চতুর্থ পর্ব – মনোবল বদলে দেবে চিন্তাধারা
আপনার জানা সুখী মানুষ হওয়ার উপায়
পরবর্তী তিনটি অধ্যায়ে আপনি ধাপে ধাপে জানতে পারবেন কি করে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণাভিত্তিক কৌশলের সঙ্গে ফাইভ সেকেন্ড রুল-টি ব্যবহার করার মাধ্যমে ভয়কে পরাস্ত, দুশ্চিন্তামুক্ত, উদ্বেগ ব্যবস্থাপনা বা নিরাময় এবং আপনার চিন্তা-ভাবনার পথ পরিবর্তন করা যায়।
আপনি যদি আমাকে সি-এন-এন এর একজন টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার হিসেবে দেখে থাকেন, অথবা সাকসেস ম্যাগাজিন-এ আমার কলাম পড়ে থাকেন, এটা অনুমান করা সহজ হবে যে আমি একজন যোদ্ধার আত্মবিশ্বাস নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। সেই অনুমান আরো শক্তিশালী হবে যখন আপনি আমার ইউটিউব ভিডিও এবং টেডএক্স টক দেখবেন অথবা মঞ্চে আমার সরাসরি সম্প্রচারের অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। হ্যাঁ, আমি এখন আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু আসলে আমি এইভাবে জন্মগ্রহণ করিনি। আমার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমি ছিলাম উচ্চকিত বহির্মুখী যে কিনা গভীর নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্ত। বছরের পর বছর ধরে প্রাত্যহিক মনোবল অনুশীলন করার মাধ্যমে আমি এই আস্থা নির্মাণ করেছি।
মানুষ আমার সম্পর্কে যা জানে না তা হলো– ২৫ বৎসরের অধিক সময় ধরে আমি উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় ভুগেছি। আমার প্রসব-পরবর্তী দুর্বলতাজনিত বিষণ্ণতা ছিল এবং প্রথম কন্যা সয়্যার জন্মগ্রহণ করার পর দুই মাস আমি তার সাথে একা থাকতে পারিনি। প্রায় দুই দশক ধরে আতঙ্ক আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাকে ঔষধ সেবন করতে হয়েছে। চিন্তাধারা নিয়ে আমার সংগ্রাম ছিল বাস্তব এবং মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর।
প্রথম যখন রুলটি আমি আবিষ্কার করেছিলাম, আমার আচরণ পরিবর্তনের জন্য এটিকে আমি ব্যবহার করতাম। রুলটি বিস্ময়করভাবে কাজ করেছিল এবং প্রাত্যহিক মনোবলের সাথে এটি দ্বিতীয় প্রকৃতি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। আমার আত্মবিশ্বাস শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। যাই হোক, উদ্বেগ কখনো ছেড়ে চলে যায়নি। এটা উপরিপৃষ্ঠের তলদেশে ফুটছিল। আমি একে সাথে নিয়ে বাস করতে শেখার উপর ফোকাস করেছিলাম, একে ম্যানেজ করা ও নিশ্চিত করা যাতে করে এটি পরিপূর্ণ আতঙ্কের ভেতর সেদ্ধ হয়ে না যায়।
প্রায় চার বৎসর আগে আমি ভাবতে গুরু করেছিলাম যে ফাইভ সেকেন্ড রুল-টি ব্যবহার করে আমার শারীরিক আচরণের চাইতে বেশি কোনো পরিবর্তন আনতে পারি কিনা। আমি ভাবছিলাম, যদি আমার চিন্তার পরিবর্তন করা যায়। অন্যান্য অভ্যাসগুলোর উপর এর প্রভাব আমি দেখতে পেয়েছিলাম। সুতরাং উদ্বেগ, আতঙ্ক ও ভয়ের অভ্যাসগুলো ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা কেন নয়? এগুলো হলো আমাদের সেই মানসিক ধরনসমূহ যা আমরা পুনরাবৃত্তি করে থাকি। এগুলো শুধুই অভ্যাস।
আমার মস্তিষ্কের কাজের ধরন পরিবর্তন করার জন্য আমি রুটি ব্যবহার করতে শুরু করি। রুলটি ব্যবহার করার মাধ্যমে আমি দুশ্চিন্তার অভ্যাস ভাঙতে শুরু করেছিলাম। যেহেতু আমি এই দক্ষতাটি আয়ত্ত করেছিলাম, আমি আমার উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ ও উড়ে যাওয়ার ভয়কে পরাস্ত করতে রুলটি ব্যবহার করেছি। এবং এটা কাজ করেছে।
আমি যখন এই বাক্যটি লিখছি, তখন আমি আপনাকে বলতে পারি– আমার উদ্বেগ সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। বেশ কয়েক বছর ধরে আমি আর ঔষধ গ্রহণ করছি না এবং এখন আমি আতঙ্কমুক্ত। দুশ্চিন্তার অভ্যাসটি এখন আর নেই। এবং উড়ে যাওয়ার ভয়? চলে গেছে। জীবনমান উন্নয়নের জন্য যে সকল একক শ্রেষ্ঠ কাজগুলো আমি করেছিলাম তা হলো– নিজের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা, চিন্তা-ভাবনাগুলোকে দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং ভয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা। আমি প্রায় কখনোই আর দুশ্চিন্তা বোধ করি না। রুটি ব্যবহার করার মাধ্যমে আমি আমার মস্তিষ্ককে রূপান্তর করেছি এবং এখন আমি যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি সুখী ও আশাবাদী। আমার মস্তিষ্ক এখন আর আমার বিরুদ্ধে নয় বরং স্বপক্ষে কাজ করছে।
এবার আপনার পালা।
প্রথমত– আপনি এখানে শিখবেন কিভাবে ফাইভ সেকেন্ড রুল-টি ব্যবহার করে দুশ্চিন্তা ও নেতিবাচক আত্মকথন আসক্তিকে ভাঙতে হয়। আপনি শিখবেন অভ্যাস বিজ্ঞান এবং কৃতজ্ঞতাবোধের শক্তি।
দ্বিতীয়ত– আপনি উদ্বেগ ও আতঙ্ক বিষয়ে ডুবে যাবেন। আপনি শিখবেন এটা কি এবং কি নয়। এবং আমি আপনাকে আপনার জীবন থেকে হস্তক্ষেপ, পুনর্গঠন এবং উদ্বেগ দূরীকরণ পদ্ধতি ধাপে ধাপে শেখাব।
সবশেষে– আপনি ভয়কে পরাস্ত করার একটি প্রমাণিত কৌশল শিখবেন। আমার উড়ে যাবার ভয়কে একটি উদাহরণ হিসেবে নিয়ে কিভাবে উপস্থাপকের চিন্তার সাথে রুলটি ব্যবহার করে মনের উপর ভয়ের প্রভাব প্রতিরোধ করতে হয়, তা শিখবেন। আপনি যা শিখতে চলেছেন তা এতটা সহজ ও শক্তিশালী যে এটা এমনকি আপনি আপনার বাচ্চাদের শেখাতে পারেন।
জীবন বিস্ময়কর
এবং তারপর এটা ভয়ানক
এবং তারপর এটা আবার আশ্চর্যজনক
এবং বিস্ময়কর ও ভয়াবহতার মাঝামাঝি
এটা সাধারণ এবং পার্থিব এবং দৈনন্দিন
আশ্চর্যের মাঝে নিঃশ্বাস নিন, ধরে রাখুন
ভয়াবহ এবং শিথিল এবং বাষ্পীভূত
স্বাভাবিক সময়ে, এটা শুধু বেঁচে থাকা
হৃদয়গ্রাহী, আত্মা নিরাময়কারী, বিস্ময়কর
ভয়াবহ, সাধারণ জীবন এবং এটা
হৃদয়গ্রাহী সুন্দর
– এল. আর. নোস্ট
*
(১২) দুশ্চিন্তামুক্তি
আপনার আশপাশে এখনো ছড়িয়ে থাকা অবশিষ্ট সৌন্দর্যের কথা ভাবুন এবং সুখী হোন।
– এ্যানা ফ্রাঙ্ক।
অন্য যে কোনো পরিবর্তনের চাইতে উদ্বেগের অভ্যাস পরিবর্তন আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় একক ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। বিশ্বাস করুন বা না করুন, আপনাকে শেখানো হবে কি করে দুশ্চিন্তা করতে হয়। ছোট বয়সে আপনি আপনার অভিভাবককে ক্রমাগত দুশ্চিন্তা করতে দেখেছেন– সাবধান, মাথায় টুপি পর, না হয় ঠাণ্ডা লাগবে অথবা টেলিভিশনের খুব কাছাকাছি বসো না। প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আমরা সেইসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে গিয়ে অনেক বেশি সময় ও শক্তি ব্যয় করি যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন অথবা অসম্ভব। আপনি আপনার জীবনের শেষ প্রান্তের যত কাছাকাছি পৌঁছুবেন, আশা করবেন তার মুখোমুখি না হতে।
ড. কার্ল পিলেমার, কর্নেল বিশ্ববিদ্যলয়-এর মানব উন্নয়ন বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং উত্তরাধিকার প্রকল্প-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জীবনের অর্থ কি? বিষয়ের উপর আলোচনা করার জন্য ১,২০০ জন জ্যেষ্ঠ নাগরিকের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তিনি এটা জেনে ধাক্কা খেয়েছিলেন যে, বেশির ভাগ মানুষেরই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একই ধরনের দুঃখ থেকে যায় যেমন– জীবনের সিংহভাগ সময় আমি যদি দুশ্চিন্তা করে না কাটাতাম! তাদের কথা ছিল– দুশ্চিন্তা আপনার মূল্যবান ও সীমিত জীবকালের এক বিপুল অপচয়।
আপনি দুশ্চিন্তা বন্ধ করুন। কেমন করে, তা আপনাকে ফাইভ সেকেন্ড রুল-টি শেখাবে। আপনি মনোযোগ প্রদানে ব্যর্থ হলে আপনার মস্তিষ্কে দুশ্চিন্তা একটি অক্ষম বিন্যাস হিসেবে স্থান গেড়ে বসবে। এ থেকে উত্তরণের উপায় হল– আপনি যখন দুশ্চিন্তার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হবেন, নিজেকে থামান এবং তারপর রুটি ব্যবহার করে মানসিক নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করুন। একটি উদাহরণ দেয়া যাক :
সম্প্রতি আমার স্বামী ক্রিস তার মোটরসাইকেল নিবন্ধন পেয়েছে এবং একটি ছোট ও ব্যবহৃত মোটরসাইকেল কিনেছে। পরদিন, আমি যখন ঘরের ভেতর বসেছিলাম, খেয়াল করলাম সে ড্রাইভওয়ে দিয়ে মোটরসাইকেলটি বের করছে। যখনি সে রাস্তায় নেমে পড়ল, আমি দেখলাম যে আমার মাথায় দুশ্চিন্তার একটি স্রোত বয়ে যেতে শুরু করেছে।
আমি দুশ্চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম সে হয়তোবা একটি গাড়ির সাথে ধাক্কা খেতে পারে অথবা পুলিশ আমাকে তার দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে ফোন করতে পারে। পাঁচ সেকেন্ড সময়ের মধ্যেই এই দুশ্চিন্তা আমাকে গ্রাস করে নিল। এতটাই দ্রুত। এবং আপনি জানেন, আমার দুশ্চিন্তা কখনোই তাকে নিরাপত্তা দেবে না কিংবা কোনো দুর্ঘটনাও রোধ করতে পারবে না। ৮৩ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি তার গবেষণায় বলেছিলেন– আমার দুশ্চিন্তা কোনোকিছুর সমাধান করবে না। এটা শুধু সর্বক্ষণ আমাকে খাদের কিনারায় টেনে নিয়ে যাবে। ক্রিস রাস্তায় মোটর সাইকেল চালাচ্ছে এই চিন্তা আমাকে বর্তমান মুহূর্তটিকে উপভোগ করা থেকে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
যখনই বুঝতে পারি আমি দুশ্চিন্তা করছি, আমি রুলটি ৫-৪-৩-২-১ ব্যবহার করি এবং আরো ইতিবাচক কিছু চিন্তা করতে শুরু করি যেমন– রাস্তায় মোটর সাইকেল চালানো অবস্থায় ক্রিস-এর হাস্যোজ্জ্বল মুখ।
মজার ব্যাপার হলো ক্রিস একজন ভালো বাইকার। সে ট্রায়থলন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল এবং নিজেই সবসময় ৪০/৫০ মাইল গাড়ি চালনা প্রশিক্ষণে রাস্তায় নেমেছে। এ ব্যাপারে আমার কখনো দুশ্চিন্তা হয়নি। কিন্তু এখানে সে যে মোটরসাইকেলটি নিয়ে ঘণ্টায় ১০ মাইল বেগে চলেছে, তা আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। কিছু কি ভুল হতে পারে? অবশ্যই পারে। তবে সাধারণতঃ হয় না।
আপনি যখন দুশ্চিন্তার সমাপ্তি টানতে রুলটি ব্যবহার করবেন, এটা দেখে বিস্মিত হবেন যে কতটা ঘনঘন আপনার মন নেতিবাচক কিছুর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আমার ক্ষেত্রে এটা প্রতিদিনই ঘটেছে। এটা সত্যিই অস্বস্তিকর। প্রতিদিন আমি এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। কখনো কখনো দিনে ১২ বা তার চাইতে বেশি বার নিজের ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাকে রুলটি ব্যবহার করতে হয়েছে। পরের দিন আবার আমি নিজেকে ক্রমাগত দুশ্চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে দেখেছি।
আমাদের কন্যা পেশাগত সফর শেষে পেরু থেকে ফিরছিল এবং দিনভর আমার মন যেসব দুশ্চিন্তার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল তা ছিল– বিমান দুর্ঘটনা, ফ্লাইট মিস, আন্দেজ পর্বতে বিমানটির পতন, বাস দুর্ঘটনা, ব্যাগ হারানো এবং বিমান বন্দরে আটকে পড়া। রুলটির সাহায্য ব্যতীত আমি হয়তো দিনটিকে শেষ করে দিতাম। প্রতিবার যখন আমি আমার মনকে খারাপ চিন্তার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখি, নিজেকে বলি– না, তুমি না… এবং এমন একটি দিকে আমার চিন্তাকে প্রবাহিত করি যা আমাকে আনন্দ দেয়।
প্রেমের অনুভূতি প্রায়শঃই দুশ্চিন্তা ঘটায়
দুশ্চিন্তা সম্পর্কিত আরেকটি বিষয় আমাকে অবাক করেছিল আর তা হলো– এটা কতটা সূক্ষ্ম এবং কত দ্রুত আপনার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। আমি দেখে বিস্মিত হয়েছি, যে মুহূর্তে আমি সুখ বা ভালোবাসা অনুভব করি তখন কতটা ঘনঘন আমি দুশ্চিন্তা বোধ করি।
এই বসন্তে, এটা আমার সাথে ঘটেছিল যখন আমি আমার ১৭ বছর বয়সী কন্যার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমি একটি অসাধারণ মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েছিলাম যখন হঠাৎ করেই আমার হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এবং তারপর, কোনোরকম সতর্কতা ছাড়াই, দুশ্চিন্তায় আমার মন ডুবে গিয়েছিল এবং মুহূর্তটি চুরি হয়ে গিয়েছিল। আমি যা অনুভব করেছিলাম তা হলো– ভয়।
আমরা একটি শপিং মল-এ গিয়েছিলাম। সয়্যার তার হাইস্কুল নাচের পোশাক খুঁজছিল। এটি ছিল একটি দীর্ঘ বিকেল যখন আমরা তৃতীয় দোকানটিতে প্রবেশ করি। সয়্যার খুব সহজেই ৪০টিরও বেশি পোশাক ট্রায়াল দিতে পারে আর সর্বশেষ পোশাকটিও সে অপছন্দ করে। কোনো পোশাকে তাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে বলাটা তার মেজাজকে শুধুই খারাপ করে।
আমি তার সঙ্গে ড্রেসিং রুম-এ ছিলাম। বাতিল হওয়া পোশাকগুলো আমি হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে দিচ্ছিলাম আর পরবর্তী পোশাকটি তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলাম ট্রায়াল দেওয়ার জন্য। আমি এই ভেবে আতঙ্কিত বোধ করা শুরু করি যে তার পছন্দের পোশাকটি হয়তো কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি তার হাতে আরেকটি পোশাক তুলে দিতে দিতে বলি– পরবর্তী তিনটি পোশাক চেষ্টা করে দেখ এবং তারপর এখান থেকে বের হই চলো। আমি তাকে কিছুটা জায়গা করে দেয়ার জন্য বাইরে আসি এবং ক্রিসকে ডাকি।
হঠাৎ করে সে আমাকে ডাকে– মা, তুমি কি এখানে একটু আসবে?
আমি তার কণ্ঠ পড়তে চেষ্টা করছিলাম কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না যে সে কি কাঁদছে, হতাশ, আটকে যাওয়া জিপার-এর ব্যাপারে সাহায্য দরকার অথবা অন্য কিছু। আমি হুড়মুড় করে দরজা খুলি। সে একটি মেঝের দৈর্ঘ্য পর্যন্ত লম্বা গাউন পরে আছে এবং আয়নায় আমি তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিলাম যা ছিল এক কথায় অসাধারণ। পোশাকটি ছিল পীচ রঙের এবং পাশের দিকটি ছিল গোলাপি রঙের সুন্দর ঢেউ খেলানো। এটা ছিল তাই যা সে চেয়েছিল– কোনো ঝকমক নেই, কোনো লেইস নেই, পেছন দিকটি খোলা আর রঙটি উজ্জ্বল। আমার চোখ আয়নায় আটকে গিয়েছিল।
কি চিন্তা করছ মা?
বুঝতে পারছিলাম আমার চোখে পানি আসছে। যখন সে ছোট্টটি ছিল, মনে পড়ে একই রকম আবেগে ভেসে গিয়েছি কতবার, যা আপনি কাউকে খুব ভালোবাসলে পরে অনুভব করবেন। মাঝরাতে আমি যখন তাকে পরীক্ষা করতে উঠতাম, সে তখন পিঠে ভর করে মাথার উপর একটি হাত তুলে ঘুমুচ্ছে, এই দৃশ্য দেখে আমি কতবার ভালোবাসার আবেগী জোয়ারে ভেসেছি এবং কোনোকিছুকে ভালোবাসার এমন সক্ষমতা দেখে শুধুই বিস্মিত হয়েছি। এটা ছিল হৃদয় বিস্ফোরিত হওয়ার মতো একটি অনুভূতি।
ড্রেসিং রুম-এর বাইরে দাঁড়িয়ে আমি ঠিক এমনটিই অনুভব করছিলাম। ভালোবাসার অনুভূতি। আর তারপরই দুশ্চিন্তা এসে ভর করল এবং মুহূর্তটিকে চুরি করে নিয়ে গেল। সতর্কতা ছাড়াই। আমি চিন্তা করছিলাম সে কলেজে যাচ্ছে, তার বিয়ে হচ্ছে, নতুন মা হচ্ছে, আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে, সময় বয়ে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে এবং আমার জীবন শেষ হয়ে আসছে। গোটা জীবন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছিল এবং এক মুহূর্তের জন্য অনুভব করেছিলাম আমি যেন তাকে হারিয়ে ফেলছি। আমি অভিভূত ও বিষণ্ণ বোধ করছিলাম এবং আমার চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল।
সয়্যার আমার আবেগ দেখতে পেল এবং ভাবল এটা তার পোশাকটির কারণে। মা, কান্নাকাটি কোরো না। তুমি তো আমাকেও কাঁদাবে। কিন্তু আমি ভয় পেয়ে কাঁদছিলাম তাকে বড় হতে দেখে। আমি কাঁদছিলাম এটা দেখে যে জীবন কত দ্রুতই না শেষ হয়ে যায় এবং আমি চাইছি জীবন যেন একটু আস্তে চলে। দুশ্চিন্তা আমার ঐ মুহূর্তটির সব আনন্দ লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। এটা আমাকে সয়্যার-এর কাছ থেকে মস্তিষ্কের একটি অন্ধকার কোণে নিয়ে যাচ্ছিল। আমার সুন্দর আদুরে মেয়েটির উপস্থিতির পরিবর্তে আমি ভীতি বোধ করছিলাম।
এভাবেই দুশ্চিন্তা আপনার মনকে অপহরণ করে এবং জীবনের জাদু ও বিস্ময়কে লুট করে নিয়ে যায়। ব্রেনে ব্রাউন তার সর্বাধিক বিক্রিত বই ডেয়ারিং গ্রেটলিতে ঠিক এই ঘটনাটিই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন আনন্দের মুহূর্তগুলোতে খারাপ দৃশ্যকল্প চিন্তা করাও একটি সাধারণ বিস্ময়কর ঘটনা (যেমন, আপনার সন্তানের খারাপ কিছু সম্পর্কে উদ্বেগ ব্যতীত তাকে আলিঙ্গন করা আপনি উপভোগ করেন না)। এবং কেন আনন্দের মুহূর্তে নরম হওয়া আমাদের জন্য এতটা কঠিন? কারণ, ড. ব্রাউন যেমনটি বলেছেন– আমরা প্রচণ্ড আঘাতের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি।
আপনার মন যখন আপনাকে এমন কোথাও নিয়ে যায় যা দুঃখভারাক্রান্ত, অন্ধকার, সন্দেহজনক বা নেতিবাচক, আপনার সেখানে যাবার দরকার নেই। হাইন আমাকে যা লিখেছিলেন তা আমার পছন্দ হয়েছিল। তার মতে– শতকরা ৯৯.৯৯৯ ক্ষেত্রে আমি আমার মস্তিষ্কে সর্বদা একটি মিথ্যে বাস্তবতা তৈরি করে থাকি।
আপনি যখন হাইন বা আমার মতো দেখতে পাবেন যে নিজের ভেতরকার কণ্ঠস্বর আপনার শত্রু হয়ে উঠছে, ৫ সেকেন্ডের ভেতর ঐ দুশ্চিন্তা বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি যাতে করে আপনি নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে পারেন।
আমি চুপি চুপি ৫-৪-৩-২-১ ক্ষণ গণনা করি এবং শরীরের ভেতরে ভয় কমে যাওয়া অনুভব করি। ক্ষণ গণনা ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে মাথা থেকে বের করে বর্তমান মুহূর্তটিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। এটা নিজেকে দুশ্চিন্তা থেকে। ফোকাস-এ স্থানান্তর করার চাবি। আমি আমার মস্তিষ্ককে কন্যার সাথে আমার এই অভিজ্ঞতা লুট করে নিয়ে যেতে দিতে রাজি ছিলাম না। দুশ্চিন্তার অভ্যাসকে আমি বর্তমান সময়ে আমার উপস্থিতি ও একটি মানসিক ছবি গ্রহণ করা থেকে বিচ্যুত করতে অনুমতি দেব না।
আমি নিজেকে দুটি সাধারণ প্রশ্ন করলাম– আমি কি এই মুহূর্তে কৃতজ্ঞ? এবং আমি কি মনে রাখতে চাই? আপনি যখন এরকম সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন, এটি আপনার মস্তিষ্কের জৈব স্তরে প্রভাব ফেলবে। উত্তর দেওয়ার জন্য তাকে আপনার জীবন, সম্পর্ক ও কাজের ভাগ নিতে হবে এবং একটি জবাব অনুসন্ধান করতে হবে।
এটি আপনাকে জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোর উপর ফোকাস করতে বাধ্য করবে। আপনি যখন চিন্তা করবেন কিসের জন্য আপনি কৃতজ্ঞ, আপনি দুশ্চিন্তার পরিবর্তে কৃতজ্ঞতা বোধ করতে শুরু করবেন। প্রশ্নের উত্তরটি আমার কাছে এখন পরিষ্কার। এমন একটি অসাধারণ তরুণীকে আমার কন্যা হিসেবে পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ। এবং তিন ঘণ্টার নাটক শেষে সে তার পছন্দের পোশাকটি খুঁজে পাওয়ার জন্যও আমি কৃতজ্ঞ।
কেটি তার কৃতজ্ঞতার কার্যকরণের উপর প্রতিফলন ও দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ফাইভ সেকেন্ড রুল-টি ব্যবহার করছেন। জীবনে কোনো কিছুই নিখুঁত নয়। একেবারেই নয়। কিন্তু মানসিক কিচিরমিচির বন্ধ করতে এবং ছোট মুহূর্তগুলোকে (যেমন নিজের কন্যার জন্য কৃতজ্ঞতা বোধ করা) প্রশংসা করা শিখতে আপনিও রুটি ৫-৪-৩-২-১ ব্যবহার করতে পারেন।
কৃতজ্ঞতাবোধ শুধু ভালো বোধ করা নয়। স্নায়ুবিজ্ঞানী এলেক্স কোর্ব-এর মতে– এটি মস্তিষ্কের ডালপালা সক্রিয় করার মাধ্যমে আপনার মস্তিষ্কের রসায়ন পরিবর্তন করে থাকে যা ডোপামিন সৃষ্টি করে। আমার দুশ্চিন্তা চলে যাওয়ার কারণ, একটি লম্বা শ্বাস টেনে কন্যা সয়্যারের কাছাকাছি হতে আমি ড্রেসিং রুম-এ প্রবেশ করি এবং তার কাঁধে হাত রাখি। আয়নায় আমাদের চোখাচোখি হয়।
সয়্যার জিজ্ঞেস করে– মা, তুমি কি ভাবছ?
আমি বলি– তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
ভয় পাওয়া খারাপ না। এর মানে আপনি সত্যি সত্যি কোনো সাহসী কাজ করতে যাচ্ছেন।
*
(১৩) উদ্বেগের অবসান
আপনার মনকে শাসন করুন, না হয় এটি আপনাকে শাসন করবে।
– হোরেচ
আপনার দুশ্চিন্তার অভ্যাস যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। জীবনভর উদ্বেগ সহ্য করার কারণে আমি জানি এটা কেমন করে আপনাকে আঁকড়ে ধরবে এবং এর অনুভূতি কতটা ভয়ঙ্কর। এই অনুভূতির জবাব হলো– পুনঃকাঠামোকরণ নামক একটি কৌশলের সঙ্গে ফাইভ সেকেন্ড রুল-টির ব্যবহার।
উদ্বেগকে পরাস্ত করতে হলে একে বুঝতে হবে। আপনি যদি শুরু হওয়া এবং পুনঃকাঠামো ধারণ করার সময় একে ধরতে পারেন, আপনার মন পুরোপুরি আতঙ্কিত হওয়ার আগেই আপনি একে স্থিতিশীল করতে পারবেন। সময়ের সাথে সাথে আপনি যত বেশি করে ফাইভ সেকেন্ড রুল্ল-টিকে ব্যবহার করবেন, আপনার উদ্বেগ দুর্বল হতে হতে দুশ্চিন্তায় ফিরে যাবে, যেখান থেকে এটি শুরু হয়েছিল। এইমাত্র আপনি যা শিখলেন– দুশ্চিন্তার অভ্যাস ভেঙে ফেলা সহজ।
আমার মনে হয় আমি উদ্বিগ্ন হয়েই জন্মেছিলাম। আমার বাবা-মার কাছ থেকে শুনেছি– ছোট বয়সে আমার স্নায়বিক পাকস্থলী ছিল এবং সব বিষয়েই আমি দুশ্চিন্তা করতাম। আমি বাচ্চাদের তাঁবুতে সেইরকম একজন ছিলাম যে কিনা ঘরকাতর এবং দ্রুত বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছুক।
যখন কলেজ ছাত্র ছিলাম, যে কোনো ডাকে আমার মুখ টমেটোর মতো লাল হয়ে যেত। পার্টিতে কোনো সুদর্শন যুবকের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমাকে তরল সাহসের উপর নির্ভর করতে হতো, কেননা অ্যালকোহল ছাড়া আমি আমার ঘাড়ে ছাপ অনুভব করতাম।
সদ্য ২০-এ আমি যখন আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করি, আমার আতঙ্ক আক্রমণ শুরু হয়। প্রতিটি আতঙ্ক আক্রমণ এক একটি হার্ট অ্যাটাক-এর মতো অনুভূত হয় এবং দুটি কারণে এটি ঘটে থাকে : (১) আপনাকে ভীতিকর কিছু করতে হবে যেমন– জনসম্মুখে বক্তৃতা করা, কোনো প্রাক্তন-এর মুখোমুখি হওয়া অথবা বিমানে আরোহণ এবং (২) কোনো কারণ ছাড়াই।
আপনার যখন আতঙ্ক আক্রমণ হয়, আপনার শরীর ও মনে কোনোরকম পূর্ব সতর্কতা বা ঘটনা ছাড়াই সেই কাছাকাছি ব্যর্থ সংবেদনশীলতা এসে ভর করে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে এককাপ কফি ঢালার সময় হঠাৎ করেই আপনার শরীরে এড্রেনালিন-এর একটি স্রোত বয়ে যেতে পারে যেমনটি ঘটেছিল মহাসড়কে লেন পরিবর্তন করতে গিয়ে একটি গাড়ির অল্পের জন্য আপনাকে। মিস করার সময়।
সাধারণ আতঙ্ক বনাম আতঙ্ক আক্রমণ
আপনার জীবনে হাজারবার আতঙ্কিত হওয়ার ঘটনা ঘটবে এবং এটাই স্বাভাবিক। মনে করুন আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন এবং মহাসড়কে লেন পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন। হঠাৎ করে, অনেকটা আকাশ থেকে একটি গাড়ি এসে আপনার সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করল, আপনার গতিপথ পরিবর্তন করে দিল এবং একটুর জন্য আপনাকে মিস করল। মহাসড়কে যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটবে, আপনি আপনার শরীরে এড্রেনালিন-এর একটি স্রোত অনুভব করবেন। আপনার হৃৎপিণ্ড দৌড়াবে। আপনার নিঃশ্বাস দ্রুততর হবে। হরমোন প্রবাহিত হবে। আপনার শরীর একটি উচ্চ সতর্কতা অবস্থানে পৌঁছুবে যাতে করে আপনি গাড়িটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আপনি হয়তো কিছুটা ঘেমেও যাবেন।
আপনার শরীর যত দ্রুত অস্বাভাবিক অবস্থায় যাবে, আপনার মন তত দ্রুত একটি কারণ খুঁজে পেতে চাইবে– কেন আপনার শরীর এতটা উত্তেজিত। মহাসড়কের এই উদাহরণটিতে আপনার মস্তিষ্ক জানে আপনি প্রায় একটি দুর্ঘটনায় পড়তে যাচ্ছিলেন এবং সেজন্যই আপনার শরীর অস্বাভাবিক অবস্থায় চলে গেছে।
আপনার মস্তিষ্ক আপনার শরীরের অস্বাভাবিক অবস্থায় চলে যাওয়ার ব্যাখ্যা যখন খুঁজে পাবে, তখন আর উদ্বিগ্ন হওয়ার পথে হাঁটবে না। আপনার মস্তিষ্ক আপনার শরীরকে শান্ত হওয়ার অনুমতি দেবে কারণ সে জানে বিপদ কেটে গেছে। আপনার জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে এবং পরবর্তী সময়ে লেন পরিবর্তন করার সময় আপনি আরো একটু বেশি সতর্ক হবেন।
আপনার যদি কখনোই আতঙ্ক আক্রমণ না হয়ে থাকে, তবে তা বর্ণনা করার সেরা উপায় হলো– এটা ছিল তালিকার বাইরে থাকা আপনার শরীর ও মনের প্রায় কাছাকাছি হওয়ার ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা। আমাকে একটি সহজ উপমা ব্যবহার করে ব্যাখ্যা করার অনুমতি দিন।
আপনার হৃৎপিণ্ড দৌড়াচ্ছিল। আপনার নিঃশ্বাস দ্রুততর হচ্ছিল। আপনি হয়তো একটু ঘেমে যাচ্ছিলেন। আপনার হরমোন প্রবাহিত হচ্ছিল। আপনার শরীর একটি উচ্চ সতর্কতা অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। এ সময় আপনার শরীর যখন একটি উদ্দীপিত অবস্থায় ছিল, আপনার মস্তিষ্ক বুঝতে চেষ্টা করছিল কেন এটা ঘটছে। যদি কোনো বৈধ কারণ না পেয়ে থাকে, আপনার মস্তিষ্ক চিন্তা করবে আপনি তাহলে সত্যিকারের বিপদে পড়েছেন। এ পর্যায়ে আপনার মস্তিষ্ক আপনার প্রাগৈতিহাসিক ব্যবচ্ছেদ করে ভয়কে আরো বাড়িয়ে দেবে এই ভেবে যে, বিপদ অত্যাসন্ন।
আপনার হৃৎপিণ্ড যখন দৌড়াতে শুরু করে, আপনার মন একটি ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে চায় এটা বোঝার জন্য যে আপনার শরীরে কি ঘটছে, যাতে করে সে আপনাকে রক্ষা করার উপায় বের করতে পারে। আপনার হয়তো একটি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, আপনি হয়তো আগামী মাসে বিয়ে করতে চাচ্ছেন না, আপনি হয়তো অবশেষে চাকরিটি হারাচ্ছেন অথবা আপনি হয়তো মারা যাচ্ছেন।
আপনার মস্তিষ্ক যদি একটি উপযুক্ত ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়, আপনার উদ্বেগ তাহলে আরো খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে এবং আপনি পরিস্থিতি এড়াতে শারীরিকভাবে পালাতে চাইবেন এবং ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাবেন। আপনি যদি কাউকে কখনো আতঙ্ক আক্রান্ত হতে দেখে থাকেন, তাহলে দেখবেন– তারা অস্বাভাবিক হয়ে যায়, চারপাশে ফলা ছুঁড়তে থাকে, চিন্তা-ভাবনা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, গাড়ির হেডলাইট-এর সামনে হরিণ দেখতে পায় এবং হঠাৎ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এটি একটি দুষ্টচক্র এবং অনেক বৎসর ধরে আমি এর ভেতরে আটকে ছিলাম।
দীর্ঘ সময় ধরে আমি বুঝতে পারিনি সাধারণ আতঙ্ক ও আতঙ্ক আক্রমণের মধ্যে কি পার্থক্য অথবা আমার ভূমিকাই বা কি যা উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। আমি মনোবিজ্ঞানীর স্মরণাপন্ন হয়েছিলাম এবং আতঙ্ক থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সকল প্রকার জ্ঞানীয় কৌশল ব্যবহার করেছিলাম। আমার অবস্থা এতটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে আতঙ্ক আক্রমণের ভয়ে আমি ভীতু হয়ে গিয়েছিলাম এবং যার কারণে আমার উপর আতঙ্ক আক্রমণ আরো বেড়েছে বই কমেনি।
অবশেষে, আমি জোলফট নামক একটি ঔষধ সেবন করি যাকে অলৌকিক ঔষধ নামে ডাকা হয়। জোলফটু আমার জন্য অসাধারণ কাজ করেছিল– প্রায় দুই দশক ধরে। আপনি যদি এমন কোনো গর্তে পড়ে গিয়ে থাকেন যা থেকে বের হওয়ার উপায় নেই, তাহলে পেশাদার কোনো সাহায্য নিন। থেরাপির কোনো বিকল্প পাওয়া না গেলে ঔষধ গ্রহণ করতে পারেন যা আপনার জীবন বদলে দিতে পারে।
আমি ভেবেছিলাম জীবনের বাকি দিনগুলো আমাকে ঔষধ সেবন করেই কাটাতে হবে। এবং তারপর আমাদের বাচ্চারা এলো আর তাদের তিনজনই নিজেদের উদ্বেগ নিয়ে সংগ্রাম করা শুরু করল। এটা ছিল উদ্বেগের চাইতেও বেশি কিছু। উদ্বেগ তাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করল– তাদের বাইরে ঘুম হতো না, আমাদের শোবার ঘরের মেঝেতে তারা ঘুমাতে শুরু করল এবং সব বিষয়ে চিন্তা করত। ওকলে তার আতঙ্ক অবস্থার নাম দিয়েছিল অলিভার এবং কন্যা সয়্যার তার উদ্বেগ অবস্থাকে বলত কি হবে চক্র। একদিন সে আমাকে বলছিল :
আমার মাথার মধ্যে একটি কি হবে চক্র আছে এবং একবার যখন আমি কি হবে নিয়ে চিন্তা করা শুরু করি, এর ভেতরে আটকা পড়ে যাই কারণ কি হবে নামক ব্যাপারটি মাথার ভেতর সবসময়ই থেকে যায়।
আমি জানতাম এটা কতটা ভীতিকর এবং আমার বাচ্চাদের সংগ্রাম করতে ও ভয় পেতে দেখা ছিল আমার জন্য হৃদয়বিদারক। তাদের উদ্বেগ মোকাবেলা করতে সাহায্য করাটা ছিল আমার জন্য চোখ খুলে দেওয়ার মতো এবং একই সাথে হতাশাজনক কারণ কোনো কিছুই কাজ করছিল না। আমরা বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হয়েছিলাম এবং সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করেছিলাম। আমরা তাদের ভয়ের মুখোমুখি হতে সাহায্য করার জন্য পুরস্কারসহ কিছু খেলার আয়োজন করেছিলাম। এটা শুধু অবস্থার অবনতি ঘটাল।
আমি জোলফট সেবন বন্ধ করেছিলাম, তাই ঔষধের সাহায্য ছাড়াই আমি এখন উদ্বেগের মুখোমুখি হতে সক্ষম। আমি বুঝতে চেয়েছিলাম কেমন করে একে পরাস্ত করা যায় যাতে করে আমি আমার বাচ্চাদের সাহায্য করতে পারি। আমি শিখেছিলাম :
শান্ত হওয়ার চেষ্টা সাহায্য করে না
আমি থেরাপিস্টদের সঙ্গে প্রচুর সময় ব্যয় করেছি যারা আমাকে ও বাচ্চাদেরকে বলেছিল– শুধু চ্যানেলটি বদলাও এবং অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা কর। আপনি নিছক চিন্তিত থাকলে এটা কাজ করবে, কিন্তু পুরোপুরি উদ্বিগ্ন অবস্থায় এই কৌশল কাজ করবে না। এর একটি কারণ রয়েছে। আপনি যখন উদ্বিগ্ন বোধ করেন, শারীরিক অস্থিরতার একটি পর্যায়ে আপনি চলে যান। আপনি যখন কাউকে শান্ত হতে বলেন, আপনি আসলে তাকে ঘণ্টায় ষাট মাইল থেকে শূন্য মাইলে নেমে আসতে বলছেন। এটা অনেকটা মালবাহী একটি রেলগাড়িকে থামানোর চেষ্টা হিসেবে সামনে পাথর ফেলে দেওয়ার মতো অবস্থা। এতে করে রেলগাড়ির ট্রাকটি লাফ দিয়ে উঠবে।
বিহেভিয়ার রিসার্চ অ্যান্ড থেরাপি পত্রিকার এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা স্বাভাবিকভাবে তাদের অবাঞ্চিত চিন্তাধারা দমন করার চেষ্টা করে তারা আরো বিব্রত হওয়ার মাধ্যমে তা শেষ করে। এটা ঠিক, আপনি যখন নিজেকে শুধু শান্ত হতে বলবেন, আপনার উদ্বেগ আরো খারাপ অবস্থার দিকে যাবে কারণ আপনি এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। আপনি যখন বুঝতে পারবেন আতঙ্ক কি করে কাজ করে, এটা কি এবং একে আরো খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আপনার মস্তিষ্কের ভূমিকা কি, আপনি একে পরাস্ত করতে পারবেন।
এক্ষেত্রে দুটি কৌশল রয়েছে যা একত্রে অবিশ্বাস্য ভালো কাজ করে। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ পরিমাপ করার জন্য ফাইভ সেকেন্ড রুল-টির ব্যবহার এবং তারপর উদ্বেগকে পুনঃকাঠামো প্রদান করার (যাতে করে আপনার মস্তিষ্ক একে বাড়াতে না পারে) মাধ্যমে আপনার শরীরকে শান্ত করা। আপনি কিভাবে এটি করবেন।
উত্তেজনা এবং উদ্বেগ আপনার শরীরে একই রকম বোধ হয়
জনসম্মুখে বক্তৃতা করতে গিয়ে সর্বপ্রথম আমি পুনঃকাঠামো কৌশল-টি ব্যবহার করি। নাগরিক বক্তৃতা বিষয়ে আমি প্রচুর প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি বিশেষ করে ভয় ও স্নায়ুকে আমি কি করে নিয়ন্ত্রণ করেছি সেই বিষয়ে। আমার উত্তর মানুষকে সবসময় বিস্মিত করেছে– আমি কখনোই আমার ভয় ও স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করিনি। আমি শুধু আমার সুবিধামতো তাদের ব্যবহার করেছি।
আমি পেশা হিসেবে বক্তৃতা করি। অনেক। ২০১৬ সালে আমাকে আমেরিকার সবচাইতে বেশি বায়নাকৃত মহিলা বক্তা হিসেবে নামকরণ করা হয়েছিল। এক বৎসরে ৯৮টি কী নোটস! অসাধারণ! আমি কি স্নায়ুচাপে ভুগেছিলাম? অবশ্যই। প্রতিটি একক সময়ে।
কিন্তু এখানে একটি কৌশল রয়েছে। আমি একে স্নায়ুচাপ বলি না। বলি উত্তেজনা, কারণ শরীরবৃত্তীয় ভাবে উদ্বেগ ও উত্তেজনা একই জিনিস। উদ্বেগ ও উত্তেজনার মধ্যকার একমাত্র পার্থক্য হলো আপনার মস্তিষ্ক একে কি নামে ডাকছে। যেমন, প্রায় মিস হওয়ার উদাহরণটি। আপনার শরীর অস্বাভাবিক অবস্থায় চলে যাওয়ার একটি ভালো ব্যাখ্যা যদি আপনার মস্তিষ্কের কাছে থেকে থাকে, এটি তাহলে বিষয়টিকে বাড়তে দেবে না।
প্রথমবার আমি যে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতাটি দিয়েছিলাম তা ছিল সান ফ্রান্সিসকোতে টেডএক্স টক। আমার মনে আছে মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে আমি একের পর এক পি-এইচ-ডি ধারীদের বক্তব্য শুনছিলাম এবং নিজের ব্যাপারে চিন্তা করছিলাম। এটা ছিল আমার নিজেকে সবচাইতে বাজে অবস্থার মধ্যে দেখতে পাওয়া। এই সকল করিতকর্মা লোকদের তুলনায় নিজেকে আমার মহামূর্খ মনে হয়েছিল।
আমার হাতের তালু ঘামছিল। হৃৎপিণ্ড দৌড়াচ্ছিল। মুখ তেতে উঠছিল। আমার শরীর অ্যাকশন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এটা ছিল কিছু একটা করার প্রস্তুতি। কিন্তু নিজেকে আমি বলেছিলাম যে, আমি স্নায়ুচাপে ভুগছি। আমি এইসব সংবেদনশীলতাকে দেখেছিলাম খারাপ কিছু সংঘটনের পূর্বচিহ্ন হিসেবে এবং আমার স্নায়ু আরো নাজুক অবস্থায় চলে যাচ্ছিল।
রূঢ় কিছু জানতে চান? ছয় বৎসর এবং শত শত বক্তৃতার পর– মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে আজো আমার শরীরে একই রকম অনুভূতি হয়। হাতের তালু ঘেমে ওঠে। হৃৎপিণ্ড দৌড়ায়। মুখ তেতে ওঠে। আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি। আমি যখন অ্যাকশন নিতে চলেছি এবং আমার শরীর যখন প্রস্তুত হচ্ছে, সেই একই জিনিস অনুভব করি– ভয়। আমি একে শুধু একটি ইতিবাচক দিকে পরিচালনা করি।
আমি যত বেশি বক্তৃতা দিয়েছি, আমার বক্তব্যের ব্যাপারে আমি ততটাই স্বস্তিকর ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। কিন্তু আমার সক্ষমতার উপর আত্মবিশ্বাস অর্জন করার পরও খেয়াল করলাম যে শরীরের অনুভূতিগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়নি। তখনি আমার মনে হলো যে, এটা হয়তো আমার শরীরের অসাধারণ কিছু করার বিশেষ একটি উপায়। সুতরাং, নিজেকে আমি বলতে শুরু করি যে– স্নায়বিক চাপের পরিবর্তে আমি উত্তেজনা বোধ করছি।
বলুন– আপনি উত্তেজিত
আমি জানতাম না যে আমার কৌশলের পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ছিল। একে বলা হয়– উদ্বেগ পুনর্মূল্যায়ন। উদ্বেগকে উত্তেজনা হিসেবে পুনঃকাঠামো প্রদান সত্যিই কাজ করে। এটা যতটা সহজ ততটাই শক্তিশালী। হার্ভার্ড বিজসেন স্কুল-এর অধ্যাপক এলিস উড ব্রুকস গবেষণার পর গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন প্রমাণ করার জন্য যে, এটা শুধু উদ্বেগই কমায় না বরং আপনাকে গণিত পরীক্ষা, কথা বলা এবং আরো অনেক ব্যাপারে ভালো করতে সাহায্য করে থাকে।
সংক্ষেপে, যেহেতু উদ্বেগ একটি অস্বাভাবিক অবস্থা, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টার বদলে আপনি আপনার মস্তিষ্ককে এই বলে সন্তুষ্ট করতে পারেন যে, এইসব স্নায়বিক অনুভূতিসমূহ আসলে শুধুই উত্তেজনা। এই কৌশলটি ব্যবহার করার সময়– কারাওকি গান গাওয়া থেকে শুরু করে ক্যামেরার সামনে বক্তৃতা করা বা গণিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণসহ সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যে সকল অংশগ্রহণকারী বলেছিল– আমি উত্তেজিত, তারা প্রতিটি একক চ্যালেঞ্জে ভালো করেছিল তাদের চাইতে, যারা বলেছিল– আমি উদ্বিগ্ন। স্নায়ুকে উত্তেজনায় পুনঃকাঠামো প্রদান করা কাজ করে থাকে। সুজি যেমনটি করেছিলেন। ফাইভ সেকেন্ড রুল-টি ব্যবহার করে এইসব অনুভূতি যা তাকে থামিয়ে দিচ্ছিল, পাকস্থলীর ভেতর পুরে রেখে দিয়েছিলেন। তার স্বামী অবসর নেওয়ার পর তারা পূর্ব উপকূলের দিকে স্থানান্তরিত হওয়ার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু প্রতিবার তার পাকস্থলীতে যে অনুভূতি হচ্ছিল তা ছিল– পরিবর্তনের ভয়।
আমি উত্তেজিত নিজেকে একথা বলার বিষয়টি হলো– এটা আপনার শরীরে বয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলোকে হ্রাস করবে না বরং আপনার মস্তিষ্ককে এমন একটি ব্যাখ্যা দেবে যা আপনাকে শক্তি জোগাবে। এই প্রক্রিয়ায় স্নায়বিক বোধগুলো আর বাড়বে না। আপনি নিয়ন্ত্রণের ভেতর থাকবেন এবং যখন মুভ করবেন, আপনার শরীরে থাকা উত্তেজনা শান্ত হতে শুরু করবে।
পরবর্তী সময়ে আপনি যখন কফি তৈরি, উত্তেজনাকর মঞ্চ অভিজ্ঞতা, খেলা-পূর্ব ভয়, পরীক্ষার দুশ্চিন্তা অথবা চাকরির সাক্ষাৎকারের মতো আতঙ্ক আক্রমণের শিকার হবেন, আপনার উদ্বেগকে পরাস্ত করতে ফাইভ সেকেন্ড রুল-টির সাথে এই নতুন গবেষণাটি ব্যবহার করতে পারেন। যখনি আপনি অনুভব করবেন উদ্বেগ আপনার শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে, রুলটি ৫ ৪-৩-২-১ ব্যবহার করে আপনার মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিন। নিজেকে বলুন– আমি খুবই উত্তেজিত এবং নিজেকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে দিন।
শারীরিক প্রভাব (ধাক্কা) খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং গণনা দ্বারা এর শুধু। নিজেকে প্রয়োগ করার মাধ্যমে এটি আপনার প্রিফ্রন্টাল করটেক্সকে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার অনুমতি দেয় এবং একটি ইতিবাচক ব্যাখ্যার উপর আপনাকে ফোকাস করে। প্রথম যখন আপনি এই কৌশলটি ব্যবহার করা শুরু করবেন, আপনাকে হয়তো ঘণ্টায় ২৭ বার এটি পুনরাবৃত্তি করতে হবে। আমার ১১ বছর বয়সী সন্তান প্রথমবার তার বন্ধুর বাড়িতে ঘুমাতে যাবার সময় উদ্বেগ দূর করতে রুলটি ব্যবহার করেছিল। তার ভাষায়– আমি উত্তেজিত ছিলাম এবং পুরো ৬ মাইল যাত্রাপথে বারবার ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। তার ছোট্ট হৃদয়ের প্রতি আশীর্বাদ।
আমি যখন কুইনস ড্রাইভওয়েতে গাড়িটি পার্ক করে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম– তুমি কি ঠিক আছ? সে জবাব দিয়েছিল– আমার হৃৎপিণ্ড এখনো দৌড়াচ্ছে এবং পাকস্থলীতে অদ্ভুত অনুভব করছি, কিন্তু আমি খুবই উত্তেজিত। সেটা ছিল ৬ মাস আগের ঘটনা। তার উদ্বেগ এখন আর নেই, সে এখন প্রকৃতই উত্তেজিত। আর এটাই হলো এই হাতিয়ারটির শক্তি, এটা সত্যিই কাজ করে।
“আপনি যতটা বিশ্বাস করেন তার চাইতে বেশি সাহসী, যতটা মনে হয় তার চাইতে বেশি শক্তিশালী এবং যতটা মনে করেন তার চাইতে বেশি করিতকর্মা।“
– এ. এ. মিল্নে
*
(১৪) ভয়কে জয়
মানোবল, প্রিয় হৃদয়।
– সি. এস. লিউইস
ভয় আমাদেরকে কঠিন কাজ করতে সাহায্য করে। আমার জীবনের একটি বড় ভয় হলো– উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় অগ্নিকাণ্ডের ভেতর মৃত্যুবরণ করা। বিমানে আরোহণ করার সময় আমি পুরোপুরি উদ্ৰান্ত হয়ে পড়তাম। আকাশ ভ্রমণের ব্যাপারে আমার সবধরনের কুসংস্কার ছিল। প্রথমেই আমি বোর্ডিং এলাকায় খুঁটিয়ে দেখতাম– ছোট বাচ্চা কোলে মহিলা, ইউনিফর্ম পরিহিত নারী-পুরুষ, পুরোহিত, নান, হুইলচেয়ার যাত্রী, কাজ শেষে কোনো পাইলট এর বাড়ির পথে গাড়ি ধরা কিংবা সাধারণ ভদ্র চেহারার মানুষজন। অতঃপর নিজেকে বলতাম– ঈশ্বর নিশ্চয় এইসব চমৎকার মানুষ নিয়ে বিমানটিকে নিচে পড়তে দেবে না। এটা বিমানে আরোহণের পূর্ব পর্যন্ত আমাকে শান্ত রাখত। তারপর, রানওয়ের পথে প্রতিটি ওঠানামা বা শব্দ আমার হৃৎপিণ্ডকে উত্তেজিত ও শরীরকে শক্ত করে দিত।
মাটি ছাড়ার মুহূর্তটি হতো সবচেয়ে খারাপ। সমতল ছেড়ে বিমানের চাকা যখন আকাশে, আমি তখন পুরোপুরি আতঙ্কিত অবস্থায়। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলতাম এবং কল্পনা করতাম একটি বিস্ফোরণ, সন্ত্রাসী হামলা, আমার আসন সারিটি বিমানের ভেতর আটকে পড়া কিংবা আকাশ থেকে বিমানটির পতন। আমি হাতল আঁকড়ে ধরতাম এবং খুব কষ্ট করে নিঃশ্বাস নিতাম। পাইলট যখন লাউডস্পিকার-এ আমাদের সঙ্গে কথা বলত, আমার ভয় তখন অর্ধেকে নেমে আসত। সিটবেল্ট লাইট বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আরাম করে বসতে পারতাম না। এটা ছিল একটি নিদর্শন যে পাইলট বিশ্বাস করছেন বিমানের ভেতর এখন নড়াচড়া করাটা নিরাপদ। বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করার সম্ভাবনা আপাতত নেই।
দ্য ফাইভ সেকেন্ড রুল এবং একটি বিশেষ উদ্বেগ পুনর্মূল্যায়ন পদ্ধতি, যাকে আমি বলি– উপস্থাপক ভাবনা ব্যবহার করে আমি আমার আকাশে ওড়ার ভীতি নিরাময় করেছিলাম। আপনিও একই ধরনের যে কোনো ভয়ের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
একটি উপস্থাপক ভাবনা তৈরি করুন
যখনি আমি কোনো কারণে স্নায়ুচাপ চিহ্নিত করি, সেটা হোক না কোনো বিপজ্জনক শব্দ, বিমানের ওঠানামা, লম্বা সময় ধরে ওপরে ওঠা, ভীতিকর আবহাওয়া কিংবা পাশের কোনো যাত্রীর খারাপ পরিস্থিতি, আমার ভয় খুব সহজেই ডালপালা মেলে দেয় কারণ আমার চিন্তা করার ধরনটি মজ্জাগত। এটা যখন ঘটে, মাথা থেকে ভয় দূর করতে, আমার প্রিফ্রন্টাল করটেক্সকে সক্রিয় করতে এবং বর্তমান মুহূর্তটিতে নিজেকে টেনে দাঁড় করাতে আমি ক্ষণ গণনা ৫-৪-৩-২-১ শুরু করি।
অতঃপর, আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানকার নির্দিষ্ট দৃশ্যকল্পের উপর নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য নিজের ওপর জোর খাটাই এবং চিন্তা করি– মায়ের সাথে সৈকতে ভ্রমণ, শিকাগোতে কোনো ক্লায়েন্ট-এর সাথে নৈশভোজ অথবা বন্ধুদের সঙ্গে উত্তাল সময় উপভোগ করার ব্যাপারে আমি কতটা উত্তেজিত।
এই উপস্থাপনার ছবিগুলো কিছু সহজ সত্যের শক্তিশালী স্মৃতিচিহ্ন। আমি যদি আজ রাতে শিকাগোতে কোনো ক্লায়েন্ট-এর সাথে রেস্তোরাঁয় বসে নৈশভোজ করি, অথবা আগামীকাল ভোরে মিশিগান-এ মায়ের সাথে সৈকত ভ্রমণ করি, অথবা সঠিক সময়ে বাড়ি ফিরে মেয়েদের সাথে লাক্রসি খেলায় অংশগ্রহণ করি, তাহলে অবশ্যই আমার বিমানটি ভেঙে পড়েনি এবং এ নিয়ে আর চিন্তা করার কিছু নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমি আমার মস্তিষ্ককে এমন কিছু দেখাচ্ছি যা সে দেখতে চাইছে, যাতে করে ভয় কমে যায়। আমি যখন উপস্থাপক ভাবনা নিয়ে চিন্তা করি, আমার শরীর শান্ত হতে থাকে।
এই কৌশলটি ক্রমাগত ব্যবহার করার মাধ্যমে আমি আমার আকাশ ভ্রমণের ভীতি নিরাময় করেছি। এটা বারবার ব্যবহার করতে করতে একসময় সহজ হয়ে যায় হঠাৎ আপনি আর কোনোরকম ভয় না পাওয়া পর্যন্ত। আপনি আপনার মস্তিষ্ককে ইতিবাচক হতে প্রশিক্ষণ দেবেন। ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আপনি যা চান– উত্তেজিত হতে।
ফ্রান, একটি সম্মেলন থেকে এই কৌশলটি শেখার পর বিমানে উঠে তৎক্ষণাৎ এর ব্যবহার করেছিলেন এবং এটি তার জন্য একটি পৃথক পৃথিবী সৃষ্টি করেছিল। তার শেষ কথাটি আমার ভালো লেগেছে– আমি বিশ্বাস করতে পারিনি ভয় পাওয়ার কারণে আমি কি হারাচ্ছিলাম। তিনি সঠিক বলেছেন এবং এটা সত্যিই হতাশাজনক। আমিও ঠিক একই জিনিস উপলব্ধি করেছিলাম– ভয়ের সাথে বসবাস করার কারণে প্রতিটি দিন আমি আমার আনন্দ, সুযোগ এবং জাদু লুট করছিলাম। এটি এরকম হওয়ার কথা ছিল না। সমান্তরাল ৫ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে আপনি নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে পারেন এবং ভয়কে পরাস্ত করতে পারেন।
এখন, বিমান ভ্রমণ করার সময় আমি আর কখনোই ভয় পাই না। কখনো যদি বিরক্তিকর ওঠানামার মধ্যে পড়ে যাই, আমি রুলটি ব্যবহার করি যাতে করে পাশে বসা যাত্রীর হাতে আমার নখের আঁচড় কাটতে না হয়।
যাইহোক, অন্যান্য ভয়ের ক্ষেত্রেও আমি এই কৌশলটি ব্যবহার করি। একটি আপসরফা কিংবা কঠিন আলোচনার পূর্বে, উদাহরণস্বরূপ, যখন আমি আলোচনার উপস্থাপক ভাবনাটি তৈরি করছি অথবা আপসরফাটি খুব ভালোভাবে এগোচ্ছে বিশেষত, যখন আমি কল্পনা করছি কারো আলিঙ্গন অথবা প্রিয় কোনো গুঁড়িখানায় বসে আমার ব্যবসায়িক অংশীদারের সাথে আলোচনা বা ব্যবসায়িক লেনদেন উদ্যাপন উপলক্ষ্যে নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছি।
এই ভাবনাগুলো আমাকে মাটিতে রাখে এবং শক্তিশালী করে। আপনি যখন ভয়কে নিয়ন্ত্রণের আলোচনায় প্রবেশ করবেন, আপনি আপনার শ্রেষ্ঠ অবস্থানে থাকবেন না কারণ বাস্তব মুহূর্তে আপনার মস্তিষ্কের অংশবিশেষ ঐ ভয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যস্ত থাকবে। আপনার যখন একটি উপস্থাপক ভাবনা থাকবে, এটি আপনাকে ভয় মুছে ফেলার অনুমতি দেবে, যখনি এটি উপলব্ধি করবে যে আপনার মন ভয়ের স্রোতে ঝুঁকে পড়েছে।
মনে রাখবেন, যদিও আপনার ভয় এবং অভ্যাস আপনাকে ৫ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে অপহরণ করে নিয়ে যেতে পারে, আপনি ঠিক ঐ সময়ের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে পারেন এবং চিরতরে এটি করে যেতে পারেন।
আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সবকিছুই সম্ভব।