পরি পয়রা

পরি পয়রা

ডানদিকে শাল আর চাল্লার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ চলে গেছে ন্যাশনাল হাইয়ের দিকে। সেখানে গিয়ে উঠল সোজা লোধাশুলি। আরও এগিয়ে গেলে শালবনী। ঝাড়গ্রাম।

মুঠিয়া জায়গাটা, বাংলা আর ওড়িশার সীমান্তবর্তী। ‘পয়রা’ পদবিটা শহরের লোকের বিশেষ পরিচিত নয়। এই পয়রাদের কাজ স্যাকরাদেরই মতো। গাঁয়ে গঞ্জেও স্যাকরা থাকে।

মদন পয়রা, পরির বর। বয়সে বছর বারোর ব্যবধান দু-জনের। মদন বাড়ি বসে গয়না বানিয়ে নিয়ে বালেশ্বরে বড়ো মহাজনের দোকানে অর্ডারি গয়না সাপ্লাই করে কখনো-সখনো নিজের পছন্দসই ডিজাইনের গয়না নিয়ে বাংরিপোসি আর ঝাড়ফুকুরিয়ের মধ্যে সপ্তাহে যে একদিনের হাট লাগে সেখানে গিয়ে বেচে আসে। তবে সে হাটে বিকোয় রুপোর গয়নাই বেশি। সরু কোমরের, কবৌঞ্জ আর নিমের তেল মাখা তন্বী মেয়েরা আসে মাঝবয়সি কালো কবুতরের মতো। বুকের আর বগলতলির ঘামের গন্ধে ছেয়ে যায় হাট, মুরগি আর মুরগির ডিমের আঁশটে গন্ধের সঙ্গে মিশে।

শেষবেলা অবধি কেনাবেচা করে জঙ্গলের পথ ধরে অনেকখানি এসে সুবর্ণরেখা পেরিয়ে মুঠিয়া গ্রামে ফেরে মদন রাতের বেলা। কখনো চাঁদ থাকে। কখনো থাকে না। গ্রামের সঙ্গী সাথিদের সঙ্গে গল্প করতে করতে হাঁড়িয়া খাওয়া সুখে অতখানি পথ যেন উড়েই আসে মদন। শরীর তখন পাখির শরীর হয়ে যায়। রাত পাখির মতো। বসন্তর বনের হাওয়া শালের পাতায় ফুরফুর করে। তার শরীরেও।

যেন পালকে ভরে গেছে বলে মনে হয় শরীর।

মদনকে মুঠিয়া গ্রামের অনেকেই হিংসে করে। বিঘে পাঁচেক ডাঙা জমি। পঁচিশ বিঘা ধান জমি। তদুপরি এই সোনা-রুপোর ব্যাবসা। কিন্তু এইসবও কিছু নয়। হিংসে করে পরির জন্যে। ডানা-কাটা পরিরই মতো রূপ ছিল পরির। এখন তিরিশে এসে সে-রূপে বান ডেকেছে।

সোনা-রুপোয় মুড়ে রাখে পরিকে মদন তবু পরির মন পায় না। ছেলেমেয়ে নেই ওদের। তারজন্যে দুঃখ নেই মদনের। যদি বুঝতে পারত একটিবারেরও জন্যে, পরি কী চায় তার কাছ থেকে? কীসে তার সুখ, তবে বর্তে যেত সে।

ও যা কিছু চায়, সবই পরি দেয় তাকে। যা খেতে ইচ্ছে হয়, রেঁধে দেয়। যখন আদর করতে ইচ্ছে করে, আদর করতে দেয়। যেমন করে চায় ও তেমন করেই দেয়। অনেক পুরুষ বন্ধুদের কাছে মদন শোনে, তাদের স্ত্রীদের সম্বন্ধে নানা অনুযোগের কথা। গণেশ কোকশাস্ত্রের বই এনে দিয়েছিল একটা কোলকাতা থেকে। কামশাস্ত্রের ছবিঅলা বইও। সব ছবিকেই ও তার শোবার ঘরের বিছানায় ফ্রেমে বাঁধিয়েছে একবার বা একাধিকবার। পরির কিছুতেই আপত্তি নেই।

কিন্তু সব দিয়েও পরি যেন কিছুই দেয় না মদনকে। কী যে সে তার নিজের কাছে রাখে, তা বুঝতে পারে না মদন তার সব বুদ্ধি দু-হাতে জড়ো করেও। বুঝতে পারে না বলেই জৈষ্ঠ্যের দুপুরের চড়াই-এর মতো ছটফট করে। পরি কথা বলে না আদর খাওয়ার সময়ে। বিলিতি পুতুলের মতো মদনের কথামতো কাজ করে যায়। তখন পরির মুখে এক আশ্চর্য হাসি লেগে থাকে। প্রদীপের পলতে নয় সে হাসি। ভালোবাসার হাওয়া গেলে তা বাড়ে কমে না। ইলেকটিরির বালবের মতো স্থির সমান উজ্জ্বলতায় জ্বলতে থাকে তা। মাঝে মাঝেই মদনের মনে হয় যে, তার কোনো মানুষীর সঙ্গে বিয়ে হয়নি; বিয়ে হয়েছে কোনো সত্যি পরির সঙ্গে। যে পরিরা গা-ছমছম জ্যোৎস্না রাতে শালের বনে কী সুবর্ণরেখার সোনার মতো বালুভূমিতে খেলে বেড়ায়। মেয়ে মানুষটার বুক চিবুক দু-হাতের মধ্যে নিয়ে, তার নিশ্বাসের মিষ্টি গন্ধে নিজের বিড়ি-ফোঁকা দুর্গন্ধ মুখ সুগন্ধি করে তুলেও মেয়ে মানুষটার মনের কাছে কোনোদিনও আসতে পারেনি গত পনেরো বছরে মদন।

পরি রাতের পর রাত তাকে বনের পরিরই মতো কুহকের রাজ্যে নিয়ে যায়। সর্বস্বান্ত হয়ে মদন পয়রা হাহাকার করে। যাকে অন্য যে-কেউই সুখের চরম বলে জানত, তা পেয়েও মদন বুঝতে পারে; সুখের বাড়ি অনেক দূরে।

পরির কোনো দোষ নেই। শরীরে কোনো রাগ নেই। সৌন্দর্যে কোনো খুঁত নেই। তার গায়ের চামড়া জলপিপির গায়ের মতো উজ্জ্বল। অথচ কুসুমফুলের মতো নরম লাল। পরিকে সুবর্ণরেখা নদীর বালির মতো নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখেও তার মনের সোনার এক কণাও তার নখে তুলতে পারেনি মদন।

দোষ বলতে একটাই। প্রতিবছর বসন্তর রাতে, দোলের চাঁদের পনেরো দিন আগে থেকে পরিকে যেন পরিতে পায়।

চাঁদ যত বড়ো হতে থাকে পরির পাগলামি ততই বাড়ে।

রাতের বেলা সে দরজা খুলে বেরিয়ে গাঁয়ের সীমানা পেরিয়ে সুবর্ণরেখার দিকে চলে যায়, সেখানে অসমসাহসী পুরুষও একা একা যেতে সাহস পায় না গভীর রাতে। মজা এইই যে, ঠিক সেইসব দিনেই মদনকে ঘুমে পায়। পরি শেষরাতে যখন নদী থেকে ফিরে আসে তখন ওর ঘুম ভাঙে। আর যখন যায়, তখন গভীর ঘুমে মড়ার মতো পড়ে থাকে। ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্যে মদন এই পনেরোদিন রাত নামলেই একাধিকবার আদর করে পরিকে। তৃপ্ত নারীর ঘুম সাপের কামড়ও টের পায় না একথা কে না জানে! তবু পরি তারপরও ঠিক বেরিয়ে যায়। মদন যা কিছু চায় সব দিয়ে তারপরও পরির অনেক উদবৃত্ত থাকে। সেই উদবৃত্ত সে কোথায় কার জন্যে যে বয়ে নিয়ে যায়, নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে; সে এক গভীর রহস্য।

পরি গত পনেরো বছরে দিনে গড়ে পনেরোটি কথাও বলেনি। পাঁচ প্রশ্নর উত্তর একটি ‘হ্যাঁ’ অথবা একটি ‘না’- তে সারে। মুখে সেই ইলেকটিরি বালের হাসি লেগে থাকে সবসময়ই। বাড়া-কমা নেই কোনো।

পরির বাড়ি যে গ্রামে, সেই গ্রাম নদীর ওপারে। সেই গ্রামে এক মাতাল গেঁজেল জুয়াখেলায় সর্বস্ব খোয়ানো-পুরুষের বাস। সে মদনেরই বয়সি হবে। নাম তার খেয়ালি। খেয়ালির সবকিছুই গেছে। গ্রামের কোণের এক পড়ো পড়ো কুঁড়েতে তার বাস। মাধুকরী করে খায় সে। সবই দোষ। গুণের মধ্যে সে, গান গায়। সে গানও কাউকে শোনাবার জন্যে নয়। কেউ শুনতে চায়ও না। বনে বনে, দিনে রাতে, সেই একা পাগল গান গেয়ে গেয়ে ফেরে।

কানাঘুসোয় শুনেছিল মদন যে, ছেলেবেলায় পরির সঙ্গে তার ভাব ছিল খুব, পরির মা যতদিন বেঁচে ছিলেন। মদন এও শুনেছিল যে, পরির বিয়ের পর থেকেই খেয়ালি মানুষটা অমন হয়ে যায়। দাবা-খেলা যুধিষ্ঠিরের মতো সব খোয়ায় একে একে। মন দিয়ে খেললে ওকে হারাতে পারে এমন লোক কমই ছিল দশটা গাঁয়ে। কিন্তু মানুষটা হারবে বলেই পণ করে যেন খেলতে বসত।

তারপর নেশা শুরু করে।

খেয়ালির সঙ্গেও পরির বিয়ে হতে পারত। কিন্তু জাতে তারা ছিল মুচি। মরা পশুর চামড়া শুকিয়ে তা দিয়ে জুতো বানাত। যে ঢোল মন্দিরে বাজে, সেই ঢোলের চামড়া আসত তাদেরই ঘর থেকে, যে খোলে ঠাকুর দেবতার নামকীর্তন হয় সেই খোলের চামড়াও আসত তাদের বাড়ি থেকেই; তবু অন্যের চোখে তারা জাতে নীচু।

পরিরা ছিল স্বর্ণকার। দেবীর গয়না বানাত তার বাপ। তার মেয়ের সঙ্গে খেয়ালির বিয়ে হলে সমাজে ঠাঁই দিত না কেউই তাদের। তাই পরির বিয়ে দিয়েছিল বাপ খগেন, পালটি ঘরে মদনের সঙ্গে।

বড়ো অদ্ভুত প্রকৃতির মেয়ে এই পরি। বাপকে অমান্য করেনি। কিন্তু বিয়ের পর একদিনের জন্যেও আর বাপের বাড়ি যায়নি। পা দেয়নি বাপের গাঁয়ে। অনেক ঝুলোঝুলি সাধাসাধিতেও না। শুধুই হেসেছে। ইলেকটিরি হাসি।

মায়ের মৃত্যুতেও তাকে কেউই নিয়ে যেতে পারেনি। নিজ গাঁয়ে মরা মায়ের মুখ দেখতে। সুবর্ণরেখার জলের পাশে সে তর্পণ আর কাজ সেরেছে। নদীর এপাশে।

বড়ো অদ্ভুত চরিত্রের মেয়েছেলে বটে।

সকলেই বলে একথা।

মদন কিন্তু বড়ো ভালোবাসে তার পরিকে। শুধু ছটফট করে মরে সবসময়ে যা, পরি তাকে দেয়নি; তা পাবার জন্যে। প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল মাটির ঘরে শালকাঠের তক্তপোশের ওপর শিমুল তুলোর তোশকের ওপরে বিছোনো খড়গপুর থেকে কিনে আনা ফুলকাটা নরম বিছানার চাদরের ওপর পরির পাশে শুয়ে পরিকে বার বার বলে, তুমি আমার হও, পরি তুমি আমার! তোমাকে পুরোপুরি দাও আমাকে, একটুও বাকি না রেখে। পরি মুখে সেই ইলেকটিরি হাসি হেসে খাট থেকে নেমে শায়া আর লালপেড়ে শাড়ি খুলে আলনায় রাখে। তারপরে তার হাঁটু সমান চুলের অর্ধেক সামনে এনে জঘন ঢাকে। অন্যপাশ থাকে পেছনে। নিতম্ব ছেয়ে। পরির হাসি বলে, এই তো আমি। নাও আমাকে। নাও! না-বলেই বলে, এর চেয়েও বড়ো পাওয়া বলে অপর কিছু কি জানে পুরুষেরা?

পরিকে নেয় মদন! খাট থেকে নেমে তাকে কোলে করে তুলে এনে শোওয়ায় খাটে। আঁতিপাঁতি করে পরির শরীরের সব রহস্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। কিন্তু পরির শরীরের আড়ালে যা থাকে; কিছু কি থাকে?

যা মদন পেতে চায়, তা একদিনের জন্যেও পায় না।

পরি হেসে বলে, এই তো আমি!

এই তুমিই কি সবটুকু তুমি?

আর কী বাকি আছে আমার মেয়েদের শরীরই তো সবটুকু। আর কী!

আর কিছু নেই?

আর কী?

তুমি আমার নও।

তবে আমি কার? এতভাবে এতবার দিয়েও কি দেওয়া হল না?

না, না। তুমি কী যেন লুকিয়ে রাখো। কী যেন দাও না আমাকে পরি।

আর কিছু নেই। একজন মেয়ের যা-কিছু আছে, থাকতে পারে, সবই তো পেয়েছ। আর কী চাও?

তা আমি জানি না। শুধু জানি যে, তুমি তোমার মধ্যে যে আর একজন আছে তাকে লুকিয়ে রাখো সব সময়। তাকে দাও না কখনো আমাকে।

একদিন পরি মদনকে বলেছিল, তুমি অহল্যার গল্প জানো তো? আমরা মেয়েরা, এ দেশের সব মেয়েরা, অহল্যারই মতো পাথর হয়ে গেছি। তোমাদেরই চোখের অভিশাপে। শরীরের পাথরে আমাদের বাস। তোমাদেরই ফিরিয়ে দিয়ে তোমাদের অসম্পূর্ণ দান সম্পূর্ণ করি আমরা। রেঁধে খাওয়াই। রোগে সেবা করি। তোমরা মরে গেলে মাথার চুল কেটে ফেলি। নিরামিষ খাই। জীবনের এক আকাশ আলোকে নিভিয়ে দিয়ে সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি। এইই তো তোমরা চেয়েছিলে চিরদিন। এই চেয়েছিলে বলেই এর চেয়ে বেশি কিছু চেয়ে আমাদের বিব্রত করো না কষ্ট দিয়ো না।

এত কথা মদন কিংবা পরি পয়রা দুজনের কেউই স্পষ্ট করে বলে না। এমন ভাষাও তাদের নেই। তবে চোখ বলে।

চোখ যা বলে তা কী মুখ কোনোদিনও বলতে পেরেছে?

আজ চতুর্দশী। পলাশ শিমুল কুসুমের ফুল আর পাতা সেদ্ধ করে ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা রং বানিয়েছে। কাল সকালে দোল খেলবে বলে। শটি আর রং মিশিয়ে আবির বানানো হয়েছে ঘরে ঘরে। হরিসভায় দোলোৎসব হবে রাতে। ঘরে ঘরে মিষ্টি বানানো হয়েছে। রং দিতে আসা ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেবে বলে। গাঁয়ের পাড়াতুতো দেওর আর বউদিদের চোখে ঘুম নেই কাল সকালে দোলের অছিলায় স্পর্শ সুখের শিহরিত আনন্দের স্বপ্নে। পরির পাগলামি আজ তুঙ্গে। মদন তার বেয়াল্লিশ বছরের যৌবনের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে প্রথম রাত থেকে বহুভাবে আদর করেছে পরিকে। আজ পরিকে সে আদরের স্যালাইন ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াবেই। পরিকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে এখন নিজেই মরা মানুষের মতো ঘুমিয়ে আছে মদন। পুরুষের ভূমিকা, ফুরিয়ে যাবার দাতার; নারীর পূর্ণ হবার গ্রহীতার।

রাত এখন অনেক। নদীপারে শেয়াল ডাকছে। শাল, মহুয়া আর করৌঞ্জ-এর গন্ধে মাতাল হয়ে হাওয়া ঝড় তুলেছে চাঁদের বনে বনে। ঘরের মধ্যে প্রদীপের পলতে কাঁপছে ঘরে-ঢোকা দামাল হাওয়ায়।

নগ্ন পরি বিছানা ছেড়ে নামল। তার এলোকেশী নগ্ন শরীরের ছায়াপ্রদীপের দেওয়ালে নড়ে উঠল। শুধুমাত্র শাড়িটা জড়িয়ে নিয়ে দরজার খিল খুলে বেরিয়ে পড়ল পরি। একটা খরিশ-কেউটে হিস হিস করে চলে গেল প্রায় পায়ের ওপর দিয়েই। কামড়াল না। ভালো হত কামড়ালে। এই স্থির হয়ে থাকা ইলেকটিরি হাসির জীবনে, পচা-পানায় ভরা, সমান-সুখের একঘেয়ে জীবনে; তবু কিছু হঠাৎ জ্বালার সুখ অথবা বিষ চারিয়ে যেত।

পরি ভাবছিল, সুখ মানেই তো বিষ। এই সমাজে। বিষের মতোই পরিত্যাজ্য সব সুখ, যা, চামচে-মাপা; স্বামী দত্ত নয়; সব সুখ। এই সমাজ—সংসারের কৃপণ হাতের কুনকো ঢালা সুখ। ভারি ইচ্ছে করে, একদিন সাপের কামড় খেয়ে দেখতে। এই খরিশ-কেউটেও তো অই পয়রা গ্রামেরই সাপ। ভুল লোককে ভুল করে সাপও কামড়ায় না এখানে। ছি:!

কুকুর ডেকে উঠল। শুঁড়িদের বাড়ির একটা মদ্দা আর একটা মাদি ওর পিছু নিল। কিছুটা। তারপর আর সাহস পেল না। গ্রামের কুকুরগুলোও সাপটারই মতো। নতুন জায়গায় যেতে, নতুন কিছু করতে ভয় পায়।

পরি চলল, আঁচল লুটিয়ে; সুবর্ণরেখার দিকে। শালবনের গভীরে আসতেই বার বার তার মনে হতে লাগল যে, সে সত্যিই পরি। সত্যি সত্যিই পরি হয়ে যাচ্ছে পরি পয়রা। আঁচলের জায়গায় তার ফিনফিনে কুসুমের পাতার মতো পাতলা আর কুসুম-লাল ডানা গজিয়ে গেছে মস্ত দুটি। উড়ে চলল পরি। তার স্বামীর আদরে আদরে পুরোনো হয়ে যাওয়া শরীর, তার সকাল থেকে সন্ধের নিয়মবদ্ধ জীবন, সব পেছনে মেলে এসে সে যেন সদ্য ঋতুমতী কোনো পশ্চদশী হয়ে গেল। অচুম্বিতা, অনাঘ্রাতা; প্রত্যাশাতে ভরপুর। উড়ে এল একেবারে সুবর্ণরেখার মধ্যে। যেখানে বড়ো বড়ো কালো কালো পাথর আছে সোনালি বালির মধ্যে। চতুর্দশীর চাঁদের আলোয় বালি এখন রুপোলি। শাড়ি খুলে ফেলে সেই পাথরের স্তূপের ওপর পায়ের ওপর পা রেখে বসল পরি।

হু-হু হাওয়া আসছে তাদের গ্রাম থেকে। খেয়ালি, কী করছে কে জানে; এত বছর এই দোলের আগের চাঁদের রাতে পরি এখানে এসে বসে শুধু সেই মানুষটা আসবে বলে। আহা! কী তার গলা। গানের কী ভাব! পরির জন্যেই এমন করে নষ্ট হয়ে গেল মানুষটা। সর্বস্বান্ত। দুবেলা দু-মুঠো ভাতও জোটে না খেয়ালির। অথচ পরির কিছুই করবার নেই। ও পেটপুরে খায়। ভালো শাড়ি পরে। কোমরের পেঁছা থেকে গলার সীতাহার, পায়ের পায়জোর, নাকের নথ সবই পরে। যেন। সোনা দিয়েই পেট ভরে একজন মানুষের। হয়তো ভরে! যাদের ভরে, কারও কারও। পরি তাদের মতো নয়। তার মনের মানুষটার জন্যে যদি একটু কিছুও করতে পারত। মানুষটা যদি একবারও এসে সামনে দাঁড়ায়, পরি পয়রা তার স্বামীর দেওয়া হাড়িটা পর্যন্ত এই বালিতে ছেড়ে রেখে তার হাত ধরে নিরাবরণ হয়ে চলে যাবে, সে যেখানে নিয়ে যাবে। সেই নরকে।

অনেক অনেক বছর আগে এক দোলের রাতে, গোয়ালঘরের পাশে দাঁড়িয়ে, গোরুর গায়ের গন্ধ, গোবরের গন্ধ, চোনার গন্ধ আর জাবনার গন্ধের সঙ্গে মিলে যাওয়া দোলপূর্ণিমার রাতের সব গন্ধর মধ্যে খেয়ালি, চোদ্দ বছরের পরিকে চুমু খেয়েছিল তাদের গ্রামে। বঞ্চিত চুমু। চুরির চুমু। ব্যথার চুমু। প্রেমের চুমু। সেই রাতেই পরি জেনেছিল প্রথম বা শেষবারের মতো যে পরির মধ্যে এক অন্য পরি আছে।

সে আর এল না। কোনোদিনও আসেনি। কই আর এল? আসবে না, জানে। যারা পরিদের ডানা গজাতে জানে, যাদের ঠোঁটে কুসুম ফুলের মসৃণতা, যাদের গলায় পাগল-কোকিলের গান, সেইসব পুরুষ, নারীর জীবনে ক্ষণিকের জন্যেই আসে। এসেই, পরক্ষণেই হারিয়ে যায়। দূর থেকে পুলক ভরে ডাক পাঠায় বাসন্তী হাওয়ায়। চেয়ে থাকে, সন্ধেতারার চাউনি হয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চৈত্রের দুপুরে শালের বনে। কিন্তু তারা জীবনে আসে না।

পরি পায়রারই মতো সব নারীরই জীবন, সব নারীই, মদন পয়রাদেরই জন্যে। অভ্যেসের খোঁটায় বাঁধা গোরুর মতো সুখের জাবনাতে জাব খায় তারা। খরিশ কেউটের কামড় তাদের জন্য নয়।

পরি জানে।

তবু পরি পয়রা এও জানে যে, অভ্যেসের বাঁধন এখনও তাকে পুরোপুরি বাঁধতে পারেনি। পরির ভেতরের পরির ডানা দুটি এখনও বছরের এই ক-টি দিনে জল ফড়িং-এর ডানারই মতো ফরফর করে ওঠে। বাঁধন ছেড়ে উড়ে যেতে চায়; সব পরির মধ্যেই যে দ্বিতীয় নারী থাকে সে গ্রীষ্মবনের খয়েরি তিতিরের মতো ছটফট করে উঠে বলতে চায়, এ নয় গো! এ নয়।

জীবনের মানে এ নয়! বাঁচার মানে এ নয়।

পরি জানে যে, এ দেশের পরিরই মুক্তির আরও অনেক অনেকেই দেরি আছে। খেয়ালিরাও তো পুরুষই! নারীকে মুক্ত করতে পারে, পরির মধ্যের পরিকে ডানা মেলে উড়তে দিতে পারে, একমাত্র পুরুষের মতো পুরুষরাই। মদন পয়রাও নয়, খেয়ালি মুচিও নয়। প্রথমজন প্রেমের কিছু বোঝে না। দ্বিতীয়জন প্রেমে যে সাহসের দরকার তা রাখে না। যে দেশের পুরুষেরা এমন, সে দেশের পরিরা সন্ধেতারার দিকে চেয়ে চেয়েই চিরদিন দিন গুনবে।

ডান পা-টাকে এবার বাঁপায়ের ওপরে করল পরি। নিজের অনাবৃত্ত ঊরুর ওপর অন্য ঊরুর পরশে শিহর লাগল। আরও একটু বসে থাকবে। মদন পয়রার স্ত্রী হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে এমন একা নিজের দুই ঊরুর উষ্ণতায় ধন্য করে বাঁচাও ঢের ভালো ছিল। এ জন্মে হল না।

কাল সকালে গ্রামের যে ছোটো ছোটো মেয়েরা পুলকভরে দোলে খেলবে, চিকন চিৎকারে, ওরা যেন সত্যিকারের পরির জীবন পায়। পরি পয়রার জীবন নয়। সত্যিকারের স্বাধীন উড়াল-পরির জীবন। পরি ভাবে যে, ও বেঁচে উঠবে ওদের মধ্যে। অন্য জন্মে, অন্য জীবনে!

ভাবে পরি, ডাইনি জ্যোৎস্নার মধ্যে উদোম হাওয়ার মধ্যে; অসভ্য গন্ধের মধ্যে বসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *