পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে আসুন
কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণে ফলে পশ্চিমবঙ্গে পর্যটন শিল্পের আশানুরূপ উন্নতি না ঘটায় এই রাজ্যের কল্যাণকামী ব্যক্তিমাত্রেরই মনে গভীর ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ অভন্তরীণ পর্যটন উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান শ্রীনিত্যচরণ সহায় জানান, কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক যে আলাপ আলোচনা হয়েছে তাতে পশ্চিমবঙ্গে পর্যটক আকর্ষণ বৃদ্ধির একটা সুরাহা হবে বলেই তিনি আশা রাখেন।
‘পশ্চিমবঙ্গ অভ্যন্তরীণ পর্যটন উন্নয়নের পথে’, শ্রীনিত্যচরণ বলেন, ‘একটা প্রধান অন্তরায় হচ্ছে যে এই রাজ্যে ভালো আরকিওলজিক্যাল রুইনস বা প্রাচীন স্থাপত্যের কোনও আকর্ষণীয় ভগ্ন নিদর্শন এতদিন ছিল না। ফলে উত্তর ভারত, পশ্চিম ভারত বা দক্ষিণ ভারতের মতো পর্যটক আকর্ষণ আমরা করতে পারছিলাম না। এ বিষয়ে আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য বিহার বা ওড়িষাও আমাদের চাইতে ঢের বেশি ভাগ্যবান। কারণ কোনারক, ভুবনেশ্বরের মন্দিরগুলোর তুলনায় আমাদের বিষ্ণুপুর বা গৌড়ের ভগ্ন নিদর্শনগুলো অপেক্ষাকলত নিষ্প্রভ।
‘কাজেই আমাদের মোডাস অপারেনডি ছিল, প্রাকৃতিক সম্পদ দেখিয়ে পর্যটকদের প্রলুব্ধ করা সেদিক দিয়ে আমাদের হাতে তুরুপের টেক্কা ছিল ওই এক দার্জিলিং।’
সবিনয়ে শ্রীনিত্যচরণ সহায় মহাশয়কে জানালাম, ‘আমাদের জলদাপাড়া গোরুমারার জঙ্গলও কম আকর্ষণীয় নয়।’
‘পশ্চিমবঙ্গ অভ্যন্তরীণ পর্যটন উন্নয়নের চেয়ারম্যান হিসাবে আমি অবশ্যই একশবার আপনার মত সমর্থন করব। কিন্তু অ্যাজ এ টুরিস্ট, আমার সামনে যদি আসামের কাজিরাঙ্গা এবং ডুয়ার্সের জলদাপাড়ার মধ্যে একটাকে বেছে নেবার প্রশ্ন ওঠে, তখন? অ্যাজ এ টুরিস্ট আপনি কোনটার পক্ষে রায় দেবেন? অনেস্টলি বলুন তো?’
আমাকে শ্রীনিত্যচরণের কথার সারবত্তা স্বীকার করতেই হল।
শ্রীনিত্যচরণ বললেন, ‘আমাদের মুশকিলটা কোথায়, এবার বুঝতে পারলেন তো।’ সত্যিই বুঝতে পারলাম এবং বললাম, ‘তাহলে তো দেখছি, পশ্চিমবঙ্গে পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার।
আমার কণ্ঠস্বরে গভীর হতাশা ছড়িয়ে পড়তে দেখে শ্রীনিত্যচরণ আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, ‘আরে মশাই, এটা একটা চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্প আজ একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তাতে হয়েছে কি? এখনই এত ভেঙে পড়ার কী হয়েছে? আমরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। এবং কেমন করে আমাদের এই রাজ্যে পর্যটকদের আকর্ষণ করা যায় তার উপায় উদ্ভাবনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন পর্ষদের অধীনে দেশ বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে রিসার্চ ডিভিশন খুলেছি।’
ভদ্রলোকের মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠতে দেখে আমার মনেও আশার সঞ্চার হল। আমি উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুরাহা কিছু হল?’
‘না হয়ে উপায় আছে?’ শ্রীনিত্যচরণ আমার মনোবলকে চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করলেন। ‘আমাদের রিসার্চ ডিভিশন কী আবিষ্কার করেছে জানেন?’
উত্তেজনায় আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। রুদ্ধকণ্ঠে জানতে চাইলাম, ‘কী আবিষ্কার করেছেন মশাই, রুইনস্?’
শ্রীনিত্যচরণ হাসতে হাসতে বললেন, ‘রুইনস্ বলুন কি ধ্বংসাবশেষ বলুন, বা আপনার ইচ্ছে। তবে আমরা যা পেয়েছি না, একেবারে ইউনিক, পৃথিবীর আর কোথাও এ জিনিস নেই। সেনসেশন্যাল ডিসকভারি মশাই।’
‘কোথায়! কোথায়! সুন্দরবনে নাকি?’
শ্রীনিত্যচরণ বললেন, ‘প্রায় কাছাকাছি। একটা নয় মশাই, আমরা দু দুটো ধ্বংসাবশেষ পেয়েছি। শুনলে অবাক হবেন, তার একটা একেবারে কলকাতার দুয়োরে।’
আমার বিস্ময় এবার একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গেল। কোনোমতে বলে উঠলাম, ‘কোন শতাব্দীর?’
শ্রীনিত্যচরণ বললেন, ‘আন্দাজ করুন? ‘
বললাম, ‘ষষ্ঠ? পঞ্চম? চতুর্থ? তৃতীয়?’
শ্রীনিত্যচরণ বললেন, ‘তবে আর ইউনিক বলব কেন? অনুমান করুন, অনুমান করুন।’ বললাম, ‘তবে কি খ্রিস্টপূর্ব কোনও শতকের? না কি বুদ্ধেরও আগেকার কোনও কালের?’ শ্রীনিত্যচরণ বললেন, ‘আরে না মশাই না। তাতে আর সেনসেশন্যাল কি আছে? পুরনো জিনিসে এত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে না। এই সব ধ্বংসাবশেষ একেবারে হাল আমলের। তাজা টাটকা সব ভগ্ন নিদর্শন। আমরা ইতিমধ্যেই যে নমুনা সমীক্ষা করেছি, তাতে দেখা গিয়েছে বিংশ শতাব্দীর এইসব অত্যাশ্চর্য ধ্বংসাবশেষ দেখবার জন্য পর্যটক মহলে অধিকতর আগ্রহ দেখা দিয়েছে।’
এক পরিসংখ্যান দাখিল করে তিনি দেখালেন যে কোনারক, খাজুরাহ দেখতে যেখানে শতকরা পঁচিশ ভাগ পর্যটক যায়, সেখানে তাঞ্জোর, মহাবলীপুরমের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে শতকরা একুশ, তাজমহল শতকরা ৫৮.২ এবং পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক ধ্বংসাবশেষ দেখতে চেয়েছেন ১১২.৫ শতাংশ পর্যটক।
‘তবেই বুঝুন’, শ্রীনিত্যচরণ বললেন, ‘আমাদের চাহিদা এখন কোথায় উঠেছে। আবার পশ্চিমবঙ্গের দুটো আধুনিক ধ্বংসাবশেষের মধ্যে হলদিয়ার তৈল শোধনাগার, পেটরো-কেমিক্যাল এবং জাহাজ নির্মাণ প্রকল্পের অত্যাশ্চর্য রুইনস্ দেখবার চাহিদাই বেশি।’
‘দ্বিতীয় রুইনস্টা কোথায়?
শ্রীনিত্যচরণ বললেন, ‘কেন দমদমে। দমদম ছাড়া পৃথিবীতে আর কোথাও তো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রুইনস্ নেই। পর্যটক আকর্ষণের এমন চাঞ্চল্যকর রুইনস্ দুটো পশ্চিমবঙ্গের হাতে তুলে দিতে কেন্দ্র এতদিন টালবাহানা করছিলেন। এই বিমাতৃসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী এবং শিল্প ও পর্যটন মন্ত্রী যুগপৎ ক্রমাগত দিল্লি-কলকাতা নিয়মমাফিক পর্যটনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে থাকায় কেন্দ্র এখন সুবিধাজনক শর্তে রুইনস্ দুটো পশ্চিমবঙ্গের হাতে তুলে দিতে স্বীকৃত হয়েছেন। এতদিনে এই রাজ্যে পর্যটনের হিড়িক পড়বে। পড়বেই।’
৬ মার্চ ১৯৭৪