॥ ১০ ॥
১৯১৮ সালটির বিশ্বের ইতিহাসে একটা বিশেষ মূল্য আছে। মনে হয় ঐ সময় থেকেই রাজাদের যুগ ক্রমে শেষ হয়ে, জন-যুগের সূচনা হয়েছিল। তবে পাহাড়ের ওপরে ঐ সুন্দর জায়গাটির অবস্থান ছিল রাজনীতির বাইরে। ঐ বছর দিদির আমার নিশ্চিন্ত শৈশব হঠাৎ ফুরিয়ে গিয়ে, দায়িত্বপূর্ণ কৈশোর আরম্ভ হল। বছরের শেষে শুনলাম বিশ্বযুদ্ধও যেমন শেষ হয়েছে, তেমনি আমাদের ডবল প্রমোশন দিয়ে ষষ্ঠ স্ট্যাণ্ডার্ডে তুলে দেওয়া হয়েছে। মা গেছিলেন স্কুলে, মাদার মার্গারিটা তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মায়ের কোনো আপত্তি নেই তো? বছরের শেষে কিন্তু প্রিলিমিনারি কেম্ব্রিজ্ পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে হবে। বলা বাহুল্য মা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে এলেন। আমরা একটু ঘাবড়ে গেলাম। আমার তখনো এগারো পূর্ণ হয়নি, অনেক বিষয়ে বড্ড ছেলেমানুষ ছিলাম, কিন্তু পড়াশুনোকে ভয় পেতাম না। বেশ তো, তাই দেওয়া যাবে।
যুদ্ধ শেষ হলে সরকারি খরচে আনন্দোৎসব হল। স্কুলের ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো-দাওয়ানো, খেলা-ধুলা, নাচ-গান, জনসাধারণের জন্য মিলিটারি ট্যাটু, ইত্যাদি কত কি হল। ঘরে ঘরে মোমবাতির আর তেলের পিদিমের সারি বসানো হল । আমাদের স্কুল ততদিনে বন্ধ হয়ে গেছিল, কাজেই দলের সঙ্গে আমোদ-আহ্লাদ থেকে বাদ পড়ে গেলাম। তবু জনসাধারণের সঙ্গে দাঁড়িয়ে খুব মজা দেখলাম। ডাক্তারবাবু না কে যেন আমাদের দেখতে পেয়ে, ধরে নিয়ে গিয়ে, খাস্তা নিমকি, গজা, মতিচুর খাওয়ালেন। ফলে খুব জলতেষ্টা পেল। তখন আবার লেমোনেড খাওয়ালেন। সেকালের লেমোনেডের বোতলের মুখটা একটা কাঁচের মার্বেল দিয়ে আঁটা থাকত। মার্বেলটাকে একটা ছোট যন্ত্রের চাপ দিয়ে নামিয়ে দিলে, তবে বোতলের মুখ খুলত। দুঃখের বিষয় বোতল না ভেঙে মার্বেল বের করার উপায় ছিল না। কম চেষ্টা করিনি।
ছুটির পর স্কুল খুললে বন্ধুদের কাউকে কাউকে দেখতে পেলাম না। সেলাই, বোনা, হাতের কাজ, ছবি আঁকা ইত্যাদির ক্লাস্ কমে গিয়ে, বই পড়ার ক্লাস্ অনেক বেড়ে গেল। এখন বুঝতে পারি ওঁদের ইংরিজি শেখাবার নিয়মটি বড় ভালো ছিল। এর আগে পর্যন্ত আলাদা গ্রামারের বই পড়িনি। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামারের যাবতীয় শিক্ষণীয় অংশ সব একেবারে পাখি-পড়া হয়ে গেছিল। গ্রামারটাকে কোনো দিনও পাঠ্যাংশ থেকে আলাদা করে দেখিনি। ফলে শুধু আমাদের নয়, আমাদের স্কুলের সকলের ধাপে-ধাপে গ্রামার সরগড় হয়ে গেছিল। ঐ ষষ্ঠ স্ট্যাণ্ডার্ডে উঠে যখন আমাদের হাতে নেস্ফ্লীড্-এর গ্রামার দেওয়া হল, খুলে দেখলাম সমস্তই জানা বিষয়, শুধু আরেকটু বিষদ্ভাবে ব্যাখ্যা করা। তাই গ্রামার কখনো একটা সমস্যা বলেই মনে হয়নি। এখনকার বিদ্যা-দিগ্গজরা যদি ঐ নিয়মে নিচের ক্লাস্ থেকে ইংরিজি গ্রামার আর বাংলা ব্যাকরণের আলাদা বই মুখস্থ না করিয়ে, পাঠের সঙ্গে সঙ্গে মুখে মুখে সরগড় করিয়ে দেবার কথা ভাবতেন, তাহলে কি ভালোই না হত।
মোটা মোটা গোটা দুই ফ্রেঞ্চ বই-ও ছিল। মাদার হায়াসিন্থ্, যিনি আমাদের নিচের ক্লাসে মুখে মুখে ফ্রেঞ্চ শেখাতেন এবং সেলাইয়ের ক্লাস্ও নিতেন, তিনি এবার আমাদের ছেড়ে দিলেন। সেলাই শেখা বন্ধ হল, ফ্রেঞ্চ পড়াতেন মাদার ক্যামিলা। তিনি অনেক পাস্টাস্ করেছিলেন, বিদ্যে অনেক ছিল, কিন্তু ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ করতেন ঠিক ইংরিজির মতো। আমরা ফরাসী নানের কাছে পাঁচ বছর ফ্রেঞ্চ পড়েছি, আমাদের বেজায় হাসি পেত। মাদার ক্যামিলা আমাদের পরীক্ষার জন্য তৈরি করতেন, মাদার হায়াসিন্থ্ আমাদের মগজের মধ্যে ফ্রেঞ্চ্ ভাষা একটু একটু করে ঢেলে দিতেন। আজ পর্যন্ত ফ্রেঞ্চ ভুলতে পারিনি।
চমৎকার শেখাতেন মাদার হায়াসিন্থ্ । খারাপ কাজ করে কখনো পার পাওয়া যেত না। একটা সায়ার সমস্ত তলাটা হয়তো কেউ ‘হেম’ করেছে, মধ্যিখানে কয়েকটা বাঁকা ফোঁড় দিয়েছে। সেটাকে আর খুলে শুধ্রোয়নি। মাদার হায়াসিন্থের ছিল বাজপাখির মতো চোখ, অমনি ভুলটি ধরেছেন। একবার দুষ্কৃতকারীর মুখের দিকে তাকিয়ে, ফুচ্ করে কাঁচি দিয়ে অকুস্থলের সুতোটি কেটে সেটা টেনে বের করে আনতেন। অপরাধীকে চার-পাঁচটি ফোঁড় না শুধরিয়ে, ফাঁকি দেবার খেসারত দিতে হত গোটা লাইন আরেকবার সেলাই করে। উল্ বোনার বেলাও তাই । ছোট্ট একটা ভুল করে হয়তো পাঁচ-ছয় ইঞ্চি বুনে-গেছি, ভাবছি মাদার লক্ষ্য করবেন না। মাদার একবার তাকিয়ে দেখে, বোনার কাঁটাদুটি টেনে বের করে এনে ফড়ফড় করে উল্ টেনে ভুল জায়গা পর্যন্ত সবটা খুলে দিলেন ! পরে অবিশ্যি আমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছিলেন ভুল বুনে তারপর অনেকখানি বুনে গেলেও, সেই কটি ঘর কি করে খুলে নামিয়ে আবার বুনে তুলতে হয়। মানুষটা ছিলেন পারফেক্শনিস্ট, ভালো গুরু তারাই হয়। খুৎ তারা বরদাস্ত করে না।
এসব কথা ভাবতে গেলে মনে হয়, কাজের কত শক্ত গাঁথুনি তৈরি করে দেবার চেষ্টা করতেন তাঁরা, যাতে তার ওপর ভবিষ্যতের প্রাসাদ গড়া যায়। এখন মনে হয় ভিৎ গড়বার সময় না দিয়ে ছেলে-মেয়েগুলোর ওপর বড় বড় বোঝা চাপাবার চেষ্টা হয়।
সে যাই হোক, যুদ্ধ তার কালো ডানা গুটিয়ে নিলে দেখা গেল খুব একটা তফাৎ চোখে পড়ছে না। আমরা পড়াশুনো নিয়ে থাকি। মাঝে মাঝে তখনো গাছেটাছে চড়ি। ছোট বোনটার দেড় বছর বয়স হল । আমার বেজায় ন্যাওটা। স্কুল ছুটি হলেই বড় বড় পা ফেলে বাড়ি চলি, বড় বড় চোখ করে সে আমার পথ চেয়ে থাকে। এমন সময় শোনা গেল বাবা আসছে বছর কলকাতার হেড আপিসে বদলি হয়ে যাবেন। আমাদের শিলং-এর পাট ফুরোল। প্রিলিমিনারি কেম্ব্রিজ্ পরীক্ষা শেষ হবে ডিসেম্বরে, আমরা শিলং-এর বাড়ি তুলে দিয়ে, বড়দিনের সময় কলকাতা চলে যাব। সেখানকার স্কুলের নতুন ক্লাস্ শুরু হয় জানুয়ারি থেকে। বাবাকে আরো ছয় মাস শিলং-এ থাকতে হবে।
খবরটা শুনে অবধি পা কাঁপছিল। এতকাল আমরা উদ্গ্রীব হয়েছিলাম কবে কলকাতা যাব। এখন কলকাতা যাবার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এ বাড়ি, এ বাগান, এই ফলের গাছ, ফুলের গাছ তরকারির বাগান ছেড়ে যাব কি করে? আর কখনো আসব না? পাশের বাড়ির ফাগু-মালির খোঁড়া ছেলের সঙ্গে আমাদের আজকাল শত্রুতা, তাকে ছেড়ে থাকব কি করে? আলুগাছ আমরা নিজের হাতে করে পুঁতেছি, সে আলু তোলা অবধিও থাকব না?
মন প্রস্তুত করতে অনেকটা সময় পেয়েছিলাম। হঠাৎ প্রিলিমিনারি কেম্ব্রিজ্ পরীক্ষা তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল। মা বললেন, “কলকাতায় গিয়ে তোদের ডায়োসেসান স্কুলে ভরতি করা হবে। সেখানকার নান্দের লেখা হয়েছে। বাঙ্গালীর মেয়ে, তোদের ভালো করে বাংলা শেখা দরকার।”
কেমন যেন সবটা অবাস্তব মনে হতে লাগল। ডায়োসেসানের মেয়েরা কেম্ব্রিজ্ পরীক্ষা দিত না, ম্যাট্রিকুলেশন দিত। হঠাৎ ছাড়ার মুহূর্তে ঐ যে স্কুলটাতে ছয় বছর পড়েছি কিন্তু কখনো একান্ত আপনার বলে মনে হয়নি, তার ওপর মায়া পড়ে গেল। মনে হল কই, অনেক দিন তো কেউ আমাদের নেটিভ্ বলে ঘেন্না করেনি। ওপরের ক্লাসের টিচারদের বেশির ভাগই নান্, খাঁটি মেম তাঁরা। তাঁরা কেউ কালো মানুষদের ঘৃণা করতেন না। তাঁদের কাছ থেকে কত যত্ন, কত স্নেহও পেয়েছি । সব কেমন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। তারি মধ্যে ঠেসে পড়াশুনো করি। সত্যি কথা বলতে কি, ঐ পড়াশুনো আমাদের একটুও কঠিন মনে হত না। কি সুন্দর সব বই। ইতিহাস, ভূগোল, জীব-বিজ্ঞান, সব গল্পের মতো সরস করে লেখা। কত ছবি, কত চার্ট, কত মডেল।
এখনো মনে আছে সৌর-মণ্ডলের মডেল ছিল। মধ্যিখানে সূর্যের জায়গায় একটা মোমবাতি জ্বালতে হত। তলায় একটা হাতল ছিল, সেটি ঘোরালে গ্রহমণ্ডলী নিজ নিজ কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে ঘুরত। তখনি লক্ষ্য করেছিলাম পৃথিবীটা অক্ষতলে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, অক্ষদণ্ড একটু বাঁকা। তার ফলে ডিম্বাকারে সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে যখন আর নিজেও পাক খেতে থাকে, তখন কখনো দিন কেমন বড় হয়, কখনো ছোট হয়। এসব জিনিস একবার মগজে ঢুকে গেলে আর ভোলা যায় না। পরে বি-এ ক্লাসে যখন অ্যাস্ট্রনমি পড়েছিলাম, ঐ মডেলগুলোর কথা মনে করে অনেক সুবিধা হয়ে গেছিল। কোনো দিশী স্কুলে বা কলেজে সেরকম মডেল আনা হয়েছে বলে তো শুনিনি। যখন ঐ স্কুল ছেড়েছিলাম আমার বারো বছর পূর্ণ হয়নি, কিন্তু মন এতদিন কাদার দলা ছিল, এতকাল ধরে যে ছাপগুলি পড়েছিল, সারাজীবনের ওপর তার চিহ্ন থেকে গেছে। ডায়োসেসান স্কুলে কলেজে আট বছর পড়েছিলাম, সেরকম কোনো প্রভাব অনুভব করিনি। তখন মনন, মানস, মন, যাই বলা যাক না কেন, সে অনেকখানি তৈরি হয়ে গেছিল।
কন্ভেন্টের মেয়েরা আর নিচের ক্লাসের টিচাররা রোমান ক্যাথলিক ছাড়া আর কাউকে বোধ হয় খ্রীশ্চান মনে করতেন না। তাই মুসলমান-হিন্দু-ব্রাহ্ম মেয়েদেরও ওরা বলত প্রটেস্টান্ট। এখন আমরা কলকাতায় গিয়ে প্রটেস্টান্ট স্কুলে পড়ব শুনে, সকলের কি দুঃখ। “তাহলে মরে গেলে আর তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না। প্রটেস্টান্টরা তো অনন্তকাল পার্গেটরিতে বাস করে, তবে যদি পাপ কমে, অর্থাৎ যদি রোমান ক্যাথলিক হয়, তবে স্বর্গে যেতে পারে।” এর উত্তরে স্বর্গবাসের ওপর আমাদের সেরকম আগ্রহ নেই শুনে ওরা বেজায় আশ্চর্য হয়ে যেত। ডিসেম্বরের গোড়ারদিকে স্কুল বন্ধ হতেই এইসব মেয়েরা সমতলভূমিতে নেমে গেল। বলে গেল, “তোমরা খুব ‘লাকি’ যে এই বিশ্রী ‘ডাল্’ জায়গাতে বছরের পর বছর পড়ে থাকতে হবে না ! এখানে আছে কি? না একটা ভালো বায়োস্কোপ না ভালো দোকান-পাট ! দেখবে কলকাতা কত ভালো।”
কথাটা খচ্ করে মনে লেগেছিল। ছিল তো একটা হল, সেখানে মাঝেমাঝে বায়োস্কোপ আসত। আমরা দেখিনি অবিশ্যি। আর কি ভালো দোকান জামাৎ-উল্লার আর গোলাম-হাইদারের ! খেলনা, টুপি, জুতো, পোশাক, বাসন-কোসন, কেক-বিস্কুট, কি না পাওয়া যায় সেখানে ! কক্ষনো কলকাতার কোনো দোকান এদের চাইতে ভালো হতে পারে না ! মনটা ভারি হয়ে গেল। যাবার আগে সব জায়গায় গিয়ে একবার ভালো করে দেখে আসতে হবে। মা বললেন, “সবাই মিলে দেখে আসব । আর হয়তো দেখা হবে না ।” মার কথা শুনে আমার কাটা টন্সিলে সেকি দারুণ ব্যথা ! স্কুল বন্ধ হয়ে যেতেই পরীক্ষার্থিনীরা ছাড়া আর সকলে তো চলে গেল। অমনি স্কুলের আবহাওয়া বদলে গেল । কেমন একটা কোমল অন্তরঙ্গতা আপনা থেকেই গড়ে উঠল। ওখানকার শীতের রোদ বড় মিষ্টি । নান্রা আমাদের বাইরে গাছতলায় বসিয়ে পরীক্ষার জন্য তৈরি করতে লাগলেন। বুঝতে পারতাম যে আমাদের দুজনার ওপর তাঁদের অনেক ভরসা, ভালো করে পাস্ করব, স্কুলের সুনাম হবে। আমাদের মন থেকে কিন্তু পরীক্ষার গুরুত্ব লোপ পেয়েছিল, যতটা আগ্রহ থাকা উচিত ছিল, ততটা ছিল না। অনেক মাস পরে কলকাতায় বসে ঐ পরীক্ষার ফল জেনেছিলাম । ভালোই পাস্ করেছিলাম, কিন্তু খুব ভালো কিছু নয়। খবর শুনে নিজেদের মনের নির্লিপ্তভাবে নিজেরাই অবাক হয়ে গেছিলাম।
যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে আমরা শিলংএ-ই ছিলাম। স্কুলের কাছেই। সেন্ট এডমাণ্ড্স স্কুল, সেখানে গিয়ে পরীক্ষা দিলাম। স্কুল থেকে আমাদের টিফিনের ব্যবস্থা হল, কত যত্ন করে ওঁরা আমাদের খাওয়াতেন। বুঝতে পারলাম ছাড়াছাড়ির সময় মায়া কত গভীর হয়।
স্কুলের একটা জানলা থেকে গৌহাটি যাবার রাস্তাটির একটুখানি দেখা যেত। একদিন সেখান থেকে দেখতে পেলাম বড় বড় দুটো মোটর নামছে। মনটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। ভয়ঙ্কর একটা উত্তেজনা হল। কত নতুন জায়গা দেখব, নতুন মানুষ দেখব। বড়দাকে দেখব। কলকাতায় থাকব ; ট্রামগাড়ি দেখব, বড় বড় দোকান দেখব, গড়ের মাঠ, যাদুঘর, বায়োস্কোপ, নিউ মার্কেট, যেসব জায়গার শুধু গল্পই শুনে এসেছি এতকাল, এবার সে সমস্তই চোখে দেখব। বিদায় ব্যথার চাইতে নতুনের ডাকটাই মনের মধ্যে সেই মুহূর্তে বেশি করে অনুভব করলাম।
অন্য বছর শীতকালের আগেই বাবা ট্যুরে যেতেন, সে বছর গেলেন না । শুনলাম এখন তিনি বড় অফিসার হয়ে গেছেন আর তাঁকে বনে যেতে হবে না। আশ্চর্যের বিষয় শিলং ছেড়ে এসে অবধি বাবার সেই অনর্গল গল্পের স্রোতও কেমন কমে এল । সন্দেশে বাবার ‘বনের খবর’ বেরুত, বাবার বনে বনে ঘোরার গল্প। এমন চমৎকার সরস গল্প বাংলায় খুব বেশি নেই। কি ঝরঝরে সহজ ভাষা ; বনজঙ্গল জন্তু-জানোয়ার সম্বন্ধে কত অভিজ্ঞতা। অনেক বছর পরে সিগনেট প্রেস্ বাবার ‘বনের খবর’ পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিলেন। বাবা তখন ইহলোকে ছিলেন না। আজ পর্যন্ত অমন বই আর চোখে পড়ল না। তবে একটা কথা মনে হত : এ যেন আমাদের ঘরোয়া বাবার চাইতে আরো উজ্জ্বল, আরো রোমাঞ্চময় আরেকটা বাবার গল্প। অথচ একটি কথাও বাড়ানো বা বানানো ছিল না, ছোটবেলায় বাবার কাছে যেমন শুনেছিলাম, হুবহু তাই। শুধু তার গায়ে সাহিত্যের সোনার আলো লেগে গেছে। সাহিত্য যে কি দিয়ে তৈরি তাই বা কে বলতে পারে। বনের খবরের ঘটনাবলী বাবার পুরনো ডাইরি থেকে নেওয়া। বাবা যেমন নোট করে রেখেছিলেন, অবসর নেবার পর সেগুলিকে খাতায় লিখেছিলেন। পরে ‘মুকুলে’ একবার কিছু কিছু বেরিয়েছিল। পুরনো সন্দেশেও সবটা বেরোয়নি। আমি বাবার হাতে লেখা খাতা সিগ্নেট প্রেস্কে দিয়েছিলাম। ওঁরা তার থেকে নকল করে নিয়ে, খাতা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। গায়ের ঘাম আর রক্ত আর প্রাণের ফুর্তি দিয়ে লেখা জিনিসকে কি কখনো ‘ঘরোয়া’ নাম দেওয়া যায়? নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপারেও যাদু লেগে যায়। এই ‘বনের খবর’ অনেক বছর পুনর্মুদ্রিত হয়নি, আশা করছি হয়তো এবার আবার প্রকাশিত হবে। বই পড়ে নিজের বাবাকে চিনতে হবে এ যেন উল্টো কথার মতো শোনায়। কিন্তু ঐ বইতে বাবার একটা না দেখা দিক বারে বারে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। যদি পারতাম সেদিনের সেই শিলংটাকে তার সমস্ত আলো হাওয়া মাধূর্যসুদ্ধ ধরে দিতাম। পরীক্ষার পর সব পুরনো প্রিয় জায়গাগুলোকে আরেকবার দেখলাম । এসব জায়গায় কত চড়িভাতি করেছি, তার কত স্মৃতি মনে জড়িয়ে আছে । এই সেই ‘সেভেন্ ফলস্’ সাতটি জলের ধারা নেমেছে। কুচি কুচি জলকণায় রোদ পড়ে এখানে রামধনু তৈরি হয়। ঐ পাহাড়ের গায়ে একবার দুটো ছাগলকে খেলা করতে দেখেছিলাম । একজনের শিং-এর ওপর আরেকজন শিং বাগিয়ে লাফিয়ে পড়ছিল, আর খটাং খটাং শব্দের প্রতিধ্বনি উঠছিল।
পৃথিবীর ভালোবাসার জায়গাগুলো অর্ধেক মাটি দিয়ে গড়া আর অর্ধেক মনগড়া। পঁচিশ বছর পরে, সে জায়গায় গিয়েও, তাকে খুঁজে পেলাম না ।
মনে আছে পরীক্ষার আগে যেদিন স্কুল বন্ধ হল, সেদিন পুরস্কার বিতরণ হল। সেই ছোটবেলায় প্রথম বছর একটা জন্তুজানোয়ারের বই আর একটা ব্যাট্-বল পেয়েছিলাম, তারপর আর পুরস্কার পাইনি। ইয়োরোপের ছবি দেওয়া কার্ড পেয়েই খুশি ছিলাম। এবার বার্ষিক পরীক্ষাই দিইনি তো আবার পুরস্কার ! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হঠাৎ শুনি আমার নাম ডাকছে । একটা খামে আটটি টাকা দিল আমার হাতে ! আমি যেমনি অবাক তেমনি খুশি। এর আগে কেউ আমাকে কখনো একসঙ্গে এতগুলো টাকা দেয়নি। তাই দিয়ে কি করেছিলাম মনে নেই।
সব চাইতে বেদনার স্মৃতির কথা বলা হল না। মাকে জিজ্ঞাসা করা হল, কলকাতায় গিয়ে কালামানিক কোথায় থাকবে? সেখানে তো বাড়িতে বাগান থাকে না।” মা একটুক্ষণ গম্ভীর মুখে চুপ করে রইলেন। আমরা ব্যাকুল হয়ে উঠলাম, “কিছু বলছ না কেন? ওখানে তো গড়ের মাঠে চরতে পারবে।” মা বললেন, “বাবাকে আর জঙ্গলের কাজ করতে হবে না, ঘোড়া রাখার দরকার হবে না। কলকাতায় ঘোড়া পোষার অনেক অসুবিধা।” “তাহলে ওর কি হবে? এইখানে একা ফেলে রেখে যাবে?” মা বললেন, “তোরা কি পাগল হয়েছিস্? তোদের কাঞ্জিলাল জ্যাঠার বদলে যিনি এসেছেন, তিনি ওকে নিচ্ছেন। ওঁরা জন্তু-জানোয়ার ভালোবাসেন, পন্নুকেও রেখে দিচ্ছেন, কালামানিকের কোনো কষ্ট হবে না।”
আমি বললাম, “ও-ও জানে? ” মা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমার মনে হল বুক ফেটে যাচ্ছে, পেট কামড়াতে লাগল, কাটা টন্সিলে ব্যথা করতে লাগল। আর কোনো দিন আমরা কেউ কালামানিকের কথা জিজ্ঞাসা করিনি। ছেলেবেলার দুঃখগুলো যে কি প্রচণ্ড, কি অসহনীয়, যাদের ছোটবেলার কথা মনে আছে তারাই জানে।
মাঝখানে দুটি বাড়ি, তার পরেই কাঞ্জিলাল জ্যাঠার বাড়ি। পাড়ার মধ্যেই থাকবে কালামানিক। যে দিন সে আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেল, আমরা সকলে তখন স্কুলে, ওর যাওয়াটা কাউকে দেখতে হয়নি। ওর আস্তাবলের দিকেও যাইনি, ওর নাম করিনি কেউ। আমার ঘুম বড় পাতলা। রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যেত, শুনতে পেতাম আস্তাবলের কাঠের মেঝেতে কালামানিক পা ঠুকছে। বেজায় ভালো লাগত। সে রাতটা ছিল নিঃসাড়, নিঃশব্দ, ভয়ঙ্কর। ওকে আর আমরা দেখতেও যাইনি। বাবা বলেছিলেন তাতে ওর কষ্ট হবে।
চলে আসার আগের দিন বিকেলে আর থাকতে না পেরে, আমরা সবাই মিলে কাঞ্জিলাল জ্যাঠার বাড়িতে বেড়ার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কালামানিক যে বেড়ার ওধারেই বাঁধা ছিল বুঝতে পারিনি। হঠাৎ বেড়ার ওপর দিয়ে চোখোচোখি । ওর চোখ দুটো যেন অতল কালো দুটি দীঘি । এক দৃষ্টে আমাদের দিকে চেয়ে রইল। গলার কাছে একটা শিরা চিড়িক-চিড়িক করতে লাগল। পন্নুও সেখানে ছিল। সে বলল “হ-হ-হ!” বলে কালামানিকের কপালে হাত রাখল । আর কি আমরা সেখানে থাকি ! কাঁদতে কাঁদতে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি এসে তবে থামলাম। সেদিন হাঁস পেরু আমাদের ঠুকরে দিয়েছিল কিনা তাও টের পেলাম না।
॥ ১১ ॥
পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে, সহ-পাঠিনীরা বলল, “তোমরা চলে যাচ্ছ, আমাদের ‘পাটিং প্রেজেন্ট’ দেবে না?” আমি মনে মনে ভাবলাম, “তোমরাও তো চলে যাচ্ছ, তোমরা কিছু দেবে না?” যাইহোক, শেষ পর্যন্ত কেউ কাউকে কিছু দিলাম না । স্কুল থেকে বাড়ি যাবার পথটির প্রত্যেকটি গাছ-পাথর-ঝোপ-ঝাড় আমাদের চেনা ছিল। পাহাড়ের গায়ে কাটা রাস্তা, আরেকটু নিচে পাহাড়ের গা বেয়ে যে জল নামত, সেই জল যাবার সরু খাল। তার পাশে ঘোড়ায় চড়ে যাবার পথ । আরো নিচে খানিকটা সমতল জায়গা, সেখানে ধানক্ষেত ছিল। জায়গাটার নামও ছিল ধানক্ষেতি। এখন সেখানে ঘিঞ্জি বাড়িঘর। ধানক্ষেতির পর আবার পাহাড় উঠেছে। সেই পাহাড়ের তলা দিয়ে যে নদী বয়ে গেছে, সেই এঁকে বেঁকে আমাদের বাড়ির নিচে দিয়ে গেছে। তারপর কত বাঁক নিয়ে, কত জলপ্রপাত পার হয়ে, কত অন্য নদীর সঙ্গে মিশে, ক্রমে ক্রমে বড় হয়ে, মোটরের রাস্তার পাশে পাশে সমতলভূমিতে নেমে গেছে। তারি নাম বড়পানি, এখনকার বড়পানির হ্রদ মানুষের তৈরি, সেকালে সে ছিল না।
সব জায়গার সঙ্গে জীবনটা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। ঐ ঘোড়ায় চড়া পথ যেখানে শুরু হয়েছিল, সেখানে ফিকে বেগুনী বুনো ভায়োলেট হত। অনেক দিন আগে এখানে দল বেঁধে বেড়াতে গিয়ে মলি মেলোনি বলে একটা সুন্দর দেখতে মেয়ে দিদির আমার সংগ্রহ করা সব ভায়োলেট নিয়ে নিয়েছিল। বলেছিল, “দুঃখ কর না.। বৃহস্পতিবার কলকাতা থেকে আমার পার্সেল আসবে, তোমাদের ভাগ দেব।” বলাবাহুল্য পার্সেল এসেছিল কিনা জানি না, তবে ভাগটাগ দেয়নি। হেসে বলেছিল, “ও মাই ! তোমরা ঠাট্টাও বোঝ না!”
ঐখানে বাঁকের কাছে পাথরের দেয়ালের গায়ে আমার নতুন ছাতা ঠেকিয়ে রেখে, সুতুদির ছাতা খুলে দিয়ে, তারপর নিজের ছাতা ফেলে চলে গেছিলাম। তখুনি ফিরে গিয়ে আর পাইনি।
ঐ পাহাড়ের বাঁশঝাড়ের পাশে স্কুলের পিক্নিক হয়েছিল, মিস্ মার্টিনের জন্মদিন উপলক্ষে। অন্য খাওয়া-দাওয়ার পর প্লাম কেক খেতে দিয়ে মিস্ মার্টিন বলেছিলেন, “এটা আমার জিনিস। বাকি সব স্কুলের।” দুঃখের বিষয় তখন আর কিছু খাবার আমার ক্ষমতা ছিল না। রুমালে জড়িয়ে বাড়ি না এনে, ঐখানে পেন্সিল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রেখেছিলাম। খুঁড়লে হয়তো তখনো পাওয়া যেত।
ঐ নিচে খুরুত পাগল থাকত। সবাইকে গাল দিত, আমাদের একদিন রাঙাআলু খেতে দিয়েছিল। কি আর বলব, স্কুল থেকে ঐ শেষ বাড়ি ফেরার দিনটিতে, সমস্ত বনভূমি আমাদের হাত-পা ধরে টেনেছিল । বাড়ি এসে দেখলাম তাক থেকে জিনিসপত্র নামানো হচ্ছে, খাটের তলা থেকে বাক্স-প্যাঁটরা টেনে বার করা হচ্ছে। কি তার উত্তেজনা।
মা বললেন, “শুধু সেই সব জিনিস নিয়ে যাওয়া হবে যা আমাদের ওখানে গিয়ে কাজে লাগবে। আর যার যা আদরের জিনিস। বাকি সব গরীবদের দিয়ে দেওয়া হবে ।”
বলাবাহুল্য দুটি কাঠের বাক্সের একটিতে বাসনপত্র আর একটিতে বই ভরা হল। কাচের বাসন সব যারা বাড়িতে কাজ করত তাদের দেওয়া হল। বই আর ছবি সব নেওয়া হল। তখন দিদির আমার পুতুল-খেলার শখ চলে গেছিল, তবু এলে-বেলেদের সবাইকে তাদের খুদে খুদে খাটপালঙ্ক, বাসনপত্রসহ পুঁটলি বেঁধে নেওয়া হল। আমরা না খেলি, ছোট বোনটা আরেকটু বড় হলেই খেলতে পারবে তো ।
আসবাব – পত্র সব বাড়িওয়ালার। কাপড়-চোপড় আমাদের নিতান্ত প্রয়োজনের বেশি ছিল না। তবে লেপ, কম্বল, তোষক, বালিশ নিয়ে নেহাৎ কম মালপত্র হল না। বাবার আপিসের লোকের হেপাজতে সেসব মালপত্র ট্রাকে করে গৌহাটি গেল। সেখান থেকে বাবা লগেজ-ভ্যানে তোলবার ব্যবস্থা করলেন। আমরা সেবিষয় কোনো চিন্তাই করিনি।
বন্ধুরা অনেকেই শীত পড়তেই নেমে গেছিল, কাজেই তাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার দরকার হয়নি । দিদিমার দুই মেয়ের কলকাতায় বিয়ে হবে, তাঁরাও চলে গেছিলেন। কলকাতায় আমরা বিয়ে দেখতে যাব ভেবে বেজায় আনন্দ হয়েছিল। ঐ এগারো বছর বয়স অবধি কারো বিয়ে দেখিনি, মরা দেখিনি। ঠিক যাবার মুহূর্তে মনটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ভোরে উঠে হেঁটে গেলাম মোটর অপিসে। সঙ্গে যে সামান্য জিনিস গেল, কুলি-মেয়েরা সেগুলি পিঠে ঝুলিয়ে নিল । এতদিন যারা আমাদের বাড়িতে কাজ করত, যাদের কাছে আমরা এত গল্প শুনেছি, এত যত্ন পেয়েছি, তারা কেউ কান্নাকাটি করল না। অনেকে বলত এরা বড় নির্বিকার হয়, যতদিন কাজ করল খুব ভালো করেই করল, কিন্তু কারো ওপর বা কিছুর ওপর এতটুকু টান জন্মায় না। জন্মালেও কখনো প্রকাশ করত না। মনে পড়ে ইল্বন ছাড়া কেউ আমাদের সঙ্গে খেলা করত না, হাসি-ঠাট্টা করত না, আদর করত না। আমাদেরও ওদের জন্য পরে মন কেমন করত না।
একবার যাত্রা শুরু হলে আর মন খারাপ করার অবকাশই রইল না। গত ছয় বছরের মধ্যে নদীর বাঁকে যেখানে সাঁকোর ওধারে ময়দার কল জলের স্রোতে ঘোরে, তার পরে কি আছে দেখতে যাইনি। তাছাড়াও দেখবার অনেক জায়গা ছিল । শিলং পীক থেকে পরিষ্কার দিনে সিলেটের বাড়ি-ঘর দেখা যেত। আমি অবিশ্যি দেখিনি। তবে আমাদের বাড়ির সামনে একটা বিশেষ জায়গায় দাঁড়ালে হিমালয় দেখা যেত। দিগন্তের কাছে মেঘের পরদা, তার ওপরে নীল আকাশে রূপোলী রঙে আঁকা পাহাড়ের ছবির মতো হিমালয় দেখেছিলাম । পৃথিবীর পাহাড় বলে মনে হত না। ভেবে আশ্চর্য লাগত যে দাদামশাই পায়ে হেঁটে ঐ পাহাড় পার হয়ে তিব্বত গিয়ে মানসসরোবর দেখে এসেছিলেন। দাদামশায়ের মুখে মা যেমন কিছু কিছু শুনেছিলেন, আমাদের কাছে গল্প করেছিলেন। দুঃখের বিষয় সুরেশ সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হিমারণ্য’ নামে দাদামশায়ের লেখা ভ্রমণকাহিনীর কপি রাখার কথা সে সময়ে কারো মনে হয়নি। আজ পর্যন্ত হিমালয়ের ছবি দেখলে, হিমালয়ের বর্ণনা পড়লে, হিমালয়ের নাম শুনলে পর্যন্ত, আমার না-দেখা দাদামশায়ের কথা মনে পড়ে। ভাবি যদি আর ছটা বছর বাঁচতেন, তার সঙ্গে আমার দেখা হত।
হিমালয়ের প্রতি আমার মনের ভাব যাই হোক, সেদিন মহাখুশি হয়ে আমরা শিলং পাহাড় আর হিমালয়দর্শন ছেড়ে নেমে এসেছিলাম। মন কেমন করার পালা শুরু হয়েছিল কলকাতার নতুনত্ব কেটে যাবার পর। রাতে শিলং-এর বাড়ি-ঘর, পাহাড়, হ্রদ, ঝর্না, ফুলগাছ, ফলগাছ, সরল-বনের স্বপ্ন দেখতাম। কাটা টন্সিলে ব্যথা করত।
সেদিন শুধু দুধারের বনভূমির অপূর্ব দৃশ্য দেখে উচ্চকিত, উচ্ছ্বসিত, হয়ে উঠছিলাম। একেবারে নিরাপদে গৌহাটি পৌঁছয়নি। মাঝপথে নংপো। সেখানে ওপরের গাড়ি, নিচের গাড়ি পার করানো হত। ছোট একটা চা খাবার জায়গা আর বিশ্রাম-ঘর ছিল। ছোটবোনের নাম লতিকা, তার জন্য বাবা দুধ গরম করার চেষ্টায় গেলেন। সঙ্গে ছিল বাবার ক্যাম্পে ব্যবহারের ছোট্ট স্পিরিট-ল্যাম্প । বাবা নিজে সব করতে ভালোবাসতেন ; তাই চায়ের ঘরে না বলে স্পিরিট-ল্যাম্প জ্বেলে দুধ গরম করতে গেলেন। স্পিরিট-ল্যাম্প ফেটে গেল, দুধ নষ্ট হল, বাবার ভুরু পুড়ল, মেজাজ খিঁচড়ে গেল। চায়ের ঘর থেকে দুধ এনে লতিকাকে খাওয়ানো হল। খাবলা খাবলা ভুরু পুড়ে যাওয়াতে বাবাকে বেশ মজার দেখাচ্ছিল। বেজায় হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু হাসবার, কিম্বা অন্যদের দিকে তাকাবার সাহস পাচ্ছিলাম না। দুপুরে নিশ্চয় কিছু খেয়েছি।
বিকেলের আগে পাহাড়তলীতে পৌঁছলাম । দুপাশের নিচু পাহাড়গুলো সরে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে লাল টিনের ছাদ দেওয়া সুন্দর সুন্দর বাংলোবাড়ি, দূরে দূরে চা বাগান । তখন পৌষ মাস, এখানেও বেশ শীত আর শরীরের মধ্যে করে শীত বেঁধে নিয়ে এসেছি আমরা, গরম বোধ করার অবকাশও ছিল না।
ক্রমে চ্যাপ্টা পরটার মতো হয়ে গেল জমিটা । মাঝে মাঝে অপূর্ব সুন্দর একটা নদীর আভাসও পাওয়া গেল। তারপর মোটর অপিসে নামলাম। গৌহাটিতে আমরা নিতান্ত নির্বান্ধব ছিলাম না, আমাদের নিতে লোক এসেছিল। রাজুমামা, জিৎ, কিডি । বলাবাহুল্য রাজুমামা কিন্তু আমাদের নিজেদের মামা ছিলেন না। মা বাবার বন্ধু এঁরা । রাজুমামা তখন কটন কলেজের প্রফেসর, পরে বোধহয় অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। কিডির নাম সুজাতা, অনেক পরে যে সুজাতা চৌধুরী লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের অধ্যক্ষা হয়েছিলেন, তিনিই আমাদের আদরের কিডি, একটা পালকের মতো হাল্কা মিষ্টি মেয়ে । শিলং-এ ওরা ছুটি কাটাত, বাড়ি ভাড়া নিয়ে অনেকদিন থাকত, রোজ দেখাশুনো হত । রাজুমামা হলেন কটকের নামকরা ক্ষীরোদ রায়চৌধুরীর বড় ছেলে । সুখে দুঃখে দুই পরিবারের দেখাশুনো। নিজের মামা আবার কাকে বলে।
রাত কাটানো হবে রাজুমামার বাড়িতে, পরদিন সকালে আবার যাত্রা। মনে আছে মামীমা আমাদের জন্য বাড়ির সামনের চওড়া বারান্দায় অপেক্ষা করছিলেন। তারপর গরম জল, হাতমুখ ধোয়া, কাপড়ছাড়া, কাপড় ছেড়ে সবাই মিলে বারান্দায় জলযোগ । তারপর একসঙ্গে জ্ঞান বড়ুয়াদের বাড়ি যাওয়া। তাঁরাও আমাদের চেনা বন্ধু । জ্ঞান বড়ুয়ার স্ত্রী ললিতা মালি বোধহয় অরু ঠাকুরের মেয়ে, মায়ের বন্ধু। তাঁদের ছেলেরা মনোভিরাম, নয়নাভিরাম, দেখতে রাজপুত্রের মতো সুন্দর, আমাদের খেলার সাথী । ললিতামাসি নামকরা চিত্রতারকা শর্মিলা ঠাকুরের দিদিমা। তাদের বাড়িতেও কত গল্প, কত হাসি । সাইকেল করে দোকানে গিয়ে জিৎ খুব ভালো ভালো বিস্কুট কিনে আনল। তারপর রাজুমামা উঠে পড়ে বললেন, “আর দেরি নয়, রাতে হাতি শিকারে যাব ভুলে গেলে নাকি । হাতি শিকার শুনে আমার বুকের রক্ত হিম । যেটাকে শিকার করা হবে সেটা ক্ষ্যাপা হাতি কি না জিজ্ঞাসা করিনি, অতবড় অমন সুন্দর জানোয়ারটাকে কেউ গুলি করে মারবে শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাজুমামা সেটা লক্ষ্য করে বললেন, “কি হল? হাতি শিকারের নাম শুনেই মুখ গম্ভীর? হাতির পায়ের নরম. মাংস কাল যখন রেঁধে তোমাদের সঙ্গে দেওয়া হবে, তখন কিন্তু অন্য রকম মনে হবে। হাতির নখসুদ্ধ পা দিয়ে চমৎকার ছাতা-লাঠি রাখার স্ট্যাণ্ড্ হয়।” মন থেকে সব খুশি দূর হয়ে গেল।
বাড়ি এসে মাংস ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি শোয়া হল। রাজুমামার দল কখন এল, কখন গেলেন টের পেলাম না। শুয়ে শুয়ে কেবলি বলতে লাগলাম, “ভগবান, তুমি হাতিটাকে তাড়িয়ে দিও, ওরা যেন মারতে না পারে। তাড়িয়ে দিও, ভগবান !” কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না। ভোরে যখন ঘুম ভাঙল, আমাদের জিনিসপত্র গোছানো হচ্ছে, আর রাজুমামা বেজার মুখ করে বলছেন “নাঃ, সব পণ্ডশ্রম, ব্যাটা কোথায় যে ভাগল বোঝা গেল না।” উঃফ্ ! কি যে খুশি হলাম। মনে মনে বললাম, “ভগবান তুমি বড্ড ভালো। আমি যা চাইলাম তাই দিলে !” ততদিনে উপাসনা-টুপাসনায় আমার মন না থাকলেও, ভগবানের ওপর আমার বেজায় আস্থা। স্কুলে নান্দের মুখেও শুনতাম—চাইলেই পাবে, দ্বারে করাঘাত করলেই দ্বার খুলবে ! বড় ভালো লাগত। এখন দেখলাম সত্যিই তাই। পরে অবিশ্যি আনেক সময়ই মনে হয়েছে ভগবানের ওপর ভার চাপিয়ে দিয়ে নিজে নিশ্চেষ্ট থাকলে কিছুই হয় না। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও উঠে-পড়ে লেগে যেতে হবে। বাস্তববাদী বন্ধু ঢের আছে, তাঁরা বলেন ঐটেই আসল কথা, ঐ উঠে-পড়ে লাগাটা। বাকিটা হল মনের দুর্বলতা, মনকে স্তোক দেওয়া। সে যাইহোক, সেদিন যে আমি গিয়ে হাতি তাড়াইনি, সেটা ঠিক ।
পিছনের বারান্দায় একটা মরা বন-মোরগ পড়ে ছিল। ছিট-ছিট গা, ল্যাজে ময়ূরের পালকের মতো চোখ, মুরগির মতো বড়। তাড়াতাড়ি চলে এলাম। পাখিটা যদি কদাকার হত তাহলে আমার অত দুঃখ হত না। শুনলাম ওটাকে রোস্ট করে আমাদের সঙ্গে দেওয়া হবে, দুপুরের খাবার জন্য।
গৌহাটিতে ট্রেনে চড়লাম, পাণ্ডুঘাটে নামলাম। সেখানে ব্রহ্মপুত্রের ওপর জাহাজ বাঁধা ছিল। জাহাজ নয় ফ্ল্যাট্। দোতলা চমৎকার একটা জাহাজেরি মতো, কিন্তু তার এঞ্জিন নেই, অন্য জাহাজে টেনে নিয়ে যায়। সে জাহাজটার মাপ এর অর্ধেক। কি সুন্দর নদী ঐ ব্ৰহ্মপুত্র, ঢেউ তুলে, জল ছিটিয়ে, ছুটে চলেছে। আমরা দোতলার ডেকে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম । মনে হল দূরে নদীর বুকে থেকে এক পাহাড় উঠেছে। একজন বুড়ো ভদ্রলোক ছিলেন, বললেন ঐ উমানন্দ, ওখানে শিব মন্দির আছে। জায়গাটা ভারি বিপজ্জনক, মস্ত ঘূর্ণিল আছে। পরে দাদামশায়ের লেখা, ‘উদাসী সত্যশ্রবার আসাম ভ্রমণ’ নামক বইতে ঐসব জায়গার বিষয়ে পড়েছিলাম। সেদিন তার চেয়েও চিত্তাকর্ষক জিনিস দেখে আর চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।
নদীর বুকে শুশুক মাছরা খেলা করছিল । মাছ বললাম বটে, কিন্তু তারা মাছ নয়, জলের জানোয়ার । চোখ দুটি কৌতুকেভরা, এই জলে ডুব দিল, পিঠখানি শুধু ভেসে রইল, মোলায়েম, মেটে, চকচকে। তারপরেই এক লাফে জল থেকে পাঁচ হাত উঠে পড়ল, গা থেকে টপটপ করে জল পড়তে লাগল, রোদ পড়ে মনে হতে লাগল যেন সোনার তৈরি। এমন অপরূপ দৃশ্য আমি কম দেখেছি। মনে আছে জাহাজে আমরা চা আর কেক্ খেয়েছিলাম । দুধ হয়তো পাওয়া যায়নি। শিলং-এ আমাদের ৩/৪, পেয়ালা দুধে ১/৪ পেয়ালা চা দেওয়া হত, আমরা ভাবতাম খুব চা খাচ্ছি। এখানে সত্যিকার চা দিল, খুব একটা ভালো লাগল না।
এপারে আমিনগাঁওতে জাহাজ থেকে নেমে আমরা আবার ট্রেনে চড়েছিলাম। সারা রাত ঐ ট্রেনে কাটল। রাতে একটা দারুন দুর্ঘটনা হতে হতে হল না। সেকালে ওদিককার গাড়ির দরজা বাইরের দিকে খুলত। বাঙ্কে শুয়ে একবার মনে হল কোনো স্টেশনে ট্রেন থেমেছে, একটা লোক দরজা ঠেলে ভিতরে মাথা ঢোকাল, জায়গা নেই দেখে আবার দরজা বন্ধ করে চলে গেল। দরজাটা বোধহয় ভালো করে বন্ধ হয়নি, ভিতর থেকে তো লক্ হয়ইনি।
আমার সব চাইতে ছোট ভাই যতি, বাবাকে ডেকে তুলে একবার বাথরুমে গেল। ওর জায়গা দরজার মুখোমুখি । গাড়িটা একবার জোরে ঝাঁকি দিয়ে থাকবে, ফলে দরজা আবার হাঁ হয়ে খুলে গেল আর যতিও ছিটকে বাইরে পড়ল । ওর তখন তিন বছর বয়স। স্নানের ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে ওর ভীত ‘মা মা’ চিৎকার শুনে বাবা চেয়ে দেখেন গাড়িতে যতি নেই। চিৎকারটা বাইরে থেকে আসছে। ব্যস্ আর বলা কওয়া নেই, বাবাও খোলা দরজা দিয়ে লাফ দিলেন । যতি বাঁধের নিচে ধানক্ষেতে পড়ে তখনো চ্যাঁচাচ্ছিল, গাড়ি থেকে আলো পড়ছিল, বাবা ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। যতি বলছিল, “মাকো পাস্ ! মাকো পাস্ !” মা প্রায়ই বলতেন ‘রাখে হরি, মারে কে!’ এও দেখলাম ঠিক তাই । আমি প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম । দাদা জেগে গিয়ে দেখতে পেয়ে, এমনি হট্টগোল লাগাল যে আমার ভাই সরোজ ছাড়া গাড়িসুদ্ধ সক্কলে উঠে বসল । চেন টানা হল । সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেমে গেল। হৈচৈ, হাঁক-ডাক । আমরা স্তম্ভিত। হঠাৎ বাবার গলা শুনলাম, বোধহয় ফিরিঙ্গি গার্ডকে ইংরিজিতে বলছেন, “ঠিক আছে, এই ছেলেটা পড়ে গেছিল।”
তারপরেই বাবা যতিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে এসে উঠলেন। মায়ের ফর্সা মুখ বরফের মতো সাদা হয়ে গেছিল । মুখে একটিও কথা বলেননি। সেইখানে মিনিট কুড়ি দেরি হল। তারপর যখন আবার গাড়ি চলতে আরম্ভ করল, ভগবানকে বললাম, “তুমি বড় ভালো, ভগবান। কাল হাতি তাড়ালে, আজ আবার যতিকে বাঁচালে !”
যতদূর মনে পড়ে বেলা ১১টা নাগাদ আমরা শিয়ালদা পৌঁছলাম। স্টেশনে চাঁদের হাট। ছোট জ্যাঠামশাই এসেছেন, বড়দা এসেছেন, মণিদা এসেছেন, আরো কারা কারা যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন। কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব হচ্ছিল । গাড়ি থেকে নেমেও মনে হচ্ছিল পায়ের তলার মাটিটা দুলছে, চলছে ; কানে তালা লেগে যাচ্ছিল।
তিন-চারটে ঠিকে গাড়ি করে আমরা ১০০ নং গড়পার রোডে গেলাম। প্রায় পঞ্চাশ বছর ঐ বাড়ির কাছে যাইনি, কিন্তু সেদিনের সেই প্রথম দেখার ছবিখানি মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে। তার মাত্র পাঁচ-ছয় বছর আগে বাড়ি তৈরি হয়েছিল। আমরা ছোটবেলায় এসে জ্যাঠাইমার সঙ্গে গিয়ে জমি দেখে এসেছিলাম। একপাশে কালা-বোবাদের স্কুল ; অন্যপাশে এথিনিয়ম ইন্স্টিটিউশন বলে ছেলেদের স্কুল ; মধ্যিখানে সাদা ধবধবে বাড়িটি। সামনেটাতে বোধহয় একটু ফিকে গোলাপী ভাব ছিল, তার ওপর সাদা একটা পদ্মফুল আঁকা। আছে হয়তো এখনো। নাকি স্বপ্নে দেখেছিলাম?
বাড়ির সামনের দিকটাতে একতলায়, দোতলায়, ছাপাখানা ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্সের কার্যালয়। আমরা পাশের ছোট দরজা দিয়ে ঢুকে, গলি পার হয়ে, খাবার-ঘরের পাশে, দোতলায় উঠবার সিঁড়ির সামনে পৌঁছলাম । সেই সিঁড়ি তিন-তলা অবধি উঠে গেছিল । ধুপধাপ করে কত উঠেছি, নেমেছি, বকুনি খেয়েছি। সিঁড়ির আকর্ষণ অভ্যাস হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল।
দোতলায় জ্যাঠাইমা আর বৌঠান ছিলেন, মণিদার স্ত্রী মেজ-বৌদিও নেমে এলেন। জ্যাঠাইমাকে চিনতে পারছিলাম না। থান-পরা, পাকা চুল, দুঃখী-মুখ, ছোট্টখাটো এই মানুষটিই কি আমাদের সেই জ্যেঠিমা, যিনি আমার মাকে মানুষ করেছিলেন? চার বছর হল জ্যাঠামশাই চোখ বুজেছেন, এই সময়টুকুর মধ্যে জ্যাঠাইমা অন্য মানুষ হয়ে গেছিলেন। সংসার থেকে নিজেকে একেবারে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আর তিনি এবাড়ির কর্ত্রী ছিলেন না। সংসারের দায়িত্ব দুই বৌয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। নিজের মধ্যে গুটিয়ে এক্কেবারে এত্তটুকু হয়ে গেছিলেন।
এখন ভাবলে দুঃখ হয় যে জ্যাঠাইমার বয়স তখন বড়জোর বাহান্ন-তিপান্ন বছর। বুড়ো হবার বয়সই নয় সেটা। কিন্তু একটা মানুষের অভাবে তাঁর জীবনের কাজ ফুরিয়ে গেছিল । যদি পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকতে পারতেন, যদি শিলং-এর দিদিমার মতো স্কুলের মেয়েদের পড়াতেন, কিম্বা নিজের বিমাতা কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর মতো ডাক্তারি করতেন, কিম্বা স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, তাহলে নিশ্চয়ই আমার জ্যাঠাইমার জীবন এত শীঘ্র এমনভাবে নষ্ট হয়ে যেত না। যে মানুষটি নিজের এবং পরের এক বাড়ি ছেলে-মেয়ে নিয়ে এত বড় সংসারটা একা হাতে দক্ষভাবে চালাতেন, তাঁর কপালের এই ব্যর্থতার কথা ভাবলেও কষ্ট হয় । কি চমৎকার রাঁধতেন, কত রকম কাজ জানতেন। পরবর্তীকালে আমার মাকে, আমার বড়দি সুখলতাকে, আমার মেজদি পুণ্যলতাকে দেখে বুঝতে পারি কি অসাধারণ কাজের মানুষের কাছে তাঁরা মানুষ হয়েছিলেন।
॥ ১২ ॥
অত বড় বাড়িটা একেবারে গম্গম্ করত। একে তো একতলার ছাপাখানার একটানা একটা ঝমঝম শব্দ সারাদিন শোনা যেত, প্রেসের লোকেরা সমস্তক্ষণ সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করত, তার ওপর বাইরের বন্ধু-বান্ধব অনবরত আসা-যাওয়া করতেন। আমরা আটটা ভাইবোন আর মা যে তার মধ্যে কেমন অনায়াসে মিলে গেলাম, এখন ভাবতে আশ্চর্য লাগে। আমাদের আগমনে কারো কারো নিশ্চয়ই অসুবিধা হয়েছিল, কিন্তু সুখের বিষয় সেটা টের পাবার বা সন্দেহ করবার বয়স আমাদের হয়নি।
একতলায় সিঁড়ির পাশে খাবার ঘর, তার পেছনে একটা শোবার ঘর, সেখানে ছোট জ্যাঠামশাই শুতেন আর লেখা-পড়া করতেন। মেজ জ্যাঠামশায়ের ছোট ছেলে নান্কুদাও ঐ ঘরে বসে মোটা মোটা বই পড়ত। সে ইতিহাসে এম এ দেবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ফর্সা, বেজায় রোগা মানুষটা, খামখেয়ালে মাথাটি ঠাসা, আমাদের অনেকদিনের বন্ধু । পড়াশুনোর ঘরই ওটা। ছোট জ্যাঠা ছোটদের উপযুক্ত করে ইংরিজি থেকে নামকরা সব বই বাংলায় অনুবাদ করতেন। এত ভালো অনুবাদ খুব বেশি দেখিনি। আর কি সব বই, কোনান ডয়লের শার্লক হোম্সের বিচিত্র কীর্তিকাহিনী, বাস্কার ভিলের কুক্কুর ; জুল ভের্ণের আশ্চর্য দ্বীপ ইত্যাদি যত সব রোমাঞ্চময় কাহিনী। তাঁর লেখা দেশী-বিদেশী পৌরাণিক গল্পের কথা তো আগেই বলেছি । ঝরঝরে সহজ কিন্তু বিশুদ্ধ বাংলা, মূল গ্রন্থের সমস্ত রসটি রক্ষা করে, নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলেছে । সে বাংলা এখন কেউ লেখে না কেন? তার ওপর সরকারি আর্ট স্কুল থেকে পাস্ করা শিল্পীও ছিলেন। নিজের হাতে প্রায় প্রমাণমাপের ফটো এন্লার্জমেন্ট করে, তাতে রঙ দিতেন। অনেক বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতি করেছিলেন, যতদূর মনে পড়ে তার মধ্যে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছবিও ছিল। আশুতোষ জ্যাঠামশাইকে খুব স্নেহ করতেন। তেমনি করতেন নাটোরের বুড়ো মহারাজা। জ্যাঠামশাই নাম করা ক্রিকেটার ছিলেন, নাটোরের দলেও খেলতেন।
তবে এসমস্ত সর্বজনস্বীকৃত গুণের জন্য আমরা ছোট জ্যাঠামশাইকে এত ভালোবাসতাম না, তাঁর ওপর এত রাগও করতাম না। আসলে জ্যাঠামশাই তাঁর সব ভাই-বোনেদের ছেলেমেয়েদের আপনার বলে জ্ঞান করতেন । কাজেই তাদের গুণ দেখে যেমনি খুশি হয়ে পাঁচ জায়গায় বলে বেড়াতেন, তাদের দোষ দেখলে তেমনি চটে গিয়ে বকেঝকে ভূত ভাগিয়ে দিতেন। বেজায় মাছ-ধরার শখ ছিল, তাঁর কাছে কত যে গল্প শুনতাম তার ঠিক নেই।
তবে কলকাতায় পৌঁছবার পরদিনই তাঁর স্বভাবের যে-দিকটা প্রকাশ পেয়েছিল, এখন সেটার কথা ভেবে যতটা আশ্চর্য হই, তখন মোটেই হইনি। আমরা এসে পৌঁছেছিলাম বোধহয় বড় দিনের আগের দিন, ১৯১৯ সালের ২৩শে কি ২৪শে ডিসেম্বর । জ্যাঠামশাই বিকেলে জলখাবার খাবার সময় বলে গেলেন, “কাল বেলা তিনটের সময় ঐ ছোটটা বাদে বাকি সবকটাকে নিউ মার্কেট দেখাতে নিয়ে যাব। বড়দিনের নিউ মার্কেট একটা দেখবার জিনিস।”
চোদ্দ থেকে সাড়ে তিন বছর বয়সের, আরেকজনের সাতটা আনাড়ি ছেলেমেয়ে নিয়ে বড়দিনের ভিড়ে ট্রামে করে নিউ মার্কেট বেড়াতে যাওয়াকে আমি দুঃসাহসিক অভিযান বলি এবং যে করে তাকে আমি বীরপুরুষ বলি । জ্যাঠামশাই বীরপুরুষ ছিলেন, বেঁটেখাটো, তামাটে গায়ের রঙ, গায়ে এক কাঁচ্চাও মেদ ছিল না, ৭৪ বছর বয়স পর্যন্ত রোদে জলে খুরখুর করে সারা শহর চষে বেড়াতেন, সক্কলের খোঁজ নিতেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষটি, পরিপাটি বেশভূষা, নিজের জুতো নিজে চক্চকে করে পালিশ করতেন। বাবার চাইতে তিন-চার বছরের বড় হয়তো, কিন্তু বাবাকে বেজায় ভয় পেতেন, জীবনের শেষ পর্যন্ত ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে সিগারেট খেতেন ! লোকজন ভালোবাসতেন, গান-বাজনা ভালোবাসতেন। কার ছেলের গলা ভালো, তার জন্য গানের মাস্টার রাখা উচিত, কে আঁকে ভালো, তাকে শেখানো দরকার । এইসব নিয়ে ছিল তাঁর ভাবনা। যেমনি ভালোবাসতাম তেমনি রাগে গা জ্বলে যেত । সক্কলের সব খবর রাখতেন এবং কোনোটাই গোপন করতেন না। কারো কিছু ভালো হলে আহ্লাদে আটখানা হতেন, যেন ওঁরই কোনো সৌভাগ্য লাভ হয়েছে এমনি ছিলেন আমার ছোট জ্যাঠামশাই।
পরদিন তিনটের সময় বেরিয়ে সুকিয়া স্ট্রীট দিয়ে হাঁটিয়ে কর্ণওয়ালিস্ স্ট্রীটে ট্রামে চড়ালেন । এসপ্ল্যানেডে নামিয়ে বললেন,“ঐ দ্যাখ ঐদিকে হাইকোর্ট!” বলে কেন জানি একটু মুচকি হাসলেন। হাইকোর্ট দেখতে পেলাম না। তবে লাটসাহেবের বাড়ির ফটক, গম্বুজওয়ালা বাড়ি দেখে অবাক হলাম। আরেকটা আশ্চর্য জিনিসও দেখালেন, এস রায় অ্যাণ্ড সন্স সাইনবোর্ড লেখা একটা দোকান। নাকি বড় জ্যাঠামশায়ের দোকান, খেলার সরঞ্জাম বিক্রি হয়। আগেও শুনেছিলাম এর কথা, এখন চোখে দেখে কৃতার্থ হলাম।
আগেকার ট্রামে যাত্রীদের লম্বা লম্বা বেঞ্চিতে মুখোমুখি বসতে হত, কন্ডাক্টর পাদানিতে ঝুলে ঝুলে চলাফেরা করত। চৌরঙ্গীর ট্রাম অনেকটা আজকালকার ট্রামের মতো। এই পাড়ায় আমার জীবনের বেশির ভাগটাই কাটল, কিন্তু সেই প্রথম দেখাটি এখনো চোখে লেগে আছে। তখন কি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পথঘাট, পুকুরের ধারে ফুলগাছ, ফুটপাথে কৃষ্ণচুড়োর সারি, ভারি ছিমছাম বড়লোকি ভাব একটা। মোড়েই সেকালের বিখ্যাত হোয়াইট্ অ্যাওয়ে লেড্ল-র মস্ত দোকান। এখন যার একতলায় ইউ-এস-আই-এস হয়েছে।
ব্রিস্টল হোটেল, গ্র্যাণ্ড হোটেল, কন্টিনেন্টেল হোটেল, ফার্পো রেস্তোঁরা, সাহেবী ব্যাপার সব ; দু-একজন বেজায় বড়লোক বিশিষ্ট খোদ্দের ছাড়া দোতলায় উঠতে হলে ডিনার স্যুট পরতে হত। রাজাদের, বড়লোকদের আর সাহেবদের ব্যবস্থা এখানে। আজকাল তার কিছুই নেই। দোকানদাররাই আজকাল রাজা বড়লোক সাহেব । সে যাইহোকগে, সত্যি কথা বলতে কি ওতে আমার কিছু এসে যায় না, কারণ আমি যাদের পছন্দ করি তাদের বেশিরভাগই নাচে গায় নাটক করে ছবি আঁকে আর লেখে । বড়লোক কোথায় পাব !
লিন্ড্সে স্ট্রীটের মোড়ে গুণে গুণে সাতটাকে তো নামালেন। তারপর রাস্তা পার করিয়ে, হাঁটিয়ে নিয়ে চললেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চললাম। এত ঐশ্বর্য স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। এখনকার তুলনায় যানবাহন খুব কম ছিল, তাই বাঁচোয়া। নিউ মার্কেটে ঢুকে হকচকিয়ে গেলাম। একি পরীদের দেশ? প্রায় বারো বছর বয়স, ইংরিজি সাহিত্যের মেলা বই পড়ে ফেলেছি, কিন্তু কাপড় গয়নার চোখ ফোটেনি ! শুধু একটি প্যাসেজ্ই মনে পড়ে। তার সঙ্গে স্বর্গের কোনো তফাৎ নেই। নাহুম ইত্যাদির দোকানের সামনে দিয়ে যে পথ গেছে, সেকালে তার দুধারে সারি সারি কেক্ প্যাটিসের দোকান ছিল। বাস্তবিক দেখবার জিনিস । বড়দিন উপলক্ষ্যে তারা দোকানের বাইরে নিচু নিচু টেবিলে চিনি আর বাদামের তৈরি সাজ দেওয়া কেক্ পেস্ট্রি আর চকোলেট সাজিয়ে রেখেছিল । শিলং-এ মোরেলোর কেকের দোকান ছিল অভিজাত ব্যাপার। খুব ভালো কেক পেস্ট্রি হত। এখনকার ফ্লুরি ট্রিঙ্কার চাইতে ভালো বই মন্দ না। কিন্তু এভাবে ঢালাও সাজানো থাকত না। দেখে মনে কেমন বে-পরোয়া ভাব জাগছিল । এবং শুধু আমাদের নয়, ছোট জ্যাঠামশায়েরও। বললেন “কোনটা চাস্, বল্।” তারপর সাদা সাদা বাক্সে ভরে আমরা যা চাইতে লাগলাম, তাই কিনে কিনে আমাদের হাতে দিতে লাগলেন। তখন অবিশ্যি নিউ মার্কেটের কেকের দাম ছিল বারো আনা-এক টাকা পাউণ্ড ; আবার তেমনি ছোট জ্যাঠামশায়ের বেশি টাকা-কড়ির বালাই ছিল না। কিন্তু হৃদয় এবং হাত ছিল উদার।
লজঞ্চুস খেলাম, চকোলেট খেলাম, জীবনে এই প্রথম আইসক্রীম খেলাম। তখনো এবং এখনো ভাবি এমন জিনিস হয় না। তারপর বোধহয় সব নেতিয়ে পড়তে লাগলাম। কারণ যতিকে জ্যাঠামশায় কোলে নিলেন। দাদা সরোজের হাত ধরল, বাকিরা হোঁচট খেতে খেতে চললাম।
বাবা হলে বকাবকি করে ভূত ভাগিয়ে দিতেন, অবিশ্যি এতগুলোকে নিয়ে মার্কেটে বেড়াতে আসতে রাজিই হতেন না তাও সত্যি। জ্যাঠামশাই একবারো বিরক্ত হলেন না। বেরিয়ে এসে একটা ফীটন গাড়ি ডেকে, গাদাগাদি করে আমাদের তুলে, ১০০ নং গড়পারে নিয়ে গেলেন। স্তম্ভিত মুখে চক্চকে চোখে সেখানে যখন নামলাম, মনে হল স্বপ্ন থেকে জাগলাম। তারপর ৫৭ বছর কেটে গেছে, সেই পরীদের নিউ মার্কেটটাকে আর খুঁজে পাইনি। এখন আমরা সেখানে গিয়ে মাছ মাংস ডিম তরকারি আর বাদাম তেল কিনে, রাগে গজ্গজ্ করতে করতে ফিরি। বলেছি না কোনো জায়গা, কোনো মানুষ পুরোপুরি মাটি দিয়ে গড়া হয় না, খানিকটা করে মনগড়াও বটে।
গড়পারের বাড়ির খাবার ঘরের ওপরেই বসবার ঘর। সেখানে বড়দার বৌঠানের কাছে কারা আসতেন ভাবতে চেষ্টা করি। কালিদাস নাগ, কালিদাস রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, জীবনময় রায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বড় ছেলে কেদার চট্টোপাধ্যায়—কি যে সুন্দর চেহারা ছিল তাঁর, হাঁ করে দেখতাম। আরো আসতেন শিরিকুমার দত্ত, অমল হোম, কত নাম করব। আমাদের সঙ্গে তো আর কারো আলাপ করিয়ে দেওয়া হত না। বরং বড়দের রোমাঞ্চময় কথা শুনবার আশায় যদি বা কাছাকাছি ঘুর ঘুর করে বেড়াতাম, পত্রপাঠ আমাদের তিন তলায় পাঠিয়ে দেওয়া হত।
তিনতলায় তিনটি ঘর, একটা ছোট ছাদ আর একটা মস্ত ছাদ। একটা ঘরে মণিদা অর্থাৎ সুবিনয় আর মেজবৌদি আর তাঁদের সুন্দর ছেলে ধন থাকত। একটা বড় ঘর খালি পড়ে থাকত। খালি পড়ে থাকত বলা ঠিক নয়, সেখানে বড়-বৌঠানের বোন কনক দাশ, অর্থাৎ কনক বিশ্বাস ; মেজবৌদির চারজন সুন্দরী অনূঢ়া বোন, সবার ছোটটি আমাদের বয়সী ছিল, তার নাম ছিল নেলি । ভারি সুন্দর চেহারা তার, পরে তার ভক্তরা বলত সুইট্ নেল্ অফ্ ওল্ড ড্রুরি । তাকে দেখতে আমাদের ভারি ভালো লাগত, একটুও হিংসে হত না, যেমন ছোটবেলায় নোটনকে দেখে হত। কারণ এখন আর কেউ আমাদের কালো বলত না, আর সত্যি কথা বলতে কি সেরকম কালো ছিলামও না। কিন্তু নোটনের পাশে দাঁড়ালে শতকরা নব্বুই জন মেয়েকেই কালোকুচ্ছিৎ দেখাত। এই সত্যটা মেনে নিয়েছিলাম। চেহারা নিয়ে আর কখনো মনে কষ্ট পাইনি, তবে এখনো মাঝে মাঝে ভাবি মা ফর্সা ছিল, দিদিমা ফর্সা ছিল, ঠাকুরমারও বেশ পরিষ্কার রঙ ছিল, ঠাকুর্দা নাকি ধবধবে ফর্সা ছিলেন—তাহলে দিদিকে আমাকেও ফর্সা করতে ভগবানের কি এমন অসুবিধা হত। এসব কথা বললে মা রেগে যেতেন, বলতেন “তোমাদেরি বা কি এমন অসুবিধাটা হচ্ছে?” বলতেন বটে, কিন্তু আমাদের জন্য কাপড় কিনতে গেলে গোলাপী, গেরুয়া, ফিকে হলুদ, ঘি-রঙ, ফিকে বেগুনী ছাড়া কিনতেন না। বলতেন “মানাবে না।” তবে আরেকটু বড় হয়েই বাবার সঙ্গে গিয়ে নীল, সবুজ, যা খুশি কিনে আনতাম। আমাদের পিসতুতো দিদি মালতী, যার অপূর্ব গানের গলা এখন পর্যন্ত টস্কায়নি এবং যাকে সবাই মালতী ঘোষাল বলে জানে সেও ছিল ওদের সম-বয়সী বন্ধু, সে-ও মাঝে মাঝে এসে ২-১ দিন কাটিয়ে যেত। তখন তিন তলার বড় ঘরে ওদের জন্য মাটিতে মস্ত বিছানা পাতা হত। আমাদের চাইতে সব ৫-৭ বছরের বড়, কলেজে পড়ে, ইয়ং-ম্যানদের গল্প করে। ওরাও আমাদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিত না। বলত, “দেখেছ, ভারি জ্যাঠা হচ্ছে।”
অগত্যা তিন তলার বাকি ঘরটায় আশ্রয় নিতাম। সেখানে নান্কুদা শুত আর ছোট জ্যাঠামশাই বড় ঈজেলে ফটো এন্লার্জমেন্টে রঙ দিতেন। দেয়াল আলমারিতে বই ঠাসা ছিল। সে যে কত রকম বই সে আর কি বলব। নান্কুদা কিম্বা ছোট জ্যাঠামশাই কখনো আমাদের ভাগিয়ে দিতেন না। বরং মনে হত খুশিই হতেন। কত যে গল্প হত তার ঠিক নেই।
একবার ঝড়ের রাতে একটা প্যাঁচার বাচ্চা ডানা ভেঙে বড় ছাদে পড়ল। কারো অসুখ করলে, ব্যথা লাগলে, নানকুদা অন্য মানুষ হয়ে যেত। অমনি প্যাঁচাটাকে তুলতে গেল। প্যাঁচা বড় বড় চোখ পাকিয়ে, ঠোঁট বাগিয়ে, নখ উচিয়ে, ফ্যাঁস্ ফ্যাঁস্ শব্দ করতে লাগল। বোঝাই যাচ্ছিল ডানা জখম হয়েছে, উড়তে পারছে না। সাহায্য না পেলে মরেই যাবে।
আমরা সবাই ব্যাকুল হয়ে উঠলাম, তাহলে কি করা যায়? কাউকে তো কাছে যেতে দিচ্ছে না। নান্কুদা সাত-পাঁচ ভেবে, একতলায় নেমে গিয়ে বাগান থেকে লম্বা একটা কাঠি নিয়ে এল। আমরা একটু দূরত্ব রেখে, গোল হয়ে দেখতে লাগলাম। কাঠি দিয়ে নান্কুদা প্যাঁচার গলায় সুড়সুড়ি দিতে লাগল। একটু পরে দেখা গেল আরামে প্যাঁচার চোখ বুজে আসছে, গলা পেতে দিচ্ছে, ঠোঁট বন্ধ করেছে, নখ নামিয়েছে।
পরে যখন নান্কুদা ওকে কোলে নিয়ে চুন-হলুদ লাগিয়ে ডানা ব্যাণ্ডেজ করে দিল, প্যাঁচা কিছু বলল না। একটা বড় জুতোর বাক্সে তার বিছানা করা হল। পরদিন আরো খানিকটা সুড়সুড়ি দিয়ে, ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলে দিয়ে, আবার চুন-হলুদ লাগানো হল। তিন দিন ছিল প্যাঁচাটা, কিন্তু কিছু খেত না। বোধহয় জ্যান্ত জানোয়ার ছাড়া ওরা খায় না। রাতে খোলা জানলার পাশে রাখা হত। চতুর্থ দিন সকালে দেখা গেল পাখি উড়ে গেছে।
এর অনেক বছর পরে হাজারিবাগে নান্কুদার মেজদি পুণ্যলতা চক্রবর্তী, যাঁর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ বইখানির মতো ভালো বই বাংলায় কম আছে—তাঁর বাড়িতে ছুটি কাটাতে গিয়ে, এই ধরনের আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল। রেলের বাঁধের ওপর বেড়াতে গিয়ে নান্কুদা দেখে একজন গরীব লোক লাইনের পাশে বসে কাঁদছে।
কি ব্যাপার? না, ওর পায়ে কেউটে সাপে কামড়েছে। কখন কামড়েছে? না, এক্ষুনি। নান্কুদার বেড়ানো মাথায় উঠল। তৎক্ষণাৎ রুমাল দিয়ে সাপের কামড়ের দাগের ওপর এঁটে বেঁধে রক্ত চলাচল বন্ধ করল। তারপর বাঁধের নিচে মেজদির বাড়ি নিয়ে গিয়ে, পেন্সিল কাটা ছুরি দিয়ে কামড়ের দাগের ওপর চিরে, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট লাগিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে, টঙায় চাপিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেখানকার ডাক্তার সব ব্যাপার শুনে বললেন, “সবাই যদি আপনার মতো হত মশাই, আমাদের ব্যবসা উঠে যেত!”
এই রকম মানুষ ছিল নান্কুদা, অথচ ওদিকে নিজের শরীর নিয়ে সে কি পুতু-পুতু বাই! আমরা খুব বকতাম।
ঐ তিনতলার বড় ঘরে যারা শুত তাদের দেখা পাবার আশায়, বসবার ঘরে কম-বয়সী জনা পাঁচেক অতিথিও ঘুর ঘুর করত। তারা কেউ কেউ বেঁচে আছে বলে আর নাম করলাম না। এটা বুঝতেও আমাদের দেরি লাগল না। কারণ শিলং-এ কন্ভেন্টের ফিরিঙ্গি সহ-পাঠিনীরা এবিষয়ে আমাদের সযত্নে পাঠ দিয়েছিল।
এরা গোড়ায় হয়তো এসেছিল বড়দার টানে, তারপর আবিষ্কার করেছিল যে এ বাড়িতে অন্য আকর্ষণীয় বস্তুও আছে। তবে সেকালের ব্যাপার তো, একটু হাসি, দুটো কথা পর্যন্ত দৌড়, একসঙ্গে বেরুবার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। রঙ্গমঞ্চে নামবার অধিকার না পেলেও, উইংস্ থেকে আমরা মজা দেখতাম। এরা সবাই নিতান্ত অযোগ্যও ছিল না। পরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ছোট ভাই প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশ, আমাদের বড় আদরের বুলাদা, ছোট জ্যাঠামশায়ের বড় মেয়ে মাধুরীলতাকে বিয়ে করেছিল। চোদ্দ বছর আগে ৬৩ বছর বয়সে বুলাদার মৃত্যু হলে আমরা একজন প্রকৃত ভালোবাসার মানুষকে হারালাম।
দোতলায় বসবার ঘরের পাশে বড়দার ঘর, তাছাড়া তার সামনে আরো দুটি ঘর। একটিতে জ্যাঠাইমা থাকতেন, আরেকটিকে ড্রেসিং-রুম হিসাবে ব্যবহার করা হত। এই দুটি ঘরে আমরাও জায়গা পেয়েছিলাম।
তবে খুব বেশিদিন দিদি আর আমি থাকিনি ওখানে। দাদা, কল্যাণ অমনি হেয়ার স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। সেখানে যে বেজায় ভালো পড়ানো হত সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। ওরা গড়পার থেকে হেঁটে স্কুলে যেত। বাবাকে ততদিনে শিলং-এ ফিরে যেতে হয়েছিল, যামিনীদা প্রথম দিন দুই ওদের পৌঁছে দিয়েছিল, তারপর ওরা কলকাতার ছেলে হয়ে গেল। পড়াশুনোয় দুজনেই খুব ভালো ছিল।
মা-র শরীর ভালো যাচ্ছিল না, কিড্নি স্টোন হয়ে বড় কষ্ট পাচ্ছিলেন। আমাদের বড় জ্যাঠামশাই সারদারঞ্জন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পরম পণ্ডিত ছিলেন। বাস্তবিক একাধারে গণিতে ও সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি বেশি দেখা যায় না। জ্যাঠামশাই আয়ুর্বেদী ওষুধ দিয়ে মায়ের কিড্নি স্টোন গলিয়ে দিয়েছিলেন। আর কখনো মাকে ঐ নিয়ে কষ্ট পেতে হয়নি।
কথা ছিল আমরা ভবানীপুরে বাড়ি ভাড়া করে থাকব। দাদা ওপরের ক্লাসে পড়ে ও হেয়ার স্কুলেই থেকে যাবে। বাকীরা ভবানীপুরের কোনো স্কুলে পড়বে। দিদি আমি তো ডায়োসেসানে ভর্তি হয়েই গেছি। স্কুল খুলবে জানুয়ারির ১০-১২ই।
মায়ের অসুখের জন্য এই ব্যবস্থার কিছু দেরি হল। দিদিকে আমাকে ডায়োসেসানের বোর্ডিং-এ তিন মাস থাকতে হয়েছিল। মনে আছে খুব কষ্ট হয়েছিল। একেবারে নতুন পরিবেশ। কাউকে চিনি না; স্কুলে বাঙ্গালী শিক্ষিকাই বেশি হলেও, তাঁরা প্রায় সকলেই প্রটেস্টান্ট খ্রীশ্চান, তবে মিশনারি স্কুল, পরিচালনা করেন নান্রা। তাঁরা রোমান ক্যাথলিকদের ওপর হাড়ে চটা; কনভেন্ট থেকে কেউ এসে ভর্তি হলে কথায় কথায় খোঁটা দিতে ছাড়েন না।
পরে এই স্কুলে কলেজে আমার কৈশোর ও প্রথম যৌবন কত সুখে কেটেছিল সে আর বলতে পারি না। কত বন্ধুবান্ধব, সত্যিকার জ্ঞানী কত শিক্ষিকা। কনভেন্টে দু-তিন জন নান্ ছাড়া সত্যিকার জ্ঞানী কাউকে পাইনি। এখানে কত ভালো অঙ্ক শেখানো হত; তবে বাবার মতো কেউ না।
বোর্ডিং-এ একটা জিনিস একেবারে অন্তর পর্যন্ত পীড়া দিত, সেটি হল সব সময় চারদিকে লোক। নিরিবিলি এক মুহূর্তও পেতাম না। স্নানের ঘরে ছাড়া সব সময় আমাদের ওপর লোকের চোখ। খাওয়া ভালো ছিল না, তাতে কোনোই কষ্ট হত না। শনি-রবি গড়পারে গিয়ে ভালো-মন্দ খেতাম। কিন্তু ঐ সারাক্ষণ অচেনা লোক দিয়ে বেষ্টিত থাকার যে কি জ্বালা, সে আর কি বলব। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, অনেকেরই এতে কোনো অসুবিধা হত না। দিদি অনেকদিন পরে আবার এর পুরনো অভ্যাসের স্মরণ নিল। থেকে থেকেই চোখ মুছত। অবিশ্যি ফোঁৎ-ফোঁৎ করত না।
আরেকটা অসুবিধাও ছিল। জীবনে এই প্রথম ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করলাম না। ওখানে মাসে মাসে রিপোর্ট দিত। ক্লাসের কাজে রোজ নম্বর দিত, মাঝে মাঝে টেস্ট হত। সব বিষয়ে ভালো ছিলাম, শুধু বাংলায় চল্লিশের ঘরে। আমি যে ছয় বছর বয়স থেকে মনে মনে জানি বাংলায় লেখা ছাড়া আমাকে দিয়ে কোন কাজ হবে না, তাকে কি না পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘কি, বিলেত থেকে এয়েচ বুঝি?’
॥ ১৩ ॥
শনিবার রবিবার দুদিন ছুটি থাকত, আমরা ১০০ নং গড়পারে যেতাম, যামিনীদা আমাদের শনিবার বেলা এগারোটায় নিতে আসত। আমরা সেই মুহুর্তটির জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকতাম। পারলে শুক্রবার বিকেলেই চলে যেতাম। কিন্তু বোর্ডিং-এর নিয়ম ছিল শনিবার সকালে ৯টা থেকে ১০-৩০টার মধ্যে নিজেদের জামা-কাপড় কোথায় কি ছিঁড়েছে, সব মেরামত করতে হবে। তার আগে কাউকে ছাড়া হবে না। তখন রাগ ধরত, এখন বুঝি নিয়মটি বড় ভালো ছিল। একেক দিন যামিনীদা দেরি করে আসত, দিদির চোখ দিয়ে জল পড়ত। আমার নেই – টনসিলে ব্যথা করত। বোর্ডিং-এ কেউ আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত না, তবু ঐ ছাড়া পাবার মুহুর্তটির সে কি আনন্দ!
ল্যান্সডাউন রোড আর এলগিন রোডের মোড়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে চার্চ অফ সেন্ট জন্ দি ব্যাপটিস্টের ক্লুয়ার সিস্টারদের মস্ত বড় প্রতিষ্ঠান। এলগিন রোডের ওপর কলেজ, নিচের তলায় ক্লাস, ওপরে কলেজের হস্টেল। মস্ত বাগান; ফুলগাছ, আমগাছ, তেঁতুলগাছ, বাতাবিলেবুর গাছ; দুটি টেনিসকোর্ট; স্কুলবাড়ি, মিশন স্কুল। ভিতর দিকে আরেকটা হস্টেল, সে এক এলাহি ব্যাপার ছিল। কিন্তু ঐ যে বললাম তার মধ্যে নিজেকে নিয়ে একান্তভাবে বসবার একটু অবকাশ ছিল না। মস্ত হলে শোয়া, সারি সারি লোহার স্প্রিং-এর খাটে, ছোট মেয়েদের থেকে বড় মেয়েরা সব একঘরে শুত। জনা দুই নিচের ক্লাসের শিক্ষিকাও শুতেন। পাশের ছোট শোবার ঘরে স্কুল-বিভাগের অধ্যক্ষা সিস্টার জর্জিনা শুতেন। ভারি গুণী, ভারি কড়া, ভারি বুদ্ধিমতী কিন্তু কন্ভেন্টের নান্দের সেই ক্ষমাশীল কোমলতার একটুও ছিল না। তার ওপর রোমান ক্যাথলিকদের কাছে এতকাল লেখাপড়া শিখেছি বলে কেবলি খোঁটা দিতেন। চমৎকার ইংরিজি সাহিত্য পড়াতেন; চার্লস ডিকেন্সের সংক্ষিপ্ত সব উপন্যাস, দি ক্রিকেট অন্ দি হার্থ, খৃস্টমাস স্টরিজ্ ইত্যাদি। কন্ভেন্টে কেউ আমাদের এমন করে রস পরিবেশন করেনি। লিখতে-টিখতে দিলে ভালোই লিখতাম, তবু মন পেতে এক বছর সময় লেগেছিল। তারপর তাঁর কাছেই অজস্র স্নেহ পেয়েছি। ভেবে ভারি মজা লাগত যে ক্যাথলিক নান্রা কখোনো প্রটেস্টান্টদের নিন্দা করতেন না। অবিশ্যি তার একটা কারণ যে রোমান ক্যাথলিকরা তো আর। কাউকে খৃশ্চান বলে মনেই করতেন না। তাদের কাছ থেকে কোনো উৎকৃষ্ট গুণ আশাও করতেন না। কন্ভেন্টে নিচের ক্লাসের মেয়েরা হিন্দু ব্রাহ্মদেরও। ‘প্রটেস্টান্ট’ বলত! তাদের কাছে দুই-ই সমান ছিল। বোর্ডিং-এ রোজ সন্ধ্যায় ‘স্টাডি আওয়ারে’ সবাই এক জায়গায় বসে পড়া তৈরি করতাম। একজন শিক্ষিকা থাকতেন। নিচের ক্লাসের শিক্ষিকা; তাঁদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া দুরাশা! এদিকে বাংলায় কাঁচা; ব্যাকরণ জানি না; কে একটু বুঝিয়ে দেবে? মাস কাবারে প্রথম রিপোর্ট এল ক্লাসে ২০ জন মেয়ের মধ্যে মাঝামাঝি স্থান! মনে মনে স্থির করলাম যা হয়, একটা কিছু করতেই হবে। ইংরিজি গ্রামার এত ভালো বুঝি আর বাংলার বেলায় শব্দগুলোর মানে বুঝি না! বাংলা পড়াতেন দুজন মাস্টারমশাই; দুজনেই পুরুষ; দুজনেই হিন্দু। পণ্ডিতমশায়ের বয়স হয়েছে, প্রাচীনপন্থী, মাথায় টিকি, আমাদের দুজনকে কৃপার চোখে দেখেন। তারপর একদিন ক্লাসে রচনা লিখতে দিলেন: ‘আমার পূর্বপুরুষরা’। আমার মন জুড়ে থাকত দাদামশায়ের কাহিনী; আমি ফলাও করে তাঁর কথাই লিখলাম। ব্যস্, আর দেখতে হল না। পরদিন খাতা ফিরিয়ে দেবার সময়ে পণ্ডিতমশাই আমাদের ডেস্কের সামনে এসে বললেন, “এতদিন বলনি কেন যে তোমাদের মা অচলানন্দস্বামীর নাতনি? ছিঃ ছিঃ! না জেনে কত অন্যায় করে ফেলেছি। যেখানে অসুবিধা হবে আমার কাছে বুঝিয়ে নিও।” সেদিন থেকে পণ্ডিতমশাইও অন্য মানুষ হয়ে গেলেন।
আর ছিলেন মিঃ কুণ্ডু; তাঁর কাছে আমরা ব্যাকরণ পড়তাম। কিছু বুঝতে পারব না বলে মনটাকে তৈরি করে রেখেছিলাম। মিঃ কুণ্ডুর বয়স কম, রঙ কুচকুচে কালো, কেমন একটা আড়ষ্ট ভাব। তিনি ইংরিজিতে বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন। ভাবতেই মজা লাগছিল। কিন্তু তিনি প্রথম দিনই বললেন, “টেক্ ডাউন মাই নোট্স্ অন দি লাস্ট লেসন্ :—কারক ইজ নট বিভক্তি। ষষ্ঠি ইজ্ নট্ এ কারক, বিকজ্ ইট্ হ্যাজ্ নো রিলেশন উইথ্ এ ক্রিয়া।” সঙ্গে সঙ্গে বলে গেলেন “কারক ইজ্ কেস্, ক্রিয়া ইজ্ ভার্ব, ষষ্ঠি ইজ্ পসেসিভ!” কথাগুলো স্মৃতির ফলকে গেঁথে গেল। ব্যাকরণের অন্ধকার আকাশে আশার আলো দেখলাম। মনে হল এ তো সব চেনা জিনিস, অন্য নাম নিয়েছে। মনে আছে কেমন একটা আত্ম-প্রত্যয় এল। ভাবলাম গরমের ছুটিতে নিচের ক্লাসের পাঠ্য, চটি একটা ব্যাকরণ বই নিয়ে পড়ে ফেলতে হবে। করেওছিলাম তাই; ঐ আমার ব্যাকরণ অনুশীলনের আরম্ভ ও শেষ। সংস্কৃত পড়িনি; বাংলা ব্যাকরণ যেখানে যেমন দরকার হয়েছে, অমনি সেটুকু শিখে নিয়েছি। ব্যাকরণে আমি পাণ্ডিত্যলাভ করিনি বটে, তবে যেটুকু জেনেছি তাতেই বুঝেছি সুন্দর স্বয়ং-সম্পূর্ণ জিনিস ঐ বাংলা ব্যাকরণ। এতে সংস্কৃতের মহিমা আছে; তার সঙ্গে আছে নিজস্ব অপূর্ব এক সহজ গতি। ভালো করে বাংলা পড়লে, সংস্কৃত ব্যাকরণ শিখবার প্রয়োজন থাকে না। তবে সংস্কৃত পড়িনি বলে সারাজীবন একটা সুগভীর খেদও থেকে গেছে। অমন জিনিসের আসল স্বাদটি পেলাম না। দাদামশাই সংস্কৃতে পণ্ডিত; বড় জ্যাঠামশাই, তাঁর বাবা, তাঁর বাবা, তাঁর বাবা সবাই সংস্কৃতে পণ্ডিত! আর আমি কিনা ফ্রেঞ্চ নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করলাম! তবে ফ্রেঞ্চটিও এত উপভোগ করেছি যে সেটুকু স্বীকার না করলে অকৃতজ্ঞতা হবে। স্টাডির পর বোর্ডিং-এর সব মেয়েরাই রোজ স্কুলের চ্যাপেলে প্রার্থনায় যোগ দিত। মিনিট পনেরোর ব্যাপার, দুটি গান, একটু পাঠ, একটু প্রার্থনা। তবে পাহাড়ের ওপরকার সেই ছোট চ্যাপেলটির মোহ-মাধুরী এখানে একটুও ছিল না। মূর্তি নেই, ফুল নেই, ধূপধুনো নেই, কপালে কেউ জর্দানের জল দেয় না; নিতান্ত একাদশী ব্যাপার মনে হত। মেয়েদের মাথা ঢাকা দিয়ে চ্যাপেলে যাবার নিয়ম। শাড়ি পরলে মাথায় কাপড়, ফ্রক পরলে মাথায় ভেল্। সে ভারি বিশ্রী ব্যাপার মনে হত।
চ্যাপেলের পর খাওয়া, খাওয়ার পর শোয়া। পরীক্ষার্থিনীরা আরো কিছুক্ষণ পড়ত। আমরা শুতাম আর সমস্ত অতীত জীবন হুড়মুড় করে এসে আমাদের গ্রাস করত। কিছুতেই ঘুম আসত না। বুধবার রাতে ভুনি খিচুড়ি, বেগুনভাজা, আর ডিমের ডালনা দিত। প্রত্যেক বুধবার। ভালোই লাগত। শনিবার দুপুরে বাড়ি গিয়ে বাঁচতাম। মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, “আর কত দিন বোর্ডিং-এ থাকব?” এক শনিবার মা বললেন, “এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঈস্টারের ছুটি হলেই আমরা চক্ৰবেড়ে রোডের একটা বাড়িতে দু মাসের জন্য উঠে, অন্য বাড়ি খুঁজে নেব।” চক্ৰবেড়ের বাড়িতে শিলং-এর এক পুরনো বন্ধু থাকতেন, তাঁরা দু মাসের জন্য দেওঘরে যাচ্ছেন।
আস্তে আস্তে নতুন বন্ধু-বান্ধব হতে লাগল। এরাই আমাদের আপন জন; কন্ভেন্টের সহপাঠিনীরা বিজাতীয় ছিল, তাদের সঙ্গে বেশি অন্তরঙ্গতা সম্ভব ছিল না। এই সময় থেকেই কত আজীবনের বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়েছিল; এখন ভাবলে আশ্চর্য লাগে। একজন চেনা মেয়েকে দেখে অবাক হলাম। শিলং-এ ডান্সাহেব ছিলেন, লোক বড় ভালো। তাঁর স্ত্রী খাসিয়া মেয়ে, তিনিও খুব ভালো। কয়েকটা মেয়ে ছিল। একজন পাইন্ মাউন্ট স্কুলে পড়ত, আমাদের নেটিভ্ বলে টিট্কিরি দিত। আমাদের চাইতে বছর পাঁচেকের বড় ছিল মনে হয়। শেষের দিকে শিলং-এ আর তাকে দেখতাম না, বোধ হয় পাস্-টাস্ করে চলে গেছিল। এখানে এসে দেখি শাড়ি-টাড়ি পরে বাংলা বলছে! আমাদের দেখেও যেন চিনতে পারল না। আমরাও কিছু বললাম না।
রেবা রায় বলে আমাদের প্রায় সমবয়সী একটি মেয়ে বোর্ডিং-এ থাকত। হয়তো বছর দুইয়ের বড় হবে, কিন্তু প্রথম দিন থেকেই একেবারে মাসি-পিসি বনে গিয়ে আমাদের কিসে একটু আরাম হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখত। রেবা রায় সাধারণ মেয়েদের মতো ছিল না; নাচ-গানে তার স্বাভাবিক প্রতিভা ছিল। সে সময়ে ভালোঘরের মেয়েরা বল্ ডান্স যদি বা করত; ভারতীয় নাচ ছিল নাচ্ওয়ালীদের একচেটিয়া ব্যাপার। এখন যে শান্তিনিকেতনের নাচ বিশ্ববিখ্যাত হয়েছে, তখনো সেসবের উদ্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথের আগেকার গীতিনাট্যেও সত্যিকার নাচ ছিল না। ছিল হাত-পা নেড়ে গান, যাকে বলে অ্যাক্শন সঙ্। রেবা রায় এখনো জীবিত আছে, কিন্তু লোকে তাকে ভুলে গেছে। সে-ই প্রথম সাহস করে প্রকাশ্য মঞ্চে একা নেচেছিল। আমি যে-সময়ের কথা বলছি তখন দেশে স্বাদেশিকতার ঢেউ উঠেছে। জালিয়ানওয়ালা বাগের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে; স্বদেশী নেতারা ক্রমে সাহস করে এগিয়ে আসছেন। রাজনীতির ক্ষেত্র ছাড়াও এসবের একটা সুফল হচ্ছিল, দেশী সংস্কৃতির ওপর লোকের, শ্রদ্ধা জন্মাচ্ছিল। তার অনেকখানির জন্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের কাছে এদেশ ঋণী। দুটি গানের স্কুল হয়েছিল, প্রতিভাদেবী, সরলাদেবী, ইন্দিরাদেবী প্রমুখের পৃষ্ঠপোষকতায় সঙ্গীত সঙ্ঘ আর মিসেস্ বি এল চৌধুরীর সঙ্গীত সন্মিলনী। নামটা ঠিক ব্যাকরণ অনুমোদিত নাও হতে পারে। সঙ্গীত সঙ্ঘের একটু আভিজাত্যের গর্ব ছিল, সঙ্গীত সম্মিলনী ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য। মিসেস বি এল চৌধুরী রেবা রায়ের কে যেন হতেন। দিদি, আমিও সেই বছর সঙ্গীত সম্মিলনীতে ভর্তি হলাম। শিলং-এ একটু একটু বেহালা শিখেছিলাম, বলা বাহুল্য পাশ্চাত্য মতে, এখানে এঞ্জেল্ স্মিথ বলে নামকরা বেহালাবাদক পাঠ দিতেন। তাছাড়া বাঙালী মেয়ে বাংলা গান না শিখলে কি করে চলে? পরে আমরা বেঁকে বসলাম, গান-বাজনা আমাদের আসে না। রেবা রায়ও এখানকার ছাত্রী। সঙ্গীত সম্মিলনীর বার্ষিক উৎসবে যত দূর মনে হয় ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটের হলে, রেবা রায় প্রকাশ্যে নেচেছিলেন। চমৎকার নেচেছিলেন। শুধু আমরা কেন, সক্কলে বলেছিল চমৎকার নেচেছেন। সাজসজ্জার কথা আর কি বলব? কণ্ঠার হাড়ের ওপরে, কনুইয়ের নিচে আর পায়ের কব্জির নিচে ছাড়া, শরীরের কোনো জায়গা দেখা যায়নি। তবু ভদ্রলোকের মেয়ে স্টেজে চড়ে নাচল বলে শহরময় ঢি-ঢি পড়ে গেছিল! গত পঞ্চান্ন বছরে আমরা নিঃসন্দেহে পঞ্চান্ন হাজার মানসিক মাইল এগিয়ে এসেছি।
অবিশ্যি তখন এত কথা ভাবিনি, রেবা রায়ের মিষ্টি ব্যবহারের জন্য তাকে ভালো লেগেছিল। ইতিহাস পড়াতেন চারুলতা দাশ, বাঙালী খৃশ্চান, জাত-শিক্ষক যাকে বলে। পড়াতে পড়াতে ইতিহাসটাকে জ্যান্ত করে ফেলতেন। পরে ইনি অনেক বছর ডায়োসেসান স্কুলের অধ্যক্ষার পদে ছিলেন। সম্প্রতি আশীর ওপরে বয়সে দেহ রেখেছেন। এঁদের অনেকের মধ্যে কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না।
শনি-রবি কাটত সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে। সে পরিবেশের রাজা ছিলেন বড়দা। বড়দা ছিলেন অবারিতদ্বার। আমরা যখন খুশি তাঁর ঘরে যেতাম। তবে কাজের মানুষ, বেশি বিরক্ত করবার সাহস হত না। আবোল-তাবোলের কবিতার জন্য ছবি আঁকা দেখতে বেজায় ভালো লাগত। আমি বড়দাকে কখনো রঙ্গীন ছবি আঁকতে দেখিনি। সেসময় সন্দেশের সব ছবিই বোধ হয় উনি আঁকতেন। ভাইবোনদের মধ্যে বড়দিও চমৎকার ছবি আঁকতেন, তার বেশির ভাগই নানান্ দৃশ্যপট, কিম্বা নিজের পরীদের গল্পের ছবি। থাকতেনও না কাছে, ওঁর স্বামী ডাঃ জয়ন্ত রাওয়ের কর্মস্থল ছিল ওড়িষা, জন্মস্থানও বটে। সেখানেই কিম্বা কাছাকাছি। কোথাও তাঁদের জীবন কেটেছিল। মারা গেছিলেন অনেক পরে কলকাতায় এসে, বিধবা বড়মেয়ের বাড়িতে।
কাজের মানুষ হলেও বড়দার সরস মধুর ব্যক্তিত্ব বাড়িময় ছড়িয়ে থাকত। এখন বুঝতে পারি সেটা ছিল ওঁদের ‘মণ্ডে ক্লাবের’ যুগের শেষের দিকটা। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে মণ্ডে ক্লাবে যতই নির্মল আনন্দের ব্যবস্থা থাক ওটি ছোটদের জন্যে নয়। বাড়িতে তখন ছোট বলতে জ্যাঠামশায়ের নিতান্ত বালখিল্য দু-তিনজন নাতি-নাত্নি ছাড়া কেউ ছিল না। তাদের মধ্যে একমাত্র সুবিনয়ের ছেলে ধন ঐ বাড়িতে থাকত। পুণ্যলতার দুই মেয়ে; পরে একজন কল্যাণী কার্লেকর আর একজন নলিনী দাশ নামে সুপরিচিতা, কিন্তু এরা ছোটনাগপুরে বাপের কর্মস্থলে মানুষ হয়েছিল। কলকাতায় আসত যেত। মোট কথা মণ্ডে ক্লাবের ব্যাপার দেখবার আমাদের সুযোগ হয়নি। শুধু একটা রবিবার দোতলার বসবার ঘরের দরজা বন্ধ করে, একটা কিছুর মহড়া চলছিল; গমকে গমকে হাসি শোনা যাচ্ছিল; প্লেট প্লেট জলখাবার যাচ্ছিল। বলা বাহুল্য আমাদের সে সময়টা কেটেছিল তিনতলায় নান্কুদার ঘরে। ছোট জ্যাঠামশাই সেখানে ছবি আঁকছিলেন; নান্কুদা অনুপস্থিত ছিল, বোধ হয় মহড়ায় যোগ দিয়েছিল। কলকাতায় এসেই টের পেয়েছিলাম এগারো বারো বছরের ছেলেমেয়েদের লোকে বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে করে না। যাই হোক, তেতলার স্নানের ঘরে স্নান করে, নান্কুদার ঘরের খালি তক্তাপোষের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে, জ্যাঠামশায়ের বইয়ের আলমারিতে পাওয়া “ড্রাকুলা” বলে এক অভাবনীয় বই পড়তে আমি ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় আমার ছোটভাই সাত বছরের সরোজ একটা লোহার হেয়ার-পিন হাতে করে, তক্তাপোষে উঠে, আমার পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে, খুব যত্ন করে হেয়ার-পিনটার দুটো ঠ্যাং একটা খোলা প্লাগ্-পয়েন্টের দুটো গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।
আর যাবে কোথায়! ফ্যাঁ—শ্ করে একটা শব্দ হল; জোরে একটা ঝিলিক দিল; সরোজ আমার পিঠের ওপর থেকে ছিটকে পাঁচ হাত দূরে জ্যাঠামশায়ের পায়ের কাছে পড়ল; ঈজেল হুড়মুড় করে উল্টে গেল আর আমার মনে হল হয় আমার মাথার ভিতরে, নয় আমার হৃৎপিণ্ডে, কিম্বা সম্ভবত দুই জায়গাতেই কেউ গায়ের জোরে একটা অদৃশ্য হাতুড়ি পিটল। আমি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। দিদিও ঘরে ছিল, দাদাও ছিল, ওদের কাছে পরে শুনেছি যে ছোট জ্যাঠামশাই কয়েক মুহূর্ত তুলি হাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর, যখন দেখলেন সরোজ তখনো শুধু জ্যান্ত নেই, হাতে হেয়ার-পিনটা নিয়েই আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে—আরেকবার চেষ্টা করার জন্য কি না ঠিক জানা যায়নি—তখন তিনি কখনো যা করতেন না, তাই করে বসলেন; আচ্ছা করে সরোজের কান পেঁচিয়ে দিলেন। তারপর আমার কাছে ছুটে এলেন। ততক্ষণে আমিও উঠে বসেছিলাম। ভাগ্যিস্ সেসময় সব জায়গায় ডি-সি কারেন্ট ছিল।
ব্যাপারটা ওখানেই চুকে গেছিল। কান প্যাঁচাবার পর ছোট জ্যাঠামশাই ঐ নিয়ে আর বাক্যালাপ করেননি। ঈজেল তুলে, বিড় বিড় করে কি যেন বলতে বলতে, আস্তে আস্তে নিচে চলে গেছিলেন। যাবার আগে শুধু নরম গলায় বলেছিলেন, “মরে যাওনি ঐ ঢের।”
বড়দা দিব্যি মোটাসোটা ছিলেন। তাই নিয়ে বৌঠান মাঝে মাঝে রাগমাগ করতেন। “আচ্ছা, খাওয়ার কথা আমি কিছু বলছি না, কিন্তু খেয়েদেয়ে তিনটে পর্যন্ত শুতে পাবে না।” বড়দা দেখলেন এ তো মহা গেরো! ভয়ঙ্কর ভালো রান্না করতেন বৌঠান। তখন দিন কাল অন্য রকম ছিল। শিক্ষিত বাড়ির মেয়েরাও রান্না করবে, পরিবেশন করে সবাইকে খাওয়াবে, এই রকমই সকলে আশা করত। আমাদের বাড়িতেও ঐ নিয়ম ছিল। আমার পিসিমার বাড়িতে, জ্যাঠামশাইদের বাড়িতে, মাসিমার বাড়িতে, সব জায়গাতেই তাই। হাজার লেখাপড়া শেখা, গাইয়ে-বাজিয়ে মেয়ে হক না কেন, রাঁধবার লোক থাকলেও ভালো রেঁধে বাড়িসুদ্ধ সকলকে পরিবেশন করে খাওয়ানোর মধ্যে ভারি একটা তৃপ্তির ব্যাপার ছিল। তার ওপর বৌঠান ছিলেন অসাধারণ রাঁধিয়ে। বড়দার খাওয়া-দাওয়াটা মন্দ হত না। কিন্তু খেয়েদেয়ে আর শোবার জো রইল না। বৌঠান বাড়িসুদ্ধ সবাইকে ডেকে ঘরে আসর জমানো ধরলেন।
দিন দুই চেয়ারে বসে বই পড়ে, প্রুফ দেখে, কাটাবার পর বড়দা বললেন, “এখানে বড্ড হট্টগোল, যাই আমার অপিস্-ঘরে গিয়ে কাজ করি।” এই বলে বাড়ির সামনের দিককার নিষিদ্ধ অঞ্চলে চলে গেলেন। তারপর থেকে রোজই খেয়েদেয়ে কাগজপত্র নিয়ে অপিস্-ঘরে চলে যেতেন। আর শোবার কথা মুখেও আনতেন না।
এতে খুশি হওয়া দূরে থাকুক, সন্দিগ্ধ মনে রবিবার দিন যখন অপিস্ বন্ধ থাকত, ঘরে তালা দেওয়া থাকত তখন নিচে থেকে রাম-দহিনকে ডেকে পাঠিয়ে, ঘর খুলিয়ে, বৌঠান দেখলেন অপিস্ ঘরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যেমন সর্বদা থাকে আর ঘরের এক পাশের বইয়ের আলমারিটা একটু সরিয়ে, চওড়া একটা কাঠের বেঞ্চির ওপর পুরু-গদী বিছিয়ে চাদর পেতে দিব্যি সুন্দর একটি বিছানা করা! বৌঠান ঘরে ফিরে এসে বললেন, “নাঃ, থাক, কাল থেকে ঘরেই শুইয়ো।”
বড়দা যখন মারা যান, আমার বয়স পনেরো বছর, কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর কথা মনে পড়লেই, মনটা ভালো হয়ে যায়। কি উচ্ছল প্রাণশক্তি ছিল মানুষটার; যেখানেই যেতেন সঙ্গে করে একটা আনন্দের ঝড় নিয়ে যেতেন। আমি ভাবতাম এই আশ্চর্য মানুষের স্নেহচ্ছায়ায় আমার লেখিকার জীবন কাটবে; ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্স থেকে সুন্দর রূপ নিয়ে আমার বই-ও বেরোবে; আমার কি সৌভাগ্য। সে-সব কিছুই হয়নি অবিশ্যি। তবু বড়দা আমার হাতেখড়ি দিয়ে গেছিলেন আর ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্স উঠে গেলেও, বহু প্রকাশকের বহু সম্পাদকের আজীবনের প্রীতি আর সহযোগিতা পেয়েছি; সে-ও কিছু কম সৌভাগ্যের কথা নয়।
কিন্তু ‘বড়দা’ বললেই তাঁর জীবনের শেষের বেদনাময় দিনগুলোর কথা মনে হয় না; মনে হয় একটা কোঁকড়া চুল, চক্চকে চোখ, হাসি-খুশি, মোটা-সোটা মানুষকে, যিনি ছিলেন একদল যুবকের নেতা ও পৃষ্ঠপোষক। নিজে ছত্রিশ বছর বয়সে বিদায় নিয়েও তিনি তাঁদের সারা জীবন প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁদের উত্তরাধিকারীরাই বাংলার রসের ভাণ্ডারটি আজ পর্যন্ত রক্ষা করে এসেছেন। আমাদের অনেক গেছে, কিন্তু সেটি যায়নি। সেটিকে রসিকতার সঙ্গে ভুল করলে চলবে না; সরসতা অনেক সুগভীর জিনিস, তার মধ্যে একটা গোটা জীবনদর্শন ধরা আছে। রসিকতা কত সময় ছেঁদো কথায় দাঁড়ায়। আমাদের সরসতা আমাদের রক্ষাকবচ।
সে যাই হক, বড়দার বেজায় বন্ধু ছিলেন প্রসিদ্ধ ডাক্তার সুন্দরীমোহন দাশের ছেলে প্রেমানন্দ দাশ। তিনি আবার আমাদের শিলং-এর দিদিমার বড় জামাই ছিলেন। তাঁরা আপার সার্কুলার রোডে থাকতেন, সেটা ১০০ নং গড়পার থেকে খুব দূরে ছিল না। একদিন দুপুরে বড়দা গেরুয়া পরে, রুদ্রাক্ষের মালা গলায়, জটা মাথায়—মণ্ডে ক্লাবের কি না ছিল!—পায়ে খড়ম, হাতে কমণ্ডলু নিয়ে, সর্বাঙ্গে ছাই মেখে, প্রেমানন্দদের বাড়ির খিড়কি-দোরের কড়া নাড়লেন। পাশেই প্রেমানন্দর ঘর; বড়দা ভেবেছিলেন রবিবার বেলা তিনটেয় সে নিশ্চয় ঘুমুচ্ছে; শব্দ শুনে খিড়কি দোর খুলবে; তারপর বেশ মজা করা যাবে।
ঠিক সেই দিনই খুলবি তো খোল্, প্রেমানন্দের মা রান্নাঘরের রকে পাটিসাপ্টা না কি ভাজছিলেন, তিনি এসে দরজা খুললেন। ঘাবড়ে গিয়ে বড়দা বললেন, “জয় হক, মা!” আর প্রেমানন্দর মা অমনি খিড়কি দোরের সামনেই বড়দাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করলেন! বড়দা কি আর সেখানে দাঁড়ান: পিছন ফিরে খড়ম খট্খট্ করে, সেই যে দৌড় দিলেন, ১০০ নং গড়পারে না পৌছে থামলেন না। আমার মনে হয়, তখন বৌঠান বলেছিলেন, “বেশ হয়েছে! আমি খুব খুশি হয়েছি!”
॥ ১৪ ॥
বড়দার বিষয়ে গল্প করতে বসলে আর এ কাহিনী কোনোদিনও শেষ হবে না। অল্পবয়স থেকেই নিজেও যে ভয়ঙ্কর গল্পে আর বেজায় তার্কিক ছিলেন তার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। আর শুধু বড়দা কেন, ওঁদের দলটিই ঐ রকম ছিল। সে-দলের মধ্যে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস নাগ, কালিদাস রায় প্রমুখও ছিলেন। কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের গা ঘেঁষে একটা সরু গলি আছে। সেই গলিতে সেকালে অনেকগুলি ব্রাহ্ম; পরিবারের বাড়ি ছিল এবং ঐ গলিটি আড্ডা দেবার আদর্শ স্থান ছিল। এক রকম বলতে গেলে ব্রাহ্ম সমাজের হেপাজতেই আড্ডা বসত, যদিও সদস্যরা সকলে ব্রাহ্ম ছিলেন না। গলির প্রথম বাড়ি ছিল প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ঠাকুরদাদা গুরুচরণ মহলানবিশের। সকালে সন্ধ্যায় গান-বাজনা উপসনার শব্দের জন্য সমাজ-পাড়ার সকলে প্রস্তুত থাকত। কিন্তু তার ওপর যখন ছুটির দিনে দুপুরে গলিতে তর্কসভা বসতে আরম্ভ করল, তখন আর তাঁদের ধৈর্য রইল না। বিশেষ করে গুরুচরণ মহলানবিশের বাড়ির সামনের রকটিকে তর্ক-সভার হেডকোয়ার্টার বললেও অত্যুক্তি হত না। শেষটা ছুটির দিনের দিবা-নিদ্রা ভঙ্গে অতিষ্ঠ হয়ে, গুরুচরণের বড় ছেলে সুবোধচন্দ্র একদিন মিস্ত্রি ডাকিয়ে রকটি কাটিয়ে ফেললেন।
আড্ডা অন্যত্র উঠে গেল।
এ-সব অবিশ্যি অনেক দিন আগের কথা, আমি তখন জন্মেছি কি না সন্দেহ। এই তার্কিক বড়দাকে আমি দেখিনি, যদিও ভারতীয় শিল্প নিয়ে ও-সি গাঙ্গুলীর সঙ্গে প্রবাসীতে তাঁর বিখ্যাত বিতর্কের প্রবন্ধগুলি পড়ে বুঝেছিলাম যে ও-সি গাঙ্গুলীর চাইতে বড়দাও কিছু কম যেতেন না। বলা বাহুল্য এ-সব তর্কাতর্কিতে চটাচটি হলেও, ব্যক্তিগত আক্রোশ থাকত না।
আমি বারে বারে বড়দার চরিত্রের কোমল দিকটা দেখতাম। গড়পারে রোজ সকালে একমুখ দাড়ি নিয়ে, একজন বুড়ো মাস্টারমশাই এসে চা টোস্ট মাখন খেয়ে চলে যেতেন। তাঁর নাম কখনো শুনিনি, সবাই বলত মাস্টারমশাই। বোধ হয় কোনো সময়ে বড়দার শৈশবে উনি বাড়ির মাস্টার ছিলেন। অপরিষ্কার কাপড়চোপড় পরে, টেবিলের এককোণে বসে তিনি চা খেয়ে চলে যেতেন। কারো সঙ্গে কথা বলতেন না, কোনো উপদ্রব করতেন না। খালি নাক থেকে ময়লা বের করে টেবিলে মাখাতেন। তাতে বাড়ির মহিলারা বেজায় চটে যেতেন। শেষটা একদিন তাঁরা মাস্টারমশাইকে ছোট একটা আলাদা টেবিলে, পরিপাটি করে গুছিয়ে চা খেতে দিলেন। মাস্টারমশাই যথাসময়ে এসে অভ্যস্ত জায়গায় তাঁর চেয়ার না দেখে, একটু বিভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকাতেই, মেয়েরা কেউ তাঁকে তাঁর নতুন জায়গা দেখিয়ে দিলেন। মাস্টারমশাই নিঃশব্দে সেখানে বসে টোস্ট তুলে নিলেন। এমন সময় বড়দা চা খেতে নেমে এলেন।
নতুন ব্যবস্থা দেখে বৌঠানের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বললেন, “আজ আবার এ ব্যবস্থা কেন?” সবাই এ-ওর দিকে তাকাল। বৌঠান বললেন, “এতেই তো ওঁর বেশি সুবিধা হবে, এ টেবিলে এত লোক—।”
বড়দা বললেন, “ও। তাহলে কাল থেকে আমাকেও ঐ ছোট টেবিলে ওঁর সঙ্গে চা দিও।” এই বলে চা না খেয়ে তখুনি ফিরে আবার ওপরে উঠে গেলেন। বলা বাহুল্য ছোট টেবিলও আধ ঘণ্টার মধ্যে অদৃশ্য হল।
বড়দা তাঁর ব্যক্তিত্বের দীপ্তি দিয়ে সকলের চোখ এমনি ধাঁধিয়ে রেখেছিলেন যে তাঁর ছায়ায় ছায়ায় যে আরেকজন অসাধারণ মানুষ সব সময় ঘুরে বেড়াতেন, তাঁর দিকে কারো চোখ পড়ত না। এই মানুষটির নাম সুবিনয় রায়, ডাকনাম মণি, বড়দার মেজভাই, গড়পারের তিনতলায় ইনি মেজবৌদি আর তাঁদের একমাত্র ছেলে ধনকে নিয়ে থাকতেন। ফরসা, লম্বা মানুষটি, গানের শখ, নানা রকম বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে পড়াশুনো করতেন, চমৎকার প্রবন্ধ আর মৌলিক গল্প লিখতেন। খানকতক বই-ও প্রকাশিত হয়েছিল; গল্পের, প্রবন্ধের, আশ্চর্য সব ধাঁধার বই। অথচ এমন মানুষের ওপর আমাদের দৃষ্টি পড়তে হয়তো আরো দশ বছর সময় লেগেছিল। বড়দার সঙ্গে সঙ্গে ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্স-এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন; বড়দার চাইতে হয়তো ৫/৬ বছরের ছোট ছিলেন। দুজনার মাঝে এক বোন; পুণ্যলতা চক্রবর্তী, যার লেখা ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’-তে মণিদার বিষয়ে অনেক কথা আছে। ঐ বয়সে মণিদার এত গুণের কথা আমরা জানতেও পারিনি, গুণগুলি সব তখনো ফোটেওনি। এখনো মাঝে মাঝে প্রকাশনী মহলের নানান্ বন্ধুর কাছে শুনি মণিদার কাছে কোনো লেখক বা বিপন্ন প্রকাশক সাহায্য চেয়ে ফিরে আসত না। মণিদাকে এখনকার ছোট ছেলে-মেয়েরা চেনে না বলে আমার দুঃখ হয়। এমন সরস, উদার, সদা-হাস্যময় মানুষ খুব বেশি দেখি না। ওঁর রচনাগুলি সংগ্রহ করে দুই খণ্ডে প্রকাশ করা যায়। দুঃখের বিষয় কোনো কোনো বইয়ের কপিরাইট মণিদা বিক্রি করে দিয়েছিলেন, তাই মেজবৌদি সাহস পান না। ধন মানসিক রোগে ভোগে। মেজবৌদির এখন আশীর ওপর বয়স। মণিদা ৫২ বছর বয়সে স্বর্গে গেছেন। কার ভাগ্যে কি থাকে কে বলতে পারে। গড়পারের দোতলায় উঠেই ডান হাতে সুন্দর করে সাজানো বসবার ঘর, আর বাঁ দিকে একটা দালান চলে গেছে; তার ওপারে কার্যালয়ের এলাকা; আমাদের প্রবেশ নিষেধ। দালানটা বাঁ দিকে একটু এগিয়ে, আবার বাঁ দিকে মোড় নিয়ে, শোবার ঘর, কলঘর ইত্যাদির দিকে চলে গেছে। ঐ বাঁকটির ওপর একটা বেশ বড় ঘর। সেই ঘরে সতীশমামা বলে একজন অদ্ভুত লোক থাকতেন। তাঁকে ভয় করব, না ভালোবাসব, ঠিক করতে পারতাম না। হাত-পা তাঁর বাঁকা; কিছুতে ভর না দিয়ে দাঁড়াতে পারেন না; একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ; পরনে পরিষ্কার ধবধবে ফতুয়া আর ধুতি। উস্কো-খুস্কো চুল; হঠাৎ দেখলে পাগল মনে হত। ছোটরা তাঁকে বেজায় ভয় পেত; এক দৌড়ে মোড়টুকু পার হত। সতীশমামা ডাকাডাকি করতেন; গলার স্বরটা বিকৃত, উচ্চারণ অস্পষ্ট; কি বলছেন সব সময় বোঝা যেত না।
সতীশমামা ছেলেপিলে ভালোবাসতেন। কারো জন্মদিন শুনলে আঁকা-বাঁকা অক্ষরে সুন্দর ছন্দ-মিল দিয়ে কবিতা লিখে দিতেন; দুটো করে টাকা হাতে গুঁজে দিতেন; মাথায়-মুখে হাত বুলিয়ে আদর করতেন। যার জন্মদিন সে জ্যাঠাইমার কাপড় আঁকড়ে ধরে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। জ্যাঠাইমা বলতেন, “ভয় কিসের? ও তোদের সতীশমামা, আমার ছোটভাই।” ছোটভাই মানে দ্বারিক গাঙ্গুলীর প্রথম পক্ষের একমাত্র ছেলে, জ্যাঠাইমার সহোদর। শিশুবয়সে কে কোল থেকে ফেলে দিয়েছিল। মাথায় চোট লেগে ঐ রকম হয়ে গেছিলেন। চিরকাল জ্যাঠাইমা মা-মরা বিকলাঙ্গ ছোট ভাইটিকে বুকে করে মানুষ করেছিলেন। বিয়ের পর সঙ্গে করে স্বামীর বাড়িতে এনেছিলেন; সতীশমামা মারাও গেছিলেন তাঁর কোলের কাছে শুয়ে।
এখনো সতীশমামার গলার স্বর মনে আছে। ভারি রসবোধ ছিল তাঁর। শরীরটাই বিকল হয়েছিল, মাথাটা সাফ ছিল। ছোট জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে তাঁর খুব জমত। একদিন দূর থেকে ছোট জ্যাঠামশাইকে দেখে বলে উঠলেন, “কিছুতেই যে হয় না রাজি!” পাশের ঘরে বসে বড়দা আস্তে আস্তে বললেন, “রাজির সঙ্গে পাজি মেলে।” সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল সতীশমামার কবিতার দ্বিতীয় পদ,
“ময়মনসিংহের বাঙ্গাল পাজি।”
জ্যাঠাইমার বাপের বাড়ির আরো অনেকে বেড়াতে আসতেন। তাঁদের মধ্যে সবার আগে নাম করতে হয় জ্যাঠাইমার বিমাতা কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর। তাঁর জীবনটাই এক আশ্চর্য ব্যাপার। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তার অনেক আগেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। বয়সে জ্যাঠাইমার চাইতে সমান্য বড় ছিলেন; দেখে মনে হত অনেক ছোট। মস্ত দশাসই চেহারা; ফুট্ফুট করত গায়ের রঙ ; থান পরে এবং এত বয়সেও রূপ চাপা পড়ত না, তবে কেমন একটু কড়া ধরনের ভাব। আমরা দূর থেকে দেখতাম; তিনিও কাছে ডাকতেন না।
শুনেছিলাম কাদম্বিনী বসু বাল-বিধবা ছিলেন; জ্যাঠাইমার বাবা দ্বারিক গাঙ্গুলীই তাঁর অভিভাবকদের বলে-কয়ে ওঁকে স্কুলে ভরতি করিয়েছিলেন। স্কুল থেকে কলেজে। তারপর একদিন কাদম্বিনী গ্র্যাজুয়েট হলেন। এর মধ্যে কোনো সময়ে দ্বারিক গাঙ্গুলী তাঁকে বিয়ে করে ফেললেন। বিদ্যাসাগর মশাই তাতে নিশ্চয় খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ে করেও কাদম্বিনী রেহাই পেলেন না। স্বামীটি স্ত্রী-শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক। দিলেন তাঁকে মেডিকেল কলেজে ভরতি করে। একটার পর একটা ডাক্তারি পরীক্ষা পাস্ করলেন কাদম্বিনী, মড়া কাটলেন, ধাত্রীবিদ্যা শিখলেন, সব করলেন। অন্তিম পরীক্ষাও পাস্ করলেন। কিন্তু স্নাতক বলে স্বীকৃতি পেলেন না। তখন বিলেতেও নাকি কোনো মহিলা ডাক্তারি পাস্ করে এম্-বি হননি। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী প্রথম পাস্ করা মহিলা চিকিৎসক, যদিও অনেকে তাঁকে সে সম্মান দেন না; যেমন সেকালের বিশ্ববিদ্যালয়ও দেয়নি।
দু তিনটি ছেলে-মেয়ে হবার পর দ্বারিক গাঙ্গুলী স্ত্রীকে বিলেত পাঠালেন ডাক্তারিতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। ছেলে-মেয়েদের ভার নিলেন তাদের দিদিমা। শুনেছি কাদম্বিনী ফিরে এলে, ছোট ছেলে কিছুতেই তাঁর কোলে গেল না। কাদম্বিনী কেঁদেছিলেন। সারা জীবন ডাক্তারি করেছিলেন এই আশ্চর্য মহিলা। অনেক দিন নেপালের রাজ-অন্তঃপুরের গৃহ-চিকিৎসক ছিলেন। সেখান থেকে চলে আসবার সময় তাঁরা তাঁকে দামী দামী সব রেশম-কিংখাবের জিনিস, মণিমুক্তোর গহনা দিয়েছিলেন। আমার মা সে-সব দেখেছিলেন। ১৯২০ সালে আমি যখন তাঁকে দেখি, তখন তিনি অন্তঃপুরবাসিনী মহিলাদের চিকিৎসার জন্য কোনো সরকারি সংস্থায় কাজ করছেন। ঘোড়ারগাড়ি করে বালিগঞ্জ টালিগঞ্জ বেহালা যেতেন। সেকালে বাস ছিল না, ট্রামের লাইনেরও এত বিস্তার হয়নি ; ও-সব জায়গাকে বিদেশ মনে হত। ঘোড়ারগাড়ি করে অত দূরে যেতে অনেক সময় লেগে যেত। কাদম্বিনী সে সময়টা নষ্ট না করে, গাড়িতে বসে বসে ক্রুশের কাঁটা দিয়ে অপূর্ব সুন্দর সূক্ষ্ম লেস বুনতেন। তাঁর এই কর্মনিষ্ঠা আর সুন্দর গাম্ভীর্যমণ্ডিত চেহারা দেখে তাঁকে ভারি শ্রদ্ধা করতাম, কিন্তু কাছে যেতে সাহস পেতাম না। মনে আছে তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে মাঝে মাঝে আসতেন। বন্ধুকে মা-জ্যাঠাইমা নগেনদিদি বলতেন।. তাঁকে একদিন গল্প করতে শুনেছিলাম যে, যদিও নেপালে কাদম্বিনী অনেক সম্মান পেয়েছিলেন, রাজবাড়ির মেয়েরা তাঁকে গুরুর মতো ভক্তি করতেন, নিজের দেশে ফিরে এসে মাঝে মাঝে যে ব্যবহার পেতেন তাকে সম্মান বলা যায় না। একবার কোনো বড়লোকের বাড়িতে কারো প্রথম সন্তান হবার সময় কিছু গোলমাল হয়েছিল, ধাত্রীরা প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কাদম্বিনী গিয়ে মা ও ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। নগেনদিদি সেবার সঙ্গে গেছিলেন।
তারপর স্নানটান করে এসে দেখলেন ভিতরবাড়ির উঠোনের পাশের বারান্দায়, যেখানে ঝিরা খেত, সেইখানে তাঁদের জায়গা করা হয়েছে। ঠাকুর পরিবেশন করল, রান্নাবান্নাও খুবই ভালো। কিন্তু খেয়ে ওঠার পর বাড়ির গিন্নি ঝিকে দিয়ে বলে পাঠালেন দাইরা যেন নিজেদের কলাপাতা তুলে ফেলে দিয়ে, জায়গাটা মুছে দিয়ে যায়। ঝিরা ও-সব নোংরা কাজ করবে না! বলিনি গত সত্তর বছরে আমরা বহু লক্ষ মাইল এগিয়ে এসেছি। আমাদের কোনো উন্নতি হয়নি, একথা ভুল।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাউকে কাউকে সকলে চেনে। বড় ছেলের নাম ছিল প্রভাত; তিনি স্বনামধন্য সাংবাদিক ছিলেন। একমাথা ঝাঁকড়া চুল, এক মুখ বুনো দাড়ি-গোঁফ, তাঁর ডাকনাম ছিল জংলি! অবিশ্যি যখন নামকরণ হয়েছিল, সে নিশ্চয় ঐ নামোপযোগী অন্য গুণও ছিল বলেই হয়েছিল; কারণ তখনো তাঁর দাড়ি-গোঁফ বেরুতে ঢের দেরি ছিল। জংলুমামা বলে আমরা তাঁকে ডাকতাম। মামা হলেও বড়দার বন্ধু জংলুমামা। জংলুমামার এক ছোট ভাই ছিলেন। তাঁকে আর এবার দেখলাম না, অকালে তিনি মারা গেছিলেন, তাঁর নাম ছিল মংলুমামা। মংলুমামাও বড়দাদের বন্ধু ছিলেন, সাহিত্য ভালোবাসতেন। বাবার কাছে তাঁর বিষয়ে একটা মজার গল্প শুনেছিলাম। কোথায় যেন জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে বাবাও ছুটি কাটাতে গেছিলেন, চুনারে কি পচম্বায়, কিম্বা ঐ রকম কোথাও। দুপুরবেলা বাবা রাইডার হ্যাগার্ডের ‘কিং সলমন্স মাইন্স্’ পড়বার চেষ্টা করছেন। এমন সময় হাতে একটা জ্যান্ত খুদে মাছ নিয়ে মংলুমামার প্রবেশ। সে কিছুতেই ছাড়বে না, গল্প বলতেই হবে। বাবা তখন ওকে ভাগাবার উদ্দেশ্যে বললেন, “বলব গল্প, যদি ঐ মাছটাকে জ্যান্ত গিলে খেতে পারিস্!” মুখ থেকে কথাটা বেরুবামাত্র মংলুমামার গলা দিয়ে কিলবিল করতে করতে মাছটা গিয়ে পেটে পৌঁছল। বাবা তো ভয়েই মরেন, শেষটা কি হতে না কি হয়ে যায়। কিন্তু কিচ্ছু হল না। মংলুমামা বহাল তবিয়তে রইলেন। লাভের মধ্যে আগাগোড়া কিং সলমন্স মাইন্সে্র গল্প শুনতে পেলেন!
জংলুমামাদের এক বোনের নাম ছিল জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী। আমরা ডাকতাম চামি-মাসি। বিয়ে-থা করেননি, নিজের মায়ের মতোই লম্বা দশাসই চেহারা, নিষ্ঠাবতী দেশকর্মী, ইংরেজ সরকারের অত্যাচারে শেষটা প্রাণও দিয়েছিলেন। এঁদের আরো ভাইবোন ছিলেন, তবে তাঁদের কথা খুব ভালো মনে পড়ে না। এক বেলিমাসি ছাড়া। তাঁর নাম ছিল বেলা হালদার, বেতার ইত্যাদিতে কাজ করেছিলেন, ভারি ফ্যাশানেবল্ ছিলেন, কয়েকটি সুন্দর দেখতে ছেলেমেয়েও ছিল। তাঁর সঙ্গে কখনো কথা বলেছি বলে মনে হয় না।
দ্বারিক গাঙ্গুলীকে আমি চোখে দেখিনি। তবে ছোটবেলা থেকে তাঁর সমাজসেবা আর স্ত্রী-শিক্ষা সম্বন্ধে উৎসাহের ও ভয়ঙ্কর তেজের কথা শুনে এসেছিলাম। তার একটা গল্প না বলে পারছি না। আমার মা-রা তখন খুব ছোট। হয়তো ১৮৯০ কি ঐরকম সময় হবে। স্ত্রী-শিক্ষার জন্য বেথুন সাহেব, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী ইত্যাদি উঠে-পড়ে কাজে লেগেছেন। এমন সময় একটা রক্ষণশীল বাংলা পত্রিকাতে—দুঃখের বিষয় পত্রিকাটার নাম শুনিনি—বিশ্রী ইঙ্গিত করে স্ত্রী-শিক্ষা সম্বন্ধে একটা সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। দ্বারিক গাঙ্গুলী সেটি কেটে পকেটে ভরে, হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে, সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। চমৎকার বলিষ্ঠ শরীর ছিল দ্বারিক গাঙ্গুলীর। তিনি সম্পাদকীয় লেখাটি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “এটি আপনি লিখেছেন?” সম্পাদক রুখে উঠে বললেন, “হ্যাঁ, লিখেছি। তাই কি?”
“তাই এই যে আই হ্যাভ্ কাম্ টু মেক্ ইউ ঈট ইয়োর ওয়ার্ডস! নিন্, জল দিয়ে গিলে খান।” এই বলে কাটিংটাকে গুলি পাকিয়ে সম্পাদকের হাতে দিয়ে, লাঠি বগলে দাঁড়িয়ে রইলেন। যতক্ষণ না সম্পাদক সত্যি সত্যি গুলিটাকে জল দিয়ে গিলে খেলেন।
তখন দ্বারিক গাঙ্গুলী বললেন, “কালকের কাগজে ঐ মন্তব্য প্রত্যাহার করে যদি সম্পাদকীয় না বেরোয়, তাহলে আমি আবার আসব।”
বলা বাহুল্য মন্তব্য প্রত্যাহার করে পরদিনের সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল।
এখন ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এই দুটি পরিবারের মধ্যে এত মধুর সম্বন্ধ কি করে এতকাল ছিল। কাদম্বিনীর ভাইদের দেখেছি গড়পারে যাওয়া আসা করতে; বড়দারা তাঁদের মেজদাদামশাই, ছোড়দাদামশাই, বলতেন। সন্দেশে তাঁরা জন্তু-জানোয়ার, পোকা-মাকড় সম্বন্ধে লিখতেন; আমাদের বেজায় ভালো লাগত। ছোড়দাদামশায়ের নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ। মেজদাদামশাইয়ের নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, হয়তো যোগেন্দ্রনাথ। তাঁর লেখা একটা বইয়ের কথাও মনে হচ্ছে। তার নাম বোধ হয় মাছ ব্যাঙ সাপ, কি ঐ রকম কিছু! উনি বোধহয় বিয়ে-থা করেননি। মারাও গেছিলেন বড়দাদাদের কাছে এসে। সেদিন অনেক রাত অবধি লেখা-পড়া করেছিলেন। তারপর মাঝরাতে ডাক দিলেন, “ওরে তাতা! তাতারে!” বড়দা এবং বাড়িসুদ্ধ প্রায় সকলে উঠে পড়লেন। বড়দা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে মেজদাদামশাই? এই যে আমি আসছি।”
মেজদাদামশাই বললেন, “এসে কি করবি রে? মেজদাদামশাই আর নেই!”
বড়দাদা নিচে এসে দেখেন সত্যি সত্যি প্রাণটা বেরিয়ে গেছে। শুনেছি রক্তচাপ বেশি ছিল, তারি ফলে এমন হয়েছিল। মনে হয় কালকের ঘটনা। সময়ের হিসাব গুলিয়ে যায়।
যাই হোক, মায়ের বিমাতার ভাইদের সঙ্গে এমন স্নেহের সম্বন্ধ সচরাচর দেখা যায় না। এতে নিশ্চয়ই উভয় পক্ষেরই কৃতিত্ব আছে। মনে আছে পরে যখন খেয়াল হল এঁরা আমাদের কেউ নন, ভারি আশ্চর্য লেগেছিল।
এঁদের দেখতে পেতাম শনি-রবিবার যখন বাড়ি আসতাম। সোমবার সকালে বোর্ডিং-এ ফিরে যেতে খুব খারাপ লাগত। এর মধ্যে আমার ১২ বছর পূর্ণ হল। সেদিন সকালে বোর্ডিং-এর লোহার খাটে ঘুম ভাঙতেই শিলং-এ গত বছরের জন্মদিনের কথা মনে পড়ে কান্না পাচ্ছিল। সারা দিন কাটল বছরের অন্য ৩৬৪টা দিনের মতো। জীবনে এই প্রথম এমন হল। শিলং-এ সকাল থেকে মা ভাইবোনেরা মজার মজার কথা বলত, ছোট ছোট উপহার দিত, বিকেলে বন্ধুবান্ধবরা আসত, লুচি আলুরদম মাছের চপ, চাটনি, পায়েস খাওয়া হত। সবাই চলে গেলে এত ক্লান্ত হয়ে পড়তাম যে সন্ধ্যে হতেই লেপের তলায় ঢুকে, এই সুন্দর দিনটার কথা ভেবে মনটা খুশিতে ভরে যেত। ভাবতাম সমস্ত বছরের মধ্যে এই দিনটি একান্ত আমার নিজের দিন। আজ পর্যন্ত সেই মধুর চিন্তার খানিকটা আমার মনে লেগে আছে। সেই একটা জন্মদিন ফাঁকা রয়ে গেল।
তবে ফাঁকা শেষ পর্যন্ত থেকে গেল না। শনিবার যেই গড়পাড়ে পৌঁছলাম, আদরে উপহারে অভিভূত হলাম। সামান্য ছোট ছোট জিনিস। একটা নতুন সূতির কাপড়, একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স-ভরা পুঁতি—তাই দিয়ে কত সুন্দর জিনিস যে তৈরি করেছিলাম তার ঠিক নেই—খুদে একটা জাপানী হ্যাণ্ডব্যাগ। বড়দা কত ঠাট্টা-তামাসা করলেন। বিকেলে পায়েস রান্না হল, বড়মাসিমা এসে সুন্দর একটা মিনে-করা বাক্স দিলেন। নোটন আমার গালে চুমো খেল। সব দুঃখ দূর হয়ে গেল।
তার ওপর সন্ধ্যেবেলায় মাসিমাকে মা বললেন, “দিদি, চক্ৰবেড়ে রোডে তিন মাসের জন্য একটা বাড়ি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উনি এসে পড়বেন, তখন পাকাপাকি একটা জায়গা ঠিক করা যাবে।” দিদি আমি লাফিয়ে উঠলাম। তাহলে আর কতদিন বোর্ডিং-এ থাকতে হবে? শুনলাম ঈস্টারের আগে পর্যন্ত। যেই মনে আশার আলো দেখলাম, অমনি দিনগুলোর যেন পাখা গজাল। বোর্ডিং আর তত খারাপ লাগত না। অনেক বন্ধুবান্ধব হয়েছিল। দেখতে দেখতে ঈস্টার এসে গেল।
ছবির মতো ৫৭ বছর আগেকার চক্ৰবেড়ে রোডের ওপর সেই ছোট্ট বাড়িটার কথা মনে পড়ে। ৪৫ টাকা ভাড়া ছিল। সামনের একটা অংশ, সেখানে যাঁরা থাকতেন তাঁরা আবার ছোট-মেসোমশায়ের আত্মীয়। পিছনের অংশে আমরা উঠলাম। খিড়কি-দোর দিয়ে ঢুকতে হত; দরজার ওপর গোলাপী ফুলের লতা। ভিতরে পরিপটি করে বাঁধানো ছোট্ট উঠোন। তার ধারে ধারে পেয়ারাগাছ, লেবুগাছ, নারকেলগাছ। তিনতলা বাড়ি। নিচে রান্নাঘর, খাবারঘর, বসবারঘর। দোতলায় একটি ঘরে তালা দেওয়া আর দুটি শোবার ঘর, একটি স্নানের ঘর। তিনতলায় একটি ছোট ঘর, সেটি যামিনীদা দখল করল আর একটি একদিক খোলা ঘর, চমৎকার খেলা-ঘর হয়। কিন্তু সেখানে একটু জোরে কথা বললেও যামিনীদা রেগে যেত। সৌভাগ্যের বিষয় বেশির ভাগ সময় যামিনীদা একতলায় ব্যস্ত থাকত।
আমাদের স্কুলের খুব কাছে ছিল ঐ বাড়ি। আমরা হেঁটে স্কুলে যেতাম। দাদা কল্যাণ হেয়ার স্কুলে আগেই ভরতি হয়েছিল, এবার নয় বছরের অমিকেও ভরতি করা হল। গৃহ-হারা পাখির মতো আমরা আবার নিজেদের বাসা পেলাম। সুখী হতে কতটুকুই বা লাগে? একটা নিরাপদ ছাদের তলায় কয়েকটা মানুষ, যারা পরস্পরের সঙ্গে স্নেহের সম্পর্কে বাঁধা। আর চারটি খাওয়া-পরার সংস্থান। কোন জায়গা, কেমন বাড়ি, তার বাগান আছে কি না, রাস্তাটা ভালো কি না, এ-সব হল তুচ্ছ কথা। ঐ বাড়িতে আমরা আসল জিনিসগুলি সব পেলাম। বাবাকে ছাড়া। আমাদের রাগী বাবাকে কাছে না পেয়ে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু বাড়িটাকে বেজায় ভালো লাগত। শিলং-এর গন্ধ মাখা বাসনপত্র; চেনা খেলনা, বই, ছবি, ফুলদানি। বাড়ি আবার কাকে বলে? আরেকটা মজার জিনিস হল, খেলনাগুলোকে আর ভালো লাগত না। খেলনার বয়স পার হয়ে গেছিলাম।
তবে মাত্র দেড় মাস ছিলাম ওখানে। তারই মধ্যে রসা রোডে একটা ফ্ল্যাটের খবর পেয়ে, মা কার সঙ্গে যেন গিয়ে দেখে পছন্দ করে, একেবারে টাকা জমা দিয়ে এলেন। আমাদের ঘরকুনো মা দরকার হলে সব করতে পারতেন। বাবা এসে আসবাব কিনে বাড়ি সাজিয়েছিলেন। ঐ বাড়িতে আমরা ৬ বছর কাটিয়েছিলাম।