পরিসর
সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। ভোরবেলা থেকে আকাশটা মেঘলা। ভেজা হাওয়ায় ডালপালা উথাল-পাথাল করছে। চারিদিকের গাছগাছালিতে বৃষ্টি-থামা আকাশে সারারাত ডালে-ভেজা পাখিগুলো এখন লাফিয়েঝাঁপিয়ে ডানা শুকোচ্ছে।
জায়গাটা ভারতবর্ষ আর বার্মার সীমান্তবর্তী একটি ছোটো গ্রাম। নাম ‘মোরে’। মোরের পাহাড়ের ওপরের ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে আছি। দু-পেয়ালা চা খাওয়া হয়ে গেছে, এক্ষুনি চান করতে যাব এমন সময় চোখে পড়ল নীচ থেকে পাহাড়-ঘেরা রাস্তা বেয়ে কালো শাড়ি-পরা এক মহিলা ডাকবাংলোর দিকে উঠে আসছেন।
একজন মহিলার আজ সকালে আমার কাছে আসার কথা ছিল। তবে, এত সকালে নয়।
ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। ইন্টারেস্টিং মানে, কলকাতায় আমি এক মহিলার কাছ থেকে একটি চিঠি পাই কিছুদিন আগে। মনে করা যাক, তাঁর নাম শ্রীমতী। শ্রীমতী খুব রাগের সঙ্গে লিখেছিলেন যে, আপনারা লেখকরা বড়োই নিষ্ঠুর। আপনাদের লেখায় প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় বিবাহিতা মহিলারা তাঁদের প্রেমিকদের সঙ্গে কত সহজে মেলামেশা করেন, কত সহজে তাঁরা স্বামীর কাছ থেকে যা পাননি তা আনন্দের সঙ্গে পেতে পারেন অন্য করো কাছ থেকে। অথচ বাস্তবজীবনে আমাদের স্বামীরা কোনো সময়েই ঘুমিয়ে থাকেন না। আমাদের মনের মতো কেউ কাছে এলেই চোখ বড়ো বড়ো করে জেগে থাকেন। কিন্তু, কেন? কেন আমরা বাস্তবে স্বামী ছাড়া মন খুলে কথা বলার মতো একজন লোকও জীবনে পাই না? পাই না এমন কাউকেই, যাকে হয়তো আমি ভীষণভাবে চাই। বাস্তবে আপনাদের গল্প সত্যি হয় না কেন?
এ চিঠির মধ্যে আমার ‘কোয়েলের কাছে’ উপন্যাসের একটি বিশেষ মুহূর্তের কথার উল্লেখ ছিল। শ্রীমতী ক্রোধের সঙ্গে জানতে চেয়েছিলেন যে, এমন এমন মুহূর্ত জীবনে আসে না কেন? যদি আসেই না, তবে এ নিয়ে লেখালেখি কেন?
চিঠি অনেকেই লেখেন প্রিয় লেখককে। কোনো লেখক উত্তর দেন, কোনো লেখক বা দেন না। কিন্তু সেসব চিঠিতে লেখকের লেখার কথা অথবা লেখকের প্রশংসা ছাড়া কিছু থাকে না। এ চিঠিটি ব্যতিক্রম ছিল। শ্রীমতী লেখক হিসেবে আমার বাস্তবতাকে কটাক্ষ করেছিলেন।
তাই অফিসের কাজে যখন মোরেতে যাচ্ছিলামই, যাওয়ার আগে একটি চিঠি লিখেছিলাম শ্রীমতীকে। বলেছিলাম, আমি সাত তারিখে (জুলাইয়ের) মোরে পৌঁছোব এবং আট তারিখ সকালে উনি যেন আমার সঙ্গে ডাকবাংলোয় দেখা করেন।
ততক্ষণে শ্রীমতী ডাকবাংলোর কাছে এসে হাজির।
হাতে একটি লেডিজ ছাতা। গায়ের রং কালো। বুদ্ধিমতী মুখ। বয়েস বোধ হয় তিরিশ-একত্রিশ হবে। বর্ষাবিধুর সকালের উথাল-পাথাল পটভূমিতে কালো শাড়ির এই বিক্ষুব্ধ মহিলাকে ভারি শান্ত দেখাচ্ছিল।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে আপ্যায়ন করলাম।
মহিলা অত্যন্ত সপ্রতিভ। আপ্যায়ন অগ্রাহ্য করে বললেন, আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতে এলাম।
বললাম, আড়াল থেকে মেঘনাদ বধ বাণ ছাড়ার চেয়ে সম্মুখ-সমর ভালো। অন্তত অনেক সৎ। বলুন, আমার ওপরে এত রাগ কেন?
রাগ, কারণ আপনি বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখেন।
সব গল্পই তো বানিয়েই লেখা হয়, যদিও কোথাও না কোথাও তার সত্য একটু থাকে, কষ্ট করে লুকিয়ে রাখা, চোখের-জলের মতো। কিন্তু বানিয়ে না লিখতে পারলে, লেখক কি হওয়া যায়?
আমি বলছি, মানে…।
এইটুকু বলেই, মহিলা নার্ভাস হাতে ওঁর কালো হাতব্যাগটার ওপর হাত বোলাতে লাগলেন যেন, খুব লজ্জা পাচ্ছেন এবং যা বলতে চাইছেন তা বলবেন কি না ভাবছেন।
আমি ওঁর সিঁথির সিঁদুরের দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং ওঁকে বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম।
উনি বললেন, আমার আপনাকে অনেক কথা বলার ছিল। আমি কোনো মনোমতো লোক পাই না বলার। পাইনি কখনোই। যদি বা কখনো পেয়েছি, বা বলেছি; তারা বোঝেওনি আমার কথা। যদি কোনো সুক্ষণে এমন লোকের দেখা পেয়েওছি, যে আমার কথা বুঝবে, তার আবার শোনার সময় হয়নি। আমি জানি, আপনি হয়তো বুঝবেন আমার কথা। কারণ, আপনারা, সাইকো-অ্যানালিস্টদেরই মতো। মানুষের মনে যখন ঝড় ওঠে, সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়; তখন আপনাদের কাছে এলে বোধ হয় শান্তি পাওয়া যায়। কারণ, আপনারা মানুষকে বোঝেন। মানুষই আপনাদের লেখার বিষয়। কিন্তু…।
একটু থেমে গিয়ে বললেন, আপনার কি শোনার মতো সময় হবে?
আমি বললাম, আজ তো রবিবার, আজ আমার ছুটি। ডাকবাংলোয় বসেই থাকতাম। নয়তো পড়তাম। কাজ কিছুই নেই আজ।— আপনি স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন কী বলার আছে আপনার।
শ্রীমতী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনার জন্যে খুব ভালো করে হরিণের মাংস রান্না করেছি। আমি গিয়েই পাঠিয়ে দেব। খাবেন।
আমি হাসলাম, বললাম, বেশ। কিন্তু এ কি কথা শোনার পারিশ্রমিক?
শ্রীমতী হাসলেন। বললেন, ঠিক তা নয়। এটা প্রণামি। সাধু সন্দর্শনে এসেছি তো!
আমি সাধু কখনোই ছিলাম না, হতেও চাই না কোনোদিন। কিন্তু অসাধুও নই। তবে হরিণের মাংস খুব রেলিশ করে খাব। আমরা বড়ো আজেবাজে কথা বলছি, এবার আপনি আপনার কথা বলুন।
শ্রীমতী গলার মটরমালায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, কী দিয়ে যে আরম্ভ করি বুঝতে পারছি না। সব যে এলোমেলো হয়ে আছে, সমস্ত কথাগুলিই আমার বুকের মধ্যে; এই সকালেরই মতন।
আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স মাত্র পনেরো বছর। তখন সেক্স সম্বন্ধে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। জানতাম, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা কী, তবে সেই কী-টা কীরকম তা জানতাম না। বিয়ের পরই আমার স্বামী আমার অল্প বয়েস, আমার কচি মন এসব কিছুর কথা ভুলে গিয়ে আমার ওপর সেক্সটা এমনভাবে চাপিয়ে দিলেন যে, এই ষোলো বছরের বিবাহিত জীবনে কোনোদিন তাঁকে সম্মানের চোখে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। ওই ব্যাপারে আমিও যে একজন অংশীদার, আমার মন বা আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছারও যে একটা ভূমিকা আছে, এটা সেই ফুলশয্যার রাতে যেমন, আজও তেমনই; কোনোদিনও বুঝতে চাননি তিনি। কখনো বুঝতে চাননি যে, স্ত্রীকে খাওয়ালে পরালেই বা প্রতিরাতে তার শরীরের কাছে এলেই স্ত্রীকে ভালোবাসা হয় না।
কিন্তু তিনি দেখতে শুনতে ভালো। বিদ্বান। বুদ্ধিমান। ভালো চাকরি করেন। ভালো পরিবারের মানুষ।
এই ভীষণ কষ্ট ছাড়া, যে কষ্টর কথা কাউকে বলা যায় না; আমার আর কোনো কষ্ট নেই। তাই…
এ সময়ে আমি বাধা দিয়ে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসেন না।
শ্রীমতী হাসলেন। বললেন, পুরুষের অভিধানে ‘ভালোবাসা’র অর্থবাহী একটাই শব্দ আছে। সে শব্দটা বড়ো জ্বলন্ত। কিছু মনে করবেন না, খুব কম পুরুষই জানেন ভালোবাসা বলতে কী বোঝায়!
একটু থেমে বললেন, অথচ উনি যে আমাকে ভালোবাসেন না একথা ওঁকে বিশ্বাস করানো যাবে না। কারণ আমরা একসংসারে ষোলো বছর ধরে রয়েছি, মেয়েটিকে মানুষ করলাম ও এখনও করছি। এখনও বড়ো ডাবল-বেড খাটে নীল আলো জ্বালানো বেডরুমে শুচ্ছি—তবুও কী করে বলি যে আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি না? মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস অমুক হয়ে নেমন্তন্নে যাচ্ছি। লোকের সামনে ভালোবাসার অভিনয় করছি। তার পর প্রতিরাতে ফিরে এসে কড়িকাঠ বা ঘুরন্ত সিলিংফ্যান বা দেওয়ালের স্থির টিকটিকির দিকে চেয়ে একটি মৃতদেহ সমর্পণ করছি আমার স্বামীকে। কারণ, এতে তাঁর অবিসংবাদী অধিকার। পাঁচ-শো লোক খাইয়ে, বাজনা বাজিয়ে, খাজনা দিয়ে তিনি আমার শরীরের জবরদখল নিয়েছিলেন আজ থেকে বহু বছর আগে। তাঁর ‘মহাল’ তিনি ভোগ করবেন, এ অধিকার যা দিয়ে রুখতে পারি এমন লাঠিয়াল আমার তো নেই!
এই অবধি বলে, শ্রীমতী চুপ করে গেলেন।
আমিও অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। তার পর চৌকিদারকে ওঁর জন্যে চা আনতে বললাম। বললাম, আপনার যদি এতই অভিযোগ আপনার স্বামী সম্বন্ধে, তো তাঁর সঙ্গে থাকেন কেন? ডিভোর্স করলেই পারেন!
ভদ্রমহিলা চমকে মুখ তুলে চাইলেন। তার পর খুব অসহায় মুখে বললেন, তার পর? কী করে বাঁচব? আমাকে খাওয়াবে কে? আমি কলকাতার এক অখ্যাত স্কুল থেকে স্কুল-ফাইনাল পাস করেছিলাম। কী আমার যোগ্যতা? কে আমাকে চাকরি দেবে? কী করে চলবে? যাইহোক, তবু তো এই ঘরের আশ্রয়টা আছে। আছে মেয়েকে মানুষ করার দায়িত্বর ঘুমপাড়ানি ওষুধ। তবু এখন শুধু একজনকেই অনিচ্ছুক শরীর সমর্পণ করছি। তখন শুধুমাত্র বেঁচে থাকবার জন্যে কী কী যে করতে হবে তা তো আমার অজানা।
আমি হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, আপনার স্বামী ছাড়া জীবনে আর কেউ আপনার কাছাকাছি আসেননি?
শ্রীমতীর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, এসেছিলেন; এসেছিল। সেই স্মৃতিটুকু নেড়েচেড়েই তো দিন কাটাই।
কে সেই ভদ্রলোক? আপনার বিয়ের আগে দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে? না বিয়ের পরে?
পনেরো বছর বয়েসেই বিয়ে হয়েছিল আমার, তাই বিয়ের আগের প্রাপ্তবয়স্ক জীবন বলতে আমার সামান্যই ছিল। বিয়ের পরেই দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে।
হঠাৎই ভদ্রমহিলার চোখে-মুখে কী যেন এক আশ্চর্য নরম মহিমা আরোপিত হয়ে গেল। অনেকগুলো আলো যেন তাঁর বুকের অন্ধকার ঠাণ্ডা ঘরটাতে দপ করে জ্বলে উঠল। ভালোবাসা বা ভালোবাসার স্মৃতি যেমন করে আমাদের সকলের বুকের মধ্যেই জ্বলে ওঠে।
স্বগতোক্তির মতো উনি বললেন, তখন আমরা দার্জিলিংয়ে—উনি সেখানেই পোস্টেড। ভদ্রলোক ওঁরই নীচে কাজ করতেন। ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে জীবনে ভালোবাসা যে কত বড়ো পাওয়া তা বুঝতে পারিনি।
কী করে আপনাকে বোঝাব যে, উনি আমার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতেন। আমার বাঁ-হাতে একটা ব্যথা হত আর্থরাইটিসের তখন। অথচ তখন আমার একমাত্র মেয়ে আড়াই বছরের ছিল। ওকে কোলে-কাঁখে করে দার্জিলিংয়ের উঁচু নীচু পথে আমার স্বামীর সঙ্গে আমাকে যেতে হত এখানে-ওখানে। কোনোদিনও আমার স্বামী আমাকে বলেননি যে, খুকুকে আমার কোলে দাও। তোমার কষ্ট হচ্ছে। অথচ উনি দেখতে পেলেই দৌড়ে আসতেন। আমার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে খুকুকে কোলে নিতেন। বলতেন, বউদি! আপনার কষ্ট হচ্ছে; আমাকে দিন।
কোথাও কখনো একসঙ্গে খেতে বসে উনি সব সময়ে চোখ রাখতেন, আমি খাচ্ছি কি না? আমার জন্যে খাবার আছে কি না? মানে, আমার স্বামী কখনো যা আমাকে দেননি বা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে বুঝতেও পারেননি সেইসব সামান্য অথচ অসামান্য দানে উনি আমাকে সবসময়ই ভরিয়ে রাখতেন। মন আমার সবসময় কৃতজ্ঞতায়, ভালো লাগায় ওঁর প্রতি নুয়ে আসত। উনি আমাদের বাড়ি এলে, ওঁর জন্যে চা এনে ওঁর সামনে দশ মিনিট বসে থাকলে মনে হত যেন এক দারুণ পাওয়া পেলাম। তাঁর গলার স্বর, তাঁর চোখ-চাওয়া, সব যেন আমার কাছে দারুণ রোমান্টিক লাগত। মনে হত একেই বুঝি ভালোবাসা বলে।
বললাম, এবার চা-টা খান। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে একেবারে।
তার পর শুধোলাম, আপনি কখনো সেই ভদ্রলোকের শরীর চাননি? শুধু কি মনই চেয়েছিলেন?
শ্রীমতী হঠাৎ চমকে উঠলেন। পেয়ালা-ধরা হাতটা যেন একবার কেঁপে গেল।
বললেন, মিথ্যা বলব না আপনাকে। চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি খুব লাজুক ছিলেন। কখনো আমার কাছে শারীরিক কিছু দাবি করেননি। ইচ্ছে হয়তো ওঁর ছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে কখনো প্রকাশ করেননি। মনে পড়ে, একবার আমার স্বামী ট্যুরে গেছিলেন। আমি খুকুকে নিয়ে একা ছিলাম। উনি আমাদের পাশের বাংলোয় থাকতেন। সে সময়ে আমরা দুজনে দুজনের মনের খুব কাছাকাছি এসেছিলাম। কিন্তু শরীরের নয়। উনি ব্যাচেলার ছিলেন এবং স্বভাবত ভদ্রলোক ও রুচিসম্পন্ন বলে শরীরের চেয়ে মনকেই বোধ হয় বেশি দাম দিতেন।
আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। তার পর শুধোলাম, আপনার স্বামী আপনাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দিলেন?
উনি হাসলেন। বললেন, উনি এখানে নেই। নইলে একা নিশ্চয়ই আমাকে আসতে দিতেন না। সঙ্গে আসতেন।
আমি হেসে বসলাম, কেন? সাহিত্যিকরা বুঝি খুব খারাপ লোক হন?
উনিও হাসলেন। বললেন, না, তা নয়। তবে উনি কখনোই আমাকে একা কোথাও যেতে দেন না। ওঁর নিজের প্রয়োজন ছাড়া। উনি কাল গেছেন ইম্ফলে। অফিসের কাজে। তাই এত কথা একা একা বলতে পারলাম আপনাকে।
আমি বললাম, তা তো হল কিন্তু আমার ওপর রাগের কারণটা যে এখনও বোঝা গেল না।
শ্রীমতী বললেন, হয়তো আমি বুঝিয়ে বলতে পারলাম না। তা ছাড়া, এ হয়তো রাগ নয়; অভিমান। তার পর হঠাৎই বললেন, এবার আপনি আমাকে কিছু বলুন। আমার জীবনের এই অতৃপ্তি, এই অশান্তি সম্বন্ধে একজন লেখকের কী বলার থাকতে পারে তা আমি শুনতে চাই। বলুন, প্লিজ।
আমার কী মনে হয় জানেন? সমস্ত বিবাহিত মহিলারাই ‘কোয়েলের কাছে’র বউদিরই ছায়া। যদি কোনো বিবাহিতা মহিলা আমাকে বলেন, মানে, এমন মহিলা, যাঁদের অন্তত পাঁচ বছর বিয়ে হয়ে গেছে; যে স্বামী ছাড়া অন্য কেউই তাঁদের মনে দাগ কাটেননি, তাঁরা মিথ্যে কথা বলেন; শারীরিক সম্পর্কটা বড়ো কথা নয়। শরীর, আমার মনে হয়, চিরদিনই ইনসিডেন্টাল ছিল; এবং চিরদিনই থাকবে। আসল হল মন। মানুষের মনের মতো দামি জিনিস তার তো আর কিছুই নেই। মনে মনে যাকে সব কিছু দেওয়া যায়, তাকে শরীরটা দেওয়া তো কিছুই নয়। তবে আমাদের মধ্যে অনেকেই শরীরের বাধা ছাড়িয়ে মনকে দেখতে পাই না। আমাদের চোখ, বিশেষ করে পুরুষের চোখ; শরীরেই থেমে থাকে। শরীর পেরিয়ে শরীরের চেয়ে বহুগুণ দামি মনে পৌঁছোয়ই না।
উনি বললেন, তার পর?
আসলে কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কোনো ঝগড়াই নেই। যে স্বামীরা চিরদিন জেগে থাকতে চান, পাহারা বসিয়ে স্ত্রীর শরীর ও মনের জমিদারির মালিকানা বজায় রাখতে চান, তাঁরা জানেন না যে, লখিন্দরের বাসরঘরের লোহার ঘরেও সূক্ষ্ম শরীরে সাপের মতো প্রেমের প্রবেশ সম্ভব। জোর করতে গেলে, বাধা দিলে; সেই সূক্ষ্ম প্রেমকে শুধু ত্বরান্বিতই, ব্যাপ্তই করা হয়। আমার তো মনে হয়, আপনার উচিত আপনার স্বামীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা। কারণ তাঁর ব্যবহারই আপনার জীবনে অন্য কাউকে জানতে দিয়েছিল, কাছে আসতে দিয়েছিল মনের।
আরও বলুন। খুব ভালো লাগছে শুনতে।
উনি বললেন।
আপনি বোধ হয় জানেন না বা খোঁজ রাখেন না যে, জীবনের যেকোনো সম্পর্কেই অভ্যাস ও দস্তুরটাই বড়ো। সব সম্পর্ক পুরোনো হলে, একঘেয়ে হলে, তাতে ক্লান্তি ও বিরক্তি আসেই। খুব কম লোকই জানেন, সম্পর্ক নতুন রাখতে। এবং ‘সম্পর্ক’ কথাটার মানেটা কী?
অথচ পৃথিবীটাই এরকম! এরমধ্যেই আমাকে, আপনাকে, আমাদের সবাইকেই বাঁচতে হবে। তাই পথ চলতে যতটুকু ভালোবাসা, ভালো ব্যবহার পাওয়া যায়, তাই মনের কোণে জমিয়ে রাখতে হয়। এমন কোনো বর্ষার দিনে, একা জানলায় বসে, ঘরের ভেতরের অন্ধকারকে ভুলে গিয়ে ঘরের বাইরের একখানি আলোকিত বারান্দার দিকে চেয়ে কেয়াফুলের গন্ধভরা বাতাসে মুখ তুলে জীবনের গ্লানিকে ভুলতে চেষ্টা করতে হয়।
আপনাদের সাহিত্যিকদের জীবনও কি সেরকমই?
আমাদের প্রত্যেকের জীবনই, সাহিত্যিকের জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। অন্ধকার ঘরটাই বাস্তব। তারমধ্যেই বছরের সব দিন গোনা। তবু আবার প্রত্যেক নারী ও পুরুষের জীবনেই একটি করে আলোকিত বারান্দাও থাকে। সে বারান্দার স্বপ্ন দেখেই আমাদের প্রত্যেকেরই দিন কাটে। কখনো কখনো বা আমরা প্রত্যেকে মহুয়ার গন্ধ-ভরা কোনো সুন্দর চাঁদনি রাতে বা স্তব্ধ শীতের সোনালি দুপুরে পা টিপে-টিপে সেই বাসমতী বারান্দায় এসে দাঁড়াই। সেখানে এসে দাঁড়ালেই আমাদের বুকের মধ্যে তোলপাড় করে। ইচ্ছে করে, সমস্ত জীবন এই বারান্দাতেই আনমনে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু তা তো হয় না!
কেন হয় না? হয় না কেন?
হঠাৎ কোনো দাঁড়কাক কর্কশ গলায় ডেকে ওঠে। কোনো দানবীয় দোতলা বাস ডিজেলের ধোঁয়া ছড়িয়ে কুৎসিত গর্জন করে মাথার মধ্যের সব মিষ্টি-দুষ্টু ইচ্ছেগুলোকেপিষে দিয়ে চলে যায়। ঘরের মধ্যে থেকে স্বামী বা স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েরা সেই একঘেয়ে, পুরোনো সামাজিক চাহিদা বা কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে ভিতরপানে ডাক দেয়। আমরা সকলে এবং প্রত্যেকেই তাড়াতাড়ি আবার ঘরের অন্ধকারে ফিরে আসি। অভ্যেসে, একঘেয়েমিতে; সংসারের জাঁতাকলে। আমরা প্রত্যেকেই চোখের আড়ালে কান্না লুকিয়ে বেড়াই, হাসিখুশি আমরা প্রত্যেক বিবাহিত স্ত্রী ও পুরুষ। কখনো-সখনো, ন-মাসে ছ-মাসে, ঘুমে বা স্বপ্নে বা জাগরণে যখনই সেই আলোকিত বারান্দায় এসে দাঁড়াই একা একা; তখনই সেই শুকিয়ে-রাখা চোখের জল বাইরে আসে। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।
আমি জানি না, আপনাকে বোঝাতে পারলাম কি না যে, আপনার জীবনে, আমার জীবনে; ঘর এবং বারান্দা দুটোই সত্যি। দুটোই অবিচ্ছেদ্য। ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ আমরা প্রত্যেকেই প্রতিদিন ঘরের মধ্যে নি:শ্বাস নিই। এবং প্রশ্বাস ফেলি। এবং সেই একফালি স্বপ্নের আলোকিত ও বা’য় বারান্দাটুকুর জন্যেই বেঁচে থাকি। আপনি বাঁচেন, আমি বাঁচি; আমরা সকলে বাঁচি।
শ্রীমতী চুপ করে উদাস চোখে বাইরের দিকে চেয়ে রইলেন।
হঠাৎ আমার মনে হল, এত কথা বললাম, বানিয়ে বললাম না তো? এ কি আমার মনের কথা? এ কি সত্যি কথা? কথাগুলো কি বাইরের পাগল হাওয়ার সঙ্গে ভেসে গেল? না ওঁর মনে পৌঁছোল?
শ্রীমতী আমার দিকে মুখ ফেরালেন। দেখলাম, তাঁর দু-চোখে জল টলটল করছে। উনি বিদায়-সম্ভাষণ পর্যন্ত জানালেন না।
উঠে দাঁড়িয়ে, হাতটা জড়ো করলেন বুকের কাছে।
বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবার সময়ে, মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ঘরে ফেরার সময় হল।
দেখলাম, ওঁর জল-ভেজা মুখে এক আশ্চর্য প্রসন্ন হাসির আভাস ফুটে উঠেছে।
আমি বারান্দাতেই বসে রইলাম।
ঘরটা বড়ো অন্ধকার; বড়ো স্যাঁতসেঁতে।
আমি বারান্দাতেই বসে রইলাম।