পলাতক

পলাতক

সকালবেলার ডাকে একটা পোস্টকার্ড পেলাম। প্রেরকের ঠিকানা নেই, নাম দস্তখত নেই, কেবল কয়েকটি হোমিওপ্যাথি ওষুধের নাম। নক্স ভমিকা, সাল্‌ফার, পালসেটিলা ইত্যাদি গোটা বারো ওষুধ।

চিঠি কে লিখেছে আমি জানি; আমার বন্ধু কমলেশ। সে অজ্ঞাতবাস করছে, দু’তিন মাস অন্তর আমি তার কাছ থেকে এই ধরনের চিঠি পাই।

চিঠি পাওয়ার আধ ঘণ্টা পরে কমলেশের শালা সৌরীন এল। বছর বত্রিশ বয়স, লম্বা মোটা দশাসই চেহারা, ভাঁটার মতো চোখ; সর্বদা কোট-প্যান্ট পরে থাকে। আমার দিকে চোখে পাকিয়ে মোটা গলায় বলল, ‘আপনি জানেন কমলেশ কোথায় লুকিয়ে আছে। ভাল চান তো বলুন, নইলে—’

প্রশ্ন করলাম, ‘নইলে কী?’

সৌরীন তার শরীরটা মুষ্টিযোদ্ধার ভঙ্গিতে টান করে দু’হাত মুঠি করে বলল, ‘দেখছেন চেহারাটা?’

সৌরীনের চেহারা ইতিপূর্বে আরো কয়েকবার দেখেছি, মাঝে মাঝে এসে আমাকে হুমকি দিয়ে যায়। একবার বোনকেও সঙ্গে এনেছিল। সেদিন ভাল করে চিনতে পেরেছিলাম কমলেশের বউ কেমন মেয়ে। প্রথমে আমার গা ঘেঁষে বসে মিষ্টি মিষ্টি খোশামোদের কথা বলেছিল, তারপর উগ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। ভদ্রঘরের মেয়ের মুখে এমন দেশি বিলিতি খিস্তি-খেউড় আগে কখনো শুনিনি। কিন্তু কোনওই ফল হয়নি। তারপর থেকে সৌরীন একাই আসে।

সৌরীন বক্সারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চোখ পাকিয়ে আছে দেখে আজ আমার মেজাজটা হঠাৎ বিগড়ে গেল। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। আমি উঠে বাঁ হাতে তার নেকটাই ধরে ডান হাতে তার গালে একটা চড় মারলাম। বললাম, ‘তুমি আমার বাড়িতে ট্রেসপাস করেছ। ভাল চাও তো এখনি বেরোও, নইলে লাথি মেরে প্যান্টুলুন ফাটিয়ে দেব।’

সৌরীন হতবুদ্ধির মতো গালে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর নেড়ি কুত্তার মতো ল্যাজ গুটিয়ে পালাল। সৌরীনের যত বিক্রম মুখে। কাগজের বাঘ।

কমলেশ আমার প্রাণের বন্ধু। তার বাবা বছর তিনেক আগে অনেক টাকাকড়ি এবং কলকাতায় একটি বসতবাড়ি রেখে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু মরবার আগে তিনি একটি কুকার্য করেছিলেন, একমাত্র ছেলের সঙ্গে দেউলিয়া ব্যারিস্টার শৈলেন মজুমদারের মেয়ে মঞ্জরীর বিয়ে দিয়েছিলেন। শৈলেন ব্যারিস্টারের এক সময় খুব ভাল ক্রিমিনাল প্র্যাকটিস ছিল; কিন্তু তিনি নিজেও ছিলেন অমিতব্যয়ী এবং তাঁর স্ত্রী পুত্র কন্যাও তাঁর ধাত পেয়েছিল। ফলে তাঁর প্র্যাকটিস যখন হঠাৎ পড়ে গেল তখন তাঁর ভাঁড়ে মা ভবানী ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি কোনও মতে মেয়েকে পাত্রস্থ করে দায়মুক্ত হলেন এবং পুনর্মুষিকের মতো জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে লাগলেন।

মঞ্জরী এসে কমলেশের সংসারে পাটরানী হয়ে বসল। বাড়িতে কেবল কমলেশ আর তার বাবা। বিয়ের তিন মাস পরে বাবাও গেলেন। রয়ে গেল শুধু কমলেশ।

কমলেশ লাজুক এবং মুখচোরা স্বভাবের মানুষ। সুতরাং মঞ্জরীর পোয়া বারো। বিয়ের ছ’ মাস যেতে না যেতে সে একাধারে বাড়ির কর্তা এবং গিন্নী হয়ে দাঁড়াল। নিজের ইচ্ছেমতো সিনেমা দেখতে যায়, বন্ধুদের নিয়ে থিয়েটার দেখে, নিজের বাপের বাড়ির সকলকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়, কমলেশের অনুমতি নেওয়া দূরের কথা, তাকে জানায় পর্যন্ত না। এক মাসের সংসার খরচ এক হপ্তায় শেষ করে দিয়ে কমলেশকে বলে, অত কম টাকায় ভদ্রলোকের সংসার চলে না, আরো টাকা বের করো।

কমলেশ কোনও দিনই আমার কাছে কিছু লুকোয় না। বিয়ের পরেও আমি তার পারিবারিক জীবনের সব খবরই পেতাম। মঞ্জরী সুন্দরী না হলেও তার চটক আছে। কমলেশ প্রথম কিছু দিন মুগ্ধ হয়েছিল, তারপর নেশার ঘোর কেটে গেল। তখন আমার কাছে এসে কাঁদুনি গাইত আর বলত, খবরদার, তুই বিয়ে করিসনি। বিয়ে করেছিস কি মরেছিস।

আমার অবশ্য বিয়ে করার ইচ্ছে কোনও দিনই ছিল না এবং কোনও কালে হবেও না। কিন্তু কমলেশের অবস্থা দেখে যেমন রাগ হতো তেমনি দুঃখও হতো।

ক্রমে কমলেশের শালা সৌরীন তার বাড়িতে এসে আড্ডা গাড়ল। খায়-দায় ঘুমোয়, কমলেশের খরচে দামী সিগারেট টানে, বোনকে ক্রিকেট ম্যাচ টেনিস ম্যাচ দেখাতে নিয়ে যায়। কমলেশ একদিন তাকে বাজার থেকে কি জিনিস কিনে আনতে বলেছিল, সৌরীন এমন চোখ ঘোরাতে আরম্ভ করল যে, তারপর থেকে আর সে সৌরীনকে কোনও কথা বলেনি।

বছরখানেক পর জানা গেল কমলেশের শ্বশুর-শাশুড়িও বাসা তুলে দিয়ে কমলেশের স্কন্ধে আরোহণের উদ্যোগ আয়োজন করছেন। তাঁদের আরো তিন-চারটি নাবালক পুত্র কন্যা আছে।

কমলেশ একদিন এসে বলল, ‘আমি এবার পাগল হয়ে যাব। কি করি বল্‌ দেখি?’

বললাম, ‘বৌকে ধরে বেদম ঠ্যাঙানি দে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

সে নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘তা যদি পারতাম তাহলে কি আমার এ দুর্দশা হতো। তুই বুদ্ধি দিতে না পারিস আমি নিজেই একটা কিছু করব।. আমি মরীয়া হয়ে উঠছি।’

‘আর কী করবি? ডিভোর্স?’

‘না না, ডিভোর্সে অনেক হাঙ্গামা। অন্য কিছু।’

কমলেশ চলে গেল। তারপর মাস দেড়েক তার আর দেখ নেই। আমি কয়েকবার তার বাড়িতে ফোন করে তাকে পেলাম না। সৌরীনের মোটা গলা পেলাম।

‘হ্যালো।’

‘কমলেশের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘কমলেশ বাড়ি নেই।’

‘কোথায় গেছে?

‘কে জানে কোথায় গেছে!’

‘আপনি কে?’

‘সৌরীন মজুমদার। আপনি কে?’

নাম বললাম। প্রশ্ন হলো, ‘কি দরকার?’

‘আপনার সঙ্গে কোনও দরকার নেই।’ এই বলে আমি ফোন রেখে দিলাম। তারপর যতবার ফোন করেছি ওই একই প্রশ্নোত্তর।

দেড় মাস পরে একদিন সকালবেলা কমলেশ আমার বাড়িতে এল। হাতে একটি পুরুষ্ঠু ব্যাগ, ছিঁচকে চোরের মতো সতর্ক ভাবভঙ্গি। দেখেই সন্দেহ হয়। বললাম, ‘কি রে, বৌকে খুন করেছিস নাকি?’

সে সন্তর্পণে ব্যাগটি কোলে নিয়ে আমার পাশে বসল। বলল, ‘উঁহু। তোর বাড়িতে আর কেউ আছে নাকি?’

বললাম, ‘বৌও নেই শালাও নেই, আমার বাড়িতে আর কে থাকবে। চাকরটা বাজারে গেছে।’

কমলেশ তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, ‘আমার বাড়ি আর গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘বলিস কী। বাড়ি গাড়ি বিক্রি করতে গেলি কেন?’

কমলেশ মুচকি হাসল, উত্তর দিল না। তারপর ব্যাগের ওপর আঙুলের টোকা দিয়ে বলল, ‘এর মধ্যে কী আছে জানিস? টাকা। ব্যাঙ্কে যত টাকা ছিল সব তুলে নিয়েছি। তার ওপর বাড়ি আর মোটর বিক্রির টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা এই ব্যাগের মধ্যে আছে।’

আমি হতবুদ্ধি হয়ে বললাম, ‘কি সর্বনাশ, এত টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! কী মতলব তোর?’

সে বলল, ‘দক্ষিণ কলকাতার একটা ব্যাঙ্কে ভল্ট আছে খবর নিয়েছি। সেখানে তোর নামে লকার ভাড়া নিয়ে টাকাগুলো রাখব।’

আমার মাথা ঘুরে গেল, ‘তারপর?’

‘তারপর আমি হাওয়া হব।’

‘হাওয়া হবি!’

‘হ্যাঁ, একেবারে নিরুদ্দেশ। পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস।’

মনটা খানিকক্ষণের জন্য অসাড় হয়ে রইল। স্ত্রী এবং শ্বশুর পরিবারের সম্পর্কে কমলেশের জীবন এতই দুর্বহ হয়েছে যে, সে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বৈরাগী হয়ে যেতে চায়। শেষ পর্যন্ত বললাম, ‘আমার নামে তোর যথাসর্বস্ব রাখতে চাস। তার দরকার কি? নিজের নামেই তো রাখতে পারিস?’

সে বলল, ‘না রে, জানিস তো শ্বশুর ব্যারিস্টার। যদি খবর পায় আমি টাকা লকারে লুকিয়ে রেখেছি অমনি আইনের ফাঁদে ফেলে সব টাকা হজম করবে।’

‘আর আমি যদি টাকা হজম করি?’

কমলেশ ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়াল, ‘তুই যদি হজম করিস বুঝব আমার টাকার সদ্‌গতি হলো। নে ওঠ, এখনি ব্যাঙ্কে যেতে হবে।’

ট্যাক্সি চড়ে দক্ষিণ কলকাতার ব্যাঙ্কের দিকে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় গিয়ে অজ্ঞাতবাস করবি কিছু ঠিক করেছিস?’

‘সব ঠিক করেছি। কিন্তু একথা কেবল তুই জানবি আর আমি জানব।’ কমলেশ তার অজ্ঞাতবাসের আস্তানা কোথায়, আমাকে বলল।

চড় খেয়ে সৌরীন প্রস্থান করবার পর আমি বাজার করতে বেরুলাম। হোমিও দোকানে গিয়ে ওষুধ কিনলাম। আরো অনেক টুকিটাকি। কমলেশ যদিও কাপড়চোপড়ের কথা লেখেনি, তবু একজোড়া ধুতি আর তিনটে গেঞ্জি কিনে নিলাম। নিজের সম্বন্ধে তার বড় গাফিলতি।

দিনটা নিঃসঙ্গ আলস্যে কাটল। সংসারে আমি একা; কেবল একটি তিনতলা বাড়ি আছে। নীচের তলায় আমি থাকি, উপরের দু’টো তলা ভাড়া দিয়েছি, সেই ভাড়া থেকে আমার জীবিকা নির্বাহ হয়।

রাত্রি এগারোটার সময় স্টেশনে গিয়ে একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরলাম। সারারাত গাড়ি থামতে থামতে চলল। তারপর ভোরবেলা একটি ছোট্ট স্টেশনে নেমে পড়লাম।

রোদ উঠেছে, সোনালী কাঁচা রোদ। স্টেশনের বাইরে রেল কর্মচারীদের কোয়ার্টার এবং কয়েকটি টিনের ঘর। মুদির দোকানের ঝাঁপ সবে মাত্র উঠছে। আমি ব্যাগ হাতে গিয়ে দাঁড়ালাম, মুদি হেসে বলল, ‘আসুন কর্তা। চা তৈরি হচ্ছে। সাইকেল চাই তো?’

বললাম, ‘সাইকেল চাই বৈকি। সাইকেল চালু অবস্থায় আছে তো?’

‘আজ্ঞে আছে। আসুন, ভেতরে এসে বসুন।’

মুদির দোকানে মুড়িমুড়কি সহযোগে চা খেলাম, তারপর সাইকেলের পিছনে ব্যাগ বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাইকেলের ভাড়া দৈনিক চার আনা; কাল সকালে এসে মুদিকে সাইকেল ফেরত দেব।

মেটে রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলেছি। রাস্তায় লোকজন নেই, দু’পাশের দৃশ্য কখনো একটু শিলাকীর্ণ কখনো দূর্বাশ্যামল। মেটে রাস্তাটি দক্ষিণ দিকে বেঁকে গেছে, কোথাও সরু শান্ত একটি নদীর গা ঘেঁষে চলেছে। দূরে দূরে তালগাছ খেজুরগাছের গুচ্ছ।

প্রায় তিন মাইল সাইকেল চালাবার পর সামনে একটি গ্রাম নজরে এল। বাঁশঝাড় ঘেরা আদিবাসীদের গ্রাম, আশেপাশে হাঁস মুরগী চরে বেড়াচ্ছে। আরো কাছে গিয়ে দেখলাম, গ্রামের কিনারায় পাকুড় গাছের তলায় একটি যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বোধ হয় আমাকে দেখতে পেয়েই ছুটে গ্রামের মধ্যে চলে গেল।

পাকুড় তলায় সাইকেল থেকে নেমে আমি সজোরে কয়েকবার ঘন্টি বাজালাম। গ্রাম থেকে নয়া পয়সার মতো এক পাল ছেলেমেয়ে পিলপিল করে বেরিয়ে এল, তাদের পিছনে কমলেশ।

কমলেশ হাসিমুখে বলল, ‘এলি? আয় আয়। তুই আসছিস আমি আগেই খবর পেয়েছি।’

যে মেয়েটা পাকুড় তলায় দাঁড়িয়েছিল সেই নিশ্চয় ছুটে গিয়ে খবর দিয়েছিল। এবার লক্ষ্য করলাম কমলেশের বেশ ছিরি হয়েছে, গায়ে মাছি পিছলে পড়ে। তবু প্রশ্ন করলাম, ‘আছিস কেমন?’

‘খাসা আছি।’ সে যেন আরো কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।

কমলেশের কুটির গ্রামের অন্য প্রান্তে। আমরা মিছিল করে সেই দিকে চললাম। আগে আগে কমলেশ, তার পিছনে আমি, আমার পিছনে অর্ধনগ্ন ছেলেমেয়ের দল। গ্রামের মেয়ে-পুরুষ নিজের নিজের কুটির থেকে দাঁত বার করে আমাকে অভ্যর্থনা করল।

কমলেশের কুটির দেখা গেল। সামনের রোয়াকে এক সারি লোক বসে আছে। তারা ওষুধ নিতে এসেছে। কমলেশ গ্রামের অবতৈনিক ডাক্তার।

কুটিরে ফিরেই কমলেশ ডাক্তারি করতে বসে গেল। আমি ব্যাগের মধ্যে সেরখানেক লবঞ্চুষ এনেছিলাম, তাই শিশুদের মধ্যে বিতরণ করলাম। তারা লবঙুষ চুষতে চুষতে হর্ষকাকলি করতে করতে চলে গেল।

কমলেশও চটপট রুগীদের ওষুধ দিয়ে বিদেয় করল। তারপর আমরা রোয়াকের ওপর মুখোমুখি বসলাম। কমলেশ মুচকি হেসে প্রশ্ন করল, ‘তারপর শত্রুপক্ষের খবর কি?’

বললাম, ‘কাল শত্রুপক্ষের সেনাপতি এসেছিল, তার গালে একটা চড় মেরেছি।’

কমলেশ হো হো করে হেসে উঠল, ‘সত্যি চড় মেরেছিস! আহা, আমি দেখতে পেলাম না।’

বললাম, ‘যাকে বাড়ি বিক্রি করেছিলি সে এখন বাড়ি দখল করেছে, তোর শালা আর বৌ বাপের বাড়িতে ফিরে গেছে। তাদের আর সে জৌলুস নেই। থিয়েটার সিনেমা দেখা বন্ধ। পাগলের মতো তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।’

এই সময় কুটিরের ভিতর থেকে একটি ষোল-সতেরো বছরের শ্যামাঙ্গী মেয়ে এসে আমার সামনে এক বাটি গরম দুধ এবং কিছু ক্ষীরের মণ্ড রাখল। মনে হলো এই মেয়েটাই আমার প্রতীক্ষা করছিল। দেখলাম তার মুখে একটু চাপা হাসি খেলা করছে, সে আমার প্রতি সকৌতুকে কটাক্ষপাত করে আবার ভিতরে চলে গেল।

আগে যতবার এসেছি, কমলেশকে নিজেই নিজের রান্নাবান্না করতে দেখেছি। এ মেয়েটাকে বোধ হয় সম্প্রতি ঘরের কাজ করার জন্যে রেখেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ মেয়েটাকে কোথা থেকে জোগাড় করলি?’

কমলেশ অপ্রস্তুতভাবে কিছুক্ষণ ঘাড় হেঁট করে রইল, তারপর মুখ নীচু করেই অস্পষ্ট, স্বরে বলল, ‘লখিয়া আমার বৌ।’

আঁতকে উঠলাম, ‘অ্যাঁ! আবার বিয়ে করেছিস?’

কমলেশ বলল, ‘কি করব ভাই। আমার উপায় ছিল না। গাঁয়ের মোড়লের আমাশা হয়েছিল, আমি ওষুধ দিয়ে সারিয়েছিলাম। সেরে উঠে মোড়ল বলল—তুমি মস্ত বড় ডাক্তার, গাঁয়ের অনেক উপকার করেছ, আমরা তোমার বিয়ে দেব, তুমি যদি একলা থাকো সেটা আমাদের ভারি লজ্জার কথা হবে।… আমি অনেক না না করলাম, কিন্তু ওরা শুনল না। লখিয়া হচ্ছে মোড়লের ভাগনী। একদিন লখিয়াকে এনে আমার সঙ্গে মালা বদল করিয়ে বিয়ে দিল। তারপর গাঁ-সুদ্ধ মেয়ে-মদ্দ মদ খেয়ে সারা রাত নাচল আর ঢোল মাদল বাজাল। এর পর আমি আর কি করতে পারি বল্‌।’

আমি একটু মুহ্যমান হয়ে পড়লাম। পৃথিবীতে ভালমানুষ হয়ে লাভ নেই; ভালমানুষ পেলে সবাই জুলুম করে, এমন কি আদিবাসী পর্যন্ত। কমলেশ একটা বৌ নিয়েই নাকানি চোবানি খাচ্ছে, এখন তার দুটো বৌ হলো। শেষ পর্যন্ত হয়তো এ গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে।

লখিয়া এসে দুধের বাটি আর রেকাব তুলে নিয়ে গেল, তারপর ফিরে এসে কমলেশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তার কানে কানে কি বলল; কমলেশ ঘাড় নেড়ে সায় দিল। তখন লখিয়া ছুটে বাইরে চলে গেল।

কমলেশকে প্রশ্ন করলাম, ‘কতদিন বিয়ে হয়েছে?’

সে বলল, ‘মাস দুই হলো। গতবার তুই এসেছিলি। তার দশ-বারো দিন পরে।’

‘দেখতে তো ভালই। স্বভাব-চরিত্র কেমন?’

কমলেশ একটু চুপ করে রইল, তারপর সহজ মোহমুক্ত স্বরে বলল, ‘ভারি মিষ্টি স্বভাব। মঞ্জরীর মতো নয়। ও এসে অবধি আমাকে ঘরের কাজ আর কিছু করতে হয় না। শুধু ডাক্তারি করি।’

‘হুঁ। এখন তোর কানে কানে কথা বলে কোথায় গেল?’

কমলেশ হাসল, ‘গাঁয়ের একটা বুড়োর গেঁটে বাত হয়েছিল, নড়তে পারত না, তাকে সারিয়েছিলাম। সে খুশি হয়ে আমাকে একটা মোরগ দেবে বলেছিল। আজ তুই এসেছিস তাই লখিয়া মোরগ আনতে গেল। আজ ফাউল কারি হবে।’

দুপুরবেলা নদীতে স্নান করে এসে দু’জনে ফাউল কারি খেলাম। লখিয়া যদিও ছেলেমানুষ কিন্তু রাঁধে ভাল। অন্তত কমলেশের চেয়ে ভাল রাঁধে।

তারপর ঘরের মেঝেয় মাদুর পেতে দুই বন্ধু পাশাপাশি শুলাম। সারা দিন গল্প হলো। বুঝলাম কমলেশ লখিয়াকে বিয়ে করে সুখশান্তির স্বাদ পেয়েছে। সে আর কোনও দিন সভ্য সমাজের কোলে ফিরে যেতে চাইবে না।।

রাত্রিটাও দুই বন্ধু এক বিছানায় শুয়ে দুপুর রাত পর্যন্ত গল্প করে কাটালাম। লখিয়া বোধ হয় মামার বাড়ি গিয়ে রাত কাটাল।

রাত্রে গল্প করতে করতে কমলেশ হঠাৎ বিছানায় উঠে বসল, ‘হ্যাঁরে, তুই বিয়ে করবি? ফুলিয়া নামে একটা মেয়ে আছে, লখিয়ার সখী। ভারি ভাল মেয়ে, ঠিক লখিয়ার মতো স্বভাব। দেখতেও ভাল! বিয়ে করিস তো বল্‌ সম্বন্ধ করি।’

আমিও উঠে বসে বললাম, ‘খবরদার। তুই দুটো বিয়ে করেছিস, ইচ্ছে হয় আরো পাঁচটা বিয়ে কর। আমি ও-সবের মধ্যে নেই। সভ্য বৌ, জংলী বৌ কিছুই আমার চাই না। পৃথিবীতে একলা এসেছি একলা চলে যাব। অন্তত মেয়েমানুষকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিনে।’

কমলেশ বলল, ‘তুই কাপুরুষ। এখন ঘুমিয়ে পড়, কাল আবার ভোরবেলায় উঠতে হবে।’

পরদিন ভোর না হতে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পৌনে সাতটার সময় ট্রেন আছে, বিকেলবেলা কলকাতায় পৌঁছুবে।

কমলেশ গ্রামের কিনারা পর্যন্ত আমার সঙ্গে এল। আমি যখন সাইকেলে চড়তে যাচ্ছি তখন সে বলল, ‘দ্যাখ, এবার যখন আসবি এক জোড়া লালপেড়ে শাড়ি আনিস। ওকে এখনো কিছু দিইনি। শৌখীন শাড়ি নয়, গড়গড়ে মোটা শাড়ি আনবি। নইলে গাঁয়ের অন্য মেয়েদের হিংসে হবে।’

‘আচ্ছা—বলে আমি বেরিয়ে পড়লাম।’

যেতে যেতে নানান কথা মনে আসতে লাগল। শহরের সভ্য জীবন তো বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। শান্তি নেই, স্বচ্ছন্দতা নেই, আনন্দ নেই। কমলেশ বেশ আছে, জীবন যন্ত্রণার সমাধান করে নিয়েছে। আমিও যদি ওর সঙ্গে জুটে যাই—

১৮ জুলাই ১৯৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *