পরিশিষ্টের বক্তব্য

পরিশিষ্টের বক্তব্য

আইন-আকবরীর যথাযথ অনুবাদ সম্ভব নহে। গ্লাড়উইন, ব্লকম্যান প্রভৃতি সাহেবরা ইংরেজী ভাষায় যে অনুবাদ করিয়াছেন, তাহাও ভ্রমপ্রমাদপূর্ণ। সেই ইংরেজী হইতে বাঙ্গালা অনুবাদ করিতে গেলে আমাদের বোধ হয়, উহা বাঙ্গালীর অপাঠ্য হইয়া পড়িত। মুসলমান লেখকের অতিশয়োক্তি আধুনিক বাঙ্গালীর ভাল লাগে না, কাজেই সে সকল অতিশয়োক্তি আমাদিগকে ছাড়িয়া দিতে হইয়াছে। অনেক গালগল্পও আইন-আকবরীতে লেখা আছে; আমরা তাহাও ছাড়িয়া দিয়াছি। জমীর বন্দোবস্ত, জমাবন্দীর হিসাব, শাসনব্যবস্থা, তৎকালের সামাজিক অবস্থা এবং বাদশাহের ঐশ্বৰ্য্য, এই সকল বিষয়ে যে ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া আমাদের প্রতীতি হইয়াছে, তাহাই প্রকাশ করিয়াছি। ইংরেজ ইতিহাস-লেখক মিল হন্টার, মার্কিণ ইতিহাস-লেখক নোলন যাহা প্রামাণ্য বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন এবং যে উপায়ে প্রামাণ্যবিষয় নির্ধারণ করিতে হইবে, তাহা দেখাইয়াছেন, তাহাই অবলম্বন করিয়া এই পুস্তক লিখিত হইল।

আইন-আকবরী আকবরনামা পুস্তকের পরিশিষ্ট মাত্র। আকবরনামার আকবর শাহের নানা গল্প লেখা আছে, অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাও উহাতে আছে; কিন্তু সে পুস্তক প্রকাণ্ড। তাহারই পরিশিষ্টরূপে আইন-আকবরী লিখিত হয়। ইহাতে শাসনব্যবস্থার কথা, রাজকর্মচারীগণের কর্তব্যনিৰ্দ্ধারণ, জরিপ ও তৌজীর ব্যবস্থা এবং জমাবন্দী স্থির করিয়া লেখা আছে। সাধারণ পাঠকের পক্ষে এ সকল বিষয় নীরস। সেই জন্য প্রথমেই আকবর শাহের জীবনকথা মোটামুটীভাবে লেখা হইয়াছে। শ্রীযুক্ত ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অনুগ্রহ করিয়া আমাকে আকবরের জীবনী লিখিয়া দিয়া বাধিত করিয়াছেন। মোগল-সাম্রাজ্যের সকল সুরার বর্ণনা এবং তাকালিক ভূতত্ত্ববিবরণ আমার প্রিয়মিত্র শ্রীযুক্ত জলধর সেন লিখিয়া দিয়াছেন। আমার অংশে নীরস আইনের কথা, ব্যবস্থার কথা, কর আদায়ের কথা প্রভৃতি বিষয় লিখিবার ভার পড়িয়াছিল। মালগুজারী বিষয় লিখিবার সময় ব্লকম্যানের আইন আকবরীর অনুবাদ পড়িয়া মিলাইয়া দেখিতে হইয়াছিল। আমি ব্লকম্যানের অনুবাদ-পুস্তকই অধিকতর প্রামাণ্য পুস্তক বলিয়া মনে করি; সেই জন্য যেখানে গ্লাউইন ও রকম্যানের অনুবাদের বিভিন্নতা ও বিরোধী হইয়াছে, সেই স্থানে আমি ব্লকম্যানেরই অনুসরণ করিয়াছি। অনেক বিষয় মিল ও হন্টার হইতে সংগ্রহ করিয়া লিখিত হইয়াছে।

যে প্রকার তাড়াতাড়িতে এই পুস্তক লিখিত হইল, তাহাতে ইহা যে ভ্রমপ্রমাদশূন্য হইবে, এমন কথা বলিতে পারি না। ভাষা বা অলঙ্কারের দিকে আমি দৃষ্টি রাখি নাই; সহজ সরল গ্রাম্য ভাষায় সকল কথা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছি; সুতরাং আধুনিক হিসাবে যে ভাষার দোষ হয় নাই, এমন কথাও বলিতে পারি না। তবে এইটুকু বলিতে পারি যে, আইন আকবরীতে লিখিত সকল জ্ঞাতব্য ঘটনা ও বিষয় সবিশেষ যত্নের সহিত লিখিত হইয়াছে। এক্ষণে পুস্তকের আদর হইলেই শিক্ষিতসমাজে ইহার বহুল প্রচার হইলেই আমি আমার পরিশ্রম সার্থক মনে করিব। ইতি।

শ্রীপাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়
বসুমতী কাৰ্যালয়
১২ আশ্বিন, ১৩০৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *