পলায়ন

পলায়ন 

গভীর রাত। 

সন্ধ্যা থেকেই কারফিউ চালু হিয়ে গিয়েছে। বহরমপুরের রাস্তায় রাস্তায় জমতে শুরু করেছে ঘন কুয়াশা। ল্যাম্পপোস্টগুলো নীরব দর্শকের মত মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। তাদের আকাশ দেখার অনুমতি নেই। ধীরে ধীরে কুয়াশা ঘন হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে শহরের অলিতে গলিতে। থেকে থেকে কুকুরের কান্না ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। 

কুয়াশাঘেরা অলিতে গলিতে শিকারীর মত টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে পুলিশ। প্রধান সড়কগুলোর মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড বসিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ ভ্যান। কাউকে দেখামাত্রই গুলি করা হবে। পুলিশের চোখ আর রাইফেলের মাজল ফাঁকি দিয়ে পরভোজী প্রাণীর মত ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশাচর মানুষেরা। কেউ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য। কেউ সেই পাপের কারণ হওয়ার জন্য। 

দ্বীপশহর হাউজিংএর ডি-ব্লকের রাস্তাটাও সুনসান। গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে একটা পুলিশ ভ্যান বেরিয়ে গেল। পুলিশ ভ্যানটা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে একটা ছায়া বের হয়ে এলো পাশের এরিকা পামের ঝোপ থেকে। পুলিশ ভ্যানের লাল ব্রেকলাইটটা কুয়াশায় মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ছায়াটা অপেক্ষা করল। তারপর সন্তর্পনে হাঁটা শুরু করল। শহরে যাওয়ার কোন যানবাহন এখন পাওয়া যাবে না। কাজেই পদব্রজই ভরসা। 

ছায়াটা ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো এড়িয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করল। আশেপাশের ভবনগুলো যেন পরিত্যক্ত। কোথাও কোন আলো নেই। বারান্দাগুলোতেও জমাট অন্ধকার। ছায়াটার পঞ্চইন্দ্রিয় সজাগ। সামনে দ্বীপশহরের সেতু। ছায়াটা দূর থেকে দেখতে পেল, ওইপারে সেতুর মুখেই একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। দুটোও হতে পারে। কুয়াশায় ভালো দেখা যাচ্ছে না। 

পুলিশের চোখে একবার পড়লে সেখানেই ফুলস্টপ। গুলি চলবে। কোনরকম ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। চিন্তা ভাবনা করে এগোতে হবে। প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলতে হবে হিসাব করে। 

ছায়াটা রাস্তা ছেড়ে রাস্তার পাশে লাগানো শিশু গাছগুলোর আড়ালে চলে গেল। তারপর গাছের নিচে জমে থাকা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকল। সেতুর কাছাকাছি আসতেই ছায়াটা সেতুর পাশের ঢালু মাটি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। সেতুর নিচে জমাট অন্ধকার। সেতুর ওপরের ল্যাম্পপোস্টের আলো আসছে না। সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে দুষিত খয়ের নদী। জঞ্জালের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে নদীটা এখন খাল বলে মনে হয়। ছায়াটা সেই কালো নোংরা পানির ভেতরে নেমে পড়ল। ছলাৎ ছলাৎ করে শব্দ হল। ছায়াটা একবার ওপরে সেতুর দিকে তাকালো। কোন শব্দ নেই। কেউ উঁকিও দিচ্ছে না। যতটা কম শব্দ করা যায় ততটা কম শব্দ করে সামনে এগোতে থাকল সে। সেতুর নিচে এত অন্ধকার যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া পচা আবর্জনার বোঁটকা গন্ধ চারিদিকে। নাড়ি উল্টে আসতে চায়। 

হঠাৎ নরম কিছু একটায় পা পড়তেই ছায়াটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেল। পানি ছলকে ওঠার শব্দ হল। অন্য সময় হলে যতটুকু হওয়া উচিৎ ছিল, নিশ্চুপ রাতে যেন সেই শব্দটাই সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের মত শোনাল। ছায়াটা স্পষ্ট দেখতে পেল, সেতুর রেলিং থেকে দুইজন মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছে। একজন টর্চের আলো ফেলছে। টর্চের আলোর বৃত্তটা ঘুরতে ঘুরতে ছায়াটার পায়ের পাতা স্পর্শ করল। ছায়াটার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। এখানেই শেষ। এতদূর এসে এখানেই শেষ সব কিছু। রক্তে এড্রেনালিনের মাত্রা বেড়ে গেল। ছায়াটা নিঃশ্বাস বন্ধ করে গান ফায়ারের শব্দের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। 

কেউ গুলি চালাল না। টর্চের আলোক বৃত্তটা ছায়াটার পায়ের কাছ থেকে সরে বামে গেল। তারপর সোজা। বৃত্তটা যেটার ওপরে পড়ল তা দেখে ছায়াটার বমি এসে গেল। একটা অর্ধগলিত লাশের ফ্যাকাশে মুখমন্ডল। এটাতেই পা বেঁধে পড়ে গিয়েছে সে। 

ছায়াটা মূর্তির মত নোংরা পানির ভেতরে পড়ে থাকল। আলোক বৃত্তটা এদিক ওদিক ঘুরে বন্ধ হয়ে গেল। সেতুর ওপরে কেউ একজন বলল, “শিয়াল মিয়াল হবে। বিরিজের নিচে তো লাশের গাদা হয়্যাছে। কাল সুইপার নি আসতি হবে।” লোক দুটোর কণ্ঠ মিলিয়ে যেতেই ছায়াটা খুব সাবধানে উঠে দাঁড়ালো। পানির দুর্গন্ধে পেটের নাড়ি উল্টে আসে। ছায়াটা নিঃশ্বাস বন্ধ করে এগোতে থাকে। আগের থেকেও আরও সতর্কতার সাথে। এবার শব্দ হলে লোক দুজন নিশ্চিত নিচে নেমে আসবে শব্দের উৎস খুঁজতে। 

খাল পার হতেই ছায়াটা হা করে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল। ঠাণ্ডা বাতাস ফুসফুসে ঢুকে ঘড়ঘড় শব্দ করছে। ছায়াটা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ঢালু মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বসে বমি করে ফেলল। ওয়াক ওয়াক শব্দ হলেও কিছুই করার নেই। নোংরা দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরা যাবে না। 

ছায়াটা কোন রকমে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠল। কয়েক গজ দুরেই সেতুটা দেখা যাচ্ছে। একটা পুলিশ ভ্যান আর একটা মোটরসাইকেল পার্ক করা। ছায়াটা জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। 

কিছুদুর গিয়েই হরিবাসর মোড়। বন্ধ দোকানপাটগুলোর সামনে অন্ধকারের ভিড়। সেই অন্ধকারেই নিজেকে সেঁধিয়ে দিয়ে ছায়াটা এগোতে লাগল। আশেপাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একটা কুকুরও নেই আশে পাশে। 

হরিবাসর মোড়ে একটা পুলিশ ভ্যান আগেই আশা করেছিল ছায়াটা। আশা পূর্ণ হল। একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। ভ্যানের ভেতরটা অন্ধকার। বোঝা যাচ্ছে না ভ্যানের ভেতরে কেউ আছে কিনা। থাকলেও জেগে আছে কিনা। কিন্তু মোড় পার হতে গেলে এর বিকল্প রাস্তা নেই। ছায়াটা অন্ধকারেই অপেক্ষা করতে লাগল। 

***

আর এক মিনিট করতে করতে বিশ মিনিট কেটে গেল। ছায়াটার বুঝতে বাকি থাকল না, নিজেকেই কিছু একটা করতে হবে। ভোর হতে বেশি দেরি নেই। আলো ফুটলে তার আর শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়া সম্ভব হবে না। 

ছায়াটা দোকানগুলোর সামনে ভারি কিছু একটা খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। একট ইট কুড়িয়ে নিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলো। ছুঁড়ল রাস্তার বিপরীতে থাকা একটা বিলবোর্ড বরাবর। প্রচণ্ড শব্দ হল। রাতের নীরবতা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে ফাঁকা রাস্তায় প্রতিধ্বনিত হল। সাথে সাথে তিনজন পুলিশ বেরিয়ে এলো ভ্যান থেকে। তিনজনের হাতেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল। তিনজনই ছুটে গেল বিলবোর্ডের দিকটায়। 

এই সুযোগ। ছায়াটা দৌড়ে রাস্তা পার হল। পুলিশরা যেদিকে গিয়েছে তার বিপরীত দিকের রাস্তায় ফুটপাথের অন্ধকারে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলল। 

হঠাৎ কান ফাটানো গুলির শব্দ। দূর থেকে ছায়াটা দেখতে পেল, বিলবোর্ডের আড়াল থেকে দুইজন যুবক পালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ তিনজনের একজন বলল, “মার কুত্তাগুলারে। হারামীরা চিকা মারতে আসছে। প্রায়শ্চিত্ত করা ঢুকায়ে দে শালাদের পাছার ভেতরে।” ছায়াটার চোখের সামনে দুইজন যুবকই রাস্তার ওপরে পড়ে গেল কাটা কলাগাছের মত। একটা ল্যান্ডরোভারকে এগিয়ে আসতে দেখে ছায়াটা আরও অন্ধকারে ঢুকে গেল। ল্যান্ডরোভারটার সামনে সামরিক পতাকা লাগানো। ল্যান্ডরোভারটা চলে যাওয়ার সাথে সাথে ছায়াটা আরেকবার উঁকি মেরে দেখল হতভাগ্য দুই যুবককে। দুজনেই লাশ হয়ে গিয়েছে। 

ছায়াটা দেরি করল না। অন্ধকার ধরে এগোতে শুরু করল। এখনও অনেকদূর যেতে হবে; বেঁচে থাকার শর্ত সাপেক্ষে। 

কখনও বন্ধ দোকানের অন্ধকারে, কখনও গলির ভাঁজের অন্ধকারে, কখনও রাস্তার পাশে পার্ক করা ট্রাকের নিচ দিয়ে, এইভাবে খুব সাবধানে ছায়াটা এগোতে লাগল। বড় বড় মোড়গুলোতে দেখতে পেল, কিছু লোক দেয়ালের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ মূলক চিকাগুলো মুছে ফেলছে। পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। যেন কেউ বাধা দিতে না পারে। সাধারণ রাস্তাগুলো যেমন তেমন, ছায়াটা বড় বড় মোড়গুলো পার হল খুব ঝুঁকি নিয়ে। কারণ বড় বড় মোড়গুলো অনেক বেশি আলোকিত এবং পুলিশের পাহারাও বেশি। 

অবশেষে তৈমুর লেনে এসে পৌছল ছায়াটা। সরু গলিগুলো যেন স্মৃতিদের কবরস্থান। এই গলির অন্ধকার যেন অনেক বেশি গাঢ়। অনেক বেশি আঠালো। আলোতে গেলেও এই অন্ধকার গায়ে লেগে থাকে অনেকক্ষণ। কুয়াশা মিশে অন্ধকারটা যেন আরও বেশি অভেদ্য হয়ে গিয়েছে। ছায়াটা সেই অন্ধকারে ডুব দিল। আর খুব বেশি দুর না। কাছাকাছি চলে এসেছে ছায়াটা। 

ছায়াটা যত গলির ভেতরে ঢুকতে থাকল, তত বেশি শীত অনুভূত হল তার। এই গলির যেন শেষ নেই। অন্ধকার যেন নাক মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। একটা সময় ছায়াটা নিজের সত্ত্বাটাকে আর অন্ধকার থেকে আলাদা করতে পারল না। যেন ছায়াটাও এই অন্ধকারের একটা অংশ। এক অন্তহীন পথের পথিক। 

অন্ধকারে কোথা থেকে যেন কুকুর ডেকে উঠল কয়েকটা। প্রথমে একটা। তারপর কয়েকটা। সেগুলো যে ছায়াটাকে দেখেই ডেকেছে, এটা তাদের কর্কশ গর্জন শুনলেই বোঝা যায়। ছায়াটার কাছে রিভলভার নেই। কোন লাঠি নেই। তিন জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ ছায়াটার দিকে এগিয়ে আসল। ছায়াটা দুই হাত দিয়ে কুকুরগুলোকে আরও তাড়ানোর চেষ্টা করল। তিনজোড়া চোখ ছায়াটাকে ঘিরে ফেলল তিনদিক থেকে। যেকোন মুহূর্তে একটা কুকুর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছায়াটা খালি হাতে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিল। দৌড়ানো যাবে না। একটা কুকুরকে কষে একটা লাথি মারতে পারলেই বাকিগুলোও পালাবে। 

অন্ধকারে, খুব কাছ থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠল, ছেই ছেই। যাহ। হুস। বাতাসে লাঠি ঘোরানোর বন বন শব্দ হল। ছায়াটা বুঝতে পারল না যে পিছু হটা উচিৎ হবে কিনা। সে পাশের পুরনো দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কুকুরের পায়ের শব্দ আর মানুষের পায়ের শব্দ এক না। যদি পুলিশ হয় তাহলে নির্ঘাত অন্ধকারেই গুলি ছুড়বে। 

পায়ের শব্দ যত এগিয়ে আসতে লাগল, ছায়াটা পাশের দুই বাড়ির মাঝখানের একটা ছোট জায়গায় ঢুকে পড়তে লাগল। লক্ষ্য রাখল, ড্রেনের ভেতরে যেন পা না পড়ে। পায়ের শব্দটা একেবারে বাড়ির দেয়ালের কাছে সরে আসতেই বাড়ির একটা জানালা আলোকিত হয়ে গেল। বাড়ির কেউ আলো জ্বালিয়েছে। একজন বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ছায়াটা, “কে? কে?” 

কণ্ঠস্বরের মালিককে দেখতে পেল ছায়াটা। সাজ্জাদ, থানার সেকেন্ড অফিসার। জানালার আলোতে এসে দাঁড়ালো সে। বলল, “মুরুব্বি, ভয় নাই। পুলিশ। ঘুমান ঘুমান। আপনি কি ভাবছিলেন? চোর? কারফিউ চলছে, ঘুমান।” 

বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করল, “আর কতক্ষণ কারফিউ?” 

“কারফিউ কতক্ষণ থাকে? হা হা হা হা। আরে যতক্ষণ ঘুমায়ে থাকবেন ততক্ষনই কারফিউ চলবে।” উত্তরের অপেক্ষা না করে সাজ্জাদ অন্ধকারে হারিয়ে গেল। 

জানালার আলোটা নিভল না। ছায়াটা দুই বাড়ির মাঝখান থেকে বের হয়ে আবার হাঁটা শুরু করল। সে পেছনে ফিরে তাকালো একবার। অন্ধকার গলিতে আলোকিত জানালাটা কেমন অদ্ভুত মনে হল তার। যেন অন্ধকারের ভেতরে জ্বলতে থাকা আয়তাকার সূর্য। 

তৈমুর লেন পার হওয়ার পরেই ছায়াটা হাউজিং-এর ফাঁকা মাঠে এসে পড়ল। ধু ধু ফাঁকা মাঠ। ছায়াটা মাঠের অন্ধকারে ডুব দিয়ে দৌড় শুরু করল। হাইওয়ের ধারে শিমুল গাছটা চোখে পড়ল ছায়াটার। সে আরও জোরে দৌড় শুরু করল। এদিকে পুলিশের দৌরাত্ম কম হবে। তাই ভয় নেই। অনেকক্ষণ পরে ছায়াটা নির্ভার মনে বুক ভরে শ্বাস নিল। 

কিন্তু ভয় পাওয়াটা জরুরী। ভয় প্রতিটা প্রাণীর টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ায়। ছায়াটা সেটা ভুলে গেল। মাঠের ভেতরে দপ করে একটা পুলিশ ভ্যানের হেডলাইট জ্বলে উঠল। অন্ধকারে পুলিশ ভ্যানটাকে খেয়াল করেনি ছায়াটা। 

পুলিশ ভ্যানের হেডলাইটের তীব্র আলোতে খাইরুল সাহেবের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ভ্যানের ভেতর থেকে কে যেন বলল, ওই কে রে? ঐ টুকুই। তারপর প্রচণ্ড শব্দে গুলি চলল। চিঁ করে গুলিটা খাইরুলের হাতের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। খাইরুল পড়িমড়ি করে ছুটল। ভ্যানটাও স্টার্ট নিল। উন্মত্ত দানবের মত এগিয়ে আসতে থাকল ছুটন্ত খাইরুলের দিকে। 

দুটো গুলি চলল পর পর। দুটোই লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল। 

একটু দুরেই হাইওয়ে। হাইওয়ে পর্যন্তই খাইরুলকে পৌঁছাতে হবে। পাগলের মত ছুটছে খাইরুল। পেছনে যমদূত। একটা গুলি। তারপরেই সব শেষ। 

খাইরুল হাচড়ে-পাছড়ে ঢালু বেয়ে হাইওয়েতে উঠে পড়লেন। শিমুল গাছের কাছে দাঁড়াতেই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটাকে দেখতে পেলেন। গাড়ির গেটটা খুলে গেল। খাইরুল লাফিয়ে গাড়ির ভেতরে পড়লেন। 

তালেব গাড়ি স্টার্ট দিল। মুহূর্তের ভেতরেই পুলিশ ভ্যানের নাগালের বাইরে চলে গেল গাড়িটা। 

তালেব হাসতে হাসতে বলল, “পুলিশের চাকরিটার জন্য আফসোস হইতাছে ছার? হা হা হা। ভাগ্য ভালো হাইওয়েতে দারাইছিলাম। নাইলে পারে তো এখনও চুইংগামের মত লাইগা থাকত।” 

খাইরুল হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “আমি চাচ্ছিলাম না আমার শহর থেকে বের হওয়াটা পুলিশ জানুক। কাল নতুন ওসির ব্যবহার তেমন একটা ভালো লাগেনি। লোকটা আমার ওপরে নজর রাখছে। অনেক ধন্যবাদ তালেব। আপনি এই নিয়ে দুইবার আমার প্রাণ বাঁচালেন।” 

তালেব অন্ধকারে হাসল শুধু। কিছুই বলল না। 

খাইরুল জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার জিনিসগুলো এনেছেন?” 

তালেব বলল, “হ্যাঁ ছার। পেছনের সিটের নিচে রাখা আছে। সেকেন্ডহ্যান্ড মাল। কিছু জিনিস একের।” 

খাইরুল সিটের নিচ থেকে বস্তায় মোড়া ‘জিনিস’ দুটো বের করলেন। বস্তা সরিয়ে ইস্পাতের শীতল স্পর্শ নিলেন। একটা রিভলভার। আর একটা এসএমজি। এই দুটো নিয়েই তিনি কাল তাকিয়া মহলে যাবেন। ওখান থেকে কোন না কোন সূত্র পাওয়া যাবেই। সেই সূত্র ধরেই প্ৰথমে তিনি মেরিলিনাকে বাঁচাবেন। তারপর ফিরোজকে খুঁজে বের করবেন। নিজের একমাত্র বোনের পোড়া লাশের থেকেও আরও বেশি পোড়াবেন ফিরোজের দেহটাকে। খাইরুল যেন চোখের সামনে ফিরোজের জ্বলন্ত শরীরটা দেখতে পেলেন। ফিরোজ যত দৌড়াচ্ছে, তত তার শরীর থেকে চর্বি খসে খসে পড়ছে। চর্বি পোড়ার মিষ্টি একটা গন্ধ বের হয়েছে। খাইরুল যেন সেই গন্ধটাও পেলেন নাকে। রিভলভারটা তুলে ধরলেন দুই হাতে। 

তালেব বলল, “চাবিতে কিছু হবে না ছার। তালা বদলাইছে দেখলাম। আমি অন্য ব্যবস্থা করে এসছি।” 

খাইরুল কিছুই বললেন না। রিভলভারটা তুলে এক হাতে তুলে ধরে মন দিয়ে দেখতে লাগলেন। ভোরের প্রথম আলোতে রিভলভারটা চক চক করে উঠল। মেরিলিনাকে নিয়ে একদিন ভোর দেখতে হবে। 

***

বিকালবেলা এয়ারপোর্টে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ল্যান্ড করল সাত মিনিট লেটে। পনেরো জন যুবক ইমিগ্রেশান শেষে বেরিয়ে এলো এয়ারপোর্ট থেকে। জেনারেলের ব্যক্তিগত সুপারিশে এই পনেরজন এসেছে। ইমিগ্রেশানে কোন রকমের ঝামেলা হল না। কেউ কোন প্রশ্নও করল না। 

কংস নামের যুবকটি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। কোন এক কারণে সে রোদ সহ্য করতে পারছে না। এই গরমেও মুখ আর গলার চারপাশ দিয়ে মোটা মাফলার জড়ানো। হাতে গ্লাভস। ঘোলাটে চোখ জোড়া এয়ারপোর্টের এরিয়ার এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরতে লাগল। 

বাকিরা ট্যাক্সি ডাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কতদিন পরে আবার এই দেশের মাটিতে পা দেওয়া। ভাবতেই ভালো লাগছে। পড়ন্ত বিকালের সূর্যটার দিকে তাকিয়ে কংস আনমনেই হেসে ফেলল। 

মাইক্রোবাস ভাড়া করা হল। ড্রাইভার “কোথায় যাবেন” জিজ্ঞাসা করতেই কংস বলল, “মথুরা চল।” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *