1 of 2

পরীক্ষা

পরীক্ষা

বউদি! দাদাবাবুর ফোন।

রেখা উত্তেজিত গলায় অরাকে ডাকল।

দিল্লি থেকে?

শোবার ঘর থেকে শুধোল অরা। তার পর বলল, দাঁড়া। দাঁড়া। আসছি। তোর সবতাতেই তাড়া।

অরা এসে ফোন ধরল। বলল, অরা বলছি। কালকে এলে না কেন? খবরও পাঠালে না কোনো!

আর বোলো না। চাড্ডার ইরেসপনসিবিলিটির জন্যে। একটা টেলেক্সও পাঠাতে পারত। আমি কি জানি যে জানায়নি!

অফিস থেকে গাড়িও পাঠিয়েছিল তোমার জন্যে। ড্রাইভার ফিরে এসে আমার ওপর হম্বিতম্বি!

কী করব!

কালকে আসছ তো?

না। কাল তো নয়ই, আরও ক-দিন থাকতে হবে। চেয়ারম্যান এসে গেছেন।

কী যে করো না! মেয়েটার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা আরম্ভ তিন দিন পরে আর মেয়ের বাবা…

তুমি তো জানোই যে আমি অপদার্থ বাবা।

শিমুল, দায়িত্ব তুমি চিরদিনই এমনি করেই এড়িয়ে গেলে। মেয়েকে নিয়ে কিন্তু বড়োই দুশ্চিন্তাতে পড়েছি। কী যে করছে, তা কী বলব!

কী করছে? কুঁচ?

রাত দেড়টাতে শুচ্ছে আর ভোর সাড়ে তিনটেতে চারটেতে উঠে পড়ছে আবার। এমনিই করে আসছে গত একমাস। কলকাতায় থেকেও তো তুমি কত খোঁজ রাখো মেয়ের!

আমি চুপ করেই রইলাম। অপরাধী লাগছিল নিজেকে। একথা সত্যিই যে অনেকই দায়িত্ব-কর্তব্য আমি করি না এই সংসারে।

বললাম, অসুখে পড়ে যাবে যে!

যাবেই তো! পরীক্ষাই দিতে পারবে না।

অরা বলল, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায়।

আমি বললাম, নার্ভাস-ব্রেকডাউন হয়ে যাবে।

যেতে পারে।

দাও তো একটু।

কাকে?

আহা কুঁচকে।

দিচ্ছি। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের রাতেও আসতে পারবে না তুমি?

না। আগের রাতে পারছি না কিছুতেই। তবে বুধবার রাতে ফিরব। প্লেনে।

বাবা! বুধবার। বৃহস্পতিবার, আর শুক্রবার বাংলা পরীক্ষা। ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলে-মেয়েদের ওই দু-দিন তো সবচেয়ে বেশি চিন্তা। নাও কুঁচ-এর সঙ্গে কথা বলো।

তার পর গলা চড়িয়ে বলল, কুঁ-উ-উ-চ। বাবা ফোন করেছেন দিল্লি থেকে।

কুঁচ এসে ফোন ধরল। বলল, কী হল আবার! আমি পড়ছি যে!

পড়ছ তো জানিই। কেমন আছ?

বাবাসুলভ দরদ ফুটিয়ে বললাম আমি।

জানোই তো ভালোই আছি। খারাপ থাকলে কি খবর পেতে না?

মায়ের কথা শুনছ না কেন? মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমুলে অসুখে পড়বে যে!

মা কি আমার হয়ে পরীক্ষা দেবে? এত বড়ো কোর্স! দু-বার অন্তত রিভাইস না করলে পরীক্ষাতে লিখব কী করে? এখানে তো আর সেমিস্টারে সেমিস্টারে পরীক্ষা হয় না। দশ বছরে যা পড়েছি তা তো তিন ঘণ্টায় উগরে দিতে হবে। যেমন পরীক্ষার সিস্টেম তেমনই তো হবে।

তা বলে, তিন ঘণ্টা ঘুমুবে?

ঠিক আছে। ছাড়ছি আমি।

মাকে দাও একটু।

মা। নাও। বলেই, চটি ফটফটিয়ে আমার ‘ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট’ মেয়ে চলে গেল।

বলো। অরা বলল, রিসিভার নিয়ে।

ওকে ফসফোমিনটা রেগুলারলি খাওয়াচ্ছ তো?

কনসার্নড গলায় শুধোলাম আমি।

না। বন্ধ করে দিয়েছি। ভীষণ গরম পড়ে গেছে।

ক্যালিফস সিক্স এক্স? রাতে দু-চামচ করে মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া? পেটটা এই সময় পরিষ্কার রাখা খুবই দরকার।

দিচ্ছি। দিচ্ছি।

অরার স্বরে অনেকদিনের জমা ক্লান্তি ঝরে পড়ল। একটু অসহায়তাও। মায়েরাই তো আসল পরীক্ষার্থী। তবে আমার পরিবারে অরাই একমাত্র পুরুষ। যত দায়দায়িত্ব সবই ওর। আমি একটা অপদার্থ। মেয়েও বললে চলে আমাকে। অনেকই ব্যাপারে। আমি এরকমই।

রাতে কী খাবে বাড়িতে? ফিরে?

না, না। প্লেনেই খেয়ে আসব।

কোথায় উঠেছ? মেরিডিয়েনে?

না। এবারে মৌরিয়া-শেরাটনে উঠেছি। চেয়ারম্যান এসেছেন তো! উনিও এখানে উঠেছেন। তাই আমাকেও।

ওই ক্যারেকটারলেস লোকটার সঙ্গে?

কী করব! চাকরি তো!

বেশি ড্রিঙ্ক ট্রিঙ্ক করছ না তো!

আরে না না। তোমার ওই এক চিন্তা। কুঁচকে বুঝিয়ে বোলো। নার্ভাস-ব্রেকডাউন না হয়ে যায়।

ওরা রক্তমাংসের নয়। ইস্পাত দিয়ে তৈরি। জন্মক্ষণ থেকেই কেরিয়ারিস্ট; রোবোট। কুঁচরা আমাদের চেয়ে অনেকই বেশি শক্ত, সেল্ফ-কনফিডেন্ট!

আচ্ছা ছাড়ছি তা হলে। কোনো প্রয়োজন হলে হোটেলের ফোন নাম্বারটা রেখে দাও। অবশ্য চ্যাটার্জিকে একটা খবর দিলেও হবে।

ঠিক আছে। একটা ক্লান্তির হাই তুলে বলল, অরা।

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে চান করতে গেলাম।

ঠাণ্ডা গরম জলের ধারার নীচে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, দিনকাল কত বদলে গেছে!

এখনকার বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের জন্যে কতই না চিন্তা করেন। আসলে আমরাই হচ্ছি, মানে, যাদের বয়েস পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই, লাস্ট জেনারেশন, যাদের শাঁখের করাতের মতো আগের প্রজন্ম এবং পরের প্রজন্মর মানুষেরা দু-দিক দিয়েই কেটে গেছে এবং যাবে। আমাদের বাবা-মায়েদের প্রতি আমাদের এখনও যতখানি চিন্তাভাবনা, দরদ, কর্তব্যবোধ আছে তার ছিটেফোঁটাও বোধ হয় আমাদের ছেলে-মেয়েদের থাকবে না আমাদের প্রতি। তবু, আমরা ছেলে-মেয়ে, তাদের কেরিয়ার, তাদের ভবিষ্যৎ ছাড়া কিছুমাত্র চিন্তা করতে পারিনি। যদিও ওরা আমাদের হয়তো পুরোপুরিই ভুলে যাবে।

আমি যখন স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিই ঠিক তখনই আমাদের কলিন রোডের ছোট্ট দোতলা বাড়িতে বড়দিদির বিয়ে। আমার জ্যাঠামশায়ের বড়োমেয়ে। জ্যাঠামশাই অল্প বয়েসে মারা গেছিলেন তাই সব দায়িত্ব ছিল বাবার। দূরাগত আত্মীয়স্বজনেরা, আমার ঠাকুমা যাঁদের বলতেন ‘নাওরি-ঝিওরি’, বিয়ের অনেকদিন আগে থেকেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। শোবার জায়গা নেই বাড়িতে, পড়ার জায়গা তো নেই-ই।ছাদের সিঁড়িতে বা কাজের লোকদের উগ্র বিড়ির গন্ধ-ভরা ঘরে বসে পড়েছি। পরীক্ষার দিনও ঠাকুরের কাছ থেকে যা রান্না হয়েছে তাই একটু চেয়ে খেয়ে আট নম্বর বাস ধরে জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে পরীক্ষা দিতে গেছি। বাবা অথবা মায়ের সেই সময় আমার কথা ভাবার সময়টুকু পর্যন্ত ছিল না। তাঁদের প্রজন্ম বিশ্বাস করতেন ‘সার্ভিস বিফোর সেল্ফ’-এ।

ভালো হবার হলে ছেলে-মেয়ে ভালো হবেই। আর না হবার হলে নয়। এমনই এক ধারণা ছিল ওঁদের। তবে আমার পরীক্ষার অল্প কিছুদিন আগে বাবা হঠাৎই বিবেকদংশনে তাড়িত হয়ে আমার জন্যে তিনজন মাস্টারমশাই রেখে দিয়েছিলেন। ইংরিজি, বিজ্ঞান এবং ম্যাথস-এর জন্যে। কিন্তু ততদিনে গোড়াই উইপোকাতে খেয়ে গেছে। ওপরে বারিসিঞ্চন করে লাভ ছিল না কিছু।

আমার মেয়ে কুঁচ প্রথম থেকেই পড়াশুনোতে ভালো। ব্রিলিয়ান্টই বলা চলে। তার ভালো স্কুল এবং তার মায়ের অতন্দ্র মনোযোগে তার খারাপ হওয়ার উপায়ও বোধ হয় ছিল না। কিন্তু সবচেয়ে যা বড়ো কথা, তা হচ্ছে ওর নিজের ভালো হওয়ার তাগিদ এবং ভেতরের জেদ। যা আমার ছিল না। আমাদের স্কুল থেকে শেখার ইচ্ছে যাদের ছিলও তাদেরও শেখার তেমন উপায় ছিল না।

কিন্তু একথাও ঠিক যে আমাদের সময়ে একজন মানুষের জীবনে পড়াশোনাটাই জীবনের একমাত্র বিবেচ্য বস্তু ছিল না। স্বভাব, চরিত্র, অন্যর উপকারে আসার গুণও ছোটো করে দেখা হত না। পড়াশোনায় ভালো হওয়াই জীবনের একমাত্র উৎকর্ষ একথা একমাত্র প্রণিধানযোগ্য সত্য বলে কখনোই বিবেচিত হত না। বাবা-মায়েদের কাছেও নয় আমাদের কাছে তো নয়ই! আমাদের শৈশব ও কৈশোরকে আমরা পুরোপুরিই উপভোগ করেছি। পড়াশোনাতে তেমন ভালো ছিলাম না বলে কোনো খেদ ছিল না আমাদের মনে। ওই সময়ে যেসব ছাত্ররা শুধুমাত্র পড়াশোনাতেই ভালো ছিল তারা পরবর্তী জীবনে অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। পড়াশোনাতে ভালো হওয়া ছাড়া জীবনে ‘কিছু’ হয়ে উঠতে গেলে যেসব গুণের দরকার হয় তা হয়তো তাদের ছিল না। কিন্তু কুঁচদের প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে পড়াশোনাতে বিশেষ ভালো না হতে পারলে পৃথিবীর সব দরজাই তাদের জন্যে বন্ধ। আমাদের সময়ে কেউ ইচ্ছে করলে ভ্যাগাবণ্ডও থাকতে পারত। প্রত্যেক পরিবারই যৌথ পরিবার ছিল। তখনও মুদ্রাস্ফীতি, আত্মসুখ, বহুবিধ ভোগ্যদ্রব্য এবং পেশাদার রাজনীতির দৈত্যরা বোতল ছেড়ে বেরিয়ে এমন ধুন্ধুমার কান্ড বাধায়নি। যৌথ পরিবারের বিমার ছাতার তলাতে কারো পক্ষেই বাঁচা অসম্ভব ছিল না তখন। পাগল, হাবা, বোকা, বেকার কাউকেই তার পরিবার সেদিন ফেলে দিত না। কিন্তু আমার মেয়ে কুঁচেরা যে-প্রজন্মের মানুষ সেই প্রজন্মে বাঁচা ও মরার মধ্যে কোনো ‘বাফার-জোন’ বা মধ্যবর্তী এলাকা নেই। নিরুপদ্রব শান্তিতে যেমন তেমন করে নিজেদের খুশিমতো বাঁচার কোনো উপায়ই নেই ওদের আর। হয় খুব ভালো হও, নয় একেবারেই হারিয়ে যাও। মুছে যাও। কঠিন, জেদি না হয়ে ওদের বাঁচারই উপায় নেই।

আমরা আমাদেরই মতো ছিলাম। কুঁচরা কুঁচেদের মতো। কোন প্রজন্ম অপেক্ষাকৃত ভালো তা বিচার করার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু আমাদের ছেলে-মেয়েদের আমরা প্রগাঢ় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি। ওদের জন্যে প্রায়শই গর্বিত এবং ক্বচিৎ লজ্জিতও বোধ করি। বড়ো ভয় হয় যে, ওরা বড়ো হলে, বিয়ে করলে, আমাদের মতো নিটোল অথচ পার্থক্য-জরজর-দাম্পত্য জীবনের দুঃখ এবং সুখ উভয় থেকেই ওরা বঞ্চিত হবে। ওদের জীবনে হয়তো সুখ থাকবে। অথবা দুঃখ। সুখেদুঃখে মেশানো এমন ইন্টারেস্টিং মিশ্র জীবনে ওরা হয়তো বিশ্বাসই করবে না। শুধুই সুখ অথবা শুধুই দুঃখ যে বড়োই ক্লান্তিকর এবং অসহনীয় এই কথাটাই হয়তো ওরা বিশ্বাস করবে না। এবং করবে না বলেই, বড়ো চিন্তা হয় ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

ভারি খারাপ লাগছিল মেয়েটার পরীক্ষার সময়েও কলকাতায় থাকতে পারলাম না বলে। বাবা হিসেবে, ওর জন্যে আমার কিছু করা উচিত ছিল। ওর মা এত কিছু করছেন। কিন্তু কী করতে পারি আমি! তবে এটুকু বলব, নিজেকেই বলব যে, একজন আধুনিক মোটামুটি শিক্ষিত বাবা হিসেবে ওদের সঙ্গে প্রায় সব বিষয়েই মতের অমিল থাকলেও ওদের একটা সম্পূর্ণ অন্য এবং ব্যতিক্রমী প্রজন্মর সদস্য হিসেবে মর্যাদা, সহানুভূতি ও মমতার সঙ্গে সবসময়েই আমি বোঝার চেষ্টা করি। ওরা আমাদের মতো নরম, অভিমানী, অন্যের প্রতি কনসিডারেট হলে ওরা যে ধনে-প্রাণেই মারা যাবে সেকথা বুঝেই ওদের বড়ো হয়ে ওঠার প্রকৃতি নিয়ে আর কোনোরকম খুঁতখুঁতানি রাখি না।

তা ছাড়া, অরার যেমন কুঁচ, আজকালকার সব ছেলে-মেয়েরাই বোধ হয় তাদের মায়েদেরই ছেলে-মেয়ে।

আমাদের সময়ে বাবারা সবসময়ই দূরের মানুষ ছিলেন। আমরাও তাই-ই হয়ে গেছি। তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। আমরা, বাবা হিসেবে ছেলে-মেয়েদের মাঝে-মধ্যে চিড়িয়াখানা, বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নিয়ে যেতে পারি বা ছুটিতে কোথাও বেড়াতে। কখনো-সখনো চাইনিজ খাওয়াতে বা সাঁতার কাটাতেও নিয়ে যেতে পারি কিন্তু ওদের হৃদয়ের মর্মস্থলে আমরা শতচেষ্টাতেও পৌঁছোতে পারি না।

তিন্নি ঘোষ, পুনপুন সেন, জ্যোতি খেতান বা পিঙ্কি মালহোত্রার সঙ্গে আমার মেয়ে কুঁচ-এর মানসিকতা রুচি বা অরুচি, তৃষ্ণা বা বিতৃষ্ণা একই সুরে বাঁধা হলেও লক্ষ করি যে, ওরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব। আমাদের বয়েস যখন ওদের মতো ছিল তখন আমাদের কারোরই ওইরকম ঋজু এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠেনি আদৌ। তাই অবাক বিস্ময়ে আমি ওদের দূর থেকে সম্ভ্রমের চোখে দেখি। ওদের জেদ, জীবনের যুদ্ধে লড়বার জন্যে এই অল্প বয়েস থেকেই প্রাণপণ চেষ্টা, আমাকে মুগ্ধ যেমন করে, তেমন দুঃখিতও যে করে না তাও নয়। ওদের এত কম বয়েস থেকেই এমন প্রতিযোগিতায় ঊষর জীবনে দীক্ষিত করার মূলে যে আমাদের প্রজন্মর অশেষ দায়িত্ব এবং কর্তব্যজ্ঞানহীনতাই দায়ী সে সম্বন্ধে কোনোই সংশয় নেই আমার।

বাথরুমের টেলিফোনটা বেজে উঠল। কতক্ষণ যে নিজের ভাবনায় নিজে বুঁদ হয়েছিলাম তার হুঁশ ছিল না।

চেয়ারম্যান বললেন, শিমুল, প্লিজ কাম টু মাই রুম। সামবডি হ্যাজ সেন্ট মি আ বটল অফ রয়্যাল-স্যালুট। জারা ‘পি-পা’কে ‘হায়াত রিজেন্সিমে’ চলেঙ্গে খানাকে লিয়ে। পাঁচ মিনিটমে আ যাও। ডোন্ট বি অ্যান আন-সোশ্যাল অ্যানিমাল।

চেয়ারম্যানের অনুরোধ! হিজ উইশ ইজ আ কম্যাণ্ড টু মি। আমরা পাঁচপুরুষের চাকর। পা-চাটাটা আমাদের অতিসহজেই আসে। সাদা, কালো বাদামি; বেতো, ফুলো, নুলো; কোনো পায়েই আমাদের বিতৃষ্ণা নেই।

বললাম, ইয়েস স্যার।

জামাকাপড় পরতে পরতে ভাবছিলাম, গিয়ে হ্যা: হ্য্যা: হি: হি: করতে হবে। অতিস্থূল সব রসিকতা শুনতে হবে। প্রথম দু-তিন মিনিট খাঁটি অক্সোনিয়ান অ্যাকসেন্টে ইংরিজি শুনতে হবে কিন্তু তার পরই অকৃত্রিম হরিয়ানা অ্যাকসেন্ট জবর-দখল নেবে চেয়ারম্যানের জিভের। এই হচ্ছে শ্রীশিমুল বোসের সাফল্যের চূড়ান্ত রূপ। আমাদের মতো মানুষদেরই কষ্টার্জিত আয়ের ওপর ট্যাক্স দেওয়া সঞ্চয় যেসব জাতীয় লগ্নিতে থাকে সেইসব জাতীয় লগ্নির টাকা মেরে যেসব মানুষ ক্যাডিলাক লিমুজিন চড়ে এবং রয়্যাল-স্যালুট হুইস্কি খায় তাদের পায়ে তেল দিয়েই হ্যা:! হ্যা:! হি:! হি:! করে আমাদের সংসার প্রতিপালন করতে হবে। দিস ইজ আওয়ার লট।

আমি ঘেন্নার সঙ্গে রয়্যাল-স্যালুট হুইস্কি খেতে খেতে ভাবছিলাম, কুঁচদের জীবনের মানে, সার্থকতার ব্যাখ্যা কি কিছু অন্যরকম হবে না? যদি নাই-ই হয়, তাহলে আমরা কী রাখার মতো রেখে যাব ছেলে-মেয়েদের জন্যে? আমিও কি ‘বাবা’ ডাকের যোগ্য? আসল উত্তরাধিকার যে ব্যাঙ্কের টাকা নয়, সম্পত্তি নয়, তা চরিত্রর শুদ্ধতা, সুস্থ সামাজিক ব্যবস্থা, মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার; একথা তো আমরা নিজেরাই বুঝিনি। কাউকে বোঝাবারও চেষ্টা করিনি। এই উত্তরাধিকার কুঁচদের দেবার জন্যেও বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করিনি। তাই আমাদের ছেলে-মেয়েদের জীবন হয়তো কুকুর-বেড়ালের জীবনেরও অধম হবে।

প্রথম পরীক্ষার দিন, সোমবার সকালে ঠিক সাতটাতে কলকাতাতে ফোন করলাম। কুঁচকে বললাম, অল দ্যা বেস্ট কুঁচ।

সে হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ বাবা।

খুব গর্ব হল আমার ওর সপ্রতিভতা ও সাহস দেখে। ওদের তুলনাতে আমরা সত্যিই ম্যাদামারা ছিলাম। নাভার্স, আত্মবিশ্বাসহীন।

রাতেও আবার ফোন করেছিলাম। শুধোলাম, পরীক্ষা কেমন হল কুঁচ?

মেয়ে মনোসিলেবল-এ বলল, ঠিকই আছে।

বুঝলাম যে, ভালো পরীক্ষা দিয়েছে। ওদের ভোকাব্যুলারির রকমই এমন।

ফ্লাইট অনেক ডিলেড ছিল। বাড়ি ফিরলাম গভীর রাতে। অরা, একনম্বর পরীক্ষার্থী; ঘুমিয়ে পড়েছিল। দু-নম্বর পরীক্ষার্থী কুঁচই এসে দরজা খুলল। কুঁচ তখনও পড়ছিল। হাউসকোট পরা। দু-দিকে দুটি রুঠো বেণী দুলছে। বড়ো রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা আমার এই ক-দিনে। চোখের কোণে কালি জমেছে।

বসবার ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে দেখলাম বারোটা বাজে।

বললাম, তুমি শোবে না কুঁচ?

শোবো। পড়া হলে। দুটোর সময়ে।

কাল কী পরীক্ষা?

বাংলা।

উঠবে কখন আবার?

চারটেতে।

অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছ?

হ্যাঁ।

তুমি অসুখে পড়ে যাবে কুঁচ। পরীক্ষাই দিতে পারবে না। তুমি যদি ফেল করো তাহলে তোমাকে সোনার মেডেল দেব আমি।

ঠিক আছে। কিন্তু খারাপ রেজাল্ট করলেও তুমি কি আমাকে পরে প্রেসিডেন্সিতে ভরতি করতে পারবে বাবা? নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি তা দেখতে পাবে? তুমি রিটায়ার করার পরও কি আমাকে এমন সুখে রাখতে পারবে বাবা?

অসহায় বাবা, আমি মুখ নামিয়ে নিলাম। এত রাতে একজন অন্তঃসারশূন্য বাবার পক্ষে এই অন্তঃসারশূন্য দেশ ও সমাজের প্রেক্ষিতে এমন সাংঘাতিক সব প্রশ্নর জবাব দেওয়া সম্ভব ছিল না।

কুঁচ বসবার ঘরের তীব্র আলোর মধ্যে আমার চোখের গভীরতম প্রদেশে তার চোখ রেখে তার ঘরে চলে গেল। নিজের ঘরে পৌঁছোনোর পূর্বমুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, যেসব কথার কোনো মানে হয় না, সেসব কথা বলো কেন বাবা?

চান-টান করে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আমি শুয়ে পড়লাম। কলকাতায় বেশ গরম পড়ে গেছে।

আমার কুঁচ, অঙ্ক করার সময় কানে হেডফোন লাগিয়ে ওয়াকম্যানে ইংরিজি গান শোনে। তাতে নাকি ‘কনসেনট্রেশান’ ভালো হয়। ওদের রকমসকমই আলাদা। বাংলা গান সে ভালোবাসে না। বাংলা বই পড়ে না। ইণ্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কোনো খোঁজ রাখে না অথচ বাখ, বিটোভেন, মোৎজার্ট, মেণ্ডলহেনসন তাদের হিরো। রক, পপ, জ্যাজ-ই তাদের ক্রেইজ। ওরা ওদেরই মতো। আমাদের মতো একেবারেই নয়।

আমাদের ছেলেবেলায় পড়াশুনো না করার জন্যে বকুনি শুনতে হয়েছে কিন্তু বেশি পড়ার জন্যে কখনো শুনতে হয়নি। ওরা এক আশ্চর্য প্রজন্ম। ওদের পুরোপুরি বোঝা আমাদের পক্ষে অসাধ্য। ওরা এত বেশি শক্ত এবং জেদি আমাদের তুলনাতে যে, ওদের ভাঙার চেয়ে নিজেদেরই ভাঙা অনেকই সহজ।

প্রায় একটা বাজে এখন। এপাশ ওপাশ করছিলাম। নানা কথা ভাবতে ভাবতে। ঘুম আসছিল না। রাতের ফ্লাইটে ফিরলে আমার ঘুম আসতে দেরি হয়।

অরার সঙ্গেই শোয় কুঁচ, অরার ঘরে। যদিও পড়াশোনা করে তার নিজেরই ঘরে। অনেক রাত অবধি আমার আলো জ্বালিয়ে পড়াশোনা করার অভ্যেস। সেই কারণে কুঁচ আসার পর থেকেই অরা কুঁচকে নিয়ে আলাদা ঘরে শোয় রাতে। সপ্তাহে দু-একদিন রাত গভীর হলে বা শেষরাতে আমার ঘরে আসে। এখন তো বানপ্রস্থে যাবার সময়ই এগিয়ে এল।

নিশুতি রাতে হঠাৎ আমার বাহুর সঙ্গে অন্য নরম বাহুর ছোঁয়া লেগে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পেলাম যে, আমার পাশে শুয়ে আছে, সে আমার স্ত্রী অরা নয়, আমার কুঁচ।

যে-মেয়েকে রোজ রাতে শোওয়ার আগে শতবার একটি ‘আব্বা’ দিয়ে যাবার জন্যে ডাকলেও সে হেসে চলে যায়। বলে, কাল সকালে। আর সকালে ডাকলে, দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে: রাতে দেব। সে মেয়েই কিনা বিনা আমন্ত্রণে আমার পাশে এসে চুপিসাড়ে শুয়েছে মাঝরাতে! অবাক কান্ড!

ফিসফিসে গলায় আমি বললাম, কী রে, কুঁচ?

কুঁচ উত্তর দিল না কোনো।

অন্ধকারে তার মুখে আমার বাঁ-হাতের আঙুলগুলি বুলোতেই দেখি তার দু-চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরছে।

আমি উঠে বসে বললাম, এ কী! কী হয়েছে কুঁচ?

কথা না বলে, হঠাৎ চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল কুঁচ। তার পরই আমার দিকে পাশ ফিরে আমার গলা জড়িয়ে ধরে অস্ফুটে বলল, বাবা!

সেই মুহূর্তটিতে কী যেন ঘটে গেল এই অপদার্থ, কর্তব্যজ্ঞানহীন, মেরুদন্ডহীন শিমুল বোসের মধ্যে; একজন বাবার মধ্যে! যে-অপত্যস্নেহ প্রকাশ-ক্ষেত্রের অভাবে, দু-পক্ষরই সময়ের অভাবে, বাঁধ-বাঁধা নদীর ফেনিলোচ্ছ্বাসেরই মতো নীরবে গর্জন করছিল এত বছর আমার নির্জন ঊষর বুকের মধ্যে, তা সহসা বাঁধ ভেঙে কুঁচের প্রতি এতদিনের পুঞ্জীভূত অপ্রকাশিত অভিমানকে ঠেলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল একমুহূর্তে। নি:শব্দে আমার চোখ ভেসে যেতে লাগল জলে। মায়ের মৃত্যুর পরে এমন করে কখনো কাঁদিনি। বুকের মধ্যে এয়ার-বাসের এঞ্জিন চালু হল। হঠাৎ। মধ্যবয়স্ক শিমুল বোস, এই আমি, আমার চোখের ধারার মধ্যে দিয়ে আমার অপদার্থতার গ্লানিকে মাড়িয়ে দিয়ে আশ্চর্য সুন্দর শিহরিত এক উত্তরণে পৌঁছোলাম।

কুঁচ বলল, আমার বড়ো ভয় করছে বাবা! আমি বাংলাতে ফেল করব।

আমার খুব আনন্দ হল একথা জেনে যে, কুঁচ আমার অতিমানবী নয়। ও আমাদেরই মতো সাধারণ। ভয় বলে কোনো ব্যাপার তারও অভিধানে তাহলে আছে!

আমি ওকে দু-বাহু দিয়ে জড়িয়ে রইলাম। তার পর বললাম, তোমাকে তো বলেইছি আমি যে, ফেল করলে সোনার মেডেল দেব।

কুঁচ কথা বলছিল না। ওর চোখ দিয়ে সমানে জল বইছিল।

ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আমি ভাবছিলাম যে, আমি ওকে মিথ্যে স্তোক দিচ্ছি। ওকে যেমন করে হোক ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। এই নিষ্ঠুর নখদন্তময় পৃথিবীতে ওকে সারাজীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। হয়তো ওর বন্ধুদের বাবাদেরও কারো নেই। আমার অসহায়তায় যেমন আমার কষ্ট হতে লাগল তেমনই আমার মেয়ে যে ভয় পেয়ে তার বাবার ঘরে উঠে এসেছে, তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে, এই ভাবনাটাই এক দারুণ অনভ্যস্ত শ্লাঘাতে আমাকে ভরে দিল। আমি জানলাম যে, মানুষ হিসেবে আমি ব্যর্থ হতে পারি, নিজের জীবনে যা হতে চেয়েছিলাম, তা না হয়ে উঠতে পারি; কিন্তু আমি একজন সার্থক বাবা। এই সার্থকতাটুকুই বা বড়ো কম কী!

কুঁচ এবার বলল, আমি পরীক্ষা দেব না বাবা।

আমি বিছানা থেকে নেমে গিয়ে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। যাতে অরার ঘুম না ভেঙে যায়। এখন ‘ফাদারিং টাইম’। বিপন্ন-কন্যা কুঁচ এখন শুধুই আমার একার। পিতাপুত্রীর এই কথোপকথনে মায়ের কোনোই ভূমিকা নেই। এমন এমন গর্বময় মুহূর্ত আজকালকার বাবাদের জীবনে বড়ো বেশি আসে না।

আমি বললাম, কোন পরীক্ষার কথা বলছিস রে কুঁচ?

স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা! আবার কোন পরীক্ষা। কাল-পরশু বাংলা আছে।

ওঃ। ওই পরীক্ষা! স্কুল ফাইনাল? তা নাই-ই বা দিলি!

দেব না? তুমি…

ও পরীক্ষা না দিলেও চলবে। কিন্তু অন্য সব পরীক্ষা?

কী? হিস্ট্রি, জিয়োগ্রাফি?

না, নারে। প্রতিদিনকার পরীক্ষা রে মা। বক্সার জো লুই কী বলেছিলেন একবার জানিস?

কী?

বলেছিলেন, ‘ইউ ক্যান রান বাট ইউ ক্যানট হাইড’। পরীক্ষারই আরেক নাম যে জীবন মা। তুই পালাবি কোথায়? এই যে আমি দিল্লিতে গেছিলাম, তাও তো একটা পরীক্ষাই দিতে! তোর বড়োমামা যে এত বড়ো সার্জন, রোজ সকালে যে তিনি এতগুলোকরে অপারেশন করেন, প্রত্যেকটি রোগীর অপারেশানই তাঁর এক-একটি পরীক্ষা। তোর মা সকাল থেকে যে রাত অবধি আমরা কী খাব, কী পরে অফিস এবং স্কুলে যাব, তোর পড়াশুনো, আমার কাজ এইসব এবং আরও কত ভাবনা নিয়ে থাকেন তাই প্রত্যেকটি দিনই সকাল থেকে রাত তাঁরও তো পরীক্ষা! রোজকার পরীক্ষা। ড্রাইভার কাউলেশ্বর সিং যে রোজ সকাল সাড়ে আটটাতে এসে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করে এবং রাত সাড়ে আটটাতে গাড়ি ঢোকায় এই বারো ঘণ্টা তারও পরীক্ষা। একটি অ্যাকসিডেন্ট হলেই তার নিজের কাছেই সে ফেল। তোর ভালোমানুষ ‘স্যার’, তোর অঙ্কের মাস্টারমশাই, যিনি তোকে এত যত্ন করে পড়ান; তাঁর পরীক্ষাও যে তোর পরীক্ষার সঙ্গে জড়ানো। প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রীর পরীক্ষাই তাঁর পরীক্ষা। কারণ তাঁর বিবেক আছে, দায়িত্ব-কর্তব্যজ্ঞান আছে। কালকের এই বাংলা পরীক্ষা তুই না দিতে চাস, তো দিস না। কিন্তু হার-জিতটা বড়ো কথা নয়। পরীক্ষাতে বসাটই সবচেয়ে বড়ো কথা। তোর রমেশকাকা যে রোজ সকালে শামলা-গায়ে হাইকোর্ট যান তিনি কি প্রত্যেকটি মামলাতেই যেতেন? হয়তো হারেন অনেক মামলাই। কিন্তু যে মামলাতে জিতবেন তারই শুধু ব্রিফ নেবেন আর যাতে হারবেন তার ব্রিফ নেবেন না, এমন ডিসিশান নিলে তো কোনোদিনই উনি বড়ো উকিল হতে পারতেন না। তোর গাডলুকাকা, যে কিছুই না করে হেসে খেলে জীবনটা কাটিয়ে গেল, আমাদের ঠাট্টা করে, ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’-এ বিশ্বাস করে, তার জীবনেও প্রত্যেকটি দিনই পরীক্ষা। পাছে, সে চাকরি নিতে বাধ্য হয়, তার বোহেমিয়ান জীবনের দফারফা ঘটে; এই তো তার সর্বক্ষণের ভয়। তোর স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষা এইবার না দিতে চাস তো দিস না। কিন্তু জীবনে পরীক্ষাকে যারা এড়িয়ে যেতে চায় তারা যে মানুষই নয় রে মা। এ জীবনের প্রত্যেকটি ঘণ্টা, প্রত্যেকটি পদক্ষেপের আরেক নামই যে পরীক্ষা।

টেবিলের ওপরের টাইমপিসটার রেডিয়াম দেওয়া কাঁটাগুলি তখন রাত দুটো দেখাচ্ছিল। টিকটিক শব্দ করে সেই মধ্যরাতের নৈ:শব্দ্যকে ফুটো করে যাচ্ছিল ঘড়িটা।

কুঁচ একটি খুব বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বড়ো বেশি কথা বলে ফেললাম কি? যাত্রাদলের নায়কের মতো? মেয়ের কাছে ‘বাবা’ হওয়ার সুযোগ পেয়ে কি ‘ওভার-ডু’ করলাম?

কুঁচ আরেকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেই বলল, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো বাবা!

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে একটি চুমু খেয়ে বললাম, আজকে ভোরে উঠবে না তুমি। আমার কাছে শুয়ে থাকো। যেমন পারবে, তেমনই দেবে পরীক্ষা। ভুলে কিছুই যাওনি তুমি। সবই মাথায় ধরা আছে। প্রশ্নপত্র পেলেই দেখবে কলমের মুখে তরতর করে শব্দ আসছে। এসব পরীক্ষা তো খেলার পরীক্ষা। এমন অনেক পরীক্ষা দেবার পরই তো আসল পরীক্ষাতে বসতে হবে তোমাকে। জীবনের পরীক্ষা।

কুঁচ আমার কানের মধ্যে গরম নি:শ্বাস ঢেলে দিয়ে বলল: ‘ব্যাটল অফ লাইফ।’

বললাম, হ্যাঁ মা। ব্যাটল অফ লাইফ। তার জন্যে অ্যাডমিট কার্ড, আগে থেকে ঠিক করা পরীক্ষাকেন্দ্র; কিছুই থাকবে না। কোথায়, কখন কার সঙ্গে যে যুদ্ধ লড়তে হবে তা আগে থেকে কিছুই জানা যাবে না। অথচ লড়তে হবে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। সে-পরীক্ষার প্রায় সব পেপারই ‘আনসিন’।

এতক্ষণ কুঁচের সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হয়েছিল। এবারে ওর শরীরের সব মাংসপেশি ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এল। নিজেকে, নিজের ভয়কে সে নি:শর্তে সমর্পণ করল তার বাবার বুকে।

কুঁচ আবার বলল, বাবা। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো।

হ্যাঁ রে মা। ধরেছি জড়িয়ে।

আমি বললাম।

কুঁচের চোখের জল শুকিয়ে গেছিল ততক্ষণে। কিন্তু আমার দু-চোখ আরও সিক্ত হল।

কিণ্ডারগার্টেন ক্লাস থেকে অরাই কুঁচের পড়াশোনার সব দায়িত্ব বহন করেছিল। আমি কিছুই করিনি। আমার মেয়ে এতদিন আধো-চেনাই ছিল আমার কাছে। মনে মনে বললাম, শিমুল বোস, ভাগ্যিস তোমার মেয়ের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। ভাগ্যিস বাংলা পরীক্ষার আগের রাতে সে ভয় পেয়েছিল। তাই তুমিও আজ হঠাৎ এক মস্ত পরীক্ষাতে পাস করে গেলে!

টাইমপিস আর পাখার শব্দে শুক্লপক্ষর চাঁদের আলো-মাখা কলকাতার রাতের দুধলি অন্ধকার চারদিকে চাড়িয়ে যাচ্ছিল। ফুলের গন্ধ আসছিল সেনদের বাড়ির বাগান থেকে। গভীর আনন্দে, আমি আমার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে রইলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *