পহেলি পেয়ার
হাঁটা পথে মাইল তিনেক পড়ত। পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে একঘণ্টার পথ। টাঙায় গেলে পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট।
মাঝে মাঝেই যেতাম পাশের বাড়ির ভোমরা-ভাবির জন্যে সুর্মা কিনতে, কী আতর কিনতে। কখনো-বা যেতাম বারাণসী মঘাই পান খেতে।
সন্ধেবেলা পুরো জায়গাটার চেহারাটাই পালটে যেত। গোঁফে আতর মেখে ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি পরে, সাদা-কালো বাদামি ঘোড়ায়-টানা একলা এক্কা চালিয়ে কতশত নবাবেরা আসতেন। নানারকম নবাব।
দোতলা বাড়িগুলোর মহলে মহলে ঝাড়লণ্ঠন জ্বলত। জর্দার খুশবু, সারেঙ্গির গজ-এর গুমরানি, অশান্ত ঘোড়ার পা-ঠোকার পৌনঃপুনিক আওয়াজ এবং তারই সঙ্গে মাঝে মাঝে বারান্দায় হঠাৎ ঝলক ঝলক দেখা দেওয়া সুগন্ধি শরীরিণী। কেয়া ফুলের গন্ধ যাদের চুলে, জিন-পরির মায়া যাদের চোখে; পান খেয়ে ঢোক গিললে যাদের ফর্সা স্বচ্ছ গলার নীল শিরা-উপশিরারা লাল হয়ে যায়, সেইসব কতশত নাম জানা না-জানা সুন্দরীদের; গায়িকাদের।
এরা কেউ সকালবেলায় গান গায় না। আশ্চর্য! সমস্ত মহল্লা ঘুমিয়ে থাকে সকালে। গত রাতের বাসিফুলের স্মৃতি নিয়ে। ফরাশে ইতস্তত তাকিয়া ছড়ানো থাকে। ক্লান্ত সারেঙ্গি গা-খুলে শুয়ে থাকে। জানলা দিয়ে কোনো ভিনদেশি মাছি এসে তারে তারে চমকে চমকে নেচে বেড়ায়। অলস হাওয়ায় পিড়িং পিড়িং করে একলা ঘরে ঘরে সুর পাখনা নাড়ে। কোনো তওয়ায়েফ-এর পেলব গা-ঘেঁষে শুয়ে থাকা কাবুলি বেড়ালটি, হয়তো ঘুম ভেঙে এসে ম্যায়ফিলের ঘরে হাই তুলে বলে, ‘মিয়াঁও, মিয়াঁও, মুঝে কুছ তো পিলাও।’
অথচ, যেমনি পাঁচটা বাজে, যখন দোতলা বাড়িগুলির ও পথের পাথরে পাথরে রৌদ্রের উষ্ণতাটা থাকে শুধু, আলোর পরশ যখন মুছে যায়, পথে পথে টাঙাগুলো যখন মাতালের মতো টলতে টলতে ঝুমঝুমি বাজিয়ে চলে, তখন এ মহল্লাতে এবং মহল্লার চারদিকে হঠাৎই একটা ব্যস্ততা পড়ে যায়। ফুলওয়ালা, ডিমওয়ালা, কাবাবওয়ালা, ইত্বরওয়ালা সকলেই তৈরি হতে থাকে রাতের জন্যে। বাঁয়া-তবলাতে ঠুকঠুক আওয়াজ ওঠে। জোড়া তানপুরা বাঁধা হয়।
বিকেল থাকতে থাকতেই মুজাব্বর বাগানে ঢোকে ফুল তুলতে। আমাদের মছিন্দার বাড়ির বাগানে। মুজাব্বর আমাদের খিদমদগার রহমানের ভাইপো।
আমি তখন কলেজে পড়ি। গরমের ছুটিতে মছিন্দাতে গেছি। উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর শহরের কাছেই মছিন্দা। মির্জাপুর থেকে এলাহাবাদ যাওয়ার পথের ওপরে। বাড়িতে ঠাকুমা আছেন শুধু। বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দিরে পূজা দেন। গঙ্গায় স্নান করেন এবং আমাকে ভালোটা-মন্দটা রেঁধে খাওয়ান।
পড়াশুনা করতে চাই। নিজেকে বার বার শাসন করি; বকি, কিন্তু দুপুর থেকে যেই ঝুরঝুর করে গাছের পাতায় পাতায় হাওয়া দেয়, শুকনো পাতা ওড়ে, টিয়া পাখির ঝাঁক ‘ট্যাঁ-ট্যাঁ-ট্যাঁ’ করে তীক্ষ্ণ স্বর ছড়িয়ে গঙ্গার দিক থেকে উড়ে আসে, অমনি মনটা উদাস উদাস লাগে। পথ বেয়ে মছিন্দার পথে ভাড়ার টাঙা টুংটুঙিয়ে চলে। পড়া আর হয় না। বারান্দার চেয়ারে বসে মুজাব্বরের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকি। বইয়ের পড়ার বাইরেও যে অনেক পড়াশুনা থাকে, যে পাঠ জীবন থেকে নিতে হয়, সেইসব পড়াশুনোর জন্যে তীব্র আকুতি জাগে।
রোজ মুজাব্বর ফুল তোলে। শুধুই গোলাপ। লাল গোলাপ। কাঁটা মুড়িয়ে ডাঁটা ভাঙে। তারপর ঝুলি ভরে নিয়ে চলে যায় মির্জাপুরে। তওয়ায়েফদের মহল্লায়। ঘরে ঘরে ফুল দেয় ও। ওকে রোজ দেখি আর ঈর্ষা হয়।
ঠাকুমা ঘরের ইজিচেয়ারে বসে গুনগুনিয়ে অতুলপ্রসাদের গান করেন।
‘‘আমার বাগানে এত ফুল, তবু কেন চলে যায়? তারা চেয়ে আছে তারি পানে, সে তো নাহি ফিরে চায়…..’’
আমি মুজাব্বরের জগতের কথা ভাবি আর কৌতূহলে কাঁদি। মুজাব্বর আমার চেয়ে সামান্যই বড়ো হবে, অথচ পৃথিবীর ও কত জানেশোনে; কত বোঝে!
সকালে ও যখন আমাকে পথ দেখিয়ে পাহাড়ে তিতির মারতে নিয়ে যায় তখন ওকে আমার কাছের মানুষ বলে মনে হয়। কিন্তু যেই বিকেল হয়ে আসে, হাসনুহানার গন্ধ হাওয়ার সঙ্গে মিশে বুকের মধ্যে মোচড় দিতে থাকে ; অমনি ও যেন আমার কাছ থেকে হঠাৎই অনেক দূরে চলে যায়। ও যেন মুহূর্তের মধ্যে অনেকই বড়ো হয়ে যায়। আমার গুরুজন হয়ে ওঠে। ও যে জগতে প্রবেশ করে, সে জগতের চৌকাঠ মাড়ানোর কোনো উপায়ই নেই আমার। সেই মুহূর্তে, প্রতিদিনই মুজাব্বরকে আমার বড়ো ঈর্ষা হয়।
একদিন ওকে কথাটা বলেই ফেললাম। কিন্তু প্রথমে ও কিছুতেই রাজি হল না। বলল, গুণ্ডা বদমাশ আছে। মির্জাপুর বহতই খতরনাক জায়গা! একমানুষ লম্বা লাঠি নিয়ে লোকে পথে-ঘাটে চলাফেরা করে। তুমি কী করতে যাবে সেখানে তওয়ায়েফ মহল্লায়? বড়া খানদানের পড়া-লিখা করা ইনসান। তা ছাড়া ঠাকুমা জানলে কেলেঙ্কারি হবে। আমার চাকরি তো যাবেই, কাকার চাকরিটাও যাবে।
কিন্তু আমি ওর প্রায় পা ধরতে বাকি রাখলাম।
শেষকালে আমায় নাছোড়বান্দা দেখে ও বলল, আচ্ছা। চলো, কাল চলো।
মুজাব্বর যে-সময়ে যায়, তেমনি সময়েই আগে চলে গেল। ওর নির্দেশমতো যথাসময়ে পানের দোকানটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকান-জোড়া আয়না। নানা লোকে পান কিনছে। মিঠি-মিঠি বলছে। লখনউ-র লোকের মতো মির্জাপুরের লোকদেরও বড়ো মিঠি জবান। আয়নায় নিজের মুখের ছায়া পড়তেই দেখলাম, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়ার আগে যেমন লাগে, তেমন লাগছে। কান গরম। এমন সময় মুজাব্বর এল এবং মনে হল, ওই যেন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র।
ও আসতেই ভয়টা প্রায় উবে গেল। রইল শুধু কৌতূহল।
এগোতে এগোতে মুজাব্বর বলল, টাকা এনেছ?
—টাকা কীসের?
—টাকা না তো তারা কি তোমার সুরত দেখে গান শোনাবে?
এটা তো সত্যিই ভাবিনি আগে।
বললাম, সঙ্গে দশ টাকার একটা নোট আছে। ঠাকুমা জন্মদিনে দিয়েছিলেন।
ও হাসল। বলল, ঠিক আছে। দশ টাকায় শুধু মুখই দেখতে পাবে। গান শোনা আর হবে না।
খুবই মনক্ষুণ্ণ হলাম। তখন তো আর কিছু করারও নেই। তা ছাড়া বেশি টাকা আমি পাবই-বা কোথায়?
যেসব লোক ও-পথে আসছিল-যাচ্ছিল, তারা আমায় দেখে অবাক হচ্ছিল। দু-একজন কীসব মন্তব্য-টন্তব্যও করল। হেসে উঠল।
মুজাব্বর তাদের একটুও পাত্তা না দিয়ে আমাকে নিয়ে একটি বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। দোতলায় উঠে গেল। চকমিলানো বাড়ি। ভেতরে চাতাল। তার চারপাশে দোতলা ঘোরানো বারান্দা। কোনো ঘরের দরজা বন্ধ। কোনো ঘরের দরজা খোলা। কয়েকটি ঘর থেকে সারেঙ্গির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, গান শোনা যাচ্ছিল।
মুজাব্বর বলল, সব ঘরে ঢুকে কী করবে? সবাইকে দেখলে ভালো লাগবেও না। যাকে দেখলে ভালো লাগবে তার ঘরেই নিয়ে যাব তোমাকে।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ও যে-যে ঘরে মেহেমান এসেছেন সে-সে ঘরে ফুল দিয়ে এল।
তারপর আমাকে নিয়ে সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে পাশের বাড়িতে পৌঁছে সটান দোতলায় উঠে একটি ঘরে ঢুকে পড়ল। ঘর মানে ফ্ল্যাটের মতো। একটির বেশি ঘর আছে। মধ্যে একটুখানি প্যাসেজ। সেই প্যাসেজ পেরিয়ে গিয়েই একটি বিরাট ঘরে গিয়ে পৌঁছোলাম। পৌঁছেই থমকে দাঁড়ালাম।
ধবধবে ফরাশ পাতা মোটা গদির ওপর। দেওয়ালে হেলানোভাবে টাঙানো আয়না। আয়নার নীচে সারি সারি দেওয়া দুধসাদা তাকিয়া। একটার পর একটা সাজানো। মাথার ওপর থেকে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে।
একটি ছিপছিপে মেয়ে আমাদের দিকে পেছন ফিরে জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়েছিল। ফুল সাজানো বেণিটি পিঠ থেকে টান টান হয়ে ঝুলে ছিল নীচে। জানলা দিয়ে কিছু দেখছিল বোধ হয়। এদিকে মুখ না ফিরিয়েই শুধোল, কওন?
—ম্যায়, মুজাব্বর।
—কই মেইমান নেহি আঁয়ে হেঁ, তো ম্যায় ফুলোঁসে ক্যা কঁরু?
মুজাব্বর আবার সংকোচের সঙ্গে ডাকল, বাই!
এবার মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল। আমার মনে হল, ঝাড়লণ্ঠনের আলো ম্লান হয়ে গেল। তার দু-চোখে এত ঔজ্জ্বল্য, তার দু-চোখ ঠিকরে এত আলো বেরোচ্ছিল যে, তাতে আমার চোখের সামনের সবকিছুই ম্লান হয়ে গেল। অবাক হলাম। আমি যেমন বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে ওর দিকে চেয়েছিলাম ও-ও তেমনি চোখে আমার দিকে চেয়ে দেখে।
ওর পক্ষে অবাক হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আমার বাপ-ঠাকুরদা কেউ কোনোদিন বাইজি-বাড়ি যায়নি। তাদের সে পাপ অথবা পুণ্যের কোনো ছাপ হয়তো আমার চেহারায় ছিল। তা ছাড়া, আমি তাজমহল দেখবার চোখ নিয়ে তার কাছে গেছিলাম। মুরগির মাংস খাবার চোখ নিয়ে যাইনি। ও হয়তো এই ‘নিপট-আনাড়ির’ চোখে এমন কিছু আবেদন দেখেছিল যার জন্যে ও অবাক হয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল।
এসে মুজাব্বরকে শুধোল, এ কে রে?
মুজাব্বর অপরাধীর মতো বলল আমার চাচার মনিবের ছেলে। গান ভালোবাসে খুব। তাই আপনার গান শুনতে এল। বারণ করেছিলাম কিছুতেই শুনল না। কিন্তু ওর টাকা নেই। মানে, মাত্র দশ টাকা আছে।
মেয়েটি টুন্ডা-প্রপাতের মতো ঝরঝরিয়ে হেসে উঠল। সাদা দাঁতে আর নখে হিরের আলো চমকাল। তারপর থমকে গিয়ে আবারও চমকাল।
বেণি থেকে একটা বেলফুল খসে পড়ল হাসির দমকে।
হাসতে হাসতে সে-মেয়ে বলল, ‘আয়া মেরি মেহমান।’ তারপর কৌতুকের চোখে শুধোল, কিতনা উমর হোগা আপকি?
—সতেরো বছর।
ও বলল, ম্যায় ভি বিশ সালকি। মগর, কিতনা ফারাক।
তারপর মেয়েটি হঠাৎ আত্মীয়তার সুরে বলল ‘আইয়ে আইয়ে, তসরিফ রাখিয়ে, আপকি পুরি তারিফ তো মুঝে বাতলাইয়ে?’
আমি যেমন বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে ওর দিকে চেয়েছিলাম ও-ও তেমনি চোখে আমার দিকে চেয়ে দেখে ।
বেশ কেটে কেটে আমার নাম বললাম। সত্যি নাম গোপন করলাম না। আমার বেশ রাগই হচ্ছিল। ও ভেবেছেটা কী? দেখতে না-হয় সুন্দরীই, গানও না-হয় ভালোই গায়; রাজারাজড়া লোক না-হয় ওর পায়ের কাছে মাথা কোটেই। তা বলে আমাকে অমন নস্যাৎ করার কী আছে, জানি না।
আমি বললাম, গান শোনার মতো আমার টাকা নেই। শুধু দেখতে এসেছি। এবার মেয়েটি হাসতে হাসতে, কাঁপতে কাঁপতে, বেলজিয়ান দেওয়াল-আয়নার মতো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ফরাশের ওপর যেন ছড়িয়ে পড়ল। তার অগণ্য টুকরোটাকরা ফরাশময় প্রতিসরিত হতে লাগল।
সে বসে কুর্নিশ করে বলল, আদাব! আদাব! বড়ি মেহেরবানি আপকি।
বসবার জন্যে জোর করাতে, বসলাম সংকোচের সঙ্গে; ফরাশের ওপর।
মুজাব্বর দাঁড়িয়ে রইল।
মেয়েটি তেমনি অবাকচোখে আবার শুধোল, আপভি খুদ গানা গাতে হেঁ?
বললাম, থোড়া বহত।
বড়ি খুশিকি বাত।
ম্যায় গানা শুনাউঙ্গি আপকো, জরুর শুনাউঙ্গি, মগর আপকাভি গানা শুনানা পড়েগা।
চমকে উঠলাম। বললাম, আমি বাথরুমে গাই, নইলে একা একা গাই। ম্যায়ফিলে গাইবার উপযুক্ত গান আমি জানি না।
মেয়ে তবু নাছোড়বান্দা।
সে বলল, এই ঘরও আপনার বাথরুম মনে করে নিন-না কেন?
মহা মুশকিলেই পড়লাম। গান শুনতে এসে মহা ফ্যাসাদে ফাঁসলাম।
তওয়ায়েফ চাকরকে ডেকে পান আনতে বলল এবং অন্য চাকরকে বলল দরজা বন্ধ করতে।
মুজাব্বর বাইরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াচ্ছিল, অবাক ও-ও কম হয়নি। হঠাৎ আমার কী মনে হল, মুজাব্বরকে বললাম, তোমার থলিতে আজ কত গোলাপ আছে? ও-বলল, তা না হলে দশ টাকার তো হবেই।
বললাম, তোমার সব গোলাপ আজ আমি কিনে নিলাম। ও অবাক হয়ে গোলাপের থলি উপুড় করে ফরাশে ঢেলে দিল। এবং বাইজি নির্বাকে আমার দিকে চেয়ে রইল।
বাইজি হাততালি দিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে যেন মন্ত্রবলে সারেঙ্গিওয়ালা হারমোনিয়ামওয়ালা এবং তবলচি এসে উদয় হল। বাইজি আমার আরও কাছে সরে এসে বসল। অত কাছ থেকে এ বয়সে মা-ঠাকুমা দিদি ছাড়া আর কোনো মেয়েকেই দেখিনি। আজও আমার চোখে সে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা হয়ে আছে। সরু কোমর, কবুতরি বুক এবং বুদ্ধিদীপ্ত চঞ্চল চাউনির মুখ। অনেক সুন্দরী আজ অবধি দেখলাম কিন্তু অমনটি আর দেখলাম না।
সারেঙ্গিওয়ালার গজের টানে টানে কত কী অব্যক্ত বেদনা, কথা গান সব বাজতে লাগল। ঠুংরির ঠাঁট-বাট, সুরের লচক, গায়িকার মুখের ভাব, কাঠঠোকরার মতো আমার চোখ কান ঠোকরাতে লাগল।
ও পেছনের আয়নায় একবার নিজের চেহারার দিকে বিমুগ্ধ নয়নে চাইল। তারপর শরৎ সকালের মতো চোখ মেলে আমার চোখে চাইল। আমার মনে হল এ চাউনি জাদুর খেপলাজাল ছেঁড়া চাউনি নয়। অন্যক বাঁধবার চাউনি এ নয়। ও যেন নিজেই বাঁধা পড়ে গেছে। হয়তো আমার অভাবনীয় সারল্যে, আমার সাবলীল স্পর্ধায় ও নিজেকে পুষ্পিত করে তুলেছে; মঞ্জরিত। সেই মুহূর্তে ওর নকল আমিকে ছাপিয়ে ওর আসল আমি ওর ওপরে আধিপত্যবিস্তার করে ফেলেছে যে, তা আমি বুঝতে পেলাম। আঁট করে চুল বাঁধা নার্সারি ক্লাসের ছটফটে মেয়ে তার ক্লাসের সহপাঠীর দিকে যেমন স্বর্গীয় চোখে চায়, সেই সুগন্ধি সন্ধ্যায় জেওহর-বাই আমার দিকে তেমনি চোখে চেয়ে রইল।
আমাকে প্রায় ধমকে বলল, অব শুরু কিজিয়ে।
আমি বললাম, না। আগে নয়।
—না। আপনি আগে।
আবদার করে মাথা নাড়ল ও।
বুড়ো সারেঙ্গিওয়ালা বলল, ‘অব শুরু কিয়া যায়।’
তারপর শরৎ সকালের মতো চোখ মেলে আমার চোখে তাকাল।
কী গান গাইব ভেবে পেলাম না। হঠাৎ মনে এল মির্জা গালিবের চারটি লাইন। তাতেই সুর বসিয়ে গেয়ে দিলাম।
‘‘বুঢ়া না মান গালিব—
যো দুনিয়া বুঢ়া কহে,
অ্যায়সাভি কোই হ্যায় দুনিয়ামে
সবহি ভালাকহে যিসে?’’
কেন জানি না, ওর চোখে চেয়ে আমার মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবী ওকে খারাপ আখ্যা দিয়ে ওর এই কুড়ি বছরের মনটাকে একেবারে দুখিয়ে রেখেছে। ও যে ভালো নয়, ওর যে কিছুই ভালো নেই, মনে হল সে বিষয়ে ও নি:সন্দেহই হয়ে গেছে। তাই মনে হল গালিবের কথায় ওকে বলি যে, এখনও সব ফুরোয়নি; আশা আছে। এখনও ভালো লাগা আছে, এতবড়ো পৃথিবীতে এখনও ভালো লাগার, ভালোবাসার অনেক কিছুই আছে। শরীরের স্বর্গ পেরিয়েও আরও অনেক মহতী স্বর্গ আছে। কাজেই অমন কান্না-কান্না চোখে চাইবার কিছুই হয়নি।
কী হল জানি না, কী করলাম জানি না। কেমন গাইলাম তাও জানি না। কিন্তু জহরের কানে সে-গান কী কথা যে, বয়ে নিয়ে গেল তা সে-ই শুধু জানে।
গান শেষ হলে ও কোনো কথাই বলল না। কেবল মুখ নীচু করে নীরবে আমাকে বার বার আদাব জানাল। দু-চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল ঝরতে লাগল ওর।
ঠিক এইরকম যে হবে, তা ভাবিনি। আমি গান শুনে ভালো লাগায় কাঁদতে এসেছিলাম, গান শুনিয়ে কাউকেই ব্যথায় কাঁদাতে চাইনি। ভারি খারাপ লাগতে লাগল আমার।
জেওহর ওর নরম হাতে আমার হাত ধরল। চোখের দিকে চেয়ে দেখলাম সেইসব গর্ব, কৌতুক, মজাক কিছুই আর নেই চোখে। জলভরা চোখে অন্য কী যেন আছে। যার নাম আমি জানি না।
ফিসফিসে ধরা গলায় জেওহর বলল, ভাইসাব আপকি তহজিব, আপকি একলাক, ঔর আপকি তমদ্দুন কি ইজ্জত কিয়া যায় অ্যায়সি কুছভি হামারি পাস হ্যায় নেই। ম্যায় মাফি মাংতি হুঁ।…….
এইটুকু বলেই ও ঘর ছেড়ে সোজা উঠে ভেতরের ঘরে গিয়ে দুয়ার বন্ধ করল।
আমি বোকার মতো বসে থাকলাম। বসে বসে ভাবতে লাগলাম। ও যা বলল, সে কথাগুলো আমার কানে টুনি পাখির শিসের মতো বাজছিল। ভাইসাহেব, তোমার সংস্কৃতি, তোমার উদারতা, তোমার ব্যবহারের ইজ্জত দেব এমন কিছুই আমার নেই। আমায় তুমি ক্ষমা কোরো।
আর এলই না ঘর থেকে জেওহর বাই।
অনেকক্ষণ বসে থেকে চলে এলাম মুজাব্বরকে নিয়ে।
ভালো-মন্দ জানি না। জানি, ‘জেওহর’ মানে বিষ। আমিও কি বিষ? জেওহরের বিশ বছর। আগেকার দিনের সুন্দরী রাজকুমারীদের মতো আংটির বিষ চুষে মরে যায় না কেন জেওহর? কী দরকার এমন করে কাঁদার? এক শরীরের জ্বালা কি অন্য শরীরের জ্বালা দিয়েই নিবৃত্ত করতে হয়? এর কি কোনো অন্যপথ নেই?
জানি না।
আর কতটুকুই-বা জানি। মুজাব্বরকে রোজ জিজ্ঞেস করি। জেওহরকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। একবার ওর কাছে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মুজাব্বর বলেছে জেওহর গুণ্ডাদের বলে রেখেছে যে, আর কোনোদিন আমাকে ও-পাড়ায় নিয়ে গেলে মুজাব্বরকে জানে খতম করে দেবে।
জানি না কেন? ওর কথা মনে হলেই মনটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে।
কেন যে জেওহর ওরকম বলল গুণ্ডাদের তা কে জানে!
‘বিরহী’ নদীতে প্রতিদিনই বিকেলে জেলেরা মাছ ধরে। মাছ কিনতে গেছি। সেদিন মাছ পাওয়া যায়নি। সন্ধে হয়ে আসছে। পা চালিয়ে মছিন্দার দিকে ফিরছি। জায়গাটা ভালো নয়।
উলটো দিক থেকে একটি ফিটন গাড়ি আসছিল। একটি কুচকুচে কালো মস্ত ঘোড়ায়-টানা। মাথায় বাক্স-তোরঙ্গ বাঁধা। কোচোয়ানের পাশে একটি গুণ্ডামতো লোক বসে। তার মাথায় পাগড়ি। হাতে ছ-ফিট লম্বা লাঠি।
আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ওই ফিটন থেকে হঠাৎই একটা পুরুষকন্ঠ বলল, বাবুজি!
থমকে দাঁড়ালাম। কোচোয়ানের পাশের লোকটিকে চেনা চেনা লাগল। একটুক্ষণ তাকাতেই চিনতে পারলাম। এ সেই, সেই-রাতের সারেঙ্গিওয়ালা। বিচিত্রবীর্য লোক যা হোক!
ফিটনের দরজা খুলে গেল। একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘মির্জা গালিব, কাঁহা চলতেঁ হেঁ আপ?’
দেখি জেওহর হাসছে।
আজকে ও সাজেনি একটুও। অতিসাধারণ শাড়ি। সুন্দর টিকালো নাকে একটি হিরের নাকছাবি। ফিনফিনে কালো ফিঙের মতো রেশমি, উজ্জ্বল চুল। বিকেলের বিষণ্ণ হাওয়ায় অলক উড়ছে। তার চোখের সুর্মা আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণতাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
শুধোলাম, কোথায় যাচ্ছ? জেওহর?
জেওহরের মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ও যেন এই মুহূর্তে আমাকেই ভীষণভাবে খুঁজছিল।
হেসে বলল, কোথায় আর যাব? এক জাহান্নম থেকে অন্য জাহান্নমে। যাবে তুমি আমার সঙ্গে? তা হলে বেহেস্তেও যেতে পারি। জিন্নতে; ফিরদৌস-এ।
ওকে দেখে এবং বলার ভঙ্গি দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হল।
হঠাৎই বলে ফেললাম, তোমাকে আমি যদি যেতে না দিই? যদি আমাদের বাড়ি নিয়ে যাই?
ও ভীষণ চমকে উঠে আমার ঠোঁটে ডান হাতের তর্জনীটি ছুঁইয়ে বলল, ‘চুপ। বিলকুল চুপ। অ্যায়সা বাঁতে কভি না কহনা; কভি না শোচনা।’
কিছুক্ষণ ফিটনের দরজা ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বললাম, তুমি তো চলে যাবেই। চলোই-না একটু বিরহীর ধারে বসবে?
পরমুহূর্তেই মনে পড়ল এ জায়গা ভালো নয়। ডাকাতদের আস্তানা এ। বললাম, না না দরকার নেই, এ জায়গা খারাপ।
ও নামতে নামতে হাসল। বলল, আমি যেখানে থাকি তার চেয়েও? খারাপ হলেও খুদাহ ঠিকই আছেন। অ্যাইসি কোই জাগে বাতাদো যাঁহা খুদাহ না হো।
আমরা দু-জনে গিয়ে বিরহীর পাশের আমলকী গাছের তলায় বসলাম। গঙ্গা থেকে তোড়ে জল ঢুকছে বিরহীতে। এখন জোয়ার। একটি একলা মাছরাঙা শেষবিকেলে মেহেন্দিরঙা জলে ছোঁ মেরে মেরে বেড়াচ্ছে।
বললাম, তোমার গান শুনতে গেলাম, গান শোনালে না তো!
—আমার গান শুনে আর কী করবে? ও তো সকলকেই শোনাই। যে পয়সা দেয়, তাকেই শোনাই।
—আর যে ফুল দেয়? শুধু লাল ফুল?
ও বড়ো এক বিষণ্ণ হাসি হাসল, বলল, তাকে আমি আর কী দেব? বলো? আমি যে ময়লা-কুচলা, বদনসিব এক জেনানা। আমি যে জেওহর!
বললাম, তোমাকে গান শোনালাম, ফুল দিলাম, তুমি আমাকে কিছুই দিলে না।
ও মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, কিছুই দিইনি কি? ঠিক জানো?
আমি মাথা নাড়লাম।
গঙ্গার দিক থেকে একঝাঁক রেড-হেডেড পোচার্ড অস্তগামী সূর্যকে পেছনে ফেলে ডানা শনশনিয়ে দূরের বিলের দিকে উড়ে গেল।
আমরা দু-জনে চুপ করে অনেকক্ষণ পাশাপাশি বসে রইলাম। দেখতে দেখতে বিরহীর জলের মেহেন্দিতে সন্ধের জামরঙা বেগুনি ছায়া পড়ল।
জেওহর উঠল। বলল, ‘চলি’।
ধীরে ধীরে গাড়ি অবধি গেলাম দু-জনে। দরজা খুলে দিলাম, ফিটনে উঠে বসল ও।
আবার কবে দেখা হবে? আমি শুধোলাম ওকে।
—জানি না; কোনোদিন আর নাও হতে পারে। জেওহর বলল।
—আমাকে কিছু দিয়ে যাও জেওহর, যাতে তোমাকে মনে রাখি।
কোচোয়ান জিভ আর তালু দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করে ঘোড়াকে এগোতে বলল, পা দিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে। জেওহরের বিদায়ের ঘণ্টা। চাকা গড়াতে লাগল।
সারেঙ্গিওয়ালা বলল, সালাম বাবুজি।
আমি বললাম, সেলাম।
আমি ফিটনের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। আবার বললাম, কিছুই দিয়ে গেলে না জেওহর? আমাকে তুমি কিছুই দিলে না।
জেওহর এবার হাতের ইশারায় আমাকে কাছে আসতে বলল। ওর আরও কাছে সরে গেলাম, চলতে চলতে। ওর খোলা চুলে চন্দনের গন্ধ পেলাম।
ও আমার কানে কানে বলল, তুমি এখন ছোটো আছ। যা তোমাকে দিয়েছি, তার দাম, আরও বড়ো হলে বুঝতে পারবে।
তবু অধৈর্য হয়ে আমি বললাম, বলো-না তা কী?
জেওহর কান্নার মতো হাসল।
তারপর দরজায় রাখা আমার হাতের ওপর ওর হাতটি ছুঁইয়ে, সন্ধেবেলার আলোর মতো নরম উদ্ভাসে বলল ‘পহেলি পেয়ার’।