পর্বতের ভাঁজ, তার ওপারে উন্মুক্ত উপত্যকা
কলকাতার এক ভদ্রলোক কাশ্মীর পৌছে প্রশ্ন করেছিলেন, “দাদা, হিমালয় কোথায়? বলেছিলাম, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন হিমালয়ে। চারদিকে দেখছেন, হিমালয়। হিমালয় তো আর একটা পর্বত নয়! এ হলো, পর্বতেরগুচ্ছ বা পর্বতরাজি (Series of mountains)। পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে শুরু, পূর্বে গেছে মিয়ানমার পর্যন্ত। দক্ষিণের হাওয়ার বিরুদ্ধে এক দুর্ভেদ্য ঢাল রচনা করেছে যে, সে হিমালয়। ভারত মহাসাগর থেকে ওঠা মৌসুমী বায়ু উত্তরে যেতে যেতে যেখানে বাধা পায় সে হিমালয়। হিমালয়ের সে দুর্ভেদ্য সজ্জা অপূর্ব! ধাপে ধাপে উঁচুতে ওঠা। প্রথমে ছছাটরা দাঁড়িয়ে; যাদের বলে পাহাড় (Smaller Himalayas)।
তারপর মাঝারি (Middle Himalayas)। সবশেষে সুবিশাল-সুউচ্চ পর্বতসারি (Greater Himalayas)। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হেঁটে হেঁটে উত্তরে যান। প্রথমে দেখা মিলবে ছোটদের। ক্রমান্বয়ে বড়রা সামনে পড়বে, উন্মুক্ত করবে তাদের উদার বক্ষ। সমুদ্রের পানিকণায় আর্দ্র বায়ুরা মেঘ হয়ে এগিয়ে যায় সামনে। ছোট পাহাড়েরা থামিয়ে দেয় তাদের গতি। তাই সমতল ভারতে আর বাঙাল এলাকায় বৃষ্টি হয়। সমতল বাংলায় তুমুল বৃষ্টিতে স্নান করে হেসে ওঠে ফুল, কদম্ব। বৃষ্টিস্নাত এই গোটা অঞ্চলের জলবায়ুকে বলে ‘মৌসুমী জলবায়ু (Monsoon Climate)’। যেসব মেঘ ছোট পাহাড়ের মাথায় ঠেকে না তারা বাধা পায় মধ্য হিমালয়ে। আছড়ে পড়ে ছোট ছোট পাহাড়ের গায়ে। তাই, ভুটান, নেপাল, উত্তরাখণ্ডের দক্ষিণ দিকে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি হয় জম্মুতেও একই কারণে।
তাই, হিমালয় পাদদেশীয় পাহাড়গুলোও পায় মৌসুমী জলবায়ুর ছোঁয়া। কাশ্মীরের অবস্থান মধ্য হিমালয়ে। তাই মৌসুমী জলবায়ু আর বৃষ্টিভেজা কদম ফুল নেই সেখানে। বৃষ্টি সেখানে হয় বটে, তবে সে অন্য কারণে। পশ্চিমের ভূ-মধ্যসাগর থেকে বয়ে আসা শীতল, পুবাল বাতাস সেখানে খানিকটা বৃষ্টি আনে। বেশিরভাগই মার্চ-এপ্রিল মাসে। তাই কাশ্মীরের জলবায়ুকে অনেকে বলেন খানিকটা ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু (Sub-Mediteranean Climate)। তবে, মূলত কাশ্মীরের নিজস্ব আবহাওয়া-জলবায়ু হলো, হিমালয়ান জলবায়ু।
যার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সে আনপ্রেডিক্টেবল। এই বৃষ্টি, এই মেঘ; আবার মিষ্টি রোদের হাসি; পরক্ষণেই মনে হবে, এ যে চামড়া জ্বালানো নিষ্ঠুর তাপদাহ। মধ্য হিমালয় পর্বতগুচ্ছের ওপরে একটা সমতল উপত্যকার নাম কাশ্মীর। পাখির মতো আকাশ থেকে তাকিয়ে দেখলে (Birds eye view) একে মনে হয়, অনেকটা উল্টো পাঁচের মতো।
চারপাশে পর্বতের সারি, মধ্যে সমতল ভূমিতে মানুষের বসবাস। শুধু পশ্চিম দিকে পর্বতের বেষ্টনী উন্মুক্ত হয়ে চলে গেছে নদী আর সড়ক। যেন, উল্টো পাঁচের মতো জায়গাটার নিচে একটা লেজ লেগে মানুষের পাকস্থলীর আকার নিয়েছে। ওয়াল্টার আর, লরেঞ্জ’র বর্ণনায় কাশ্মীর হলো, কালো পর্বতমালার মধ্যে একখণ্ড জমিন সাদা পায়ের ছাপের মতো।
খেচর হয়ে যখন আমরা দেখি কাশ্মীর, তখন সে নীরব, শুভ্র। তুলার বলের মতো আকাশে উড়ে চলা মেঘ, আর পর্বতের চূড়ায় জমাটবাঁধা বরফ একে অন্যের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যেন আলাদা করাই দায়। আকাশ থেকে মাটিতে নামলে, যতদূর চোখ যাবে, দেখা মিলবে ফার, পপলার অথবা দেওদার গাছের সারি। মাঝেমধ্যে দু-একটা চিনার গাছ। চারপাশে তুষারে ঢাকা ঝিকিমিকি পর্বত আর পাহাড়ি ঝরনার পানি জমা উপত্যকা- সব মিলে মনোমুগ্ধকর!
সমতল কাশ্মীরে দাঁড়িয়ে দেখবেন চারদিকেই পর্বত। কিন্তু, সেগুলো ততটা কাছে নয়। কাশ্মীরের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার। বানিহাল থেকে বারামুলা। আর প্রস্থে হলো ৪২ কিলোমিটার। দুপুরের রোদে সমতলে দাঁড়িয়ে তাকান দূরের পর্বতের দিকে। সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে পর্ব থেকে পর্বান্তর। প্রথমে সবুজ সারিবদ্ধ গাছের জঙ্গল। তার পেছনে দৃষ্টির আড়ালে হয়তোবা বিশাল জলাশয়। তার পিছে, রোদের আলোয় কালচে হওয়া শ্যামল গাছের মাদুর জড়ানো উর্ধ্বমুখী পর্বতের ঢাল। আরও পেছনে খাড়া উঠে যাওয়া কালো-ল্যাংটা পর্বত। তার চূড়ায় তুষারের সাদা টুপি আলিঙ্গন করছে উড়ন্ত মেঘের সঙ্গে। ধাপে ধাপে আঁকা এই বিরাট ছবিটির ক্যানভাস হলো মস্তবড় নীল আকাশ।
যেখানে আকাশের সঙ্গে পর্বতের চূড়ার মিলন হয়েছে সেটাই হলো পর্যটকের পরম আরাধ্য গন্তব্য। তাই তো, যে কেউ ছুটে চলেন চূড়ার পানে। আপনি জানতে চান, কাশ্মীরের কোথায় যাবেন বেড়াতে? আমি বলব, যেকোনও দিকে সমতল থেকে পর্বতের চূড়ার দিকে ধাবিত হন। সর্বত্র দেখবেন একই রূপ। শ্রীনগর হলো কেন্দ্র। কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই এগিয়ে যান। ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরিয়ে বলি। উত্তর-পূর্ব (উত্তর থেকে ডান দিকে সোমার্গ হয়ে লাদাখ, তারপর কোলহাই পর্বতের চূড়া, দক্ষিণ-পূর্বে পেহেলগাম, আরও নিচে কোকরনাগ, ডাকসুম, সিনথেন টপ, ভেরি নাগ, আচ্ছাবাল হয়ে সর্ব দক্ষিণে বানিহালের জওহর টানেল।
দক্ষিণ-পশ্চিমে অ্যাহারবাল, মানসারওয়ার লেক, পীর কি গলি, মোগল রোড। ক্রমে পশ্চিম দিক হয়ে উত্তরে উঠলে মিলবে ইউসমার্গ, চারার-ই-শরীফ, দুধপত্রি। উত্তর-পশ্চিমে এসে গুলমার্গ, উলার আর গুরেজ হয়ে মানসবাল লেক। ঘুরলেন? এবার থামুন। থিতু হন শ্রীনগরে। কাশ্মীরিরা যাকে উচ্চারণ করেন শিরিনগর। গ্রামীণ কাশ্মীরি ভাষায় বলে ‘শহর’। পাঁচ হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যের শহর শ্রীনগর। তাকে দেখে নিতে পারেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে বিখ্যাত ঝিলাম নদী। পাশেই রয়েছে সুবিশাল ডাল লেক। দক্ষিণ থেকে উত্তরে রয়েছে অগণন প্রত্ননিদর্শন। মোগলদের প্রকৃতি আর প্রকৌশলের মিশেলে গড়ে তোলা বাগানবিলাস আর আসর-বাসরগুলো।
উপরের এই বর্ণনায় কাশ্মীরকে কেমন মনে হলো? গামলার মতো- যার চারপাশে পর্বতের দেয়াল, আর মধ্যখানে সমতল? ঠিক গামলার মতো নয়, কিছুটা বাথটাবের মতো, লম্বাটে। তবে, পর্বতে ঘেরা কাশ্মীরের মাঝের জমিন তেমন মসৃণ নয়। উঁচুনিচু। আসলে, পর্বতের ঢাল সবসময় মসৃণ হয় না। তা হয় এবড়ো-থেবড়ো। বড় পর্বতের পাশে থাকে বাচ্চা পর্বত, তারপর আরও ছোট্ট টিলা। তারপর যখন সমতল শুরু হয় তারও বুকের ওপর থাকে ঢেউ খেলানো। কাশ্মীরও তাই। কাশ্মীরের জমিনটাও নদী ও নারীর মতো ঢেউ খেলানো। কোথাও আবার সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে উঁচু থেকে নেমে যাওয়া নিচে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রলয়ঙ্কারী বন্যা
হয়েছিল কাশ্মীরে। গত এক শতাব্দীর মধ্যে ভয়ঙ্করতম বন্যা ছিল তা। তখন। দেখেছি, চোখের সামনে শ্রীনগরের বাজার-ঘাট, মানুষের ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। রাস্তার ডান পাশে ডাল লেকের তীরে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এনআইটি) পানিতে ডুবে গেল। হাজার হাজার এনআইটি পড়ুয়া শিক্ষার্থী ডুবে যাওয়া হোস্টেল ছেড়ে রাস্তার এপাশে এসে ভিড় করেছিল। অন্য
পাশেই কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে আমরা ছিলাম নিরাপদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন খুলে দেওয়া হলো বন্যার্ত মানুষের আশ্রয়ের জন্য। বলছিলাম পর্বতের সৌন্দর্যের কথা। কাশ্মীরের প্রকৃতির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো অপূর্ব লীলাময়ী পর্বতের মায়া। আর তার বুক থেকে সিঞ্চিত হয়ে কলকল রবে বয়ে চলা স্বচ্ছ পানির ঝরনাধারা; কোথাও স্রোতস্বীনী আর কোথাও মৃদুমন্দ গতিতে সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া সেই ঝরনা। পার্বত্য এলাকার সুন্দরের আরেক রহস্যের নাম ‘উপত্যকা; দুই পাহাড়ের খাঁজ। তার সামনে দাঁড়ালেই কেবল বোঝা যায়, কবি ও শিল্পীরা নারীকে কেন প্রকৃতির সঙ্গে মেলায় সবসময়।
সে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। সে যেন সুখজাগানিয়া অসীম আলিঙ্গনের আমন্ত্রণ। সে বয়ে আনে দুই পাহাড়ের মধ্যখানে হারিয়ে যাওয়ার উচ্ছ্বাস। যেকোনো দিকে একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠুন। আপনার চোখজোড়া সমান্তরাল হয়ে উপরে উঠতে থাকবে; পক্ষান্তরে পাহাড়ের দেয়াল নামবে নিচে। অকস্মাৎ! আপনার দৃষ্টি পড়বে সামনের বিস্তীর্ণ উপত্যকায়। আপনার চোখে একটা প্যানারমিক ভিউ এসে হাজির হবে। আপনার যদি সুন্দর একটি হৃদয় থাকে তাহলে এই দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আপনি বলে
উঠবেন, ওয়াও!! খোদায় বিশ্বাস যার আছে তার মুখে জিকির উঠবে ‘সুবহানাল্লাহ’!! এবার বিপরীত দিকের ঢাল বেয়ে নামুন উপত্যকায়। বিচরণ করুন। হয়তো দেখবেন সেখানেও আছে জীবন। মানুষের বসবাস আছে সেখানে। একটি সবুজ উপত্যকার মধ্য দিয়ে সুতীব্র বেগে বয়ে চলা ঝরনার বারিধারা মানুষকে যে কতটা উদ্বেলিত করে তা অনুভব করা যাবে কাশ্মীরে। স্পষ্টতই, বাংলাদেশিদের কাছে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন যেমন চেনা-জানা; কাশ্মীরিদের কাছে তেমনি হলো পার্বতী ঝরনাধারার রিমঝিম শব্দ, আঁকাবাঁকা ঢেউ। এই দুয়ের মধ্যে মিল হলো, উভয়ই জীবন্ত, সর্বদা সচল-চঞ্চল। মনে হবে এই উপত্যকার ওপারে বুঝি আবার নেমে যাওয়ার পথ।
এখানেই হলো সুন্দরের শেষ। এগিয়ে যান। দেখবেন, রীতিমতো চমকে উঠবেন! ওপাশে গেলে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে আরও সুন্দর, মনোহর প্রকৃতির দৃশ্যাবলী। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সুখের আড়ালে’ উপন্যাসের একটি উদ্ধৃতি এখানে বলতে হয়। তিনি লিখেছিলেন, একটা সূর্যডোবার যে রঙ তার সব সৌন্দর্য কি লেখায় আসে? লিখতে গিয়ে তাই বড় দুর্বল লাগে। দেখেছি, অনুভব করেছি, আনন্দিত হয়েছি। সেটা আর পাঁচজনকে বোঝাই কী করে? কেবল সুন্দর, মনোহর, অতীব চমকপ্রদ- এ আর কত লেখা যায়?” কাশ্মীরের সুন্দরের মাহাত্ব লিখে বোঝাতে না পারার অসহায়ত্বে হয়তো সব লেখকই ভুগেছেন।
অনেকেই ওই সুন্দরের বর্ণনা করতে গিয়ে ভুলে গিয়েছেন সেই সব মানুষের কথা, যারা হাজার হাজার বছর ধরে ওই প্রকৃতির লালন পালন করেছেন, কিংবা এখনও করছেন। যারাই ওখানে গিয়েছেন, ওই প্রকৃতির প্রেমে পড়েছেন; দখল করতে চেয়েছেন। ভুলে গিয়েছেন, ওটা যে অন্যের সম্পদ। তারাই কাশ্মীরের নাম দিয়েছেন, ভূ-স্বর্গ’। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আকুল আকাঙ্ক্ষা ছিল কাশ্মীরের তৃণভূমিতে মৃত্যুবরণ করার। তিনি ফার্সি ভাষায় বলেছিলেন, ‘আগার ফেরদৌস বেরোহী যামীন আস্তু, হামীন আস্ত, হামীন আস্তু, হামীন আস্ত-যদি পৃথিবীতে কোনো বেহেশত থেকে থাকে তাহলে তা এখানে, এখানে, এখানে।
যারা ওই মাটির সন্তান এই সুন্দরের প্রতি তাদের অনুভূতি কী- তা জানার জন্য চেষ্টা চালিয়েছি নিরন্তর। এমনই একটি ঘটনা বলি। যাচ্ছিলাম পেহেলগাম। হিমালয়ের গা বেয়ে নেমে আসা বরফ-ঠাণ্ডা পানি পাথরের ছোঁয়া লেগে ঘূর্ণি তুলে এগোয়। সেখানে জেগে ওঠে সাদা ফেনা। স্বচ্ছ পানির বুকে ঢেউ খায় আকাশের নীল। মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয় মানুষের হৃদয়-মন। যতই সামনে যাই, শুনি আরও বাকি আছে দেখার। নিচে বহতা নদী, পাশে পর্বতের দেয়াল জুড়ে সবুজ গাছ, দূরে তুষারের মুকুট পরা শৃঙ্গ, আরও দূরে নীল আকাশ। অনিন্দ্য সুন্দরের এই সজ্জা দেখে আমি ছিলাম নির্বাক। আমার কাশ্মীরি বন্ধু জানতে চাইল, কেমন লাগছে পেহেলগাম? ওর দিকে তাকালাম। বললাম, সুন্দর! মনোহর!! বারিয়া আসল’!!! গর্বে ওর বুক ফুলে উঠল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, কাশ্মীর হামারা হ্যায়’।
ওর দুই চোখের কোণ দিয়ে বেরিয়ে এলো দু’ফোঁটা জল। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, হাম কেয়া চাহতেহে?/আজাদি; হক হামারা/আজাদি; ছিন কে লেঙ্গে/আজাদি’। একদিন বন্ধুদের সামনে গাইছিলাম, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। ইংরেজি তরজমা করে বুঝিয়ে দিলাম কাশ্মীরি সহপাঠীকে। বলল, ‘মাতৃভূমির প্রতি সবার দাবি এমনই। আমার কাছেও কাশ্মীর তাই।’ এতক্ষণ বলা হলো প্রকৃতির কথা। একজন দর্শকের দৃষ্টিতে বর্ণিত হলো দর্শক যখন দেখে কোনো কিছু তখন তার বর্ণনা দেয় ভাষায়।
কিন্তু, গবেষক যখন দেখে তখন সে শুরু করে মাপ-জোক। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা, জনসংখ্যা আর আয়তন না বললে; ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিন্যাস না বললে সাহিত্যের বর্ণনা চলে, গবেষণা চলে না। তাই এখানে তুলে ধরা যাক সেই সব কথা। আমি কাশ্মীরে ছিলাম-এমনটি জানার পর প্রায় সবসময়ই একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। কোনো কাশ্মীর- জম্মু না আজাদ? বাংলাদেশের মানুষের ধারণা, জম্মু’ আর ‘আজাদ’ শব্দ দুটি কাশ্মীরের দুই উপমা। একটি কাশ্মীরের ভারত-শাসিত অংশের জন্য, অন্যটি পাকিস্তান-শাসিত অংশের জন্য প্রযোজ্য। আসলে বাংলাদেশিরা জম্মু’ শব্দটিকে জিম্মির অপভ্রংশ মনে করেন। ফলে তাদের কাছে ভারত-শাসিত কাশ্মীর হলো জম্মু কাশ্মীর’। আসল ব্যাপার হলো, ‘জম্মু এবং কাশ্মীর দুটি আলাদা অঞ্চল। জম্মু হলো হিমালয়ের পাদদেশে সমতল থেকে শুরু করে ছোট-ছোট পাহাড় অধ্যুষিত এলাকা।
অন্যটি হিমালয়ের মধ্যে মাঝারি পর্বতসমূহ দিয়ে বেষ্টিত কাশ্মীর উপত্যকা। দুইটি অঞ্চলের মধ্যখানে অবস্থিত ওই মাঝারি পর্বতমালাকে বলা হয় পীরপাঞ্জাল। দুই অঞ্চলের রয়েছে ভৌগোলিক আর সাংস্কৃতিকভাবে ব্যাপক বৈপরীত্য। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে অমৃৎসরে এক চুক্তির মাধ্যমে এই দুই এলাকাসহ লাদাখ, পুঞ্চ, গিলগিত ও বালতিস্তানের জমিদারি পান জম্মুর রাজা গুলাব সিং। তখন থেকেই গুলাব সিংয়ের গোটা জমিদারিকে একসঙ্গে কাগজে কলমে বলা ও লেখা শুরু হয় জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ রাজ্য। যদিও মহারাজার উত্থান হয়েছিল জম্মু থেকে। কিন্তু, প্রায় সবসময়ই রাজ্যটির সংক্ষিপ্ত নাম ‘কাশ্মীর’ হিসেবেই পরিচিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এখনও কাশ্মীর সমস্যা’ বলা হয় মূলত, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ রাজ্যকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান সমস্যাকে বোঝাতেই। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের সময় এই রাজ্যের অধিকার দাবি করে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই। এ নিয়ে চলতে থাকে জটিল রাজনীতি। ওই ডামাডোলে জম্মুর কয়েকটি জেলা, কাশ্মীরের সামান্য অংশ, গিলগিত ও বালতিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয় পাকিস্তান। পাকিস্তানের অধীনের ওই অংশ থেকে পরে গিলগিত ও বালতিস্তানকে আলাদা করে নর্দার্ন এরিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়, তাকে পাকিস্তানের অধীনে নেওয়া হয়। অবশিষ্ট অংশের নাম দেওয়া হয় ‘আজাদ জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ বা ‘আজাদ কাশ্মীর। পাকিস্তানের সংবিধানে ওই অংশের কোনো
উল্লেখ নেই। অর্থাৎ, রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তাদের শাসনাধীন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ অংশকে বলা হয় আজাদ’। আবার তারা ভারত শাসনাধীন অংশকে বলে মকবুজা’ বা পরাধীন। পাকিস্তানের অংশে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’-এর রয়েছে আলাদা প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য ব্যবস্থা। তবে, পররাষ্ট্রনীতিসহ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা ব্যাপকভাবে পাকিস্তাননির্ভর। মূলত, ওখানকার শাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই পরিচালিত। এ কারণেই, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ওই এলাকাকে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর’ বলে চিহ্নিত করা হয়।
পাশাপাশি, সেখানকার জনসাধারণের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি এক ধরনের সম্পর্কবোধ আছে। ফলে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের লোকদের কোনো সশস্ত্র বিরোধ নেই। হয়তো ক্ষোভ আছে। পক্ষান্তরে ভারতের পক্ষ থেকে তাদের নিজেদের শাসনাধীন অংশকে ‘জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ নামে একটি রাজ্য হিসেবে শাসন করা হয়। ভারতের সংবিধানে ওই রাজ্যের জন্য রয়েছে বিশেষ ধারা (নম্বর ৩৭০)। ভারত থেকে প্রকাশিত সকল মানচিত্রে মহারাজার অবিভক্ত জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়। সংবিধানের ওই ধারার অধীনে সম্পূর্ণ জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরকেই ভারত নিজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে দাবি করে। এবং কাশ্মীরের যে অংশ পাকিস্তানের অধীনে আছে তাকে পাকিস্তান দখলকৃত (Occupide) বলে দাবি করা হয়। ভারত শাসিত এই জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ রাজ্যের তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চল আছে।
জম্মু (আয়তন ২৬ শতাংশ), কাশ্মীর (১৬ শতাংশ) ও লাদাখ (৫৮ শতাংশ)। অর্থাৎ, লাদাখ বৃহত্তম এলাকা জুড়ে আছে। তবে, লাদাখে জনবসতি খুবই কম। আর রাজ্যের নামের সঙ্গেও লাদাখের নাম যুক্ত নেই। এই তিনটি অঞ্চলের মধ্যে কাশ্মীর উপত্যকায় রয়েছে জনঅসন্তোষ। উপত্যকার সিংহভাগ লোক ভারতের শাসন থেকে আলাদা হতে চায়। কাশ্মীরের জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। পুরো জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যা এক কোটি ২৫ লাখ। লাদাখ হলো হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বতসারির মধ্যে অবস্থিত। ওই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি আলাদা। তিব্বতিদের সঙ্গে মিল আছে তাদের। সেখানে দুটি জেলা। কারগিল ও লেহ। কারগিলের বাসিন্দারা শিয়া মুসলিম।
লেহ-এ বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পুরো প্রদেশের সিংহভাগ জমি লাদাখের অন্তর্ভুক্ত। জনসংখ্যা মাত্র ২.৩ শতাংশ। মহারাজার সময় থেকেই জনমানবহীন ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বহীন বলে প্রদেশের নামের সঙ্গে লাদাখের নামটি কখনোই সংযুক্ত হয়নি। এখন সেখানে শিক্ষার প্রসার ঘটছে। মানুষের সচেতনতা বাড়ছে। সেখানকার বৌদ্ধ সংগঠনগুলো লাদাখকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল (Union Territory) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করছেন। জম্মু হলো প্রদেশের শীতকালীন রাজধানী। গ্রীষ্মকালের রাজধানী হলো কাশ্মীর ভ্যালির শ্রীনগর শহর। জম্মু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। জম্মুতে এখন প্রায় ৬৫ শতাংশ হিন্দু, মুসলিম ৩১ শতাংশ। কাশ্মীরে প্রায় ৯৮ শতাংশ মুসলিম।
১৯৯১ – ৯২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ শতাংশ হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন কাশ্মীরে। যারা হাজার হাজার বছরের কাশ্মীরি। কিন্তু, সশস্ত্র সংঘাত শুরুর পর একযোগে প্রায় সবাই কাশ্মীর ত্যাগ করেছিল। সামান্য কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার অবশ্য এখনও অবস্থান করছে সেখানে। তারাই এখনও টিকিয়ে রেখেছে কাশ্মীরের অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্য। শত সংঘাতের পরও ভিটে ছাড়েন নি তারা। তারা সেখানকার মুসলিম পরিবারগুলোর সঙ্গেই দুঃখে-সুখে কাটাচ্ছে জীবন-মরণ। এখানেই শেষ নয়। মহারাজার আমল থেকেই অবিভক্ত জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর রাজ্যের উত্তর দিকের সীমান্ত নিয়ে বিরোধ ছিল চীনের সঙ্গে। সেই বিরোধের জের ধরে চীনের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে ‘অবিভক্ত রাজ্যের কিছু অংশ। চীনের অধীনে থাকা
ওই অংশ মূলত গিলগিত, বালতিস্তান ও লাদাখের। আর সেখানে জনবসতিও সামান্য। ফলে ওই বিরোধ তেমন একটা আলোচনায় আসে না। মূল কাশ্মীর উপত্যকার আলোচনায় ঘুরে ফিরে ভারত পাকিস্তানই সামনে আসে। মহারাজা শাসিত বৃহত্তর জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর রাজ্যের মোট ভূমি হলো ২ লাখ ২২ হাজার ২৩৬ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণে আছে প্রায় এক লাখ বর্গ কিলোমিটার, যা মোট এলাকার ৪৫ শতাংশ। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আছে ৭৮
হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা প্রায় ৩৬ শতাংশ। আর চীনের অধীনে ছিল ৩৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা প্রায় ১৬ শতাংশ। পরে ১৯৬৪ সালে চীন-পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তসংক্রান্ত সমঝোতার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান আরও ৫ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটার চীনের কাছে হস্তান্তর করে। সেটুকু যুক্ত করলে চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা প্রায় ১৯ শতাংশ।
নোট/সূত্র
১. Walter R Lawrence; The Valley of Kashmir (1895); Srinagar: Gulshan Books. Pl.
২. জাকারিয়া পলাশ; ঝিলাম নদীর মূলে (২০১৫), ntvbd.com
৩. শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়; ত্রিনয়নী (১৪০১ বাং), পৃষ্ঠা: ৭৮-৭৯।
৪. Niyaz Ilahi; Current News Servies (2013), Srinagar.
৫. জাকারিয়া পলাশ; কাশ্মীরের পেহেলগামে একদিন (২০১৫); ntvbd.com
৬. Mridu Rai; Hindu Rulers, Muslim Subjects (2014); P36.
৭. বিস্তারিত পড়ুন ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম অধ্যায়ে
৮. বিস্তারিত পড়ুন ১১শ অধ্যায়ে আরও
৯. দেখুন জাকারিয়া পলাশ; কাশ্মীর: তুষার ঢাকা উপত্যকা’; মানবজমিন ঈদ। সংখ্যা (২০১৪)।