পাঁঠা পাঁঠি
রাত দুটো। পিঠে এক খোঁচা। সবে ঘুমটা বেশ কাঁঠালের রসের মতো মজে আসছিল। স্বপ্নের চৌকাঠ হয়তো ছিল আর সামান্য দূরে। মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে স্বপ্নটাই তো সব। দিবা স্বপ্ন আর নিদ্রার স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখতে পারি বলেই বেঁচে আছি এখনও। সেই প্রবাদেই তো আছে—’চটে শুয়ে মুটে রাজা।’
খোঁচা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল।
‘কি ঘুমোলে না কি?’
‘প্রায়’।
‘কী করে অমন নিশ্চিন্তে ঘুমোও। বিছানায় পড়লে কী মরলে।’
লেডি ম্যাকবেথকে বোঝাই কী করে, এই সাময়িক মৃত্যুটুকুর জোরেই বেঁচে আছি। আমাদের জীবনের একমাত্র ‘নারিশমেন্ট’ হল এই ঘুম। দুধ, ঘি, ছানা, মাখন, মাছ, মুসুম্বি নয়। নিদ্রা।
খোঁচাদায়িনী বললেন, ‘কি করলে? খোঁজ নিয়েছিলে?’
‘কীসের খোঁজ বলো তো?’
‘মেয়ের বিয়ের। বলেছিলে?’
‘কাকে বলব’?
‘পাঁচজনকে’।
‘কাল সকালে বলব। কোনও রকমে আজকের রাতটা পার করে দাও।’
‘হ্যাঁ, ওই করে করে জীবনটাই পার করে দাও। তুমি ভাবছ মাঝরাতে পক্ষীরাজ চেপে তোমার ভাঙা বাড়ির ছাদে কাশ্মীর প্রিন্স এসে নামবে আর সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে, তোমার ধেড়ে মেয়ের ঘুম ভাঙিয়ে হুস করে আকাশে উড়ে যাবে। ওই ঘোড়ার মতো মুখে যখন চুনকালি মাখিয়ে, যার তার সঙ্গে ঝুলে পড়বে, তখন যেন বোলো না মায়ের শাসন ছিল না। তুমি কি? তুমি একটা মানুষ। কেমন নিশ্চিন্তে নাক ডাকাচ্ছ, ফুরফুর ফুরফুর। সত্যি করে বলো তো কারওকে বলেছ।’
‘বলেছি রে, বাবা। আচ্ছা জ্বালাতন’।
‘হ্যাঁ, জ্বালাতন তো হবেই। নেচে-নেচে কেষ্টঠাকুরটির মতো নিজের বিয়ে করতে বেশ মজা লেগেছিল, আর মেয়ের বিয়ের বেলায় নাকে সরষের তেল। তোমার লজ্জা করে না। খাচ্ছো দাচ্ছো আর বগল বাজিয়ে ধর্মের ষাঁড়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘তা কী করব, ফ্ল্যাগ হাফমাস্ট করে করুণ সুরে ব্যায়লা বাজাব?’
‘তুমি কাকে কাকে বলেছ? লিস্ট দাও’।
‘আমাদের বাড়িতে যে খবরের কাগজ দেয়, তাকে বলেছি।’
‘তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে?’
তোমার মাথা। সে অন্তত পাঁচশো বাড়িতে ঘোরে। তার সঙ্গে অন্তত রোজ হাজার ছেলের দেখা হয়। সে তোমার গিয়ে গোয়েন্দার মতো কাজ করবে। যেই আমাকে খবর দেবে আমি অমনি চিতা বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ব। সেই ছেলেবেলায় দেখেছিলুম, আমাদের পাড়ায় টগরকুমার বলে এক কুস্তিগির ছিল। অনেকটা দূর থেকে প্রতিপক্ষের ওপর বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত। তারপর মাটিতে পেড়ে ফেলে, আড়াই প্যাঁচ। আমিও সেই টগরকুমারের মতো মোড়ের মাথার পেড়ে ফেলব, ব্যাটা। ব্যাংকে, ইনসিওরেনসে, কাগজের অফিসে, রেলে, সরকারে, চাকরি করছ। মোটা টাকা কামাই করছ। টেরিকটের চেকনাই মেরেছ। কপাল ঢাকা পমেরেরিয়ান চুল, বাতাসে ঝুমকা গিরারে। বিকেলে ঢুকু বিয়ার, চিলি চিকেনের টুকু মারছ। পায়ে সাড়ে তিনশোর জুতো। ঝান্ডা ওড়াচ্ছে। বিপ্লবের বুলি কপচাচ্ছে, আর বাঙালির ঘরে-ঘরে মেয়েদের যৌবন চলে যাচ্ছে। কোল কুঁজো হয়ে যাচ্ছে। চোখের নীল ব্যর্থ বাণ মেরে-মেরে হলুদ হয়ে আসছে। তার কী হবে? তোমার একটা সামাজিক দায়িত্ব নেই? পৃথিবীটা কি আমার একার নরক? আমার একার কটাহ? তুমি ছাপকা লুঙ্গি ভুঁড়ির তলায় পরে কোলে ছেলে নয়, স্টিরিয়ো টেপরেকর্ডার নাচাবে। তুমি প্রেম করবে, বিয়ে করবে না। মামার বাড়ি! আগে শ্বশুর বাড়ি করো, তারপর প্রেমযমুনায় ঢেউ তুলবে, বাবাজীবন।’
‘তারপর তুমি প্যাঁদানি খেয়ে হাড়গোড় ভেঙে বৃদ্ধ জটায়ুর মতো এই দুখিনী সীতার কোলে এসে ইনভ্যালিড হয়ে পড়বে।’
‘তোমারও তো একটা দায়িত্ব আছে। তুমি কী করছ?’
‘আমি তো তোমার মৃণালবাবুকে বলেছিলুম। তার ভাইয়ের সঙ্গে। কায়দা করে ভাইকে এনে দেখালেন।’
‘তিন মাস তো হয়ে গেল। বলছে কী?’
‘এখন বলে কি না, মেয়েকে যেভাবেই হোক খাইয়ে দাইয়ে মোটা করুন। তারপর বীরভূমে বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলুন। তারা টিপেটিপে দেখে অ্যাপ্রুভ করলে দেনাপাওনার কথা। তারপর বিয়ে।’
‘আমাদের মেয়ে দুম্বা না কি? যে গ্র্যাম ফেড ভেড়ার মতো, পাঁঠার মতো রেওয়াজি করে বিয়ের বাজারে রিলিজ করতে হবে। কজন মিলে খাবে। আচ্ছা, তোমার আমার বিয়ে কীভাবে হয়েছিল? মনে আছে? সেই ফরমুলাটা অ্যাপ্লাই করলে হয় না।’
‘তোমার মতো পাঁঠার সংখ্যা যে কমে গেছে। নেই বললেই চলে। ভিনি, ভিডি, ভিসির কাল শেষ। এ কাল হল ধূর্ত শৃগালের কাল।’
কথায় কথায় রাত ভোর হয়ে এল। বিছানায় এক পাশে পাঁঠা, আর এক পাশে আমার পাঁঠি। দুজনেরই চুলে পাক ধরেছে। দেহে মধ্য বয়েস, মুখে বার্ধক্য। কপালে দুশ্চিন্তার বলি যেন প্রভাত সরোবরে বাতাসের হিল্লোল।