পরিশিষ্ট : এক – ভাষা আন্দোলন : নূরুল আমীনের দৃষ্টিতে
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাতক আর শহীদদের ইতিহাস। শুরুতেই ঘাতকেরা দখল করেছিলো দেশটি; এবং এমন এক সংকল্প যেনো নিয়েছিলো যে দেশটিকে পরিণত করবে তারা বধ্যভূমিতে, যার কোনো দ্বিতীয় ও তুলনা থাকবে না। দশকে দশকে পাকিস্তানে জন্মে ঘাতকগোত্র;- ওই ছ-সাত ফুটি ঘাতকসংঘে জুটেছিলো এক সোয়া পাঁচ ফুটি ঘাতক, নাম নূরুল আমীন। মধ্যযুগের পর তার সমান কলঙ্ক আর কারো কপালে জোটে নি পলিমাটির এ-অঞ্চলে। বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনের সময় সে ছিলো ‘পূর্ব পাকিস্তানের উজীরে আলা’। পাকিস্তান-মুসলমান-ইসলাম ইত্যাদি প্রতারণা, অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীল নিজেদের রক্ষার জন্যে একুশে ফেব্রুয়ারিতে সে ঢাকার কালো রাস্তা লাল করেছিলো তরুণদের তাপভরা দ্রোহী রক্তে। একুশের রক্তাঞ্জলি বিশশতকের বাঙালি জীবনের প্রথম বড়ো ঘটনা। তিন দশক ধ’রে বাঙালির যৌথ স্মৃতি-স্বপ্ন-বাস্তবতা জড়ো হচ্ছে ওই দিনটিকে ঘিরে; এবং রচিত হয়েছে বাঙালি জাতির জীবনের মহত্তম মিথ : একুশে ফেব্রুয়ারি বা শহীদ দিবস। একুশ, কারো কাছে, বাঙলা ভাষার উত্থান দিবস, কারো কাছে আধুনিক বাঙালি জাতির উদ্ভবের দিন; কারো কাছে অঘোষিত অস্বীকৃত স্বাধীনতা দিবস। ওই দিনটি বাঙালির চোখে দেয় অজস্র রকম আলো। কিন্তু ঘাতকেরা বায়ান্নোর মহাবিদ্রোহকে কী চোখে দেখেছিলো;— ঘাতক নূরুল আমীনের চোখে কী রূপে ধরা দিয়েছিলো বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলন? তার কিছু পরিচয় পাওয়া যায় ‘ভাষা-আন্দোলনের অন্তরালে’ নামে প্রকাশিত (মাহে-নও, চতুৰ্থ বর্ষ : প্রথম সংখ্যা; এপ্রিল ১৯৫২ : বৈশাখ ১৩৫৯, ৪৫-৪৯) নূরুল আমীনের একটি বেতার ভাষণে (১৯৫২র ৩রা মার্চের রাতে পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত)। বেতারকেন্দ্রগুলো ছিলো পাকিস্তানি ঘাতকদের চোঙ্গা;- খুন ক’রে এসে তারা ওই চোঙ্গাগুলো দিয়ে ফুঁকে দিতো তাদের খুনখারাবির সফলতার কথা। নূরুল আমীনও তাই করেছিলো মার্চের তৃতীয় রাত্রে। তার বেতার ভাষণটি অশ্লীল সরকারি মাসিক মাহে-নও-এর পৃষ্ঠায় শুয়োরমাংসের মতো চাপা প’ড়ে আছে। প্রচণ্ড কুৎসিত ওই বক্তৃতা আর বক্তা। বক্তৃতাটিকে বলতে পারি প্রতিক্রিয়াশীলতা সাম্প্রদায়িকতা ভণ্ডামো মিথ্যার বস্তা।
নূরুল আমীনের ভাষণটি সব দিক দিয়ে একটি আদর্শ পাকিস্তানি ভাষণ : মোহাম্মদ আলি জিন্না থেকে ইয়াহিয়া খাঁর সব ভাষণে যে-বিষয়গুলো জায়গা পেতো, তার সবই এটিতে জড়ো হয়ে আছে। আছে কল্পিত কম্যুনিস্ট ও বিদেশি চরের ভীতি; আছে ইসলাম, সাম্প্রদায়িকতা, গোয়ার্তুমি, মিথ্যাচার; এবং আপাতসাফল্যের তৃপ্তি। অনেক খুন ও খোয়াবের পরে পাকিস্তান পেলে পাকিস্তানের পিতা আর পাহারাদারেরা একটি দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তাদের দুঃস্বপ্নের গলিতেগলিতে হাঁটতে থাকে কম্যুনিস্ট, পথেপ্রান্তরে লুকিয়ে থাকে বিদেশের চর; এবং ওই দুঃস্বপ্নদ্রষ্টারা একটি মারাত্মক দূরদৃষ্টি অর্জন করে যে পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটি অচিরে ধ্বংস হয়ে যাবে। ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠে তারা রাস্তায়, বস্তিতে, বারান্দায়, বিছানার তলায় দেখতে পায় শুধু কম্যুনিস্ট আর কম্যুনিস্ট, বিদেশি চর আর বিদেশি চর (ভাবতে বিস্ময় লাগে তিন দশক পরেও যে-দেশে একটিও কম্যুনিস্ট নেই, সেখানে তারা পঞ্চাশের শুরুতে এতো কম্যুনিস্ট পেতো কই? ভুল লোককে ধরতো তারা কম্যুনিস্ট ভেবে, ফলে অনেক সম্ভাব্য ও প্রমাণিত প্রতিক্রিয়াশীল ওই সময়ে অনায়াসে অর্জন করেছিলো কম্যুনিস্ট নামী উজ্জ্বল ঈর্ষাকর অভিধাটি)। মোহাম্মদ আলি জিন্না, পাকিস্তানের পিতা, ১৯শে মার্চ ১৯৪৮ সালে ঢাকার রেসকোর্সের ভাষণে বারবার ভয় দেখিয়েছে কম্যুনিস্ট ও বিদেশি চরের। ভাষা- আন্দোলনকারীদের জিন্না চিহ্নিত করেছিলো কম্যুনিস্ট আর ‘নানা বিদেশি এজেন্সির অর্থ সাহায্যপুষ্ট’ লোক ব’লে; এবং সাবধান ক’রে দিয়েছিলো এভাবে : ‘সোজাসুজিভাবে আমি একথা আপনাদের বলতে চাই যে আপনাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক কম্যুনিস্ট এবং বিদেশিদের সাহায্যপ্রাপ্ত এজেন্ট আছে এবং এদের সম্পর্কে সাবধান না হ’লে আপনারা বিপদগ্রস্ত হবেন।’ ২৪শে মার্চের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতায় জিন্না একই কথা বলে : সাবধান থাকতে বলে কম্যুনিস্ট ও বিদেশের চরদের থেকে। নূরুল আমীনের বেতার ভাষণটি জিন্নার ভাষণের আদর্শেই রচিত। সম্ভবত একই বক্তৃতালেখক লিখে দিয়েছে জিন্না থেকে ইয়াহিয়া খাঁর সমস্ত বক্তৃতা।
নূরুল আমীনের কাছে ভাষা-আন্দোলন ছিলো ‘কম্যুনিস্ট, বিদেশি চর এবং হতাশ রাজনৈতিকদের ধ্বংসাত্মক চক্রান্ত’। পাকিস্তানঅলারা ক্ষমতায় থাকার জন্যে যে-কয়েকটি শ্লোগান আবিষ্কার করেছিলো, তার মধ্যে ছিলো কম্যুনিস্ট আর বিদেশি চর, সংহতি, ইসলাম। তাদের কাছে বিরোধীমাত্রই ছিলো কম্যুনিস্ট, আর কম্যুনিস্ট মানেই সংহতি ও ইসলামের অবসান। কয়েক শো বছর ধ’রেই ইসলাম অত্যন্ত অপব্যবহৃত হচ্ছে দুষ্টদের হাতে; তারা আপন স্বার্থ-ক্ষমতা রক্ষার জন্যে দোহাই পাড়ে ইসলামের, যেনো ইসলাম তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। পাকিস্তানি ঘাতকেরা সাধারণত ইসলামের কোনোই শর্ত পালন করতো না, কিন্তু পটু ছিলো ইসলামি অভিনয়ে। তাদের ও তাদের উত্তরাধিকারীদের হাত থেকে মুক্ত করা দরকার ইসলামকে। নূরুল আমীন তার ভাষণে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্যেই ইসলাম-সংহতির শরণ নিয়েছিলো, যদিও তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো ঘাতকসংঘের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখা। তাই সে ভাষা-আন্দোলনকে চিত্রিত করেছিলো পাকিস্তান ও ইসলাম নাশের ষড়যন্ত্র রূপে। তার উক্তি : ‘ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রুরা সাময়িকভাবে হইলেও কিছুটা সাফল্য লাভ করিয়াছে এবং আমাদের কোমলমতি যুবক ও জনসাধারণের মধ্যে কিছু লোককে বিভ্রান্ত করিতে পারিয়াছে দেখিয়া আমি দুঃখিত।’ অন্ধত্ববশত সে দেখতে পায় নি যে আন্দোলনকারীদের সাফল্য সাময়িক নয়; তাদের ভবিষ্যতে প’ড়ে আছে আরো বড়ো সাফল্য। বক্তৃতার একাংশে বেশ ভালোমানুষের মতো সে বলেছে যে বাঙলা-উর্দুর মিলনে বাঙলা ভাষার সমৃদ্ধি ঘটছে। পাকিস্তানের পিতারা বাঙলার যে-ধরনের সমৃদ্ধি সাধনে উৎসাহী ছিলো, তার নমুনা পাওয়া যায় সে-সময়ের মাহে-নও পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। সে-সমৃদ্ধ বাঙলা ভাষার কিছুটা উদাহরণ :
গোজাশতা এশায়াতে আমরা অতীতে বাংলা ভাষার নানা মোড় পরিবর্তনের কথা মোতাসারভাবে উল্লেখ করেছিলাম। বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল সকলকে স্বীকার করতেই হবে, যে শৈশবে বাংলা ভাষা মুসলমান বাদশা এবং আমীর ওমরাহদের নেক নজরেই পরওয়ারেশ পেয়েছিল এবং শাহী দরবারে শান-শওকত হাসিল করেছিল।
বাঙলার এমন সমৃদ্ধি যে বিনাশের অন্য নাম, তা সহজেই বোঝা যায়। ইসলাম রক্ষার স্বেচ্ছাদায়িত্ব নিয়েছিলো ঘাতকগোত্র এবং নূরুল আমীন। তার উক্তি : ‘লক্ষ লক্ষ লোকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তান হাসিল করিয়াছি শুধুমাত্র ইসলামকে কায়েম রাখিবার জন্যেই।’ মিথ্যে কথা;- তারা চেয়েছিলো নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থ চিরকায়েম রাখতে, ইসলাম তাদের হাতিয়ার। তার একটি উক্তিতে ভেতরের চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেছে। নূরুল আমীন বলছে : ‘আমার ধারণা অনুযায়ী প্রমাণ করিতে চাই যে ভাষার প্রশ্নটা মোটেই আসল প্রশ্ন নয়, বরং ভাষা বিতর্কের অন্তরালে একটি নিগূঢ় দুরভিসন্ধি রহিয়াছে, অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়া সরকারকে ধ্বংস করার জন্য শত্রুর চর এবং দুশমনেরা একটি পরিকল্পনা করিয়াছিল।’ অর্থাৎ যা সত্য তা সে দেখতে চায় না, দেখাতে চায় না; সে প্রমাণ করতে চায় এমন একটা কিছু যা তার পক্ষে যায়। সে ভেবেছিলো যদি প্রমাণ করা যায় যে ভাষা-আন্দোলন পাকিস্তান-ইসলাম-সরকার ধ্বংসের চক্রান্ত, তবে ক্ষমতায় টেকা যাবে অনেকদিন। হয়তো সে ‘প্রমাণ’ শব্দটি ব্যবহার করতে চায় নি, চেয়েছিলো অন্য কোনো শব্দ। কিন্তু বাঙলা ভাষা তার শত্রুকে ক্ষমা করে নি; গোপনে এমন একটি শব্দ তার মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যা রাষ্ট্র ক’রে দিয়েছে ঘাতকদের আন্তর চক্রান্ত ও চরিত্রহীনতা।
খুন ক’রে কেমন শাস্তি পেয়েছিলো নূরুল আমীন? খুব চমৎকার; এবং খুব বেশি। যদিও সে বলেছে যে ‘পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ’ পাঁচজনের প্রাণ নাশ ক’রে সে খুব ব্যথিত (জাতীয় সম্পদ নাশ করাই তো ছিল তাদের আনন্দ); তবু সে যখন বলে যে ‘কম্যুনিস্ট, বিদেশি-চর এবং হতাশ রাজনৈতিকদের ধ্বংসাত্মক চক্রান্ত অঙ্কুরেই বিনষ্ট হইয়াছে’, তখন তার ভিতরের তৃপ্তি ও স্বস্তি স্পষ্ট বের হয়ে পড়ে। আর একটি উক্তি এখন উল্টোভাবে সত্যে পরিণত। সে বলেছিলো : ‘যদি দৃঢ়তার সঙ্গে এই অরাজকতা দমনে আমি ও আমার সহকর্মীগণ অগ্রসর হইতে না পারিতাম, তাহা হইলে জনগণ ও ইসলামের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনের আমরা আপনাদের সামনে ও আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের সামনে নিশ্চয়ই অপরাধী হইতাম’। বাঙলা ভাষা জানতো যে ভবিষ্যতের কাছে সে অপরাধী হয়ে থাকবে চিরকাল, তাই ওপরের দাবিটি করার সময় বাঙলা ভাষা পুনরায় তার সাথে শত্রুতা করে, এবং বাক্যটি অশুদ্ধরূপ পায়। তার কামনা উল্টোভাবে সত্য হয়েছে; সকলের কাছে সে এখন অপরাধী, চিরদণ্ডিত। তার ভাষণের শেষে সে একটি ভয়াবহ সংকল্প জ্ঞাপন করেছিল : “ইনশাআল্লাহ ইসলামের, পাকিস্তানের ও মুসলিম জাহানের প্রতি আমাদের পবিত্র কর্তব্য সম্পাদনে আমরা কোনদিনই পশ্চাদপদ হইব না।’ তার সংকল্পটি বাস্তবায়িত ক’রে তারই উত্তরসুরী ঘাতক ইয়াহিয়া খাঁ, একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতে : ‘ইসলামের, পাকিস্তানের ও মুসলিম জাহানের’ প্রতি কর্তব্য পালনে পশ্চাদপদ না হয়ে।
নিচে মুদ্রিত হলো নূরুল আমীনের ঘৃণ্য বক্তৃতাটি; এখন পড়ুন, শুনুন খুনীর কণ্ঠস্বর!
.
দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ আপনাদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা বলিতেছি। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় যে সব ঘটনা ঘটিয়াছে তাহাতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হইয়াছি। আমি আপনাদেরই একজন; আপনারাই আমাকে খাদেম হিসাবে আপনাদের খেদমত করার সুযোগ ও গৌরব দিয়াছেন। আমার বিবেকবুদ্ধি মতে আমার সাধ্যমত আপনাদের খেদমত করাই আমার কর্তব্য। এই কথা হয়ত না বলিলেও চলে যে প্ৰত্যেক পাকিস্তানীর জীবন- সে ছাত্রই হউক বা অন্য কেউ হউক- আপনাদের কাছে যেমন প্রিয় ঠিক আমার তেমনি প্রিয়। প্রত্যেকটি পাকিস্তানীর জীবন পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ, তাই ঢাকার দুর্ঘটনায় যে পাঁচ জনের জীবন নাশ হইয়াছে তাহাকে আমি জাতীয় ও ব্যক্তিগত ক্ষতি বলিয়াই মনে করি। ঢাকার সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় যাহারা ভুক্তভোগী তাহাদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, ঢাকার গুলীচালনা সংক্রান্ত ঘটনাবলী যথাসময়ে প্রকাশিত হইবে এবং এ সম্পর্কে কেহ দোষী সাব্যস্ত হইলে তাহার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে।
যেহেতু অবস্থা ক্রমেই স্বাভাবিক হইয়া আসিতেছে এবং গত কয় দিনের ঘটনার ফলে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা ক্রমেই প্রশমিত হইতেছে, এখন এ বিষয়ে ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করিবার সময় আসিয়াছে। রাষ্ট্রের স্বার্থে আমার আগের বক্তৃতায় আপনাদের কাছে অনেক কিছুই খুলিয়া বলিতে পারি নাই। এখন আরো কিছু তথ্য প্রকাশ করিতে চাই এবং তাহা হইতে আপনারা সহজেই বুঝিতে পারিবেন যে সরকার এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়াছিলেন যেখানে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা ছাড়া আর গত্যন্তর ছিলনা। কম্যুনিস্ট, বিদেশী-চর এবং হতাশ রাজনৈতিকদের ধ্বংসাত্মক চক্রান্ত অংকুরেই বিনষ্ট হইয়াছে। এই চক্রান্তের পটভূমি, স্বরূপ এবং চক্রান্তকারীদের পন্থা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখন আপনাদিগকে অবগত করান আমার কর্তব্য। এ সমস্ত ব্যাপারে পর্দার আড়ালে থাকিয়া যে সকল শক্তি কাজ করিতেছিল তৎসম্পর্কে আমার পূর্ব বক্তৃতায় কিছু কিছু ইংগিত করিয়াছিলাম।
পূর্ব-পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র
২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখে ঢাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব হইতেই সরকার সংবাদ পাইতেছিলেন যে, যাহারা পাকিস্তান পরিকল্পনাকে একটি অভিসম্পাত বলিয়া বিবেচনা করিত, পাকিস্তানের অস্তিত্বকে যাহারা পথের কাঁটা বলিয়া মনে করিত এবং পাকিস্তান ধ্বংস করার চিন্তা যাহারা কখনও ত্যাগ করে নাই তাহারা পুনরায় তৎপর হইয়া উঠিয়াছে। এই দল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও কাজ করিতেছিল এবং কিছু সংখ্যক ছাত্রকে ভুল পথে পরিচালিত করিতেছিল। দেশে উচ্ছৃঙ্খলার সৃষ্টি করিয়া শাসন ব্যবস্থাকে জবরদস্তিক্রমে বানচাল করিয়া দিবার জন্য ইহারা ব্যাপক পরিকল্পনা করিতেছিল। তাহারা শুধু সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল। কায়েদে আজম ও কায়েদে মিল্লাতের জীবদ্দশায় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত এই সকল লোক নীরব ছিল। কায়েদে মিল্লাতের শাহাদাতের পর তাহারা সুযোগের সন্ধান পায়। বাংলা ভাষা প্রশ্নটি স্বভাবতঃই সকলের ভাবাবেগ আকর্ষণ করে বলিয়া উহার আড়ালে এই সকল লোক তাহাদের হীন প্রচেষ্টা লুক্কায়িত রাখিবার সুযোগ পায়।
সব দিক বিবেচনা করিয়া দেখিলে এই কথাই সুস্পষ্ট হইয়া উঠে যে, প্রাদেশিক আইন সভার অধিবেশনের প্রথম দিন হইতে আরম্ভ করিয়া যতদিন দরকার হয় ততদিন গোলমাল বাঁধাইয়া রাখিবার পরিকল্পনা করা হইয়াছিল। সরকার খবর পাইয়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য জনসাধারণের নিয়মতান্ত্রিক দাবীকে দাবাইয়া রাখিবার কোন প্রশ্নই ইহার মধ্যে ছিল না। ঘটনার মাত্র পক্ষকাল পূর্বে ও ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় এই সম্পর্কে সভার অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রা বাহির করা হইয়াছিল। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কোথাও কোন হস্তক্ষেপ করেন নাই। ১৪৪ ধারা জারী করিয়া এই ধরনের সভা ও শোভাযাত্রা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় নাই। জেলা কর্তৃপক্ষের অনুমতি লইয়া উহা করা যাইত। কিন্তু কেহ এইরূপ কোন অনুমতি চান নাই। ইহার পরবর্তী ঘটনাবলী হইতে সরকারের প্রাপ্ত সংবাদেরই সুস্পষ্ট সমর্থন পাওয়া যায় যে, যে সকল লোক গোলযোগ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করিতেছিল, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি তাহাদের এই হীন ষড়যন্ত্রের প্রতি জনসাধারণের সমর্থন লাভের একটি হাতিয়ার ব্যতীত আর কিছুই নহে।
ভাষা-বিতর্ক
পাকিস্তানের অন্যান্য শুভাকাংখীদের মত আমিও আশা করিয়াছিলাম যে আমাদের দেশবাসী তাহাদের জ্ঞান-বুদ্ধি, ইসলাম-প্রীতি ও পাকিস্তানের প্রতি দরদ বোধে নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাদ-বিসম্বাদ ভুলিয়া যাইবেন এবং দেশ প্রেমিক নাগরিক হিসাবে ঐক্যবদ্ধভাবে ঢাকায় সাম্প্রতিক গোলযোগের মত জাতীয় বিপদের প্রতিরোধ করিতে প্রস্তুত হইবেন। ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রুরা সাময়িকভাবে হইলেও কিছুটা সাফল্য লাভ করিয়াছে এবং আমাদের কোমলমতি যুবক ও জনসাধারণের মধ্যে কিছু লোককে বিভ্রান্ত করিতে পারিয়াছে দেখিয়া আমি দুঃখিত। ঢাকার সাম্প্রতিক গোলযোগের পিছনে যাহারা আছে তাহাদের কর্মপদ্ধতি ও তাহারা যে-ভাবে নিজেদের ইচ্ছা জনগণের উপর চাপাইয়া দিতে চাহিয়াছিল, তাহা হইতে সহজেই বুঝা যায় তাহাদের উদ্দেশ্য কি ছিল। জনসাধারণের অনেকেই রাষ্ট্রের দুশমনদের চক্রান্ত বুঝিতে না পারিয়া তাহাদের ফাঁদে পড়িয়াছিলেন বলিয়া আমি মর্মাহত হইয়াছি। আরো বহুদিন পর্যন্ত ইংরাজী ভাষা পাকিস্তানে চালু থাকিতে বাধ্য বলিয়া রাষ্ট্রভাষার আশু মীমাংসা অত্যাবশ্যকীয় মনে করা হয় নাই। এই অবস্থায় যথাসময়ে স্বাভাবিক বিবর্তনের ভিতর দিয়া এই সমস্যা সমাধান করাই সংগত বিবেচিত হইয়াছিল। আপনারা জানেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ায় আমাদের জাতীয় জীবনে নবীন প্রাণধারা ও নূতন অবস্থার সঞ্চার হইয়াছে এবং ফরে উর্দু-বাংলা উভয় ভাষারই নিত্য পরিবর্তন ঘটিতেছে। উর্দুভাষী ও বাংলাভাষী লোকদের পারস্পরিক মিলনের ফলে দুইটি ভাষাই সমৃদ্ধ হইতেছে এবং এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় ব্যবহৃত হইতে থাকায় দুই ভাষাভাষী নাগরিকদের ব্যবধান ক্রমেই দূর হইতেছে। এই জন্যই মরহুম কায়েদে আজম এবং কায়েদে মিল্লাত অযথা তাড়াতাড়ি করিয়া এ সম্পর্কে গণপরিষদের নিকট হইতে কোন সিদ্ধান্ত করানোর প্রয়োজন মনে করেন নাই। বাংলা ভাষা যথাসময়ে এ প্রদেশের সরকারী ভাষা হইবে, ইত্যবসরে ইহা স্বীকার করিয়া লইয়া পূর্ববঙ্গ সরকার এই ভাষার সর্ববিধ উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য পূর্ণ সুযোগ দান করেন। এই ভাষাকে সাধারণভাবে পাকিস্তানের এবং বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিভা ও সংস্কৃতির উপযোগী করিয়া তোলার সর্ব প্রকার প্রচেষ্টাকে সরকার উৎসাহ প্রদান করেন।
যাহা হউক, গত ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তৎপ্রতি লক্ষ্য রাখিয়া আমি ভাষা-বিতর্ককে রাজনীতি হইতে পৃথকভাবে বিবেচনার সিদ্ধান্ত করি এবং আমার ধারণা অনুযায়ী প্রমাণ করিতে চাই যে, ভাষার প্রশ্নটি মোটেই আসল প্রশ্ন নয়, বরং ভাষা-বিতর্কের অন্তরালে একটি নিগূঢ় দূরভিসন্ধি রহিয়াছে; অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়া সরকারকে ধ্বংস করার জন্য শত্রুর চর এবং দুশমনেরা একটি পরিকল্পনা করিয়াছিল। ২২শে ফেব্রুয়ারী তারিখেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদের নিকট সোপারেশ করিয়া আমি ব্যবস্থা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করি। আমার এ প্রস্তাব পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। যাহারা আইন অমান্যের ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, ভাষা-সমস্যা ছাড়া যদি অন্য কোন বিশেষ মতলব তাহাদের না থাকিত, তাহা হইলে পরিষদের এ ব্যবস্থায় তাহারা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হইত।
ভীতিপ্রদর্শন ও উচ্ছৃঙ্খলতা
কিন্তু আমি কি দেখিলাম? যাহারা হাঙ্গামার সূত্রপাত করিয়াছিল তাহারা উক্ত প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্যান্য দাবী উত্থাপন করিতে শুরু করিল। ক্রমে ইহা সবারই নিকট পরিষ্কার হইয়া উঠিল (অবশ্য ইহা শুরু হইতেই সরকারের জানা ছিল) যে, ক্ষমতায় সমাসীন সরকারকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, ভীতি প্রদর্শন ও ষড়যন্ত্র দ্বারা বানচাল করা ব্যতীত
হাংগামাকারীদের আর কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। উপরন্তু সরকারকে হিংসাত্মক উপায়ে ধ্বংস করিয়া তৎস্থলে নিজেদের মতলব হাসিলের উপযোগী একটি তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠিত করিতে চক্রান্তকারীরা চাহিয়াছিল। ইহা উল্লেখযোগ্য যে, গোলযোগের সময় নারায়ণগঞ্জে এক শোভাযাত্রায় বিক্ষোভকারীরা খোলাখুলি “মুক্ত বাংলা চাই” বলিয়া ধ্বনি তুলিয়াছিল। দেশ বিভাগের পর এই সর্বপ্রথম অকস্মাৎ তাহারা এইরূপ ধ্বনি উত্থাপন করিতে সাহসী হইল, ইহা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। সরকারের নিকট চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনা সংক্রান্ত যে সব তথ্য আছে সেইগুলির সংগে ইহাদের পূর্ণ সামঞ্জস্য রহিয়াছে। নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাহারা অভিনব পন্থা গ্রহণ করে। ইহা সকলেই জানেন যে, তাহারা ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যগণকে ভীতি প্রদর্শন করে; এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে দৈহিক নির্যাতনের ভয় দেখাইয়া কিছু সংখ্যক সদস্যকে মুসলিম লীগ পার্টি হইতে পদত্যাগ করিতে বাধ্য করা হয়। নিজেদের কার্যকলাপের জন্য স্থানীয় সংবাদপত্রগুলির প্রতিও অনুরূপ ভীতি প্রদর্শন করা হয়। অন্যান্য সংবাদপত্রগুলিকে ভয় দেখাইবার জন্য এই পরিকল্পনানুযায়ী “মর্নিং নিউজ” পত্রিকার ছাপাখানা সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করা হয়। শাসন ব্যবস্থা ব্যাহত করার জন্য অনেক সরকারী কর্মচারীকেও অনুরূপভাবে ভয় দেখাইয়া কাজে যোগদানে বিরত করা হয়। হুমকী প্ৰদৰ্শন দ্বারা অথবা বলপূর্বক সাধারণ যানবাহন ও দোকানপাট প্রায় তিনদিন বন্ধ করিতে বাধ্য করা হয়। রেডিও পাকিস্তানের কাজকর্ম বন্ধ করিয়া দেওয়ার চেষ্টা চলে।
টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা এবং ট্রেন চলাচলের বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়। পরিশেষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে বাধ্য হইয়া সরকার কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে বদ্ধপরিকর হন। সুতরাং চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের নিকট ইহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা প্রকৃত প্রশ্ন মোটেই ছিল না; বরং সরকার একদল লোককে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিপন্ন করিতে দিবেন কিনা, তাহাই ছিল সত্যিকারের প্রশ্ন। এমতাবস্থায় সরকারের কি করা উচিৎ ছিল তাহাই বিবেচ্য। এইরূপ হীন ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হইয়া পৃথিবীর কোন দায়িত্বশীল সরকার কি ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেন? অতি নগণ্য সংখ্যক লোক জনগণের প্রতিনিধি ব্যবস্থা পরিষদের মুসলিম সদস্যদিগকে ভয় দেখাইয়া বাধ্য করা এবং এই ভাবে মুসলিম লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া নিজেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইবার জন্য চেষ্টায় অবতীর্ণ হইয়াছিল। ইহা ঘটিতে দিলে আমরা জনসাধারণের নিকট বিশ্বাসভংগের অপরাধে দোষী হইতাম। যদি দৃঢ়তার সঙ্গে এই অরাজকতা দমনে আমি ও আমার সহকর্মীগণ অগ্রসর হইতে না পারিতাম, তাহা হইলে জনগণ ও ইসলামের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনের আমরা আপনাদের সামনে ও আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের সামনে নিশ্চয়ই অপরাধী সাব্যস্ত হইতাম। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের পতন ঘটান যাইতে পারে। কেবল মাত্র আইন সভার সদস্যগণই নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় ভোট দিয়া সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিতে পারেন। আইন সভায় সদস্যগণ যাহাতে ধীর স্থির ও স্বাধীনভাবে এই ব্যাপারে নিজেদের মতামত প্রকাশ করিতে পারেন, তাহার জন্য এমন পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন যেন সর্বপ্রকার ভয় ভীতির বাহিরে থাকিয়া তাহারা কাজ করিতে পারেন। এইরূপ পরিবেশ সৃষ্টি না হইলে গণতান্ত্রিকতার বিলোপ হইয়া উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনই কায়েম হয়। ভয় দেখাইয়া ও উচ্ছৃঙ্খলতার সৃষ্টি করিয়া দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিপন্ন করিবার এই যে ষড়যন্ত্র হইয়াছিল, সরকারের অবলম্বিত ব্যবস্থার ফলে যদিও সাময়িকভাবে সে বিপদের অবসান হইয়াছে তথাপি আমাদের আজাদীর বিরুদ্ধে যে বিপদ দেখা দিয়াছিল এখনও তাহা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয় নাই। প্রদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা যেমন করিয়াই হউক আমাদিগকে রক্ষা করিতে হইবে। আমি আশা করি এই ব্যাপারে সরকার দেশপ্রেমিক সকল পাকিস্তানীরই পূর্ণ সমর্থন পাইবেন। আমি সকল পাকিস্তানীর কাছে আবেদন করিতেছি, সরকারের হাত মজবুত করিতে আগাইয়া আসুন, সমগ্র প্রদেশে আইন ও শৃঙ্খলা অব্যাহত রাখিতে সরকারকে সাহায্য করুন— দুষ্কৃতিকারীদের আতংক সৃষ্টি, মিথ্যা গুজব প্রচারণা এবং জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির প্রয়াস ব্যর্থ করুন।
ইসলামের আদর্শ
দেশবাসীর খেদমতে আমার আরও আরজ, আপনারা সীমান্তের ওপারে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন; উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করুন বর্তমানে আমরা কি সংকটের সম্মুখীন হইয়াছি। শুধু পাকিস্তান নয় বরং ইসলামই আজ নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন। আমরা দাবী করিয়া থাকি জাতিগত, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত ব্যবধান দূর করিয়া ইসলাম একদিন যে স্বর্ণযুগের সূচনা করিয়াছিল, বর্তমানেও ইসলাম তাহা করিতে সক্ষম- যাহার ফলে মানব জাতির জীবনে আসিবে অশেষ সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি। আমরা পাকিস্তানে ইসলামের এই আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করিতে চাই। লক্ষ লক্ষ লোকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তান হাসিল করিয়াছি শুধুমাত্র ইসলামকে কায়েম রাখার জন্যই। বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষাভাষী লোক অধ্যুষিত ভৌগোলিক বৈচিত্রপূর্ণ আমাদের এই পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশকে ইসলামই একসূত্রে গ্রথিত করিয়া রাখিয়াছে। আমাদের সংহতি ও সংঘবদ্ধতা শত্রুমিত্র সকলকেই বিস্মিত করিয়াছে।
পাকিস্তান সমগ্র মুসলিম জাহানে নব জীবন আনয়ন করিয়াছে এবং সর্বত্রই ইসলামের এই নবীন জীবন স্পন্দন অনুভূত হইতেছে। দুনিয়ার নিকট আমাদিগকে প্রতিপন্ন করিতে হইবে যে যদিও আমাদের পথ প্রদর্শন করার জন্য কায়েদে আজম ও কায়েদে মিল্লাত আজ আর নাই, তথাপি ইসলাম আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখিয়া আমাদিগকে সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করিতে সক্ষম। এই ব্যাপারে আমাদের দায়িত্বই বেশী। কারণ, এখানে যত মুসলমানের বাস দুনিয়ার আর কোথাও এক জায়গায় এত মুসলমান বাস করে না। সুতরাং বিশ্ব মুসলিমের সংহতি রাখার দায়িত্ব বিশেষভাবে আমাদের। মুসলিম জাহানের এই সংকট মুহূর্তে আমরা কি পাকিস্তান ও ইসলামের প্রতি এই গুরু দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইব? না, কিছুতেই না। ইন্শা আল্লাহ ইসলামের, পাকিস্তানের ও মুসলিম জাহানের প্রতি আমাদের পবিত্র কর্তব্য সম্পাদনে আমরা কোন দিনই পশ্চাদপদ হইব না।
পাকিস্তান জিন্দাবাদ