পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট: ১ -ব্যোমকেশ ও সত্যবতীর প্রস্থান

পরিশিষ্ট: ১ -ব্যোমকেশ ও সত্যবতীর প্রস্থান – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত

সকালবেলা, সাড়ে সাতটা বেজেছে। সত্যবতী কেয়াতলা থেকে রিক্সা করে গড়িয়াহাট মার্কেটে যাচ্ছিল, এমন সময় মোড়ের মাথায় খবরের কাগজের স্টলে চোখ পড়ল। একটা কাগজ কিনে পাতা ওল্টাতেই দেখে বড় হরফে একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে—শরদিন্দু অম্‌নিবাসের শেষ খণ্ড শিগগির বের হবে। পাঠক-পাঠিকাদের প্রকাশক ধন্যবাদ জানাচ্ছেন তাঁরা এতদিন এই গ্রন্থাবলীকে যথেষ্ট সমাদর করেছেন। সত্যবতীর মনে হল যাক এতদিনে কাজটা শেষ হল। প্রথমে যতটা তাড়াতাড়ি হচ্ছিল শেষের দিকে অতটা নয়; পনের বছর লেগেছে। তাহলেও একটা কাজ শেষ হল তো। বেচারি শরদিন্দুবাবু। জীবনের একটা বড় অংশ ব্যোমকেশ-সত্যবতীর জন্য তিনি ব্যয় করেছেন। ভদ্রলোক একটা গাড়ি দেবেন বলেছিলেন সেকথা রাখতে পারেননি। মারা গেলে আর কি করা যাবে? সেই যে কে যেন এক অধ্যাপকের সঙ্গে হাতিবাগানে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলেন সেখানে অভিনেতা একজন খুন হয়ে গেল; তারপর তো পুলিসের হাঙ্গামা। আগে থেকেই তাঁর শরীর ভাল যাচ্ছিল না। থিয়েটারের হুজ্জুতি না উঠলে তিনি হয়ত আরও কিছুদিন ভাল থাকতেন। এই ভাবতে ভাবতে সত্যবতীর চোখ ছলছল করে উঠল। রিক্সা এর মধ্যে গড়িয়াহাট বাজারে এসে গিয়েছিল। সত্যবতী দুটি ব্যাগ হাতে করে নামল। অন্যদিন সত্যবতী খুব উৎসাহে বাজার করে। আজ তার সেরকম উৎসাহ ছিল না; বাজার করতে করতে শরদিন্দুবারুর কথা মনে পড়ায় কিরকম অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। আলু, বেগুন, ঝিঙে, পটল, লঙ্কা, থোড়, উচ্ছে সে তত বাঁধাই আছে তার জন্য ভাবতে হবে না। চিংড়িমাছও কিনল। ভীষণ দাম, তা হোক। ব্যোমকেশ লাউচিংড়ি খেতে চেয়েছে। অন্যদিকে চোখ পড়ল, দেখল একটু দূরে একটা ঝুড়িতে অনেক ইলিশ মাছ রয়েছে। রোজ বাজারে ‘মুখপোড়া ইলিশ’ উঠছিল আজ তার বদলে ভাল জাতের নধর ইলিশ মাছ। একটা প্রায় এক কিলো ওজনের ইলিশ মাছ কিনল। দুজন প্রাণীর জন্য একটু বেশি হল, তা হোক্‌গে, ফ্রিজে রেখে দিলে চলবে। লাউ কিনতে ভুলে গেল। একবার বাড়ি গিয়ে পৌঁছলে পুঁটিরাম যা হয় করবে কিন্তু লাউচিংড়ি আর হবে না; ব্যোমকেশের কপালে নেই। ফিরতি রিক্সায় উঠে একবার ভাবল ফিরে গিয়ে একটা লাউ কিনে আনে কিন্তু বেশ গরম পড়ে গিয়েছে। মনে হল আবার এতটা পথ ফিরে যাব? লাউ না হলে এমন কি ক্ষতি হবে?

কেয়াতলায় বাড়িতে পৌঁছে দোতলায় উঠে দরজায় বেল টিপল। কেবল দুজনের জন্য পুরো বাড়ি রাখবার কোন মানে হয় না তাই ব্যোমকেশ একতলাটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। সত্যবতী প্রথমটা একটু আপত্তি করেছিল কে না কে এসে উঠবে কিন্তু ব্যোমকেশ সে কথা শোনেনি। যাই হোক ভাড়াটেদের সঙ্গে কোন গোলমাল হয়নি; তারা বেশ ভদ্র। আর ব্যোমকেশের বিষয়ে লেখা-টেখা পড়ে তার উপরে ভক্তিও হয়েছে। বেল টিপতে না টিপতে পুঁটিরাম দরজা খুলে বাজারের থলিদুটো ভিতরে নিয়ে গেল। স্নানের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যবতী বলল, ‘এই শুনছ।’ বলতে দোষ নেই সত্যবতীরও একটু বয়স হয়েছে। আগেকার দিনের মত আর তন্বী নেই। সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে হাঁপাচ্ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে আবার বলল, ‘এই শুনছ।’ স্নানের ঘরের দরজায় ছিটকিনিতে একটু আওয়াজ হল। দরজা খুলে ব্যোমকেশ বেরিয়ে এল। তার দাড়ি কামানো হয়ে গিয়েছে, ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিল, বলল, ‘এত চেঁচাচ্ছ কেন? হয়েছে কি? গরমে একেবারে ঘেমে নেয়ে গিয়েছ যে। দেখছ ন’টা বাজেনি এখনও, কিরকম গরম পড়েছে।’ সত্যবতী বলল, ‘সাধে কি চেঁচাচ্ছি। আমি আজকাল কিছু বললেই তোমার চেঁচানি মনে হয়। খবরের কাগজটা দেখ তাহলেই বুঝবে চেঁচালেও কোন দোষ হত না।’ ব্যোমকেশ কাগজটার উপর চোখ বুলিয়ে চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি। ভাবতেও খারাপ লাগছে। এখনও তো অনেক কিছু করবার বাকি ছিল। শার্লক হোম্‌স মরে গিয়েও কি ফিরে আসেনি। তাছাড়া তার ‘কেসবুকে’র কথা তো সবাই জানে। ব্যোমকেশেরও একটা ‘কেসবুক’ বের হতে পারত। সত্যবতী বলল, ‘তুমি যেমন আলসে, বাড়ি থেকে বের হতে বললেই তোমার প্রাণ বেরিয়ে যায়, তোমার আবার ‘কেসবুক’।’ ব্যোমকেশ বলল, ‘ঐ তো তোমার দোষ, চট করে রেগে যাও। আমার কত কথা তো লেখাই হয়নি। শেষের দিকে শরদিন্দুবাবু আবার ইতিহাসের গল্প-টল্প নিয়ে মেতেছিলেন কিনা। সেগুলো সিনেমা হয়েছে। খুব যে ভাল ছবি হয়েছে বলব না।’ সত্যবতী একটু চটে গিয়ে বলল, ‘ভাল খারাপের তুমি কি বুঝবে বল। তুমি এক ঠ্যাঙাড়েদের কথা বুঝতে পার।’ এমন সময় পুঁটিরাম ঘরে ঢুকে বলল, ‘মা, লাউ কোথায়? বাবুর জন্য লাউচিংড়ি হবে বলেছিলেন।’ সত্যবতী একটু বিব্রত হয়ে বলল, ‘এই যাঃ ভুলে গেছি। না ঠিক ভুলিনি; ফেরার পথে মনে পড়ল। তখন এত রোদ্দুর উঠে গিয়েছে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করল না। ভাবলাম পুঁটিরাম আছে যা হোক্‌ করে নেবে। পুঁটিরাম, তুমি বাবা একবার বাজারে যাবে?’ পুঁটিরাম বলল, ‘আপনাদের চা করে দিয়ে যাচ্ছি।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পুঁটিরাম চলে যেতেই ব্যোমকেশ কট্‌মট্‌ করে সত্যবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না ও যাবে না।’ সত্যবতী বলল, ‘কেন গেলে কি হয়? রাস্তায় বেরোলে তোমার চাকরের গায়ে ফোস্কা পড়বে?’ ব্যোমকেশ বলল, ‘সত্যবতী, তুমি তো এরকম ছিলে না। তোমার মন ভারি কোমল ছিল। দোষের মধ্যে তুমি খুব কাঁদতে। তোমার রং কালো বটে তবে তোমার বড় বড় চোখে বেশ মানাত।’ সত্যবতী বলল, ‘ওসব হেঁদো কথা রাখ। এখন কি করা যায় বল। তোমার গল্প তুমি নিজে একবার চেষ্টা করে দেখবে?’ ব্যোমকেশ বলল, ‘ও আমাকে দিয়ে হবে না। গল্প লেখা ডাকাত ধরার চেয়েও শক্ত।’ সত্যবতী বলল, ‘আমাকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা কোর না। আমি কি জানি না তোমার কী বুদ্ধি? সেই যে চীনে পাড়ার মেসে মেঝেতে কান পেতে নীচের ঘরের কথাবার্তা একটু একটু শুনেছিলে তাতে কতবড় একটা চোরাকারবারীর দল ধরা পড়ে গেল। তখন থেকে তো অজিতের সঙ্গে ভাব তোমার। বলতে বটে ‘সত্যান্বেষী’ কিন্তু কে তোমাকে চিনত? অজিত এখন কোথায় আছে কে জানে? শুনলাম দূরে কোথায় ব্যবসা করছে। গাড়িও কিনেছে নিশ্চয়।’ ব্যোমকেশ উত্তর দিল না। সত্যবতী আবার বলল, ‘সেই যে আর একবার তুমি একটি মেয়ের নীল চোখ দেখে আসল কথাটা বুঝে ফেললে। তখন অবশ্য তোমার বেশ নাম হয়েছে।’ ব্যোমকেশ আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বোধহয় অজিতের কথা তারও মনে পড়ছিল। খানিকক্ষণ পরে বলল, ‘সত্যবতী, যদি রাগ না কর তো একটা কথা বলি।’ সত্যবতী অনেকদিন ব্যোমকেশের এরকম গলা শোনেনি। সে বলল, ‘কিছু বলবে তো, দাঁড়াও, লাউয়ের পয়সা দিয়ে আসি।’ এই বলে উঠে গেল। দু মিনিট পরে ফিরে এসে বলল, ‘কি বলছিলে এইবার বল।’ ব্যোমকেশ বলল, ‘কিছুদিন থেকে আমিও ভাবছি কি করা যায়। এদিকে কাজকর্ম তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। অভিনয়ের সময় exit লাইন ভুলে গেলেই বিপদ। রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজেকেই কেমন বোকা বোকা মনে হয়।’ সত্যবতী বলল, ‘সে কি গো, এখনি exit লাইন কি? আমার তো নানারকম প্ল্যান আছে। তিনটে বড় টব এনে রেখেছি বৃষ্টি পড়লেই তাতে দুটো কাঞ্চন আর বোগেনভিলিয়া লাগিয়ে দেব। সেগুলো তো বড় হবার আগে আমি কোথাও চলে যাবার কথা ভাবতেই পারছি না।’ ব্যোমকেশ বলল, ‘ঐ তো মেয়েদের দোষ, সবজায়গায় সংসার পেতে বসে আছ। আমার ঠাকুমা বাড়ির গাছের মোচা, গোরুর দুধ আর রান্নাঘরের চালে লাউয়ের ডগা এইসবের মায়ায় এমন জড়িয়েছিলেন যে তাঁর শ্রীক্ষেত্র যাওয়া হল না। যাদের সঙ্গে পুরী যাবার কথা ছিল তারা ডাকতে এসে হতাশ হয়ে বকতে বকতে চলে গেল। তোমারও তো সেই দশা হয়েছে দেখছি।’ সত্যবতী বলল, ‘তুমি কি করে বলছ দুই একরকম। পুরী গেলে তো ফিরবার পথ আছে কিন্তু তুমি যা বলছ তাতে ফিরবার কোন পথ নেই। এখানেই বা এমন কি মন্দ আছি।’ ব্যোমকেশ বলল, ‘আহা, তুমি বুঝছ না। চিরকাল তো এমন থাকবে না। মানুষ সাজতে গেলেই বয়স বলে একটা জিনিস আছে তো। এই আমাকেই দেখ ছুটতে গেলেই হাঁপ ধরে। পিছনে পিছনে ছুটবে এমন ‘মোরিয়েটি’ আমার কেউ নেই কিন্তু তার পিছনে ছুটছি এমন ভাবতেও আমার হাঁপ ধরে। মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবার অসুবিধেও অনেক। বাজার তো দিন দিন চড়ছে। তবু দেখ আমাদের দুজনের কি এমন খরচ লাগে। অবিশ্যি পুঁটিরামকেও ধরবে আমাদের সঙ্গে। নীচেটা তো ভাড়া দিয়ে দিয়েছি, বই থেকেও আসছে কিছু। তাছাড়া এমন ডিটেকটিভ আছেন যাঁরা ঘর থেকেই বের হন না। ঘরে বসেই সব সমস্যা সমাধান করেন। আসল কথা আর আমার ভাল লাগছে না।’ এইসময় পুঁটিরাম ঘরে ঢুকে বলল, ‘মা, অনেক বেলা হয়ে গেছে। আমার রান্না হয়ে এল। বাবু এবার স্নান করে নিলে ভাল হত।’ সত্যবতীর তো সকালেই স্নান করা অভ্যাস। অন্যদিন হলে ব্যোমকেশের এইসময় স্নান হয়ে যেত কিন্তু আজ সত্যবতীর সঙ্গে কথাবার্তায় দেরি হয়ে গেল। তাছাড়া কিছুদিন হল ব্যোমকেশেরও কিরকম ‘শিথিল স্বভাব’ হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, ‘আমি স্নান করে নিচ্ছি।’ এই বলে তোয়ালে কাঁধে ফেলে স্নানের ঘরে ঢুকল।

বেলা প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। ইতিমধ্যে দৃশ্য পরিবর্তন হয়েছে। ব্যোমকেশ ও সত্যবতী খেতে বসেছে। খাবার টেবিলটি ছোট তবে চারজন বসতে পারে। টেবিলের উপরে ভাত, মুগের ডাল, ইলিশ মাছের ডিমের ভাজা, লাউচিংড়ি, ইলিশ মাছের ঝোল। একটি বড় পাত্রে বাড়িতে পাতা দই। রাত্রে শুতে যাবার আগে সত্যবতী পেতে রেখেছিল। এটা তার বহুদিনের পুরনো অভ্যাস। ব্যোমকেশ খাবার সময় একটু দই খেতে ভালবাসে। খাবার সময় বিশেষ কথাবার্তা হল না। একই কথা বারে বারে মনে হতে লাগল। ব্যোমকেশ শেষ পর্যন্ত না থাকতে পেরে বলল, ‘একেবারে ‘ফেড-আপ’ হয়ে গেছি। অজিত ট্যাক্সির কারবার করলে তার ওখানে অন্তত ট্যাক্সি চালাবার কাজ পাওয়া যেত।’ সত্যবতী শুধু বলল, ‘বাজে বোকো না।’ ব্যোমকেশ খবরের কাগজ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল কিন্তু কথা আর জমল না। এমন সময় পুঁটিরাম ঘরে ঢুকে বলল, ‘মা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, দেশের লোক এসেছে। বিকেলে চা ক’টার আনব? সত্যবতী বলল, ‘যা গরম চা খেতে ইচ্ছে করছে না। যাক্‌ পাঁচটার সময় সময় নিয়ে এস; তার আগে দরকার নেই। আরও আধঘন্টা কেটে গিয়েছে। এমন সময় নীচ থেকে কে ‘ব্যোমকেশ বাড়ি আছ’ বলে হাঁক দিল। সত্যবতী বলল, ‘কে চেঁচাচ্ছে দেখ। বেল টিপছে না কেন?’ ব্যোমকেশ বলল, ‘লোডশেডিং তো আরম্ভ হয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক আগে তা খেয়াল করনি। এই হচ্ছে শহর। মাছ ছোঁবার উপায় নেই এত দর। লোডশেডিং দিনে তিনবার করে হচ্ছে। দোতলায় জল তুলবার জন্য যে পাম্প চালাব তার উপায় নেই।’ এই বলে নীচে গিয়ে দরজা খুলল। দুমিনিট পরে ব্যোমকেশ যাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল তাকে দেখে সত্যবতী যেমন খুশি তেমন অবাক। সত্যবতী বলল, ‘অজিত, আজ সকালেই তোমার কথা হচ্ছিল। কতদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। কোথায় আছ, কি করছ কিছুই জানি না।’ অজিত বলল, ‘সব কথা হবে ধীরে ধীরে। তোমরা কি করছ সে কথাও তো আমার জানা দরকার। এখন এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল দাও তো। কি গরম!’ সত্যবতী বলল, ‘জল দিচ্ছি, ঘোল করে দেব? কিন্তু খুব ঠাণ্ডা হবে না। দেখছ না কারেন্ট নেই।’ এই বলতে বলতেই পাখা ঘুরতে আরম্ভ করল। ব্যোমকেশ বলল, ‘দেখেছ অজিতের কি ক্ষমতা। ওর এত ক্ষমতা যখন আমরা একসঙ্গে ছিলাম টের পাইনি।’ অজিত বলল, ‘এখানে থাকতে ক্ষমতা দেখবে কি করে? তুমিই তো সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে রাখতে, আমাকেও। তোমাদের সঙ্গে শেষ দেখা হবার পর পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। দেখ ব্যোমকেশ, যা ঘটে তা মঙ্গলের জন্যই ঘটে। আমি জানি তুমি একথা বিশ্বাস করবে না; তাহলে আমার কথা শোন। বইয়ের ব্যবসা তো চলল না অথাৎ চালাতে পারলাম না। সে কি আমার কাজ! কোথায় কার কাছে একটু সস্তায় কাগজ পাওয়া যায় তার পিছনে ঘোরাঘুরি, দপ্তরীকে তোয়াজ করা। বই ছাপা হলেও ঘুম হত না যদি দপ্তরীর বাড়ি আগুন লেগে যায়, সব ফর্মা পুড়ে যাবে। লেখকদের কথা আর বোলো না। যাদের কিছু নামডাক হয়েছে তাদের কি রোয়াব। বলে তিন হাজার টাকা দিয়ে যাও আগে, ভেবে দেখছি তোমাকে কি দেব। কিংবা তিন ফর্মার ম্যাটার ছুঁইয়ে দিয়ে বলে এইটে প্রেসে পাঠিয়ে দিন, তারপর যেমন লিখব এসে নিয়ে যাবেন। কিছু পুরনো বইয়ের যার কপিরাইট নেই কিন্তু বাজার আছে তাই ছাপতে গেলুম। দেখি সব প্রকাশক একই কথা ভেবে রেখেছে কাজেই দাঁড়াব কোথায়। তোমাদের সঙ্গে তখন দেখাসাক্ষাৎ হয় না। এক গুজরাটি ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। সে বলল, ‘অজিতবাবু, আপনি যা করছেন ওতে কোন নাফা নেই।’ আমি চোখ বুজে তার সঙ্গে নেমে পড়লাম; ফল কিছু খারাপ হয়নি বুঝতেই পারছ।’ ব্যোমকেশ বলল, ‘কিসের ব্যবসা?’ অজিত বলল, ‘বলছি। ব্যবসা তো একটা নয়। রাজনন্দনগাঁও বলে একটা রেল স্টেশন আছে জান। ইদানীং তো তুমি প্লেন ছাড়া নড়তে না। সেকালে যখন ট্রেনে চড়তে তখন বোম্বাই যেতে দেখেছ নিশ্চয় কলকাতা থেকে ন’শ কিলোমিটার দূরে। সেখানে আমার ইটের কারবার—ইটের ভাঁটা আর তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক। সেখান থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে আমার আর একটা ব্যবসা আছে কাগজ তৈরি করবার মিল। সেখানে এখনও প্রোডাক্‌সন আরম্ভ হয়নি। বইয়ের ব্যবসা যখন শুরু করেছিলাম তখন কাগজওলারা তো আমাকে বিলক্ষণ ঘুরিয়েছে। ভাবলাম আমি একবার দেখি ঘোরাতে কেমন লাগে। জায়গাটার নাম ‘তিনসোনা’। ছোট ছোট তিনটে পাহাড় আছে, ঝরণা, রাত্রে মাঝে মাঝে নেকড়ে বের হয়। জায়গাটা খুব সুন্দর। সত্যবতীর ভাল লাগবে। আমি বলছি কি তোমরা আমার সঙ্গে চল। দুটো জায়গাই দেখ, যে জায়গাটা পছন্দ হবে সেইখানে থেকে যাবে।’ সত্যবতী বলল, ‘আমার তো ভাল লাগছে, শুনেই যেতে ইচ্ছে করছে।’ অজিত বাধা দিয়ে বলল, ‘সে আমি বুঝতে পেরেছি।’ ব্যোমকেশ বলল, ‘আমি ওখানে গেলে তোমার এমন কি কাজে লাগব?’ অজিত বলল, ‘সেকথা বোল না। আমার পাঁচ বছর ব্যবসা করে অনেক জ্ঞান হয়েছে। তুমি যদি স্পেশাল অফিসার হয়ে যেতে বা ম্যানেজার হয়ে যেতে তাহলে লোকে ভাববে তুমি একজন ইট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অথবা কাগজের মিলের সঙ্গে তোমার অনেকদিনের সম্পর্ক। আর যদি ডিরেক্টর হয়ে যাও তাহলে এসব কথা উঠবেই না। আর ব্যোমকেশ বক্সীকে ওখানে চিনে ফেললে অসুবিধে হবে ভাবছ? ব্যোমকেশ, তুমি হয়ত রাগ করবে কিন্তু কলকাতা ও দিল্লীর বাইরে কে তোমাকে চিনবে? দরকার হয় তো ওখানে গিয়ে একটু গোঁফ রাখতে পার।’ সত্যবতী বলল, ‘গোঁফ, রামঃ। তাহলে আর গিয়ে কাজ নেই।’ অজিত খুব তাড়াতাড়ি বলল, ‘না না, গোঁফের দরকার নেই। সব কিছুই তো বদলে যায়। আমাকে দেখছ না আমি কিরকম বদলে গেছি।’ সত্যবতী অনেকক্ষণ থেকে ঠাহর করে অজিতকে লক্ষ্য করছিল, দেখছিল অজিত কিরকম বদলে গিয়েছে। অজিতের গায়ে মাংস লেগেছে। জায়গাটার আবহাওয়া নিশ্চয় ভাল। পোশাকও বদলেছে। আগে তো ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া কিছু পরত না। এখন দামী কাপড়ের ট্রাউজার ও শার্ট। অজিত আবার বলল, ‘শোরগোল করে কাজ নেই। সঙ্গে গাড়ি আছে, গাড়ির ভিতরে আমার স্যুটকেস আছে, চল বেরিয়ে পড়ি। আমি তো আজকেই যাব বলেই বেরিয়েছিলাম। একটু ঘুরে যাব, রাজনন্দনগাঁও যেতে দু’একদিন দেরি হবে। দেরি হলে তোমাদের এমন কি অসুবিধে? পুঁটিরাম কি বাড়িতে আছে?’ সত্যবতী বলল, ‘না, কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। পাঁচটায় চা নিয়ে আসবে।’ অজিত বলল, ‘তাহলে চল, তাড়াতাড়ি চলে যাই। পনের মিনিট সময়।’ সত্যবতী বলল, ‘দাঁড়াও, একটু গোছগাছ করতে হবে না।’ অজিত বলল, ‘গোছগাছ আবার কি? এমনভাবে যাব যাতে বুঝতে পারবে না আমরা চলে গেছি। সেই তো মজা। আমি বলি কি ব্যোমকেশ, কয়েকটা ট্রাউজার আর বুশশার্ট করেছিলে তার একটা পরে নাও, বাকিগুলো সঙ্গে নিয়ে নাও। সত্যবতী, তুমি একটা হাল্কা শাড়ি পরে নাও আর সচরাচর যেসব শাড়ি পর না তার মধ্যে থেকে চার পাঁচটা নিয়ে নাও। তোমরা কেউ বাইরে যাবার জুতো পর না। বাড়ির চটি পরে চল।’ ব্যোমকেশ বলল, ‘কিছু টাকা নেওয়া দরকার। বাড়িতে তো মোটে শ’ চারেক টাকা আছে। এখন তো ব্যাঙ্ক বন্ধ হবার সময় হয়ে এল। চারশ টাকা থেকে আবার পুঁটিরামের জন্য কিছু রেখে যাব তা নাহলে ও খাবে কি?’ সত্যবতী বলল, ‘এই তোমার বুদ্ধি! ভুলে গেলে গড়িয়াহাট রোডের কাছে যে ব্যাঙ্ক আছে তাতে তোমার আমার জয়েন্ট একাউন্ট আছে। সেটা তো বিকেলে খোলে। তাতে তো বিশেষ হাত দেওয়া হয় না, কয়েক হাজার জমেছে। সেটা তুলে নিলেই হবে। এ ব্যাঙ্কের টাকা যেমন আছে থাক। তুমি বরং ব্যাঙ্ক দুটোর চেক্‌ বই নিয়ে চল।’ চারটে বাজবার কিছু আগে অজিতের গাড়ি সত্যবতী ব্যোমকেশকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তাদের জামাকাপড় খবরের কাগজে জড়ানো। গাড়ির বুটে অজিতের স্যুটকেসের পাশে প্যাকেটটা পড়ে রইল।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে তারা প্রথমে ব্যাঙ্কে গেল। ব্যোমকেশ গাড়ি থেকে নামল না। সত্যবতী আর অজিত গিয়ে টাকাটা তুলে আনল। তখন ভিড় ছিল না, বারো-তের মিনিটের মধ্যে কাজ হয়ে গেল। সাত হাজার টাকা তুলে নিল; আরও কিছু পড়ে রইল। ব্যোমকেশ বলল, ‘সবটা না তুলে ভালই করেছ।’ গাড়ি সেখান থেকে প্রথমে মার্কেটের কাছে গেল। গাড়ি একজায়গায় পার্ক করে অজিত সত্যবতীকে বলল, ‘কয়েকটি শাড়ি, বাইরে বেরোবার চটি এবং অন্যান্য টুকিটাকি যা লাগবার কিনে নাও। আমি ততক্ষণ ব্যোমকেশের জুতো কিনছি।’ সত্যবতী জিনিস কিনে এসে দেখল অজিতের সওদা শেষ হয়ে গেছে। শুধু ব্যোমকেশের জুতোই কেনেনি, দুটো ফ্ল্যাস্কও কিনেছে। একটায় ঠাণ্ডা জল ভর্তি আর একটায় চা। তাছাড়া এক বাক্স ভর্তি চিকেন স্যান্ডউইচ, ছ’টা ন্যাংড়া আম আর একটা সস্তা দামের স্যুটকেস। অজিত বলল, ‘সব তো হয়ে গেল, কেনাকাটার আর কিছু বাকি নেই। চল এবার বেরিয়ে পড়ি।’ সত্যবতী বলল, ‘দুর্গা, দুর্গা।’ রোদ পড়বার আগেই তাদের গাড়ি হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে গেল। ব্যোমকেশ একটু অন্যমনস্ক। অজিত তাকে বলল, ‘কি হে সত্যান্বেষী, ‘রিটার্ন অফ শার্লক হোমস’-এর কথা মনে পড়ছে।’ ব্যোমকেশ উত্তর দিল না। একটা আনকোরা সিগারেটের বাক্স বার করে একটা সিগারেট ধরাল। তার সিগারেটের বাক্সটা বাড়িতে ফেলে এসেছিল।

সবে পাঁচটা বেজেছে। পুঁটিরাম আধঘণ্টা আগে বাড়ি ফিরেছে। তার হাতে একটা ছোট ট্রে। তাতে টি পট, দুটি পেয়ালা আর একটা প্লেটে কয়েকটা নারকেল নাড়ু। বসবার ঘরে ঢুকে দেখল কেউ নেই। পুঁটিরাম শোবার ঘরের দরজার সামনে এসে বলল, ‘মা, চা এনেছি।’ কোন উত্তর পেল না। দরজায় টোকা দিয়ে আবার বলল, ‘চা এনেছি মা।’ তারপর টেবিলের উপর চায়ের ট্রেটা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কুড়ি মিনিট পরে এসে দেখল ট্রে সেইরকমই রয়েছে। শোবার ঘরের দরজার সামনে একটু চেঁচামেচি করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে দেখল কেউ নেই। দুপুরে কেউ সেখানে শুয়েছে বলে মনে হল না। পুঁটিরাম ভাবল ব্যাপারখানা কি! এরকমভাবে তো কেউ কখনও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়নি। আরও কিছুক্ষণ পুঁটিরাম চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল কিন্তু কেউ ফিরে এল না। পুঁটিরাম ভাবল বাবুর প্রকাশকদের সঙ্গে দেখা করা যাক। তাদের যদি বাবু কিছু বলে গিয়ে থাকেন। দেরাজ খুলে দেখল একটা খামে কয়েকটা দশ টাকার নোট ও কিছু খুচরো রাখা আছে। তার থেকে পুঁটিরাম একটা দশ টাকার নোট ও কিছু খুচরো তুলে নিল। যাওয়া আসার খরচ আছে তো। এমন সময় দেখল ড্রয়ারের ভিতরে আর একটা জিনিস রয়েছে। প্রথমে চোখ সরিয়ে নিল। লোভ থেকে দূরে থাকাই ভাল। এক মিনিট পরে হাত ঢুকিয়ে বাক্সটা বার করে আনল। দশটা সিগারেটের মধ্যে তিনটে শুধু খরচ হয়েছে, সাতটা তখনও বাকি। পুঁটিরাম একটা সিগারেট সন্তর্পণে তুলে নিয়ে বাক্সটা ঠিক জায়গায় রেখে দিল। তারপর আধময়লা ফতুয়ার উপর ধোপদুরস্ত শার্ট গায়ে দিয়ে চটি ফট্‌ফট্‌ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। দরজায় তালা লাগাল। ব্যোমকেশ ফিরে এলেও কোন অসুবিধে নেই, তার কাছে তো ডুপ্লিকেট চাবি থাকেই। সিগারেটটা রাস্তায় বেরিয়ে তবেই ধরাবে। একটু পা চালিয়ে চলতে হবে, এরপর কলেজ স্ট্রীটের বাসে উঠতে গেলে ভিড়ের ধাক্কা খেতে হবে।

এই রচনাটি পূর্বে শরদিন্দু অম্‌নিবাস দ্বাদশ খণ্ডের ভূমিকা হিসাবে মুদ্রিত হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *