পর্বত – মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য
সার্কাসের হাতি—পর্বত। আজ সাত দিন ধরে শুধু অপেক্ষা করছে সে। ধুলোর ওপর হাঁটু গেড়ে বসে, চোখের পর্দা ঢেকে পিচুটি আর কুয়াশার ভিতর দিয়ে মানুষদের দেখতে দেখতে, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে। কখন যে সে-মুহূর্ত আসবে, তা পর্বত জানে না।
গায়ের ফাটা চামড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘা। তাতে মাছি বসছে। পায়ে শিকল বাধার দাগ বেয়ে ঝরছে রক্ত আর পুঁজ। মাথার ওপর দিয়ে রোদ যাচ্ছে দিনভর। বালতি ভরা জল আর চাল-বিচালির ডাবা পড়ে আছে যেমনকার তেমনি, ছোঁয়নি পর্বত। মালিক তার হাত মোচড়াচ্ছে তাঁবুতে। বুড়ো মাহুত বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে, আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে পর্বতকে। সমস্ত গা দিয়ে একটা গন্ধ বেরুচ্ছে। এ গন্ধ কোনও ঘা, অসুখ বা নোংরার জন্যে নয়। এ হল মৃত্যুর গন্ধ। হাতিদেব যখন মৃত্যু ঘনিয়ে আসে তখন এমনি ভাবেই জানান দেয়। তবু মালিক বুঝছে না। বলছে, খেলাতেই হবে পৰ্বতকে।
সার্কাসটা নতুন কিনেছে মালিক। এখন লোকসান দেখছে। কেমন করে তাকে বোঝাবে মাহুত, ভেবে পায় না। তোমার লোকসান হোক আর না হোক, ও মরবেই। মালিকের আর এক দুর্ভাবনা, জমি কিনতে হবে, গোর দিতে হবে হাতিকে। গোর দাও আর না দাও, ও মরবেই। মালিক ভাবছে, খেলা না দেখালে দর্শকরা খেপে যাবে। মাটিতে থুথু ফেলে মাহুত বিড়বিড় করে। পর্বত তাকে দেখেও দেখে না। আশি বছর ধরে মানুষ দেখেছে তার চোখ। এখন সে একটু বন খোঁজে। মাটির গন্ধ, ঘাসের গন্ধ খোঁজে ধুলোতে শুঁড় ডুবিয়ে।
কোনও গন্ধ, কোনও স্বাদ পায় না। কয়েকদিন থেকেই শরীরের ভিতরে জানান দিচ্ছে সেই অনুভূতি। প্রথমে এই বিশাল দেহের স্নায়ু, শিরা সব বিকল হল। শিরশিরে আর অদ্ভুত একটা অনুভূতি গুঁড়ি মেরে মেরে এল তার হৃৎপিণ্ডের কাছে। যে-কোনও মুহূর্তে সময় হবে আর চলে যেতে হবে তাকে।
সময় এল সন্ধের ঝোঁকে। জল ঢেলে, জল খাইয়ে, অনেক করে তাকে ঠেলেঠুলে তুলেছিল মাহুত, মালিকের বউ রঙিন ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সার্কাসের এরিনাতে। পর্বতের পিঠে উঠে বসল সে। শুরু হল বাজনা। চমক ভাঙল পর্বতের, ভিতরে যেন তার ভূমিকম্প হচ্ছে। যেমন হত তার বন্ধনহীন জীবনে, ত্রিপুরার জঙ্গলে। ঝাঁকুনি নয়, আঘাত করছে কেউ। আর সেই আঘাতে একটার পর একটা বাঁধন ছিঁড়ছে। পায়ে শিকল, পেটে পিঠে দড়ি, আবার তার ভিতরটাকেও বেঁধেছিল নাকি মানুষ, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে? ছটফট করে ওঠে পর্বত। টলে ওঠে তার দেহ। বেঞ্চি রয়েছে, পা তুলতে হবে, লোহার বল গড়াতে হবে? এখনও এইসব হুকুম, পুতুলের মতো মেপে মেপে বাঁচবার নির্দেশ? নিজেকে একবার ঝাঁকানি দেয় পর্বত। না। পায়ে তার শিকল নেই। বেরিয়ে যেতে চায় সে। শুধু মানুষ আর মানুষ। জায়গা চাই। নির্জন জায়গা একটু।
আতঙ্কিত জনতা চিৎকার করে ওঠে। ক্লাউন, ব্যান্ডপার্টি, মালিকের বউ, গ্যালারি, চেয়ার সব ছিটকে ছিটকে পড়ে। ফাঁক কোথায়? তাঁবুর কাপড়, দড়িদড়া সব টেনে নিয়ে ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় পর্বত। শুঁড় বাড়িয়ে এদিকে ওদিকে শুঁকে শুঁকে খোঁজে। শুধু ধুলোর গন্ধ, মানুষের গন্ধ। সার্কাসের গেট ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষের চিৎকার—হাতি খেপে গিয়েছে! হাতি পাগল হয়ে গিয়েছে, তার কানে আসে না। মেহগনি আর শিরীষের ছায়াঢাকা রাস্তা দিয়ে টলতে টলতে ছুটে চলে পর্বত। হাটুরেদের গোরুর গাড়িগুলো কিছু মাড়িয়ে, কিছু ফেলে দিয়ে, পুরনো গোরস্থানের পাশ দিয়ে, লেভেল ক্রশিং পেরিয়ে ছুটতে থাকে। শুড় বাড়িয়ে কীসের যেন গন্ধ পেতে চায়, আর তা না পেয়ে তীব্র চিৎকারে আকাশ চিরে ফেলে। মানুষের ওপর যে রাগ ভাব আশি বছর ধরে জমেছে এখন সেটা ফেনা হয়ে নামতে থাকে। এই সময় এতটুকু বন, ঘাস, নীরবতা তাকে দেবে না, এ হল চরম বিশ্বাসঘাতকতা।
আস্তে আস্তে মানুষের ছোঁয়াচ কমে আসে। ঝোপঝাড় শুরু হয়। বড় বড় গাছের জঙ্গল নয়। ছোট ছোট ঝোপ ঝাড়, পুকুর। তার ও-পাশে ধান খেত। খেতভরা কচিকচি ধানের সমুদ্র। এই বিশাল বিস্তৃতি দেখে তবু তার ভাল লাগে। চুপ করে দাঁড়ায় পর্বত। ধানখেতটা দলেমথে ফেলেছে দুপায়ে। তার গন্ধ এখন সে পাচ্ছে। শুঁড় ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে নিতে তার মনটা স্থির হয়। চুপ করে দাঁড়ায় পর্বত। এখন আর কোনও অস্থিরতা নয়। এখন চুপ করে থাকতে হবে। কেননা এখন সেই সময় এসেছে। বহুদিন আগে তার পূর্ব-পুরুষরা এমনি করে অপেক্ষা করত জঙ্গলের গভীরে গিয়ে। সে-ও আপেক্ষা করবে।
এখন অনেক কথা মনে পড়ল তার। আশি বছরের জীবনখানা জলছবির মতো পর্বতের চোখে এল। তিন বছরের পর্বত, তাদের দলের সঙ্গে ঘুরছে আসাম-ভূটান সীমান্ত দিয়ে। রাইডক নদীর পাড়ে লোনা পাথর। তারা চাঁদনীরাতে সেই পাথর চাটছে। মানুষের ঘৃণ্য গন্ধ পেতেই সর্দার কেমন সামলে বেরিয়ে গেল গোটা দল নিয়ে। মনে পড়ল আসামের জঙ্গলে সেই খেদার কথা। প্রথম ‘মস্তি’ আসবার পর কুনকী দেখে মেতে গেল পর্বত। তাতেই হল তার মরণ। তারপর থেকে পরিচয় শুধু মানুষের সঙ্গে। শহরের পিলখানায় বন্দি জীবন। একফালি চাঁদের মতো সুন্দর দাঁতজোড়া দেখে কুমার নাম রাখলেন পর্বত। কুমারকে পিঠে নিয়ে বেরুবার মুখে সেই সাদর সম্বর্ধনা। পাকা ধানের গোছা আর মিঠাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহুত। আবার পিলখানায় দুই দাঁতালে লড়াই। খেপে বেরিয়ে গেল বাহাদুর। একখানা দাঁতের আধখানা রেখে গেল পরাজয়ের চিহ্ন। বাহাদুর পরাজয় মানল কি? পিলখানার কুনকীদের ডাক রোমাঞ্চ জাগাত তার মনে, ছুটে যেত সে। শহরের প্রান্ত দিয়ে আঁধার রাতে। কমিশনার সায়েবের গুলিতে বাহাদুর মাটি নিয়েছে আগরতলা থেকে ন-মাইল দূরে। মানুষ এমনিতেই ঘৃণ্য। শিকার আর হত্যার মুখোমুখি হলে তার গায়ের গন্ধ আরও কত ঘৃণ্য। সেই একটা সময় মনে পড়ল তার। শিকার করতে নিয়ে গিয়েছে কুমার সায়েব। খ্যাপা দাঁতালের সঙ্গে তার লড়াই হল। দাঁতাল মরল। জখম হল সেও। এত নির্বোধ মানুষ যে, গুলি করল তাকেও। সেই জখমেই সে পঙ্গু হল। খরচ কমাতে সার্কাস দলে বেচে দিল তাকে।
সেই বিশাল ঐতিহ্য তার মনে পড়ল। জঙ্গল, পাহাড়, চরাই, উতরাই, নদী জুড়ে তার যে স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্র পেয়েছিল জন্মসূত্রে—সেইসব বিশাল ও মহৎ ব্যাপ্তি থেকে তাকে সরিয়ে এনেছে মানুষ। তার সেইসব পূর্বপুরুষ, হাজার হাজার বছর ধরে যারা বিচরণ করেছে পৃথিবীর বনেজঙ্গলে—তাদের সঙ্গে যোগসূত্র অনুভব করল সে। মানুষের আগে তাদের অধিকার কায়েম ছিল পৃথিবীতে মানুষ তাদের বঞ্চিত করেছে। নির্মম, নির্বোধ ও চূড়ান্তভাবে বঞ্চনা করেছে। কিন্তু তাতেই কি মানুষের জয় সম্পূর্ণ হল?
শুঁড় দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস টানে পর্বত। মানুষ জয় করতে পারেনি তাকে। আশি বছরের বন্দি জীবন আজ এমনি তুচ্ছ হল। মৃত্যুর মহান লগ্নে তার পূর্বপুরুষরা নির্জন স্থান খুঁজেছে। স্থির হয়ে গ্রহণ করেছে মৃত্যুকে। সেও তাই করছে। এবং এতেই সে পিতৃপুরুষদের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্রের বাঁধন অনুভব করছে। এখন শুধু স্থির হতে হবে। শুঁড় নামাল পর্বত। আকাশের পটভূমিকায় সেই বিশাল দেহ স্থির হয়ে রইল।
শহরে এদিকে সারারাত হট্টগোল চলল। হাজার হাজার মানুষ ছুটোছুটি করল। আলো নিভল না। জরুরি খবর নিয়ে মোটর সাইকেল ছুটল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশসুপার, ডি সি’র কুঠিতে। ঘুম ভেঙে সৈন্যরা উঠল। বিপদের ঘণ্টা শুনে জামাকাপড় পরল। বন্দুক নিল। ছুটে বেরুল। সব নিয়মমাফিক।
সবাই যখন এসে পৌঁছল তখন ভোর হয়ে আসছে। আকাশ সবে ফিকে হয়েছে। পুলিশসুপার চাপা গলায় হুকুম দিলেন। গুড়ি মেরে এগোল সৈন্যরা। দুদিক থেকে ঘিরে এল। ধানখেতের জলকাদায় পা ডুবে যাচ্ছে। তবু শব্দ করছে না মুখে। প্রত্যেকটি সৈন্য নিজের কৃতিত্ব অনুভব করল।
ফায়ার! সুপারের গলা আর বন্দুক একই সঙ্গে গর্জন করল। সবুজ ধানের ওপর ঝরঝর করে পড়ল লাল রক্ত আর আস্তে আস্তে, কাঁপতে কাঁপতে, পড়তে পড়তে পর্বত তীব্র চিৎকার করল।
মানুষের নির্বোধ আচরণের বিরুদ্ধে সেই অন্তিম প্রতিবাদ আকাশের কত দূরে গেল কে জানে। কেন তার পরেও সূর্য উঠতে লাগল, সমস্ত ছবিটা আরও পরিষ্কার দেখা গেল তাতে। মানুষদের মুখে ফুটল সাফল্যের হাসি। পুলিশ সুপার বুটপরা পা তুলে দিলেন পর্বতের গায়ের ওপর আর এই চূড়ান্ত নির্বোধ ও নিষ্ঠুর প্রহসনের ওপর তেততা থুথু ফেলতে লাগল বুড়ো মাহুত। এতজনের মধ্যে একমাত্র সে-ই বুঝল, পর্বত সাবধান করে গেল সবুজ অরণ্যবাসী তার জাতভায়েদের।
আর বুঝল এক ঝাঁক পাখি। বক্তের গন্ধমাখা মাটি ছেড়ে আকাশে উঠতে উঠতে ডেকে উঠল তারা।
২২ জুন ১৯৫৮