পশ্চাদ্দেশে দিল এক কামড়
ময়মনসিংহের হর্ষ ডাক্তার ছিলেন এলএমএফ। তবে তাঁর বেশ পসার ছিল। ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা হর্ষবাবু রুগি দেখে বেড়াতেন। ছোটখাটো, খুব ফরসা, মৃদুভাষী মানুষ। হঠাৎই শোনা গেল তাঁর এক মেয়ের সঙ্গে আমার জ্যাঠতুতো বড়দার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তখন আমার বয়স বড়জোর বছর পাঁচ বা ছয়।
সেই বিয়েতে আমি ছিলাম নিতবর। তবে বিয়ে দেখার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বউদির সঙ্গে প্রথম দেখা বউভাতের দিন, সকালে। মহিলা-পরিবৃতা হয়ে বউদি বড় ঘরের মেঝেতে মাদুরের ওপর বসে ছিল। বড়দা আমাকে কোলে তুলে ঝপাস করে নতুন বউদির কোলে বসিয়ে দিল। বউদি সস্নেহে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আর আমি বউদির মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁ, এত সুন্দর কোনও মানুষ হয়? যেমন ফরসা রং, তেমনই টানা টানা চোখ, নাক আর মুখের ডৌল। বউদির রূপের কথা মুখে মুখে ছড়িয়েও গিয়েছিল। শুধু একটু বেঁটে ছিলেন। তা আমার জ্যাঠতুতো দাদারাও বেঁটেই। কাজে, বউদি ও দাদার জোড় ভালই মিলেছিল। গল্পটা অবশ্য বউদির নয়, টমির। বউদির বাপের বাড়িতে দুটো সাদা রঙের দিশি হাউন্ড কুকুর ছিল। টমি আর ভমি। দুজনের মধ্যে এক জন অর্থাৎ টমি, বউদির সঙ্গেই আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিল। বেশ লম্বা-চওড়া, বলবান কুকুর। তেমনই তেজ।
কুকুর ভালবাসতাম বলে টমির সঙ্গে ভাব হতে সময় লাগল না। বউদির যেমন বাধ্য ছিল সে, আমারও তেমনই বশ মেনেছিল। তবে, তেজস্বী, রাগী ও মারমুখো টমির জন্য বাড়িতে কিছু অশান্তি শুরু হল। অচেনা লোক, বেড়াল, নেড়ি কুকুরের পাল, কাকপক্ষী, ফিরিওয়ালা— কেউ আমাদের বিশাল উঠোন ও প্রান্তরওলা বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে পারত না। টমি সড়ালে কুকুর, হাঁকডাক কম, কিন্তু চকিতে বাঘের মতো তেড়ে গিয়ে আক্রমণে জুড়ি নেই। বাড়ি আসার ক’দিনেই পাড়ার নেড়ি কুকুরদের কয়েকটা তার কামড়ে ঘায়েল হয়। ধোপা কাপড় নিতে এসে পোঁটলা নিয়ে যেই বেরতে যাচ্ছে, টমি বিনা নোটিসে তার পশ্চাদ্দেশে এমন কামড় বসাল যে, বেচারা হাউমাউ করে সে কী কান্না! বাড়ির বেড়ালরা টিনের চালে আশ্রয় নিল। কেউ কেউ পাড়াছাড়া হল। প্রতিবেশিরাও আসা প্রায় বন্ধ করে দিল।
কেউ কেউ পরামর্শ দিল, শিকলে বেঁধে রাখার। কিন্তু শিকল পরানোর পর তার বিরক্তি ও লম্ফঝম্পে বিরক্ত হয়ে জ্যাঠামশাই-ই বোধহয় খুলে দিতে বললেন। টমির প্রধান দোষ ছিল ঘেউ ঘেউ না-করা। সে শব্দ করা পছন্দ করত না, হঠাৎ আক্রমণই ছিল স্বভাব।
অমন সাদা ধপধপে কুকুর বড় একটা দেখা যায় না। তখনই আমার বুক-সমান উঁচু। পেশিশক্তিও যথেষ্ট। অন্য পাড়ার কুকুর প্রথম প্রথম তার সঙ্গে দল বেঁধে লাগতে এলেও একা টমির প্রবল প্রতি-আক্রমণে তারা গো-হারা হেরে, রক্তাক্ত হয়ে পালানোর পথ পেত না।
পাড়ার ভদ্রলোকেরা আমাকে রাস্তায় পেলে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা একটা গুন্ডা কুত্তা পুষছ নাকি? কামটা ভাল করো নাই।
টমি দিশি কুকুরদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু জাতের। আমি অবশ্য আগাগোড়া টমির কীর্তিকলাপ লক্ষ করার সুযোগ পাইনি। বাবা-মা, দিদির সঙ্গে বাবার কর্মস্থলে চলে যেতে হল। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন ময়মনসিংহে বেড়াতে আসতাম, টমির সে কী উল্লাস! লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে আহ্লাদ প্রকাশ করত। কিন্তু তার বিরুদ্ধে রাজ্যসুদ্ধ লোকের অভিযোগ। কত লোককে যে কামড়েছে, হিসেব নেই। তার ভয়ে আমাদের বাড়ি অনেকেই বয়কট করে বসে আছে।
কিন্তু টমিকে আমার দুষ্টু কুকুর বলে কখনও মনে হত না। তাকে মাংস বা পুষ্টিকর কিছুই খাওয়াতাম না। এঁটোকাঁটা খেত। ভাতের সঙ্গে ডাল বা মাছের ছিবড়ে-জাতীয় নিকৃষ্ট খাবার। তবু পরাক্রম কখনও হ্রাস পায়নি। যদিও শক্তিতে হয়তো ধীরে ধীরে ভাটা পড়ছিল। কুকুরের পুষ্টি নিয়ে ভাবনার চল তো তখনও হয়নি। এক বার গিয়ে দেখলাম, টমির পিছনের বাঁ পায়ের গাঁটটা লাল হয়ে ফুলে আছে এবং সে একটু লেংচে হাঁটছে। এ যুগে হলে টমিকে পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু তখন পশু চিকিৎসকেরও বড্ড অভাব ছিল।
পাড়ার যে সব কুকুরকে সে আঁচড়ে-কামড়ে পাড়া-ছাড়া করেছিল, তারা প্রায়ই দল বেঁধে তার ওপর হামলা করত। টমি একলা বীরপুরুষ। সে একা দশ জনের সঙ্গে বরাবরের মতোই লড়াই করেছে। কিন্তু বয়স হচ্ছিল। আগের ক্ষমতা আর ছিল না। আমার সামনেই বারবাড়ির মাঠের এক ধারে শুকনো নালায় তাকে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আট-দশটা কুকুর। আমি লাঠি নিয়ে ছুটে গিয়ে বিস্তর চেষ্টায় তাকে উদ্ধার করি বটে, কিন্তু তত ক্ষণে তার প্রায় সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত। হ্যা হ্যা করে হাঁফাচ্ছিল। বাড়িতে গিয়ে আয়োডিন-টায়োডিন দেওয়া হল। সেটা ঠিক চিকিৎসা হল না। বুঝতে পারছিলাম, টমির বয়স হচ্ছে। বড়দা চাকরি পেয়ে বউদিকে নিয়ে চলে গিয়েছে। হর্ষ ডাক্তারবাবু মারা গেছেন। টমির দিকে নজর দেওয়ার কেউ নেই। শেষে টমিকে শিকল পরালাম। আপত্তি করল না। যেমন ঝিমোচ্ছিল, তেমন ঝিমোতে লাগল। বাকিটা থাক। ওটা উচ্চারণ করার দরকার কী!