পরীক্ষা
বিনায়ক বসুর ড্রয়িং-রুম।
রাত্রিকালে বিদ্যুৎবাতির আলোয় ঘরটি অতি সুন্দর দেখাইতেছে। ফিকা সবুজ রংয়ের দেয়াল; নূতন আধুনিক গঠনের আসবাব। তিনটি আলোর বাল্ব ঘরে বিভিন্ন স্থানে থাকিয়া ঘরটি প্রায় ছায়াহীন করিয়া তুলিয়াছে।
ঘরের দুইপাশে দুইটি দ্বার, একটি ভিতরে এবং অন্যটি বাহিরে যাইবার পথ। ঘরের তৃতীয় দেয়ালের মাঝখানে ইংলন্ডেশ্বর ষষ্ঠ জর্জের সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো একটি প্রতিকৃতি শোভা পাইতেছে।
বিনায়ক বসু ডিনার শেষ করিয়া ড্রয়িং-রুমে আসিয়া বসিয়াছে এবং একটি কৌচে প্রায় চিৎ হইয়া শুইয়া একখানি ইংরেজী উপন্যাস পড়িতেছে। তাহার পরিধানে ঢিলা পায়জামা ও পাঞ্জাবির উপর একটি সিল্কের ড্রেসিং গাউন।
বিনায়কের বয়স ত্রিশের নীচেই, সে এখনও অবিবাহিত। তাহাকে সুপুরুষ বলা চলে। গৌরবর্ণ দীর্ঘ দেহ, মাথায় ছোট করিয়া ছাঁটা কোঁকড়া চুল; মুখের লালিত্যের সঙ্গে এমন একটা পরিমার্জিত হঠকারিতার ভাব মিশ্রিত আছে যে, তাহাকে চালিয়াৎ বলিয়া মনে হয় এবং তাহার নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধেও খাট্কা লাগে। উপরন্তু সে তরুণীদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে মিশিতে পারে; তরুণীরাও কেন জানি না, তাহার প্রতি একটু বেশি মাত্রায় আকৃষ্ট হন। এইসব কারণে শহরে তাহার কিছু বদনাম রটিয়াছে।
বিনায়ক সরকারী ইঞ্জিনীয়ার; মাস দুই পূর্বে সে পশ্চিমবঙ্গের এই সমৃদ্ধ শহরে বদলি হইয়া আসিয়াছে এবং স্থানীয় অভিজাত সমাজের তরুণীমহলে বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছে।
নিবিষ্ট মনে বই পড়িতে পড়িতে বিনায়ক অন্যমনস্কভাবে চোখ তুলিতেছিল এবং ঈষৎ ভ্রূকুটি করিয়া শূন্যে তাকাইতেছিল, যেন তাহার মনের মধ্যে অন্য কোনও চিন্তা ঘোরাঘুরি করিতেছে। একবার সে বই রাখিয়া উঠিল; ঘরের কোণে একটি ক্ষুদ্র আলমারি ছিল, তাহার ভিতর হইতে বোতল ও পেগ বাহির করিয়া পেগ পূর্ণ করিয়া লইয়া আবার আসিয়া বসিল। বই পড়িতে পড়িতে মাঝে মাঝে পেগে চুমুক দিতে লাগিল।
বাহিরের দিকের দরজা দিয়া একটি উর্দিপরা ফিটফাট খানসামা প্রবেশ করিল; তাহার হাতে জার্মান সিল্ভারের রেকাবের উপর একখানি চিঠি। খানসামা নিঃশব্দে প্রভুর সম্মুখে রেকাব ধরিল। বিনায়ক চিঠি তুলিয়া লইয়া ছিঁড়িয়া পড়িল। তাহার ভ্রূ একটু উঠিল। সে একবার ঘড়ির দিকে তাকাইল; পাশের টেবিলে বুদ্বুদের ন্যায় কাচে ঢাকা সুন্দর একটি টাইমপীস্, তাহাতে দশটা বাজিয়া পঁচিশ মিনিট হইয়াছে। বিনায়ক চিঠিখানি ড্রেসিং গাউনের পকেটে রাখিল, পেগ তুলিয়া লইয়া খানসামার দিকে না তাকাইয়াই বলিল, ‘তুমি এখন যেতে পারো, তোমাকে আর দরকার হবে না।— হ্যাঁ, সদর দরজা বন্ধ করবার দরকার নেই।’
খানসামা ‘জী’ বলিয়া প্রস্থান করিল।
বিনায়ক পেগে একটি ক্ষুদ্র চুমুক দিয়া রাখিয়া দিল; একটি জয়পুরী কৌটার মধ্য হইতে সিগারেট লইয়া ধরাইয়া ঘরময় পায়চারি করিতে লাগিল। তারপর ঘরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া পকেট হইতে চিঠি বাহির করিয়া অনুচ্চকণ্ঠে পড়িল—
“বিনায়কবাবু, আপনার সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে— আজ রাত্রি সাড়ে দশটার সময় আমি আসব— সে সময় যেন কেউ না থাকে—
ইতি— মণিকা নন্দী।”
বিনায়কের মুখ দেখিয়া তাহার মনের ভাব কিছুই বোঝা গেল না। সে চিঠি মুড়িয়া পকেটে রাখিল, তারপর সিগারেটে একটা টান দিয়া সেটা অ্যাশ্-ট্রেতে ফেলিয়া পেগ তুলিয়া লইল।
পেগ ঠোঁটের কাছে তুলিয়াছে এমন সময় বহির্দ্বারের ওপার হইতে স্ত্রীকণ্ঠের আওয়াজ আসিল, ‘বিনায়কবাবু, আসতে পারি?’
বিনায়ক ক্ষণেক দ্বারের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর পেগ নামাইয়া রাখিয়া হাস্যমুখে অগ্রসর হইয়া গেল।
বিনায়ক: এসো মণিকা।
মণিকা ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার আবির্ভাবে ঘরটা যেন ঝলমল করিয়া উঠিল। মণিকা শুধু সুন্দরী নয়, তাহার মুখে চোখে বুদ্ধি ও চিত্তবলের এমন একটি প্রভা আছে যে তাহা তাহার দৈহিক সৌন্দর্যকে আরও ভাস্বর করিয়া তুলিয়াছে। মণিকার বয়স কুড়ি বছর, তাহার কবরীতে যূথীফুলের মালা, পরিধানে চাঁপা রঙের একটি সূক্ষ্ম বেনারসী শাড়ি, কর্ণে কণ্ঠে মণিবন্ধে মুক্তার লঘু অলঙ্কার, উচ্ছল যৌবনের ছটা বিচ্ছুরিত করিয়া সে যখন বিনায়কের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল তখন মনে হইল, সেকালে রাজকন্যারা বুঝি এমনি ভাবেই চোখ ধাঁধাইয়া স্বয়ংবর-সভায় আবির্ভূতা হইতেন।
মণিকার অধরে একটু হাসি লাগিয়া আছে; বিরাগ ও অনুরাগ অবিশ্লেষ্যভাবে মিশিয়া গেলে বোধ করি মেয়েদের মুখে এইরূপ হাসি দেখা দেয়। মণিকা বলিল, ‘আমার চিঠি পেয়েছিলেন?’
বিনায়ক পকেট হইতে চিঠি বাহির করিয়া ধরিল, মণিকাকে দেখিয়া তাহার বুক যে গুরুগুরু করিতেছে তাহা তাহার মুখ দেখিয়া বোঝা গেল না।
বিনায়ক: সেকালের পণ্ডিতগুলো ঠিক ধরেছিল। স্ত্রীজাতির চরিত্র আর পুরুষের ভাগ্য— কখন কী ঘটবে বলা যায় না। আমার ভাগ্য যে হঠাৎ এত প্রসন্ন হয়ে উঠেছে তা দশটা বেজে পঁচিশ মিনিটের আগে জানতে পারিনি। তাই সামাজিক ভদ্রবেশ পরবার সময় পেলুম না।
মণিকা এই ত্রুটি-স্বীকারের কোনও উত্তর না দিয়া চিঠিখানি লইয়া নিজের ব্লাউজের মধ্যে রাখিল।
মণিকা: এটার আর বোধ হয় আপনার দরকার নেই?
বিনায়ক মুখ টিপিয়া হাসিল।
বিনায়ক: না। তা ছাড়া তোমার চিঠি আমার কাছে না থাকাই ভাল। সাবধানের মার নেই। কিন্তু যাক্, তোমার সংবর্ধনা করা হয়নি। এসো— বোসো—
মণিকাকে সোফায় বসাইয়া সিগারেটের জয়পুরী বাক্সটা তাহার সম্মুখে খুলিয়া ধরিয়া বিনায়ক বলিল, ‘নাও।’
মণিকা একবার বাক্সের দিকে তাকাইল, একবার বিনায়কের মুখের পানে তাকাইল; তারপর শান্তকণ্ঠে বলিল, ‘আমি সিগারেট খাই না। আপনার পরিচিতা মহিলারা কি সকলেই সিগারেট খান?’
বিনায়ক: সকলেই নয়। তবে কয়েকজন আছেন যাঁরা এক টানে একটা আস্ত সিগারেট পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারেন। কিন্তু তুমি যখন ধূমপান করো না তখন অন্য কোনও পানীয়ের ব্যবস্থা করি! চা—? কফি—? সরবৎ—?
মণিকা পেগের দিকে কটাক্ষপাত করিল।।
মণিকা: আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না, বরং আপনি যা খাচ্ছিলেন সেটা শেষ করে ফেলুন।
বিনায়ক: আমি—? ওঃ!
অর্ধপূর্ণ পেগ হাতে তুলিয়া লইয়া বিনায়ক হাসিল।
বিনায়ক: তুমি যা ভাবছ তা নয়, আমি মাতাল নই। মাঝে মাঝে ডিনারের পর একটু পোর্ট খাই, শরীর ভাল থাকে। তুমিও ইচ্ছে করলে খেতে পারো। মেয়েদের পোর্ট খেতে বাধা নেই।
মণিকা: ধন্যবাদ। পোর্ট আর ব্রান্ডি-হুইস্কির মধ্যে কি তফাৎ তা বোঝবার অভিজ্ঞতা আমার নেই। সুতরাং ওটা থাক্।
বিনায়ক পেগ নিঃশেষ করিয়া রাখিয়া দিল।
বিনায়ক: বেশ, তোমার যেমন ইচ্ছে। আমার অতিথি-সৎকারের ত্রুটি হচ্ছে বুঝতে পারছি, কিন্তু উপায় কি?
সে কৌচের অন্য প্রান্তে বসিল। মণিকা ঘরের চারিদিকে একবার সপ্রশংস দৃষ্টি বুলাইল; রাজার ছবির উপর দৃষ্টি পড়ায় তাহার ভ্রূ ঈষৎ কুঞ্চিত হইল।
মণিকা: আপনি খুব সৌখীন লোক দেখছি। কিন্তু রাজার ছবি কেন? ওতে আপনার ড্রয়িং-রুমের শোভা আরও বেড়েছে বলে মনে হয়?
বিনায়ক: না। ওটা ভেক।
মণিকা: ভেক?
বিনায়ক: হ্যাঁ। ইংরেজের চাকরি করতে হলে ওটা দরকার হয়।
মণিকা: (ঈষৎ তীক্ষ্ণকণ্ঠে) আমার বাবাও ইংরেজের চাকরি করেন, এ জেলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তিনি। কিন্তু তিনি তো ঘরে রাজার ছবি টাঙান্নি।
বিনায়ক: তবে কার ছবি টাঙিয়েছেন?
মণিকা: কারুর নয়। বাবার ঘরে কোনও ছবিই নেই।
বিনায়ক: আমার ঘরে কিন্তু অন্য ছবি আছে।
মণিকা: (চারিদিকে চাহিয়া) কই— কোথায়? দেখছি না তো!
বিনায়ক: এসো আমার সঙ্গে— দেখাচ্ছি।
সে উঠিয়া রাজার ছবির দিকে গেল, মণিকাও তাহার অনুবর্তিনী হইল। বিনায়ক ছবির ফ্রেমের উপর একটা বোতাম টিপিতেই রাজার ছবি উল্টাইয়া গিয়া তাহার স্থানে মহাত্মা গান্ধীর ছবি দেখা দিল। মণিকা কিছুক্ষণ বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া তাকাইয়া রহিল, তারপর একটু অপ্রতিভভাবে হাসিল।
মণিকা: ভুলে গিয়েছিলুম আপনি ইঞ্জিনীয়ার। বেশ কল বানিয়েছেন—
সে ফিরিয়া গিয়া কৌচে বসিল।
মণিকা: কিন্তু এতে একটা কথা প্রমাণ হল।।
বিনায়ক: কী প্রমাণ হল?
মণিকা: প্রমাণ হল যে আপনার ভেতরে এক বাইরে আর। আপনি সাদা লোক নন।
বিনায়ক: (হাসিয়া) এতে আশ্চর্য হবার কি আছে। পৃথিবীতে সাদা লোক ক’টা পাওয়া যায়? তুমি আজ যে ভাবে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ তার মধ্যেও তো লুকোচুরি রয়েছে।
মণিকার মুখ একটু লাল হইল, সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিনায়কের মুখের পানে চাহিল।
মণিকা: লুকোচুরি কিছু নেই। আমি আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এসেছি।
বিনায়ক: বেশ তো। কিন্তু সেজন্য এই রাত্রে একলা আসার দরকার ছিল কি? অন্তত তোমার ছোট ভাই শম্ভু সঙ্গে এলে কোনও দোষ হত না।
মণিকা যেন একটু অস্বস্তি অনুভব করিল, একবার চকিত চক্ষে বাহিরের দ্বারের পানে তাকাইল, তারপর একটু তাড়াতাড়ি বলিল, ‘একলা আসার দরকার ছিল। আমার কথা গোপনীয়। এ বাড়িতে আর কেউ নেই তো?’
বিনায়ক: কেউ না। স্রেফ তুমি আর আমি।
বিনায়ক আড়চোখে মণিকার পানে তাকাইল। মণিকার মুখে ক্ষণেকের জন্য শঙ্কার ছায়া পড়িল, তারপরই সে সোজা হইয়া বসিল, তাহার চক্ষু প্রচ্ছন্ন উত্তেজনায় প্রখর হইয়া উঠিল। বিনায়ক তাহা লক্ষ্য না করিয়া বাক্স হইতে সিগারেট লইতে লইতে প্রশ্ন করিল, ‘আপত্তি নেই? খেতে পারি?’
মণিকা: স্বচ্ছন্দে।
সিগারেট ধরাইয়া বিনায়ক কৌচের পাশে বসিল, কয়েকটা ধোঁয়ার আংটি ছাড়িয়া বলিল, ‘এবার তোমার গোপনীয় প্রশ্ন আরম্ভ হোক।’
মণিকা বিনায়কের পানে তাকাইল না, দেয়ালে মহাত্মার ছবির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া ধীরে ধীরে বলিল, ‘আজ সকালে আপনি বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?’
বিনায়ক: হ্যাঁ।
মণিকা: আমার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন?
বিনায়ক: করেছিলুম।
চকিতে বিনায়কের দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টি ফিরাইয়া মণিকা বলিল, ‘বিয়ের প্রস্তাব করবার কী যোগ্যতা আছে আপনার?’
সিগারেটের ছাই সন্তর্পণে অ্যাশ্-ট্রেতে ঝাড়িয়া বিনায়ক নীরসকণ্ঠে বলিল, ‘যোগ্যতার পরিচয় তো আজ সকালে তোমার বাবার কাছে দিয়েছি। আমি সরকারী ইঞ্জিনীয়ার, বর্তমানে চারশ’ টাকা মাইনে পাই; ভবিষ্যতে মাইনে আরও বাড়বে। আমার স্বাস্থ্যও বেশ ভাল— ’
মণিকা: (অধীরভাবে) আমি ও যোগ্যতার কথা বলছি না। বিয়ে করবার নৈতিক যোগ্যতা আপনার আছে কি?
বিনায়ক: কথাটা একটু পরিষ্কার করে না বললে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে।
মণিকা: বিনায়কবাবু, যে কুমারী আপনাকে বিয়ে করবে, সে আপনার কাছে নৈতিক পবিত্রতা আশা করতে পারে, একথা আপনি স্বীকার করেন?
বিনায়ক: নিশ্চয় স্বীকার করি। শুধু তাই নয়, আমি বিশ্বাস করি, যে-পুরুষের নৈতিক পবিত্রতা নেই তার বিয়ে করা উচিত নয়।
মণিকা কিছুক্ষণ স্থিরনেত্রে বিনায়কের পানে চাহিয়া রহিল।
মণিকা: তাহলে আপনি বিয়ে করতে চান কোন্ সাহসে?
বিনায়ক: (গম্ভীরভাবে) আমার সে দাবি আছে।
মণিকা অবিশ্বাসের তীক্ষ্ণ হাসি হাসিয়া উঠিল।
মণিকা: বিনায়কবাবু, আপনি নিজেকে যতটা সাধু বলে প্রমাণ করতে চান, সত্যি আপনি ততটা সাধু নন। আজ আমি নিজের চোখে আপনাকে মদ খেতে দেখেছি। তা ছাড়া শহরে আপনার অন্য বদনামও আছে—
বিনায়ক: অসম্ভব নয়, বদনাম কার না হয়? কিন্তু মদের কথা যে বললে, আগেই বলেছি আমি মাতাল নই, নিয়মিত মদ খাই না—
মণিকা: প্রমাণ করতে পারেন?
বিনায়ক: (হাসিয়া) একথা প্রমাণ করা যায় না। মহাত্মা গান্ধীও প্রমাণ করতে পারেন না যে তিনি লুকিয়ে মদ খান না; ওটা তাঁর চরিত্র থেকে অনুমান করে নিতে হয়। তোমার কথাই ধরো। আজ তুমি একলা লুকিয়ে আমার বাড়িতে এসেছ। লোকে যদি মনে করে তুমি রোজ রাত্রে আমার বাড়িতে আসো, সেকথা কি সত্য হবে?
মণিকা: আচ্ছা, ও কথা ছেড়ে দিলুম। কিন্তু আপনি যে স্ত্রীজাতির সঙ্গ খুবই ভালবাসেন একথা অস্বীকার করতে পারেন?
বিনায়ক হাসিয়া উঠিল, দগ্ধাবশেষ সিগারেট অ্যাশ্-ট্রের উপর ঘষিয়া নিভাইয়া বলিল, ‘কি মুশকিল, অস্বীকার করতে যাব কোন্ দুঃখে? স্ত্রীজাতির সঙ্গ যদি ভালই না বাসব, তাহলে তোমাকে বিয়ে করতে চাই কেন?’
মণিকার দৃষ্টি ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল।
মণিকা: হেসে ওড়াবার চেষ্টা করবেন না। দু’মাস হল আপনি এ শহরে এসেছেন, এরি মধ্যে আপনার সব কীর্তি প্রকাশ হয়ে পড়েছে।— অমিতা সেনের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক তা সবাই জানে।
বিনায়কের মুখ সহসা কঠিন হইয়া উঠিল।
বিনায়ক: না, কেউ জানে না। অমিতার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক— তা শুধু আমি জানি আর অমিতা জানে।
মণিকা: সত্যি? খুব গোপনীয় সম্পর্ক বুঝি? আমরা জানতে পারি না?
বিনায়ক: অমিতা আমার ভাবী ভাদ্রবধূ। তোমরা জানো না, আমার ছোট ভাই বিলেত গেছে। অমিতা তাকে ভালবাসে।
মণিকা থতমত খাইয়া গেল।
মণিকা: ও, তা তাই যদি হয়, তাহলে এত লুকোচুরির কি দরকার?
বিনায়ক: লুকোচুরির কারণ অমিতার বাবা এ বিয়ের বিরুদ্ধে, তিনি জাতের বাইরে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না।
মণিকার দৃষ্টি নত হইল, কিন্তু তখনি আবার সে চোখ তুলিল।
মণিকা: আচ্ছা, সে যেন হল। মেয়ে-স্কুলের টিচার মিসেস রমা গাঙ্গুলীর সঙ্গে আপনার সম্বন্ধটা কি রকম?
বিনায়ক: তিনি আমার বান্ধবী।
মণিকা: (মুখ টিপিয়া) বান্ধবী। ও কথাটার অনেক রকম মানে হয়।
বিনায়ক ক্ষণেক গম্ভীর হইয়া রহিল, তারপর ঈষৎ ভর্ৎসনার স্বরে বলিল, ‘মণিকা, আমার সম্বন্ধে তুমি যা ইচ্ছে ভাবতে পারো, কিন্তু একটি শুদ্ধচরিত্রা নিষ্ঠাবতী বিধবা মহিলা সম্বন্ধে ও রকম ইঙ্গিত করলে অপরাধ হয়।’
মণিকার মুখে লজ্জার রক্তিমাভা ফুটিয়া উঠিল; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাহার মেরুদণ্ডও শক্ত হইয়া উঠিল। ক্ষণেক নীরব থাকিয়া সে ঈষৎ তিক্তস্বরে বলিল, ‘আর হাসপাতালের লেডি ডাক্তার মিস মল্লিকা? তিনিও কি শুদ্ধচরিত্রা নিষ্ঠাবতী মহিলা? তাঁর সঙ্গেও তো আপনার খুব ঘনিষ্ঠতা।’
বিনায়কের ঠোঁটের কোণে একটু হাসি খেলিয়া গেল।
বিনায়ক: শ্ৰীমতী মল্লিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক একটু অন্য ধরনের। শিকারের সঙ্গে শিকারীর যে ঘনিষ্ঠতা, তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতাও সেই রকম। ভুল বুঝো না; তিনি শিকারী— আর আমি শিকার। ভাগ্যক্রমে এখনও অক্ষত শরীরে আছি।
মণিকা হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল; বিনায়কও সঙ্গে সঙ্গে উঠিল। মণিকা অস্থিরভাবে ঘরের এটা-ওটা নাড়িয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, যেন কিছুতেই তাহার মনের অসন্তোষ দূর হইতেছে না।
বিনায়ক: কি হল! আর কোনও প্রশ্ন খুঁজে পাচ্ছ না?
মণিকা: ক’টা বেজেছে? আমি এবার বাড়ি যাব।
ঘড়ি দেখিবার জন্য বিনায়ক পিছন ফিরিতেই মণিকা এক অদ্ভুত কাজ করিল, মদের শূন্য পেগটা তাহার হাতের কাছেই ছিল, ক্ষিপ্র হস্তসঞ্চালনে তাহা মেঝেয় ফেলিয়া দিল। ঝন্ঝন্ করিয়া কাচ ভাঙার শব্দ হইল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎবাতি নিভিয়া ঘর অন্ধকার হইয়া গেল। অন্ধকারের ভিতর হইতে মণিকার উচ্চকিত কণ্ঠস্বর আসিল, ‘ঐ যাঃ! এ কী হল! আলো নিভে গেল! বিনায়কবাবু?’
বিনায়ক: কোনও ভয় নেই। মাঝে মাঝে এমন হয়— পাওয়ার হাউসে কোনও গোলমাল হয়ে থাকবে। তুমি যেমন আছ তেমনি দাঁড়িয়ে থাকো, নইলে পায়ে কাচ ফুটে যেতে পারে। আমি পাশের ঘর থেকে মোমবাতি নিয়ে আসছি।
মণিকা: না না, আপনি কোথাও যাবেন না, আমার ভয় করবে।
বিনায়কের হাসির শব্দ শোনা গেল।
বিনায়ক: আচ্ছা আমি দেশলাই জ্বালছি।
সে ফস্ করিয়া দেশলাই জ্বালিল। অন্ধকার কিন্তু সম্পূর্ণ দূর হইল না, দু’জনকে আবছায়াভাবে দেখা গেল। মণিকা সেই অস্পষ্ট আলোকে সাবধানে পা ফেলিয়া আবার কৌচে আসিয়া বসিল। দেশলাই-কাঠি নিভিয়া গেল।
মণিকা: আপনার কাচের গ্লাসটা ভেঙে ফেললুম—
বিনায়ক: কি করে ভাঙল?
মণিকা: কি জানি অসাবধানে হাত লেগে গিছল।
বিনায়ক আবার দেশলাই জ্বালিল। দেখা গেল, তাহার মুখে একটু বাঁকা হাসি লাগিয়া আছে।
বিনায়ক: মদের গ্লাস ভাঙার মধ্যে হয়তো নিয়তির কোনও ইঙ্গিত আছে।
মণিকা: তা জানি না। আপনি অত দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? কাছে আসুন, আমার যে ভয় করছে।
বিনায়ক মণিকার কাছে গিয়া বসিল। দেশলাই নিঃশেষ হইয়া নিভিয়া গেল।
মণিকা: আমার হাত ধরুন।
বিনায়ক: হাত ধরলে দেশলাই জ্বালব কি করে?
মণিকা: দেশলাই জ্বালতে হবে না।
কিছুক্ষণ নীরব। বিনায়ক মণিকার হাত ধরিয়া আছে কিনা অন্ধকারে তাহা দেখা গেল না।
বিনায়ক: মণিকা।
মণিকা: কী?
বিনায়ক: ঘর অন্ধকার—
মণিকা: জানি।
বিনায়ক: তুমি আর আমি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই।
মণিকা: হুঁ।
বিনায়ক: আমার মতো অসাধু লোকের সঙ্গে থাকতে তোমার ভয় করছে না?
মণিকা: না।
বিনায়ক: তোমরা অদ্ভুত জাত। সাধে পণ্ডিতেরা বলেছেন—
মণিকা: পণ্ডিতদের কথা শুনতে চাই না।
বিনায়ক: বেশ, চলো তাহলে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
মণিকা: না। আলো জ্বললে বাড়ি যাব।
বিনায়ক: আলো কখন জ্বলে ঠিক নেই। আজ রাত্রে না জ্বলতেও পারে।
মণিকা কথা বলিল না। ক্ষণেক পরে বিদ্যুৎবাতি যেমন হঠাৎ নিভিয়া গিয়াছিল তেমনি হঠাৎ জ্বলিয়া উঠিল। দেখা গেল, দুইজনে পাশাপাশি কৌচের উপর বসিয়া আছে, মণিকার ডান হাত বিনায়কের বাম মুষ্টির মধ্যে আবদ্ধ।
মণিকা বিনায়কের মুখের পানে চাহিয়া মধুর আনন্দোচ্ছল হাসিল, তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া নম্র কুহক-কোমল স্বরে বলিল, ‘এবার আমি বাড়ি যাই!’
বিনায়কও উঠিয়া দাঁড়াইল।
বিনায়ক: তুমি আজ আমাকে অনেক জেরা করেছ। আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবে?
মণিকা: কি প্রশ্ন?
বিনায়ক: আমি ভাগ্যবান কিংবা হতভাগ্য সেটা জানাবে কি?
মণিকা বিনায়কের দিকে পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইল, মুখ টিপিয়া একটু হাসিল।
মণিকা: তুমি ভাগ্যবান কিনা জানি না, কিন্তু আমার ভাগ্য মন্দ নয়।
বিনায়কের মুখ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, সে মণিকার সম্মুখে গিয়া তাহার একটি হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইল।
বিনায়ক: আর তোমার মনে সন্দেহ নেই?
মণিকা: না।
বিনায়ক: (হাসিয়া) অন্ধকারের পরীক্ষায় পাস করেছি তাহলে?
মণিকা: হ্যাঁ। (চমকিয়া) অ্যাঁ, কি বললে? অন্ধকারের পরীক্ষা। তুমি— তুমি বুঝতে পেরেছ?
বিনায়ক: তা পেরেছি—
মণিকা: কী করে বুঝলে?
বিনায়ক: খুব সহজে। তুমি যখন হাত দিয়ে গ্লাসটা ফেলে দিলে তখন আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলুম, ঘড়ির কাচে সবই দেখতে পেলুম। তারপরই আলো নিভে গেল। বুঝতে দেরি হল না যে, গ্লাস ভাঙার শব্দটা সঙ্কেত, তোমার যে সহচরটি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি বারান্দায় মেন্ সুইচ বন্ধ করে দিলেন। সহচরটি বোধ হয় শম্ভু— না?
মণিকা নীরব বিস্ময়ে ঘাড় নাড়িল।
বিনায়ক: এর পরে তোমার এই রাত্তিরে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার প্ল্যানটা পরিষ্কার হয়ে গেল। অন্ধকারে আমি কোনও অসভ্যতা করি কিনা তাই পরীক্ষা করতে চাও। যখন বুঝতে পারলুম তখন পরীক্ষায় পাস করা আর শক্ত হল না।
মণিকার মুখ আবার সংশয়াকুল হইয়া উঠিল।
মণিকা: কিন্তু— কিন্তু— আমার সন্দেহ তো তাহলে গেল না। তুমি যদি জেনে-শুনে—
বিনায়ক হাসিয়া তাহাকে কাছে টানিয়া লইল।
বিনায়ক: একটু সন্দেহ থাকা ভাল। কবি বলেছেন— “ক্ষুদ্র হৃদয়ের প্রেম একান্ত বিশ্বাসে হয়ে আসে জড় মৃতবৎ, তাই তারে মাঝে মাঝে জাগায়ে তুলিতে হয় মিথ্যা অবিশ্বাসে।”* কিন্তু মণিকা, আমি যদি সত্যই অসভ্যতা করতুম? শম্ভু এসে অবশ্য আমাকে উত্তম-মধ্যম দিত। কিন্তু তুমি কী করতে?
মণিকার মুখ কাঁদো-কাঁদো হইয়া উঠিল।
মণিকা: কী আর করতুম, তোমাকেই বিয়ে করতুম। তুমি কি আমার কিছু রেখেছ? আমার নিজের ইচ্ছে বলে কি কিছু আছে?
দু’হাতে মুখ ঢাকিয়া মণিকা কাঁদিবার উপক্রম করিল। স্নেহে আনন্দে বিনায়কের মুখ কোমল হইয়া উঠিল। সে মণিকার চুলের উপর একবার লঘুস্পর্শে হাত বুলাইয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিল— ‘ওহে শম্ভু, ভেতরে এসো।’
আঠারো বছরের হৃষ্টপুষ্ট বলবান যুবক শম্ভু একটি হকি-স্টিক্ হাতে লইয়া প্রবেশ করিল এবং প্রসন্নমুখে দন্ত বিকশিত করিল।
বিনায়ক: শম্ভু, তোমার বোনকে শিগ্গির বাড়ি নিয়ে যাও। আর বেশি দেরি করলে আমার বদনাম রটে যাবে।
২৭ শ্রাবণ ১৩৫৪
* রাজা ও রানী