পাঁচে পঞ্চবাণ

পাঁচে পঞ্চবাণ

মালব্যনগরে দেড় বছর বাদে এল প্রথমা। এইবারে আসার উদ্দেশ্য নিখাদ ছুটি কাটানো। ট্রেকিং করা, বৌদ্ধ মঠ আর ভোলানাথ মন্দির দর্শন, ক্যাসিনোয় গ্যাম্বলিং, রেস্তোরাঁয় খানাপিনা। আগের বার এসেছিল কাজে। মালব্যনগর বর্ডার দিয়ে জাল টাকা ভারতবর্ষের বাজারে ঢোকা বন্ধ করতে।

মালব্যনগর বাংলার উত্তরে অবস্থিত পুঁচকে একটা রাষ্ট্র। এখনও সেখানে রাজতন্ত্র চালু আছে। রাজার আদেশই এই দেশে আইন। অতীতে বুদ্ধদেব এই দেশে পদধূলি দিয়েছিলেন বলে বৌদ্ধরা আসেন স্পিরিচুয়াল ট্যুরিজমে। ভারতীয় ট্যুরিস্টরা আসেন গ্যাম্বলিং করতে। খুব ছোট্ট একদল ট্যুরিস্ট আসেন ইন্ডোলজি নিয়ে পড়াশুনো করতে।

ডিকশনারি বলছে ইন্ডোলজি মানে ‘স্টাডি অফ ইন্ডিয়ান হিসট্রি, লিটারেচার, ফিলোজফি অ্যান্ড কালচার’। মালব্যনগরে বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি ভোলানাথ মন্দির আছে। আছে লাইব্রেরি ভর্তি পুঁথি, মিউজিয়াম ভর্তি দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা, গয়না এবং নানান টুকিটাকি।

প্রথমা মালব্যনগরে এসেছে পর্যটন মন্ত্রী গিরিরাজ থাপার আমন্ত্রণে। সকালে পৌঁছে পাঁচতারা হোটেল ‘আদিনাথ ইন্টারন্যাশনাল’-এ উঠেছে। গিরিরাজের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ সেরে ঢুকে পড়েছে হোটেলের ক্যাসিনোয়। আস্ত একটা দিন কেটে গেছে সেখানে।

সন্ধে ছ’টার সময়ে পোকার খেলে কিছু টাকা জিতে, গেমিং মেশিনে সেই টাকা খুইয়ে প্রথমা ভাবছে এবার এখান থেকে বেরোনো উচিত, এমন সময়ে মোবাইল বেজে উঠল। গিরিরাজ ফোন করেছেন।

‘বলুন!’ ফোন ধরে বলল প্রথমা।

‘প্রথমা, গ্যাম্বলিং পরে করবে,’ বললেন গিরিরাজ, ‘এখন আমাকে সাহায্য করো। মালব্যনগর স্টেশানে চলে এসো।’

প্রথমার সিক্সথ সেন্স বলছে কিছু একটা হয়েছে। সন্ধে ছ’টার সময় পর্যটন মন্ত্রী তাকে স্টেশানে ডেকে পাঠাচ্ছেন। কণ্ঠস্বরে আকুতি। এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা আছে। সামথিং ইজ সিরিয়াসলি রং। মালব্যনগর স্টেশান থেকে এই সময় একটাই ট্রেন ছাড়ে। মালব্য এক্সপ্রেস, যার গন্তব্য কলকাতা। সেই ট্রেনে কোনও সমস্যা?

ক্যাসিনোর প্রধান দরজা খুলে বেরোল প্রথমা। বলল, ‘আপনি যা বলার মোবাইলে বলতে থাকুন। আমি ট্যাক্সি ধরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনার কাছে পৌঁছচ্ছি।’

‘মালব্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা আদিনাথ মালব্যের আমলে মুজিব স্বর্ণকার নামে এক স্যাঁকরা মুর্শিদাবাদ থেকে এখানে এসেছিলেন। আদিনাথের প্রতিষ্ঠা করা ভোলানাথ মন্দিরের জন্যে তিনি অজস্র সোনার অলংকার বানিয়েছিলেন। এ ছাড়াও, সদ্য বিবাহিত রাজা তাঁর পত্নীকে উপহার দেবেন বলে মুজিব স্বর্ণকারকে দিয়ে বানিয়েছিলেন এক অদ্ভুত গয়না। পঞ্চবাণ।’

‘সেটা আবার কী?’

‘পাঁচ আঙুলে পরার জন্যে পাঁচটি আংটি। মদনদেব হলেন কামের অধিষ্ঠাতা দেবতা। তাঁর অস্ত্র হল পুষ্পধনু এবং পঞ্চবাণ। এই পঞ্চবাণ হল সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন ও স্তম্ভন। বুঝতেই পারছ, পর্যায়ক্রমে এদের প্রয়োগ করলে মানুষের মনে ও শরীরে কী এফেক্ট হতে পারে?’

প্রথমা একটা ট্যাক্সিতে উঠে বলল, ‘মালব্যনগর স্টেশান।’

গিরিরাজ বলছেন, ‘আজ বিকেলে মিউজিয়াম থেকে পঞ্চবাণ চুরি হয়েছে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ পাঁচজন ভারতীয় ট্যুরিস্ট মিউজিয়ামে ঢুকেছিলেন। মিউজিয়ামের সিকিয়োরিটি স্টাফেরা নিশ্চিত যে ওই পাঁচজনের মধ্যে একজন আংটিগুলো চুরি করেছেন।’

‘মিউজিয়ামে নজরদারি ক্যামেরা আছে। চেক করে নিলেই হয়।’

‘নজরদারি ক্যামেরা সব ঘরে নেই। তবে যে ঘরে আংটিগুলো ছিল, সেই ঘরে আছে। ক্যামেরা কোথায় বসানো আছে চোর জানতেন। তিনি সবার আগে ক্যামেরার লেন্সের ওপরে কাপড় পেতে দিয়েছিলেন। ফলে কোনও ফুটেজ দেখা যাচ্ছে না। এবং ওই পাঁচ ছাত্র আজই মালব্যনগর ছেড়ে কলকাতা চলে যাচ্ছেন। ওঁরা আর ফিরবেন না।’

‘ওঁদের লাগেজ সার্চ করুন। তা হলেই চোরাই মাল পাওয়া যাবে।’ পরামর্শ দেয় প্রথমা।

মালব্যনগর স্টেশান এসে গেছে। ট্যাক্সি ব্রেক কষতেই রেলরক্ষী বাহিনীর এক কর্মী প্রথমাকে দেখে স্যালুট ঠুকলেন।

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে রেলরক্ষী বাহিনীর কর্মীর সঙ্গে প্রথমা দৌড় লাগাল। মোবাইলে গিরিরাজ বলছেন, ‘অত সোজা নয় প্রথমা। মালব্যনগরের সঙ্গে ভারতের কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নিতে ওঁরা এসেছে। পাঁচজনই ইন্ডোলজিস্ট। তা ছাড়া, রানি যে কলেজে পড়াশুনো করেছেন, ওঁরা সবাই সেই কলেজের ছাত্র। রানি বলেছেন, ওঁদের লাগেজ বা বডি সার্চ করা যাবে না।’

প্রথমার মনে পড়ল, মালব্যনগরের রাজা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশুনো করেছেন। সেই সময় এক বঙ্গ তনয়ার সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়। মেয়েটি এখন মালব্যনগরের রানি।’

‘রাজার বং কানেকশানের কথা ভুলে গিয়েছিলাম,’ মালব্যনগর স্টেশনের চিফ সিকিয়োরিটি অফিসারের চেম্বারে ঢুকে মোবাইল অফ করল প্রথমা। সামনেই বসে রয়েছেন গিরিরাজ। হাতের ইশারায় তিনি প্রথমাকে বসতে বললেন।

চেয়ারে বসে প্রথমা বলল, ‘রানির পরিচিত বলে অভিযুক্তদের সার্চ বা জেরা করা যাবে না?’

গিরিরাজ বললেন, ‘রানি ওভাবে বলেননি। তিনি বলেছেন, বাঙালি ট্যুরিস্টদের রেভিনিউতে আমাদের দেশ চলে। বাঙালিদের হ্যারাস করা যাবে না। আমি যদি রানির হুকুম অমান্য করে ওঁদের লাগেজ বা বডি সার্চ করে চোরাই মাল না পাই, তা হলে আমার মন্ত্রীত্ব কেড়ে নেওয়া হবে।’

‘এটা কোনও যুক্তি হল?’ বিরক্ত হয়ে বলল প্রথমা।

‘এটা ভারতবর্ষের মতো গণতান্ত্রিক দেশ নয় প্রথমা, এখানে রাজতন্ত্র চলে।’ বললেন গিরিরাজ, ‘এদিকে রাজা আমাকে বলেছেন, আংটিগুলো মালব্যনগরের হেরিটেজ। উদ্ধার করে দিতে না পারলে আমাকে পদত্যাগ করতে হবে।’

প্রথমা নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল। বেশ গন্ডগোলের সিচুয়েশান। হাতে সময়ও নেই।

গিরিরাজ দেওয়ালে লাগানো মনিটরের দিকে আঙুল দেখালেন। তারপরে রিমোট টিপলেন।

প্রথমা বুঝতে পারল, এটা নজরদারি ক্যামেরায় রেকর্ড করা মিউজিয়ামের দৃশ্য। মনিটরের এক কোণে লেখা রয়েছে, ‘ক্যাম ওয়ান।’ তারপর সাল, তারিখ এবং সময়। পাঁচটা সাত মিনিট থেকে ক্লিপ চালু হল।

ফাঁকা মিউজিয়াম। কোনও লোক নেই। কোনও শব্দ নেই। পাঁচটা আট মিনিটে একটা হাত মনিটরের ওপরে পড়ল। তারপর মনিটর কালো হয়ে গেল। এবং পরবর্তী দশ মিনিট মনিটর কালোই রইল। এগারোতম মিনিটে মনিটরে আবার মিউজিয়ামের অভ্যন্তর দেখা যাচ্ছে। এক সিকিয়োরিটির হাতে কালো একটি কাপড়। তিনি উত্তেজিত হয়ে ওয়াকি টকিতে কথা বলছেন। অন্য সিকিয়োরিটিরা দৌড়ে আসছেন। পঞ্চবাণ নেই দেখে ঘর থেকে দৌড়ে বেরোচ্ছেন…।

প্রথমা খুব মন দিয়ে ক্লিপিংটা দেখল। তারপর বলল, ‘আবার গোড়া থেকে চালান।’ গিরিরাজ আবার রিমোট টিপলেন।

পাঁচটা সাত মিনিট। ফাঁকা মিউজিয়াম। কোনও লোক নেই। কোনও শব্দ নেই। পাঁচটা আট মিনিটে মনিটর কালো হয়ে গেল। প্রথমা ফিশফিশ করে বলল, ‘শুনুন!’

গিরিরাজ বললেন, ‘কী?’

‘চোখ বন্ধ করে শুনুন।’

গিরিরাজ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘শিস শোনা যাচ্ছে। আই নো দিস সং! দিস ইজ আ বেঙ্গলি লাভ সং!’

প্রথমা বলল, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির গান। ‘এই রাত তোমার আমার।’ গায়ক ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানের শুরুতে খানিকটা শিস আছে। চোর সেই শিসটা দিচ্ছে।’

গিরিরাজ বললেন, ‘চোর শিস দিতে দিতে আংটি চুরি করেছে। হায় রে কপাল!’

প্রথমা বলল, ‘আপনি আমার কাছে কী চাইছেন?’

গিরিরাজ ফ্যাকাশে হেসে বললেন, ‘আমার মন্ত্রীত্বটা বাঁচিয়ে দাও।’

‘ওই পাঁচজন সম্পর্কে যা জানেন বলুন। কী নাম, কী করেন, কোথায় থাকেন, পুলিশ রেকর্ড আছে কি না, কোনও লাভ ইন্টারেস্ট, বদভ্যাস… আই মিন এভরিথিং।’

গিরিরাজ প্রথমার দিকে নিজের স্মার্টফোন এগিয়ে দিলেন। প্রথমা দেখল স্ক্রিনে একটি ফোটোগ্রাফ। পাঁচজন বছর ত্রিশের ছেলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন থামস আপ করছেন।

গিরিরাজ বললেন, ‘যে ছেলেটি থামস আপ করছেন তাঁর নাম অজয় মণ্ডল। ওঁর ডানদিকে পরপর দাঁড়িয়ে সন্দীপ হালদার, বিমল ঘোষ, দেবাশিস রায় আর মনোজ সরকার। এঁরা সবাই ইন্ডোলজির স্টুডেন্ট। কারও কোনও পুলিশ রেকর্ড নেই। কারও কোনও লাভ ইন্টারেস্ট নেই। বদভ্যাসের কথা জানা নেই।’

‘এরা থাকতেন কোথায়?’

‘সব ইন্ডোলজিস্টই মালব্যনগরে এসে জেফ্রি মুরের কাছে পেয়িং গেস্ট থাকেন।’

‘তিনি আবার কে?’

‘জেফ্রি এক খ্যাপাটে ইন্ডোলজিস্ট। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। বিয়ে-থা করেননি। পণ্ডিত মানুষ। মালব্যনগরে বাড়ি করে এ দেশেই থেকে গেছেন। দিন-রাত আদিনাথ ক্যাসিনোয় পড়ে থাকেন। যেসব ছেলেরা ইন্ডোলজি নিয়ে পড়তে মালব্যনগরে আসেন, তাঁদের পেয়িং গেস্ট রাখেন। রোজগারের একটা বড় অংশ পোকার খেলে উড়িয়ে দেন।’

‘জেফ্রি মুর…’ বিড়বিড় করে প্রথমা, ‘উনি মেয়ে পেয়িং গেস্ট রাখেন না?’

গিরিরাজ মাথা চুলকে বললেন, ‘আমার কাছে খবর আছে, হি ইজ আ গে।’

‘লোকটার সম্পর্কে আর কোনও তথ্য?’

‘আর কিছু জানা নেই,’ ঘড়ি দেখলেন গিরিরাজ। ‘বাই দ্য ওয়ে, ওই পাঁচজন এখন ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে বসে রয়েছেন। ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র পঁচিশ মিনিট বাকি।’

প্রথমা বলল, ‘দেখছি।’ তারপর দরজা ঠেলে বেরোল।

মালব্যনগর স্টেশানের ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে অনেকগুলো টেবিল চেয়ার রয়েছে। পাঁচটি চেয়ারে বসে স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত পাঁচ বন্ধু। এদের মধ্যে কোনও একজনের ব্যাকপ্যাকে রাখা আছে পঞ্চবাণ!

প্রথমা একটু আগে দেখা ছবির সঙ্গে মুখগুলো মিলিয়ে নিল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘হাই! আমি প্রথমা!’

‘তো?’ মুখ তুলে বললেন অজয়।

প্রথমা গভীর শ্বাস নিল। সে এখন এঁদের সঙ্গে একটা মাইন্ড গেম খেলবে! একটা জুয়া! লাগলে তুক! আর না লাগলে…

চোখের তারায় সম্মোহন ফুটিয়ে অজয়ের চোখে চোখ রেখে প্রথমা বলল, ‘আপনারা তো জেফ্রিকে চেনেন।’

‘জেফ্রি মুর?’ জানতে চাইলেন বিমল। পাঁচজনই অবাক হয়ে প্রথমার দিকে তাকালেন।

কণ্ঠস্বরে মাপা উত্তেজনা এনে প্রথমা বলল, ‘আমার জীবনের একটা ঘটনা আমি আপনাদের বলতে এসেছি। ঘটনার শুরু আজ ভোরবেলায়। আমি তখন আদিনাথ হোটেলের ক্যাসিনোয় পোকার খেলছিলাম। ভোর চারটে নাগাদ দেখলাম যত টাকা নিয়ে ক্যাসিনোয় ঢুকেছিলাম, তা শেষ হয়ে গেছে। ঠিক করলাম, আর নয়।’

প্রথমাকে থামিয়ে সন্দীপ বললেন, ‘আপনি কি আমাদের কাছে টাকা চাইতে এসেছেন?’

দেবাশিস বললেন, ‘আপনি প্লিজ এখান থেকে যান। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে।’

মনোজ হাতঘড়ির দিকে তাকালেন।

প্রথমা বলল, ‘প্লিজ আমার কথা পুরোটা শুনুন।’

পাঁচ বন্ধু একে অন্যের দিকে তাকিয়ে শ্রাগ করলেন। অজয় বললেন, ‘বলুন!’

প্রথমা বলল, ‘রাস্তার ধারের ক্যাফেতে বসে আমি কফি আর চিজ স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলাম। এমন সময়ে আমার পাশে এসে বসলেন বছর পঁয়তাল্লিশের এক সাহেব। মোবাইলে উত্তেজিত হয়ে কাউকে বলছিলেন যে পোকার খেলতে গিয়ে অনেক টাকা খুইয়েছেন। ওঁর কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। ভদ্রলোক ফোনালাপ শেষ করে মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাসলেন কেন?’ আমি বললাম, ‘জুয়া খেলে কখনও টাকা রোজগার করা যায় না। এটা জেনেও আমরা জুয়া খেলি। এটা অদ্ভুত না?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘খুবই অদ্ভুত। তবে আরও অদ্ভুত হল যে মহিলার নাম জানি না তার সঙ্গে গল্প করা। বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম জেফ্রি মুর।’ করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘আমার নাম প্রথমা লাহিড়ী।’

‘লাভ স্টোরি শোনাচ্ছেন নাকি?’ বিমল মুখ ভেটকে বললেন।

প্রথমা ব্লাশ করল। মাথা নিচু করে বলল, ‘ভোরবেলায় ক্যাফেতে আর কেউ নেই। জেফ্রি আর আমি গল্প করছি। আলোচনা ঘুরে যাচ্ছে ক্যাসিনো থেকে পাশা খেলায়। জুয়া থেকে মহাভারতে। সেখান থেকে ইন্ডোলজিতে। জেফ্রির পাণ্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করছে। ওঁর সান্নিধ্যে আমার মন ভরে যাচ্ছে। গল্প করতে করতে সকাল পেরিয়ে দুপুর। কথায় কথায় জেফ্রি জানালেন, তিনি ইন্ডোলজিস্ট, মালব্যনগরেই বাড়ি কিনেছেন। ইন্ডোলজি স্টুডেন্টদের পেয়িং গেস্ট রাখেন, পোকার খেলতে ভালোবাসেন। গল্পে গল্পে সময় কেটে গেল। আমরা ক্যাফে ছেড়ে বেরোলাম। আমি তখন জেফ্রির প্রেমে পড়ে গেছি। ওকে ‘আপনি’ না বলে ‘তুমি’ বলছি।’

‘ইন্টারেস্টিং!’ বললেন দেবাশিস।

প্রথমা বলল, ‘দু’জনে পাহাড়ি পথ দিয়ে হাঁটছিলাম। রাস্তার ধারের জঙ্গল থেকে বুনোফুল তুলে জেফ্রির হাতে দিয়ে বললাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি জেফ্রি!’ ও ফুলের তোড়া নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘দেখো প্রথমা, সোজা কথাটা গোড়াতেই বলে দেওয়া ভালো। আমি সমকামী। এবং আমি আমার এক ছাত্রকে ভালোবাসি।’

পাঁচ বন্ধু একসঙ্গে প্রথমার দিকে তাকালেন। কারও চোখে অবিশ্বাস, কারও চোখে সন্দেহ, কারও চোখে রাগ। প্রথমা বলল, ‘প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আমি ব্যাপারটা খুব স্পোর্টিংলি নিলাম। কারও সেক্সুয়াল প্রেফারেন্স অন্য রকম হলে আমার আর কী করার আছে? তবে সেই প্রেমিককে খুব হিংসে হল। আমি জেফ্রিকে বললাম, ‘তোমার প্রেমিক খুব ভাগ্যবান। আমি তাঁকে একবার দেখতে চাই।’ জেফ্রি বলল, ‘ওরা পাঁচ বন্ধু ইন্ডোলজি নিয়ে পড়াশুনো করতে মালব্যনগরে এসেছিল। আজই মালব্য এক্সপ্রেসে ইন্ডিয়া ফেরত যাচ্ছে।’

সন্দীপ, অজয়, মনোজ, দেবাশিস আর বিমল একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। সকলের চোখে অবিশ্বাস আর সন্দেহ।

প্রথমা বলল, ‘আমি জেফ্রিকে বললাম, ‘আমি ওঁকে একবার দেখতে চাই। কথা দিচ্ছি, বিরক্ত করব না।’ জেফ্রি বলল, ‘নাম বলব না। ওদের মধ্যে যে ছেলেটি ভালো শিস দেয়, সেই-ই আমার প্রেমিক। স্টেশানে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করে এসো।’

প্রথমা চুপ করে গেল। সে দেখতে পাচ্ছে, গোল টেবিল ঘিরে বসে থাকা পাঁচজনের মধ্যে চারজন এখন পঞ্চম জনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। অজয়, মনোজ, দেবাশিস আর বিমল তাকিয়ে রয়েছেন সন্দীপের দিকে। চারজন কোনও কথা না বললেও চোখ-মুখের অভিব্যক্তি বলছে, ‘সন্দীপ, তুই হোমো? জানতাম না তো!’

প্রথমা হাসল। বলল, ‘ধন্যবাদ। এবার আপনারা যেতে পারেন।’

পাঁচ বন্ধু ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে এগোচ্ছে। হঠাৎ রেলরক্ষী বাহিনীর এক কর্মী সন্দীপকে দাঁড় করিয়ে ব্যাকপ্যাক কেড়ে নিল। শুরু করল তল্লাশি। গিরিরাজও চলে এসেছেন। তিনি ব্যাকপ্যাক থেকে বার করে আনলেন ছোট্ট একটি চামড়ার পাউচ। পাউচ খুলতেই বেরিয়ে এল পাঁচটি আংটি। পঞ্চবাণ!

সন্দীপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

প্রথমা হোটেলে ফিরে স্নান করে টিভি খুলে বসেছে, এমন সময়ে গিরিরাজের ফোন এল। প্রথমা বলল, ‘বলুন।’

গিরিরাজ বললেন, ‘বাকি চার বন্ধু চলে গেছে। ওদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সন্দীপের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশান নিয়ে আমরা কিছু জানি না। আমরা শুধু জানতে চেয়েছিলাম, কে ভালো শিস দিতে পারে।’

‘ভালো করেছেন।’

‘রাজা এবং রানি—দুজনেই ফোন করেছিলেন,’ বললেন গিরিরাজ, ‘হেরিটেজ ফেরত পেয়ে রাজা খুশি। আর বাংলার মানুষকে অমর্যাদা না করে চোর ধরা হয়েছে বলে রানিও খুশি। তোমার জন্যে আমার মন্ত্রীত্ব গেল না। ধন্যবাদ প্রথমা!’

প্রথমা হাসতে হাসতে বলল, ‘আমাকে নয়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ দিন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *