পলি প্যাকে জল

পলি প্যাকে জল

লালবাজারে সুদীশ নাগের সঙ্গে দেখা হতেই বলল, ”রোনাল্ডাকে না এনে তা হলে আমরা ভালোই করেছি বল কালকেতু।”

কথাটা শুনে হাসলাম। সুদীশ নাগ পাঁড় ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার। আমি ফ্রান্স বিশ্বকাপ থেকে ফিরে আসার পর অবুঝের মতো ও বলতে শুরু করেছিল, রোনাল্ডোকে লাল—হলুদ জার্সি পরাতেই হবে। যত টাকা লাগে লাগুক। কিন্তু আজ উলটো কথা বলছে। জিজ্ঞেস করলাম, ”কেন রে?”

”দূর, রোনাল্ডো তো চান্সই পাচ্ছে না এ সি মিলানে। এত বাজে ফর্মে। প্লেয়ার হচ্ছে বাতিস্তুতা। যদি আমরা ওকে ইস্টবেঙ্গলে আনি, কত লাগবে রে?”

হাসতে হাসতে বললাম, ”পরে হিসেব করা যাবে। আগে যে কাজে জন্য এসেছি, সেটা সেরে নিই। তোকে কি এরা কিছু বলেছে?”

সুদীশ নিস্পৃহভাবে বলল, ”বলেছে। ইডেনে টেস্ট ম্যাচের সময় সেই গণ্ডগোলের ব্যাপারটা তো? অত গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে? আলটিমেটলি তো কিছুই হয়নি। একটা লোকও মারা যায়নি। এমনকী, কেউ হসপিটালাইজডও হয়নি। এ নিয়ে এত তদন্তরই বা কি আছে! তোরা মিডিয়ার লোকেরা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশি বেশি করছিস…”

মাসখানেক হল ইডেনে ভারত—পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ হয়ে গেছে। ওই ম্যাচে দর্শক হাঙ্গামা নিয়ে কাগজে কাগজে প্রচুর লেখালেখিও হয়েছে। দর্শকরা মাঠের ভেতর জলের বোতল ছুঁড়ে রাগ প্রকাশ করেছিলেন। গণ্ডগোল পাকানোর পেছনে নিশ্চয়ই কারো কোনো উদ্দেশ্য ছিল। সেটা জানার জন্যই হোম সেক্রেটারি অমিয়কান্তি বসু কাল আমার বাড়িতে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন। আমি না করতে পারিনি। তখন হোম সেক্রেটারিকে বলেছিলাম, তদন্ত করে একটা রিপোর্ট আমি তৈরি করে দিতে পারি, তবে সুদীশের সাহায্য দরকার। সেই সঙ্গে টেস্ট ম্যাচের পাঁচদিন ইডেনের গ্যালারির যে ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়েছিল, তার ক্যাসেট দেখতে দিতে হবে। উনি রাজি হওয়ায় আজ লালবাজারে এসেছি ক্যাসেট দেখতে।

সুদীশ আরও কী বলতে যাচ্ছিল, ডি সি হেড কোয়ার্টারস রণদা চক্রবর্তীকে দেখে চুপ করে গেল। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই আমাকে বললেন, ”আপনারা রেকর্ডিং রুমে চলে যান। ভিডিও ক্যাসেট তৈরি রাখা আছে, এখনই দেখতে পারেন।”

রেকর্ডিং রুমে গিয়ে আমরা ক্যাসেট দেখায় মন দিলাম। কিছুদিন আগে মহারাজ অর্থাৎ কি না সৌরভ গাঙ্গুলির জন্য আনা হিরের আংটি একটা পার্টিতে হারিয়ে ফেলেছিল আমার এক বন্ধু দিগিন। শেষে সেই আংটির খোঁজ পেয়েছিলাম ভিডিও ক্যাসেট দেখে। সেই কাহিনি লিখেওছিলাম আনন্দমেলাতে। ইডেনের গ্যালারির ক্যাসেট দেখার ইচ্ছেটা হল, কোনো ক্লু যদি পাওয়া যায় সেই ভেবে। গণ্ডগোলের দু”দিনই অবশ্য ইডেনে ছিলাম। সবকিছু প্রেসবক্স থেকে দেখেছি। শচীনের আউট নিয়ে ঘটনাটা ঘটেছিল ফোর্থ ডে—র লাঞ্চের ঘণ্টা দেড়েক পরে। আমরা সময় বাঁচানোর জন্য সেই সময়ের ক্যাসেট চালিয়ে দিলাম।

গ্যালারিভর্তি লোক। বিভিন্ন বয়সের। তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের উচ্ছ্বাস। প্রথম জলের বোতলটা মাঠের ভেতর পড়েছিল জি ব্লক থেকে। খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম সেই সময় গ্যালারিতে ঠিক কী হয়েছিল। বছর চল্লিশের ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির গোলগাল একটা লোক উত্তেজিত হয়ে কী যেন বলছে। পরনে কী পরদায় তা দেখা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে ওই সময়ই শচীনের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে শোয়েবের। মোটা মতো লোকটাই প্রথম বোতল ছুঁড়ে মারল মাঠের ভেতরে। তার দেখাদেখি অন্যরাও বোতল ছুঁড়তে লাগল।

ঘণ্টাখানেক মন দিয়ে সেদিনের ঘটনাবলী দেখে, ফিফথ ডে—র ক্যাসেট চালিয়ে দিলাম। সৌরভ আউট হয়ে যাওয়ার পর সেদিন কিন্তু প্রথম বিক্ষোভটা শুরু হয় উলটো দিকের এইচ ব্লক থেকে। সেখানকার ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমি আর সুদীশ দু’জনেই সোজা হয়ে বসলাম। গ্যালারিতে অন্যদের তাতাচ্ছে সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির ভদ্রলোক। এদিনও প্রথম জলের বোতলটা মাঠে ওই লোকটাই ছুঁড়ে মারল। ছবিটা স্টিল করে দিলাম। তারপর সুদীশকে বললাম, ”এই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির লোকটাকে আজই খুঁজে বের করতে হবে। দু’দিনই গ্যালারি উত্তেজিত করেছে লোকটা, আলাদা আলাদা ব্লক থেকে। নিশ্চয়ই এর কোনো উদ্দেশ্য আছে।”

সুদীশ খুব মন দিয়ে লোকটাকে দেখে বলল, ”দাঁড়া দাঁড়া, মনে হচ্ছে একে আমি চিনি। বেলেঘাটা অঞ্চলে থাকে। খুব সম্ভব আলোছায়া সিনেমার কাছাকাছি।”

সুদীশের পক্ষেই সম্ভব। ও একবার যাকে দেখে, তাকে কোনোদিন ভোলে না। নিশ্চয়ই এমন কোনো জায়গায় ও লোকটাকে দেখেছে যে, মনে রেখেছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ”মনে করে দ্যাখ তো কোথায় দেখেছিস।”

কয়েক মিনিট চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবল সুদীশ। তারপর বলল, ”মনে পড়েছে। এই লোকটা একটা সময় ক্রিকেট—ট্রিকেটও ময়দানে খেলেছে। বেশ টাফ টাইপের। চল তো, বেলেঘাটায় একবার ঢুঁ মেরে আসি।”

কেন লোকটার খোঁজে যাচ্ছি, পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু কেন জানি না, মনে হল বেলেঘাটায় গেলে একটা ক্লু পাওয়া যাবে। সুদীশ আর আমার একই চিন্তাধারা, ”যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।”

লালবাজার থেকে দু’জনে বেরিয়ে যখন বেলেঘাটা পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় চারটে। আলোছায়া সিনেমার কাছে কিছু সময়ের মধ্যেই বের করে ফেলল ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা লোকটার নাম আর ঠিকানা। নাম হিন্দোল কাঞ্জিলাল। থাকে রাজা রাজেন মিত্তির রোডে।

প্রতিটা সিনেমা হলের কাছে যে ডি ডি—র লোক মাঝেমধ্যে ঘোরাঘুরি করে তা আগে জানতাম না। সুদীশের সেই সোর্সই আমাদের নিয়ে গেল হিন্দোল কাঞ্জিলালের বাড়িতে। আগেকার দিনের বেশ বড় বাড়ি। এককালে এই পরিবারটির যে পয়সাকড়ি ছিল তা বোঝা যায়। এখন বেশ দুর্দশায়। বাড়িটাতে অনেক ভাড়াটেও আছে। উঠোনে গিয়ে খোঁজ করতেই বেরিয়ে এল লোকটা। আমরা পরিচয় দিতেই ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসাল। মনে হল অফিস ঘর। হিন্দোল কাঞ্জিলালের তাহলে ব্যবসা আছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না ব্যবসাটা কীসের?

সুদীশ ভদ্রতার কোনো ধার ধারে না। পুলিশের চাকরিতে ওসব করলে চলেও না। প্রথমেই ও বলল, ”তোমাকে এখনই একবার লালবাজারে যেতে হবে।”

কথাটা শুনে হিন্দোল কাঞ্জিলাল ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর বলল, ”কেন বলুন তো?”

”তোমার বিরুদ্ধে রায়টিংয়ের চার্জ আছে ইডেনে।”

হিন্দোল কাঞ্জিলাল চট করে সামলে নিল নিজেকে। তারপর বলল, ”ওহ এই ব্যাপার। বসুন, একটু চা—কফি খান, তারপর না হয় লালবাজারে ঘুরে আসা যাবে।”

সুদীশ চোখাচোখি করল আমার সঙ্গে। তারপর ধমক দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ”টেস্ট ম্যাচ চলার সময় গ্যালারির লোকজনকে উত্তেজিত করেছিলে কেন দু’দিন?”

”কারণ আছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজেও উত্তেজিত ছিলাম ওই ক’দিন।”

ভেবেছিলাম হিন্দোল কাঞ্জিলাল অভিযোগ অস্বীকার করবে। তা না করে খোলা মনে কথা শুরু করল। টেবিলের ড্রয়ার খুলে হঠাৎ একটা ফাইল বের করল হিন্দোল। তারপর বলল, ”কেন রেগে গিয়েছিলাম তার সব ডকুমেন্ট এই ফাইলে আছে।”

দ্রুত চোখ বোলাতে লাগলাম ফাইলে। একটা মিনারেল ওয়াটার কোম্পানি সি এ বি কর্তাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, টেস্ট ম্যাচের সময় যাতে তাদের জল বিক্রির বরাত দেওয়া হয়।

কয়েকটা চিঠি চালাচালি হয়েছে দু’পক্ষের মধ্যে। অত পড়ার সময় আর ধৈর্য নেই সুদীশের। বলে উঠল, ”মুখে বল তো কী হয়েছে।”

হিন্দোল বলল, ”দেখুন, আমার বন্ধুর একটা ছোট্ট কোম্পানি আছে মিনারেল ওয়াটারের। আমি তার এজেন্ট। বোতলে নয়, এই কোম্পানিটা জল বেচে পলি প্যাকে। মাদার ডেয়ারির দুধের প্যাকেট দেখেছেন? ঠিক ওইরকমভাবে। দাম খুব কম। সাড়ে তিন টাকা। চেন্নাই টেস্টের সময় চিদাম্বরম স্টেডিয়ামেও এবার আমরা বিক্রি করেছি। চেন্নাই পুলিশ প্লাস্টিকের বোতলে জল বিক্রি করতে দেয়নি। নিরাপত্তার কারণে। তাই জল হু হু করে বিক্রি হয়েছিল চেন্নাইতে। ইডেনে আমরা চেষ্টা করেছিলাম, পলি প্যাকের জল বিক্রির। কিন্তু অদ্ভুত কারণে ওরা আমাদের দিনের পর দিন ঘোরাতে লাগল।”

সুদীশ আর আমি মন দিয়ে শুনছি হিন্দোল কাঞ্জিলালের কথা। সুদীশ জিজ্ঞেস করল, ”কেন?”

”সেটা বুঝতেই আমার অনেক দিন লেগে গেছে। পলি প্যাকে জল বিক্রি করতে দিলে কোনো লোক তো মাঠের ভেতর ছুঁড়তে পারত না। ইডেনের দর্শকদের সুনামও নষ্ট হত না।”

হিন্দোল কাঞ্জিলালের কথা শুনে অবশ্য নিছক মাস্তান বলে মনে হচ্ছে না। লোকটা বেশ গুছিয়ে কথা বলছে। তবুও সুদীশ যে ওকে পছন্দ করছে না, তা ওর চোখমুখ দেখে বেশ বুঝতে পারছি। হঠাৎ বেশ কড়া গলায় ও বলল, ”তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুমি লোকদের উসকে দিচ্ছিলে কেন? মাঠের ভেতর বোতলই বা ছুঁড়লে কেন?”

”ভবিষ্যতে পুলিশ যাতে জলের বোতল নিয়ে মাঠে ঢোকা বন্ধ করে, তার জন্য। দেখুন, মাঠে বোতল ছুঁড়েছিলাম বলেই পুলিশ এখন ভাবছে ভবিষ্যতে বোতল নিয়ে ঢুকতে দেবে না। পুলিশ এবারও জলের বোতল ব্যান করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। কেন, সেটা আগে খোঁজ করুন।”

সুদীশ ফের কড়া গলায় বলল, ”ন্যাকামি না করে সোজাসুজি বল।”

হিন্দোল বলল, ”চেতলায় মনুয়া বলে একটা ছেলে আছে তাকে ধরুন। তা হলেই বুঝতে পারবেন।”

”কোথায় থাকে?”

”দুর্গাপুর ব্রিজের নীচে। খোঁজখবর করলে তাকে পেয়ে যাবেন।”

সুদীশ উঠে দাঁড়াল। তারপর বেরিয়ে আসার আগে বলল, ”আমার সঙ্গে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। ফের তোমার কাছে আসছি।”

হিন্দোল বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি আছি।” কথাটা বলার পর ওর ঠোঁটে পাতলা হাসি দেখে আমার বেশ অবাকই লাগল। হাসিটার মধ্যে একটু ডোন্ট কেয়ার ভাব ছিল।

বেলেঘাটা থেকে চেতলা কম রাস্তা নয় । সন্ধেবেলায় ট্রাফিক জ্যাম পেরিয়ে যখন দুর্গাপুর ব্রিজের কাছে পৌঁছলাম, তখন প্রায় সাতটা। ব্রিজের নীচ দিয়ে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে রেললাইনের দিকে। খানিকটা বাঁ দিকে একটা স্টেশনারি দোকানে জিজ্ঞেস করতেই একজন মনুয়ার বাড়িটা দেখিয়ে দিল। টালির চালের একটা ক্লাবঘর। সেখানে কয়েকজন মিলে ক্যারম খেলছে। সুদীশ গিয়ে দাঁড়াতেই ছেলেগুলো অবাক হয়ে তাকাল। একজন বলল, ”কাকে চান?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ”মনুয়া আছে?”

”কোত্থেকে এসেছেন?”

”পুলিশ।”

”মনুয়াদা ও বাড়িতে আছেন। আসুন।”

একটা ছেলে পেছনের দরজা দিয়ে নিয়ে গেল পাশের বাড়িতে। ছোট্ট একাটা উঠোন। সেখানে প্রচুর প্লাস্টিকের খালি বোতল দেখে সুদীশ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। ছেলেটা আমাদের নিয়ে বাইরের ঘরে ঢোকার পর দরজার পাশ থেকে বেরিয়ে এল মাঝবয়সী একটা লোক। দেখেই মনে হল এই লোকটা মনুয়া। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি। গলায় সোনার মোটা চেন। হাতে গোল্ডেন কালারের ঘড়ি। গায়ের রং বেশ কালো। লোকটা ভ্রু কুঁচকে আমাদের দিকে তাকাল।

”তুমি মনুয়া?”

”হ্যাঁ সার। আপনারা?”

”পরিচয়টা পরে নেবে। আগে বল তো বাইরে অত প্লাস্টিকের বোতল কিসের?”

”আমি পুরনো বোতলের ব্যবসা করি।”

”এটা তো খুব ভালো ব্যবসা নয় বাপ। একটু খোলসা করে বলো তো দেখি।”

সুদীশের প্রশ্নে মনুয়া বলল, ”যত পুরনো বোতল আমি জোগাড় করি। সাপ্লাই দিই এক জায়গায়।”

”কোথায়, সেই লোক আর জায়গাটার নাম—ঠিকানা আমার চাই।”

মনুয়ার চোখমুখ শুকিয়ে গেল এই প্রশ্নে। বলল, ”সার, লোকটার নাম হরি ঝুনঝুনওয়ালা। থাকে কাছাকাছি।”

সুদীশ হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে হাত বাড়িয়ে মনুয়ার পাঞ্জাবির কলারটা খামচে ধরে বলল, ”চল এখনই সেখানে যাব।”

বোধ হয় কোনও ক্লু পেয়েছে। সুদীশ সেই কারণে এতটা অ্যাগ্রেসিভ। ঘর থেকে বেরিয়েই ও সামনে ঠেলে দিল মনুয়াকে। তারপর কোমরের রিভলভারে হাত রেখে বলল, ”কোনওরকম চালাকির চেষ্টা করবে না। একদম খুন করে দেব।”

মনুয়া মিনমিন স্বরে বলল, ”কী যে বলেন সার, আমার কিন্তু কোনো দু’নম্বরি ধান্ধা নেই।”

”সেটা তো বুঝতেই পারছি।”

দুর্গাপুর ব্রিজ থেকে বসতি মিনিট চার—পাঁচেকের কথ। গোবিন্দ আঢ্যি রোড ধরে এগোতেই একটা পাঁচিল—ঘেরা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল মনুয়া। তারপর ব্যাজার মুখে জানাল, ”সার এটাই ঝুনঝুনওয়ালার বাড়ি।”

গেটের সামনে উর্দিপরা দরোয়ান বসে। মনুয়াকে সঙ্গে দেখেই বোধ হয় কোনো প্রশ্ন করল না। ভেতরে ঢুকে যা দেখলাম তাতে আমাদের চক্ষুস্থির।

সুদীশ অনেকক্ষণ আগে লালবাজার চলে গেছে। কম্পিউটারের সামনে আমি বসে আছি রিপোর্ট লেখার জন্য। কিন্তু ”টু দ্য হোম সেক্রেটারি” লিখে চুপ করে বসে আছি। কী লিখব? আজ যা অভিজ্ঞতা হল, আগে কখনও তা হয়নি। জগতে কত কী ঘটে যায়, তার আসল কারণটা কোনোদিনও জানা যায় না। এক—একজন এক—একরকম ব্যাখ্যা করে, আর তা আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই। এই যে ইডেনে দর্শক হাঙ্গামা—এর আসল কারণটা যদি হোম সেক্রেটারিকে জানাই উনি হয়তো বিশ্বাস করবেন কিন্তু বাকি যাঁরা শুনবেন তাঁরা হাসবেন। বলবেন, গাঁজাখুরি গল্প।

সুদীশ একদিন কথায় কথায় বলেছিল, ”আমাদের চারপাশে যা ঘটে, বুঝলি কালকেতু তার বেশির ভাগের আর্থিক লাভ—ক্ষতির একটা হিসেব থাকে।” আমি কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝে—মাঝে মনে হয়, সুদীশই ঠিক। এই যে টেস্ট ম্যাচের সময় ইডেনে দু’দিন ধরে গণ্ডগোল হল, তার পেছনেও যে জলব্যবসায়ীদের একটা লড়াই চলছিল তা কে জানত? মনুয়া সেদিন ঝুনঝুনওয়ালার বাড়িতে নিয়ে না গেলে ভেতরের রহস্যটা জানতেই পারতাম না।

সুদীশ সেদিন ঝুনঝুনওয়ালার বাড়ির ভেতর ঢুকেই অ্যাকশনে নেমে পড়েছিল। একটা বিরাট টিনের শেডের তলায় কিছু লোককে কাজ করতে দেখে ও হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠেছিল, ”যে যেখানে আছো, দাঁড়িয়ে থাকো।”

ভাল করে তাকিয়ে দেখি, পাঁচ—ছয়জন লোক পুরনো বোতলে কর্পোরেশনের জল ভরছে। আর কয়েকজন ওই বোতলগুলোতে ছিপি আটকানোর কাজে ব্যস্ত। প্লাস্টিকের বোতলগুলোতে নামী কোম্পানির নাম। দেখেই বুঝতে পারলাম, ভুয়ো জিনিস তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো বাজারে যাবে, লোকে কেনার সময় বুঝতেও পারবে না নকল জিনিস কিনছে। হরি ঝুনঝুনওয়ালা পরে স্বীকার করল, নকল জিনিস প্রচুর পরিমাণে ও চালিয়ে দেয় শিয়ালদহ আর হাওড়া স্টেশনে।

কিন্তু নকল জলের সঙ্গে ইডেনের গণ্ডগোলের সম্পর্কটা কী? সেটাও সুদীশ জেরা করে ঝুনঝুনওয়ালার পেট থেকে বের করে নিয়েছিল লালবাজারে বসে। টেস্ট ম্যাচের সময় প্রচুর পরিমাণ জলের বোতল বিক্রি হবে ইডেনে, এটা ঝুনঝুনওয়ালারা আন্দাজ করেছিল। গ্যালারিতে যদি এক লাখ লোক হয় তা হলে কমপক্ষে পনেরো থেকে কুড়ি হাজার জলের বোতল এক—একদিন বিক্রি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তার মানে পাঁচদিনে প্রায় এক লাখ বোতল। যাঁরা মাঠে বোতল কেনেন, সাধারণত তাঁরা সেটা বয়ে আর বাড়িতে নিয়ে যান না। গ্যালারিতেই বোতল ফেলে রেখে যান। সেগুলো কুড়িয়ে নেওয়ার কন্ট্রাক্ট ঝুনঝুনওয়ালার কাছ থেকে নেয় মনুয়া। প্রতিদিন খেলার শেষে কুড়ি—পঁচিশজন লোক লাগিয়ে মনুয়া প্লাস্টিকের খালি বোতল কুড়িয়ে চেতলায় নিয়ে যেত। পরে তা ঝুনঝুনওয়ালার গোডাউনে পাঠিয়ে দিত। তারপর ঝুনঝুনওয়ালা কী করত তা তো আগেই বলেছি।

হিন্দোল জল বিক্রি করতে না পারায় এমনিতেই চটে ছিল। খোঁজ করে ও জানতে পারে প্লাস্টিক বোতলের জলব্যবসায়ীরাই চাপ দিয়ে ওর জিনিস ইডেনে ঢুকতে দেয়নি। এ নিয়ে মনুয়ার সঙ্গে ক্লাব হাউসের সামনেই ওর একদিন তর্কাতর্কি হয়ে যায়। মনুয়া সেদিন হিন্দোলকে শাসায়, ইডেনে ওদের এরিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করলে লাশ ফেলে দেবে। সেদিন থেকেই হিন্দোল সুযোগ খুঁজতে থাকে পালটা আঘাত করার। চতুর্থ দিনে সেই সুযোগটা ও পেয়েও যায়। একসময় খেলাধুলো করত বলে হিন্দোল দর্শকদের মনমেজাজ খুব জানে। ও নিশ্চিত ছিল, দর্শকরা এমন খেপে আছেন, একবার কেউ বোতল ছুঁড়তে শুরু করলে সঙ্গে সঙ্গে তা সংক্রামিত হয়ে যাবে অন্যদের মধ্যে। সবাই রাগ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে হাতের কাছে বোতলটাকেই ব্যবহার করবেন। হিন্দোলের অনুমান ভুল হয়নি।

হোম সেক্রেটারির কাছে কী লিখব বুঝতে পারছি না। হরি ঝুনঝুনওয়ালা এখন লালবাজারের লক আপে। ইডেনের গণ্ডগোলের জন্য সরাসরি ওকে দোষারোপ করা যায় না। ওর অপরাধ অন্যরকমের। মনুয়াকেও ধরা যাচ্ছে না। কেননা ও স্রেফ ঝাড়ুদারের কাজটা করেছে। তা হলে রইল হিন্দোল। কিন্তু একটা বা দুটো প্লাস্টিকের বোতল মাঠে ছোঁড়ার জন্য সেও মারাত্মক কিছু অপরাধ করেনি। কিন্তু সব মিলিয়ে পরে বিরাট ঘটনা ঘটে গিয়েছে।

টেলিফোনটা বাজছে। রিসিভার তুলতেই সুদীশের গলা পেলাম, ”শোন, হিন্দোল লোকটা কে জানিস?”

”কেন রে?”

”লালবাজারে এসে জানলাম, হিন্দোল ব্যাটা হোম সেক্রেটারির রিলেটিভ। খুব যাতায়াত আছে ওদের মধ্যে। তুই রিপোর্টে লিখে দিস, এর পর থেকে যেন খেলার সময় প্লাস্টিকের বোতলে জল বিক্রির পারমিশান দেওয়া না হয়। তার বদলে বিক্রি হোক পলি প্যাকে জল। হোম সেক্রেটারি জানেন, আসল রহস্যটা তুই ধরে ফেলবি। ঘুরিয়ে তোর হাত দিয়েই উনি যা চান, তা লিখিয়ে নিচ্ছেন। ও কে, ছাড়ি তা হলে?”

আমি কোনও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সুদীশ ফোনটা ছেড়ে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *