পরিশিষ্ট
আশা ও ফ্রানজ কাফকার লেখায় অ্যাবসার্ড
কাফকার সমগ্র শিল্প এমনভাবে গঠিত যে, পাঠককে পুনর্পাঠে বাধ্য করে। তাঁর সমাপ্তি বা সমাপ্তিতে তাঁর অনুপস্থিতি, সেগুলোকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। যাই হোক, সেইসব স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করে না, তবে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। এমন কিছু তাতে রয়েছে যা গল্পটি পুনর্পাঠ করতে হয় অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে। মাঝে মাঝে দুটো অর্থ করার সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে দু’বার পড়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। লেখক এটাই চান। বিশদভাবে সব লেখাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হলে ভুল করা হবে। সাধারণ অর্থে প্রতীকী সব সময়ই থাকে, যাই হোক যথাযথ অনূদিত হলে, একজন শিল্পী কেবল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পুনঃসঞ্চয় করতে পারে : প্রতিদানস্বরূপ শব্দের বদলে শব্দ নয়। অধিকন্তু প্রতীকী কাজ অপেক্ষা কোনো কিছু বোঝা শক্তও নয়। প্রতীককে সব সময় উৎকৃষ্ট করে তোলে, তাকে কাজে লাগায় এবং সচেতন হয়ে ব্যক্ত করার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব করে তোলে। এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত উপায়ে একে ধরতে, একে উত্তেজিত বা প্রলুব্ধ করে না, প্রাক-ধারণ মনোভাব ছাড়া লেখার সঙ্গে শুরু এবং এর লুকোনো স্রোতকে অন্বেষণ করে না। কাফকার জন্য বিশেষ করে ওর নিয়মে একমত হওয়াটাই ভালো, এর বাইরের দিক দিয়ে নাটকে প্রবেশ এবং গঠনের ভেতর দিয়ে উপন্যাসে।[২৫]
প্রথম চাহনিতে ও একজন সাদামাটা পাঠকের জন্য অ্যাডভেঞ্চারগুলোতে ওরা বিরক্ত বোধ করে, সেই অ্যাডভেঞ্চারগুলোয় ভয় ও জেদি চরিত্রগুলোকে জয় করে সমস্যা অনুসরণ করে তারা ওর ভেতরে কখনো সূত্র গড়ে তোলে না। দ্য ট্রায়াল-এ জোসেফ কে. কে অভিযুক্ত করে। তবে কিসে সে অভিযুক্ত জানে না। নিজেকে রক্ষা করার জন্য সে আগ্রহী এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই, তবে সে জানে না কেন। আইনজীবীরা তার কেসটায় জটিলতা দেখতে পায়। ইতিমধ্যে ভালোবাসতে, খেতে, তার কাগজপত্তর পড়াকে অবহেলা করে না। তারপর তাকে বিচার করে। তবে কোর্ট-রুমটি বেশ অন্ধকার। সে বেশি কিছু বুঝতে পারে না। কেবল সে মনে করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তবে কিসে, সে শুধু বিস্মিত। কখনো কখনো শুধু সন্দেহ করে, বেঁচে থাকে। কিছু পরে, দুজন সুবেশধারী ও নম্র ভদ্রলোক তার কাছে আসে এবং তাদের অনুসরণ করতে বলে। অত্যন্ত সৌজন্যতার সঙ্গে এক জঘন্য শহরতলীতে তাকে নিয়ে যায়, একটা পাথরের ওপর তার মাথাটা রাখে এবং গলাটা চিরে দেয়। মৃত্যুর আগে দণ্ডিত ব্যক্তি কেবল বলে : ‘কুকুরের মত’।
তুমি দেখবে উপাখ্যানে প্রতীকীর কথা বলা শক্ত যার অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উৎকৃষ্টতা কেবল স্বাভাবিকতা নিয়ে ঘটে। কিন্তু স্বাভাবিকতা বোঝা শক্ত ধরনের। লেখাগুলো যাতে পাঠকের কাছে মনে হয় স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু অন্যগুলোতে (দুর্লভতর, নিশ্চিত হয়ে) যার ভেতর যা তার কাছে ঘটে চরিত্র মনে করে স্বাভাবিক। অদ্ভুত কিন্তু স্পষ্টভাবে কূটাভাস, আরো অসাধারণ চরিত্রের দুঃসাহসিক অভিযানগুলো, আরো দর্শন—গ্রাহ্য হয়ে উঠবে গল্পের স্বাভাবিকতা : বিপথ গমনের অংশে মানুষের জীবনের অদ্ভুতত্ত্ব ও মানুষ যে সরলতা গ্রহণ করে তাদের মাঝে অনুভব করে। মনে হয় এই স্বাভাবিকতাই হলো কাফকা। আর যথাযথরূপে একজন বেশ ভালোভাবেই সচেতন ‘দ্য ট্রায়াল’ কী বলতে চায়। মানব অবস্থার ধারণার কথা লোকেরা বলেছে। নিশ্চিত হয়ে। তবু এ অধিকতর সরল ও অধিকতর জটিল, উভয়ই। আমি বোঝাতে চাইছি উপন্যাসের গুরুত্ব হলো আরো বিশেষ এবং আরো বেশি ব্যক্তিগত কাফকার কাছে। একটা বিশেষ স্তর পর্যন্ত, তিনি এমনই একজন যিনি কথা বলেন, আমাদের কাছে মনে হয় তিনি দোষ স্বীকার করেছেন। তিনি বাস করেছেন এবং দণ্ডিত হচ্ছেন। উপন্যাসের প্রথম পাতাগুলো থেকে তিনি জানছেন তিনি এ জগতে অভিযুক্ত, আর এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেষ্টা করলেও, তৎসত্ত্বেও বিস্ময়কর ছাড়াই তিনি তা করেন। এই বিস্ময়করতার অভাবে তিনি কখনো যথেষ্ট বিস্ময়ভাব দেখান না। এরূপ বিরোধিতার মধ্য দিয়েই অ্যাবসার্ড কাজের প্রথম চিহ্নগুলোকে চেনায়। এর আত্মিক ট্র্যাজেডি দৃঢ়রূপ মন দেখায় এবং সম্পূর্ণ এককভাবে এ করতে পারে চিরস্থায়ী কূটাভাসের মাধ্যমে, একে তুলনা করে রঙের শক্তিকে যা শূন্যকে ব্যক্ত করে এবং প্রতিদিনকার অভিব্যক্তির শক্তিকে অনূদিত করে শাশ্বত আকাঙ্ক্ষাগুলোকে।
.
অনুরূপ সম্ভবত কর্মের বা ক্রিয়াকলাপে ‘দ্য ক্যাসল’ এক ঈশ্বরতত্ত্ব, কিন্তু আত্মার ব্যক্তিগত অভিযানে এর উজ্জ্বলতা প্রথমটি, মানুষ যে জগতের বস্তুগুলোর অনুসন্ধান করে, তাদের রাজকীয় গোপনীয়তা এবং স্ত্রীলোকদের, ঈশ্বরের চিহ্নমালা যা তাদের ভেতর ঘুমিয়ে রয়েছে। মেটামরফসিসের ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বচ্ছতার এক নৈতিকতার ভয়ঙ্কর কল্পনাকে স্থাপন করে। কিন্তু সেই ধারণাতীত বিস্ময়কর মানুষের সৃষ্ট, অনুভব করে পশুর সচেতনতায় আবেশিত রূপ যা সে প্রয়াসহীনভাবেই হয়ে ওঠে। এই মৌলিক দ্বৈত অর্থ রয়েছে কাফকার রহস্য। স্বাভাবিকতা ও অসাধারণত্বের মাঝে ব্যক্তি ও বিশ্বের, ট্র্যাজিক ও প্রতিদিন, অ্যাবসার্ড ও যৌক্তিক— এদের মাঝে চিরস্থায়ী চালনা, তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে দেখা যায় এবং অনুরণন ও অর্থের প্রকাশ। এগুলো হলো কূটাভাস, এসব গণনা করা যায়; বিরোধিতা সব অবশ্য শক্তিশালী হয়ে ওঠে, অ্যাবসার্ড লেখা বোঝার উদ্দেশ্যে।
বস্তুত একটি প্রতীক ধরে নেয় দুটো সমভূমি, ভাবনা ও সংবেদনার দুটো জগৎ, তাদের মাঝে যোগাযোগের এক অভিধান। এই অভিধান আঁকা বা তৈরি করা সবচেয়ে শক্ত কাজ। কিন্তু দুটো জগতে জেগে মুখোমুখি নিয়ে আসে, তাদের গোপন সম্পর্ক টেনে হিচড়ে নিয়ে আসাতে অগ্রসর হয়, তা সমানভাবেই। কাফকার জীবনে এই দুই জগৎ রয়েছে প্রতিদিনকার জীবনে, অপরদিকে রয়েছে অলৌকিক দুশ্চিন্তা। মনে হয় নিৎসের মন্তব্যের এক সীমাহীন শোষণের আমরা সাক্ষ্য দিয়ে চলেছি : ‘রাস্তার মাঝে রয়েছে বৃহৎ সমস্যাগুলো।’
মানব শর্তে (আর সব সাহিত্যেই এটা সাধারণ স্থান) রয়েছে এক প্রাথমিক অ্যাবসার্ড ও এক অপ্রশম্য মহত্ত্ব। দুটোই মেলে, যেমন স্বাভাবিকতা। তাদের দুটোই উপস্থাপিত হয়, আমাকে আবার বলতে দাও, আমাদের আত্মিক অতিরিক্ততা ও ক্ষণস্থায়ী দেহের আনন্দ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াটা এক অদ্ভুত বিচ্ছেদ অ্যাবসার্ড বস্তু হলো এই দেহের আত্মা হওয়া উচিৎ, এই দেহ এতই সাধারণভাবে অতিক্রমণ করে। যে কেউই এই অ্যাবসার্ডতাকে প্রতিনিধিত্ব করতে পছন্দ করে, তা অবশ্য এক সমান্তরাল বৈসাদৃশ্যের এক সিরিজ জীবনকে দেয়। এভাবে প্রতিদিন কাফকা ট্র্যাজেডিকে ব্যক্ত করে এবং যুক্তির সাহায্যে অ্যাবসার্ড প্রকাশ করে।
একজন অভিনেতা এক ট্র্যাজিক চরিত্র জোর করে আরো বেশি ধার দেয়, আরো যত্নের সঙ্গে তাকে বেশি বেশি করতে হয় না। যদি সে নিয়ন্ত্রণকারী হয়, যে উদ্বুদ্ধ হয় সে নিয়ন্ত্রণকারী নয়। এক্ষেত্রে গ্রিক ট্র্যাজেডিতে পাঠগুলো উচ্চমানের। সব সময় ট্র্যাজিক লেখার ভাগ্য নিজেই যুক্তি ও স্বাভাবিকতার ছদ্মবেশে আরো বেশি অনুভব করে। অগ্রিম অয়দিপাউসের ভাগ্য ঘোষিত হয়। অলৌকিকভাবে ঐ স্থির হয় যে হত্যা করে ও পোকা হয়ে যায়। নাটকের সমগ্র প্রয়াসকে দেখাতে হয় যৌক্তিক রীতি যা বাদ দিতে দিতে নায়কের দুর্ভাগ্যের মুকুট হয়ে উঠবে। আমাদের কাছে কেবল ঘোষিত হয় যে এই অসাধারণ ভাগ্য মোটের ওপর ভয়ঙ্কর, এর অভাবই রয়েছে কারণ এর অসম্ভাব্যতা। কিন্তু প্রতিদিনকার জীবনে, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিচিত আবেগকে ফ্রেমের ভেতর আমাদের দেখানোর প্রয়োজন যদি হয় তবে ভয়ঙ্করকে পবিত্রায়িত করা হবে। সেই বিদ্রোহে মানুষকে আন্দোলিত করবে এবং তাকে বলাবে : ‘সেটা সম্ভব নয়,’ এখানে রয়েছে স্পর্ধার ট্র্যাজেডির যে ‘ঐ’ হতে পারে।
এ হলো গ্রিক ট্র্যাজেডির সমগ্র রহস্য অথবা ন্যূনপক্ষে এর দৃষ্টিকোণের একটি। কারণ রয়েছে আরেকটি, বিপরীত পদ্ধতি, যা দিয়ে আমরা কাফকাকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি। মানব হৃদয়ের রয়েছে এক ক্লান্তিকর ঝোঁক ভাগ্যকে সমান করে তোলার, যা একে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। কিন্তু অনুরূপ, সুখ, আর পথে, কারণ ছাড়াই, যেখান থেকে অপরিহার্য। যাই হোক আধুনিক মানুষ নিজেই এ থেকে কৃতিত্ব নেয়, যখন একে চিনতে ব্যর্থ হয় না। অনেক বলা যেতে পারে, গ্রিক ট্র্যাজেডির ভাগ্যের সুবিধে সম্পর্কে, কিংবদন্তীতে সেগুলো পছন্দ করে, যেমন ইউলিসিস, যে খারাপ অভিযানের মাঝে নিজেরাই রক্ষা পায়। ইথাকাতে ফিরে যাওয়া তত সহজ ছিল না।
যে কোনো ঘটনায় কী স্মরণ হবে তা হলো গোপন দুষ্কর্মে সাহায্য করা বা জটিলতা যা যুক্ত হয় যৌক্তিকতায় ও প্রতিদিনকার ট্র্যাজেডিতে। কেন সামসা, মেটামরফসিসের নায়ক একজন ট্র্যাভেলিং সেলসম্যান। কেন কেবল একটা জিনিস এক অচেনা অদ্ভুত অভিযানে তাকে বিরক্ত করে যা তাকে ইঁদুর তৈরি করে যায়। ফলে তার অনুপস্থিতিতে তার বস রেগে যাবে। পা ও শুঁয়া তার শরীরে গজিয়ে বের হয়, তার শিরদাড়া বেঁকে যায়, তার পেটের ওপর সাদা ছোপ ছোপ ওঠে আর–আমি বলব না যে এ তাকে বিস্মিত করেনি, কারণ প্রতিক্রিয়া নষ্ট হয়ে গেছে—এ তাকে ‘এক বিরক্ত’ করার কারণ। কাফকার সমগ্র শিল্প রয়েছে এরূপ স্বাতন্ত্র্য। তাঁর প্রধান লেখা, দ্য ক্যাসল-এ রয়েছে প্রতিদিনকার জীবনের খুঁটিনাটি, তার ওপরেই দাঁড়িয়ে, তবু সেই বিস্ময়কর উপন্যাসে যার ভেতর কোনো উপসংহার টানা যায় না, সব কিছু পুনরায় শুরু হয়, এর উজ্জ্বলতা খোঁজে আত্মার অপরিহার্য অভিযান। যা এতে উপস্থাপিত করে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিক্রিয়া ভেতর সমস্যাকে যা অনূদিত হয়, সাধারণ ও বিশেষের মিলন বা সমাপতন চেনা যায় যেমন এক ছোট শিল্প কৌশলের অনুরূপ যা প্রতিটি মহান স্রষ্টাই এর অধিকারী। ‘দ্য ট্রায়াল’-এর নায়কের নাম হতে পারে স্মিডট বা ফ্রানজ কাফকা। কিন্তু তার নাম রাখা হয়েছে জোসেফ কে। সে কাফকা নয় এবং তবুও সে কাফকা। সে একজন গড়পড়তা ইউরোপীয়। সে সবার মতোই। কিন্তু সে কে. এর সত্তাও, যে এই রক্তমাংসের এক্স-এর সমীকরণ।
অনুরূপ যদি কাফকা চায় অ্যাবসার্ডকে ব্যক্ত করতে, তাকে সাযুজ্য বজায় রাখতে হবে। তুমি খ্যাপা লোকটির গল্প জানো, সে বাথটাবে মাছ ধরে। যেমন একজন মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার মতো ডাক্তার তাকে বলে, ‘যদি ওরা কামড়ায়’, যাতে সে একটা কর্কশ উত্তর পায় : “নিশ্চয় না, তুমি বোকা, এটা একটা বাথটাব।’ গল্পটা বারোক ধরনের। কিন্তু এর মধ্যে স্পষ্টরূপে সম্পূর্ণ আঁকড়ে ধরতে পারে একটা স্তর পর্যন্ত যে অ্যাবসার্ড প্রতিক্রিয়ায় রয়েছে এক যুক্তির অতিরিক্ততার সঙ্গে যুক্ত। কাফকার জগৎ রয়েছে এক অবর্ণনীয় বিশ্বের সত্যে যাতে মানুষ নিজেই মেনে নেয় বাথটাবে মাছ ধরার পীড়নের বা যন্ত্রণার বিলাস। এ জেনেও কোনো কিছু এর থেকে আসে না।
ফলত এখানে এক লেখাকে চিনতে পারি যার বৈশিষ্ট্যগুলো হলো অ্যাবসার্ড 1 উদাহরণ স্বরূপ, ‘দ্য ট্রায়াল’-এর বিষয়ে, বস্তুত আমি বলতে পারি এ এক সম্পূর্ণ সাফল্য। মাংসেরই জয় হয়। কোনো কিছুরই অভাব ঘটে না। অব্যক্ত বিদ্রোহও নয় (তবে এ কী লিখছে), আবার স্বচ্ছ ও নীরব হতাশাও নয় (কিন্তু এ কী সৃষ্টি করছে), আবার এও নয় আচরণের বিস্ময়বিহ্বল স্বাধীনতা, যা উপন্যাসের চরিত্রগুলো যতক্ষণ না চূড়ান্তরূপে মরছে ততক্ষণ দৃষ্টান্তস্বরূপ।
.
তথাপি এ জগৎ ততটা কাঁচের নয় যতটা মনে হয়। এই বিশ্বের ভেতর প্রগতিবিহীন, বিস্ময়কর ফর্মে কাফকা আশা পরিচিত করতে যাচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে ‘দ্য ট্রায়াল’ বা ‘দ্য ক্যাসল’ একই দিকে অনুসরণ করে না। এরা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। একটির থেকে আরেকটি কেবল প্রতীতির উন্নয়ন উপস্থাপিত করে কৌশলে রাজ্যের ভয়ঙ্কর বিজয়। ‘দ্য ট্রায়াল’ এক সমস্যাকে উপস্থাপন করে যা ‘দ্য ক্যাসল’ একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সমাধান করে। প্রথম বর্ণনা করে বাতিল- বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসারে, এবং উপসংহার ব্যতীত। দ্বিতীয়, একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত ব্যাখ্যা করে। ‘দ্য ট্রায়াল’ রোগ নির্ণয় করে, চিকিৎসা কল্পনা করে ‘দ্য ক্যাসল’। তবে সমাধান এখানে বলা হলেও আরোগ্য লাভ করে না। এ কেবল স্বাভাবিক জীবনে ব্যাধিই ফিরিয়ে আনে। একে গ্রহণ করতে সাহায্য করে। একটা নির্দিষ্ট চেতনায় (আসুন আমরা কিয়ের্কেগার্দ-এর কথা ভাবি), লোকেদের এটাকে লালন করতে দেয়। ল্যান্ড সার্ভেয়ার বা জমি জরিপকারী এ একজনকে পীড়ন করা ছাড়া অন্য কিছু দুর্ভাবনা বলে কল্পনা করতে পারে না। যারা তার চারপাশে সেইসব মানুষেরা হয়ে ওঠে খালি পরিত্যক্ত ও নামহীন কষ্টের সঙ্গে যুক্ত। যেন কষ্টকে সুবিধেজনক দৃষ্টিকোণকে ধরে নেয় এ ক্ষেত্রে। ফ্রাইয়েডা কে. কে জিজ্ঞাসা করে, ‘কীভাবে তোমাকে আমার প্রয়োজন।’ ‘কতটা পরিত্যক্ত আমি অনুভব করি, তোমাকে জানার পর থেকে, যখন তুমি আমার সঙ্গে থাকো না।’ এই সূক্ষ্ম সমাধান যা আমাদের ভালোবাসায় তৈরি করে আমাদের চূর্ণবিচূর্ণ করে এবং কোনো ইস্যু ছাড়াই আশায় পরিপূর্ণ করে লাফিয়ে ওঠে, এই হঠাৎ ‘ঝাঁপ’-এর ভেতর দিয়ে সবাই পাল্টে যায়, এই প্রয়োজনীয় বিপ্লব গোপনীয়তায় হলো এটা, আর ‘দ্য ক্যাসল’-এর ভেতর তা রয়েছে।
ক্যাসলটির কাছে ল্যান্ড সার্ভেয়ারের নামে কে এবং সে গ্রামে এসেছে, দ্য ক্যাসল-এ এর চেয়ে ভয়ঙ্কর হলো তাদের উন্নয়নের কিছু কাজকর্ম। কিন্তু গ্রাম থেকে ক্যাসেলে যোগাযোগ করা অসম্ভব। এক শ’ পাতাজুড়ে কে. তার পথ খুঁজতে জেদ করে বা বাধ্য হয়, প্রতিটি অগ্রগমনে চতুর কৌশল ও উপযোগিতা ব্যবহার করে, কখনো রাগে না এবং পরাজিত সুনাম দিয়ে তাকে যে কর্তব্য করতে দেওয়া হয়েছে তাকে অনুধাবন করার চেষ্টা করে। প্রতিটি অধ্যায়ে এক নতুন হতাশা। আর এক নতুন শুরু। এ যুক্তি নয় তবে সঙ্গতিসূচক পদ্ধতি। সেই জেদ সেই তাড়নার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যবিন্দু তৈরি হয় লেখার ট্র্যাজেডির গুণ। যখন কে. ক্যাসেলে টেলিফোন করে, সে শুনতে পায় এলোমেলো শব্দ, মিশ্র কণ্ঠস্বর, অস্পষ্ট হাসি, দূর থেকে ক্ষীণ আহ্বান। যথেষ্ট আশাবাদী তাতে তার আশা, ঐসবের মতো গ্রীষ্মের আকাশে ফুটে ওঠে কিছু চিহ্ন বা ঐসব সন্ধের উপলব্ধি বা প্রত্যাশাগুলো, ওসব আমাদের বেঁচে থাকার যুক্তিগুলো পূরণ হয়। কাফকার কাছে এখানে দেখা যায় অদ্ভুত বিষাদের গোপনীয়তা। সত্যের ভেতর একই জিনিস দেখা যায় প্রুস্তের লেখায় বা প্লাটিনাসের ল্যান্ডস্কেপে : ‘হারানো স্বর্গের জন্য নস্টালজিয়া। ওগলা বলে,
আমি বেশ দুঃখিত, যখন সকালবেলায় বারনাবাস আমায় বলে, সে ক্যাসলে যাচ্ছে : সম্ভাব্য ব্যর্থ ভ্রমণ। সেই নষ্ট দিন, সম্ভাব্য শূন্য আশা।’ সম্ভাবনাময়-এই প্রয়োগ কাফকা তাঁর সমগ্র লেখায় জুয়া খেলেছেন। কোনো কিছু পাওয়া যায়নি; শাশ্বত অন্বেষণ এখানে অতি সতর্কভাবে করা হয়, খুঁটিনাটি নজর এড়িয়ে যায় না। আর ওগুলো উৎসাহিত করে স্বয়ংক্রিয়তাকে, কাফকার চরিত্রগুলো, আমাদের যা হওয়া উচিত যদি আমাদের বিক্ষেপ[২৬] থেকে বা বিহ্বলতা বঞ্চিত করা হয়ে থাকে, সেই যথাযথ ধারণা আমাদের সরবরাহ করে এবং আক্ষরিক অর্থে দিব্যতার অবমাননার ওপর ন্যস্ত হয়।
দ্য ক্যাসল-এ সবার কাছে আত্মসমর্পণ করে, হয়ে ওঠে নীতি। কের বড় আশার গ্রহণ করে তাকে ক্যাসলকে পেতে হবে। একার দ্বারা তা হবে না, গ্রামের অধিবাসী হয়ে, বিদেশি মর্যাদা হারিয়ে এই আনুকূল্যের যোগ্যতা হয়ে উঠতে তার সমগ্র চেষ্টা করতে হবে। সবাই তাকে অনুভব করবে। সে কী চায়, একটা চাকরি, একটা বাড়ি, স্বাস্থ্যকর জীবন, স্বাভাবিক মানুষ। আর একটু পাগলামো সহ্য করতে পারে না। যুক্তিসঙ্গত হতে চায় সে। অদ্ভুত অভিশাপ সে পরিত্যাগ করতে চায়, তাকে গ্রামের এক আগন্তুক করে তোলে। এই ক্ষেত্রে ফ্রাইয়েডার কাহিনী গুরুত্বপূর্ণ। এই মহিলা ক্যাসলের একজন অফিসারকে জেনেছে, কারণ এটাই তার অতীত, যদি তাকে মিস্ট্রেস হিসেবে এই মহিলাকে নেয়। তাকে কিছু সিদ্ধান্ত নেয় যা তাকে উল্লেখযোগ্য করে তোলে—যখন সচেতন হয়ে যা চিরকালের জন্য তাকে ক্যাসলের মূল্যহীন করে তোলে। একজন ভাবায় রেজিনা ওলসন-এর জন্য কিয়ের্কেগার্দের অদ্ভুত ভালোবাসা। নির্দিষ্ট মানুষদের, তাদের উপভোগ করে শাশ্বত আগুন, এর ভেতর পুড়িয়ে তাদের জন্য যথেষ্ট রকম মহান, তাদের বিশেষ হৃদয় তাদেরই ঘনিষ্ঠতম। গুরুতর ভুল যা হয়েছে তা ঈশ্বরকে দেওয়া হয়, তা ঈশ্বরের নয়, সেই ভুল দ্য ক্যাসল-এর কাহিনীর বিষয়ের অনুরূপ। তবে কাফকার জন্য মনে হয় এ ভুল নয়। এ হলো এক উপদেশ বা মতবাদ ও এক ‘ঝাঁপ’। কিছুই নেই, আর সেটা ঈশ্বর নয়।
এমনকি আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো ঘটনাটি, বারনাবাস বোনেদের দিকে যাওয়ার উদ্দেশে ল্যান্ড সার্ভেয়ার ফ্রাইয়েডার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দেয়। কারণ বারনাবাস পরিবার হলো গ্রামের একমাত্র পরিবার যারা আক্ষরিক অর্থে ক্যাসলের দ্বারা পরিত্যক্ত এবং গ্রামের দ্বারাও। আমালিয়া, বড় বোন বাতিল করে দেয় এই লজ্জাকর প্রস্তাব, ক্যাসলের একজন অফিসকর্মী যে কিনা তাকে প্রস্তাব দিয়েছে। অনৈতিক অভিশাপ যা অনুসরণ করা হয়েছিল, চিরকালের জন্য তাকে ঈশ্বরের ভালোবাসা থেকে সরিয়ে দেয়। ঈশ্বরের জন্য একজন সম্মান হারানোর অসমর্থ হয়ে হিসেব করে তার উজ্জ্বলতার মূল্যহীন করে তোলে। অস্তিত্ববাদী দর্শনের পরিচিত থিমকে চিনতে পারো : সত্যের বিপরীতে নৈতিকতা। এই বিন্দুতে জিনিসগুলো দূরবর্তী। ফ্রাইয়েডা থেকে বারনাবাসের বোনেদের দিকে কাফকার নায়কপথ অনুসরণের কারণে, সেটা হলো বিশেষ একটি যা বিশ্বাসভাজন ভালোবাসা থেকে অ্যাবসার্ডের দেবত্ব আরোপণের দিকে। এখানে আবার কাফকার ভাবনা কিয়ের্কেগার্দের সমান্তরাল হয়ে ছুটছে। এ বিস্ময়কর যা বইয়ের শেষে ‘বারনাবাসেদের গল্প’ রাখা হয়েছে। ঈশ্বরকে পুনরায় ধরার জন্য ল্যান্ড সার্ভেয়ারকে শেষ চেষ্টা করতে হয়, যা তাকে পরিত্যক্ত করেছে, তার ভেতর দিয়ে, তাকে চেনে, আমাদের ভালোত্ব ও সৌন্দর্যের পর্যায় অনুসারে নয়, তার উদাসীনতায়, তার অন্যায়ে, তার ঘৃণায় লালিত শূন্য ও লুকানো দৃষ্টিকোণ এর পেছনে রয়েছে। সেই আগন্তুক যে কিনা তাকে নিতে ক্যাসেলকে বলে, তার ভ্রমণের শেষে সামান্য নির্বাসিত কারণ এ সময় নিজের ওপর বিশ্বস্ততা নেই, আদর্শ বিচ্যুত হয়, যুক্তি ও বৌদ্ধিক সত্যতা প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে চেষ্টা করে, ওর উন্মত্ত আশার সঙ্গে একাই সঁপে দেয়, দিব্যতার উজ্জ্বলতার নির্জনতা।[২৭]
‘আশা’ শব্দ এখানে ব্যবহার করা হয় তা অদ্ভুত নয়। অপরদিকে, কাফকা আরো ট্র্যাজিকের অবস্থাকে বর্ণনা করেন; আরো বলিষ্ঠ আরো আক্রমণাত্মক আশা হয়ে ওঠে। দ্য ট্রায়াল, আরো সত্য অ্যাবসার্ড, আরো গতিশীল ও অবৈধ, দ্য ক্যাসল- এর আবেগিত ‘ঝাঁপ’ মনে হয়। তবে আমরা এখানে আবার দেখতে পাই শুদ্ধ রাষ্ট্রে অস্তিত্বের ভাবনার কূটাভাস, যেমন ব্যক্ত হয়, উদাহরণস্বরূপ কিয়ের্কেগার্দ : ‘পার্থিব আশাকে হত্যা করা হয় : কেবল তখন ‘প্রকৃত সত্য’[২৮] আশা একজনকে রক্ষা করতে পারে কি; যে আশা অনূদিত হতে পারে : ‘দ্যা ক্যাসলকে ধারণ করে একজন লিখতে হয়েছিল দ্য ট্রায়াল।’
তাদের মধ্যে অধিকাংশ যারা কাফকা সম্পর্কে বলেছেন, তাঁর লেখাকে দেখিয়েছেন হতাশ বেপরোয়া চিৎকার যা কোনো প্রবাহ কোনো আশ্রয় রেখে যায়নি মানুষের কাছে। একে বলা যায় রিভিউ। আশা আর আশা। আমার কাছে হেনরি বোরডেক্সের আশাবাদী লেখা মনে হয় অদ্ভুতভাবে নিরুৎসাহজনক। কারণ এতে পার্থক্য করার মতো কিছু নেই। অপরদিকে মালরোর লেখা সব সময়ই চাঙা করার মতো। তবে দুটি ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে আশা যেমন নেই তেমন একই হতাশাও নেই। আমি কেবল দেখি অ্যাবসার্ড লেখা ধর্মে অবিশ্বাসের দিকে নিয়ে যায়, এ আমি এড়াতে চাই লেখা বন্ধ্যা অবস্থায় ফলদায়ক নয়, তারই পুনরাবৃত্তি করে, এখানে তা হয়ে ওঠে ভ্রমের দোলনা। এ ব্যাখ্যা করে, দেয় আশার আকার। স্রষ্টা এর থেকে দ্রুত বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। এ ট্র্যাজিক খেলা নয় যা হতে হয়েছিল। লেখকের জীবনে এ একটা অর্থ দেয়।
যে কোনো ক্ষেত্রে এ অদ্ভুত কাফকা, কিয়ের্কেগার্দ বা চেস্টভের মতো লেখকদের যে লেখার উৎসাহ সম্পর্কিত, অস্তিত্ববাদী ঔপন্যাসিক ও দার্শনিকগণ সম্পূর্ণরূপে অ্যাবসার্ডের সঙ্গে বিজড়িত এবং এর ফলাফল, পরিণামে আশা প্ৰবল চিৎকারের দিকে চালিত করে।
ওরা ঈশ্বরকে আলিঙ্গন করে, যিনি তাদের ভোগ করে। পীড়নের ভেতর দিয়ে, আশা প্রবেশ করে। এই অস্তিত্বের অ্যাবসার্ডের কারণে আরো কিছু অলৌকিক বাস্তবতা তাদের আশ্বাস দেয়। যদি এই জীবনের স্রোত ঈশ্বরের দিকে চালিত করে, সর্বোপরি একটা পরিণতি তো আছে। আর অধ্যবসায়, দৃঢ়তা যার সঙ্গে কিয়ের্কেগার্দ, চেস্টভ ও কাফকার নায়কেরা পুনরায় তাদের এমন করে, এসব সেই নিশ্চয়তার উপেরাত্থিত শক্তির এক বিশেষ সমন।[২৯]
কাফকা তাঁর ঈশ্বরকে অস্বীকার করে নৈতিক মহত্ত্বে, সাক্ষ্যে, মূল্যে, কর্তব্যে, সুসঙ্গতিতে, কেবল তার বাহুতে পড়ে যাওয়াটা অধিকতর ভালো। অ্যাবসার্ড চেনা যায়, গ্রহণ করা হয়, আর মানুষ পদত্যাগ করে, কিন্তু তার থেকে আমরা জানি অ্যাবসার্ড হয়ে এ বন্ধ করে দেবে। মানব অবস্থার সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকে আশার চেয়ে বৃহত্তর আশা অবস্থা থেকে পালানোর সুযোগ দেবে? আরো একবার যেমন আমি দেখি, এই ক্ষেত্রে অস্তিত্বের ভাবনা (অপরদিকে বর্তমান মত) বৃহৎ আশায় পরিব্যাপ্ত করে। বিশেষ আশা, প্রথমদিকের খ্রিস্টীয় সময়ে এবং সংবাদ ছাড়ানোর সময় আশা প্রাচীন পৃথিবীতে অগ্নিশিখার মতো ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেই ঝাঁপে চরিত্র কীভাবে পায় সব অস্তিত্ববাদী ভাবনা। সেই দৃঢ়তা, দিব্যতার জরিপে ভূপৃষ্ঠ বিলীন হয়, পারে একজন স্বচ্ছতার চিহ্ন দেখতে ব্যর্থ হতে যা নিজে নিজেই ছুড়ে ফেলে? কেবল দাবি করে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ত্যাগ করার গৌরব। এরূপ পরিত্যাগ হয়ে ওঠে ফলপ্রসূ। কিন্তু এতে তা বদল হয় না। আমার চোখ থেকে স্বচ্ছতার নৈতিকতা মিলিয়ে যেতে পারে না। সব গৌরবের মতো একে বন্ধ্যা বললেও। এর বিশেষ সংজ্ঞা কারণ সত্যও বন্ধ্যা, নিষ্ফলা। সবই ঘটনা। যে জগতে সব কিছুই দেওয়া হয়েছে আর কোনো কিছু ব্যাখ্যা করা হয়নি, মূল্যের ফলদায়কতা অথবা আধিবিদ্যক এক অর্থের বিলীনতার ধারণা।
যে কোনো ক্ষেত্রে, এখানে তুমি দেখেছ কোন ভাবনার ঐতিহ্য কাফকার লেখায় স্থান পেয়েছে। বস্তুত ‘দ্য ট্রায়াল’ থেকে ‘দ্য ক্যাসল’ পর্যন্ত অপরিহার্য উন্নতি হিসেবে বিবেচনা করে তা বৌদ্ধিক হয়ে ওঠে। জোসেফ কে. এবং ল্যান্ড সার্ভেয়ার কে. দু’জনে দুই মেরুর মানুষ শুধু যা কাফকাকে আকর্ষণ করে।[৩০] যেমন সে করে এবং যা বলে তাই আমি বলব, তাঁর লেখা সম্ভবত অ্যাবসার্ড নয়। কিন্তু এর মহত্ত্বতা ও চিরন্তনতা দেখার থেকে এর আমাদের ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করা উচিত নয়। তারা ঘটনা থেকে আসে, তা সে এত পুরোপুরি উপস্থিত করার ব্যবস্থা করে, প্রতিদিনকার আশা থেকে দুঃখের আসা-যাওয়ার পথে এবং বেপরোয়া প্রজ্ঞা থেকে আন্তর্জাতিক অন্ধত্ব পর্যন্ত। তাঁর লেখা বিশ্বজনীন (প্রকৃত অ্যাবসার্ড লেখা বিশ্বজনীন হয় না) থেকে প্রসারিত যাতে এ উপস্থিত করে মানুষের আবেগভরা চলমান মুখ যার থেকে মানবতা অদৃশ্য, বিশ্বাসের জন্য সিদ্ধান্ত নেয় তার স্ববিরোধী কারণ, তার পরিত্যক্ত হতাশা থেকে আশার কারণ এবং মৃত্যুতে আহ্বান করে আতঙ্কিত জীবন। এ বিশ্বজনীন কারণ এর অনুপ্রেরণা হলো ধর্মীয়। যেমন সব ধর্মে, তার নিজের জীবনের ওজন থেকে মানুষ মুক্ত। কিন্তু আমি যদি জনতাম, যদি আমি এমনকি প্রশংসা করতে পারতাম, আরো আমি জানি বিশ্বজনীন কী এবং সত্য কী তা আমি খুঁজছি না। দুটো ভালোভাবে মিলতে পারে না।
বিশেষ মতটি আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে যদি আমি বলি, সত্যই আশাহীন ভাবনা কেবল ঘটে, বিপরীত বিচারের মান বা নীতি নির্ণয়ের দ্বারা এবং ট্র্যাজিক লেখা বা কাজ হতে পারে লেখা বা কাজ, সর্বোপরি ভবিষ্যতের আশা নির্বাসিত, একজন সুখী মানুষের জীবন বর্ণনা করে। আরো উত্তেজক জীবন, এ হারিয়ে এ ধারণা আরো বেশি অ্যাবসার্ড। সম্ভবত সেই গর্বিত উষর গোপনীয়তা অনুভব করে নিৎসের লেখায়। এই যোগসূত্রে কেবল নিৎসেই একমাত্র শিল্পী অ্যাবসার্ডের নন্দনতত্ত্বের চূড়ান্ত ফলাফলকে বিশ্লেষণ করেছে, যেহেতু তাঁর চূড়ান্ত বাণী রয়েছে এক বন্ধ্যা নিষ্ফলা ও স্বচ্ছতাকে জয় এবং যে কোনো অলৌকিক সান্ত্বনার একগুঁয়ে দুর্দমনীয় বাতিল।
তৎসত্ত্বেও এই রচনা বা প্রবন্ধের কাঠামোতে কাফকার প্রধান গুরুত্বকে সমানরূপে বের করতে পূর্ববর্তী ঘটনার প্রয়োজন মেটানো। এখানে মানব ভাবনার সীমাবদ্ধতায় আমাদের বহন করতে হয়েছে। ভাষার পূর্ণ অর্থে, বলতে পারা যায় ঐ লেখায় সবকিছু প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো ক্ষেত্রে একত্রে অ্যাবসার্ড সমস্যা উপস্থাপন করা হয় গুরুত্বসহকারে। যদি কেউ আমাদের প্রাথমিক স্তরের মন্তব্যগুলোকে তুলনা করতে চায়, ফর্মের সঙ্গে বিষয় ভাবনা, স্বাভাবিক শিল্পের সঙ্গে দ্য ক্যাসলের গোপন অর্থ যাতে রয়েছে কে. এর আবেগতাড়িত রূপগুলো ছাঁচে ঢালা হয়েছে, প্রতিদিনকার গর্বিত অন্বেষণকে স্থাপিত করা হয়েছে যা কিছু এর ভেতর ঘটেছে, এর থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাহলে তাকে বুঝতে হবে এর মহত্ত্ব কী হতে পারে। কারণ যদি নস্টালজিয়া মানব চিহ্ন হয়, সম্ভবত কেউই এসব ফ্যান্টমের ভেতর রক্ত মাংস ও স্বর দেয়নি। কিন্তু একই সময়ে সময় সচেতন হয়ে উঠবে কিসে ব্যতিক্রমী মহত্ত্বে অ্যাবসার্ড কর্মকে স্মরণ করা হবে, সম্ভবত এখানে এর ভেতর দেখা যাবে না। যদি শিল্পের প্রকৃতি সাধারণের থেকে বিশেষ বেঁধে দিতে হয়, একবিন্দু জলের ক্ষণস্থায়ী চিরন্তনতা এর আলোতে খেলা, এমনকি দূর থেকে অ্যাবসার্ড লেখকের মহত্ত্বকে বিচার করা আরো সত্য যে এই দুই জগতের মাঝে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে সমর্থ। তার গোপনীয়তা ঠিক বিন্দুটিকে চিনিয়ে দিতে সমর্থ সে, এমনই সে সাঁজিয়ে দেয় যেখানে তাদের মহৎ অসামঞ্জস্য মেলে।
এবং সত্য বলতে কী, মানুষের এই জ্যামিতিক অবস্থান এবং পবিত্র হয়ে হৃদয়ে অমানবিকতা সর্বত্র দেখা যায়। যদি ফাউস্ট ও ডন কিহোটে উল্লেখযোগ্য শিল্প সৃষ্টি, এর কারণ তাদের পার্থিব হাত দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে অপরিমেয় মহত্ত্বকে। তবুও এক মুহূর্ত সব সময় আসে যখন সত্যগুলোকে নাকচ করে মন, আর সত্যগুলোকে ঐ হাতগুলো স্পর্শ করতে পারে। এক মুহূর্ত আসে যখন সৃজন ট্র্যাজিকরূপে গ্রহণ করা থেকে নিবৃত্ত করে; এ গভীরভাবে কেবল গ্রহণ করে। তারপর মানুষ আশার সঙ্গে সংসক্ত হয়। কিন্তু এটা তার কাজ নয়। এড়িয়ে কৌশলে পালিয়ে যাওয়া থেকে ঘুরে আসাটাই তার কাজ। তবু এ কেবল যা আমি দেখি এই সিদ্ধান্তকালে সমগ্র বিশ্বের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দীপ্ত পূর্ববর্তী কাফকার গঠন যা তিনি গড়েছেন। এই ভয়ঙ্কর কুৎসিত ও উলট-পালট জগতে অবিশ্বাস্য রায়, যাতে গন্ধ মূষিকেরা আশা করার স্পর্ধা করে।[৩১]
***
নোট
২৫. সামাজিক সমালোচনার (উদাহরণস্বরূপ দ্য ট্রায়াল) জ্ঞানে কাফকার লেখার সম্পূর্ণ বৈধরূপে ব্যাখ্যা হতে পারে, এ মূল্যবান নিরিখ। অধিকন্তু পছন্দ করার প্রয়োজন নেই- এ সম্ভাবনা রয়েছে। উভয় ব্যাখ্যাই ভালো। অ্যাবসার্ড দিক দিয়ে যেমন আমরা দেখেছি মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, এ সরাসরি-ঈশ্বরের বিরুদ্ধে : মহান বিদ্রোহ সবসময় আধিবিদ্যক।
২৬. দ্য ক্যাসল-এতে মনে হয় পাস্কেলীয় অর্থে ‘বিক্ষেপ’ সহকারীদের দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করে, তারা তার দুর্ভাবনা থেকে কে. কে বিক্ষেপ করে। পরিণামস্বরূপ যদি ফ্রাইয়েডা সহকারীদের মধ্যে একজনের শিক্ষিকা হয়, এর কারণ সত্যের দিকে মঞ্চ-স্থাপন পছন্দ করে, প্রতিদিনকার জীবন ভাগ করে নেয় কষ্টকে।
২৭. দ্য ক্যাসল-এর অসমাপ্ত ভাষ্যে কেবল অবশ্যম্ভাবী সত্য রয়েছে যেখানে কাফকা আমাদের ছেড়ে দেন। তবে সন্দেহ নেই শেষ অধ্যায়গুলো লেখক ধ্বংস করে তাঁর উপন্যাসের সুরের ঐক্য।
২৮. হৃদয়ের শুদ্ধতা।
২৯. দ্য ক্যাসল-এর ভেতর আশা ব্যতীত কেবল চরিত্রটি হলো আমালিয়া। সে এমনই একজন যাকে অত্যন্ত হিংস্ররূপে ল্যান্ড সার্ভেয়ার স্থাপিত করে তুলনামূলকরূপে।
৩০. কাফকার ভাবনা দুটো বিষয়ের ওপর, তুলনা করে ‘ইন দ্য পেনাল কলোনি’ প্রকাশিত Cahier du Sud কৃত, (Partisan Review কর্তৃক আমেরিকা–অনুবাদের নোট) : ‘অপরাধ [“মানুষের” উহ্য] কখনোই সন্দেহপূর্ণ নয় এবং দ্য ক্যাসল-এর সারমর্ম (‘মোমুস’ এর রিপোর্ট) : ‘ল্যান্ড সার্ভেয়ার-এর অপরাধ প্রকাশ করা কঠিন।’
৩১. কাফকার লেখা অবশ্যম্ভাবী এক ব্যাখ্যা আমাদের সামনে সুযোগ করে দেয়। কিন্তু বিবেচনার যোগ্য হয়ে এ পরিচ্ছন্ন যোগ করে এতে কোনো বাঁধা দেয় না। নন্দনতত্ত্বের বিন্দু থেকে এক আলাদা দৃষ্টিকোণ। উদাহরণস্বরূপ B, Groethuysen—তার দ্য ট্রায়াল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা সীমায়িত করে। আমাদের চেয়ে অধিকতর জ্ঞানসমৃদ্ধ, যা তিনি বলেছেন কেবল, তার বেদনাদায়ক কল্পনা সবচেয়ে আঘাত করে; দিবাস্বপ্নের দর্শক একজন। এ ভাগ্য, সম্ভত সেই লেখার মহত্ত্ব যা সবকিছু পড়তে বলে এবং সুনিশ্চিত করে।
***