পরাশর শীল – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

পরাশর শীল – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

।। এক।।

রাস্তাটা যে এত খারাপ বুঝতে পারেনি বিরূপাক্ষ সেন।

অবিশ্যি কিছুটা অনুমান যে করতে পারেনি তা নয়। কাঁচা মাটির পথ—বিশেষ করে যেখান থেকে শুরু হয়েছে—মেটাল বাঁধানো সড়কের পরেই—

একে বর্ষাকাল—তার উপর গরুর গাড়ি ও লরি চলে চলে রাস্তাটা সত্যিই অগম্য হয়ে উঠেছে। এখানে—ওখানে খানা—খোদল—কোথাও বড় বড় পাথর, ইট—জিপটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে এগুচ্ছিল। সামনে বসেছিল বিরূপাক্ষ সেন ও ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের রথীন ঘোষদস্তিদার—

যে লোকটা ওদের সাথে ছিল—জনার্দন সামন্ত—সে অবিশ্যি বলেছিল ঘোষদস্তিদারকে, রাস্তাটা কিন্তু ভালো নয় স্যার—তা ছাড়া পথটা একেবারে কমও নয়—

ঘোষদস্তিদার সে কথায় কান দেয়নি।

বিশেষ করে যেতে যখন তাকে হবেই এবং চাকরিটা যখন পুলিশের এবং বিরূপাক্ষর সঙ্গেই যেতে হবে। খোদ বড়কর্তার হুকুম। দু’দিন আগে ওই জায়গায় প্রবল বর্ষণ হয়ে গিয়েছে—একনাগাড়ে তিনটে দিন—তিন রাত্রি সর্বক্ষণই বলতে গেলে প্রায়।

জনার্দন—ঘোষদস্তিদার ডাকলো।

স্যার—জনার্দন তাকালো সামনে ড্রাইভারের পাশে উপবিষ্ট পুলিশ অফিসার ঘোষদস্তিদারের দিকে, কিছু বলছিলেন স্যার?

আর কতদূর হে তোমার মদনমোহনতলা!

প্রায় এসে গিয়েছি স্যার—জনার্দন বললে, আর বেশি দূর নয়—এইতো পৌঁছে যাবো এবারে। দেখুন না।

জনার্দন, তোমার খবরটা তো পাক্কা—

হ্যাঁ স্যার—আজ ‘নদের নিমাই’ পালায় সে নিমাই সাজছে—আর দলেরও ও—ই প্রধান অ্যাট্রাকশন। বায়না তো ওর নামেই হয়—নায়কের দলে ও না থাকলে বায়নাই করে না—মধ্যে মধ্যে যখন ডুব দেয় মাস দুই—তিনের জন্য—দলও বসে থাকে—কোনো বায়না হয় না।

আটদিন ধরে ঘোষদস্তিদার লোকটার পিছনে পিছনে ছুটছে—কিন্তু আজ পর্যন্ত ধরতে পারেনি। কতবার খবর পেয়ে কত জায়গায় ছুটেছে—কিন্তু পার্টিকে ধরতে পারেনি। বরাবর একাই গিয়েছে—এবার সঙ্গে বিরূপাক্ষ সেন।

কখন যে কোন ফাঁকে পালিয়ে যায় জানতেই পারেনি ঘোষদস্তিদার।

লোকটা সত্যিই যেন বহুরূপী।

ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়—বেশ বদলায়—কখনো পাঞ্জাবি, কখনো বিহারি, কখনো পুরোদস্তুর সাহেব, কখনো মাদ্রাজী, কখনো উড়িষ্যাবাসী। চার—পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে—এত সহজে বলে যেন কে বলবে ভাষাটা তার মাতৃভাষা নয়।

কথাটা অবিশ্যি নিজের অভিজ্ঞতা ও বিচার—বিবেচনা থেকেই বিরূপাক্ষ বলেছিল ঘোষদস্তিদারকে, অত সহজে লোকটাকে ধরা যাবে না মিঃ ঘোষদস্তিদার। ভালো করে সুলুক—সন্ধান নিয়ে অতর্কিতে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে—তবে যদি সে আমাদের ফাঁদে পড়ে। আর একটা কথা মনে রাখবেন—ওর চরেরা সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে—সর্বক্ষণ তারা সজাগ থাকে, পাছে ওর গতিবিধি সম্পর্কে কেউ কোনো সন্ধান পায়—কোনো অসতর্ক মুহূর্তে।

ঘোষদস্তিদার বলেছিল, তা আমি আর জানি না মিঃ সেন! কি হে জনার্দন—আর কতদূর! ঘোষদস্তিদার শুধায়।

ওই যে স্যার, প্যাণ্ডেলের আলো দেখা যাচ্ছে; দূরে চেয়ে দেখুন—জনার্দন বললে।

ঘোষদস্তিদার চেয়ে দেখলো সত্যিই দূরে একটা প্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে—আর একটা মৃদু কোলাহল বহু মানুষের।

এই সময়টায় এখানে সাতদিনের জন্য মেলা বসে—সেই উপলক্ষেই যাত্রা—জনার্দন বললে।

জিপটা এসে মেলার সামনে দাঁড়াল।

বহু লোক জমায়েৎ হয়েছে—অস্থায়ী দোকান পাট বসেছে। অজস্র পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে।

এই আমবাগানেই জিপটা থাকুক মিঃ ঘোষদস্তিদার—চলুন, জিপ থেকে নেমে বাকি পথটুকু আমরা পায়ে হেঁটেই যাবো। বিরূপাক্ষ জানাল।

হ্যাঁ স্যার, তাই চলুন—জনার্দন বলল।

বিরাট একটা আমবাগান—এখানে মেলার আলো এসে পৌঁছায়নি তাই বেশ অন্ধকার।

পাতার ওপরে জমে জমে থাকা বৃষ্টির জল টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে। ব্যাঙের ডাক মাঝে মাঝে শোনা যায় আর শোনা যায় একটানা ঝিঁঝিঁ ডাক।

সঙ্গে দু’জন আর্মড পুলিশ ছিল, তাদের জিপে প্রহরায় রেখে ওরা তিনজন—বিরূপাক্ষ, ঘোষদস্তিদার ও জনার্দন—ইনফরমার, ভেজা মাটির ওপরে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যায়—মিঃ ঘোষ দস্তিদারের হাতে একটা হানটিং টর্চ। মাঝে মাঝে আলো ফেলে ঘোষদস্তিদার।

গান বোধ করি যাত্রার আসর থেকে শোনা যাচ্ছে।

ক্রমশ গানের কলি আরও স্পষ্ট শোনা যায়—

 ক্ষমা করো বিষ্ণুপ্রিয়া—

 ঘর ছাড়ি চলিনু আমি

 ক্ষমা করো পতিরে তোমার—

আরো কিছুটা এগুতে গান ও সুর আরও স্পষ্ট হল।

নিমাই বোধ করি গৃহ ছেড়ে চলল—ঘুমন্ত বিষ্ণুপ্রিয়াকে ফেলে।

বিরাট প্যান্ডেল—দশ বারোটা পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে; মধ্যখানে যাত্রার আসর—চারিদিকে দর্শক গিস গিস করছে—মাঝে দাঁড়িয়ে নিমাই—গান গাইছে—

বেশ লম্বা চেহারা লোকটার—ধবধবে গায়ের রং। মাথায় বাবরি চুল, পরনে ধুতি, গায়ে চাদর—

স্যার—

ফিসফিস করে ডাকল জনার্দন।

ওই নাকি?

হ্যাঁ স্যার—ওই পরাশর শীল।

ভারি সুন্দর গানের গলা, ঘোষদস্তিদার বলে।

হ্যাঁ স্যার—যাকে বলে মধু গলা—নচেৎ বুঝতে পারছেন না স্যার—ওর ওই অভিনয় দেখতে দূর দূর থেকে লোকেরা এসে ভিড় করে।

বিরূপাক্ষ দেখছিল মানুষটাকে—মাথায় বাবরি চুল, হয়তো পরচুলা। নিমাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করছে বলেই হয়ত ওই পরচুলা মাথায় পরেছে। নাকটা একটু ভোঁতা, বাঁ গালে থুতনির নীচে দেখা যাচ্ছে একটা বড় তিল—

ওই তিলটাই লোকটার আইডেনটিটি মার্ক—সব ফটোতেই ওই তিলটা নজরে পড়ে।

বিভিন্ন বেশের ফটো পুলিশের দপ্তরে আছে লোকটার।

এবং অনেক নামও আছে পুলিশের কনফিডেনশিয়াল খাতায়। ইসমাইল খান—রঘুনাথ পাণ্ডে—বলবিন্দর সিং—কমলেশ্বর মহাপাত্র—কেবল পরাশর শীল নাম ছিল না।

দিন পনেরো আগে ইনফরমার জনার্দন সমস্ত সংবাদটা এনেছিল লালবাজারে।

সংবাদ পেয়েই ছুটে গিয়েছিল বিরূপাক্ষ।

বেঁটে খাটো কালো মিশমিশে গারে রং—মুখ ভর্তি কাঁচা—পাকা ছোট ছোট দাড়ি, ছোট ছোট কদমছাঁট মাথার চুল।

পরনে একটা প্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট।

পায়ে চপ্পল।

জনার্দন বলছিল, পুলিশ থেকে একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে—আমি জানি হুজুর সে—ই।

ডি.সি চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পুলিশ তো আসল ক্রিমিন্যালকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে—কার কথা তুমি বলছো—

পরাশর শীল—

ওই নাম তো মনে পড়ছে না। পুলিশের খাতায় আছে—

জানি স্যার—তাকে আজ পর্যন্ত আপনারা ধরতে পারেননি—কোনোদিন পারবেন না—তবে আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি যদি তাকে ধরতে চান।

মনে হচ্ছে লোকটা তোমার শত্রু?

অতবড় শত্রু জীবনে আমার নেই।

।। দুই।।

ডি.সি. চক্রবর্তীর কেমন যেন কৌতূহল হল—তিনি বাঘা বাঘা ক্রিমিন্যালদের ফটোর অ্যালবামটা আনালেন—জনার্দনকে অ্যালবামটা দিয়ে বললেন, দেখ তো, এর মধ্যে তোমার পরাশর শীল আছে কিনা।

অ্যালবামের কয়েকটা ছবি দেখে জনার্দন বললে, এরা সব একই ব্যক্তি স্যার—দেখুন ভালো করে, এই ইসমাইল খান, রঘুনাথ পাণ্ডে, বলবিন্দর সিং, কমলেশ্বর মহাপাত্র এবং পরাশর শীল। সবই এক ব্যক্তি। পরাশর শীলই ওর আসল নাম—অন্য নামগুলো ভুয়ো।

ডি.সি ও বিরূপাক্ষ মিলিয়ে দেখলো—সত্যি, সব চেহারার মধ্যেই একটা মিল আছে—একটু নজর করে দেখলেই বোঝা যায় থুতনির নীচে বাঁ গালে একটা তিল প্রত্যেকেরই।

শুধু ওই তিলই নয় স্যার—ওর বাঁ হাতে ডবল কড়ে আঙুল আছে—যেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। বেশির ভাগ সময়েই ও হাতে দস্তানা ব্যবহার করে ওই জন্যই—রবারের দস্তানা—চামড়ার সঙ্গে একেবারে মিশে যায়—দস্তানাটা হাতে আছে বোঝাই যায় না। আর তাই চোরাকারবারিরা সেটা জানতে পারে না।

বিরূপাক্ষ মন দিয়ে জনার্দনের কথাগুলো শুনছিল।

জনার্দন—বিরূপাক্ষ ডাকল।

বলুন স্যার—

মনে হচ্ছে লোকটা সত্যি তোমার এক বড় শত্রু!

হ্যাঁ স্যার—আমি ওকে শেষ করে দেবো প্রতিজ্ঞা করেছি।

কেন বলতো—হঠাৎ লোকটা তোমার এমন শত্রু হয়ে উঠলো কেন?

আমি তো এক সময় ওই জগন্নাথ অপেরায় চাকরি—মানে অভিনয় করতাম—আমার পরিবার বেলাও করতো। আমার পরিবারকে ও ছিনিয়ে নিয়েছে।

কবে?

আমি একটা নিরেট বোকা—অনেকদিন বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা।—বুঝতে পারিনি আড়ালে—আবডালে ওদের প্রেমের খেলা চলছে—বুঝতে যখন পারলাম অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে—ওকে প্রথমে শাসালাম।

কাকে?

পরাশরকে—কিন্তু ও আমাকে লাথি মেরে বের করে দিল বেলার সামনেই।

বল কি হে জনার্দন—তবু তুমি সেই স্ত্রীকে—

না—তাকে আর ফিরে পেতে চাই না—তবে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি একেবারে পরাশরকে শেষ করে দেবো—ও জানে না যে ওর সব কাহিনি আমি জানি! যাত্রার দলে চাকরি করা তো ওর পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া মাত্র।

তাই নাকি!

হ্যাঁ স্যার! আসলে এক নম্বরের চোরাকারবারি লোকটা—সবই আমি জানতাম—কিন্তু কিছু বলিনি।

কেন? ভাগ আছে বলে? ডি.সি. চক্রবর্তী বললেন।

না স্যার—তা নয়।

তবে কি?

ও—ই আমাকে যাত্রার দলে চাকরিটা দিয়েছিল—তখন বুঝিনি বেলাকে হাত করতে সুবিধা হবে বলেই আমাকে চাকরি দিয়েছিল।

তারপর বল।

তবে মিথ্যা বলব না স্যার—মাঝে মাঝে যে আমাকে ও কিছু দিত না, তাও নয়।

হাত পেতে তা নিতে?

নিতাম বৈকি। কারণ তখনো বুঝিনি সেটা আমাকে ঘুষ দেওয়া। আর এও তখন জানতাম না—পরাশরের চোরা—কারবার আছে।

কবে জানতে পারলে সেটা—

ও যেদিন যাত্রার দলটা কিনে নিলো অনেক টাকা দিয়ে গণেশ ভাণ্ডারীর কাছ থেকে—তখনই প্রথম মনে হয়েছিল এত টাকা পরাশর পেলো কোথায়। মাত্র তো এক হাজার টাকা মাইনেয় যাত্রার দলে চাকরি করে। বেলাই তখন এক রাত্রে কথাটা আমাকে বলে। ওর অনেক টাকা। যাত্রায় অভিনয় করাই ওর একমাত্র উপায়ের পথ নয়। নানা ধরনের ওর ব্যবসা আছে—যাত্রায় মোটে হাজার টাকা কামায় ও। আমি গোপনে খোঁজ নিতে নিতে জানলাম—লোকটা একটা চোরাকারবারি। ওর অনেক নাম। নানা নামে ওকে চেনে ওর চোরাকারবারের ব্যবসায়ীরা। ও যেদিন লাথি মেরে আমাকে বেলার সামনে ঘর থেকে বের করে দিলো, অপমানে মাথা নীচু করে বের হয়ে এলাম। ভাবতে লাগলাম কিভাবে ওই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া যায়। অবশেষে ভেবে ভেবে আপনার কাছে এসেছি স্যার।

ভালো করেছ।

জানি—কারণ ওকে আপনারা না ধরতে পারলে প্রতিশোধ আমার নেওয়া হবে না।

কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখেছ জনার্দন—

জানি স্যার, আপনি তো বলবেন ও আরো ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে—আমাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে।

না—তা পরাশর পারবে না। তুমি পুলিশের পুরো প্রোটেকশন পাবে।

জনার্দন হাসল। বলল, ওকে আপনারা জানেন না।

তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো জনার্দন। এখন বলো তোমার সংবাদ ঠিক তো! পাকা একেবারে?

হ্যাঁ স্যার। মদনমোহনতলায় জন্মাষ্টমীর মেলায় ওর দল গাইতে যাচ্ছে ‘নদের নিমাই’ পালা। ও নিমাই সাজবে। তারপর আমি খবর পেয়েছি যাত্রার শেষে ও সোজা ওর গাড়ি নিয়ে চলে যাবে দুর্গাপুর। খুব সম্ভবত সেখানে একটা লেনদেনের ব্যাপার আছে। ওর গাড়িটা কালো রঙের একটা পুরাতন মডেলের ফিয়েট গাড়ি। ডবলু বি সি দিয়ে নম্বর।

যেখানে যায় সেখানেই গাড়িতে যায় নাকি?

হ্যাঁ—নিজেই চালায় সেই গাড়ি। ড্রাইভিং—এ খুব এক্সপার্ট। হাত খুব স্টেডি। বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালায়। কিন্তু কখনো অ্যাক্সিডেন্ট করে না।

যাত্রা ভাঙবার পর ও দুর্গাপুরে যাবে বলছো?

হ্যাঁ—যাবে।

কি করে জানলে?

বেলাকে ও বলেছে পালা ভাঙবার পর দুর্গাপুরে যাবে। আবার পরের দিন সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসবে। কারণ পরের দিন অন্য একটা পালা গাইতে হবে।

একটা কথা জনার্দন। বেলার সঙ্গে তোমার এখন কি রকম সম্পর্ক?

বেলার কাছে এখনো আমি মধ্যে মধ্যে যাই। তবে পরাশর যখন না থাকে—খুব গোপনে যাই।

পালাটা বেশ জমে উঠেছে।

নিমাই গৃহত্যাগ করেছে। শচী মাতা ‘নিমাই’, ‘নিমাই’ করে বুক চাপড়ে কাঁদছেন।

জনার্দন—

স্যার—বিরূপাক্ষর ডাকে ওর দিকে তাকাল জনার্দন।

সাজঘরটা কোথায়?

আসুন স্যার আমার সঙ্গে—দেখিয়ে দিচ্ছি।

আসর থেকে বের হয়ে পড়ল জনার্দন। একটা দোতলা বাড়ির নীচের তলায় সাজঘরের ব্যবস্থা হয়েছিল।

বাড়িটা অনেক দিনের পুরানো। সামনের দিকে একটা আম—কাঁঠালের বাগান। পিছন দিকে একটা দিঘি। দিঘির পাড় দিয়ে আগাছার জঙ্গল ভেদ করে অন্ধকারে সন্তর্পণে আগে আগে জনার্দন ও পেছনে বিরূপাক্ষ এগোয়।

হঠাৎ জনার্দন থেমে গেল।

পেছন থেকে বিরূপাক্ষ প্রশ্ন করল, কি হল?

ওই দেখুন ভালো করে চেয়ে স্যার—ওই যে বাড়ির সামনে ওই গাছটার নীচে অন্ধকারে মোটামতো যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, ও হচ্ছে পরাশরের ডান হাত—

রঘুনাথ মণ্ডল। পরাশরের এক চর নিবারণ খবর এনেছে, লোকটা অন্তত দু’তিনটা খুন করেছে।

বিরূপাক্ষ জনার্দনের গা টিপে ইশারা করল এগুবার জন্য এবং ফিসফিস করে বলল, বেশি কথা বলো না।

কি বললেন স্যার?

ফিসফিস করে বিরূপাক্ষ বলল, সাজঘরের দিকে চল।

ওরা আবার এগোয়। বিরূপাক্ষ সেন ও জনার্দন।

বাড়িটা পুরাতন হলেও এখনো ব্যবহারযোগ্য।

একটা লম্বা টানা দরদালান—গোটাতিনেক সিঁড়ির পরেই দরদালানটা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই ওদের চোখে পড়ল জানলার পাশে দরদালানের আলো এসে পড়েছে।

সেইদিকেই এগিয়ে গেল বিরূপাক্ষ ও জনার্দন, জনার্দনেরই ইশারায়। সন্তর্পণে জানালা—পথে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো সাতাশ—আটাশ বৎসরের একটি স্ত্রীলোক— পরনে শাড়ি—মাথার চুল এলো করা।

স্ত্রীলোকটিকে দেখে বিরূপাক্ষর চিনতে কষ্ট হয় না। বিষ্ণুপ্রিয়ার সাজে সজ্জিতা জনার্দনের স্ত্রী বেলাকে। আয়নার সামনে একটা হাতল—ভাঙা চেয়ারে বসে বেলা—নিজের মেকআপ নিচ্ছিল।

নিমাইবেশী পরাশর শীল ঘরে প্রবেশ করল পিছন থেকে।

কে! ফিরে তাকাল বেলা পদশব্দ পেয়েই বোধহয়—বিরূপাক্ষর মনে হল।

বেলা—আমি—

তোমার তো এখুনি সিন। আসবে? বেলা বলল।

হ্যাঁ।

আমি আজ একটু রাত করে বেরুবো। প্রথমে যাবো কলকাতায়! তারপর সেখান থেকে রাত দুটো নাগাদ বেরুবো।

এখান থেকে তাহলে সোজা দুর্গাপুর যাচ্ছো না?

না।

মনে হচ্ছে আরো কিছু বলবে?

জনার্দনের সঙ্গে কতদিন তোমার দেখা হয় না?

দিন তিনেক আগেও তো হয়েছিল।

মানে গত বৃহস্পতিবার?

হ্যাঁ।

এর মধ্যে আর হয়নি?

না। কেন বলো তো?

আবার তার বোধ হয় পুরানো রোগটা মাথা চাড়া দিয়েছে।

কি বলছো তুমি—আমাদের মধ্যে তো একটা বোঝাপড়া হয়েই গিয়েছে।

তোমার দিক থেকে হলেও তার দিক থেকে হয়নি।

না—না—

মণ্ডল এসেছিল একটু আগে—

।। তিন।।

মণ্ডল মানে সেই শয়তান চরটা তোমার—

শয়তান ও নয়—শয়তান যদি কেউ থাকে তো তোমার স্বামী জনার্দন। পিপীলিকার পাখনা গজিয়েছে—

পরাশরের কথাটা ঠিক বুঝতে পারে না বেলা। সে পরাশরের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলে, ও কিন্তু সত্যিই খুব নিরীহ।

নিরীহই বটে। জানো সে লালবাজারে গিয়েছিল।

লালবাজারে! কী বলছো তুমি?

আমি খবর পেয়েছি। তুমি বরং এখন তোমাদের বেলগাছিয়ার বাড়িতে যাও। কাল সকালে আবার আমার মদন মিত্তির লেনের বাড়িতে এসো।

কেন?

ওর কাছ থেকে কিছু বের করতে পারো কিনা দেখো। ও তো এখনো তোমাকে পেলে পাগল হয়ে যায়—তা ছাড়া আসার দিন তো তোমায় পায়নি।

আমার যেন কেমন গা ঘিন ঘিন করে ওর কথা ভাবলেই—

ঘিন ঘিন ছেড়ে বমি হলেও তোমাকে যেতে হবে, বেলা। প্রয়োজনটা তোমার নয়, প্রয়োজনটা আমার।

বেশ, বলছো যখন যাবো। তবে—

তবে আবার কি? একসময় তো ওর সঙ্গে রাতের পর রাত কাটিয়েছো।

পরাশর—

তোমরা মেয়েছেলেরা কত নেকামিই না জানো—

পরাশর—

যাক, আমি যা বললাম, তাই করবে। কথাগুলো বলে পরাশর শীল আর দাঁড়ায় না; সাজঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিন্তু পরাশর বুঝল না যে, সে তার নিজের কত বড় ক্ষতি করল।

বেলা চুপচাপ চেয়ারটার উপরে বসেছিল। সে ভাবছিল পরাশর আজ প্রকারান্তরে তাকে এই মুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে পরাশরের একজন রক্ষিতা ছাড়া সে আর কিছু নয়। পরাশর তার রক্ষিতাকে যা বলেছে, তাকে তাই করতে হবে। এইজন্যই সে জনার্দনের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল?

বেলার চোখ ফেটে জল আসে।

বিরূপাক্ষ ওদের সব কথাই জানালার ওপাশ থেকে শুনতে পেয়েছিল। দুটো ব্যাপার সে বুঝতে পেরেছিল—জনার্দনের গতিবিধি সম্পর্কে পরাশর তীক্ষ্ন নজর রেখেছে। তার চরেরা জনার্দনের গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। পরাশর শীল সম্পর্কে বিরূপাক্ষর ধারণা, লোকটা অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক। পরাশর সম্পর্কে তার অনুমান নিৰ্ভুল।

জনার্দনও কথাগুলো শুনতে পেয়েছিল। আজ রাত্রে বেলাকে আবার সে পাবে ভেবে পুলকিত হয়। অনেকদিন সে বেলাকে একান্তে পায়নি।

স্যার—

জনার্দনের নীচু স্বরের ডাকে বিরূপাক্ষ ওর দিকে ফিরে তাকায়।

আমি কি এখন যেতে পারি?

যেতে পারি মানে? কোথায় যাবে?

স্যার—আমার কাজ তো হয়ে গিয়েছে—পরাশরকে তো চিনিয়ে দিয়েছি—এবারে তাহলে আমাকে ছেড়ে দিন।

চলে যাবে?

হ্যাঁ স্যার—যদি অনুমতি করেন—

কোথায় যাবে—বাড়ি?

হ্যাঁ স্যার।

যেতে হয় বাড়িতে তোমার পরে যেও—আজ রাতে নয়।

কেন—কেন স্যার?

সেখানে তোমার আজ রাতে মৃত্যুফাঁদ পাতা হয়েছে।

না, না—কি বলছেন স্যার।

হ্যাঁ—পরাশরকে তুমি চেনো—আমার চাইতে ঢের বেশি—শুনলে না একটু আগে পরাশরের মুখেই তুমি যে লালবাজারে গিয়েছিলে তা সে জানতে পেরেছে। আর যাতে তুমি সেখানে কখনো না যেতে পারো তারই ব্যবস্থা করলো পরাশর আজ রাত্রে—বেলা যদি তোমার কাছে ফিরে আসতে চায় বেলাকে তুমি পাবে।

পাবো?

হ্যাঁ পাবে—চল এখন।

কোথায়?

পরাশরের গাড়িটা যেখানে আছে সেখানে।

।। চার।।

পরাশরের গাড়ি?

হ্যাঁ।

সেটা তো আম বাগানেই আছে—আসার সময় দেখলেন না স্যার একটা পুরানো মডেলের কালো রংয়ের ফিয়াট গাড়ি—সেটাই পরাশরের গাড়ি।

চল তবে—ওখানে গিয়েই আমরা অপেক্ষা করবো—এসো।

ঘোষদস্তিদার তখনো গাড়িটার সামনে একটা গাছের নীচে অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল—ওদের আসতে দেখে বলল—কি হল মিঃ সেন?

পরাশর আজ রাত দুটোয় দুর্গাপুরের দিকে রওনা হবে—ওর মদন মিত্র লেনের ডেরা থেকে।

পালা শেষ হবার পর তাহলে বেরুচ্ছে না?

না—ও এখান থেকে ওর মদন মিত্র লেনের বাড়িতে যাবে।

বাড়িটা চেনেন?

না—এই জনার্দন দেখিয়ে দেবে।

বাড়িটার উপরে কি ওয়াচ রাখতে হবে?

সেটাই আপাতত আমাদের প্রথম কাজ নয়—আমরা একটু পরে সোজা যাবো বেলার, মানে জনার্দনের বেলগাছিয়ার বাড়িতে।

হঠাৎ সেখানে কেন? পরাশর সেখানে যাবে নাকি?

যদিও সে বলেছে—সে আজ রাতে মদন মিত্র লেনের বাড়িতে থাকবে—কিন্তু আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো—সে মদন মিত্র লেনের বাড়িতে যাবে না। যাবে বেলার বাড়িতে বেলগাছিয়ায়।

কি করে বুঝলেন মিঃ সেন?

বিরূপাক্ষ সেন সংক্ষেপে আড়াল থেকে বেলা ও পরাশরের যেসব কথাবার্তা শুনেছিল বলে গেল।

কিন্তু মিঃ সেন—

আমার মনে হয় পরাশর জনার্দনকে শেষ করার চেষ্টা করবে—চিরদিনের জন্য ওর মুখটা বন্ধ করবে।

জনার্দনকে যদি সত্যি সত্যিই মেরে ফেলে পরাশর?

তাতে কারো আশ্চর্য হবার কিছু নেই—তাই আমরা সেখানে উপস্থিত থাকতে চাই।

জনার্দন এতক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে একপাশে ওদের কথা শুনছিল। এবারে বললে, আমি তাহলে সেখানে যাবো না স্যার।

বিরূপাক্ষ বললে, ভয় নেই তোমার—বাড়িটার চারপাশে পুলিশ থাকবে। তুমি নিশ্চিন্তে চলে যাও তোমার বেলগাছিয়ার বাড়িতে।

চলে যাবো বলছেন।

হ্যাঁ—চলে যাও।

বিরূপাক্ষর আশ্বাস পেয়েও জনার্দনের কিন্তু ভয় যায় না। পরাশর শীলকে সে খুব ভালো করেই চেনে। পরাশর যদি আজ তাকে শেষ করে দেবে স্থির করেই থাকে, সাধ্য নেই কারো তাকে তার হাত থেকে রক্ষা করে। আশংকায় বুকের ভিতরটা কাঁপতে থাকে জনার্দনের। মুখে কিছু আর প্রতিবাদ জানায় না।

জনার্দন—

বলুন স্যার।

বেলার সঙ্গে তুমিও আজ এখানে দেখা করোনি?

না।

যাও, বেলার সঙ্গে গিয়ে দেখা করো।

এখানে—মানে এখানেই দেখা করবো?

হ্যাঁ—করবে বৈকি! যাও।

কিন্তু স্যার—

ভয় নেই তোমার—পরাশর এত মানুষের মাঝখান থেকে তোমাকে কিছু বলবে না। তা ছাড়া ও তো তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছে আজ রাতে যেতে বলেছেই।

বেলাকে নিয়ে আমার বেলগাছিয়ার বাসায়ই তো যাব স্যার?

যাবে।

জনার্দন চলে গেল বটে তবে বিরূপাক্ষ বুঝতে পারে যেন জনার্দনের যাবার খুব একটা উৎসাহ নেই। জনার্দন পায়ে পায়ে সাজঘরের দিকে এগোয়।

পালার শেষ দৃশ্য তখনও আসরে অভিনীত হচ্ছে।

নিমাই সন্ন্যাস নিয়েছে—ঈশ্বরপুরীর কাছ থেকে তার নতুন নামকরণ হয়েছে—শ্রীচৈতন্য। মুণ্ডিত মস্তক, পরনে গেরুয়া বসন—হাতে দণ্ড ও কমণ্ডলু।

নবীন সন্ন্যাসী।

চলেছে নবীন সন্ন্যাসী পুরীধামের পথে—মুখে একটিমাত্র শব্দ, কৃষ্ণ পাহি মাম।

হাজারো দর্শকের দু’চোখে অশ্রুর ধারা।

হা কৃষ্ণ—কোথা কৃষ্ণ!

বেলা মুখের প্রসাধন তুলছিল ক্রিমের সাহায্যে, চোরের মতোই পা টিপে টিপে সন্তর্পণে সাজঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল জনার্দন।

বেলা—

কে? চমকে মুখ ঘুরিয়ে পশ্চাতে তাকাল বেলা—একি তুমি!

বেলা—

এ সময় হঠাৎ তুমি কোথা থেকে?

কলকাতা থেকে আসছি।

পরাশর তোমাকে দেখেনি তো?

না। সে জানে না আমি এসেছি।

এক মুহূর্ত আর এখানে থেকো না। এক্ষুনি চলে যাও। হুট করে পরাশর হয়ত এসে পড়বে। সোজা তুমি বেলগাছিয়ার আমাদের বাসায় চলে যাও। এখান থেকে সোজা আমি সেখানে যাবো।

সত্যি বলছো?

হ্যাঁ—যাও—আর দেরি করো না।

জনার্দন ঘর থেকে বের হয়ে গেল। পরাশরের মুখোমুখি সে পড়তে চায় না। রেলস্টেশন এখান থেকে বেশ দূরে। রাত সাড়ে দশটার ট্রেনটা তাকে ধরতে হবে।

।। পাঁচ।।

যাত্রার আসর ভেঙে গেছে।

আসরের ভিড় পাতলা হয়ে আসছে। পরাশর নিজের সাজঘরে আয়নার সামনে বসে। তার অনুচর মণ্ডল এসে পিছনে দাঁড়াল। আয়নায় তার চেহারাটা প্রতিফলিত হয়।

পরাশর ঘুরে তাকাল, কি খবর রে?

বাগানে পুলিশ দেখে এলাম।

পুলিশ!

হ্যাঁ—আমার মনে হচ্ছে—

কি?

তোমাকে ধরবার জন্যই ওরা এখানে এসেছে।

কখন জানতে পারলি?

তোমার কাছে আসছিলাম। দেখি পুলিশের একটা জিপ। দু—তিনজন লোক আছে।

আমার গাড়িটা কোথায়?

দিঘির ধারে বকুল গাছটার তলায়।

ঠিক আছে। তোকে যা বলেছি, মনে আছে তো?

হ্যাঁ।

জনার্দনকে আজ রাতেই বেলার ওখানে খতম করে দিবি।

আর বেলার কি ব্যবস্থা হবে?

তোরা লাশটা নিয়ে সোজা চলে যাবি রেলওয়ে ইয়ার্ডের মাঠে। সেখানে লাশটা লাইনের ওপর শুইয়ে রেখে চলে আসবি—বুঝেছিস?

হ্যাঁ। কিন্তু বেলা—বেলার কী ব্যবস্থা হবে?

বেলার ব্যবস্থা আমি করব। তার জন্য মাথা ঘামাতে হবে না। দলের সকলের ফিরে যাবার ট্রাকটা এসেছে?

হ্যাঁ।

মণ্ডল চলে যেতেই পরাশর চটপট উঠে পড়ল। জামাটা গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে পড়ল। সোজা এলো বেলার ঘরে। বেলা ঘরে ছিল না।

টপ স্পিডে গাড়ি চালিয়ে পরাশরের কলকাতায় পৌঁছোতে রাত বারোটা বেজে গেল। সোজা সে বেলগাছিয়ায় আসে।

নিশুতি রাত। যানবাহন অনেকটা কমে গেছে। পথে তেমন মানুষজন নেই।

বেলগাছিয়ায় নিজের বাড়ির সামনে রিকশা করে পৌঁছে বেলা দেখল তার দোতলার ঘরে আলো জ্বলছে। বেলা বুঝতে পারে জনার্দন আগেই পৌঁছে গিয়েছে। বেলা রিকশা থেকে নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে দিলো।

ট্রাকটা বেলাকে ব্রিজের সামনেই নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

কলিং বেল বাজালো বেলা।

কি জানি কেন, বেলা মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি বোধ করছিল। আজ হঠাৎ বেলাকে পরাশর জনার্দনের সঙ্গে রাত কাটাতে বলল কেন?

ইদানীং পরাশর কখনো বেলাকে জনার্দনের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। পরাশরের অবর্তমানে লুকিয়ে—চুরিয়ে মাঝে মাঝে জনার্দন তার কাছে গেছে।

হঠাৎ আজ এভাবে পরাশর কেন তাকে পাঠালো জনার্দনের কাছে?

জনার্দনের কাছ থেকে কথা বের করে নেবার জন্য পরাশর তাকে এখানে আসতে বলেছে, কথাটা বেলার বিশ্বাস হয়নি তখন।

জনার্দন যদি পুলিশের দলে ভিড়েই থাকে—সে কথা সে বেলাকে নিশ্চয় বলবে না। কারণ তাদের দুজনের মধ্যে আগেকারের সেই মধুর সম্পর্ক আর নেই।

জনার্দনকে সে সহজে ভুলতে পারবে না।

কিন্তু এও বুঝতে পারে না জনার্দন হঠাৎ পুলিশকে পরাশরের কথা বলতে গেল কোন দুঃসাহসে! সে কি পরাশর শীলকে চেনেনি?

সাপের চেয়েও খল, নেকড়ের চাইতেও হিংস্র ওই পরাশর শীল লোকটা। ওর অসাধ্য কিছু নেই।

কলিং বেলটা বাজতেই দরজাটা খুলে গেল।

প্যাসেজটা অন্ধকার।

বেলা অন্ধকারে ঠাহর করতে পারল না কে দরজাটা খুলে দিলো। প্যাসেজের আলোটা জ্বালাবার কথাও মনে হলো না বেলার। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায়।

ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল।

ঘরের মধ্যে আলোটা জ্বলছিল।

ঘরের মধ্যে ঢুকে থমকে দাঁড়াল বেলা—জনার্দনের দেহটা ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। মেঝেতে রক্তের স্রোত আর দু’জন লোক সামনে তার দাঁড়িয়ে। আর তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে পরাশর।

একটা অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে বেলা।

সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে কে যেন দুটো বলিষ্ঠ হাতে বেলার মুখটা চেপে ধরে।

সিঁড়িতে ওই সময় পায়ের শব্দ শোনা যায়—দ্রুত পায়ের শব্দ।

একটা লোক হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঘরে ঢুকল—তার হাতে একটা ছোট চামড়ার অ্যাটাচি কেস।

পুলিশ—লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

পরাশর তখন অন্য দুজন লোককে বলল, শোন, তোদের যা বলেছি তাই করবি। যা তাড়াতাড়ি, পিছনের সিঁড়ি দিয়ে চলে যা।

বেলা গোঁ গোঁ করছে তার মুখে হাত চাপা দেওয়ায়।

কিন্তু লোক দুটো পালাবার সময় পেল না।

বিরূপাক্ষ সেন ও ঘোষদস্তিদার এসে সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল।

ঘোষদস্তিদারের হাতে পিস্তল।

ডোন্ট ট্রাই টু মুভ পরাশর, ঘোষদস্তিদার বলল, ইয়োর গেম ইজ আপ!

ঘোষদস্তিদারের কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা সামারসল্ট খেয়ে ডান পায়ের লাথি দিয়ে তার হাতের পিস্তলটা পরাশর ছিটকে ফেলে দিলো। পরমুহূর্তেই বিদ্যুৎগতিতে দরজা দিয়ে বের হয়ে এসে বাইরে থেকে দরজার শেকল তুলে দিলো এবং পিস্তলের গুলি ছুড়তে ছুড়তে—

সঙ্গে সঙ্গে ঘোষদস্তিদার ও বিরূপাক্ষ সেন তার পেছনে ছোটে। কিন্তু বাইরে থেকে দরজার শেকল তোলা থাকায় দরজা খুলতে পারে না।

পরাশর সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সোজা নিজের গাড়িতে উঠে চাবি ঘুরিয়ে গাড়িটা চালিয়ে দেয়।

পুলিশের জিপটা একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। তারা ব্যাপারটা সম্যক বুঝে উঠবার আগেই পরাশরের কালো রঙের ফিয়াটটা সাঁ করে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

বেলা এতক্ষণ থতমত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জনার্দনের মৃতদেহটা চোখের সামনে দেখেই বেলা বুঝতে পেরেছিল পরাশর জনার্দনকে খুন করবার জন্যই—এবং তার চোখের সামনেই—আজ রাত্রের প্ল্যানটা করেছিল। বেলা ভাবতে পারেনি পরাশর লোকটা এত বড় শয়তান। এমনি নিষ্ঠুরভাবে জনার্দনকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করবে।

বিরূপাক্ষ সেন ও ঘোষ দস্তিদার তখনো ভিতর থেকে দরজাটা খুলবার চেষ্টা করছে।

বেলা বলল, অফিসার, আমি পাশের ঘর দিয়ে বাইরে গিয়ে দরজার শেকল খুলে দিচ্ছি।

বেলা মধ্যবর্তী দরজাপথ ধরে পাশের ঘরে চলে গেল। এবং একটু পরে শেকল খুলে ওদের মুক্ত করে দিলো।

ঘোষদস্তিদার বাইরে যাচ্ছিলো, বাধা দিলো বেলা, দাঁড়ান অফিসার। পরাশর পালিয়েছে। ওকে ধরতে পারবেন না।

বিরূপাক্ষ বলল, ও তো দুর্গাপুরে যাবে।

না, দুর্গাপুরে গেলেও আজ অন্তত যাবে না সেখানে।

যাবে না?

না। কিন্তু তাতে ঘাবড়াবেন না। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। ও যাতে ধরা পড়ে, সে ব্যবস্থা আমিই করব।

কিন্তু কেমন করে?

পরাশর আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। আজ কাল বা পরশুই হোক, আসবেই। আমি সময়মতো আপনাদের জানাব।

জানাবে?

নিশ্চয়। ও আমার স্বামীকে খুন করেছে। ওকে সহজে আমি নিষ্কৃতি দেবো না। বেলা বলল।

কথাটা মিথ্যা বলেনি বেলা। জনার্দনকে সত্যিই ভালোবাসত বেলা। পরাশরের হাতে খুব সহজে নিজেকে ধার দেয়নি বেলা। সে জানত না, তাকে দেখা অবধি তার ওপরে পরাশরের লোভ জন্মেছিল। সেটা যে বেলা স্ত্রীলোক হয়ে বুঝতে পারেনি, তা নয়। পুরুষের দৃষ্টিকে চিনতে অন্তত একজন স্ত্রীলোক ভুল করে না। সেজন্য বেলা সর্বদা সতর্ক থাকত।

আগে পরাশর অন্য একটা দলে ছিল। বেলার আকর্ষণেই সে এসে ওদের যাত্রার দলে ভিড়েছিল। তারপর বেলাকে পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বেলা ধরা দেয়নি।

অবশেষে অনেক টাকা ঢেলে পরাশর দলটাকে কিনে নেয়।

দলটাকে কিনে নিতে তার অসুবিধা হয়নি।

চোরাকারবারের অনেক টাকা হাতে আসত তার। সেই টাকা ঢেলে দলের মালিককে সে কিনে নিয়েছিল।

জনার্দন দলে ছোটখাটো পার্ট করত। বিশেষ করে কমিক রোলে। কিন্তু বেলা ছিল দলের মক্ষিরানি—নায়িকা।

বস্তুত বেলার জন্য জনার্দনের চাকরি।

গোবেচারা টাইপের সাদামাটা মানুষ জনার্দন।

দল কিনবার পরেই জনার্দনকে তাড়াবার জন্য পরাশর উঠে পড়ে লাগে। এবং শেষ পর্যন্ত টাকার লোভ দেখিয়ে জনার্দনকে হাতের মুঠোর মধ্যে আনে।

জনার্দন প্রথমে বুঝতে পারেনি পরাশরের আসল মতলবটা। কিন্তু যখন বুঝতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তারপর জনার্দনের অনুপস্থিতিতে পরাশর এক রাতে বেলার শয়নঘরে ঢুকে জোর করে বেলাকে অধিকার করে।

প্রথম প্রথম পরাশর জনার্দনকে তার চোরাকারবারে টেনে নিতে শুরু করে—এবং যখন চোরাকারবারে বেশ লিপ্ত হয়ে উঠেছে—জনার্দনকে ভয় দেখায়—কারণ ইতিমধ্যে বেলার ব্যাপারটা জনার্দন জানতে পেরে গিয়েছে।

সরল গোবেচারা জনার্দন মুখ বুজে সব সহ্য করে চলত প্রাণের ভয়ে। বেলাকে জোর করে পরাশর অধিকার করলেও বেলা পরাশরকে কোনদিনই পছন্দ করত না। জনার্দনের অমঙ্গল আশঙ্কায় চুপ করে থাকত।

আজ জনার্দনকে খুন হতে দেখে বেলা মরিয়া হয়ে ওঠে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, জনার্দনের হত্যার প্রতিশোধ সে নেবে।

এক মাস বাদে পরাশর একদিন এলো।

বেলা তখনো তার বেলগাছিয়ার বাসায় আছে। বিরূপাক্ষের পরামর্শমতো বেলার বাড়ির ওপর নজর রাখছিল ঘোষদস্তিদারের লোকেরা।

পরাশর কিন্তু এসেছিল ছদ্মবেশে। কারণ সেও সতর্কতা অবলম্বন করেছিল।

বেলা নিজের ঘরে তখন একটা যাত্রার বই পড়ছিল।

পরাশর এসে ঘরে ঢুকল।

ধুতি—পাঞ্জাবি পরিহিত—হাতে একটা অ্যাটাচি কেস—চোখে দামি সোনার ফ্রেমে কালো কাচের চশমা। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।

বেলা একাই বাড়িতে ছিল। ঝিটাকে বাজারে পাঠিয়েছিল।

পরাশরকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বলে বেলা, কে?

তুমি—মানে আপনি আমাকে চিনবেন না। না—আমাকে তো কখনো আপনি দেখেননি।

কি জন্য এসেছেন?

একটা যাত্রার দল থেকে এসেছি আপনার সঙ্গে কনট্রাক্ট করার জন্য।

কোন দল?

সবই জানতে পারবেন।

আপনি এ বাড়িতে ঢুকলেন কি করে?

কেন সদর দরজা দিয়ে।

দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ ছিল।

বন্ধ দরজা কি খোলা যায় না?

যাবে না কেন—যায়—তবে সেটা বাইরের গা—তালার চাবি দিয়ে। শোন পরাশর, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি।

বেলা—

সদরের চাবি দুটোই—একটা জনার্দনের কাছে থাকত—অন্যটা আমার কাছে থাকত—কথাটা শেষ না করেই বেলা পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে লোডেড পিস্তলটা বের করে ফায়ার করল পরাশরকে লক্ষ করে।

পরাশরের কাঁধে গুলি লাগে। সে লাফ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সিঁড়ির দিকে ছোটে।

কিন্তু পালাতে পারে না; ঘোষদস্তিদারের লোকদের হাতে ধরা পড়ে। আগে থেকেই তারা ওৎ পেতে ছিল।

বেলা তখন ক্ষেপে উঠেছে। সে পরাশরের পেছন পেছন এসে আবারও তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়! পরপর তিনটি।

পরাশর ঢলে পড়ল রক্তাপ্লুত হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *