পর্ণশবরীর শাপ

পর্ণশবরীর শাপ

পূর্বকথা :

পাকদণ্ডী বেয়ে দ্রুত নেমে আসছিল লাকপা শেরপা আর চিৎকার করে ডাকছিল, বৈজন্থী, এ বৈজন্থী।

তার সেই ডাক প্রতিধ্বনিত হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছিল ঘন কুয়াশায়, কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছিল না। এই বৈজন্থীকে নিয়ে ভারী মুসিবতে পড়ে গিয়েছে লাকপা। আরে বাবা স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হয়, আবার মিটেও যায়। তাই বলে কি রাগ করে এত রাতে কেউ বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে! তাও যদি বৈজন্থী পাহাড়ের মেয়ে হতো! বৈজন্থীর বাড়ি কার্শিয়াং-এ। কার্শিয়াংকে পাহাড় বলে মনে করে না লাকপারা। বলে, ও তো শহর। ওখানের সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আট হাজার ফুট ওপরে, সেঞ্চল ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির মধ্যে অবস্থিত চটকপুরের জীবনযাত্রার কোনও মিল নেই। এখানে জীবন অনেক বেশি নির্মম। বছরের বেশিরভাগ সময়েই তাপমাত্রা ছয় থেকে আট ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করে। নভেম্বর পেরতে না পেরতেই তা নেমে যায় শূন্যের নীচে। দমবন্ধ করে দেওয়া ঘন কুয়াশা এবং হাড়মজ্জা জমিয়ে দেওয়া ঝোড়ো হাওয়ার সাথে সাথে যোগ হয় তুষারপাত। আর কপাল আরও খারাপ থাকলে গ্রামে হানা দেয় পাহাড়ি চিতা। অতর্কিতে তুলে নিয়ে যায় গবাদিপশু এবং কখনও কখনও মানুষও। তাই এই নভেম্বরের রাতে রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া মানে সাধ করে মৃত্যুকে ডেকে আনা। তাও যদি বৈজন্থী পাহাড়ের মেয়ে হত!

পাকদণ্ডী বেয়ে দ্রুত নেমে আসছিল লাকপা আর ভাবছিল, কোথায় যেতে পারে বৈজন্থী? আজ পূর্ণিমা। গোল থালার মতো একটা চাঁদ উঠেছে। কিন্তু এমন কুয়াশা যে দু’হাত দূরেও স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না। লাকপার কাছে একটা টর্চ আছে বটে কিন্তু সেটা সে পকেটেই রেখে দিয়েছে। এই কুয়াশায় গাড়ির হেডলাইট অবধি কাজ করে না, সেখানে টর্চ কি করবে? লাকপা মনে করার চেষ্টা করছিল, আজ অবধি এই জঙ্গলের কোন কোন জায়গায় সে বৈজন্থীকে নিয়ে গেছে? আচমকা কথাটা মনে পড়ে গেছিল লাকপার। দশেরার দিন ঘুরতে যাওয়ার বায়না করেছিল বৈজন্থী। তাকে নিয়ে নীচের লেকের ধারে গিয়েছিল লাকপা। জলে পা ডুবিয়ে বসেছিল দু’জনে। বৈজন্থী বলেছিল, এই জায়গাটা তার খুব ভাল লেগেছে। লাকপা যখন আর তাকে মহব্বত করবে না তখন সে এখানে ঝোপড়ি বেঁধে থাকবে। নির্ঘাত ওখানেই গেছে বৈজন্থী। সামনের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে। সেটা ছেড়ে বাঁ দিকে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল লাকপা। ঢোকার আগে গাছ থেকে শক্ত একটা ডাল ভেঙে নিল। বনবরা মানে বুনোশুয়োর সামনে পড়লে খেদাতে পারবে। কিন্তু লাকপা যেটা খেয়াল করল না সেটা হল, একটা উঁচু পাইন গাছের ডালে একদলা অন্ধকার নিঃশব্দে নড়ে উঠল। নিশ্চিত মৃত্যুর মতো দু’টো সবুজ রঙের চোখ জরিপ করতে লাগল লাকপাকে।

অনেক দিন পর শিকার এ ভাবে নিজে থেকে ধরা দিয়েছে। ভারি খুশিয়াল হয়ে উঠেছিল লেপার্ডটি। নিঃসাড়ে নেমে এসেছিল মাটিতে এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে পিছু নিতে শুরু করেছিল শিকারের। যদিও তার চলাফেরা অতর্কিত মৃত্যুর মতোই শব্দহীন তবু আজ একটা অতিরিক্ত সুবিধা হয়েছে। কুয়াশার জন্য গাছ থেকে টুপ টুপ করে জল ঝরছে ক্রমাগত। যদি বা সামান্য শব্দ শিকারকে সচকিত করে তুলতে পারত কিন্তু এই জলের আওয়াজে তা আর শিকারের কান পর্যন্ত পৌঁছবে না। পেশীগুলিকে টানটান করে নিচ্ছিল লেপার্ডটি। এ বারই সেই চরমক্ষণ। এক লাফে উঠে পড়তে হবে শিকারের ঘাড়ে এবং তীক্ষ্ন শ্বদন্ত দিয়ে ছিন্ন করে দিতে হবে শিকারের শ্বাসনালী। তার পর চোয়ালের চাপে ভেঙে দিতে হবে ঘাড়। কিন্তু লাফ দেওয়ার আগের মুহূর্তেই থমকে গেল সে। বিস্ফারিত হয়ে গেল তার দুই চোখ। সে এমন কিছু দেখেছে বা অনুভব করেছে যা তার মধ্যে বুনে দিয়েছে তীব্র ভয়। একটা বেড়াল ছানার মতোই গুটিয়ে এতটুকু হয়ে গেল লেপার্ডটি আর তার পরেই লেজ গুটিয়ে উর্ধশ্বাসে ছুট দিল উল্টো দিকে।

একটা খড়মড় শব্দ পেয়ে পেছন দিকে ফিরে তাকাল লাকপা কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। যাকগে যাক, এখন পেছনে দেখার সময় নেই। দু’হাতে ঝোপঝাড় সরিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেল সে আর যেতেই অনুভব করল, জঙ্গলের চরিত্র যেন বেশ খানিকটা বদলে গেছে এখানে। ছেলেবেলা থেকে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাকপা। সে জানে, জঙ্গলের একটা নিজস্ব শব্দ আছে। কিন্তু ঠিক এই জায়গাটায় কোনও শব্দ নেই। কোনও শব্দ নেই মানে কোনও শব্দ নেই। যেন কেউ বিরক্ত হবে বলে ডাকা বন্ধ করে দিয়েছে ঝিঁঝিঁ পোকারা, গাছের পাতাগুলিও যেন প্রাণপণে সামলে রেখেছে পতনোন্মুখ জলবিন্দুগুলিকে। বলে বোঝাতে পারবে না কিন্তু হঠাৎ করে যেন ভারী অস্বস্তি হতে লাগল লাকপার। তার এত দিনকার শিক্ষা তাকে বলল, এ জায়গায় এমন কিছু ঘটছে বা ঘটতে চলেছে যা তার অভিজ্ঞতায় নেই। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ফিসফিস করে বলল, ফিরে যা লাকপা। ভাল চাস তো ফিরে যা।

কিন্তু বৈজন্থীকে খুঁজে না পেয়ে সে ফিরবে কেমন করে? সবটুকু সাহস বুকের মধ্যে এক জায়গায় করে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে আরও কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেল লাকপা আর তার সমগ্র চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে গেল আশ্চর্য এক সুগন্ধে! যেন হাজার হাজার ফুল ফুটেছে একসাথে! পাহাড়ি ফুলে এমনিতেই রং বেশি, গন্ধ কম। সেখানে এমন তীব্র শ্বাসরোধকারী সুগন্ধ কল্পনাও করা যায় না। এ সুগন্ধ লাকপার অচেনা। হাড় কাঁপানো ঠান্ডার সাথে সাথে বিনবিনে একটা ভয় তার শিরদাঁড়া বরাবর উঠে আসতে লাগল ওপর দিকে। ভয়টা চারিয়ে যাতে লাগল লাকপার মাথার ভিতর। লাকপা বুঝতে পারছে না, তার এত ভয় করছে কেন? সে প্রাণপণে ভয় না পেতে চাইছে কিন্তু অলঙ্ঘ্য নিয়তির মতো ভয়টা সরীসৃপের মতো পাকে পাকে সাপটে ধরছে তাকে। উত্তেজনায় পাগলের মতো লাফাচ্ছে লাকপার হৃৎপিণ্ড। সে শব্দ ছাড়া চরাচরে আর কোনও শব্দ নেই। এমন নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা একমাত্র মৃত্যুর সঙ্গেই তুলনীয়।

আচমকা লাকপা খেয়াল করল, কুয়াশা যেন বেশ খানিক পাতলা হয়ে এসেছে। পূর্ণচন্দ্রের আলো প্রবেশ করেছে জঙ্গলের অভ্যন্তরে। ওই তো খানিক দূরে চিকচিক করছে লেকের জল। আর লেকের জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে, ও কে? বৈজন্থী না? কুয়াশা পাতলা হয়ে এলেও এতটাও পাতলা হয়ে আসেনি যে এত দূর থেকে বৈজন্থীকে স্পষ্ট দেখতে পাবে লাকপা। সে শুধু একটি নারীর অবয়ব দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু এত রাতে বৈজন্থী ছাড়া আর কোন মেয়েমানুষ বসে থাকবে লেকের জলে পা ডুবিয়ে! এমন অভিমানী পাগলি বৈজন্থী ছাড়া আর আছেটা কে? কী যে করে না মেয়েটা! মাথার মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা ভয়টাকে খানিক অগ্রাহ্য করেই লেকের দিকে এগিয়ে গেল লাকপা এবং ডেকে উঠল, বৈজন্থী।

লাকপার ডাক শুনে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে তাকাল নারীটি এবং সেই মুহূর্তে লাকপার চেতনা জুড়ে ভয়ের বিস্ফোরণ হল। নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল সে। পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে রইল সেই নারীর দিকে। চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেল। ধীরে ধীরে লাকপার কাছে এগিয়ে এল সেই নারী। বিরক্তিতে কুঞ্চিত হয়ে রয়েছে তার ভ্রূগুলি। অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একটি হাত তুলে একটি আঙুল দিয়ে সে স্পর্শ করল লাকপার দুই ভুরুর মাঝখানে। কাটা কলাগাছের মতো ঝপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লাকপা।

একটা রাতচরা পাখি ডেকে উঠল তীক্ষ্ন স্বরে। সেই ডাক হাহাকারের মতো ছড়িয়ে গেল পাহাড়ের কোণায় কোণায়। ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল শিশুরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *