ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

পশুরাজের বিদ্রোহী প্রজা

পশুরাজের বিদ্রোহী প্রজা

রাজতন্ত্রের ইতিহাসে দেখা যায়, প্রবল প্রতাপশালী নরপতির রাজত্বেও একশ্রেণির স্বাধীনচেতা মানুষ বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে ভয় পায় না। মহারাজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মুখ বুজে মেনে নিয়ে রাজস্বের দাবীকে রাজার প্রাপ্য বলে স্বীকার করে না এই বিদ্রোহী প্রজার দল এবং রাজশক্তির প্রবল আক্রমণে যখন পৃথিবীর বুক হয় রক্ত-রঞ্জিত, তখনও ওই ভয়ংকর মানুষগুলো মৃত্যুপণ করে শূন্যে উড়িয়ে দেয় বিদ্রোহের উদ্ধত পতাকা। অসি ও ভল্লের শাণিত আস্ফালন অথবা কামান-বন্দুকের অগ্নিবৃষ্টি কিছুতেই সেই উদ্যত ও উদ্ধত ধ্বজাকে মাটিতে নামিয়ে আনতে পারে না, বরং বিদ্রোহী প্রজাশক্তির তীব্র আক্রমণে একসময় মহারাজের মহিমা হয় ধূলায় লুষ্ঠিত!

মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে পশুজগতের কিছু কিছু মিল আছে। উদাহরণস্বরূপ পশুরাজ সিংহের কথাই যদি ধরা যায়, তবে বলতে হয় যে, তার রাজ্যপাট খুব নিষ্কণ্টক নয়। এই প্রসঙ্গে অবশ্য ভারতবর্ষের গির অরণ্যের রাজ-পরিবারের কথা ধর্তব্য নয়। কারণ সেখানে সিংহের সংখ্যা খুব কম, আর পশুরাজের রক্তচক্ষুকে অবজ্ঞা করতে পারে এমন কোনো শক্তিশালী জানোয়ার সেখানে বাস করে না; বিশেষত ভারতীয় বনরাজ্যের বিভীষিকা ভোরাদার বাঘ ওই অরণ্যে অনুপস্থিত। অতএব ভারতীয় সিংহরা বেশ নির্বিঘ্নেই রাজত্ব করে, এবং নিরীহ পশুদের ঘাড় ভেঙে মনের সুখে মাংসের খাজনা আদায় করে দিন কাটায়।, আফ্রিকার সিংহ কিন্তু তার ভারতীয় জ্ঞাতি-ভাইদের মতো ভাগ্যবান নয়। নিজের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য তাকে দস্তুরমতো লড়াই করতে হয়। আফ্রিকার অরণ্যে অ্যান্টিলোপ, জেব্রা, জিরাফ, না প্রভৃতি যেসব তৃণভোজী জন্তু ঘুরে বেড়ায়, তারা সকলেই সিংহের খাদ্য তালিকার অন্তর্গত। নিজের দেহ দিয়ে ক্ষুধার্ত রাজার আহার যোগাতে তারা কিন্তু মোটেই ইচ্ছুক নয়, তাই সঙ্গী-সাথীরা যখন সিংহের অতর্কিত আক্রমণে মৃত্যুবরণ করে, তখন এই সব জানোয়ার খুব চটপট পা চালিয়ে দূরে সরে যায়, কখনো রুখে দাঁড়িয়ে রাজার অপমান করে না। তৃণভোজী মাত্রেই যদি এমন রাজভক্ত প্রজা হত, তবে সিংহের বরাতে দুঃখ ছিল না। কিন্তু কয়েকটি উদ্ধত তৃণভোজী জানোয়ার পশুরাজকে বিনা প্রতিবাদে রক্তমাংসের খাজনা দিতে চায় না।

আফ্রিকার মহিষাসুর কেপ-বাফেলো, খঙ্গধারী গন্ডার এবং বিপুলবপু হস্তী সিংহকে রাজার প্রাপ্য সম্মান দিতে নিতান্তই নারাজ।

সচল পর্বতের মতো হস্তিযূথ যখন বনপথ ধরে এগিয়ে যায়, তখন স্বয়ং পশুরাজ সপরিবারে তাকে রাস্তা ছেড়ে দেয়।

একটু তর্জন-গর্জন সে করে বটে, তবে হাতিরা তাতে মোটেই বিচলিত হয় না। রাজ-মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলেও সিংহরা হস্তিযুথের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না, কারণ যুদ্ধের পরিণাম যে রাজ-পরিবারের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা সেখানে নেই।

গণ্ডারের সান্নিধ্যও সিংহ এড়িয়ে চলে। সুযোগ বুঝলে গণ্ডার-শাবকের উপর সে আক্রমণ চালায় বটে, তবে এই হত্যাকাণ্ড গণ্ডার-জননীর দৃষ্টিগোচর হলে সিংহের মৃত্যু অবধারিত। গণ্ডারের কঠিন বর্মের মতো দেহচর্ম ভেদ করে সিংহের নখদন্ত গভীর ও মারাত্মক ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু গণ্ডারের খঙ্গ অনায়াসেই পশুরাজের দেহটিকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারে। গণ্ডার, মহিষ প্রভৃতি তৃণভোজী পশুর আক্রমণে মাংসাশী পশুরাজের প্রাণ বিপন্ন হওয়ার ঘটনা নিতান্ত বিরল নয়। পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর পথ খোলা থাকলেও, আক্রান্ত হলে পশুরাজ রণে ভঙ্গ দেয় না। যুদ্ধক্ষেত্রে তার নীতি, হয় মারো, নয় মরো!

রাজকীয় বৈশিষ্ট্য সন্দেহ নেই।

প্রত্যক্ষদশীর বিবরণী থেকে এই ধরনের একটি ঘটনা তুলে দিচ্ছি।

বনের পথ ধরে ভ্রমণ করতে করতে জনৈক শিকারির চোখে পড়ল, সরু বনপথের উপর তার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে একটি মস্তবড়ো কেশরধারী সিংহ*। [*কেশরধারী বিশেষণটি ব্যবহার করলুম এইজন্য যে, সাধারণত পুরুষজাতীয় সিংহের মাথায় কেশর থাকলেও প্রকৃতিদেবী কখনো কখনো সিংহকে কেশরের শোভা থেকে বঞ্চিত করেন। অবশ্য এই কেশরহীন সিংহের সংখ্যা খুব কম। আর আমরা জানি, সিংহীর মাথায় কখনোই কেশর হয় না।] একটু লক্ষ্য করে শিকারি দেখলেন, নিকটবর্তী অরণ্য ভেদ করে যে মহিষটি এগিয়ে আসছে, সিংহের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে তারই দিকে। মহিষ এগিয়ে এসে সিংহের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং নাক দিয়ে ভোস ভোস শব্দ করে পশুরাজকে পথ ছেড়ে দিতে ইঙ্গিত করল। সিংহ পথ ছাড়ল না। বোধ হয় সে ভাবল, রাজা যদি প্রজাকে রাস্তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, তবে আর রাজ-মর্যাদা রইল কোথায়? অতএব দাঁত খিঁচিয়ে সে মহিষকে দিল এক প্রচণ্ড ধমক!

কোনো মাংসাশী শ্বাপদের ধমক-ধামকে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্র নয় আফ্রিকার কেপ-বাফেলো। সজোরে মাটিতে পা ঠুকে মহিষ জানিয়ে দিল, ভালো চাও তো সরে যাও।

সিংহ আবার গর্জে উঠল, মহিষও অচল অটল।

 কিছুক্ষণ ধরে চলল একই দৃশ্যের অবতারণা।

কোনো পক্ষই পিছিয়ে যেতে রাজি নয়।

অবশেষে মহিষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, রুদ্রমূর্তি ধারণ করে সে ছুটে এল সিংহের দিকে। আর সঙ্গেসঙ্গে কী! তুচ্ছ তৃণভোজীর এত বড়ো স্পর্ধা!! সিংহ সগর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ল মহিষের উপর…

তারপর কিছুক্ষণ ধরে চলল দাঁত আর নখের সঙ্গে শিংয়ের বোঝাঁপড়া… অবশেষে আহত ও রক্তাক্ত দেহ নিয়ে পশুরাজ হল মৃত্যুশয্যায় লম্বমান এবং বিজয়ী বীরের মতো সর্বাঙ্গে রক্তের আলপনা বহন করে রণস্থল ছেড়ে সগর্বে প্রস্থান করল মহিষ- আফ্রিকার ভয়ংকর কেপ-বাফেলো!

শিকারি ইচ্ছা করলে মহিষকে গুলি চালিয়ে হত্যা করতে পারতেন, কিন্তু সিংহজয়ী বীরকে গুলি করার প্রবৃত্তি তার হয়নি।

এই লড়াইটা খাদ্য-খাদকের লড়াই নয়, এ লড়াই মানের লড়াই, ইজ্জতের লড়াই!

বন্য পশুদের মধ্যেও আত্মসম্মানবোধ বিলক্ষণ জাগ্রত। তবে মানুষের মতো বিভিন্ন উপায়ে সম্মানবোধ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার সুযোগ তাদের নেই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাবোধ প্রমাণ করতে হয় শৃঙ্গ ও খুরের কঠিন প্রহারে, দন্ত ও নখরের মারাত্মক আলিঙ্গনে। অরণ্য-জগতে শক্তিই একমাত্র যুক্তি!

সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে শুধুমাত্র প্রাধান্য বিস্তারের জন্যও অনেক সময় যুদ্ধের অবতারণা হয়। বিখ্যাত শিকারি জে. হান্টার একদিন আফ্রিকার বনপথে একটি জলহস্তী ও গণ্ডারের মৃতদেহ দেখতে পান। জলহস্তীর দেহে গণ্ডারের খঙ্গ করেছে কয়েকটি বৃহৎ ও রক্তাক্ত ছিদ্রের সৃষ্টি এবং শত্রুর করাল দন্তের আঘাতে গণ্ডারের পৃষ্ঠদেশ হয়েছে ছিন্নভিন্ন!

দুটি জানোয়ারই তৃণভোজী, কাজেই প্রাণধারণের তাগিদে খাদ্য ও খাদকের লড়াই এটা নয়। কার শক্তি বেশি, বনপথে কার প্রাধান্য থাকবে, এই প্রশ্নের মীমাংসা করতেই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল।

অর্থাৎ বন্য পশুরাও অনেক সময় প্রাণের চাইতে মান রাখাটাই বেশি প্রয়োজন মনে করে। এই ঘটনার প্রসঙ্গে হান্টার সাহেব বলেছেন,.. সম্পূর্ণ অনর্থক দ্বন্দ্বযুদ্ধে দুজনে প্রাণ দিয়েছে বটে, কিন্তু এর সঙ্গে যে মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।

হান্টার সাহেবের ওই বিবরণীতে গণ্ডার ও জলহস্তী ঘটিত সমাচার পাঠ করলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, পশুরাজের যাবতীয় প্রজা খুব শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট নয়। এমন সব বদমেজাজী প্রজা নিয়ে রাজত্ব করা কী সহজ কাজ?

জলবাসী সরীসৃপ কুম্ভীরের সঙ্গেও সিংহের সম্পর্ক খুব মধুর নয়। কুমির সাধারণত জলের ভিতর থেকে জলপানরত পশুকে আক্রমণ করে, তবে অনেক সময় শিকার না পেলে ক্ষুধার্ত সরীসৃপ জলাশয় বা নদীগর্ভ ত্যাগ করে জঙ্গলের মধ্যেও শিকারের খোঁজে হানা দেয়। জেব্রা, অ্যান্টিলোপ, প্রভৃতি জানোয়ার ডাঙার উপর এমন অভাবনীয় বিপদের জন্য প্রস্তুত থাকে না– ঘন ঘাস-ঝোপের ভিতর থেকে একটা গাছের গুঁড়ি যখন হঠাৎ একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের ফাঁদে শিকারকে চেপে ধরে, তখন বেচারার উদ্ধার পাওয়ার সমস্ত চেষ্টাই নিষ্ফল হয়ে যায়। শিকারের দেহটাকে কঠিন দংশনে বন্দি করে কুমির তখন ছুটতে থাকে তার আস্তানার দিকে এবং একটু পরেই জলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায় শিকার ও শিকারি।

পশুরাজ নিজের এলাকার মধ্যে জলবাসী সরীসৃপের এই গুণ্ডামি সহ্য করতে চায় না। তাই ডাঙার উপর সিংহ ও কুমিরের শুভদৃষ্টি ঘটলেই সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকে।

উইলসন বি. মেনার্ড নামক জনৈক শিকারি আফ্রিকার জাম্বেসি নদীর তীরবর্তী অরণ্যে এই ধরনের এক যুদ্ধের পরিণাম স্বচক্ষে দর্শন করেন।

নদীগর্ভ থেকে অনেক দূরে জঙ্গলের মধ্যে যেখানে লড়াই শুরু হয়েছিল, সাহেব যখন সেখানে পদার্পণ করেন তখন সিংহ ও কুমিরের বোঝাঁপড়া শেষ হয়ে গেছে। এখানে প্রথম কে আক্রমণকারীর ভূমিকা নিয়েছিল বলা মুস্কিল, তবে কোনো পক্ষই যে জয়লাভ করতে পারেনি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সিংহের নীচের পাটির চোয়াল আর বুকের কিছু অংশ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং নখদন্তের আপ্যায়নে কুমিরের সর্বাঙ্গ হয়েছিল ক্ষতবিক্ষত। দুই যোদ্ধার প্রাণহীন দেহ টান হয়ে পড়েছিল মাটির উপর!

তবে বনের রাজা ও জলের রাজার মধ্যে এই ধরনের সংঘর্ষ খুব কমই হয়। হস্তী, গণ্ডার ও মহিষের সঙ্গেও সিংহ সহজে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না। ওই সব তৃণভোজী পশু সিংহকে দেখলেই রণং দেহি মূর্তি ধরে রুখে দাঁড়ায়, আর পশুরাজ অধিকাংশ সময়ে অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করে মান বাঁচিয়ে সরে পড়ে। হস্তী, গণ্ডার বা মহিষ গায়ে পড়ে লড়াই করতে চায় না। সিংহ নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলেই তারা সন্তুষ্ট থাকে।

কিন্তু পশুরাজের রাজত্বে এমন একটি জীব আছে, যার সামনে থেকে পালিয়ে গিয়েও পশুরাজ নিস্তার পায় না। এই ভয়ংকর জীবটি হচ্ছে আফ্রিকার বন্য কুকুর।

সমগ্র অরণ্যের বুকে সন্ত্রাসের রাজত্ব ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় এই বুনো কুকুরের দল এবং হস্তী, গণ্ডার ও বন্য মহিষ ছাড়া সব জানোয়ারই এই সারমেয়-বাহিনীকে যমের মতো ভয় করে। অ্যান্টিলোপ, ন্যু, জেব্রা প্রভৃতি পশু প্রায়ই বুনো কুকুরের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই কুকুরগুলো মাইলের পর মাইল অনায়াসে ছুটতে পারে, তাই অত্যন্ত দ্রুতগামী জন্তুও এই ভয়ংকর মৃত্যুদূতদের ফাঁকি দিতে পারে না।

লেপার্ডের মতো হিংস্র পশুও এই বুনো কুকুরের দলকে ভয় পায়। তবে শ্বাপদ-বাহিনীর। আক্রমণে লেপার্ড বড়ো একটা বিপন্ন হয় না, কারণ চটপট গাছে উঠে সে অনায়াসেই কুকুরদের কলা দেখাতে পারে।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বোধ হয় বলা দরকার। বাংলা ভাষায় লেপার্ডকে চিতা বলা হয়, কিন্তু তা ভুল। বাংলায় লেপার্ডের কোনো প্রতিশব্দ আছে বলে জানি না। চেহারায় কতকটা মিল থাকলেও চিতা ও লেপার্ড, দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের জানোয়ার। চিতা একটু ভীরুস্বভাবের, লাজুকও বলা যেতে পারে। কিন্তু লেপার্ড ঠিক তার বিপরীত উগ্র ভয়ংকর দুর্দান্ত।

পশুরাজ সিংহ লেপার্ডের ন্যায় বিড়ালজাতীয় পশু হলেও তার ফোঁটাকাটা জাতভাইয়ের মতো গাছে ওঠার বিদ্যাটাকে আয়ত্ত করতে পারেনি। তাই সারমেয়-বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হলে, পলায়ন অথবা পালটা আক্রমণ ছাড়া সিংহের আত্মরক্ষার অন্য কোনো উপায় থাকে না। এই ধরনের একটি ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছিলেন বিখ্যাত শিকারি জে. হান্টার। তার লিখিত বিবরণী থেকে উদ্ধার করে ঘটনাটা এখানে সংক্ষেপে বলা হল।

সাঁজোয়া গাড়ি চালিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলের পথে ভ্রমণ করছিলেন হান্টার সাহেব, তাঁর সঙ্গী ছিলেন একজন ভারতীয় মহারাজা। আচম্বিতে তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য।

বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপর দিয়ে পলায়মান এক সিংহের পিছনে তাড়া করে ছুটছে একদল বুনো কুকুর!

দলটা বেশ বড়–কুড়ি অথবা আরও কিছু বেশি সংখ্যক কুকুর নিয়ে দলটা তৈরি হয়েছে। মি. হান্টার এবং মহারাজা গাড়ির ভিতর থেকেই সমস্ত ঘটনাটা দেখতে ইচ্ছুক হলেন। ধাবমান সিংহ ও সারমেয় বাহিনীকে অনুসরণ করে গাড়ি কয়েক শো গজ এগিয়ে গেল এবং তারপরই আরোহীরা গাড়ি থামিয়ে দিলেন। কারণ অনুসরণ-পর্ব তখন শেষ হয়ে গেছে। পশুরাজ সিংহ এবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে!

দশটি কুকুর দল ছেড়ে এগিয়ে এসেছিল, অর্থাৎ সারমেয়-বাহিনীর তারাই হল প্রধান যোদ্ধা।

সিংহ একবার দিক পরিবর্তন করে বাঁচার চেষ্টা করল, কিন্তু অগ্রবর্তী ছয়টি কুকুর সিংহের পলায়নের পথ আটকে দাঁড়াল। পশুরাজের অবস্থা দেখে শিকারিরা বুঝলেন, মাইলের পর মাইল ছুটে সিংহ হাঁপিয়ে পড়েছে, তার আর ছুটোছুটির ক্ষমতা নেই।

কুকুরগুলো কিন্তু একটুও ক্লান্ত হয়নি। হিংস্র দন্ত বিস্তার করে তারা পশুরাজকে ঘিরে ফেলল। সিংহ বুঝল, পালিয়ে প্রাণ বাঁচানো যাবে না। ভীষণ ক্রোধে সে একবার গর্জন করে উঠল, তারপর আশ্রয় গ্রহণ করল একটা কাটা গাছের নীচে।

ক্রুদ্ধ সিংহের সেই ভয়াল সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তার দীর্ঘ লাঙ্গুল চাবুকের মতে আছড়ে পড়ছে ভূমিপৃষ্ঠে এবং অধর-ওষ্ঠের ফাঁকে ফাঁকে আত্মপ্রকাশ করছে তীক্ষ্ণ দন্তের সারি।

কুকুরগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পাঁয়তারা করার পর পাঁচটা কুকুর একসঙ্গে সিংহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পশুরাজের প্রচণ্ড থাবা তৎক্ষণাৎ একটা কুকুরকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল, কিন্তু অপর চারটি কুকুর সিংহের পিছন দিকে থেকে খানিকটা মাংস তুলে নিয়ে পিছিয়ে এল নিরাপদ ব্যবধানে। গাড়ির ভিতর থেকে শিকারিরা সবিস্ময়ে দেখলেন, আক্রমণকারী চারটি কুকুরের রক্তমাখা চোয়ালের ফাঁকে ফাঁকে আটকে রয়েছে সিংহের রক্তাক্ত মাংসের টুকরো?

দলের অন্যান্য কুকুরগুলো এতক্ষণ ইতস্তত করছিল। রক্তের গন্ধ পেয়ে এবার তারা ক্ষেপে গেল। সবাই একসঙ্গে আক্রমণ করল সিংহকে।

তবে এবার তারা অন্ধের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েনি, দলের একটি কুকুরের মৃত্যু দেখে তারা সাবধান হয়েছিল, সিংহের মারাত্মক থাবা দুটির বিষয়ে সারমেয়-বাহিনী অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠল। এমন অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে শিকারের দেহে কামড় বসিয়ে তারা সরে আসতে লাগল যে, পশুরাজের পালটা আঘাত করার সমস্ত চেষ্টাই হয়ে গেল ব্যর্থ।

ক্রমাগত দংশনের পর দংশনে সিংহের দেহ রক্তাক্ত হয়ে উঠল। অবশেষে প্রায়-জীবন্ত অবস্থাতেই পশুরাজের শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল কুকুরগুলো।

বীভৎস দৃশ্য!

এমন ভয়ানক শত্রুর পাশাপাশি বাস করেও আফ্রিকার সিংহ যে তার প্রাধান্য ও অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে, তার অন্যতম কারণ, সে সামাজিক জীব– অন্যান্য বিড়ালজাতীয় পশুর মতো সে একা থাকতে ভালবাসে না, অধিকাংশ সময়েই সে দল বেঁধে থাকে।

সিংহের দলকে ইংরেজিতে বলে প্রাইড (Pride of lions)। এক-একটি প্রাইড বা দলের মধ্যে ছয় থেকে শুরু করে পনের-ষোলটি সিংহ ও সিংহী থাকে। দলবদ্ধ এই প্রাইডের উপর হামলা করার সাহস কুকুর বাহিনীর নেই। অতগুলো সিংহের বিপজ্জনক সান্নিধ্য তুচ্ছ করার সামর্থ্য রাখে একমাত্র গজরাজ। অপর কোনো প্রাণী ওই ধরনের দুঃসাহস প্রকাশ করলে রাজ-পরিবারের রোষে তার মৃত্যু অনিবার্য।

শাপদ-গোষ্ঠীর মধ্যে বুনো কুকুরই সিংহের একমাত্র শত্রু নয় কুকুরজাতীয় আর একটি জীব সিংহের উপর তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করে। ওই জীবটির নাম হায়না। কুকুরের মতো ক্ষিপ্র ও দ্রুতগতিসম্পন্ন নয় বলে হায়নার পক্ষে শিকার ধরা অত্যন্ত কঠিন। তাই অধিকাংশ সময়ে সে নিরাপদ দূরত্ব থেকে সিংহের উপর নজর রাখে এবং পশুরাজের শিকারপর্ব ও ভোজনপর্ব শেষ হলে ভুক্তাবশিষ্ট শিকারে ক্ষুধা নিবৃত্তি করে।

হায়নার এই চৌর্যবৃত্তি সিংহ কিন্তু মোটেই পছন্দ করে না। খাওয়ার সময়ে কোনো অসহিষ্ণু হায়না যদি কাছে আসে, তাহলেই প্রচণ্ড চপেটাঘাতে পশুরাজ তার দেহ চূর্ণ করে দেয়।

কিন্তু ছোটো ছোটো এক ধরনের শেয়াল সিংহের ভোজে ভাগ বসালেও সে বিরক্ত হয় না, বরং অনেক সময় দেখা গেছে, উদার-হৃদয় সম্রাটের মতোই সে ওই শৃগালদের প্রসাদ বিতরণ করছে।

হায়নারা সিংহের উদ্ধত ভাবভঙ্গী ও গাম্ভীর্য পছন্দ করে না। হায়নার চোয়ালের জোর সিংহের চেয়ে বেশি এবং পশুরাজের উপর তার আক্রোশও প্রচুর। তবু উদ্যত বজ্রের মতো দু-দুটো থাবার চপেটাঘাত এড়িয়ে রাজার দেহে দাঁতের ধার পরখ করার মতো সাহস বা ক্ষিপ্রতা হায়নার নেই। সুস্থ ও সবল সিংহকে হায়না তাই কখনো আক্রমণ করে না।

কিন্তু শিকারির গুলিতে বা নিগ্রোদের বর্শার খোঁচায় সিংহ যদি খুব বেশি আহত হয়, তবে আর হায়নার কবল থেকে তার নিস্তার নেই। ঘন ঘাস ঝোপের ভিতর লুকিয়ে সিংহ শিকারির চোখে ধুলো দিলেও হায়নার ক্ষুধার্ত দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে না। রক্তের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে হায়নার দল। সিংহকে খুঁজে বার করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আহত ও অবসন্ন দেহ নিয়ে পশুরাজ হায়নার মিলিত আক্রমণ রোধ করতে পারে না। সিংহের সর্বাঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে বীভৎস ভোজসভা বসিয়ে দেয় হায়নার দল।

এইরকম ভয়াবহ পরিস্থিতির ভিতর দিয়েই পশুরাজকে রাজত্ব চালাতে হয়। এতগুলো উদ্ধত, দুর্বিনীত এবং কিছু কিছু ইতর ও হিংস্র প্রজাকে সামাল দিয়ে রাজত্ব বজায় রাখা দস্তুরমতো কঠিন।

তাই পশুরাজ যে এখনও এই অবস্থায় তার রাজ্যপাট বজায় রেখে বংশবৃদ্ধি করছে, সেজন্য তাকে প্রশংসা করা উচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *