পরিক্রমা – ৮

আজ শেষ রাত্রি। ক’দিন কয়েক রাত্রি তাদের পথে পথে কেটেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন পেশার—বিচিত্র স্বভাবের বহু মানুষ এসে এক নামের বাঁধনে বাঁধা পড়েছিল একসূত্রে। 

কাল থেকে আবার কে কোনদিকে ছিটকে পড়বে। আর অনেকের দেখাও হবে না। গোপালের মা বুড়ি বলে ললিতাকে, 

—বৌমা, মানুষ জাত, পক্ষী জাত, আজ এখানে—কাল কে কোথায় ছিটকে পড়বে কে জানে বাছা। ক’দিন ঠাকুরের দয়ায় কি আনন্দেই না কাটল। 

ললিতাও বলে—সত্যি খুড়িমা। ক’দিন সংসারের সব জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলেছিলাম, এরপর আবার সেই যন্ত্রণা শুরু হবে। 

নবীন ডাক্তারও ক’দিন এখানে এসে তার গতানুগতিক জীবন, ব্যাধির ভিড়—মানুষের যন্ত্রণা এগুলোকে ভুলেছিল। এক নতুন জগতের সন্ধান পেয়েছিল সে। নবীন ডাক্তারও বলে, 

—ভুবনদা, আপনি তো ঠাকুর মন্দির ধর্মশালা এসব নিয়েই থাকেন, আর আমরা থাকি মানুষের রোগ-যন্ত্রণা-অসুখ নিয়ে, ক’দিন বেশ ছিলাম। আবার ফিরতে হবে সেখানে। 

ভুবনবাবু হাসেন—সেকি ডাক্তার, ওটাও তো জীবন গো। বরং বহুজন হিতায়—বহুজন সুখায় তুমি কাজ করো। ওতে অনেকের ভালো হয়—অনেকে শান্তি পায়—সুখ পায়। তার মাঝেও নাম-গান করা। জীবনকে ভোগ নয় ত্যাগের মধ্যে নিয়ে চলো—দেখবে গৌরসুন্দরের কৃপা তুমি পেয়েছ। 

.

সন্ধ্যা পার হয়ে রাত্রি নামছে। 

যাত্রীরা আজ অনেকেই ঘুমোয়নি। কারল এই সময় এই মিলনমেলা ভেঙে গেছে, ওরাও ফিরে গেছে যে যার ঘরে। 

যুধিষ্ঠির গাছতলায় বসে আছে। রামচন্দ্রও জুয়ার ছক ছিঁড়ে ফেলেছে। 

যুধিষ্ঠিরকে বলে—ওসবে আর নাই রে। 

হঠাৎ ওদিকে একটা কলরব শুনে তাকাল যুধিষ্ঠির। 

একটা বাঁশঝোপের নীচে কিছুলোক জটলা করছে, কাকে নাকি সাপে কামড়েছে। 

অবশ্য সাপের অভাব এখানে নেই। পথও সরু-পায়ে চলা মাটির পথটার দু’দিকে আশতোওড়া, ভেঁটু, কালকাসিন্দের ঘন জঙ্গল। চারিদিকে ঘন বাঁশবন, অন্য সব গাছের জটলা। সাপ-শিয়ালের আস্তানা। 

সর্পাঘাতের খবর শুনে যুধিষ্ঠির উঠে পড়ে, 

—কাকে সাপে কাটাল গো? আমাদের পরিক্রমার দলের কাউকে নয় তো? 

রামু বলে—চল তো, দেখি। 

ওরা উঠে পড়ে। 

মোনা মিত্তির সন্ধ্যার পর এইদিকে আসছিল। তার মদের মাত্রাটা কদিনে বেড়ে গেছে। তার সহচর ভূধরও বলেছে বারবার, 

—বাবু, বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে মালটা। একটু কমান। 

যুধিষ্ঠিরও বলে—বাবু ওসব ছেড়ে দিয়ে প্রাণভরে গৌর নাম করুন, দেখবেন শান্তি পাবেন।

মোনা মিত্তির হাসে, বলে—ব্যাটা ধম্মপুত্তুর, আজীবন চোর থেকে এখন কদিন সাধু হয়েই জ্ঞান দিচ্ছ বাওবা! কালকা যোগী ভাতকে বলে ‘পেসাদ’। 

এটি যেমন চলছে, চলবে। সবাই আমাকে ছেড়ে গেছে ধম্মপুত্তুর! বউ-পিরিতের মেয়েছেলে সবাই সবাই বেইমান। কিন্তু একমাত্র ‘ফেথফুল’ হচ্ছে এই কারণসুধা। বেইমানি জানে না। আর একেই ছেড়ে দেব? নেভার। 

মোনা মিত্তির মদের বোতল সম্বল করেই পথে পথে ঘুরছে ক’দিন। 

.

চন্দনার কিছুই করার নেই। 

সে ওই মানুষটাকে ছন্নছাড়ার মতো পথে পথে ঘুরতে দেখেছে। 

নিজেও গেছে তার কাছে। 

মোনা মিত্তির গাছতলায় বসে আছে। ঝিমোচ্ছে। হঠাৎ চন্দনাকে দেখে তাকাল। 

চন্দনা বলে—এ কি করছ? পথে পথে এই ভাবে ঘুরছ কেন? 

নাওয়া-খাওয়াও ঠিক মতো করো না। আমার তাঁবুতেই চলো—ওগো! 

মোনা মিত্তির বলে, 

—তোমাকে বাড়ি ফিরতে বলেছি। মিত্তির বাড়ির বউ—এইভাবে পথে পথে ঘুরবে? তা যাওনি। স্বামীর কোনো কথাই মানবে না আর তোমার কথা মানতে হবে আমাকে? তোমার স্বামী আমি—তাকে ইনসাল্ট করো এতবড় হিম্মৎ। 

চন্দনা ওকে থামাবার চেষ্টা করে। বলে, 

—বাড়ি চল, সেখানে গিয়ে আমার অবাধ্যতার জন্য যে কোনো শাস্তি দাও মাথা পেতে নেব। বাড়ি চল— 

—নেভার। আমার কথাই যখন শুনবে না—আমার পথে আমাকে চলতে দাও। গো টু হেল।

মোনা মিত্তির চন্দনাকে উল্টে শাসিয়ে নিজে এড়িয়ে গেছে। চন্দনা হতাশ হয়েই ফিরেছে।

আর বারবার মনে হয়েছে এক জায়গায় সে নিদারুণভাবে হেরে গেছে। হেরে গেছে ওই পায়েলের কাছে। 

দেখেছে চন্দনা পায়েলকে। 

সেই মেয়েটা যেন ইন্দ্রাণীর মতোই ডাঁটসে চলেছে পরিক্রমায়। যেন কাউকে চেনে না। তার স্বামী ওই মেয়েটার জন্যই সব ছেড়ে পথে পথে ঘুরছে যাকে চন্দনা কোনমতে আজও ফেরাতে পারেনি। 

চন্দনার মনে হয় স্বামীর মঙ্গলের জন্য সে তার মাথা নিচু করে ওই মেয়েটার কাছেই যাবে। স্ত্রী হয়ে প্রার্থনা জানাবে পায়েলের কাছে সে যেন তার স্বামীকে ফিরিয়ে দেয় দয়া করে। সেই দয়াটুকুই চাইবে সে ওই রহস্যময়ী পায়েলের কাছে। এছাড়া আর কোনো পথই নজরে পড়ে না চন্দনার। 

মানদা বলে—ঘরে চলো বউদিমণি। 

চন্দনা বলে—শেষ দেখেই যাব মানদা। আর দুটো রাত বই তো নয়। 

তবু চন্দনা এসেছিল পায়েলের কাছে। 

সেদিন পরিক্রমার পর রাত নেমেছে। যে-যার তাঁবুতে রয়েছে। 

চন্দনা এর আগেও নজর রেখেছিল পায়েলের উপর। তার তাঁবুটাকেও চিনে রেখেছিল।

তাই সন্ধ্যার পর একটু রাত বাড়তে চন্দনা একাই আসে পায়েলের তাঁবুতে। ভেবেছিল সেখানেই দেখবে চন্দনা দুজনকে স্ফূর্তি-ফার্তা করতে। হয়তো দিনে পরম ভক্তিমতীর মতো ঘুরে বেড়ানো ওই পায়েল রাতের অন্ধকারে বদলে যাবে। মহফিলই বানাবে হয়তো তাঁবুতেই সে আর মোনা মিত্তির। 

চন্দনা কিন্তু পায়েলের তাঁবুতে ঢুকে অবাক হয়। 

ওদিকে সুগন্ধি ধূপ জ্বলছে, একটা প্রদীপ জ্বেলেছে পায়েল গৌরাঙ্গের ছবির সামনে—। আর নিজে ওই ছবির সামনে তন্ময় হয়ে ধ্যান করছে। মোনা মিত্তির তাঁবুতে নেই। 

পায়ের শব্দে তাকাল পায়েল। চন্দনাকে দেখেছে সে। পরনে সাদামাঠা শাড়ি, তবু বড় ঘরের বউ বলেই মনে হয়। 

পায়েল শুধোয়—আপনি? 

চন্দনা বলে—আমার স্বামীর সন্ধানে এসেছি বোন। ঘর-সংসার ছেড়ে সে তোমার এখানেই পড়ে থাকে। এখানেও এসেছে তোমার সঙ্গে। তাকে ঘরে ফিরে যেতে বলো বোন। একজন ঘরের বউ হয়ে তোমার কাছে এইটুকু চাইছি বোন—আমার স্বামীকে মুক্তি দাও। 

পায়েল দেখছে ওকে। ওর কথায় বুঝেছে ওই মহিলার পরিচয়টা। 

পায়েল বলে—তিনি তো এখানে আর থাকেন না বোন। তাঁর নিজের তাঁবুতেই তিনি থাকেন। আমি ওঁকে এখানে আসতে নিষেধ করেছি। বরং তাঁকে বাড়ি ফিরে যেতেই বলেছি বারবার। তার সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধই নেই। 

চন্দনা শুনছে পায়েলের কথাগুলো। 

নিজেও দেখেছে ওই মিত্তির মশায় এখানে নেই। বের হয়ে আসে সে তাঁবু থেকে।

রাত্রি নেমেছে আম বাগান-বাঁশ বনে। 

দূরে গাছগাছালির ওদিকে দেখা যায় গঙ্গার বিস্তার। আকাশের উজ্জ্বল তারার প্রতিবিম্ব জাগে ওই বিস্তারে। 

চন্দনা চলেছে মোনা মিত্তিরের তাঁবুর দিকে। 

যদি দেখা পায় তার চোখের জলেই আবার অনুরোধ করবে ঘরে যাবার জন্য। 

কিন্তু তাঁবুতে মিত্তির মশাই নেই। 

ভূধরও যোগ্য গুরুর যোগ্য শিষ্য। প্রভু খান বিলেতি আর চ্যালা ভক্ত দেশি চুল্লু। তাই নিয়েই বসেছে। বউরানিকে দেখে বোতল সামলে এগিয়ে আসে—মা! 

—বাবু কোথায়? 

চন্দনার প্রশ্নে ভূধর বলেছিলেন, গেলেন ওদিকে কোথায়। 

—কিছু বলতে হবে? 

চন্দনা বলে–না। আমি মন্দিরের পাশের তিন নম্বর তাঁবুতে আছি। তোমার বাবু ফিরলে খবর দিও। 

চন্দনা চলে আসে নিজের তাঁবুতে। কোথায় গেল লোকটা কে জানে। দেবদ্বিজে ভক্তি তার নেই—মন্দিরেও যাবে না মোনা মিত্তির। 

.

মোনা মিত্তিরের বিলিতি মদ ফুরিয়ে গেছিল ওবেলায়। মাতালরা চেনে মদের ব্যবসায়ীদের। ওই পরিক্রমায় একজন খোল বাজিয়ের সন্ধান পেয়েছে যে ওইসব মালের ধান্দা করে। মোনা মিত্তির সকালে তাকে টাকা দিয়েছে—সে তার লোক দিয়ে শহর থেকে বৈকালের বাসেই মাল এনে দেবে অবশ্য তার জন্য খরচা দিতে হবে। মোনা মিত্তির তাকে খরচা দিয়েছে, আর সন্ধ্যার পর মাল তখনও না পেয়ে মিত্তির মশাই সেই মদের ব্যাপারির সন্ধানে বের হয়েছে। তাঁবু বসতের এদিকের অস্থায়ী চালায় ওদের থাকার জায়গা। সেখানেই এসেছে মোনা মিত্তির আর মালও পেয়ে যায়। কারণ ছেলেটা তখনই ফিরেছে—মাল নিয়ে যাবে মিত্তির মশায়ের কাছে পথেই ত্যানার দর্শন পেয়ে মালের বোতল দুটো দেয় মিত্তির মশাইকে। 

পথের মাঝেই মিত্তির মশাই বোতলে চুমুক দিতে থাকে। অনেকক্ষণ এ পদার্থ তার পেটে পড়েনি। আর পেটে পড়তেই তার মেজাজও খুশ হয়ে ওঠে। 

মোনা মিত্তির ফিরছে তার তাঁবুর দিকে। 

পথটা বনে ঢাকা। উপারে বাঁশ বনের ঘন ছায়া এখন জমাট অন্ধকারে পরিণত হয়েছে। রাতে এদিকে লোকজন আসে না। মোনা মিত্তির নির্ভয়ে চলেছে ওই পথে, হঠাৎ পায়ের কাছে চলমান একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ পেতেই নেশা ছুটে যায় ভয়ে। 

চমকে ওঠে মোনা মিত্তির। 

—ওরে বাবা সাপ, সাপ! 

আবছা একফালি চাঁদের আলোয় দেখা যায় বিরাট সাপটা হঠাৎ বাধা পেয়ে সামনে বিদ্যুৎগতিতে ফণা মেলে উঠে দাঁড়ায় আর মোনা মিত্তির সরে যাবার আগেই সগর্জনে তার পায়েই ছোবল মেরেছে। 

শিউরে আর্তনাদ করে মোনা মিত্তির। 

—সাপ্–সাপে কামড়েছে রে! উরে বাপ্! 

সাপটা ছোবল মেরেই লম্বা দেহটা টেনে বাঁশবনের ওদিকে অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে যায়, আর তার চিহ্নও দেখা যায় না। ওদিকে মাটিতে পা চেপে ধরে বসে মোনা মিত্তির আর্তনাদে করে, 

—সাপে কামড়েছে গো—মস্ত সাপ! উঃ সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল! জ্বলে গেল আমার!

লোকজন জুটে গেছে ওর আর্তনাদে। যুধিষ্ঠিরও ছুটে এসে দেখে মোনা মিত্তিরের পায়ের ক্ষত থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরছে আর লোকটা আর্তনাদ করছে—জ্বলে গেল! সারা গা-জ্বলছে! যুধিষ্ঠির বুঝেছে আসল জাত সাপের কামড়ই! সঙ্গে সঙ্গে মোনা মিত্তিরের চাদরটাকে ছিঁড়ে দুটো তিনটে সরু ফালি বের করে তাই দিয়ে ওই ক্ষতের উপরে দু’জায়গায় শক্ত করে বাঁধন দিয়ে বলে রামুকে, 

—একে তোল। কোনমতে বয়ে নিয়ে চল মন্দিরের কাছে ডাক্তারবাবুর তাঁবুতে। এখানে কিছু করা যাবে না। 

ওরা মোনা মিত্তিরকে ওই অবস্থায় তুলে নিয়ে এসে হাজির করে নবীন ডাক্তারের তাঁবুর বাইরে। পাশেই নাটমন্দির—ওরই চাতালে ওকে শুইয়ে দিয়ে এবার যুধিষ্ঠির হাঁক-ডাক শুরু করে,

—ডাক্তারবাবু, অ ডাক্তারবাবু! টপ্ করে আসেন-দ্যাখেন মিত্তির মশাইকে কালে কেটেছে গো। 

নবীন ডাক্তারও দিনভোর পরিক্রমা সেরে কাজকর্ম মিটিয়ে এবার শোবার আয়োজন করছেন। ওদিকে ভুবনবাবু দেবতার শয়ন দিয়ে নিজে সামান্য দুধ একটু মিষ্টি খেয়ে শুতে যাবেন, এমন সময় ওই চিৎকার শুনে বের হয়ে আসেন। 

অনিরুদ্ধও কাছেই ছিল। কাল ভোর থেকেই ওর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে কাজের ফর্দ বুঝিয়ে দিচ্ছিল। যুধিষ্ঠিরের মুখে কাকে ওই সাপে কাটার খবর শুনে সেও বের হয়ে আসে।

মন্দির চাতালে ওরা শুইয়ে রেখেছে মোনা মিত্তিরকে। যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্ করছে সে।

আর এর মধ্যে অনেকে এসে হাজিরও হয়েছে। 

কেউ বলে—রোজা থাকলে তাকেই ডাকো, এ জাতসাপের কামড়। ভালো রোজা হলে ঠিক মন্ত্রের জোরে সেই সাপকে টেনে এনে বিষ তুলিয়ে ছাড়বে। রোগীও বেঁচে যাবে। 

কে বলে—রোজা-ফোজার দিন আর নাই। একে হাসপাতালেই পাঠাতে হবে। দ্যাখো—গাড়ি-ফাড়ি যদি মেলে। 

নবীন ডাক্তার খবর পেয়েছে, ভুবনবাবুই তাকে খবর দিয়ে আনান। তখন বেশ সময় কেটে গেছে। 

যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্ করছে মোনা মিত্তির। 

নবীন ডাক্তার দেখে শুনে বলে—বিষধর সাপের কামড়েই এমন হয়েছে। কেস ভালো বুঝছি না ভুবনদা। অ্যান্টি ভেনম সিরাম পেলে একবার চেষ্টা করে দেখা যেত। ওই একমাত্র ওষুধ। 

এসে পড়েছে খবর পেয়ে পায়েলও। 

দেখে যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্ করছে মোনা মিত্তির। চমকে ওঠে পায়েল। মোনা মিত্তির যন্ত্রণায়- আর্তনাদ করছে। পায়েল বলে, 

—ডাক্তারবাবু, যত টাকা লাগে আমি দিচ্ছি, ওই মানুষটাকে বাঁচান। ওষুধ-ইনজেকসন যা লাগে আনান। 

পায়েলই বেশ কিছু টাকা বের করে দেয়। ভুবনবাবু বলেন, 

—চেষ্টা করতে পারে মানুষ, বাকি তো সব ভগবানের হাত। পায়েল বলে, 

—পরিক্রমায় এসে তার নাম নিয়ে তার পথে ঘুরলেও এটুকু দয়া কি তার হবে না? নবীন ডাক্তার এর মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে দেখে বলে, 

—সেদিন তুই তো রাতে ওষুধ এনেছিলি। আজ একটু চেষ্টা কর যুধিষ্ঠির। যদি ওকে বাঁচানো যায়।

যুধিষ্ঠির বলে, 

—চোর যুধিষ্ঠিরের চোখ বিল্লির চোখ ডাক্তারবাবু, আঁধারেও জ্বলে। দাও কাগজপত্তর লিখে, দেখি যাই শহরে। 

যুধিষ্ঠির বের হয়ে যায়। 

ভুবনবাবু দেখছে ওই অসহায় যন্ত্রণা-কাতর লোকটাকে। ঈশ্বরের নামও নেয় না সে অনাচার-অত্যাচার করেই দিন কাটায়। তবু কি দেবতার করুণা পাবে না সে! 

মোনা মিত্তির আর্তনাদ করে—আমাকে বাঁচাও ঠাকুর! আমি মহাপাপী—তোমার কি দয়া পাব না ঠাকুর? 

ভুবনবাবুর মনে হয় এও যেন সেই গোরাচাঁদেরই এক বিচিত্র পরীক্ষা। অতীতে জগাই-মাধাই-এর মতো পাষণ্ডদের তো গৌরসুন্দরই উদ্ধার করেছিলেন। আজও কি সেই লীলাই প্রকট হতে চলেছে। 

পায়েল দেখেছে ব্যাপারটা। ওষুধের ব্যবস্থা করে আজ পায়েল বের হয়ে আসে। রাতের স্তব্ধতা নেমেছে। জানে না পায়েল দেবতার কি ইচ্ছা! মোনা মিত্তিরকে সে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিল বারবার। তার সংসার, স্ত্রী সবই আছে। পায়েলও আজ এই ভোগ-বিলাসের মোহময় জীবন থেকে সরে গিয়ে ত্যাগের এই জীবনে, নিজেকে দেবতার চরণে আত্মনিবেদন করে বাঁচতে চায় নতুন পথে। এপথে মানুষকে চলতে হয় একাই। সব ছেড়ে তাই এই পথেই আসতে চায় সে। তাই মোনা মিত্তিরকেও সরিয়ে দিয়েছিল। মোনা মিত্তির আজ এই বিপদ বাধিয়েছে। 

লোকটাকে সে এড়াতে চেয়েছিল তারই ভালোর জন্য, কিন্তু সেই লোকটা এভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হবে, তা ভাবেনি। 

.

চন্দনা এতদিন আশায় বুক বেঁধে পথে পথে ঘুরেছে। আজ পরিক্রমার শেষ রাত্রি। কাল দুপুর নাগাদ পরিক্রমা সেরে যে যার ঘরে ফিরে যাবে। চন্দনাকেও কালই কলকাতায় ফিরতে হবে, কিন্তু সে কি শূন্য হাতেই ফিরে যাবে সেখানে? তার স্বামীকে কি ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না? গৌরসুন্দরের দয়া কি সে পাবে না? 

চন্দনার চোখে-জল নামে। গৌরাঙ্গদের করুণাঘন মূর্তির সামনে আজ তার সারা মন যেন কান্নায় ব্যাকুল হয়ে ভেঙে পড়ে। 

হঠাৎ মানদার গলা শুনে তাকাল। 

মানদা এমনিতেই বেশ ডাঁটিয়াল মেয়ে। বাইরে তাঁবুর মুখেই তার ভরাটি গলা শোনা যায়। 

—এখন বউদিমণির সঙ্গে দেখা হবে না। 

অন্য একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। বলে সে, 

—কিন্তু দেখা আমাকে করতেই হবে। 

মানদা বলে—কাল সকালে এসো—এখন যাও তো। 

—এখুনিই দেখা না করলে তোমার বউদিমণিরই ক্ষতি হতে পারে। 

কথাটা শুনেছে চন্দনাও। বলে সে, 

—কে রে মানদা! 

মানদা ক’দিনেই পরিক্রমায় ঘুরে অনেক খবরই জেনেছে। জেনেছে সে ওই মেয়েটির পরিচয়। বলে মানদা, 

—সেই ঢলানি মেয়েটা গো! নাচনেওয়ালি—এখন পৈতে পুড়িয়ে বেম্মচারিণী হয়েচেন।

পায়েলের এসব কথা শোনার সময় নেই। সে এই ফাঁকে মানদার হাত এড়িয়ে তাঁবুর ভিতরে চলে এসেছে। চন্দনাও তাকে দেখে অবাক হয়। 

—তুমি! এসময়! এখানে? 

পায়েল বলে। 

—মিত্তির মশাইকে সাপে কামড়েছে, তিনি খুব অসুস্থ। ওরা তাকে মন্দির চাতালে ওই বকুল গাছের নিচে নিয়ে গেছে! 

চমকে ওঠে চন্দনা—সেকি! 

তার স্বামী, যার জন্য সে আজ পথে পথে ঘুরছে সেই লোকটাকে এই রাতের অন্ধকারে বিষধর সাপে কামড়েছে, কি হবে কে জানে! 

খবরটা শুনেই চন্দনা বলে, 

—মানদা, সরকার মশাইকে খবর দিয়ে মন্দিরে আয়, আমি যাচ্ছি। কথাগুলো বলে ঝড়ের বেগে বের হয়ে যায় চন্দনা একাই। 

.

মোনা মিত্তিরের জ্ঞান ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, বিষের যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্ করছে সে, অস্ফুট আর্তনাদ করে। নবীন ডাক্তারের করার কিছুই নাই। ভুবনবাবুও যেন দিশেহারা হয়ে পড়েন—এসে পড়ে চন্দনা। আজ দু’চোখে তার অশ্রুধারা। দেখছে সে ওই মানুষটাকে। হাহাকার করে ওঠে চন্দনা, 

—একি সর্বনাশ করলে গৌরহরি! তোমার নাম নিয়ে তোমার পরিক্রমায় এসে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরতে হবে দয়াময়! এ কি বিচার তোমার? কি অপরাধ করেছি ঠাকুর! যে আমার স্বামীকে হারিয়ে ফিরতে হবে! 

কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। মন্দিরের চাতালে ওই মূর্তির সামনে মাথা ঠোকে চন্দনা। সবাই নীরবে এই যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্যটা দেখছে। 

ভুবনবাবু বলেন—ধৈর্য ধরো মা! দয়াময়কে ডাকো—তাঁর দয়া পাবেই। 

সমবেত কণ্ঠে ওরা নাম-গান করছে। 

এই নাম-গান আজ থেকে পাঁচশো বছর আগেও এখানে ধ্বনিত হয়েছে। এই পুণ্যভূমিতে এই সিদ্ধ বকুলের ছায়ায় অতীতে একদিন গৌরাঙ্গদেবের কৃপায় তাঁর আশ্রিত ভক্ত সারঙ্গদেবের মহা নাম-গানে এক সর্পাঘাতে মৃত বালক প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। 

আজ পাঁচশো বৎসর পর এই তীর্থে যেন সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে।

ওই ভক্তের দল নাম-কীর্তন করে চলেছে— 

ভুবনবাবুর করার কিছুই নাই। অচেতন মানুষটার মুখে মাঝে মাঝে চরণামৃত দিয়ে চলেছে কুশিতে করে, কিছুটা ভিতরে যায়, কিছুটা বাইরে পড়ে যায়। ওইভাবেই চরণামৃত দিয়ে চলেছে আর নাম-গান করে চলেছে রাত্রির আদিম-অন্ধকারে অসহায় মানুষগুলো। 

সামনে সেই কয়েক শতাব্দীর বৃদ্ধ বকুল গাছও মহাকালের বুকে নীরব সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। নবীন ডাক্তার নাড়ি দেখছে—বিষক্রিয়ায় নাড়িও নিস্তেজপ্রায়—এখনও ইনজেকশন পেলে সে শেষ চেষ্টা করে দেখত। এখনও যুধিষ্ঠির ফেরেনি ওষুধ নিয়ে, এক অসহায় অবস্থার মধ্যে দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে— 

নাম সংকীর্তন চলেছে। দ্রুতলয়ে নাম-গান করছে তারা- 

ব্যাকুল হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে চন্দনা। আর পায়েল আজ যেন ওই মানুষটাকে আর চেনে না। সে ওই নামগানে ডুবে গেছে। 

যুধিষ্ঠির দৌড়োতে দৌড়োতে ঢোকে। 

—বাবু, ডাক্তারবাবু—এই নাও ওষুধ ইনজেকশন সব পেয়েছি— 

নবীন ডাক্তারও ওর পথ চেয়েই ছিল, ওকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়—এসেছিস! বাঁচালি যুধিষ্ঠির।

ওরা নাম গান করছে—ওই নামের আভাসেই যেন আজও এতকাল পরেও গৌরাঙ্গ দেবের কৃপা তারা পাবে, সব বিপদ কেটে যাবে। 

নবীন ইনজেকশন দিতে থাকে! 

নাম—গান চলেছে—হঠাৎ চোখের পাতা নড়ে ওঠে মোনা মিত্তিরের। ধীরে ধীরে চোখ খোলে সে। 

নবীন ডাক্তার ওর নাড়ি দেখছে, তার মুখেও আশার আশ্বাস জাগে। 

—কেমন আছেন মিত্তির মশাই? 

নবীন ডাক্তারের কথায় মিত্তির তাকাল। ধীর কণ্ঠে বলে—অনেকটা ভালো বোধ হচ্ছে।

নবীন বলে—আর একটু শুয়ে থাকুন—কিছুক্ষণের মধ্যে আরও সুস্থ বোধ করবেন।

ভুবনবাবুও রয়েছেন। চন্দনাকে বলেন নবীন ডাক্তার—আর কোনো ভয় নাই মা।

ভুবনবাবু বলেন— সবই গৌরসুন্দরের দয়া মা 

মোনা মিত্তির আজ বদলে গেছে। মৃত্যুর দরজা থেকে সে আবার ফিরে এসেছে জীবনের প্রাঙ্গণে। মোনা মিত্তিরের আজ কি এক বিচিত্র অভিজ্ঞতাই হয়েছে। বলে সে, 

—সত্যিই ভুবনবাবু, এসবে কোনো দিন বিশ্বাস ছিল না। নিজের মোহের জগতেই বাস করেছি—আজ মনে হয় ভুবনবাবু এই জগতে এমন কিছু আছে—তাঁর দয়ায় এমন কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা নাই। মনে হল অন্ধকার অতলে তলিয়ে যাচ্ছি—হঠাৎ সেই অতল অন্ধকারে দেখলাম এক অপূর্ব জ্যোতির্ময় মূর্তি—আকাশ-বাতাস এক বিচিত্র মধুর সুরে মুখরিত—হাত তুলে আমাকে আশীর্বাদ করলেন- 

মনে হয় অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে এলাম— 

ভুবনবাবু জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠেন—জয় শচীনন্দন গৌরহরি। এসব তাঁরই কৃপা মিত্তির মশাই। তুমি ধন্য—তাঁর কৃপা পেয়েছ, উনার অহৈতুকী কৃপা। 

অদ্যপি নিত্যলীলা করে গোরা রায়। 
কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।। 

তুমি তার দর্শন পেয়েছ—কৃপা পেয়েছ মিত্তির মশাই! তাই মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরে এসেছ।

চন্দনার চোখে-জল। দেখছে ওকে মোনা মিত্তির। তার মনে হয় চন্দনার ওই সীমন্তিনীর বেশ দেখে, ওর ব্যাকুলতা দেখে যেন একালের সতী সাবিত্রীই ওরা, ওদের ত্যাগ, সাধনা যমরাজকেও অভিভূত করেছে, সেই সাধনায় তারা আজ স্বামীকে ফিরিয়ে এনেছে অন্ধকার থেকে আলোর জগতে। 

চন্দনা বলে—কেমন আছ? 

—ভয় নেই নতুন বউ—সেরে উঠেছি। এবার তোমার সঙ্গে ঘরেই ফিরে যাব।

চন্দনার চোখে-জল নামে, তার পরিক্রমায় আসা—এই কৃচ্ছ্রসাধন আজ সার্থক হয়েছে।

বিপদ কেটে গেছে—রাত্রি ভোর হচ্ছে, আজ থেকে পাঁচশো বছর আগেও এক মৃত বালক গৌরকৃপায় প্রাণ ফিরে পেয়েছিল—আজও তারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটেছে—গৌরকৃপাতেই। 

জয়ধ্বনি দেয় ভক্তবৃন্দ। 

তাদের চোখের সামনেই আজও যেন গৌরলীলার একটি অধ্যায় রচিত হল, সমবেত ভক্তবৃন্দ জয়ধ্বনি দেয়, 

—জয়, শচীনন্দন গৌরহরি। 

নতুন সূর্য উঠছে সবুজ গাছগাছালির মাথায় গঙ্গার বিস্তারে। 

আজ চন্দনা মোনা মিত্তিররাও যেন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। 

.

সকাল হয়েছে। 

বের হয়েছে পরিক্রমা গঙ্গা পার হচ্ছে ওই পরিক্রমার দল নৌকায়, লঞ্চে। ওদের কণ্ঠে নাম-গান গঙ্গার বুকে যেন সুর লহরীর সৃষ্টি করেছে। 

ফিরছে নরহরি—কুন্তী! আজ কুন্তীর মনোবাসনাও পূর্ণ হয়েছে, মা হতে চলেছে সে। নরহরি ও এতকাল পর তার জীবনে প্রকৃত শান্তি খুঁজে পেয়েছে। গোপালের মা-ললিত—ওদের মনেও নিবিড় শান্তির স্পর্শ। 

যুধিষ্ঠির এখন ভুবনবাবুর মন্দিরেই সেবক হয়ে থাকবে—যুধিষ্ঠির বলে, 

—গৌরাঙ্গের কৃপা অসীম গো—নাহলে আমার মতো হতভাগ্যকেও তিনি অশেষ দয়া করেন। ঠাকুর আমার পরম দয়াল গো। 

জুয়াড়ি রামচন্দ্রও জুয়ার ছক ছিঁড়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে এখন অন্য মানুষ। 

আর চন্দনার শূন্য ঘর আজ যেন ভরে উঠেছে কি পূর্ণতায়। মোনা মিত্তিরকে এতদিন পর তার নিজের তাঁবুতে এনেছে, সরকার মশায়ও এর মধ্যে কৃষ্ণনগর গিয়ে গাড়ির ঠিক করে এসেছেন, টানা-গাড়িতে পরিক্রমা সেরে তারা আজই ফিরবে কলকাতায়। মানদাও খুশি হয়। বলে সে, 

—বাবাঃ, কদিন যেন ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম। ধূপ রোদে ঘোরা—যা পাও তাই খাও–কষ্টের শেষ নাই গো। এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফেরো বউদিমণি। 

চন্দনার কাছে এই কষ্ট আর কষ্টই মনে হয় না। গৌর কৃপায় আজ তার শূন্য জীবন পূর্ণ হয়েছে। 

মোনা মিত্তিরও এবার চরম বিপদের দিনে বুঝেছে কোথায় তার প্রকৃত আশ্রয়, আশ্বাস রয়েছে। তাই আজ সেও নিশ্চিন্তে চন্দনার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখে সেও এই যাযাবর জীবন থেকে। 

চন্দনা আজ অনেক পেয়েছে, তার মনে পড়ে বারবার পায়েলের কথা। তাকেও প্রথমে ভুলই বুঝেছিল চন্দনা। ক্রমশ মনে হয়েছে পায়েল যেন পাঁকের মধ্যে থেকে ফোটা একটি নিষ্পাপ পবিত্র পদ্মফুল। তাকে মনে পড়ে বারবার তার এই আনন্দের দিনে। এতে পায়েলের অবদানও কম নয়। মেয়ে হয়ে একজন মেয়ের এই দুঃখকে অনুভব করতে পারে চন্দনা। 

পরিক্রমা এবার নদীর তীরে এসেছে, এক এক দল নৌকায়, লঞ্চে পার হচ্ছে, বাকিরা এখনও গঙ্গার তীরে নাম-গান করছে। 

পায়েল হঠাৎ চন্দনাকে দেখে তাকাল। 

পায়েলও রাতভোর জেগেছিল কি উৎকণ্ঠা নিয়ে। তার জন্য পাগলের মতো ঘুরেছে মানুষটা—শেষে সাপের কামড় খেয়ে এবার লুটিয়ে পড়ে। তাই পায়েলও ঘাবড়ে গেছিল, সেও নিজেকে অপরাধীই ভাবে কিন্তু দয়াল ঠাকুর তাকে এক চরম অপবাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। সেরে উঠেছে মিত্তির মশাই তার স্ত্রীও এসেছে, মোনা মিত্তির আজ ঘরের সন্ধান পেয়েছে, দেখে সরে আসে পায়েল। 

পায়েল বসে আছে পারানির নৌকার আশায়। চন্দনাকে দেখে এগিয়ে আসে। বলে সে,

—তোমাকেই খুঁজছিলাম দিদি। 

পায়েল দেখছে ওই সীমন্তিনীকে। শুধোয়—কেন? 

চন্দনা বলে—আমরা আজই কলকাতা ফিরছি। তুমি ফিরবে না? 

পায়েল দেখছে ওকে। আজ পায়েলের পথ ওদের পথ থেকে আলাদাই হয়ে গেছে। পায়েল ম্লান হেসে বলে, 

—তোমরাই যাও, দেখি আমি এখনও কিছু ঠিক করিনি ভাই। 

নৌকা এসে গেছে। পায়েল গিয়ে পারের নৌকায় উঠল—নৌকাও ছেড়ে দিল। চন্দনাকে আর কিছুই বলার সময় পায় না সে, কেমন যেন এড়িয়েই চলে গেল পায়েল। 

.

ভক্তরা ফিরেছে এবার দীর্ঘ কয়েকদিনের কষ্টসাধ্য ওই পরিক্রমা সেরে। মন্দিরে ধুলোট কীর্তন শেষ হয়। তখনও যেন যাত্রীদের মনে সেই সুরের রেশ রয়ে গেছে। কারণ তারা এক বিচিত্ৰ বাতাবরণের মধ্যে ছিল যেখানে অহরহ ধ্বনিত হয়েছে নাম-গান, শুনেছে নানা যুগের নানা বিচিত্র কাহিনি। 

কত অজানা মানুষ ক্রমশ সব বাধা ভুলে একটি পরিবারে পরিণত হয়েছিল। 

তাই সকলকে ছেড়ে যেতে এবার কষ্ট হয়। 

দুপুরের প্রসাদ পাবার পরই ওই হাজার যাত্রীর দল এবার দিক-দিগন্তের ছড়িয়ে পড়ে। যে-যার ঘরে ফিরে চলেছে এক তৃপ্তিভরা মন নিয়ে 

ভুবনবাবুদের বাসও এসে গেছে— মোনা মিত্তিরের জন্য প্রাইভেট গাড়ি এনেছে ন্যাপা সরকার।

নরহরি, কুন্তী, ললিতা, গোকুল, যুধিষ্ঠির ওরা সবাই উঠেছে নিজেদের বাসে। নরহরি বলে,

–কানাই তোরা ওঠ। সব দেখেশুনে নে, মালপত্র পড়ে রইল কিনা। ওরে যুধিষ্ঠির—

যুধিষ্ঠির বলে—হ্যাঁ গো। সব মালপত্তর তুলছি। অনিরুদ্ধ তার দলবল নিয়ে তদারক করছে।

মানুষ আসতে সময় লাগে। বিভিন্ন দিক থেকে আসে একে একে দলবেঁধে। ক্রমশ দল বেড়ে ওঠে। কিন্তু যাবার সময় ছত্রভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগে না। 

যে-যার মতো চলে যায়। 

কদিন এত কলরব-কোলাহল ছিল এই মন্দিরকে ঘিরে-আজ সব স্তব্ধ হয়ে গেছে। চলে গেছে হাজারো যাত্রীদল যে-যার ঘরে। 

আনন্দ মহারাজ শূন্য মন্দির চত্বরে আজ ঘুরছেন—তিনিও বৃন্দাবনে ফিরে যাবেন এবার হঠাৎ মন্দির চত্বরে কাকে দেখে তাকালেন। সবাই ফিরে গেছে—যায়নি শুধু একজন। সে পায়েল। আনন্দ মহারাজ শুধোন— তুমি ঘরে ফিরে যাওনি মা? 

পায়েল বলে—ঘরের ঠিকানা আমার নেই বাবা—ঘর ছেড়ে, সব ছেড়ে এবার বৃন্দাবনেই যাব বাবা। সেখানেই জীবনের বাকি দিনগুলো কৃষ্ণসেবাতেই কাটাব বাবা। 

আনন্দমহারাজ তাকালেন। পায়েল আজ সব বৈভব ছেড়ে ওই পরম দেবতার চরণে আশ্রয়-আশ্বাস খোঁজে। তার কণ্ঠস্বরে ফুটে ওঠে নিবিড় আর্তি, 

—মানস, দেহ, গেহ যো কিছু মোর,
অর্পিলু তুয়াপদে, নন্দকিশোর।
সম্পদে-বিপদে, জীবনে মরণে। 
দায় মম গেলা, তুয়া ও-পদ বরণে।। 

পায়েলের দু’চোখে নামে অশ্রুধারা, আজ সে সংসারের যন্ত্রণা থেকে পরম মুক্তির সন্ধানই পেয়েছে। 

.

যাত্রীরা ফিরছে— 

বাস চলেছে। ভুবনবাবুরা ফিরছেন গ্রামে, যে মন নিয়ে তারা বের হয়েছিল—ফিরছে অনেক প্রশান্তি নিয়ে, গৌরসুন্দরের কৃপায় তার জীবনের পথ নতুন আশায় আলোকিত হয়ে উঠেছে। ফিরছে চন্দনা তার স্বামীকে নিয়ে কলকাতার দিকে। মোনা মিত্তিরের মতো মানুষও আজ যেন কি কৃপাস্পর্শে বদলে গেছে। 

জীবনের পথ চলাই যেন এক পরিক্রমা—ওই প্রবহমান জীবনধারা মানুষকে অনেক পরিপূর্ণ—সম্পূর্ণ করে তোলে। জীবনই তো সেই মহিমময় কোনো মহাদেবতার প্রসাদে রূপময়—বর্ণময়—অপরূপ। আজ সেই মহাজীবনকে তারা স্পর্শ করেছে ওই নরহরি-কুন্তী-যুধিষ্ঠির-মোনা মিত্তির—সেই শান্তি ভরা মন নিয়ে ওরা ঘরে ফিরছে। 

ফেরে নাই শুধু একজন— সে পায়েল, নুনের পুতুল সমুদ্রে এসে হারিয়ে গেছে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *