পরি? না পরি না?
মিলির খুব ইচ্ছে একটা ড্রাগন দেখার৷ খুব কাছ থেকে নয়, দূর থেকে৷ ড্রাগনের মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরোয়, দূরে থাকাই ভালো৷
কিন্তু পৃথিবীতে কি আর একটাও ড্রাগন আছে?
কখনো একটা উড়ন্ত পরি দেখতেও তার খুব সাধ হয়৷ কিংবা একটা পক্ষিরাজ ঘোড়া৷
সাত-আট বছর বয়েস পর্যন্ত মিলি ভাবত, সত্যি সত্যি ড্রাগন আছে, পরিরা মাঝে মাঝে পুকুরের ধারে নেমে আসে৷ আর আকাশ দিয়ে পক্ষিরাজ ঘোড়া উড়ে যায়৷ বইয়ের পাতায় যা থাকে, সব সত্যি৷ টিভি-তেও তো ওদের দেখা যায়৷
এখন মিলির বয়েস ন’বছর আট মাস৷ এই তো সেপ্টেম্বর মাসে তার দশ বছরের জন্মদিন হবে৷ কী যেন কেন এর মধ্যে একদিন সকালে ঘুম ভেঙে ওঠার পরই মিলির মনে হল, না, না, পক্ষিরাজ ঘোড়া, ডানাওয়ালা পরি, ড্রাগন-ট্রাগন কিচ্ছু নেই৷ ওগুলো সব বানানো৷ যাকে বলে রূপকথা! ওদের গল্প পড়তে ভালো লাগে, তা বলে বিশ্বাস করতে হবে কেন?
একটু বেলা হবার পর ইস্কুলে যাবার জন্য রেডি হতে হতে আবার তার মনে হল, তবে কি আগেকার দিনে ওইসব ছিল? এখন আর নেই? যেমন একসময় তো পৃথিবীতে ডায়নোসেরস, টেরাডাকটিল এসব সত্যিই ছিল, অনেকদিন আগেই তারা শেষ হয়ে গেছে৷ সেইরকম কি পক্ষিরাজ ঘোড়া কিংবা পরিরাও…৷ অনেকদিন আগে, মানে কতদিন আগে!
এসব কথা কাকে জিজ্ঞেস করা যায়?
মা-ই মিলির সবচেয়ে ভালো বন্ধু৷ বাবা এখন দিল্লিতে, দু’মাস থাকবেন সেখানে৷ দাদা কলেজে পড়ে, অনেক কিছু জানে৷ কিন্তু দাদাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই দাদা অমনি নাকটা টিপে দিয়ে বলবে, এটাও জানিস না বোকারাম? যেমন কিছুদিন আগে মিলি দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা দাদা, বেলুন কেন বেশি ফোলালে দুম ফটাস করে ফেটে যায়?
দাদা বলেছিল, ওমা, তাও জানিস না! দ্যাখ তা হলে!
দাদা তখন মিলিকে কাতুকুতু দিতে শুরু করল৷ মিলি একেবারে কাতুকুতু সহ্য করতে পারে না৷ সে হাসতে হাসতে যত বলতে লাগল, আর না, আর না, দাদা ততই তাকে জোর করে আরও বেশি কাতুকুতু দিতে লাগল৷ মিলি মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল, আর তার মনে হল এক্ষুনি পেটটা ফেটে যাবে৷
একসময় থেমে গিয়ে দাদা বলল, এবার বুঝলি তো?
কিছুই বোঝা গেল না৷ দাদাটা একদম বাজে৷
মা অনেক সময় দাদাকে বকুনি দিয়ে বলে, এই অভি, তুই ওরকম করিস কেন রে? ছোট বোন একটা কিছু জানতে চাইলে ঠিক মতন বুঝিয়ে দিতে পারিস না? এই বয়েসে তো অনেক কিছু জানতে চাইবেই!
দাদা উত্তর দেয়, যতদিন এসব জানতে-বুঝতে না পারে ততদিনই ভালো৷ বড় হয়ে তো কত কিছু জানতে জানতে লাইফ হেল হয়ে যাবে!
সেই থেকে আর দাদাকে সে কিছু জিজ্ঞেস করে না৷ লাইফ হেল মানেই বা কী?
স্কুল ফ্রক পরে নিয়ে খাবার টেবিলে বসে মিলি জিজ্ঞেস করল, মা, তুমি যখন খুব ছোট ছিলে, তখন কোনো পক্ষিরাজ কিংবা পরি দেখেছ?
মা কয়েক মুহূর্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, খুব ছোটবেলায় ওসব কিছু দেখিনি, তবে বড়বেলায় একটা পরি দেখেছি৷
খুব উৎসাহ পেয়ে মিলি বলল, কোথায় দেখেছ? কোথায়? কোথায়?
মা বললেন, পরি কিন্তু তার ডানা নেই৷ সে তো আমার সামনেই বসে আছে৷
মিলি চমকে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখল, আর তো কেউ নেই!
তারপর সে বুঝতে পেরে হাত-পা ছুড়ে বলল, মা, ভালো হচ্ছে না বলছি! তুমি আমার সঙ্গে…
মা হাসতে হাসতে বললেন, আমি মোটেই মিথ্যে বলিনি৷ পরিরা তো দেখতে বিচ্ছিরি হয়, তুইও সেরকম বিচ্ছিরি৷ সেই জন্যই তো বলছি৷
তার মানে মায়ের কাছ থেকেও কিছু জানা গেল না৷
মিলিকে আর কেউ পরির মতন দেখতে বলে না যদিও, কিন্তু তার গায়ের রং খুব ফর্সা, তাই নতুন কেউ এসেই বলে, ইশ, মেয়েটি ঠিক পুতুলের মতন ফুটফুটে!
এই কথাটাও শুনতে মোটেই ভালো লাগে না মিলির৷ সে মানুষ, পুতুল হবে কেন? আর ইচ্ছে করে তো তার গায়ের রং ফর্সা হয়নি৷ ইচ্ছে করলে কালোও হওয়া যায় না৷
পুজোর ছুটি পড়তেই বাবা সবাইকে দিল্লি চলে আসতে বললেন ফোনে৷ তিনি এখন কলকাতায় আসতে পারছেন না৷ সবাইকে নিয়ে ওইদিকে বেড়াবেন৷
দাদা যেতে পারবে না৷ সে তার বন্ধুদের সঙ্গে বেঙ্গালোর যাবে, আগেই ঠিক করে ফেলেছে৷ মায়ের সঙ্গে মিলি একদিন রাজধানী এক্সপ্রেসে চেপে বসল৷
দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে বাবা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন৷ সেখানে থাকা হল মাত্র দু’দিন৷ বাবা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, বেড়াতে যাওয়া হবে পাহাড়ে, অনেক উঁচুতে, সেই জায়গাটার নাম মানালি৷
যাবার আগের দিন দিল্লির বাড়ির ছাদে উঠেছে মিলি৷ বিকেলবেলা৷ এই ছাদে সাজানো রয়েছে অনেকগুলো ফুলের টব৷ তাতে কতরকমের ফুল৷ যেন ছাদের ওপর একটা বাগান৷
মিলি সেই টবগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছে, এমন সময় হঠাৎ আকাশটা অন্ধকার হয়ে গেল৷ এ কী, এত তাড়াতাড়ি তো সন্ধে হবার কথা নয়৷ কোথা থেকে ঘন কালো মেঘ সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে৷ এই রে, বৃষ্টি হবে নাকি? কাল গাড়িতে অনেকদূর যেতে হবে৷ বাবা বলেছিলেন, বৃষ্টি হলে পাহাড়ি রাস্তায় যাওয়া খুব মুস্কিল৷
কিন্তু দমকা হাওয়ায় কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই মেঘ কেটে গেল৷ আবার আকাশ পরিষ্কার৷
মিলি আবার ফুলগুলো দেখতে লাগল৷
হঠাৎ একবার মুখ তুলতেই সে দেখতে পেল, কাছেই একটা বাড়ির ছাদে তারই বয়েসি একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে এদিকেই৷
চোখাচোখি হতেই মিলি চোখ নামিয়ে নিল৷
একটা ফুলের টব একটুখানি কাত হয়ে গেছে, সোজা করে দিল সেটিকে৷
আবার মুখ তুলতে সে দেখল, মেয়েটি এখন চেয়ে আছে এদিকেই৷
এবার মিলি হাসল৷ মেয়েটিও হাসল৷
মিলি আগেই লক্ষ করেছিল, দিল্লিতে এ পাড়ায় সবাই বাংলাতে কথা বলে৷ তাই সে বাংলাতেই জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?
মেয়েটি একটুক্ষণ যেন চিন্তা করল, নিজের নাম বলবে কি না ভাবছে? দিল্লিতে বুঝি কেউ কারুর নাম জিজ্ঞেস করে না?
মেয়েটি বাংলাতেই বলল, আমার নাম লিমি৷ তোমার নাম কী?
মিলি নিজের নাম জানাতেই মেয়েটি হি-হি করে হেসে উঠল৷
মিলি অবাক হয়ে বলল, হাসছ কেন? আমার নামটা খারাপ?
মেয়েটি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না, না, তোমার নামটা বেশি ভালো৷ আমার লিমি নামটা উলটে দিলেই তোমার নাম হয়ে যায়৷ উলটে দিই?
মিলি ভাবল, নিজের নাম কি কেউ ওল্টায় নাকি? বাবা-মায়ের রাখা নাম কি বদলানো যায়?
মিলি আর কিছু বলার আগেই নীচ থেকে মা তার নাম ধরে দু’বার ডাকলেন৷
মিলি ছাদের দরজার কাছে গিয়ে বলল, আসছি, একটু পরে৷
মা বললেন, এক্ষুনি আয়৷ দ্যাখ, কে এসেছেন!
মিলি আবার এদিকটায় এসে বলল, আমি এখন নীচে যাচ্ছি৷ মা ডাকছেন৷ তোমার সঙ্গে আবার পরে কথা বলব৷
মেয়েটির মুখখানা যেন ম্লান হয়ে গেল৷ সে আপন মনে বলল, মা? মা, মানে, আমার তো মা নেই!
তা শুনে মিলির মনটাও একটু খারাপ হয়ে গেল৷ কারুর মা নেই, তা সে ভাবতেও পারে না৷
কিন্তু এখন তো আর কথা বলা যাবে না৷ মা আবার ডাকছেন৷ সে নেমে গেল নীচে৷
নিতুমামা থাকেন দিল্লিতে, তিনি দেখা করতে এসেছেন৷
নিতুমামা বছরে একবার করে যান কলকাতায়, তাই তাঁকে মিলি ভালোই চেনে৷ নিতুমামা খুব আমুদে লোক, সব সময় হৈচৈ করতে ভালোবাসেন৷ খুব লম্বা চেহারা তাঁর, বাবার চেয়েও লম্বা৷
মিলিকে দেখেই নিতুমামা বললেন, মিল মিল মিল মিল মিল! গিল গিল গিল গিল গিলি! এতক্ষণ তুই কোথায় রে ছিলি ছিলি ছিলি!
নিতুমামা এরকম পদ্য পদ্য করে কথা বলেন৷ দাদা থাকলে সেও মিলিয়ে মিলিয়ে উত্তর দিতে পারে৷ মিলি তা পারে না৷
একবার দাদাকে দেখে নিতুমামা বলেছিল, আমার ভাগ্নে, নামটি যার অভি৷ সে তো হবেই মস্ত বড় কবি৷ জিলিপি দিয়ে কাঁচালঙ্কা খাওয়াই তার হবি৷
দাদা সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, আমাদের আছে নিতুমামা মহারাজ, রাবড়ি খেয়েই ঢেঁকুর তোলেন, আর নেই কোনো কাজ৷ মাঝে মাঝে তেড়ে-ফুড়ে গান গান, কালোয়াতি মাছ খাম্বাজ৷
এই ছড়াটা মনে আছে মিলির, শুধু কালোয়াতি মাছ খাম্বাজ-এর মানে জানে না৷
যাই হোক, অনেক রাত পর্যন্ত গল্প-টল্প হল৷ কাল খুব ভোরে বেরুতে হবে৷
গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বাবা, পেছনে মা ও মিলির পাশে নিতুমামা৷ এখন ট্রেনের জানলার কাচ এমন ঘষা থাকে যে বাইরের কিছু দেখা যায় না৷ কিন্তু চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে চোখে পড়ে কত সুন্দর সুন্দর দৃশ্য৷
প্রথম কয়েক ঘণ্টা সমতলের সোজা রাস্তা৷ তারপর রাস্তাটা উঠে গেল পাহাড়ে৷ ঘুরে ঘুরে রাস্তাটা চলেছে পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙিয়ে, দু’পাশে কোথাও ঘন জঙ্গল, কখনো ঝর্না বা নদী৷ মিলি প্রাণভরে দেখছে সেই সব অপূর্ব দৃশ্য৷
কিন্তু শান্তিতে সব কিছু কি দেখার উপায় আছে! নিতুমামা অনবরত গল্প করে চলেছেন৷ সেই সব গল্প শুনতেই হবে, না হলে তিনি কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দেবেন, তার সঙ্গে আছে খাওয়া৷ নিতুমামা খেতে খুব ভালোবাসেন৷ মা এনেছেন বাক্স বাক্স সন্দেশ আর কয়েক প্যাকেট বাদাম৷ নিতুমামা নিজেও এনেছেন অনেক চকলেট, চানাচুর আর শোনপাপড়ি৷ সবসময় তো এইসব টুকটাক খাওয়া চলছেই, মাঝে মাঝে কোনো পাহাড়ি গ্রামে ঝুপড়ি চায়ের দোকান দেখলেই গাড়ি থামাতে বলছেন৷
বাবা দু’একবার বললেন, নিতু, এতবার থামলে খুব দেরি হয়ে যাবে, পৌঁছোতে হবে রাত্তিরের আগে৷
মা বললেন, আহা, চা খেতে ইচ্ছে হলে খাওয়া যাবে না? আমিও তো বেশি চা খাই৷
প্রথম রাতটা কাটাতে হল মান্ডি শহরে৷ তার পরের দিন মানালি৷
একটা সরকারি গেস্ট হাউজ রিজার্ভ করা আছে৷ সে বাংলো বাড়িটি ভারি চমৎকার৷ তিনখানা ঘর, সামনে খোলা বারান্দা৷ সেই বারান্দার নীচে একটা খোলা মাঠের মতন, তবে দৌড়ে দৌড়ে সেটা পার হতে গেলে এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হবে৷ সেখানে গভীর খাদ৷ তা এতই গভীর যে তলাটা প্রায় দেখাই যায় না৷ একবার পা ফস্কে সেখানে পড়ে গেলে দেহটাই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না৷
খাদের ওপাশে সারি সারি পাহাড়৷ চূড়ায় বরফ ঢাকা৷
এখানকার আকাশ মাঝে মাঝেই মেঘে ঢাকা থাকে, বৃষ্টি পড়ে যখন-তখন৷ আবার হঠাৎ হঠাৎ সব মেঘ সরে যায়, আলোয় ঝলমল করে সব দিক৷ তখন বরফ ঢাকা পাহাড়গুলোকে মনে হয় বরফের তৈরি৷ আবার এক এক সময় সেখানে সোনালি রং ঝিলিক মারে৷
মিলি সঙ্গে অনেকগুলো গল্পের বই এনেছে৷ বারান্দার চেয়ারে বসে বসে বই পড়তেই সময় কেটে যায়৷ মাঝে মাঝে চোখ তুলে দূরের পাহাড় দেখে নেয়৷
বিকেলবেলা মিলি সেই বারান্দায় বসে আছে, একসময় হঠাৎ দেখতে পেল, সামনের খোলা জায়গাটায় একটা মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ তারই বয়েসি হবে, একটা হলুদ রঙের সোয়েটার পরা, সে পেছন ফিরে আছে বলে মুখটা দেখা যাচ্ছে না৷
এ মেয়েটা কোথা থেকে এল?
বই মুড়ে রেখে মিলি তাকিয়ে রইল সেদিকে৷
মেয়েটি একটা সাদা ফ্রকের ওপর হলুদ সোয়েটার পরে আছে বটে, কিন্তু খালি পা, মোজাও নেই৷ এখানে দারুণ শীত, খালি পায়ে কেউ হাঁটতে পারে? ওর ঠান্ডা লেগে যাবে না!
মিলি চেঁচিয়ে ডাকল, এই, এই!
মেয়েটি মুখ ফেরাল৷ এবার আর একটি চমক লাগল মিলির৷ এ মেয়েটিকে খুব চেনা চেনা লাগছে৷ কোথায় দেখেছে? খুব শিগগিরই—
তারপরই মনে পড়ল, এ তো সেই দিল্লির পাশের বাড়ির ছাদে দেখা মেয়েটা! ও একটা মজার কথা বলেছিল৷ প্রথমে নিজের নাম বলেছিল লিমি, তারপরই বলেছিল, আমার নামটা উল্টে দিই?
লিমি ওল্টালেই মিলি৷ কেউ এভাবে নিজের নাম ওল্টায় নাকি?
মিলি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এই, তুম কব আয়া?
এখানে সবাই হিন্দিতে কথা বলে৷ তাই মিলির মুখ দিয়ে হিন্দিই বেরিয়ে এল৷
মেয়েটি একটু যেন চিন্তা করে, বাংলাতেই উত্তর দিল, এই তো একটু আগে!
ওই মেয়েটাও যে এখানে বেড়াতে আসবে, তা মিলি জানত না৷ অবশ্য, জানবেই বা কী করে? বেশি কথা তো হয়নি৷
মিলি বলল, তুমি এখানে চলে এসো৷ ওখানে খালি পায়ে ঘুরলে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে৷
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল, তুমি এখানে এসো৷ এখানে বেড়াতে খুব ভালো লাগবে৷
মিলির মনে হল, মেয়েটিই ঠিক বলছে৷ এত সুন্দর জায়গায় এসে, বারান্দায় বসে বই পড়ার কোনো মানে হয় না৷
সে ঘর থেকে নিজের একজোড়া মোজা আর জুতো নিয়ে এল৷ তারপর নেমে এল সেই খোলা জায়গাটায়৷ মেয়েটির কাছে এসে বলল, তুমি চট করে এই মোজা আর জুতো পরে নাও৷
মেয়েটি কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মিলির দিকে৷
মিলি এবারে দেখল, ওর গায়ের সোয়েটারটাও অনেকখানি ছেঁড়া৷ সে এবারে প্রায় শিউরে উঠল৷ এ মেয়েটা কীরকম, পাহাড়ের দেশে বেড়াতে এসেছে, একটা ভালো সোয়েটারও আনেনি?
মিলি বলল, শিগগির মোজা আর জুতো পরো৷ তারপর ভেতরে এসো, আমার একটা সোয়েটার তোমাকে দেব৷
মেয়েটি একটু চিন্তিত ভাবে বলল, একটু আগে রাস্তায় দেখলাম, একটা ছেলে আর মেয়ে, মাথায় করে কী যেন নিয়ে যাচ্ছে, তাদেরও পায়ে, ওই কী যেন বললে, কী যেন, মোজা? মোজা আর জুতো পরে নেই৷ তাদেরও সোয়েটার ছেঁড়া৷ তাই আমি ভাবলাম, এখানে বুঝি সবাইকেই ছেঁড়া জামা পরে, খালি পায়ে থাকতে হয়!
মিলি বলল, ধ্যাৎ! কী সব অদ্ভুত কথা বলছ৷ ওরা নিশ্চয়ই গরিব৷ জুতো-মোজা কিনতে পারে না৷
মেয়েটি বলল, গরিব? গরিব মানে কী?
মিলি বলল, গরিব মানে, যাদের টাকা-পয়সা কম থাকে৷
মেয়েটি মুখস্থ করার মতন বলতে লাগল, গরিব মানে টাকা-পয়সা কম৷ টাকা-পয়সা কম৷ টাকা-পয়সা কম৷
মিলি বলল, ওদের খালি পায়ে থাকা অভ্যেস হয়ে যায়৷ তুমি দিল্লিতে এরকম গরিব ছেলেমেয়ে দেখোনি?
সে কথার উত্তর না দিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে তোমার জুতো-মোজা দিচ্ছ, ওদের কেন দাও না?
মিলি বলল, দিই তো৷ আমার জামা-টামা ছোট হয়ে গেলে মা অন্যদের দিয়ে দেয়৷ আমাদের কলকাতার বাড়িতে যে কাজের দিদি আছে, তার মেয়ে তো আমারই জামা-জুতো পরে৷ সে আমার থেকে একটু ছোট৷ তাকে আমার বই-ও দিই৷ দুটো খেলনাও দিয়েছি৷
মেয়েটি বলল, রাস্তার ওই ছেলে-মেয়েদের দাও না কেন?
মিলি বলল, এই রে, সবাইকে আমি দেবো কী করে? গরিব যে অনেক৷ আমার তো অত জামা-টামা নেই৷
মেয়েটি আবার মুখস্থ করার মতন বলল, গরিব অনেক! গরিব অনেক! গরিব অনেক৷
তারপর থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, গরিব হওয়া ভালো না খারাপ?
মিলি বলল, তুমি তাও জানো না? গরিবদের কত কষ্ট…নাও, নাও, শুধু কথাই বলছ, আগে মোজা দুটো পরে নাও৷ ঠান্ডা লেগে তোমার অসুখ করবে৷
মেয়েটি বলল, আমার ঠান্ডা লাগে না৷ অসুখও করে না৷ চলো, একটু বেড়াই৷ ওই যে সাদা সাদা পাহাড়, ওখানে যাই৷
মিলি বলল, ধ্যাৎ! ওখানে যাবে কী করে? মস্ত বড় খাদ দেখোনি? তা ছাড়া, বাবা বলেছেন, পাহাড়গুলো খুব কাছে মনে হলেও আসলে অনেক দূর৷ ওখানে যাওয়া যায় না৷
মেয়েটি সরলভাবে বলল, ও, যাওয়া যায় না বুঝি? আচ্ছা, আমি কি তোমার থেকে একটু বড় না তুমি বড়?
মিলি জিজ্ঞেস করল, তোমার বয়েস কত?
মেয়েটি বলল, বয়েস? তার মানে? বয়েস কাকে বলে? ওঃ হো, বুঝেছি, বুঝেছি৷ কী জানি, বয়েস কত জানি না৷ আমি বলছি—
হাত দিয়ে সে বোঝাল, লম্বায় সে কতটা৷
মিলি বলল, এসো মেপে দেখি৷
ওরা দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়াল, মিলি মাথায় হাত দিয়ে বলল, তুমি আমার চেয়ে একটু মোটে লম্বা৷
মেয়েটি বলল, ও কিছু না৷ ঠিক হয়ে যাবে৷
মেয়েটির কথাবার্তা কেমন যেন অদ্ভুত৷ একটু বেশি লম্বা হলে তা আবার ঠিক হয়ে যায় কী করে?
ওর গায়ে গা ছোঁয়াবার পর মিলির গায়েও কেমন যেন ইলেকট্রিক শক লাগার মতন হয়েছিল৷
এবার মিলির মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠল৷
এ কি সত্যিই মেয়ে, না অন্য কিছু?
ভূত?
যাঃ, এখনো দিনের আলো রয়েছে, মেয়েটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ও ভূত হবে কী করে? তা ছাড়া, বাবা বলেছেন, ভূত-টুত কিছু নেই৷ মানুষ কখনো ভূত হতে পারে না৷ কেউ কখনো ভূত দেখেওনি৷ সব গল্প!
তবে কি অন্য গ্রহের থেকে এসেছে? আকাশে কত গ্রহ-নক্ষত্র আছে, তার কোনোটাতে কি মানুষের মতন আর কেউ নেই? সিনেমায় যে দেখায়, কারা যেন মাঝে মাঝে আকাশ থেকে নেমে আসে এখানে?
কিন্তু নিতুমামা বলেছে, ওসবও বানানো গল্প! কী সব কঠিন কঠিন ব্যাপার আছে, তাই অন্য গ্রহে মানুষ থাকলেও তারা আসতে পারবে না৷
মেয়েটি এবার মিলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, তুমি কি ভালো৷ তুমি কি সুন্দর৷ আমি ঠিক তোমার মতন হতে চাই৷ এবার দ্যাখো তো, আর কোনো তফাত আছে কিনা৷ লম্বাটা ঠিক করে নিয়েছি৷ আর দ্যাখো, আমার নাকের ফুটো দুটো ছোট ছিল, আর চোখ দুটো, ভুরু….
মিলি আবার কেঁপে উঠল৷ মেয়েটির চেহারা বদলে যাচ্ছে, আয়নায় মিলি নিজেকে যেমন দেখে, ওকেও ঠিক সেইরকম দেখাচ্ছে৷
কাঁপা কাঁপা গলায় মিলি জিজ্ঞেস করল, সত্যি করে বলো তো, তুমি কে?
মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল, আমি তোমারই মতন একটি মেয়ে৷ আমার নাম মিলি৷
মিলি বলল, না, তুমি কাল বলেছিলে, তোমার নাম লিমি৷
সে বলল, তখন একটু ভুল হয়েছিল৷ আমি যে তোমারই মতন হতে চাই, তাই নামটাও এক হওয়া দরকার৷
মিলি বলল, কেন, তুমি আমার মতন হতে চাও কেন? আমি মোটেই চাই না, আর কেউ আমার মতন দেখতে হোক৷
মেয়েটি বলল, কিন্তু এখন যে হয়ে গেছি? দু’জনে একইরকম৷ তোমার মায়ের সামনে গিয়ে যদি বলি, আমিই আসল মিলি, তাহলে কী হবে? আমাদের দু’জনের মধ্যে কে তোমার মায়ের মেয়ে, তা তিনি চিনতে পারবেন?
মিলি জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন! তুমি তো সত্যি সত্যি আমার মতন নও৷ তুমি সেজেছ৷ আসল আর নকল দেখলেই বোঝা যায়৷ তুমি কী করে এরকম সাজলে? তুমি কি ম্যাজিক জানো?
সে কথার উত্তর না দিয়ে সে বললে, চলো না, তোমার মায়ের কাছে একবার যাই, পরিক্ষা করে দেখি!
মিলি বলল চলো, এক্ষুনি চলো!
মেয়েটি আবার হেসে বলল, না, না, আমি এমনি বলছিলাম৷ আমাদের ওসব করতে নেই৷ কারুকে পরিক্ষা করা নিষেধ৷ ভয় দেখানো নিষেধ৷ তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ?
মিলি বলল, রাগ করব কেন? কিন্তু এখনো বললে না কেন, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?
মেয়েটি ওপরের দিকে আঙুল তুলে বলল, ওপর থেকে!
মিলি খানিকটা অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, আকাশ থেকে? যা! আকাশ থেকে কেউ আসতে পারে নাকি? সত্যি করে বলো৷
মেয়েটি বলল, একদম সত্যি কথা৷ ওই আকাশের অনেক দূরে আমার বাড়ি৷
মিলি বলল, সেখান থেকে তুমি উড়ে উড়ে এসেছ? তুমি কি পরি?
মেয়েটি একটু ভেবে বলল, পরি কাকে বলে তা তো জানি না৷ তবে উড়ে উড়ে এসেছি, এটা সত্যি!
মিলি বলল, রকেটে চেপে?
মেয়েটি বলল, নাঃ, এখন আমাদের রকেটও লাগে না৷ এমনিই পারি৷
মিলি বলল, পাখিরা আকাশে ওড়ে, তাদের ডানা থাকে৷ পরিদেরও ডানা থাকত৷ তোমার ডানা নেই, তুমি উড়বে কী করে?
মেয়েটি বলল, সত্যি বলছি, এখন আর ডানাও লাগে না৷ অনেক আগে লাগত৷
মিলি বলল, পরিরাও অনেক আগে আসত৷ এখন আসে না৷ আমার নিতুমামা বলেছেন, অন্য কোনো গ্রহ থেকে কেউ এখানে আসতে পারে না৷ সিনেমায় যা দেখি, সব মিথ্যে৷ তুমিও মিথ্যে?
মেয়েটি বলল, তোমার নিতুমামা জানে না, আমি তো একা নই, আরও অনেকে আসে, এখানে ঘুরে বেড়ায়, কয়েকদিন থেকে আবার চলে যায়৷ তোমরা তাদের দেখতেও পাও না৷ এই পৃথিবীতে তোমরা কীরকমভাবে বেঁচে থাকো, নিজেদের মধ্যে কেমন ব্যবহার করো, কী খাও, কী পরো, এসব জেনে যাই৷ আমাদের ইয়ে, কী যেন বলে, গুরুমশাই, তাঁরা এসব জানতে চান৷ আমরা অনেকরকম সাজতে পারি৷ ওই যে তোমাদের বাড়ির পাশে একটা ছোট্ট গাছ দেখছ, ওর মধ্যেও আমাদের একজন রয়েছে, সে তোমাদের বাড়ির ভেতরটা সব দেখছে৷ কাল বিকেলে একটা খুব ঝড় উঠবে, তাতে ওই গাছটা ভেঙে পড়ে যাবে৷ তোমরা ভাববে, ঝড়ে তো গাছ পড়েই৷ আসলে ওই গাছটার মধ্যে আমাদের যে আছে, সে চলে যাবে৷ ওই যে আকাশে অত পাখি ওড়ে, ওদের মধ্যে এক একটা পাখি সত্যি নয়, আমাদের কেউ৷ তোমরা বুঝতে পারো না, গাছ তোমাদের দেখছে, পাখিরা তোমাদের দেখছে, একটা ছোট্ট কাঠবিড়ালি, সেও মানুষকে দেখছে৷ শুধু হাওয়া, হাওয়াও তোমাদের দেখে৷
মিলি বলল, তুমি আমার মতন সেজেছ৷ তোমাকে আসলে দেখতে কেমন?
সে বলল, দেখবে? তারপরেই কিন্তু আমাকে চলে যেতে হবে৷ তবে আমি আবার আসব৷ আমার সব কাজ শেষ হয়নি, তখন আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে৷ তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে৷
এক মুহূর্তে মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে গেল৷ আবার পরের মুহূর্তে সেখানে দেখা গেল প্রদীপের আলোর মতন একটা আলোর শিখা৷ শিখাটা এক এক সময় বড় হতে লাগল, তখন মনে হল যেন একটা মেয়ের মতন; আবার, আবার কখনো সেটা দুলতে লাগল৷
আকাশে এইসময় কোথা থেকে ঘনিয়ে এল কালো মেঘ৷ ঝড় উঠল, তার মধ্যে মিলিয়ে গেল সেই আলোর শিখা৷
সেই আলোর শিখায় মিলির মনটা এমনই ভালো হয়ে গেল যে সে ঝড়ও টের পেল না৷ দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে একই জায়গায়৷
এদিকে ঝড় দেখে জানলা-টানলা বন্ধ করতে গিয়ে মা দেখলেন মিলি বারান্দায় নেই৷ ডাকতে লাগলেন, মিলি, মিলি, কোথায় গেলি?
বাবাও ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন, মিলি দাঁড়িয়ে আছে ফাঁকা জায়গায়৷ তিনি দৌড়ে এসে মিলির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন৷
বারান্দায় ওঠার পর মা বারবার বলতে লাগলেন, ওপাশে কেন দাঁড়িয়েছিলি? ঝড়ের মধ্যে? মাথায় যদি বাজ পড়ত?
মিলি কিছু বলল না৷ এখন তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না৷ তার মুখখানা হাসি হাসি৷
সে দেখল, ঝড়ের ঝাপটা থেকে বাঁচার জন্য দুটো ঘুঘু পাখি বারান্দার এক কোণের রেলিং-এর ওপর বসে আছে৷
মিলি সেদিকে তাকিয়ে ভাবল, এই পাখি দুটোও কি ওরা? পাখি দুটো মিলিদের দেখছে৷ আর ছোট্ট ফুলগাছটা হেলছে-দুলছে৷ সেও দেখছে মানুষদের৷
—