পরিচিতি

পরিচিতি

কিছুদিন পরপরই নতুন করে আলোচনা হয় এখনও লোকে মপাসাঁ পড়ে কি না, পড়লে কারা পড়ে? ইংরেজ, ফরাসি, জর্মন, রুশ? ফ্রান্সের লোকের কথা বাদ দেওয়া যেতে পারে। তারা অল্পবিস্তর সবসময়ই পড়বে। উপস্থিত শুনতে পাই, মার্কিন দেশেই নাকি তার সবচেয়ে বেশি কদর। যারা এসব আলোচনা করেন তারা প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্যগুলোর সঙ্গে আদৌ পরিচিত নন বলে সেগুলোকে হিসাবেই নেন না। আমার জানামতে আরব দেশে এখনও তার প্রচুর সম্মান; তার অন্যতম কারণ আরবি প্রচলিত মিশর থেকে বাইরুৎ-দামাস্কস পর্যন্ত ফরাসির প্রচলন ইংরেজির তুলনায় বেশি। অধুনা মার্কিন ভাষা ওইসব দেশে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে, কিন্তু তাতে মোসর কোনও ক্ষতি হবে না; কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি, মার্কিনজাত মপাসাঁ-ভক্ত।

তা সে যা-ই হোক, ফ্রান্সের বাইরে কিন্তু তাঁর রচনা (essays) নিয়ে কখনও কোনও আলোচনা হতে দেখিনি। এ যেন অনেকটা কনান ডয়েলের মতো। তার শার্লক হোমস নিয়ে সবাই এমনই মুগ্ধ যে তার অন্যান্য লেখার দিকে কেউই বড় একটা নজর দেন না। শার্লক হোমসে এমনই ঝাল যে তার পর বাকি তাবৎ রান্না অতিশয় সুনিপুণ হলেও ফিকে বলে মনে হয়।

আমার বলার উদ্দেশ্য এ নয় যে, মোসর প্রবন্ধ তার ছোটগল্পকে হার মানায়। বস্তৃত তার সর্বোত্তম উপন্যাসদ্বয়ই–য়্যুন ভি এবং বেল আমি(১)– তার ছোটগল্পকে হার মানাতে পারেনি।

তার নাট্য ও কবিতাও নিম্নাঙ্গের। পক্ষান্তরে চেখফ ছোটগল্প এবং নাটক, উভয়েই অদ্বিতীয়।

আমার নিজের মনে হয়, মপাসাঁর প্রবন্ধগুলো অত্যুত্তম। তার গুরু ফ্লোবের ও গুরুসম– ফ্লোবেরের অন্তরঙ্গ বন্ধু– তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে তিনি যে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন সেগুলো অতুলনীয়। মপাসাঁর ছোটগল্প বা উপন্যাসে পাঠক পাবেন দেহ ও যৌবন ক্ষুধার ছড়াছড়ি কিন্তু সত্যকার প্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা, কিংবা সে শ্রদ্ধার প্রতি সহানুভূতি, অথবা স্নেহের প্রতি অনুরাগ, মানুষের এসব তাবৎ মহামূল্যবান বৈভবের প্রতি মপাসাঁর কোনও আকর্ষণ নেই। তিনি যা চান তাই ফুটিয়ে তুলতে পারেন বলে যখন এগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন তখন সেগুলো প্রকাশ করেছেন তার যাদুকাঠির পরশ দিয়েই কিন্তু তখন তাঁর উদ্দেশ্য অন্য, ওইসব বৈভবকে সম্মান দেখানো নয়, ওগুলো ব্যবহার করা হয়েছে যেন প্যাডিংরূপে। অথচ আমরা জানি মপাসাঁ তার মাকে ভালোবাসতেন গভীর রূপে বস্তুত এরকম মাতৃভক্ত পুত্র সর্বকালেই সর্বদেশেই বিরল– যে-লোক প্রতিদিন ভালো-মন্দ-মাঝারি, ডাচেস থেকে স্বৈরিণী পর্যন্ত বিচরণ করে, আপন ফুর্তির জন্য কাড়া কাঁড়া টাকা ছড়ায়, হেন দুষ্কর্ম নেই যা তার অজানা এবং যার জন্য সে পয়সা খর্চা করতে রাজি নয়– সেই লোক ঠিক নিয়মিতমাকে মোটা টাকা পাঠায়, নিয়মিত মধুর চিঠি লেখে, পাছে মা টের পেয়ে যান তাই অতিশয় অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রাচীন প্রথামত নববর্ষের পরব রাখতে গায়ে মায়ের বাড়িতে যায় (তার পাঁচ দিন পরই তার মাথার ব্যামো- সিফিলিসজনিত উন্মাদরোগ তাকে এমনি বিভ্রান্ত করে যে তিনি ছুরি দিয়ে গলা কেটে আত্মহত্যা করার চেষ্টা দেন; অনুগত ভৃত্য ফ্রাসোয়া পিস্তলের গুলি আসন্ন সর্বনাশের আশঙ্কায় সরিয়ে রেখেছিল), সে যে শ্রদ্ধা ভালোবাসার সম্মান দিত না, এ তো হতেই পারে না।

শুধু তাই নয়, সেই শ্রদ্ধার নির্লজ্জ উচ্ছ্বাস পাঠক পাবেন ফ্রোবের ও তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে লিখিত মোসর প্রবন্ধে।

তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে লেখা তার প্রবন্ধটি অন্য দেশ কতখানি সম্মান দেয়, আমার জানা নেই। তবে রুশ দেশ তার চরম সম্মান দেয় ও দিয়েছে। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তুর্গেনিয়েফের মৃত্যুর পঁচাত্তর বৎসর পূর্ণ হলে সারা রুশদেশব্যাপী তাঁকে স্মরণ করা হয়। সেই উপলক্ষে তুর্গেনিয়েফের ভাইয়ের মেয়ে (কিংবা আপন জারজ, পরে আইনসম্মত কন্যা দেশবাসী কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে তার সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি তার প্রবন্ধ আরম্ভ করেন তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে মপাসাঁর প্রশংসাকীর্তন নিয়ে। তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে রুশ দেশ এবং রুশ দেশের বাইরে বিস্তর প্রবন্ধ বের হয়েছে (এবং আশ্চর্য, মপাসাঁ যখন তার খ্যাতির চরমে, যখন তাঁর ছোটগল্প ইয়োরোপের প্রায় সর্ব ভাষায় অনূদিত হচ্ছে তখন তিনি খাতির পাননি এক রুশ দেশে, যদিও রুশ দেশ সবসময়ই ফ্রান্স-পাগল, কারণ রুশে তখন তলস্তয়, তুর্গেনিয়েফ, লেসকফ(২), দস্তয়েস্কি, চেখফ কেউ-বা তাঁর বিজয়শঙ্খ বাজাচ্ছেন বিপুল বিক্রমে, কারও বাণী দূর-দূরান্তরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, কারও-বা মধুর কণ্ঠের প্রথম কাকলি দেশের সর্বত্র নবীন চাঞ্চল্য জাগিয়ে তুলেছে- মপাসাঁকে লক্ষ করার ফুর্সং তাদের নেই) কিন্তু ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে তুর্গেনিয়ে পরিবারের প্রতিভূ স্মরণ করলেন মাপাসাঁকে সেই মপাসাঁ যার প্রবন্ধ পৃথিবীর সর্বত্র পরিচিত।(৩)

তাই বলছিলুম, মপাসাঁর নির্লজ্জ উচ্ছ্বাস পাঠক পাবেন এ দুটি প্রবন্ধে এবং তার অন্যান্য রচনায়। মানুষ মপাসাঁকে চেনবার ওই একমাত্র উপায়। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা মপাসাঁ বন্ধুদের সঙ্গে তো করতেনই না, লেখাতে যা করেছেন তা-ও পঞ্চাশ লাইনের বেশি হয় কি না হয়।

আর আছে তার চিঠি। কিন্তু সেগুলোতে তিনি তার হৃদয়ের গভীর ব্যথা, তার আশা-আকাক্ষা সম্বন্ধে নীরব। তার কারণ গুরু ফ্লোবের কর্তৃক জর্জ সানডকে লেখা তার অন্তরঙ্গ চিঠি যখন ছাপাতে প্রকাশিত হয়, তখন ফ্রান্সের মতো দেশেও তাই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। মপাসাঁ তখনই সাবধান হয়ে যান। পারলে মপাসাঁ ফ্লোবেরের চিঠিগুলো প্রকাশিত হতে দিতেন না। শেষটায় যখন দেখলেন প্রকাশ হবেই হবে তখন মপাস সে সংকলনের ভূমিকা লিখতে রাজি হন। তিনি আশা করেছিলেন গুরুর পদতলে তাঁর শ্রদ্ধা অর্ঘ্য নিবেদন দেশের পাঁচজনকে বুঝিয়ে দেবে, ফ্লোবেরকে কোন পরিপ্রেক্ষিতে দেখে তার সত্য মূল্য দিতে হয়।

তবুও মপাসাঁর চিঠিগুলো যে অমূল্য, তুলনাহীন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

আমার জানা মতে তার সর্বশেষ চিঠি তার ডাক্তারকে লেখা এইটি সর্বশেষ না হলেও এটিতে পাঠক পাবেন রাজহংসের মরণগীতি।

তার চিকিৎসক ডাক্তার আঁরি কাজালি (জালাওর)-কে লিখিত,

কান, ইজের কুটির।
আমি একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছি। তারও বেশি। আমি এখন মৃত্যুর শেষ যন্ত্রণায়। নাকের ভিতর নোনা জল ঢেলে সেটা ধুয়েছিলাম বলে তারই ফলে আমার মগজ নরম হয়ে গিয়েছে। সেই নুন মাথার ভিতর গাঁজিয়ে ওঠায় (ফের্মাতাসিয়ে– ফার্মেন্টশন) সমস্ত রাত ধরে আমার মগজ গলে গিয়ে চ্যাটচেটে পেস্টের মতো নাক আর মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে। এ হচ্ছে আসন্ন মৃত্যু, আর আমি উন্মাদ।(৪) আমি প্রলাপ বকছি। শেষ-বিদায় বন্ধু, বিদায়! তুমি আমাকে আবার দেখতে পাবে না…(৫)

আমি ডাক্তার নই, তাই বলতে পারব না, মানুষের জীবিতাবস্থায় কিংবা মৃত্যুর পরও তার নাক কান দিয়ে মগজ গলে বেরোয় কি না, নুনের ফার্মেন্টেশন হয় কি না তা-ও জানিনে। স্পষ্টত এ চিঠি উন্মাদের প্রলাপ। কিন্তু প্রশ্ন, উন্মাদ কি স্বীকার করে সে প্রলাপ বকছে?

***

ফরাসি ভাষায় মপাসাঁর দু-খানি অত্যুত্তম রচনা ও পত্রসংগ্রহ আছে। ইংরেজিতে এগুলোর অনুবাদ হয়েছে কি না জানিনে।

(১) CHRONIQUES, ETUDES, CORRESPONDANCE

DE GUY DE MAUPASSANT

 Recueillies Prefacees et Annotees par

RENE DUMESNIL

 avec la collaboration de Jean Loize

 et publiees pour la premiere fois avec nombreux

DOCUMENTS INEDITS

LIBRAIRIE GRUEND, 60, RUE MAZARINE. 60,

PARIS, VI, 1938

(২) CORRESPONDANCE INEDITE

DE

 GUY DE MAUPASSANT

Recueihie et presentee

ARTINE ARTINIAN

avec la collaboration d

EDOURAD MAYNIAL

 Editions Dominique Wapler,

6, Rue de Londres,

Paris, 1951

বছর কুড়ি পূর্বে একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকা নানা দেশের চুয়াত্তর জন খ্যাতনামা লেখককে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, কোন কোন লেখক তাদের সৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। উত্তরে মপাসাঁ- জর্মন কবি হাইনে, এবং হোমার হুইটমানের সমান সম্মান পান এবং ইবসেন ও তাঁদালের চেয়ে বেশি।

এদেশেও মপাসাঁ নিয়ে কৌতূহল আছে। কয়েকদিন পূর্বে শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক অধুনা লিখিত সাহিত্যিকদের জীবনী সম্বলিত সাহিত্যালোচনার একখানা অত্যুত্তম পুস্তক আমার হাতে এসে পৌঁছল। সোনার আলপনা (এভারেস্ট বুক হাউজ, ১৯৬০)।

বইখানিতে অন্যান্য মনোরম প্রবন্ধের ভিতর গি দ্য মপাস ও ইভান তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধেও দুটি রচনা রয়েছে।

আজকাল এদেশে অনেকেই ফরাসি শিখছেন। উপরের দুখানা মূল গ্রন্থ ও বাঙলা বইখানা নিয়ে আলোচনা হলে বাঙলা সাহিত্য উপকৃত হবে।

————

১. অনেকেরই বিশ্বাস, যেহেতু মপাসাঁ মেয়েদের ইটানেল হাট বলেছেন তাই পুরুষদের তিনি খুব সম্মানের চোখে দেখতেন। বস্তৃত বে আমি পড়ার পর পুৰুষকুলকেও ইটার্নেল জিগলো (পুং বেশ্যা) বলা যেতে পারে। তবে যৌনক্ষুধাতুর মপাস স্বভাবতই মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন বেশি এবং তাদের সম্বন্ধে লিখেছেন বেশি।

২. লেসকফের একটি দীর্ঘ গল্প আমি অনুবাদ করেছি, বিশ্বসাহিত্য এ গল্পটি অতুলনীয় বলে– যদিও আমি পাঁচটা বাবদের ন্যায় এটাতেও অক্ষম। একাধিক গুণীকে অনুরোধ করার পরও তারা যখন সেটি অবহেলা করলেন, তখন বাধ্য হয়ে আমাকেই করতে হল। প্রেম নামে প্রকাশিত হয়েছে।

৩. মপাসাঁর এই প্রবন্ধটি আমি অনুবাদ করি একই সময়ে পচাত্তর বত্সরের পরব উপলক্ষে।

৪-৫. এই দুটি ছত্র ক্যাপিটাল অক্ষরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *