মহাবস্ত্ববদান ‘রাজকোষ হতে চুরি! ধরে আন্ চোর, নহিলে নগরপাল, রক্ষা নাহি তোর— মুণ্ড রহিবে না দেহে!’ রাজার শাসনে রক্ষী দল পথে পথে ভবনে ভবনে চোর খুঁজে খুঁজে ফিরে। নগর-বাহিরে ছিল শুয়ে বজ্রসেন বিদীর্ণ মন্দিরে বিদেশী বণিক পান্থ তক্ষশিলাবাসী; অশ্ব বেচিবার তরে এসেছিল কাশী, দস্যুহস্তে খোয়াইয়া নি:স্ব রিক্ত শেষে ফিরিয়া চলিতেছিল আপনার দেশে নিরাশ্বাসে—তাহারে ধরিল চোর বলি। হস্তে পদে বাঁধি তার লোহার শিকলি লইয়া চলিল বন্দীশালে। সেই ক্ষণে সুন্দরীপ্রধানা শ্যামা বসি বাতায়নে প্রহর যাপিতেছিল আলস্যে কৌতুকে পথের প্রবাহ হেরি—নয়নসম্মুখে স্বপ্নসম লোকযাত্রা। সহসা শিহরি কাঁপিয়া কহিল শ্যামা, ‘আহা মরি মরি! মহেন্দ্রনিন্দিতকান্তি উন্নতদর্শন কারে বন্দী করে আনে চোরের মতন কঠিন শৃঙ্খলে! শীঘ্র যা লো সহচরী, বল্ গে নগরপালে মোর নাম করি শ্যামা ডাকিতেছে তারে, বন্দী সাথে লয়ে একবার আসে যেন এ ক্ষুদ্র আলয়ে দয়া করি!’ শ্যামার নামের মন্ত্রগুণে উতলা নগররক্ষী আমন্ত্রণ শুনে রোমাঞ্চিত; সত্বর পশিল গৃহমাঝে, পিছে বন্দী বজ্রসেন নতশির লাজে আরক্তকপোল। কহে রক্ষী হাস্যভরে, ‘অতিশয় অসময়ে অভাজন-’পরে অযাচিত অনুগ্রহ! চলেছি সম্প্রতি রাজকার্যে। সুদর্শনে, দেহো অনুমতি।’ বজ্রসেন তুলি শির সহসা কহিলা, ‘একি লীলা, হে সুন্দরী, একি তব লীলা! পথ হতে ঘরে আনি কিসের কৌতুকে নির্দোষ এ প্রবাসীর অবমানদুখে করিতেছ অবমান!’ শুনি শ্যামা কহে, ‘হায় গো বিদেশী পান্থ, কৌতুক এ নহে, আমার অঙ্গেতে যত স্বর্ণ-অলংকার সমস্ত সঁপিয়া দিয়া শৃঙ্খল তোমার নিতে পারি নিজদেহে; তব অপমানে মোর অন্তরাত্মা আজি অপমান মানে।’ এত বলি সিক্তপক্ষ্ম দুটি চক্ষু দিয়া সমস্ত লাঞ্ছনা যেন লইল মুছিয়া বিদেশীর অঙ্গ হতে। কহিল রক্ষীরে, ‘আমার যা আছে লয়ে নির্দোষ বন্দীরে মুক্ত করে দিয়ে যাও।’ কহিল প্রহরী, ‘তব অনুনয় আজি ঠেলিনু সুন্দরী, এত এ অসাধ্য কাজ। হৃত রাজকোষ, বিনা কারো প্রাণপাতে নৃপতির রোষ শান্তি মানিবে না।’ ধরি প্রহরীর হাত কাতরে কহিল শ্যামা, ‘শুধু দুটি রাত বন্দীরে বাঁচায়ে রেখো এ মিনতি করি।’ ‘রাখিব তোমার কথা’ কহিল প্রহরী। দ্বিতীয় রাত্রির শেষে খুলি বন্দীশালা রমণী পশিল কক্ষে, হাতে দীপ জ্বালা, লোহার শৃঙ্খলে বাঁধা যেথা বজ্রসেন মৃত্যুর প্রভাত চেয়ে মৌনী জপিছেন ইষ্টনাম। রমণীর কটাক্ষ-ইঙ্গিতে রক্ষী আসি খুলি দিল শৃঙ্খল চকিতে। বিস্ময়বিহ্বল নেত্রে বন্দী নিরখিল সেই শুভ্র সুকোমল কমল-উন্মীল অপরূপ মুখ। কহিল গদ্গদস্বরে ‘বিকারের বিভীষিকা-রজনীর’পরে করধৃতশুকতারা শুভ্র উষা-সম কে তুমি উদিলে আসি কারাকক্ষে মম— মুমূর্ষুর প্রাণরূপা, মুক্তিরূপা অয়ি, নিষ্ঠুর নগরী-মাঝে লক্ষ্মী দয়াময়ী!’ ‘আমি দয়াময়ী!’ রমণীর উচ্চহাসে চকিতে উঠিল জাগি নবভয়ত্রাসে ভয়ংকর কারাগার। হাসিতে হাসিতে উন্মত্ত উৎকট হাস্য শোকাশ্রুরাশিতে শতধা পড়িল ভাঙি। কাঁদিয়া কহিলা, ‘এ পুরীর পথমাঝে যত আছে শিলা কঠিন শ্যামার মতো কেহ নাহি আর!’ এত বলি দৃঢ়বলে ধরি হস্ত তার বজ্রসেনে লয়ে গেল কারার বাহিরে। তখন জাগিছে উষা বরুণার তীরে পূর্ব বনান্তরে। ঘাটে বাঁধা আছে তরী। ‘হে বিদেশী, এসো এসো, কহিল সুন্দরী দাঁড়ায়ে নৌকার’পরে, ‘হে আমার প্রিয়, শুধু এই কথা মোর স্মরণে রাখিয়ো— তোমা-সাথে এক স্রোতে ভাসিলাম আমি সকল বন্ধন টুটি হে হৃদয়স্বামী, জীবনমরণপ্রভু!’ নৌকা দিল খুলি। দুই তীরে বনে বনে গাহে পাখিগুলি আনন্দ-উৎসব-গান। প্রেয়সীর মুখ দুই বাহু দিয়া তুলি ভরি নিজবুক বজ্রসেন শুধাইল, ‘কহো মোরে প্রিয়ে, আমারে করেছ মুক্ত কী সম্পদ দিয়ে। সম্পূর্ণ জানিতে চাহি অয়ি বিদেশিনী, এ দীনদরিদ্রজন তব কাছে ঋণী কত ঋণে।’ আলিঙ্গন ঘনতর করি ‘সে কথা এখন নহে’ কহিল সুন্দরী। নৌকা ভেসে চলে যায় পূর্ণবায়ুভরে তূর্ণস্রোতোবেগে। মধ্যগগনের’পরে উদিল প্রচণ্ড সূর্য। গ্রামবধূগণ গৃহে ফিরে গেছে করি স্নান সমাপন সিক্তবস্ত্রে, কাংস্যঘটে লয়ে গঙ্গাজল। ভেঙে গেছে প্রভাতের হাট; কোলাহল থেমে গেছে দুই তীরে; জনপদবাট পান্থহীন। বটতলে পাষাণের ঘাট, সেথায় বাঁধিল নৌকা স্নানাহার-তরে কর্ণধার। তন্দ্রাঘন বটশাখা-’পরে ছায়ামগ্ন পক্ষিনীড় গীতশব্দহীন। অলস পতঙ্গ শুধু গুঞ্জে দীর্ঘ দিন। পক্কশস্যগন্ধহারা মধ্যাহ্নের বায়ে শ্যামার ঘোমটা যবে ফেলিল খসায়ে অকস্মাৎ, পরিপূর্ণ প্রণয়পীড়ায় ব্যথিত ব্যাকুল বক্ষ, কণ্ঠ রুদ্ধপ্রায়, বজ্রসেন কানে কানে কহিল শ্যামারে, ‘ক্ষণিকশৃঙ্খলমুক্ত করিয়া আমারে বাঁধিয়াছ অনন্ত শৃঙ্খলে। কী করিয়া সাধিলে দু:সাধ্য ব্রত কহি বিবরিয়া। মোর লাগি কী করেছ জানি যদি প্রিয়ে, পরিশোধ দিব তাহা এ জীবন দিয়ে এই মোর পণ।’ বস্ত্র টানি মুখ-’পরি ‘সে কথা এখনো নহে’ কহিল সুন্দরী। গুটায়ে সোনার পাল সুদূরে নীরবে দিনের আলোকতরী চলি গেল যবে অস্ত-অচলের ঘাটে, তীর-উপবনে লাগিল শ্যামার নৌকা সন্ধ্যার পবনে। শুক্ল চতুর্থীর চন্দ্র অস্তগতপ্রায়, নিস্তরঙ্গ শান্ত জলে সুদীর্ঘ রেখায় ঝিকিমিকি করে ক্ষীণ আলো; ঝিল্লিস্বনে তরুমূল-অন্ধকার কাঁপিছে সঘনে বীণার তন্ত্রীর মতো। প্রদীপ নিবায়ে তরীবাতায়নতলে দক্ষিণের বায়ে ঘননিশ্বসিতমুখে যুবকের কাঁধে হেলিয়া বসেছে শ্যামা। পড়েছে অবাধে উন্মুক্ত সুগন্ধ কেশরাশি সুকোমল তরঙ্গিত তমোজালে ছেয়ে বক্ষতল বিদেশীর, সুনিবিড় তন্দ্রাজালসম। কহিল অস্ফুটকণ্ঠে শ্যামা, ‘প্রিয়তম, তোমা লাগি যা করেছি কঠিন সে কাজ সুকঠিন, তারো চেয়ে সুকঠিন আজ সে কথা তোমারে বলা। সংক্ষেপে সে কব; একবার শুনে মাত্র মন হতে তব সে কাহিনী মুছে ফেলো।—বালক কিশোর উত্তীয় তাহার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মোর উন্মত্ত অধীর। সে আমার অনুনয়ে তব চুরি-অপবাদ নিজ স্কন্ধে লয়ে দিয়েছে আপন প্রাণ। এ জীবনে মম সর্বাধিক পাপ মোর, ওগো সর্বোত্তম, করেছি তোমার লাগি এ মোর গৌরব।’ ক্ষীণ চন্দ্র অস্ত গেল। অরণ্য নীরব শত শত বিহঙ্গের সুপ্তি বহি শিরে দাঁড়ায়ে রহিল স্তব্ধ। অতি ধীরে ধীরে রমণীর কটি হতে প্রিয়বাহুডোর শিথিল পড়িল খসে; বিচ্ছেদ কঠোর নি:শব্দে বসিল দোঁহামাঝে; বাক্যহীন বজ্রসেন চেয়ে রহে আড়ষ্ট কঠিন পাষাণপুত্তলি; মাথারাখি তার পায়ে ছিন্নলতাসম শ্যামা পড়িল লুটায়ে আলিঙ্গনচ্যুতা; মসীকৃষ্ণ নদীনীরে তীরের তিমিরপুঞ্জ ঘনাইল ধীরে। সহসা যুবার জানু সবলে বাঁধিয়া বাহুপাশে, আর্তনারী উঠিল কাঁদিয়া অশ্র্রুহারা শুষ্ককণ্ঠে, ‘ক্ষমা করো নাথ, এ পাপের যাহা দণ্ড সে অভিসম্পাত হোক বিধাতার হাতে নিদারুণতর— তোমা লাগি যা করেছি তুমি ক্ষমা করো।’ চরণ কাড়িয়া লয়ে চাহি তার পানে বজ্রসেন বলি উঠে, ‘আমার এ প্রাণে তোমার কী কাজ ছিল! এ জন্মের লাগি তোর পাপমূল্যে কেনা মহাপাপভাগী এ জীবন করিলি ধিক্কৃত! কলঙ্কিনী, ধিক্ এ নিশ্বাস মোর তোর কাছে ঋণী! ধিক্ এ নিমেষপাত প্রত্যেক নিমেষে।’ এত বলি উঠিল সবলে। নিরুদ্দেশে নৌকা ছাড়ি চলি গেলা তীরে, অন্ধকারে বনমাঝে। শুষ্কপত্ররাশি পদভারে শব্দ করি অরণ্যেরে করিল চকিত প্রতিক্ষণে। ঘনগুল্মগন্ধপুঞ্জীকৃত বায়ুশূন্য বনতলে তরুকাণ্ডগুলি চারি দিকে আঁকাবাঁকা নানা শাখা তুলি অন্ধকারে ধরিয়াছে অসংখ্য আকার বিকৃত বিরূপ। রুদ্ধ হল চারি ধার। নিস্তব্ধনিষেধসম প্রসারিল কর লতাশৃঙ্খলিত বন। শ্রান্তকলেবর পথিক বসিল ভূমে। কে তার পশ্চাতে দাঁড়াইল উপচ্ছায়াসম! সাথে সাথে অন্ধকারে পদে পদে তারে অনুসরি আসিয়াছে দীর্ঘ পথ মৌনী অনুচরী রক্তসিক্তপদে। দুই মুষ্টি বদ্ধ করে গর্জিল পথিক, ‘তবু ছাড়িবি না মোরে!’ রমণী বিদ্যুৎবেগে ছুটিয়া পড়িয়া বন্যার তরঙ্গ-সম দিল আবরিয়া আলিঙ্গনে কেশপাশে স্রস্তবেশবাসে আঘ্রাণে চুম্বনে স্পর্শে সঘন নিশ্বাসে সর্ব অঙ্গ তার; আর্দ্রগদ্গদবচনা কণ্ঠরুদ্ধপ্রায় ‘ছাড়িব না’ ‘ছাড়িব না’ কহে বারম্বার—‘তোমা লাগি পাপ, নাথ, তুমি শাস্তি দাও মোরে, করো মর্মঘাত, শেষ করে দাও মোর দণ্ড পুরস্কার।’ অরণ্যের গ্রহতারাহীন অন্ধকার অন্ধভাবে কী যেন করিল অনুভব বিভীষিকা। লক্ষ লক্ষ তরুমূল সব মাটির ভিতরে থাকি শিহরিল ত্রাসে। বারেক ধ্বনিল রুদ্ধ নিষ্পেষিত শ্বাসে অন্তিম কাকুতিস্বর, তারি পরক্ষণে কে পড়িল ভূমি-’পরে অসাড় পতনে। বজ্রসেন বন হতে ফিরিল যখন, প্রথম উষার করে বিদ্যুৎবরন মন্দিরত্রিশূলচূড়া জাহ্নবীর পারে। জনহীন বালুতটে নদী ধারে-ধারে কাটাইল দীর্ঘ দিন ক্ষিপ্তের মতন উদাসীন। মধ্যাহ্নের জ্বলন্ত তপন হানিল সর্বাঙ্গ তার অগ্নিময়ী কশা। ঘটকক্ষে গ্রামবধূ হরি তার দশা কহিল করুণকণ্ঠে, ‘কে গো গৃহছাড়া, এসো আমাদের ঘরে।’ দিল না সে সাড়া। তৃষায় ফাটিল ছাতি, তবু স্পর্শিল না সম্মুখের নদী হতে জল এক কণা। দিনশেষে জ্বরতপ্ত দগ্ধ কলেবরে ছুটিয়া পশিল গিয়া তরণীর’পরে, পতঙ্গ যেমন বেগে অগ্নি দেখে ধায় উগ্র আগ্রহের ভরে। হেরিল শয্যায় একটি নূপুর আছে পড়ি, শতবার রাখিল বক্ষেতে চাপি—ঝংকার তাহার শতমুখ শরসম লাগিল বর্ষিতে হৃদয়ের মাঝে। ছিল পড়ি এক ভিতে নীলাম্বর বস্ত্রখানি, রাশীকৃত করি তারি’পরে মুখ রাখি রহিল সে পড়ি— সুকুমার দেহগন্ধ নিশ্বাসে নিঃশেষে লইল শোষণ করি অতৃপ্ত আবেশে। শুক্ল পঞ্চমীর শশী অস্তাচলগামী সপ্তপর্ণতরুশিরে পড়িয়াছে নামি শাখা-অন্তরালে। দুই বাহু প্রসারিয়া ডাকিতেছে বজ্রসেন ‘এসো এসো প্রিয়া’ চাহি অরণ্যের পানে। হেনকালে তীরে বালুতটে ঘনকৃষ্ণ বনের তিমিরে কার মূর্তি দেখা দিল উপচ্ছায়াসম। ‘এসো এসো প্রিয়া!’ ‘আসিয়াছি প্রিয়তম!’ চরণে পড়িল শ্যামা, ‘ক্ষম মোরে ক্ষম! গেল না তো সুকঠিন এ পরান মম তোমার করুণ করে!’ শুধু ক্ষণতরে বজ্রসেন তাকাইল তার মুখ’পরে, ক্ষণতরে আলিঙ্গন লাগি বাহু মেলি চমকি উঠিল, তারে দূরে দিল ঠেলি— গরজিল, ‘কেন এলি, কেন ফিরে এলি!’ বক্ষ হতে নূপুর লইয়া দিল ফেলি, জ্বলন্ত-অঙ্গার-সম নীলাম্বরখানি চরণের কাছ হতে ফেলে দিল টানি; শয্যা যেন অগ্নিশয্যা, পদতলে থাকি লাগিল দহিতে তারে। মুদি দুই আঁখি কহিল ফিরায়ে মুখ, ‘যাও যাও ফিরে, মোরে ছেড়ে চলে যাও!’ নারী নতশিরে ক্ষণতরে রহিল নীরবে। পরক্ষণে ভূতলে রাখিয়া জানু যুবার চরণে প্রণমিল, তার পরে নামি নদীতীরে আঁধার বনের পথে চলি গেল ধীরে, নিদ্রাভঙ্গ ক্ষণিকের অপূর্ব স্বপন নিশার তিমির-মাঝে মিলায় যেমন।