পরে বলবো
‘ঘুম পাচ্ছে?’ এতোক্ষণ পরে আমি রুণুকে জিজ্ঞেস করলাম। ‘উহু’, রুণু বললো, ‘বেশ মজার লাগছে। ছিল খুদে খুদে জীব, হয়ে গেল মাছ। ছিল মাছ, হয়ে গেল উভচর। ছিল উভচর, হয়ে গেল সরীসৃপ। ছিল সরীসৃপ, হয়ে গেল স্তন্যপায়ী। আবার, ছিল বনমানুষ, হয়ে গেল মানুষ! এর চেয়ে মজা কি আর কিছু হতে পারে?
‘উহ্’। এর চেয়ে ঢের মজার ব্যাপার আছে। আমার গল্প এই তো সবে শুরু হয়েছে।
‘বেশ তো। তাহলে সেই বেশি বেশি। মজার মজার ব্যাপারগুলো বলো।
‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোমার ঘুম পাচ্ছে।’
‘উহু। আমার বেশ মজার লাগছে।’
‘তাহলে বোধ হয় আমারই ঘুম পাচ্ছে।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে এখন আমি একটু গড়িয়ে নেই। পরে আবার গল্পটা চালাবো।’
‘বেশ, তা নাও। কিন্তু পরে ঠিক বলবে তো?’
‘নিশ্চয়ই বলবো।’ আমি বললাম।
.
দুপর বেলা খেয়েদেয়ে একটুখানি গড়িয়ে নেবো ভাবছি, এমন সময় একটি ছোট্ট মেয়ে আমার ঘরে এলো। আর মেয়েটি সোজাসুজি বললে, ‘ভালো চাও তো একটা গল্প বলো, খুড়ো, নইলে দর্জিপাড়া থেকে কাঁচি এনে তোমার গোঁফজোড়া এক্কেবারে সাফ করে দেবো।’
মেয়েটি আমারই ভাইঝি। ওর আসল নাম রুণু, কিন্তু আমি ওকে আদর করে ডাকি চিঙকি প্ৰসাদ বলে। নইলে আমার নামের সঙ্গে ওর নামের যে মিল থাকে না! আর এই নামটার জন্যে মেয়েটি আমাকে দারুণ ভালোবাসে। কেননা, ওর মতে রুণু নামটা বড় খটোমটো, করাত দিয়ে কাঠ কাঠবার মতো। চিঙকিপ্ৰসাদ নামটি বেশ মোলায়েম, সাবানের ফেনার মতো।
আমাকে এতো ভালোবাসে বলেই দুপুর বেলায় গল্প শোনবার জন্যে আমার ঘরে হাজির হয়। আর পাছে আমি গল্প বলতে রাজি না হই এই ভয়ে আমাকে নানান রকম ভয় দেখায়।
আমি অবশ্য জানি দর্জিপাড়ায় সত্যিই গোঁফ কাটবার কাচি পাওয়া যায় না। তবু ওকে খুশি করবার জন্যে গল্প বলা শুরু করলাম। তাহলে? পৃথিবীটা এলো কোথা থেকে? কোথা থেকে এলো মানুষ? সেই কথা দিয়েই গল্পটা শুরু করতে গেলাম। সেই কথাটুকু শেষ করতে করতেই একটা বই শেষ হয়ে গেল। ফ্যাসাদে পড়া গেল। কিন্তু যাৱ ফরমাসে এই গল্প শুরু করেছিলাম, সে বললো, ফ্যাসাদ আবার কোথায়? ওই বইটার মলাটে লিখে দাও প্রথম খণ্ড আর তারপর শুরু করে দাও মানুষের আদিত গল্পটা।’ আমিও দেখলাম, সেই ভালো। মানুষের আদত গল্পটাই শুরু করছি।
কিন্তু গোড়ার কথাটা ভুললে চলবে না। হাতের গুণেই মানুষ হয়েছে মানুষ। আর কোনো জানোয়ারের হাত নেই। আর হাত নেই বলেই হাতিয়ার বানাতে পারে না, পারে না হাতের মুঠোয় হাতিয়ার ধরতে। আর তাই মেহনত করতে জানে না, জানে না পৃথিবীকে জয় করতে। শুধু মানুষই জানে পৃথিবীকে জয় করতে। তার এই দিগ্বিজয়ের শেষ নেই। শেষ নেই তাই মানুষের গল্পের।