পরিশিষ্ট-১ সাক্ষাৎকার ‘‘যৌনতা সব সময়েই এক চরম বিপজ্জনক এলাকা…’’
‘কারুবাসনা’-র পক্ষে কথা বলেছেন সব্যসাচী সেন
প্রশ্ন: বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করে গবেষণার জন্য উনিশ শতকের বাঙালির যৌনতা বেছে নিলে কেন?
অর্ণব: বাংলা ডিসিপ্লিনে গবেষণার যে ধারাটি জনপ্রিয় সেটি ক্রমশ একটি একঘেয়ে নির্বোধ বিষয়ে পরিণত হয়েছে ৷ যেমন—বাংলা সাহিত্যে মা, বাংলা সাহিত্যে নদী, তারাশঙ্করের সমাজচেতনা ইত্যাদি ৷ এটাই বাংলা সাহিত্যের গবেষণার মূলধারা ৷ একইসঙ্গে এটাও বলতে হবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা অন্যান্য বিষয়ের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা একটা ডিসিপ্লিন ৷ সেই অর্থে বাংলা অ্যাকাডেমিকস-এর আমি একজন পুরোদস্তুর আউটসাইডার ৷ তো সেই জায়গা থেকে যখন এই বিষয় নিয়ে গবেষণার কথা ভাবলাম, ভাবার বিষয়টা ঠিক অ্যাকাডেমিক ছিল না ৷ মূল কারণটা ছিল অনেক বেশি ব্যক্তিগত ৷
প্রশ্ন: সেই ব্যক্তিগত বিষয়টা কী?
অর্ণব: আমার স্ত্রী ছিলেন তখন আমার সহপাঠিনী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৷ বিষয়ও এক—বাংলা ৷ স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মধ্যে শরীরের একটা চাহিদা ছিল ৷ আমার বাবা মা দুজনেই চাকরি করতেন ৷ বাড়ি ফাঁকা থাকত দুপুরবেলা ৷ তো আমরা দুজনে আমার ফাঁকা বাড়িতে দুপুরটা কাটিয়ে আবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতাম ৷ একটা সময় বাবা জানতে পারল ৷ এর আগে আমার বান্ধবী যখন বাবা মা থাকাকালীন বাড়িতে আসত, তখন বাবা প্রথম প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোর বান্ধবী বাড়িতে এলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কী করিস?’ বাবার এই কথাটি আমার খুব মনে ধরেছিল ৷ আমি বাবাকে বলেছিলাম যে, ‘সম্পর্কের তো কতকগুলো চাহিদা আছে, তার একটা আড়ালও দরকার ৷’ বাবা বললেন, ‘এগুলো কুশিক্ষা ৷ এসব এখানে চলবে না ৷’ প্রথমে বাবার সঙ্গে তর্ক করেছিলাম, পরে বুঝলাম তর্ক করা বৃথা ৷ তাঁর মানসিক গঠনটাই এমন যে তিনি এটা বুঝতে পারবেন না ৷ ওঁর মূল বক্তব্য ছিল, ‘প্রাক-বিবাহ যৌনতা খারাপ’ ৷ তখন আমি ভাবলাম এটা কি ওঁর একার মত? নাকি এর পেছনে কোনো সামাজিক ইতিহাস আছে? তখন আমার মনে হল আমার এটা নিয়ে কাজ করা দরকার ৷ আমার বাবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমিস্টিতে পিএইচডি করেছেন ৷ কিন্তু বাবার মনে যৌনতা সম্পর্কে যেসব ধারণা আছে সেগুলো আমি গোঁড়ামি বলব না, তাঁর বেড়ে ওঠার মধ্যেই এগুলো রয়ে গেছে ৷ তাই তিনি ওই ভাবে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছেন ৷ আমি সেই অর্থে বরাবরই বাড়ির বাইরের লোক ৷ বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাবনাচিন্তার এতটাই ফারাক হয়ে যায় যে যে সেই অর্থে আমি ওই বাড়ির কেউ নই ৷ আমি নিজেকে আমার পরিবারে একজন ‘ডেঞ্জারাস আউটকাস্ট’ বলেই মনে করি ৷
সেই ধারণা থেকেই স্থির করি বাঙালির যৌনতা নিয়ে গবেষণা করব ৷ মানে বাবাই আমাকে একপ্রকার ঠেলে দেন বিষয়টার দিকে ৷ শিরোনাম ছিল: ‘‘উনিশ শতকের বাংলায় শরীর-যৌনতার এলাকা নির্মাণ (১৮২৫ থেকে ১৯০০)’’ ৷ কিন্তু কাজটা আমি টেনে এনেছি ১৯২০/৩০ অবধি ৷ এরপর গবেষণার শুরুতে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম যে এর একটা লম্বা ইতিহাস আছে ৷ সেটা যে খুব পুরোনো তাও নয় ৷ বাঙালির আধুনিক হয়ে ওঠার যে দেড়শো বছরের ইতিহাস, তার মধ্যেই এটা লুকিয়ে আছে ৷ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কিন্তু একটা ২২ বছরের ছেলে আর ১৫ বছরের মেয়ের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে এই ধরনের ট্যাবু বাঙালি সমাজে ছিল না ৷
প্রশ্ন: তার মানে সেই সময় সমাজ অনেক লিবারেল ছিল?
অণব: না, লিবারেল ছিল না ৷ তবে দেখার চোখটা অন্যরকম ছিল ৷ আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ২০ বছরের একটি ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে ৷ যে মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে তার বয়স ৭ কি ৮ ৷ যতক্ষণ না সে যৌন সংসর্গের উপযুক্ত বয়সে পৌঁছচ্ছে তাকে স্বামীর ঘরে পাঠানো হত না ৷ অবশ্য অনেক সময় এটা মানাও হত না, সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ধর্ষণেরই নামান্তর ছিল ৷ ফুলমনি নামে একটি মেয়ে ওই ভাবে মারা যায় ৷ এরপর ব্রিটিশ সরকার নিয়ম করে দেয় যে রজঃস্বলা না হওয়া পর্যন্ত মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যাবে না ৷ বয়সের সঙ্গে যৌনতার যে সম্পর্ক সেটা অন্য চোখে দেখা হত ৷ সেই দেখাটা বদলে যেতে শুরু করল উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে, মানে ওই ১৮৫০ থেকে ৷
প্রশ্ন: সেই বদলে যাওয়া দেখার চিহ্নগুলো কোথায় কোথায় পাওয়া গেল?
অর্ণব: আমরা যদি সাহিত্যের মধ্যে খোঁজ করি, তাহলে মাইকেলের সাহিত্য, বঙ্কিমের সাহিত্য বা রঙ্গলালের সাহিত্য আমাদের হাই লিটারেচারের ধারা ৷ বিক্রির হিসেব ধরলে দেখা যাবে বঙ্কিমের বইয়ের থেকে বটতলার বইয়ের বিক্রি ছিল বেশি ৷ কামিনীকুমার বা হেমলতা-রতিকান্তর বিক্রি অনেক বেশি ৷ প্রথমটি লেখা হয়েছে ১৮৩৯, পরেরটি ১৮৪৬-এ ৷ এই বটতলার ফিকশনের প্রভাব পরবর্তীকালে বঙ্কিমের উপরও পড়েছে ৷ গৌতম ভদ্র দেখিয়েছেন বটতলার কী কী প্রভাব বঙ্কিমের মধ্যে পড়েছে ৷ বঙ্কিমের লেখায় অনেক স্ল্যাং রয়েছে, যেমন, শতেকখোয়ারি, আবাগির বেটি, মাগি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন ৷ কিন্তু ১৮৫০ সাল থেকে এক ধরনের শুদ্ধতার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে ৷ এই প্রক্রিয়াটা ছিল ত্রিমুখী ৷ ১. ব্রিটিশ সরকার, ২. ব্রিটিশ মিশনারি, ৩. ভিক্টোরিয়ান মরালিটি প্রভাবিত বাঙালি ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণি ৷ যদিও ৩ নম্বর অংশটি সংখ্যায় অল্প, কিন্তু তাদের হাতেই সব ক্ষমতা ৷ প্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাঁদের হাতে ৷ তাঁরা যা বলবেন সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি ৷ ১৮৫৩/৫৪ থেকে বাংলা বইয়ের ক্যাটালগিং শুরু করলেন পাদ্রি জেমস লং ৷ উনি ৪টে ক্যাটালগ তৈরি করেছিলেন, তার প্রথম ক্যাটালগে একটি পুস্তককে তিনি বলছেন, ‘এটি একটি জনপ্রিয় সাহিত্য’ ৷ দ্বিতীয় ক্যাটালগ যখন বেরোচ্ছে ১৮৫৬ সালে তখন ওই বইটিকেই তিনি বলেছিলেন ‘আদিরসাত্মক গল্প’ ৷ এক ধরনের মরাল কোডিং তার উপর আরোপ করা হচ্ছে ৷ পরের ক্যাটালগ দুটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ ও ১৮৫৯ সালে ৷ একই সঙ্গে ইংলন্ডে লেখালেখির মধ্যে যেসব তথাকথিত ‘অনৈতিক’ বিষয়গুলো উঠে আসছে সেগুলোকে বন্ধ করবার জন্য সোসাইটি তৈরি হচ্ছে ৷
প্রশ্ন: আমাদের এখানেও ‘অশ্লীলতা নিবারণী সভা’ তৈরি হয়েছে।
অর্ণব: হ্যাঁ, ১৮৫৬ সালে এখানে তৈরি হয় ওই সভা ৷ তারপর ১৮৭৩ সালে বাবু কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে সেই সমিতি কোমর বেঁধে নেমে পড়ে ৷ এমনকি কেশববাবুর যে কাগজ ‘সুলভ সমাচার’ তারা এই অশ্লীলতার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছিল ৷ কারণ ব্রাহ্মরা ভিক্টোরিয়ান মরালিটির ভক্ত ছিল ৷ যে কথা হচ্ছিল, এই সময় থেকেই ‘আদিরসাত্মক বই’ শিরোনামে একটা নতুন ক্যাটাগরি তৈরি হচ্ছে ৷ ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য ছিল এর মধ্যে এক নম্বর ৷ ‘বিদ্যাসুন্দর’ নিয়ে কলকাতায় বিতর্ক সভা হয়েছিল ৷ একদল বলল, ‘এটাই আমাদের জাতীয় সাহিত্য ৷ এটাই আমাদের ধারা’ ৷ আরেকদল বলল, ‘না, এটা সম্পূর্ণ কুরুচিকর একটি বিষয়’ ৷ এই যে ‘আদিরস’ বলে একটা বিষয়কে মার্কা মেরে দিচ্ছি, এটা তৈরি হওয়ার একটা ইতিহাস জন্মাচ্ছে ৷ এবার এই ভিক্টোরিয়ান মরালিটি শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মধ্যে যত গেঁড়ে বসছে, তত বেশি করে ভাষার শুদ্ধিকরণ শুরু হল, উনিশ শতকের শুরুতে কলকাতার বাবুরা যে ভাষায় কথা বলত, মেয়েরা যে ভাষায় কথা বলত, সেই ভাষায় এমন অনেক শব্দ ছিল যেগুলো আজকের মাপকাঠিতে দেখলে মনে হবে অশ্লীল ৷ স্বামী বিবেকানন্দর অনেক লেখার মধ্যে ‘মাগি’ শব্দটা আছে, লিখেছেন ‘জাহাজের পাছা’—১৮৯৮ সালে লেখা ৷ তবে কি ১৮৫০ সালের পর সবাই শুদ্ধভাষায় কথা বলত? আর তার আগে অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলত? তা নয়, যে মুষ্টিমেয় শিক্ষিত মানুষের হাতে ক্ষমতা এল তারাই ভাষায় শুদ্ধিকরণে জোর দিলেন ৷ এর বাইরে একটা বিরাট অংশের মানুষ এই ‘তথাকথিত’ শুদ্ধভাষায় কথা বলছে না ৷ যেমন, রাধামাধব কর সে-যুগের একজন বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব, তিনি বারবার বলছেন, যে এই যে তোমরা হঠাৎ নীতিবাগীশ হয়ে উঠলে, যে কোনও খারাপ শব্দ শুনলে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত হয়ে ওঠে… তিনি এই শুদ্ধিকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন ৷ বিপিনবিহারীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছেন, এই যে নব্য পিউরিটানিজম এসেছে, এর সঙ্গে আমি একমত নই ৷ আমাদের ভাষায় যে ধারাবাহিকতা ছিল সেটা গ্রহণযোগ্য নয় বলে আমার মনে হয় না ৷ অমতৃলাল বসু বটতলার সাহিত্যের স্বপক্ষে সওয়াল করছেন ৷
প্রশ্ন: যৌনতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে লোকের নিন্দেমন্দ শুনতে হয়নি?
অর্ণব: নিন্দেমন্দর চেয়েও প্রথম যে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল যে গাইড কাকে পাব! বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাট আছে ৷ ওটা নিজে নিজে করা যায় না ৷ আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং মনে করা হত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ অন্য বিদ্যালয়ের তুলনায় মুক্তমনা ৷ এটা ২০০৪ সালের কথা ৷ শেষ পর্যন্ত সৌমিত্র বসুর কাছে গেলাম, বিষয়টা নিয়ে কথা বললাম আর উনি রাজিও হয়ে গেলেন ৷ কিন্তু উনি বলেছিলেন, যে পরে আমাকে প্রশ্ন করা হবে, এরকম একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করলে কেন? কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয় পড়ানো হয় না, ফলে এরকম বিষয় নিয়ে গবেষণা করে লাভ কী? এছাড়াও অনেকে মুখে কিছু বলবে না ৷ কিন্তু আচরণে বুঝিয়ে দেবে দেবে তোমার এই গবেষণাটি তিনি পছন্দ করছেন না ৷ গত ১০ বছরে এই তিনটি আচরণেরই মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে ৷ তখন আমি বুঝলাম বাংলা ভাষা নিয়ে যারা পড়াশুনা করেছেন তাদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাব না ৷ তাই ঠিক করি সোশ্যাল হিস্ট্রি নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের কাছে যাব ৷ গৌতম ভদ্র এ ব্যাপারে প্রচুর সাহায্য করেছেন ৷ ওঁর ঋণ অপরিশোধ্য ৷ যেসব বই আমি কোনওনি পেতাম না, সেইসব বই উনি আমাকে পড়িয়েছেন, হদিশ দিয়েছেন ৷ আর গবেষণার তাত্বিক দিকটায় যিনি সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন তিনি হলেন সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সের মানস রায়, ওঁর কাছেও আমি ঋণী ৷ গৌতম ভদ্রও তখন সেন্টারে ৷ এমনকী বাবাও শেষ পর্যন্ত গবেষণার বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন ৷
প্রশ্ন: এই গবেষণা করতে গিয়ে ফরাসি ভাবুক মিশেল ফুকোর সেক্সুয়ালিটি নিয়ে লেখা পড়তে হয়নি?
অর্ণব: হ্যাঁ ৷ প্রথমে সমস্যা ছিল মিশেল ফুকোকে গ্রহণ করব কীভাবে? আমি কি হুবহু তাঁর নকল করব? যেভাবে তিনি পশ্চিমের সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন ৷ উনি একটা পরিষ্কার বিভাজন করেছেন, পশ্চিমে ছিল সায়েন্স অফ সেক্সুয়ালিটি এবং প্রাচ্যে ছিল আর্টস ইরোটিকা, আমি আমার গবেষণায় এই তত্বের বিরোধিতা করেছি ৷ আমি লিখেছি যে বিষয়টা এই রকম কোনও সহজ বাইনারিতে চলে না ৷ আমাদেরও ক্ষমতার একটা নিজস্ব রাজনীতি ছিল ৷ ফুকো সেটা অতটা নজর করেননি ৷ ফুকোর লেখায় প্রাচ্যকে ইউরোপের চোখ দিয়ে দেখার একটা ব্যাপার আছে ৷ এরপর আমার গবেষণাজাত লেখাগুলো ‘অনুষ্টুপ’ প্রত্রিকায় বেরোতে শুরু করে ৷ উনিশ শতকের ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকা নিয়ে একটা দীর্ঘ লেখা আমি লিখেছিলাম ৷ আমার আগে ওই কাগজটি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ আর কেউ লেখেনি ৷
প্রশ্ন: কাজটা করতে গিয়ে কী কী সমস্যা হল?
অর্ণব: কাজটা করতে গিয়ে সমস্যা হয়নি ৷ সমস্যা শুরু হল যখন কলেজের অধ্যাপনার চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলাম ৷ আমাকে প্রশ্ন করা হল, ‘এই বিষয় নিয়ে গবেষণা কেন করেছেন?’ ‘এই গবেষণা করে কী লাভ? এটা তো কোথাও পড়ানো হয় না ৷’ ৷ আসলে আমার গবেষণার বিষয়টাই ওঁদের কাছে একটা নীচু নজরে দেখার ব্যাপার ৷ কোনও শিক্ষিত ভদ্রলোকের বিষয় নয় ৷ আমি গবেষণার আগে থেকেই একটি স্কুলে বাংলা পড়াতাম ৷ গবেষণা করতে গেলে নিয়ম অনুযায়ী স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়, আমিও নিয়েছিলাম ৷ এবার সহকর্মীরা যখন জানতে পারল যে আমি এই বিষয়ে গবেষণা করছি, একজন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সোনাগাছি নিয়ে গবেষণা করছ? তুমি কি ওইসব জায়গায় যাও?’ আমি বললাম, ‘একথা কেন বলছেন?’ উনি বললেন, ‘এই যে বলছ যৌনতার এলাকা নির্মাণ! কলকাতায় তো যৌনতার এলাকা সোনাগাছি’ ৷ একজন বললেন, ‘তোমাকে তো ফিল্ড ওয়ার্কও করতে হচ্ছে ৷ তার মানে রেড লাইট এরিয়ায় যেতে হয়েছে ৷ সহকর্মীদের প্রশ্ন, ‘তুমি ছুটি নিয়ে যৌনতার এলাকা নির্মাণ করতে কোথায় যাও? লাইব্রেরিতে নিশ্চয় নয়’ ৷ ব্যাপারটা আমি পরেও লক্ষ করেছি কলেজে অধ্যাপনা করতে এসে ৷ আমি আসানসোলের কাছে একটি মেয়েদের কলেজে অধ্যাপনা করি! একা ঘর ভাড়া করে থাকি, তাই নিয়ে সকলের প্রশ্ন, তোমার স্ত্রী এসে থাকেন না কেন? অর্থাৎ বৈধ স্ত্রী থাকা মানেই আমার যৌন অস্তিত্বটাও একধরনের বৈধতা অর্জন করবে ৷
প্রশ্ন: এই বিষয়গুলো নিয়ে তোমার কী কী কাজ এখনও অব্দি প্রকাশিত হয়েছে?
অর্ণব: উনিশ শতকের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস নিয়ে আমার অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ এবং আর্টিকল বেরিয়েছে অনেকগুলো ৷ অনুষ্টুপ, অবভাস, পরিকথা, একালের রক্তকরবী, ব্রাত্যজন নাট্যপত্র, বর্ণপরিচয় ছাড়াও বেশকিছু সংবাদপত্রে পাতায় নিয়মিত লিখেছি ৷ প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে আছে পর্নোটোপিয়া, উত্তরে থেকো যৌন ও অন্যান্য লেখা, বাবু বিবি সম্বাদ, ঠিকানা বটতলা, উনিশ শতক: বাঙালি মেয়ের যৌনতা ৷ সম্পাদনা করেছি ‘যৌনতা ও বাঙালি’, ‘দুষ্প্রাপ্য বাংলা সাহিত্য’ তিন খণ্ড, ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’র সটীক সংস্করণ ৷ মূল থিসিস পেপারের লেখাগুলো এখনও পত্রপত্রিকার পাতায় রয়েছে ৷ একটি পূর্ণাঙ্গ বইয়ের চেহারা দিচ্ছি ৷ এই বইটাই পূর্ণাঙ্গ কাজ ৷
প্রশ্ন: তুমি তো উনিশ শতকে বাংলায় লেখা সেক্স ম্যানুয়ালগুলো পড়েছ। সে সম্পর্কে কিছু বলো।
অর্ণব: উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বিষয়টা একরকম ছিল ৷ বিশ শতকের শুরুতে আমাদের দেশে ফ্রয়েড, হ্যাভলক এলিস—এদের বইপত্র এসে গেছে ৷ শরীরের যে ধারণা আমরা এতদিন বয়ে নিয়ে আসছি, সেটা একটু পাল্টে গেল ৷ অর্থাৎ জীবশরীর হয়ে গেল মনস্তাত্বিক শরীর ৷ বায়োলজিক্যাল বডির বদলে সাইকোলজিক্যাল বডি ৷ এখানে আবার ফুকোর কথা এসে পড়ে ৷ উনি বলছেন সামাজিক ক্ষমতার সঙ্গে যৌনতার সম্পর্কটা ঠিক কীরকম? আমরা যেমন ভাবি যে ভিক্টোরিয়ান মরালিটির রেগুলেটরি কোডগুলো সক্রিয় হওয়ায় যৌনতা অনেকটা সাপ্রেসড হয়ে গেল, ফুকো বলছেন যে, না সাপ্রেসড হল না ৷ তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটি’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলছেন, আসলে যেটা হচ্ছে সেটা হল প্রলিফারেশন অফ ডিসকোর্স ৷ মানে যেটা নিষিদ্ধ সেটাকে আরও বেশি করে তাত্বিক আকারে উচ্চারণের আওতায় নিয়ে আসছি ৷ তাই আরও বেশি আলোচনায় আসছে বিষয়টা এবং রেগুলেশনটা আরও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজ করছে ৷ একই জিনিস দেখা যাচ্ছে আমাদের বাংলায় বিশ শতকের শুরুর দিকে ৷ বাংলা সাহিত্যে ‘কল্লোল’ এবং ‘কালি কলম’-এর যুগ সেটা ৷ সেই যুগে যৌনতা নিয়ে উচ্চারণ করতে হবে, কিন্তু যৌনতা যে একটা মনস্তাত্বিক বিষয় এবং তার যে একটা থিওরি আছে, এই জিনিসটা লেখালেখিতে বেশি করে আসতে শুরু করল ৷ লেখকরা যৌনতাকে উচ্চারণের আওতায় নিয়ে আসছেন বটে, তবে সেটা আগের মতো খোলামেলা নয় ৷ অনেকটা ডিসকার্সিভ চেহারায় ৷ এটা বেশ কিছুদিন ধরে চলল ৷ আমাদের প্রাক-স্বাধীনতার যুগ পর্যন্ত ৷ ওই সময় ১৪৭ চিত্র-সহ যৌবনপথে নামে একটি সেক্স ম্যানুয়াল প্রকাশিত হচ্ছে ৷ চণ্ডীচরণ বসাকের লেখা বা ‘আরাধনা দেবী’ ছদ্মনামে লেখা নরনারীর যৌনবোধ ৷ এই সেক্স ম্যানুয়ালগুলো লেখা হয়েছে ফ্রয়েডকে মাথায় রেখে এবং তার রেগুলেশনটা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক, এটাও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ ৷ এর আগে উনিশ শতকে বাংলায় প্রথম যে সেক্স ম্যানুরোলটি লেখা হয়, সেটি অন্নদাচরণ খাস্তগীরের লেখা, ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত ৷ উনি লিখেছেন, যৌনতা একটা এমন ফোর্স যেটাকে আমি অস্বীকার করতে পারব না ৷ তাই এটাকে সঠিক পথে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ৷ এই সঠিক পথে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে মেনে নেওয়া হচ্ছে ভিক্টোরিয়ান মরালিটির কোডগুলি ৷ দুটি প্রধান শর্ত: ১. বীর্য সংরক্ষণ করতে হবে ২. বীর্য বাজে খরচ করা যাবে না ৷ একমাত্র প্রজননমূলক যৌনতাই ভালো ৷ বাকি সব যৌনতা বিপথগামী, খারাপ যৌনতা ৷ প্রজনন ছাড়া সেক্স করলে কী হবে? আমাদের জাতীয়তাবাদী প্রকল্পটি শক্তিশালী হবে না ৷
উনিশ শতকের শেষে আমার দেখছি যে আমাদের জাতীয়তাবাদী কাঠমোর প্রধান ইউনিট হচ্ছে পরিবার ৷ পরিবারকে শক্তিশালী করতে গেলে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক পথে চালাতে হবে ৷ এইভাবে ব্রহ্মচর্যের ধারণা আসছে ৷ এবং স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা সবাই এই ব্রহ্মচর্যের চর্চা করতেন ৷ এই সময় দুটো দিক থেকে যৌনতাকে দেখা হচ্ছে ৷ একটা হচ্ছে ফ্রয়েডের চোখ দিয়ে যৌনতাকে দেখা, আর একটি দিক, এখুনি আমার মনে পড়ল আদীশ্বর ভট্টাচার্যর লেখা একটা বই ছিল, ১৯১৫ সালে লেখা, ছাত্রগণের নৈতিক অবস্থা ও তার প্রতিকার ৷ তাতে লেখা রয়েছে ছাত্রদের মধ্যে হস্তমৈথুন, সমকামিতা সব কিছুর চল রয়েছে ৷ এর ফলে সমাজ অধঃপাতে যাচ্ছে ৷ এই অধঃপতন রোধ করতে হবে ৷ আমাদের যদি শক্তিশালী জাতি হয়ে উঠতে হয়, তাহলে প্রথমেই যেটা করা দরকার তা হল ‘বীর্য সংরক্ষণ’ ৷ এই ধারণাটা কিন্তু সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ভাবে কাজ করছে ৷
প্রশ্ন: ভারতসরকার বিভিন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের বলেছে, যে, পর্নসাইটগুলো যাতে ভারতে দেখা না যায় তার ব্যবস্থা করতে। এই তথাকথিত ‘স্বচ্ছ’ ভারত তৈরির চেষ্টা কী ভারতীয় যৌনতার ঐতিহ্যের পরিপন্থী নয়?
অর্ণব: অবশ্যই ভারতীয় যৌনতার ঐতিহ্যের পরিপন্তী ৷ কারণ যৌনতার যে উচ্চারণ আমাদের প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগের গোড়া পর্যন্ত এসেছে, সেখানে আমার যৌনতার বিচিত্র ব্যবহার পাই ৷ কোনটা সুস্থ যৌনতা কোনটা অসুস্থ যৌনতা এই ভাগাভাগি থেকেই তো এই প্রশ্ন আসে যে সমকামিতা (পুরুষ বা নারীর) একটা পাপ ৷ অথচ সংস্কৃত সাহিত্যে এর অনেক উল্লেখ আছে ৷
প্রশ্ন: শকুন্তলা তার দুই সখি অনুসূয়া আর প্রিয়ংবদার সঙ্গে সারাক্ষণ জঙ্গলে কী করত?
অর্ণব: ঠিকই ৷ তাদের মধ্যে যৌন আকর্ষণ থাকা অস্বাভাবিক নয় ৷ খাজুরাহোর মন্দিরের যে স্থাপত্য, আমরা বিভিন্ন পর্নসাইটে যে ধরনের শারীরিক বিভঙ্গ দেখি তা সবই খাজুরাহোতে আছে ৷ শুধু প্রাচীন ভারত কেন, গার্লস স্কুল, গার্লস কলেজ, গার্লস হোস্টেল সর্বত্র খোঁজ নিলে এই সমকামী আকর্ষণের অসংখ্য প্রমাণ মেলে ৷ ছেলেদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা হুবহু এইরকমের ৷
প্রশ্ন: এমনকি পশুকামিতাও আছে খাজুরাহো স্থাপত্যে…
অর্ণব: হ্যাঁ, আছেই তো ৷
প্রশ্ন: যেটা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় যে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের গায়েও ওই একই ধরনের স্থাপত্য ছিল, শুদ্ধবাদীরা ভেঙে সাফ করে দিয়েছে।
অর্ণব: শুধু পুরীর মন্দির নয়, আমার ধারণা কোণার্কের মন্দিরের স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে ৷ এই যৌনতা আমাদের ঐতিহ্য ৷ এই বিষয়ে খোলামেলা উচ্চারণের জায়গা আমাদের সমাজে বরাবরই ছিল ৷ নইলে বাৎসায়ন ‘কামসূত্র’ লিখতে পারতেন না ৷ আমাদের বাংলায় যে আদি কৃত্তিবাসী রামায়ণ, সেখানে ভগীরথের জন্ম সম্পর্কে বলা হচ্ছে ভগে ( যোনি) ভগে ঘর্ষণে ভগীরথের জন্ম হয়েছে ৷ মানে নারী সমকামিতার সম্পর্ক থেকেই ভগীরথের জন্ম ৷ যদিও ঘটনাটা অলৌকিক, কিন্তু ধারণাটা সমাজে ছিল, নইলে লেখায় সেটা এল কী করে? আর পুরো যৌনতাটাই ধর্মের সুতোয় বাঁধা ৷ মন দিয়ে পুরাণগুলো পড়লে বোঝা যাবে বহুগামিতা, বহুকামিতা, সমকামিতা, পশুকামিতা সবরকম যৌনতার কথাই সেখানে আছে ৷
প্রশ্ন: তাহলে সরকার ঐতিহ্যের নামে পর্নসাইট বন্ধ করছে কেন?
অর্ণব: এই যে সরকার এখন শাসন করছে আমাদের, এদের পেছনে আছে আর.এস.এস ৷ এই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের যৌনতা সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ধারণা আছে ৷ সেটি হল যৌনতাকে পরিবারের মধ্যেই আবদ্ধ রাখতে হবে এবং সেটি প্রজননের কাজে লাগাতে হবে ৷ এটিই একমাত্র ভালো যৌনতা, বাদ বাকি সব খারাপ যৌনতা ৷ একটু আগে যে অন্নদাচরণ খাস্তগীরের কথা বললাম, তাঁর ধারণাটাই ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে গৃহীত হয়ে আর.এস.এস-এর তত্বে পরিণত হয়েছে ৷ উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বুদ্ধিজীবী ভূদেব মুখোপাধ্যায় বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এঁদের লেখা থেকে যা পাওয়া যায় তা হল এই হিন্দুত্বে যৌনতাকে দমন করার চেষ্টা হয়েছে, তাকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে ফেলা হয়েছে ৷ স্বামী-স্ত্রীর যৌনতার বাইরে যে কোনও যৌনতা খারাপ ৷ সেই অতিরিক্ত যৌনতার জাতি গঠনে কোনও প্রয়োজন নেই ৷ সেই ধারণা থেকেই মকবুল ফিদা হুসেন যখন নগ্ন সরস্বতী আঁকেন, তখন তাঁর উপর আক্রমণ নেমে আসে ৷
প্রশ্ন: সেটার আরও একটা কারণ মুসলমান শিল্পী কেন হিন্দু দেবীকে নগ্ন করেছে?
অর্ণব: হতে পারে ৷ কিন্তু মীরা নায়ারের ‘ফায়ার’ সিনেমাটিকেও তারা আক্রমণ করেছে, সেখানে নারী সমকামিতা দেখানো হয়েছে বলে ৷ মূল ব্যাপারটা হল শুদ্ধ ভারতীয় পারিবারিক যৌনতার বাইরে কোনও কিছুকে সহ্য করা হবে না ৷ এই সরকার ক্ষমতায় আসার ফলে এই শুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারটা নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে ৷ এই আর.এস.এস-এর হিন্দুত্ব রক্ষার অনেকগুলো মুখ আছে বজরং দল, দুর্গাবাহিনী ইত্যাদি ৷
প্রশ্ন: যৌনতা নিয়ে আমাদের কম্যুনিস্টরাও কিন্তু খুব রক্ষণশীল, তোমার মনে কী হয়?
অর্ণব: বাংলার কমিউনিস্টদের যৌন নৈতিকতার ভণ্ডামিটা ভয়ংকর ৷ এঁদের মাথার মধ্যে একটা উচ্চরক্ষণশীল নৈতিকতা কাজ করছে যেটাকে তারা মার্কসবাদ নাম দিয়ে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে এসেছে ৷ যেন মার্কসবাদ যৌনতা বিরোধী ৷ বাংলার মার্কসবাদীরা বোঝাতেন যৌনতা ব্যাপারটাই এসেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি থেকে এবং কম্যুনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করবেই ৷ যে কারণে ওরা হাংরি জেনারেশন সাহিত্যের বিরোধিতা করেছিল ৷ হাংরি সাহিত্যে যৌনতার যে উচ্চারণ সেটাকে প্রতিষ্ঠিত মার্কসবাদীরা কী চোখে দেখেছে? বাংলার কমুন্যনিস্টরা যৌনতা বিষয়টাকেই বুঝতে পারেনি ৷ সেই একই হিন্দুত্ববাদী ব্রহ্মচর্যের ধারণা রয়ে গেছে ভালো কম্যুনিস্ট হয়ে ওঠার পদক্ষেপ হিসেবে ৷ অথচ এরা ভিরমি খাবেন স্বয়ং কার্ল মার্কসের একাধিক অবৈধ সন্তান ছিল, এটা জানলে ৷
প্রশ্ন: বাংলা পর্নোগ্রাফি নিয়েও তুমি কাজ করেছ, সেই বিষয়ে কিছু বলো।
অর্ণব: গত শতকের ৬০-এর দশক হল বাংলা পর্নোগ্রাফির উচ্চফলনশীলতার দশক ৷ আমার সংগ্রহে ৬০ ও ৭০-এর বাংলা পর্নোগ্রাফি আছে ৷ ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলা পর্নোপত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ৷ যেমন ১৯৭৭-এর আগে যে পত্রিকাটির নাম ছিল ‘রূপালী প্রজাপতি’, তাতে সেক্স ম্যানুয়াল থাকত, পর্নো স্টোরি থাকত পাশাপাশি জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্পও থাকত ৷ সেটা কিন্তু হলুদ পর্নোগ্রাফি বলতে যা বোঝায় তা ছিল না ৷ ৭৮/৭৯ থেকে দেখছি নামটি এক থাকলেও তার ম্যাগাজিন চরিত্রটি আর নেই ৷ তা পুরোপুরিই পর্নোপত্রিকায় পরিণত হয়েছে ৷ ‘রূপালেÏ প্রজাপতি’ প্রকাশ্যে বিক্রি হত ৷ হলুদ পর্নো পত্রিকাটি গোপনে বিক্রি হয় ৷ আমার মনে হয়, ক্ষমতাসীন মার্কসবাদীরা যে যৌন অবদমন শুরু করেছিল যার ফলে এত হলুদ পর্নোবইয়ের জন্ম হল ৷ ৭০-এর দশকে ‘তনুমন’ প্রকাশ্যে বিক্রি হত ৷ ‘দেহমন’ বিক্রি হত ৷ এই পত্রিকাগুলোতে সেক্স ম্যানুয়াল থাকত, থাকত যৌনতা সংক্রান্ত নানা সমস্যার প্রশ্ন-উত্তর ৷ সিনেমার খবর ৷ ছোটো গল্প ৷ এইসব পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হওয়া বন্ধ হয়ে গেল ৷ এই জিনিসটা বেড়ে উঠছিল ৮০র দশক পর্যন্ত ৷ ৯০-এর দশকে এসে এটা ভেঙে পড়ে ৷ বিশ্বায়নের ফলে ইন্টারনেটের ব্যবহার আমাদের জীবনে ঢুকে পড়ল ৷ এসে পড়ল হাজার হাজার পর্নসাইট ৷ বাংলা পর্নোগ্রাফির বাজার শেষ হয়ে গেল ৷ কারণ, পড়ার বদলে সে চোখের সামনে রঙিন জ্যান্ত যৌনতা দেখতে পাচ্ছে ৷ বাংলা পানু আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল ৷ ইন্টারনেটে যৌনতার একটা নতুন বাণিজ্যিক চেহারা তৈরি হল ৷ এবং তা উত্তুঙ্গ চাহিদায় বদলে গেল ৷ স্বাভাবিক ভাবেই ব্যক্তিগত অধিকারের দাবিতে, সরকার পর্নসাইট নিষিদ্ধ করেও এক পা পিছিয়ে গিয়ে তা উন্মুক্ত করে দিয়েছে ৷ এছাড়া বাজারে ব্লুফিল্ম ঢেলে বিক্রি হচ্ছে ৷ শুধু তাই নয় পর্নসাইটে যেমন ফিল্মগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা, সেরকম যারা বিক্রি করে তারাও ওইরকম ভাগ করে রাখে, খদ্দেরের চাহিদা অনুযায়ী দেয়, ইনসেস্ট বা ওল্ড এজ সেক্স বা ফ্যামিলি সেক্স, এক্সপ্লয়েটেশন সেক্স বা বিডিএসএম ৷
প্রশ্ন: ১৪৪ টা সাইট শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো চাইল্ড পর্ন সংক্রান্ত…
অর্ণব: হ্যাঁ ৷ একটা সার্ভে আমি দেখেছিলাম ফেসবুকে, সারা ভারতে কোথায় কোথায় কত লোক পর্নসাইট দেখে এবং কখন পর্নসাইটে হিট বেড়ে যায় ৷ ২৬ জানুয়ারি আর ১৫ অগাস্ট পর্নসাইটে হিট সারা বছরের তুলনায় ৪% বেশি বাড়ে ৷ সবচেয়ে কম হিট হয় দেওয়ালিতে ৷ মনে রাখতে হবে, যৌনতা একটা বিরাট সামাজিক শক্তি ৷ যে শক্তিটা হল অ্যাংকারেজ পয়েন্ট, এটা ফুকো বলেছেন, যে শক্তি পুরো কাঠামোকে ধরে রেখেছে ৷ এই কাঠামোটাকে কীভাবে রেগুলেট করব সেটা আমি ভাবতে পারি, কিন্তু কাঠামোটাকে ভাঙতে পারি না ৷ আজকে ১৮ থেকে ২২ এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে ধরনের খোলামেলা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেখানে যৌনতা অনেক সহজ হয়ে এসেছে ৷ আমার তো মনে হয় এটা ভালোই হয়েছে ৷
প্রশ্ন: ‘‘বাঙ্গালীদের বেশী কলঙ্ক। জাতিতে জাতিতে, জাতিতে বিজাতিতে, সম্পর্কে সম্পর্কে, সম্পর্কে নিঃসম্পর্কে, বাঙ্গালী নর-নারী পাপলিপ্ত হলেই নিরাপদের আশাতে কাশীতে পালিয়ে আসে, মাতুলের ঔরসে ভগিনী-পুত্রী, পিতৃব্যের ঔরসে ভ্রাতৃকুমারী, ভ্রাতার ঔরসে বিমাতৃকুমারী, ভাগিনেয়ের ঔরসে মাতুলানী, জামাতার ঔরসে শ্বশ্রু-ঠাকুরানী, শ্বশুরের ঔরসে যুবতী পুত্রবধূ গর্ববতী হলেও কাশীধামে পালিয়ে আসে! গর্ভগুলি নষ্ট কোত্তে হয় না, কাশীর পবনের প্রসাদে বংশ-রক্ষা হয়’’। (হরিদাসের গুপ্তকথা/ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়) এই বইটি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা। তো এই হল উনিশ শতকে বাঙালির পারিবারিক যৌনাচারের ইতিহাস। এই বিষয়টা তুমি কীভাবে দেখ?
অর্ণব: ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’-র একমাত্র সটীক সংস্করণটি আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪-র বইমেলায় ৷ শেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৪-এ এবং খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ হয়েছিল ৷ এই বইয়ের লেখক নিয়েও বিতর্ক আছে ৷ শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে বইটি লেখানো হচ্ছে ৷ ভুবনচন্দ্র ছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়ির ভাড়াটে লেখক ৷ উনি পরে নিজে একটি বটতলা সংস্করণ প্রকাশ করেন ৷ দুটোর ভাষাগত পার্থক্য আছে ৷ এরপর তো বইটা ভুবনচন্দ্রর নামে চলেছে ৷ কাশী শহর হচ্ছে এমন একটা জায়গা যা বাঙালি হিন্দুর যাবতীয় যৌন কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে ৷ কাশীতে আমি আমার নিষিদ্ধ যা কিছু ব্যক্তিগতকে নিয়ে পালিয়ে থাকতে পারি ৷ আমার যাবতীয় ‘অপর’কে নিয়ে কাশীতে থাকতে পারি, কিন্তু বাংলার সমাজে থাকতে পারব না ৷ এখানকার যা কিছু অবৈধ সম্পর্ক সেসব নিয়ে কাশীতে চলে যাওয়াই রীতি ছিল বাঙালির ৷ আর কাশী যেহেতু বাবা বিশ্বনাথের স্থান তাই ওখানে সব কিছুই পবিত্র হয়ে যায় ৷
প্রশ্ন: একদিকে বলা হচ্ছে পবিত্র পরিবার আর এইসব সম্পর্কগুলো পারিবারিক সম্পর্ক…
অর্ণব: এটাই তো উনিশ শতকের পরিবারগুলোর ভেতরের চেহারা, এটাই তো আসল চেহারা ৷ এটা তো শুধু ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ নয়, ওই সময়ের ৫০৭টি বটতলার টেক্সট নিয়ে জয়ন্ত গোস্বামীর যে সুবৃহৎ গ্রস্থ (প্রহসনে উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির সমাজচিত্র) পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ প্রহসনের বিষয় হচ্ছে অবৈধ সম্পর্ক ৷ এটা পড়লে বোঝা যাবে আমাদের হিন্দু জাতীয়বাদের যে প্রকল্প তার নিয়মগুলো কোথায় কোথায় বিচ্যুত হচ্ছে ৷ এবার বিষয়টাকে যদি আমি উল্টো করে দেখি, তবে বুঝব, যেটাকে বিচ্যুতি বলা হচ্ছে সেটাই সমাজের চেহারা, সমাজটা এই রকমই যৌনাচারে পূর্ণ ৷ আমি দেখাতে চাইছি পলিসিমেকার সমাজে এইসব যৌনাচার থাকা উচিত নয় ৷ অথচ বাস্তবটা এরকমই ৷ উনিশ শতকের ইউরোপীয় সমাজের ক্ষেত্রেও এটা সত্য, শুধু বাঙালি বলে নয় ৷ বাঙালি লিখে রেখেছে ৷ অন্যরাও কি লিখে রাখেনি? আরও বেশি লিখেছে ৷ মোদ্দা কথা হল, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই আমাদের ‘পরিবার গঠন’ সংক্রান্ত নতুন ধারণার জন্ম হল ৷ পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা ‘পরিবার’কে কন্দ্রে করে নিজেকে পুনর্গঠিত করল আর নতুন করে নির্ধারিত হল পরিবারে নারীর স্থান, শিশুর পরিচর্যা, শিশু-কিশোরদের যৌনতার উপর নজরদারির নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক প্রকল্প ৷ পরিবার হল ‘কাল্পনিক জাতি রাষ্ট্রে’র একক ৷ কাজেই সুস্থ-সবল জাতি গঠনের প্রধানতম শর্ত স্যানিটাইজড পরিবার ৷ সেই স্যানিটাইজেশনের প্রক্রিয়াই নির্ধারণ করে দেয় ভালো যৌনতা আর খারাপ যৌনতার পৃথক পৃথক শর্তাবলি ৷ বিগত ১৫০ বছর ধরে বাঙালি পরিবার, বিশেষত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার এই মরাল কোডগুলোকেই বিচিত্রভাবে আত্মস্থ করেছে ৷ আজও শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের অভিভাবকদের কাছে যৌনতা একটা ভয়ঙ্কর ট্যাবু ৷ প্রজননমূলক কৃত্য হিসেবেই এর যা কিছু ভ্যালিডিটি ৷ সামাজিক শ্রেণি হিসেবে বাঙালি ভদ্র মধ্যবিত্তর উত্থানের সঙ্গে এই যৌন নৈতিকতা সরাসরি জড়িত ৷ বিশ্বায়নের প্রবল ঢেউ এবং ফোকাসে গ্লোবাল ভিউ চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে খুব ধীরে হলেও এই দৃষ্টিকোণ বদলাচ্ছে ৷ কিন্তু মোটের উপর কোনও বদল আসেনি ৷ আজও আমাদের ছেলেমেয়েরা সমকামী বা রূপান্তরকামী হলে সবার আগে আমরা ক্লিনিক্যাল রিজন খুঁজি ৷ এটা যে চয়েস হিসেবেই থাকা সম্ভব সেটা শিক্ষিত বাঙালির মাথাতেও আসবে না ৷
প্রশ্ন: এই গবেষণার খোঁজ আর তোমার ব্যক্তিগত জীবনের ভিতর আর কী কী ধরনের যোগ রয়েছে বলে তুমি মনে করো?
অর্ণব: ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটি যে আসলে একটি দানবিক অণুক্ষমতার একক এটা আমি গোড়ায় বুঝতে না পারলেও পরে ক্রমশ বুঝতে পারি ৷ ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটি ক্রমশ অকেজো হয়ে যাবে একদিন, কারণ মাত্রই কয়েকটা মোটাদাগের দাবি পূরণ আর স্থ²ল বস্তুগত চাহিদা ছাড়া এই হিংস্র প্রতিষ্ঠান মানুষকে আর কিছুই দিতে পারে না ৷ যে কারণে উন্নত পৃথিবীতে ক্রমশই দাম্পত্য তার গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে ৷ বরং বড়ো হয়ে উঠছে নারীপুরুষের মুক্ত পারস্পরিক সম্মানবোধের সম্পর্ক ৷ পাশে থাকতে পারা, হাতে হাত ধরা ৷ বিবাহে যৌনতার ভূমিকা কী? জাস্ট নাথিং ৷ প্রজননমূলক ক্ষণস্থায়ী কিছু মুহূর্ত ছাড়া যৌনতার কোনও ঠাঁই নেই বাঙালির বিবাহে ৷ অথচ যৌনতার সবচেয়ে বড়ো দিক হল উপভোগ বা pleasure, যা বাঙালি দম্পতিরা আজও কল্পনাই করতে পারে না ৷ দাম্পত্যের সবচেয়ে সুন্দর দিক হল সন্তান ৷ যদিও সন্তান উৎপাদনের জন্য বিবাহের আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই ৷ এটা আজ আমার স্থির বিশ্বাস ৷ মোটের উপর বলতে পারি বাঙালি দাম্পত্য আসলে একটা অসুস্থ অবদমন প্রবণ আধিপত্যমূলক ক্ষমতাকাঠামো ৷ একজন ক্রিয়েটিভ লেখকের প্রধান কাজ একে চ্যালেঞ্জ করা ৷ একে ভিতর থেকে ভেঙেচুরে দেওয়া ৷ তার ফলে জন্ম নেবে অভিজ্ঞতার বিচিত্র রামধনু বর্ণালি ৷
প্রশ্ন: বাঙালি মধ্যবিত্ত মননে এই বিশেষ দিকটি তৈরি হবার পিছনে ঠিক কী কাজ করছে?
উত্তর: এটা হল একটা অস্বাভাবিক বাধ্যতামূলক ছাঁচ ৷ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নামক যে বাঙালি বর্গ দেড়শ বছরে ডেভেলপ করেছে তাদের মতো হিপোক্রিট জাতি গোটা ভারতে আছে কিনা প্পসন্দেহ ৷ প্রথমত কেরানিবৃত্তি, শিক্ষকতার মতো নিরীহ নিরাপদ পেশায় এরা প্রথমদিন থেকেই সচ্ছন্দ ৷ লর্ড মেকলের সাধের সন্তানরা এক চূড়ান্ত রক্ষণশীলতা, সংকীর্ণতা, পিছুটানসর্বস্বতার শিকার ৷ অথচ মুখে তাদের সর্বদা প্রগতিশীলতার বুলি ৷ প্রত্যেকটি মধ্যবিত্ত নারীপুরুষের মনের অন্তরে একটা করে পল্লিসমাজ, চণ্ডীমণ্ডপ আর ‘খাপ পঞ্চায়েত’ আছে ৷ জগৎ ও জীবনের বৃহত্তম আঙিনা থেকে বিচ্যুত বলে এদের বৃহদংশ আজও মাতৃগর্ভ ছেড়ে বেরোতে শেখেনি ৷ রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’তে এদের কথাই বলেছিলেন ৷ এরা না পুরোদস্তুর পুরুষ, না যৌনতাকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারা নারী ৷ একটা অদ্ভুত ইফেমিনেট জাত, ঔপনিবেশিক আধুনিকতার সঙ্গে নিজস্ব রক্ষণশীলতার মিশেলে তৈরি ৷