথার কথা তার পরবর্তী ৪৪ বছরের সুগভীর পরিপূর্ণতায় মুছে গেছে। এখন আর মনে এতটুকু তিক্ততা বাকি নেই। কিন্তু বাবা সেদিনের পর থেকে আর আমার সঙ্গে কথা বলেননি; দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ঐ তাঁর বিশাল হৃদয়ের একটিমাত্র খুঁৎ ছিল; অপরের মনের কথা তিনি কল্পনাও করতে পারতেন না। তাই বলে আমার জীবনের প্রথম চব্বিশটা বছর তো আর কেড়ে নিতে পারেননি। পায়ের তলায় মাটি নিজের হাতে শক্ত করে গেঁথে দিয়েছিলেন, সেটা তো আর নিয়ে নেননি।

ঐ যা বলছিলাম, বড় জ্যাঠামশাইতো এসে উপস্থিত হলেন। সব ঘর দেখলেন; কিচ্ছু খেলেন না, বাইরে তিনি খেতেন না। মা প্রণাম করলেন; তিনি আশীর্বাদ করলেন; কিন্তু ভাদ্দরবৌদের মুখ তিনি সেকালের নিয়ম অনুসারে, কখনো দেখতেন না। আমার জানার মধ্যে মায়ের বিয়ের পর একবারই তিনি মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করেছিলেন। আমরা সকলে আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম। মার নিউমোনিয়া হয়েছিল; রোগটা তখন সবে ভালোর দিকে মোড় নিয়েছে। বড় জ্যাঠাইমার খবর নিতে এলেন। বাবা বাড়ি ছিলেন না। আমাদের কাছে খবর নিয়ে বললেন, “যাই, দেখেই আসি।” এই বলে মায়ের খাটের পাশে চেয়ারে বসে ভারি প্রসন্ন ভাবে অনেক গল্প করে গেলেন, যেন নিজের মেয়ের সঙ্গে গল্প করছেন। জ্যাঠামশায়ের বড় মেয়ে মায়ের চাইতে হয়তো সামান্য বড়ই হবেন। এর পরেই জ্যাঠামশাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে অসুখ সারেনি। তবে এসব হল আরো তিন-চার বছর পরের কথা।

ক্রিকেটের সময় রবিবার রবিবার তিন ভাই এক সঙ্গে খেলা দেখতে যেতেন। প্রথমে আসতেন ছোট জ্যাঠা, “কই রে শম্ভুয়া, স্নান হল?” বাবাও স্নান করে তৈরি। দুজনে পাশাপাশি ভাত খেতে বসতেন। দুরকম ভাত। আমরা চিরকাল আতপ চাল খাই। ছোট জ্যাঠা সেদ্ধ চালের শক্ত ভাত খেতেন। বলতেন, “দ্যাখ্ ন্যাড়া, ওপর থেকে ভাত ফেলবি, পাতে পড়ে ঠুং করবে, তবে বুঝবে ভালো হয়েছে!” বলেছি তো ন্যাড়া মানে আমার মা। তারপর সুন্দর জ্যাঠাও আসতেন, তিনিও মাকে ন্যাড়া এবং তুই বলতেন। তবে লোকের সামনে নয়। চোখের সামনে মানুষ হতে দেখেছিলেন যে। কি আর বলব। সে সময়কার কথা বলতে গেলে আমি পঞ্চমুখ হয়ে পড়ি। পৃথিবীতে যত রকম ভালোবাসা আছে, তার মধ্যে পারিবারিক ভালোবাসা সব চাইতে মধুর।

॥ ১৭ ॥

সকালে খবরের কাগজ খুলে মন খারাপ হয়ে গেল। বাপি বোস পরলোকে গেছে। সমস্ত কৈশোরটা ঝন্ঝন্ করে আমার মাথার ওপর ভেঙে পড়ল। বাপি আমার সোনাপিসিমার অষ্টম ছেলে, আমার চাইতে সাত মাসের ছোট, আমার বন্ধু, আমার ভাই। পঞ্চাশ বছর আগে কেউ যদি বলত বাপি মরে যাবে আর আমি টের পাব না, পরদিন কাগজে দেখব, তাহলে আমার হাসি পেত। এমনি করে গত বছর গণেশদাও চলে গেছিল। আমি জানতে পারিনি, দেখতে পাইনি। তার আগে অনেক দিন দেখা হয়নি, চিঠিপত্র লেখার অভ্যাস না ছিল বাপির, না ছিল গণেশদার। আমার ঠাস বুনটের কৈশোর, তার মধ্যে কি ফাঁকা দেখা দেওয়া সম্ভব? পরের ঘাটতির জন্য কি আগের ঘনিষ্ঠতা মিথ্যা হয়ে যায়?

কত বছর ধরে আমহার্স্ট স্ট্রীটের আমার পিসিমার বাড়ি ছিল আমাদের আনন্দ-নিকেতন। আমরা সবাই জানতাম বাবা থেকে আমার ছোট বোন লতিকা পর্যন্ত যে-কেউ যে-দিন যে-সময়ই ওদের বাড়িতে যাই না কেন, ওদের বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ হাসতে হাসতে ছুটে আসবে। পৃথিবীতে এমন একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া যে কত বড় সৌভাগ্য এখন বুঝতে পারি। তখন নিত্য-নৈমিত্তিকের মধ্যে ধরে নিয়েছিলাম।

ওদের বাড়িটা ছিল পৃথিবীর আর সব বাড়ি থেকে আলাদা। আমহার্স্ট স্ট্রীটের মর্টন ইনস্টিটিউটের পাশে, অনেকখানি জমিওয়ালা মস্ত লাল দোতলা বাড়ি। জমির চারদিকে গাছপালা থাকলেও মধ্যিখানটা ফাঁকা। সেখানে বোধ হয় বারো-মাস ক্রিকেট পেটা হত। এক বৃষ্টি পড়লে বন্ধ থাকত। নিজেরা তো খেলতই, আত্মীয়-স্বজনদের ছেলেরাও খেলত, বন্ধুবান্ধব কত যে আসত, তার ঠিক নেই। ওখানে পঙ্কজ গুপ্ত, বেরি সর্বাধিকারী, বেচু দত্ত রায় ইত্যাদির যখন তরুণ বয়স, তাদের দেখেছি। বেচুদার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, ওর মা আমার বাবার কিঞ্চিৎ দূর সম্পর্কের খুড়তুতো বোন। ঘনিষ্ঠতাটা পারিবারিক কারণে যত না, বন্ধুত্বের কারণে তার চাইতে বেশি। বেচুদার কথা পরে আরো বলা হবে।

পিসিমার বড় ছেলে জিতেন্দ্রনাথ আরবি-ফারসি পড়তেন। মৌলবী রেখে ওমর-খৈয়মের একটা বাংলা অনুবাদ করেছিলেন, সেটি অন্য সব অনুবাদের চাইতে আলাদা, কারণ মূল গ্রন্থ থেকে করা। তার কথা অনেকেই জানে না। জিতেনদার চমৎকার গ্রন্থ সংগ্রহ ছিল। তার মধ্যে বহু দুষ্প্রাপ্য কন্টিনেন্টাল বইও ছিল। দুঃখের বিষয়, জিতেনদাকে কিছুতেই বিশ্বাস করানো যেত না যে ও নিজে ছাড়া আর কারো ওসব বই পড়া উচিত। তবে বইগুলো খাবার ঘরের পাশে একতলার একটা বড় ঘরে বন্ধ থাকত। সে ঘরের দরজায় বড় তালা ঝুলত, কিন্তু গোটা সাতেক বড় বড় জানলায় শিক দেওয়া ছিল না। বাপি আর গণেশদা অতি সহজে জানলার একটা কাচ ভেঙে, হাত গলিয়ে জানলা খুলে, ভিতরে ঢুকে বই বের করে আনত। এই ভাবে আমার কন্টিনেন্টাল সাহিত্যের সঙ্গে প্রথম পরিচয়।

জিতেনদার ছোট আসানদা। সে একা এইচ্ বোস অ্যাণ্ড সন্সের সুগন্ধী দ্রব্যের ব্যবসা দেখত। অন্য ভাইদের একজনেরো এদিকে আকর্ষণ ছিল না। কোম্পানি উঠে যাবার এও একটা কারণ ছিল। আসানদা আমাদের চাইতে ১২-১৩ বছরের বড় ছিল, ওদের বাড়িতে গেলে দেখা পাওয়া যেত না। কিন্তু থেকে-থেকেই আমাদের বাড়িতে এসে রাশি রাশি তেল, সাবান, সেন্ট, সরবৎ, পানের মশলা দিয়ে যেত। পুরনো একটা মটর ছিল, সেটাকে নিজেই মিস্ত্রি লাগিয়ে সারিয়ে-টারিয়ে আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেত। পরে সেজ-ভাই নীতিন আর পঞ্চম ভাই মুকুলদা চলচ্চিত্রে কিছু সাফল্য করলে ভালো ভালো মটর কিনেছিল। ততদিনে আমরা কৈশোর পার হয়ে গেছি। মধ্যিখানে চতুর্থ ভাই কুঁকুদাও আমাদের বন্ধু মানুষ, শিলং-এও গেছিল সে।

মুকুলদার পর গণেশদা, কার্তিকদা, বাপি আর সবার ছোট বাবুলাল। সে আমার চাইতে পাঁচ বছরের ছোট। চার মেয়ের মধ্যে মালতীদি সবার বড়, নামকরা গাইয়ে মালতী ঘোষালকে সবাই চেনে। সে আমার চাইতে বছর পাঁচেকের বড় হবে। ছোট তিন বোন—ময়না, সোনা, দানু, যেন তিনটি সোনার পুতুল। সাজেনা-গোজেনা, চুল আঁচড়ায় না, তবু রূপ ফেটে পড়ে, মুখে সদাই হাসি আর রোগা রোগা হাত দিয়ে আমাদের জড়িয়ে জড়িয়ে ধরত। ময়না, সোনাও চমৎকার গাইত।

এত হাসি, এত গল্প, এত খেলা, এত স্নেহ আমার সোনা-পিসিমার বাড়িতে জমা হয়ে থাকত। লোকে বলত মেয়েরা ভালো; কিন্তু বাড়িতে কোনো বাইরের লোক গেলে, ছেলেরা সব এক্কেবারে ‘নেই’ হয়ে যায়! বাইরের লোকে যাই দেখুক, আমরা দেখতাম এক বাড়ি ছেলেমেয়ের যার যা আছে, অমনি সব খুলে বাড়িয়ে ধরত। বাড়িতে যে আসত, চেনা বা অচেনা, সকলে খাবার শোবার ভাগ পাবে, এটা ছিল জানা কথা।

আমরা শুনেছিলাম আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ওদের অবস্থাই সব চাইতে ভালো। মালতীদির একটা ব্রুচ্ ছিল, তাতে একটা মস্ত মুক্তোর ভিতরে আলো জ্বলত। ব্রুচের তলায় ছোট্ট ব্যাটারি, ব্ৰুচ লাগালেই আলো জ্বলত। এর চাইতে বড়মানুষি আমরা ভাবতে পারতাম না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ওদের বাড়িতে কোনো দিনও কোনো লোক-দেখানি বড় মানুষি দেখিনি। আমার পিসিমার বাড়িটি আমার মনের মধ্যে নরম, গরম ছোট্ট একটি স্নেহের নীড়ের মতো হয়ে আছে, আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো আঘাত পেলে সেইখানে মুখ গুঁজে রাখা যায়। যদিও পিসিমা, জিতেনদা, আসানদা, কুঁকুদা, গণেশদা আর এখন আমার আদরের বাপিও স্বর্গে গেছে। বাড়িটা খালি খাঁ খাঁ করছে। মেয়েদের কোনকালে বিয়ে হয়ে গেছে, কুঁকুদার স্ত্রী, বাবুলালের স্ত্রী কেউ বেশি দিন বাঁচেনি। একমাত্র জিতেনদার স্ত্রী, আমার লীলা-বৌদি শূন্য পরী আগলাচ্ছেন।

পিসিমার বাড়িতে সুন্দর জ্যাঠামশায়ের ছেলেদের কেউ কেউ এসে ক্রিকেট খেলত। তাদের মধ্যে হৈমজারঞ্জন, নীরজারঞ্জন ইন্দুজারঞ্জনকে সবাই চিনত। ক্রিকেট, হকিতে এরা নাম করেছিল। সুন্দর জ্যাঠামশায়ের বড় ছেলে শৈলজারঞ্জন বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা করতেন। খেলাধুলোয় এঁরও খুব খ্যাতি ছিল। মোটর দুর্ঘটনায় শৈলজার একটা পা চিরকালের মতো জখম হলেও, খেলা ছাড়েননি। হৈমদা, নীরজাদা আর নেই, কিন্তু শৈলদা এখনো চলে-ফিরে বেড়ান; মুখে বেশি কথা বলেন না; কি ভাবেন কে জানে। সুন্দর জ্যাঠামশায়ের বাড়ির সকলেরও আলাদা আলাদা ঘর-সংসার। তার ছয় ছেলের চারজন, চার মেয়ের তিনজন আছে। পরিবারে কারো বিয়ে-থা হলে দেখা হয়; আর মাঝে-মধ্যে হয়তো দৈবাৎ দেখা হয়ে গেল, তখন সকলের সে কি আনন্দ। হৈমদার স্ত্রীর, নীরজাদার স্ত্রীর আমার কাছাকাছি বয়স, তারা আমার নিকট বন্ধুর মতো। বড় স্নেহশীল আমাদের পরিবার। কি বৌরা, কি জামাইরা।

১৯২১-২২ সালে কলকাতা শহরে আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকি, কিন্তু সবার খবর সবাই পাই। বাবাদের ক ভাইবোনের সপ্তাহে একবার দেখা হওয়া চাইই। এইভাবে সবার সংবাদ সবাই পেত। আমাদের ছোটদের মধ্যেও খবর চালা-চালি হত। কিছু দিন পরে বুঝতে পারলাম যে একই খবর দু রকম হয়; বড়রা ওপর থেকে দেখেন, ছোটরা তলা থেকে দেখে। নান্‌কুদা আমাদের চাইতে ১০-১১ বছরের বড় হলেও, নিখুঁৎভাবে খবর সরবরাহের কাজ করত। তবে মুশ্‌কিল ছিল যে সবার খবর সবাইকে বলে দিত। কোনো গোপন কথা বলবার আগে ওকে দিয়ে বলিয়ে নিতে হত যে বড়দের বলবে না।

এর মধ্যে আমাদের স্কুলে, ভালো করেই মন বসে গেছিল। কলকাতার স্কুল-জীবন আমরা বড়ই উপভোগ করেছি। পড়াশুনো ছাড়াও মাঝে মাঝে ছোটখাটো উপলক্ষ্যে সংক্ষিপ্ত নাটিকা প্রহসন ইত্যাদি করা হত, ইংরিজিতে বা বাংলাতে। আমি এই সুযোগে হাসির নাটিকা লিখে একটু খ্যাতিও করে ফেললাম। নিজেরাই লিখতাম, নিজেরাই অভিনয় করতাম।

‘প্রসূন’ বলে আমাদের ক্লাসের মেয়েরা একটা হাতেলেখা মাসিক-পত্র বের করতে লাগল। সকলের কি উৎসাহ! একটি মাত্র কপি বেরোত; চমৎকার করে ছবি-টবি আঁকা হত। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, জীবনী সব থাকত। বলা বাহুল্য আমি তার সম্পাদিকা ছিলাম না। আমার সে যোগ্যতা ছিল না, যদিও উচ্চাকাঙ্ক্ষা যথেষ্ট ছিল। কারণ তখনো আমি ‘বাংলায় কাঁচা’। সকলে তাই বলত। বলত আমার গল্প নিঃসন্দেহে সব চাইতে সরস, আমার প্রবন্ধও খুব ভালো, কবিতা লিখতাম না। কিন্তু আমি বাংলা জানি না। এ নিন্দা আমি মেনে নিয়েছিলাম। প্রাণপণ চেষ্টা করে বানানটা অনেকখানি সরগড় করেছি। কিছু কিছু বানানের নিয়মও শিখেছি। এক সারি অভিধানের স্মরণ নিয়েছি। তবু যে অর্থে সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বাংলা জানতেন, আমি এখনো জানি না। বাংলা জানি না, কিন্তু ইংরিজি জানি। তাতে আমার অনেক সাহায্য হয়। অদ্ভুত শোনালেও, কথাটা সত্যি।

ততদিনে ১৯২১ সাল শেষ হয়ে এসেছিল। সারা বছরের ক্লাসের কাজে নম্বর দেওয়ার নিয়ম ছিল। বছর শেষে সেগুলি জুড়ে, যারা যে-বিষয়ে ৭৫% নম্বর পেত, তাকেই একটি ভালো বই পুরস্কার দেওয়া হত। আলাদা প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থানের পুরস্কার দেবার নিয়ম ছিল না। এর একটা সুফল হল যে যে-মেয়ে কোনো একটি বিষয়ে ভালো, অন্য বিষয়ে ততটা নয়, সেও একটি পুরস্কার পেত। একেবারেই কোনো পুরস্কার পেল না, এমন ছাত্রী কম ছিল। আর কিছু না হক গান, সেলাই, ছবি-আঁকা, ড্রিল ইত্যাদিতেও আলাদা প্রাইজ্ ছিল। ভালো ব্যবহারের জন্য নাম লেখা রুপোর পিন্ দেওয়া হত। এখন মনে পড়ছে এই পুরস্কার আমি কোনো দিন পাইনি। তবে সেকালে ‘ভালো ব্যবহার’ বলতে বোঝাত ক্লাসে চুপ করে থাকা, শিক্ষিকা কিম্বা সহপাঠিনীদের সঙ্গে কোনো তর্কাতর্কি করে না। এমন পুরস্কার আমি পাই কি করে?

বাংলার পুরস্কারও পেতাম না। সেজন্য মনে মনে ভারি দুঃখও ছিল। তবে অন্যরা আমার চাইতে বেশি ব্যাকরণ জানত এও সত্যি কথা। বাড়ি এসে এসব দুঃখ চলে যেত। ছোট বোনটার তিন বছর বয়স, তার বড় ভাইটার পাঁচ। গল্প শোনবার জন্য আজকাল এরা দুজনও মুখিয়ে থাকে। এদের আবার শুধু মুখে গল্প বললে চলত না, ছবি এঁকে বলতে হত। একটা স্লেট আর একটা পেন্‌সিল আমার সহায় ছিল। গল্প বলি আর মজার মজার ছবি আঁকি। শেষটা এমন হল যে যোগীন সরকার সম্পাদিত, সিটি-বুক-সোসাইটি থেকে প্রকাশিত চমৎকার সচিত্র খুকুমণির ছড়ারো আরেক সেট্ ছবি আঁকতে হত। সুখের বিষয়, এরা ছবি সম্বন্ধে ততটা তীব্র সমালোচক ছিল না। তবে ছবিগুলোতে প্রাণ থাকা দরকার ছিল, এই লাফাচ্ছে, এই গড়াচ্ছে, এই দৌড়চ্ছে! তাই আঁকতাম আমি। ওরা ভাবত এমন চিত্রকর হয় না। সেই সময় থেকেই নিজের অগোচরে অজ্ঞাতে ছোটদের বই সম্পাদনার পাঠ নিচ্ছিলাম। ঐ রকম ছবি এঁকে এঁকে ওদের আমি সেই ১৩-১৪ বছর বয়সেই পদী-পিসির বর্মী বাক্সের গল্প আগা-গোড়া বলেছিলাম। লিখেছিলাম হয়তো তার ২৫ বছর পরে। ছোট জ্যাঠামশাই ঐ-সর আঁচড়-কাটা ছবি দেখে আমার জন্য পরেশ গুপ্ত বলে একজন প্রবীণ এবং দক্ষ শিল্পী ঠিক করে দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে বছর চারেক চার্কোল ড্রইং, তেল রঙ ইত্যাদি শিখেছিলাম। একবার কংগ্রেস অধিবেশনের মেলায় মহিলাদের বিভাগে দেখানো একটা ছবির জন্য রূপোর পদক পেয়েছিলাম। সন্দেশে সেকালে আমার নিজের গল্পের জন্য কালি দিয়ে, জল-রঙ দিয়ে ছবিও আঁকতাম। তার নমুনা পর্যন্ত নিখোঁজ হয়ে গেছে। পরে লেখাতেই মন দিলাম, ছবি আঁকা ছেড়ে দিলাম। আমার আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই ভালো ছবি আঁকত। হিতেনদা, হিতেনদার ছোটবোন দানু, আমার নিজের ভাইবোনদের কেউ কেউ, ভালোই আঁকত। পত্রিকার ছবি, বইয়ের মলাট এঁকে আমার ভাই অমি কিছু রোজগার পাতিও করেছিল। নিয়ম ছিল ভাই-বোনদের রোজগার করা, বা প্রাইজ-পাওয়া টাকা দিয়ে সবাইকে খাওয়ানো হবে। ভাবি ছোটবেলাটাকে সত্যিই আকণ্ঠ উপভোগ করেছি।

এই সময় বড়দাকে রোগে ধরল। জমিদারী ব্যাপারে বড়দা ময়মনসিংহ গেছিলেন, ফিরে এলেন জ্বর নিয়ে। জ্বর মানে কালাজ্বর। তখনো কালাজ্বরের কোনো ভালো ওষুধ বেরোয়নি। লোকে বলত কোনো রকমে যদি কালাজ্বরের রুগী একটা বছর বেঁচে যায়, তবে আর ও রোগ তার কিছু করতে পারে না। প্রথমটা কেউ সেরকম ভয় পাইনি। বড়দা আমাদের ঘরের আলো ছিলেন। তিনি চলে যাবার পরে ৫৪ বছর কেটে গেছে, তবু তাঁর পায়ের কাছে দাঁড়াতে পারে এমন আর একটিও মানুষ দেখলাম না। আমি ভাবতাম আমি বড়দার ছায়ায় ছায়ায় মানুষ হব। আমার দাদা হলেও, মায়ের থেকে মাত্র ২ ১/২ বছরের ছোট, আজন্মের খেলার সাথী। বড়দার অসুখে দেখতাম মায়ের বড় ভাবনা। প্রথম প্রথম বড়দা ওষুধ-পত্র খেতেন, পথ্যি করতেন বটে, কিন্তু ঘরে একখানি গদী-আঁটা আরাম-কেদারায় বসে নিজের কাজ-কর্মও আগের মতোই করে যেতেন আমরা তাই দেখে আশ্বস্ত হয়ে নিজের নিজের কাজে মেতে থাকতাম। তখনো ভাবতাম, “আমি জানি আমাকে দিয়ে কিছু লেখাপড়া ছাড়া আর কোনো কাজ হবে না; বড়দা আছেন আমার আবার ভাবনা কিসের।”

বড়দা অসুখে পড়বার ঠিক আগেই সত্যজিৎ জন্মেছিল। মাঝে-মাঝেই গড়পারের বাড়িতে গিয়ে ওকে আমরা দেখে আসতাম। ভারি মজা লাগত। মনে হয় শরীরটা বড়সড় কিন্তু সরু ছিল, নাকটা বড় আর পাখির ছানার মতো সারাক্ষণ এত বড় হাঁ করে থাকত। এই সময় বড়দা হঠাৎ একদিন আমাকে বললেন, “সন্দেশের জন্য একটা ছোট গল্প লিখে দে।” আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এমন সৌভাগ্যের কথা আমি ভাবতে পারিনি। কিন্তু পারব তো? বড়দা বললেন, “পারবিনে কেন? ভাই-বোনদের তো ঝুড়ি-ঝুড়ি গল্প বলিস্। সেই রকম একটা দে।”

আমি চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরে এলাম। আমাদের বাড়ির একটা মজা ছিল যে একলা হওয়া অসম্ভব ছিল। এটা সেই বোর্ডিং এর একলা-না-থাকার থেকে আলাদা জিনিস। কারণ এটা স্নেহ দিয়ে মোড়া ছিল। হয়তো নিরিবিলি একটু ভাববার জন্য তিনতলার মস্ত ছাদে গেলাম. তা ছাড়া আর নিরিবিলি কোথায় পাব? পাঁচ মিনিট না যেতে অমনি খোঁজ পড়বেই। ঐ দেখ, নিশ্চয় কারো ওপর রেগেছে ; নয় তো ওকে কেউ কিছু বলেছে; কিম্বা কোনো মুশ্‌কিলে পড়েছে; অতএব চল্ গিয়ে দেখা যাক। আমাদের বাড়িতে কারো প্রাণ ভরে মন খারাপ করবার, কিম্বা নির্জনে চিন্তা করবার জো ছিল না। কাজেই আমার কোনো গল্পই নির্জন-চিন্তা-প্রসূত নয়। মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করতে থাকে, খোঁচা দিলেই ঝরে পড়ে। মাঝে মাঝে আবার পড়েও না। মন তখন বন্ধ্যা মরুভূমি। একটি গল্পও দানা বাঁধে না। আজ পর্যন্ত এমন হয়। একেক বছর পুজোর সময়ও একটিও ভালো গল্প উতরোয় না। জোর করে গল্প লেখা কখনো ভালো হয় না। আপনি ফুলের মতো ফুটল তো ফুটল, নইলে রইল অমনি বন্ধ হয়ে, সময় হলে নিজেই ফুটবে। তখন হয়তো সাত দিনে সাতটি গল্প তৈরি হবে। তবে আমার ঐ প্রথম গল্পটির কুঁড়ি আগে থাকতেই ধরেছিল কি না মনে নেই। এইটুকু মনে আছে, বাড়ি এসে, কাকেও কিছু না বলে খস্-খস্ করে লিখে ফেলেছিলাম। মা এত তাড়াহুড়ো দেখে একটু আশ্চর্য হয়েছিলেন, কিন্তু মুখে কিছু বলেননি। কোনো দিনই মুখে কিছু বলেননি, তবে লেখা যদি ভালো হত, তবে ভারি খুশি হতেন।

সেই গল্প কাউকে পড়াইনি। এখন ভেবে আশ্চর্য লাগে বড়দা কত ক্ষমাশীল ছিলেন। আমি হলে ও গল্প পুনর্লিখনের জন্য ফিরিয়ে দিতাম। রস যথেষ্ট ছিল, বরং এতটা বেশি মাত্রায় ছিল যে বড়দা বুদ্ধি করে খানিকটা ছেঁটে দিয়েছিলেন। ভাষাও একটা চোদ্দ বছরের বাংলায় কাঁচা মেয়ের পক্ষে মন্দ হয়নি। আমার আপত্তি অন্য দিক দিয়ে। ঐ গল্পে একটা মা-বাপ-মরা ছেলে চালাকি করে তার ভালোমানুষ মামাকে ভোগা দিয়ে, তাঁদের বাড়িতে নিজের আদর বাড়িয়ে নিয়েছিল। কেউ ফাঁকি দিয়ে নিজের সুবিধে করে নিচ্ছে, এমন গল্প আমি সন্দেশের সম্পাদনা করতে গিয়ে, কোনোমতেই বরদাস্ত করি না। গল্প যদি ভালো হয় তো পত্রপাঠ পুনর্লিখনের জন্য ফেরত দিই। গল্পের নাম দিয়েছিলাম ‘লক্ষ্মীছাড়া’। ছেলেটার লক্ষ্মীছাড়ামিতে আপত্তি না জানালেও, বড়দা নামটা বদলে ‘লক্ষ্মী ছেলে’ করে দিয়েছিলেন। তার মানে যে লক্ষ্মী ছেলের উল্টোটি, সে-কথা আর বলে দিতে হবে না।

এ-বিষয় আরেকটু বলতে হয়। দুষ্টু ছেলে-মেয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই, আমি নিজেও যথেষ্ট দুষ্টু ছিলাম এবং অনেক দুষ্টু ছেলেমেয়ের গল্প লিখি এবং ছাপাই। আমার আপত্তি হল দুষ্টুমি করে কেউ নিজের সুবিধে করতে পাবে না। যদি মজা করতে পারে, তবে ঐ মজাটাই যথেষ্ট। সবচাইতে আশ্চর্য কথা, এই দিক দিয়ে কেউ গল্পের খুঁৎ ধরেনি। বরং অনেকে ভালো বলেছিল। কিন্তু আমি নিজে খুশি হতে পারিনি। এর পরের ৭ বছরে, অনেক গল্প লিখেছিলাম, আমাদের ‘প্রসূনে’ তার ২-৩ টি বেরিয়েছিল, তার বেশি নয়। সন্দেশে বা অন্য কাগজে যাবার চেষ্টা করিনি। কেবলি বই পড়তাম, লিখতাম আর নিজেকে তৈরি করবার চেষ্টা করতাম। এদিকে বড়দা ক্রমেই আরো রোগা, আরো দুর্বল হয়ে যেতে লাগলেন। তবু বসে বসে হাসি-মুখে কাজ করে যেতেন।

বলেছি তো আমরা পরম নিশ্চিন্তে্ নিজেদের কাজকর্ম করে যেতাম। সোনা-পিসিমার বাড়ির একতলায় একটা ঘেরা উঠোনে, সুন্দর একটা ১২ কোণা লাল চৌবাচ্চা ছিল। তাতে লাল, সোনালী মাছ রাখার কথা। বলা বাহুল্য পিসিমার ছেলেরা তাতে লাল মাছ রাখেনি। তার বদলে রেখেছিল একটা বেজায় বদমেজাজী কুমীর-ছানা। কে যে সেটাকে কোত্থেকে এনেছিল, তা মনে নেই। সেটা আবার দিনে দিনে শশীকলার মতো বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমরা ভয়ে মরি কবে না বেরিয়ে এসে, কাকে কামড়ায়। এমনিতেই তো বেশি ঝুঁকে দেখতে গেলে ফ্যাঁশ-ফ্যাঁশ শব্দ আর দাঁত কট-কট করত। ছোট ছোট লাফ দিত। বেরিয়ে গেলও একদিন। বেজায় বৃষ্টির ফলে চারদিক জলে ভেসে গেল, উঠোনে জল দাঁড়াল, লাল চৌবাচ্চা উপচে পড়ল। সকালে দেখা গেল কুমীর নেই!

সকলের চক্ষুস্থির! পিসিমার সে কি রাগ! কুমীর-পোষা তিনি আদৌ সমর্থন করতেন না। কিন্তু ব্যাটা গেল কোথায়? তিন চার দিন পরে মর্টন ইন্সটিটিউশনের বড় দরোয়ান এসে বলল, “খোকাবাবুরা! ওদিকে কাঠ-গুদোমে কেউ ঢুকতে পারছে না, কি যেন ফোঁশ-ফ্যাঁশ কট্-কট্ করে তেড়ে আসছে!” সকলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অমনি বলা! বলা!’ করে ডাক ছাড়া হল। সুন্দর জ্যাঠামশায়ের চতুর্থ ছেলে বলরাম দড়ির ফাঁস বানিয়ে নিয়ে গিয়ে কুমীর ধরে নিয়ে এল। এবাড়ির সকলে অম্লানবদনে স্বীকার করল যে ও কুমীর ধরা তাদের কর্ম নয়। এর পর আরেকটু বড় হলে কুমীরটা নিজেই খচমচ করে চৌবাচ্চা থেকে বেরিয়ে এসে, এখানে-ওখানে ওঁৎ পেতে বসে থাকত। ওর ভয়ে একতলার স্নানের ঘরে যেতে সবাই ভয় পেত; তার পাশেই সেই উঠোন, আর কুমীর অনায়াসে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে বসে থাকত। তার ওপর বলরাম যখন ধর্মঘট করল যে সে আর কুমীর ধরতে পারবে না, তখন ওটাকে চিড়িয়াখানায় উপহার দেওয়া ছাড়া উপায় রইল না।

॥ ১৮ ॥

এই দুই বছরে আমরা পাকা কলকাতাইয়া হয়ে গেছিলাম। শিলং-এর সেই গাছ থেকে পেড়ে ন্যাসপাতি, খোবানি, প্লাম, পীচ, ব্ল্যাক্‌বেরি, রাস্প্‌বেরি খাওয়া মনের পিছনে সরে গেছিল। ভাবতাম কলকাতার খাবারের মতো আছে কি! আম, জাম, কাঁঠাল, আতা। তাল-শাঁস খাইনি এর আগে, ডাবের জল খাইনি। একটা ফেরিওয়ালা সাড়ে বত্রিশ ভাজা বিক্রি করতে আসত। বত্রিশ রকম চাল-কড়াই আর ১/২ খানা শুকনো লঙ্কা। আরেকটা লোক কুচি কুচি কাগজে মুড়ে চিনি দিয়ে তৈরি ১২ রকম খুদে খুদে নকল ফল আনত, প্রত্যেকটিতে আসল ফলের রঙ আর গন্ধ। এখন ভাবি গন্ধটি কি সত্যি ছিল, নাকি আমাদের উৎসুক নাকের চাঁদা? একজন প্যাটিওয়ালা বেজায় ভালো চিকেন-প্যাটি্ আর চিজ্-কেক বেচে যেত। একেকটার দাম বড়জোর দু আনা। কুল্‌পী-বরফওয়ালা সন্ধ্যাবেলায় চটে মোড়া মাটির হাঁড়িতে করে কুল্‌পী আনত। মনে হত স্বর্গে নিশ্চয় এই সব খায়। সাধারণ কুল্‌পী এক আনা, মালাই কুল্‌পী দু আনা, ডবল মালাই তিন আনা। কালিকা হোটেল থেকে মাঝে মাঝে রসুনের গন্ধলাগা চপ-কাটলেট্ আসত। ইন্দুভূষণের দই, গিরীশ ময়রার সন্দেশ, দ্বারিক ঘোষের মিষ্টান্ন।

এ-সবের মধ্যে পড়ে শিলং-এর সেই তাজা ফলের স্বাদ, সেই ঘরে করা জ্যাম-জেলি, মাল্‌পোয়া, সিঙাড়া, পাঁড়েজির সেই ক্ষীরের বরফি প্যাঁড়ার কথা একেবারে ভুলে গেলাম। আশ্চর্য যে পাহাড়-নদী বনের মধ্যে জীবনের প্রথম ১১ বছরের বেশি কাটালাম সারাদিনের মধ্যে তার জন্যে এতটুকু মন কেমন করত না। সেই পাহাড়ের চুড়োর প্রথম স্কুল, সেই ধূপ-ধুনোর গন্ধেভরা মা-মেরির মূর্তি দিয়ে সাজানো সুন্দর চ্যাপেল—সব ভুলে গেলাম। খালি অনেক সময় গভীর রাতে বাড়ির সামনেকার ট্রাম চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার অনেক পরে, যেদিন ঘুম ভেঙে যেত আর চারদিকের বিকট নৈঃশব্দ্য বোঝার মতো বুকে চেপে বসত, তখন সরল গাছের সেই একটানা মর্মরের জন্য হৃদয়টা আমার হুহু করে উঠত। কিছুতেই আর ঘুমোতে পারতাম না। তখন থেকেই আমার পাতলা ঘুম, অনিদ্রার জ্বালা আজও গেল না।

আরো বদলেছিলাম। শিলং-এ সাজ-পোশাক সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন ছিলাম। কলকাতায় এসে নতুন বন্ধু-বান্ধবের মতো কাপড়-জামা পরতে ইচ্ছে করত। আমরা হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসা করতাম, হাত-গলা খালি থাকত। বন্ধুদের হাতে দেখতাম সোনার চুড়ি, গলায় সরু সোনার চেন্ লকেট। আমাদেরও শখ হত; তবে এতটা বেশি নয় যে কাঁচের চুড়ি পরে সন্তুষ্ট না হওয়া যায়। ঐ চুড়িওয়ালার হাঁক শুনে নিঃশব্দ দুপুরে গায়ে রোমাঞ্চ লাগত।

প্রথম বছরটা কাপড়-জামার শখ মেটাবার কোনো সুযোগ পাইনি। কারণ আমরা বোর্ডিং-এ ভরতি হবার সময়, ছোট জ্যাঠামশাই দিদিকে আমাকে নিউ মার্কেটের রুলম্যানের দোকানে নিয়ে গিয়ে ৬টা-৬টা করে সাদা লং-ক্লথের লম্বা হাতা ফ্রক, পিনাফোর, বডি-পেটিকোট আর ইজের কিনে দিলেন। তার কোথাও এতটুকু ফুল-তোলা কি কুঁচি কি রঙীন বোতাম ছিল না, শুধু পিনাফোরের গলার কাছে খানিকটা সাদা লেস্ লাগানো ছিল। দিনের পর দিন আমরা তাই পরে স্কুলে যেতাম। বন্ধুরা হাসাহাসি করত। আজকাল হলে আর কেউ কিছু বলত না, কারণ সবাই রোজ এক রঙের, এক প্যাটার্নের উর্দি পরে ইস্কুল করে।

পরের বছর দুজনে শাড়ি ধরলাম, সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা শখ মেটাবার সুযোগ পাওয়া গেল। বাবা সঙ্গে করে নিউ মার্কেটে নিয়ে গিয়ে জামা করবার জন্য ভয়েল, লন ইত্যাদি কিনে দিতেন। এক গজের দাম ছিল আট আনা থেকে চোদ্দ আনার মধ্যে। এক বুড়ো দর্জিকে এক টাকা দিলে সুন্দর ব্লাউজ তৈরি করে দিত। মা তাকে ধরে আমাদের জামা তৈরি শেখাবার বন্দোবস্ত করলেন। দর্জি কাগজে একটা করে ব্লাউজ কেটে দিল। আমরা সেটি ফেলে জামা কাটা মক্স করলাম। ক্রমে সাহস বাড়লে অন্য প্যাটার্নের জামাও তৈরি করতে পারতাম। মাঝে মাঝেই পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে হল্ অ্যাণ্ড অ্যাণ্ডারসনের মস্ত দোকানের রেডিমেড্ জামার বিভাগে ‘সেল’ হত। সব জামা জলের দরে বিক্রি হত। চমৎকার কারিকুরি করা সব বিলিতী ভয়েলের জামা। তার একেকটার ভিতর দিদি আমি একসঙ্গে ঢুকে যাই। তারি মধ্যে সব চাইতে ছোট দু-একটি কিনে, সেলাই খুলে, ছোট করে কেটে, আবার সেলাই দেওয়া অভ্যাস করা হল। দুজনে ওস্তাদ দরজি হয়ে উঠেছিলাম। শিলং-এর কনভেণ্টে ফ্রেঞ্চ নান্‌দের কাছে শেখা এম্‌ব্রয়ডারি এতদিনে কাজে লাগল। আজ পর্যন্ত আমি কখনো কেনা জামা, কিম্বা দর্জির করা জামা পরি না।—যাক্‌গে এসব মেয়েলী কথা কেই বা শুনতে চায়। এও আমাদের কলকাতাবাসী হওয়ার একটা পর্যায়।

তাই বলে বারো মাস তো আর একটানা কলকাতায় থাকা হত না। মাঝে মাঝে অল্প দিনের জন্য ছাড়া পাওয়া যেত। মনে আছে ফিরে এসে কলকাতাটাকে যেন আরো ভালো লাগত, আরো সুন্দর মনে হত। সুন্দর আরো সত্যিই ছিল। আরো পরিষ্কার ছিল। দুবেলা রাস্তায় ঝাঁট পড়ত, হোস্-পাইপে করে জল দেওয়া হত। হপ্তায় হপ্তায় রাস্তার মধ্যিখানের বড় নর্দমার ঢাকনি খুলে কোমরে দড়ি-বেঁধে একটা ছোট ছেলেকে নামিয়ে দেওয়া হত। সে বাল্‌তি করে ভিতরকার ময়লা আর কাদা তুলে ঢাকনির পাশে জমা করে রাখত। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘোড়ায় টানা ট্যাঙ্কের মতো গাড়ি এসে সব কাদা তুলে নিয়ে যেত। ভোরে সব ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যেত। ঐ ছেলেটার বিষয় আমি গল্প লিখেছি।

আজকাল শুনি নালায় কাদা জমে পাথর হয়ে আছে, জল যাবার জায়গা নেই, তাই কুড়ি মিনিট বৃষ্টি হলেই জল দাঁড়ায়। আগে নাকি জল দাঁড়াত না। কিন্তু আসল ব্যাপার তা নয়। তখন তো নালা পরিষ্কার করা হত, তবু আধঘণ্টার মধ্যে ভবানীপুরে হাঁটুজল হত। ট্রাম বন্ধ হত, বাস ছিল না, লোকে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় গুটিয়ে, যে যার কাজকর্ম করত। পরদিন উত্তর কলকাতার খবর পেতাম। গণেশদারা বুক ফুলিয়ে বলত, “আমাদের মেছুয়া বাজারে গামলা চড়ে লোকে যাতায়াত করেছে। কালীতলায় গলা-জল”—এইসব। এ আমি নিজের চোখে দেখিনি। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেও দেখেছি, পার্ক স্ট্রীটের মোড়ের কাছেই চৌরঙ্গীতে যে বড় পুকুর ছিল, এখন যেখানে পাতাল রেলের কাজ হচ্ছে, সে পুকুরের জল উপচে পড়ে গড়ের মাঠের জমা-জলের আর চৌরঙ্গীর জমা-জলের সঙ্গে মিলেমিশে ছোটখাটো একটি মহাসাগর তৈরি হয়ে যেত। তাতে বড় বড় মাছ সাঁতরে বেড়াত। তাদের আদি বাস ঐ বড় পুকুরটি।

এই কলকাতাকে আমাদের নিজেদের শহর মনে হত। এখানে আমার মা জন্মেছিলেন, আমার দাদা, দিদি, আমি এবং ছোট ভাইদের কেউ কেউ জন্মেছি। এইটাই আমাদের বাড়ি। আর সেই টিনের চালের লম্বা সাদা, অর্কিড ঝোলানো বাড়িটার স্থান তবে কোথায়? তাকে জোর করে মনের পিছনে ঠেলে রাখতাম, পাছে রাতের ঘুম নষ্ট করে। আরেকটা জায়গাও ছিল আমাদের। সে জায়গা কখনো চোখে দেখিনি। ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে, মসূয়া বলে একটা গ্রাম। সেখানে আমাদের ঠাকুমা থাকতেন, আমাদের বাপ-ঠাকুর্দাদের বাড়িতে। ঐ ময়মনসিংহেই নেত্রকোণা বলে এক জায়গায় আমার সেই বড় পিসিমা থাকতেন। তার পুত্র-ভাগ্য ভালো ছিল না। বড় দুটি গিয়ে, একটিতে দাঁড়িয়েছিল। মেজ ছেলের এক ছেলে। আমার চাইতে দু বছরের ছোট। তার জ্যাঠার ছেলেরা মানুষ হল না দেখে, বড় পিসিমা আর তাঁর বিধবা পুত্রবধূ তার একমাত্র ছেলেকে আমার বাবার কাছে মানুষ হবার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। সেই ছেলে দেখতে দেখতে আমাদের আরেকটা ভাইয়ের মতো হয়ে গেল। তার নাম অশোক। এমন রসিক আর কর্মক্ষম মানুষ আমি কম দেখেছি। ঐ ৯-১০ বছরের ছোট ছেলেটা যখন অদেখা অচেনা আমাদের কাছে এসেছিল, তখন তার মনের মধ্যে কেমন হয়েছিল তাই ভাবি। দুদিনে সে আমাদের একজন হয়ে গেল। মা-হারা, বাপ-হারা, গৃহ-হারা মানুষদের আমার বাপ-মা-হারা গৃহ-হারা মা অমনি বুকে জড়িয়ে নিতেন। অশোক আমাদের দেশের কত যে মজার মজার গল্প বলত, তার ঠিক নেই। দেশটা হঠাৎ আমাদের যেন বড় কাছে এনে ফেলত। গোড়ায় গোড়ায় ময়মনসিংহি কথা বলত, কলকাতার ভাষা শিখতে ওর এক মাস লেগেছিল। ও-ও কল্যাণ অমির সঙ্গে এল্-এম-এস স্কুলে ভর্তি হল। বুঝবার জো ছিল না ও আমাদের ভাই নয়। শুধু একটা বিষয়ে তফাৎ ছিল। বাবা আমাদের যেমন ধমকাতেন, চড়টা-চাপড়টা চালাতেন, কিন্তু অশোকের বেলা সাতখুন মাপ। কখনো ওকে বকেছেন বলেও মনে পড়ে না। ও-ও অমনি বাবার মাথায় চড়ে বসল, সমানে সমানে ঠাট্টা তামাসা করতে লাগল। দেখে আমরা হাঁ। শুধু ছুটি-ছাটায় অশোক দেশে তার মা-ঠাকুমার কাছে যেত, আমরা কলকাতায় থাকতাম। প্রথমদিকে দেশে যাবার জন্য ও উদ্গ্রীব হয়ে থাকত। পরে আগ্রহটা কমে গেল। গরমের ছুটিতে দেশে গেলেও, পুজোর সময় হয়তো আমরা কাছাকাছি কোথাও গেলাম, তখন ও-ও আমাদের সঙ্গে যেত। কত যে আনন্দের স্মৃতি মনে জমা হয়ে রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে সেসব জায়গার শিলং-এর সঙ্গে তুলনা হয় না, কিন্তু আনন্দের দিক থেকে একটুও কম যায় না।

প্রথম ঈস্টারের ছুটিতে আমরা কৃষ্ণনগরের কাছে মহেশগঞ্জের বাবুদের পৈতৃক বাড়িতে তিনদিন কাটিয়ে এসেছিলাম। বাবুরা অন্য জায়গা থাকতেন; তাঁদের বোন আমার মায়ের কলেজের বন্ধু, তাঁর নিমন্ত্রণেই আমাদের যাওয়া। বাংলার ছোট শহরের ঐ আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। বাড়ির পাশে একটা নদী। বেশ চওড়া, কিন্তু এক হাঁটুর বেশি জল ছিল না। কয়েকটা ফুটো নৌকো বালির ওপর রাখা ছিল। ঐ নদীতে মোষরা স্নান করত, আমরাও করতাম, তাই আমাদের গায়ে ফুটকি-ফুটকি বেরিয়েছিল। নদীর ধারে দুটি আলাদা বাড়ি। একটি বন্ধ, রহস্যময়। অন্যটিতে আমাদের সেই মাসিমারা থাকতেন। এক সময় তাঁরা খুব ধনী ছিলেন, তখন অবস্থা পড়ে গেছিল। বাড়ি ভরা দামী দামী পালিশ-জ্বলা মেহগনির আসবাব। কারিকুরি করা উঁচু উঁচু খাট, মস্ত মস্ত আয়না, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দেরাজ, দেয়ালে সোনালী ফ্রেমে তেল-রঙে আঁকা হাঁড়িমুখ লোকদের ছবি। বেজায় পুরনো বুড়ো বুড়ো চাকরবাকর। সমস্ত বাড়িটার কেমন একটা সেকালের আবহাওয়া। নক্সা করা টানা-পাখা, মস্ত মস্ত দেয়ালগিরি, ঝোলানো বাতি। দেখেশুনে আমি রোমাঞ্চিত। পরে আমার অনেক গল্পে, আপনা থেকেই ঐ রকম একেকটা বাড়ি দেখা দিয়েছে।

আমাদের শোবার ঘরে প্রকাণ্ড ডিম্বাকৃতি আয়না লাগানো ড্রেসিং-টেব্‌ল। আয়নাটা কেবল মুখ থুবড়ে পড়তে চায়। দেরাজগুলোর চমৎকার পেতলের হাতল। কিন্তু টেনে খোলা দায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল একবার ওগুলো খুলতে পারলে, ভিতর থেকে নিশ্চিত রোমাঞ্চকর সব জিনিস বেরুবে। ওপরের একটা ছোট দেরাজ অনেক কষ্টে টেনে খুলে ভিতরে দেখি একটা হলদে হয়ে-যাওয়া মলাট-ছেঁড়া ইংরিজি বই। সেটিকে বের করে দেখি, তার নাম ‘কাউন্ট ড্র্যাকুলা’। অমনি পড়তে বসে গেলাম। কি আর বলব, বইটাকে আর নামাতে পারি না! খাওয়া-শোয়া মাথায় উঠল। বীভৎস-রস যে কি বেজায় আকর্ষণীয়, ঐ আমার অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। আমার চোখ কপালে উঠে গেল, গায়ের রক্ত হিম হল, চুল খাড়া হয়ে উঠল, তবু বই ছাড়তে পারি না। এখন পর্যন্ত সে শিহরণের কথা ভুলিনি। এর অনেক বছর পরে আমি যখন এম্-এ পাস্‌ করে রবীন্দ্রনাথের ডাকে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করতে এলাম, তখন একদিন দেখি একটা ১৩-১৪ বছরের ছেলে, ক্লাসের মধ্যে কি একটা বই পড়ছে, কিছু শুনছে না। পড়তে পড়তে ছেলেটার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, চুল খাড়া হয়ে উঠছে, মুখ হাঁ হয়ে যাচ্ছে। লক্ষণগুলো আমার বিলক্ষণ চেনা। ছেলেটাকে বললাম, “নিয়ে আয়, দেখব।” সে কাঁচুমাচু মুখ করে বইটা এনে দিল। দেখলাম মলাটে একটা কালো গুহা থেকে একটা বিকট জানোয়ার মুখ বের করে রেখেছে, নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বইয়ের নাম ‘তিব্বতী গুহার ভয়ঙ্কর’, রোমাঞ্চ সিরিজ, ২২ নং! এই ধরনের বইয়ের ভয়ঙ্কর আকর্ষণ। আমি নিজে কখনো লিখি না, কিন্তু আকর্ষণটা অস্বীকার করা যায় না। রাতে অবিশ্যি ওঠবার সময় সেদিন দিদিকে ডেকেছিলাম। তাতে আর কি এমন ক্ষতি হয়েছিল? আমার বড়দা ছোটবেলায় ভাইবোনদের এমনি সব ভয়ের গল্প বলতেন যে রাতে কেউ উঠতে চাইত না। ঐ মহেশগঞ্জের ছুটিটি তাই আমার মনের মধ্যে আঁকা হয়ে রয়েছে।

এর পরের বছর আমরা মিহিজাম গেছিলাম। সেখানে বড় জ্যাঠামশায়ের একটা বাংলো-বাড়ি ছিল। কোনো সাহেবের শখের বাড়ি, সে বিলেত যাবার সময় ওটি সস্তায় বেচে গেছিল। বড় জ্যাঠামশায়ের ছেলেমেয়েরা সেখানে বড় একটা যেত-টেত না। বাড়ি বন্ধই থাকত। একজন সাঁওতাল মালি দেখাশুনো করত। বাড়ির নাম “রোজি নুক্”, সামনে অযত্নে বাড়া সারি সারি নানান্‌ রকম গোলাপগাছ। পেছনে পাঁচিলঘেরা তরকারির বাগান। কত রকম তরকারি গাছের জঙ্গল হয়ে আছে। দেখে কষ্ট হল। সাপের আড্ডা। কয়েকটা ঝিঙে, কাঁচালঙ্কা, কাগজি লেবু পেড়ে পালিয়ে এলাম।

ভারি সরল গ্রামবাসীরা। বাবা মুরগির ডিমের খোঁজ করতেই, যে যার ঘরের মুরগি ঠেলে সরিয়ে, তলা দেখে দু-চার দিন তা দেওয়া ডিম এনে দিয়েছিল। পয়সা পয়সা করে। কিন্তু সেদ্ধ করে ভেঙে দেখা গেল, প্রত্যেকটাতেই নানা পর্যায়ে মুরগি-ছানা তৈরি হচ্ছে।

এ বাড়িটারও কেমন একটা সেকেলে আবহাওয়া। পুরনো সাহেবী আসবাব। এখানেও একটা ঐ রকম ডিমের আকারের আয়না দেওয়া ড্রেসিং টেবিল। সে আয়নাটাও কেবলি সামনে ঝুঁকে পড়ছিল। তার দেরাজও অনেক কষ্টে খুলতে হল। তার ভিতরেও হলদে হয়ে যাওয়া এক রাশি কাগজ। খবরের কাগজের কাটিং, একসঙ্গে আল্‌পিন দিয়ে আঁটা। খুলে দেখি বোয়ার যুদ্ধের ধারাবাহিক বিবরণী। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেই ধারাবিবরণী পড়েছিলাম। তার আশ্চর্য রোমাঞ্চ। এখন মনে হয় রস-রোমাঞ্চ উপভোগ করতে হলে, তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্বন্ধ থাকলে চলবে না। কাজেই আমাদের জীবনকালের যুদ্ধগুলোর বর্ণনা পড়ে যে উত্তেজনা হয়, সেটার একটা ব্যক্তিগত দিক থাকাতে, পরীদের গল্পের মতো উপভোগ্য হয় না। একমাত্র দুঃখ হল ঐ কাটিংগুলো কেন হস্তগত করিনি।

আরেকটা জায়গায় প্রায়ই যাওয়া হত। শিবপুরের বোটানিকেল গার্ডেন্স-এর ধারে মেসোমশায়ের বাড়িতে। সেখানকার আবহাওয়া অন্য রকম। সেকালের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। যেন মস্ত একটা পার্কের ভেতর প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হস্টেল বাড়ি, কলেজ-হল, ছোট বড় সুন্দর দেখতে বাংলো, তাতে অধ্যাপকরা থাকেন। মেসোমশাই ফিজিক্সের অধ্যাপক। তাঁর একতলা বাংলোতে ঢুকলেই মনে হত অন্য কোথাও এলাম। চারদিকে রাশি রাশি বই, আলমারিতে, টেবিলে, চেয়ারে, মেঝেতে। কেমন একটা বই বই গন্ধ। বড় ভালো গন্ধ সে। আমি অনেক সময় নতুন বইতে নাক গুঁজে বসে থাকি। বইয়ের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকত বর্মা চুরুটের গন্ধ, অম্বুরী তামাকের গন্ধ। সে এক অপূর্ব ব্যাপার। যারা চুরুট তামাক খায়, তারা ভোগাসক্তি নিয়ে তার গন্ধ উপভোগ করে। সত্যি করে ঐ গন্ধটি উপভোগ করে তারা, যারা তামাক ছোঁয় না। যেমন আমি। আমাদের বাড়ির চাকররা পর্যন্ত হয় ছাদে গিয়ে, নয় বাড়ির বাইরে গিয়ে বিড়ি খেত। বাবা পান ভালোবাসতেন, কিন্তু চুরুট সিগারেটে একটা টান দেবার সঙ্গে সঙ্গে যে চরিত্র স্খলন হয়, সে বিষয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তবে মেসোমশাইকে বেজায় ভালোবাসতেন। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে চুরুট খেলে বাবার এতটুকু আপত্তি হত না। কিন্তু ছোট জ্যাঠামশাই যে আজীবন বাবাকে লুকিয়ে সিগারেট খেতেন, এ তাঁর নিজের মুখে শোনা।

নিটোল সুন্দর পরিবারটি ছিল আমাদের। আগে বড় জ্যাঠামশাই আর সুন্দর জ্যাঠামশাই এক বাড়িতে থাকতেন। পরে বড় জ্যাঠামশাই সেজ ভাইকে ডেকে বলেছিলেন, ‘এই স্নেহের সম্পর্ক চিরস্থায়ী করবার একমাত্র উপায় হল আলাদা বাড়িতে থাকা।” ভাবি কি আশ্চর্য বুদ্ধি ছিল বড় জ্যাঠার! সত্যিই শেষ পর্যন্ত ভাইবোনদের ভালোবাসা অটুট ছিল। মাথার ওপর ছিলেন ঠাকুমা। তিনি মসূয়া গ্রামের বাড়িতে লোকজন নিয়ে একা থাকতেন। চমৎকার সব ফলের গাছ ছিল শুনেছি। দুধ খুব সস্তা ছিল। কেউ এলেই ঠাকুমা, বড়-পিসিমা আমাদের জন্য ক্ষীরের নাড়ু, নারকেল ছাঁচ, ক্ষীরের ছাঁচ, ক্ষীর-নারকেলের ‘ইচা-মুড়া’, দেখতে ঠিক যেন চিংড়ি মাছের মুড়ো, আনারস ইত্যাদি পাঠাতেন। বলেছিই তো দেশের জন্য মনের মধ্যে একটা বড় কোমল স্থান ছিল। যাইনি কখনো। কেন যাইনি ঠিক জানি না। হয়তো বাবা জাত ভেঙে বামুনের মেয়ে বিয়ে করেছেন বলে পাছে কোনো অপ্রিয় কথা ওঠে। ওদিকে কিন্তু দেশের আত্মীয়রা এসে আমাদের বাড়িতে খেতেন। বড়-পিসিমা, অশোকের মা আমার বৌদি, এঁরা আমাদের বাড়িতে এসে থাকতেন। নিজেরা রাঁধাবাড়া করতেন। আমাদের বাড়িতে সম্পূর্ণ এক প্রস্থ রান্নার ও খাবার বাসন তোলা থাকত। খাবার সময় পিসিমাদের না ছুঁলেই হল। এতদিনে সেই পুরনো দুঃখটা আমার দূর হয়ে গেল। বলেছি তো আমরা দেখলে কারো খাওয়া নষ্ট হয় ভাবলেও আমার বড় কষ্ট হত। অনেক পরে আমার গোঁড়া হিন্দু বামুনের বিধবা ননদ বলনে, আমি সামনে না বসলে, তাঁর খাওয়া হয় না। কোথাও কোনো খেদের অবকাশ রাখেননি ভগবান।

সেবার ঠাকুমার আশী বছর বয়স হল। তাঁর যে পেটে ক্যালার ছিল একথা কেউ আমাদের বলেনি। একদিন খুব অসুস্থ হয়ে ঠাকুমা দেশ থেকে.এসে বড় জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে উঠলেন। দেখতে দেখতে তাঁর জীবন শেষ হয়ে গেল। চারদিকে ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি ঘিরে রইল, মাঝখান থেকে ঠাকুমা স্বর্গে গেলেন। গল্প শুনেছিলাম ৩৩ বছর বয়সে ঠাকুমার শ্বশুরের ইচ্ছা—মৃত্যু হয়েছিল। বুড়ো মা—বাবা ছেলেমানুষ স্ত্রী আর ছোট্ট এক ছেলে রেখে মারা যাবার সময়, তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন “দুঃখ কর না; তোমার ঐ এক ছেলে থেকে একশো হবে।” সেই ছেলে আমার ঠাকুরদা। ঠাকুমার আট ছেলে মেয়ে ও ৫৪টি নাতি-নাতনি হয়েছিল। তাদের ছেলেমেয়েদের ধরলে ১০০ না হলেও, কাছাকাছি হবে। মুশ্‌কিল হল ঠাকুমার নাতি-নাতনিদের কারো একটি, কারো দুটি সন্তান; কারো কেউ নেই, আবার কেউ কেউ বিয়েই করেনি।

॥ ১৯ ॥

অনেকে জানতে চায় পাকদণ্ডী নাম কেন। পাকদণ্ডী হল তো পাহাড়ের খাড়াই ওঠার জন্য সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথ। সেই পথ-ই। ছোটবেলায় দেখতাম মধ্যিখানে আমাদের শহরখানি, তার প্রায় চারদিক ঘিরে পাহাড়। কাছের পাহাড়ের দিকে চেয়ে দেখতাম, একেবারে তলা থেকে চুড়ো অবধি পথ চলে গেছে। সে পথ সোজা নয়। সোজা পথ-ও একটা থাকত; পাকদণ্ডীর বাঁক থেকে বাঁকে সে পথ খাড়া উঠে যেত। ভারি কষ্টকর, হাঁপ—ধরা পথ সেটা; পাকদণ্ডীর সিকি ভাগ লম্বা; কাজের মানুষদের পথ। খাসিয়া মেয়েরা পিঠে বোঝা নিয়ে সেই পথ দিয়েই উঠত। আরাম করা কাকে বলে তারা জানত না।

কিন্তু পাকদণ্ডী আস্তে আস্তে, ঘুরে ঘুরে, ছায়ায় ছায়ায় উঠত। মাঝে মাঝে মনে হত বুঝি বনের মধ্যে ঢুকল। দুদিকের গাছ ঝুঁকে পড়ে পথটাকে কোলে নিত। একদিকে তার পাহাড়ের গা, একদিকে ঢাল নেমে গেছে। পাহাড়ের গায়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে সিল্‌ভার-ফার্ন, মেডেন-হেয়ার ফার্ন; তাদের কি বাহার। সিল্‌ভার-ফার্নের তলায় কে যেন খড়ি মাখিয়েছে; হাতে চেপে ধরলে, ফার্নের ছাপ হাতে উঠে আসে। আর ফুলের কথা কত বলব। বুনো ভায়োলেট, বুনো স্ট্রবেরি, পাতার সঙ্গে মিশিয়ে থাকা লজ্জাশীলা হানি-সাক্‌ল্‌, তার মধু-গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত। দেখতে দেখতে, ফুল-পাতা তুলতে তুলতে, পাহাড় চড়া। সে পাহাড় চড়াতে কোনো কষ্ট থাকে না। একমাত্র মুশ্‌কিল হল গন্তব্যস্থানে পৌঁছবার সময় না-ও পাওয়া যেতে পারে কারণ কখন সূর্য ডোবে কে জানে। গন্তব্যস্থানের কথা ভুলে যাওয়াও বিচিত্র নয়।

এইজন্য পাকদণ্ডী নাম। এর বেশি কি বলব? ভালো জিনিস দেখে দেখে চলা, মন বোঝাই করে সুন্দর জিনিস জমা করা।

এদিকে ১৯২২ শেষ হল,১৯২৩ শুরু হল। আমার পনেরো বছর বয়স হল। নাবালকত্বর আর কিছু বাকি রইল না। এর আগেই মা দিদিকে আমাকে ডেকে নিয়ে একদিন অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, “মানুষের ছেলেমেয়ে কেন হয় জানিস?” আমরা তো অবাক। আমতা আমতা করে বললাম, “ভগবান দেন।” মা সোজা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হাতে করে কিছু দেন না, মানুষরা নিজেরা পাকায়।” এই বলে সোজা বাংলায় আমাদের মুখের দিকে চেয়ে মানুষের জন্মরহস্য উদঘাটন করে দিলেন। আমি তখন হয়তো ১৩ পূর্ণ হয়ে ১৪য় পড়েছি। আমাদের ভিক্টোরীয় মায়ের মুখে এমন অকথ্য সংবাদ শুনে বলা বাহুল্য আমরা শক্‌ড্‌। একেবারে ‘শকু’। জাপানী ভাষায় উপযুক্ত শব্দ না থাকায়, ওরা শক্‌ড্‌কে বলে ‘শকু’!

‘শকু’ হলেও একেবারে বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়নি। অনেকগুলো জিজ্ঞাস্য বিষয়ে সেই সুযোগে জেনে নিলাম। ছেলেপুলে হওয়ার যখন এমন সহজ উপায় আছে, তখন রাজারা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করত কেন? মা তারো সহজ উত্তর দিলেন। অতিরিক্ত বিলাসী আর উচ্ছৃঙ্খল জীবন কাটানোর ফলে ছেলে হত না। ওষুধ-পত্র, তাবিজ, শেকড়, কিছুতেই কিছু হত না। “তাহলে তো বিয়ে না হলেও ছেলে হতে পারে।” মা বললেন, “পারেই তো।” তার অসুবিধাগুলোও বুঝিয়ে দিলেন। মা সেই এক দিনেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমাদের একটা চলন-সই যৌনবিজ্ঞানের পাঠ দিলেন। আর কোনো দিনও বিষয়টা উত্থাপন করেননি। তবে কতকগুলো ভালো ইংরিজি বই কিনে দিয়েছিলেন। আমার ভিক্টোরীয় আদর্শে মানুষ মায়ের পক্ষে এই পাঠ দেওয়া যে কত শক্ত কাজ ছিল এবং তিনি যে কি স্পষ্ট ও নির্মলভাবে সে পাঠ দিয়েছিলেন ভেবে আশ্চর্য হই।

ব্যস্‌, আর কি চাই? আমাদের বড় হওয়ার আর কি বাকি রইল? তবু ছিল বাকি। সেই বছর দুটি ভালোবাসার মানুষকে হারালাম। দুটি কেন, বলতে হয় তিনটি। একজন হলেন আমাদের বড় জ্যাঠামশাই। আরেকজনের মৃত্যুর কথা ভাবলে আজ পর্যন্ত মনটা হু-হু করে। তিনি আমাদের বড়দাদা।

মনে হত বড় জ্যাঠা খুব বুড়ো। সাদা দাড়ি, গম্ভীর ভাব। কিন্তু কিছুদিন আগে পর্যন্তও রোজ আমহার্স্ট রো থেকে হেঁটে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে স্নান করে আসতেন। তাঁকে ধরল জ্বরে। সে জ্বরের কারণ ছিল বুকের দোষ। দেখতে দেখতে তাঁর ঐ বলিষ্ঠ শরীর ভেঙে পড়ল। জ্যঠামশাই দেওঘর গেলেন হাওয়া বদল করতে। আর ফিরলেন না। তখন তাঁর হয়তো ৬৮-৬৯ বছর বয়স। মনে আছে এত দূরে দূরে থাকতেন যে ব্যক্তিগত অভাব বিশেষ কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু বাবার বড় কষ্ট হয়েছিল। কতদিন বাবার মুখ দেখলে আমাদের কষ্ট হত। তাছাড়া ঠাকুমা নেই, বড় জ্যাঠাও গেলেন, কেমন একলা লাগত।

কাজে ভরা ছিল জ্যাঠামশায়ের জীবনটা। যৌবনে বাপকে হারিয়ে, তাঁর সব দায়িত্ব নিজে বহন করেছিলেন। ছোট বোনের বিয়ে দেওয়া, ছোট ভাইদের মানুষ করা, সবই তাঁর দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঐ গম্ভীর চেহারার পিছনে আশ্চর্য উদার প্রাণরসে ভরপুর একটা চিত্ত ছিল। বাংলার যুবকদের জীবনযাত্রার মোড় তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এ রাজ্যের তরুণরা একটা বলিষ্ঠ ক্রীড়ানুরাগী আদর্শ উত্তরাধিকাররূপে পেয়েছিল। একদিকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, দুরূহ গণিতশাস্ত্রের বই রচনা করেছেন; অন্যদিকে ঘরকুনো বাঙালী ছেলেদের খেলার মাঠে তিনিই প্রথম ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর আগে পর্যন্ত এ-দেশের শিক্ষাবিদ্‌দের একটা অলিখিত ধারণা ছিল যে গড়ের মাঠে গিয়ে সবার সামনে বল্ পেটালে সে ছেলে মানুষ হয় না। এই বজ্রগম্ভীর মানুষটির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে চিরকালের মতো বাঙালী ছেলেরা বেঁচে গেছে।

প্রথম উল্লেখযোগ্য ক্রিকেট খেলার দেশী ক্লাব হল টাউন ক্লাব। ১৯০০ সালেরও আগে, বিশেষ করে বড় জ্যাঠামশায়ের আগ্রহে ও অপরিসীম চেষ্টায় কয়েকজন দূরদর্শী ও চিন্তাশীল বাঙালী মিলে এই ক্লাবের পত্তন করেছিলেন।

চাট্টিখানিক কাজ নয় একটা গোটা জাতিকে বোঝানো মাঠে গিয়ে ছোট ছেলের মতো একটা কাঠের চ্যাপ্টা ডাণ্ডা দিয়ে শক্ত একটা গোলাকে পেটা-পিটি করলে কিভাবে কলেজের ছেলেদের উপকার হতে পারে। পৃষ্ঠপোষক অবিশ্যি আরো ছিলেন: নাটোরের মহারাজা, ভূ-কৈলাসের রাজা, মালখানগরের বসু পরিবারের কয়েকজন মাতব্বর আর অনেকগুলো আগ্রহে অধীর যুবক। এই উৎসাহী যুবকদের দলে আমার বাবা প্রমদারঞ্জন, আর দুই জ্যাঠা মুক্তিদা আর কুলদাও ছিলেন। পরে মুক্তিদারঞ্জনের ছেলেরা; সোনা পিসিমার ছেলেরা, আমার অতুল পিসেমশায়ের ছেলেরা, বেচু দত্তরায়, প্রেমা দত্তরায় এবং আরো অনেকে বড় জ্যাঠামশায়ের দেখানো পথ ধরেছিল।

টাউন ক্লাব হল। এখন যেটাকে সকলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ বলে সকলে জানে, গোড়ায় সেটাই ছিল টাউনক্লাবের মাঠ। পরে কোনো কারণে ক্লাবটি উঠে পাশের মাঠে চলে যায় এবং এখনো সেখানে আছে। বলা যেতে পারে বাঙালী ক্রিকেট ক্লাব বলতে, টাউন ক্লাবই প্রথম। পরে অবশ্য খ্যাতিতে ঔজ্জ্বল্যে স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাব তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু টাউন ক্লাবই বাঙালী ক্রিকেট ক্লাবের পিতামহ ।

ক্লাব তৈরি হয়েছিল, ভালো ভালো খেলোয়াড় তৈরি হয়েছিল, আমাদের গোটা পরিবারের ক্রিকেটের ওপর একটা জন্মগত আত্মীয়তাও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু জনসাধারণকে ক্রিকেটমুখী করতে আরো প্রায় ৫৫ বছর লেগেছিল। ক্রিকেটের মাঠে মেয়ে দর্শক কেউ ভাবতেও পারত না। টিকিট গ্যালারি, একে ওকে ধরাধরির কথা কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারত না।

ছোট জ্যাঠামশাই বোধ হয় সবটাতে বাড়াবাড়ি করতেন। একদিন ১৯২২ সালে, ভাগ্নী ভাইঝিদের একটা দল নিয়ে ইডেন গার্ডেনে উপস্থিত হলেন। ক্যালকাটা: ক্লাবের সায়েবদের সঙ্গে টাউন ক্লাবের খেলা। বড় জ্যাঠামশাই উপস্থিত থাকবেন। বলাবাহুল্য এই পরিকল্পনার কথা তাঁকে আদৌ বলা হয়নি। ছেলেদের শিক্ষা সম্বন্ধে যতই উদার হন, নিজের মেয়েদের বাড়িতে পড়াশুনোর ব্যবস্থা করেছিলেন, স্কুলে দেননি। ১৫-১৬ বছরের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই আমাদের খেলার মাঠে যাওয়া সম্বন্ধে তাঁর সমর্থন থাকা অসম্ভব। না জানানোই ভালো।

এখানে বাবার মনোভাব অবধানযোগ্য। কথাটা পাড়তেই তিনি ছোটজ্যাঠামশাইকে বললেন, “দেখ ছোড়দা, তুমি যা খুশি করতে পার, খালি আমাকে এর মধ্যে জড়িও না। একপাল মেয়ে নিয়ে তুমি মাঠে যেও। আমি বাধা দেব না। কিন্তু আমি আলাদা যাব।”

তাই করা হল। ছোটজ্যাঠাকে গড়পার থেকে নিজের দুই মেয়ে, আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে পিসিমার দুই মেয়ে আর রসা রোড থেকে আমাদের দুই বোনকে নিজস্ব গাড়ির অভাবে সংগ্রহ করতে কতখানি বেগ পেতে হয়েছিল সহজেই কল্পনা করা যায়। ভুলে গেছি, তবে মনে হয় উত্তর কলকাতার চার মেয়েকে সম্ভবত সুন্দর জ্যাঠার ঘাড়ে চাপিয়েছিলেন। আবছা মনে পড়ছে তাঁদের বাড়িরও গোটা দুই বোন গেছিল। আমাদের দুই বোনকে ছোট জ্যাঠামশাই ট্যাক্সি করে ইডেন গার্ডেনে নামালেন।

সে ইডেন গার্ডেনের কথা আজকালকার লোকে ভাবতেই পারে না। মধ্যিখানে খেলা হত, তার চারদিক ঘিরে স্রেফ নন্দন-কানন ছড়িয়ে থাকত। যত্ন করে ছাঁটা ঘাসজমি, তার মাঝখানে নিখুঁৎ পিচ্‌, দেখেও চোখ জুড়োত। কেমন একটা অন্য জগৎ। হৈ-হল্লা নেই, ঠেলা-ঠেলি, গালা-গালি নেই। মাথার ওপর নীল আকাশ, গায়ে লাগে গঙ্গার বাতাস, চারধারে ফুলের বাহার, সবুজ মাঠে সাদা পোশাকপরা বাইশটা খেলোয়াড় আর তাদের সাহায্যকারীরা। মাঠে খেলা হচ্ছে, চারধারে মুষ্টিমেয় ক্রিকেটপাগল রোদে পা ছড়িয়ে ঘাসে বসে খেলা দেখছে। সুন্দর ছোট প্যাভিলিয়ন, তার কাছে এক সারি বেতের চেয়ার পাতা ছিল। ক্যাল্‌কাটা ক্লাবের কর্তৃপক্ষকে হয়তো বলা ছিল। বার্কমায়ার সাহেব মোটা শরীর নিয়ে হাসি-মুখে আমাদের অভ্যর্থনা করে বসালেন। তাঁর সঙ্গে ক্রিকেটিং ক্যাপ পরা সাদা পোশাকপরা, সায়েব-সায়েব চেহারার যে দাড়িমুখ মানুষটি ছিলেন, তিনিই যে আমাদের বড় জ্যাঠামশাই সেটা বুঝতে সময় লাগল।

বার্কমায়ারের সঙ্গে দেখলাম তাঁর খুব ভাব। বড় জ্যাঠাকে এমন চমৎকার ইংরিজি বলতে শুনে আমরা ‘থ’। বার্কমায়ার বললেন, “কি পানীয় দেব লেডিজ্‌দের?” কেউ কিছু বলবার আগে বড় জ্যাঠা বললেন, “নাথিং স্ট্রং!” বলে মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেলেন আর সেমুখো হলেন না। ঐ বড়জ্যাঠাকে বিলেতে নিয়ে গিয়ে লর্ডস্‌-এ ব্যাট্‌ হাতে দাঁড় করিয়ে দিলেও নিশ্চয় ঘাবড়াতেন না, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমরা আইসক্রীম সোড়া খেলাম।

ছোট জ্যাঠামশাই আমাদের মাঝখানে বসে ক্রিকেট খেলার নিয়ম-কানুন বলে দিতে লাগলেন। মাঠের কোন জায়গাটা লং ফীল্ড, কোথায় কভার পয়েন্ট, কাকে স্লিপ বলে, গুগলি কি, পায়ের বদলে হাত থাকলেও লেগ-বিফোর-উইকেট হয়, এ-সব আমাদের তাঁর কাছে শেখা। দুঃখের কথা আর কি বলব, এখন সব নাম পাল্টেছে। কিন্তু আমরা ৮-৯টি বোন-ই যে প্রথম বাঙালী মেয়ে ক্রিকেট ফ্যান এবং প্রথম দর্শক, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সেদিনের স্মৃতিটি আমার মনের পটে সোনার জলে লেখা হয়ে রইল। আজ পর্যন্ত তার মাধুর্য এতটুকু টশ্‌কায়নি। লাঞ্চের সময় আমাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল।

যতদূর মনে পড়ে এটা হল ১৯২২ সালের কথা। এক বছর আগেও হতে পারে, সময় গুলিয়ে যায়। বলেছি তো ১৯২৩ সালটি ভালো যায়নি। বছরের গোড়ায় যামিনীদা দেশে গিয়ে আর ফেরার নাম করে না। দু বছর আগে তার স্ত্রী মারা যায়। যামিনীদা ব্যস্ত হয়ে দেশে গিয়ে শ্রাদ্ধ-শান্তি করে, তারপর আরেকটা বিয়ে করে ফিরে এসেছিল। বাবা চটে কাঁই। বললেন, “বাল-বিবাদের আবার বিয়ে হক; কিন্তু তা তো দেবে না। বুড়ো হাবড়া নিজে আর একটা বিয়ে করে এল!”

বাল-বিধবার কথা কি করে উঠল ভেবে পেলাম না। কারণ যামিনীদার তো মেয়েই ছিল না, ছেলেরও বিয়ে হয়নি যে মরে গিয়ে বাল-বিধবা বানাবে! সে যাই হক, যামিনীদা সে বছর আবার দেশে গেল। ছয় মাস আট মাস কেটে গেল, আর ফেরে না। সকলে বিরক্ত। এমন সময় হঠাৎ ন্যাড়া মাথায় যামিনীদার ছেলে তারিণী এসে বলল, “বাবা জ্বর হয়ে মারা গেছে; তার কি টাকা—কড়ি পাওনা আছে নিতে এসেছি।”

দারুণ আঘাত লেগেছিল। যামিনীদা আমাদের রান্না করে খাওয়ায় না, এমন কোনো সময়ের কথা মনে পড়ে না। হয়তো আমার ২ বছর বয়স থেকেই ছিল। ধমক-ধামক, ঠেলে রান্নাঘর থেকে বের করে দেওয়া, চ্যালা কাঠ নিয়ে তেড়ে আসা, সব কথা মা বাবার কাছে গিয়ে লাগানো ইত্যাদি কারণে,যদিও তার সঙ্গে আমাদের গেরিলা যুদ্ধ থামত না, এখন ছবির অন্য দিকটাই কেবলি মনে পড়তে লাগল।

আমরা যে যা খেতে ভালোবাসতাম, তাকে ঠিক সেইটি দিতে যামিনীদার ভুল হত না। সর, জমিয়ে বাড়িতে গাওয়া ঘি করত, তার চাঁচির ওপর গুড়ো চিনি ছড়িয়ে ডাক দিত, “কোথায় গেলে, চাঁচি খাবা না?” অমনি আমরা আমাদের সেই মস্ত বাগানের যে যেখানে থাকতাম, সেখান থেকে ছুটে এসে ময়লা হাত পাততাম। যামিনীদা ন্যাশপাতি গাছের নিচে জলের কল দেখিয়ে দিত, “যাও, হাত ধুইয়া আস।”

মাকে যামিনীদা দেবতার মতো ভক্তি করত। মার কখনো অসুখ-বিসুখ হলে, বাবা যদি ট্যুরে থাকতেন, যামিনীদাই একাধারে আমাদের মা বাবা হয়ে যেত। রোগা টিং-টিঙে শরীর, খোঁচা-গোঁফ, খিটখিটে যামিনীদার জন্য আজ পর্যন্ত আমার মন কেমন করে। টাকা পনেরো মাইনে পেত, কাপড়-চোপড় বিছানাপত্র পেত, মাঝে মাঝে ধার-ধোর করত। ওর মৃত্যুর খবর যখন এল, তখন অন্য লোকে আমাদের রান্না করত। তার নাম ছিল বৈষম। পুরীর কাছে বাড়ি। আমরা ডাকতাম বিষ্ণু বলে। সে কিছু রান্না জানত না। গরম তেলে মাছ ছাড়তে হলে, ‘মা’ বলে এক ডাক দিয়ে, পাঁচ হাত দূরে গিয়ে দাঁড়াত। মা তাকে হাতে ধরে সব শিখিয়েছিলেন। পরে তেলের স্টোভের ওপর তন্দুর বসিয়ে সাহেববাড়ির মতো কেক্‌ বানাত। প্রথমে আমার মায়ের সংসারে, তার পর বোনদের সংসারে, সব নিয়ে ৫০ বছর আমাদের বাড়িতে কাজ করেছিল। শেষে দেখতে পায় না, পা কাঁপে, তবু কাজ ছাড়বে না। ওর ছেলে ভালো কাজ করত, সে নিয়ে যেতে চাইত। কিছুতেই যাবে না! দিদিকে বলত “তুমি বেঁচে থাকতে, আমি ছেলের ভাত খাব?” দিদি তাকে পেন্‌শন দিত, বলত, “নিজের ভাতই খাও।” অবসর নিয়ে বেশিদিন সে বাঁচেনি।

এসব লোক আজকাল হয় না। যখন এসেছিল, আমার ছোটবোনের বয়স ছিল তিন। যামিনীদা রান্না করত, বিষ্ণু কাপড় কাচত, বিছানা তুলত, ফাই-ফর্মায়েস খাটত। লতিকাকে ডাকত ‘খুকী’, কারণ মা ডাকতেন ‘খুকী’ আর বিষ্ণুর সব কিছু মায়ের মতো করা চাই। লতিকার বয়স যখন ত্রিশ, কার্শিয়ং-এর ‘ভাও-হিল্‌’ স্কুলের অধ্যক্ষা, বিষ্ণু, তখনো তাকে ডাকে ‘খুকী’। একবার বাংলার রাজ্যপাল ও তাঁর স্ত্রী গেছেন স্কুল দেখতে। পরিদর্শনের কাজ হয়ে গেলে, লতিকার বাংলোর বসবার ঘরে বসে গরম কফি, ঘরে করা কেক্‌ বিস্কুট খাওয়া হচ্ছে। আমি তখন ওখানে ছিলাম; দু-একবার চোখে পড়ল, গলা-বন্ধ সোয়েটার পরে ভারি অপ্রসন্ন মুখে বিষ্ণু বসবার ঘরের দরজার কাছে ঘোরাঘুরি করছে। আমার সঙ্গে চোখোচোখি হতেই, আমি ভুরু কোঁচকালাম, বিষ্ণু সরে গেল।

আবার দেখি পাশের দরজা দিয়ে উঁকি মারছে আর বিড় বিড় করছে। অবশেষে বিশিষ্ট অতিথিরা উঠলেন; আমরা গাড়ি-বারান্দা অবধি গিয়ে তাঁদের গাড়িতে তুলে দিলাম। রাজ্যপালের স্ত্রী মায়ের কলেজের বন্ধু, তাঁর সঙ্গে শেষ কটা কথা বলে নিচ্ছেন, এমন সময় স্পষ্ট শুনলাম বিষ্ণু আর ধৈর্য রাখতে না পেরে, লতিকার কাছে গিয়ে বলল, “এই খুকী! এ-সব কি হচ্ছে, দুধ খাবার সময় হয়ে গেছে না?” ওকে বকতে গিয়ে লতিকা হেসে ফেলল আর যারা শুনতে পেল তারা সবাই হেসে ফেলল। এতক্ষণ পর লজ্জা পেয়ে বিষ্ণু পিছটান দিল। এ ঘটনা হল ১৯৫২ সালের ব্যাপার। আমার ছোটবেলা সম্বন্ধে যে বই লিখেছিলাম তার নাম দিয়েছিলাম, “আর কোনোখানে।” এ-ও সেই আর কোনোখানের কথা, এ জগতে এমন হয় না।

১৯২৩ সালের সব চাইতে বড় আঘাত বড়দার মৃত্যু। বছরটা শুরুই হয়েছিল হতাশার মধ্যে দিয়ে। দিদির আমার অক্ষর-চেনা এক সঙ্গে; সেই ইস্তক এক সঙ্গে পড়াশুনো, খেলাধুলো; একরকম কাপড়-চোপড়; ওর চাইতে পড়ায় আমি একটু ভালো, তবে ও-ও ক্লাসের খুব ভালোদের একজন ছিল—কিন্তু ও বেজায় লক্ষ্মীমন্ত; আমি দুরন্ত, মুখফোঁড়, অসহিষ্ণু। স্কুলে দুজনায় ছাড়াছাড়ি হবে কখনো ভাবিনি। ১৯২২ সালের ডিসেম্বর অবধি ভাবছি কয়েক মাস পরেই দুজনে একসঙ্গে ম্যাট্রিক দেব। তখন ১৬ পূর্ণ হলে ম্যাট্রিক দেবার কথা। স্কুলের হেডমিস্ট্রেস্‌ বললেন, “মেয়েদের বেলা অত নিয়ম কেউ মানে না। তোমার ফেব্রুয়ারিতে ১৫ পরবে, তুমি পরীক্ষা দিতে পারবে।” দুঃখের বিষয় সে অনুমতি পাওয়া গেল না। দিদি এবং পুরনো বন্ধুর দল পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে লাগল, আমি নিচের ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে বসলাম। আমার বিশেষ বন্ধু মীরা দত্তগুপ্তাও পরীক্ষা দিল, তার সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হল।

তবে নতুন সহপাঠিনীরাও মন্দ ছিল না। অল্প দিনে তাদের সঙ্গেও ভাব হয়ে গেল। কথাটা একবার মেনে নেবার পর আর তত কষ্ট হত না। মজা হচ্ছে, তার পরের বছর থেকে পরীক্ষার বয়স ১৬ থেকে কমিয়ে ১৫ করে দেওয়া হল। মাঝখান থেকে আমার একটা বছর নষ্ট হল। তবে নষ্ট বোধহয় হয়নি, অজস্র ইংরিজি বাংলা বই পড়েছিলাম। ছবি আঁকা শিখেছিলাম। বিশেষ সেলাই ক্লাসে যোগ দিয়ে নানা রকম এমব্রয়ডারির কাজ শিখেছিলাম। দিদিরা পাস করে কলেজে ভর্তি হল। আমি স্কুলেই রইলাম।

এর মধ্যে একদিন সকালের দিকে একজন শিক্ষিকা এসে আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন। নাকি মা আমাদের নিতে এসেছিলেন। নিচে নেমে মায়ের মুখ দেখে বুকটা ধড়াস্ করে উঠল। দেখলাম মার হাতটাও থরথর করে কাঁপছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *