রাজপুত্রের বয়স কুড়ি পার হয়ে যায়, দেশবিদেশ থেকে বিবাহের সম্বন্ধ আসে।
ঘটক বললে, ‘বাহ্লীকরাজের মেয়ে রূপসী বটে, যেন সাদা গোলাপের পুষ্পবৃষ্টি।’
রাজপুত্র মুখ ফিরিয়ে থাকে, জবাব করে না।
দূত এসে বললে, ‘গান্ধাররাজের মেয়ের অঙ্গে অঙ্গে লাবণ্য ফেটে পড়ছে, যেন দ্রাক্ষালতায় আঙুরের গুচ্ছ।’
রাজপুত্র শিকারের ছলে বনে চলে যায়। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, ফিরে আসে না।
দূত এসে বললে, ‘কাম্বোজের রাজকন্যাকে দেখে এলেম; ভোরবেলাকার দিগন্ত-রেখাটির মতো বাঁকা চোখের পল্লব, শিশিরে স্নিগ্ধ, আলোতে উজ্জ্বল।’
রাজপুত্র ভর্তৃহরির কাব্য পড়তে লাগল, পুঁথি থেকে চোখ তুলল না।
রাজা বললে, ‘এর কারণ? ডাকো দেখি মন্ত্রীর পুত্রকে।’
মন্ত্রীর পুত্র এল। রাজা বললে, ‘তুমি তো আমার ছেলের মিতা, সত্য করে বলো, বিবাহে তার মন নেই কেন।’
মন্ত্রীর পুত্র বললে, ‘মহারাজ, যখন থেকে তোমার ছেলে পরীস্থানের কাহিনী শুনেছে সেই অবধি তার কামনা, সে পরী বিয়ে করব।’
২
রাজার হুকুম হল, পরীস্থান কোথায় খবর চাই।
বড়ো বড়ো পণ্ডিত ডাকা হল, যেখানে যত পুঁথি আছে তারা সব খুলে দেখলে। মাথা নেড়ে বললে, পুঁথির কোনো পাতায় পরীস্থানের কোনো ইশারা মেলে না।
তখন রাজসভায় সওদাগরদের ডাক পড়ল। তারা বললে, ‘সমুদ্র পার হয়ে কত দ্বীপেই ঘুরলেম—এলাদ্বীপে, মরীচদ্বীপে, লবঙ্গলতার দেশে। আমরা গিয়েছি মলয়দ্বীপে চন্দন আনতে, মৃগনাভির সন্ধানে গিয়েছি কৈলাসে দেবদারুবনে। কোথাও পরীস্থানের কোনো ঠিকানা পাই নি।’
রাজা বললে, ‘ডাকো মন্ত্রীর পুত্রকে।’
মন্ত্রীর পুত্র এল। রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘পরীস্থানের কাহিনী রাজপুত্র কার কাছে শুনেছে।’
মন্ত্রীর পুত্র বললে, ‘সেই যে আছে নবীন পাগলা, বাঁশি হাতে বনে বনে ঘুরে বেড়ায়, শিকার করতে গিয়ে রাজপুত্র তারই কাছে পরীস্থানের গল্প শোনে।’
রাজা বললে, ‘আচ্ছা, ডাকো তাকে।’
নবীন পাগলা এক মুঠো বনের ফুল ভেট দিয়ে রাজার সামনে দাঁড়াল। রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘পরীস্থানের খবর তুমি কোথায় পেলে।’
সে বললে, ‘সেখানে তো আমার সদাই যাওয়া-আসা।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলে, ‘কোথায় সে জায়গা।’
পাগলা বললে, ‘তোমার রাজ্যের সীমানায় চিত্রগিরি পাহাড়ের তলে, কাম্যক-সরোবরের ধারে।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলে, ‘সেইখানে পরী দেখা যায়?’
পাগলা বললে, ‘দেখা যায়, কিন্তু চেনা যায় না। তারা ছদ্মবেশে থাকে। কখনো কখনো যখন চলে যায় পরিচয় দিয়ে যায়, আর ধরবার পথ থাকে না।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুমি তাদের চেন কী উপায়ে।’
পাগলা বললে, ‘কখনো বা একটা সুর শুনে, কখনো বা একটা আলো দেখে।’
রাজা বিরক্ত হয়ে বললে, ‘এর আগাগোড়া সমস্তই পাগলামি, একে তাড়িয়ে দাও।’
৩
পাগলার কথা রাজপুত্রের মনে গিয়ে বাজল।
ফাল্গুনমাসে তখন ডালে ডালে শালফুলে ঠেলাঠেলি, আর শিরীষফুলে বনের প্রান্ত শিউরে উঠেছে। রাজপুত্র চিত্রগিরিতে একা চলে গেল।
সবাই জিজ্ঞাসা করলে, ‘কোথায় যাচ্ছ।’
সে কোনো জবাব করলে না।
গুহার ভিতর দিয়ে একটি ঝরনা ঝরে আসে, সেটি গিয়ে মিলেছে কাম্যকসরোবরে; গ্রামের লোক তাকে বলে উদাসঝোরা। সেই ঝরনাতলায় একটি পোড়ো মন্দিরে রাজপুত্র বাসা নিলে।
এক মাস কেটে গেল। গাছে গাছে যে কচিপাতা উঠেছিল তাদের রঙ ঘন হয়ে আসে, আর ঝরাফুলে বনপথ ছেয়ে যায়। এমন সময় একদিন ভোরের স্বপ্নে রাজপুত্রের কানে একটি বাঁশির সুর এল। জেগে উঠেই রাজপুত্র বললে, ‘আজ পাব দেখা।’
৪
তখনি ঘোড়ায় চড়ে ঝরনাধারার তীর বেয়ে চলল, পৌঁছল কাম্যকসরোবরের ধারে। দেখে, সেখানে পাহাড়েদের এক মেয়ে পদ্মবনের ধারে বসে আছে। ঘড়ায় তার জল ভরা, কিন্তু ঘাটের থেকে সে ওঠে না। কালো মেয়ে কানের উপর কালো চুলে একটি শিরীষফুল পরেছে, গোধূলিতে যেন প্রথম তারা।
রাজপুত্র ঘোড়া থেকে নেমে তাকে বললে, ‘তোমার ঐ কানের শিরীষফুলটি আমাকে দেবে?’
যে হরিণী ভয় জানে না এ বুঝি সেই হরিণী। ঘাড় বেঁকিয়ে একবার সে রাজপুত্রের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। তখন তার কালো চোখের উপর একটা কিসের ছায়া আরও ঘন কালো হয়ে নেমে এল— ঘুমের উপর যেন স্বপ্ন, দিগন্তে যেন প্রথম শ্রাবণের সঞ্চার।
মেয়েটি কান থেকে ফুল খসিয়ে রাজপুত্রের হাতে দিয়ে বললে, ‘এই নাও।’
রাজপুত্র তাকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুমি কোন্ পরী আমাকে সত্য করে বলো।’
শুনে একবার মুখে দেখা দিল বিস্ময়, তার পরেই আশ্বিনমেঘের আচমকা বৃষ্টির মতো তার হাসির উপর হাসি, সে আর থামতে চায় না।
রাজপুত্র মনে ভাবল, ‘স্বপ্ন বুঝি ফলল—এই হাসির সুর যেন সেই বাঁশির সুরের সঙ্গে মেলে।’
রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে দুই হাত বাড়িয়ে দিলে; বললে, ‘এসো।’
সে তার হাত ধরে ঘোড়ায় উঠে পড়ল, একটুও ভাবল না। তার জলভরা ঘড়া ঘাটে রইল পড়ে।
শিরীষের ডাল থেকে কোকিল ডেকে উঠল, কুহু কুহু কুহু কুহু।
রাজপুত্র মেয়েটিকে কানে কানে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তোমার নাম কী।’
সে বললে, ‘আমার নাম কাজরী।’
উদাসঝোরার ধারে দুজনে গেল সেই পোড়ো মন্দিরে। রাজপুত্র বললে, ‘এবার তোমার ছদ্মবেশ ফেলে দাও।’
সে বললে, ‘আমরা বনের মেয়ে, আমরা তো ছদ্মবেশ জানি নে।’
রাজপুত্র বললে, ‘আমি যে তোমার পরীর মূর্তি দেখতে চাই।’
পরীর মূর্তি! আবার সেই হাসি, হাসির উপর হাসি। রাজপুত্র ভাবলে, ‘এর হাসির সুর এই ঝরনার সুরের সঙ্গে মেলে, এ আমার এই ঝরনার পরী।’
৫
রাজার কানে খবর গেল, রাজপুত্রের সঙ্গে পরীর বিয়ে হয়েছে। রাজবাড়ি থেকে ঘোড়া এল, হাতি এল, চতুর্দোলা এল।
কাজরী জিজ্ঞাসা করলে, ‘এসব কেন!’
রাজপুত্র বললে, ‘তোমাকে রাজবাড়িতে যেতে হবে।’
তখন তার চোখ ছল্ছলিয়ে এল। মনে পড়ে গেল, তার ঘড়া পড়ে আছে সেই জলের ধারে; মনে পড়ে গেল, তার ঘরের আঙিনায় শুকোবার জন্যে ঘাসের বীজ মেলে দিয়ে এসেছে; মনে পড়ল, তার বাপ আর ভাই শিকারে চলে গিয়েছিল, তাদের ফেরবার সময় হয়েছে; আর মনে পড়ল, তার বিয়েতে একদিন যৌতুক দেবে ব’লে তার মা গাছতলায় তাঁত পেতে কাপড় বুনছে, আর গুন্গুন্ করে গান গাইছে।
সে বললে, ‘না, আমি যাব না।’
কিন্তু ঢাক ঢোল বেজে উঠল; বাজল বাঁশি, কাঁসি, দামামা—ওর কথা শোনা গেল না।
চতুর্দোলা থেকে কাজরী যখন রাজবাড়িতে নামল, রাজমহিষী কপাল চাপড়ে বললে, ‘এ কেমনতরো পরী।’
রাজার মেয়ে বললে, ‘ছি, ছি, কী লজ্জা।’
মহিষীর দাসী বললে, ‘পরীর বেশটাই বা কী রকম।’
রাজপুত্র বললে, ‘চুপ করো, তোমাদের ঘরে পরী ছদ্মবেশে এসেছে।’
৬
দিনের পর দিন যায়। রাজপুত্র জ্যোৎস্নারাত্রে বিছানায় জেগে উঠে চেয়ে দেখে, কাজরীর ছদ্মবেশ একটু কোথাও খসে পড়েছে কিনা। দেখে যে, কালো মেয়ের কালো চুল এলিয়ে গেছে, আর তার দেহখানি যেন কালো পাথরে নিখুঁত করে খোদা একটি প্রতিমা। রাজপুত্র চুপ করে বসে ভাবে, ‘পরী কোথায় লুকিয়ে রইল, শেষরাতে অন্ধকারের আড়ালে উষার মতো।’
রাজপুত্র ঘরের লোকের কাছে লজ্জা পেলে। একদিন মনে একটু রাগও হল। কাজরী সকালবেলায় বিছানা ছেড়ে যখন উঠতে যায় রাজপুত্র শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে বললে, ‘আজ তোমাকে ছাড়ব না—নিজরূপ প্রকাশ করো, আমি দেখি।’
এমনি কথাই শুনে বনে যে হাসি হেসেছিল সে হাসি আর বেরোল না। দেখতে দেখতে দুই চোখ জলে ভরে এল।
রাজপুত্র বললে, ‘তুমি কি আমায় চিরদিন ফাঁকি দেবে।’
সে বললে, ‘না, আর নয়।’
রাজপুত্র বললে, ‘তবে এইবার কার্তিকী পূর্ণিমায় পরীকে যেন সবাই দেখে।’
৭
পূর্ণিমার চাঁদ এখন মাঝগগনে। রাজবাড়ির নহবতে মাঝরাতের সুরে ঝিমি ঝিমি তান লাগে।
রাজপুত্র বরসজ্জা প’রে হাতে বরণমালা নিয়ে মহলে ঢুকল; পরীবৌয়ের সঙ্গে আজ হবে তার শুভদৃষ্টি।
শয়নঘরে বিছানায় সাদা আস্তরণ, তার উপরসাদা কুন্দফুল রাশ-করা; আর উপরে জানলা বেয়ে জ্যোৎস্না পড়েছে।
আর, কাজরী?
সে কোথাও নেই।
তিন প্রহরের বাঁশি বাজল। চাঁদ পশ্চিমে হেলেছে। একে একে কুটুম্বে ঘর ভরে গেল।
পরী কই?
রাজপুত্র বললে, ‘চলে গিয়ে পরী আপন পরিচয় দিয়ে যায়, আর তখন তাকে পাওয়া যায় না।’
বৈশাখ ১৩২৯