পরিশিষ্ট: ২ – ব্যোমকেশের সঙ্গে সাক্ষাৎকার – পার্থ চট্টোপাধ্যায়
আমি এইমাত্র ব্যোমকেশের সঙ্গে দেখা করে এলাম। হ্যাঁ, ব্যোমকেশ বক্সী, সত্যান্বেষী এবং সত্যবতী-পতি। ব্যোমকেশ যাঁকে আপনারা সকলেই চেনেন এবং কেউ দেখেননি—সেই ব্যোমকেশ।
ভগবানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে ভক্তকে ধরতে হয়, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁর পি-একে আগে ধরা চাই। অশরীরী আত্মার সঙ্গে সাক্ষাৎকার—তাও দরকার মিডিয়ামের। তেমনি গল্প উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে মূলাকাৎ করতে গেলে খোদ তার স্রষ্টাকে ধরতে হবে।
আমি তাই ধরলাম শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ব্যোমকেশের দেখা পেয়ে গেলাম।
ব্যোমকেশকে আমি দেখেছিলাম একটি বাংলা ছবিতে। শরদিন্দুবাবুকে বলতেই তিনি বললেন, আরে দূর ওই ব্যোমকেশ নাকি? ব্যোমকেশ কস্মিনকালে চোখে চশমা পরেনি, আর সে হচ্ছে বক্সী, কায়স্থর সন্তান, সে আবার হল বাড়ুজ্যে হল কবে? তা বাদে ব্যোমকেশের নাক হল ধারালো, বেশ লম্বা, নাতিস্থূল চেহারা।
বাধা দিয়ে বললাম, এমন চেহারা কোথাও দেখেছেন, না অর্ধেক মানব আর অর্ধেক কল্পনা?
—কল্পনা ঠিক নয়। শরদিন্দুবাবু বললেন, বলতে পারেন সেলফ প্রজেকশান। নিজেরই আত্মকৃতি।
আমি এবার তাকালাম শরদিন্দুবাবুর দিকে—হ্যাঁ, এই তো সত্যিকারের ব্যোমকেশ। লম্বা নাতিস্থূল চেহারা। ইস্পাতের ফলার মত ধারালো নাক। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। বয়স হয়েছে। তবু এখনও ঋজু।
—ব্যোমকেশ কি আপনারই বয়সী?
—না। আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। তার বয়স এখন ষাট। বেণীসংহারে তার বয়স এই ষাট বছরই। আমি শিল্পীকে নির্দেশ দিয়েছি ব্যোমকেশকে যখন আঁকবেন মনে রাখবেন তার বয়স এখন ষাট।
—ব্যোমকেশ কাহিনী কীভাবে আপনার মাথায় এল?
—সে এক ইতিহাস। ষোল-সতের বছর বয়স থেকে ডিটেকটিভ গল্প পড়তে শুরু করি। আগাথা ক্রিস্টি ও কোনান ডয়েলের আমি দারুণ ভক্ত ছিলাম। তবে নিজে লিখব কোনদিন ভাবিনি। ১৯২৯ সালে যখন লিখতে শুরু করলাম তখন মনে হল এত ডিটেকটিভ বই পড়েছি, টেকনিকটা আয়ত্ত হয়েছে। এবার নিজে গোয়েন্দা কাহিনী লিখলে কেমন হয়। ১৯৩৩ সালে প্রথম গোয়েন্দা গল্পে হাত দিলাম। তখন থেকেই ব্যোমকেশের সঙ্গে পরিচয়।
—ব্যোমকেশ যে বক্সী হলেন তা কি নামের অনুপ্রাসের সুবিধার জন্য?
—তা ঠিক নয়। তবে চেয়েছিলাম ব্যোমকেশ নিজে যেমন অসাধারণ, নামটির মধ্যে তেমনি যেন অসাধারণত্ব থাকে। অনেক নাম মনে এসেছিল। কোনটিই আর পছন্দ হয় না। শেষে ব্যোমকেশ বক্সী পছন্দ হল। নায়কের নামটিও ব্যক্তিত্বপূর্ণ হওয়া চাই। ধরুন, শার্লক হোমস না হয়ে যদি হত ডেভিড হোমস, তাহলে কি অমন ব্যক্তিত্ব আসত? নায়কের একটা ‘ক্যাচি’ নাম দেওয়া আমাদের লেখকদের পুরনো ট্রিক।
—ব্যোমকেশকে ব্রাহ্মণ না করে কায়স্থ করলেন কেন?
হাসতে হাসতে শরদিন্দুবাবু বললেন, আমার ধারণা কায়স্থরা ব্রাহ্মণদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরে।
—ব্যোমকেশের সহকারী অজিতকে পেলেন কোথায়?
—অজিত সিনথিটিক চরিত্র। আমার বাল্যবন্ধু অজিত সেনের নামে নাম।
—ব্যোমকেশ গোয়েন্দাগিরি শিখল কোথা থেকে? তার কি কোন ট্রেনিং ছিল?
—না। স্রেফ ইনটিউশন। ব্যোমকেশ অঙ্কে খুব দড়। তার বাবাও ছিলেন বড় ম্যাথমেটিসিয়ান। মা বৈষ্ণব বংশের মেয়ে। এই দুয়ের সংমিশ্রণে ব্যোমকেশের বুদ্ধি খুব দৃঢ় হয়েছে। এই বুদ্ধি দিয়েই সে জটিল রহস্যের জট ছাড়ায়।
—অন্যান্য বাঙালী গোয়েন্দার মত ব্যোমকেশকে তো গুলি চালাতে দেখি না। ব্যোমকেশ কাহিনীতে ভায়োলেন্ট অ্যাকশন নেই বললেই চলে। এর কারণটা কি?
—আমার মেজাজের সঙ্গে গুলি গোলা খাপ খায় না। তাছাড়া গোয়েন্দা কাহিনীকে আমি ইনটেলেকচ্যুয়াল লেভেলে রেখে দিতে চাই। ওগুলি নিছক গোয়েন্দা কাহিনী নয়। প্রতিটি কাহিনীকে আপনি শুধু সামাজিক উপন্যাস হিসাবেও পড়তে পারেন। কাহিনীর মধ্যে আমি পরিচিত পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। মানুষের সহজ সাধারণ জীবনে কতগুলি সমস্যা অতর্কিতে দেখা দেয়—ব্যোমকেশ তারই সমাধান করে। কখনও কখনও সামাজিক সমস্যাও এর মধ্যে দেখাবার চেষ্টা করেছি। যেমন ‘চোরাবালি’ গল্পে আছে বিধবার পদস্খলন। একটি কথা, জীবনকে এড়িয়ে কোনদিন গোয়েন্দা গল্প লেখার চেষ্টা করিনি।
—ব্যোমকেশবাবু এখন কোথায় আছেন?
—আগে হ্যারিসন রোডে ছিলেন। এখন কেয়াতলাতে বাড়ি করে সেখানে আছেন।
—কেয়াতলাতে বাড়ি করলেন কেন? নিউ আলিপুর কিংবা যোধপুর পার্ক তো আরও খানদানি জায়গা?
শরদিন্দুবাবু হাসতে হাসতে বললেন, কেয়াতলাতে যে আমি কিছুদিন ছিলাম। বেশ পরিচিত জায়গা। ব্যোমকেশকেও তাই এখানে এনে ফেললাম।
তাছাড়া ব্যোমকেশের বাড়ি করারও একটা ইতিহাস আছে।
আমার বন্ধু প্রতুল গুপ্ত প্রায়ই আমাকে তাগাদা দিতেন, সত্যবতীকে একটা বাড়ি তৈরি করে দিতেই হবে। ওঁর অনুরোধেই ব্যোমকেশের বাড়ি হল। এখন আবার প্রতুলবাবু ধরেছেন, সত্যবতীকে একখানা গাড়ি কিনে দিতে হবে। গাড়ি না হলে সত্যবতী গড়িয়াহাটে বাজারে যাবে কী করে? আমি বলেছি, হেঁটে যাবে। ব্যোমকেশ গাড়ি কেনার টাকা পাবে কোথায়? আমি কিছুতেই রাজী হচ্ছি না। প্রতুলবাবুও চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন।
—ব্যোমকেশবাবু কি গোয়েন্দাগিরি থেকে রিটায়ার করবেন?
—ব্যোমকেশের দশম গল্পে সত্যবতীর সঙ্গে তার বিয়ে হল। আমি ভাবলাম বিয়ে হলে বাঙালীর ছেলের আর পদার্থ থাকে না, তাই ব্যোমকেশকে তখনই রিটায়ার করিয়ে দিয়েছিলাম। যোল বছর আর লিখিনি। তারপর কলকাতায় এসেছিলাম কিছুদিন। সে সময় অনেকে আমাকে ধরলেন আবার লিখুন। যখন দেখলাম, আজকালকার ছেলেমেয়েরা চায় তখন আবার লিখতে আরম্ভ করলাম।
—ব্যোমকেশবাবু বিয়ে করলেন কেন? ওঁর মত ক্যারেকটরের লোকের তো ঠিক সংসারী হওয়া সাজে না।
—কী আর করবে—বেচারা প্রেমে পড়ে গেল।
—ওঁর সন্তানাদি কি?
—এক ছেলে। একবার একটি বইয়ে তার উল্লেখ আছে। ছেলেকে সাধারণত আমি সামনে আনিনি।
—ব্যোমকেশ সত্যবতীর জীবনে দাম্পত্য কলহ আছে?
—তা আর নেই! অদ্বিতীয় গল্প তো এই দাম্পত্য কলহ দিয়েই শুরু।
—অন্য কোন সমস্যা আছে?
—থাকলেও সেটা আনিনি।
—কিছু মনে করবেন না, যদিও ব্যক্তিগত প্রশ্ন, ব্যোমকেশবাবুর এখন প্রাপ্তিযোগ কেমন?
—ব্যোমকেশ ও অজিত মিলে একটি পাবলিশিং ফার্ম খুলেছে। অজিতই ফার্মটি দেখাশোনা করে। তা থেকে ওদের বেশ আয় হচ্ছে।
শরদিন্দুবাবু বললেন, এইবার ব্যোমকেশকে একটু ছুটি দিন। অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। কি খাবেন বলুন কফি না চা?
আমি বললাম, না, এইমাত্র চা খেয়ে আসছি।
—তাহলে কফিই হোক। তারপর কফি আসতে দেরি দেখে নিজেই ভেতরে ঢুকে দু-কাপ কফি হাতে করে ঢুকলেন। একটা চিনি ছাড়া। সেটি নিজের জন্য।
কফি খেতে খেতে ব্যক্তিগত কথা। নিজের জীবনের কথা। আধুনিক সাহিত্যের কথা। সেসব আলোচনা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক এখানে। ঘুরে ফিরে সেই ব্যোমকেশেই এসে পড়লাম আবার। জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যোমকেশ চরিত্র কি আপনাকে কখনও হন্ট করে?
—সব চরিত্রই লেখককে হন্ট করে। লেখক যাকে জীবন দিয়ে গড়েছেন, যত্ন করে এঁকেছেন, সব চরিত্রই এসে তাঁকে নাড়া দেয়। ৩১টা গল্প লিখেছি ব্যোমকেশকে নিয়ে। এক-একটা গল্পের কথা ভেবেছি। কীভাবে এগুবো, যখন বুঝতে পারছি না, তখন ব্যোমকেশ এসে আমাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছে। এটা কোন ভৌতিক ব্যাপার নয়, সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। যারা একই চরিত্র নিয়ে অনেক গল্প লেখে, তাদের এমন হয়।
—ব্যোমকেশ গল্পের প্লট কীভাবে সংগ্রহ করেন?
—অনেক ভেবে। খবরের কাগজ থেকে পাই। ইংরাজী গল্প থেকেও আইডিয়া পাই। তারপর তা নিয়ে ভাবতে থাকি। তারপর গল্পের প্রথম লাইন মাথায় এসে গেলে তখন লিখতে বসি।
—ব্যোমকেশবাবুর শরীর এখন কেমন?
—ষাট বছর বয়সেও দৈহিক ও মস্তিষ্কের দিক থেকে কোন অবক্ষয় তার হয়নি। তবে সে এখন নিজে বেশি কিছু করে না। তার সহকারীরাই কাজকর্ম করে। ব্যোমকেশ শুধু নির্দেশ দেয়।
এবার আমি বলি, ব্যোমকেশবাবুকে কবে ছুটি দেবেন?
শরদিন্দুবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমি তো এখনই ছুটি দিতে চাই। বার বার ভাবি ব্যোমকেশের ষাট বছর বয়স হয়ে গেল। এবার ওকে ছুটি দেওয়া উচিত। কিন্তু তখনই দেশসুদ্ধ পাঠকের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আবার ভাবি এদের নিরাশ করব?
একদিকে সৃষ্ট চরিত্রের প্রতি মায়া, অন্যদিকে পাঠকের দাবি—এই দুয়ের টানাপোড়েনে ব্যোমকেশের স্রষ্টা আজ দ্বিধাগ্রস্ত।
তারপর বললেন, এক সময়ে হঠাৎ ছেড়ে দেব। পাঠকরা চাইলেও ব্যোমকেশের প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে তো। সে আর কত পারবে।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ কার্তিক, ১৩৭৫-তে প্রকাশিত এই রচনাটি শরদিন্দু অম্নিবাস দ্বিতীয় খণ্ডের পরিশিষ্টে পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।