পরার্থপরতার অর্থনীতি
যা ঘটে গেছে তা বিধাতা পরিবর্তন করতে পারেন না; ঐতিহাসিকগণ পারেন–শুধু যে পারেন তাই নয়, হরহামেশাই করে থাকেন। অবশ্য এখানেই ঐতিহাসিকগণ বিধাতার কাছে হেরে গেলেন—বিধাতা সম্পূর্ণ সত্যটুকু জানেন, তাঁর ইতিহাস পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। ঐতিহাসিকগণ কখনও সবটুকু সত্য জানেন না; অন্ধের হাতি দেখার মত সত্যের খণ্ড খণ্ড রূপ তাঁদের কাছে ধরা পড়ে। তাই যে কোন ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যা বার বার পরিবর্তিত হয়। এ সব খণ্ডিত ব্যাখ্যা হতেই আমরা সত্যের বহুমাত্রিক রূপ দেখতে পাই। ঐতিহাসিক ঘটনার নতুন নতুন ব্যাখ্যাতে আমি তাই উদ্বিগ্ন হই না, আনন্দিত হই। বরং যে সব ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই সে সব ঘটনা নিয়েই আমার মনে খটকা লাগে।
পরার্থপরতার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে প্রবাদ-পুরুষ হলেন সম্রাট হর্ষবর্ধন। তিনি সপ্তম শতকে কনৌজের সম্রাট ছিলেন। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে হর্ষবর্ধন ছিলেন অতি দানশীল রাজা। প্রতি চার বছরে একবার তিনি প্রয়াগের মেলায় তাঁর সর্বস্ব দান করতেন। সব কিছু দেওয়া হয়ে গেলে তিনি তাঁর নিজের গায়ের কাপড় দান করে গঙ্গায় স্নান শেষে অন্যের বস্ত্র ধার নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতেন। ইতিহাসের এ কিংবদন্তী নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই। তবু কিংবদন্তীটি সম্পর্কে ছাত্রজীবনে আমার মনে কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু এ সব প্রশ্নের জবাব আমি কোন ঐতিহাসিকের কাছে পাইনি।
দীর্ঘদিন পরে আমার নিজের জীবনেই এ ঐতিহাসিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই। একবার পবিত্র শবে বরাতের পূর্বে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার মা শবে বরাতের দিন আমার হাতে এক টাকার নোটের একটি বান্ডিল দিয়ে ভিখারিদের তা দান করতে হুকুম দিলেন। আমি পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বাড়ির দরজার বাইরে প্রতিটি ভিখারিকে একটি করে এক টাকার নোট দেওয়া শুরু করি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি ভিখারিদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে যাই। ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে ভিখারিরা আমার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলে এবং আমার হাত থেকে নোট ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আত্মরক্ষার্থে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে আমি চলে এলাম। সেই মুহূর্তে হঠাৎ হর্ষবর্ধনের ঘটনা আমার মনে পড়ে গেল। আমার বদ্ধ ধারণা যে, সম্রাট হর্ষবর্ধনও হয়ত ইচ্ছে করে প্রয়াগের মেলায় তাঁর পরনের কাপড়-চোপড় দান করেননি। হয়ত আমারই মত সম্রাট হর্ষবর্ধনও ঘেরাও হয়েছিলেন, তিনি গায়ের কাপড় দান করার সময়ই পাননি। হয়ত তাঁর পরনের কাপড় ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং বাধ্য হয়েই তাঁকে গঙ্গাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। হর্ষবর্ধনের জীবনীকার ছিলেন তাঁর সভাসদ্। কাজেই কাপড় ছিঁড়ে নেবার পর গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে সম্ভ্রম রক্ষার অসম্মানজনক ঘটনাকে তিনি একটু রঙ লাগিয়ে লিখে গেছেন। তাঁর বয়ানে তাই হর্ষবর্ধন ইচ্ছে করেই তাঁর পরনের কাপড় দান করে গঙ্গাস্নান করেন।
হর্ষবর্ধনের ঘটনা অনেক দিন আগে ঘটেছে। সত্যি কি ঘটেছে একমাত্র বিধাতাই জানেন। তবে আমার অভিজ্ঞতা সত্য ঘটনা এবং তা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। প্ৰতি বছরই ঈদের সময় জাকাতের শাড়ি বিতরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশে এ ধরনের অজস্র ঘটনা ঘটেছে। সোমালিয়াতে জাতিসংঘের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, দুর্গত লোক ও ত্রাণসামগ্রী থাকলেই সাহায্য করা সম্ভব হয় না। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য কোথাও কোথাও প্রয়োজন হয় সশস্ত্র রক্ষীদের। অথচ অনেক দার্শনিকই বিশ্বাস করেন যে, দান করতে চাইলেই যত খুশি দান করা যায়। তাই দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন লিখেছেন[১]:
The desire of power in excess caused the angels to fall, the desire of knowledge in excess caused man to fall, but in charity there is no excess, neither can angel or man come in danger by it. (অতিরিক্ত ক্ষমতার লোভ দেবদূতদের স্খলন ঘটায়, অপরিমিত জ্ঞানস্পৃহা মানুষের পতন ঘটায়, কিন্তু দান-খয়রাতে কোন আতিশয্য নেই। দান-খয়রাত মারফত দেবদূত বা মানুষ কারও কোন বিপদ আসবে না)।
বেকন সাহেব বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে বা সোমালিয়াতে দান-খয়রাতের নতিজা দেখেননি। যদি দেখতেন তবে দান-খয়রাত সম্পর্কে তাঁর এ উক্তি অবশ্যই প্রত্যাহার করতেন।
দীর্ঘদিন ধরে দান-খয়রাত বিষয়টি ধর্মতত্ত্বের একচেটিয়া দখলে রয়েছে। দান—খয়রাত হচ্ছে আখেরাতের পাথেয়। বাইবেলের মতে দান-খয়রাত অজস্র পাপ মুছে দেয়। পবিত্র কোরানে দান-খয়রাতকে বীজ বপনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, একটি ভুট্টার বীজ হতে জন্ম নেয় সাতটি শীষ আর প্রতিটি শীষে শত শত দানা ধরে। তেমনি ছোট্ট একটি দানের বরকত অনেক। সমাজবিজ্ঞান ইহকাল নিয়ে ব্যস্ত; পরকাল সমাজবিজ্ঞানের চিরাচরিত গণ্ডির বাইরে। যে মূল্যবোধের উপর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত তা দান-খয়রাতের অনুকূল নয়। দান-খয়রাতের জন্য প্রয়োজন স্বার্থহীন ব্যক্তি। অর্থনীতির পূর্বানুমান ( assumption) হচ্ছে, সকল মানুষই স্বার্থপর। প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিস্বার্থই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চালু রেখেছে। এডাম স্মিথের ভাষায়[২]:
It is not from the benevolence of the butcher, the brewer, or the baker that we expect our dinner, but from the regard of their own interest. We address ourselves not to their humanity but to their self-love and never talk to them of our necessities but of their advantage. (আমরা কসাই, শুঁড়ি বা রুটিওয়ালার বদান্যতা হেতু আমাদের আহার প্রত্যাশা করি না, তারা তাদের স্বার্থেই খাদ্য সরবরাহ করে। আমরা তাদের মানবতাবোধের কাছে আবেদন করি না, বরং তাদের স্বার্থপরতার উপর নির্ভর করি, কখনও আমাদের প্রয়োজনের কথা বলি না, বরং তাদের সুবিধার কথা বলি)।
এ ধরনের স্বার্থপর অর্থব্যবস্থায় দান-খয়রাত হচ্ছে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক আচরণ। পরকালের ভয়কেই তাই এক পর্যায়ে দান-খয়রাতের একমাত্র কারণ গণ্য করা হত।
দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক তত্ত্বে ব্যক্তিগত দান-খয়রাত ছিল উপেক্ষিত। অথচ বাস্তব জীবনে দান-খয়রাতের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। বন্ধু-বান্ধব, পাড়া—পড়শী ও আত্মীয়-স্বজনকে বছরে কত দান-খয়রাত করা হয় তার কোন হিসাব পাওয়া যায় না। তবে ১৯৯০ সালে একটি হিসাব হতে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহস্থালি আয়ের প্রায় ১.৭ শতাংশ দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নগদ দান-খয়রাতে ব্যয় করা হয়ে থাকে। এ হিসাবের মধ্যে স্বেচ্ছাশ্রম অন্তর্ভুক্ত নয়।[৩] অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে উন্নত দেশসমূহে দান-খয়রাতের পরিমাণ বাড়ছে। উপরন্তু সকল শিল্পোন্নত দেশেই দীন দরিদ্রের কল্যাণের জন্য সরকারী খাতে ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। সমাজবিজ্ঞানীদের পক্ষে তাই দান—খয়রাত একেবারে উপেক্ষা করার কোন যুক্তি নেই। অর্থনীতিবিদ্রা তাই আস্তে আস্তে বিষয়টির প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। অবশ্য অর্থনীতিবিদ্রা দান-খয়রাতের অর্থনীতির নাম দিয়েছেন “পরার্থপরতার অর্থনীতি” (economics of altruism)। স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে এঁরা বলেন লাভের সাথে সম্পর্কহীন (non-profits) প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, দান-খয়রাত সম্পর্কে সম্প্রতি সমাজবিজ্ঞানীরা ২৭টি গ্রন্থ ও ৭৭টি গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।[৪]
পরার্থপরতা শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, জীবজন্তুর জগতেও এ ধরনের স্পৃহা দেখা যায়। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পরার্থপরতা হল সে ধরনের আচরণ যা পালন করতে গিয়ে সমাজের একজন সদস্য ত্যাগের অথবা ঝুঁকির বিনিময়ে অন্যদের উপকৃত করে (behaviour that benefits others at some cost or risk, to onself)। আপাতদৃষ্টিতে স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা পরস্পরবিরোধী প্রবণতা। অর্থনীতির জনক এডাম স্মিথ মানুষের মধ্যে উভয় ধরনের স্পৃহাই লক্ষ্য করেছেন। ১৭৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই “The Theory of Moral Sentiments” গ্রন্থে এডাম স্মিথ একে অপরের ভাল করার স্পৃহাকে মানুষের সামাজিক আচরণের ভিত্তি হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত “Wealth of Nations” গ্রন্থে এডাম স্মিথের মূল বক্তব্য হলো এই যে, মানুষ স্বার্থপর এবং বাজারে অদৃশ্য হাতের মাধ্যমে এ স্বার্থপরতা চরিতার্থ হয়। মানুষ একই সাথে কিভাবে স্বার্থপর ও পরার্থপর হয় সে সম্পর্কে এডাম স্মিথ কোন ব্যাখ্যা দেননি। অর্থনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে মানুষের মধ্যে এই দুই আপাতবিরোধী প্রবণতার উপস্থিতি “এডাম স্মিথ সমস্যা” নামে পরিচিত। এডাম স্মিথ এ সমস্যার সমাধান না করলেও, সমকালীন ইংরাজ দার্শনিক ডেভিড হিউম স্বতন্ত্রভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন হিউমের মতে মানুষ নিজেকেও ভালবাসে (স্বার্থপর) ও শত্রু ছাড়া অন্যদেরও ভালবাসে (পরার্থপর)। কিন্তু এই ভালবাসার নিবিড়তা নির্ভর করে সামাজিক দূরত্বের (social distance) উপর। সামাজিকভাবে যে যত কাছে থাকে মানুষ তাকে তত ভালবাসে। সামাজিক দূরত্ব যত বাড়ে ভালবাসার নিবিড়তা তত কমে। পরবর্তীকালে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী বোগারডাস (Bogardus) সামাজিক দূরত্বের মাপকাঠি সম্পর্কে বিস্তারিত তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন।
পরার্থপরতার অর্থনীতিতে তিনটি মৌল প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। প্রথম প্রশ্ন হলো, কারা এবং কেন দান-খয়রাত করেন? দ্বিতীয়ত, কি ধরনের দান-খয়রাত সবচেয়ে উপকারী? সর্বশেষ প্রশ্ন হলো, দান-খয়রাত সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য কতটুকু কল্যাণকর?
প্রথম প্রশ্নটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দাতারা কি কারণে দান করে তা জানতে পারলে দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহ দাতাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ে অধিকতর সাফল্য অর্জন করতে পারে। বর্তমানে যে গবেষণা চলছে তাতে তিন ধরনের মতবাদ দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, কোন কোন অর্থনীতিবিদ্ মনে করেন যে, পরার্থপরতা হচ্ছে এক ধরনের স্বার্থপর কাজ। বিশেষ করে আত্মীয়স্বজনদের সাহায্য করার পেছনে থাকে বংশানুগত সম্পর্কিতদের রক্ষার জন্য জৈব তাড়না। তবে এ ধরনের সামাজিক—জৈববিজ্ঞান (socio-biology) অনাত্মীয়দের দান-খয়রাতের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। কোন কোন অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে, দান-খয়রাতের পেছনে দাতার মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকে। কোন কোন দাতা তাদের মর্জি মাফিক পথে দানগ্রহীতাদের চালাতে চান। যেমন, কোন দাতা হয়ত দানগ্রহীতাদের মাদকাসক্তি নিরুৎসাহিত করতে চান; তাই তিনি মাদকাসক্তিবিরোধী প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দেন। কেউ কেউ আবার দানগ্রহীতাদের কল্যাণে আনন্দ লাভ করেন। আবার অনেকে দান করেন এই ভেবে যে, অন্যরা যখন দান করছে তখন নিশ্চয়ই তাতে কোন না কোন ফায়দা রয়েছে। তৃতীয় মতবাদ হচ্ছে, দাতারা শিল্পোন্নত দেশসমূহে করের সুবিধা লাভের জন্য দান-খয়রাত করেন। বেশিরভাগ দেশেই আয়কর আইনে দান-খয়রাতের জন্য কর-অব্যাহতি দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এ ধরনের কর-অব্যাহতি দান-খয়রাতের জন্য কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে সন্দেহ আছে। যদি করের হার বেড়ে যায় তবে দান-খয়রাত বাড়ালে কর-অব্যাহতির পরিমাণ বাড়ে। অন্যদিকে করের হার বাড়লে ব্যক্তির আয় হ্রাস পায়, এর ফলে দান-খয়রাত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই দান-খয়রাতের উপর করের প্রভাব সব সময়ে সুনিশ্চিত নয়। উপরোক্ত তিনটি মতবাদের পক্ষেই বাস্তব (empirical) প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু পরার্থপরতার মৌল প্রণোদনা সম্পর্কে কোন সরলীকরণ সম্ভব নয়। পরার্থপরতা এখনও আমাদের কাছে ধর্মীয় ও বৈষয়িক প্রেষণার এক আলো-ছায়ার জগৎ।
কি ধরনের দান-খয়রাত গ্রহীতার জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর সে সম্পর্কে তাত্ত্বিক গবেষণা এখনও সীমিত। দান-খয়রাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, যারা দান-খয়রাতের উপযুক্ত নয় তারা দান-খয়রাতের সিংহভাগ নিয়ে যায়, অথচ যারা দান-খয়রাতের উপযুক্ত তারা কিছুই পায় না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা দান-খয়রাত করে তারা যথাযথ যত্ন নিলে এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এটাই সবচেয়ে জটিল কাজ। এ সমস্যা জাতীয় পর্যায়ে যেমন রয়েছে তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও রয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যদাতাদের একটি বড় নালিশ হলো যে, দারিদ্র্য নিরসনের জন্য যে সাহায্য তারা দিচ্ছে তা দরিদ্রদের কাছে পৌঁছচ্ছে না। উন্নত দেশসমূহে বৈদেশিক সাহায্যের সমালোচকরা তাই বলে থাকেন যে, বৈদেশিক সাহায্যের জন্য প্রদত্ত উন্নত দেশের গরীব করদাতাদের অর্থ দরিদ্র দেশের বড় লোকেরা তছরুপ করছে। দান—খয়রাতের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন এমন ব্যবস্থা যাতে সাহায্য উপযুক্ত লোকদের কাছে পৌঁছে।
ত্রাণসামগ্রীর আত্মসাৎ দু’ভাবে হ্রাস করা যেতে পারে। প্রথমত, প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে যারা ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার উপযুক্ত নয় তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তিরা যাতে ত্রাণসামগ্রী না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য দানগ্রহীতাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রয়োজন। বাইরের কোন প্রশাসনের পক্ষে এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ ব্যয়বহুল। বাইরের প্রশাসনকে তথ্য সংগ্রহের জন্য স্থানীয় মাতব্বরদের উপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় মাতব্বররা ইচ্ছে করে ত্রাণসামগ্রী তছরুপ করার চেষ্টা করে। তবে স্থানীয় মাতব্বরদের বাদ দিলে বেতনভোগী কর্মচারিদের দ্বারা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ সম্ভব। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে বেতনভোগী কর্মচারিরাও কম দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তাই তাত্ত্বিকভাবে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় খয়রাতি মালের তছরুপ হ্রাস করা সম্ভব হলেও বাস্তবে তা সব সময় হয়ে ওঠে না।
দ্বিতীয়ত, গরীবদের উপকার করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পন্থা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয়, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হল বাজারভিত্তিক সমাধান। দান-খয়রাতের প্রকৃতি এমন হতে হবে যে, তা গরীবদের কাজে লাগবে, অথচ তা বড়লোকদের আকৃষ্ট করবে না। অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে তিন ধরনের পণ্য রয়েছে : বিলাস দ্রব্য (luxury), স্বাভাবিক পণ্য (normal goods), এবং নিকৃষ্ট পণ্য (inferior goods)। বিলাস দ্রব্য শুধু বড়লোকরা ভোগ করে। লোকের আয় বাড়লে যে পণ্যের চাহিদা বাড়ে তা হল স্বাভাবিক পণ্য। লোকের আয় বাড়লে যে পণ্যের চাহিদা কমে তাকে বলে নিকৃষ্ট পণ্য। নিকৃষ্ট পণ্য তাই শুধু গরীবদের ভোগে লাগে। গরীবদের আয় বেড়ে গেলে তাদেরও নিকৃষ্ট পণ্যের জন্য চাহিদা কমে যায়।
নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিত্তবানরা যে পণ্য ভোগ করে সেই পণ্যই দীনদরিদ্রদের দান করা উচিত। দরিদ্রদের নিকৃষ্ট পণ্য দান করা নিষ্ঠুর মনে হতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক পণ্য দান করলে দেখা যায় যে যারা ত্রাণ পাওয়ার উপযুক্ত নয় তারাও এ পণ্য আত্মসাতের জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে নিকৃষ্ট পণ্য দান করলে বিত্তবানরা এ পণ্যের জন্য গরীবদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে উৎসাহিত বোধ করে না। বাংলাদেশের খাদ্যশস্য সাহায্য সম্পর্কে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি সংক্রান্ত গবেষণা পরিষদের (IFPRI) সমীক্ষা এ অনুমান সমর্থন করে।[৫] বাংলাদেশে পল্লী অঞ্চলে গম একটি নিকৃষ্ট পণ্য। তাই ত্রাণসামগ্রী হিসাবে গম বিতরণ করলে তা গরীবদের কাছে অনেক সহজে পৌঁছে। কিন্তু চাল একটি স্বাভাবিক পণ্য। চাল বিতরণ করলে গরীবদের চাল বিত্তবানরা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে। এ অভিজ্ঞতা থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, নিকৃষ্ট পণ্য দান করলে গরীবরা বেশি উপকৃত হয়। গরীবদের বেশি উপকার করতে চাইলে গরীবরা লাভবান হয় না। এমন পণ্য বিতরণ করতে হবে যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্যগোষ্ঠীতে পৌঁছার প্রবণতা রয়েছে। লেডিজ সু কিংবা বাটার অয়েল ত্রাণসামগ্রী হিসাবে দিলে তা গরীবদের কাছে পৌঁছবে না, তা বিত্তবানরা আত্মসাৎ করবে। নগদ টাকা দিলে তছরুপের পরিমাণ আরও বাড়বে। নগদ অর্থের চেয়ে স্বাভাবিক পণ্য সাহায্য হিসাবে গরীবদের জন্য অধিকতর উপযোগী, তার চেয়েও বেশি উপকারী হল নিকৃষ্ট পণ্য দান
ত্রাণের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য, ভর্তুকির ক্ষেত্রেও তা সত্য। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, কৃষিঋণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, যেখানে কৃষিঋণের সুদের হার কম সেখানে ঋণ গরীবদের কাছে পৌঁছে না। এ ধরনের ঋণের সিংহভাগ আত্মসাৎ করে বড়লোকেরা। যে সব ঋণে সুদের হার বেশি সেখানে বিত্তবানরা ভিড় জমায় না। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, সরকারী ব্যাংক কর্তৃক সহজ শর্তে প্রদত্ত ঋণ আদায় হয় না, কিন্তু বেসরকারী সংস্থা কর্তৃক উচুঁ সুদের ঋণ ঠিকই পরিশোধিত হয়। গরীব লোকরা আইন কানুনকে ভয় পায়। তারা ঋণ পরিশোধ করে। বিত্তবানরা জানে তাদের সাত খুন মাফ; তারা ঋণ পরিশোধ করে না।
ভর্তুকি দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তা গরীবদের ভোগে না লেগে ধনীদের আরো ধনী করে তোলে। কোন সরকারের পক্ষেই ভর্তুকির জন্য অঢেল সম্পদ বরাদ্দ করা সম্ভব হয় না। সীমিত ভর্তুকির জন্য তাই বিত্তবান ও গরীবদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। এ প্রতিযোগিতায় গরীবরা টিকে থাকতে পারে না। তাই গরীবদের জন্য উচ্চ হারে ভর্তুকি দিতে গিয়ে গরীবদের অপকার করার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক দল জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য ভর্তুকি বাড়িয়ে সারের দাম কমায়। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বাড়ার ফলে প্রচুর সার প্রতিবেশী দেশে চোরাচালান হয়ে যায়। ফলে দেশে সার-সংকট দেখা দেয়। সারের জন্য কৃষকদের রক্তাক্ত আন্দোলন রাজনৈতিক দলটির জন্য নির্বাচনে একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। গরীব চাষীরা সাহায্য চায় না। ন্যায্য মূল্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ যথাসময়ে পেলেই তারা খুশি। গরীবরা অল্পেই তুষ্ট হয়। বড়লোকদের মত তাদের ক্ষুধা সর্বগ্রাসী নয়।
দান-খয়রাত কিভাবে কার্যকর করা যায়, সে সম্পর্কে অর্থনৈতিক গবেষণা নতুন হলেও অর্থনীতির জন্মলগ্ন হতেই সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির উপর দান-খয়রাতের প্রভাব নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ বিতর্কের জন্ম আঠার শতকের ইংল্যান্ডে। রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় হতে ইংল্যান্ডে গরীব আইন (poor law) চালু ছিল। এই আইনের বিধান ছিল যে, স্থানীয়-সরকারসমূহ তাদের আয় থেকে গরীবদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে। আঠার শতকে ধ্রুপদী (classical) অর্থনীতিবিদ্ ম্যালথুস এই আইনের কুফলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ম্যালথুসের মতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গরীবদের সাহায্য করার ব্যবস্থা তাদের রাষ্ট্রের উপর আরও নির্ভরশীল করে তোলে। সাহায্যপ্রাপ্ত গরীবরা কাজ করে না। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয় সাহায্যের উপর নির্ভর করে তারা বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। এর ফলে জনসংখ্যা বেড়ে যায়। গরীবদের সন্তান সন্ততিরা দান-খয়রাতের উপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একই যুক্তিতে ডেভিড রিকার্ডো গরীবদের স্থানীয় সরকার থেকে সাহায্য দেওয়ার প্রথা তুলে দেওয়ার দাবি জানান। তাদের সাথে একমত হন হিতবাদী (utilitarian) দার্শনিক জেমস মিল।
গরীব আইন সংশোধনে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডুমন্ড অধ্যাপক (যে পদ পরবর্তীকালে অমর্ত্য সেন অলংকৃত করেছেন) সিনিয়র (Senior)-এর। ১৮৩৪ সালে গরীব আইন সংশোধন করে নগদ সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। নতুন আইনে সাহায্যের যোগ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়। গরীবদের সাহায্য করার জন্য কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের সংস্কার ইংল্যান্ডে প্রচণ্ড বিতর্কের সৃষ্টি করে। যদিও তৎকালীন অর্থনীতিবিদ্গণ এ ধরনের সংস্কারের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু সাংবাদিক ও সাহিত্যিকগণ এ ধরনের সংস্কারকে অমানবিক বলে আখ্যায়িত করেন। দরিদ্র আইন সংস্কারের বিপক্ষে ছিলেন লন্ডনের টাইমস পত্রিকা এবং বিখ্যাত ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স। শেষ পর্যন্ত এ লড়াইয়ে প্ৰথম পর্যায়ে অর্থনীতিবিদ্গণই জয়যুক্ত হয়।
অবশ্য ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদ্গণের এ বিজয় ছিল ক্ষণস্থায়ী। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আবার নতুন করে গরীবদের সাহায্য করার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ শুরু হয়। এ উদ্যোগ অবশ্য অগ্নিগর্ভ সমাজতান্ত্রিক নেতাদের কাছ থেকে আসেনি, বরং বাস্তববাদী রক্ষণশীল নেতারা ছিলেন এ ধারার সারথি। ১৮৮০-এর দশকে জার্মানিতে প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করেন অটো ফন বিসমার্ক–যিনি ছিলেন অতি রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থী রাজনীতিবিদ্। শ্রমিকদের জন্য দুর্ঘটনা, অসুস্থতা ও বার্ধক্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বীমার ব্যবস্থা তিনি প্রথম প্রচলন করেন। বিশ শতকের প্রথম দিকে যুক্তরাজ্যে সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাতে নেতৃত্ব দেন রক্ষণশীল নেতা উইনস্টন চার্চিল। ক্রমে এ ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার জাল হয়েছে অনেক বেশি সম্প্রসারিত। এ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার পুরোধা বুনো-চোখো ও অনলবর্ষী বামপন্থীরা ছিল না। ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিবিপ্লবী ব্যবস্থার এ জাল বিছিয়েছিলেন বিসমার্ক আর চার্চিলের মত অতিদক্ষিণপন্থী নেতারা।
সামাজিক নিরাপত্তার বিতর্কে রাজনৈতিক আবেগের কাছে অর্থনৈতিক যুক্তি হেরে যায়। কিন্তু এতে বাস্তবতার কোন পরিবর্তন হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদ্গণ গরীবদের সাহায্যের কুফল সম্পর্কে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তা আজও সত্য। সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পেলে দরিদ্ররা চাকুরি খোঁজার চেষ্টা ছেড়ে দেয়। ক্রমবর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠী সরকারী খয়রাতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সরকারী খয়রাত ব্যবস্থায় দেখা দেয় নানা দুর্নীতি। একদিকে অযোগ্য আমলাতন্ত্র দিন দিন স্ফীত হতে থাকে, অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচীকে অপব্যবহার করে অনেকে বিলাস—বহুল জীবন ধারণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুঃখ করে বলা হয়, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য উঁচু হারে আরোপিত করের ফলে যে সব গরীব লোক কাজ করে হালাল জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করে, তাদের গ্রাসাচ্ছাদনই শক্ত হয়ে পড়ে। আর যারা কাজ না করে সরকারী সাহায্যের উপর নির্ভরশীল তারা ঢাউস ক্যাডিলাক গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়।
সামাজিক নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আর্থিক। এর ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। যতই ব্যয় বাড়বে ততই সরকারের কর বাড়াতে হবে। কর বাড়লে, যারা কাজ করে তাদের আয় কমতে থাকবে। তাই যারা কাজ করে, তাদের কর্মস্পৃহা কমে যাবে। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে; অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে। তাই সামাজিক নিরাপত্তার জন্য নতুন সম্পদের যোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তার ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হচ্ছে না। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাতে আমলারা করদাতাদের অর্থে দানগ্রহীতাদের উপকার করে। এ ব্যবস্থায় ব্যয় হ্রাসের কোন তাগাদা নেই। তাই বিশ্বব্যাপী আজ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য তোড়জোড় চলছে। সবাই চায় সমাজের উপর দরিদ্রদের নির্ভরশীলতা কমাতে। দান-খয়রাত নয় বরং সকলেই যাতে কাজ করে খেতে পারে এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই সামাজিক নিরাপত্তার মূল লক্ষ্য।
দান-খয়রাতের মৌলিক তাগাদা পরার্থপরতা হতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক মৌল উপাদানসমূহ অস্বীকার করে দান-খয়রাত ফলপ্রসূ হয় না। গরীবের ভাল করার ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়। এমনভাবে ভাল করতে হবে যাতে গরীবরা উপকৃত হয়। এ কাজ শুধু আবেগের ভিত্তিতে করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা। বাজারের অদৃশ্য হাতকে অগ্রাহ্য করে যে নীতি প্রণীত হয় তার সাফল্যের সম্ভাবনা অত্যন্ত সীমিত। বাজার-অর্থনীতির তিনটি অনুশাসন কখনও ভুলে গেলে চলবে না। প্রথমত, গরীবদের এমন সাহায্য দেওয়া সঠিক হবে না যা তাদের কাজ করতে নিরুৎসাহিত করবে। এ ধরনের ব্যবস্থা টেকসই হবে না। যে সমাজে অলসতা পুরস্কৃত হয় সে সমাজে সবাই ফাঁকি দিতে চাইবে। দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজে বিত্তবানদের আধিপত্য রয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত গরীবদের জন্য নিকৃষ্ট পণ্য ত্রাণসামগ্রী হিসাবে অধিকতর উপযোগী হবে। নিকৃষ্ট পণ্য গরীবদের ক্ষুধা মেটায় অথচ ধনীদের আকর্ষণ করে না। তৃতীয়ত, গরীবদের কর্মসূচী সমাজের অন্যান্য কর্মসূচী হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে হবে। সকলের জন্য অভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করলে গরীবরা তার সুফল পাবে না। ডক্টর ইউনূস তাঁর আত্মজীবনীতে এ কথা সুন্দরভাবে বলেছেন[৬]:
Like good old Gresham’s law, it is wise to remember that in the world of development if one mixes the poor and the non-poor within a programme, the non-poor will always drive out the poor, and the less poor will drive out the more poor, and this may continue ad infinitum unless one takes protective measures right at the beginning. And what will happen is that in the name of the poor, the non-poor will reap the benefits.
(গ্রেশামের সনাতন বিধির মত এটি মনে রাখা ভাল যে, উন্নয়নের জগতে একই কর্মসূচীতে যদি গরীবদের সাথে যারা গরীব নয় তাদের একত্রিত করা হয়, তবে যারা দরিদ্র নয় তারা দরিদ্রদের এবং যারা দরিদ্র তারা হতদরিদ্রদের বঞ্চিত করবে এবং এ পরিস্থিতি অনির্দিষ্টভাবে চলতেই থাকবে যদি প্রথমেই উপশমমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়। যা ঘটবে তা হল গরীবদের নামে যারা গরীব নয় তারা সকল সুবিধা ভোগ করবে)।
দু’শ বছর আগে স্যামুয়েল জনসন লিখেছেন, “The road to hell is paved with good intentions”[৭] (দোজখের সড়ক সদিচ্ছা দিয়ে বাঁধানো)। দান-দক্ষিণার জন্য হামলার সম্মুখীন হওয়ার আগে এ আপ্তবাক্যের অর্থ আমি পুরোপুরি বুঝতাম না। আজ বুঝতে পারি যে, বেশি ভাল করতে গেলেও অকল্যাণ ডেকে আনা সম্ভব।
প্রাচীন গ্রীসে একটি পবিত্র স্থান ছিল ডেলফি নগরের ভবিষ্যদ্বাণীর মন্দির। এ মন্দিরের ফটকে মূলমন্ত্র লিপিবদ্ধ ছিল “meden agan” – “কোন কিছুতেই বাড়াবাড়ি করবে না”।[৮] এ সত্য সম্রাট হর্ষবর্ধনের পরার্থপরতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। দার্শনিক বেকনের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। আজকের দিনেও এ সত্য সমভাবে বলবৎ আছে। অর্থনীতির মৌলিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে টেকসই পরার্থপরতা সম্ভব নয়।
.
তথ্যসূত্র
১. উদ্ধৃত, Webster’s Compact Dictionary of Quotations (Merriam—Webster, 1992), p. 44
২. Smith, Adam, An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations—a Selected Edition, Sutherland, Kathryn, ed., (Oxford: Oxford University Press, 1993), Book-I, chapter II, p. 22
৩. . Rose-Ackerman, Susan, “Altruism, Nonprofits and Economic Theory”, Journal of Economic Literature, June 1996, vol. XXXIV. No. 2. pp. 701-729
8. প্রাগুক্ত
৫. Ahmed, Raisuddin, et al, Out of the Shadow of Famine: Evolving Food Markets and Food Policy in Bangladesh (Washington : IFPRI, 1998)
৬. Yunus, Muhammad, Banker to the Poor (Dhaka: University Press Ltd. 1999), p. 72
৭., Peter, Laurence, J., Peter’s Quotations (New York: Quill 1977), p. 243
৮. Durant, Will, The Life of Greece (New York: Simon and Schuter, 1966), p. 118