ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

পলাতক গুণ্ডা

পলাতক গুণ্ডা (ছোট গল্প)

০১.

সন-তারিখের হিসাব গুণ্ডা রাখে না। আমরা রাখি। তাই পৌষমাসের এক সকালে জমিদার প্রতাপনারায়ণ চৌধুরী এবং তার বন্ধু দেবেন্দ্রবিজয় বসুর শিকারের তোড়জোড় করার কথা শুনে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ, সময়টা হচ্ছে ১৯১০ সাল, ইংরেজ-অধিকৃত ভারতে তখনও জমিদারি প্রথা বর্তমান।

গুণ্ডা অবশ্য এ সব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। সত্যিকথা বলতে কি, একমাত্র খাবার-দাবারের ব্যাপার ছাড়া খুব কম বিষয়েই সে মাথা ঘামায়। একটু দূরে উঁচু জমির উপর দাঁড়িয়ে থোকাবাবু যে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঠোঁট চাটছে, সেই দৃশ্যটা গুণ্ডার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি, কিন্তু ব্যাপারটাকে সে মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। সামনের ভিজে মাটিতে বেশ মিষ্টি মিষ্টি গাছের মুল পাওয়া গেছে, সেগুলো দিয়ে পেট ভরাতেই সে ব্যস্ত কোথাকার কে খোকাবাবু তার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে আর কি করছে তা নিয়ে চিন্তা করতে সে এখন রাজি নয়।

গুণ্ডা চিন্তা না করলেও খোকাবাবু কিন্তু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। গুণ্ডার দিকে তাকিয়ে তার জিভে জল জমছে। তবে হঠাৎ তার উপর লাফিয়ে পড়া উচিত হবে কি না বুঝতে পারছে না।

ওই যাঃ! প্রথমেই তো আসল কথাটা বলতে ভুলে গেছি! গুণ্ডা হচ্ছে একটা মস্ত দাঁতাল শুয়োর। আর আমাদের খোকাবাবু হচ্ছে একটি খোকা-চিতাবাঘ। চিতাবাঘদের সমাজে তাকে বাচ্চা মনে করা হয় বটে, কিন্তু তোমরা তাকে দেখলে কিছুতেই বাচ্চা বা খোকা বলে মানতে রাজি হবে না। মাত্র দেড় বছর বয়সেই তার কাধ আর পায়ের মাংসপেশী দস্তুরমতো পুষ্ট, থাবার নখ আর মুখের দাঁত দেখলে মস্ত বড়ো ‘হাউণ্ড’ কুকুরও তার সামনে এককভাবে এগিয়ে আসতে সাহস পাবে না।

খোকা দাঁড়িয়ে ছিল একটু উঁচু জমির উপর। এতক্ষণে সে হয়তো লাফিয়ে পড়ত, তবে কয়েকটা কথা ভেবে সে একটু ইতস্তত করছিল। খুব ছোটোবেলা থেকেই সে মায়ের কাছে শুনে এসেছে দাঁতাল শুয়োরগুলো বড়ো সাংঘাতিক জীব, ওদের সঙ্গে লাগতে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। ও সব কথার খুব বেশি দাম দেয়নি খোকা। অল্প বয়সের গরম রক্তে এখন খুনের নেশা, খোকা সুবিধা পেলেই শিকারের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে চায় বেশি বয়সের অভিজ্ঞতার দাম সে এখনও দিতে শেখেনি। তবু সে যে এতক্ষণে শিকারের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, তার কারণ মায়ের উপদেশ নয় শুয়োরের চেহারা দেখেই সে একটু ঘাবড়াচ্ছে। এর মধ্যে জন্তুটা একবার তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে, তারপর আবার মাটি খুঁড়ে শিকড় বার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিকারের এমন নির্বিকার ভাব দেখে আশ্চর্য হয়েছে খোকা। তার অভিজ্ঞতায় সে জেনেছে জন্তুরা তাকে দেখলে দৌড়ে পালায়, অথবা রুখে দাঁড়ায় কিন্তু এই জটা তাকে গ্রাহ্যই করছে না।

খোকা মনস্থির করে ফেলল। তার কাঁধের মাংসপেশী ফুলে উঠল, দুই কান চ্যাপটা হয়ে মিশে গেল মাথার খুলির সঙ্গে, লেজটা চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল মাটির উপর একবার, দুবার, তিনবার কিন্তু লাফ দেবার আগেই ঘাড়ের উপর এক দারুণ থাপ্পড় খেয়ে ছিটকে পড়ল খোকাবাবু, সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চাপা গর্জন, করছিস কি খোকা? মরবি নাকি?

মা-চিতাবাঘ যে কিছুক্ষণ আগেই ছেলের খোঁজ করতে করতে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে এবং আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ করছে সে কথা খোকা জানতে পারেনি- এখন আচমকা মার খেয়ে তার মেজাজ বিগড়ে গেল।

দুই চোখে আগুন জ্বালিয়ে থোকা মায়ের দিকে ফিরল, আমি মরব না, ওকে মারব। কিন্তু তুমি আমায় যখন-তখন চড় মারবে না। সাবধান!

মায়ের চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে খোকার চোখের আগুন নিবে গেল তৎক্ষণাৎ। খোকা জানে এখনও মায়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা তার হয়নি। গায়ের জোর হয়তো তার মায়ের চাইতে কম নয়, কিন্তু লড়াইয়ের কায়দা-টায়দাগুলো সে এখনও তেমন রপ্ত করতে পারেনি মা এত চটপট দাঁত আর নখ চালাতে পারে যে মারামারি করতে গেলে খোকা মার খেয়ে ভূত হয়ে যাবে।

তোমরা হয়তো ভাবছো, সে কি! ভারি অসভ্য ছেলে তো! মা মারলে কোনো ছেলে উলটে মাকে মারে নাকি?

তা মারে; চিতাবাঘদের সমাজে মাতৃস্নেহ আছে, মায়ের প্রতি ছেলের আকর্ষণও থাকে— কিন্তু সময়-বিশেষে খুনোখুনি করতে তাদের বাধে না।

আমাদের খোকাবাবু অবশ্য মায়ের গায়ে এখনও পর্যন্ত থাবা তোলেনি। তবে তার মা জানে কয়েক দিন বাদেই খোকা আর মাকে মানতে চাইবে না। সেইজন্য মা-চিতাবাঘ যে বিশেষ চিন্তিত তা নয়, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে সে ভালোভাবেই জানে এখন ছেলের অবাধ্যতার চাইতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়েই সে বিশেষভাবে চিন্তিত।

শোন খোকা, মা বলল, এখান থেকে এক লাফ মেরে শুয়োরটাকে ডিঙিয়ে চলে যা। তারপর সামনের ছোটো বিলটার মধ্যে নেমে সাঁতার কেটে উলটোদিকে গিয়ে ঢুকে যাবি পাশের বনে। আমি তোর পিছনে আসছি।

খোকা অবাক হয়ে বলল, কেন মা? শুয়োরটাকে তো আমরা দুজনে মিলে মেরে ফেলতে পারি। আর যদি ওকে না মারি তাহলেই বা শুধু শুধু ছুটোছুটি করতে যাব কেন? আমার খিদে পেয়েছে। আমি এখন খেতে চাই, ছুটতে বা সাঁতার কাটতে চাই না।

মা বলল, ওই গুণ্ডা শুয়োরটাকে আমরা দুজনে মিলেও মারতে পারব না। তবে ওকে নিয়ে এখন আমি একটুও মাথা ঘামাতে রাজি নই। ওকে না ঘটালে ও আমাদের সঙ্গে লাগতে আসবে না। তা ছাড়া, গাছে উঠে আমরা ওকে অনায়াসেই ফাঁকি দিতে পারি। কিন্তু শুয়োর নয় আমাদের পিছন দিক থেকে এগিয়ে আসছে আর এক বিপদ। গ্রাম থেকে এক দল লোক কুকুর নিয়ে বনে শিকার করতে আসছে। পাজি কুকুরগুলো গন্ধ শুঁকে আমাদের ধরে ফেলবে। গাছে উঠেও রক্ষা নেই, মানুষগুলো তলা থেকে এক রকম লাঠি থেকে আগুন ছুঁড়ে মারবে, আর সেই আগুন গায়ে লাগলেই আমরা মারা যাব। গুণ্ডা শুয়োরটা এখনো শিকারিদের খবর পায় নি। ও হয়তো আমাদের তাড়া করতে পারে। কিন্তু সেজন্য ভাবনা নেই। চিতাবাঘদের সঙ্গে দৌড়ে কোনো শুয়োর জিততে পারে না। আর কুকুরগুলো যদি ওর পিছনে তাড়া করে তাহলে তো আমরা বেঁচেই গেলাম।

খোকা প্রশ্ন করল, দলে কতগুলো কুকুর আছে তুমি জানো? মা বলল, জানি বৈকি। গাছের উপর থেকে ওদের দেখতে পেয়েই আমি এদিকে ছুটে এসেছি। দলে আছে চার-চারটি কুকুর। কুকুরদের সঙ্গে আছে অনেকগুলো মানুষ। তাদের হাতে অনেক অস্ত্রশস্ত্র। দু’জন আবার ঘোড়ায় চড়ে আসছে। নাঃ, আর দেরি করা ঠিক নয়। খোকা! এইবার টেনে এক লাফ মার, কে জানে ভাগ্যে কি আছে!

.

০২.

ভাগ্যে কি আছে ভগবানই জানেন, শান্তা দেবীর গলার স্বরে ক্ষোভ, বাবার বড় আদরের জীব ছিল ও। ওকে মারতে যাওয়া কি উচিত হবে?

প্রতাপনারায়ণ হেসে উঠলেন, বাবার আদরের জীব এখন আর আদর করার মতো নেই। হয়তো একদিন শুনবে সে মানুষ মেরে বসেছে। তা ছাড়া ওকে মারব বলেই যে শিকারে যাচ্ছি একথা ভাবছ কেন? ওই জঙ্গলে দুটো চিতাবাঘ এসেছে; বুনো খরগোশ আর ছোটো হরিণও ওখানে পাওয়া যায়।

শান্তা বললেন, তুমি যাই বলল না কেন, আমি তো জানি গুপ্তার উপর তোমার অনেক দিনের রাগ। গাঁয়ের ধারে ছোটো জঙ্গলগুলোতে আজকাল ওকে প্রায়ই দেখা যায়। আমার মনে হচ্ছে সুবিধে পেলেই তুমি ওকে মারবার চেষ্টা করবে।

কী মুশকিল, প্রতাপনারায়ণ বললেন, মারার ইচ্ছে থাকলে আমি কি আগেই ওকে মারতে পারতুম না?

সে তো আমার জন্যে, শান্তা বললেন, প্রত্যেক বার শিকারে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে দিব্যি দিয়ে গুণ্ডাকে মারতে নিষেধ করেছি।

-তবে আর ভয় পাচ্ছো কেন?

-ভয় পাচ্ছি, কারণ, এইবার তোমার সঙ্গে আছেন দেবেনবাবু। তাকে তো আর আমি দিব্যি দিয়ে বারণ করতে পারব না। তোমার ইশারায় যদি দেবেনবাবু–

দেবেনবাবু আবার কি অপরাধ করল বৌঠান? বলতে বলতে সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রতাপনারাণের বন্ধু দেবেন্দ্রবিজয়।

শশব্যস্তে ঘোমটা টেনেশান্তা বললেন, আপনার বন্ধুকে একটা কথা বলছিলাম। পাশের জঙ্গলে একটা মস্ত শুয়োর আছে। ওটা এককালে এই বাড়িতেই ছিল, বাবা শখ করে পুষেছিলেন ওকে। বাবার মৃত্যুর পর গুণ্ডা অর্থাৎ ওই শুয়োরটা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তাই ওঁকে সাবধান করে দিচ্ছিলাম ওটার উপর যেন হামলা না হয়। আর আপনাকেও ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে বলছিলাম।

দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, আপনার শ্বশুরমশাইয়ের পোষা শুয়োরের কথা আমি আগেই শুনেছি প্রতাপের মুখে। আপনি যদি বারণ করেন তাহলে ওটাকে না হয় ছেড়েই দেওয়া হবে। তবে জঙ্গলে তো আরও দুচারটে শুয়োর থাকতে পারে, আর শুয়োরদের গায়ে নাম লেখাও থাকে না– সুতরাং অজান্তে যদি ওটাকে মেরে বসি, তাহলে অপরাধ নেবেন না। আরও একটা কথা বলছি বৌঠান– বুনো শুয়োর সাংঘাতিক জীব। গাঁয়ের এত কাছে জন্তুটা থাকে, এ ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না, কোনোদিন হয়তো তোকজনকে মেরে ফেলতে পারে।

শান্তার মুখে ক্রোধের আভাস ফুটে উঠল, কিন্তু অতিথির মর্যাদার কথা ভেবে তিনি কণ্ঠস্বর সংযত করলেন, ঠাকুরপো! গুণ্ডাকে আমি ছোটোবেলা থেকেই দেখছি। ওকে না মারলে ও কারুকে মারবে না। আর গায়ে নাম লেখা না থাকলেও ওর চেহারা দেখলেই ওকে আপনি চিনতে পারবেন। ভারতবর্ষের কোনো শুয়োরের ঘাড়ে ওরকম ঝাঁকড়া কেশরের মতো লোম হয় না, চেহারাটাও বেশ অন্য রকম– আপনি যখন ওর কাছে সব কথাই শুনেছেন, তখন এ কথাও নিশ্চয়ই জানেন যে, গুণ্ডা এখানকার জন্তু নয়।

দেবেন্দ্রবিজয় বুদ্ধিমান মানুষ, বন্ধুপত্নীর সংযত স্বর থেকেও তিনি উম্মার আভাস ধরে ফেললেন। ব্যাপারটাকে সহজ করে নেবার চেষ্টা করলেন তিনি, হ্যাঁ শুনেছি, আফ্রিকা থেকে এক সাহেব ওকে ধরে এনেছিল। আপনার শ্বশুরমশাই সেই সাহেবের কাছ থেকেই ওই শুয়োরটা উপহার পেয়েছিলেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বৌঠান আপনার আদরের শুয়োর যদি গায়ে পড়ে মারামারি করতে না আসে, তাহলে আমরা তাকে মারতে যাব না।

প্রতাপনারায়ণ বললেন, কিন্তু অন্য জন্তু তো মারব। যদি শিকারে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে তবে এইবার বেরিয়ে পড়া উচিত। যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে।

দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, দেরির জন্য আমি দায়ী নই। তোমরা কর্তা গিন্নি যদি শিকারে যাওয়ার আগে বরাহতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করো, তাহলে আমি কি করব?

অন্তঃপুর থেকে বাইরের দালানের দিকে পা চালাতে চালাতে প্রতাপনারায়ণ বললেন, আর সময় নষ্ট করব না। চল, ঘোড়া সাজাতে বলে দিয়েছি অনেকক্ষণ আগে।

বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে লাগলেন শান্তা দেবী। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারটে প্রকাণ্ড শিকারি কুকুর আর একদল লাঠি ও বর্শাধারী মানুষ নিয়ে দুই বন্ধু অশ্বপৃষ্ঠে অগ্রসর হলেন।

লাঠি-সোঁটা হাতে যে লোকগুলো শিকারিদের সাহায্য করতে চলল, তাদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শান্তার সুন্দর মুখে উদ্বেগের কালো ছায়া পড়ল, অস্পষ্ট স্বরে তিনি বলে উঠলেন, ও কি, হারান-সর্দার! সেও আছে দলের মধ্যে! কী জানি, আজ কী সর্বনাশ হয়?

অস্ত্রধারী মানুষগুলোর মধ্যে হারান-সর্দার নামক যে বিশেষ ব্যক্তিটি জমিদার-গৃহিণীর চিত্তে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে তার একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। ওই সঙ্গে পূর্ব কথা নিয়েও একটু আলোচনা নিতান্তই প্রয়োজন। শিকারিরা এগিয়ে যাক সেইদিকে, যেখানে খোকা-চিতাবাঘ আর তার মা গুপ্তার ঘাড়ের উপর দিয়ে লাফ মেরে চম্পট দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আমরা ততক্ষণ হারানো অতীত নিয়ে একটু আলোচনা করি।

.

০৩.

প্রতাপনারায়ণের পিতা প্রদ্যোতনারায়ণ চৌধুরী অদ্ভুত মানুষ। তখনকার দিনে অধিকাংশ জমিদারই হতেন স্বেচ্ছাচারী ও বিলাসী প্রদ্যোতনারায়ণকে সেদিক থেকে নিয়মের ব্যতিক্রম বললে সত্যের অপলাপ হয় না। তবে তিনি ছিলেন ভয়ংকর খামখেয়ালি। আর সেই খেয়ালের ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তাঁর স্ত্রী যোগমায়া দেবী।

প্রদ্যোতনারায়ণের প্রধান শখ ছিল শিকার এবং জন্তু-জানোয়ার পোষা। বই পড়তেও তিনি খুব ভালোবাসতেন। তখনকার দিনের ভূস্বামীদের মতো বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে না দিয়ে তিনি অধিকাংশ সময়েই পড়াশুনা করে সময় কাটাতেন। এই ব্যাপারে যোগমায়ার বিশেষ আপত্তি ছিল না। অবশ্য খুব দরকারি কথা বলতে এসে পাঠমগ্ন স্বামীর মুখ থেকে যখন হাঅথবা না ছাড়া আর কোনো কথা শোনা যেত না তখন জমিদারপত্নী খুবই বিরক্ত হতেন সন্দেহ নেই, তবে সেই বিরক্তিটা এমন কিছু ধর্তব্য নয়। সংসার করতে গেলে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়, স্বামীর বই পড়া বাতিকটাও যোগমায়া মেনে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন জাতের পাখি আর জানোয়ার (কুকুর তো ছিলই) দিয়ে কর্তা যখন জমিদার বাড়িকে প্রায় চিড়িয়াখানা করে তুললেন তখনও বিশেষ আপত্তি করেননি যোগমায়া, কিন্তু একবার শিকার করে ফিরে আসার সময়ে কর্তা যখন একটা বাঘের বাচ্চা নিয়ে এলেন এবং জানালেন সেটাকে তিনি পুষবেন, সেই দিনই যোগমায়া সরোষে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন।

বাঘ যে কুকুরের মতোই পোষ মানতে পারে, এ কথা বিশ্বাস করলেন না যোগমায়া। বাঘ সম্বন্ধে জীবতত্ত্ববিদদের মূল্যবান তথ্যগুলোকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন মানুষখেকো জন্তুর সঙ্গে ঘর করতে তিনি রাজি নন, প্রদ্যোতনারায়ণ যদি নিতান্তই বাঘের বাচ্চা পষতে চান তবে স্ত্রী সান্নিধ্য তাঁকে ত্যাগ করতে হবে, কারণ, যোগমায়া তাহলে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়িতেই বসবাস করবেন।

বাঘ মাত্রেই যে মানুষখেকো হয় না, এ কথা বার বার বলেও কোনো ফল হল না, গেম-কিলার আর ক্যাটল লিফটার-এর সঙ্গে ম্যান-ঈটার বাঘের তফাত বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলেন অভিজ্ঞ শিকারি প্রদ্যোতনারায়ণ–কিন্তু যোগমায়া স্বামীর কথায় কর্ণপাত করলেন না। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে সব বাঘই মানুষ খায় এবং ছেলেপুলের ঘরে এমন বিপজ্জনক জানোয়ারকে তিনি স্থান দিতে রাজি নন~ অতএব বাঘের বাচ্চা আর স্ত্রীর মধ্যে এক জনকে প্রদ্যোতনারায়ণের বেছে নিতে হবে।

প্রদ্যোতনারায়ণকে দেখলে খুব শান্ত মানুষ মনে হয়। তাকে কেউ কখনো উত্তেজিত হতে দেখেনি। মাত্র দশ হাত দূর থেকে তেড়ে-আসা বাঘকে যখন তিনি গুলি চালিয়ে মাটির উপর পেড়ে ফেলেছেন তখনো তার মুখে-চোখে সঙ্গীরা উত্তেজনার চিহ্ন দেখতে পায়নি। কিন্তু আপাতশান্ত প্রদ্যোতনারায়ণ ছিলেন ভীষণ জেদি। একবার জেদ ধরলে তাঁকে নিরস্ত করা খুবই কঠিন।

স্ত্রীর সঙ্গে অনেকক্ষণ বাদানুবাদ করার পরেও যোগমায়া যখন বাঘের বাচ্চার সান্নিধ্য সহ্য করতে রাজি হলেন না, তখ ভাবেই প্রদ্যোতনারায়ণ জানালেন কারও স্বাধীন ইচ্ছায় বাধা দিতে তিনি চান না এবং তার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করে, এটাও বাঞ্ছনীয় নয়– অতএব যোগমায়া যদি নিতান্তই বাপের বাড়ি যেতে চান তবে যাবেন, কিন্তু বাঘের বাচ্চা থাকবে।

ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কি হত বলা মুশকিল, তবে শেষ রক্ষা করল পুত্রবধূ শান্তা। খুব অল্প বয়সেই একমাত্র পুত্র প্রতাপের বিয়ে দিয়ে এই সুলক্ষণা মেয়েটিকে পুত্রবধূ করে ঘরে এনেছিলেন প্রদ্যোতনারায়ণ। কন্যাসমা এই মেয়েটির আবদার তিনি ঠেলতে পারতেন না। ঘরের বৌ নয়, ঘরের মেয়ের মতোই ব্যবহার করতে শান্তা শ্বশুরের সঙ্গে।

যোগমায়া যখন বাপেরবাড়ি যাওয়ার উদ্যোগ করছেন, এবং সেদিকেদৃকপাতনা করেপ্রদ্যোতনারায়ণ যখন ব্যাঘ্ৰশাবকের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, সেই সময় হঠাৎ এগিয়ে এল শান্তা-বাবা! এ কি হচ্ছে? মার চাইতে কি বাঘের বাচ্চা তোমার কাছে বড়ো হল?

দুই একবার ক্ষীণ প্রতিবাদ করে শান্তার কাছে হার মানলেন প্রদ্যোতনারায়ণ। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে প্রদ্যোতনারায়ণের খুবই দহরম-মহরম ছিল, হঠাৎ একটা বাঘের বাচ্চা উপহার পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ভারি খুশি হয়েছিলেন।

কিন্তু প্রদ্যোতনারায়ণ খুশি হতে পারেননি। শোনা যায়, তিনি নাকি এক মাস পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ রেখেছিলেন। শান্তা যে স্ত্রীর প্ররোচনাতেই ব্যাঘ্র শাবকের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছিল, এ বিষয়ে প্রদ্যোতনারায়ণের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না।

যাই হোক, এক সময় সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে এল। কয়েক বছর পরে যোগমায়া যখন বাঘের বাচ্চার কথা প্রায় ভুলতে বসেছেন, সেই সময় হঠাৎ একদিন কোথা থেকে একটি শূকরশাবক সঙ্গে নিয়ে কর্তা বাড়ি ফিরলেন এবং ঘোষণা করলেন ওটাকে তিনি পুষবেন। যোগমায়া এবারেও আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু তার আপত্তি ধোপে টিকল না। নোংরামির জন্য অভিযোগ করতেই প্রদ্যোতনারায়ণ জানালেন জমিদারবাড়িতে অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়ার কিংবা ময়লা ঘাঁটার সুযোগ জন্তুটার হবে না, অতএব সে-বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। শুয়োর খুব নিরীহ জন্তু না হলেও সে যে বাঘের মতো ভয়ানক জীব নয়, এ কথা যোগমায়া দেবীও মানতে বাধ্য হলেন। তার উপর শান্তা এবার শ্বশুরের পক্ষ নিল, সে সাফ বলে দিল সব ব্যাপারে খিটখিট করলে পুরুষ মানুষের রাগ তো হবেই- বিশেষত শুয়োরটা যখন ভিতর-বাড়িতে থাকবে না, তার জন্য যখন আলাদা খোঁয়াড়ের ব্যবস্থা হচ্ছে, তখন আর মায়ের আপত্তির কি কারণ থাকতে পারে? বাড়িতে কুকুর আছে, বাঁদর আছে, হরেক রকমের পাখি আর বিড়ালও রয়েছে- শুয়োরছানা কি অপরাধ করল?

যোগমায়া কাবু হলেন। শূকর-শাবক থাকল। প্রতাপনারায়ণ কিছু বলল না, কারণ তার বলা কওয়া বাবা গ্রাহ্যই করেন না। তবু জন্তুটাকে সে বিশেষ সুনজরে দেখেনি। কিন্তু প্রতাপের ভালো না লাগলেও বালিকাবধুর সঙ্গে বাচ্চাটার ভারি ভাব হয়ে গেল। কথায় কথায় শান্তা জানতে পারল এক সাহেব শিকারির সঙ্গে মধ্যভারতের অরণ্যে শিকার করতে গিয়েছিলেন। প্রদ্যোতনারায়ণ এবং বাঙালি শিকারির হাতের টিপ দেখে মুগ্ধ হয়ে সাহেব ওই শূকর-শাবকটিকে উপহার দিয়েছে। জন্তুটা ভারতবর্ষের শূকর নয়। আফ্রিকার জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে ওই বাচ্চাটিকে ধরেছিল সাহেব– তারপর ভারতে আসার সময় জন্তুটাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে স্থানান্তরিত হয়ে আফ্রিকার ওয়ার্ট হগ প্রদ্যোতনারায়ণের গৃহেই আশ্রয় গ্রহণ করল।

বাচ্চাটার নামকরণ হল কালু। নাম রেখেছিল শান্তা নিজেই। শূকর-শাবকের নিরাপত্তার জন্য শান্তার দুশ্চিন্তা ছিল যথেষ্ট। দুশ্চিন্তা অহেতুক নয়, জমিদারবাড়িতে বাস করত অনেকগুলো শিকারি কুকুর! অবশ্য কুকুরগুলো দিনের বেলা বাঁধা থাকত, শূকর-শাবকের খোঁয়াড়টাও ছিল বেশ মজবুত। তবু শান্তার ভয় করত- দৈবাৎ যদি সারমেয়বাহিনীর কোনো একটি কুকুর বাচ্চাটার নাগাল পায় তবে শূকর-শাবকের মৃত্যু যে অনিবার্য, এ বিষয়ে শান্তার সন্দেহ ছিল না বিন্দুমাত্র।

কিন্তু আফ্রিকার ওয়ার্ট হগ যে কেমন জিনিস সেটা শান্তার জানা ছিল না। খুব অল্প বয়সেই বাচ্চাটা প্রমাণ করে দিল কারও সাহায্য ছাড়াই সে আত্মরক্ষা করতে জানে। এক রাত্রে হঠাৎ কুকুরদের চিৎকার শুনে বাড়িসুদ্ধ লোকের ঘুম ভেঙে গেল। চিৎকারের শব্দ আসছিল কালুর খোয়াড়ের দিক থেকে। সেখানে গিয়েই সকলের চোখ ছানাবড়া! খুব সম্ভব খাবার দেবার সময়ে ভৃত্য নিধিরাম খোঁয়াড়টা ভালো করে বন্ধ করেনি, ফলে শূকর-শাবক বেরিয়ে পড়েছে নৈশ-ভ্রমণে। রাতের টহলদারকুকুরগুলো বাচ্চাটাকে দেখে ফেলেছে, তারপরই লেগেছে ধুন্ধুমার কাণ্ড! পূর্ববর্তী ঘটনা কি ঘটেছে তা বলা মুশকিল, সকলের চোখে যে দৃশ্য ধরা পড়ল তা হচ্ছে এই :

খোঁয়াড়ের কাছেই একটা কোণ নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে কালু এবং তাকে ঘিরে গর্জন করছে ক্রুদ্ধ কুকুরের দল। দলের পাণ্ডা ডিক (কর্তার প্রিয় হাউন্ড) রক্তাক্ত কাঁধ নিয়ে মাটির উপর ছটফট করছে, স্পষ্টই বোঝা যায় শূকর-শাবকের দন্তাঘাতেই তার ওই দুর্দশা। অন্যান্য কুকুরগুলোর মধ্যে কয়েকটির দেহে রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে, কালু নিজেও অক্ষত নয়। কিন্তু কুকুরগুলো এখন আর শুকর-শাবকের দিকে এগোতে চাইছে না, দূরে দাঁড়িয়ে আস্ফালন। করছে পয়লা দফা লড়ায়ের পরই তারা বুঝে গেছে এ শিকার খুব নিরীহ নয়, বিশেষ করে দলপতি ডিক আহত হওয়ায় ককরবাহিনী দস্তুরমতো ঘাবড়ে গেছে। দর থেকে জাতীয় ভাষায় গালাগালি করলেও সামনে এসে মোকাবিলা করার সাহস আর কুকুরদের ছিল না।

কুকুর সামলে শূকর-শাবককে খোঁয়াড়ে পুরে ফেলা হল। কর্তা তার পোষা জন্তুর নূতন করে নামকরণ করলেন–গুণ্ডা। নামটা সার্থক হয়েছিল সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে কুকুরগুলো সাধারণ কুকুর নয়, শক্তিশালী হাউন্ড। এতগুলো শিকারি কুকুরের মহড়া নেওয়া চিতাবাঘের পক্ষেও কঠিন।

কর্তা অবশ্য খুব অবাক হননি। তিনি জানতেন ওয়ার্ট হগ কি জিনিস। আহত কুকুরগুলোর চিকিৎসা করা হল। সবচেয়ে ভীষণভাবে আহত হয়েছিল ডিক। চিকিৎসার গুণে সেও আবোগ্যলাভ করল। মাঝে মাঝে গুণ্ডার দিকে তাকিয়ে গর্জন করলেও ডিক আর শক্তিপরীক্ষায় অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেনি- এক রাতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝে গিয়েছিল এ শত্রু বড়ো ভয়ানক, দুর থেকে একে গালি দেওয়া যায় কিন্তু কাছে গিয়ে ঠোকাঠুকি করলে যে কোনো সময়ে প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া হতে পারে।

শুধু কুকুর নয়, গুণ্ডার আরও একটি শত্রু ছিল। সে হচ্ছে পাইকদের দলপতি হারান-সর্দার। যখন-তখন জন্তুটাকে বিরক্ত করে হারান ভারি মজা পেত।

গুণ্ডার খোঁয়াড়টা ছিল মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি। একদিন ওই গুঁড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে হারান যখন একটা কলা নিয়ে শুয়োরটাকে লোভ দেখাচ্ছে, আর সে কলাতে কামড় বসাতে গেলেই সেটা চট করে টেনে নিচ্ছে সেই সময়ে হঠাৎ ব্যাপারটা দেখে ফেললেন প্রদ্যোতনারায়ণ স্বয়ং।

কঠোরভাবে তিরস্কৃত হল হারান। অনেকদিনের পুরোনো লোক বলে আর শিকার-খেলাতে খুব ওস্তাদ খেলোয়াড় বলে কর্তা তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন না; কিন্তু ভবিষ্যতে এরকম কিছু ঘটলে চাকরি তো থাকবেই না, উপরন্তু পৃষ্ঠদেশের চামড়াও যে স্থানত্যাগ করতে পারে সে কথা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রদ্যোতনারায়ণ।

বলাই বাহুল্য, এরপর আর গুণ্ডার পিছনে লাগতে সাহস পায়নি হারান-সর্দার।

শেষ পর্যন্ত গুণ্ডা হয়তো বহাল তবিয়তে জমিদারবাড়িতেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারত, কিন্তু পর পর দুটো দুর্ঘটনার ধাক্কায় সব কিছুই বদলে গেল।

প্রথমে মারা গেলেন যোগমায়া দেবী। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলেন তিনি। ডাক্তার এল, চিকিৎসাও হল, কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না।

স্ত্রীর মৃত্যুর পর অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রদ্যোতনারায়ণ। তার অসুরের মতো স্বাস্থ্যে ভাঙন ধরল। কয়েক বছর পরে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে প্রদ্যোতনারায়ণও সহধর্মিণীর পথ অনুসরণ করলেন।

পিতার মৃত্যর পর জমিদারির মালিক হল প্রতাপনারায়ণ। পূর্বোক্ত গুণ্ডা এখন সত্যিই গুণ্ডা তার দৈহিক আয়তন এবং চোয়ালের দুধারে বেরিয়ে-আসা দাঁত দুটো এখন ভয়ানক আকার ধারণ করেছে।

আগের মতো তার পরিচর্যা এখন হয় না। গৃহস্থালির অনেক দায়িত্ব নিয়ে বিব্রতা শান্তা সবসময়ে শুকরের তত্ত্বাবধান করতে পারে না। ভৃত্য তার কর্তব্যে গাফিলতি করে।

এইসব অসুবিধা বিশেষ গ্রাহ্য করে না গুণ্ডা। তার লাল লাল চোখ দুটো এদিক-ওদিক ঘুরে পরিচিত মানুষটির সন্ধান করে, তাকে দেখতে পায় না। মাঝে মাঝে শান্তাকে দেখে সে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দে আনন্দ জানায়, কিন্তু বিশালকায় গুণ্ডা যে-মানুষটিকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত তার দেখা না পেয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়ে, আফ্রিকার বুনো চোখে ভাসে বিষাদের ছায়া। শান্তা সবসময় কাছে এসে খোঁজ নিতে পারে না, খোঁয়াড়ের মধ্যে নিঝুম হয়ে শুয়ে থাকে গুণ্ডা।

বিশেষ কাজে বাপের বাড়িতে গিয়েছিল শান্তা কয়েক দিনের জন্য। ঘটনাটা ঘটল সেইদিন, যেদিন সে ফিরল স্বামীর ঘরে। পালকি তখন সিংহদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকছে, হঠাৎ কানে এল গুণ্ডার তীব্র চিৎকার। তাড়াতাড়ি পালকি থামিয়ে নেমে পড়ল শান্তা এবং ছুটে গেল বাড়ির পিছনে উঠানের দিকে ওইখানেই ছিল গুপ্তার খোঁয়াড় এবং শব্দটা আসছিল সেদিক থেকেই। অকুস্থলে গিয়ে শান্তা দেখল গুণ্ডাকে পরমানন্দে লাঠি দিয়ে খোঁচাচ্ছে হারান-সর্দার। লাঠিটাকে কামড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে খেপে উঠেছে গুণ্ডা। হারানের নাম ধরে চেঁচিয়ে ওঠার উপক্রম করল শান্তা, কিন্তু তার গলা থেকে আওয়াজ বেরিয়ে আসার আগেই অঘটন ঘটে গেল। লাঠিটাকে আক্রমণের চেষ্টা ছেড়ে হঠাৎ গুণ্ডা খোঁয়াড়ের দরজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং শাণিত ছোরার মতো এক জোড়া দাঁতের প্রচণ্ড আঘাতে দরজা ভেঙে ছুটে এল হারান-সর্দারের দিকে।

অন্য লোক হলে তখনই মারা পড়ত, কিন্তু হারান হচ্ছে পাকা লাঠিয়াল এক মুহূর্তের জন্য সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। তারপরই নিজেকে সামলে লাঠির উপর ভর দিয়ে মারল এক দারুণ লাফ। সে কী লাফ– এক লাফেই হারান পৌঁছে গেল নিকটবর্তী পাঁচিলের উপর।

একটা ক্রুদ্ধ চিৎকার ছাড়ল গুণ্ডা। তারপর ঝড়ের বেগে সিংদরজা পার হয়ে অদৃশ্য হল। শান্তার দিকে তাকিয়েও দেখল না।

হারানকে যথাসম্ভব তিরস্কার করল শান্তা। স্বামীর কাছে ব্যাপারটা জানিয়েছিল সে যথাসময়ে। প্রতাপনারায়ণ বলল হারান-সদারকে সে শাস্তি দেবে, কিন্তু শান্তার মনে হয়েছিল তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই ও কথা বলল প্রতাপ- আসলে হারানের অপরাধটা স্বামীর কাছে খুব গুরুতর নয়।

তা যাই হোক, গুণ্ডা আর জমিদারবাড়িতে ফিরল না। গাঁয়ের পাশে জঙ্গলের মধ্যে তার দেখা পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। গ্রামবাসীদের মুখে তার খবর পেত শান্তা। আফ্রিকার ওয়ার্ট হগ বাংলার জঙ্গলেই দিন কাটাতে লাগল নির্বিবাদে। না, একেবারে নির্বিবাদে নয়- গোড়ায় একটু গোলমাল হয়েছিল। তিনটে নেকড়ে, যারা ওই এলাকাতেই থাকত গুণ্ডার নধর রূপ দেখে লোভ সংবরণ করতে পারেনি, এগিয়ে এসেছিল শূকরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করতে। গুণ্ডার দস্তাঘাতে সর্দার নেকড়ে মারা পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই, আর অন্য দুটো প্রাণপণে ছুটে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল।

তারপর থেকে আর কেউ তাকে বিরক্ত করে না। খরগোশ আর হরিণদের সঙ্গে গুণ্ডার ঝগড়া নেই। বেশ স্বচ্ছন্দেই তার দিন কাটছিল। সম্প্রতি কিছুদিন হল দুটো চিতাবাঘ এই অঞ্চলে

আস্তানা পেতেছে। গুণ্ডা জানে ওরা মা আর ছেলে। ওই ফোঁটাকাটা বিড়াল দুটোকে সে মোটেই পছন্দ করে না, তবে সে জানে ওরা তার সঙ্গে লাগতে সাহস পাবে না।

তাই মাটি খুঁড়ে গাছের মূল খেতে খেতে একটু দূরে উঁচু জমিটার উপর বসে থাকা খোকা-চিতাবাঘকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় নি গুণ্ডা। একটু পরেই যে তার মা এসে সেখানে উপস্থিত হয়েছে সেই সংবাদও গুণ্ডার অজানা নয়– বনের বাতাস তার নাকে চিতাবাঘদের খবর জানিয়ে দিয়ে গেছে।

এত কাছাকাছি জোড়া চিতাবাঘের উপস্থিতি গুণ্ডা পছন্দ করে না। মুখ তুলে একটা ধমক দেবে কি না ভাবছে, এমন সময়ে তার মাথার উপর দিয়ে হলদেকালে উদার একটা কম্বল উড়ে গেল বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। সচমকে মুখ তুলে তাকাতেই আর একটা হলদেকালো কম্বল বসানো শরীর তাকে ডিঙিয়ে দূরে ছিটকে পড়ল।

হতভম্ব হয়ে কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে রইল গুণ্ডা, তারপরই ব্যাপারটা তার বোধগম্য হল। তার দেহটাকে ডিঙিয়ে চিতাবাঘদের লং জাম্প প্র্যাকটিস গুণ্ডার বিবেচনায় খুব অপমানকর বলেই মনে হল, অতএব ধাবমান চিতাবাঘ দুটিকে পাকড়াও করে তাদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য সে ঘুরে দাঁড়াল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে

সেই মুহূর্তে তার নাকে এসে ধাক্কা মারল একটা গন্ধ। শত্রু! উপর দিকে নাক তুলে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাসগ্রহণ করেই গুণ্ডা বুঝল বনে শত্রুর আবির্ভাব ঘটেছে। এই দিকে ছুটে আসছে অনেকগুলো মানুষ আর কুকুর। মানুষেরা কুকুর সঙ্গে নিয়ে কেন জঙ্গলে আসে সে-কথা ভালোভাবেই জানে গুণ্ডা। চিতাবাঘদের লাফালাফির কারণটাও সে বুঝতে পারল।

.

০৪.

কর্তা, ওরা শিকারের গন্ধ পেয়েছে, চেঁচিয়ে উঠল হারান-সর্দার।

হ্যাঁ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। গলার শিকল নিয়ে কুকুরগুলো যেরকম টানাটানি লাগিয়েছে, তাতে বোঝা যায় তারা শিকারের গন্ধ পেয়েছে।

ওদের ছেড়ে দাও, প্রতাপনারায়ণ আদেশ করলেন

কুকুরগুলো ছাড়া পেয়ে দ্রুতবেগে সামনে এগিয়ে গেল কিছু দূর। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল দলের নেতা ডিক। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল, একটা অনুচ্চ হাঁক দিয়ে সে দিক পরিবর্তন করল।

ভ্রূ কুঁচকে প্রতাপ বললেন, হারান, ব্যাপারটা লক্ষ করেছ? আমার মনে হল একটা জানোয়ারকে অনুসরণ করেই কুকুরগুলো ছুটতে শুরু করেছিল। হঠাৎ যেন নতুন শিকারের সন্ধান পেয়ে ওরা ঘুরে গেল।

প্রতাপ ঠিক ধরেছেন। চিতাবাঘদের গায়ের গন্ধ পেয়েই জন্তু দুটোকে অনুসরণ করেছিল কুকুরের দল। হঠাৎ অন্য একটা গন্ধ নাকে যেতেই থমকে দাঁড়িয়েছে তারা। ডিকের কাছে ওই গন্ধ পরিচিত, পুরোনো শত্রুর উপর প্রতিশোধ নেবার এমন সুযোগ সে ছাড়তে চাইল না কুকুর বাহিনী নিয়ে সে গুণ্ডার গায়ের গন্ধ অনুসরণ করে ছুটতে শুরু করল। শিকারির দলও তৎক্ষণাৎ কুকুরদের পিছু নিতে একটুও দেরি করল না…।

ঝোপের ভিতর থেকে ভেসে এল কুকুরের ক্ষুব্ধ গর্জন আর ঝটাপটির আওয়াজ। ঘোড়ার রাশ টেনে বন্দুক বাগিয়ে ধরলেন প্রতাপনারায়ণ আর দেবেন্দ্রবিজয়, সবিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন, এমন জোর ঝটাপটি করছে কোন জন্তু এতগুলো কুকুরের সঙ্গে?

সঙ্গের লাঠিসোঁটাধারী মানুষগুলো এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। কিন্তু তারা কিছু করার আগেই ঝোপের ভিতর থেকে তিরবেগে বেরিয়ে এল দুটো কুকুর। দারুণ আতঙ্কে তাদের গায়ে লোম খাড়া হয়ে উঠেছে এবং নিশানের মতো উদ্ধত লাঙ্গুল প্রবেশ করেছে পেটের তলায়! কুকুর দুটো ভীষণ ভয় পেয়েছে!

ডিক! ডিক কোথায়? চেঁচিয়ে উঠলেন প্রতাপনারায়ণ, ব্রাউনেরও তো দেখা পাচ্ছি না। চল, সবাই এগিয়ে চল।

তীব্রবেগে তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন সেইদিকে, যেদিক থেকে ছুটে এসেছে কুকুর দুটো। তার সঙ্গে ছুটল দেবেন্দ্ৰবিজয়ের ঘোড়া এবং অশ্বারোহীদের পিছন পিছন ছুটতে লাগল লাঠি আর বর্শাধারী গ্রাম্য শিকারির দল।

বেশি দূর যেতে হল না। জঙ্গল শেষ হয়ে যে ফাঁকা মাঠটা দেখা যাচ্ছে, সেই মাঠের উপর পড়ে আছে দুটো প্রকাণ্ড কুকুরের রক্তাক্ত দেহ। একটা আর নড়াচড়া করছে না, আর একটার শরীরে তখনও প্রাণের চিহ্ন বর্তমান।

এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে কুকুর দুটোর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রতাপ, তারপর উত্তেজিত স্বরে ডাকলেন, ডিক! ডিক!

যে কুকুরটা তখনও মৃত্যু-যাতনায় ছটফট করছিল, সে একবার লেজ নেড়ে প্রভুকে স্বাগত জানিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল- পরক্ষণেই তার সমস্ত শরীর ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে আবার সোজা হয়ে আছড়ে পড়ল মাটির উপর। সব শেষ!

হাঁটু পেতে মাটিতে বসে পড়লেন প্রতাপ। সঙ্গীরা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়াল। কুকুর দুটোর মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করে দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, চিরে ফাঁক করে দিয়েছে। বুনোনা শুয়োরের কীর্তি!

হারান-সর্দার নীচু হয়ে জমিতে কি যেন লক্ষ করল, তারপর অস্ফুট স্বরে বলল, গুণ্ডার খুরের দাগ দেখতে পাচ্ছি। ওর পায়ের খোঁচ আমি চিনি।

দেবেন্দ্রবিজয় সবিস্ময়ে বললেন, গুণ্ডা! বৌ-ঠাকরুন কি এই জন্তুটার কথাই বলছিলেন প্রতাপ?

প্রতাপ মাথা নেড়ে সায় দিলেন। দাঁত কামড়ে ঠোঁট কামড়ে তিনি আবেগ সামলাতে চেষ্টা করছিলেন।

ডিক তাঁর বাপের আমলের কুকুর। প্রতাপের সঙ্গে অনেক শিকার-অভিযানের সঙ্গী হয়েছিল

হারান বলল, একলা হাতে চার-চারটে ডালকুত্তার মওড়া নিতে পারে এমন খ্যামতা গুণ্ডা ছাড়া এ তল্লাটে কোনো জানোয়ারের নেই।

দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, তবে তো মুশকিল। আমরা ওকে মারতে পারব না। এবার তাহলে ফিরে যাওয়াই ভালো।

হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো ঘুরে দাঁড়ালেন প্রতাপ, কেন? কেন? ওকে মারতে পারব না কেন? তোমার ভয় হলে তুমি ফিরে যেতে পার, আমি এই ব্যাপারের শেষ না দেখে ঘরে ফিরব না।

আমতা আমতা করে দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, না মানে আমি ঠিক ভয় পাইনি। তবে ইয়ে মানে- বৌ-ঠাকরুন বলছিলেন।

বৌ-ঠাকরুন কি বলছিলেন আমি শুনতে চাই না, বাধা দিয়ে গর্জে উঠলেন প্রতাপ, যে শয়তান জানোয়ার ডিককে এমনভাবে খুন করেছে তাকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না। হারান!

–হুজুর!

–শোনো হারান, একটু দূরে ফাঁকা মাঠের ও ধারে যে ঝোঁপটা আছে, ওইখানেই নিশ্চয় শয়তানটা লুকিয়েছে। জমিটা বাঁ দিকে ঢালু হয়ে গেছে, দেখেছ?… ঢালু জমির উপর উঁচু জায়গাটাতে কয়েকজনকে উঠে দাঁড়াতে বল। শুয়োর লাফিয়ে উপরে উঠতে পারবে না, ও ঘুরে একটা ঢাল বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করলে তোমরা উঁচু জায়গা থেকে সড়কি আর লাঠি চালিয়ে ওকে ঘায়েল করতে পারবে। নীচে জঙ্গলের বাইরে একদিকে দেবেনকে নিয়ে আমি পাহারা দেব, আর-একদিকে নজর রাখবে তুমি। দলের আর সবাই ঝোপের ভিতর ঢুকে ওকে তাড়া লাগাও।

প্রতাপনারায়ণের নির্দেশ অনুসারে কাজ শুরু হল। শুয়োরের খোঁচ (পায়ের দাগ) দেখে অভিজ্ঞ হারান-সর্দার জানিয়ে দিল জন্তুটা যে ঝোপের ভিতর রয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কুকুর দুটো কিছুতেই শিকারিদের পথ দেখাতে রাজি হল না। অতএব লাঠি-সোঁটা হাতে মানুষগুলো কুকুরের সাহায্য ছাড়াই বন ঠ্যাঙাতে শুরু করল।

…হঠাৎ ঝোপের ভিতর থেকেতিরবেগে বেরিয়ে এল গুণ্ডা। একটু দূরে খাড়া জমির একপাশে যে ঢালু জায়গাটা রয়েছে সেটাই তার লক্ষ্য বোধহয় উপরে উঠে সে আক্রমণকারীদের ফাঁকি দিতে চায়।

কিন্তু উপর থেকে তাড়া খেয়ে সে আবার নীচে নামতে বাধ্য হল। প্রথমবার সে হারানের পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল, এবার সে শত্রুকে এড়িয়ে যেতে পারল না। হারানের হাতের বর্শা ছুটে এসে বিধল তার কাঁধে। আফ্রিকার জঙ্গলে ওয়ার্ট হগের শক্ত রবারের মতো কাঁধের মাংসপেশী শাপদের সনখ থাবার আক্রমণ বহুবার ব্যর্থ করে দিয়েছে আজ হারান-সর্দারের বর্শাও গুণ্ডার কঠিন স্কন্ধদেশের উপর মারাত্মক দংশনে চেপে বসতে পারল না, এক ঝলক রক্ত ঝরিয়ে অস্ত্রটা ছিটকে পড়ল মাটির উপর। পরক্ষণেই উল্কার মতো ছুটে এল আফ্রিকার জান্তব হিংস্র হারান সর্দারের দিকে।

উপর থেকে কে যেন একটা বর্শা ছুঁড়ে মারল। বর্শা বিঁধল গুণ্ডার পিঠে, কিন্তু তার গতি রুদ্ধ হল না, গুণ্ডা ঝাঁপিয়ে পড়ল হারানের উপর। এক গুঁতো মেরে শত্রুকে ধরাশায়ী করে সে ধারালো দাঁতের সদ্ব্যবহার শুরু করল।

এর মধ্যেই গুণ্ডাকে লক্ষ্য করে ঘোড়া ছুটিয়েছেন দেবেন্দ্রবিজয় আর প্রতাপনারায়ণ। হারানের রক্তাক্ত মৃতদেহটা ছেড়ে এবার নতুন শত্রুর দিকে ঘুরে দাঁড়াল গুণ্ডা। পিঠের উপর বেঁধা বর্শাটাকে এক ঝটকায় ছিটকে ফেলে সে দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে তেড়ে গেল। দেবেন্দ্রবিজয় বন্দুক ছুঁড়লেন, গুণ্ডার রক্তাক্ত শরীরে আরও একটা লাল চিহ্নের সৃষ্টি হল- পরক্ষণেই কাতর আর্তনাদ করে ধরাশয্যা গ্রহণ করল দেবেন্দ্রবিজয়ের ঘোড়া, গুণ্ডার দস্তাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেছে তার উদর। ঘোড়াকে ছেড়ে সওয়ারের দিকে ফিরল গুণ্ডা। ভূপতিত দেবেন্দ্রবিজয় দুহাতে ভর দিয়ে উঠে বসে সভয়ে দেখলেন বন্দুকটা তার নাগালের বাইরে ছিটকে পড়েছে এবং তাকে লক্ষ্য করে ধেয়ে আসছে মুর্তিমান মৃত্যুর মতো আহত বরাহ।

কিন্তু গুণ্ডা শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই প্রতাপের বন্দুক সশব্দে অগ্নিবর্ষণ করল। এক মুহূর্তের জন্য মাটির উপর লম্বমান হল গুণ্ডার দেহ- পরক্ষণেই রক্তাক্ত দাঁত দুটো উঁচিয়ে সে ছুটে গেল দুই নম্বর শত্রুর দিকে।

প্রতাপ আবার গুলি চালানোর উপক্রম করলেন। তার বরাত খারাপ, ঘোড়াটা হঠাৎ ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল– টাল সামলাতে না পেরে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে প্রতাপ এসে পড়লেন মাটির উপর। বন্দুক হাত থেকে খসে পড়েছিল। সেটাকে হস্তগত করার জন্য হাত বাড়ালেন প্রতাপ, কিন্তু অস্ত্রে হাত দেবার আগেই তার সামনে এসে পড়ল গুণ্ডা।

প্রতাপ দেখলেন বাঁকা ছোরার মতো এক জোড়া ভয়ংকর দাঁত তাঁর দেহ লক্ষ্য করে উদ্যত হয়েছে এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে জ্বলে জ্বলে উঠছে এক জোড়া লাল টকটকে চোখ- এক জোড়া জ্বলন্ত কয়লার মতো!-দারুণ আতঙ্কে তিনি চোখ বুজে ফেললেন।

কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত। শরীরের উপর ধারালো দাঁতের যাতনাদায়ক স্পর্শ পেলেন না প্রতাপ, ভয়ে ভয়ে তিনি আবার চোখ মেলে তাকালেন

একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে গুণ্ডা! সামনের পা দিয়ে মাটি খুঁড়ছে, কিন্তু আক্রমণের চেষ্টা করছে না।

মানুষ ও শূকর পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপরই হঠাৎ একটা অস্ফুট শব্দ করে গুণ্ডা ছুটল। না, প্রতাপের দিকে নয়– তাঁর পাশ কাটিয়ে পিছনের জঙ্গল লক্ষ্য করেই ছুটেছিল গুণ্ডা।

জঙ্গলের ভিতর থেকে তখন বন-তাড়ুয়ারা বেরিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন গুণ্ডাকে রুখতে চেষ্টা করল। শন শন শব্দে ছুটে এসে দুটো বর্শা গুণ্ডার রক্তাক্ত শরীর থেকে আরও কিছুটা রক্ত ঝরিয়ে দিল, প্রচণ্ড শব্দে পড়ল কয়েকটা লাঠি তার পিঠে আর কাঁধে কিন্তু কার সাধ্য রোধে তার গতি? গুণ্ডার গ্রাহ্যই নেই!

এক জন বর্শাধারীকে এক তোয় ছিটকে ফেলে বন-তাড়ুয়াদের ব্যুহ ভেদ করে ঝড়ের মতো ছুটে চলল গুণ্ডা ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে খুরের বাজনা বাজাতে বাজাতে!

প্রতাপের শুকনো গলায় আওয়াজ ফুটল না, কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় এখন নিজেকে সামলে নিয়েছেন। দুহাতে ভর দিয়ে মাটির উপর উঠে বসে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, মারো! মারো! ও যে গাঁয়ের দিকেই যাচ্ছে!

সত্যি কথা! গুণ্ডার গতি গাঁয়ের দিকেই বটে!

বন-তাড়ুয়ার দল হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। প্রতাপ এবার সম্বিৎ ফিরে পেলেন, যা, যা, ওর পিছনে যা। চোট-খাওয়া জানোয়ার গাঁয়ের ভিতর ঢুকে মানুষ মারতে পারে। যেভাবেই হোক, ওকে সামাল দে।

সাধারণ বন-তাড়ুয়া হলে দলটা আর এগোতে চাইত না। কিন্তু এই দলটা শিকারের তালিম নিয়েছে প্রদ্যোতনারায়ণের কাছে, বুনো জানোয়ারের আক্রমণে অপঘাত মৃত্যু তারা অনেকবার দেখেছে, হুকুম পেলে তারা আহত বাঘের মুখেও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে হৈ হৈ শব্দে তারা ছোটো-হুঁজুরের হুকুম তামিল করতে ছুটল।

.

০৫.

আমরা দুজনেই আজ খুব বেঁচে গেছি, দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, তোমার গুলি খেয়েই জন্তুটা আমাকে ছেড়ে তোমার দিকে ফিরল। কিন্তু সামনে এসে তোমাকে ও কিছু বলল না– ভারি আশ্চর্য ব্যাপার। তাই না?

মাথা নেড়ে বন্ধুর কথায় সায় দিলেন প্রতাপ, তারপর হারানের রক্তাক্ত মৃতদেহের দিকে আঙুল তুলে বললেন, আমার অবস্থাও হত হারান-সর্দারের মতো, তবে

তবে?–

তবে আফ্রিকার বুনো শুয়োরের স্মৃতিশক্তি খুব জোরালো বলেই বোধহয় এযাত্রা বেঁচে গেলাম।

হা হা করে হেসে উঠে দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, স্মৃতিশক্তি না ঘোড়ার ডিম। তুমি যদি ভেবে থাকো ও তোমাকে চিনতে পেরে ছেড়ে দিয়েছে তাহলে বলব তুমি একটি আস্ত হাঁদাগঙ্গারাম। বুনো জানোয়ার অনেক সময় অপ্রত্যাশিত কাণ্ড করে থাকে। শিকারি হিসাবে তুমি কি জানো না আমার কথা কতটা সত্যি?

আশেপাশে আরও লোকজন ছিল বলেই জন্তুটা ভয় পেয়েছিল, আর সেইজন্যই শেষ মুহূর্তে ওটা তোমাকে আক্রমণ করতে সাহস পায়নি।

প্রতাপ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, অস্ফুট স্বরে তিনি বললেন, হয়তো তোমার কথা সত্যি, হয়তো তোমার কথা সত্যি নয়। কিন্তু আমার মনে হয়

হঠাৎ চমকে উঠলেন প্রতাপ, উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, গাঁয়ের শিকারিদের হাতে বন্দুক নেই, আছে শুধু বর্শা আর লাঠি। গুণ্ডার কবলে যদি আবার কারও প্রাণ যায় তাহলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। দেবেন, তোমার ঘোড়াটা তো মারা গেছে, তুমি আস্তে আস্তে হেঁটে এস। আমি ঘোড়া ছুটিয়ে চললুম গুণ্ডার খোঁজে। ফিরে এসে হারানের মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করব।

দেবেন্দ্রবিজয় মাথা নেড়ে বন্ধুকে সমর্থন জানালেন। ধুলোর ঝড় তুলে প্রতাপের ঘোড়া ছুটল গ্রামের দিকে…

সিংদরজার সামনে দণ্ডায়মান জনতা চমকে উঠল। দুই হাতে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে প্রতাপ বলে উঠলেন, তোরা এখানে কী করছিস? গুণ্ডা কোথায়?

লাঠি হাতে একজন শিকারি বলে উঠল, হুজুর! জন্তুটা ভিতরে চলে গেছে।

-বলিস কি! আর তোরা এখানে দাঁড়িয়ে সং-এর মতো তামাশা দেখছিস! ভিতরে যেতে সাহস হল না? ও যদি ঝি-চাকরদের কাউকে চোট করে? কেমন মরদ তোরা? শিকারের পিছু নিতে ভয় পাস?

একাধিক কণ্ঠ উগ্রস্বরে সাড়া দিল, ভয়? আজ্ঞে ভয় মোরা যমকেও করি না। বড়ো হুজুরের সাথে আমরা অনেকবার শিকারে গেইছি। কিন্তুক বৌ-ঠাকরুন

–বৌ-ঠাকরুন?

—আজ্ঞে হাঁ, বউ-ঠাকরুন তো আমাদের মানা করলেন ভেতরে আসতে।

–সেকি!

-আজ্ঞা হাঁ। উপর থেকে তিনি তো বলে দিলেন, তোরা ভেতরে আসবি না। তাই জন্য তো মোরা এখানে দাঁইড়ে রইচি।

-বেশ করেছ। তবে তোদর বৌ-ঠাকরুনের বুদ্ধি আছে। চোট-খাওয়া জানোয়ার উপরে গিয়ে লোকজন জখম করতে পারে সে বিষয়ে ও নিশ্চয়ই খেয়াল রেখেছে, আর লাঠি-সড়কি দিয়ে শুয়োর মারতে গিয়ে তোরা বিপদে পড়বি সেটাও বোধহয় ও চায় না– উপরে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে শান্তা বোধহয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছে।

–আজ্ঞা না। উপরের দরজা বন্ধ হয়নি। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে বৌ-ঠাকরুন তো নেমে গেলেন নীচে।

সর্বনাশ, দারুণ আতঙ্কে চমকে উঠলেন প্রতাপ, ও সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নীচে! আরে, ওইখানেই কোথায় গুণ্ডা ঘাপটি মেরে আছে কে জানে… তোরা সব জেনেও বৌ-ঠাকরুনের কথা বেদবাক্যি ধরে নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?

বন্দুক বাগিয়ে এক লাফে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়লেন প্রতাপ, তারপর দ্রুতবেগে পা চালিয়ে দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। ঘোড়ার পিঠে ভিতরে ঢুকতে সাহস হল না, ভড়কানো-ঘোড়া যদি আবার ঘাবড়ে যায় তবে তার পিঠ থেকে গুলি চালানো মুশকিল হবে।

জনতা হঠাৎ প্রতাপের অগ্রগতিতে বাধা দিল, আমরা ভিতরে তো গেছিলাম। কিন্তু বৌ-ঠাকরুন আবার ধমকে উঠতে বেইরে এইচি। কিন্তু আপনি ভেতরে যাবেন না। বিপদ হতি পারে।

গর্দভ, রাগে ফেটে পড়লেন প্রতাপ, আমার বিপদ হতে পারে বলে খুব তত দরদ দেখাচ্ছিস! আর একটা মেয়েমানুষের কি অবস্থা হতে পারে ওই শুয়োরটার সামনে পড়লে সে খেয়াল আছে?

সমান ওজনে জবা এল, আজ্ঞা, খেয়াল থাকবে না কেনে? দেখেই তো এলাম বৌ-ঠাকরুন ওই গুণ্ডার সামনে বসে আছে। কিন্তু আপনাকে দেখলে ও নিচ্যয় মেরে দিবে।

অ্যাঁ! বলে কি! চোট-খাওয়া শুয়োরের সামনে বসে আছে শান্তা! জনতার দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেউড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন প্রতাপনারায়ণ।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে তিনি অট্টালিকার পিছন দিকে এগিয়ে গেলেন। নিশ্চয় বিরাট উঠানের পিছন দিকেই রয়েছে গুণ্ডা। ওইখানেই তো ছিল ওর খোঁয়াড়। এতক্ষণে শান্তাকে মেরে ফেলেছে কি না কে জানে- প্রতাপের বুকের ভিতর কাঁপতে লাগল, কল্পনায় ভেসে উঠল শান্তার প্রাণহীন দেহ, শুকরের দস্তাঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন ও রক্তাক্ত…

রক্তের মতোই লাল টকটকে দুটি জলভরা চোখ মেলে তাকালেন শান্ত, আর কেন? ওকে শান্তিতে মরতে দাও। আধমরা জীবটার উপর গুলি চালিয়ে আর নাই বা বীরত্ব দেখালে?

গুণ্ডা তখনও মরেনি। পরিত্যক্ত খোয়াড়টার সামনে শান্তার পায়ের কাছে পড়ে সে অতি কষ্টে নিঃশ্বাস ফেলছে। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকাতে পারলেন না প্রতাপ, বলতে পারলেন না এইমাত্র জন্তুটা নরহত্যা করে এসেছে মুখ নীচু করে তিনি সরে গেলেন সেখান থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *