পরিণাম-পর্ব

পরিণাম-পর্ব

প্রথম পরিচ্ছেদ

নুরল এসলামের পরবর্তী জীবনের ঘটনা বর্ণনা করিবার পূর্বে, বেলগাঁও বন্দরের একটি চিত্র এস্থলে পাঠকগণের হৃদয়ঙ্গম করিয়া দেওয়ার আবশ্যক হইয়াছে।

স্রোতোবাহিনী-সরিতের সৈকতসমন্বিত পশ্চিম তটে অর্ধবৃত্তাকারে বেলগাঁও বন্দর অবস্থিত। বন্দরের দক্ষিণ উপকণ্ঠে কোম্পাণির পাটের কারখানা ও অফিস ঘর। নাতিবৃহৎ অফিস-গ্রহ করগেট টিনে নির্মিত, দুই প্রকোষ্ঠে বিভক্ত; সদর দরজা দক্ষিণ মুখে। পশ্চিমের প্রকোষ্ঠে বড়বাবু নুরল এসলাম, পূর্ব-প্রকোষ্ঠে ছোটবাবু রতীশচন্দ্র সরকার কার্য করেন। প্রকাণ্ড লোহার সিন্দুকে কোম্পানির মূলধন থাকে, তাহা পশ্চিম প্রকোষ্ঠে বড়বাবুর জিম্মায়। গ্রীষ্মকালে তটিনীর সৈকতসীমা পূর্বদিকে বহুদূর বিস্তৃত হয়, এইজন্যে এই সময় বন্দরে পানির বড়ই কষ্ট হয়। সদাশয় জুট ম্যানেজার সাহেব সর্বসাধারণের এই পানির কষ্ট নিবারণের জন্যে কোম্পানির অর্থে, অফিস ঘরের পশ্চিমাংশে একটি পুষ্করিণী খনন করিয়া দিয়াছেন। পুষ্করিণীর পূর্বে ও উত্তরে দুইটি শানবাঁধা ঘাট। পূর্বের ঘাট দিয়া অফিসের লোক ও উত্তরের ঘাট দিয়া সাধারণ লোক পানির জন্যে যাতায়াত করে। পশ্চিম পাড় নানাবিধ আগাছা লতাগুল্মে পূর্ণ, দক্ষিণ দিকে কোম্পানির ফলবান বৃক্ষের বাগান। অফিস ঘরের উত্তর দিকে অনতিদূরে বড়বাবুর বাসা। বাসার উত্তর প্রান্তে জুম্মা মসজিদ। মসজিদের বায়ু-কোণে বাজার, সোম ও শুক্রবারে বন্দরে হাট বসে। বন্দরের পশ্চিম অংশে থানার ঘর। তাহার পশ্চিম দক্ষিণে কিছু দূরে বারাঙ্গনা-পল্লী। রতীশবাবুর বাসা বন্দরের উপর সদর রাস্তার ধারে। তাঁহার চরিত্র মন্দ;—এক রক্ষিতা রাখিয়াছেন। উপার্জিত অর্থ তাহার সেবাতেই ব্যয়িত হয়। রতীশবাবু বড়বাবু অপেক্ষা কিছু বেশিদিনের চাকর। তিনি ধূর্তের শিরোমণি অসৎকার্যে তাঁহার অদম্য সাহস; মাসিক বেতন ১৫ টাকা। বড়বাবুর নিযুক্তির পূর্বে তিনি অসদুপায়ে ৫০, ৬০ টাকা উপার্জন করিতেন। যাচনদার দাগু বিশ্বাস পুরাতন চাকর। সে শয়তানের ওস্তাদ; মাসিক বেতন ৯ টাকা। বড়বাবু আসিবার পূর্বে তাহারও ৩০, ৩৫ টাকা আয় হইত। নিম্নপদে আরও ৩/৪ জন চাকর আছে। তাহাদের উপরি আয়ও ঐ অনুপাতে হইত। ভিজা পাট শুক্‌না বলিয়া চালাইয়া, ১০০ মণে একমণ করিয়া পাইকার বেপারীগণের নিকট দস্তুরী ও ঘুষ লইয়া দুষ্টেরা উল্লিখিতরূপে উপরি আয় করিত। এইরূপ করিয়া তাহারা কোম্পানির সমূহ টাকা ক্ষতি করিত। আবার ভিজা পাট চালান দেওয়ার দরুন অনেক সময় কলিকাতার ক্রয়মূল্য অপেক্ষা কমদরে কোম্পানির পাট বিক্রয় হইত। ইহাতেও কোম্পানির অনেক টাকা লোকসান হইত। নুরল এসলাম কার্যে নিযুক্ত হইয়া অল্পদিনেই ব্যবসায়ের অবস্থা বুঝিয়া উঠিলেন। নিমকহারাম চাকরদিগের বিশ্বাসঘাতকতায় কোম্পানি যে আশানুরূপ লাভ করিতে পারে না তিনি তাহা টের পাইয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন এবং দুষ্টদিগের কার্যের প্রতি তীব্র দৃষ্টি রাখিতে আরম্ভ করিলেন। ইহাতে অল্পদিনেই দুষ্টদিগের উপরি আয় বন্ধ হইয়া আসিল। বুভুক্ষিত আহারনিরত হিংস্র পশুর মুখের গ্রাস সরাইলে তাহারা যেমন রুখিয়া উঠে, ভৃত্যগণ নুরল এসলামের প্রতি প্রথমত সেইরূপ খড়গহস্ত হইল। শেষে তাঁহাকে জব্দ ও পদচ্যুত করিবার জন্য নানা ফন্দী পাকাইতে লাগিল। সেই সময় হইতে সামান্য খুঁটিনাটি ধরিয়া তাহারা তাঁহার বিরুদ্ধে আলোচনা আরম্ভ করিল। কিন্তু গত তিন বৎসরের মধ্যে নীচাশয়দিগের বাসনা পূর্ণ হইল না। এদিকে বিশ্বস্ততা ও ব্যবসায়নৈপুণ্যে উত্তরোত্তর নুরল এসলামের পদোন্নতি হইতে লাগিল। তিনি ছয়মাস কাতর থাকায় রতীশবাবু তাঁহার স্থলে কার্য করিয়াছিলেন। এই সময়ের মধ্যে অফিসের সমস্ত চাকরের উপরি আয়ের পুনরায় বিশেষ সুবিধা হইল, এজন্যে তাহারা রতীশবাবুর একান্ত অনুগত হইয়া পড়িল। ছয়মাস পরে রোগমুক্ত হইয়া নুরল এসলাম যখন পুনরায় কার্য গ্রহণ করিলেন, তখন অর্থ-পিশাচ ভৃত্যগণের মাথায় যেন আবার বজ্র পড়িল। তাহারা এখন হইতে প্রাণপণ চেষ্টায় নুরল এসলামের ছিদ্রান্বেষণে ও অনিষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হইল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

আব্বাস আলীদিগের কারাগারে যাইবার কিছুদিন পর, একদিন রাত্রি ১১ টার সময় স্থানীয় সাবরেজিস্ট্রার সাহেবের বাসায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া, নুরল এসলাম নিজের বাসায় যাইতেছিলেন। পূর্বে বলা হইয়াছে, রতীশবাবুর বাসা, বন্দরের উপর রাস্তার ধারে। নুরল এসলাম ঐ বাসার নিকটে আসিলে শুনিতে পাইলেন ৩/৪ জন লোক তথায় বসিয়া গল্প করিতেছে। একজন লোক কহিল, “রতীশবাবু, আজকাল পাওয়া-থোওয়া কেমন?”

রতীশ। নেড়ে দাদা কাজে আসা অবধি পাওয়া-থোওয়া চুলোয় গেছে।

প্রথমে ব্যক্তি। রতীশবাবু, আপনি যাই বলুন, আপনাদের বড়বাবু লোকটি বড় মন্দ নয়। আজকালকার বাজারে অমন খাঁটি লোক পাওয়া কঠিন। বেচারার কথা মিষ্ট, ব্যবহার উত্তম, চরিত্র দেবতার ন্যায়।

রতীশ। (গরম মেজাজে বলিলেন) তুমি বুঝি বড়বাবুর ঘোড়ার ঘাসী? নইলে অসতী স্ত্রীলোক লইয়া ঘর-সংসার করিতে যে ঘৃণা বোধ করে না, তুমি তাহারই গুণগান করিতে বসিয়াছ?

দ্বিতীয় ব্যক্তি। আপনি বলেন কি? বড়বাবুর স্ত্রীর সতীপনায় গুণ্ডাগণের হাত হইতে এদেশ রক্ষা পাইয়াছে।

তৃতীয় ব্যক্তি। আমরাও শুনিয়াছি, মোকদ্দমার ঘটনা শুনিয়া জজ সাহেবও তাঁহার সতীত্বের প্রশংসা করিয়াছেন।

রতীশ। আব্বাস আলীর মত গুণ্ডার হাতে যে স্ত্রীলোক একবার পড়িয়াছে, তাহার যে সতীত্ব আছে, তাহা তুমি শপথ করিয়া বলিলেও বিশ্বাস করি না। স্বয়ং সীতাদেবী হইলেও না।

নুরল এসলামের খানাবাড়ির প্রজা নবাব আলী ওরফে নবা নামক একটি লোক তথায় উপস্থিত ছিল। সে বলিল, “মুনিবের বিবি বলিয়া বলিতে ভয় হয়, কিন্তু ছোটবাবু যাই বলেন, আমারও ত তাহাই মনে হয়।” নুরল এসলাম ঘরের পাশে দাঁড়াইয়া সব শুনিলেন। রতীশবাবুর শেষ উক্তি নুরল এসলামের কর্ণ ভেদ করিয়া সবেগে এবং সজোরে তীরের ন্যায় তাঁহার হৃদয়ের অন্তস্থলে প্রবিদ্ধ হইল। তিনি দম বন্ধ করিয়া বাসায় আসিলেন। হায়! বিনা মেঘে অশনিপাত হইল। নুরল এসলাম শয্যায় পড়িরা হা-হুতাশ করিতে লাগিলেন। তিনি বলিতে লাগিলেন, “হায়, কি শুনিলাম! ক্ষয়কাশে মৃত্যু হইলেও ত ভাল ছিল! তাহা হইলে এমন ঘৃণিত কথা আর শুনিতে হইত না।

অপরিসীম যাতনায় তাঁহার হৃদয় নিষ্পেষিত হইতে লাগিল। শয্যা কন্টক অপেক্ষাও তীক্ষ্ণবিদ্ধ হইয়া উঠিল। তিনি সারারাত্রি অনিদ্রায় কাটাইলেন। প্রাতে শান্তিলাভ-বাসনায় ধীরে ধীরে মসজিদে নামাজ পড়িতে গেলেন। নামাজ অন্তে ঊর্ধ্ব-করযোড়ে বলিতে লাগিলেন, “দয়াময়! যদি রোগে রক্ষা করিলে তবে দুর্ভোগ কেন? হৃদয়ে যে দাবানল জ্বলিতেছে; প্রভো! আর ত সহে না, তুমি অসহায়ের গতি, বিপন্নের বন্ধু, দুর্বলের বল, তুমি সর্বশান্তির আধার, অতএব দাসের হৃদয়ে শান্তি দান কর, কর্তব্য নির্ণয়ে বুদ্ধি দাও!”

নুরল এসলাম এইরূপ নানাবিধ বিলাপের সহিত মোনাজাত শেষ করিয়া হাত নামাইলেন। তাঁহার হৃদয়-যাতনার অনেক উপশম হইল। তিনি বাসায় আসিয়া যথাসময়ে অফিসের কার্যে ব্রতী হইলেন, কিন্তু মন কি আর অফিসের কার্যে স্থির হয়! অল্প সময় মধ্যে তাঁহার মনের আবার ভাবান্তর জন্মিল; থাকিয়া থাকিয়া পত্নীর সতীত্ব-নাশ সন্দেহের অপবিত্র ছায়াপাতে তাঁহার পবিত্র হৃদয় কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, হায়! আমার ন্যায় অসুখী, আমার ন্যায় অভাগা বুঝি দুনিয়ায় আর নাই? ফলতঃ এইরূপ দুর্ভাবনার দিনারুণ নিষ্পেষণে তাঁহার চিত্ত-বৈকল্য ঘটিয়া উঠিল এবং তাহা হইতে উন্মনা ভাব জন্মিল। উন্মনা ভাব হইতে ক্রমশঃ তাঁহার স্মৃতিশক্তির বিপর্যয় ঘটিতে লাগিল। সরকারি কার্যাদিতে ভূলভ্রান্তি, হিসাবপত্রে কাটকুট আরম্ভ হইল। তিনি মনে স্থিরতা-সম্পাদন জন্য মসজিদে যাইয়া পাঁচ অক্ত নামাজ পড়িতে আরম্ভ করিলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বৈশাখ মাস শেষ হইতে আর বেশিদিন বাকি নাই। শনিবার, মাধ্যাহ্নিক রবি পশ্চিম গগনে হেলিয়া পড়িয়াছে। গ্রীষ্মের নিদারুণ অত্যাচারে সর্বংসহা পৃথিবী শাঁ শাঁ খাঁ খাঁ করিতেছে। জীবকুল যেন রোজ কেয়ামত স্মরণ করিয়া সভয়ে নীরব হইয়াছে। যে যাহার আবাসে পড়িয়া ঝিমাইতেছে। কেবল ২/৪ টি অপান্ত বালক এদিকে ওদিক ছুটাছুটি করিতেছে। আর আমাদের বড়বাবু ও ছোটবাবু অবিশ্রান্তভাবে মসী-লেখনীর সদ্ব্যবহার করিয়া কেরানী- জীবনের দুর্ভাগ্যের পরিচয় প্রদান করিতেছেন। বড়বাবুর চিত্ত নিদারুণ ঘটনাবশে বিভ্রান্ত, তথাপি তিনি কর্তব্যকার্যে যথাসাধ্য মনোযোগী। তাঁহার ছিদ্রান্বেষণে রত ছোটবাবুও কার্য করিতেছেন, আর থাকিয়া থাকিয়া জানালা-পথে বড়বাবুর কার্য দেখিতেছেন।

বেলা ২টার পর বড়বাবু নুরল এসলাম চিত্তের প্রসন্নতার জন্য মসজিদে নামাজ পড়িতে গেলেন। একঘন্টা পর তথা হইতে ফিরিয়া আসিয়া পুনরায় অফিসের সেদিনের অবশিষ্ট কার্য শেষ করিলেন। অনন্তর ৪ টার সময় সাহেবের নিকট বিদায় লইয়া তিনি বাড়ি রওয়ানা হইলেন। কিন্তু হায়! বাড়ি-মুখে গমনোদ্যত তাঁহার প্রফুল্লচিত্ত ও উৎসাহী হস্ত-পদ আজ অবশ হইয়া আসিতে লাগিল। তিনি বিষাদের বোঝা বুকে করিয়া চিন্তাকুলচিত্তে সমস্ত পথ অতিবাহিত করিলেন।

তিনি বাড়ির নিকটবর্তী হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, হায়! আমি এখন কেমন করিয়া সেই পতিপ্রাণার সম্মুখে উপস্থিত হইব। এই কলুশিত অন্তর লইয়া তাহার সম্মুখে কেমন করিয়া দাঁড়াইব—হাসিয়া কথা কহিব? আমার হৃদয়ে যে কি দাবানল জ্বলিতেছে, সে-ত’ তাহার কিছুই জানে না; হায়, সে যখন হাসিয়া আসিয়া আমার হাত ধরিবে, আদর করিয়া কথা কহিবে, তখন আমি কি বলিয়া উত্তর দিব? কিরূপেই বা সরিয়া দাঁড়াইব? কেমন করিয়া তাহাকে উপেক্ষা করিব? হায়! সে যে আমা বই আর কিছুই জানে না! আমাকে সে যে প্রাণের চেয়েও ভালবাসে—সে যে আমার জন্য হাসিতে হাসিতে জীবন দানে উদ্যত। অহো! তাহার ভালবাসায় আমার আর অধিকার নাই। আমি আর সে পুণ্যবতীকে স্পর্শ করিবার যোগ্য নহি। ঘৃণিত সন্দেহের ছায়া লইয়া সে সতী-রত্নকে ছলনা করিতে পারিবে না। এইসব চিন্তা করিতে করিতে তিনি বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলেন।

বাড়ির দাসী নুরল এসলামকে বৈঠকখানায় বিষণ্নচিত্তে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আনোয়ারাকে যাইয়া সংবাদ দিল। শুনিয়া আনোয়ারা উৎকণ্ঠিতা হইল। ফুফু-আম্মা দাসী দ্বারা ডাকাইয়া তাহাকে বাড়ির মধ্যে আনাইলেন। নুরল এসলাম বাড়ির মধ্যে আসিলে ফুফু আম্মা সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, অসুখ করিয়াছে কি?” নুরল ‘জি’ বলিয়া শয়ন ঘরে প্রবেশ করিলেন। আনোয়ারা ফুফু-আম্মার অসাক্ষাতে ছুটিয়া ঘরে গেল। কিন্তু স্বামীর বিবর্ণ মুখ ও ভীষণ ভাবান্তর দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া পড়িল। শেষে জিজ্ঞাসা করিল, “অমন হইয়াছেন কেন? মুখে যে কালির ছাপ পড়িয়াছে; কি অসুখ করিয়াছে?” নুরল এসলাম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন; কোন উত্তর করিলেন না।

অন্যান্য দিন আনোয়ারা নিকটে যাইবামাত্র স্বামী তাঁহাকে প্রেম-সম্ভাষণে সাংসারিক নানাবিধ প্রশ্ন করিতে করিতে অস্থির করিয়া তোলেন। আনোয়ারা উত্তর দিতে দিতে তাহার গায়ের পোশাক নিজ হস্তে খুলিয়া লয়, ব্যজনে শ্রান্তি দূর করে, অজুর জন্যে পানি দিয়া, নানাবিধ উপাদেয় নাস্তায় টেবিল পূর্ণ করে। নামাজ শেষ হইলে ‘এটা খান, ওটা খান’ বলিয়া নানাবিধ আব্দার করিতে থাকে।

কিন্তু হায়! আনোয়ারা আজ স্বামীর প্রেমময় আদর-সম্ভাষণ কিছুই পাইল না। নিরাশায় পতিপ্রাণার হৃদয় দীর্ণ-বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। রাত্রিতেও নুরল এসলাম স্ত্রীর সহিত বিশেষ কোন বাক্যালাপ করিলেন না। কেবল থাকিয়া থাকিয়া হাহুতাশ দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সহিত রাত্রি অতিবাহিত করিলেন। আনোয়ারা অশ্রু মুছিতে মুছিতে প্রাতে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। কিছুক্ষণ পর সালেহা আনোয়ারার নিকট উপস্থিত হইল। সে কহিল, “ভাবী, আপনার মুখ মলিন কেন?” আনোয়ারা মনের বেদনা চাপিয়া, বাহিরে প্রফুল্লতা দেখাইবার চেষ্টা করিল। কহিল, “কই বুবু, মুখ মলিন হইবে কেন?” শারীরিক অসুখের ভানে অনাহারে আনোয়ারার দিন গেল, বৈকালে সালেহা তাহার চুল বাঁধিয়া দিতে চাহিল, সে অস্বীকার করিল। রাত্রি আসিল, আনোয়ারা অনাহারেই ঘরে গেল। যথাসময়ে এশার নামাজ পড়িয়া স্বামীর পদপ্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইল। নুরল এসলাম নীরব। আনোয়ারা কহিল, “আপনি এত বিমনা হইয়াছেন কেন? দাসীর অজ্ঞানে বা অজ্ঞাতে কোন দোষ হইয়া থাকিলে পায়ে পড়িয়া ক্ষমা চাহিতেছি। কাল হইতে আমার কিভাবে দিন যাইতেছে, একবার ভাবিয়া দেখুন। আপনার মলিন মুখ দেখিয়া কলিজা যে জ্বলিয়া খাক হইতেছে, দয়া করিয়া বলুন কি হইয়াছে। আমি আর সহ্য করিতে পারিতেছি না।” এই বলিয়া সে স্বামীর প্রতি করুণনেত্রে চাহিয়া তাঁহার পা ধরিতে উদ্যত হইল। সেই একান্ত-নির্ভরপূর্ণ দৃষ্টিতে নুরল এসলামের মর্ম ছিন্ন হইয়া গেল। তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় পা সরাইয়া লইয়া আর্তস্বরে কহিলেন, “আমাকে স্পর্শ করিও না।” আনোয়ারা ভক্তির আবেগ-উত্তেজনায় কহিল, “কেন স্পর্শ করিব না? খোদার বন্দেগীর পর এই চরণযুগলই দাসী তাহার জীবন-ব্রতের সার সম্বল করিয়াছে। যদি অপরাধিনী হই, অন্য শাস্তি বিধান করুন, তথাপি চরণসেবায় বঞ্চিত করিবেন না।” এই বলিয়া আনোয়ারা স্বামীর পদপ্রান্তে লুটাইয়া পড়িল। নুরল করুণ কণ্ঠে কহিলেন, “তুমি বুঝিতেছ না আমার হৃদয়ে কি দারুণ অগ্নি জ্বলিতেছে।” স্বামীর কথা শুনিয়া সতীর প্রেম- প্রবণ হৃদয় আরও অস্থির হইয়া উঠিল। সে কহিল, “আপনার সুখ-শান্তি আপনার দুঃখ- অশান্তির সমভাগিনী হইব, আপনার রোগ-শোক বুক পাতিয়া লইব বলিয়াই ত এ জীবন ও- চরণে বিকাইয়াছি।”

প্রজ্বলিত হুতাশনর উপর সুশীতল সলিল পতিত হইলে তাহা যেমন আরও দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠে, আনোয়ারার প্রেমপূর্ণ সুমধুর বাক্যে নুরল এসলামের অন্তরের জ্বালা সেইরূপ বাড়িয়া উঠিল। তিনি যন্ত্রণাতিশয্যে দুই হস্তে বুক চাপিয়া ধরিয়া ভগ্ন-কণ্ঠে কহিলেন, “আমাকে আর কিছু বলিও না। আমাকে একাকী থাকিতে দাও।” এবার স্বামীর উক্তি শত বজ্রঘাত অপেক্ষাও সতীর কোমল হৃদয়ে আঘাত করিল। সে বুক চাপিয়া ধরিয়া অবসন্ন দেহে মাটিতে বসিয়া পড়িল।

অনেকক্ষণ পরে বালিকা উঠিয়া দাঁড়াইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। ‘হায়! কি হইল,’ ভাবিয়া তাহার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

নুরল এসলাম স্ত্রীকে উপেক্ষার ভাব দেখাইলেন বটে, কিন্তু দুশ্চিন্তার তুষানলে তিনিও ভস্মীভূত হইতে লাগিলেন। তিনি ভাবিতে লাগিলেন ‘একদিকে সাধ্বীসতী, অপরদিকে লোকাপবাদ; কোটি ত্যাজ্য? কোটি উপেক্ষণীয়? সরলা অবলা—অন্ধকার রাত্রি—সত্যই কি পাপিষ্ঠেরা তাহার ধর্মনাশ করিতে পারিয়াছে?’ স্মরণমাত্র তাহার শরীর শিহরিয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে চিত্তের ভাবান্তর ঘটিল। তিনি আবার ভাবিতে লাগিলেন, “যে ব্যক্তি জীবনদানসংকল্পে আমার জীবন রক্ষা করিয়াছেন, যাহার মত প্রেমময়ী, পতিপ্রাণা সতী দুনিয়ায় আছে বলিয়া জানি না, যাহার প্রতি কার্যে পতিহিতৈষিতার পরিচয় পাইতেছি, যাহার প্রতি নিঃশ্বাসে সতীত্বের তেজ ও সৌরভ অনুভব করিতেছি, পাপিষ্ঠেরা কি তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে। সতী-অঙ্গ কি কখনও কলঙ্কিত হইতে পারে? শুধু কতিপয় নীচাশয় ব্যক্তির অলীক কথায় বিশ্বাস করিয়া পতিপরায়ণা সতী রমণীকে ত্যাগ করিব? অহো কি নিষ্ঠুরতা! কি নীচাশয়তা!! ধর্মবিক্রয়ে কর্ম রক্ষা, দীন ছাড়িয়া দুনিয়া, না না, আমার দ্বারা তাহা হইবে না, শত কোটি অপমানের বোঝা অম্লানচিত্তে বহন করিব, তথাপি আমার সহধর্মিনীকে ত্যাগ করিব না’–এইরূপ দুশ্চিন্তার তিনি ক্ষণকাল শান্তি-সুখ অনুভব করিতে লাগিলেন—কিন্তু হায়! এই সুখ-শান্তি অধিকক্ষণ হৃদয়ে স্থায়ী হইল না। রতীশের ঘৃণিত উক্তি আবার পিশাচমূর্তিতে আবির্ভূত হইয়া স্ত্রীর সম্বন্ধে অনুকূল সাধু মত সকল চৈত্রানিল-তড়িত তুলার ন্যায় উড়াইয়া দিল। তিনি শূন্যহৃদয়ে আবার ভাবিতে লাগিলেন, “লোকাপবাদ অমূলক হইলেও সামান্য নহে। হায়! আমি কেমন করিয়া লোকের মুখ বন্ধ করিব? রাজদ্বারে, সমাজে, সভাস্থলে লোক যখন আমাকে অপহৃতা স্ত্রীর স্বামী বলিয়া ভ্রূকুটি উপেক্ষা করিবে, হায়! তখন আমি কোথায় লুকাইব? হায়! খোদা আমি জীবন্তে হত হইলাম।” এইরূপ মর্মান্তদ বিলাপ-পরিতাপের ও এইরূপ মরণ-যন্ত্রণাধিক চিন্তা তরঙ্গের মধ্যে দিয়া নুরল এসলামের রাত্রি প্রভাত হইল। এইসময় গ্রামীণ মসজিদ হইতে প্রভাতিক মধুর আযানধ্বনি দিগন্ত মুখরিত করিয়া তুলিল। নুরল এসলাম মনের শান্তি নিমিত্ত নামাজ পড়িতে মসজিদে চলিয়া গেলেন এবং বাড়ি না আসিয়া নামাজ অন্তে তথা হইতেই বেলগাঁও কার্যস্থলে গমন করিলেন। এদিকে আনোয়ারা অশ্রুপূর্ণনেত্রে রন্ধন-প্রাঙ্গণে আসিয়া উপস্থিত হইল। পূৰ্ব দিনের ন্যায় কিছুক্ষণ পর সালেহা তথায় আসিল। সে আনোয়ারার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “ভাবী, কাল আপনার মুখ ভার দেখিয়াছি, আজ আবার আপনি কাঁদিতেছেন। নিশ্চয় ভাইজান আপনাকে তিরস্কার করিয়াছেন।” আনোয়ারা চোখের পানি মুছিয়া কহিল, “বুবু, তিনি তিরস্কার করিলে পুরস্কার ভাবিয়া মাথায় লইতাম।” সালেহা কহিল, “তবে কি হইয়াছে?”

আনো। তিনি বাড়ি আসা অবধি আমার সহিত কথা বলিতেছেন না। তাঁহার মুখের ভাবে অন্তরের নিঃশ্বাসে বোঝা যায়, কি যেন অব্যক্ত দারুণ দুঃখে তিনি নিস্পেষিত হইয়াছেন।

সরলা সালেহা কহিল, “ভাবী এক কথায় শুনিয়াছি”–কথাটি বলিয়াই বালিকা চাপিয়া গেল। আনোয়ারার শরীর কন্টকিত হইয়া উঠিল। সে কহিল, “কি কথা বুবু?” সালেহা ফাঁপড়ে পড়িয়া ইতস্তত করিতে লাগিল। আনোয়ারা শুনিবার জন্য নাছোড় হইয়া পড়িল। সালেহা অগত্যা কহিল, “কাল নবার বউ আমাদের এখানে আসিয়াছিল; সে একটা খারাপ মিথ্যা কথা কহিল, আমি শুনিয়া তাহাকে তখনই তাড়াইয়া দিয়াছি। “

পূর্বেই বলিয়াছি, নবাব আলী ওরফে নবা নুরল এসলামের খানা-বাড়ির প্রজা। সে বেলগাঁও বন্দরে গাঁট বাঁধাই-এর কর্ম করে। রতীশ বাবুর বাসার সন্নিকটে তাহার রাত্রি যাপনের আড্ডা! প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর বহু টাকা ব্যয় করিয়া নবাব আলী কথিত স্ত্রীর পানিগ্রহণ করিয়াছে। স্ত্রী ভরা যৌবনা এবং রূপসী। নবা তাহার চরণে আত্মপ্রাণ উৎসর্গ করিয়াছে। বৃদ্ধা মাতার বর্তমানেও স্ত্রীই তাহার সংসারের সর্বময় কর্ত্রী। সেদিন রাত্রিতে রতীশ বাবুর বাসায় যে সকল লোক নুরল এসলামের সম্বন্ধে কথাবার্তা বলে, তাহার মধ্যে নবা ছিল, এবং সে রতীশ বাবুর মতের পোষকতা করিয়া কথা বলিয়াছিল। পাঠক, একথা পূর্বেই অবগত হইয়াছেন।

আনোয়ারা সালেহাকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “বুবু, আমাকে যদি কথা খুলিয়া না বল, তবে আমি এখনই গলায় ফাঁস লাগাইব।” সরলা সালেহা ভয় পাইয়া তখন কহিল, “নবাব বউ চুপে চুপে আমাকে বলিল, তার সোয়ামী তার নিকট বলিয়াছে, বন্দরে সকলে গাওয়া পেটা করে,–কোম্পানির বড়বাবু অসতী স্ত্রী লইয়া ঘর-সংসার করে।” তীব্র আশীবিষ দংশনে দৃষ্ট ব্যক্তি যেমন দেখিতে দেখিতে মুহূর্তে ঢলিয়া পড়ে, আনোয়ারা সালেহার মুখের কথা শেষ হইতে না হইতে সেইরূপ রন্ধন আঙ্গিনায় আবসন্ন হইয়া পড়িল। সালেহা অপ্ৰস্তুত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ফুফু-আম্মা ‘কি হইয়াছে’ বলিয়া নিকটে আসিলেন। আসিয়া দেখেন, বউয়ের মুখশ্রী বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে, টানিয়া টানিয়া নিঃশ্বাস ফেলিতেছে; ফুফু-আম্মা দুইদিন যাবত দেখিতেছেন, বউ অনাহারে রহিয়াছে, সর্বদা চোখের পানি ফেলিতেছে; ছেলের মুখও বিষদমাখা। ঘরে বুঝি কোন অকুশল ঘটিয়াছে, এইরূপ মনে করিয়া তিনি সালেহাকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না, কেবল দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। দাসী ফুফু-আম্মার আদেশে আনোয়ারাকে বাতাস করিতে লাগিল। সালেহা তাহার চোখে-মুখে পানি দিল। অনেকক্ষণ পরে আনোয়ারা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল। অতঃপর ধীরে ধীরে আক্ষেপ করিয়া বলিতে লাগিল, “খোদা তুমি না দয়াময়? তুমি না সুখ-শান্তির জনক? তবে তোমার এ বিধান কেন? অন্তর্যামীন প্রভো! দাসীর যাতনা চরমে উঠিয়াছে, আর সহিতে পারিতেছি না। মঙ্গলময়! এখন মৃত্যুই দাসীর পক্ষে শ্রেয়ঃ! অতএব প্রার্থনা, আর জীবিত রাখিয়া দন্ধিয়া মারিও না, এককালে মৃত্যুপথে শান্তিদান কর। দুনিয়া আর চাই না।

সালেহা ও ফুফু-আম্মার যত্ন, চেষ্টা এবং প্রবোধ বাক্যে আনোয়ারা দিনমানে কথঞ্চিৎ সুস্থ হইল এবং সইকে দুঃখের কথা জানাইয়া জেলার ঠিকানায় পত্র লিখিল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

নুরল এসলাম অফিসে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, খরিদ পাটের মূল্যের জন্য ১০/১২ জন বেপারী অফিস-বারান্দায় বসিয়া আছে। তিনি তাহাদিগকে টাকা দেওয়ার জন্য পকেট হইতে লোহার সিন্দুকের চাবি বাহির করিলেন। ঐ সঙ্গে একখানা পত্রও বাহির হইয়া পড়িল। পত্রখানি টেবিলের উপর রাখিয়া, নুরল এসলাম সিন্দুক খুলিতে ক্যাশ-কামরায় প্রবেশ করিলেন। সিন্দুকের ডালা তুলিয়া তন্মধ্যে দৃষ্টিপাতমাত্র তাঁহার অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠিল। তিনি শিরে অশনিসম্পাৎ বোধ করিলেন, চক্ষে অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। কারণ, সিন্দুকে ছয় পেটি টাকার মধ্যে দুই পেটি মাত্র আছে; চার পেটি টাকা নাই। প্রথমে মনে করিলেন তিনি ভুল দেখিতেছেন; এই জন্য রুমালে চক্ষু মুছিয়া পুনরায় সিন্দুকের তলায় দৃষ্টিপাত করিলেন, তখন ভুল নির্ভুল বলিয়া বুঝিলেন। সিন্দুকে চারি পেটি টাকা নাই দেখিয়া দৌড়াইয়া টেবিলের নিকট আসিলেন, ক্যাশ-বুক বাহির করিলেন, হিসাবের খাতা মিলাইয়া দেখেন, খরচ বাদে বারো হাজার টাকা তহবিলে আছে। প্রত্যেক পেটিতে দুই হাজার করিয়া টাকা থাকে, সুতরাং ১২ হাজার টাকা থাকিবার কথা; কিন্তু দুই পেটি মাত্র টাকা মজুদ আছে। চারি পেটিতে আট হাজার টাকাই নাই। সিন্দুকের চাবিও বরাবর তাঁহার নিকট। খুলিবার আগে সিন্দুকও বন্ধ পাইলেন। তবে এমন হইল কেন? টাকা কোথায় গেল? কিছু ঠিক করিতে না পারিয়া নুরল এসলাম ভাবিতে ভাবিতে অবসন্ন হইয়া চেয়ারে আসিয়া বসিয়া পড়িলেন। বেপারীগণ কহিল, “বাবু, অমন করিতেছেন কেন? আমাদিগকে টাকা দেন!” নুরল এসলাম অনেকক্ষণ কথা কহিলেন না। পরে ধীরভাবে কহিলেন, “বাপু সকল, একটু থাম।” এই বলিয়া তিনি মাথায় হাত দিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন।

এ জগতে ধর্মভীরু লোক পদে পদে পাপের ভয় করিয়া চলেন। অসম্ভব অচিন্ত্যরূপে তহবিল তছরুপাতে ধর্মভীরু নুরল এসলামের তখন মনে হইল, সতী সন্দেহ পাপে বুঝি এমন হইল। মনে করার সঙ্গে সঙ্গে কথাটি তাঁহার হৃদয়ের অন্তঃস্থল স্পর্শ করিল। এই সময় টেবিলের উপরিস্থিত সেই পত্রখানির প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। দেখিবামাত্র তিনি তাহা সমাদরে চুম্বন করিয়া পড়িতে লাগিলেন।

পাঠক, বুঝিয়াছেন কি, এ পত্র কাহার? ইহা আনোয়ারার সেই সঞ্জীবনী ব্রতের চিরবিদায় লিপি। নুরল এসলাম নীরোগ হওয়ার পর দাসী একদিন বিছানাপত্র রৌদ্রে দিবার সময় এই চিঠি খাটের নিচে পাইয়া নুরল এসলামের জামার পকেটে রাখিয়া দেয়, এ কথা পূর্বে বলা হইয়াছে। পত্র পাঠে নুরল এসলাম একান্ত বিকলচিত্ত হইয়া পড়িলেন। সতী- অনাদর পাপের ধারণা তাঁহার হৃদয়ে দৃঢ়রূপে বদ্ধমূল হইল। তিনি বুঝিলেন, নিশ্চয় সতীকে সন্দেহ করাতেই এই ভয়ানক সর্বনাশ উপস্থিত হইয়াছে। হায়, হায়, আমি কি ভীষণ দুষ্কার্য করিয়াছি! যে নারী নিজের প্রাণের বিনিময়ে, পতির প্রাণ রক্ষা করিতে পারে, সে যদি কলঙ্কিনী, তবে এ জগতে আর সতী কাহাকে বলিব? আমি মূঢ় পাপাত্মা, তাই সতীত্বের মর্মগ্রহণে অসমর্থ হইয়াছি। তাই সতীকে চিনিতে পারি নাই।”

কিয়ৎক্ষণ পর নুরল এসলাম আবার চিন্তা করিতে লাগিলেন, “শুধু অনুতাপে এ মহাপাপের শাস্তি প্রচুর নহে। তাই বুঝি আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় এমন ভাবে তহবিল তছরুপাত হইয়াছে, অতএব আত্মরক্ষার আর চেষ্টা করিব না। পার্থিব নিরয়-নিবাসে লইয়াই সতী-অবজ্ঞা-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিব।

এই সময় নুরল এসলামের মানসিক অবস্থা ভীষণভাবে শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে। আত্মগ্লানির অনিবার্য হুতাশনে তাঁহার সুরম্য হৃদয়োপবন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে; এবং সেই দাবাগ্নির প্রবর্দ্ধিত বহিমুখশিখায় তাঁহার মুখমণ্ডল বিবর্ণ ও সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছে; আয়ত লোচন যুগল অস্বাভাবিকরূপে প্রদীপ্ত হইতেছে!

উপস্থিত বেপারিগণ নুরল এসলামের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আর কিছু বলিতে সাহস পাইল না।

অনন্তর নুরল এসলাম ক্যাশ-কোঠা বন্ধ করিয়া উত্তেজিতভাবে ম্যানেজার সাহেবের বাংলোয় উপস্থিত হইলেন। ম্যানেজার সাহেব তাঁহার মুখের চেহারা দেখিয়া বিস্মত ও ভীত হইলেন। তাড়াতাড়ি কহিলেন, “নুরল, খবর কি?” ম্যানেজার সাহেব নুরলকে অন্তরিক বিশ্বাস ও স্নেহ করিতেন, তাই ঐ ভাবে নাম ধরিয়া ডাকিতেন। নুরল এসলাম তহবিল তছরুপাতের কথা অসঙ্কোচ খুলিয়া বলিলেন। সাহেব, “বল কি?” বলিয়া দৌড়িয়া অফিস ঘরে আসিলেন। ক্যাশের সিন্দুক পুনরায় খোলা হইল, টাকা গণিয়া দেখা গেল, ক্যাশবুক মিলান হইল, শেষে আট হাজার টাকাই তহবিলে কম পড়িল। সাহেব নুরল এসলামকে কহিলেন, “এখন তোমার বক্তব্য কি আছে?” উপস্থিত রতীশবাবু বিনা জিজ্ঞাসায় কহিলেন, “চোরে লইলে সমস্ত টাকাই লইত।” সাহেব বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “তবে তোমরাই টাকা চুরি করিয়াছ।” রতীশ বাবুর মুখ কলিমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। তিনি কহিলেন, “হুজুর, চাবিত বড় বাবুর কাছেই থাকে। সাহেব কহিলেন, ‘হু।’ অনন্তর তিনি ক্যাশ-অফিসের প্রহরী ও অন্যান্য চাকর-বাকরদিগকে টাকা চুরি সম্বন্ধে নানারূপ প্রশ্ন, তৎসঙ্গে জেরা প্রভৃতি করিলেন, নানাপ্রকার শাস্তির ভয় প্রদর্শন করিলেন। অন্যান্য প্রকারে অনেক চেষ্টা হেকমত করিলেন, কিন্তু কোন ফল হইল না। অগত্যা বৈকালে তিনি কলিকাতা হেড অফিসে আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করিলেন। উত্তর আসিল অপরাধীকে ফৌজদারীতে দাও এবং তাহার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দ্বারা তহবিল পূরণ কর।

ম্যানেজার সাহেব নুরল এসলামকে যারপরনাই বিশ্বাস ও স্নেহ করিতেন। এজন্য তিনি তাহাকে নিজের বাংলোয় ডাকিয়া লইয়া কলিকাতার টেলিগ্রাম দেখাইলেন।

অনন্তর সাহেব নুরল এসলামকে কহিলেন, “তুমি টাকা লইয়া কি করিয়াছ?”

নুরল। এরূপ কথা না বলিয়া আমাকে বধ করুন।

সাহেব। তবে টাকা কে চুরি করিয়াছে?

নুরল। বলিতে পারি না।

সাহেব। কাহাকেও সন্দেহ কর কি না?

নুরল। সন্দেহ করিয়া কি করিব? চাবি ত আমার কাছেই ছিল।

সাহেব আশ্চর্যভাবে নুরল এসলামের মুখের দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, জ্বলন্ত সত্যতা ও সরলতার মধ্যে দিয়া এক অব্যক্ত যন্ত্রণার ভাব আসিয়া তাঁহার আনন্দিত মুখমণ্ডল পরিম্লান করিয়া ফেলিয়াছে।

সাহেব। শুনিতেছি, তোমার স্ত্রী ঘটিত মোকদ্দমার পর তুমি নাকি বড়ই উন্মনা হইয়াছ? কাজ-কর্মে ভুল-ভ্রান্তি করিতেছ, সুতরাং এমনও হইতে পারে, ক্যাশ বন্ধ করিয়া অসাবধানে চাবি স্থানান্তরে রাখিয়াছিলে, সেই সময় অন্যে চাবি দিয়া সিন্দুক খুলিয়া টাকা চুরি করিয়াছে।

নুরল। কিছুই বুঝিতেছি না।

সাহেব। রতীশ, দাগু প্রভৃতি তোমার বিরুদ্ধে হিংসা পোষে?

নুরল। বিশেষরূপে না জানিয়া তাদের প্রতি কিরূপে সন্দেহ করিব?

সাহেব মনে মনে তাঁহার সাধুতায় আরও সন্তুষ্ট হইলেন। প্রকাশ্যে কহিলেন “তবে তুমি এখন টাকার উপায় কি করিবে?”

নুরল। আপনি আমায় ফৌজদারীতে সোর্পদ করিয়া অতঃপর যাহা ভাল বোধ হয় করুন।

সাহেব। তোমাকে যদি ফৌজদারীতে না দেই?

নুরল। কর্তৃপক্ষের আদেশ লঙ্ঘনের জন্য ও টাকার জন্য আপনাকে দায়ী হইতে হইবে।

সাহেব। সেইজন্য বলিতেছি টাকা সংগ্রহের উপায় দেখ।

নুরল। হুজুর, টাকা কোথায় পাইব? ছয় মাস কাতর থাকিয়া সর্বস্বান্ত হইয়াছি।

সাহেব। তোমার না তালুক আছে?

নুরল। তালুকে আমার কোন স্বত্ব নাই।

সাহেব। সে কি কথা?

নুরল। স্ত্রী ও ভগিনীদিগকে হেবা করিয়া দিয়াছি।

সাহেব। নবীন বয়সে এরূপ করিয়াছ কেন?

নুরল। কাতর থাকাকালে মৃত্যু আশঙ্কা করিয়া।

সাহেব। সমস্ত সম্পত্তি হেবা করিয়াছ?

নুরল। সমস্তই।

সাহেব। ডেপুটি গণেশবাহন বাবুর নিকট শুনিয়াছি, তোমার স্ত্রী নাকি তাঁহাদের সীতা- সাবিত্রীর মত সতী। তিনি কি তোমার এ বিপদে তাঁহার সম্পত্তি দিয়া রক্ষা করিবেন না?

নুরল। করিলেও দানের বস্তু প্রতিগ্রহণ করিব না।

সাহেব। তবে কি করিবে?

নুরল। জেলে যাইব।

সাহেব। জেলে যেতে এত সাধ কেন?

নুরল। জেলে না গেলে আমার পাপের প্রায়শ্চিত হইবে না! আমি মহাপাপী।

নুরল এসলাম কাঁদিয়া ফেলিলেন।

সাহেব। টাকাও চুরি কর নাই, তবে কি পাপ করিয়াছ?

নুরল এসলাম পকেট হইতে আনোয়ারার সেই পত্র বাহির করিয়া সাহেবের হাতে দিলেন এবং কহিলেন, “লোকপবাদে—এমন স্ত্রীকে ভীষণভাবে অবজ্ঞা করিয়াছি।” সাহেব জনৈক পুণ্যশীল পাদ্রী সাহেবের পুত্র। নিজেও পরম সাধু। অদৃষ্ট-ফলে পাট-অফিসের ম্যানেজার হইয়াছেন। সুন্দর বাঙ্গালা জানেন। তিনি অগ্রাহের সহিত পত্রখানি পড়িতে লাগিলেন। পাঠ করিয়া সহজে ধন্য ধন্য করিয়া উঠিলেন এবং কহিলেন, “আমাদের কথা দূরে থাক তোমাদের মধ্যেও অমন মেয়ে পাওয়া কঠিন। তুমি নবীন যুবক, সংসার চিন না; তাই অমন রত্ন লাভ করিয়াও পায়ে ঠেলিয়াছ। লোকাপবাদ ত দূরের কথা তোমার স্ত্রীর সতীত্বগৌরবে নারীজাতির মুখোজ্জ্বল হইবে। তাঁহাকে অবজ্ঞা করিয়া গুরুতর অন্যায় করিয়াছ।” এই বলিয়া সদাশয় ম্যানেজার সাহেব নিজ রুমাল দিয়া নুরল এসলামের অশ্রু মুছাইয়া দিলেন। তারপর কহিলেন, “আমি সামান্য নয়শত টাকা বেতনে চাকুরি করি। ছেলের পড়ার খরচের জন্য মাসে ৫০০ শত টাকা বিলাতে পাঠাইতে হয়। অবশিষ্ট চারিশত টাকায় আমরা উভয়ে দুঃখে-কষ্টে সংসার চালাই; সুতরাং তোমাকে এই বিপদে বেশি কিছু সাহায্য করিতে পারিলাম না। এই পাঁচ কিতা নোট তোমাকে দিলাম, অবশিষ্ট সাড়ে সাত হাজার টাকা-সংগ্রহ করিয়া তহবিল পূরণ কর। কলঙ্কের হাত হইতে রক্ষা পাইবে, আর তোমার চাকুরি যাহাতে বজায় থাকে আমি তাহা করিব।

নুরল। তহবিল পূরণ করা আমার অসাধ্য। বাঁচিবার চেষ্টাও আর করিব না। সুতরাং অনর্থক আপনার টাকা লইয়া আমি কি করিব?

সাহেব অনন্যোপায়ে বাধ্য হইয়া তখন থানায় সংবাদ দিলেন। দারোগা আসিলেন। মৌরসীভাবে তদন্ত চলিল, কিন্তু চুরির আস্কারা হইল না। নুরল এসলাম তহবিল তছরুপাতের আসামী হইয়া জেলায় চালান হইলেন। যাইবার সময় তিনি একখানা পত্র লিখিয়া স্ত্রীকে দেওয়ার জন্য একটি বিশ্বস্ত লোকের হাতে দিয়া গেলেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

নুরল এসলাম জেলায় চালান হইবার পূর্বদিন বৈকালে, আমজাদ হোসেন সাহেব তাঁহার নির্জন লাইব্রেরি ঘরে বসিয়া একখানি মাসিক পত্রিকা পড়িতেছিলেন; এমন সময় হামিদা একখানি পত্রহস্তে মলিনমুখে তাঁহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। আমজাদ মুখ তুলিয়া পত্নীর মুখের দিকে চাহিয়া চমকিয়া উঠিলেন, কহিলেন, “একি! শরৎ-চন্দ্রমা রাহু-কবলিত যে?” হামিদা সে কথায় কান না দিয়া কহিল, “আমি আর তোমাকে ভালবাসিব না।”

আমজাদ। কেন গো, কি অপরাধ করিয়াছি?

এই সময়ে পাশের ঘরে খোকা কাঁদিয়া উঠিল। হামিদার একটি ছেলে হইয়াছে। হামিদা হাতের চিঠি স্বামীর সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছেলের উদ্দেশ্যে ছুটিল। আমাজদ পত্ৰ লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিলেন। পত্রের আরম্ভ এইরূপ লেখা ছিল :

“সই, আমার সঞ্জীবনী-লতা তোলার কথা তোমাকে লিখিয়াছি। ঐ ঘটনা হইতে আমাদের লোকাপবাদ ঘটিয়াছে এবং ঐ লোকপবাদ হইতে এ হতভাগিনীর কপাল ভাঙ্গিয়াছে।”

এই পর্যন্ত পড়া হইলে হামিদা খোকাকে কোলে করিয়া পুনরায় তথায় আসিল।

আম। তোমার সই দেখিতেছি ক্রমে সীতা দেবী হইয়া উঠিলেন।

আমি। সেইজন্যই ত বলিতেছি, আমি আর তোমাকে ভালবাসিব না। সই-এর সঞ্জীবনী-লতা তোলার কথা মনে হইলে, এখনও আমার গা কাঁটা দিয়া উঠে। স্বামীর জন্য অমনভাবে আত্মত্যাগের কথা কোথাও শুনি নাই। আবার তারই ফলে এখন এই কাণ্ড?

আম। কাণ্ড, বিষম কাণ্ড!

হামি। সয়া কি সইতে ত্যাগ করিয়াছেন?

আম। সয়া বোধ হয় ত্যাগ করেন নাই। সই-ই হয়ত অভিমানে হাদিস উল্টাইয়া দিয়া থাকিবেন।

হামিদা। সে কেমন কথা?

আম। হাদিস অনুসারে স্ত্রী, স্বামীকে ত্যাগ করিতে পারে না। কিন্তু লোকাপবাদে স্বামী সংশ্রব ত্যাগ করা তোমার সইয়ের পক্ষে বিচিত্র নহে।

হামি। যে স্বামীর জন্য প্রাণ দিতে পারে, সে কি স্বামীর সংশ্রব ত্যাগ করিতে পারে?

আম। তা যাক; পত্রের ভাবে বুঝিতেছি উভয়ের মধ্যে খুব একটা মন-ভাঙ্গাভাঙ্গি হইয়াছে; আমি ভাবিতেছি দোস্ত এখন উদ্ভ্রান্ত চিত্তে ভুল-ভ্রান্তি করিয়া সরকারি কার্যে কোন বিভ্রাট না ঘটান। হাজার হাজার টাকা তাঁহার হাতে আমদানি-রপ্তানি হয়।

এই সময় আমজাদের বালক-ভৃত্য আসিয়া কহিল, “হুজুর সদর বাড়িতে পিয়ন দাঁড়াইয়া।”

আম। চিঠি-পত্র থাকে’ত লইয়া আইস।

ভৃত্য। মনিঅর্ডার অনেক টাকার, আর লাল চিঠি একখানা।

আমজাদ শুনিয়া বাহির বাটিতে আসিলেন। পিয়ন সেলাম করিয়া একখানি ৫০০ টাকার টেলিগ্রাম মনিঅর্ডার ফরম ও একখানি লাল চিঠি আমজাদের হাতে দিল। তিনি ফরম সহি করিয়া টাকা লইলেন। লাল চিঠিখানা সেইখানেই খুলিয়া পড়িলেন। তাহাতে লেখা আছে,

“আমাদের আট হাজার টাকার তহবিল তছরুপের জন্য কোম্পানির আদেশানুসারে নুরল এসলামকে ফৌজদারীতে সোর্পদ করা হইল। সে আত্মরক্ষায় রাজী নহে। শুনিয়াছি, আপনি তাহার অকৃত্রিম বন্ধু। ওখান হইতে তাহার রক্ষার জন্য যাহা করিতে হয় করিবেন। মোকদ্দমার সাহায্য বাবদ আমি নিজ হইতে তাহাকে ৫০০ টাকা দিলাম। আশা করি, মনিঅর্ডার ও চিঠির কথা আর কাহাকেও বলিবেন না।

সি. ডব্লিউ. স্মিথ,
জুট ম্যানেজার, বেলগাঁও

বালক-ভৃত্য টাকাগুলি তোড়া করিয়া বাড়ির মধ্যে লইয়া চলিল। আমজাদ লাল চিঠি

হাতে করিয়া স্ত্রীকে যাইয়া কহিলেন, “হামি, যে কথা সেই কাজ। তোমার সয়া ত জেলে চলিলেন।”

হামি। ওমা! সে কি কথা?

আম। এই দেখ না, তাঁহার ম্যানেজার সাহেব ‘তার’ করিয়াছেন।

হামি। কি লিখিয়াছেন?

আম। আট হাজার টাকার তহবিল তছরুপাতে নুরলকে ফৌজদারীতে সোপর্দ করা হইয়াছে।

হামি। তহবিল তছরুপ হইল কিরূপে?

আম। কিছুই বুঝিতেছি না।

হামি। ও টাকা কিসের?

আম। ইংরেজ জাতির মহত্ত্বের নমুনা। ম্যানেজার সাহেব স্বয়ং বাদী হইয়াও আসামীর সাহায্যের জন্য ৫০০ টাকা পাঠাইয়াছেন।

হামি। (কাঁদ কাঁদ মুখে) তুমি সয়াকে বাঁচাও।

আম। তিনি যদি সত্যই টাকা চুরি করিয়া থাকেন, তবে বাঁচাইব কিরূপে?

হামি। সই একদিন আমাকে বলিয়াছিল, ফেরেশতাদিগের স্বভাব বদ হইতে পারে, তথাপি তোমার সয়ার চরিত্র মন্দ হইতে পারে না।

আম। আমি ত তাহাকে দেব চরিত্র বলিয়াই জানি। তবে তিনি যুবক, যুবকের মতিগতি কখন কিরূপ হইয়া দাঁড়ায় বলা যায় না।

হামি। (ভ্রূকুটি করিয়া) তুমি বুঝি এখন বুড়া হইয়াছ, না?

আম। বাকি বড় বেশি নাই।

হামি। দরবেশী কথা রাখ; আমার সয়াকে রক্ষা করিবে কি না তাহাই বল।

আম। সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিব।

হামি। শুনয়াছি, বড় বড় সঙ্গীন মোকদ্দমায় বড় বড় আসামীকে রক্ষা করিয়াছ। তোমার পায়ে পড়ি, যেরূপে পার আমার সয়াকে বাঁচাইবে। আমি ভাবিয়া অস্থির হইতেছি, এ সংবাদ পাইয়া সই আত্মঘাতিনী না হয়।

আম। তিনি যদি সংশ্রব ত্যাগ করিয়া থাকেন, তবে আর মরিবেন কার জন্য?

হামি। পতিব্রতার হৃদয় বুঝিতে এখনও তোমার ঢের বাকি।

নুরল এসলামের আসন্ন বিপদে আমজাদ হোসেন একান্ত দুঃখিত ও উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছেন। তিনি স্ত্রীর কথার কোন উত্তর না করিয়া বিষণ্নচিত্তে চিন্তা করিতে লাগিলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

নুরল এসলাম তহবিল তছরুপাতের আসামী হইয়া হাজত-ঘরে প্রবেশ করিলেন। আমজাদ যথাসময়ে তাঁহার মুক্তির জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট দরখাস্ত করিলেন। তিনি উদীয়মান ক্ষমতাশালী গভর্নমেন্ট উকিল, অল্প সময়ের মধ্যে জেলার উপর পাকা বাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া করিয়া ফেলিয়াছেন। তথাপি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নুরল এসলামের জামিন মঞ্জুরে অনেক ওজর-আপত্তি করিলেন। কিন্তু আমজাদ নাছোড়বান্দা। তিনি অনেক সাধ্য-সাধনা করিয়া করিয়া দশ হাজার টাকার জামিন মঞ্জুর করাইয়া জেলখানার দ্বারে উপস্থিত হইলেন। নুরল এসলামকে আর চেনা যায় না, এই অল্প সময়ের মধ্যে তাঁহার মুখে কালির ছাপ পড়িয়াছে, চক্ষু বসিয়া গিয়াছে, শরীর কৃশ ও দুর্বল হইয়াছে, দেখিয়া আমজাদের চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। তিনি ক্লেশপূর্ণ স্বরে নুরল এসলামকে কহিলেন, ‘বাহির হইয়া আইস। তোমাকে জামিনে মুক্তি করিয়াছি।” নুরল এসলাম আমজাদকে দেখিয়া স্ত্রীলোকের ন্যায় ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। আমজাদ কহিলেন, “এখন আইস, কাঁদিয়া ফল কি?” আমজাদের চক্ষু দিয়াও অশ্রু গড়াইতে লাগিল। নুরল এসলাম কহিলেন, “আমি মুক্তি চাই না, এখানে বেশ আছি, তুমি আমার জন্য এত করিতেছ কেন?”

আমজাদ। তাহা পরে হইবে, এখন ত আইস। এই বলিয়া হাত ধরিয়া হাজত গৃহ হইতে তাঁহাকে টানিয়া বাহির করিলেন। তারপর গাড়িতে তুলিয়া বাসায় লইয়া আসিলেন। হামিদ ছুটিয়া আসিয়া পরদার অন্তরাল হতেই সয়াকে দেখিল। দেখিয়া সেও আঁচলে চোখ মুছিতে লাগিল।

অনেক সাধাসাধি করিয়া রাত্রিতে নুরল এসলামকে আহার করান হইল। আহারান্তে আমজাদ তাঁহাকে লইয়া বৈঠকখানায় যাইয়া বসিলেন।

আমজাদ। তহবিল তছরুপ কিরূপে হইল?

নুরল। পাপের ফলে।

আম। কি পাপ করিয়াছ?

নুরল। সতীকে অবজ্ঞা করিয়াছি। এই বলিয়া অবিরল ধারে অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কহিলেন, “সেই মহাপাপের প্রায়শ্চিত্তের নিমিত্ত জেলে যাইব স্থির করিয়াছি।”

আম। তাহাতে কতকটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় প্রকাশ পাইবে। আমার বিবেচনায়, প্রকৃত পাপীকে ধরিয়া শাস্তি দেওয়া এবং সতীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা শ্রেয়।

নুরল। মহাপাপী সাধারণ পাপীকে ধরিতে সমর্থ নয়।

আম। তবে কি করিবে?

নুরল। কারাগারে যাইব।

আমজাদ দেখিলেন সতী-অবজ্ঞায় তহবিল তছরুপ হইয়াছে মনে করিয়া বন্ধুর হৃদয় দীর্ণ বিদীর্ণ হইয়াছে; জীবনে ধিক্কার জন্মিয়াছে। ফলতঃ ঘটনা যাহাই হউক, ফল ভয়ানক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সুতরাং এখন তাহাকে রক্ষা করিতে হইলে কেবল নিজ চেষ্টায় সব করিতে হইবে। এইরূপ ভাবিয়া আমজাদ কহিলেন “স্থানীয় পুলিশ কোন তদন্ত করেন নাই?”

নুরল। আমার বাসাবাড়ি, সেকেন্ড ক্লার্ক রতীশ বাবুর ও অন্যান্য চাকরদিগের আড্ডা প্রভৃতি অনুসন্ধান করিয়া পুলিশ কিছু পায় নাই।

আম। রতীশ বাবু লোক কেমন?

নুরল। তিনি বেশ্যাসক্ত, বন্দরে তাহার এক রক্ষিতা আছে। উপার্জিত সমস্ত অর্থ তাহাকেই দেন। আমার ভয়ে উৎকোচ লইতে পারেন না বলিয়া তিনি আমার পরম শত্রু। দাগু প্রভৃতি চাকরেরাও এই কারণে আমার প্রতি বিদ্বেষপরায়ন।

শুনিয়া আমজাদ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। আবার কহিলেন, ক্যাশাদি কাহার জিম্মায় থাকিত?”

নুরল। আমার জিম্মায়। আম। চাবি?

নুরল। আমার নিকট।

আমজাদ কি যেন ভাবিয়া আর কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না।

পরদিন ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ লইয়া, ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও ইন্‌পেক্টার সঙ্গে করিয়া আমজাদ বেলগাঁও চলিয়া গেলেন। পুনরায় অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। জুট-অফিসের আমলা চাকরদিগের প্রত্যেকের বাসাবাড়ি, আড্ডা প্রভৃতি স্থান তন্ন তন্ন করিয়া দেখা হইল। অনেককে অনেক প্রকার প্রশ্ন করা হইল। এই কার্যেই দুই দিন গেল। তৃতীয় দিন অফিসের পুষ্করিণীতে জাল ফেলা হইল। ফলে কিছু মাছ পাওয়া গেল, আর কিছুই মিলিল না তৎপর পুষ্করিণীতে লোক নামাইয়া দিয়া দলামলা হইল হাঁড়ি-পাতিল কিছু উঠিল। সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেব আশাপূর্ণ অন্তরে তাহা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া দেখিলেম কিন্তু সব শূন্য। ঐ তিন দিন গুপ্তানুসন্ধানও চলিল, কিন্তু ফল কিছুই হইল না। পুলিশ হতাশ হইয়া পড়িলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

নুরল এসলাম জেলায় চালান হইবার সময় স্ত্রীকে যে পত্র লিখিয়া যান, তাহা যথাসময়ে আনোয়ারার হস্তগত হইল। ঐ সময়ে সে জোহরের নামাজ পড়িয়া নিজের দূরদৃষ্টের বিষয় চিন্তা করিতেছিল। স্বামীর হস্তাক্ষরযুক্ত পত্র দেখিয়া তাহার হৃদয়ে তুফান ছুটিল। সে কম্পিত হস্তে পত্রখানি চুম্বন করিয়া তাজিমের সহিত মাথায় রাখিল, তাহার পরে চক্ষে স্পর্শ করাইয়া বুকে ছোঁয়াইল, তৎপরে খুলিয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু হায়! পাঠান্তে—’খোদা, তুমি কি করিলে? এই বলিয়া জায়নামাজের উপরই অজ্ঞান হইয়া পড়িল।

সালেহা পূর্বে লেখাপড়া জানিত না। আনোয়ারার শিক্ষা-দীক্ষায় সে এখন কোরান শরিফ ও বাঙ্গালা পুস্তকাদি পড়িতে পারে। তাহার দেখাদেখি, পাড়ার আরও ৫/৬ মেয়ে আনোয়ারার কাছে পড়াশুনা করে। সালেহা পড়া বলিয়া লইতে এই সময় ঘরে আসিয়া দেখিল, আনোয়ারা জায়নামাজের উপর শুইয়া আছে। সালেহা প্রথমে ‘ভাবী’ বলিয়া ২/৩ বার ডাকিল, কোন উত্তর পাইল না; পরে জোরে গায়ে ধাক্কা দিল, তথাপি সাড়াশব্দ নাই; পরে এপাশ ওপাশ করিয়া দেখিল, যেদিকে কাৎ করে সেই দিকেই থাকে। এই অবস্থা দেখিয়া বালিকা সভয়ে চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “ফুফু-আম্মা, ভাবী মরিয়া গিয়াছে।” ফুফু-আম্মা শুনিয়া দৌড়িয়া আসিলেন। প্রতিবাসী অনেক স্ত্রীলোক আসিয়া জুটিল, আনোয়ারার কয়েকটি ছাত্রীও আসিল। ফুফু বউ-এর গায়ে হাত দিয়া দেখিলেন গা ঠাণ্ডা; নাকে হাত দিলেন, নিঃশ্বাস চলে না, মুখের ভিতর হাত দিয়া দেখিলেন দাঁতে দাঁতে দৃঢ়রূপে লাগিয়া গিয়াছে। ফুফু-আম্মাও তখন বৌ মরিয়া গিয়াছে বলিয়া হায়, হায়, করিতে লাগিলেন। উপস্থিত একজন প্রবীণা প্রতিবাসী স্ত্রীলোক কহিলেন, “আপনারা এত অস্থির হইবেন না, দাঁত লাগিয়াছে, মাথায় পানির ধারাণী দিউন।” তাঁহার কথামত কার্য চলিল, কিন্তু কি নিমিত্ত বৌ-এর এরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে; তাহা কেহই ঠিক করিতে পারিল না। পরে সেই প্রবীণা স্ত্রীলোকটি এদিক ওদিক চাহিয়া কহিলেন, “বিবি সাহেবার পাশে চিঠির মত ওখানা কি পড়িয়া রহিয়াছে?” কুসম নামে একটি বুদ্ধিমতী ছাত্রী চিঠিখানি তুলিয়া লইল এবং খুলিয়া মনে মনে পড়িতে লাগিল,—

“প্রাণাধিকে–

তুমি ফেরেশ্তাদিগের পূজনীয়। আমি নরাধম, তাই তোমাকে চিনিতে পারি নাই! পরন্তু লোকাপবাদে উন্মনা হইয়া তোমার পবিত্র হৃদয়ে যে ব্যথা দিয়াছি, সেই মহাপাপে আজ কারাগারে চলিলাম। সরকারি তহবিল হইতে আট হাজার টাকা কিরূপে খোয়া গিয়াছে কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। কোম্পানির আদেশে আমি দায়ী হইয়া ফৌজদারিতে সোর্পদ হইয়া জেলায় চলিলাম। হায়! তোমার স্বর্গীয় বিমল মূর্তি আর দেখিতে পাইলাম না, ইহাই দুঃখ রহিল। কারাগারে যাইয়া আর বেশি দিন বাঁচিবার আশা নাই। অন্তিম অনুরোধ, শুধু শরিয়তের নহে, ধর্মবিধি—প্রাণের দোহাই দিয়া বলিতেছি, নরাধমের জীবিতকাল পর্যন্ত তাহাকে পতি বলিয়া মনে রাখিও। ইতি–

তোমারই হতভাগ্য
নুরল এসলাম

পত্র পাঠ করিয়া কুলসম কহিল, “অজ্ঞানই হবারই কথা।” ফুফু-আম্মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “পত্রে কি লেখা আছে, মা?” কুলসম কারাগারে যাওয়ার কথা চাপা দিয়া কহিল, “দেওয়ান সাহেব সরকারি টাকা-পয়সার গোলমালে পড়িয়াছেন।” শুনিয়া ফুফু-আম্মা আরও উতলা হইলেন।

অনেক সেবা-শুশ্রূষার পর আনোয়ারার চৈতন্য হইল। সে জোর করিয়া উঠিয়া বসিতেই ‘উহ” বলিয়া আবার অজ্ঞান হইয়া পড়িল। পুনরায় সেবা-শুশ্রুষা চলিল। ধীরে ধীরে আনোয়ারা আবার চেতনা লাভ করিল। ফুফু-আম্মা হৃদয়ের ব্যাকুলভাব চাপিয়া বউকে প্রবোধ দিবার জন্য কহিলেন, “টাকা-পয়সার একটু গোলমাল হইয়াছে, তাহাতেই তুমি এত অস্থির হইয়াছ?” আনোয়ারা কহিল, “না, তিনি যে জেলে”—বলিয়াই আবার অজ্ঞান হইয়া পড়িল।

ফুফু-আম্মা কাঁদিতে লাগিলেন। আনোয়ারার বারংবার মূর্ছা ও ফুফুর কান্নাকাটিতে দিবা অবসান হইল, রাত্রি আসিল। অতিকষ্টে রাত্রিও প্রভাত হইল। আনোয়ারা বুকে গুরুতর বেদনা লইয়া শয্যায় উঠিয়া বসিল। ফুফু টোকা ওষুধের প্রলেপ তাহার বুকে দিয়া কহিলেন, “তুমি অত উতলা না হইয়া ছেলের রক্ষার জন্য মধুপুরে ও জেলার ঠিকানায় পত্র লিখ।”

অষ্টম পরিচ্ছেদ

আনোয়ারা যেন কি ভাবিয়া আর সইকে পত্র লিখিল না। উপস্থিত বিপদের কথা উল্লেখ করিয়া মধুপুরে তাহার দাদিমাকে পত্র লিখিল। বৃদ্ধা হামিদার পিতাকে সঙ্গে দিয়া— আনোয়ারার পিতাকে টাকা কড়িসহ রতনদিয়ায় পাঠাইলেন।

নির্দিষ্ট দিনে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট-কোর্টে মোকদ্দমা উঠিল। বাদী ম্যানেজার সাহেবের কথা, আসামী চরিত্রবান বলিয়া প্রমাণিত হইলেন; কিন্তু উপস্থিত ঘটনায় তিনি যে নির্দোষ তাহা সাব্যস্ত হইল না। রতীশ বাবু ও দাগু সাক্ষ্য দিল “নুরল এসলাম দীর্ঘদিন পীড়িত থাকিয়া সর্বস্বান্ত হইয়াছিলেন; তারপর কার্যে পুনরায় উপস্থিত হন। ক্যাশ সিন্দুকের চাবি সর্বদা তাহার কাছে থাকিত।” দারওয়ান জগন্নাথ মিশ্র সাক্ষ্য দিল, “টাকা চুরির আগে বড়বাবু বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলিতেন আর থাকিয়া থাকিয়া রাম রাম বলিতেন।” তার কথায় আদালতের লোক হাসিয়া উঠিল। উকিল সাহেব দোস্তের দোষহীনতা প্রমাণের নিমিত্ত জ্বলন্ত ভাষায় বক্তৃতা করিলেন। ফলে, ম্যাজিস্ট্রেট নানাদিক্ বিবেচনা করিয়া নুরল এসলামের প্রতি ১৮ মাসের কারাদণ্ডের বিধান করিলেন। হুকুম শুনিয়া তালুকদার ও ভূঞা সাহেব পরিশুষ্ক মুখে ও উকিল সাহেব চক্ষু মুছিতে মুছিতে বাহিরে আসিলেন। বিচারের দিন তালুকদার ও ভূঞা সাহেব কোর্টে উপস্থিত ছিলেন।

সেদিন হামিদা অনাহারে কাটাইয়াছে। প্রাণের খোকাকে লইয়া তাহার হাসিখুশি সেদিন বন্ধ ছিল, তালুকদার সাহেব বিমর্ষ-চিত্তে অন্দরে প্রবেশ করিলে হামিদা ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবাজান, সয়া কি মুক্তি পাইয়াছেন?”

তালু। না মা, তাহার ১৮ মাসের জেল হইয়াছে।

হামিদার দম বন্ধ হইবার উপক্রম হইল।

তালু। মা, তুমি দেখছি আনোয়ারার মত হইলে।

হামিদা আরও অস্থিরচিত্তে কহিল, “বাবজান, তার কি হইয়াছে?”

তালু। রতনদিয়ায় আসিয়া শুনিলাম, দুলামিঞা হাজতে আসিবার দিনই তাহাকে চিঠি লিখিয়া আসিয়াছে—আমি জেলে চলিলাম, তখন তাকে লইয়াই কান্নাকাটি। রাত্রে ৪/৫ বার মূৰ্চ্ছা যায়। প্রাতে বুকে বেদনা ধরিয়া শয্যাগত হইয়াছে।

হামিদা। হায়! হায়! কি সর্বনাশ! এমন গজবও কি মানুষের উপর হয়।

তালু। মা, সকলই অদৃষ্টের ফল। তবে বিপদে ধৈর্য অবলম্বন করাই মনুষ্যত্ব।

হামিদা। বাবাজান, এমন বিপদেও কি ধৈর্য থাকে?

তালু। মা, কারবালার বিপদে হযরত হোসেন-পরিবার খোদাতায়ালার প্রতি আত্মসমৰ্পণ করিয়া ধৈর্যবলে মর-মহীতে অমর হইয়া গিয়াছেন

হামিদা পিতার উপদেশ কথঞ্চিৎ শান্ত হইয়া, তাহাদের আহারের আয়োজনে চলিয়া গেল।

পরদিন তালুকদার ও ভূঞা সাহেব রতনদিয়া হইয়া বাড়ি রওয়ানা হইলেন। ভূঞা সাহেব জামাতার সাহায্যের নিমিত্ত বাড়ি হইতে যে সাড়ে চারিশত টাকা লইয়া আসিয়াছিলেন তাহার মধ্য হইতে মাত্র ১০ টি টাকা আনোয়ারাকে দিয়া গেলেন।

তাঁহার বাড়ি পৌছিলে সংবাদ শুনিয়া বৃদ্ধা কাঁদিতে বসিলেন। এদিকে বুকের বেদনা বাড়িয়া আনোয়ারা একেবারে শয্যাশায়িনী হইল।

নবম পরিচ্ছেদ

নুরল এসলাম কারাগারে যাইবার পর, কোম্পানির টাকা আদায়ের নিমিত্ত কলিকাতা হইতে একজন কর্মচারী বেলগাঁও আসিলেন। ম্যানেজার সাহেব তাহাকে বলিলেন, “আসামীর সম্পত্তি যাহা ছিল, সে তাহা পূর্বেই ভগিনী ও স্ত্রীকে দান করিয়া গিয়াছে। সুতরাং তাহার নিকট টাকা আদায় অসম্ভব। এমন অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া যাহা হয়।” কিন্তু রতীশ বাবু পূর্বকথিত নবার নিকট শুনিয়া স্থানীয় রেজেস্টারী অফিসে খোঁজ করিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন—নুরল এসলাম দানপত্র রেজেস্টারী করিয়া দেন নাই। তিনি কলিকাতার কর্মচারীকে গোপনে বলিলেন, “আসামীর দানপত্র এ পর্যন্ত রেজেস্টারী হয় নাই, সুতরাং এখন সে সম্পত্তি আসামীর বলিয়া নালিশ করিতে পারেন।” কর্মচারী ম্যানেজার সাহেবের নিকট, আসামীর নামে সেই সূত্রে নালিশের প্রস্তাব করেন। উকিল সাহেব তাহা অবগত হইয়া রতনদিয়ায় পত্র লেখেন।

উকিল সাহেবের পত্র পাইয়া শয্যাশায়িনী আনোয়ারা বুকের ব্যাথা বুকে চাপিয়া উঠিয়া বসিল। সকলে মনে করিল, বউ সুস্থ হইয়া উঠিয়াছে।

আনোয়ারা সংক্ষেপে তাহার দাদিমাকে পত্র লিখিল,

“তোমরা সকলে আমার সালাম জানিবে। বাবাজান আমাদের বিপদে এখানে আসিয়া মাত্র দশটি টাকা দিয়া গিয়াছেন! এক্ষণে কোম্পানি আমাদের তালুক বিক্রয় করিয়া টাকা লইতে চেষ্টা করিতেছে। অতএব এই চিঠি পাওয়া মাত্র তুমি নিজ হইতে তিনশত, বাবাজান তিনশত, আমার পুঁজি টাকা চারি শত এবং কয়েকখানি শাড়ী ও তোমার প্রদত্ত আমার সমস্ত গহনা বিলম্ব না করিয়া পাঠাইবে। যদি ঐ সকল পাঠাইতে ইতস্তত বা বিলম্ব কর, তবে আমাকে আর জন্মের মত দেখিতে পাইবে না।” ইতি——

তোমার সোহাগের —

আনোয়ারা

স্নেহপরায়না বৃদ্ধা পৌত্রীর আত্মহত্যার আশঙ্কা করিয়া অগৌণে বস্ত্রালঙ্কার ও নগদ টাকা পাঠাইলেন। মাত্র ১০ টি টাকা মেয়েকে দিয়া আসিয়াছে শুনিয়া বৃদ্ধা পুত্রকে তিরস্কার করিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে তিনশত টাকা লইয়া তাহাও এই সঙ্গে পাঠাইলেন। আনোয়ারা যথাসময়ে টাকা, অলঙ্কার ও বস্ত্র পাইল।

এদিকে আনোয়ারা উকিল সাহেবকে রতনদিয়ায় আসিতে সই-এর নিকট পত্র লিখিল। উকিল সাহেবও যথাসময়ে রতনদিয়ায় আসিলেন। দিনমানে তিনি দোস্তের সংসারের সিজিল মিছিল করিলেন। রাত্রিতে কোম্পানির দেনা শোধের কথা তুলিলেন। সরল ফুফু-আম্মা কহিলেন, “বাবা তুমি যাহা ভাল বুঝ তাহাই কর।” উকিল সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “টাকা ২/৩ হাজার নয়, আট হাজার! তালুক বিক্রয় ছাড়া উপায় দেখিতেছি না। আনোয়ারা ফুফু-শাশুড়ীর নিকট ঘরের ভিতরে বসিয়াছিল, সে ছোট করিয়া ফুফু-শাশুড়ীকে কহিল “তা কেন, আমার নিকট হাজার টাকা ও আমার এগার শত টাকার গহনা আছে। তাঁর (স্বামীর) পীড়ার সময় সই আমাকে একশত টাকা দিয়াছিল, তাহাও মজুদ আছে। এই সব দিয়া কোম্পানির টাকা মিটাইতে বলেন।”

ফুফু বউ-এর সমস্ত কথা উকিল সাহেবকে শুনাইলেন। উকিল সাহেব শুনিয়া বালিকার পতিপরায়ণতায় মনে মনে ধন্যবাদ দিলেন। মুখে কহিলেন, “আট হাজার টাকার দেনা এতে মিটিবে না।”

নুরল এসলাম কারাগারে যাইবার সময় আনোয়ারাকে পত্র লিখিয়াছিলেন, “অন্তিম অনুরোধ, শুধু শরিয়তের নহে, প্রাণের দোহাই দিয়া বলিতেছি, নরাধমকে পতি বলিয়া মনে রাখিবে।” আনোয়ারার সেই কথা এখন হৃদয়ে উজ্জ্বলভাবে জাগিয়া উঠিল এবং উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে পতির সম্পর্ক রক্ষা করা সে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্যকর্ম মনে করিল। তাই সে বিবাহের সময় স্বামীদত্ত যে নয়শত টাকার অলঙ্কার পাইয়াছিল, তাহাও এই ঋণ শোধার্থে দেওয়া কর্তব্য মনে করিয়া ফুফু-শাশুড়ীকে কহিল, “আপনারা যে আমাকে নয়শত টাকার গহনা দিয়াছিলেন, তাহাও পোটম্যানে তোলা আছে। ওগুলিও সয়া সাহেবকে দেওয়া যাক।” ফুফু সে কথাও উকিল সাহেবকে জানাইলেন। উকিল সাহেব মনে করিয়াছিলেন পূর্বে যে এগার শত টাকার গহনা দেওয়ার কথা হইল, তাহাই দোস্ত সাহেবের প্রদত্ত। এক্ষণে আরও নয়শত টাকার গহনার কথা শুনিয়া তিনি বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা ইতঃপূর্বে যে এগারশত টাকার অলঙ্কারের কথা বলিলেন তাহা কাহার”? ফুফু-আম্মা কহিলেন, “ওগুলি বউমার দাদিমা দিয়াছিলেন।” উকিল সাহেব শুনিয়া মনে মনে কহিলেন, “সতী, তুমিই ধন্য তুমিই পতিব্রতাদিগের আদর্শস্থানীয়া।”

উকিল সাহেব তখন হিন্দুদিগের বিশ্বামিত্র-প্রকৃতি পরিগ্রহ করিয়া পুনরায় কহিলেন, “নগদে ও গহনায় তিন হাজার এক শত হইতেছে, বাকি চারি হাজার নয়শত টাকা। তার উপায় কি?” আনোয়ারা তখন কাঁদিতে কাঁদিতে ফুফু আম্মাকে কহিল, “আমার হাতে এখন ৬০ টাকার অঙ্গুরী আছে। পরিধানে ৫/৬ শত টাকার শাড়ী আছে, ইহাও দেওয়া যাক।” ফুফু-আম্মা কহিলেন “বউ মা তুমি কাঁদিও না; শাড়ী দেওয়ার আবশ্যক নাই। ছেলের শোকে আমি পাগল হইয়াছি, তাই মনে ছিল না; আমাদের বিপদের কথা শুনিয়া রশিদা নিজ হাতে দুইশত ও তাহার সোয়ামী একশত টাকা দিয়াছিল, সেই তিনশত টাকা আমার কাছে আছে। কাল ছেলেকে শাড়ীর বদলে তাহাই দেওয়া যাইবে।” এইবার উকিল সাহেবের পরীক্ষা শেষ হইল। তিনি কহিলেন, “আপনারা কান্নাকাটি করিবেন না, আপনাদের পাঁচশত টাকা আমার নিকট মজুদ আছে। দোস্ত সাহেবের ম্যানেজার সাহেব তাঁহার মোকদ্দমার সাহায্যের জন্য আমার হাতে দিয়াছিলেন, তাহাও এই দেনায় শোধ দিন।” এই বলিয়া তিনি পাঁচ কিত্তা নোট ফুফু-আম্মার হাতে দিলেন।

রাত্রি প্রভাতে ফুফু-আম্মা—

নিজের নিকট মজুদ – ৩০০

উকিল সাহেবের প্রদত্ত নোট – ৫০০

আনোয়ারার সয়ের প্রদত্ত – ১০০

আনোয়ারার পিত্রালয় হইতে আনীত – ১০০০

আনোয়ারার দাদিমার প্রদত্ত গহনা – ১১০০

আনোয়ারার স্বামী প্রদত্ত গহনা – ৯০০

আনোয়ারার আংটি – ৬০

মোট : ৩,৯৬০

মোট ঊনচল্লিশ শত ষাইট টাকা নগদে-গহনায় দেনা শোধের জন্য উকিল সাহেবের হাতে দিলেন। তিনি ঐ সকল লইয়া যথাসময়ে বাসায় আসিলেন।

উকিল সাহেব বাসায় পৌঁছিলে হামিদা কহিল, “এত টাকা ও গহনা কোথায় পাইলে?”

উকিল। পতির ঋণ-মুক্তির জন্য তোমার সই যথাসর্বস্ব আমার হাতে সঁপিয়া দিয়াছেন।

হামিদা। তাই ত’ দেখিতেছি, আমার প্রদত্ত আংটিটি পর্যন্ত দিয়াছে। ধন্য পতিব্রতা? এমন সতী সই হইয়া, নারী জন্ম সুন্দর ও সার্থক মনে হইতেছে।

উকিল। এতে সতীর উদ্দেশ্য সফল হইবে কিনা তাহাই ভাবিতেছি।

হামিদা। আর কত হইলে দেনা শোধ করিতে পারিবে?

উকিল। কমপক্ষে মোট সাড়ে চারিহাজার টাকা হইলে কথা বলা যায়।

হামিদা। তাহাই নাজাই কত?

উকিল। আর ৫৪০ হইলে সাড়ে চারিহাজার হয়।

হামিদা। তুমি ৩০০ দেও, আমি নিজ হইতে ২৪০ দেই।

উকিল। তোমার নিজ তহবিলে খুব টাকা জমিয়াছে নাকি?

হামিদা। জমিয়াছে বৈকি?

উকিল। কোথায় পাইলে?

হামিদা। আমি খোকার মুখে ক্ষীর দেওয়া উপলক্ষ ৩০০ টাকা জমাইয়াছি। তোমার অনুমতি হইলে তাহা হইতে দিতে চাই।

উকিল। তোমার হৃদয়ের মহত্ত্ব দেখিয়া সুখী হইলাম।

অতঃপর জুট ম্যানেজারের সহিত অনেক লেখালেখি হওয়ার পর তাঁহার বিশেষ অনুগ্রহে চারি হাজার টাকায় কোম্পানির টাকা শোধ সাব্যস্ত হইল। বন্ধুর তালুক ও বন্ধু- পত্নীর গাত্রালঙ্কার যাহাতে পরভোগ্য না হয়, তজ্জন্য উকিল সাহেব নিজ নামে হাজার টাকার হ্যান্ডনোট লিখিয়া দিয়া এবং বক্রী নাজাই নিজ হইতে দিয়া কোম্পানির রফার টাকার শোধ করিলেন। স্ত্রীকে হ্যান্ডনোটের কথা জানাইয়া কহিলেন, “অলঙ্কারগুলি সযত্নে তুলিয়া রাখ, সময়ে ফেরত দেওয়া যাইবে।” হামিদা আহ্লাদে গহনাগুলি নিজ বাক্সে পুরিল।

দশম পরিচ্ছেদ

জুট কোম্পানির টাকা শোধের পর, একদিন রাত্রিতে শয়ন করিয়া ফুফু-আম্মা আনোয়ারাকে কহিলেন, “বউ মা, এখন উপায় কি?” আনোয়ারা শোক নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “কিসের উপায়ের কথা বলিতেছেন, আম্মাজান?” ফুফু কহিলেন, “টাকা পয়সা সব গেল, আশ্বিন মাস না আসিলে তালুকের খাজনাপত্র পাওয়া যাইবে না। খুসীর কাপড় নাই। সে তাহার জন্য বায়না ধরিয়াছে। কাল বাদে হাট, তাহারই বা উপায় কি? আনোয়ারা পুনরায় দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “সব যাইয়া যদি,—” আর বলিতে পারিল না। তাহার বাকরোধ হইয়া আসিল। চোখের পানিতে তাহার বুক ভাসিয়া যাইতে লাগিল।

রাত্রি প্রভাত হইলে আনোয়ারা ফজরের নামজ পড়িয়া ট্রাঙ্ক হইতে নিজের একখানি এক ধোপের লালপেড়ে ধুতি খুসীকে ডাকিয়া পড়িতে দিল। খুসী কাপড় পাইয়া সন্তুষ্ট হইয়া বউ- বিবিকে আশীর্বাদ করিতে লাগিল।

বিকাল বেলায় নবাব বৌ এই বাড়িতে বেড়াইতে আসিল। এই নবার বউই প্রথমে সালেহার নিকট আনোয়ারার লোকপবাদের কথা বলিয়া যায়। এজন্য আনোয়ারা তাহাকে দেখিয়া প্রথমে শিহরিয়া উঠিল, শেষে আত্মসম্বরণ করিয়া তাহাকে ডাকিয়া ঘরে লইল। নবার বৌ ঘরে আসিলে আনোয়ারা পোটম্যান খুলিয়া একখানি রেশমের উপর পদ্মফুল তোলা নিলাম্বরী শাড়ি বাহির করিয়া তাহার হাতে দিয়া কহিল, তোমার সোয়ামীকে দিয়া শাড়ীখানা বিক্রয় করিয়া দিবে?”

নবার বৌ সহৃদয়তা জানাইয়া কহিল, “আপনারা বড়লোক, হাড়ী বেচবেন ক্যান?”

আনো। আমাদের টাকা পয়সার খুব টানাটানি হইয়াছে।

নবার বৌ। এ্যার দাম কত?

আনো। নয় টাকা; এখন সাত টাকা হইলেই দিব।

নবার বৌ। পোটম্যানের দিকে চাহিয়া কহিল, “ঐ যে হোনার ল্যাগান জ্বতিছে ওহান কি হাড়ি?”

আনো। হ্যাঁ, ওর দাম বেশি।

নবার বৌ। কত?

আনো। পনরকুড়ি টাকা।

নবার বৌ। ওহান বেচবেন না?

আনো। খরিদ্দার পাইলে বিক্রয় করিব।

নবার বৌ। দাম কত চান?

আনো। এখন অর্ধেক দামে দিব!

নবার বৌ। খুইল্যা দেহান ত?

আনোয়ারা শাড়ী খুলিয়া দেখাইল। কিছু দিন ব্যবহার হইলেও বিচিত্র বেনারসী শাড়ী দেখিয়া নবার বৌ-এর চোখ ঝলসিয়া গেল। সে শাড়ীর জন্য উন্মত্তা হইয়া উঠিল। কিন্তু সন্ধ্যা উপস্থিত হওয়ায় কহিল, “আজ থাক, কাইল লইয়া যামু।” নবার বৌ চলিয়া গেল।

রাত্রিতে নবা বেলগাঁও হইতে বাড়ি আসিল। নবার বৌ পূর্বেই তাহাকে শাড়ির ফরমাস গিয়াছিল। বাড়ি আসিবামাত্র বউ নবাকে কহিল, “আমার ছাড়ী কই?”

নবা কহিল, “রতীশ বাবু কলকাতা থাইকা আইলেই হাড়ী পাইবা। “

নবার বৌ মুখ ভার করিয়া রাত্রিতে অনেকক্ষণ কথাবার্তা কহিল না। নবা অনেক সাধ্য- সাধনা করিলে বৌ শেষে অভিমানের নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “আচ্ছা, আমাকে বুঝি বিশ্বাস পাও না? ছোরানী দুড্যা আমার কাছে দেওনা ক্যান?” নবপ্রেমে আত্মহারা নবা তখন বউ-এর আচলে চাবি দুইটা বাঁধিয়া দিয়া কহিল, “এই নাও ছোরানী। হুঁশিয়ার হয়া রাখবা।” প্রাতে নবা বন্দরে গেল। নবার বাক্স খুলিয়া শাড়ির অর্ধেক মূল্য সাড়ে সাতকুড়ির স্থলে আটকুড়ি আর সাত টাকা লইয়া শাড়ী কিনিতে চলিল।

আনোয়ারা তখন কোরান পাঠ করিতেছিল।

নবার বৌ টাকাগুলি তাহার পায়ের কাছে ঢালিয়া দিয়া কহিল, “হাড়ী দুইহান দ্যান।”

আনোয়ারা টাকা দেখিয়া চমকিত হইয়া উঠিল। কোরান পাঠ বন্ধ করিয়া কহিল, “তোমরা গরিব মানুষ, এত টাকা কোথায় পাইলে?

নবার বৌ মিশিরঞ্জিত দন্ত বিকশিত করিয়া কহিল, “খোদার দিছে।”

আনো। তা ত’ সত্যি; কিন্তু খোদা কেমন করিয়া দিল?

নবার বৌ ইতস্তত করিতে লাগিল। আনোয়ারা ভরসা দিয়া কহিল, “আমার কাছে বলিতে ভয় কি?” নবার বৌ তথাপি ইতস্তত করিতে লাগিল। আনোয়ারা তখন কহিল, “তুমি টাকার কথা না বলিলে আমি তোমাকে শাড়ী দিব না।” নবার বৌ শাড়ীর জন্য পাগল! সে এদিক্ ওদিক চাহিয়া কহিল, “বাড়ি আলা এক ছালা ট্যাহা পৈরে পাইছে।”

আনো। কোথায় পাইয়াছে?

নবার বৌ। সাহেবের পুষ্কন্নিতে রাতে মাছ মারতে যারা।

আনোয়ারা শুনিয়া অনেকক্ষণ কি যেন চিন্তা করিল। পরে দশ টাকা ফেরত দিয়া শাড়ীর কথিত মূল্য ১৫৭ টাকা রাখিয়া শাড়ী দুইখানি নবার বউ-এর হাতে দিল। সে মহানন্দে শাড়ি লইয়া প্রস্থান করিল।

একাদশ পরিচ্ছেদ

আনোয়ারার শাড়ি বিক্রয়ের তিন দিন পর জেলা হইতে জনৈক নামজাদা পুলিশ ইনস্পেক্টার রতনদিয়ায় আসিয়া হঠাৎ নবাব আলীর বাড়ি ঘেরাও করিলেন। পাঠক, নবার আলী ওরফে নবার পরিচয় পূর্বেই পাইয়াছেন।

নবা বন্দরে যাইতে বাড়ির বাহির হইতেছিল। পুলিশ দেখিয়া তাহার অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠিল। জনৈক কনেস্টবল তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কি?”

নবা। হুজুর, কর্তা, আমার নাম—আমার না—ন—নবা। না, আমার নাম কর্তা মহাশয় নবাব আলী শ্যাক।

ইস্পেক্টারের ইঙ্গিতে কনেস্টবল নবাব আলীর হাত চাপিয়া ধরিল। নবার মুখ দিয়া তখন ধূলা উড়িতে লাগিল। সে মনে করিতে লাগিল, সমস্ত দুনিয়াটা বুঝি তাহার বিপদে ওলট-পালট খাইতেছে। সে এখন দিশাহারা, তথাপি বিলুপ্ত সাহসের কৃত্রিম ছায়া অবলম্বনে কনেস্টবলকে কহিল, ‘আপনে হুজুর কর্তা আমার হাত চাইপ্যা ধল্লেন কেন্? ছাড়েন, না ছাড়লে আমি এহনি এই দারোগা বাবুর কাছে নালিশ কইর‍্যা দিমু।”

ইন। (স্মিত মুখে) কি বলে নালিশ করবি?

নবা। হুজুর আমার বাপ-দাদা দুই পুরুষে কেউ চোর হয় নাই। আমিও চোর না। তবে কিছু ট্যাহা পইরা পাইছি, তা চান্ত’ এহনি বার করা দিতেছি।

ইনস্পেক্টার কহিলেন, “তবে বাড়ির ভিতর চল্।” কনেস্টবল নবার হাত ছাড়িয়া দিল, ইনস্পেক্টার তাহাকে সঙ্গে করিয়া সদলে নবার বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিলেন।

কনেস্টবল সঙ্গে গিয়া নবার টাকার বাক্স বাহিরে আনিল। সর্বসম্মুখে খোলা হইল, বাক্সে মাত্র ২০০ টাকা পাওয়া গেল। আর একটি ছোট রকমের টিনের বাক্স খোলা হইল, তাহা হইতে একখানি বেনারসী ও একখানি নীলাম্বরী শাড়ি আর ১৩ টি টাকা বাহির হইল। এই বাক্সটি নবা তাহার স্ত্রীকে ভালবাসিয়া খরিদ করিয়া দিয়াছিল। ইনস্পেক্টার নবাকে কহিলেন, “তোর বউ বেনারসী পরে, আর তুই বলিস আমি চোর না।” শাড়ী দেখিয়া নবার মাথা ঘুরিয়া গেল। কারণ সে এই শাড়ীর বিষয় কিছুই অবগত নয়। সে একটু সামলাইয়া কহিল, “হুজুর, আমি হাড়ীর কথা কিছুই জানি না। বউকে পুছিয়া দেহি কেমন কইরা এমন হাড়ী গরিবের বাড়ি আইল।” ইনস্পেক্টার আদেশ দিলেন। সে ঘরে গিয়া বউকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, তাহাদের মনিব-বউ তাহার স্ত্রীর নিকট দুইখানি শাড়ী বিক্রয় করিতে দিয়াছেন। বাস্তবিক তাহার স্ত্রী যে শাড়ী নিজে পরার জন্য মুনিব-বউয়ের নিকট হইতে টাকা দিয়া ক্ৰয় করিয়া আনিয়াছে, তাহা সে স্ত্রীর মুখে শুনিয়াও গোপন করিল।

ইন্। আচ্ছা, আর টাকা কোথায় রাখিয়াছিস বল।

নবা। আমি আর কোন হানে ট্যাহা রাখি নাই।

তখন ইনস্পেক্টারের আদেশে তাঁহার অনুচরগণ নবার বাড়িঘর তন্ন তন্ন করিয়া দেখিল, কিন্তু কিছু পাইল না, শেষে তাহার শয়নঘরের মেঝে খুড়িতে খুড়িতে এক পাতিল টাকা বাহির হইল। গুণিয়া দেখা গেল, সতর শত। ইনস্পেক্টার ক্রোধভরে নবাকে কহিলেন, “আট হাজারের মধ্যে ১,১৯৩ টাকা পাওয়া গেল। আর টাকা কোথায় আছে ভাল চাহিস ত খুলিয়া বল।”

নবা। হুজুর, এখন কাইট্যা ফেলালেও আর নবার ঘরে এক পয়সা পাইবেন না।

পুলিশ-অনুচারগণ নবার বাড়ি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া বাস্তবিকই আর কিছু পাইল না।

ইন্। তুই এত টাকা কোথা হইতে চুরি করিয়াছিস?

নবা। হুজুর আমি চোর না। ট্যাহা পইরা পাইছি।

ইন্। কোথায় পেয়েছিস বল। ঠিক কথা বলিলে, তোকে ফাটকে দিব না।

নবা। হুজুর, বাপ মা, যদি গোলামকে বাঁচান, তবে সব খুইল্যা কই?

ইন্। বল, তোর কোন ভয় নাই।

নবা। যেদিন আমার মুনিবকে জেলায় ধ’রে লিয়া যায়, হেইদিন রাতে আমি সায়েবের পুষ্কন্নিতে মাছ মারতে গেছিলাম। পশ্চিমপারে জালি দিয়া মাছ মারতেছি; দেহি তিনজন মানুষ অফিসের ঘাট দিয়া নাইমে আইসে একজন পানিতে নাম্‌ল। তারপর কি যেন তুইলে উপরের দুইজনের মাথায় দিল, আর, নিজেও একটা নিল। তারপর তিনজনাই উপরে উঠে গ্যাল। আমি পানিতে মিইশ্যা থাইক্যা দেহলাম।

ইন্। তিনজন কে কে?

নবা। কাল্‌ছা আঁধারে চেনা গেল না।

ইন্। তুই তখন কি করলি?

নবা। তারা চইল্যা গ্যালে আমি আস্তে আস্তে পূর্বপারে যাইয়া দ্যাহি পানির কিনারে কি যেন উচা হ’য়া আছে। হাত দিয়া দ্যাহি ট্যাহার ছালা। আমি তাই মাতায় কইর্যা বাড়ি আনছি।

ইন্। এই তিনটি লোককে কি একেবারেই চিনিতে পারিস নাই?

নবা। হুজুর পরে পারচি।

ইন্। (সোৎসাহে) কে কে?

নবা। রতীশ বাবু আর দাগু মামু।

ইন্। তারা যে চুরি করিয়াছে কেমন করিয়া বুঝিলি?

নবা। আমি হেই দিন ভোরে বাড়ি হইতে আইসে সায়েবের পুষ্কন্নিতে মুখ ধুইতে গেছিলাম। দ্যাহি রতীশ বাবু আর দাগু মামু পুষ্কন্নিতে রাতে হেই জায়গায় খাড়া হ’য়া কি যেন বলা করা করতেছে। আর রতীশ বাবু ট্যাহার জায়গায় হাত ইশারা কইরা কি যেন দেহাইতেছে। ওগার উপর আমার ভারি শোবা হইল কিন্তু ভাবলাম আর একজন কে? ধরার জন্যি তাহে তাহে থাক্‌লাম।

এই পর্যন্ত বলিয়া নবা থামিয়া গেল।

ইন্। তাহারপর আর কোন খোঁজ করিতে পারিস নাই?

নবা। হুজুর, আমাকে ছ্যাইড়া দিবেন ত?

ইন্‌। হাঁ, হাঁ, তুমি যদি সব কথা সত্য করে খুলে বলিস, তবে তোকে বেকসুর খালাস দিব।

নবা। তবে কই হোনেন। আমরা ৩/৪ জন গরিব মানুষ পাট বাঁধাই করি। রতীশ বাবুর বাসার নিকট আমাগোর বাসা।

ইন। রতীশ বাবু কি পরিবার লইয়া থাকেন?

নবা। না, হুজুর, তিনি ক্যাবল বাসায় পাক কইরা খান।

ইন্। রাত্রে কোথায় থাকেন?

নবা। হুজুর, অনেক রাতে থানার পশ্চিমে বৈষ্টমী পাড়া যান।

ইন্। কোন্ বৈষ্ণবীর বাড়িতে থাকেন, জানিস?

নবা। জানি, নলিনী বৈষ্টমীর বাড়িতে থাহেন। আমরা সেই বৈষ্টমীকে নলিনী ঠাকরাণী বলি! ঠাকরাণী না বললে বৈষ্টমী বেজার হয়, বাবুও রাগ করেন।

ইন্। থাক, আসল কথা বল।

নবা। হুজুর, আমি এ্যাক দিন বেশি রাত জাইগ্যা বাসায় বইসে আছি, পাশে রতীশ বাবুর বাসায় তেনি, দাগু মামু আর ফরমান ৩ জন মানুষের কথা শুইনা কান খাড়া কলাম। দাগু মামু এই কইতাছে, বাবু, যে ছালা আলাদা বালুতে গাড়া হইচিল, তা আপনি আগে চালাকী কইরা তুইল্যা আনচেন। তার অংশ আমাকে না দিল আমি সব ফাঁসায়া দেব। রতীশ বাবু কইল, “না দাগু ভাই, আমি কালী ঠাকুরুণের দিব্যি কইরা কইতে পারি আমি তা আনি নাই।’ দাগু মামু তখন ফরমান ভাইকে কইলেন, ‘একাজ তবে তুমিই কর’চ? ‘ফরমান ভাইও তখন রাগের মুখে কইল, ‘আমাকে অত শয়তান মনে কইর না। চিনির বলদের মত বোঝা বওয়াইয়া মোটে পাঁচ গণ্ডা ট্যাহা দিতে চাও, খোদায় এ্যার বিচার করবো। রতীশ বাবু হাইসে কইলেন, ‘ নেও ফরমান, তুমি আর আপত্তি কইর না, এ্যাক ঘন্টায় এক কুড়ি, আর কত? ফরমান কইলেন—”বাবু, আপনারা যে ছালায় ছালায়। আমি যদি ফাঁসায়ে দিই? দাগু মামু কইল, ‘কয়া দিয়া আর কি ঘন্টা করবা? মোকদ্দমা ত’ মিট্যা গ্যাছে। তার জন্যি বড়বাবুর ফাটক হইচে। রতীশ বাবু কইলেন, ‘আমার মনে কয়—যে জলের ছালা চুরি করচে, হেই বালুতে আলাদা গাড়া ছালা নিছে।”

দূরদর্শী, শান্তশিষ্ট ইনস্পেক্টার নবাকে আর প্রশ্ন করা আবশ্যক বোধ করিলেন না। যাহা শুনিলেন, তাহাই যথেষ্ট মনে করিয়া লিপিবদ্ধ করিলেন। অনন্তর নবাকে সঙ্গে করিয়া সদলে বেলগাঁও উপস্থিত হইলেন। বেলা তখন ১১টা।

ইনস্পেক্টার সাহেব নলিনী, রতীশ, দাগু ও ফরমানকে স্থানীয় পুলিশের হেফাজতে পৃথক বন্দী করিয়া রাখিয়া স্নানাহারের জন্য ডাকবাংলায় উপস্থিত হইলেন।

আহারান্তে অপরাহ্ণে ২টায় ইনস্পেক্টার সাহেব জোহরের নামাজ পড়িয়া খানাতল্লাসী আরম্ভ করিলেন। অগ্রে নলিনী বৈষ্ণবীর বাড়ি দেখা হইল। তাহার ঘরে নূতন লোহার সিন্দুক ও নূতন মজবুত স্টীলট্রাঙ্ক। সিন্দুক ও বাক্সের চাবি নলিনীর নিকট চাওয়া হইল। নলিনী ঝাড়িয়া জবাব দিল, “চাবি নাই, কাল হারাইয়া গিয়াছে।” ইনস্পেক্টার কহিলেন, “শয়তানি ছাড়, চাবি দাও। “ নলিনী নির্ভয়ে উত্তর করিল, “বলছি চাবি হারাইয়া গিয়াছে, কোথা হইতে দিব?”

নবা। চাবি বুঝি রতীশ বাবুর কাছে আছে। আমি তার কোমরে অনেকবার বড় ছোড়াণী দেকচি।

তখনই রতীশ বাবুর নিকটে পুলিশ গেল। বাবু চাবি লুকাইতে সময় পাইলেন না; অগত্যা বাহির করিয়া দিলেন। চাবি দুইটি পাইয়া ইনস্পেক্টার নবার প্রতি খুশী হইলেন। অগ্রে লোহার সিন্দুক খোলা হইল। তন্মধ্যে নগদ দুই হাজার টাকা ও পাঁচ শত টাকার নোট পাওয়া গেল। স্টীলট্রাঙ্ক হইতে নগদ চারিশত টাকা এবং কুড়ি ভরি পাকা সোনা বাহির হইল। ইনস্পেক্টার নলিনীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর টাকা কোথায় রাখিয়াছ!” নলিনী নিরুত্তর। ইনস্পেক্টার অন্যান্য বেশ্যাদিগের নিকট প্রমাণ লইয়া জানিতে পারিলেন, এক বৎসর হইল রতীশ বাবু নলিনীকে তাঁর দেশ হইতে এখানে আনিয়া ঘর করিয়া দিয়াছেন। নলিনী রতীশ বাবুর প্রতিবেশী জনৈক তন্তুরায়ের বাল্যবিধবা কন্যা। প্রথম যখন এখানে আইসে তখন অবস্থা শোচনীয় ছিল। অল্পদিন হইল হঠাৎ স্বচ্ছল হইয়াছে।

ইনস্পেক্টারের আদেশে নলিনীকে হাতকড়া দিয়া থানার হাজতে পুরা হইল। রতীশ বাবুর বাসাবাড়ি খানাতল্লাসী করিয়া কিছুই পাওয়া গেল না। শেষে ফরমানকে ধরা হইল।

ফরমান আমাদের পূর্বকথিত গণেশের ন্যায় সজ্ঞান বাচাল; ছোটবেলায় সে গ্রাম্য স্কুলে লেখাপড়া শিখিয়াছিল; কিন্তু অদৃষ্ট মন্দ, তাই দাগু যাচনদারের সহকারিতা করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। সে ইন্‌স্পেক্টার সাহেবকে দেখিয়াই লম্ফ-লম্ফ দিয়া বলিতে লাগিল, “হুজুর বুঝি খোদ ধর্মরাজ! ধর্মমাহাত্ম্য দেখাইতে আসিয়াছেন! আমি বুঝিয়াছিলাম, এই হোমরা-চোমরা সাহেব-সুবা সব আসিয়া যখন খাট্টা খাইয়া গেল, তখন ইংরেজের মুলুকে ধর্ম নাই, কিন্তু হুজুরের দাড়ির ভিতর ধর্ম আছে বলিয়া মালুম হইতেছে!” ইনস্পেক্টার সাহেবের সুন্দর চাপদাড়ি ছিল। তাঁহার বয়সও ৩৫/৩৬ বৎসরের বেশি নয়। তিনি হাসিয়া কহিলেন, তোমাকে ভাল লোক বলিয়া বোধ হইতেছে; মিথ্যা কথা বলিও না, ঠিক করিয়া বল, তুমি কত টাকা চুরি করিয়াছ?

ফর। হুজুর, ভাল লোক কি চুরি করে? তা’ যদি হয় তবে হুজুরকেও চোর বলা যায়। ইনস্পেক্টার সাহেব পুলিশ প্রভুদিগের ন্যায় অগ্নিশর্মা না হইয়া কার্যোদ্ধারের নিমিত্ত কহিলেন, “টাকার লোভে ভাল লোকও চোর হয়।”

ফর। তা হুজুরদিগের জেয়াদা।

ইন্। তবে তুমি টাকা চুরি কর নাই?

ফর। এক পয়সাও না।

ইন্। তবে কোম্পানির এত টাকা কে চুরি করিয়াছে?

ফর। হুজুর, দাগু বেটাকে ধরুন। বেটা দুপুর রাতে আমাকে ঘুম হইতে উঠাইয়া টাকার বোঝা বহাইয়া ৭/৮ দিন পরে মোটে কুড়িটি টাকা দিয়াছে। হুজুর, ভিজা ছালার টাকা— বালুচরে বহিয়া নিয়া আমার মাথার বেদনা ধরিয়াছিল, এখনও সারে নাই! হুজুর আমি যেন দাগু বেটার চিনির বলদ।

ইন্। তুমি যদি চুরির সব কাণ্ডকারখানা খুলিয়া বল, তবে তোমাকে আর চালান দিব না।

ফর। হুজুর, সেই কাণ্ডকারখানা আপনি শুনিলে তাজ্জব হইবেন। আমি সত্য ছাড়া এক বিন্দুও মিথ্যা বলিব না। আহা! হুজুর যদি হোমরা-চোমরাদিকের আগে আসিতেন, তবে বড়বাবুর ফাটক হইত না। হুজুর, তাঁর মত ভাল লোক এদেশে নাই। আমার মনে হলে তাঁর জন্য কান্না আসে!

ইন্। কে কে টাকা চুরি করিয়াছে?

ফর। রতীশ বাবু আর দাগু।

ইন্। কেমন করিয়া চুরি করিল?

ফর। হুজুর, প্রথমে টের পাই নাই। শেষে আস্তে আস্তে সব মালুম হইয়াছে।

ইন্। খুলিয়া বল।

ফর। যেদিন দুষ্টেরা টাকা চুরি করে, সেই দিন শনিবার ছিল। বড় বাবুর মন আগে থাকিতেই কি কারণে যেন খারাপ হইয়াছিল। কাজ কাম উদাসভাবে করিতেন, ভুল-ভ্রান্তি খুবই হইত।

ইন্। কি কাজে ভুল করিতেন?

ফর। তাই ত’ বলিতেছি, শুনেন না?

ইন্। (হাসিয়া) আচ্ছা বল।

ফর। উব্দা করে দোয়াতে কলম দিতেন।

ইন্। থাক আসল কথা বল।

ফর। বড়বাবুর ভুলের কথা বলি নাই; এখন আসল!

ইন্। (মৃদুহাস্যে) তবে তাড়াতাড়ি বল।

ফর। একদিন বাবু আমাকে বলিলেন, –’ফরমান বাবাজি, এক বদনা পানি আন ত’।’ আমি পানি আনিয়া দিলাম। বাবু চোখ বুজিয়া ফুরসী টানিতে শুরু করিলেন। অনেকক্ষণ টানিয়া টানিয়া কহিলেন, “ফরমান কি পানি দিলে হে, ধুঁয়া ত’ বাহির হয় না?’ আমি বললাম—”বাবু, পানি দিয়া কি ধোঁয়া বাহির হয়? তখন বাবুর চৈতন্য হইল। কহিলেন, ‘আরে না, পানি নয়, আগুন দাও।’

ইন্। তুমি মদ খাও নাকি?

ফর। তওবা, তওবা। আপনার বুঝি অভ্যাস আছে?

ইনস্পেক্টার সাহেব রাগ করিয়া কহিলেন, “বাচলামী রাগ, কেমন করিয়া কে কত টাকা চুরি করিয়াছে তাই বল।”

ফর। ভাবিয়াছিলাম আপনি বুঝি সক্রেটিস, তা এখন টের পাইলাম আপনি বাবা শা- ফরিদের দাদা।

ইন্। (ফরমানের দিক চাহিয়া) তুমি ওসকল নাম কিরূপে জান?

ফর। আপনি কি আমাকে চাষা মনে করেন?

ইন্। (হাস্য করিয়া) না, না, তুমি বিশিষ্ট ভদ্ৰলোক।

ফর। তবে শুনেন,—সেই শনিবার দুপুরের পর বড় বাবু অফিস-ঘর হইতে মসজিদে নামাজ পড়িতে গেলেন। দাগু বেটা আমাকে কহিলেন, ‘ফরমান, তুমি মসজিদের পথ আগুলিয়া দাঁড়াইয়া থাক; বড়বাবু মসজিদ হইতে বাহির হইলেই আমাদিগকে সংবাদ দিবে। রতীশ বাবু কহিল, ‘প্রিয় ফরমান, তুমি জান বড়বাবু নিজে দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার তামাক খান, কিন্তু আমাদের ভাগ্যে ২/১ বারও ঘটে না। তা’ এই অবসরে প্রাণভরে তামাক খাই, তুমি খুব সাবধানে বড়বাবুর আসার পথের দিকে চাহিয়া থাক।’ হুজুর রতীশ বাবু ও দাগু বেটার কল্যাণে দু’পয়সা উপরি পাই, তারা না দিলে উপায় নাই তাই তাদের কথামত কাজে প্রবিত্ত হইলাম। হুজুর, যদি জানতেম বড়বাবু ভুলে টেবিলের উপর ক্যাস বাক্সের চাবি রাখিয়া নামাজ পড়িতে গিয়াছেন, আর শালারা সেই অবসরে সিন্দুক খুলিয়া ছালা-বোঝাই টাকা পুষ্করিণীতে ডুবাইয়াছে তাহা হইলে কি আমি তাদের কথায় ভুলি? এমন বিশ্বাসঘাতক কাজের কথা আমি জন্মেও শুনি নাই, দেখা ত’ দূরের কথা।

ইন্। ঐরূপভাবে যে চুরি হইয়াছে, তুমি কত দিন পরে কেমন করিয়া জানিলে?

ফর। বড়বাবুর জেল হওয়ার পর চোরদের মুখেই শুনিয়াছি।

ইন্। তোমরা পুষ্করিণী হইতে টাকা কবে তুলিয়া বালুচরে রাখিয়াছিলে?

ফর। যেদিন বড়বাবু জেলায় চালান হইয়া যান সেই রাত্রিতে।

ইন্। তোমাকে কত টাকা দিয়াছিল?

ফর। মাত্র কুরি টাকা।

ইন্‌! তোমাকে ত’ খুব ঠকাইয়াছে?

ফর। হুজুর, না ঠকাইলে ফরমান মিয়ার কাছে এত খবর পাইতেন কিনা, সন্দেহের কথা বলিয়া মনে করুন।

ইনস্পেক্টার সাহেব অতঃপর দাগুকে ধরিয়া কহিলেন, ‘কোম্পানির টাকা চুরি করিয়া কোথায় রাখিয়াছ?’

দাগু। আমি কেন টাকা চুরি করিব?

ইস্পেক্টার সাহেবের হুকুমে তাহার অনুচরেরা দাশুর থাকিবার স্থান খুঁজিতে আরম্ভ করিল, কিন্তু কিছুই পাইল না।

ইন্। তোমার বাড়ি কোথায়?

দাগু। দুধের গ্রাম।

ইন্। গ্রামের নাম?

দাগু। আজ্ঞে হ্যাঁ।

ইন্। এখান হইতে কত দূর?

দাগু। দুই মাইল।

ইনস্পেক্টার সাহেব ঘরি দেখিয়া দাশুকে কহিলেন, “চল তোমার বাড়িতে যাইব।’ দাগুর মুখ শুকাইল। অনুচরেরা দাগুকে বাঁধিয়া লইয়া ইনস্পেক্টার সাহেবের পশ্চাদগামী হইল।

দাশুর বাড়ি তন্ন তন্ন করিয়া দেখা হইল, কোথাও কিছু পাওয়া গেল না; ইনস্পেক্টার সাহেব হতাশ হইয়া ফিরিতে উদ্যত হইলেন। ফরমান সঙ্গে গিয়াছিল, সে ইনস্পেক্টার সাহেবকে কহিল, “হুজুর, একটা জায়গা দেখা বাকি আছে, আমি গল্পে শুনিয়াছি, সেয়ানা চোরেরা চুরির মাল চুলার নিচে রাখে।’ ফরমানের কথা ইনস্পেক্টার সাহেবের মনে ধরিল। তিনি দাগুর রান্না ঘরের চুলা খুঁড়িতে অনুচরগণকে আদেশ করিলেন। আদেশানুসারে কার্য চলিল। চুলার অনেক নিচে মুখবন্ধ একটি তামার ডেকচি পাওয়া গেল। ভুলিয়া দেখা গেল পুরা দুই হাজার টাকাই পাত্রে রাহিয়াছে! ইনস্পেক্টার সাহেব উল্লসিত হইয়া কহিলেন, “ফরমান, তুমি বাঁচিয়া গেলে।“

ফরমান। আপনার মুখে ধান-দূর্বা।

অতঃপর ইস্পেক্টার সাহেব অনুমান করিলেন বালুচরে পৃথক পোতা যে এক ছালা টাকার জন্য রতীশ বাবু কালী ঠাকুরুণের শপথ করিয়াছেন,–নবা বলিয়াছে সে টাকা রতীশ বাবুই চোরের উপর বাটপারী করিয়া আত্মসাৎ করিয়াছেন। কারণ, ম্যানেজার সাহেব বলিয়াছেন, চারি ছালা টাকা খোয়া গিয়াছে, প্রত্যেক ছালায় দুই হাজার করিয়া টাকা ছিল। সুতরাং রতীশ বাবু এক ছালা টাকা লইলে তাঁহার রক্ষিতার ঘর হইতে নগদ মোট দুই হাজার নয়শত এবং বাকি সোনার ভরি ২৫ টাকা ধরিলে ২০ ভরি স্বর্ণের মূল্য ৫০০ টাকা অর্থাৎ মোট তিন হাজার দুইশত টাকা! অবশিষ্ট টাকা পাওয়া অসম্ভব। কারণ প্রমাণে নলিনীর যে অবস্থা জানা গেল, তাহাতে এক ছালা টাকা বাদে সে নিজে এক হাজার দুইশত টাকা জমাইতে পারে নাই। এখন দেখা যাইতেছে, মোট আট হাজারের মধ্যে আটশত টাকা নাই। এই টাকা হয় রতীশ না হয় নলিনীর নিকট আছে।

রতীশ বাবু যখন অবশিষ্ট টাকার কথা মোটেই স্বীকার করিলেন না, তখন ইনস্পেক্টার সাহেব স্থানীয় পোস্ট অফিসে উপস্থিত হইয়া মাস্টার বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানকার পাট অফিসে কেরানী রতীশ বাবু ২/১ সপ্তাহের মধ্যে সেভিংস ব্যাঙ্কে কোন টাকা জমা দিয়াছেন কি না? অথবা মনিঅর্ডারে কোথাও পাঠাইয়াছেন কি না?” পোস্ট মাস্টার বাবু খাতাপত্র দেখিয়া কহিলেন, ‘হ্যাঁ, চারিশত টাকার মনিঅর্ডার করিয়াছিলেন এবং চারিশত টাকা ব্যাংকে জমা দিয়াছেন।”

ইন্। কোথায় মনিঅর্ডার করিয়াছে?

পোস্ট। বাড়িতে তাঁহার পিতার নিকট।

রতীশ বাবুর সহিত পোস্ট মাস্টারের জানাশুনা ছিল। ইন্‌স্পেক্টার সাহেব রতীশ বাবুর পিতার নাম জানিয়া তখনি তার, করিলেন, “চারিশত টাকার মনিঅর্ডার পাঠাইয়াছি, এ পর্যন্ত প্রাপ্তি সংবাদ রসিদ না পাইয়া চিন্তিত আছি।” ইতি –

রতীশচন্দ্র—বেলগাঁও।

উত্তর আসিল, টাকা পাইয়াছি।

ইনস্পেক্টার সাহেব তখন আপন আনুমানিক কার্যের সত্যতা দেখিয়া খোদাতায়ালাকে অশেষ ধন্যবাদ করিলেন।

এইরূপে চুরি আস্কারা করিয়া ইনস্পেক্টার সাহেব ডাকবাংলায় চলিয়া গেলেন।

তিনি ডাকবাংলায় উপস্থিত হইলেন, জুট-ম্যানেজার সাহেবও তথায় আসিলেন।

ম্যানে। কল্পনার অতীত এমন জটিল চুরি আপনি কিরূপে আস্কারা করিলেন? আপনি সত্বর সুপারিন্টেণ্ডেন্ট হইবেন।

ইন্। ইহাতে আমার কৃতিত্ব কিছুই নাই।

ম্যানে। তবে কাহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে এমন ডাকাতি ধরা পড়িল?

ইন্। আপনারা যে নির্দোষ ব্যক্তিকে জেলে দিয়াছেন, তাঁহার সহধর্মিণীর সন্ধানে। ম্যানেজার সাহেব লজ্জিত ও দুঃখিত হইলেন। পরে কহিলেন, “তিনি অসূর্যস্পশ্যা, কিরূপে এমন সন্ধান করিয়াছেন?”

ইন্। আপনাদের তহবিল তছরূপের টাকা শোধের জন্য সতী গাত্রালঙ্কার প্রভৃতি বিক্রয় করতঃ শেষে উদরান্নের জন্য পরিধেয় শাড়ী বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, সেই সূত্রে

চোরের সন্ধান হয়।

ম্যানে। আমি নুরল এসলামের স্ত্রীর প্রতি-ভক্তিতে ক্রমশঃই বিস্ময় বিমুগ্ধ হইতেছি। পীড়িত পতির প্রাণরক্ষাই এই লোকাতীত ঘটনা! আবার এই এক আশ্চর্য ব্যাপার! খুলিয়া বলুন।

ইন্। আমাদের উকিল সাহেবকে আপনি জানেন। তাঁহার নিকট আপনার মহত্ত্বের ভূয়সী প্রশংসা শুনিয়াছি। তাহার স্ত্রী আপনাদের নুরল এসলাম সাহেবের স্ত্রীর সখী। নুরল এসলাম সাহেবের স্ত্রী, তাঁহার সখীকে পত্র লিখেন, “আমাদের খানাবাড়ীর প্রজা নবাব আলী শেখের স্ত্রী আমার নিকট হইতে ১৫৭ টাকা দিয়া দুইখানা শাড়ি কিনিয়া লইয়াছে। তাহার স্বামী দিন মজুরী করিয়া খায় সুতরাং এত টাকা সে কোথায় পাইল—জিজ্ঞাসা করায় ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, ‘আমার সোয়ামী কিছু টাকা কুড়াইয়া পাইয়াছে।’ সবিশেষ জিজ্ঞাসায় অবগত হইলাম, নবাব আলী বেলগাঁও জুট ম্যানেজার সাহেবের পুষ্করিণীতে রাত্রিতে মাছ ধরিতে যাইয়া একছালা টাকা পাইয়াছে। আমার বিশ্বাস, যে টাকার নিমিত্ত তোমার সয়া” – এই পর্যন্ত লিখিয়া পতিপ্রাণা আর কিছু লিখিতে পারেন নাই। আমি উকিল সাহেবের নিকট এই চিঠি দেখিয়াছি। তিনি এই চিঠি লইয়া ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখাইয়া সব খুলিয়া বলেন; ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে তদন্তের জন্য পাঠাইয়াছেন।

ম্যানেজার সাহেব শুনিয়া সহর্ষে বলিয়া উঠিলেন, “জগতে সতী-মহাত্ম্যের তুলনা নাই।”

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

যথাসময়ে ইস্পেক্টার জহরুল আলম সাহেব রতীশ ও নলিনী প্রভৃতি আসামীগণকে চুরির মালসহ জেলায় চালান দিলেন। মনিঅর্ডার ও সেভিংস ব্যাঙ্কের টাকাও সত্ত্বর আনয়ন করা হইল। ম্যাজিস্ট্রেট নানাবিধ বিবেচনা করিয়া মোকদ্দমা দায়রায় দিলেন।

নবা ও ফরমান বাঁচিবার আশায়, জজকোর্টে চুরির সমস্ত কথা খুলিয়া সাক্ষ্য দিল। ম্যানেজার সাহেব পুনরায় সাক্ষীর আসনে দাঁড়াইলেন। চুরির সত্যতার জন্য আসামীগণের বিরুদ্ধে যাহা নাজাই ছিল, উকিল সাহেবের জেরার কৌশলে তাহা বাহির হইয়া পড়িল। রতীশ সরকারের নিকট যে নোট পাওয়া গিয়াছিল ইনস্পেক্টার সাহেবের সূক্ষ্ম তদন্তের ফলে সেই নোটের নম্বরই তাহাকে প্রকৃত চোর বলিয়া ধরাইয়া দিল। বিচারের দিন নুরল এসলামকে জেল হইতে জবানবন্দীর নিমিত্ত বিচারালয়ে আনা হইল। তাঁহাকে বেনারসী ও নীলাম্বরী শাড়ী দেখাইয়া জজ সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ শাড়ী চিনেন? নুরল এসলাম শাড়ী দেখিয়া মূর্ছিত হইবার উপক্রম হইলেন। উকিল সাহেবের ইঙ্গিতে জনৈক চাপরাশী তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া নিচে লইয়া গেল। জজ সাহেব এসেসারগণকে বিশেষভাবে মোকদ্দমা বুঝাইয়া দিলেন। পরে সকলের মত এক হইলে তিনি রায় লিখিলেন, আসামী রতীশ সরকার ও দাগুকে বিশ্বাসঘাতকতা ও চুরির অপরাধে ১০ বৎসর, পৃষ্ঠপোষক নলিনীর প্রতি ৩ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড বিধান করা হইল। ইনস্পেক্টার সাহেবের বিশেষ অনুগ্রহে নবা ও ফরমান বাঁচিয়া গেল। সঙ্গীন চুরি আস্কারা করার জন্য নুরল এসলাম সাহেবের স্ত্রী গবর্নমেন্ট হইতে পুরষ্কার প্রাপ্তির যোগ্যা, জজ সাহেব রায়ের উপসংহারে একথা উল্লেখ করিতে ত্রুটি করিলেন না।

প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়িয়া শাস্তি পাওয়ায় আপিলে নুরল এসলাম বেকসুর খালাস পাইলেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

উকিল সাহেব বন্ধুকে সঙ্গে করিয়া বাসায় আসিলেন। হামিদা উল্লাসে আত্মহারা হইয়া পড়িল। তখনই রতনদিয়া ও মধুপুরে তার করা হইল।

আনোয়ারা যেরূপ নিজের সর্বস্ব দিয়া কোম্পানির দাবির টাকা শোধ করিয়াছে; যেরূপ শাড়ী বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়া চোরের সন্ধান করিয়াছে; নুরল এসলাম বাসায় আসিয়া উকিল সাহেবের নিকট তাহার সমস্ত অবগত হইলেন।

রাত্রিতে আহারান্তে উকিল সাহেব নুরল এসলামকে পরিহাস করিয়া কহিলেন, “দোস্ত, বাড়ি যাইয়া আবার সই-এর মনে ব্যথা দিবে না কি?” নুরল কহিলেন, “ব্যথা? বাড়ি যাইয়া তাহাকে মুখ দেখাইব কিরূপে তাহাই ভাবিতেছি।” হামিদা আড়ালে থাকিয়া অস্ফুটস্বরে কহিল, “ভাবিয়া কি করিবে? পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাহিতে হইবে। ছি, ছি, পুরুষগুলো কি, হালকা, লোকপবাদে এহেন সাধ্বী সতী পত্নীর প্রতি সন্দেহ!”

এদিকে তারের সংবাদে নুরল এসলামের বাড়িতে আনন্দের রোল পড়িয়া গেল। গৃহস্বামীর কারামুক্তিতে সকলেই সহর্ষে নিশ্বাস ত্যাগ করিল; আনোয়ারা রাত্রিতে ঘরে আসিয়া এশার নামাজ অন্তে খোদাতায়ালার শোকর গোজারীর জন্য দুই রেকাত নফল নামাজ পড়িল। শেষে ঊর্ধ্বহস্তে মোনাজাত করিতে লাগিল, ‘দয়াময়! তোমার অপরিসীম অনুগ্রহে আজ দাসীর নারী জন্ম ধন্য হইল। প্রভো! যেদিন আমি পতিরমুখে প্রথম কোরান শরীফ ও মোনাজাত শুনিয়াছিলাম, সেইদিন এইরূপ আনন্দলাভ করিয়াছিলাম; যেদিন প্রিয়তমের প্রাণরক্ষা হইবে মনে করিয়া নিজ প্রাণদান-সঙ্কল্পে সঞ্জীবনী লতা তুলিতে গিয়াছিলাম; সেইদিন যেরূপ সুখী হইয়াছিলাম, আজ প্রভো সেইরূপ”–বলিতে বলিতে সতীর চক্ষু দিয়া আনন্দের অশ্রুধারা বিগলিত হইতে লাগিল। সে অপরিসীম আনন্দে আত্মবিস্মৃত হইয়া ভাবিতে লাগিল, “স্বামী বাড়ি আসিলে তাঁহাকে কিভাবে সম্ভাষণ করিব? আগে কোন কথাটি বলিয়া তাঁহার মনস্তুষ্টি বিধান করিব? হায়! কারাক্লেশে না জানি তাঁহার শরীর কত কৃশ, কত মলিন হইয়া গিয়াছে? কি কি ভাল খাদ্য প্ৰস্তুত করিয়া তাঁহাকে খাওয়াইব? কেমন করিয়া তাঁহার শরীর সুস্থ করিব?” সতী আবার ভাবিতে লাগিল, “আচ্ছা, এবারো যদি তিনি আমার সহিত মন খুলিয়া কথা না বলেন, তবে কি করিব? কেন? আমি কি তাঁহার ধর্মপত্নী নহি, কোন্ অপরাধে তিনি আমার প্রতি বাম হইবেন?” সহসা নবার বৌ-এর ঘৃণিত কথা তাহার স্মৃতিপটে উদিত হইল। সতী তখন শিহরিয়া উঠিল। তাহার পতি পরায়নতা-সুলভ সুকল্পনা নিমিষে অন্তর্হিত হইল। তাহার মনে হইল, ‘অহো! আমি যে পরাপহৃতা, আমি যে লোকপবাদে কলঙ্কিনী,—আমার দোসেই ত স্বামীর কারাবাস! অতএব আমার ন্যায় হতভাগিনী কি স্বামী-সহবাস সুখের আশা করিতে পারে? হায়! এখন আমার কর্তব্য কি? খোদা তুমি এই মন্দভাগিনীর কর্তব্য বুঝাইয়া দাও! তুচ্ছ ভোগ-বাসনায় স্বামী সহবাসে তাঁহার চির-পবিত্র জীবন চির কন্টকময় করিব? ধিক্ দুনিয়া। শতধিক্ কামনা!”

অতঃপর যুবতী নিমিষে কর্তব্য নিরূপণ করিয়া লইল। কর্তব্য নির্ণয়ের সহিত তাহার কমনীয় মূর্তি সংযমের কঠোরতায় উদ্দীপ্ত হইতে লাগিল, যেন দ্বাদশ সূর্য কিরণে শতদল হাসিয়া উঠিল। সতীর মনের ভাব আর কেহ বুঝিল না, তাহার আকৃতির প্রতিও কেহ লক্ষ্য করিল না। কেবল নৈশ প্রকৃতি যেন যে স্বর্গাদপি গরীয়সী মূর্তি নীরিক্ষণ করিয়া নীরবে স্তম্ভিত হইয়া রহিল। প্রকৃত যেন গৃহস্তগৃহে অমন অগ্রতপা, জ্যোতির্ময়ী যোগিনীমূর্তি আর কোথাও দেখে নাই। তাই সে সভয় দেখিতে লাগিল,—এ মূর্তি মৃত-সঞ্জীবনীব্রতের মূর্তি নহে। তাহাতেও ইহাতে অনেক প্রভেদ- অনেক অন্তর। সে মূর্তি মৃতের শান্তিময় সমাধির উপর স্থাপিত ছিল, আর এ মূর্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দাহনশীল, জীবন-জ্বালাময় সংযমের পাদপিঠে প্রতিষ্ঠিত। সে মূর্তি চাঁদের অমিয় কিরণে হাসিত আর এ মূর্তি প্রখর রবিকরে উদ্ভাসিত। তাহার কামনা ছিল,—পতির রোগমুক্তি, সঞ্জীবণীব্রত তাহার আরম্ভ, প্রাণদানে পর্যবসিত! আর ইহার সাধনা—পতির লোকাপবাদ মোচন, সহবাস ত্যাগ আরম্ভ, চির কঠোর সংযমে সমাপ্ত।

সতী আজ সংসারের যাবতীয় সুখ সার্থ বিসর্জন দিয়া নীরবে যোগ-সাধনায় নিজের কর্তব্য সুদৃঢ় করিয়া লইল।

প্রাতঃকালে আনোয়ারা স্বামীর শয়ন-ঘর সজ্জিত করিতে আরম্ভ করিল। নুরল এসলাম কারাগারে যাইবার পর, আনোয়ারা আর সে ঘরে প্রবেশ করে নাই। দক্ষিণদ্বারী ঘরে ফুফু- আম্মার সহিত কালযাপন করিয়াছে। সে আজ স্বামীর ঘরে প্রবেশ করিয়া প্রথমে স্বামীকে প্রাণাধিক প্রিয় সোনার জেকরা কোরান শরীফটি বাহির করিয়া ভক্তির সহিত চুম্বন করিল; পরে নিজ অঞ্চলে ঝাড়িয়া-মুছিয়া যথাস্থানে রাখিয়া দিল। তাজমহলের ফটোখানিও ঐরূপে পরিষ্কার করিল। স্বামীর পরম আদরের পরম সাধের লাইব্রেরীর পুস্তকগুলি আলমারীসহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া রাখিল। গদী, তোষক, খাট, টেবিল, চেয়ার, দর্পণ, চিরুণী প্রভৃতি আসবাবপত্র পরিপাটিরূপে মার্জিত করিয়া যথাস্থানে স্থাপন করিল। ব্যবহারাভাবে পতির রৌপ্যফুরসী হুকা ও পাদুকা-যুগলে যে ময়লা ধরিয়াছিল, আনোয়ারা যত্নের সহিত তাহা পরিষ্কার করিয়া রাখিল। ফলতঃ স্বামী বাড়ি আসিয়া ঘর-দ্বার অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন দেখিয়া বিরক্ত না হয়, এ নিমিত্ত সে সারাদিন তাহার সুশৃঙ্খলাবিধানে ব্যাপৃত রহিল।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

এদিকে উকিল সাহেব নিজের পাল্কী করিয়া দোস্তকে বাড়ি পাঠাইলেন। পথিমধ্যে সাধ্বী পত্নীর অলৌকিক পতি ভক্তির ঘটনাবলী একে একে নুরল এসলামের হৃদয়ে জাগিয়া উঠিতে লাগিল, সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে অন্যায় প্রত্যাখ্যান নিত্তি অনুতাপের অগ্নি তাঁহাকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিল। নুরল এসলাম দহনজ্বালায় ক্রমে অস্থির হইয়া উঠিল। তখন চিরসহচর প্রেম, বন্ধুকে বিপন্ন দেখিয়া তাঁহার কানে কানে যেন কহিল, “চল, আমরা বাড়ি গিয়া এবার সতীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিব; তাহা হইলে অনুতাপের দাহিকাশক্তি হ্রাস হইয়া যাইবে।” নুরল এসলাম কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া অপরাহ্নে বাড়ি পৌঁছিলেন।

তাঁহাকে দেখিয়া বাড়ির সকলে আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিল। সরলা ফুফু-আম্মা ছেলের কাছে যাইয়া হর্ষ বিষাদের অশ্রু উপহার দিলেন; সোহাগে ছেলের মুখে হাত বুলাইতে লাগিলেন। সালেহা সোৎসুক দৃষ্টিতে ভ্রাতাকে দেখিতে লাগিল। দাস-দাসী ও প্রতিবাসী জনমন্ডলীর আনন্দের সীমা রহিল না। তাহাদের যেন কতকালের অভাব অভিযোগ নিমেষে পূরণ হইয়া গেল। কিন্তু যে জন এই মুক্তিমহানন্দের মূলীভূতা, সে এ সময়ে কোথায়? যে নুরল এসলামের বৈষয়িক চিন্তা দূরীকরণমানসে ত্রি-সহস্র মুদ্রার দেনমোহর দলিল অম্লানচিত্তে ছিন্ন করিয়া তাঁহার চরণে উৎসর্গ করিয়াছে, যাহার লোকাতীত সতীত্ব গুণে নুরল এসলাম দুরারোগ্র ব্যাধির করাল গ্রাস হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছেন, এ সময়ে সে কোথায়? যে জন পৈত্রিক-প্রাপ্ত নিজস্বধন সর্বস্ব দিয়া নুরল এসলামের বিষয় রক্ষা করিয়াছে, গাত্রালঙ্কার তাঁহাকে দায়মুক্ত ও পরিধান বস্ত্র বিক্রয়ে তাঁহাকে কারামুক্ত করিয়া আজ গৃহে আনিয়াছে, সেই সতীকূল-পাটরাণী এখন কোথায়?

নুরল এসলাম স্ত্রীর সাড়াশব্দ না পাইয়া শয়নঘরের দিকে, রন্ধনশালার দিকে পলকে পলকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন; কিন্তু হায়! নিষ্ফল দৃষ্টি। শেষে তিনি অধীরভাবে নিজে শয়নঘরে প্রবেশ করিলেন,—গৃহ শূন্য। চতুর্দিক দৃষ্টিপাত করিলেন, দেখিলেন, –গৃহে আছে সবই, কিন্তু কিছুই যেন নাই। আসবাবপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ঝক্‌ক করিতেছে, তথাপি গৃহ সৌন্দর্যহীন। আরও বিষাদের অন্ধকার যেন সেই শূন্য গৃহে জমাট বাঁধিয়া হা-হুতাশ করিতেছে। নুরল এসলাম সভয়ে প্রণয়ের আবেগে ডাকিলেন, “আনোয়ারা!” প্রতিধ্বনি কহিল, “কোথায় আনোয়ারা?” নুরল এসলামের হৃদয়ে তখন বিষাদ-নৈরাশ্যের ঝড় বহিতে লাগিল, স্ত্রীকে না দেখিয়া তিনি দশদিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন।

নুরল এসলাম যখন পাল্কী হইতে নামিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেন, তখন আনোয়ারা দক্ষিণদ্বারী ঘরে একটি ক্ষুদ্র জানালা পার্শ্বে অলক্ষিতে দাঁড়াইয়া স্বামীকে দেখিতেছিল। কারাক্লিষ্ট পতির মলিন মূর্তি দেখিয়া তাহার চক্ষু দিয়া দরবিগলিত ধারা বহিতে লাগিল। স্বামী যখন এখন এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করিয়া শূন্যমনে শয়নঘরে প্রবেশ করিলেন, তখন তাঁহার চরণসেবা করিতে সতী আর অগ্রসর হইতে পারিল না। নিজের ঘর, নিজের স্বামী, সমস্তই সম্মুখে, সমস্তই নিকটে; অথচ সে যেন বহু যোজন দূরে অবস্থিত। সংযমের কঠরতায় আজ সতীর বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

নুরল এসলাম শয়নগৃহে প্রবেশের কিয়ৎকাল পরে দাসী তামাক সাজিয়া তথায় উপস্থিত হইল। দাসীকে দেখিয়া নুরল এসলামের হৃদয়ে আরও উদ্দামবেগে ঝড় বহিতে লাগিল। তাঁহার বুক ভাঙ্গিয়া যাওয়ার মত হইল। অজ্ঞাতে আবেগ-উচ্ছ্বাসে তাঁহার মুখ দিয়া হঠাৎ বাহির হইল “আনোয়ারা!” দাসী মনে করিল, আমাকেই বুঝি জিজ্ঞাসা করিলেন, তাই সে কহিল, “তিনি দক্ষিণদ্বারী ঘরে বসিয়া কাঁদিতেছেন।” দাসীর কথায় নুরল এসলাম হঠাৎ মৃতদেহে প্রাণ পাইলেন। স্ত্রীর অস্তিত্ব পরিজ্ঞাতে তাঁহার তাপ দগ্ধ হৃদয়ের জ্বালা মন্দীভূত হইয়া আসিল। তিনি দাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ফুফু-আম্মা কোথায়?”

দাসী! তিনি রান্নাঘরে গিয়াছেন।

নুরল অতি মাত্রায় ব্যগ্রভাবে দক্ষিণদ্বারা ঘরে প্রবেশ করিলেন! আনোয়ারা স্বামীকে দেখিয়া দাঁড়াইয়া থর্ থর্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল। নুরল তাহার দিকে অগ্রসর হইতেই আনোয়ারা বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “দাসী অস্পৃশ্যা।” গুরুতর অপরাধের নিদারুন অনুতাপ- চিহ্ন নুরলের মুখমণ্ডলে নিমিষের মধ্যে প্রকাশিত হইয়া পড়িল। তিনি করুণ স্বরে কহিলেন, “সতী পাপীর অস্পৃশ্যই বটে।”

আনো। আপনি চির পুণ্যবান—দাসী পরাহৃতা-অপবাদ কলঙ্কিনী, তাই আপনার ন্যায় পবিত্র মহাত্মার পক্ষে অস্পৃশ্যা।

নুরল। আমি ভ্রান্ত কল্পনার বশীভূত হইয়া তোমা হেন সতীরত্নকে অবজ্ঞা করিয়া যথেষ্ট মর্মযাতনা পাইয়াছি। সন্দেহের চক্ষে দেখিয়া তোমার হৃদয়েও অনেক ব্যথা দিয়াছি, কিন্তু প্রিয়তমে—আমার প্রতি চিরদিনই তোমার ভালবাসার সীমা নাই। আমি না বুঝিয়া তোমর পবিত্র সরলতাপূর্ণ হৃদয়ের সহিত বড়ই দুর্বব্যহার করিয়াছি। প্রিয়ে! যে প্রেমপূর্ণ সরলতা প্রকাশে নুরলকে কিনিয়াছ, সেই সরলতা পূর্ণ ভালবাসা দানে দয়া করিয়া আজ আমার সেই অপরাধ ক্ষমা করিবে কি? আমি নরাধম! তোমা হেন সতীর উপর সন্দেহ করিয়া যেরূপ পাপ করিয়াছি কিছুতেই তাহার প্রায়শ্চিত্ত হইতে পারে না। নিরপরাধ কুটিলবোধবিহীনা সাধ্বী সতীর কোমল প্রাণে যে ব্যথা দিয়াছি, ইহজন্মে আমার হৃদয় হইতে তাহা অপনীত হইবে না। এ অকিঞ্চিৎকর পাপ জীবনের সহিত সে নিদারুণ অনুতাপের সম্বন্ধ চিরদিনই থাকিবে, আজ আমি তোমার নিকট ক্ষমার ভিখারী।

বলিতে বলিতে নুরল এসলাম সাশ্রুনয়নে আনোয়ারার হাত ধরিলেন। হৃদয়ের অসীম যাতনায় ও শোকোচ্ছ্বাসে নিতান্ত কাতর হইয়া অশ্রুজলে প্রিয়তমার পবিত্র হস্ত প্লাবিত করিতে লাগিলেন। আনোয়ারা অতি যত্নে স্বামীকে প্রকৃতিস্থ করিয়া তাহার চরণে পড়িল এবং কোকিল কন্ঠে গভীর প্রেমের আবেগে কহিল, “আপনাকে ক্ষমা? আপনার দুর্বাক্য যাহার কর্ণে মধু বর্ষণ করে, যে আপনার চরণের ভিখারিণী,—তাহার নিকট ক্ষমা?—কিন্তু নাথ! আপনি যে ভ্রমে আমাকে চরিত্রহীনা বলিয়া মনে স্থান দিয়াছেন, আজ দাসী সে কলঙ্ক মোচনে মুক্তকণ্ঠে তাহার প্রতিবাদ করিবে।”

নুরল। জীবিতেশ্বরী! আমার মন ভ্রান্ত হইয়াছিল বটে কিন্তু অজ্ঞানান্ধকারে দিগ-ভ্রান্ত হইয়া, আমার হৃদয় সন্দেহমার্গে পরিভ্রমণ করিয়াছিল সত্য; কিন্তু চিত্ত অনুতাপে দগ্ধ হইতেছে। প্রাণেশ্বরী! তুমি ভিন্ন আমার এ জগতে আর কেহ নাই; আমি তোমার পবিত্র সংসর্গে এ কলুষিত দেহ পবিত্র করিব। অজ্ঞানান্ধ নুরলের যত কিছু পাপ হওয়া সম্ভব, প্রাণেশ্বরী! সে সকল পাপেই সে মহাপাপী। যদি সে সকল অজ্ঞানকৃত পাপের আর প্রায়শ্চিত্ত না থাকে; তবে তোমার সাক্ষাতেই জীবন ত্যাগ করিয়া এ পাপ-পঙ্কিল দেহ বিসর্জন দিব।

আনো। প্রাণেশ্বর, ইচ্ছাপূর্বক আপনি আমাকে মনকষ্ট দেন নাই, এজন্য আপনাকে দোষী হইতে হইবে না। অদৃষ্টের দোষে নিজে দুঃখ পাইলাম, আপনাকেও যথেষ্ট দুঃখ দিলাম। প্রিয়তম, স্বামিন! অভিন্নহৃদয় প্রাণেশ। আপনি পবিত্র, প্রেমময়! আপনার প্রেমের কণিকা লাভের জন্যও আমি ভিখারিণী! আপনি আমার জীবনের একমাত্র ধ্রুবতারা, আপনার হৃদয়ে আমার স্থান নাই জানিয়াও এ শূন্য হৃদয়ে প্রিয়তম লাভের শেষ আশা পোষণ করিত জীবিত রহিয়াছি; কিন্তু আপনি ভাল করিতেছেন না, এই হতভাগিনীর সহবাসে থাকিয়া আপনি আর সুখী হইতে পারিবেন না, লোকাপবাদে আপনার কর্মময় জীবনে চিরঅশান্তি আসিয়া হৃদয়তন্ত্রী ছিন্ন ছিন্ন করিয়া দিবে। অতএব দাসীর প্রার্থনা, আপনি পুনরায় বিবাহ করিয়া বংশরক্ষা ও সংসারধর্ম পালন করুন। আপনার সুখের জন্যই আমার জীবন, আপনার সুখে আমার সুখ। এই নিমিত্ত গতরাত্রিতে আমি সঙ্কল্প স্থির করিয়াছি, লোকপবাদ মোচনের জন্য আপনার সহবাস-সুখ বিসর্জন দিব। অতএব দাসীর এই দৃঢ়ব্রত আর ভঙ্গ করিবেন না। দাসীর শেষ প্রার্থনা, খোদা তায়ালার অনুগ্রহে আপনি বিবাহ করিয়া চির সুখী হউন, কিন্তু দাসীকে চরণ-ছাড়া করিবেন না। দাসী যেন দাসীবৃত্তি অবলম্বনে আপনার পুণ্যধামে থাকিয়া প্রত্যয় আপনার পবিত্র সুন্দর মুখশ্রী সন্দর্শন করিয়া—জীবিতকাল অতিবাহিত করিতে পারে। আমি কলঙ্কিনী হইলেও আপনার দাসী।

সতীর অশ্রুপূর্ণ নিষ্কাম প্রেমপূর্ণ বাক্যগুলি মিছরির ছুরির ন্যায় নুরল এসলামের হৃদয় দীর্ণ-বিদীর্ণ করিয়া ফেলিল। তিনি অভিমান-ব্যাকুলচিত্তে কহিলেন, “অনুতাপের দাবানলে ভষ্মীভূত হইয়াছি, আর দগ্ধ করিও না।”

আনো। আপনি অকারণ অনুতাপ করিবেন না। যাহা বলিলাম ভাবিয়া দেখুন তাহাই আপনার পক্ষে শ্ৰেয়ঃ।

নুরল। আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি—জগতের শিক্ষার্থে যাহার স্ত্রী তোমার ন্যায় ব্রতী তাহার জীবন ধন্য। তোমার মত স্ত্রী যার ঘরে তার মর্ত্যেই স্বর্গ।

কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া পরে গুরুগম্ভীর স্বরে আবার কহিলেন, “আমি আর অধিক বলিতে চাই না প্রিয়তমে, তুমি শত কলঙ্কে কলঙ্কিনী হইলেও আজ তাহা পবিত্র বিশ্বাস- তুলিকাতে মুছিয়া ফেলিলাম, তুমি রমণীরত্ন! তোমাকে আমি ক্লেশ দিয়াছি। সংসার যায়, যাউক;–লোকসমাজে অপমানিত হই, হইব,—হৃদয় অশান্তি-শ্মশান হয়, হউক;—অদ্য আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি—আনোয়ারা! তুমি আমার পরম ধার্মিকা সতী-সাধ্বী পত্নী। ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশতী হইয়া আর তোমায় কষ্ট দিব না। তুমি আমার অজ্ঞানকৃত অনাদর ভুলিয়া যাও এবং তোমার সঙ্কল্প পরিত্যাগ কর; নচেৎ এখনই তোমার সম্মুখে আত্মঘাত হইয়া সর্বদুঃখের অবসান করিব।” প্রেমাভিমানের কঠোরতায় নুরল এসলামের হৃদয় চিরিয়া, কথাটি বিদ্যুদ্বেগে সতীর প্রেমময় হৃদয়ের অন্তস্তলে প্রবেশ করিল। তখন সে আর স্থির থাকিতে পারিল না। পতি-হত্যা মহাপাপজনিত আশঙ্কায় তাহার কঠোর সঙ্কল্প তিরোহিত হইল। সে তৎক্ষণাৎ পতির চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করিল।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

অতঃপর অনন্ত সুখ-শান্তির মধ্য দিয়া প্রেমশীল দম্পতির দিন যাইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে ছয়মাস অতীতের গর্ভে বিলীন হইল। তারপর আর এক দুর্ঘটনায় আনোয়ারার হৃদয় ভাঙ্গিয়া পড়িল। তাহার সংসার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অবলম্বন দাদিমার উদরাময় রোগে মৃত্যু হইল। বৃদ্ধার মৃত্যুর সময় আপন গাত্রালঙ্কার যাহা এতকাল সিন্দুকে পুরিয়া রাখিয়াছিলেন, তৎসমস্ত ও নগদ ১৫ শত টাকা এবং ১১টি আকবরী মোহর আনোয়ারাকে দিয়া গেলেন। আনোয়ারা দাদিমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পাঁচশত টাকা ব্যয় করিল।

নুরল এসলামের কারামুক্তির পর গবর্নমেন্ট জুট-কোম্পানির অপহৃত আট হাজার টাকা ম্যানেজার সাহেবকে বুঝাইয়া দিলেন। ম্যানেজার সাহেব পূর্বেই উকিল সাহেবের নিকট অপহৃত চারিহাজার টাকা বুঝিয়া পাইয়া নুরল এসলামকে অব্যাহতি দিয়াছিলেন। এক্ষণে তিনি তাঁহার মহান মহত্বের নিদর্শন-স্বরূপ গবর্ণমেন্ট হইতে প্রাপ্ত আট হাজার টাকা নুরল এসলামকে ফেরত দিলেন। নুরল এসলাম টাকাগুলি লইয়া স্ত্রীর নিকট দিয়া কহিলেন, “এই টাকা হইতে তোমার নগদ দেওয়া টাকা বুঝিয়া লও। অবশিষ্ট টাকা দোস্ত সাহেবকে দিতে হইবে। তিনি আমার জন্য যাহা করিয়াছেন, এ ভবে তাহার তুলনা নাই, তাঁহার ঋণ অপরিশোধ্য।” আনোয়ারা হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা, টাকা লইলাম; কিন্তু এ টাকা এক্ষণে আমি আর কাহাকেও দিব না। আমার একটা প্রার্থনা শুনিতে হইবে।” নুরল সোৎসাহে কহিলেন, “তোমার আদেশ-উপদেশ আমার শিরোধার্য” আনোয়ারা কহিল, “আদেশ- উপদেশ নয়, বাঁদীর আরজ,—আপনাকে আর আমি কোম্পানীর চাকরি করিতে দিব না। এই টাকা আর দাদিমার দত্ত হাজার টাকা লইয়া আপনি স্বাধীনভাবে ব্যবসা আরম্ভ করুন।” নুরল এসলাম স্ত্রীর বৈষয়িক যুক্তি-বুদ্ধির কথা শুনিয়া মনে মনে খোদতোয়ালাকে অশেষ ধন্যবাদ প্রদান করিলেন। প্রকাশ্যে কহিলেন, ‘আমি যে আশা চিরদিন হৃদয়ে পোষণ করিয়া আসিতেছি, তোমার কথাতে তাহা আজ ব্যক্ত হইল। আমি আর কোম্পানির চাকরি করিব না। স্বাধীনভাবে বেলগাঁয়-এ পাটের ব্যবসা অবলম্বন করিব

এই সময়ে একদিন নুরল এসলাম একটি ইসিওর পার্শ্বেল ডাকপিয়নের নিকট পাইলেন। খুলিয়া দেখিলেন, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট চোরের অনুসন্ধান করিয়া দেওয়ার জন্য তাঁহার স্ত্রীকে পুরস্কারস্বরূপ তিনশত টাকা মূল্যের এক ছড়া হার ও দুই শত টাকা মূল্যের একজোড়া বালা পাঠাইয়াছেন।

নুরল হাসিতে হাসিতে স্ত্রীকে বলিলেন, “ডিটেকটিভ মশাই, আপনার গোয়েন্দাগিরির পুরষ্কার নিন।” আনোয়ারা কিছু বুঝিতে না পারিয়া কহিল, “খুলিয়া বলুন না, ব্যাপারখানা কি?”

নুরল। আপনি শাড়ী বিক্রয় করিতে বসিয়া যে চুরির সন্ধান করিয়াছিলেন, সেইজন্য সরকার বাহাদুর খুশি হইয়া এইগুলি বক্‌সিস পাঠাইয়াছিলেন।

এই বলিয়া নুরল সাদরে স্ত্রীর কমনীয় কণ্ঠে হেমহার এবং হস্তে স্বর্ণবলয় পরাইয়া দিলেন। আনোয়ারা প্রফুল্ল মুখে স্বামীর পদচুম্বন করিয়া কহিল, “ইহা আপনার ব্যবসায়ের প্রাথমিক সুখলক্ষণ বলিয়া জানিবেন।’

অতঃপর ম্যানেজার সাহেব নুরল এসলামকে চাকরীতে হাজির হইতে ডাকিলেন। নুরল বিনীতভাবে ম্যানেজার সাহেবের নিকট আপাততঃ ছয় মাসের ছুটি লইয়া বেলগাঁও এ পাটের ব্যবসা খুলিয়া দিলেন।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

এই সময় উকিল সাহেব, জেলার উপর বাসাবাড়িতে পুত্রের মুখে ক্ষীর দেওয়া উপলক্ষে দোস্তকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন এবং আনোয়ারাকে আনিবার জন্য পাল্কী-বেহারা প্রেরণ করিলেন।

নুরল স্ত্রীকে কহিলেন, সই-এর বাড়িতে যাইবে নাকি?

আনো। যদি অনুমতি পাই।

নুরল এসলাম ভগ্ন স্বরে স্ত্রীকে কহিলেন, “তোমার শরীরে কোন অলঙ্কার নাই, কি লইয়া ক্ষীরোৎসবে যাইবে?”

আনো। গলার স্বর ধরিয়া গেল যে! এরূপ দুঃখ প্রকাশ করিয়া কথা বলিতেছেন কেন?

নুরল। আমার দোষে তুমি তোমার গা-ভরা গহনা খালি করিয়াছ মনে হওয়ায় বুক ফাটিয়া যাইতেছে।

আনো। আপনি অকারণ দুঃখ করিতেছেন, আমি খালি গায়েই বেশ যাইতে পারিব। নুরল। সেখানে গহনা পরিয়া অনেক বড় বড় ঘরের বউ-ঝি আসিবে।

আনো। গহনা পরিয়া বেড়ান আমি মোটেই পছন্দ করি না।

নুরল। তথাপি আমার অনুরোধ, গবর্নমেন্টের দেওয়া হার, বালা, দাদিমার শেষ-দত্ত গহনা যাহা যেখানে সাজে পরিয়া যাও।

আনো। আমার অলঙ্কারাদি লইবার ইচ্ছা আদৌ নাই। পয়ন্ত দাদিমার সেরবরাদ্দ ওজনের অলঙ্কারের বোঝা আমি বহন করিতে কোন মতেই পারিব না।

নুরল। আচ্ছা, তবে হার ও বালা লইয়াই যাও, আর খোকার মুখ দেখার জন্য গুটি দুই তিন আকবরী মোহর লইয়া গেলে ভাল হয়।

আনোয়ারা অতঃপর স্বামীর আদেশ লইয়া উকিল সাহেবের বাসা-মোকামে রওয়ানা হইল।

এদিকে ক্ষীরদান মহোৎসবে উকিল সাহেবের অন্দরমহল কুলকামিনী কুলকলম্বরে কল- কলায়িত; বালক-বালিকাগণের ধাবন-কুর্দন-হর্ষক্রন্দন-কোলাহলে সুখ-তরঙ্গায়িত, পাচক- পাচিকাগণের পরস্পর দ্বন্দ্বে, পরস্পর রসালাপে, পরস্পর কর্ম-প্রতিযোগিতার উত্তেজনায় উচ্ছ্বসিত ও রবপূরিত হইয়া উঠিয়াছে। স্থানীয় জমিদার সাহেবের গৃহিনী, ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের পত্নী, স্কুল ইনস্পেক্টার সাহেবের বিবি, সেরেস্তাদার সাহেবের ভগিনী, দারোগা সাহেবের প্রথমা স্ত্রী, নাজির সাহেবের দুহিতা মৌলভী সাহেবের কাবিলা, মোক্তার সাহেবের বণিতা, শিক্ষক সাহেবের সহধর্মিনী প্রভৃতি গণ্যমান্য ভদ্রমহিলাগণের বেশ-ভূষার ঔজ্জ্বল্য ও নিক্কণে সেই ভাগ্যবান ব্যবহারজীবীর অন্তঃপুর আজ উদ্ভাসিত ও মুখরিত। আবার এই সকল ভদ্রমহিলা কেহ কুলাভিমানিনী, কেহ বড় চাকুরিয়ার ঘরণী বলিয়া গরবিনী, কোন ভামিনী আপাদবিলম্বী ঘনকৃষ্ণ চাঁচ-চিকুরাধিকারিণী বলিয়া অহঙ্কারিণী, কোন তরুণী বেশভূষায় মোহিনী সাজিয়া বাহুলতা অল্প দোলাইয়া দর্পভরে ধীরগামিনী; কোন সীমন্তিনী অতিমাত্রায় বিদুষা বলিয়া বঙ্কিমনয়নে অপরের উপরে কটাক্ষকারিণী। কেবল শিক্ষক-সহধর্মিণী বিলাস বিরাগিণী আত্মপ্রসাদভোগিনী বিনতা বিদূষী।

আনোয়ারা যথাসময়ে উকিল সাহেবের অন্তঃপুরে আসিয়া প্রবেশ করিল। হামিদা অগ্রগামিনী হইয়া পরমাদরে তাহাকে ঘরে তুলিয়া লইল। অনেক সুখ-দুঃখের কাহিনী মসীযোগে পত্রপৃষ্ঠে লেখনী-তুলিকায় চিত্রিত হইয়া আদান-প্রদান পর উভয়ের সন্দর্শন। কিয়ৎক্ষণ উভয়ে উভয়ের প্রতি চাহিয়া চাহিয়া সন্দর্শন-সুধা রস উপভোগ করিতে লাগিল। সঞ্জীবনী লতা তোলা ও শাড়ী বিক্রয় কাহিনী প্রভৃতি স্মরণ করিয়া হামিদা সইয়ের মুখের দিকে তাকাইয়া মনে মনে কহিল, ‘তুমি এমন কার্য করিয়াছ!’ জনৈক দাসী খোকাকে কোলে করিয়া উভয়ের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। আনোয়ারা সহর্ষে পরম স্নেহে ছেলে কোলে লইয়া তার মুখ চুম্বন করিল। শিশু অনিমেষে আনোয়ারার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। অতখানি সুন্দর মুখ দেখিয়া সে যেন মায়ের সুন্দর মুখও ভুলিয়া গেল।

কিয়ৎক্ষণ পর হামিদা আগন্তুক ভদ্রমহিলাদিগের সহিত সই-এর পরিচয় করাইয়া দিল। আনোয়ারা বিনা-অলঙ্কারে তাহাদের মধ্যে তারকারাজি বেষ্টিত শশধরসন্নিভ শোভা পাইতে লাগিল। ভদ্রমহিলাগণ বাহ্যভাবে আনোয়ারার সহিত শিষ্টাচার প্রদর্শন করিলেন বটে; কিন্তু তাহার অসামান্য রূপলাবণ্য দর্শনে অনেকেই স্ত্রীস্বভাব-সুলভ হিংসার বশবর্তিনী লইয়া উঠিলেন। সন্ধ্যার পূর্বে আনোয়ারা বাসায় পৌঁছিয়াছিল, আলাপ-পরিচয়ে সন্ধ্যা আসিল। তখন আনোয়ারা ও অন্যান্য রমণীগণ মগরেবের নামাজ পড়িতে কক্ষান্তরে প্রবেশ করিলেন, কেবল ডেপুটি-পত্নী ও দারোগার স্ত্রী অন্তঃপুরে বাগানে যাইয়া দাঁড়াইলেন।

নামাজান্তে ভদ্রমহিলাগণ প্রায় সকলে এক দুই করিয়া হামিদার দক্ষিণদ্বারী শয়ন-ঘরের বড় ‘হলে’ আসিয়া সমবেত হইলেন।

ভদ্রমহিলাগণের প্রায় সকলেই তরুণী, কেবল জমিদার-গৃহিণী ও স্কুল ইনস্পেক্টার সাহেবের বিবি প্রৌঢ় বয়স্কা। জমিদার-গৃহিণী স্কুল ইস্পেক্টার সাহেবের বিবি ও ডেপুটি-পত্নী তিনখানি চেয়ারে উপবেশন করিলেন। অন্যান্য সকলে ফরাশের চৌকিতে স্থান লইলেন। গল্পগুজব আরম্ভ হইল। এই সময় শিক্ষক-সহধর্মিণী নামাজ শেষ করিয়া তথায় আসিলেন। হামিদা পাকের আয়োজনে ব্যস্ত। সে কার্যবশতঃ এই সময় ‘হলে’ প্রবেশ করিলে ডেপুটি- পত্নী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার সই কোথায়?’ এখনও নামাজে আছেন নাকি?’ শিক্ষক-সহধর্মিণী কহিলেন, “জ্বি হাঁ।’ হামিদা কার্যান্তরে গেল।

দারোগার স্ত্রী। মাগরেবের নামাজে এত সময় লাগে?

মোক্তার-বণিতা। কি জানি ভাই আমরাও নামাজ পড়ি; কিন্তু অমন লোক দেখানো নামাজ আমাদের পছন্দ হয় না।

ডেপুটি-পত্নী। নামাজ পড়া লোক দেখানো ছাড়া আর কি?

জমিদার-গৃহিণী। আপনি বলেন কি?

ডেপুটি-পত্নী। আমারত’ তাই মনে হয়। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ডবল এম-এ। তিনি বলেন, নামাজ রোজা মানুষের মনের মধ্যে। খোদার প্রতি মন ঠিক রাখারই কথা। তিনি আরও বলেন, হৃদয় পবিত্র করাই নামাজ রোজার উদ্দেশ্য, সুতরাং উচ্চশিক্ষা দ্বারা যাহাদের হৃদয় পবিত্র হইয়াছে, তাঁহাদের স্বতন্ত্র নামাজের প্রয়োজন কি?

জমিদার-গৃহিণী। আজকাল ছেলেপিলেগুলি ইংরেজি শিখিয়া একেবারে অধঃপাতে যাইতে বসিয়াছে।

স্কুল ইনস্পেক্টার বিবি। হ্যাঁ মা, কেমন যে দিনকাল পড়িয়াছে! নামাজে পড়িতে বলিলে বলেন,—ওসব তোমাদের একটা বোকামী। মনে মনে খোদার প্রতি ভক্তি থাকিলে ৫ বার পশ্চিমমুখী হওয়া ও ৩০ দিন রোজা করার আবশ্যক করে না।

সেরেস্তাদার ভগিনী। ভাই সাহেব ত’ আন্ডার গ্রাজুয়েট, তিনিও নামাজ রোজা সম্বন্ধে ঐ কথাই বলেন।

দারোগা-স্ত্রী। দারোগা সাহেব দুইবারে এন্ট্রাস পাস করিয়াছেন। তিনি বলেন, নামাজ- রোজা ইংরেজদের আইনের মত। অশিক্ষিত ছোটলোকগুলিকে দমন রাখার জন্য উহার দরকার।

এই সময় নামাজ শেষ করিয়া আনোয়ারা তথায় উপস্থিত হইল। সে নামাজ সম্বন্ধে এইরূপ উৎকট সমালোচনা শুনিয়া তথায় আর বসিল না, তওবা করিতে করিতে পাকশালের দিকে চালিয়া গেল।

ডিপুটি-পত্নী। দেখিলেন, আমাদের উকিল-বিবির সই কতদূর অহঙ্কারী, আমাদিগকে উপেক্ষা করিয়া চলিয়া গেলেন। আমি প্রথমে দেখিয়াই মনে করিয়াছি, রূপের অভিমানে ইনি ধরাকে সরা মনে করেন। গা-ভরা গহনা থাকিলে না জাতি কি হইত!

জমিদার-গৃহিণী। উনি বোধ হয় কোন প্রয়োজনবশতঃ চলিয়া গিয়াছেন।

দারোগা স্ত্রী। এতগুলি ভদ্রমহিলা অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেলেন; বলিয়া গেলেও ত কতকটা ভদ্রতা রক্ষা হত—তবুও ত কেরানীর বউ!

ডেপুটি-পত্নী। পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিতা জানানা, শিষ্টাচার-ভদ্রতার কি বুঝিবে?

দারোগা-স্ত্রী। বোধ হয় রূপ দেখিয়াই উকিল-বিবি উহার সহিত সই পাতিয়াছেন।

এইরূপে তাহারা মুচকি হাসির সহিত আনোয়ারার বিরুদ্ধে বিদ্রূপবান নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।

এদিকে আনোয়ারা পাকশালে উপস্থিত হইল। হামিদা কহিল, ‘সই, ডেপুটি সাহেবের স্ত্রী আমাকে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। তুমি কি নামাজ বাদ ‘হলে’ যাও নাই?

আনো। গিয়াছিলাম, কিন্তু যেখানে নামাজ-রোজা সম্বন্ধে মন্দ আলোচনা হয়, তথায় থাকা উচিত মনে করি নাই।

হামিদা। নামাজ-রোজা মন্দ আলোচনা! কে করিয়াছে?

আনো। আমি কেবল একজনের মুখে শুনিয়াই চলিয়া আসিয়াছি।

হামিদা। প্রতিবাদ করিয়া বুঝাইয়া দিলেই হইত?

আনো। বুঝাইতে গেলে বিরোধ বাঁধিতে পারে।

হামিদা। বিরোধের ভয়ে চলিয়া আসা ঠিক হয় নাই। কারণ, অন্ধকে কূপের দিকে যাইতে দেখিলে হাত ধরিয়া পথে দিতে হয়, পরন্তু ভদ্রমহিলাগণকে উপেক্ষা করিয়া আসায় লৌকিক ব্যবহারেও তুমি দোষি হইতেছ।

আনো। তা বুঝি, কিন্তু শুভ উৎসবে জেহাদ করিতে পারিব না।

হামিদা। তুমি বুঝি কেবল সয়ার প্রাণরক্ষায় যমের সহিত জেহাদ করিতে মজবুত, না?

আনো। সই, সে জেহাদ স্বতন্ত্র।

হামিদা। তা হোক, নামাজ-রোজার প্রতি যিনি অবজ্ঞা দেখাইয়াছেন, তাঁহাকে কিছু আক্কেল সেলামি দিতে হইবে। চল, তোমাকে জেহাদের মাঠে রাখিয়া আসি ।

এদিকে শিক্ষক সহধর্মিণী কথা প্রসঙ্গে ডেপুটি-পত্নীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার স্বামী কি নামাজ পড়েন না?”

ডেপুটি-পত্নী। তিনি উচ্চশিক্ষিত।

শিঃ সঃ। রোজাও করেন না?

ডেঃ পঃ। রোজা করেন।

শিঃ সঃ। উচ্চ শিক্ষিতের রোজার প্রয়োজন কি?

ডেপুটি-পত্নী একটু ফাঁপরে পড়িয়া রুক্ষমুখে কহিলেন, “রোজা বছরে একবার মাত্র করিতে হয়, আর সেই সময় ছোট বড় সকলেই রোজা রাখে।”

শিক্ষক-সহধর্মিণী হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। এই সময় আনোয়ারা ও হামিদা তথায় উপস্থিত হইল।

ডেপুটি-পত্নী শিক্ষক-সহধর্মিণীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার স্বামী কি কার্য করেন?” তখন ঘৃণা ও ক্রোধ তাঁহার গর্বিত মুখমণ্ডলকে ছাইয়া ফেলিয়াছে।

শিক্ষক-সহধর্মিণীও উত্তেজিত হইয়া উত্তর দানে উদ্যত; আনোয়ারা দেখিল, ডেপুটি- পত্নীর প্রশ্নের ভঙ্গিমায় বিবাদের সম্ভাবনা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, এজন্য সে শিক্ষক-সহধর্মিণীকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “কোন্ কথা হইতে এরূপ জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ হইয়াছে?”

শিঃ সঃ। নামাজ-রোজার কথা হইতে।

আনো। বড়ই আফছোছের কথা।

এই বলিয়া আনোয়ারা উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিল, “নামাজ-রোজা, বেশেহশতের চাবি, আপনারা তাই দিয়া দোজখের দ্বার খুলিতে উদ্যত হইয়াছেন, ইহা অপেক্ষা দুঃখের কথা আর কি হইতে পারে? আমাদের তিনি (স্বামী) নামাজ-রোজার প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, ‘মালি যেমন ফুলগাছে জড়িত লতাগুল্মের শিকড় তুলিতে বসিয়া, নির্বুদ্ধিতায় আসল গাছসুদ্ধ উপড়াইয়া ফেলে আজকাল নূতন শিক্ষাদীক্ষাপ্রাপ্ত অনেক যুবক-যুবতী নামাজ-রোজার মূলতত্ত্ব না জানিয়া, কুটতর্কে উহার আবশ্যকতাই অস্বীকার করিয়া ফেলেন। আমি নামাজ রোজা সম্বন্ধে ঐ সকল যুবক-যুবতীগণের মতামত ও নামাজ রোজার মূলতত্ত্ব জানিতে ইচ্ছা করায়, তিনি আমাকে যে সকল উপদেশ দিয়াছেন, তাহা আমার রোজানামচায় সংক্ষেপে লিখিয়া রাখিয়াছি। আমি তাঁহার মূল্যবান উপদেশ মনে রাখার জন্য প্রায় রোজনামচায় লিখিয়া রাখি। আমার মনে হইতেছে আপনারা কেহ কেহ নামাজ-রোজা সম্বন্ধে যে মতামত ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহার অনেক কথার মিমাংসা তাহাতে আছে।”

শিঃ সঃ। সে রোজনামাচা কি আপনি সঙ্গে আনিয়াছেন?

আনো। হ্যাঁ, তা সর্বদা আমার সঙ্গে থাকে।

শিঃ সঃ। দয়া করিয়া শুনাইলে সুখী হইতাম।

আনো। সকলের মতামত আবশ্যক।

মৌঃ-কবিলা। ধর্মের কথায় কাহার অমত?

জঃ গৃহিণী। আচ্ছা, আপনার স্বামীর উপদেশ আমাদিগকে পড়িয় শুনান দেখি।

আনোয়ারা ঘরে গিয়া ট্রাঙ্ক হইতে তাহার রোজনামচা লইয়া আসিল। শিক্ষক-সহধর্মিণী সূত্রপাতেই কহিলেন, “আপনি দেখিতেছি আমাদের ন্যায় অসার স্ত্রীলোকমাত্র নহেন।” আনোয়ারা সে কথার কোন উত্তর না করিয়া কিছু লজ্জিত—কিছু সঙ্কুচিতভাবে রোজনামচা দেখিয়া বলিতে লাগিল, “আমরা যদি আল্লাহ, ফেরেস্তা, কোরান, পয়গম্বর ও কেয়ামত বিশ্বাস করি অর্থাৎ ভক্তির সহিত খোদাতালার প্রতি ঈমান স্থির রাখি, তবে নামাজ রোজা সম্বন্ধে মনগড়া ভিন্নমত ব্যক্ত করা কাহারও উচিত নহে। আল্লাহ কোরান মজিদে আদেশ করিয়াছেন, ৫ অক্ত নামাজ ও ৩০ দিন রোজা নর-নারীর সকলেই পক্ষেই ফরজ। এ সম্বন্ধে আলেমের প্রতি যে আদেশ, জালেমের প্রতিও সেই আদেশ; এ সম্বন্ধে মোল্লা-মাওলানা, এম এ বি-এল, অলি-দরবেশ, পয়গম্বরের প্রতি যে আদেশ, বর্বরের প্রতিও সেই আদেশ; এ সম্বন্ধে শাহান্শা বাদশার প্রতি যে আদেশ, কড়ার কাঙ্গালের প্রতিও সেই আদেশ; এ সম্বন্ধে সালঙ্কারা নব-যুবতীর প্রতি যে আদেশ, ছিন্নবসনা ও বিগত-যৌবনা কাঙ্গালিনীর প্রতিও সেই আদেশ, একই বিধি ও একই নীতি। খোদাতায়ালার এই আদেশ নর-নারীর মঙ্গলের জন্য অকাট্য, চূড়ান্ত যুক্তি প্রমাণের উপর স্থাপিত। এই যুক্তি প্রমাণের সমালোচনা করিয়া রোজার মাহাত্ম্য ও উপকারিতা বুঝিয়া লওয়া মন্দ নয়। বরং তাহাতে নামাজ রোজার প্রতি আমাদের অধিকতর ভক্তি বিশ্বাস জন্মিবারই সম্ভাবনা। কিন্তু খোদাতায়ালার জ্ঞানের নিকট আমাদের জ্ঞান অপূর্ণ ও অকিঞ্চিৎকর। এই তুচ্ছ জ্ঞানের বড়াই করিয়া পূর্ণ জ্ঞানময়ের আদিষ্ট ও বিধান বিহিত নামাজ রোজা সম্বন্ধে ভিন্নমত ব্যক্ত করা এবং সেই মতের পোষকতা করিয়া নামাজ রোজা ত্যাগ করা বা অবজ্ঞা করা মানুষের কর্ম নহে। যাহারা নিজজ্ঞানে নামাজ রোজার উপকারিতা ও মাহাত্ম্য বুঝিতে অক্ষম, মহাজনগণের পথ ধরিয়া চলাই তাঁহাদের একান্ত কর্তব্য। হযরত রাসূলে (দঃ) মত তত্ত্বজ্ঞানী এ পর্যন্ত দুনিয়ায় কেহ আসেন নাই। হযরত আবুবকরের মত সত্যবাদী ও ঈমানদার, হযরত ওমরের মত ন্যায়পরায়ণ ধর্মবীর, হযরত ওসমানের মত বিনয়ী পরহেজগার, হযরত আলীর মত জ্ঞানী ও বিদ্বান, হযরত আবদুল কাদের জিলানীর মত সাধক এ পর্যন্ত সংসারে কেহ হন নাই; কিন্তু ইঁহারা সকলেই ভক্তির সহিত নামাজ রোজা করিতেন। বিবি আয়েশা, ফাতেমা, জোহরা, উম্মে কুলসুম, জোবেদা খাতুন প্রমুখ আদর্শ মাতৃগণ, নামাজ-রোজাকে প্রাণাপেক্ষাও অধিকতর ভালবাসিতেন।

“কেহ কেহ বলেন, নামাজ-রোজা মানুষের মনের মধ্যে! মনে মনে খোদার প্রতি ভক্তি থাকিলে, ৫ বার পশ্চিমমুখে ছেজদা করা, ৩০ দিন উপবাস করিবার দরকার কি? চাই মন একটু খেয়াল করিলে, তাঁহাদের এ কথা যে ভিত্তিশূন্য তাহা সহজেই বুঝা যায়। কারণ, কাহারও ঘরে যদি মহামূল্য রত্ন থাকে, আর তিনি যদি তাহার সদ্ব্যবহার না করিয়া, চিরকাল সিন্দুকে মাত্র তুলিয়া রাখেন, তবে সে রত্ন থাকিয়া লাভ কি? পরন্তু আমরা নিষ্পাপ, ইহা বলিয়া যদি তাঁহারা দাবী করিতে পারিতেন, তাহা হইলে তাঁহাদের এ কথা কতকটা সম্ভবপর বলিয়া মানিয়া লওয়া যাইত। কিন্তু তাঁহারা যে মায়ামোহে জড়িত প্রবৃত্তির বশীভূত; তাঁহারা যে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তাড়িত, ভোগ-বিলাসে, উন্মত্ত; এমতাবস্থায় নিষ্পাপ বলিয়া দাবী বলা তাঁহাদের পক্ষে একান্তই অসম্ভব। অতএব পাপক্ষয়ের জন্য মনে, মুখে ও কার্যের দ্বারা খোদার বন্দেগী অর্থাৎ নামাজ-রোজা না করিলে যে তাঁহাদের মুক্তির আশা নাই। যে স্ত্রীলোক বলে, আমি মনে মনে আমার স্বামীকে খুব ভালবাসী ও ভক্তি করি, কিন্তু বাহিরের কার্যের দ্বারা অর্থাৎ মিষ্ট সম্ভাষণ দ্বারা, সেবা-শুশ্রূষার দ্বারা, আদেশ-উপদেশ পালন দ্বারা তাহারা কিছুই করে না, এমতাবস্থায় তাহার কি স্বামীর প্রতি কর্তব্য পালন করা হয়? আর স্বামীই কি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হইতে পারেন? কখনই নয়? অতএব নামাজ-রোজা দ্বারা নিজের কর্তব্য পালন করিয়া জগৎ-স্বামীর মনন্তুষ্টি সম্পাদন করা নর-নারীর সকলের পক্ষেই একান্ত কর্তব্য।

“সামান্য যুক্তিমূলে যাহা বলা হইল তাহার সূক্ষ্মতত্ত্ব এইরূপ—আমাদিগের মন ও হৃদয়ের সহিত শরীরের আশ্চর্য সম্বন্ধ। মনে চিন্তা প্রবেশ করিলে দেহ অবসন্ন ও দুর্বল হইয়া পড়ে; আবার আনন্দে হৃদয়-মন উভয় প্রফুল্ল হয়, সঙ্গে সঙ্গে শরীরও সুস্থ হইয়া উঠে। ইষ্টজন বিয়োগ বা অত্যানন্দে অশ্রু বিগলিত হয়; ফলতঃ ভিতরে ভাবান্তর ঘটিলে বাহিরে তাহা প্রকাশ না হইয়া যায় না। আবার বাহিরের অবস্থান্তরে ভিতরের ভাবান্তর অনিবার্য। আমাদের নামাজের প্রক্রিয়া সমূহ অর্থাৎ ওজু, কেরাম, সূরা পাঠ প্রভৃতি কার্য খোদাভক্তির বাহ্য অবস্থান্তর। যাঁহারা বলেন, মনে মনে খোদাভক্তি থাকিলে বাহিরে আর কিছু করিবার আবশ্যক নাই, এখানেই তাঁহাদের কথার অযৌক্তিকতা ধরা পড়ে। তবে যে অবস্থায় খোদাভক্তিতে বাহিরের ভাব একেবারে বিলুপ্তি হয়, সে অবস্থা বড়ই কঠিন। তাহাকে ‘মারেফাতের’ অবস্থা বলে। খয়বরের যুদ্ধে হযরত আলীর পাদমূলে-প্রবিদ্ধ তীর তাঁহার নামাজের সময় টানিয়া বাহির করা হইয়াছিল; কিন্তু তিনি সেই তীর বাহির করা টের পান নাই, নামাজের সমাধি অবস্থায় ঐরূপ ঘটে।

‘হৃদয়-মন পবিত্র করাই নামাজ-রোজার উদ্দেশ্য; সুতরাং সুশিক্ষা দ্বারা যাঁহাদের তাহা হইয়াছে, স্বতন্ত্র নামাজ-রোজা করা তাঁহাদের প্রয়োজন কি? এমন উৎকট ভ্রমাত্মক কথাও ২/৪ জন শিক্ষিতাভিমানী প্রকাশ করিয়া থাকেন। যাঁহারা এমন কথা বলেন, আমার ভয় হয়, বলিবার সময় তাঁহাদের রসনা বুঝি জড়তাপ্রাপ্ত হইয়া যায়। হাজার শিক্ষা লাভ করুন, তদ্বারা হৃদয় পবিত্র হইয়াছে একথা অপূর্ণ মানব বলিতে পারে না। হযরত মুহাম্মদের (দঃ) মত চরিত্রবান লোক জগতে আর কে আছে? কিন্তু তিনিও নামাজ-রোজা ত্যাগ করেন নাই।

“কেহ কেহ বলেন, নামাজের অর্থ খোদার বন্দেগী। সুতরাং তাহার আবার সময় অসময় কি? নির্দিষ্ট ৫ বারই বা নামাজ পড়িতে হইবে কেন? যতবার ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা খোদার বন্দেগী করায় কি দোষ আছে? যাহারা এমন কথা বলেন, নামাজ পড়া বা খোদার নাম লওয়া দূরে থাক, তাঁহাদের সংসার-যাত্রা নির্বাহ করাইত’ কঠিন ব্যাপার। কারণ, দুনিয়ার প্রত্যেক কার্যই যে নির্দিষ্ট সময়ের মুখাপেক্ষী; তাহা কাহাকেও বুঝাইবার আবশ্যক করে না। সময় মত কাৰ্য না করিলে তাহা সুসম্পন্ন হয় না বলিয়াই সময় অমূল্য! যদি মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে কার্য না করিত, তাহা হইলে দুনিয়া অচল হইয়া সৃষ্টি বিপর্যয় ঘটিবার আশঙ্কা হইত। যাহা হউক, নামাজের নির্ধারিত সময়টি অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ির মত; অর্থাৎ যে ঘড়ি যেমন নিদ্রিত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ে জাগাইয়া দেয়, নামাজের নির্ধারিত সময়টি তেমনি সংসারমত্ত মানবকে খোদাতায়ালার গুণগানে প্রলুব্ধ করে।

“আর এক কথা, খোদাতায়ালার সুমহান অনুগ্রহে আমরা পরম সুখে সংসারে কালযাপন করিতেছি, এ-নিমিত্ত তাঁহার নিকট অহোরাত্রি মধ্যে ৫ বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের পক্ষে নিতান্তই উচিত। আবার পাঁচ অক্তের যে সময় নির্ধারিত হইয়াছে, সহজ খেয়ালেই বুঝা যায়, তাহা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পক্ষে উপযুক্ত সময় বটে। দয়াময়ের অনুগ্রহে নির্বিঘ্নে সুখদ শয়নে রাত্রি যাপন করিয়া, প্রাতে তাঁহার গুণগান করা, কি সুন্দর সময়! নামাজের অন্যান্য অক্তগুলি, তাঁহার স্তবস্তুতির পক্ষে এইরূপ প্রশস্ত।”

“প্রিয়তমে, এ সম্বন্ধে আরো জানিয়া রাখ, পাঁচ এই সংখ্যাটি আমাদের শাস্ত্রকর্তারা শ্রেষ্ঠ ও পুণ্যার্থকবাচক বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। কারণ, দুনিয়া সৃষ্টির বহুকাল পূর্বেই আল্লাহতায়ালা নিজ নূরে হযরত রাসূলকে সৃষ্টি করিয়া, গোপনে রাখিয়াছিলেন। সেই সময় হজরত রছুল খোদাতালাকে পাঁচবার ছেজদা করেন। পাঁচ অক্ত নামাজের ইহাই মূল।”

“খোদাতায়ালার নূরে, হযরত রাসূল, আলী, ফাতেমা, হাসান, হোসেন এই পাঁচজন পয়দা হন।”

‘আল্লা, মোহাম্মদ, আদম, এসলাম, এন্‌ছান—ঈমান, শরীয়ত, মারেফত, নুছুত, মালাকুত প্রভৃতি ধর্মাভাবপূর্ণ-পদগুলি আরবী পাঁচ পাঁচ অক্ষরে লিখিত হয়।

“কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, জাকাত— এই পাঁচটি বিষয় আমাদের ধর্মের মূল! ইহাও পাঁচ প্রকার।“

‘মৃত্যুর পরে অজু, গোসল, কাফন, জানাজা, কবর ইহাও পাঁচটি। আমাদের চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয় পাঁচ, আব, আতস, খাক্, বাত প্রভৃতি পাঁচ। ফলতঃ দুনিয়ার সৃষ্টিস্থিতিলয়ের পক্ষে যাহা প্রধান, তাহা এই ৫ সংখ্যাযুক্ত। সুতরাং জগতের সর্বোত্তম বিষয় খোদাতালার বন্দেগী পঞ্চবার হওয়া স্বাভাবিক ও সুসঙ্গত হইয়াছে।”

“কেহ কেহ বলেন, খোদাতায়ালার প্রতি একাগ্রচিত্ত হওয়াই নামাজের উদ্দেশ্য বটে; কিন্তু কেয়ামে আহকামে সে উদ্দেশ্যই নষ্ট হইয়া যায়। যাঁহারা এমন কথা বলেন, তাঁহারা কেয়ামে আহকামের মাহাত্ম্য বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই। বাদশার দরবারে যে প্রজা অবনত মস্তকে, করযোড়ে, বিনীতভাবে উপস্থিত হয়, তাহার প্রতি বাদশার যেরূপ সুনজর ও দয়ার দৃষ্টি পড়ে, অবিনয়ী, উদ্ধত বা জড়স্বভাব প্রজার প্রতি সেরূপ নজর পড়ে না। পরন্তু দুনিয়ার বাদশার প্রকৃতি বিশ্ব-বাদশার প্রকৃতির প্রতিচ্ছায়া মাত্র। সুতরাং তাঁহার দরবারে হাজির হইবার সময় অর্থাৎ নামাজের সময় আমাদিগকে কতদূর বিনীত হওয়া উচিত, তাহা খেয়ালের বিষয়; কিন্তু অপূর্ণ মানব পূর্ণ পরাৎপরের সন্নিধানে কিরূপভাবে বিনীত হওয়া উচিত, তাহা নির্ধারণ করিতে পারে কি? তাই স্বর্গীয় দূত জিব্রাইল আসিয়া, বিশ্বপতির নিকট কিরূপ বিনয় ও দীনতাভাব প্রকাশ করিতে হইবে, হযরত মুহাম্মদকে হাতে ধরিয়া তাহা শিক্ষা দিয়া যান। হযরতের অনুগামী দাস আমরা, সেই মহাপুরুষ হইতেই নামাজের কেয়াম অর্থাৎ বিনয়-নীতি-রত্ন লাভ করিয়াছি। নামাজের সময় দুই পা কিছু দূরে রাখিয়া কেবলামুখে দণ্ডায়মান হইয়া পার্শ্ববর্তী জনকে খোদার নামে সহমিলনে আহ্বান করা, স্বহস্তে কর্ণস্পর্শ করিয়া সেই হস্ত বক্ষ বা নাভিমূলে স্থাপন করা; একভাবে প্রণতস্থানের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া আল্লার নামে জাতিবাক্য উচ্চারণ করা, পরে ঊর্ধ্ব শরীরাধসহ মস্তক অবনত করিয়া পুনরায় উত্থান, পরে সষ্টাঙ্গ-প্রণত হইয়া আবার উত্থান আবার পতন, শেষে জানু পাতিয়া উপবেশন প্রভৃতি ক্রিয়া দ্বারা যেরূপ বিনয়ভাব প্রকাশ করা হয়, তদ্রূপ আর কোন অবস্থায় হইতে পারে না। প্রায় আট হাজার বৎসর গত হইল, হযরত আদমবংশ দুনিয়ায় আসিয়াছে; এ সুদীর্ঘকাল মধ্যে কত জাতি কত প্রকারের উন্নতির উচ্চতম সোপানে আরোহণ করিয়াছে। কিন্তু মুসলমান ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কোন জাতি ধর্মনুষ্ঠান ব্যাপারে খোদার সম্মুখে এমন চুড়ান্ত বিনয় ও দীনতার উচ্চতম নিদর্শন দেখাইতে সমর্থ হন নাই। খোদার প্রতি এই বিনয় ও দীনভাবই এসলামের অনুপম মহত্ত্ব এবং একেশ্বরবাদের পাদপিঠ।”

এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা নীরব হইল। তাহার রোজনামজার লিখিত উপদেশ শুনিয়া উপস্থিত রমণী মণ্ডলী তাজ্জববোধ করিতে লাগিলেন। যাঁহারা নামাজ-রোজা সম্বন্ধে বিরুদ্ধ কথা বলিয়াছেন, তাঁহারা লজ্জায় মস্তক অবনত করিলেন। শিক্ষক-সহধর্মিণী আনোয়ারাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আপনার ন্যায় ভগিনীরত্ন পাইয়া আজ আমরা বাস্তবিকই গৌরবান্বিত ও সুখী হইলাম। আপনার মুখে ধর্ম কাহিনী শ্রবণ করিয়া শুনিবার ইচ্ছা আরও বাড়িয়া উঠিয়াছে। অতএব নামাজ-রোজার উপকারিতা ও মাধুর্য সম্বন্ধে আমাদিগকে আরও কিছু উপদেশ দান করিয়া কৃতার্থ করুন।”

আনোয়ারা বিনীতভাবে কহিল, “আমি মূঢ়মতি অবলা, নামাজ-রোজার মহদ্দেশ্য ও উপকারিতা আপনাদিগকে বুঝাইবার শক্তি আমার নাই; তবে তিনি এতদ্‌সম্বন্ধে দাসিকে যে সকল উপদেশ দিয়াছেন এবং আমি রোজনামচায় যাহা লিখিয়া রাখিয়াছি, তাহা আরও কিছু আপনাদিগকে শুনাইতেছি। তিনি (স্বামী) বলেন, “আমাদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য আমাদিগকে সর্বদা বহির্জগতে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়, এজন্য আমাদিগের অনেক সময় নামাজ-রোজা কাজা হইয়া যায়, কিন্তু তোমাদের সে সকল অসুবিধা নাই। নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত (এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা জিভ কাটিল) তোমরা নিশ্চিন্তে নামাজ-রোজা করিতে পার। আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি, তাঁহার কথা সম্পূর্ণ সত্য। খোদার প্রতি ভক্তি থাকিলে নামাজ-রোজা করা আমাদের পক্ষেই সুবিধাজনক। তিনি বলেন, নামাজ-রোজা আমাদের ইহ-পরকালের সার- সম্বল; যে সকল স্ত্রী-পুরুষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ রীতিমত পড়েন, পাপের প্রতি তাঁহাদের ঘৃণা ও ভয় থাকে। সুতরাং তাঁহারা প্রকৃত সুখ-শান্তির অধিকারী হন। আবার মৃত্যুর পর যখন অন্ধকার কবরে গমন করেন, তখন নামাজ সে অন্ধকারে তাঁহাদের আলোকস্বরূপ হয়। হযরত রাসুল বলিয়াছেন, “নামাজ ধর্মের শোভন স্তম্ভ। যে স্ত্রী-পুরুষ এমন নামাজকে ত্যাগ করিয়াছে, তাহারা ধর্মকে ধ্বংস করিয়াছে।” তিনি আরও বলিয়াছেন, নামাজ গৃহদ্বার সম্মুখে প্রবাহিত স্রোতস্বিনীর ন্যায়। তুমি প্রত্যহ পাঁচবার সেই নদীতে অবগাহন কর, দেখিবে তোমার দেহের পাপ-দেহের ময়লা ধৌত হইয়া গিয়াছে।” এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা কহিল, “নামাজের আর একটি অবস্থা আছে তাহা বড়ই কঠিন। আমি তাহার মুখে শুনিয়া লিখিয়া রাখিয়াছি, ভালরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।” ডেপুটি-পত্নী কহিলেন, “যত কঠিন হউক না কেন আপনি বলুন; আমরা কি এতই অশিক্ষিতা যে তাহার কিছুই বুঝিতে পারিব না?” আনোয়ারা তখন রোজনামচার পাতা উল্টাইয়া বলিতে লাগিলেন, “প্ৰকৃত নামাজী দুনিয়ার খেয়াল ভুলিয়া মিনতি ও দীনতা লইয়া নামাজে প্রবৃত্ত হন। ইহাতে খোদাতায়ালার সহিত তাঁহার এক দুশ্ছেদ্য স্মরণসম্বন্ধ স্থাপিত হইয়া যায়। বিবি আয়েশা বলিয়াছেন, “নামাজের সময় উপস্থিত হইলে, হযরত আমাকে, আমি হযরতকে চিনিতে পারিতাম না। খোদাতায়ালার ভয় সম্মানে আমাদের চেহারা বদলাইয়া যাইত।’ নামাজের সময় হযরত ইব্রাহিম ও হযরত রাসুলের পাক দেহমধ্যে এক প্রকার শন্ শন্ শব্দ উত্থিত হইত। জগতে অদ্বিতীয় বীর হযরত আলী নামাজের সময় থর থর করিয়া কাঁপিতেন। খোদাতায়ালাকে সাক্ষাৎ জানিয়া তাঁহার সম্মুখীন হইতে প্রকৃত নামাজীর দেলের অবস্থা এইরূপ হইয়া থাকে। সংসারের মায়া-মোহের মলিনতা হৃদয় হইতে সহজে উঠে না, নামাজের এই অবস্থার পর, তাহা পরিষ্কার ভাবে উঠিয়া যায়। তখন তিনি দর্পণের ন্যায় স্বচ্ছচিত্ত হইয়া নিজেকে ভুলিয়া নিরঞ্জন দর্শনলাভে তাহাকে অবিশ্রান্তভাবে ডাকিতে থাকেন। আমটি যখন গাছে ধীরে ধীরে পাকিয়া উঠে, তখন তাহা যেমন স্বভাবত রসপূর্ণ হয়, তেমনই খোদাতায়ালাকে ডাকিতে ডাকিতে নামাজীর মনে এক প্রকার অমৃত রসভাবের সঞ্চার হয়। এই রসভাবের নাম প্রেম। দুনিয়ায় এই প্রেমের তুলনা নাই। জ্ঞানবলে এ প্রেমের লাভ হয় না। ঈগল পক্ষীর ন্যায় উড়িতে যাইয়া কচ্ছপ যেমন পাহাড়ে পড়িয়া চুরমার হইয়াছিল, এই স্বর্গীয় প্রেমের নিকট জ্ঞানের গর্ব সেইরূপ খর্ব হইয়া যায়। জ্ঞান বিরোধের সৃষ্টি কর্তা, প্রেম মিলনের নেতা। জ্ঞান বাইবেল-কোরানে বিরোধ বাধাইয়া তোলে, প্রেম মাতব্বরী করিয়া সকলের কলহ পানি করিয়া দেয়। বস্তুত প্রেম সংসারে সমস্ত বিপরীতের সমন্বয়বিধাতা। ইহার নিকট সব সমান কোন কিছুরই ভেদাভেদ নেই। প্রেম পূর্ণরূপে নির্মল, পূর্ণরূপে পবিত্র, পরিপূর্ণরূপে সরল।

‘নামাজী দিন দিন নামাজরূপ হাপরে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস-বাসনা ভস্মসাৎ করিয়া তবে এ হেন প্রেমরত্ব লাভ করিতে ক্ষমতা লাভ করেন। এই অমূল্য রত্ন লাভের প্রথমাবস্থায় নামাজীর মন দিনরাত প্রেমময় খোদাতায়ালার ধ্যানে ডুবিয়া থাকে, অন্য কোন দিকে তাঁর মন যায় না। কেবল ধ্যানই তিনি সুখকর বলিয়া বোধ করেন। এই অবস্থায় তাঁহার ধ্যানের উপর ধ্যেয় পদার্থ ক্রমশঃ জাগিয়া উঠে অর্থাৎ যে খোদাকে স্মরণ করা হয়, সেই খোদাই তখন নামাজীর হৃদয় সম্পূর্ণ অধিকার করিয়া বসেন। সেখানে তখন অন্য কিছুরই প্রবেশ স্থান থাকেন না। প্রেমের প্রাবল্যে প্রেমিক এইরূপে আপনাকে বিস্মৃতি-সাগরে ডুবাইয়া দেন। তাঁহার দৈহিক অনুভূতি অন্তর্হিত হয়। বিশ্ব-সংসারে অন্য সমস্ত পদার্থ তাঁহার অস্তিত্বের বাহিরে চলিয়া যায়। তখন যাঁহার জন্য এত সাধনা, এত ধ্যানধারণা, এত উপবাস অনিদ্রা, সেই প্রেমাধার খোদা, প্রেমিকের দর্শন-পথে প্রকট মূর্তিতে আসিয়া উপস্থিত হন। প্রেমিক তখন বিশ্বময় এক খোদা ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পান না। তখন তিনি সহর্ষে বলিয়া উঠেন, অহো! কি সৌভাগ্য! অহো কি আনন্দ! খোদা, তুমি ছাড়া যে আর কিছুই নাই, কিছুই দেখিতেছি না। কি শান্তি! কি সুখ!

এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা ভদ্রমহিলাগণের মুখের দিকে তাকাইয়া লজ্জিত হইল। সে দেখিল, তাঁহারা তাহার মুখের প্রতি নির্বাক নিস্পন্দ নয়নে চাহিয়া আছেন। তাঁহাদের সকলেরই জজবার ভাব উপস্থিত।

এই সময় হামিদা আসিয়া কহিল, “গরিবের নিমক-পানি তৈয়ার।”

ডেপুটি-পত্নী ধ্যান ভাঙ্গিয়া কহিলেন, “আমরা শরাবন তহুরা পানে আত্মহারা!”

এই সময় ডেপুটি-পত্নী হঠাৎ চেয়ার হইতে উঠিয়া সসম্মানে আনোয়ারার হস্ত ধারণ করিলেন এবং বিনীতভাবে কহিলেন, “আপনার সম্মুখে এতক্ষণ চেয়ারে বসিয়া ছিলাম, বেয়াদবী মাফ করিবেন।” আনোয়ারা লজ্জিতভাবে কহিল, “আমি সামান্যা নারী, আমাকে ওরূপ কথা বলিয়া আপনি লজ্জা দিবেন না।” জমিদার গৃহিণী হাসিয়া কহিলেন, “মা, আমাদের অসার বাসরে লজ্জা ব্যতীত এমন কোন সার সম্পদ নাই—যাহা দিয়া তোমার এই অমূল্য উপদেশ দানের প্রতিদান করি।”

ডেপুটি-পত্নী। তাহা, যাহাই হোক, এক্ষণে আপনি রোজার সম্বন্ধে কিছু উপদেশ দিয়া আমাদিগকে সুখী করুণ।

আনো। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, রোজার এত মাহাত্ম্য কেন? তিনি বলিলেন, মাসের নামেই রোজার মাহাত্ম্য প্রকাশ পাইতেছে। রমজান শব্দের অর্থ দগ্ধ হওয়া অর্থাৎ মানুষের পাপরাশি এই মাসে দগ্ধ হইয়া যায়। চাতক চাতকী যেমন বৈশাখের নূতন মেঘের পানি-পানাশায় আকাশ পানে চাহিয়া থাকে, খোদাভক্ত মুসলমান নর-নারী সেইরূপ রমজান মাসের আশায় চাঁদের তারিখ গণিতে থাকেন। হযরত রাসুলও রমজান মাসকে নিজস্ব মাস বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। আমি তাঁহাকে বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, উপবাসে পাপ নাশ হয় কিরূপে? তিনি তখন হাদীস হইতে একটি দৃষ্টান্ত দিলেন। দৃষ্টান্তটি এইঃ

“আল্লাহতায়ালা নফছ-আম্মারকে সৃষ্টি করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, তুমি কে? আমি কে? সে অসঙ্কোচে উত্তর দিয়াছিল,–-‘আমি আমি’ ‘তুমি তুমি’! তখন তাহাকে দোজখে নিক্ষেপ করা হয়। বহুদিন পর তাহাকে দোজখ হইতে তুলিয়া পুনরায় প্রশ্ন করা হয় তুমি কে? আমি কে? তখনও সে এইরূপ উত্তর দান করে। শেষে তাহাকে ক্রমান্বয়ে ক্রমাধিক ক্লেশজনক সাতটি দোজখে রাখা হয়, কিন্তু সে কিছুতেই খোদাতায়ালাকে সৃষ্টিকর্তা বলিয়া স্বীকার করে না। পরিশেষে তাহাকে অনাহার-ক্লেশের দোজখে আবদ্ধ করা হয়; তখন সে ক্রমশঃ হীনবল হইয়া বিনীতভাবে বলে, হে সর্বশক্তিমান খোদা। তুমি সৃষ্টিকর্তা, তুমি রক্ষাকর্তা, তুমি পালনকর্তা। আমি তোমারই সৃষ্ট নগণ্য কীটাণুকীট। ইহা হইতে আমরা বুঝিতে পারি, প্রবৃত্তি দমনের যত প্রাকার উপায় আছে, তন্মধ্যে উপবাস যেমন, এমন আর একটিও নহে। এই প্রবৃত্তি দমনকারী ব্রতের নাম-রোজা। মানুষ প্রবৃত্তিবশে অদম্য পশু, নামাজ তাহাদের লাগাম, রোজা চাবুকস্বরূপ।

এক্ষণে, আমি আপনাদিগকে শেষ একটি কথা বলিতেছি, মনে রাখিবেন—আমরা অবলা, দুনিয়ায় আমাদের যদি সুখ-শান্তি থাকে, তবে তাহা নামাজ-রোজা ও পতিভক্তির মধ্যে নিহিত রহিয়াছে। আপনাদের দোওয়ায় আমি নামাজের প্রত্যক্ষ ফল লাভ করিয়াছি।

এই সময় হামিদা পুনরায় আসিয়া কহিল, “আমার এই সই আপনাদিগকে যাদু করিয়াছে নাকি?”

ডেপুটি-পত্নী। তাহারও উপরে।

দারোগা-স্ত্রী। যাদু অস্থায়ী, কিন্তু আপনার সইয়ের যাদুপনা আমাদের দেলে বসিয়া গেল।

অতঃপর সকলে উঠিয়া আহারার্থে গমন করিলেন। রাত্রিতে শয়নকালে ডেপুটি-পত্নী তাঁহার দাসীকে কহিলেন, “সূর্যোদয়ের পূর্বে আমাকে জাগাইয়া দিও ফজরের নামাজ পড়িতে হইবে।”

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তাহবাদ আনোয়ারা রতনদিয়ায় রওয়ানা হইতে প্রস্তুত হইল। সে পতির ঋণশোধের জন্য যে সকল অলঙ্কার সয়ার হাতে দিয়াছিল, তাহা এবং নবাব স্ত্রীর নিকট বিক্রিত, পরে ঘটনাচক্রে জজকোর্ট হইতে ফেরতপ্রাপ্ত সেই নীলাম্বরী ও বেনারসী শাড়ী হামিদা সই-এর সম্মুখে উপস্থিত করিল। আনোয়ারা দেখিয়া কহিল, “সই, একি! এ সকল যে ঋণশোধের জন্য দেওয়া হইয়াছিল?” হামিদা স্মিতমুখে বিলোল কটাক্ষে কহিল, “আমি অতশত জানি না—তোমার সয়া কহিলেন, ‘মৃতসঞ্জীবনী বৈষ্ণবী ব্রতের সময় কোন উপঢৌকনাদি দিবার সুযোগ পাই নাই। এক্ষণে এই সকল বস্ত্রালঙ্কারগুলি উপায়নস্বরূপ তাঁহাকে দিয়া দাও।” আনোয়ারার মুখ লজ্জায় রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। হামিদা নিজদিগের দেওয়া নূতন একখানি মূল্যবান শাড়ী সইকে পরিধান করিতে দিয়া, অলঙ্কারগুলি যা যেখানে সাজে নিজ হস্তে পরাইয়া দিল। অবশিষ্ট বস্ত্রালঙ্কার একটি বাক্সে পুরিয়া তাহার সঙ্গে দিল। আনোয়ারা খোকাকে ক্রোড়ে লইয়া তিনটি আকবরী মোহর তাহার হাতে দিল। অনন্তর সোহাগভরে তাহার মুখচুম্বন করিয়া পাল্কীতে উঠিল।

আনোয়ারা রতনদিয়ায় আসিবার এক সপ্তাহ পর, ডাকপিয়ন তাহার নামে একটি বাক্স পার্শ্বেল বিলি করিয়া খুলিল। দেখা গেল সুন্দর একটি মূল্যবান বাক্সের ভিতর সোনার জেল করা একটি কোরান শরীফ ও বিচিত্র কারুকার্যখচিত একখানি জায়নামাজ। প্রত্যেক পদার্থেরই গায়ে লেখা আছে—”প্রীতি উপহার”। নুরল এসলাম স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পার্শ্বেলের পৃষ্ঠে তোমার নাম, জিনিসের গায়ে ‘প্রীতি উপহার’ ব্যাপারখানা কি?”

আনোয়ারা ক্ষীরোৎসবে সমাগত ভদ্রমহিলাগণকে নামাজ-রোজা সম্বন্ধে যেভাবে উপদেশ দিয়াছিল, তৎসমস্ত কথা স্বামীর নিকট খুলিয়া বলিল।

নুরল। চন্দ্রের সুধাময় কিরণে যেমন ভূবন আলোকিত হয়, তোমার গুণ ও মাহাত্ম্যে দেখিতেছি তেমনি নারীজাতির হৃদয় ধর্মালোকে আলোকিত হইতে চলিয়াছে।

আনো। চন্দ্রের হৃদয় অন্ধকারাচ্ছন্ন। কিন্তু সূর্যকিরণ সংযোগে ঐ রূপ প্রভাময় হইয়া থাকে।

নুরল। তথাপি সুধাংশুর সুধামাখা জ্যোতি—বিরহসন্তাপনাশিনী ও প্রাণতোষিণী।

আনোয়ারা প্রেমকোপে স্বামী গা টিপিয়া দিল।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

নুরল এসলাম অনেকদিন পাট-অফিসে চাকরি করিয়া পাটের কারবারে প্রভূত জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন, এ নিমিত্ত ব্যবসায়ে সত্বর লাভবান হইতে লাগিলেন। উকিল সাহেব লাভ দেখিয়া এককালে সাত হাজার টাকা দোস্তের কারবারে নিয়োগ করিলেন। তাহাতে নুরল এসলামের মূলধন ১৭/১৮ হাজার টাকা হইল। ব্যবসায়ে মূলধন যত বেশি হইবে, লাভও সেই অনুপাতে পড়িবে। ১৭/১৮ হাজার টাকা মূলধন লইয়া কলিকাতার বড় বড় মহাজনদিগের সহিত ঘনিষ্ঠতা ঘটাইয়া নুরল এসলাম লক্ষাধিক টাকার ব্যবসায় চালাইতে লাগিলেন। এতদ্দেশে পাট ব্যবসায়ের পূর্ণ উন্নতির সময় নুরল এসলাম এই ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছিলেন। সততায়, অভিজ্ঞতায় ও ব্যবসায়ের কল্যাণে তিনি ২/৩ বৎসরে স্বয়ং লক্ষপতি হইয়া উঠিলেন।

অদৃষ্ট প্রসন্ন হইলে সুখ-সন্তোষ উপযাচক হইয়া অদৃষ্টবানের দ্বারস্থ হয়। এই সময় নুরল এসলামের পত্নী অন্তঃসত্ত্বা হইলেন। অনন্তর সাত মাসের সময় সে স্বামীর আদেশ লইয়া মধুপুরে গেল।

আষাঢ়ে মাসে নূতন পাটের মরশুম আসিল। নুরল এসলাম বদ্ধপরিকর হইয়া ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইলেন। দেশের ভাল পাট জন্মিবার স্থানগুলি পূর্বেই নির্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছিলেন; যথাসময়ে ক্রেতা ও দালাল পাঠাইয়া তত্তাবৎ স্থানের পাট খরিদ করিয়া আনিলেন। শ্রাবণ মাসের প্রথম ভাগে সাতাইশ শত মণ পাট কলিকাতায় চালান দিলেন। বিক্ৰয়ান্তে আড়াই হাজার টাকা লাভ দাঁড়াইল। কলিকাতার মহাজন বেরামপুর আড়তে সমস্ত টাকার বরাত পাঠাইলেন। নুরল এসলাম টাকার জন্য বেরামপুর কর্মচারী না পাঠাইয়া, চারদাড়ী পাসি লইয়া স্বয়ং যাত্রা করিলেন। তাঁর ইচ্ছা, আসিবার সময় মধুপুরে স্ত্রীকে দেখিয়া আসিবেন। বেরামপুর হইতে মধুপুর দশ মাইল মাত্র পশ্চিমে।

নুরল এসলাম বেরামপুর আসিয়া বরাতি রোক্কা আড়তে দাখিল করিলেন। চব্বিশ হাজার চারিশত টাকার বরাতি ছিল। নুরল এসলাম নগদ চৌদ্দ হাজার টাকা ও অবশিষ্ট টাকার নোট লইলেন। চৌদ্দ হাজারে চৌদ্দ তোড়া টাকা হইল। নুরল এসলাম সন্ধ্যার পূর্বে টাকা লইয়া মধুপুরে আসিলেন। নৌকা ঘাটে লাগিলে তিনি অবতরণ করিয়া বাহির বাড়িতে কাহাকেও না দেখিয়া একছার বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। নুরল এসলামকে দেখিয়া দাসীর “সন্দেশ, সন্দেশ” রবে আনন্দ কোলাহল করিয়া উঠিল। একজন বয়স্কা দাসী “চাঁদ দেখুন” বলিয়া তখনই নুরল এসলামের আচকানের প্রান্ত ধরিয়া তাহাকে সূতিকাগৃহের সম্মুখে হাজির করিল। নুরল এসলাম দেখিলেন, শিশু সূতিকাগৃহ আলোকিত করিয়া শোভা পাইতেছে। দেখিয়া, নুরল এসলামের হৃদয় আনন্দে ভরিয়া গেল। তিনি অতঃপর অন্তঃপুরের সকলকে যথাযোগ্য আপ্যায়িত করিয়া বহির্বাটিতে আসিলেন। এই সময় পকেটে হাত দিয়া নোটের তোড়া দেখিয়া, দেওয়ানের দস্তখতি প্রাপ্তিস্বীকার রসিদ যাহা কলিকাতায় পাঠাইতে হইবে, তাহার কথা তাঁহার মনে পড়িল। তিনি পকেট খুঁজিয়া দেখিলেন রসিদ নাই। নৌকায় উঠিয়া বাক্স প্রভৃতি তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলেন, রসিদ আর পাওয়া গেল না। তখন মনে হইল বেরামপুরে দেওয়ান গদিতেই রসিদ ছাড়িয়া আসিয়াছেন। তিনি অবিলম্বে টাকার তোড়াগুলি বাড়ির উপর নামাইয়া রাখিয়া মাল্লাগণকে রসিদ আনিতে বেরামপুরে পাঠাইলেন।

যাইবার সময় নৌকার মাঝি কহিল, “হুজুর উজান পানি, আজ ফিরিয়া আসা যাইবে না। কাল এক প্রহরে আসিয়া পৌঁছিব।

নুরল এসলাম টাকার তোড়াগুলি তাঁহার শ্বশুরের শয়নঘরে হেফাজতে রাখিতে শাশুড়ীর নিকট দিলেন।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

ভূঞা সাহেব কার্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গিয়াছিলেন। সন্ধ্যার পর বাড়ি আসিলেন। জামাতাকে দেখিয়া আশির্বাদ করার পর কুশল-প্রশ্নাদি জিজ্ঞাসা করিলেন। রাত্রিতে যথাসময়ে সকলের আহার-ক্রিয়া সম্পন্ন হইল। ভূঞা সাহেবের কৃষাণ চাকরগুলি সকলেই তাঁহার প্রতিবাসী। এজন্য সকলেই রাত্রিতে বাড়ি যায়। কেবল পালাক্রমে প্রহরীরূপে একজন চাকর তাঁহার বাহির বাড়ির গোলাঘরে শয়ন করিলেন। ভূঞা সাহেব শয়ন ঘরে প্রবেশ করিয়া মেঝেতে সারি দেওয়া চৌদ্দটি তোড়া দেখিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এগুলিতে কি? কোথা হইতে আসিল?” স্ত্রী স্বামীর মুখের প্রতি তীব্র কটাক্ষ হানিয়া কহিল “খুলিয়া দেখ না?” ভূঞা সাহেব একটি তোড়া হাতড়াইয়া কহিলেন, “এ টাকা কে দিল?” স্ত্রী পুনরায় মর্মস্পর্শী কটাক্ষ নিক্ষেপে কহিল, “খোদায় দিয়াছে, জামাই আনিয়াছে।” ভূঞা সাহেব তাহার উত্তরে কিছু না বলিয়া পান চাহিয়া শয়ন খাটে উঠিলেন।

রাত্রি দ্বিপ্রহর। ভূঞা সাহেবের শয়ন-ঘরে বাতি জ্বলিতেছে। কৃপণের ঘরে এত রাত্রি পর্যন্ত আলো। প্রৌঢ়াতীত ভূঞা সাহেবের স্ত্রৈণ জীবনের আরাম দায়িনী, সুখ-সন্তোষ – বিধায়িনী, ধর্মসহচারী, কর্মবিধাতৃ, আজ্ঞাপ্রদায়িনী, প্রেমময়ী প্রাণাধিকা পত্নী গোলাপজান অতি সন্তর্পণে তোড়ার মুখ খুলিয়া টাকাগুলি মেঝেতে ঢালিতে লাগিল। এক দুই করিয়া পাঁচ তোড়া ঢালা হইল। এক গাদা টাকা! তদুপরি আরো দুই তোড়া ঢালিল। স্তূপাকার রজতমুদ্রার ধবল চাকচিক্য প্রদীপালোকে আরও উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। হায়রে রৌপ্য চাক্তি! সাধু বলেন, “তুমি হারামের হাড্ডি।” বহুদর্শী বলেন, “তুমি সর্বগুণিনাশিনী শয়তানের জননী। পৃথিবীর যাবতীয় অনিষ্টের মূলেই তুমি। কারুণ, নমরুদ, শাদ্দাদ, হামান ও ফেরাউন শ্রেণীর লোকের কার্যকলাপ ভাবিলে তোমাকে বাস্তবিক পিশাচের প্রসূতি বলিয়া মনে হয়; কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, তোমার এত দোষ, তুমি এত নীচ, তথাপি নরনারী তোমার মায়ায় এত মুগ্ধ। তোমার মোহুমদে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান তিরোহিত হয়। ধর্মবুদ্ধি সুদূরে পলায়ন করে। হায়! মানুষ যখন তোমার মোহনরূপে আত্মহারা হইয়া পড়ে, তখন অতি ভীষণ দুষ্কার্যও সুসঙ্গত মনে করে এবং পরিণাম চিন্তায় অন্ধ হইয়া তৎসম্পাদনে কৃতসঙ্কল হয়।’

রাশিকৃত রৌপ্যখণ্ড দীপালোকে ঝক্ ঝক্ করিতেছে। গোলাপজান একদৃষ্টে তৎপ্রতি চাহিয়া আছে। এত মুদ্রা এক সঙ্গে সে কখনও দেখে নাই, আজ দেখিয়া চক্ষু সার্থক করিতেছে! ইহা ছাড়া আরও এত টাকা পাশেই তোড়াবন্দী রহিয়াছে। সবগুলি টাকা সে নিজস্ব করিয়া লইয়া দেখিবার সঙ্কল্প করিতেছে। হায়! উদ্দাম-প্রবৃত্তি-প্ররোচনায় সে আর সাধের সঙ্কল চাপিয়া রাখিতে পারিল না। প্রকাশে পতিকে কহিল, “এ টাকাগুলি রাখা যায় না?” পতি চমকিয়া উঠিলেন, পরে কহিলেন, “তুমি বল কি? তোমার কথা ত, বুঝিতেছি না।” গোলাপজান এবার স্ত্রৈণ পতির মুখখানিতে ভুবন-ভুলান সম্মোহনবাণ নিক্ষেপ করিল, কামিনী কটাক্ষ দামিনীর প্রকৃতিসম্পন্ন। তাই কবি বলিয়াছেন—

“যে বিদ্যুচ্ছটা রমে আঁখি,
মরে নর তাহার পরশে।”

স্ত্রৈণ পতির মাথা ঘুরিয়া গেল। গোলাপজান শরসন্ধান সার্থক মনে করিয়া পুনরায় কহিল, “আমি টাকাগুলি নিজস্ব করিয়া রাখিতে চাই।” রৌপ্য-সুন্দরীর মোহিনী মায়ায় পতিও তখন অল্পে অল্পে অভিভূত হইয়া পড়িতেছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে কহিলেন, “জামাতা বিশ্বাস করিয়া যে টাকা দিয়াছে, তাহা তুমি কেমন করিয়া রাখিবে? “গোলাপজান কোপ-কটাক্ষে কহিল, “তুমি নামে মরদ, কিন্তু আসলে”— স্ত্রীর তীব্র বিদ্রুপে স্ত্ৰীগত প্ৰাণ পতির মনুষ্যত্ব দুর্বল হইয়া পাশবত্ব বাড়িয়া উঠিল। তখন তিনি মোহান্ধ হইয়া কহিলেন, “টাকা কি উপায়ে রাখিতে চাও?” গোলাপজান বাক্স হইতে এক সুবৃহৎ ছুড়ি বাহির করিয়া পাতিকে দেখাইল। পতির প্রাণ শিহরিয়া উঠিল। কিন্তু গোলাপজান অসঙ্কোচে ছুরির ধার পরীক্ষা করিতে লাগিল। ছুরির মুখে কিছু মরিচা ধরিয়াছিল। গোলাপজান খাটের নিচ হইতে একটা নূতন পাতিল বাহির করিয়া তৎপৃষ্ঠে সাবধানে মরিচা তুলিতে লাগিল। মৃৎপাত্রের হৃদয় চিরিয়া চিড় চিড় কিডু কিডু শব্দ উত্থিত হইতে লাগিল। সাবধান, অতি সাবধান! তথাপি মৃৎপাত্র যেন মর্মভেদী করুণ আর্তনাদে গোলাপজানকে বলিতে লাগিল, ওহে সুন্দরী, তুমি কুসুম-কোমল স্নেহ-দয়ারূপা পুণ্যের জননী, নারীর পূত নামে কলঙ্ককালিমা লেপন করিও না।” গোলাপজান তখন রৌপ্য চাক্তির লোভে আত্মহারা অভিভূতা; সুতরাং সে আর্তনাদের ভাবে তাহার পাষাণ-প্রাণ বিচলিত হইল না; কিন্তু বিচলিত হইল তাঁহার চিরানুগত পতির প্রাণ, আর অত্যধিক বিচলিত হইল পাশের সুতিকাগৃহের একটি নব- প্রসূতির অন্তরাত্মা; প্রসূতি, ছুরি ধার দেওয়ার বিকট শব্দে জাগ্রত হইয়া পৃথক শয্যায় নিদ্রাভিভূতা ধাত্রীকে নিঃশব্দে জাগাইল এবং অবিলম্বে অবস্থা জানিতে তাহাকে পিতার ঘরের দিকে পাঠাইয়া দিল। আনোয়ারার সূতিকাগৃহ দক্ষিণদ্বারী ঘরের সম্মুখে করিয়া দেওয়া হইয়াছিল।

এই সময় বিচলিত পতি, ভয়াতুর ভাষায় স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ছুরি দিয়া কি করিবে?” পিশাচী পতির পরিশুষ্ক মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “সাধে কি তোমায় না-মরদ বলিয়াছি, এতক্ষণ বুঝ নাই ছুরি দিয়া কি করিব? এই ছুরির সাহায্যে তোমাকে সবগুলি টাকা নিজস্বরূপে সিন্দুকে তুলিতে হইবে।” পতি কহিলেন, “সর্বনাশ! আমা দ্বারা কিছুতেই এক কার্য হইবে না।” স্ত্রী ক্রোধভরে কহিল, “হইবে যে না তাহা বুঝিয়াছি। আচ্ছা আমার সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হও।” পতি কহিলেন, “আমি তাহাও পারিব না। তোমাকে এই ভীষণ কার্য করিতে নিষেধ করিতেছি। এ দুষ্কার্য অপ্রকাশ থাকিবে না। এই খুনের বদলে আমাদের উভয়কে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে।” স্ত্রী বুক ফুলাইয়া কহিল, “আমি জাফর বিশ্বাসের কন্যা। আমার কথামত কাজ করিলে, ভূতেও জানিতে পারিবে না, তোমার গায়ে কাঁটার আঁচড়ও লাগিবে না।” পতি কহিলেন, “মেয়েটি চিরকালের মত দুঃখিনী হইবে।” স্ত্রী কহিল, “ মেয়ে ত’ ভারী সুখে আছে! তার যত পুঁজিপাটা ছিল, কোন রাজার মেয়েরও অত থাকে না। মেয়ে সর্বস্ব সোয়ামীর পায়ে দিয়াও তাহার মন পায় নাই। এই ত’ ছেলে হওয়ার পূর্বে নাকি জামাই তাহাকে ত্যাগ করিয়াছিল। আরও শুনিলাম, তোমার কুলিন জামাই সাহেব টাকা চুরি করিয়া জেল খাটিয়া আসিল। বেহায়া মেয়ে আবার তাহাকেই রক্ষা করিবার জন্য নিজের টাকা-গহনা তার দাদিমার সব পুঁজিপাটা দিল। উপরন্ত তুমিও অনটন সংসার হইতে ৩০০, ৪০০ টাকা দিলে। আবার মেয়ের দাদি মরার পর দাদির এতগুলি সোনা-রুপার গহনা নগদ টাকা-পয়সা দুষ্ট জামাই মেয়েকে ফুসলাইয়া বাড়িতে পার করিয়াছে। বাঁচিয়া থাকিলে এইরূপে আস্তে আস্তে তোমার গৃহস্থালী উজার করিবে। এই গুণের জামাই-মেয়ের জন্য তোমার মায়া ধরিয়াছে, তোমাকে আর বলিব কি?” কৃপণ পতি মনে মনে ভাবিয়া দেখিলেন, স্ত্রী যে সকল কথা বলিল, তাহার একটি কথাও মিথ্যা নয়। চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে তাহার পাশবত্ব পূর্ণমাত্রায় বৃদ্ধি পাইল; মনুষ্যত্ব অধিকতর দুর্বল হইয়া পড়িল। স্ত্রী দেখিল, পতির মন খুবই নরম হইয়া আসিয়াছে। সে আবার বলিতে লাগিল, আজ যদি ফয়েজ উল্লার (আজিম উল্লার পুত্র) সহিত মেয়ের বিবাহ হইত, তবে মেয়ের ও তাহার দাদিমার হাজার হাজার টাকার গহনা ও নগদ টাকা-পয়সা রতনদিয়ায় যাইত না; সমস্তই শেষে তোমার হাতে পড়িত। ফয়েজের পিতা যত টাকা নগদ দিতে চাহিয়াছিল তাহাও তোমার হাতে থাকিত। তাছাড়া, ভাই হামেশা টাকা-পয়সা দিয়া তোমার উপকার করিত, কিন্তু এই জামাইয়ের গুণে তোমার সব আশাতেই ছাই পড়িয়াছে।” এই পতির দুর্বল মনুষ্যত্বটুকু একেবারে লোপ পাইল। স্ত্রী পতির মনের ভাব বুঝিয়া আনন্দিত হইয়া কহিল, “আমি মনে করিয়াছি এই রাত্রেই এই আপদটাকে শেষ করিয়া টাকাগুলি সিন্দুকে তুলিব। ফয়েজ উল্লার বউ মরিয়াছে, তোমার বিধবা মেয়েকে তাহার সহিত বিবাহ দিয়া আমাদের চির আশা পূর্ণ করিব। মেয়েও সুখে থাকিবে, তুমিও এই টাকায় চিরকাল সুখে শুইয়া বসিয়াই কাটাতে পারিবে। এখন বুঝিয়া দেখ, আমি কেমন ফন্দি ঠাওরাইয়াছি।” এইবার পতি কহিলেন, “তুমি যাহা করিবে তাহার সাথী আছি।”

এদিকে ধাত্রী নব-প্রসূতির উপদেশে প্রসূতির পিতার ঘরের বারান্দায় উঠিয়া জানালা পথে সমস্ত দেখিল, সমস্ত শুনিল; অতঃপর ঘরে পুনঃ প্রবেশ করিয়া প্রসূতিকে সমস্ত কহিল। শুনিয়া প্রসূতি হতবুদ্ধি হইয়া কাঁপিতে লাগিল।

বিংশ পরিচ্ছেদ

শ্রাবণ মাস। বর্ষা পূর্ণযৌবনা। সর্বত্র পানি থৈ থৈ করিতেছে। ভূঞা সাহেবের বাড়ির পূর্বপার্শ্বের গলি দিয়া স্রোত পূর্ণবেগে দক্ষিণ দিকে ছুটিয়া চলিতেছে। সম্মুখে অমানিশীথিনী। জীব-কোলাহল মুখরিত মোদিনী সুষুপ্ত। রাত্রি নিঝুম। অনন্ত নীলাকাশের অগণিত প্রদীপ মিটি মিটি করিয়া জ্বলিতেছে, তথাপি নিবিড় অন্ধকার বিশ্বগ্রাস করিতে ছাড়ে নাই। ভূঞা সাহেবের বাড়ির উপরই যেন আজ তামসরাজের প্রকোপ বেশি। এই সময় গোলাপজান পতিকে সঙ্গে করিয়া ঘরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। অগ্রে বদ্ধপরিকর-বাসনা আততায়িনী পাপীয়সী;—হস্তে তীক্ষ্ণধার উজ্জ্বল অসি, পশ্চাতে কিঙ্করসম স্ত্রৈণ পতি;-হস্তে দড়ি, কলসী ও ছালা! যেন করাল কৃতান্তরূপিনী দানবীর পশ্চাতে মন্ত্রমুগ্ধদৈত্য।

পিশাচ-দম্পতি প্রাঙ্গণে পদার্পণ করিতেই আনোয়ারা সভয়ে সূতিকাগৃহের প্রদীপ নির্বাপণ করিয়া দিল। তখন সহসা ভীষণ অন্ধকার যেন গোলাপজানের গতিপথ রোধ করিয়া দণ্ডায়মান হইল। আবার সেই সূচীভেদ্য অন্ধকার ভেদ করিয়া বজ্রগম্ভীরে যেন শব্দ হইল— বিশ্বাসঘাতিনী, ডাকিনী, দস্যু-দুহিতে। সামান্য অর্থের লোভে, অহেতুকী হিংসার বসে, এ সময় কোথায় চলিয়াছিস? পাপীয়সী! ঐ দ্যাখ, তোর পাপানুষ্ঠান দর্শনে ঊর্ধ্বকাশে ফেরেশতাগণ স্তম্ভিত হইয়া রহিয়াছে। প্রকৃতি নীরব ও নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। এখনও নিরস্ত হও। এখনও পাপ আশা ত্যাগ কর। গোলাপজান ক্ষণকাল নিমিত্ত থমকিয়া দাঁড়াইল, মুহূর্তে আকাশপানে চাহিল, পরক্ষণে আবার সম্মুখদৃষ্টিতে দেখিতে পাইল, বাসনার বিচিত্র যবনিকা তাহার সম্মুখে প্রতিভাত। তখন সে ভবিষ্যৎ ভুলিয়া চিন্তা করিতে লাগিল, বিনা চেষ্টায় চৌদ্দ তোড়া টাকা ঘরে আসিয়াছে; সঙ্কল্প সিদ্ধির পর আবার চক্ষুঃশূল সতীন-কন্যাকে ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ করিয়া ভ্রাতার নিরাশায় আশাবারি সিঞ্চন করিতে পারিতেছি। পিত্রালয়ে যাইয়া, এ বাড়িতে বসিয়া তখন আদেশে তিরস্কারে সতীন কন্যার রূপের বাহার খর্ব করিতে পারিতেছি। অহো! এমন সুযোগে এত সুখ, এত সৌভাগ্য!

গোলাপজান প্রফুল্লচিত্তে পতি সঙ্গে বহির্বাটিতে উপস্থিত হইল। বহির্বাটিতে আসিয়া সে সাবধানে চতুর্দিকে দেখিয়া লইল। শেষে অনুচ্চভাবে স্বামীর সহিত অনেক বাদানুবাদ করিল। পরে স্থির হইল পতি মাথার দিক্ চাপিয়া ধরিবে, সে গলা কাটিবে। তখন ধীরে নিঃশব্দে দম্পত্তি বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল। গৃহ অন্ধকার। গ্রীষ্মাতিশয্যে জামাতা প্রদীপ নির্বাণ করিয়া শয়ন করিয়াছেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া গোলাপজান থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। তাহার হাতের অস্ত্র হঠাৎ মাটিতে পড়িয়া গেল। সে অবসন্ন-দেহে বসিয়া পড়িল।

পতি অস্ফুটস্বরে কহিলেন, “বসিলে কেন?”

স্ত্রী। আমার হাত-পা অবশ হইয়া আসিতেছে, বুকের মধ্যে ভয়ানক ব্যথা লাগিতেছে।

পতি। আমি ত’ প্রথমেই নিষেধ করিয়াছিলাম, দেখ আমারও গাঁ কাপিতেছে। আমি চলিলাম।

স্ত্রী। (অস্ফুটে) না, না, যাও কোথায়? এই উঠিতেছি। এই বলিয়া পাপিয়সী অদম্য বাসনাবলে দাঁড়াইয়া দৃঢ়মুষ্টিতে ছুরির বাঁট চাপিয়া ধরিল, পরে শয়ন-খাটের নিকট আসিয়া সম্মুখভাগ হাতড়াইয়া দেখিল কেহ নাই। শেষপ্রান্তে দেখিল, লোক আছে; পরীক্ষা করিয়া বুঝিল, গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত। তখন বিলম্বমাত্র না করিয়া একই সময়পতি মাথা ঠাসিয়া ধরিল, স্ত্রী সতীকন্যা-জামাতার গলা কাটিয়া দুই ভাগ করিল। হায় ভবের লীলা! হায় দুনিয়া!

একবিংশ পরিচ্ছেদ

অতঃপর দিখণ্ডিত লাশ ছালায় ভরিয়া কলসী সঙ্গে বাঁধিয়া স্রোতে ডুবাইয়া দেওয়া হইল। গোলাপজান আলো জ্বলিয়া বৈঠকখানার রক্তাদি ধৌত করিল। তখন রাত্রি দ্বি-প্রহর অতীত। স্বামী-স্ত্রী ঘরে আসিল। গোলাপজান ঘরে আসিয়া পুনরায় অবসন্নচিত্তে টাকার পার্শ্বে মেঝেতেই বসিয়া পড়িল। তাহার অন্তরাত্মায় ঘোর অশান্তির তুফান। ক্রমে সর্বাঙ্গ দিয়া ঘৰ্ম ছুটিল। সে নির্বাক হইয়া পরিশ্রান্ত কলেবরে ক্রমশঃ ঝিমাইতে ঝিমাইতে টাকার পার্শ্বে তন্দ্রাভিভূতা হইয়া পড়িল। ভূঞা সাহেব ম্রিয়মান হইয়া শয়নখাটে আশ্রয় লইলেন, কিন্তু পাপের বিভীষিকা তন্দ্রাবস্থায় উভয়কে অস্থির করিয়া তুলিল।

গোলাপজান তন্দ্রাবশে স্বপ্ন দেখিতে লাগিল, তাহার সম্মুখে বিশাল আগ্নেয় দেশ। তাহাতে সারি সারি অত্যুচ্চ আগ্নেয়গিরি অসংখ্য আগ্নেয় গহ্বর, অসংখ্য জ্বালাময় উৎস, স্থানে স্থানে আগ্নেয় নদী। পৃথিবীর অগ্নি অপেক্ষা যেন সহস্রগুণ তেজস্কর অগ্নি তাহাতে ধক্ ধক লক্ লক্ করিয়া জ্বলিতেছে এবং তাহার ভীম গর্জনে ভয়াবহ হুহুঙ্কারে সেই ভয়াবহ সর্বভূক্ দেশ কম্পিত হইতেছে। আবার পাপীদের অস্থিমর্জা পুড়িয়া পলকে পলকে ঝলকে ঝলকে তাহা হইতে অগ্নিময় ধূম্রপুঞ্জ মহাবেগে মহাগর্জনে ঊর্ধ্বগামী হইয়া সেই বহবায়তে অগ্নিরাজ্য সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছে। কোন স্থানে রক্ষিগণ অসংখ্য নর-নারীর হস্তপদ বন্ধন করিয়া জ্বালাময় অনলকুণ্ডে নিক্ষেপ করিতেছে; আর তাহাদের পঞ্জরাস্থিসমূহ উত্তপ্ত কটাক্ষে তপ্ত-তৈল ভর্জিত মৎস্যের ন্যায় পটপট চট পট রবে ফুটিয়া উঠিতেছে। কোন স্থানে নব- নবতিশিরা ফণিনী তীব্র হলাহল মুখে অসংখ্য নরনারীর বক্ষঃস্থল পুনঃ পুনঃ দংশন করিতেছে। আগ্নেয় রাজ্যের এই ভয়াবহ অবস্থা দর্শনে গোলাপজান থাকিয়া থাকিয়া আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিতে লাগিল। এই অবস্থায় সে আরও দেখিতে লাগিল, কোন স্থানে বিশ্বদাহী হুতাশন-তেজে শত শত মানব-মানবীর দেহ হইতে সফেন ক্লেদাদি নির্গত হইতেছে; আর তাহারা আর্তনাদ করিয়া বলিতেছে, কি ভীষণ যাতনা! কি নিদারুণ পিপাসা! উঃ বুক ফাটিয়া গেল। এই যন্ত্রণার উপর আবার তত্রত্য প্রহরীগণ, তাহাদের পিপাসা শান্তির ছলে উত্তপ্ত গলিত শবনির্যাস সেই হতভাগ্যদিগের মুখের মধ্যে ঢালিয়া দিতেছে। এই দৃশ্য দেখিয়া গোলাপজান আর স্থির থাকিতে পারিল না; চীৎকার করিয়া উঠিল। আবার সে দেখিতে লাগিল, কোন স্থানে ভীমদর্শন রক্ষীগণ শত শত লোকের চক্ষুমধ্যে অগ্নিময় ত্রিধার লৌহ শলাকা প্রবিষ্ট করিয়া দিয়া পেটের ভিতর দিয়া বাহির করিয়া ফেলিতেছে। কোন স্থানে শত শত লোকের আপাদমস্তক আগুনের বিনামা প্রহারে জর্জরিত করিতেছে। জিহ্বা টানিয়া বাহির করিয়া জ্বলন্ত লৌহশলাকায় প্রবিদ্ধ করিতেছে। হৃৎপিণ্ড ছিঁড়িয়া লেলিহান কুকুরের মুখে ফেলিয়া দিতেছে। শেষে শতকোটি মণ ভারী আগ্নেয় প্রস্তর বুকে চাপা দিয়া চলিয়া যাইতেছে।

এই সকল ভয়াবহ নিদারুণ দৃশ্য দেখিয়া গোলাপজান একান্ত ভীত চিত্তে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “হায়! আমি কোথায়? আমি এখানে কেন?” তখন জনৈক ভীমদর্শন নরকপাল, তাহার সন্নিহিত হইয়া সক্রোধে কহিল, ‘পাপিয়সী! এইত’ তোর উপযুক্ত স্থান। তুই অবলা হইয়া আজ যে কার্য করিলি, এমন দুষ্কার্য দুনিয়ায় কেহ করে না। হায়! তোর মহাপাপে আজ খোদাতায়ালার আরশ পর্যন্ত কম্পিত হইয়াছে। তোর নারীজন্মে শতধিক্! বিশ্বাসঘাতিনী, পরানষ্টে, আত্ম-বিনাশিনী, ঐ দ্যাখ তোর চির বাসস্থান।” গোলাপজান সম্মুখে দৃষ্টিপাত করিয়া আরও শিহরিয়া উঠিল। সে দেখিল সর্বাপেক্ষা গভীরতমন গভীর এক প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড। ঊষ্ণতার আতিশয্যে তাহার অগ্নিনীলবর্ণ হইয়া গিয়াছে এবং লোলশিখা আকাশ স্পর্শ করিয়াছে। নরকপাল গোলাপজানের গলদেশে অগ্নিময় পাশ সংলগ্নকরত টানিয়া লইয়া সে ভীষণ অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিল। সে তখন উচ্চ চীৎকারে জাগিয়া উঠিল।

এই সময় ভূঞা সাহেবও তন্দ্রাবস্থায় ধীর উচ্চরবে বলিতেছিলেন, “হায় কি করিলাম, পাপী, পাপ ধনে, প্রাণে বিনষ্ট হইলাম। ডাকিনী, পিশাচী তোর রূপে পাপ! ডাকাতের মেয়ে, বিবাহ চাই না, দুরহ দুরহ! (শয়নখট্টায় পদপ্রহর।)

গোলাপজান জাগ্রত হইয়া ভাবিতে লাগিল, –আমি যেরূপ ভয়ানক খোয়াব দেখিলাম; উনিও বুঝি সেইরূপ দেখিয়া বকাবকি করিতেছেন। খুন করিলে লোকে বুঝি ঐরূপ খোয়াবই প্রথম প্রথম দেখিয়া থাকে। তা’ খোয়াব ত’ মিছা। খোয়াবে কতদিন আকাশে উঠিয়াছি, সাগরে ডুবিয়াছি, বাঘের মুখে পড়িয়াছে, আগুনে জ্বলিয়াছি, কিন্তু আজতক্ তার কোনটিই ফলে নাই, সব মিছা হইয়াছে। ফলে, খোয়াব দেখা কিছুই নয়। মনের বিকারে ওসব হয়। এইরূপ বিতর্ক করিয়া সে মনে মনে সাহস সঞ্চার করিতে লাগিল। ভূঞা সাহেব আবার বলিতে লাগিলেন, “ওঃ কি সাংঘাতিক দুষ্কার্য! হায়, এ মহাপাপের মুক্তি নাই! ঐ যে পুলিশ— ফাঁসি—দ্বীপান্তর।” গোলাপজান তখন স্বামীর শরীরে ঠেলা দিয়া কহিল, “কি গো, ভূতে পাইয়াছে নাকি?

ভূঞা। অ্যা অ্যা কি?

গোলাপ। এতক্ষণ কি বকিতেছিলে?

ভূঞা। কৈ? কি? না, না।

গোলাজপান ঘৃণার ভাবে কহিল, “তুমি পুরুষ হইয়াছিলে কেন?” অতঃপর এইরূপে রাত্রি প্রভাত হইল।

ভূঞা সাহেব গ্রামের প্রধান ও পঞ্চায়েত। প্রাতঃকালে কার্যোপলক্ষ্যে অনেক লোক ক্রমে তাঁহার বাড়িতে সমাগত হইতে লাগিল। চৌকিদার ট্যাক্স আদায়ের সাড়া দেওয়ার হুকুম লইতে আসিল। ভূঞা সাহেব দারুণ অশান্তি-উৎকণ্ঠ হৃদয়ে চাপিয়া বাহির বাড়িতে আসিলেন। এই সময় গ্রামান্তর হইতে কতিপয় ভদ্রলোক প্রয়োজন বিশেষে নৌকাপথে তথায় উপস্থিত হইলেন। কথা প্রসঙ্গে তাঁহারা কহিলেন, “আমরা আসিবার সময় আপনাদের গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে একটা লাশ দেখিয়া আসিলাম। একটি আমগাছের শিকড়ে আটকাইয়া আছে এবং ছালার ভিতর হইতে পা দেখা যাইতেছে। অদ্য মরিয়াছে বলিয়া বোধ হইল। থানায় সংবাদ দেওয়া উচিত।” শুনিয়া ভূঞা সাহেবের মুখ দিয়া ধুলা উড়িতে লাগিল। উপস্থিত গ্রামবাসীরা লাশ দেখিতে চৌকিাদারসহ নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইল।

কিয়ৎকাল পর ছালায় ভরা সেই লাশ আনিয়া ভূঞা সাহেবের বাহির বাড়িতে নামান হইল। খুলিয়া দেখা গেল, গোলাপজানের প্রাণাধিক পুত্র বাদশা। গোলাপজান যখন অন্তঃপুর হইতে শুনিল, কে যেন বাদশাকে খুন করিয়াছে; তখন সে কিয়ৎক্ষণ বজ্রাহত ব্যক্তির ন্যায় নির্বাক ও নিস্পন্দ হইয়া রহিল। তাহার পর হঠাৎ দ্রুতবেগে উন্মত্তার মত বহির্বাটিতে আসিয়া মৃত পুত্রের নিকট মূর্ছিতা হইয়া পড়িল। ভূঞা সাহেব কাষ্ঠ পুত্তলিকার ন্যায় নিশ্চেষ্টভাবে স্বস্থানে বসিয়া রহিলেন। শবের চতুর্দিকে সমবেত লোক সকল নীরব ও স্তম্ভিত। অনেকক্ষণ পর-ধীরে সভয়ে জনতা মধ্য হইতে শব্দ হইল, “ওহ্! কি ভয়ানক খুন! কি নিদারুণ হত্যা! নিদারুণ হত্যা! হায়! এমন সর্বনাশ কে করিল?” এমন সময় গোলাপজান চৈতন্য লাভ করিয়া উন্মত্তভাবে বলিয়া উঠিল, “সর্বনেশে জামাই আমার ছেলে খুন করিয়া পলাইয়াছে। এই সময় নুরল এসলাম অগ্রসর হইয়া কহিলেন, “মাগো, আমি পলায়ন করি নাই, আপনার পুত্রও হত্যা করি নাই! টাকাই বুঝি এ কার্য করিয়াছে।” গোলাপজান ভীষণ বিকট কটাক্ষে নুরল এসলামের দিকে চাহিয়া কহিল, “ও ভরানেশে, তুই এখনও বাঁচিয়া আসিছ? আর না, আমার সে ছুরি কৈ? তাই দিয়া তোকে এখনি ছেলের সাথী করিতেছি।”—এই বলিয়া পুত্রনাশিনী ক্ষিপ্ত রাক্ষসীর ন্যায় উন্মুক্তবেশে ছুরি আনিতে অন্দরে দিকে ছুটিল। তাহার গতিরোধে কেহই সাহসী হইল না। আলুলায়িত উন্মাদিনীর সর্বসংহারিণী মূর্তি দেখিয়া দাসীগণ অন্তঃপুরে চীৎকার করিয়া উঠিল! আনোয়ারা সূতিকাগৃহে থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল! পিশাচী ছুরির জন্য ঘরে উঠিতেই হামিদার পিতা পশ্চাদ্দিক হইতে যাইয়া ঝাপটিয়া ধরিয়া তাহার হাত বাঁধিয়া ফেলিলেন।

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

বাদশা গোলাপজানের পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত পুত্র, নবীন যুবক, স্কুলে পড়ে। এ সকল পাঠক অবগত আছেন। সে রোজ রাত্রিতে প্রতিবাসী, সমবয়সী ও সমপাঠি দানেশদিগের বাড়িতে পড়িতে যাইত এবং রাত্রিতে সেইখানেই থাকিত। গতকল্য গিয়াছিল; কিন্তু অধিক রাত্রিতে দানেশদিগের বাড়িতে কুটুম্ব আসার শয়নস্থানের অভাবে তাহারা রাত্রিতেই বাদশাকে রাখিয়া গিয়াছিল।

বাদশা দানেশদিগের বাড়ি হইতে অত্র রাত্রিতে বাড়িতে আসিয়া মা বাপের বিরক্তির ভয়ে নিঃশব্দে বৈঠকখানায় নুরল এসলামের অপর পাশে শয়ন কারিয়াছিল।

ধাত্রী যাইয়া যখন নুরল এসলামের হত্যার আয়োজনের কথা আনোয়ারার নিকট বলিল, তখন আনোয়ারা প্রথমে ভীতচিত্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িল, শেষে ধাত্রীকোলে পুত্র রাখিয়া, অসীম সাহসে বাহির বাটীতে যাইয়া স্বামীকে নিঃশব্দে জাগরিত করিল এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আতুর ঘরে লইয়া আসিল। বাদশা যে নুরল এসলামের পাশে যাইয়া শয়ন করিয়াছিল, তাহা নুরল এসলাম বা আনোয়ারা কেহই জানিতে পারে নাই। আনোয়ারা স্বামীকে সূতীকাগৃহে লইয়া আসিবার অব্যবহিত পরেই গোলাপজান স্বামীসহ বহির্বাটিীতে উপস্থিত হয়। যাহা হউক, অতঃপর থানায় সংবাদ দেওয়া হইল। দারোগা আসিলেন, নুরল এসলামের জবানবন্দীতে সমস্ত প্রকাশিত হইয়া পড়িল, অপ্রত্যাশিতরূপে পুত্র নিহত হওয়ায় গোলাপজান একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার চিত্তের সমস্ত শক্তিও হিতাহিত জ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। যন্ত্রচালিত পুতুলের ন্যায় সেও সমস্ত দোষই স্বীকার করিল। লাশসহ আসামীদ্বয়কে মহকুমায় চালান দেওয়া হইল।

তথা হইতে তাহারা দায়রায় সোপর্দ হইল। জর্জ সাহেব বিচারান্তে হত্যাকারীদ্বয়ের প্রতি যাবজ্জীবন দীপান্তর বাসের দণ্ডাজ্ঞা প্রদান করিলেন। নুরল এসলাম যথাসময়ে টাকা ও নবপ্রসূত স্ত্রীসহ নিজালয়ে আসিলেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ওয়ারিশসূত্রে অতঃপর আনোয়ারা সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হইল। পিতার জোতের মূল্য বিশ হাজার ও অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য পাঁচ হাজার, মোট পঁচিশ হাজার টাকার সম্পত্তি পাইয়া আনোয়ারা তাহা তাহার স্বামীর চরণে উৎসর্গ করিল।

হত্যাকাণ্ডের গোলযোগে নুরল এসলামের পাটের ব্যবসায়ের অনেকটা ক্ষতি হইয়াছিল। তথাপি আশ্বিনের শেষে হিসাবান্তে ষোল হাজার টাকা লাভ দাঁড়াইল। পর বৎসর তিনি মরসুমের প্রথমেই কারবার আরও বিস্তৃত করিয়া লইলেন। লাভও আশানুরূপ হইতে লাগিল। এইরূপে নুরল ইসলাম বাণিজ্য প্রাসাদাৎ অল্প সময় মধ্যে ধনকুবের হইয়া উঠিলেন। অর্থাগমের সহিত তাঁহার পৈতৃক ভদ্রাসন দ্বিতল-সৌধরাজিতের শোভিত হইল। নুরল এসলামের অর্থ সাহায্যে ও স্বজাতিপ্রিয়তায় গ্রামের দুঃস্থ লোকগণের সুখ-সন্তোষ বৃদ্ধি হইতে লাগিল। তিনি দরিদ্র লোকের শিক্ষার জন্য স্বগ্রামে অবৈতনিক মাইনর স্কুল খুলিয়া দিলেন।

পূর্বে বলা হইয়াছে, আলতাফ হোসেন সাহেব পুত্রের জন্য যথাসর্বস্ব হারাইয়া সপরিবারে ভগিনীর আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। বহু পোষ্য লইয়া আসিয়াছিলেন, সুতরাং খরচ বাড়িয়া যাওয়ায় ভগিনীর তালুকটুকু অল্প অল্প করিয়া ঋণে আবদ্ধ করতঃ পোষ্যগণের গ্রাসাচ্ছাদন নির্বাহ করিতে লাগিলেন। ক্রমে ভগ্নীর দুরবস্থা চরমে উঠিল। মাতার সহিত বিবাদ করিয়া সালেহা কিছুদিন নুরল এসলামের বাড়িতে ছিল; কিন্তু অভিমানিনী মাতা কন্যাকে শাসন করিয়া পরে বাড়িতে লইয়া যান। এখন তাঁহাদের কখন অর্ধহারে কখন বা অনাহারে দিন যাইতে লাগিল। সালেহা সময় সময় বিশুষ্ক মুখে চুপে চুপে আনোয়ারার নিকট যায়। আনোয়ারা তাহাকে আদর করিয়া নানাবিধ সুখাদ্য পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া দেয়। কাছে বসাইয়া নানাবিধ সুখ-দুঃখের কথা বলে। সালেহার মায়ের খাওয়া-পরার কথা জিজ্ঞাসা করে, সরলা সালেহা মাতার অনাহার ও বস্ত্রকষ্টের কথা সব খুলিয়া বলে।

একদিন আনোয়ারা স্বামীকে কহিল, “আম্মাজানদিগের দিন চলে না, আল্লার ফজলে এখন তোমার স্বচ্ছল অবস্থা, এ সময় তাঁহাদিগকে সাহায্য না করা বড়ই অন্যায় হইতেছে।”

সন্তান হওয়ার পর, আনোয়ারা স্বামীকে তুমি বলিয়া সম্বোধন করিতে আরম্ভ করিয়াছে।

নুরল। তুমি কিভাবে সাহায্য করিতে বল?

আনো। তাঁহাকে পুনরায় এই সংসারে আনিতে চাই।

নুরল। তিনি মানিনীর মেয়ে; আসিবেন বলিয়া বোধ হয় না।

আনো। সংসারের সর্বস্ব তাঁহার হাতে ছাড়িয়া দিলে বোধ হয় আসিতে পারেন।

নুরল। তুমি তাহাতে রাজি আছ?

আনো। একশ বার, হাজার হইলেও তিনি আমাদের পূজনীয়া। তাঁহার অন্নবস্ত্রে কষ্টের কথা শুনিয়া আমার বরদাস্ত হইতেছে না। আমি তাহার হাতে সংসার ছাড়িয়া দিয়া সৰ্বদা তাঁহার খেদমত করিব।

নুরল। আমি তোমার প্রস্তাবে সুখী ও সম্মত হইলাম।

অতঃপর আনোয়ারা একদিন রাত্রিকালে খোকাকে কোলে লইয়া একজন দাসী সঙ্গে সালেহাদিগের আঙ্গিনায় উপস্থিত হইল; সালেহার মা আনোয়ারাকে দেখিয়া বিস্ময়ে অভিভূত হইলেন। কারণ, আনোয়ারা একজন রাজরাণীতুল্য। আর রাজরাণী না হইলেও ভিন্ন স্থানে পদার্পণ তাহার পক্ষে অসম্ভব। সালেহা আনোয়ারাকে দেখিয়া অতীব আনন্দিত হইল। তাড়াতাড়ি খোকাকে কোলে লইয়া সোহাগ করিতে লাগিল। আনোয়ারার নিরভিমান সারল্যে সালেহা-জননীর বিজাতীয় কৌলিন্যাভিমান খর্ব হইয়া আসিতে লাগিল। আনোয়ারা শাশুড়ীর পদচুম্বন করিয়া কহিল, “আম্মাজান, আমার খোকাকে দোয়া করুন।” উন্নতশিরা ফনিণী যেমন ঔষধের গন্ধে নতমস্তক ও দুর্বল হইয়া পড়ে, আনোয়ারার অনুপম শিষ্টাচারে সালেহা- জননীর অন্তর সেইরূপ কোমল হইয়া আসিল। সালেহা তাহার মায়ের কোলে ছেলে দিল, মা সাগ্রহে ছেলেকে চুম্বন করিয়া আশীর্বাদ করিলেন। আনোয়ারা কহিল, “আম্মাজান, খোকা আপনাকে লইতে আসিয়াছে, আপনি আপনার বাড়িতে চলুন।” অগ্নির উত্তাপে যেমন লৌহ দ্রবীভূত হয় এবার সালেহার মা সেইরূপ বিগলিত হইলেন। তিনি ভগ্নকন্ঠে গদ্‌গদ্‌ভাবে কহিলেন, “খোকার বাপ আমায় পৃথক করিয়া দিয়াছে।” আনোয়ারা দুঃখের স্বরে কহিল, “আম্মাজান, অমন কথা বলিবেন না। সংসার জুড়িয়াই এমন কিছু হয়; আপনি বাঁদীকে ফিরাইয়া দিবেন না।” অনুতাপে তখন সালেহা জননীর বিগলিত হৃদয় দগ্ধ হইতেছিল। তিনি কি যেন ভাবিয়া কহিলেন, “আগামীকল্য খোকা আসিলেই আমি যাইব।”

পরদিন পুনরায় আনোয়ারা পুত্র কোলে করিয়া আসিয়া সালেহাসহ তাহার মাতাকে বাড়িতে লইয়া গেল। অতঃপর আনোয়ারার স্বর্গীয় ব্যবহারে তাহার সৎ-শাশুড়ী আপন মায়ের অধিক হইয়া উঠিলেন। সুখ-শান্তিতে নুরল এসলামের সংসার আনন্দময় হইয়া উঠিল।

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

শীতকাল। দিবাকর দক্ষিণায়নে দাঁড়াইয়া সহস্ররশ্মি-প্রভায় ভূবন আলোকিত করিয়াছে। রতনদিয়া গ্রামের একটি দ্বিতল অট্টালিকার নির্জন চত্বরে একজন যুবতী প্রাতঃস্নানান্তে সুমসৃণ কাষ্ঠাসনে উপবেশন করিয়া সোনার আলনায় চুল শুকাইতেছে; একটি শিশু তাহার সম্মুখে সৌধদ্বারে দাঁড়াইয়া তুর্কী অর্শ্বে আরোহণ নিমিত্ত বারংবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু অকৃতকার্য হইয়াও চেষ্টায় বিরত হইতেছে না, যুবতী একদৃষ্টে শিশুর অশ্বক্রীড়া দেখিতেছে। এই সময় একখানি পত্র হস্তে একজন যুবক নিচের সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতেই, যুবতীকে তদবস্থায় দেখিয়া থামিয়া গেলেন এবং ঈষৎ অন্তরালে থাকিয়া তাহাকে দেখিতে লাগিলেন। যুবতীর সুলম্বিত ঘনকৃষ্ণ কুন্তলরাশি সোনার আলনায় সুধীর প্রভাত সমীরণে ইতস্তত মৃদুমন্দ সঞ্চালিত হইতেছিল। মেঘের কোলে ক্ষণপ্রভার অপরূপ শোভা অনেকেই দর্শন করিয়াছেন, কিন্তু রামধনু কোলে স্থিরা সৌদামিনীর মোহন মাধুরী কি কেহ কখন দেখিয়াছেন? যুবক অতৃপ্ত নয়নে যুবতীর এই অদৃষ্টপূর্ব ভুবন ভুলান রূপলাবণ্য দেখিতে লাগিলেন; হঠাৎ যুবতীর দৃষ্টি যুবকের উপর পতিত হইবামাত্র যুবতী সলাজ-সঙ্কোচে হাসিমুখে মাথায় ঘোমটা টানিয়া আসন হইতে উত্থিত হইল এবং কহিল, “এখন না আসিলে কি চলিত না?” যুবক অগ্রসর হইয়া সাহাস্যে কহিলেন, “এত সত্বর খোকাকে সব ভালোবাসা বিলাইয়া দিয়াছ?” খোকা যুবকের কথার প্রতিধ্বনি করিয়া কহিল, “ছব বালা বিলাই দেছে।” যুবক-যুবতী হাসিতে লাগিলেন। শিশু তখন অশ্ব ত্যাগ করিয়া অফুটন্ত কুসুমাননে পিতার কোলে উঠিতে ক্ষুদ্র বাহু দুইটি বিস্তার করিল, যুবক কহিলেন, “এস বাবা, আজ আমারও ভালবাসা সবটুকু তোমাকে দান করিয়া ফেলি।” এই বলিয়া তিনি শিশুকে কোলে লইয়া মুখ চুম্বন করিলেন।

যুবতী। তোমার দান দেখিতেছি হযরত আবুবকরের দানের চেয়েও বড়; তিনি সর্বস্ব দান করিয়া একখানি কম্বল সম্বল রাখিয়াছিলেন; তুমি যে কিছুই রাখিতেছ না।

যুবক। তুমিও ত’ কিছুই রাখ নাই।

যুবতী। কে বলিল রাখি নাই? আমার বাকি জেন্দেগীর নিমিত্ত যাহা প্রয়োজন, সমস্ত মজুদ রাখিয়া বাকিটুকু বিলাইতেছি।

যুবক। মজুদের প্রয়োজন?

যুবতী। নারীজন্মের কর্তব্যহেতু ও পরলোকের সম্বলার্থে।

যুবতী। কর্তব্য কিছুই বাকি রাখিয়াছ কি?

যুবতী। সমস্তই বাকি, দাসীর ওয়াশীলের ঘর শূন্য! বাকি পর্বত প্রমাণ অন্তকালেও তাহার আদায় অসম্ভব।

যুবতীর চক্ষু ভক্তি প্রেমে অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল। যুবক খোকাকে কোলে রাখিয়াই ঘর হইতে একখানি কুরসী টানিয়া আনিয়া যুবতীর সম্মুখে রৌদ্রে বসিলেন এবং তাহাকে তাহার আসনে বসিতে আদর করিলেন। ইত্যবসরে খোকা পিতার হস্ত হইতে চিঠিখানা কাড়িয়া লইয়া আজরাইলের হাতে দিতে উদ্যত হইল।

যুবতী। খোকা যে একেবারে নষ্ট করিয়া ফেলিল দেখিতেছি, ওখানা চিঠি নাকি?

যুবক। হ্যাঁ, ঐ চিঠির কথাই ত তোমাকে বলিতে আসিয়াছি।

যুবতী। বল না।

যুবক। বড় খুকীরা মসজিদ-মিলাদে আসিবে। কল্য স্টীমার-ঘাটে পাল্কী বেহারা রাখিতে বলিয়াছে, ছুটি পাইলে ডেপুটি সাহেবও আসিবেন।

যুবতী। শুনিয়া সুখী হইলাম। এখন স্ব-পতি ছোট খুখি আসিলেই আমার আশা পূর্ণ হয়।

যুবক। ছোট খুকি বোধ হয় আসিতে পারিবে না। তাহার স্বামী জ্বরে কাতর হইয়া বাড়ি আসিয়াছেন।

যুবতী। তিনি না এবার বি.এ. পরীক্ষা দিবেন? তবে বুঝি পরীক্ষা দেওয়া ঘটে না।

যুবক। তাই ত বোধ হইতেছে।

যুবতী। পরীক্ষা না দিতে পারুন—খোদার ফজলে সত্বর তিনি আরোগ্য লাভ করিলে হয়। যেমন মেয়ে তেমনি জামাইটি হইয়াছে। মামুজান বাছিয়া বাছিয়া সৎপাত্রে ভাগ্নী দুইটি সম্প্রদান করিয়াছিলেন। জামাই দুইটি যেন সাক্ষাৎ ফেরেশ্তা।

যুবক। ননদদের সতীন হইতে সাধ যায় নাকি?

যুবতী। (সহাস্যে) দুই ননদ দুইখানে,—যাইয়া সতীন হওয়া কঠিন; বরং তুমি সম্মত হইলে, তাহাদিগকে এখানে আনিয়া সতীন করিয়া লইতে পারি।

যুবক। তুমি এ ত মুখরা দুষ্ট হইলে কবে?

যুবতী। এত দুষ্টামির কথা নয়। ঢিলটি ছুঁড়িল পাটকেলটি খাইতে হয়।

যুবক। রক্ষা কর আর পাটকেল-টাটকেল ছুঁড়িও না। একটু অবজ্ঞার ঢিলা দিয়া জেলের

গুতানি খাইয়া আসিয়াছি।

যুবতী। থাক, তোমার মিলাদের আয়োজন কতদূর?

যুবক। উদোরপিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে নাকি?

যুবতী। সে কি কথা?

যুবক। মিলাদ আমার না তোমার?

যুবতী। যারই হোক, আয়োজন কতদূর?

যুবক। এত’ শুধু মিলাদ নয়, রাজসূয় উৎসব; এ উৎসবের বিধিবন্দোবস্ত করা ক্ষুদ্র মাথায় কুলাইতেছে না।

যুবতী। মাথা খাটাইয়া ফর্দ করিয়াছ। এখন তদৃষ্টে বন্দোবস্ত করা বেশি কঠিন কি!

যুবক। এত মওলানা, মৌলবী সাহেবানের আনা-নেওয়া, দেশসুদ্ধ লোকের আহারাদির বন্দোবস্ত করা কি সহজ ব্যাপার?

যুবতী। আমার দাদিমা বলিয়াছিলেন, দাদা মিঞা মক্কা শরীফ যাইবার পূর্বে এক মণ হরিদ্রার আয়োজনে গরিব ভোজনের মহোৎসব সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়াছিলেন। এ ব্যাপারে হদ্দ ১০/১২ সের হরিদ্রা ব্যয় হইবে, এর বন্দোবস্তে অক্ষম হইতেছ? দাদিমার মুখে আরও শুনিয়াছি, ঈমানের সহিত কার্যে প্রবৃত্ত হইলে, দয়াময় আল্লাহতালা নিশ্চয় লোকের মকছেদ পুরা করিয়া থাকেন। আমি জানি সৎকার্যে খোদা সহায়।

যুবক। তোমাদের দাদি-নাতিনীর কথা অভ্রান্ত ও শিরোধার্য; দয়াময় খোদা এ পর্যন্ত আমার সব মনোবাসনা পূর্ণ করিয়াছেন, তবে সে বাসনা ভিন্নরূপ।

যুবতী। ভিন্নরূপ কিরূপ?

যুবক। প্রথমে তোমাকে পাইবার বাসনা। দ্বিতীয় স্বাধীন-ব্যসায়ে জীবিকা-নির্বাহ করা, তৃতীয় তোমার চুল শুকানোর নিমিত্ত সোনার আলনা ও চাঁদীর কুর্সি প্রস্তত করিয়া দেওয়া।

যুবতী। চাঁদীর কুর্সি ত পাই নাই?

যুবক। ফরমাইশ দিয়াছি।

যুবতী। কবে পাইব?

যুবক। মিলাদের দিন।

যুবক। চাঁদীর কুসির কথায় আমার একটি স্বপ্নের কথা মনে পড়িল।

যুবক। শুনিতে পাই না?

যুবক। মিলাদের দিন।

যুবতী। যেদিন রুপার কুর্সিতে বসিব সেইদিন বলিব।

যুবক। আমারও একটি কথা স্মরণ হইল।

যুবতী। (অধরে হাসি লইয়া) বলিবে না?

যুবক। (স্মিতমুখে) সেদিন তুমি স্বপ্নের কথা বলিবে সেদিন আমার কথাও শুনিতে পাইবে।

এই সময় খোকা পিতার কোলে থাকিয়া ‘মা যাই, মা যাই’ বলিয়া আবদার ধরিল। যুবতী চুল গোছাইয়া পুত্র কোলে লইল। যুবক পুত্রকে চুম্বনে পরিতুষ্ট করিয়া আগমনপথে প্রত্যাগমন করিলেন।

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

কিছুদিন পর পুণ্যবতী আনোয়ারার কামনায় তাহাদের বহির্বাটিতে দশ সহস্র মুদ্রা ব্যয়ে এক পরম রমণীয় প্রকাণ্ড মসজিদ নির্মিত হইল এবং সর্বসাধারণের পানির ক্লেশ নিবারণের জন্য মসজিদ সম্মুখে এক সুবৃহৎ পুষ্করিণী খনিত হইল। আনোয়ারা গ্রামের মেয়েদিগের সুশিক্ষার নিমিত্ত অন্তঃপুর পার্শ্বে এক সুন্দর অট্টালিকায় বালিকা বিদ্যালয় খুলিয়া স্বয়ং তাহাতে শিক্ষা দিতে লাগিল।

মসজিদ ও পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠিত করিয়া আনোয়ারা সেই পুণ্যকার্যের স্মরণার্থে স্বামীর নিকট মিলাদ উৎসবের প্রস্তাব করিয়াছিল, নুরল এসলাম আহলাদ সহকারে স্ত্রীর প্রস্তাব অনুমোদন করিয়াছিলেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আপনারা বোধ হয় তাহা পূর্ব পরিচ্ছেদে যুবক-যুবতীর কথোপকথন হইতেই বুঝিতে পারিয়াছেন।

যথা সময়ে নুরল এসলামের বাড়িতে মসজিদ মিলাদের ধুম পড়িয়া গেল। সে রাজসূয় উৎসবের বিবরণ লিখিয়া পাঠক-পাঠিকাগণকে আর বিরক্ত করিতে চাই না। তবে আপনার জানিয়া রাখুন, আনোয়ারা এই ব্যাপারে ১০/১২ সের হরিদ্রা ব্যয়ের অনুমান করিয়াছিল, তাহার স্থলে অর্ধমণ হরিদ্রা খরচ হইল। মিলাদ উৎসবে নুরল এসলাম ও আনোয়ারার যাবতীয় আত্মীয়স্বজন, পরিচিত বন্ধুবান্ধব নিমন্ত্রিত হইয়া আসিলেন। কেবল স্বামী কাতর থাকাবশত নুরল এসলামের ছোট ভগিনী মজিদা আসিতে পারে নাই। এই উৎসবে পুরুষ মহলে উকিল সাহেব, অন্দর মহলে হামিদা, সব ব্যাপারের পরিপাটি বন্দোবস্ত করিতে সর্বাপেক্ষা বেশি পরিশ্রম করিয়াছিলেন। রতনদিয়ার চতুষ্পান্থ দশ বারো গ্রামের লোক, বেলগাঁও বন্দরের যাবতীয় হিন্দু-মুসলমান স্বয়ং জুটের ম্যানেজার সাহেব এই মহা মিলাদে নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছেন। তদ্ব্যতীত রবাহূত, অনাহূত অগণিত লোক এই মহোৎসবে উপস্থিত হইয়াছিল। সকলেই চতুর্বিধ রসপূরিত ভোজ্য তৃপ্তির সহিত ভোজন করিল। দীনহীন কাঙ্গালদিগকে যথাযোগ্য অর্থ ও বস্ত্র দান করা হইল। দান প্রাপ্ত ভোক্ত হর্ষবিহ্বলচিত্তে দলে দলে, ‘ধন্য আনোয়ারা বিবি’ ‘ধন্য দেওয়ান সাহেব’ রবে প্রতিধ্বনি তুলিয়া রতনদিয়া মুখরিত করিয়া তুলিল। মলয়ানিল-সংযোগে পুষ্পসৌরভের ন্যায় প্রেমশীল দম্পত্তির পুণ্যকাহিনী দেশদেশান্তরে বিঘোষিত হইতে লাগিল।

উপসংহার

মিলাদের দিন আনোয়ারা রজতাসন পাইয়াছে। মিলাদ শরিফ সুচারুরূপে সম্পন্ন হওয়ায়, সে পরদিন স্নানান্তে দ্বিতল বাসগৃহের সেই নির্জন চত্বরে পরমানন্দে সেই রুপার খাটে বসিয়া সোনার আলনায় পূর্ববৎ চুল শুকাইতেছে। এমন সময় নুরল এসলাম তথায় আসিয়া কহিলেন, “রুপার খাটে ত’ বসিয়াছ, এখন তোমার স্বপ্নের কথাটি শুনা যাক।” আনোয়ারা সহাস্যে কহিল, “যদি নাছোড় হও তবে শুন।” নুরল একখানি আসন টানিয়া স্ত্রীর সম্মুখে বসিলেন।

আনোয়ারা বলিতে লাগিল, “অনেক দিনের কথা, ভালরূপে মনে নাই, তবে যাহা মনে আছে তাহাই বলিতেছি। স্বপ্নে দেখিয়াছিলাম, আমি যেন একটি ক্ষুদ্র নদীরতীরে বসিয়া আছি। নদীর পরপারে নীলাকাশে চাঁদ উঠিয়া ক্রমে যেন আমার দিকে অগ্রসর হইতেছে। আমি কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া একদৃষ্টে তাহাই দেখিতেছি, সহসা অদূরে বুলবুলের প্রাণ মাতানো সঙ্গীতের ন্যায় এক সুমধুর রব আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। স্থিরচিত্তে শুনিয়া বুঝিলাম কে যেন অদৃশ্যে থাকিয়া কোরআন পাঠ করিতেছে। শেষে সেই স্বরে আবার এক বিশ্বপ্রেমভরা মোনাজাত শুনিতে পাইলাম। আমার মনে হইল, ইতিপূর্বে ওরূপ ভক্তিভাবপূৰ্ণ মোনাজাত ও কোরআন পাঠ কোথাও কখনও শুনি নাই। তাই আত্মহারা হইয়া শুনিতে লাগিলাম।”

স্ত্রীর স্বপ্নের কথা শুনিয়া নৌকার সেই কোরআন পাঠ ও মোনাজাতের কথা নুরল এসলামের স্মৃতিপথারূঢ় হইল। তিনি সহাস্যে কহিলেন, “ কোরান পাঠ ও মোনাজাত যত সুন্দর না হউক, তোমার বর্ণনাটি কিন্তু পরম সুন্দর! উহা লিখিয়া রাখিবার যোগ্য

আনো। তুমি যদি ঠাট্টা কর, তবে স্বপ্নের কথা আর বলব না।

নুরল। না, না, ঠাট্টা নয়, সত্য কথাই বলিতেছি।

নুরল প্রশান্ত সরল মুখে এই কথা কহিলেন। আনোয়ারা তখন বলিতে লাগিল, “কিয়ৎকাল পর আবার স্বপ্নাবেশেই দেখিলাম, একজন সুন্দর যুবক করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া আছে। আমি তাঁহাকে দেখিবামাত্র লজ্জিত হইয়া উঠিয়া যেন পলায়ন করিলাম। অল্পকাল পরে দেখিলাম, কে যেন আমার হাত-পা বাঁধিয়া দুর্গন্ধময় কূপে নিক্ষেপের চেষ্টা করিতেছে; এই সময় আবার আকাশের গায়ে মেঘ সাজিল, ঝড়-তুফানে ক্রমে প্রলয়কাণ্ড ঘটাইয়া তুলিল। মেঘের গর্জনে বিজুলির চমকে জীবজন্তু সব অস্থির হইয়া উঠিল। সর্বত্র দাউ দাউ করিয়া আগুন জ্বলিতে লাগিল। আমি ভয়ে চীৎকার করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে আবার সব থামিয়া গেল। শেষে দেখিলাম, এই,–’ এই বলিয়া আনোয়ারা থামিয়া গেল।

নুরল। এই কি?

আনো। (ভ্রূকুটি সহকারে) আরও ভাবিয়া বলিতে হইবে?

নুরল। এমন স্বপ্ন কি আর ইশারা করিয়া বলিলে চলে?

আনো। আমি দো-মহলা দালানে রুপার কুর্সিতে বসিয়া সোনার আলনায় চুল গুকাইতেছি। আর পূর্বে যে যুবককে দেখিয়া লজ্জায় পালাইতেছিলাম, তিনি আমাকে যেন কি বলিতেছেন।

এই পর্যন্ত বলিতেই আনোয়ারার রক্তিমাভ মুখমণ্ডল তাহার সুখতরঙ্গায়িত হৃদয়ের ভাব ফুটিয়া উঠিল। নুরল এসলাম পুনরায় হাসিয়া কহিলেন, “যুবক তোমাকে কি বলিয়াছেন!” আনোয়ারা বিলোল কটাক্ষে কহিলো, “অত দিনের কথা মনে নাই।”

নুরল। আমি বলিতে পারি। আনো। বল দেখি?

নুরল। যুবক বলিয়াছিলেন,–

প্রেমময়ী প্রেমের ছলে,
রোখো দাসে চরণ তলে।

আনোয়ারা আসন হইতে উঠিয়া নুরল এসলামের মুখ চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “তোমার পায়ে পড়ি, অমন মনগড়া কথা বলিলে আমি আর তোমাকে কোন কথাই বলিব না।” নুরল স্ত্রীকে বাহুবাশে বেষ্টন করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা আমি আর কিছু বলিব না। তোমার মনগড়া স্বপ্নের কথাই শুনা যাউক!”

আনো। আমার মাথার কছম, মনগড়া কথা নয়, এমন সফল স্বপ্ন কেহ কখন দেখে না। সেইদিন রুপার খাটের কথায় স্বপ্নের কথা মনে হওয়ায় খেয়াল করিয়া দেখিতেছি, স্বপ্ন আমার ষোল আনা রকমে ফলিয়াছে।

নুরল। এত বড় স্বপ্নের কথা এত দিন আমাকে বল নাই কেন?

আনো। তোমার ঐকদম শরিফের গুণে উহা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছিলাম।

নুরল। (হাসিয়া) আমি ত’ তোমার স্বপ্ন সফলতার কিছু দেখিতেছি না।

আনো। আরও চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিব?

নুরল। তাহাই হউক।

আনোয়ারা। তবে শুন। যে রাত্রিতে স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম, তাহার পরদিন ভোরবেলাতে খিড়কীর দ্বারো ওজু করিতে যাইয়া সত্যই নৌকার উপর কোরআন পাঠ ও মোনাজাত শুনিলাম; তারপর দেখিলাম সত্যই সেই স্বপ্নদৃষ্ট যুবক পেট কাট ছৈ-এর মধ্যে দাঁড়াইয়া বেগানা কুলবালার দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া আছে।

এই পর্যন্ত বলিয়া আনোয়ারা স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া মুখ চাপিয়া হাসিতে লাগিল।

নুরল এসলাম মৃদু হাস্যে কহিলেন, “তারপর?”

আনো। কিছুদিন পরে বাবাজান দুর্গন্ধকূপে নিক্ষেশের ন্যায় নীচবংশে আমার বিবাহের প্রস্তাব করিলেন। বিবাহের লগ্নদিনে সত্যই ঝড়-তুফান হইল, বাজ পড়িয়া আমাদের গোশালায় আগুন লাগিল। স্বপ্নের শেষ ফল এই দেখ, রুপার খাটে বসিয়া সোনার আনায় চুল শুকাইতেছি, আর সেই দু–”

নুরল। (হাসিয়া) আচ্ছা, নৌকার উপরে সেই দুষ্ট যুবককে দেখিয়া সেই সাধ্বী কুলবালার মনে কিছু উদয় হইয়াছিল না?

আনো। (স্মিতমুখে) কি আর মনে হইবে? দেখিয়া তাজ্জব হইয়াছিল।

নুরল। আর কিছু নয়?

আনোয়ারা ফাঁপরে পড়িয়া স্বামীর মুখে প্রেম-তীব্র কটাক্ষ হানিল।

নুরল। সত্য কথা না বলিলে ছাড়িব না। মেয়ে লোকে পুরুষের দোষই বেশি দেখে।

আনোয়ারা চুল গোছাইয়া পলায়নে উদ্যত হইল; নুরল ধা করিয়া তাহাকে বক্ষে চাপিয়া ধরিলেন।

আনো। ছাড়—সই আড়ি পাতিয়া দেখিবে!

নুরল। তিনি ওজিফা পড়িতেছেন।

আনো। খোকা আসিবে।

নুরল। সে মরিয়মকে (উকিল সাহেবের কন্যার নাম) সঙ্গে করিয়া বাগানে খেলা করিতেছে।

আনো। উভয়ের ভাব দেখিয়া সই আমাকে এক কথা বলিয়াছে।

নুরল! এ-কথা সেকথা থাক; মনের কথাটি আগে হোক।

আনো। আচ্ছা, চোখে দেখা আর ভাবা কি এক?

নুরল। সে বিচার পরে হইবে।

আনো। তুমি ত’ বলিয়াছিলে আমার একটি কথা স্মরণ হইতেছে।

নুরল। তাই আগে শুনিতে চাও?

আনো। হ্যাঁ।

নুরল। তুমি ফিরানীতে মধুপুরে গিয়া একমাস নফল রোজা করিয়াছিলে কেন? আনোয়ারা খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিয়া উঠিল।

নুরল। হাসিতেছ কেন?

আনো। তুমি নজুম হইলে কবে?

নুরল। নজ্জম হইলাম কেমন করিয়া?

আনো। পেটের কথা টানিয়া বাহির করিতে জান।

নুরল। কোন্ কথা?

আনো। যে কথা এতক্ষণ চাপিয়া আসিতেছিলাম, তোমার প্রশ্নের উত্তরেই তাহা বলিতে হইতেছ।

নুরল। বেশ, তবে বল।

আনো। আচ্ছা, তবে শুন,–সেই প্রথম দিন তোমাকে নৌকার উপরে দেখিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশকালে অস্ফুটস্বরে হৃদয়ের সহিত বলিয়াছিলাম, মা, তোমার কথা যেন সত্যে পরিণত হয়। আমি একমাস নফল রোজা করিব। ফল লাভ করিয়া ফিরানীতে মধুপুর গিয়া সেই মানত শোধ করিয়াছি।

নুরল। (মৃদুহাস্যে) কি ফল লাভ করিয়াছিলে?

আনোয়ারা প্রেমকোপে চোখ রাঙাইয়া চুপ করিয়া রহিল।

নুরল। আচ্ছা, মা তোমাকে কি কথা বলিয়াছিলেন?

আনো। মা বলিয়াছিলেন, শেষ রাত্রিতে স্বপ্ন বিফল হয় না। আমি শেষ রাত্রে ঐ খোয়াব দেখিয়াছিলাম।

নুরল। আর একটি কথা, তুমি অন্তঃপুরে যাইয়া সেদিন অত কাতর হইয়াছিলে কেন? আনো। কেন যে কাতর হইয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না—তবে সেদিন মায়ের (বিমাতার) অকারণ তিরস্কারে মন যেন একেবারে ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। সেই তিরস্কারে দারুণ যাতনায়, ঘৃণা আসিয়া ব্যথিত করিল, রাত্রিতে অনাহারে থাকিলাম এবং শেষ রাত্রিতে ঐরূপ স্বপ্ন দেখিলাম। ভোরে আবার তোমার উজ্জ্বল মুখচ্ছবি দেখিয়া স্বপ্ন সফলতায় মনের আনন্দের সঞ্চার হইল; কিন্তু পরক্ষণে আবার সই-এর মুখে চোরের ঘরে বিবাহের সংবাদ পাইয়া, সংসার আমার পক্ষে জ্বলন্ত শ্মশানসদৃশ হইয়া উঠিল। মন আবার নিরাশ সমুদ্রে ডুবিয়া গেল। দুঃখে হতাশায় প্রাণ ব্যাকুল হইয়া পড়িল। ফলে, এরূপ হর্ষ-বিষাদের অবিরাম ঘাত-প্রতিঘাতে মনের যে শোচনীয় অবস্থা হইল, তুমি সে সময় চিকিৎসা না করিলে, ঐ অবস্থায়ই আমার মৃত্যু ঘটিত। অতএব, আমি যে কেন কাতর হইয়াছিলাম তাহা মনে ভাবিয়া দেখ।

নুরল। তাহা ত’ দেখিয়াছি; কিন্তু লক্ষ টাকার জান বাঁচাইয়া তাহার পুরস্কার ত’ পাই নাই।

আনো। কেন? যাহা যত্ন করিয়া রক্ষা করিয়াছ, তাহা সমস্তই তোমাকে ধরিয়া দেওয়া হইয়াছে।

নুরল। সে ত মূলধন; কিছু উপরি লাভ কই?

আনোয়ারা কি যেন মনে করিয়া “আজ দিব” বলিয়া উৎফুল্ল হইয়া উঠিল।

“তবে এখনই দাও” বলিয়া নুরল সোৎসাহে মস্তক অবনত করিলেন। আনোয়ারা বিদ্যুদ্বেগে নিজে উত্তোলন করিয়া “তবে এই নাও” বলিয়া হাসিতে হাসিতে সাদরে স্বামীর মুখ-চুম্বন করিয়া মধুর উপরি লাভ প্রদান করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *