উপন্যাস
গল্প

পাইক্র্যাফট প্রহেলিকা

পাইক্র্যাফট প্রহেলিকা ( The Truth About Pyecraft)

[‘The Truth About Pyecraft’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Strand Magazine’ পত্রিকায় এপ্রিল ১৯০৩ সালে। পরে ‘Macmillan and Co.’ থেকে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘Twelve Stories and a Dream’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। পরবর্তী কালে এটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘Alfred Hitchcocks Ghostly Gallery’ সংকলনটিতে স্থান পায়।]

পাইক্র্যাফট বসত আমার কাছ থেকে প্রায় বারো গজ দূরে। কিন্তু ঠায় চেয়ে থাকত আমার দিকে, দুচোখে অসীম মিনতি নিয়ে। নিছক মিনতি বলব না, তার সঙ্গে মিশে থাকত একটু সন্দেহ।

এত সন্দেহ? কোনও কথাই তো কাউকে বলিনি এদ্দিন। বলবার হলে অনেক আগেই বলতাম। বললেই বা কে বিশ্বাস করছে?

বেচারি পাইক্র্যাফ্ট। যেন একটা জেলির পিপে। লন্ডনের সবচাইতে ধুসকো মোটকা মানুষ!

চুল্লির ধারে বসে কেক গিলছে, গিলছেই। আর আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে আমার দিকে। চোখে সেই নীরব মিনতি, কাউকে বলো না, ভায়া!

বলতাম না, যদি-না ওর চোখের কোণে আমার সতোর ওপর সন্দেহের ছায়াপাত দেখা যেত। পাইক্র্যাফট, এই জন্যেই সব কথা বলব সবাইকে। অনেক সাহায্য করেছি তোমাকে, অথচ তোমার জন্যেই আজ আমার ক্লাব-জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে। তাই তোমার সামনেই এই টেবিলে বসে লিখে যাচ্ছি তোমার গুপ্তকথা।

এত খাওয়াই বা কেন? খাওয়ার কি আর শেষ নেই? গিলেই যাচ্ছ কোঁত কোঁত করে।

 যাক গে, এবার অবসান ঘটুক পাইক্র্যাফট প্রহেলিকার!

পাইক্রাটের সঙ্গে প্রথম পরিচয় এই ধূমপানকক্ষেই। একে তো অল্প বয়স, তার ওপর নতুন সদস্য, কাজেই একটু নার্ভাস ছিলাম। পাইক্র্যাফ্ট তা লক্ষ করেই হেলেদুলে ভারী গতরখানা টেনে এনে ধপাস করে বসে পড়েছিল আমার গা ঘেঁষে। হুস-হুঁস কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলার পর ইয়া মোটা একখানা চুরুট বার করে ধরিয়ে নিয়েছিল দেশলাই জ্বেলে। তারপর কথা শুরু হয়েছিল আমার সঙ্গে। কী কথা তা সঠিক মনে নেই। তবে দেশলাইয়ের কাঠিগুলো যে একেবারেই বাজে, এই জাতীয় কিছু বলেই মনে আছে। পাশ দিয়ে যত ওয়েটার গেছে, তাদের প্রত্যেককে ডেকে বলেছে একই কথা, অতি রদ্দিমার্কা দেশলাই। ঘষতে ঘষতে প্রাণ বেরিয়ে যায়।

খ্যানখেনে সরু গলায় অসভ্য দেশলাই-প্রসঙ্গ দিয়েই পাইক্র্যাট গায়ে পড়ে আলাপ জমিয়েছিল আমার সঙ্গে।

হাবিজাবি অনেক বিষয় নিয়ে ভ্যাড়ভ্যাড় করে বকতে বকতে অবশেষে জ্ঞান দিতে আরম্ভ করেছিল খেলাধুলো সম্বন্ধে। আমার চেহারাটা একটু পাতলা, রোগাই বলা চলে; গায়ের রংটাও কালচে, ঠাকুমার মা হিন্দু বলেই হয়তো, কিন্তু সে জন্যে লজ্জা পাই না মোটেই। কিন্তু আমার গায়ের রং দেখে ধমনির হিন্দু রক্ত সম্বন্ধে কেউ ইঙ্গিত করুক, এটাও চাই না মোটেই। তাই যখন পাইক্র্যাফট ফট করে বলে বসল, নিশ্চয় ক্রিকেট খেলি আমি, কেন-না চেহারাটা বেশ পাতলা, গায়ের রংও কালচে, খাইও নিশ্চয় কম, পাইক্র্যাফটের মতোই (সব মোটা মানুষের মতো ওরও বিশ্বাস, স্রেফ না খেয়েই নাকি মোটা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন), ব্যায়ামও করি কম নাকি ওর মতোই–তখন থেকেই মনটা খিঁচড়ে গিয়েছিল পাইক্র্যাফটের ওপর।

তারপর থেকেই শুরু হয়ে গেল নিজের মোটা হওয়া নিয়ে ধানাইপানাই। মোটা হওয়ার ব্যাপারে কী কী করেছে এবং কী কী করতে চায়। পাঁচজনে কী কী উপদেশ দিয়েছে তার মোটা হওয়ার ব্যাপারে এবং মোটা যারা হয়েছে, তারাই বা কী কী করেছে তাদের মোটা হওয়ার ব্যাপারে, পুষ্টিকর খাবারদাবার বন্ধ করলেই ল্যাটা চুকে যায় না, আসলে দরকার খাদ্যনিয়ন্ত্রণ এবং উপযুক্ত ওষুধপত্র। মাথা ধরে গেল যাচ্ছেতাই মোটা মোটা কথাবার্তায়।

ক্লাব-জীবনে এ ধরনের অত্যাচার এক-আধদিন সওয়া যায়। কিন্তু পাইক্র্যাফট অত্যাচার চালিয়ে গেল দিনের পর দিন। ওর জন্যে ধূমপানকক্ষে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু রেহাই পেলাম না। যেখানেই থাকি-না কেন, ঠিক হেলেদুলে ভারী গতরখানা নিয়ে আমার গা ঘেঁষে বসে পড়ত এবং শুরু হয়ে যেত একই বিষয়ের চবির্তচর্বণ। প্রথম থেকেই একটা জিনিস আঁচ করেছিলাম। ওর বিষম বিপদের সুরাহা নাকি আমার মধ্যে দিয়েই হতে পারে –একমাত্র সুযোগ বাড়িয়ে দিতে পারি কেবল আমিই–এইরকম একটা ধারণা ঘুরঘুর করছে ওর মগজে। গায়ে পড়ে তাই এত আলাপ জমানোর চেষ্টা।

শেষ পর্যন্ত তো একদিন বলেই ফেলল, পশ্চিমি ওষুধপত্রের নাকি কোনও ক্ষমতাই নেই চর্বি কমানোর–শরীর হালকা করার। পারে কেবল প্রাচ্যের মানুষরা। আর সামলাতে পারিনি নিজেকে। তেড়েমেড়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার ঠাকুমার মা যে ভারতবর্ষের মেয়ে, এ খবরটা দিয়েছে কে? প্যাটিসন?

হ্যাঁ, মিনমিন করে বলেছিল পাইক্র্যাফট। ঘুরিয়ে বলেছিল অবিশ্যি। জানি কথাটা মিথ্যে। প্যাটিসন পাঁচন খেয়েছিল নিজের ঝুঁকিতে।

বলেছিলাম ঝাঁজের সঙ্গে, আমার ঠাকুমার মা অনেকরকম পাঁচনের ফর্মুলা দিয়ে গেছে। আমাদের ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটা বিপজ্জনক ব্যাপার। আনাড়ির হাতে পড়লে আর রক্ষে নেই। পইপই করে বারণ করে গেছে বাবা

পরখ করে দেখেছিলেন বুঝি? যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না, এমনি সুরে। বলেছিল পাইক্র্যাফট।

একবারই করেছিল–একটা পাঁচনের।

এমন কোনও পাঁচন কি নেই, যা খেলে—

বিদঘুটে পুঁথিগুলোয় যা লেখা আছে, তা পড়েই ভয় ধরে যায়। অদ্ভুত, উদ্ভট সব ব্যাপার ঘটতে পারে। খাওয়া তো দূরের কথা–নাকে গন্ধ পেলেও

কিন্তু পাইক্র্যাফটকে আর কি আটকানো যায়? ভেবেছিলাম, ওইটুকু বলেই ওর উৎসাহ নিবিয়ে দেওয়া যাবে। ঘটল ঠিক তার উলটো। উৎসাহটা গেল বেড়ে। জান কয়লা করে ছাড়ল আমার। প্যাটিসন যে পাঁচনটা গিলেছিল, তার মধ্যে ক্ষতিকর কিছু ছিল না। অন্যান্য পাঁচনের ফর্মুলাতেও দোষের কিছু নেই বলেই জানি। কিন্তু পাইক্র্যাটকে অত কথা বলতে যাব কেন? পাঁচন খাওয়ার মধ্যে ঝুঁকি আছে বললেই ঘ্যানর ঘ্যানর করে এক গানই গেয়ে গেছে–ঝুঁকি নিতে সে রাজি আছে।

মোট কথা, অতিষ্ঠ করে ছাড়ল আমাকে পাইক্র্যাট হারামজাদা। বিদঘুটে পাঁচনগুলোর মধ্যে বিষ-টিশ যদি কিছু থাকে…

ভাবতেই চনমন করে উঠেছিল মনটা। মোটকা পাইক্র্যাটকে বিষ-পাঁচন গিলিয়ে দিলে কেমন হয়?

সেই দিনই রাত্রে অদ্ভুতদর্শন অদ্ভুতগন্ধী চন্দন কাঠের বাক্সটা বার করলাম সিন্দুকের ভেতর থেকে। ভেতরকার খসখসে চামড়াগুলো দেখলাম উলটে-পালটে। যে ভদ্রলোক ফর্মুলা লিখে দিয়েছিলেন ঠাকুমার মা-কে, তাঁর বাতিক ছিল নানা ধরনের পশুচর্ম সংগ্রহের। গোটা গোটা অক্ষরে এইসব চামড়ার ওপরেই ঠেসে লিখে গেছেন অজস্র ফর্মুলা। আমাদের ফ্যামিলির অনেকেই ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যুক্ত থাকায় বংশানুক্রমে কাজ চলার মতো হিন্দুস্তানি ভাষায় দখল আছে প্রত্যেকেরই। তা সত্ত্বেও কয়েকটা ফর্মুলা এক্কেবারে পড়তেই পারলাম না এবং কোনওটাই খুব সহজবোধ্য ঠেকল না। এরই মধ্যে একটায় নাক গলাতে পারলাম কোনওমতে এবং সেইটা নিয়েই বসে পড়লাম সিন্দুকের পাশে।

পরের দিন পাইক্র্যাফ্টকে চামড়াখানা দেখাতেই ছিনিয়ে নেয় আর কী–ঝাঁ করে সরিয়ে নিয়েছিলাম নাগালের বাইরে।

বলেছিলাম, দেখ বাপু, অতিকষ্টে পাঠোদ্ধার করেছি–যদূর বুঝেছি, মনে হয়, এই পাঁচন খেলেই তোমার ওজন কমবে। তুমি তো ওজনটাই কমাতে চাও–তা-ই না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে কী উৎসাহ পাইক্র্যাফটের।

আমি বলেছিলাম, আমার পরামর্শ যদি নাও, তাহলে বলব, এসব ঝুটঝামেলার মধ্যে যেয়ো না। প্রথমত, পাঁচনের ফর্মুলার মানেটা পুরোপুরি বুঝেছি বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, আমার মায়ের দিকের পূর্বপুরুষরা বড়ই সৃষ্টিছাড়া টাইপের মানুষ ছিলেন। বুঝেছ, কী বলতে চাইছি?

চেষ্টা করেই দেখা যাক-না।

বুঝলাম গোঁ ছাড়বার পাত্র নয় মোটকা পাইক্র্যাফ্ট। কী আর করা যায়, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে জানতে চেয়েছিলাম, রোগা হয়ে যাওয়ার পর নিজের চেহারাখানা কীরকম দাঁড়াবে, সে ব্যাপারটা কি ভাবা হয়েছে। কিন্তু পাইক্র্যাফটকে তখন যুক্তি দিয়ে বোঝায় কার সাধ্যি। নিরুপায় হয়ে ছোট্ট চামড়াখানা ওর হাতে গছিয়ে দিয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম, খবরদার, আর যেন নিজের মোটা বপু সম্বন্ধে মোটা মোটা কথা শোনাতে আমাকে না আসে।

শেষকালে বলেছিলাম, পাঁচনটা কিন্তু সুবিধের নয় বলে রাখছি। জঘন্য।

হোক গে, বলে চামড়াখানা উলটে-পালটে দেখেই খাবি খেয়েছিল হিন্দুস্তানি হরফ দেখে! ইংরেজি তো নয়!

শেষ পর্যন্ত তরজমা করে শোনাতে হয়েছিল আমাকেই। তারপর গেছে পনেরোটা দিন। এই পনেরো দিনে যতবার আমার কাছে ঘেঁষতে এসেছে সে, ততবারই দূর থেকে হাত নেড়ে বলেছি আরও দূরে সরে পড়তে। কিন্তু পরে পনেরোটা দিন যাওয়ার পরেও দেখেছি, মোটা রয়েছে আগের মতোই।

পনেরো দিন পর আর দূরে আটকে রাখা যায়নি পাইক্র্যাফটকে। শুরু হয়েছিল নাকিকান্না। নিশ্চয় কোথাও গোলমাল হয়েছে। পাঁচনে কাজ হচ্ছে না কেন?

ফর্মুলাটা চাইতেই পকেট বুক থেকে বার করে দিয়েছিল পাইক্র্যাফট।

উপাদানগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, ডিমটা ফেটিয়ে নিয়েছিলে?

না তো। দরকার ছিল কী?

 সেটা কি বলতে হবে? ঠাকুমার মা ঠিক যেভাবে পাঁচন তৈরি করতে বলেছে, সেইভাবেই করতে হবে। সামান্য হেরফের থেকেই মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। র‍্যাটল সাপের বিষটা টাটকা ছিল তো?

র‍্যাটল সাপের বিষ জোগাড় করেছিলাম জ্যামরাকসের কাছ থেকে। দামটা

 সেটা তোমার ব্যাপার। শেষ উপাদানটা—

ওটার ব্যাপারে একজনের সঙ্গে

 বুঝেছি। এই ফর্মুলায় চলবে না। একই পাঁচনের আরও কয়েকটা ফর্মুলা লেখা রয়েছে দেখছি। তা-ই থেকেই আর-একটা লিখে দিচ্ছি। বানানটা দেখছি জঘন্য–আমার বিদ্যেয় কুলাচ্ছে না। ভালো কথা, কুকুর মানে খুব সম্ভব নেড়িকুত্তা!

এরপর ঝাড়া একটা মাস ধরে দেখেছি একই রকম মোটা শরীর নিয়ে ভীষণ উদবেগে ক্লাবময় চক্কর মারছে পাইক্র্যাফ্ট। চুক্তিভঙ্গ করেনি একবারও। দু-একবার শুধু দূর থেকেই মাথা নেড়েছে হতাশভাবে। একদিন পোশাক-ঘরে আমাকে একলা পেয়েই যেই বলেছে, তোমার ঠাকুমার মা, অমনি এক দাবড়ানি দিয়ে আমি বলেছি, খবরদার, কোনও কথা বলবে না আমার ঠাকুমার মা সম্বন্ধে। বাস, এক্কেবারে ঠান্ডা মেরে গেছে। পাইক্র্যাফট।

ভেবেছিলাম, বুঝি আর ঘাঁটাতে আসবে না আমাকে। একদিন দেখলাম, তিনজন নতুন সদস্যকে জ্বালিয়ে মারছে নিজের মোটা চেহারার কথা শুনিয়ে। নতুন ফর্মুলার সন্ধানে আছে নিশ্চয়। তারপরেই বলা নেই, নেই দুম করে পেলাম তার টেলিগ্রাম।

ঈশ্বরের দোহাই, এখুনি এসো।–পাইক্র্যাফ্ট।

 যাক, ওষুধ তাহলে ধরেছে। পাঁচনে কাজ হয়েছে। ঠাকুমার মায়ের ইজ্জত রক্ষে পেয়েছে। মনের আনন্দে দশ রকমের পদ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খেলাম দুপুরের খাওয়া। কফি খাওয়ার পর চুরুটটা শেষ না করেই রওনা হলাম পাইক্র্যাফটের বাড়ির দিকে। ঠিকানা জোগাড় করেছিলাম ক্লাব থেকে। ও থাকে ব্লমসবুরির একটা বাড়ির ওপরতলায়। সদর দরজায় পাইক্র্যাফট কোথায় আছে জিজ্ঞেস করতেই শুনলাম, নিশ্চয় শরীর খারাপ হয়েছে, দুদিন তার টিকি দেখা যায়নি। ও যে তলায় থাকে, সেই তলার চাতালে পৌঁছাতেই উদবিগ্ন মুখে এগিয়ে এসেছিল এক মহিলা। আমার নাম শুনেই বলেছিল, পাইক্র্যাফ্ট বলেই রেখেছে, আমি পৌঁছালেই যেন ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু…

শেষ কথাটা ভেঙেছিল ভীষণ একটা গুপ্তকথা বলার ভঙ্গিমায় ফিসফিস করে, স্যার, উনি তো ঘরে তালা দিয়ে রেখেছেন ভেতর থেকে।

তালা দিয়ে রেখেছে ভেতর থেকে?

 গতকাল সকাল থেকে ঘর বন্ধ ভেতর থেকে। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। অনবরত গালাগাল দিয়ে যাচ্ছেন যেন কাকে।

ওই দরজাটা তো?

আজ্ঞে, হ্যাঁ।

 ব্যাপারটা কী?

কিসসু বুঝছি না। খালি খাবার চাইছেন। কত খাবারই তো এনে দিলাম, তবুও… ভীষণ কিছু একটা নিশ্চয় ঘটেছে।

দরজার ওদিক থেকে ভেসে এল সরু খ্যানখেনে গলার চিৎকার–ফর্মালিন নাকি?

পাইক্র্যাফট? বলেই দমাদম ঘুসি মেরেছিলাম দরজায়।

তোমার পাশে যে রয়েছে, দূর হতে বল ওকে।

তা-ই বললাম।

তারপরেই শুনলাম দরজার ওপর একটা অদ্ভুত খড়মড় খচমচ আওয়াজ। অন্ধকারে কে যেন দরজার হাতল হাতড়াচ্ছে, ধরতে পারছে না। সেই সঙ্গে পাইক্র্যাফটের গজগজানি– শুয়োরের ঘোঁত ঘোঁত শব্দের সঙ্গে যার আশ্চর্য মিল আছে। বলেছিলাম, খামকা দেরি করছ কেন? আর কেউ নেই এখানে। তবুও খুলল না দরজা। বেশ কিছুক্ষণ গেল এইভাবে। তারপরেই শুনলাম দরজার চাবি ঘোরানোর শব্দ, সেই সঙ্গে পাইক্র্যাফটের কণ্ঠস্বর, এসো ভেতরে।

হাতল ঘুরিয়ে খুললাম দরজা, কিন্তু পাইক্র্যাফ্টকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম না।

না, পাইক্র্যাফট নেই ঘরের মধ্যে।

এরকমভাবে আমার পিলে জীবনে চমকায়নি–সেই মুহূর্তে যেমন চমকে ছিল। ঘরের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। বই আর লেখবার সরঞ্জামের ওপর খাবার প্লেট-ডিশ গড়াগড়ি যাচ্ছে, খানকয়েক চেয়ার উলটে পড়ে রয়েছে, কিন্তু পাইক্র্যাফট গেল কোথায়?

ঠিক আছে হে, ঠিক আছে। দরজাটা আগে বন্ধ কর। পাইক্র্যাফটের ঝাঁজালো কণ্ঠস্বর।

আঁতকেই উঠেছিলাম।

 তারপরেই আবিষ্কার করেছিলাম তাকে, সশরীরে।

ঘরের কোণে কার্নিশের কাছে দরজার ঠিক মাথায় আটকে রয়েছে কড়িকাঠের সঙ্গে কে যেন আঠা দিয়ে তাকে আটকে রেখেছে সেখানে। মুখখানা রাগে আর উদ্‌বেগে থমথম করছে, হাঁপাচ্ছে হুসহাস করে আর হাত-পা ছুড়ছে পাগলের মতো, দরজাটা… দরজাটা বন্ধ কর আহাম্মক কোথাকার! মেয়েছেলেটা যদি ঢুকে পড়ে ভেতরে…

দরজা বন্ধ করে এসে দাঁড়িয়েছিলাম তার নিচে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিলাম কড়িকাঠে আটকানো শূকরপ্রতিম বপুখানার পানে।

বলেছিলাম, পাইক্র্যাফ্ট, এ আবার কী খেলা? পড়ে গেলে যে ঘাড়খানা ভেঙে যাবে।

 ভাঙলে তো বাঁচি, সে কী তেজ গলায়।

এই বয়স আর এই ওজন নিয়ে এ ধরনের ছেলেমানুষি জিমন্যাস্টিক দেখাতে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?

নিকুচি করেছে তোমার ঠাকুমার মায়ের। তার জন্যেই…

 সাবধান!

 কথাটা শোনই-না!

তার আগে বল দিকি, কড়িকাঠে আটকে আছ কীসের আঠায়?

বলে ফেলেই বুঝলাম, আঠা নয়, আঠা নয়–কোনও আঠার জোরেই পাইক্র্যাফট আটকে নেই কড়িকাঠে, গ্যাস ভরতি বেলুনের মতো ফুলে উঠে সেঁটে রয়েছে কার্নিশের কোণে। হাঁচোড়-পাঁচোড় করে দেওয়াল খামচে ধরে নিচের দিকে নামবার চেষ্টা করতে করতে পাইক্র্যাফট বলেছিল, যত নষ্টের মূল ওই প্রেসক্রিপশনটা। তোমার ঠাকুমার মা…

খবরদার! হেঁকে উঠেছিলাম আমি।

দাবড়ানি খেয়ে একটা বাঁধানো ফ্রেম অন্যমনস্কভাবে চেপে ধরেছিল পাইক্র্যাফ্ট, ফ্রেম ভেঙে রয়ে গেল হাতে, ছবি আছড়ে পড়ে খানখান হয়ে গেল মেঝেতে, সাঁ করে ফের শুন্যে উঠে গিয়ে ধাঁই করে কড়িকাঠে ধাক্কা খেয়ে রবারের বলের মতো নেচে নেচে উঠল পাইক্র্যাফট। গতরখানার উঁচু উঁচু জায়গায় সাদা হয়ে রয়েছে কেন, বুঝলাম এতক্ষণে। চুনকাম মেখে কি খোলতাই চেহারাখানিই হয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র নয় এত মেহনত এবং ধকল সত্ত্বেও। হুঁশিয়ার হয়ে একটু একটু করে চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে নেমে এল ম্যান্টল ধরে।

দৃশ্যটা বাস্তবিকই অপূর্ব! অসাধারণ! ওইরকম বিশাল, চর্বি-থসথসে, সন্ন্যাসরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাযুক্ত একখানা গতর যদি মাথা নিচের দিকে করে কড়িকাঠ থেকে মেঝের দিকে দেওয়াল বেয়ে নিম্নগামী হয়, তাহলে কি দৃশ্যটা মনে রাখবার মতো হয় না?

ফর্মালিন, প্রেসক্রিপশনটা দারুণ কাজে লেগেছে।

 কীভাবে পাইক্র্যাফ্ট?

 ওজন হারিয়েছি–এক্কেবারে।

এতক্ষণে বুঝলাম ব্যাপারটা।

 কী সর্বনাশ! পাইক্র্যাফ্ট, তোমার মনের ইচ্ছেটা ছিল চর্বি কমানোর, মুখে কিন্তু আগাগোড়া বলে গেছ, ওজন কমাতে চাও।

কেন জানি না, দারুণ খুশিতে ডগমগ হয়েছিলাম পাইক্র্যাফটের এহেন পরিস্থিতিতে। সেই মুহূর্তে বড় ভালো লেগেছিল ওকে। হাত বাড়িয়ে ধরে টেনেহিঁচড়ে নামিয়েও এনেছিলাম। পা দুখানা ছুঁড়ে পা রাখবার জায়গা পেতে গলদঘর্ম হয়ে গিয়েছিল বেচারি। আমার কিন্তু মনে হয়েছিল, ঠিক যেন ঝোড়ো বাতাসে নিশান উড়ছে পতপত করে। আঙুল দিয়ে মেহগনি কাঠের ভারী টেবিলটা দেখিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল অপরূপ নাটকের নায়ক, ওর তলায়… ওর তলায় ঢুকিয়ে দাও–আটকে রেখে দেবে—

তা-ই দিয়েছিলাম। বন্দি বেলুনের মতোই সাঁই করে টেবিলের তলায় আটকে গিয়েছিল ফুলো গতরখানা। মেঝের কার্পেটে পরম আয়েশে বসে জেরা চালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। আগে অবশ্য একটা চুরুট ধরিয়ে নিয়েছিলাম মৌজ করে।

তারপর জিজ্ঞেস করেছিলাম খুশি খুশি গলায়–এবার বল, কীভাবে এ হাল হল তোমার।

পাঁচনটা খাওয়ার পরেই।

 খেতে কীরকম?

 জঘন্য!

জঘন্য তো বটেই। সব কটা পাঁচনের স্বাদই তাই। গুণাগুণ যা-ই থাক-না কেন, ঠাকুমার মায়ের কোনও পাঁচনই আমার কাছে রুচিকর নয়।

প্রথমে এক চুমক খেয়েছিলাম, খুব সামান্য।

 তারপর?

 বেশ হালকা হালকা লাগছিল নিজেকে। ঘণ্টাখানেক বাদে বেশ তাজা তাজা। তাই ঠিক করলাম, এক ঢোকেই মেরে দেব সবটা।

বল কী?

নাক টিপে গিলেছিলাম অবশ্য। তারপর থেকেই হালকা হতে হতে এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এই পর্যন্ত মিনমিন করে বলে হঠাৎ ঝাঁ করে তেড়ে উঠল আমার ওপর, ফর্মালিন, কী করি এখন বল তো?

একটা কাজ কখনওই করবে না। বাইরে বেরবে না। বেরলেই শূন্যে উড়ে যাবে, হস্তসঞ্চালনে দেখিয়েছিলাম উড়ে যাওয়ার দৃশ্য।

পাঁচনের কাজ নিশ্চয় মিলিয়ে যাবে আস্তে আস্তে?

 সে গুড়ে বালি, খুব জোরে মাথা নেড়ে নাকচ করে দিয়েছিলাম সম্ভাবনাটা। তৎক্ষণাৎ এক পশলা ঝাঁজালো তেজালো রসালো গালাগাল বৃষ্টি হয়ে গেল আমার ওপর। আমার চোদ্দোপুরুষের পিণ্ডি চটকানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে আদ্যশ্রাদ্ধ করা হল আমার ঠাকুমার মা বেচারির। এমতাবস্থায় ওর মতো মোটকা হোঁতকা অশিষ্ট মানুষের পক্ষে এবংবিধ আচরণ খুবই স্বাভাবিক। তাই আমি গায়ে মাখলাম না। শুধু বললাম, আমি তো তোমায় সাধিনি, তুমি নিজেই

বলে, উঠে বসলাম ওই হাতলওয়ালা চেয়ারে। বিপদে যে বন্ধু পাশে দাঁড়ায়, সে-ই প্রকৃত বন্ধু। উপদেশ-টুপদেশ দিলাম কিছুক্ষণ। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম, এ অবস্থার জন্যে দায়ী পাইক্র্যাফ্ট নিজেই। অতখানি পাঁচন ঢক করে গিলে ফেলা উচিত হয়নি। কোঁত কোঁত করে গেলার স্বভাব ওর চিরকালই। এই বিষয়টা নিয়ে ঘোর মতান্তর ঘটল দুজনের মধ্যে।

গাঁক গাঁক চিৎকার শুনে আর মারদাঙ্গা মূর্তি দেখে ঠিক করলাম, শিক্ষাদানের এ প্রসঙ্গটা মুলতুবি থাক আপাতত। যুক্তি দিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিলাম, মহাপাপ সে করেছে শ্রুতিকটু পদের পরিবর্তে কোমলতর পদের প্রয়োগ করে। বলা উচিত ছিল চর্বি, কিন্তু শুনতে খারাপ লাগে বলে বলেছিল ওজন। কাজটা অত্যন্ত গর্হিত। ফল পেয়েছে হাতে হাতে

প্রসঙ্গটা অসমাপ্ত রাখতে বাধ্য হলাম পাইক্র্যাফটের প্রবল বাধাদানে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব দোষই সে মানছে। মহাপাপ সে করেছে, অস্বীকার তো করছে না। কিন্তু এখন করণীয়টা কী?

নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখছি না, বুঝিয়ে বলেছিলাম আমি। সমস্যা সমাধানের সত্যিকারের আলোচনাটা শুরু হয়েছিল তখনই, এবং বেশ মনে রাখবার মতো আলোচনা। বলেছিলাম, চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে কড়িকাঠে হাঁটাটা এমন কিছু অসুবিধাজনক হবে না কিছুদিনের চেষ্টার পর

ঘুমাতে তো পারছি না, গোঙিয়ে উঠেছিল পাইক্র্যাট।

সেটা কি একটা বিরাট সমস্যা? ধীরেসুস্থে সে সমস্যারও সমাধান করে দিয়েছিলাম আমি। কড়িকাঠে একটা তারের জাল লাগিয়ে নিলেই হল। বিছানার লেপ-তোশক ফিতে দিয়ে লাগানো থাকবে কড়িকাঠের জালে। কম্বল, চাদর বোতাম দিয়ে লাগানো থাকবে পাশে পাশে। ঘরকন্না দেখার ভার রয়েছে যে মেয়েছেলেটার ওপর, তাকেই শুধু সব কথা খুলে বলতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ গজর গজর করার পর রাজি না হয়ে পারেনি। পাইক্র্যাফট। যথাসময়ে জিনিসপত্র এসে পৌঁছেছিল ঘরের মধ্যে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই। উলটো বিছানাপত্র নিয়ে তিলমাত্র উলটো-পালটা কৌতূহল না-দেখানোটা বিলক্ষণ উপভোগ্য হয়েছিল কিন্তু অন্তত আমার কাছে। লাইব্রেরি থেকে মইটা এনে রাখা যাবেখন বসবার এই ঘরে। খাবারদাবার সমস্ত রাখা হবে বুকশেলফের ওপরে। হাত বাড়িয়ে খেয়ে নিলেই হল। খুশিমতো মেঝেতে নেমে আসার মৌলিক পদ্ধতিটাও বাতলে দিয়েছিলাম কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর। খুবই সোজা কায়দা, খোলা বুকশেলফে ব্রিটিশ এনসাইক্লোপিডিয়ার দশম সংস্করণটা রেখে দিলেই হল। হাত বাড়িয়ে খান দুয়েক খণ্ড টেনে নিলেই আস্তে আস্তে নেমে আসবে নিচে। আরও অভিনব একটা ব্যাপারে মতৈক্য ঘটল দুজনের মধ্যে। ঘরের ধার বরাবর অনেকগুলো লোহার আঁকশি লাগানো থাকবে। আঁকশি আঁকড়ে ধরে ঘরের নিচের দিক দিয়ে যত্রতত্র গমন করা যাবে। বুদ্ধিটা মন্দ বলা যায় কি?

এই ধরনের বুদ্ধির পর বুদ্ধি গজিয়ে যাচ্ছিল মাথার মধ্যে ফটাফট করে। বেশ চনমনে বোধ করছিলাম বিপদগ্রস্ত বন্ধুকে সাহায্য করার সুযোগ পেয়ে। উদ্যোগী হয়ে আমিই ঘরকন্না দেখার মেয়েছেলেটাকে ডেকে এনেছিলাম, পাইক্র্যাফটের গুপ্ত রহস্য ফাঁস করেছিলাম, এবং মূলত আমিই ওলটানো বিছানা কড়িকাঠে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, পুরো দুটো দিন কাটিয়েছিলাম ওর ফ্ল্যাটে। স্ক্রু-ড্রাইভার বাগিয়ে অনেক অভিনবআয়োজন সমাপন করেছিলাম আমিই। তার টেনে ঘণ্টা রেখেছিলাম ওর হাতের কাছে, সব কটা ইলেকট্রিক লাইট লাগিয়েছিলাম উলটো করে। এই ধরনের বহুবিধ বিচিত্র ব্যবস্থা সবই করেছিলাম নিজের হাতে এবং পরমোৎসাহে। সব মিলিয়ে দৃশ্যটা এতই সুখপ্রদ হয়ে উঠেছিল যে, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কড়িকাঠ থেকে দরজার পাশ দিয়ে বিশালকায়। টিকটিকির মতো নেমে আসছে ধুসকো পাইক্র্যাফট, আঁকশি ধরে ধরে যাচ্ছে এক ঘর থেকে আর-এক ঘরে… কিন্তু ছায়া মাড়াতে পারছে না ক্লাবের… জীবনে আর পারবেও না! অহো! অহো!

তারপরেই কুড়ল মেরে বসলাম নিজেরই পায়ে। দায়ী এই উর্বর মগজটা। ভুরভুর করে গজিয়ে যাচ্ছিল বুদ্ধির পর বুদ্ধি–শেষকালে সুড়ত করে এসে গেল এমন একটা বুদ্ধি, যে সর্বনাশ হয়ে গেল আমার নিজেরই।

বসেছিলাম বসবার ঘরে। আগুনের ধারে ওরই চেয়ারে বসে ওরই হুইস্কি পান করছিলাম মৌজ করে। পাইক্র্যাফট লেপটে ছিল ওর অতিপ্রিয় কার্নিশের কোণে হাতে হাতুড়ি নিয়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে তুরস্ক দেশের একটা কার্পেট বসাচ্ছিল কড়িকাঠে। বুদ্ধিটা মাথার মধ্যে ঝলসে উঠল ঠিক সেই মুহূর্তেই। চিৎকার করে উঠেছিলাম সঙ্গে সঙ্গে পাইক্র্যাফট! এত ঝামেলার তো কোনও দরকারই দেখছি না।

আইডিয়াটার পুরো প্রতিক্রিয়া ধারণা করে নেওয়ার আগেই গাঁক গাঁক করে তা ব্যক্ত করে ফেলেছিলাম স্বমুখে–সিসের অন্তর্বাস! বাস, ক্ষতি যা হবার হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।

পাইক্র্যাফটের চোখে জল এসে গিয়েছিল শুধু ওই দুটি শব্দ শুনেই–তাহলে বলছ, আবার মাথা তুলে দাঁড়ানো যাবে

চমকপ্রদ আইডিয়াটা গরগর করে বলে গিয়েছিলাম নিজের ক্ষতি কতখানি হতে পারে তা না ভেবেই–সিসের চাদর কেননা পাইক্র্যাফট। চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে সেলাই করে নাও গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, পায়জামায়। পায়ে পর সিসের সুকতলা দেওয়া বুটজুতো। হাতে নাও নিরেট সিসে ভরতি থলি। বাস, আর কী চাই! বন্দিদশা ঘুচবে, আবার টো টো করে যেখানে খুশি টহল দিতে পারবে

বলতে বলতে আরও প্রীতিপদ একটা আইডিয়া ফুরুক করে ঠেলে উঠেছিল মগজের বুদ্ধিকোষ থেকে, জাহাজডুবি হলেও আর তোমাকে মরার ভয় করতে হবে না, পাইক্র্যাফট। কিছু বোঝা বা জামাকাপড় ফেলে দিলেই হল–দরকারমতো মালপত্র হাতে নিয়ে হু-উ-উ-স করে ভেসে উঠবে ডোবা জাহাজ থেকে জলের ওপর–ঠিকরে যাবে শূন্যে! বিষম উত্তেজনায় হাতুড়িটা খসে পড়েছিল পাইক্র্যাফটের হাত থেকে–আমার মাথা ঘেঁষে।

ফর্মালিন! আবার তো তাহলে ক্লাবে যাওয়া যাবে।

শুনেই তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! উৎসাহ নিবে গেল দপ করে। খাবি খেতে খেতে সায় দিয়েছিলাম এইভাবে, তা-ও তো বটে! তা-ও তো বটে!

হ্যাঁ, ক্লাবে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে পাইক্র্যাফ্ট। ওই তো ওই টেবিলে বসে কোঁত কোঁত করে গিলে যাচ্ছে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়। জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমার পানে। চোখে সেই নীরব মিনতি–বলো না ভায়া, বলো না কাউকে। কড়িকাঠে হেঁটেছি কেউ যদি শুনে ফেলে, ঢি ঢি পড়ে যাবে যে।

পড়ুক। ওর ওই গেলা দেখে ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারছে না যে তিলমাত্র ওজন নেই অত বড় গতরখানার–হালকা… হালকা… বাতাসের মতোই হালকা চর্বির ওই বিশাল পাহাড়টার। তাই জানুক সকলে, কী কুক্ষণেই শেষ বুদ্ধিটা বাতলে ফেলেছিলাম আমি। লেখা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নতুন একখানা প্লেট নিয়ে চোখ নামিয়ে গোগ্রাসে গিলছে পাইক্র্যাফট, এই ফাঁকে পাশের দরজাটা পেরিয়ে যাওয়া যাবে না?

পাইক্র্যাফট প্রহেলিকা

পাইক্র্যাফট প্রহেলিকা

পাইক্র্যাফট প্রহেলিকা ( The Truth About Pyecraft)

[‘The Truth About Pyecraft’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Strand Magazine’ পত্রিকায় এপ্রিল ১৯০৩ সালে। পরে ‘Macmillan and Co.’ থেকে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘Twelve Stories and a Dream’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। পরবর্তী কালে এটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘Alfred Hitchcocks Ghostly Gallery’ সংকলনটিতে স্থান পায়।]

পাইক্র্যাফট বসত আমার কাছ থেকে প্রায় বারো গজ দূরে। কিন্তু ঠায় চেয়ে থাকত আমার দিকে, দুচোখে অসীম মিনতি নিয়ে। নিছক মিনতি বলব না, তার সঙ্গে মিশে থাকত একটু সন্দেহ।

এত সন্দেহ? কোনও কথাই তো কাউকে বলিনি এদ্দিন। বলবার হলে অনেক আগেই বলতাম। বললেই বা কে বিশ্বাস করছে?

বেচারি পাইক্র্যাফ্ট। যেন একটা জেলির পিপে। লন্ডনের সবচাইতে ধুসকো মোটকা মানুষ!

চুল্লির ধারে বসে কেক গিলছে, গিলছেই। আর আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে আমার দিকে। চোখে সেই নীরব মিনতি, কাউকে বলো না, ভায়া!

বলতাম না, যদি-না ওর চোখের কোণে আমার সতোর ওপর সন্দেহের ছায়াপাত দেখা যেত। পাইক্র্যাফট, এই জন্যেই সব কথা বলব সবাইকে। অনেক সাহায্য করেছি তোমাকে, অথচ তোমার জন্যেই আজ আমার ক্লাব-জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে। তাই তোমার সামনেই এই টেবিলে বসে লিখে যাচ্ছি তোমার গুপ্তকথা।

এত খাওয়াই বা কেন? খাওয়ার কি আর শেষ নেই? গিলেই যাচ্ছ কোঁত কোঁত করে।

 যাক গে, এবার অবসান ঘটুক পাইক্র্যাফট প্রহেলিকার!

পাইক্রাটের সঙ্গে প্রথম পরিচয় এই ধূমপানকক্ষেই। একে তো অল্প বয়স, তার ওপর নতুন সদস্য, কাজেই একটু নার্ভাস ছিলাম। পাইক্র্যাফ্ট তা লক্ষ করেই হেলেদুলে ভারী গতরখানা টেনে এনে ধপাস করে বসে পড়েছিল আমার গা ঘেঁষে। হুস-হুঁস কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলার পর ইয়া মোটা একখানা চুরুট বার করে ধরিয়ে নিয়েছিল দেশলাই জ্বেলে। তারপর কথা শুরু হয়েছিল আমার সঙ্গে। কী কথা তা সঠিক মনে নেই। তবে দেশলাইয়ের কাঠিগুলো যে একেবারেই বাজে, এই জাতীয় কিছু বলেই মনে আছে। পাশ দিয়ে যত ওয়েটার গেছে, তাদের প্রত্যেককে ডেকে বলেছে একই কথা, অতি রদ্দিমার্কা দেশলাই। ঘষতে ঘষতে প্রাণ বেরিয়ে যায়।

খ্যানখেনে সরু গলায় অসভ্য দেশলাই-প্রসঙ্গ দিয়েই পাইক্র্যাট গায়ে পড়ে আলাপ জমিয়েছিল আমার সঙ্গে।

হাবিজাবি অনেক বিষয় নিয়ে ভ্যাড়ভ্যাড় করে বকতে বকতে অবশেষে জ্ঞান দিতে আরম্ভ করেছিল খেলাধুলো সম্বন্ধে। আমার চেহারাটা একটু পাতলা, রোগাই বলা চলে; গায়ের রংটাও কালচে, ঠাকুমার মা হিন্দু বলেই হয়তো, কিন্তু সে জন্যে লজ্জা পাই না মোটেই। কিন্তু আমার গায়ের রং দেখে ধমনির হিন্দু রক্ত সম্বন্ধে কেউ ইঙ্গিত করুক, এটাও চাই না মোটেই। তাই যখন পাইক্র্যাফট ফট করে বলে বসল, নিশ্চয় ক্রিকেট খেলি আমি, কেন-না চেহারাটা বেশ পাতলা, গায়ের রংও কালচে, খাইও নিশ্চয় কম, পাইক্র্যাফটের মতোই (সব মোটা মানুষের মতো ওরও বিশ্বাস, স্রেফ না খেয়েই নাকি মোটা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন), ব্যায়ামও করি কম নাকি ওর মতোই–তখন থেকেই মনটা খিঁচড়ে গিয়েছিল পাইক্র্যাফটের ওপর।

তারপর থেকেই শুরু হয়ে গেল নিজের মোটা হওয়া নিয়ে ধানাইপানাই। মোটা হওয়ার ব্যাপারে কী কী করেছে এবং কী কী করতে চায়। পাঁচজনে কী কী উপদেশ দিয়েছে তার মোটা হওয়ার ব্যাপারে এবং মোটা যারা হয়েছে, তারাই বা কী কী করেছে তাদের মোটা হওয়ার ব্যাপারে, পুষ্টিকর খাবারদাবার বন্ধ করলেই ল্যাটা চুকে যায় না, আসলে দরকার খাদ্যনিয়ন্ত্রণ এবং উপযুক্ত ওষুধপত্র। মাথা ধরে গেল যাচ্ছেতাই মোটা মোটা কথাবার্তায়।

ক্লাব-জীবনে এ ধরনের অত্যাচার এক-আধদিন সওয়া যায়। কিন্তু পাইক্র্যাফট অত্যাচার চালিয়ে গেল দিনের পর দিন। ওর জন্যে ধূমপানকক্ষে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু রেহাই পেলাম না। যেখানেই থাকি-না কেন, ঠিক হেলেদুলে ভারী গতরখানা নিয়ে আমার গা ঘেঁষে বসে পড়ত এবং শুরু হয়ে যেত একই বিষয়ের চবির্তচর্বণ। প্রথম থেকেই একটা জিনিস আঁচ করেছিলাম। ওর বিষম বিপদের সুরাহা নাকি আমার মধ্যে দিয়েই হতে পারে –একমাত্র সুযোগ বাড়িয়ে দিতে পারি কেবল আমিই–এইরকম একটা ধারণা ঘুরঘুর করছে ওর মগজে। গায়ে পড়ে তাই এত আলাপ জমানোর চেষ্টা।

শেষ পর্যন্ত তো একদিন বলেই ফেলল, পশ্চিমি ওষুধপত্রের নাকি কোনও ক্ষমতাই নেই চর্বি কমানোর–শরীর হালকা করার। পারে কেবল প্রাচ্যের মানুষরা। আর সামলাতে পারিনি নিজেকে। তেড়েমেড়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার ঠাকুমার মা যে ভারতবর্ষের মেয়ে, এ খবরটা দিয়েছে কে? প্যাটিসন?

হ্যাঁ, মিনমিন করে বলেছিল পাইক্র্যাফট। ঘুরিয়ে বলেছিল অবিশ্যি। জানি কথাটা মিথ্যে। প্যাটিসন পাঁচন খেয়েছিল নিজের ঝুঁকিতে।

বলেছিলাম ঝাঁজের সঙ্গে, আমার ঠাকুমার মা অনেকরকম পাঁচনের ফর্মুলা দিয়ে গেছে। আমাদের ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটা বিপজ্জনক ব্যাপার। আনাড়ির হাতে পড়লে আর রক্ষে নেই। পইপই করে বারণ করে গেছে বাবা

পরখ করে দেখেছিলেন বুঝি? যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না, এমনি সুরে। বলেছিল পাইক্র্যাফট।

একবারই করেছিল–একটা পাঁচনের।

এমন কোনও পাঁচন কি নেই, যা খেলে—

বিদঘুটে পুঁথিগুলোয় যা লেখা আছে, তা পড়েই ভয় ধরে যায়। অদ্ভুত, উদ্ভট সব ব্যাপার ঘটতে পারে। খাওয়া তো দূরের কথা–নাকে গন্ধ পেলেও

কিন্তু পাইক্র্যাফটকে আর কি আটকানো যায়? ভেবেছিলাম, ওইটুকু বলেই ওর উৎসাহ নিবিয়ে দেওয়া যাবে। ঘটল ঠিক তার উলটো। উৎসাহটা গেল বেড়ে। জান কয়লা করে ছাড়ল আমার। প্যাটিসন যে পাঁচনটা গিলেছিল, তার মধ্যে ক্ষতিকর কিছু ছিল না। অন্যান্য পাঁচনের ফর্মুলাতেও দোষের কিছু নেই বলেই জানি। কিন্তু পাইক্র্যাটকে অত কথা বলতে যাব কেন? পাঁচন খাওয়ার মধ্যে ঝুঁকি আছে বললেই ঘ্যানর ঘ্যানর করে এক গানই গেয়ে গেছে–ঝুঁকি নিতে সে রাজি আছে।

মোট কথা, অতিষ্ঠ করে ছাড়ল আমাকে পাইক্র্যাট হারামজাদা। বিদঘুটে পাঁচনগুলোর মধ্যে বিষ-টিশ যদি কিছু থাকে…

ভাবতেই চনমন করে উঠেছিল মনটা। মোটকা পাইক্র্যাটকে বিষ-পাঁচন গিলিয়ে দিলে কেমন হয়?

সেই দিনই রাত্রে অদ্ভুতদর্শন অদ্ভুতগন্ধী চন্দন কাঠের বাক্সটা বার করলাম সিন্দুকের ভেতর থেকে। ভেতরকার খসখসে চামড়াগুলো দেখলাম উলটে-পালটে। যে ভদ্রলোক ফর্মুলা লিখে দিয়েছিলেন ঠাকুমার মা-কে, তাঁর বাতিক ছিল নানা ধরনের পশুচর্ম সংগ্রহের। গোটা গোটা অক্ষরে এইসব চামড়ার ওপরেই ঠেসে লিখে গেছেন অজস্র ফর্মুলা। আমাদের ফ্যামিলির অনেকেই ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যুক্ত থাকায় বংশানুক্রমে কাজ চলার মতো হিন্দুস্তানি ভাষায় দখল আছে প্রত্যেকেরই। তা সত্ত্বেও কয়েকটা ফর্মুলা এক্কেবারে পড়তেই পারলাম না এবং কোনওটাই খুব সহজবোধ্য ঠেকল না। এরই মধ্যে একটায় নাক গলাতে পারলাম কোনওমতে এবং সেইটা নিয়েই বসে পড়লাম সিন্দুকের পাশে।

পরের দিন পাইক্র্যাফ্টকে চামড়াখানা দেখাতেই ছিনিয়ে নেয় আর কী–ঝাঁ করে সরিয়ে নিয়েছিলাম নাগালের বাইরে।

বলেছিলাম, দেখ বাপু, অতিকষ্টে পাঠোদ্ধার করেছি–যদূর বুঝেছি, মনে হয়, এই পাঁচন খেলেই তোমার ওজন কমবে। তুমি তো ওজনটাই কমাতে চাও–তা-ই না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে কী উৎসাহ পাইক্র্যাফটের।

আমি বলেছিলাম, আমার পরামর্শ যদি নাও, তাহলে বলব, এসব ঝুটঝামেলার মধ্যে যেয়ো না। প্রথমত, পাঁচনের ফর্মুলার মানেটা পুরোপুরি বুঝেছি বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, আমার মায়ের দিকের পূর্বপুরুষরা বড়ই সৃষ্টিছাড়া টাইপের মানুষ ছিলেন। বুঝেছ, কী বলতে চাইছি?

চেষ্টা করেই দেখা যাক-না।

বুঝলাম গোঁ ছাড়বার পাত্র নয় মোটকা পাইক্র্যাফ্ট। কী আর করা যায়, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে জানতে চেয়েছিলাম, রোগা হয়ে যাওয়ার পর নিজের চেহারাখানা কীরকম দাঁড়াবে, সে ব্যাপারটা কি ভাবা হয়েছে। কিন্তু পাইক্র্যাফটকে তখন যুক্তি দিয়ে বোঝায় কার সাধ্যি। নিরুপায় হয়ে ছোট্ট চামড়াখানা ওর হাতে গছিয়ে দিয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম, খবরদার, আর যেন নিজের মোটা বপু সম্বন্ধে মোটা মোটা কথা শোনাতে আমাকে না আসে।

শেষকালে বলেছিলাম, পাঁচনটা কিন্তু সুবিধের নয় বলে রাখছি। জঘন্য।

হোক গে, বলে চামড়াখানা উলটে-পালটে দেখেই খাবি খেয়েছিল হিন্দুস্তানি হরফ দেখে! ইংরেজি তো নয়!

শেষ পর্যন্ত তরজমা করে শোনাতে হয়েছিল আমাকেই। তারপর গেছে পনেরোটা দিন। এই পনেরো দিনে যতবার আমার কাছে ঘেঁষতে এসেছে সে, ততবারই দূর থেকে হাত নেড়ে বলেছি আরও দূরে সরে পড়তে। কিন্তু পরে পনেরোটা দিন যাওয়ার পরেও দেখেছি, মোটা রয়েছে আগের মতোই।

পনেরো দিন পর আর দূরে আটকে রাখা যায়নি পাইক্র্যাফটকে। শুরু হয়েছিল নাকিকান্না। নিশ্চয় কোথাও গোলমাল হয়েছে। পাঁচনে কাজ হচ্ছে না কেন?

ফর্মুলাটা চাইতেই পকেট বুক থেকে বার করে দিয়েছিল পাইক্র্যাফট।

উপাদানগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, ডিমটা ফেটিয়ে নিয়েছিলে?

না তো। দরকার ছিল কী?

 সেটা কি বলতে হবে? ঠাকুমার মা ঠিক যেভাবে পাঁচন তৈরি করতে বলেছে, সেইভাবেই করতে হবে। সামান্য হেরফের থেকেই মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। র‍্যাটল সাপের বিষটা টাটকা ছিল তো?

র‍্যাটল সাপের বিষ জোগাড় করেছিলাম জ্যামরাকসের কাছ থেকে। দামটা

 সেটা তোমার ব্যাপার। শেষ উপাদানটা—

ওটার ব্যাপারে একজনের সঙ্গে

 বুঝেছি। এই ফর্মুলায় চলবে না। একই পাঁচনের আরও কয়েকটা ফর্মুলা লেখা রয়েছে দেখছি। তা-ই থেকেই আর-একটা লিখে দিচ্ছি। বানানটা দেখছি জঘন্য–আমার বিদ্যেয় কুলাচ্ছে না। ভালো কথা, কুকুর মানে খুব সম্ভব নেড়িকুত্তা!

এরপর ঝাড়া একটা মাস ধরে দেখেছি একই রকম মোটা শরীর নিয়ে ভীষণ উদবেগে ক্লাবময় চক্কর মারছে পাইক্র্যাফ্ট। চুক্তিভঙ্গ করেনি একবারও। দু-একবার শুধু দূর থেকেই মাথা নেড়েছে হতাশভাবে। একদিন পোশাক-ঘরে আমাকে একলা পেয়েই যেই বলেছে, তোমার ঠাকুমার মা, অমনি এক দাবড়ানি দিয়ে আমি বলেছি, খবরদার, কোনও কথা বলবে না আমার ঠাকুমার মা সম্বন্ধে। বাস, এক্কেবারে ঠান্ডা মেরে গেছে। পাইক্র্যাফট।

ভেবেছিলাম, বুঝি আর ঘাঁটাতে আসবে না আমাকে। একদিন দেখলাম, তিনজন নতুন সদস্যকে জ্বালিয়ে মারছে নিজের মোটা চেহারার কথা শুনিয়ে। নতুন ফর্মুলার সন্ধানে আছে নিশ্চয়। তারপরেই বলা নেই, নেই দুম করে পেলাম তার টেলিগ্রাম।

ঈশ্বরের দোহাই, এখুনি এসো।–পাইক্র্যাফ্ট।

 যাক, ওষুধ তাহলে ধরেছে। পাঁচনে কাজ হয়েছে। ঠাকুমার মায়ের ইজ্জত রক্ষে পেয়েছে। মনের আনন্দে দশ রকমের পদ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খেলাম দুপুরের খাওয়া। কফি খাওয়ার পর চুরুটটা শেষ না করেই রওনা হলাম পাইক্র্যাফটের বাড়ির দিকে। ঠিকানা জোগাড় করেছিলাম ক্লাব থেকে। ও থাকে ব্লমসবুরির একটা বাড়ির ওপরতলায়। সদর দরজায় পাইক্র্যাফট কোথায় আছে জিজ্ঞেস করতেই শুনলাম, নিশ্চয় শরীর খারাপ হয়েছে, দুদিন তার টিকি দেখা যায়নি। ও যে তলায় থাকে, সেই তলার চাতালে পৌঁছাতেই উদবিগ্ন মুখে এগিয়ে এসেছিল এক মহিলা। আমার নাম শুনেই বলেছিল, পাইক্র্যাফ্ট বলেই রেখেছে, আমি পৌঁছালেই যেন ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু…

শেষ কথাটা ভেঙেছিল ভীষণ একটা গুপ্তকথা বলার ভঙ্গিমায় ফিসফিস করে, স্যার, উনি তো ঘরে তালা দিয়ে রেখেছেন ভেতর থেকে।

তালা দিয়ে রেখেছে ভেতর থেকে?

 গতকাল সকাল থেকে ঘর বন্ধ ভেতর থেকে। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। অনবরত গালাগাল দিয়ে যাচ্ছেন যেন কাকে।

ওই দরজাটা তো?

আজ্ঞে, হ্যাঁ।

 ব্যাপারটা কী?

কিসসু বুঝছি না। খালি খাবার চাইছেন। কত খাবারই তো এনে দিলাম, তবুও… ভীষণ কিছু একটা নিশ্চয় ঘটেছে।

দরজার ওদিক থেকে ভেসে এল সরু খ্যানখেনে গলার চিৎকার–ফর্মালিন নাকি?

পাইক্র্যাফট? বলেই দমাদম ঘুসি মেরেছিলাম দরজায়।

তোমার পাশে যে রয়েছে, দূর হতে বল ওকে।

তা-ই বললাম।

তারপরেই শুনলাম দরজার ওপর একটা অদ্ভুত খড়মড় খচমচ আওয়াজ। অন্ধকারে কে যেন দরজার হাতল হাতড়াচ্ছে, ধরতে পারছে না। সেই সঙ্গে পাইক্র্যাফটের গজগজানি– শুয়োরের ঘোঁত ঘোঁত শব্দের সঙ্গে যার আশ্চর্য মিল আছে। বলেছিলাম, খামকা দেরি করছ কেন? আর কেউ নেই এখানে। তবুও খুলল না দরজা। বেশ কিছুক্ষণ গেল এইভাবে। তারপরেই শুনলাম দরজার চাবি ঘোরানোর শব্দ, সেই সঙ্গে পাইক্র্যাফটের কণ্ঠস্বর, এসো ভেতরে।

হাতল ঘুরিয়ে খুললাম দরজা, কিন্তু পাইক্র্যাফ্টকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম না।

না, পাইক্র্যাফট নেই ঘরের মধ্যে।

এরকমভাবে আমার পিলে জীবনে চমকায়নি–সেই মুহূর্তে যেমন চমকে ছিল। ঘরের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। বই আর লেখবার সরঞ্জামের ওপর খাবার প্লেট-ডিশ গড়াগড়ি যাচ্ছে, খানকয়েক চেয়ার উলটে পড়ে রয়েছে, কিন্তু পাইক্র্যাফট গেল কোথায়?

ঠিক আছে হে, ঠিক আছে। দরজাটা আগে বন্ধ কর। পাইক্র্যাফটের ঝাঁজালো কণ্ঠস্বর।

আঁতকেই উঠেছিলাম।

 তারপরেই আবিষ্কার করেছিলাম তাকে, সশরীরে।

ঘরের কোণে কার্নিশের কাছে দরজার ঠিক মাথায় আটকে রয়েছে কড়িকাঠের সঙ্গে কে যেন আঠা দিয়ে তাকে আটকে রেখেছে সেখানে। মুখখানা রাগে আর উদ্‌বেগে থমথম করছে, হাঁপাচ্ছে হুসহাস করে আর হাত-পা ছুড়ছে পাগলের মতো, দরজাটা… দরজাটা বন্ধ কর আহাম্মক কোথাকার! মেয়েছেলেটা যদি ঢুকে পড়ে ভেতরে…

দরজা বন্ধ করে এসে দাঁড়িয়েছিলাম তার নিচে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিলাম কড়িকাঠে আটকানো শূকরপ্রতিম বপুখানার পানে।

বলেছিলাম, পাইক্র্যাফ্ট, এ আবার কী খেলা? পড়ে গেলে যে ঘাড়খানা ভেঙে যাবে।

 ভাঙলে তো বাঁচি, সে কী তেজ গলায়।

এই বয়স আর এই ওজন নিয়ে এ ধরনের ছেলেমানুষি জিমন্যাস্টিক দেখাতে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?

নিকুচি করেছে তোমার ঠাকুমার মায়ের। তার জন্যেই…

 সাবধান!

 কথাটা শোনই-না!

তার আগে বল দিকি, কড়িকাঠে আটকে আছ কীসের আঠায়?

বলে ফেলেই বুঝলাম, আঠা নয়, আঠা নয়–কোনও আঠার জোরেই পাইক্র্যাফট আটকে নেই কড়িকাঠে, গ্যাস ভরতি বেলুনের মতো ফুলে উঠে সেঁটে রয়েছে কার্নিশের কোণে। হাঁচোড়-পাঁচোড় করে দেওয়াল খামচে ধরে নিচের দিকে নামবার চেষ্টা করতে করতে পাইক্র্যাফট বলেছিল, যত নষ্টের মূল ওই প্রেসক্রিপশনটা। তোমার ঠাকুমার মা…

খবরদার! হেঁকে উঠেছিলাম আমি।

দাবড়ানি খেয়ে একটা বাঁধানো ফ্রেম অন্যমনস্কভাবে চেপে ধরেছিল পাইক্র্যাফ্ট, ফ্রেম ভেঙে রয়ে গেল হাতে, ছবি আছড়ে পড়ে খানখান হয়ে গেল মেঝেতে, সাঁ করে ফের শুন্যে উঠে গিয়ে ধাঁই করে কড়িকাঠে ধাক্কা খেয়ে রবারের বলের মতো নেচে নেচে উঠল পাইক্র্যাফট। গতরখানার উঁচু উঁচু জায়গায় সাদা হয়ে রয়েছে কেন, বুঝলাম এতক্ষণে। চুনকাম মেখে কি খোলতাই চেহারাখানিই হয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র নয় এত মেহনত এবং ধকল সত্ত্বেও। হুঁশিয়ার হয়ে একটু একটু করে চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে নেমে এল ম্যান্টল ধরে।

দৃশ্যটা বাস্তবিকই অপূর্ব! অসাধারণ! ওইরকম বিশাল, চর্বি-থসথসে, সন্ন্যাসরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাযুক্ত একখানা গতর যদি মাথা নিচের দিকে করে কড়িকাঠ থেকে মেঝের দিকে দেওয়াল বেয়ে নিম্নগামী হয়, তাহলে কি দৃশ্যটা মনে রাখবার মতো হয় না?

ফর্মালিন, প্রেসক্রিপশনটা দারুণ কাজে লেগেছে।

 কীভাবে পাইক্র্যাফ্ট?

 ওজন হারিয়েছি–এক্কেবারে।

এতক্ষণে বুঝলাম ব্যাপারটা।

 কী সর্বনাশ! পাইক্র্যাফ্ট, তোমার মনের ইচ্ছেটা ছিল চর্বি কমানোর, মুখে কিন্তু আগাগোড়া বলে গেছ, ওজন কমাতে চাও।

কেন জানি না, দারুণ খুশিতে ডগমগ হয়েছিলাম পাইক্র্যাফটের এহেন পরিস্থিতিতে। সেই মুহূর্তে বড় ভালো লেগেছিল ওকে। হাত বাড়িয়ে ধরে টেনেহিঁচড়ে নামিয়েও এনেছিলাম। পা দুখানা ছুঁড়ে পা রাখবার জায়গা পেতে গলদঘর্ম হয়ে গিয়েছিল বেচারি। আমার কিন্তু মনে হয়েছিল, ঠিক যেন ঝোড়ো বাতাসে নিশান উড়ছে পতপত করে। আঙুল দিয়ে মেহগনি কাঠের ভারী টেবিলটা দেখিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল অপরূপ নাটকের নায়ক, ওর তলায়… ওর তলায় ঢুকিয়ে দাও–আটকে রেখে দেবে—

তা-ই দিয়েছিলাম। বন্দি বেলুনের মতোই সাঁই করে টেবিলের তলায় আটকে গিয়েছিল ফুলো গতরখানা। মেঝের কার্পেটে পরম আয়েশে বসে জেরা চালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। আগে অবশ্য একটা চুরুট ধরিয়ে নিয়েছিলাম মৌজ করে।

তারপর জিজ্ঞেস করেছিলাম খুশি খুশি গলায়–এবার বল, কীভাবে এ হাল হল তোমার।

পাঁচনটা খাওয়ার পরেই।

 খেতে কীরকম?

 জঘন্য!

জঘন্য তো বটেই। সব কটা পাঁচনের স্বাদই তাই। গুণাগুণ যা-ই থাক-না কেন, ঠাকুমার মায়ের কোনও পাঁচনই আমার কাছে রুচিকর নয়।

প্রথমে এক চুমক খেয়েছিলাম, খুব সামান্য।

 তারপর?

 বেশ হালকা হালকা লাগছিল নিজেকে। ঘণ্টাখানেক বাদে বেশ তাজা তাজা। তাই ঠিক করলাম, এক ঢোকেই মেরে দেব সবটা।

বল কী?

নাক টিপে গিলেছিলাম অবশ্য। তারপর থেকেই হালকা হতে হতে এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এই পর্যন্ত মিনমিন করে বলে হঠাৎ ঝাঁ করে তেড়ে উঠল আমার ওপর, ফর্মালিন, কী করি এখন বল তো?

একটা কাজ কখনওই করবে না। বাইরে বেরবে না। বেরলেই শূন্যে উড়ে যাবে, হস্তসঞ্চালনে দেখিয়েছিলাম উড়ে যাওয়ার দৃশ্য।

পাঁচনের কাজ নিশ্চয় মিলিয়ে যাবে আস্তে আস্তে?

 সে গুড়ে বালি, খুব জোরে মাথা নেড়ে নাকচ করে দিয়েছিলাম সম্ভাবনাটা। তৎক্ষণাৎ এক পশলা ঝাঁজালো তেজালো রসালো গালাগাল বৃষ্টি হয়ে গেল আমার ওপর। আমার চোদ্দোপুরুষের পিণ্ডি চটকানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে আদ্যশ্রাদ্ধ করা হল আমার ঠাকুমার মা বেচারির। এমতাবস্থায় ওর মতো মোটকা হোঁতকা অশিষ্ট মানুষের পক্ষে এবংবিধ আচরণ খুবই স্বাভাবিক। তাই আমি গায়ে মাখলাম না। শুধু বললাম, আমি তো তোমায় সাধিনি, তুমি নিজেই

বলে, উঠে বসলাম ওই হাতলওয়ালা চেয়ারে। বিপদে যে বন্ধু পাশে দাঁড়ায়, সে-ই প্রকৃত বন্ধু। উপদেশ-টুপদেশ দিলাম কিছুক্ষণ। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম, এ অবস্থার জন্যে দায়ী পাইক্র্যাফ্ট নিজেই। অতখানি পাঁচন ঢক করে গিলে ফেলা উচিত হয়নি। কোঁত কোঁত করে গেলার স্বভাব ওর চিরকালই। এই বিষয়টা নিয়ে ঘোর মতান্তর ঘটল দুজনের মধ্যে।

গাঁক গাঁক চিৎকার শুনে আর মারদাঙ্গা মূর্তি দেখে ঠিক করলাম, শিক্ষাদানের এ প্রসঙ্গটা মুলতুবি থাক আপাতত। যুক্তি দিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিলাম, মহাপাপ সে করেছে শ্রুতিকটু পদের পরিবর্তে কোমলতর পদের প্রয়োগ করে। বলা উচিত ছিল চর্বি, কিন্তু শুনতে খারাপ লাগে বলে বলেছিল ওজন। কাজটা অত্যন্ত গর্হিত। ফল পেয়েছে হাতে হাতে

প্রসঙ্গটা অসমাপ্ত রাখতে বাধ্য হলাম পাইক্র্যাফটের প্রবল বাধাদানে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব দোষই সে মানছে। মহাপাপ সে করেছে, অস্বীকার তো করছে না। কিন্তু এখন করণীয়টা কী?

নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখছি না, বুঝিয়ে বলেছিলাম আমি। সমস্যা সমাধানের সত্যিকারের আলোচনাটা শুরু হয়েছিল তখনই, এবং বেশ মনে রাখবার মতো আলোচনা। বলেছিলাম, চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে কড়িকাঠে হাঁটাটা এমন কিছু অসুবিধাজনক হবে না কিছুদিনের চেষ্টার পর

ঘুমাতে তো পারছি না, গোঙিয়ে উঠেছিল পাইক্র্যাট।

সেটা কি একটা বিরাট সমস্যা? ধীরেসুস্থে সে সমস্যারও সমাধান করে দিয়েছিলাম আমি। কড়িকাঠে একটা তারের জাল লাগিয়ে নিলেই হল। বিছানার লেপ-তোশক ফিতে দিয়ে লাগানো থাকবে কড়িকাঠের জালে। কম্বল, চাদর বোতাম দিয়ে লাগানো থাকবে পাশে পাশে। ঘরকন্না দেখার ভার রয়েছে যে মেয়েছেলেটার ওপর, তাকেই শুধু সব কথা খুলে বলতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ গজর গজর করার পর রাজি না হয়ে পারেনি। পাইক্র্যাফট। যথাসময়ে জিনিসপত্র এসে পৌঁছেছিল ঘরের মধ্যে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই। উলটো বিছানাপত্র নিয়ে তিলমাত্র উলটো-পালটা কৌতূহল না-দেখানোটা বিলক্ষণ উপভোগ্য হয়েছিল কিন্তু অন্তত আমার কাছে। লাইব্রেরি থেকে মইটা এনে রাখা যাবেখন বসবার এই ঘরে। খাবারদাবার সমস্ত রাখা হবে বুকশেলফের ওপরে। হাত বাড়িয়ে খেয়ে নিলেই হল। খুশিমতো মেঝেতে নেমে আসার মৌলিক পদ্ধতিটাও বাতলে দিয়েছিলাম কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর। খুবই সোজা কায়দা, খোলা বুকশেলফে ব্রিটিশ এনসাইক্লোপিডিয়ার দশম সংস্করণটা রেখে দিলেই হল। হাত বাড়িয়ে খান দুয়েক খণ্ড টেনে নিলেই আস্তে আস্তে নেমে আসবে নিচে। আরও অভিনব একটা ব্যাপারে মতৈক্য ঘটল দুজনের মধ্যে। ঘরের ধার বরাবর অনেকগুলো লোহার আঁকশি লাগানো থাকবে। আঁকশি আঁকড়ে ধরে ঘরের নিচের দিক দিয়ে যত্রতত্র গমন করা যাবে। বুদ্ধিটা মন্দ বলা যায় কি?

এই ধরনের বুদ্ধির পর বুদ্ধি গজিয়ে যাচ্ছিল মাথার মধ্যে ফটাফট করে। বেশ চনমনে বোধ করছিলাম বিপদগ্রস্ত বন্ধুকে সাহায্য করার সুযোগ পেয়ে। উদ্যোগী হয়ে আমিই ঘরকন্না দেখার মেয়েছেলেটাকে ডেকে এনেছিলাম, পাইক্র্যাফটের গুপ্ত রহস্য ফাঁস করেছিলাম, এবং মূলত আমিই ওলটানো বিছানা কড়িকাঠে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, পুরো দুটো দিন কাটিয়েছিলাম ওর ফ্ল্যাটে। স্ক্রু-ড্রাইভার বাগিয়ে অনেক অভিনবআয়োজন সমাপন করেছিলাম আমিই। তার টেনে ঘণ্টা রেখেছিলাম ওর হাতের কাছে, সব কটা ইলেকট্রিক লাইট লাগিয়েছিলাম উলটো করে। এই ধরনের বহুবিধ বিচিত্র ব্যবস্থা সবই করেছিলাম নিজের হাতে এবং পরমোৎসাহে। সব মিলিয়ে দৃশ্যটা এতই সুখপ্রদ হয়ে উঠেছিল যে, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কড়িকাঠ থেকে দরজার পাশ দিয়ে বিশালকায়। টিকটিকির মতো নেমে আসছে ধুসকো পাইক্র্যাফট, আঁকশি ধরে ধরে যাচ্ছে এক ঘর থেকে আর-এক ঘরে… কিন্তু ছায়া মাড়াতে পারছে না ক্লাবের… জীবনে আর পারবেও না! অহো! অহো!

তারপরেই কুড়ল মেরে বসলাম নিজেরই পায়ে। দায়ী এই উর্বর মগজটা। ভুরভুর করে গজিয়ে যাচ্ছিল বুদ্ধির পর বুদ্ধি–শেষকালে সুড়ত করে এসে গেল এমন একটা বুদ্ধি, যে সর্বনাশ হয়ে গেল আমার নিজেরই।

বসেছিলাম বসবার ঘরে। আগুনের ধারে ওরই চেয়ারে বসে ওরই হুইস্কি পান করছিলাম মৌজ করে। পাইক্র্যাফট লেপটে ছিল ওর অতিপ্রিয় কার্নিশের কোণে হাতে হাতুড়ি নিয়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে তুরস্ক দেশের একটা কার্পেট বসাচ্ছিল কড়িকাঠে। বুদ্ধিটা মাথার মধ্যে ঝলসে উঠল ঠিক সেই মুহূর্তেই। চিৎকার করে উঠেছিলাম সঙ্গে সঙ্গে পাইক্র্যাফট! এত ঝামেলার তো কোনও দরকারই দেখছি না।

আইডিয়াটার পুরো প্রতিক্রিয়া ধারণা করে নেওয়ার আগেই গাঁক গাঁক করে তা ব্যক্ত করে ফেলেছিলাম স্বমুখে–সিসের অন্তর্বাস! বাস, ক্ষতি যা হবার হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।

পাইক্র্যাফটের চোখে জল এসে গিয়েছিল শুধু ওই দুটি শব্দ শুনেই–তাহলে বলছ, আবার মাথা তুলে দাঁড়ানো যাবে

চমকপ্রদ আইডিয়াটা গরগর করে বলে গিয়েছিলাম নিজের ক্ষতি কতখানি হতে পারে তা না ভেবেই–সিসের চাদর কেননা পাইক্র্যাফট। চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে সেলাই করে নাও গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, পায়জামায়। পায়ে পর সিসের সুকতলা দেওয়া বুটজুতো। হাতে নাও নিরেট সিসে ভরতি থলি। বাস, আর কী চাই! বন্দিদশা ঘুচবে, আবার টো টো করে যেখানে খুশি টহল দিতে পারবে

বলতে বলতে আরও প্রীতিপদ একটা আইডিয়া ফুরুক করে ঠেলে উঠেছিল মগজের বুদ্ধিকোষ থেকে, জাহাজডুবি হলেও আর তোমাকে মরার ভয় করতে হবে না, পাইক্র্যাফট। কিছু বোঝা বা জামাকাপড় ফেলে দিলেই হল–দরকারমতো মালপত্র হাতে নিয়ে হু-উ-উ-স করে ভেসে উঠবে ডোবা জাহাজ থেকে জলের ওপর–ঠিকরে যাবে শূন্যে! বিষম উত্তেজনায় হাতুড়িটা খসে পড়েছিল পাইক্র্যাফটের হাত থেকে–আমার মাথা ঘেঁষে।

ফর্মালিন! আবার তো তাহলে ক্লাবে যাওয়া যাবে।

শুনেই তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! উৎসাহ নিবে গেল দপ করে। খাবি খেতে খেতে সায় দিয়েছিলাম এইভাবে, তা-ও তো বটে! তা-ও তো বটে!

হ্যাঁ, ক্লাবে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে পাইক্র্যাফ্ট। ওই তো ওই টেবিলে বসে কোঁত কোঁত করে গিলে যাচ্ছে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়। জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমার পানে। চোখে সেই নীরব মিনতি–বলো না ভায়া, বলো না কাউকে। কড়িকাঠে হেঁটেছি কেউ যদি শুনে ফেলে, ঢি ঢি পড়ে যাবে যে। পড়ুক। ওর ওই গেলা দেখে ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারছে না যে তিলমাত্র ওজন নেই অত বড় গতরখানার–হালকা… হালকা… বাতাসের মতোই হালকা চর্বির ওই বিশাল পাহাড়টার। তাই জানুক সকলে, কী কুক্ষণেই শেষ বুদ্ধিটা বাতলে ফেলেছিলাম আমি। লেখা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নতুন একখানা প্লেট নিয়ে চোখ নামিয়ে গোগ্রাসে গিলছে পাইক্র্যাফট, এই ফাঁকে পাশের দরজাটা পেরিয়ে যাওয়া যাবে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *