পরাশর বর্মা ও ভাঙা রেডিও – প্রেমেন্দ্র মিত্র

পরাশর বর্মা ও ভাঙা রেডিও – প্রেমেন্দ্র মিত্র

কেন যে এমন ভুল করেছিলেন।

এসে অবধি এই ক-দিন ধরেই আফসোস করছি।

এসেছি সেই শুক্রবার। আজ পরের শনিবার। এই আট দিনেই মন মেজাজ বিগড়ে গেছে। এখন যেন পালাতে পারলেও বাঁচি।

কিন্তু তার কি জো আছে?

পরাশরের খপ্পরে একবার পড়লে অনুনয় বিনয় চোখ রাঙানি— কিছুতেই কিছু ফল হবার নয়।

সেকি! এইতো সবে এলে— এই তার বুলি। এমন মজার দিন কাটানো ছেড়ে কেউ যে চলে যেতে চাইতে পারে, এ যেন তার বিশ্বাসই হয় না। বলে বোম্বাই শহর কি দু-দিনে দেখে সারা যায়।

বোম্বাই আমি ঢের দেখেছি।— একটু বিরক্তির সঙ্গেই আমি বলি হয়তো তোমার সঙ্গেই তো এই সেবছ র বোম্বাই চষে বেড়াতে হয়েছে সেই সাংঘাতিক শিশির ব্যাপারে। বোম্বাই— এ আর আমার দেখবার আছে কি!

আছে, আছে— পরাশর হেসে আশ্বাস দেয়, বোম্বাই নিত্যিনতুন। হররোজ এখানে নতুন খেল হচ্ছে। তা না হয়ে তোমায় ট্রাঙ্ককল করে আনাই! আর ক-টা দিন একটু মজা করো না, দুজনে একসঙ্গেই ফিরে যাব।

না—এবার শক্ত হয়ে বলি, তোমার সঙ্গে ফেরবার সৌভাগ্য আর আমার ভাঙা রেডিওর গান শুনেই যতদিন পারে কাটাও, আমি আজই রওনা হচ্ছি।

মুখে শাসালেও সেদিনই রওনা হওয়া সম্ভব হয়নি। পরাশরের পিড়াপিড়িতে রবিবারটা থেকে যেতে হয়েছে। সেআশ্বাস দিয়েছে, সোমবারের পর আর আমায় কিছুতেই ধরে রাখবে না।

সোমবার পর্যন্ত কি সুখে যে সেথাকতে চাচ্ছে তা আমার বোঝার ক্ষমতা নেই। ওর ভাঙা রেডিওটা অবশ্য সেদিন ফেরত আনবার কথা মেরামতের দোকান থেকে। দিয়েছে আজ— মাত্র শনিবার দুপুরে। রবিবার ছুটির দিন বাদ দিয়ে সোমবার তা যে ফেরত পাওয়া অসম্ভব, তা তাকে বৃথাই বোঝাবার চেষ্টা করেছি। কি ক্যামেরার মতো যন্ত্রপাতি যে একবার মেরামতের জন্য গেলে তার তেরো মাসে বছর হয়ে দাঁড়ায়, সেঅভিজ্ঞতা বোধহয় পরাশরের নেই।

আর ওই অখাদ্য ভাঙা রেডিও কি একদিনে সারাবার।

এসে অবধি সবচেয়ে জ্বালাতন করে মেরেছে ওইটেই। মেরামতের জন্য না দিয়ে ওটাকে কোলাবার ‘কজওয়ে’ থেকে সমুদ্রের জলে ফেলে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম।

বোম্বে পৌঁছোবার পর প্রথম হোটেলে ঢুকে পরাশরের আঠারো নম্বর ঘরের সামনের করিডরে গিয়ে দাঁড়ানোর পর থেকেই ওই রেডিওতে কান ঝালাপালা।

ওইটাই যে পরাশরের কামরা বিশ্বাস করতেই পারিনি। সঙ্গে হোটেলের খানসামা এসেছিল, সেঘরটা দেখিয়েই চলে গেছে।

ভুল করেছি কিনা বুঝতে না পেরে দোমনা হয়ে দরজায় মৃদু করাঘাত করেছি প্রথমে। তাতে কোনো ফল হয়নি। না হবারই কথা। দরজা ভেদ করেও কর্কশ নিনাদ আসছে তা ছাপিয়ে শোনা যায়।

একটু জোরেই তাই বেশ কয়েক ঘা দিতে হয়েছে দরজায়।

দরজা খুললে পরাশরই এসে দাঁড়িয়েছে সহাস্য বদনে।

এসো এসো। তোমার জন্যে কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি। ট্রেন তোমার লেট ছিল বোধ হয়? ফিরে যাওয়াই বোধ হয় উচিত ছিল। ওটা কি যন্ত্রণার ব্যবস্থা করেছ?

পরাশরের পিছু পিছু তখন তার হোটেলের কামরার ভিতর গিয়ে ঢুকেছি। নেহাত অপ্রশস্ত নয়। দুজনের জন্য বরাদ্দ ঘর। আসবাবপত্রও চলনসই।

ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে পরাশর প্রথম যেন আমার অভিযোগের হেতুটা বুঝতেই পারেনি।

অবাক হয়ে বলছে, যন্ত্রণা কীসের?

কীসের যন্ত্রণা বুঝতে পারছ না।— সুটকেশ আর ফোলিও ব্যাগটা একটা সোফার ওপর রেখে ঘরের কোণের রেডিওটার আঙুল দেখিয়ে বলেছি,— ওটা কী?

ওঃ ওই রেডিওটা? পরাশর ব্যাপারটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়েই বলেছে, আওয়াজটা একটু কেমন বেসুর।

একটু বেসুরো! শুধু বিরক্তির দরুন নয়, বেয়াড়া রেডিওর থেকে সপ্তমে ওঠা বিদঘুটে আওয়াজও ছাপিয়ে যাবার জন্যে গা চড়িয়ে বলেছি, স্বয়ং বৃত্রাসুরও ও-আওয়াজ শুনে লজ্জা পাবে, রেডিওটা দয়া করে থামাবে। চল্লিশ ঘণ্টা ট্রেনে কাটিয়ে এসে আর এ শাস্তিভোগ করতে পারব না।

বলছ যখন তখন বন্ধ করে দিচ্ছি। পরাশর যেন অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে রেডিওটা তখনকার মতো বন্ধ করে দিয়েছিল।

একটু শান্তি পেয়ে বলেছি, এ রেডিওটি জোগার করলে কোথায়?

জোগাড় করব কোথায়? পরশু তো কিনলাম। পরাশর একটু যেন ক্ষুণ্ণ হয়ে বলছে।

তুমি বোম্বাই-এ এসে রেডিও কিনলে? আমি তাজ্জ্বব, আর এই রেডিও। আহা, রেডিওটা এমন কী খারাপ। পরাশর নিজের সওদার হয়ে ওকালতি করছে, একটু মাঝে মাঝে বিগড়ে যায়। কিন্তু গানগুলো বুঝতে তো কষ্ট হয় না। বোম্বাই ফিল্মের গান শোনবার জন্যেই ওটা কিনলাম।

বোম্বাই ফিল্মের গান শোনাবার জন্যে রেডিও কিনলে। আমি তার দিকে চেয়ে হতভম্ব হয়ে বলেছি। তুমি কি এখানকার ফিল্মের গান লিখবে নাকি?

না, না, সেবড়ো শক্ত। পরাশর যেন নিজের অক্ষমতায় দুঃখি হয়েছে, কিন্তু মাঝে মাঝে খুব অদ্ভুত সব আইডিয়া পাওয়া যায়।

এবার আমার মুখ দিয়ে আর কথা সরেনি।

শুধু রেডিও হলেও হয়তো রক্ষে ছিল।

পরাশর সুযোগ পেলেই যেমন সেটা চালিয়ে দেয়, আমিও ধারে কাছে থাকলে তেমনি বন্ধ করে দিই ততক্ষণাৎ।

আমার অনুপস্থিতে একলা থাকলে পরাশর যে বেপরোয়া হয়ে প্রাণ ভয়ে সেরেডিও চালায়, আসার দু-দিন বাদেই তার প্রমাণ পেলাম।

আমাদের ঠিক পাশের কামরায় এসে সেদিন সকালে নতুন একটি প্রৌঢ় দম্পতি ঢুকেছিলেন। দুপুরে আমি একটু নিজের কাজে বেরিয়েছিলাম। বিকেলে ফিরে দেখি তাঁরা এ কামরা ছেড়ে দূরের একটি কামরায় চলে যাচ্ছেন।

ব্যাপারটায় তখন তেমন কিছু গুরুত্ব দিইনি।

কামরা বদলের রহস্যটার ইঙ্গিত পেলাম সন্ধ্যের পর। তখন পরাশরের ঘরে এ ক-দিন ধরে যা দেখেছি, সেই একই নিয়মিত তাসের আড্ডা বসেছে।

স্বয়ং চলে যাবার পর পরাশর যে রকম মুখ করে তাদের আসরে ফিরে এল, তা কারুর দৃষ্টি এড়াবার নয়।

এ আসরে মধ্যমণি মনুভাই তাঁর সুবিশাল পা দুলিয়ে হেসে উঠে আধা হিন্দি আধা ইংরেজিতে বললেন, কী, ব্যাপার কী ভার্মাসাব খেদি ম্যানেজার এসে কানে কানে কথা বলে যাচ্ছে। খুব বড়ো গোছের শিকার বোধ হয়।

উঁহু, শিকার হয়তো বড়ো গোছেরই ছিল। কিন্তু ফসকেছে। পাকানো দড়ির মতো চেহারা দেখছ না।

পরাশরই এবার বিরক্তির সঙ্গে ঝাঁঝালো গলায় বললে, না এ হোটেলে আর থাকব না।

সেকী। আসরের সবচেয়ে গম্ভীর মানুষ ভাবনানি এবার তাসের টেবিল থেকে চোখ তুললেন সরিয়ে, এ হোটেল ছাড়বেন কে? ছাড়ব না।— পরাশর গরম,— আমার এই রেডিও নিয়ে না কি নালিশ উঠেছে। কারা না কি পাশের কামরা বদল করে চলে গেছে আমার রেডিওর জ্বালায়। নিজের ঘরে আমি রেডিও বাজাতে পারব না।

এবার সবাই হেসে উঠল।

মনুভাই বললেন, কিছু যদি মনে না করো তো বলি ভার্মাসাব। আপনার পাশের কামরায় আমিও পারত পক্ষে থাকতে রাজি নই। এ করিডরে আসতে যেতে দু-একবার যা কানে গেছে তাতেই অ্যাসপিরিন দরকার হয়েছে মাথা ধরা সারাতে।

আর একবার হাসির রোল ওঠবার পর ভাবনানি বললে, তা আপনার রেডিওটার কী গলদ হয়েছে দেখিয়ে নিলেই তো পারেন। আচ্ছা তাই, দেখাব। পরাশর নিতান্ত অনিচ্ছায় প্রস্তাবটা মেনে নিলেও কিন্তু শান্ত হল না। জোর দিয়ে বললে, তবু এ হোটেল ছাড়তেই হবে।

কেন? কেন?— এবার হাসির বদলে সকালের বিস্মিত প্রশ্ন।

কেন।— পরাশর পকেট থেকে একটা কাগজ টেবিলের ওপর রেখে বললে, দেখুন দিকি এটা কী?

জাসুমলই সেটা প্রথম তুলে নিয়ে একটু পরীক্ষা করে বললে, আরে। এটা তো বিলেতের এক পাউণ্ডের নোট!

হ্যাঁ।— পরাশর স্বীকার করে আবার খাপ্পা হয়ে উঠল, ম্যানেজার বলে কিনা আমি এ হপ্তার চার্জ চুকিয়ে দেবার সময় এই নোটটা দিয়েছি। পাঁচ টাকার বদলে এক পাউণ্ডের নোট দেব, আমি কি এমন আহম্মক। এর ভিতর কোথাও একটা কারসাজি আছে।

পরস্পরের দিকে একটু চিন্তিতভাবে চেয়ে জাভেরিই প্রথম জিজ্ঞাসা করলে কী কারসাজি থাকতে পারে মনে করেন?

সেইটে ঠিক বুঝতে পারছি না।—পরাশর একটু বিব্রতভাবে জানালে কিন্তু তা না থাকলে আমার ঘাড়েই এটা চাপাবার চেষ্টা কেন? ম্যানেজার বলছে যে ক্যাসিয়ার তখন ছিল না বলে হোটেল-ক্লার্ক আমার দেওয়া টাকাটা নিয়ে একটা খামে আলাদা করে রেখেছিল। সেইখানেই ওটা পাওয়া গেছে।

আশ্চর্য। মনুভাই নোটটা জাসমুলের হাত থেকে নিয়ে একটু উলটে-পালটে বললেন, আচ্ছা, আপনার কোনো ভুল হয়নি তো? আপনার কাছে এ ধরনের নোট আছে?

আমার কাছে।— পরাশর যেন একটু থতমত খেয়ে বললে, আমার কাছ এ ধরনের নোট থাকবে কোথা থেকে? আর থাকলে এ নোট বেশি দামে বিক্রি না করে আমি পাঁচ টাকার নোটের বদলে দিই?

ঠিক। ঠিক। মনুভাই হাসলেন, কিন্তু এ নিয়ে এত ঘাবড়াবার কী আছে। আপনি কিছু বিদেশি চোরাই কারবারও করেন না, আর ম্যানেজারও এই একটা নোটের জন্যে আপনার নামে পুলিশে খবর দিচ্ছে না। আসুন খেলতে বসুন। এ হোটেল ছেড়ে যাবেন কোথায়?

যাওয়াটা মনুভাই জাসুমল বা জাভরির পক্ষে অবশ্য বাঞ্ছনীয় হওয়া উচিত।

তাস খেলা আমি বুঝি না। পরাশরের কামরায় যে খেলা, তা তো আরো জটিল। পরাশর যে এসব খেলায় অত পাকা, তা আমার জানা ছিল না। একটু-আধটু এক আধ দিন হারলেও বেশির ভাগ সবাইকে সেবেশ দোহনই করে নেয় রোজ।

তার সঙ্গিদের তাতে অবশ্য ভ্রূক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। তিন জনেই বেশ শাঁসালো। হারের শোধ নেবার জন্যে জেদটাই তাদের কাছে বড়ো।

পরাশরকে হোটেল ছাড়তে দিতে না চাওয়াতে এটাও একটা কারণ।

পরাশরের ভাঙা রেডিওটা তো বটেই, এবার বোম্বে অসহ্য লাগার আর একটা কারণ নিত্য সকাল বিকেল এই তাসের আড্ডা।

মানুষ হিসাবে পরাশরের সঙ্গিরা যে খারাপ তা বলব না। সবাই বেশ মিশুক অমায়িক ভদ্র। কিন্তু যত সজ্জনই হোক, দিনের পর দিন তাদের তাসের আড্ডায় সাক্ষীগোপাল হয়ে বসে থাকতে কারুর ভালো লাগে।

তা-ও তাস যদি আমার দু-চক্ষের বিষ না হয় তো কোনো রকমে সেই পারতাম।

সব জেনে শুনে আমায় এ শাস্তি দিতে বারো শ মাইল ছুটিয়ে আনা কেন? তাও আবার ট্রাঙ্ককলে।

ট্রাঙ্ককলের কথাটা তুলতেই পরাশরকে কেমন একটু অবশ্য অপ্রস্তুত মনে হয়েছে? তাসের আড্ডা এক বেলা বেশ কিছু জিতেই হঠাৎ খেয়ালের মাথায় সেযে এটা করে ফেলেছে, এবিষয়ে আমার সন্দেহ নেই।

দু-চারবার এ খোঁচাটা দেবার পর তার ঈষৎ লজ্জিত অবস্থা দেখে মায়া করেই আর এ প্রশ্ন তুলিনি। সোমবারে যাওয়ার সঙ্কল্পটা কিন্তু জোরের সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছি।

সোমবারের আগে রবিবারটাও অবশ্য এক দিক দিয়ে আরামেই কাটল।

পরাশরের সে-রেডিওটার উৎপাতে অতিষ্ঠ হতে হয়নি। শনিবার দুপুরে বেরিয়ে পরাশর নিজেই সেটা সারাবার জন্যে কোথায় দিয়ে এসেছে।

তার ধারণা সোমবারই সেসারানো অবস্থায় রেডিওটা ফেরত পাবে। দু-চারবার তার এ হাস্যকর বিশ্বাস ভাঙতে গিয়ে বিফল হয়ে চুপ করে গেছি। সেতার দিবাস্বপ্ন নিয়েই থাক, আমাদের ফিরে যাওয়াটা বন্ধ না হলেই হল।

তাসের আড্ডায় এ নেশা ছেড়ে সোমবার আমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সেযেতে পারবে কিনা, এ বিষয়ে একটু সন্দেহ যে মনে ছিল না এমন নয়।

সোমবার সকালে ভাবগতিক দেখে কিন্তু আশা হল তার কথা সেরাখবে। সকালেই তার জানা একটি ট্রাভেল এজেন্সিকে ফোন করে আমাদের দুজনের বার্থের ব্যবস্থা করে ফেলতে শুনলাম। তারপর আমায় নিয়ে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু কেনাকাটা করতেও বেরুল।

কেনাকাটা সামান্যই। কিন্তু তা সেরে যখন হোটেলে ফিরলাম, তখন বেলা প্রায় পাঁচটা।

আর দু-ঘণ্টা বাদেই ট্রেন। ধীরে সুস্থে এবার তৈরি হওয়া যেতে পারে। হোটেলে-বয় ট্রেতে করে চা দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে সেই কথাই ভাবছি এমন সময় পরাশর একেবারে যেন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এই যা:।

হল কী? পরাশরের মুখের চেহারা দেখে আমি রীতিমতো উদবিগ্ন।

আমার রেডিও।— পরাশরের প্রায় আর্তনাদ, সেটা দোকান থেকে ফেরত আনতেই ভুলে গিয়েছি।

ভুলে আমিও গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা এমন বুক চাপড়ে আর্তনাদ করবার মতো ব্যাপার বলে ভাবতে পারলাম না। বললাম, ভুলে গেছ, তখন তো আর উপায় নেই।

উপায় নেই মানে? পরাশর অধৈর্যের সঙ্গে বললে, দোকান তো এখন বন্ধ হয়নি?

দোকান বন্ধ হয়নি। কিন্তু সেটা এখন আনতে গেলে ট্রেন আর ধরা যাবে? বিরক্তির সঙ্গে বললাম।

খুব যাবে। —পরাশর অর্ধভুক্ত চায়ের পেয়ালা ফেলে উঠে দাঁড়াল, ট্যাক্সিতে যাব আসব এসোনা।

যাচ্ছি। রাগ, বিরক্তি, হতাশা সব আমার গলায় তখন মেশানো, কিন্তু দোকানে যদি দেরি হয় তা হলে ওই ট্যাক্সিতেই আমি একলা চলে যাব বলে রাখছি। আমার সুটকেশ আমি নিজেই নিচ্ছি।

আহা, শুধু তোমারটা কেন। আমার লাগেজও নিয়ে নাওনা। তাতে তো আপত্তি করছি না কিন্তু ও রেডিও আর ফেলে যাওয়া যায় না।— পরাশর যেন নিরুপায়।

ফেলে যাওয়া যায় না। এবার ঝঙ্কার দি, কিন্তু রেডিও যদি মেরামত না হয়ে থাকে, তাই ফেরত নেবে তো। দোকানে তর্কাতর্কি করে সময় নষ্ট করবে না।

সময় নষ্ট আর! পরাশর আশ্বাস দিলে।

সেই রেডিও নিয়ে অমন ঝামেলা তারপর হবে ভাবতেও পারিনি।

ট্যাক্সিতে বিকেলের ভিড়ের রাস্তার পদে পদে বাধা পেয়ে যেতে যেতে তো মনে মনে সারাক্ষণ ভাঙা রেডিও আর তা মালিকেরও মুন্ডুপাত করেছি।

প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে বোম্বাই-এর ঘিঞ্জি সাবেকি ব্যবস্থা কেন্দ্রে একটি সংর্কীণ গলির মধ্যে যথাস্থানে পৌঁছবার পর পরশরের প্রস্তাব শুনে একেবারে জ্বলে উঠলাম।

রেগে উঠে বললাম, আনবে তো একটা রেডিও ফেরত। তাতে আমার সঙ্গে যাওয়ার দরকারটা কি? না মালপত্র ট্যাক্সিতে ফেলে আমি যেতে পারব না। আমি ট্যাক্সিতেই থাকব আর তোমার অকারণে দেরি হলে এই ট্যাক্সি নিয়েই সোজা স্টেশনে চলে যাব বলে রাখছি।

আহা, তাতে কি আমি আপত্তি করছি?— পরাশর নাছোড়বান্দা, কিন্তু আমার সঙ্গে গেলে, কারণে না অকারণে দেরি সেটাতো ঠিকমতো বুঝতে পারবে। ও মালপত্রের জন্যে ভাবনা নেই। ও ট্যাক্সিওয়ালা আমার চেনা।

তোমার চেনা। অবাক হয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকাতে সেহেসে বললে, হাঁ সাব গাবড়ানেকা কুছ নেই। ম্যায় হিঁয়ে খাড়াই রহেঙ্গে।

অগত্যা পরাশরের সঙ্গে দোকানের ভেতরেই গেলাম।

দোকান দেখতে এমন কিছু সাজানো গোছানো চমকদার নয়। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে সেটা যে একটা বড়ো আড়তের অফিস তা বোঝা যায়।

ভেতরে তখন একটি কর্মচারী ছাড়া আর কেউ নেই।

পরাশর গিয়ে তার রসিদটা দেখাতে সেএকটু অবাক হয়ে বললে, এ রেডিও তো আজ ফেরত পাবেন না।

কেন? মেরামত হয়নি এখনও। পরাশর বেশ ক্ষুণ্ণ।

আপনি ভুল করছেন।— কর্মচারী রসিদটা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলে, পরের সোমবার এ রেডিও ফেরত দেবার কথা। তারিখটাই পড়ে দেখুন না ভালো করে। ও তারিখে মেরামত হওয়া অবস্থায় না পেলে বলবেন।

রসিদটা ভালো করে এতক্ষণে লক্ষ করে দেখলাম। কর্মচারীর কথাই ঠিক।

পরাশর একটু অপ্রস্তুত হয়ে কী বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিরক্তির সঙ্গেই বলালম, মিছে কৈফিয়ৎ দেবার চেষ্টা কোরো না। রেডিওটা যেমন আছে তাই ফেরত নাও।

পরাশর যেন একটু দুঃখিতভাবে সেই কথা জানাবার পর কর্মচারী দূরের একটি শেলফ থেকে রেডিওটা এনে কাউন্টারের ওপর রাখতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে শোনা গেল,—

এ মিস্টার ভার্মা না?

অবাক হয়ে চেয়ে দেখি পেছনে দিকের এক পাশের একটি দরজা থেকে স্বয়ং মনুভাই-ই বেরিয়ে আসছেন।

আরে, এটা আপনার দোকান নাকি।— পরাশরকেও রীতিমত বিস্মিত মনে হল।

হাসি মুখে সামনে এসে মনুভাই বললেন, হ্যাঁ আর আপনি বেছে আমার দোকানেই ও রেডিও মেরামত করতে দিয়ে গেছেন। কী আশ্চর্য বলুন তো।

তাই তো দেখছি।— পরাশর হাসি মুখে বললে, কিন্তু মেরামতো করানো আর হল না মনু ভাইজি। এখুনি গিয়ে আমাকে ট্রেন ধরতে হবে। রেডিওটা নিয়ে যাচ্ছি।

image5.jpg

তা কি হয় ভার্মা সাহেব। মুখের হাসি সত্বেও মনুভাই কেমন একটু অন্য রকম গলায় বললে, আমার দোকানে সারাতে দিয়েছেন, ও রেডিও এমনি আপনাকে ফেরত দিতে পারি? আসুন, বসুন আমার ঘরে। এত কষ্ট করে খুঁজে-পেতে এসেছেন, একটু বসে যান।

কিন্তু ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি।— এবার আমি উদবিগ্নভাবে না বলে পারলাম না।

মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি কী বলছেন। ও ট্রেন এখন ছাড়ে কিনা তাই দেখুন। আসুন আমার ঘরে।

এ সময়ে মনুভাই-এর এ রকম ঠাট্টার সুরটা আমার ভালো লাগল না। বললাম, তাহলে তুমি যাও পরাশর। আমি স্টেশনে চললাম।

পরাশর কিন্তু তখন বজ্রমুষ্ঠিতে আমার একটা হাত চেপে ধরেছে। মুখে কিন্তু হেসে বললে, আরে ট্রেনের জন্য তোমার ভাবনা নেই। এই ট্রেন ফেল করলে নাইট প্লেনে তোমায় পাঠিয়ে দেব কথা দিচ্ছি। মনুভাইজি এত করে ডাকছেন, ওঁর ঘরে একটু না বসে পারি।

যেভাবে পরাশর হাতটা চেপে ধরে আছে, প্রতিবাদ করতে হলে তখন ওই দোকানের মধ্যেই তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে হয়। রাগে মুখখানা কালো করেই তার সঙ্গে মনুভাই-এর ঘরে গিয়ে এবার বসলাম।

দোকানের পাশে ছোটো কুঠির। কিন্তু সামনের দোকানের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। ছোটো ঘরটির সাজসজ্জা আসবাবে সৌখিনতার চূড়ান্ত পরিচয়।

মেহগনি কাঠের দামি টেবিলের একপাশে মখমল মোড়া চেয়ারে আমাদের বসিয়ে মনুভাই অন্য দিকের উঁচুদরের কাঠের কাজ করা আসনে নিজে গিয়ে বসে প্রথমেই যা বললেন তাতে আমি অবাক।

দরজাটা বন্ধ করে দাও রাজন।

রাজন নামে কর্মচারীটির হুকুম তালিক করতে দেরি হল না। বিমূঢ়ভাবে পরাশরের দিকে তাকিয়ে দেখি তার মুখে কৌতুকের হাসি।

সেই রকম হাসি মুখেই পরাশর বললে, ভালোই করেছেন মনুভাইজি। আমাদের মতো বন্ধুদের আলাপ একটু নিভৃতে হওয়াই দরকার। কিন্তু আলাপটা কী নিয়ে শুরু করা যায় বলুনতো।

ধরুন, আপনার সেই এক পাউণ্ডের নোটটা নিয়ে,— মনুভাইয়ের মুখের চেহারা আর গলা দুই-ই এখন যেন আলাদা— যেটা ভুলে হোটেলের ম্যানেজারকে দিয়েছিলেন।

ওঃ সেই নোটটা। — পরাশর হেসে বললে, আপনি তাহলে ম্যানেজারের কাছে খোঁজ নিয়েছিলেন। জানতাম আপনি নেবেন।

জানতেন। মনুভাইয়ের মুখ এবার কঠিন, জেনেশুনেই মিথ্যে কথাটা আমাদের বলেছিলেন।

তাইতো বলেছিলাম। পরাশর অম্লান বদনে জানল, সত্যি সত্যি।

ও নোট তো ম্যানেজারকে আমি দিই নি।

এ রকম মিথ্যে বলার উদ্দেশ্য? মনুভাই-এর গলা তীক্ষ্ণ।

উদ্দেশ্য তো জলের মতো পরিষ্কার। প্রথমে ভারি মক্কেল হিসাবে আপনার একটু কৌতূহল হবে, তারপর খোঁজ নিয়ে জেনে সন্দিগ্ধ ও উদবিগ্ন হয়ে উঠবেন। তারপর আমার সম্বন্ধে খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করবেন। কিন্তু খোঁজখবর যখন পাবেন, তার আগেই আমি কাজ হাসিল করে ফেলেছি। সবেতো আজ ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে আপনার টনক নড়েছে আমি তো দু-মাস আগে থেকে পাঁয়তাড়া কষছি। আর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা না বললে অন্যভাবেও আপনাকে উদবিগ্ন করবার ব্যবস্থা করতাম। এমন কী শেষ মুহূর্তে আপনার এই টনক নড়াবার ব্যবস্থাও না করে ছাড়তাম না।

বটে। মনুভাই-এর গলাটা বজ্রগম্ভীর। কী পাঁয়তাড়া শুনতে পাই?

নিশ্চয়, নিশ্চয়। এক তাসের আড্ডায় বন্ধুদের মধ্যে গোপনতা থাকা উচিত নয়। পরাশর যেন বন্ধু বৎসলতায় ডচ্ছসিত। প্রথম এখানে এসে আপনার গতিবিধি স্বভাব চরিত্র সব কিছুর তালিকা করে ফেলেছি। তা থেকে জেনেছি, নানা সৎ-অসৎ উপায়ে টাকার কুমির হয়ে উঠলেও প্রথম জীবনের (জু) নেশা আপনার কাটেনি। সেই নেশা এখন শুধু অবশ্য তাস খেলা দিয়েই মেটান। আপনি যাদের সঙ্গে সাধারণত মোটা টাকার খেলা খেলেছেন, তাদের সঙ্গে ভাব করেছি। এ বিষয়ে ভাবনানির সাহায্য অবশ্য সবচেয়ে দামি। আজ এক বছর ধরে আপনাদের মতোই সুড়ঙ্গ ব্যবস্থায় ওস্তাদ বলে নিজের পরিচয় কায়েমি করে সেকেন্দ্রীয় হয়ে আপনার ওপর নজর রাখছে। শুধু হাতে হাতে প্রমাণের অভাবেই আপনার হাতে হাতকড়াটা পরাতে পারিনি। সেই প্রমাণ অকাট্যভাবে পাবার জন্যে ভাবনানির সাহায্যে আমার হোটেলের ঘরে জমাট তাসের আড্ডা বসিয়েছিলাম। বন্ধু বান্ধবের কথায় আর ভাবনানির অনুমোদনে আপনি এখানে এসে জমে গেছেন। জমে গেছেন প্রায় নিত্য হেরে যাওয়ার দরুন। আমার জেদ বাড়াতে আর আমার ভূমিকাটা বিশ্বাসযোগ্য করাবার জন্যে আমি নিজে বেশির ভাগ খেলায় জেতবার ব্যবস্থা করেছি। আমিই জেতার বদলে বেশি হারতে হয়তো আপনার সন্দেহ হতে পারত, জেদও এত বাড়ত না।

কিন্তু এত পাঁয়তাড়া যার জন্যে কষা আমায় হাতকড়া পরাবার মতো সেই অকাট্য তার গলার বিদ্রূপ।

না, না, তা কেন?— পরাশর যেন সরলভাবে বোঝাতে ব্যাকুল হয়ে উঠল,— ও তাসের আসরে তো শুধু ওই ভাঙা রেডিওটা আপনাকে বার বার দেখিয়ে শুনিয়ে বিশ্বাস করবার জন্যে। আসল প্রমাণ ওই ভাঙা রেডিওর মধ্যে।

ভাঙা রেডিওর মধ্যে। মনুভাই-এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেল। মনুভাই-এর গলার সুরটা অবশ্য আলাদা।

হ্যাঁ, ওই রেডিওটা সত্যিই বিকল বলে আপনাকে বুঝিয়ে ওটা মেরামতের জন্যে শনিবার আপনার এ দোকানে দিয়ে গেছি। শনিবারের পর গেছে ছুটির দিন রবিবার, আর আজ সোমবার। এই রবিবারেই যা প্রমাণ দরকার সব সংগ্রহ হয়ে গেছে ওই রেডিওর মারফত।

কী রকম?—মনুভাই-এর গলাটা এবার অত্যন্ত তীক্ষ্ণ।

আপনাদের এ ঘরেই রবিবারে যে যা বলেছে সব ওই জাল রেডিওতে তোলা হয়ে গেছে বলে। আমার ভাঙা রেডিওটা তো নয়, তারই বাঁ-ধারের খোলসের ভেতরে একটা ইনফ্রা রেড আলোর ক্যামেরা আর অত্যন্ত শক্তিমান টেপ রেকর্ডার বসিয়ে সারাবার নামে এখানে রেখে গেছি। রবিবার তো নয়ই, দু-চার দিনের মধ্যে তাতে কেউ হাত দেবে না আমি জানতাম। আজ আপনি সন্দিগ্ধ করতে চেয়েছিলেন একথা তো দুবার বললেন। তাতে আপনার সুবিধে— মনুভাই পারেন। তাতে অনেক হাঙ্গামা বেঁচে যায়।

আপনার হাঙ্গামা বাঁচাতে পেরে আমি বাধিত।— মনুভাই এবার কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,— কিন্তু ও রেডিওর ভেতরকার ক্যামেরা আর টেপ-রেকর্ডার কি অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে মনে করেন?

সেটাও আমার মুখ দিয়ে শুনতে চান?— পরাশর হেসে উঠল, দেখুন আজ বহুদিন ধরে এই বম্বে শহর থেকে লক্ষ লক্ষেরও বেশি বিদেশি মদের গোপন লেনদেন অনবরত চলেছে। পুলিশ দু-একজনকে ধর-পাকড় করলেও আসল চাঁইদের ধরবার মতো সাক্ষাৎ প্রমাণ না পেয়ে ঠুঁটো হয়ে আছে। সত্যিকার লেনদেন কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় হয় না, কিন্তু কোথায় তা হবে ঠিক করবে একটা গোপন আড্ডা। এই আপনার দোকানটি। রবিবার কোনো একটা সময়ে যখন যে মক্কেল আসে, তার সঙ্গে আপনি দেখা করেন। পুলিশ যে সময়ে হানা দিয়েও কিছু করতে পারবে না। কারণ তারা এসে দেখবে দুজন ভদ্রলোক নিতান্ত কথাবার্তা আর ছবি তোলার দরকার ছিল। ওই ভাঙা রেডিও তাই করেছে।

ভালো! ভালো— নীচের দিকের ড্রয়ার থেকে একটা পিস্তল বার করে আমাদের দিকে উঁচিয়ে এতোক্ষণে মনুভাই যে নেকড়ের হাসি হাসলেন।— কিন্তু আমার এ গোপন কারবারের প্রমাণ ও রেডিও এখন গলবস্ত্র হয়ে আপনার হাতে তুলে দেব বলে আপনি আশা করেন?

তুলে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি? অনর্থক ঝামেলা আর তাহলে হয় না। পরাশরের মুখে যেন মাখন মাখানো, আর ওটা যদি ভেঙে নষ্ট করে ফেলেন, তাহলেও এমন কিছু ক্ষতি নেই। ও সম্ভাবনার কথা ভেবেই আমার এই বন্ধুটিকে সাক্ষী হিসেবে ধরে রেখেছি।

কাল কি পরশু তারও পরে আপনার আর আপনার এই সাক্ষীর লাশ হয়তো বান্দ্রা কি আরো সুদূর সমুদ্রের পাথুরে চড়ায় এসে লাগতে পারে, সেকথা কি ভেবেছেন? মনুভাই-এর গলাও এবার মিছরি।

না, তা ভাবিনি।— পরাশর যেন লজ্জিতভাবে স্বীকার করলে, কারণ আমাদের মারলেও আপনার এখন পরিত্রাণ নেই। দরজাটা বন্ধ না থাকলে দেখতে পেতেন পুলিশ এসে সমস্ত দোকান আর তার চারধার পাহারা দিচ্ছে।

এত কথা শোনার পরও সত্যিই সেই মুহূর্তে সজোরে দরজা ঠেলে পুলিস এসে ঘরে ঢুকবে ভাবতে পারিনি।

মনুভাই অবশ্য শেষ পর্যন্ত বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে বিনা ঝঞ্ঝাটেই ধরা দিলে।

খানিকক্ষণের জন্যে কেমন মুহ্যমান হয়েছিলেন। মনুভাইকে পুলিস ভ্যানে নিয়ে যাবার পর ট্যাক্সিতে উঠতে হঠাৎ চমকে গিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন, একি এখন যে আটটা বাজে। তাতো বাজবেই। নির্বিকার ভাবে বললে পরাশর, ট্রেন অনেকক্ষণ ছেড়ে গেছে। তবে তোমার ভাবনা নেই। রিজার্ভেশন ক্যানসেল করে নাইট প্লেনের দুটো সিটের ব্যবস্থা করে রেখেছি। এখতো রেডিওটাকে কাকে দান করে যাব তাই ভাবছি।

ভাঙা রেডিওটা যে সেইতিমধ্যে দোকান থেকে এনে মোটরে তুলেছে তা খেয়াল করিনি।

অবাক হয়ে বললাম, সেকি। দান করবে কি। ওর মধ্যে অত বড়ো প্রমাণ। পুলিশে জমা দিতে হবে না?

জমা দেব। পরাশর হাসল, এই ভাঙা রেডিও।

ভাঙা রেডিও মানে? ওর ভেতরকার ইনফ্রায়েড আলোর ক্যামেরা, টেপ-রের্কডার।

একটা রেডিওর ভেতর অত কান্ড সম্ভব বলে তো জানি না— পরাশর হাসল, অন্তত এদেশে ও রকম যন্ত্র এখনো কেউ দেখেনি। মনুভাইকে ভয় পাইয়ে নিজমূর্তি ধরাবার জন্যে ওই ভাঁওতা দিয়েছিলাম। ওই ভাঁওতার আসল যা কাজ তা হয়ে গেছে। অকাট্য প্রমাণ আছে বিশ্বাস করে মনুভাই নিজেই এখন সব কবুল করবে।

আচ্ছা— একটু ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, সত্যিই মনুভাই-এর কথার সাক্ষী হবার জন্যেই কি আমাকে কলকাতা থেকে ট্রাঙ্ককল করে আনিয়েছিলে?

না, না, তা কেন,— পরাশর হেসে বললে তোমায় আনিয়েছি শুধু ভাঙা রেডিওতে জ্বালাতন হবার জন্যে। নিজের লোকও তিতিবিরক্ত নাহলে ওরা বিশ্বাস করবে কেন?

শুধু তিতিবিরক্ত হবার জন্যে?— মুখ চোখ লাল করে আমি পরাশরের দিকে তাকালাম।

পরাশরের কোনো ভ্রূক্ষেপেই নেই। তাচ্ছিল্যভাবে বললে ভালো মানুষ গোছের কাকেও যন্ত্রণা দেওয়া যায় ভাবতে গিয়ে তোমার নামটাই মনে পড়ল।

আমি গুম হয়ে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *