পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ

পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ (রচনা ১৯৭৬-৭৮। প্রকাশ ১৯৮০)

অর্কেস্ট্রা

ভোর এল ভয় নিয়ে, সেই স্বপ্ন ভুলিনি এখনও।

স্থির অমাবস্যা, আমি শিয়রে দাঁড়িয়ে আছি দিগন্তের ধারে
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে
আমার শরীর যেন আকাশের মূর্ধা ছুঁয়ে আছে।

বুক থেকে হাতে খুলে নিয়েছি পাঁজর আর তালে তালে নাচে সেই হাত
গ্রহনক্ষত্রের দল ঝমঝম শব্দে বেজে ওঠে।
স্তূপ হয়ে অন্ধকারে সোনারঙা সুর ওই ওঠে আর উঠে ঝরে পড়ে।

সেই সুরে খুলে যায় নামহারা গহ্বরের মৃতদেহগুলি
 পিছনে অলীক হাতে তালি।
অবসন্ন ফিরে দেখি ঘাসের উপরে শুয়ে আছে

পুরোনো বন্ধুর দল
 শিশির মাখানো শান্ত প্রসারিত হাতগুলি বাঁকা।

*

পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ

পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে
নৌকোর গলুই ভেঙে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ
জলজ গুল্মের ভারে ভরে আছে সমস্ত শরীর
আমার অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে।

.

ঝড়ে-ভাঙা লাইটপোস্ট একা পড়ে আছে ধানখেতে
শিয়রে জোনাকি, শুন্যে কালপুরুষের তরবারি
 যুদ্ধ হয়ে গেছে শেষ, নিঃশব্দ প্রহর দশ দিকে
 যেদিকে তাকাও রাত্রি প্রকাণ্ড নিকষ সরোবর।

.

চোখের পাতায় এসে হাত রাখে শ্লথ বেলপাতা
পাকা ধান নুয়ে প’ড়ে আদরে ঘিরেছে শরীরীকে
বালির গভীর তলে ঘন হয়ে বসে আছে জল  
এখানে ঘুমোনো এত সনাতন, জেগে ওঠা, তাও।

.

ভাসন্ত শবের মুখে বসেছিল দক্ষিণের পাখি
সূর্যের অন্তিম হাত মুছে দিয়েছিল দুঃখরেখা
পলিতে পলিতে দেশ ছেয়ে যাক! যায়নি এখনও?
 ভাসন্ত শবের পাখি সূর্যের কুহরে উড়ে যায়।

.

আর্তনাদ করে ওঠে, দুহাত বাড়িয়ে বলে : এসো
এসো সর্বনাশে এসো আগ্নেয় গুহায় এসো বোধে
এসো ঘূর্ণিপাকে বীজে অন্ধের ছোঁয়ায় এসো এসো
শিকড়ে গরল ঢেলে শিখরে জাগিয়ে দেব জ্বালা।

.

ঘরবাড়ি ভিজে যায় অশান্ত ধানের মাঝখানে।
 রবিউল ব’সে দেখে। এ রকমই মীড় বা গমকে
ভরে ছিল সময়ের স্তরগুলি একদিন, আজ
বাজনা রয়েছে পড়ে, ফিরে গেছে বাজাবার হাত।

.

১১

এইসব লেখা তার মানে খুঁজে পাবে বলে আসে
 শহরের শেষ ধাপে কবরসারির পাশাপাশি
এপিটাফগুলি তার অভিধা বাড়ায় সন্ধ্যাবেলা
নগ্ন অক্ষরের গায়ে মৃত বন্ধুদের হিম শ্বাসে।

.

১৩.

আমি আছি, এই শুধু। আমার কি কথা ছিল কোনো?
যতদূর ফিরে চাই আদি থেকে উপাস্ত অবধি
কথা নয়, বাঁচা দিয়ে সমূহ প্রবাহ পাব ব’লে
এই দুই অন্ধ চোখ ভিজিয়ে নিয়েছি অন্ধকারে।

.

১৬

ওই স্নেহময় মুখে যখন রেখেছি দুই-হাত
তরুণ সবুজ পাতা স্মৃতিতে বুলায় মর্মরতা
 বেঁচে যে ছিলাম তার বিরলতা জল হয়ে নামে
হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় পিছে পড়ে-থাকা সব মান।

.

২৪

নদী খুব নদী নয়, ভেজায় পায়ের মূল, পাতা
প্রেম তত প্রেম নয়, ঘিরে আছে সীমানা কেবল
শ্মশানও তেমন ধুনি সাধনার বিশালতা নয়
রাত্রি শুধু বীজময়, ভোর শুধু ভোরের বাগিচা।

.

.

৩০

এই উষ্ণ ধানখেতে শরীর প্রাসাদ হয়ে যায়
প্রতিটি মুহূর্ত যেন লেগে থাকে প্রাচীন স্ফটিক
 সীমান্ত পেরিয়ে যেই পার হই প্রথম খিলান
 ঘর থেকে ঘর আর হাজার দুয়ার যায় খুলে।

.

৩১

পদক্ষেপে পদক্ষেপে এক অক্ষৌহিণী বৃষ্টিরেখা
স্তব্ধ বসতির দিকে ধেয়ে আসে প্রান্তর পেরিয়ে
প্রস্তুত ছিল না রথ, ঢালবর্ম দূরে, পড়ে আছি
 খোলা দশ দিগন্তের মাঝখানে সিক্ত পরাভূত।

*

৩২

মজ্জায় মজ্জায় তার আলস্যমথিত অন্ধকারে
 জেগে ওঠে দীর্ঘ শাল আজানুলম্বিত বটঝুরি
সন্ন্যাসী জ্বালায় চুল্লি দুঃসহ গহনে মন্ত্র পড়ে
উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।

.

৩৩

শিকড়, ব্যথিত শিরা, মানুষের অতল উৎসার  
এর ওর মুখে এত ভাঙা ছবি সাজিয়ে রেখেছ!
জানো না আমিও ঠিক সেইভাবে চেয়েছি তোমাকে
মাটিতে আঙুল দিয়ে খুঁড়ে ধরে যেভাবে এ বট।

.

৩৪

এখানেই ছিলে তুমি? এইখানে ছিলে একদিন?
 ছুঁয়ে দেখি লাল মাটি, কান পেতে শুনি শালবন
 সমস্ত রাত্রির প্রেত সঙ্গে নিয়ে ঘুরি, আর দেখি
তোমার শরীর নেই, তোমার আত্মাও আজ ঢেকে গেছে ঘাসে।

.

৩৫

আমি কি মৃত্যুর চেয়ে ছোটো হয়ে ছিলাম সেদিন?
আমি কি সৃষ্টির দিকে দুয়ার রাখিনি খুলে কাল?
ছিল না কি শষ্পদল আঙুলে আঙুলে? তবে কেন
হীনতম অপব্যয়ে ফেলে রেখে গেছ এইখানে?

.

৩৯

পাত্র তো সুন্দর, কিন্তু কানায় কানায় ভরা বিষ
দেখো, অভিভূত হও, ঠোঁটে তুলে নিয়ো না কখনো।
 ঝলক লেগেছে চোখে, দুপুরে পারদ, হলকা ওঠে
চেতনা বধির ক’রে ভাসমান তরল আগুন।

.

৪০

উঁচু হয়ে জেগে আছে নষ্ট প্রতিভার মরা ডাল
আকণ্ঠ কলঙ্কে বুঝি দুঃখ উঠেছিল কত দূর।
 আজ নেমে গেছে সব, ছিন্ন শাঁসগুলি মনে রাখো
দুপাশে মহুয়া, কিন্তু মাঝখানে সামাজিক সাঁকো।

.

৪১

 ঝাঁপ দিয়ে উঠে আসে কয়েক রক্তিম বিন্দু জল।
 আমার বুকের কাছে, নিশ্চিন্ত শকুন ডানা ঝাড়ে।
 সবুজ, সবুজ হয়ে শুয়ে ছিল প্রাকৃত পৃথিবী
 ভিতরে ছড়িয়ে আছে খুঁড়ে-নেওয়া হৃৎপিণ্ডগুলি।

.

৪২

 আমার শরীরে কোনো গান নেই। কাঠুরেরা আসে
একে একে কেটে নেয় মরা ডাল গুঁড়ি ও শিকড়
তার পরে ফেলে রাখে মাঠের পশ্চিম পাশে, আর
দূরের লোকেরা এসে ধুলোপায়ে বেচাকেনা করে।

.

৪৪

দাও ডুবে যেতে দাও ওই পদ্মে, কোরকে, কোমলে
দাও চোখ ধুয়ে দাও ভেরের আভায়, জন্মভোর
 শিরায় শিরায় বাঁধো, পাপড়িগুলি ঢেকে বলে যাও
ফিরে যাওয়া যাওয়া নয়, সেই আরো কাছাকাছি আসা।

.

৪৬

 কথা ব’লে বুঝি ভুল, লিখে বুঝি, হাত রেখে বুঝি
এ রকম নয় ঠিক, এ তো আমি চাইনি বোঝাতে।
কাগজের মুখ নিয়ে সভাশেষে ফিরে গেলে লোকে
মনে হয় ডেকে বলি : এইবার ঠিক হবে, এসো।

.

৫০

নিচু হয়ে এসেছিল যে মানুষ অপমানে, ঘাতে
ঝরে গিয়েছিল যার দিনগুলি প্রহরে উজানে
তারই কাছে এসে ওই পাঁজরে পালক রেখেছিলে
তোমার আঙুলে আমি ঈশ্বর দেখেছি কাল রাতে।

.

৫১

কেন কষ্ট পাও? কেন ওই হাতে হাত ছুঁতে চাও?
 জলের লহরী যেন ভাস্কর্য ধরেছে বুকে এসে।
 পুরোনো অভ্যাসবশে দাঁড়িয়ে রয়েছে নষ্ট মাথা
 চন্দন পায়ের তলে, চোখের পাতায় তুলসী পাতা।

.

৫২

আজও কেন নিয়ে এলে ভ্রষ্ট এই অন্ধ মৃত্যুজপ
 দুরূহ যুবারা যাকে ভালোবেসে প্রসিদ্ধ করেছে!
 ধমনী শিথিল জলে ভরে দেয় ঘূর্ণমান তারা
 হাজার স্লিপিং পিল মাথার ভিতরে আত্মহারা।

.

৫৫

প্রগাঢ় অন্যায় কোনো ঘটে গেছে মনে হয় যেন
 কিছু কি দেবার কথা কিছু কি করার কথা ছিল?
থেমে-থাকা বৃষ্টিবিন্দু হাড় থেকে টলে পড়ে ঘাসে
 ভেজা বিকেলের পাশে ডানা মুড়ে বসে আছে আলো।

.

৫৮

কিছু-না-পারার এই ক্লীব খোলসের বন্দী ভ্রূণ
গোপন রাত্রির স্তূপে পড়ে আছে পরিত্যাগে রাগে
 হাওয়ায় জাগানো মুখে অবিরাম জ্বলে থাকে ক্ষার
সহজ হয়নি তার যে-কোনো সহজ অধিকার।

.

৬০

 তুমি কি কবিতা পড়ো? তুমি কি আমার কথা বোঝো?
ঘরের ভিতরে তুমি? বাইরে একা বসে আছে রকে?
কঠিন লেগেছে বড়ো? চেয়েছিলে আরো সোজাসুজি?
আমি যে তোমাকে পড়ি, আমি যে তোমার কথা বুঝি।

.

৬১

প্রতি মুহূর্তের ধান আসক্ত মুঠোয় রাখি ধরে
 তার পরে যায় যদি অবাধ সন্ন্যাসে ঝরে যায়
এই মাঠে আসে যারা সকলেই বোঝে একদিন
এক মুহূর্তের মুখ আরেক মুহূর্তে সত্য নয়।

.

৬২

খুব অল্প ভালো লাগে এইসব বহু বিচ্ছুরণ
 খান খান হতে থাকা রংকরা সামাজিকতায়।
 মাটির ভিতরে শস্য নিভৃত আশ্বাস নিয়ে বাড়ে
বুকে ইথারের ভারে নিশ্চল হয়েছি একেবারে।

.

৬৩

মাটি খুব শান্ত, শুধু খনির ভিতরে দাবদাহ
হঠাৎ বিস্ফারে তার ফেটে গেছে পাথরের চাড়।
 নিঃসাড় ধুলায় দাও উড়িয়ে সে লেখার অক্ষর
যে লেখায় জ্বর নেই, লাভ নেই, অভিশাপও নেই।

.

৬৪

ঘিরে ধরে পাকে পাকে, মুহূর্তে মুহূর্ত ছেড়ে যাই
 জলপাতালের চিহ্ন চরের উপরে মুখে ভাসে
 তাঁবু হয়ে নেমে আসে সূর্যপ্রতিভার রেখাগুলি
স্তব্ধ প্রসারিত-মূল এ আমার আলস্যপুরাণ।