পরিক্রমা – ৪

নৃপেন সরকারের বয়স হয়েছে। এই বাড়িতে প্রায় চল্লিশ বছর কাজ করেছেন তিনি। এই ছোট মায়ের কথায় তাই অবাক হয় সরকার। খুশিও হয় মনে মনে। সরকার মশায়ও ধর্মপ্রাণ লোক। সেও গৌরভক্ত। আর পরিক্রমার কথা সেও জানে। বহুদিন ধরে তারও বাসনা পরিক্রমায় যাবে। 

কিন্তু সময়, সুযোগ কোনোটাই হয়ে ওঠেনি নৃপেন সরকারের। 

আজ ঠাকুরের কৃপায় সেই সুযোগই ঘটতে চলেছে। 

চন্দনা বলে, সরকার মশাই, সামনের দোল-পূর্ণিমায় আমরা নবদ্বীপ ধাম পরিক্রমায় যাব। আপনি বরং এর মধ্যে মায়াপুর গিয়ে পরিক্রমার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে আসুন। তাঁবুও লাগবে একটা। মানদা সঙ্গে যাবে—আপনিও থাকবেন। সব ব্যবস্থা করে আসুন। 

এ বাড়িতে এখন চন্দনার কথাই চলে। 

কারণ কর্তাবাবু মারা যাবার পর মোনা মিত্তির আইনত এই ছ’ আনির এস্টেটের কর্তা হলেও তিনি বেশ কিছুদিন বাড়িছাড়া—তাই বউমাকেই এই বাড়ির হাল ধরতে হয়েছে। 

সরকার মশাইও খুশি হয়। তার এতদিনের স্বপ্ন সত্য হতে চলেছে। বলে সরকার—সব ব্যবস্থাই করে আসব মা, ভাববেন না। 

চন্দনাও স্বপ্ন দেখে গৌরাঙ্গের কৃপায় তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। তার ঘরছাড়া স্বামীকে সে ঘরে ফিরিয়ে এনেছে কোনো বাইজির কবল থেকে। আজ চৈতন্যদেবের মূর্তির সামনে অশ্রুসজল চোখে লুটিয়ে পড়ে চন্দনা, আজ তার দু’চোখে নামে বেদনার অশ্রুধারা। 

আর্তকণ্ঠে বলে সে, –আমাকে দয়া কর গৌরসুন্দর। এই মনোবাসনা পূর্ণ কর দেবতা!

মানুষের নিজের শক্তি, সামর্থ্য যেখানে ফুরিয়ে যায় তারপর সে দেবতার করুণাই ভিক্ষা করে। মানুষের সামর্থ্য-শক্তির সীমানা থেকেই এই বিশ্বাসের শুরু। ওর মূলে কোনো সত্য আছে কিনা জানা নেই, তবে এইটাই আজও ঘটে থাকে এইটিই পরম সত্য। 

.

ব্রাহ্মমুহূর্তের শুরু। গঙ্গার পূর্ব উপকূলে তখনও কুয়াশার ক্ষীণ আবরণ রয়েছে। পুব আকাশে সবেমাত্র প্রস্তুতি চলেছে সূর্যোদয়ের। অন্ধকার মুছে গিয়ে অস্বচ্ছ আভাষ জাগে আকাশের বুকে—বাতাস-স্নিগ্ধ আমন্থর, স্তব্ধতার মাঝে গঙ্গার মৃদু প্রবাহ ধ্বনিত হয়। ঢেউগুলো দলবদ্ধভাবে তীরে এসে ভাঙছে। পাখিদের কলরব সবে শুরু হয়েছে, শেষ তারাটিও ম্লান হয়ে ডুবে গেল আকাশের বুকে। 

হঠাৎ বেজে ওঠে শত শ্রীখোল—হাজার কণ্ঠের জয়ধ্বনির মধ্যে। 

নবদ্বীপের এই পুণ্য আকাশ-বাতাসে আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে জত জত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল মহানাম মন্ত্র। তারপর প্রায় বিকৃত, লুপ্ত হয়েছিল, আবার গঙ্গার ধারাপ্রবাহের মতই এই নামপ্রবাহ অকুণ্ঠ গতিতে প্রবাহিত হয়েছে। 

আজ এই ঊষালগ্নে সেই মহামন্ত্র ধ্বনিত হয় হাজারো কণ্ঠে— 

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। 
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।। 

পথের ধূলিতে তখনও ভোরের শিশিরের আর্দ্রতা, ওই কুয়াশার যবনিকা ভেদ করে মহানাম ধ্বনিত হয়। শঙ্খ বাজে—সামনে ধ্বজা পতাকা—হাজারো নরনারী বের হয়েছে পরিক্রমায়। অর্থাৎ নবদ্বীপধাম পরিক্রমা শুরু হল আজ ভোর থেকে। 

সারবেঁধে চলেছে হাজারো নরনারী। কণ্ঠে তাদের মহামন্ত্র। এগিয়ে চলেছে তারা। ভুবনবাবু, নবীন ডাক্তার অন্যদেরও দেখা যায় ভিড়ের মধ্যে। তরুণ অনিরুদ্ধ ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে সবকিছুর তদারক করছে। 

ভিড়ের মধ্যে দেখা যায় নরহরি বিশ্বাসকে। 

সর্বাঙ্গে তার এই ভোরের বেলাতেও তিলকছাপ আঁকা হয়ে গেছে। বেশ নধর শাঁসেজলে পরিপুষ্ট ঘৃতপক্ক দেহ—গলায় কণ্ঠী, মাথায় পুরুষ্ট পালং ঝাড়ের মতো এক গোছ শিখা, তার ডগে আবার একটা গেরো বাঁধা তাতে ফুল রয়েছে। 

নরহরি চোখ-বুজে নাম গান করছে গদগদ চিত্তে যেন ওই নামামৃত পান করা ছাড়া তার আর কোনো কাজই নাই। কিন্তু আসলে তার নজর ওই ভিড়ের মধ্যেও তার তরুণী ভার্যা কুন্তীর দিকে। কুন্তীও এসেছে পরিক্রমায়। নরহরি তার সুবিধার জন্য নানা ব্যবস্থাই করেছে। তবু স্ত্রী-জাতির উপর তার সন্দেহ জন্মগতই বলা যেতে পারে। জরু, জমিন ধান—তিন বশে আন। এই নীতিতে সে বিশ্বাসী। স্ত্রী, জমি আর জমির ধান অন্য লোকের হাতে গেলে তা ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন কাজ। বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা কদাপিও এই তিনটি বস্তু নিজের নজরছাড়া করে না। 

তাই নরহরিও নজর রেখেছ কুন্তীর উপর। ওরা একটু পিছনের লাইনে আছে আরও কয়েকজন মেয়েছেলের সঙ্গে—নরহরি সর্বাগ্রে এসে শোভাযাত্রার আগে নর্তন আর নাম-গান করছে। এই মণ্ডলীতে রয়েছে ভুবনবাবু, নবীন ডাক্তার, গোপেশ্বর বাড়ুয্যে—অন্য ভক্তরা কিন্তু নরহরি ওই চিতাবাঘের মতো সর্বাঙ্গে তিলক ছাপ লাগিয়ে রেশমি উত্তরীয় হাওয়ায় উড়িয়ে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে ব্রজ হুঙ্কার দিয়ে নাম-গান করে জানাতে চায় সেইই এই পরিক্রমার দলপতি, একনম্বর ভক্ত। তাই আগের সারিতেই এসে পড়েছে সে। 

তবে তার নজর রয়েছে কুন্তীর দিকে। 

নরহরি দেখছে কুন্তীও যেন এই পরিক্রমায় এসে এই খোলামেলার মধ্যে বদলে গেছে। ঘরে তাকে ঘোমটা দিয়ে মুখ-বুজে থাকতে হয় নরহরির দাপটে। 

এখানে সেটার অস্তিত্ব এখনও টের পায়নি কুন্তী। ভোরেই স্নান করে কাপড়-চোপড় বদলে বের হয়েছে তারা। গ্রামের মেয়েরাও রয়েছে—কুন্তী এখানে তাদের সঙ্গে সহজভাবেই মেশে।

অনিরুদ্ধ সবদিকে তদারক করছে। এরপর কোনও আশ্রমে গিয়ে ভক্তদের বাল্যভোগের প্রসাদ দেওয়া হবে। অনিরুদ্ধ খোঁজ নিচ্ছে কতজন আছে। 

মেয়ে মহলেও সে পরিচিত। গ্রামেরই ছেলে—কুন্তী ওর সঙ্গে কি কথা বলছে। ও জানতে চায় তাদের যাত্রাপথের কথা। 

অনিরুদ্ধ বলে—আজ পরিক্রমার সময় দুপুরের প্রসাদ গঙ্গাতীরেই হবে—আর সন্ধ্যায় ক্যাম্প হবে জগন্নাথ মন্দিরের বাগানে। লোকজন সেখানে এর মধ্যেই চলে গেছে। ক্যাম্প তৈরি হবে, মণ্ডপ বানানো হবে, বহু তাঁবুও পড়বে–রাতের প্রবচন প্রসাদ সব কিছুর ব্যবস্থা হবে ওখানেই 

কুন্তীকে অনিরুদ্ধের সঙ্গে কথা বলতে দেখে নরহরির নাম-গানও থেমে যায়। ছেলেটার মতলব সুবিধার নয় মনে হচ্ছে। কুন্তী-এর মধ্যেই ওর সঙ্গে কথাবার্তাও শুরু করেছে। মাথার ঘোমটার বালাই নেই—অনিরুদ্ধের কথায় হাসছে কুন্তী। তার সামনে এমনি করে কখনও হেসেছে বলে মনে হয় না। সাবধান হওয়া আবশ্যক। 

অনিরুদ্ধ লাইনের পিছনে কাদের সঙ্গে কথা বলছে—নরহরি এই অবসরে পিছিয়ে গিয়ে কুন্তীর খুলে পড়া ঘোমটাটা মাথায় ঢেকে দিয়ে চাপা-স্বরে হিস্ হিস্ করে বলে নরহরি স্ত্রীকে শাসনের ভঙ্গিতে, 

—লজ্জাই নারীর ভূষণ। বের হয়ে ঘোমটা খুলে ফেললে চলবে? 

কুন্তী চমকে ওঠে। এই স্বার্থপর কঠিন মানুষটিকে চেনে সে। নরহরি বলে—যার তার সঙ্গে হেসে গড়িয়ে কথা বলবে না। এত ঢলাঢলির কী দরকার! লোকে কী বলবে? 

কুন্তীকে দাবড়ে ঘোমটা মুড়ে এবার নরহরি ভিড় ঠেলে ভীমবেগে এগিয়ে গিয়ে প্রথম সারিতে পৌঁছে হুঙ্কার ছাড়ে। 

—জয় শচীননন্দন গৌরহরি। জ—য়—। 

.

পরিক্রমা এসে পৌঁছায় জগন্নাথ মিত্রের ভবনের প্রাঙ্গণে। আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে এই পুণ্য মৃত্তিকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন নিমাই। 

ভক্তরা আজ পরিক্রমা প্রথমেই এসেছেন শচীর আঙিনায়। ভুবনবাবু সেই পুণ্যকাহিনি শোনাচ্ছেন ভক্তদের—হাজারো নরনারী আজও সেই বিচিত্র কাহিনি তন্ময় হয়ে শুনছে। আজ তারা সেই পুণ্য মৃত্তিকায়, সেই পবিত্র নিমগাছের নীচে এসেছে। এ যেন তাদের বহু পুণ্যের ফল। 

ভুবনবাবু সুরেলা কণ্ঠে কীর্তন গাইছেন— 

—শচীর আঙ্গিনায় নাচে বিশ্বম্ভর রায়।
হাসি হাসি ফিরি ফিরি মায়েরে লুকায়।।
বয়নে বসন দিয়া বলে লুকাইনু।
শচী বলে বিশ্বম্ভর আমি না দেখুনি।।
মায়ের অঞ্চল ধরি চঞ্চল চরণে।
নাচিয়া নাচিয়া যায়, খঞ্জন গমনে।। 
বাসুদেব ঘোষ কয় অপরূপ শোভা। 
শিশুরূপ দেখি হয় জনমন লোভা। 

ওই কীর্তনেরই মধ্যেই একটি অপরূপ শিশুরূপের মনোলোভা ছবি—লীলা প্রসঙ্গ ফুটে ওঠে। মুগ্ধ-জনতা হরিধ্বনি দেয়। 

আবার শুরু হয় পরিক্রমা। 

পরিক্রমা মানেই তা পথচলা। পরিক্রমা করা। পথচলতি মানুষ নানা তথ্য, তত্ত্ব—জ্ঞান আহরণ করে যেমন জীবনের প্রতিদিনের পথ চলার মাধ্যমে তেমনি এই পরিক্রমার পথের দু’দিকে ছড়ানো অতীতের বহু গৌরবময় উজ্জ্বল মুহূর্ত, কত দীর্ঘ ইতিহাস। আজও শত শত বৎসর পরও মানুষ এই পথে পথে চলে, সংগ্রহ করে সেই জ্ঞান। তার আজকের শোক-তাপ-সন্তপ্ত জীবনে এই জ্ঞানের আলো দিয়ে অন্ধকারকে দূর করে, আলোক সন্ধান করে। 

.

ছোট্ট গোকুলের আগ্রহই যেন বেশি। 

সেও মাকে নিয়ে জোর করে এসেছে এই পরিক্রমায়। ললিতা প্রথমে আসতে চায়নি। কিন্তু গোকুলই বলে, 

—চলো তো, বাবা ঠাকুরও বলেছেন। দিনরাত বাড়িতে বসে কেঁদে কী হবে? চলো-পরিক্রমায়। বাবা ঠাকুর বলছিলেন গৌরাঙ্গদেবের কৃপা হলে সব দুঃখ-কষ্ট ঘুচে যায়। ঠাকুরকেই ডাকবে মা। আমি তো রোজই ডাকি, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। 

গোকুল এই বয়সেই সব হারিয়ে এই বিশ্বাসটুকু নিয়েই পরম আনন্দে আছে। ভূবনবাবুও দেখছেন এটা। মাধব মাস্টার স্কুলের সহকারী শিক্ষক। তিনিও দেখেন গোকুল পড়াশুনাতেও খুবই ভালো। আর ভোরের রোজ মন্দিরে আসবে ফুল নিয়ে, ভুবনবাবু বলেন—তোর ফুল না হলে পুজো হবে না গোকুল। 

গোকুল হবে—তাই তো ভোরেই কে যেন ঠেলে তুলে দেয় গো। 

আমিও ফুল নে চলে আসি। ফুলগুলো সাজিতে রেখে গেলাম গো— 

পড়তে বসতে হবে। চলি। 

ভুবনবাবু বলেন—ওরে প্রসাদ নিয়ে যা 

গোকুলের গ্রামে এই প্রাত্যহিক প্রোগ্রাম। এখানে ওই ভোরেই গোকুল স্নান সেরে কাপড় বদলে সে কীর্তনে নেমেছে। যেন পরিক্রমার আগে আগে নেচে চলেছে ছোট্ট-সুন্দর এক দেবশিশু। 

কুন্তীর চোখে পড়েছে এই অপরূপ দৃশ্যটা। তার মনে হয় একটু আগেই কীর্তন শুনছিল শচীর আঙ্গিনায় নাচে বিশ্বন্তর রায়। 

এ যেন তেমনি এক দেবশিশু নেচে চলেছে সংকীর্তনের আগে। মিষ্টি চেহারা—মুখে হাসি।

কুন্তী জানে গোকুলকে। জানে ওইই জমিদারের একমাত্র সন্তান। আজ নরহরি তার স্বামীই কৌশলে হীন-চক্রান্ত করে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পথে বের করেছে। নিজেকেই আজ অপরাধী মনে হয় কুন্তীর। ওরা সবাই জানে তার স্বামীর লোভ আর নীচতার কথা। তাতে অবশ্য নরহরির বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ নাই। কিন্তু কেন জানে না কুন্তী, তার বিশ্রী লাগে। 

পরিক্রমা চলেছে—ওদিকে গঙ্গার বুকে সূর্যের লাল আভা পড়েছে—গঙ্গা এই নবদ্বীপ ধামের বুকে এই পাঁচশো বছরের মধ্যে কতবার গড়াগড়ি দিয়ে তার গতিপথ পরিবর্তিত করেছে, তা সার্বিক জানা যায় না। তবে আশপাশের মরা নদী খাত—পরিত্যক্ত দহ-জলাশয় দেখে মনে হয় সেই পথ পরিবর্তন বেশ কয়েকবারই ঘটেছে। 

তাই চৈতন্যদেবের অপ্রকট হবার পর এই নবদ্বীপ ধাম দীর্ঘকাল জলমগ্নই ছিল। 

—প্রভু যবে অপ্রকট হইবে তখন। 
তাঁহার ইচ্ছায় গঙ্গা হইবে বৰ্দ্ধন।
মায়াপুর প্রায় গঙ্গা আচ্ছাদিবে জলে।
শতবর্ষ রাখি পুনঃ ছাড়িবেন বলে।।
স্থানমাত্র জাগিবেক গৃহ না রহিবে।
বাসহীন হয়ে কতকাল স্থিত হবে।।
পুনঃ কভু প্রভু ইচ্ছা হয়ে বলবান। 
হবে মায়াপুরে এইরূপ বাসস্থান।। 

অর্থাৎ মায়াপুর নবদ্বীপ ধাম নতুন করে আবার গড়ে উঠবে। সেইসব লুপ্ত মহিমাপূর্ণ স্থানগুলোও জেগে উঠবে নতুন করে কোনো নতুন ভগীরথের সাধনায়। মানুষ তীর্থ পথে আবার যাত্রা শুরু করবে—আজ যেন সেই তীর্থযাত্রাই চলেছে। 

সূর্যের আলো লাল থেকে গিনিসোনা রং ধরেছে—পরিক্রমা এসে পৌঁছায় শ্রীবাস অঙ্গনে। 

.

এই শ্রীবাস অঙ্গনেই চৈতন্যদেব নিজেকে প্রকট করেছিলেন—বহু লীলা বিলাস করেছিলেন ভক্তদের নিয়ে এই পুণ্য ক্ষেত্রে। 

ভক্তরা যে যেখানে পেরেছে বসে পড়েছে। ভুবনবাবু এই স্থান-মাহাত্ম্য বর্ণনা করে চলেছেন। কীর্তন থেমে গেছে—তবে অখণ্ড নাম চলেছে অন্যদিকে। 

কুন্তী—ললিতা—গোপালের মা অন্য মেয়েরাও রয়েছে। এই পরিক্রমায় শামিল হয়েছে পায়েলও। ভিড়ের মধ্যে সে যেন নিজেকে লুকিয়ে রেখে চলেছে। ওই ভিড়ের মধ্যে বসেই প্রবচন শোনে, তীর্থভূমির পবিত্র ধূলিকণা মস্তকে নেয় পরম ভক্তিভরে। জীবনে পায়েল তার ক্ষেত্রে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তার নাচের আসরে বহু ধনী—বড় বড় ব্যবসায়ী মানুষ টাকার থলি নিয়ে আসে তার সামান্য কৃপালাভের আশায়। 

সেখানে সেইই প্রধানা। এখানে এই নাম-গানের আসরে সে সামান্য একজন ভক্ত মাত্র। এসেছে তার তাপ-সন্তপ্ত জীবনেগৌর সুন্দরের করুণাকণা লাভের আশায়। তার ব্যক্তিত্ব এখানে গৌণ—সে তাই যেন অন্তরালবর্তিনী হয়েই চলেছে। 

এসে পৌঁছেছে পরিক্রমা শ্রীবাস অঙ্গনে। পরমভক্ত জীব গোস্বামীও অতীতে এখানে এসেছিলেন। 

—শত ধনু উত্তরেতে শ্রীবাস অঙ্গনে।
জীবে দেখাইলে প্রভু আনন্দিত মন।।
শ্রীবাস অঙ্গনে জীব যায় গড়াগড়ি।
শুনিয়া প্রভুর লীলা প্রেম ছুড়াছুড়ি।।
শ্রীজীব উঠিবামাত্র দেখে এক রঙ্গ।
নাচিছে গৌরাঙ্গ লয়ে, ভক্ত অন্তরঙ্গ।
মহা সংকীর্তন দেখে বল্লভ নন্দন।
সর্বভক্ত মাঝে প্রভুর অপূর্ব নর্তন।
নাচিছে অদ্বৈত, প্রভু নিত্যানন্দ রায়।।
গদাধর হরিদাস নাচে আর গায়।।
শুক্লাশ্বর নাচে আর শত শত জন।
দেখিয়া প্রেমেতে জীব হৈলা অচেতন।
চেতন পাইলে আর সে রঙ্গ না ভায়।
কাঁদি জীব গোস্বামী করেন হায়, হায়।
কেন মোর কিছু পূর্বে জনম নহিল।
এমন কীর্তনানন্দ ভাগ্যে না ঘটিল।। 

শ্রীবাস অঙ্গনে অতীতে জীব গোস্বামীও তার দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছিলেন চৈতন্যলীলার কিছু প্রকাশ, আজও সেই মধুর ঔদার্য লীলা প্রকট হয়ে আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই লীলা আস্বাদন ঘটে না। 

তবু ভক্তদের মন ভরে ওঠে কি এক বিচিত্র ভাবে। 

হরিধ্বনি নিয়ে পরিক্রমা আবার চলতে থাকে—সামনে দীর্ঘ পথ। ক্রমশ রোদের তাপ বাড়ছে। জনস্রোত বয়ে চলেছে ওই তপ্ত ঊষর পথে। 

.

নরহরির কীর্তন সমানে চলেছে। 

অবশ্য তার নজর রয়েছে কুন্তীর দিকে। বেলা বেড়ে চলেছে। বাড়ছে রোদের তাপ। পরিক্রমা চলেছে। 

কুন্তীর এইভাবে পথ চলা অভ্যাস নেই। রোদের তাতে ঘামছে সে, তেষ্টাও পায়। পরিক্রমা চলেছে। এর মধ্যে নরহরি এসে পড়েছে কুন্তীর কাছে। জনতা থেকে ওকে বের করে পথের ধারে একটা গাছতলায় আনে, সঙ্গের লোকও তৈরি ছিল। নরহরির ইঙ্গিতে সে একটা পাত্রে কিছু সন্দেশ আর একটা ডাব এনে হাজির করে। 

নরহরি বলে—ছোট বউ খাও, জল খাও, যা রোদ, মিষ্টিটুকুও খাবে সব। কুন্তী অবাক হয়। দেখেছে হাজারো মানুষ চলেছে, বয়স্ক বহু নারী-পুরুষ চলেছে নাম গান করতে করতে গোকুলও চলেছে। হঠাৎ পথের ধারে ওদের দেখে তাকাল গোকুল। 

কুন্তী দেখছে সুন্দর ছেলেটাকে, বোধহয় ওর তেষ্টা পেয়েছে। ডাকতে যাবে ওকে, নরহরি গোকুলকে চেয়ে থাকতে দেখে ধমকে ওঠে—তুমি এখানে কী করছ? যাও—নাচ-গান করোগে। 

গোকুল এমনিতেই ওদিকেই যাচ্ছিল, নাম গানের দিকে। পিছনে তার মা ললিতা চলেছে, সঙ্গ নিয়েছে তার গোপালের মা বুড়ি। আরও দু’একজন মহিলা। গোকুল মায়ের খবর নিয়ে আবার এগিয়ে যায় কীর্তনে, তারও ওই পেট মোটা নরহরিকে মোটেই ভালো লাগে না। লোকটাকে দেখে মনে হয় যেন বন থেকে একটা চিতাবাঘ বের হয়ে দু’পায়ে হেঁটে চলেছে।

কুন্তীকে বলে নরহরি—খেয়ে নাও ওটুকু, ফটকে, ডাবট কেটে দে ওকে।

কুন্তী বলে—এত লোক না খেয়ে চলেছে, আর আমি পারব না? 

নরহরি শোধায়—আরে ওদের সেই সঙ্গতি নাই, তোমার আছে। তুমি খাবে। খাও তো।

কুন্তী দেখছে ওই বিচিত্র লোকটিকে। বলে কুন্তি। 

—এখন থাক। পরে খাব। চলো—পরিক্রমা এগিয়ে গেছে। 

নরহরি ব্যাজার মুখে বলে—জেদ তবু গেল না। চলো— 

.

এ যেন জেদই। কি এক জেদ আর শপথ নিয়েই চন্দনা মিত্র তার কলকাতার বাড়ির বিলাস-ব্যসন ছেড়ে এসেছে এই পরিক্রমায়। সঙ্গে আছে তাদের পুরনো সরকার মশাই ওই নৃপেন, সবাই ওকে ন্যাপা সরকার বলেই চেনে। ন্যাপা সরকার আগে সেই পরিক্রমায় যাবার সব ব্যবস্থাই করে গেছে। 

এখন শীত গিয়ে গ্রীষ্মের আভাস এসেছে। এদিকে শীতও যেমন বেশি পড়ে, আবার রোদের তেজও বেড়ে ওঠে চড় চড় করে। এই অঞ্চলের আবহাওয়াই এমনি ধরনের। 

মানদা-ঝিও এসেছে বাধ্য হয়ে বউরানীর সঙ্গে। 

চন্দনা বড় ঘরের বৌ হলেও এই বাইরে ঘেরা তার আগেও অভ্যাস ছিল। কলেজে পড়ার সময় বেশ হইচই করেছে। কলেজ থেকে অনেক ট্যুরেও গেছে। তাই এই পরিক্রমায় এসে তাঁবুর জীবনেও অভ্যস্ত হয়ে গেছে একদিনেই। 

কর্তাপক্ষ অবশ্য সব ব্যবস্থাই করেছে। পথের মাঝে টিউওয়েলও বসিয়েছে, দুপুরে কোন বাগানের ছায়ায় মণ্ডপ করেছে, সেখানে দুপুরের আগেই লোকজন চলে গেছে তারা রান্নার ব্যবস্থাও করেছে। অন্ন-ডাল-লাবড়া ব্যঞ্জন আর পায়েস। এই অল্প সময়ের মধ্যে এত লোকের জন্য ওই প্রসাদের আয়োজন করা ব্যয়সাধ্য কষ্টের ব্যাপার। তবু সবই করেছেন তারা। 

অবশ্য অনেকে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেয়। তবে অধিকাংশ যাত্রীই দিনের বেলায় ওই প্রসাদ পায় আর সন্ধ্যার সময় বেশি পেলে, তখন যে-যার নিজের ব্যবস্থাও করে নিতে পারবে। 

চন্দনাও চলেছে পরিক্রমায়। বিরাট মিছিল চলেছে—কয়েক হাজার নরনারীর মিছিল, নাম-গান করছে সবাই। 

পথ দিয়ে চলেছে দেশি-বিদেশি অনেক মেয়ে-পুরুষ ভক্তের দল। বিদেশিদের পরনেও ধুতি-পাঞ্জাবি আর বিদেশিনীরাও শাড়ি ব্লাউজ পরে খালি পায়েই চলেছে এই রোদে। ঘামছে তবু তাদের নামগানের বিরাম নেই। 

চন্দনাও চলেছে, মানদা-ঝি এই গরমে চলতে পারে না। যদিও সে এই অঞ্চলের মানুষ, মাঠে-ঘাটে এখানেই রোদবৃষ্টিতে কাজ করেছে খেতে তবু দীর্ঘদিন এই অঞ্চল ছেড়ে কলকাতায় থেকেছে বাবুদের বাড়িতে, দৈহিক খাটুনিও তেমন নেই ওখানে। 

বেশ জুত করে খেয়েছে আর আরাম আয়েশই করেছে। ফলে তার সেই কষ্ট-সহ্য করার ক্ষমতাও আর নেই। 

মানদা এসে পড়েছে, কিন্তু এখানে কাল সন্ধ্যার আগে এসে দেখেছে লোকজন প্রচুর এসে গেছে, থাকার ঘরও পায়নি, ন্যাপা সরকারে একটা তাঁবুর ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে বউমণি আর মানদা ছিল আর ন্যাপা সরকার মন্দিরের চাতালেই পড়েছিল। 

মানদা বলে—মাগো কি ভ্যাপসা গরম, তেমনি মশা। পাখাও নাই। 

চন্দনা বলে—তোরই তো দেশ, এখানে তো আগেও ছিলি। 

মানদা বলে—সে কবে ছিনু। এখন তো নাই। কেন যে এলে বউমণি কলকাতা ছেড়ে এই তেপান্তরে মাঠে কে জানে। 

চন্দনা কিছু বলে না, ও এসেছে গৌরসুন্দরের কৃপাপ্রার্থী হয়ে, তার জন্য এটুকু কষ্ট তার কাছে কিছুই নয়। মানদার জীবনে এই কামনার তীব্রতা নেই, তাই তার কাছে বাইরের এই জীবন অসুবিধা জীবন বলেই মনে হয়। 

রোদের তেজ বাড়ছে। সূর্য উঠছে মাথার উপর—মাটি তাতছে, খালি পায়ে চলছে পথযাত্রীর দল, চলেছে মৃদঙ্গ-শ্রীখোল-করতাল কাঁসর শঙ্খ নিয়ে অনেকে। 

মানদা এর মধ্যে একটা ছাতা এনেছে। বলে সে–বউদিমণি যা রোদ, ছাতাটা মাথায় দাও। এত রোদে-চলা তো অভ্যাস নেই, শেষে অসুখ না বাধাও। 

ছাতাটা দেখে চন্দনা। সারা পথ জুড়ে চলেছে দীর্ঘ ওই মিছিল। কেউ এখানে ছাতা মাথায় দেয়নি। এই রোদে সারা জনতা চলেছে খালি মাথায়। খালি পায়ে নাম-গান করতে করতে। 

এর মধ্যে একা ছাতা মাথায় দিয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারবে না চন্দনা। 

ওদিকে ভুবন কাকাও চলেছেন খালি মাথায়—ঘামছেন বৃদ্ধ, অন্য সকলেই। বহু বয়স্কা মহিলা ও চলেছে ওই ভাবে। চন্দনা বলে— 

—ছাতা বন্ধ কর মানদা, কেউ ছাতা নেয়নি এখানে। এইভাবেই চলেছে, আমরাও যাব এইভাবে, হোক রোদ। 

মানদা বলে,— যে পারে যাক, আমার রোদে মাথা ঘুরছে, আমি বাপু ছাতা নে যাবো। হ্যাঁ- মানদা নিজেই ছাতাটা মাথায় দিয়ে চলেছে। চন্দনা নিষেধ করে। মিছিলের বাইরে গিয়ে যা খুশি কর, এখানে নয়। 

মানদা গজগজ করে—যাচ্ছি গো, তাই যাচ্ছি। আমার এত পুণ্যির দরকার নেই। 

.

মোনা মিত্তিরও চলেছে পরিক্রমায়। পায়েল অবশ্য সামনের সারিতে নেই, নিজেকে সে যেন অপ্রকাশিতই রাখতে চায়। ঘোমটায় মুখ ঢেকে অতি সাধারণ পোশাকে চলেছে সে। তাকে চেনে অনেকেই, পায়েল বাইজিকে চেনা লোকের অভাব এখানেও হবে না। তাই নিজেকে সন্তর্পণে নিয়ে চলেছে পায়েল। নাম-গান করছে—ওই পরিক্রমার আনন্দের গভীরে যেন হারিয়ে যেতে চায় সে। 

মোনা মিত্তিরও চলেছে ওই পরিক্রমায় পায়েলের পাশাপাশিই, পায়েল অবাক হয়, তুমিও চলেছ মিত্র মশায়? 

মোনা মিত্তির-এর বাহন ভূধরও চলেছে। সঙ্গে মোনা মিত্তির অবশ্য গলা ভেজাবার মতো বিয়ার—অন্য পানীয়ও নিয়েছে। কিছু শুকনো খাবার, জল সন্দেশ এসবও রয়েছে। 

পায়েলের কথায় বলে মোনা মিত্তির, 

—লোকে চলেছে গৌরাঙ্গের কৃপা পাবার জন্য এই পরিক্রমায়, আমিও চলেছি কেন জানো পায়েল? 

পায়েল তাকাল। মোনা মিত্তির বলে, 

—গৌরকৃপা না পেলেও চলবে—কিন্তু পায়েলের কৃপা আমার চাই-ই। 

পায়েল শিউরে ওঠে। বলে সে, 

—তোমার মুখে কিছুই আটকায় না মিত্তির মাশাই। ছিঃ ছিঃ—আমি একটা তুচ্ছ নটী—পাপীয়সী।

হাসে মোনা মিত্তির, বলে সে-পাপী! শ্লা পাপ কি গো? এনারাই বলেন, শুধু নামাভাসেই কোটি জন্মের পাপ ধুয়ে-মুছে যায়। এত নাম করেও পাপী কেন থাকবে তুমি? বরং আমাকে বলতে পারো-পরিক্রমাতে এসেও মাল ঠিক চালাচ্ছি। তা জল-টল খাবে? যা রোদ। চিলড বিয়ারও আছে। 

পায়েল বলে—না, আমার কথা ভাবতে হবে না। নিজের কথা ভাবো মিত্তির মশাই। ফিরে যাও—আর পাপের বোঝা বাড়িয়ো না। 

হাসে মিত্তির মশাই। বলে সে, 

—ফিরব বৈকি। এই বেহ্মডাঙ্গায় থাকতে তো আসিনি। তোমাকে নিয়েই ফিরব পায়েল। তোমাকে ছেড়ে নয়। 

পরিক্রমা এগিয়ে চলেছে। পায়েল জবাব দেয় না। নামাকীর্তন করছে ওই মানুষটাকে এড়াবার জন্য। 

চলেছে হাজারো মানুষ। ওদের কন্ঠে ধ্বনিত হয় সেই মহামন্ত্র—হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে- 

ধু-ধু প্রান্তরে সেই নাম-গান আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে-আজ থেকে পাঁচশো বছর আগেও এই নাম ধ্বনিত হয়েছিল এই সুরধনীর কুলে আকাশ-বাতাসে। আজও সেই অনুরণন চলেছে। 

গঙ্গাতীরে এসে পড়েছে পরিক্রমা—সামনে তরঙ্গিণী ভাগীরথী, তীরে গঙ্গানগর 

এখানেও অতীতের এক বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল। ভক্তরা গঙ্গাতীরে ছায়াঘন মন্দিরের পরিবেশে বসে পড়ে। গঙ্গার বুক থেকে ভেসে আসে স্নিগ্ধ-দখিনা বাতাস, তাপ সন্তপ্ত ভক্তবৃন্দ কিছুটা শান্তি পায়। 

গোপালের মা বুড়ি বলে- জল যদি পেতাম। 

অনিরুদ্ধ দলবল নিয়ে এর মধ্যে তার কাজ শুরু করেছে। ছোট ট্যাঙ্কিতে খাবার জল নিয়ে তার দলবল ঘুরে বেড়াচ্ছে। ট্যাপকল খুলে তৃষ্ণার্তদের জল দিচ্ছে। 

গোকুলেরও তেষ্টা পেয়েছে। 

সেই-ই বলে—ঠাকুমা, নাও জল এনেছি। খাও, মা খাবে তো! 

গোপালের মা বুড়ি বলে—বাঁচালে ভাই। কই গো বাবুরা—দাও, জল দাও বাবু। বড় তিয়াস পেয়েছে। কই গো–বউমা, তোমার পাত্রটা দাও, জল পুরে রাখো বাছা। 

গোপালের মা বুড়ি এর মধ্যে ললিতার সহচরী হয়ে উঠেছে। 

পথে বের হয়ে ললিতা কেমন একা একা বোধ করছিল। গোকুল তো মায়ের কাছ ছেড়ে কীর্তনে ওই ভুবনবাবুদের সঙ্গে গিয়ে ভিড়েছে—নাচছে। 

গোপালের মা বুড়ি ললিতাকে বলে—বউমা, তোমার পুঁটুলিটা দাও বাছা, তোমার বইতে কষ্ট হচ্ছে। ললিতা দেখছে বুড়িকে, বলে—না-না মা, পারব। 

হাসে বুড়ি—মোট বওয়া তো অভ্যাস নেই মা। কত বড় ঘরের বৌ—আমি খেটে খাই এখনও মাল বওয়ার অভ্যাস আছে। এ তো আমার বোঝার উপর শাকের আঁটি, বোঝাই নয়। দাও আমাকে— 

গোপালের মা-ই ললিতাকে যেন আগলে নিয়ে চলেছে। গোকূলও খুশি হয়—ঠাকুমাও জুটে গেছে তাহলে। জয় নিতাই—জয় গৌর। দেখবে মা-ঠাকুর সব ব্যবস্থাই করে দেবেন। তাই— 

ললিতা বলে—ওরে গোকুল, কিছু মুখে দিয়ে যা। সকাল থেকে কিছুই খাসনি।

—খিদে লাগেনি গো। গোকুল চলে গেল ওদিকে। 

ললিতা বলে—ওই এক ছেলে, নিজের খেয়ালেই থাকে। খিদে-তেষ্টাও লাগে না—লাগলেও কাউকে কিছু বলবে না মা। 

গোপালের মা বলে—বড় ভালো ছেলে—যেন দেবশিশু। চল মা ওদিকে ছায়ায় বসবে একটু। যা রোদ। 

গঙ্গাতীরে ছায়াঘন পরিবেশে ভক্তরা বসেছে। 

আনন্দ মহারাজ দীর্ঘদিন সন্ন্যাস নিয়ে বৃন্দাবনবাসী হয়েছেন। অতীতে নবদ্বীপ ধামেই ছিলেন। সর্বত্যাগী বৈষ্ণব—বৈষ্ণব শাস্ত্রে তাঁর পান্ডিত্যও প্রগাঢ়, ভুবনবাবু তখনও অধ্যাপনা করেন কলেজে, ছুটিছাটায় নবদ্বীপ ধামে আসেন। গঙ্গাতীরে এইদিকেই ছিল আনন্দ মহারাজের আশ্রম। ভুবন সেখানেই আসবেন ওঁর কাছে, আর আনন্দ মহারাজই ভুবনবাবুর মধ্যে শ্রদ্ধা ভক্তি, জ্ঞান-এর পরিচয় পেয়ে উপযুক্ত আধার ভেবে তাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। সে আজ প্রায় কুড়ি বৎসর আগেকার কথা। 

তারপর আনন্দ মহারাজ সারা ভারত তীর্থ পরিক্রমায় বের হয়ে শেষে বৃন্দাবনেই থেকে যান। আজ ভুবনবাবু পরিক্রমায় ওর আশ্রমে এসে গুরুদেবকে দেখে খুশিতে ফেটে পড়েন। 

আনন্দ মহারাজ গঙ্গাতীরে মন্দির চাতালে বসে শাস্ত্র পাঠ করছিলেন ভক্তদের সামনে, পরিক্রমা আসতে দেখে তিনি ও তাঁর অনুচরদের নিয়ে প্রণতি জানান কীৰ্তন মিছিলকে, ভুবনবাবু চমকে ওঠেন আনন্দ মহারাজকে দেখে। 

—গুরুদেব! আপনি! কি পরম সৌভাগ্য আমার। কতদিন পর দর্শন পেলাম। 

আনন্দ মহারাজ বলেন— হ্যাঁ ভুবন দীর্ঘদিন বৃন্দাবনে থাকার পর এবার নবদ্বীপ ধামে এসেছি আর পরিক্রমায় তোমার দেখাও পেলাম। আমিও পরিক্রমায় যাব বলেই এসেছি। 

ভুবনবাবু বলেন—এ তো আমাদের সৌভাগ্য। জয় শচীনন্দন গৌর হরি। 

আনন্দ মহারাজ বলেন—তোমরা বিশ্রাম করো, শাস্ত্রাদি আলোচনা করো, আমি তৈরি হয়ে নিই।

ভুবনবাবু গঙ্গানগরের আদি ইতিহাস প্রসঙ্গে বলে চলেছেন। জীব গোস্বামীর ভ্রমণ— বৃত্তান্তে আছে, 

—প্রভু বলে, শুন জীব এ গঙ্গানগর।
স্থাপিলেন ভগীরথ রঘু বংশধর।।
যবে গঙ্গা ভাগীরথী আইল চলিয়া।
ভগীরথ যায় আগে শঙ্খ বাজাইয়া।। 
নবদ্বীপ ধামে আসি গঙ্গা হয় স্থির।
ভগীরথ দেখে গঙ্গা না হয় বাহির।
ভগীরথ বলে মাতা তুমি নাহি গেলে।
পিতৃলোক উদ্ধার না হবে কোন কালে।
গঙ্গা বলে—শুন বাছা ভগীরথ বীর।
কিছুদিন তুমি হেথা হয়ে থাকো স্থির।
মাঘ মাসে আসিয়াছি নবদ্বীপ ধামে।
ফাল্গুনের শেষে যাবো তব পিতৃকামে।।
যাঁহার চরণ জল আমি ভগীরথ। 
তাঁর নিজধামে মোর পুরে মনোরথ।।
ফাল্গুন পূর্ণিমা তিথি প্রভু জন্মদিন।
সেইদিন মম ব্রত আছে সমীচীন।। 
সেই ব্রত উদযাপন করিয়া নিশ্চয়। 
চলিব তোমারি কাজে না করিহ ভয়।।

রঘুবংশধর ভগীরথকে তাই গঙ্গাতীরে এই গঙ্গানগর প্রতিষ্ঠা করে মাসাবধি কাল প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল, গঙ্গাদেবী ফাল্গুনী পূর্ণিমায় শ্রীগৌরাঙ্গের জন্ম তিথিতে এখানে ব্রত-উদ্যাপন করে সাগর দ্বীপের দিকে যাত্রা শুরু করেন। 

এই নবদ্বীপের কিছু নীচেই ছিল জহ্নুমুনির আশ্রম। সেখানে আবার গঙ্গার স্রোত অবরুদ্ধ হয়েছিল, ভগীরথ জহ্নুমুনিকে তুষ্ট করে আবার গঙ্গাকে প্রবাহিত করেন। 

এই গঙ্গানগরে কিছুক্ষণ অতিবাহিত করে তাপদগ্ধ পথে আবার শুরু হল পরিক্রমা। চলেছে যাত্রীদল। 

নাম-কীর্তনের বিরাম নাই। কঠিন দাবাদাহ তুচ্ছ করে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে তারা চলেছে। এবার ভুবনবাবুও খুশি। পরিক্রমার মুখ্য সঞ্চালক এবার ভুবনের গুরুদেব আনন্দ মহরাজ স্বয়ং। পরম উৎসাহে চলেছে ভক্তবৃন্দ। 

গাছের ছায়ায় বসেছে মোনা মিত্তির। 

ওই হরিনামে তার মোহ নেই। তার মহাপ্রাণীর ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কামনা-বাসনা সবই আছে। রোদের তাপে যেন সর্বাঙ্গ জ্বালা করছে মোনা মিত্তিরের। 

তার সহচর ভূধর জানে কর্তাবাবুর এখন কোন বস্তুর দরকার। গাছতলায় সে বিয়ারের বোতল তার সঙ্গে কিছু বাদাম, উৎকৃষ্ট চানাচুরও এনেছে, তাই দেয়। 

বলে মোনা মিত্তির। 

—ব্যাটা ভূধর। নাহ্—তোর জ্ঞান আক্কেল আছে। যা তেষ্টা পেয়েছিল। 

ঠান্ডা বিয়ার চুমুক দিয়ে এক মুঠো বাদাম মুখে পুরে মোনা মিত্তির বলে—আঃ। জ্বালা জুড়োল। 

ভূধর বলে এদিক-ওদিক চেয়ে—কিন্তু তীর্থস্থানে এসে এসব খাচ্ছেন—মোনা মিত্তির বলে

-–এর দরকার তীর্থস্থানেও ছিল, আছে ভূধর। জগাই-মাধাইয়ের নাম শুনলি না? একটু আগে যে মাধাই ঘাট হয়ে এলি, তাদেরই একজন। স্রেফ মদ গিলেই থাকত—তারা না থাকলে মহাপ্রভুর প্রেম বিতরণ যে হতো না বাবা, তাই এই বস্তুর দরকার এই তীর্থপথেও। 

ভূধর বলে—ওরা এগিয়ে চলেছে, বল্লে বল্লাল ঢিবির ওখানে যাবে পরিক্রমা। 

মোনা মিত্তির বলে—যাক। আমরা পরে ওদের ধরে নেব, শান্তিতে একটু মৌতাত করতে দে। ওরা নামসুধা পান করুক, আমি পাপী-তাপী মানুষ, কারণ সুধাতেই ড্যাম গ্ল্যাড। 

বোতলে চুমুক দিচ্ছে মোনা মিত্তির, পরিক্রমা এগিয়ে চলেছে। ভক্তবৃন্দ চলেছে দূরে নাম-গান করতে করতে। 

—বাবু! 

হঠাৎ কার ডাকে তাকাল মোনা মিত্তির। কালো—ছিপছিপে একটা মাঝবয়েসি বুভুক্ষু চেহারার লোক ড্যাব ড্যাব করে তার বোতলের দিকে চেয়ে মনে মনে যেন ঢোক গিলছে। একদৃষ্টে চেয়ে আছে বোতলের দিকে লোকটা। 

চোরা যুধিষ্ঠিরও এসেছে পরিক্রমায়, সঙ্গে এসেছে রামচন্দ্র জুয়াড়িও। ওদের চেনা-জানা কিছু লোকজনও এসেছে। 

তাদের গ্রামের কানাই, কেষ্ট, রাধু, মোড়লের দলও এসেছে দেখে যুধিষ্ঠির অবাক হয় কেষ্টরা তিনজনে গাছতলায় গত রাতে মুড়ি খাচ্ছিল, যুধিষ্ঠির একটা ছোট পাঁইট ম্যানেজ করেছে রামচন্দ্রকে বলে কয়ে। কারণ কাল এসেই রামচন্দ্রও রোজকারের আশায় সন্ধ্যাতে মন্দিরের বাইরে একটা গাছতলায় জুয়ার ছক পেতে বসেছিল। 

ভোর রাত থেকে পরিক্রমা শুরু হবে। তাই সন্ধ্যার মুখ থেকেই লোকজন দোকানদাররা আসতে শুরু করেছে। বৈষ্ণবের দলও এখানে-ওখানে কীর্তন শুরু করে। বেশ মেলা মেলা ভাবই নেয়। দোকানপত্রও বসেছে। সুতরাং জুয়ার আসরও বসতে পারে। 

যুধিষ্ঠিরও এর মধ্যে ওই জুয়ার ছকে বসে বাজিই ধরছে—আর প্রতিবারই জিতেই চলেছে। লোকজনও জুটে গেছে—তারাও দেখছে টাকায় টাকা লাভ করছে লোকটা। ওরা জানে না যে, এসব আপসের ব্যাপার। জুয়াড়ির দলেরই লোক—যা জিতছে ও সেটা পরে সবই ফেরত দেবে জুয়াড়িকে, ওটা খদ্দের টানার কৌশল মাত্ৰ 

তাকে জিততে দেখে এবার বেশ কিছু লোকও জুয়ার ছকে টাকা লাগাতে থাকে—আর তাদের খেলা জমে ওঠে, সেই ফাঁকে যুধিষ্ঠিরও কেটে পড়ে। 

টাকা সব ফেরত চলে যায় জুয়াড়ির কাছে আর বকশিস বাবদ পেয়েছিল একটা পাঁইট। সে কাল রাতেই শেষ হয়ে গেছে। 

যুধিষ্ঠির অবশ্য কাল রাতেই দু’তিনটে পকেট সাফ করে কুল্যে প্রায় আশি টাকা পেয়েছে। মন-মেজাজ ভালোই আছে। এর মধ্যে যুধিষ্ঠির পরিক্রমার যাত্রীদের জরিপও করেছে। 

দেখেছে নরহরি বিশ্বাস এসেছে, ওর ফতুয়ার নিচে কোমরে গেজিয়ায় মজবুত করে বাঁধা আছে টাকার তোড়া। অবশ্য ওর তৃতীয় পক্ষের গিন্নির হাতে রয়েছে বেশ কিছু সোনার চুড়ি, গলার হারটাও বেশ ওজনদার, গহনাগুলো দামিই। যুধিষ্ঠির অবশ্য তাক করে আছে, দেখা যাক কাকে ছোবল মারতে পারে। কর্তা না গিন্নিকে। 

দেখেছে কোন কলকাতার এক বউরানিকে। তার হাতে গলার কানে গহনা রয়েছে তবে সঙ্গের ঝি-টা একেবারে মহাচালু। যুধিষ্ঠির ভিড়ের মধ্যে দু’একবার নাচার ভান করে নামগান করতে করতে ওদের দিকে একটু এগোবার চেষ্টা করতেই সেই কাজের মেয়েটা ফুঁসে ওঠে—নাম-গান করতে হয় ওদিকে গে নাচন কোঁদন কর গে মিসে, ছেলেমেয়েদের মধ্যিখানে কেনে? সরো তো— 

যুধিষ্ঠির বুঝেছে এখানে আপাত সুবিধা হবে না, সরে যায় কীর্তন থামিয়ে 

সকাল থেকে হেঁটেই চলেছে যুধিষ্ঠির। খিদে-তেষ্টাও লেগেছে। প্রসাদের এখনও দেরি আছে। খোল কর্তালের তালে খালিপেটে নাচন কাঁহাতক পারা যায়? যুধিষ্ঠির পিছিয়ে পড়েছে—হঠাৎ নজর পড়ে ওই গাছতলার বাবুটির দিকে। 

শৌখিন বাবু গোছের চেহারায় আভিজাত্য ফুটে উঠেছে। ওকে গাছতলায় বসে বেশ জুত করে মদ্যপান করতে দেখে যুধিষ্ঠিরও পায়ে পায়ে ওইদিকে এগিয়ে যায়। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ওর বোতলের দিকে। 

রতনে রতন চেনে, মোনা মিত্তির রসিক ব্যক্তি, তাই এক নজরে সে ওই যুধিষ্ঠিরকে দেখেই চিনেছে। যুধিষ্ঠির-এর চোখ পড়েছে মোনা মিত্তিরের হাতের বোতল আর ওর গলার বেশ ওজনদার সোনার চেনটার দিকেই। 

এই বোতলটাও এখন পূর্ণই রয়েছে, কিছুটা খেয়েছে মাত্র মোনা মিত্তির।

যুধিষ্ঠিরকে দেখে বলে—কি হে এখানে? নাম-কীর্তন তো ওদিকে। ওখানে নামসুধা—এদিকে কারণসুধা। চলে টলে? 

যুধিষ্ঠির এবার ভরসা পেয়ে ঘাসের উপরই বসে পড়ে এদিক-ওদিক চেয়ে বলে— আজ্ঞে তীর্থস্থানে মিছে কথা বলব নাই। খাই, তবে পেলে পাবনে। মানে কেউ দিলে টিলে আর পাল-পার্বণে যদি মিলে যায় কখনও তখন খাই। 

মোনা মিত্তির বলে, 

—রিয়েল রসিক ব্যক্তি। পেলে আর পার্বণে খাও। ঠিক আছে—নাও এক পাত্তর, তবে বাবা—পরিক্রমায় ওই বাবাজিদের দলে বেঘোর হয়ো না, পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে। 

যুধিষ্ঠির বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে বলে—আজ্ঞে বিলেতি। আর একটু- 

—হ্যাঁ। দেশি আমার সয় না। তা বাবা, মাল তো আর নেই এখন। আমারই টান পড়ে গেছে। সন্ধ্যাবেলাতে এসো—তাঁবুতে হবে। তোমার নাম? 

—আজ্ঞে শ্রীযুধিষ্ঠির দাস। 

—শ্রীযুধিষ্ঠির, তুমিতো বাবা ধম্মপুত্তুর। তা তোমার আবার ধৰ্ম্ম-উপার্জনের দরকার কী?

হাসে যুধিষ্ঠির—আজ্ঞে সেই এক নম্বর যুধিষ্ঠির নাই গো— 

—তাহলে দু’নম্বরি যুধিষ্ঠির। ভেরি গুড। এসো—সন্ধ্যার পর। 

—যে আজ্ঞে। 

যুধিষ্ঠির দেখছে মোনা মিত্তিরের গলার দামি চেনটা। বেশ মুক্তা বসানো লকেটও আছে। টানতে পারলে বেশ কয়েক হাজার টাকা আমদানি হয়ে যাবে। আর আশার কথা, লোকটা মালটাল খায়। কোনরকমে বেশি খাইয়ে একটু আউট করতে পারলেই যুধিষ্ঠির গুরুর কৃপায় তার হাতের খেলা দেখাতে পারবে, বাবু টেরও পাবে না। 

যুধিষ্ঠির খুশি মনেই এবার পরিক্রমার দিকে এগিয়ে যায়। এখানে এসে সে বেশ কিছু ধান্দাই করতে পারবে বলে মনে হয়। 

রামচন্দ্রও চলেছে, যুধিষ্ঠিরকে ফিরতে দেখে শুধোয়। 

—কোথায় ছিলি! বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে? আমদানি হলো নাকি? 

যুধিষ্ঠির বলে।—না হয়নি, তবে হবে গৌরাঙ্গের দয়ায়। ঠাকুর বড় জাগ্রত হে। তোমারও তো আমদানি হচ্ছে রামচন্দর। তবে কি জানো? 

দিনকাল সুবিধার নয়। রামচন্দ্র যুধিষ্ঠির জুয়াড়ি—চোর সব হয়ে গেল—এবার গোরাকে নিয়ে টানাটানি না শুরু হয়। 

রামচন্দ্র বলে–ঠাকুরের দোষ কি বল। বাবা মা তো ভেবেছিল ছেলের ঠাকুর ঘেঁষা নাম রাখলে—তারা ডেকেও পুণ্যিলাভ করবে। 

কিন্তু ব্যাটারা খাবে কী করে তা তো ভাবেনি। তাই আমাদের ওইসব ধান্দা করেই পেট পালতে হচ্ছে। আমাদের দোষ কী বলো? আমি কি জুয়াড়ি হতে চেয়েছিলাম? তুই কি চোর হতে চেয়েছিলি? বল? 

যুধিষ্ঠির বলে—ছাড়ো ওসব কথা। ওসব ভেবে আর লাভ কী? ঠাকুরই মানুষকে চোরও করেন—আবার সাধু, সৎ করেন তিনিই। যার অদৃষ্টে যা আছে—কোন্ ব্যাটা খন্ডাবে বলো। 

চলেছে ওরা সামনের বিশাল উঁচু একটা স্তূপের দিকে। 

সমবেত কণ্ঠে শোনা যায় ওই স্তোত্র- 

—প্রলয় পয়োধি জলে ধৃতবানসি বেদম্
বিহিত বহিতচরিত্রমখেদম্ 
কেশব ধৃত-মীনশরীর জয় জগদীশ হরে।।
ক্ষিতিরিহ বিপুলতরে তব তিষ্ঠতি পৃষ্ঠে
ধরণিধরণকিণচক্রগরিষ্ঠে। 
কেশব ধৃত-কূর্ম শরীর জয় জগদীশ হরে।।
বসতি দশন শিখরে ধরণী তব লগ্না
শশিনি কলঙ্ক কলেব নিমগ্না। 
কেশব ধৃত-শূকররূপ জয় জগদীশ হরে।। 
তব করকমলবরে নখমদ্ভূত শৃঙ্গ 
দলিত হিরণ্য কশিপু তনু—ভৃঙ্গম 
কেশব ধৃত-নরহরিরূপ জয় জগদীশ হরে।। 

স্রোতারা শুনছে ওই দশাবতার স্তোত্র। ভুবনবাবুর কন্ঠস্বর ধ্বনিত হয় 

—এই সে বল্লাল ঢিপি। এখানেই অতীতে ছিল রাজা বল্লাল সেনের রাজধানী। তখন বাংলার এক মহান যুগ। এখানে আজও মাটির অতলে সমাহিত রয়েছে সেই ইতিহাসের অধ্যায়। 

আর এই দশাবতার স্তোত্র রচনা করেছিলেন কবি জয়দেব এই পুণ্যভূমিতে। তাঁর কাব্যসুষমায় মুগ্ধ হয়ে রাজা বল্লাল সেন তাঁকে তাঁর সভাকবির পদ অলঙ্কৃত করতে বলেন—কিন্তু পরম ভক্ত কবি ওই রাজসম্মান, ঐশ্বর্য আর কোলাহল ছেড়ে চলে গেলেন এখান থেকে দূরে গঙ্গার অপর পারের এক নিভৃত গ্রামসীমান্তে। সেখানেই তার মহৎ কাব্য গীতগোবিন্দ রচনা করেন। 

এই সেই রাজা বল্লাল সেনের রাজধানী—ওদিকে তাঁরই সৃষ্ট সুপেয় জল পরিপূর্ণ বল্লালদিঘি। আজ কালের প্রবাহে সবই জীর্ণ—বিলীয়মান, তবু ইতিহাস মাটির অতলেও তাকে সযত্নে রচনা করে চলেছে। 

আর এই ইতিহাসের আর একটি অধ্যায়-এর কাছে এসে গেছি আমরা। 

পরিক্রমা এসে পৌঁছায় ছোট্ট সবুজ জনপদের একটি বিশেষ স্থানে। বহু প্রাচীন এক গলঞ্চ গাছ কয়েক শতাব্দীর স্মৃতি বহন করে আজও বিরাজমান, নীচে একটি সমাধি—ওই গাছ থেকে অজস্র ফুল ওই সমাধির উপর ঝরে পড়ে আজও। 

ভক্তরা সমবেত হয় ওই সমাধি মন্দিরের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে—ভুবনবাবুর কন্ঠস্বর শোনা যায়—তিনি এই পবিত্র ভূমির প্রসঙ্গে প্রবচন পাঠ করে চলেছেন, 

—হেথা গৌরাঙ্গ রায়—কীর্তন করিয়া। 
কাজি নিস্তারিল প্রভু প্রেমরত্ন দিয়া।
শ্রীকৃষ্ণ লীলায় যেই কংস মথুরায়।
গৌরাঙ্গ লীলায় চাঁদ গাজি নাম পায়।।
এইজন্য প্রভু তারে মাতুল বলিল।
ভয়ে কাজি গৌরাঙ্গ শরণ লইল।।
কীর্তন আরম্ভে কাজী মৃদঙ্গ ভাঙ্গিল। 
হোসেন সাহার বলে উৎপাত করিল।
হোসেন সা সে জরাসন্ধ গৌঢ় রাজ্যেশ্বর। 
তাহার আত্মীয় কাজি প্রতাপ বিস্তর। 
প্রভু তারে নৃসিং রূপেতে দেয় ভয়।
ভয়ে কংস সম কাজী জড়সড় হয়।।
তারে প্রেম দিয়া কৈল বৈষ্ণব প্রধান।
কাজির নিস্তার কথা শুনে ভাগ্যবান।। 

জয়ধ্বনি দেয় ভক্তবৃন্দ। ভুবনবাবু এখানে গৌর তত্ত্বের এক সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করে চলেছেন। ব্রজের লীলা আর নবদ্বীপে সেই অবতারের লীলা প্রসঙ্গে তিনি ব্যাখ্যা করেন। 

—ব্রজতত্ত্ব নবদ্বীপ তত্ত্বে দেখ ভেদ। 
কৃষ্ণ অপরাধী লভে নির্বাণ অভেদ।।
হেথা অপরাধী পায় প্রেমরত্ন ধন। 
অতএব গৌরলীলা সর্বোপরি হন।।

ভক্তবৃন্দ যেন গৌরলীলার এই অপরূপ রূপ অনুভব করে ধন্য হয়। তারা পরিক্রমায় এসে সেই রৌদ্রতপ্ত পৃথিবীর পথে কি যেন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। 

সারা এলাকাটায় সবুজ গাছের সমারোহ। দুপুরে এই ছায়ামতো বিস্তীর্ণ এলাকায় এসে থামল পরিক্রমা। এখানে সকাল থেকেই লোকজন এসে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছে, ওদিকে প্যান্ডেলে এত লোকের রান্নার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। 

ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত ভক্তদের এবার প্রসাদ পাবার জন্য বিরতি শুরু হয়েছে। ভুবনবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়েন। 

ওদিকে অনিরুদ্ধও পরিক্রমার কর্তাদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছে অতিথি সৎকারে। 

গাছের ছায়ায় বসেছে হাজারো মানুষ। অনেকেই অনেককে এর আগেও দেখেনি, চেনেও না। কিন্তু কি এক অদৃশ্য বাঁধনে তারা বিভিন্ন বাতাবরণ থেকে এসে এখানে একটি সূত্রে যেন বাধা পড়েছে। 

যুধিষ্ঠির রামচন্দ্ররাও বসেছে পাতা নিয়ে। 

ওদিকে খেতে বসেছে কেষ্টচরণ, কানাই রাধুর দল। তারাও এসেছে। আর তারা তৈরি হয়েই এসেছে ওই নরহরিকে তারা মৌকা পেলেই শেষ করে দিয়ে তাদের এতদিনের শত্রু নিপাত করে পালাবে তারা। তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেবার শোধ এই ভাবেই নেবে ওরা। মুখে তাদের ওই হিংস্রতার কোনো প্রকাশই নেই। চুপচাপ খেয়ে চলেছে। 

কারোও কাছে তাদের সেই মনোবলও প্রকাশ করেনি। যুধিষ্ঠির খাচ্ছে তাদের পাশে বসে। সে বলে, 

—কিরে কানাই, তোরাও এসেছিস পরিক্রমায়? 

কানাই বলে—চাষবাসের কাজও চুকে গেল, ক’দিন কাজ-কাম নাই, চলে এলাম। 

—তা ভালো করেছিস। পুণ্যির কাজ করা ভালো রে। 

যুধিষ্ঠির বেশ গম্ভীর ভাবে ওকে জ্ঞান দিয়ে হঠাৎ পরিবেশনকারীদের দেখে হাঁক পাড়ে—এদিকে ভাত আর তরকারি আনো হে ছোকরা। 

যুধিষ্ঠির যেন জীবনের শেষ খাওয়া খাচ্ছে, এত-ভাত-ডাল সবজি পাতে চাঁই করে গবাগব গিলছে। 

রামু বলে—আর কত খাবি রে যুধিষ্ঠির? 

যুধিষ্ঠির বলে—শুনলাম রাতে যে-যার খাবার ব্যবস্থা করবে। তাই ওটাও এখান থেকেই করে রাখছি। 

নরহরি অবশ্য তার নিজের ব্যবস্থা করেছে। তার লোককে দিয়ে মূল মন্দির থেকে খাঁটি ঘিয়ের পুষ্পান্ন তরিতরকারি ছানার কালিয়া উৎকৃষ্ট পায়েস, মালপোয়া ইত্যাদি আনিয়েছে টিফিন কেরিয়ার করে। 

জনতা তৃপ্তিভরে প্রসাদ খাচ্ছে লাইনে বসে। কুন্তী দেখে জমিদার বাড়ির বউ ললিতা ও বসেছে—আরও অন্য মেয়েদের সঙ্গে। মেয়েদের মধ্যে কলকাতার বনেদি বাড়ির বউ চন্দনাকেও দেখা যায় বসেছে ওই পঙ্ক্তিতে, অবশ্য তার সঙ্গিনী মানদা বলে—ওই ইত্যিজাতের মেয়েদের সঙ্গে খেতে বসবে বউদিমণি? 

চন্দনা বলে—এখানেও জাত বিচার? চৈতন্যদেব ওটাকে মানতেন না রে। বৈষ্ণব ভক্তের আবার জাত কি! বসে পড়। 

মানদা বলে—ধন্যি যা হোক! কিসের জন্য যে কলকাতার আরাম আয়েস ছেড়ে বের হয়েছে কে জানে? সেখানে গাড়ি ছাড়া একপাও হাঁটো না, এখানে ভোর থেকে মাঠে-ঘাটে চষে বেড়াচ্ছ। শরীরে সইলে বাঁচি। 

চন্দনা আজ পরম পাওয়ার আশায় পথে বের হয়েছে। বলে সে মানদার কথার-ওরে শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই-ই সয়। নে প্রসাদ খা। 

পায়েল প্রকাশ্যে পাতা পেতে প্রসাদ খেতে আসেনি। সে ওই দূরের একটা গাছের ছায়ায় বসে সামান্য কিছু কিছু মিষ্টি, ফলমূল দিয়েই আহার সারে। মোনা মিত্তির অবশ্য আয়োজনের ত্রুটি রাখেনি। 

সে এর মধ্যে কৃষ্ণনগরের একটা বড় হোটেলে অর্ডার দিয়ে রেখেছে, তাদের লোক বাসে করে খাবার নিয়ে এসে পৌঁছে দেবে। সেইমতো হটপট-এ করে বিরিয়ানি, চিলি চিকেন— চিকেন কাটলেট এসবও এসে গেছে। 

মোনা মিত্তির ওইসব নিয়ে বসেছে। বিজাতীয় গন্ধ ওঠে। পায়েলের নাকেও এখন ওই গন্ধ বাজে। সে বেশ কিছুদিন থেকেই নিরামিষ খেতে শুরু করেছে। পায়েল তার সেই পোশাক গহনা সবই ছেড়েছে, মায় এতদিনের অভ্যস্ত আহারও ছেড়েছে সে। 

আজ মোনা মিত্তিরকে এখানে ওই চিকেন-মটন-মাছ এসব খেতে দেখে বলে পায়েল, 

—এখানে দেখছ সবাই সাত্ত্বিক আহার করছে। মাছ-মাংস এসব ছাড়তে পারো না? নিরামিষই খেতে হবে এখানে—আমিষ নয়। এই রীতি মানতেই হবে। 

—নাহলে? মোনা মিত্তির মুরগির ঠ্যাং চুষতে চুষতে প্রশ্ন করে। 

বলে পায়েল-নাহলে বলব, এসব খেতে হলে, এখান থেকে চলে যেতে হবে। এই অনাচার সইবে না—এখানে করো না। 

—তাই নাকি? হাসছে মোনা মিত্তির। 

পায়েল বলে—তোমার ভালোর জন্যই বলছি মিত্তির মশাই। মানুষের জীবনে পাপ ওই নেশাঅখাদ্য আহার এসবের উপর ভর করেই আসে। মদ ওইসব খাবার এবার ছাড়ো। নিরামিষ খেলে মানুষ সুস্থ থাকে—মনের শান্তি বাড়ে। 

মোন মিত্তির বলে—দেখা যাক। তোমার ঠাকুর আমাকে নিয়ে কী করেন। 

পায়েল বলে—ঠাকুর যা করাবেন সেটা তুমি নিজেই করতে পার মিত্তির মশাই।

—তাই নাকি? তা ঠাকুরের কী ইচ্ছা? 

মোনা মিত্তিরের কথায় বলে পায়েল—তুমি কলকাতায় ফিরে যাও মিত্তির মশাই, আমাকে আমার পথে চলতে দাও। আগেকার সেই বিলাসের জীবন ছেড়ে আমি এই কঠিন ত্যাগ আর সাধনার জীবনেই আসতে চাই। আমার কাছে তোমার আর কোনো কিছু পাবার আশা নেই, তুমি তোমার সংসারে ফিরে যাও; আমার জীবনে অশান্তি আর বাড়িয়ো না। তুমি ঘরে ফিরে যাও, শুনেছি তোমার স্ত্রী আছেন, তবে কেন এইভাবে পথে পথে ঘুরছ? 

মোনা মিত্তির বলে, 

—আমাকে কাটিয়ে অন্য কোথাও নোঙর ফেলতে চাও, পায়েল তা জানি। আমার টাকার কি কমতি আছে? বলো—কি চাই? 

পায়েল বলে—আমি চাই তুমি এখান থেকে চলে যাও, আর কিছুই চাই না। আমাকে মুক্তি দাও তুমি। 

হাসছে মোনা মিত্তির বিজয়ীর মতো। বলে সে, 

—ধানাই পানাই ছেড়ে চলো কলকাতায় ফিরে চলো, ব্যস। 

নাচো গাও—দিন বিতাও, ব্যস। 

নরহরি গিন্নির জন্য এবার কৃষ্ণনগরের উৎকৃষ্ট সরভাজা-সরপুরিয়া—মন্দিরের ওই প্ৰসাদ সাজিয়ে ডাকে কুন্তীকে। 

—কই গো হাত-মুখ ধোয়া হলো? এসো প্রসাদ ঠান্ডা হয়ে যাবে। 

গোকুল ওইদিক দিয়ে যাচ্ছিল, তারও খিদে পেয়েছে। ওদিকে মা অন্যরা খেতে বসেছে, গোকুল সেদিকেই চলেছে, হঠাৎ কার ডাকে তাকাল। 

কুন্তী ডাকছে তাকে—শোনো। 

গোকুল বলে—আমাকে ডাকছেন? 

কুন্তী বলে—হ্যাঁ। শোনো 

দাঁড়াল গোকুল, কুন্তী বলে—এসো না? এসো–খাওয়া হয়নি তো এখনও? 

গোকুল দেখছে ওই উৎকৃষ্ট খাবারগুলোকে। বাতাসে ঘিয়ের সুবাস ওঠে। ওসবের তুলনায় ওই প্রসাদ তেমন কিছুই নয়। তবু গোকুল বলে, 

—মা, দাদুরা অপেক্ষা করবেন। ওঁরা খেতে বসেছেন, আমি যাই। ওখানেই খাব। 

—কিছু নিয়ে যাও। সন্দেশ। 

হঠাৎ নরহরি ধমকে ওঠে—সন্দেশ দেবে? দাম কত জানো? একশো টাকা কিলো। 

কুন্তী অবাক হয় লোকটার কথায়। নরহরি বলে—থাক। আমি দানছত্র খুলিনি। আপনার জোটে না শঙ্করাকে ডাক। 

তারপর গোকুলকে ধমকে ওঠে নরহরি। 

—এই ছোঁড়া, যা তো এখান থেকে। তখন থেকেই দেখছি এখানেই ঘুরঘুর করছিস। শেষে কিছু হাতিয়ে কেটে পড়ার তাল। 

গোকুল অবাক হয় ওর কথায়। বলে, 

 —আমি তো আসিনি। তোমরাই ডাকলে। কে চায় তোমাদের সন্দেশ, কে চায় তোমাদের টাকা?

ছেলেটা চলে যায়। নরহরি গজরায়, 

—আবার মেজাজ আছে। ট্যাকখালির জমিদারের বাচ্চার আবার মেজাজ! 

কুন্তী বলে—থামবে তুমি! মানুষকে মানুষ ভাবো না। এসেছ পরিক্রমায় গৌরাঙ্গদেবের দয়া চাইতে। তুমি ভক্ত—ঠগ—ঠাকুরের দয়া কোনোদিনই পাবে না। 

নরহরি অবাক হয় স্ত্রীর কথায়। বলে সে, 

—আঃ রাগারাগি কেন? নাও—খেয়ে নাও। দামি প্রসাদ। 

—দামি প্রসাদ তুমিই খাও। আমি ওই পঙ্ক্তিতে বসে সকলে যা খাচ্ছে সেই প্রসাদই পেতে চাই। তোমার ওই একশোটাকার দামি সন্দেশ আমার রুচবে না, তুমিই খাও ওসব 

হনহন করে চলে গেল কুন্তী, নরহরি বিড়বিড় করে। 

—এখানেও শান্তি নাই হে গৌর। 

বৈকাল নামছে। পরিক্রমা চলেছে ছায়ানামা গ্রাম্য পথ দিয়ে। কীর্তনের সুর ওঠে গ্রামের ধূলিধূসর পথে। গ্রামবাসীদের অনেকেই পথের দু’দিকে দাঁড়িয়ে শঙ্খধ্বনি করে। 

ওরা গঙ্গার তীর দিয়ে এগিয়ে চলেছে, সামনে এক প্রাচীন মন্দির। সেখানে নতুন মন্দির ও গড়ে উঠেছে, রয়েছে বিশাল বাগান— 

গঙ্গার বুকে দিনের শেষে সূর্যের আলো মুছে আসছে। 

সারাদিন পরিক্রমার পর এবার আজকের মতো বিরতি। 

ভক্তরা গঙ্গার জলে সারাদিনের তাপ-মুছে ফেলার জন্য স্নানে নেমেছে। 

সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে শোনা যায় কার সুরেলা গলায় গঙ্গাস্তোত্র। 

পায়েল মুগ্ধ হয়ে শুনছে। 

—দেবী সুরেশ্বরী ভগবতি গঙ্গে 
ত্রিভুবন তারিণী তরলতরঙ্গে। 
শঙ্কর মৌলি নিবাসিনী বিমলে 
মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে।। 
ভাগীরথী সুখদায়িনী মাতস্তব 
জলমহিমা নিগমে খ্যাতঃ। 
নাহং জানে তব মহিমান 
ত্রাহি কৃপাময়ী মামজ্ঞানম্।। 
হরিপাদপদ্ম তরঙ্গিনী গঙ্গে 
হিমবিধুমুক্তা ধবল তরঙ্গে। 
দূরীকুরু মম দুষ্কৃতিভারং 
কুরু কৃপয়া ভবসাগরপারম্।। 

ওই ব্যাকুল আর্তি যেন গঙ্গার কলধ্বনিতে মিশে কোন সীমাহীন অনন্তের দিকে বয়ে চলেছে।

মোনা মিত্তির গঙ্গার ধারে বসে আছে, হঠাৎ কাকে দেখে চমকে ওঠে। 

দু’একটা তারার রোশনি জানে—নিকোনো আকাশ, চাঁদের আলো পড়েছে গঙ্গার জলে। সেই বিচ্ছুরিত আলো দেখে চন্দনা তার পতিদেবতাকে। চমকে ওঠে সে, যার জন্য ঘর ছেড়ে পথে বের হয়েছে চন্দনা দৈবীকৃপার আশায়, আজ এই পরিবেশে একান্তে তাকে পেয়ে খুশিই হয় চন্দনা। 

—তুমি! 

মোনা মিত্তির ভাবতেই পারেনি যে তার স্ত্রীকে সে দেখবে এই হাটের মাঝে পরিক্রমার ভিড়ে। তার বংশমর্যাদা, আভিজাত্য বোধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। স্বামীত্বের অধিকার যে তারই সেটা তো ভোলে না মোনা মিত্তির এখন সে নীলরক্তের ধারাবাহী কোনো মানুষ।

বলে মোনা মিত্তির—তুমি বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছ এখানে? আমাদের বংশের কোনো বউ যা করেনি তাই করেছ তুমি? 

চন্দনা বলে, 

—দোষ করেছি বাধ্য হয়েই। তুমি ঘরে ফিরে চলো, সেখানে গিয়ে আমাকে যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে মেনে নোব। 

তোমার জন্যই আমি পথে বের হয়েছি। 

মোনা মিত্তির ওর কথায় যেন জ্বলে ওঠে। তাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্যই এসেছে চন্দনা। মোনা মিত্তির বলে, 

—অতবড় সাহস তোমার? এতদূরে চলে এলে হুট করে? 

চন্দনা বলে একা আসিনি। সরকার মশাই—মানদাও সঙ্গে এসেছে। 

—ও, বেশ তোড়জোড় করেই এসেছ তাহলে। 

চন্দনা বলে—আমার স্বামীকে গৌরাঙ্গদেবের দয়াতেই ফিরে পেয়েছি। ঘরে চলো—

মোনা মিত্তির বলে, 

—তুমি ঘরে ফিরে যাও কালই। ক’দিন বাদেই আমি কলকাতায় যাব। 

—এখনই কেন নয়? চন্দনা শুধোয়। 

—আঃ, ফের জবাব! শোনো, যা বললাম তাই করো। কালই ফিরে যাও, এখানের কাজ সেরেই আমি ফিরে যাব। তুমি চলে যাও কলকাতায়। 

চন্দনা দেখছে মনে। আজ চন্দনা নিজের মনের জোর পেয়েছে। এতদিন ধরে অনেক সহ্য করেছে অপমান, অবজ্ঞা আর অবহেলা। আর নয়। এবার স্বামীকে নিয়েই ফিরবে সে। 

তাই বলে চন্দনা, 

—না। তোমাকে না নিয়ে আমি বাড়ি ফিরব না। পরিক্রমার মাঝেই থাকব। দেখি গৌরসুন্দরের কৃপা পাই কিনা।

কথাটা বলে চন্দনা চলে যায় তাদের তাঁবুর দিকে। 

ওদের সব কথাগুলো শুনেছে পায়েল। সে গঙ্গাস্নান করতে আসছিল। 

হঠাৎ মোনা মিত্তিরকে একটি মহিলার সঙ্গে কথা বলতে দেখে প্রথমে অবাকই হয়। তারপর পায়েলও জানতে পারে ওই মহিলার পরিচয়। পরিক্রমাতে দেখেছে তাকে পায়েল। তখনই মনে হয়েছিল, বনেদি ঘরের বউ। ভক্ত, তাই এসেছে পরিক্রমায়। 

এখন জানতে পারে কি ব্যাকুলতা নিয়ে ওই মহিলা কলকাতার আরাম বিলাসকে তুচ্ছ করে এখানে এই পরিক্রমাতে এসেছে। গৌরাঙ্গদেবের কৃপায় সে স্বামীকে ফিরে পেতে চায়। 

এবার পায়েলের নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। 

কি বলতে যাবে, দেখে মোনা মিত্তির বিরক্তিভরে উঠে পড়েছে ওখান থেকে। চলে গেল অন্যদিকে। বেশ চঞ্চলই দেখায় তাকে, পায়েলও চায়—ও ঘরে ফিরে যাক। ওই ভদ্রমহিলার ব্যাকুল আর্তির যেন পূরণ হয়। পায়েল আপাতত কিছু বলার সুযোগ পায় না মোনা মিত্তিরকে, তবে এই ব্যাপারটা তার মনকেও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। একজন মেয়ে হয়ে সে আজ মোনা মিত্তিরের স্ত্রীর মনের ব্যাকুলতাকে মনে মনে অনুভব করেছে। তাই তার জন্য এবার সত্যিই কিছু করবে পায়েল। প্রয়োজন হলে কঠিনই হবে সে। 

মোনা মিত্তিরকে তার ঘাড় থেকে নামাতেই হবে পায়েলকে। আজ পায়েলও মুক্তি চায়।

মোনা মিত্তিরের মেজাজটা একদম বিগড়ে গেছে। সে ভাবতেই পারেনি। যে চন্দনা কলকাতা থেকে এখানে এসে হাজির হবে তার সন্ধানে। ঠাঁই-ঠাঁই অন্ধকার নেমেছে বাগানে। বাগানের অন্যদিকে চলেছে আলোকিত মন্ডপে ‘ধর্মসভা’ ভক্তদের কেউ ভাষণ দিচ্ছেন। শ্রোতাদেরও অভাব নেই। এখানে এসে যাত্রীরা এক ধর্মের বাতাবরণের মধ্যে এসে পড়েছে, নাম-কীৰ্তন, ধর্মশাস্ত্ৰ আলোচনা এর মধ্যেই সময় কেটে যায় ওদের। 

তাঁবুতে এসেছে মোনা মিত্তির, পায়েল তখনও ফেরেনি, বোধহয় কোথাও নাম-কীর্তনের আসরেই বসে গেছে। মরুক গে! 

মোনা মিত্তির দেখে বাইরে তার অনুচর ভূধর কাঠের উনুনে কি রান্না করছে। মোনা মিত্তির গিয়ে মদের বোতল নিয়ে বসে তাঁবুর ওদিকে একটা গাছের নিচে আবছা অন্ধকারে। কীর্তনের শব্দ ভেসে আসে। মোনা মিত্তির মদ্যপান করে মেজাজটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। 

.

যুধিষ্ঠির তক্কে তক্কেই ছিল। সে দেখেছে যাত্রা থামিয়ে পরিক্রমার দলের ভক্তরা এবার যে যেখানে পেরেছে রাতের জন্য আশ্রয় নিয়েছে। কারোও ভাগ্যে জুটেছে তাঁবুর আশ্রয়। কেউ এনেছে নিজেই ভাড়া করা তাঁবু। তারা সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। 

ওদিকে প্রধান মন্ডপে পাঠ-কীর্তন চলেছে। 

যুধিষ্ঠির দেখেছে ওই পায়েলকে সেখানে, আর মনে হয়েছে বাবু তাহলে তাঁবুতেই আছে।

রামচন্দ্র ওদিকে মূল মন্ডপের বাইরে দোকান-পত্রের এক কোণে একটা গাছের নিচে কারবাইড গ্যাসের আলো জ্বেলে জুয়ার ছক সাজিয়ে বসেছে। রাতের খাবার বলতে দোকানের আটার রুটি, সবজি, ডাল মেলে, নাহয়, মুড়ি-বাতাসা-রসগোল্লা মেলে। তাই দিয়েই যাত্রীরা রাতের খাওয়া সারে। দিনের মতো রাতে ঢালাও প্রসাদের ব্যবস্থা নেই। ওটা নিজেদেরই জোগাড় করে নিতে হয় যাত্রীদের। 

তাই রাতের বেলায় খাবারের দোকানগুলোয় ভিড় বেশিই হয়। আর তাই রামচন্দ্ৰও সেখানে জুয়ার ছক সাজিয়ে বসে—আর যুধিষ্ঠির খদ্দের সেজে প্রথমে জুয়া খেলতে শুরু করে, আর জেতেও। তাই দেখে খদ্দেররাও বসে পড়ে। নিজেদের কষ্টের টাকা দিয়ে বাজি আড়ে—দ্বিগুণ তিনগুণ পাবার আশাতে, আর সর্বস্ব তাদের কেড়ে নেয় রামচন্দ্র—যুধিষ্ঠিরের সাহায্যে। অর্থাৎ প্রতারণার ক্ষেত্রে রামায়ণ মহাভারত সব একাকার হয়ে গেছে, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি চারযুগেই সেই প্রতারণার পথ চলেছিল, আজও চলেছে আর চলবেও। 

যুধিষ্ঠির জুয়ার ঠেক চালু করে দিয়ে এবার নিজের ধান্দাতে বের হয়। তাঁবুগুলোতে দু’একবার উঁকি মেরেছে যুধিষ্ঠির। এখনও সবাই জেগে। রাত গভীর হলে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন হাতের খেলা দেখাবে যুধিষ্ঠির। এখন ওই মিত্তিরবাবুর সন্ধানেই চলেছে যুধিষ্ঠির যদি বিনা-পয়সায় মদ জোটে। লোকটা বেশ মালদার আর দিলদারও, তাকে ডেকে বিলাতি খাইয়েছে। যুধিষ্ঠির অবশ্য চিনে রেখেছে তাঁবুটা—তাই ভিড়ের মধ্যে পথ চিনে চলেছে সে। 

ললিতা—গোপালের মা বুড়ি—আরও দু’একজন মহিলা, গোকুলদের জন্য ভুবনবাবু একটা তাঁবুর ব্যবস্থা করেছেন। অনিরুদ্ধের দলবল-এর মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে কিছু খড় এনে পেতে বলে,

–কাকিমা, এর উপর শতরঞ্চি চাদর পেতে শুয়ে পড়বেন। রাতে বেশিক্ষণ জাগবেন না। কাল ভোর চারটেয় উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে বের হতে হবে পরিক্রমায়। সূর্যোদয়ের আগেই যাত্ৰা শুরু হবে। 

গোকুলের মা বুড়ি বলে—দিনভোর রোদে যা ধকল গেছে বউমা, ও গোকুল ভাই—সকাল সকাল খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়। কাল ভোর থেকে আবার কেত্তন শুরু হবে। 

নরহরি নিজের তাঁবুতে এবার শয্যা নিয়েছে। কোলা ব্যাঙের মতো গোলাকার মেদবহুল ঘৃতপক নধর বপু বিছানায় পড়ে আছে আর তার খাস চাকর বেশ কড়াহাতে দলাই-মালাই করছে নরহরিকে। 

নরহরি বলে—উঃ! রোদে ঘোরাও কষ্টকর। তা নতুন বউ, তোমার কষ্ট হয়নি তো?

কুন্তী ওদিকে স্টোভে গরম গরম লুচি-আলুবেগুন ভাজা আর ক্ষীরের ব্যবস্থা করছে। সন্দেশও রয়েছে, নরহরি বলে, 

—নতুন বউ, খাবার-দাবার সব আয়োজন করো—নিজেও উত্তমভাবে সেবা করবে। নাহলে পথের যা ধকল—যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো—আতান্তরে পড়ব। 

কুন্তী বলে—হলে তো বেঁচে যাই! 

—কেন? নরহরি অবাক হয়। 

কুন্তী বলে পরিক্রমায় এসে গৌরাঙ্গের নাম-গান করতে করতে যদি প্রাণ যায়—তাহলে তো পরম ভাগ্য গো? 

কুন্তী ওই লোকটার দিকে চেয়ে হাসে যেন কিছুটা পরিহাস তরল স্বরে।—ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গোরু মরে। তুমিও আবার—নরহরি ভাবছে কথাটা। তিনবারের বেলায় বিয়ে করতেই বহু ঝকমারিতে পড়েছিল, নেহাৎ টাকার জোরে পার পেয়েছে। এবার চতুর্থ বারে আর টাকা খরচা করলেও বউ মিলবে কি না সন্দেহ। মিললেও বহু টাকা খরচা হয়ে যাবে। টাকা তার প্রাণ, অযথা ওটা খরচা করতে সে চায় না। 

নরহরি তাই বলে—থাক আর ওসব কথা কেন! হ্যাঁ—লুচিগুলো একটু কড়া করে ভাজবে, আর পায়েসও করো। জয় গৌর! 

পরক্ষণেই তার দেহরক্ষীকে ধমকায়। 

—আঃ জোরে পা দুটো দাবা। হেঁটে হেঁটে টাটিয়ে গেছে, জোরে দাবা। আঃ— আরামটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে নরহরি। অল্প আলো পড়েছে কুন্তীর মুখে। তার কমনীয় মুখ, যৌবনমদির দেহের ওই নড়াচড়া নরহরির চিত্তে কেমন বৈকল্য আনে। 

নরহরি মনকে সংযত করতে চায়—তাই হুঙ্কার ছাড়ে, 

—জয় গৌর—জয় শচীনন্দন গৌরহরি। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *