পরাণের ঘোড়া
ঘোড়ার মতো জিনিস হয় না। দেখতে যেমন বাহারের, ক্ষ্যামতাও তেমনি দশ মুখে বলার মতো। পরাণ সেই ছেলেবেলা থেকে ঘোড়া দেখে আসছে। তার বাবা গড়ান মণ্ডল ছিল শশীবাবুর আস্তাবলের ছোটো সহিস। মস্ত জমিদার শশীবাবুর ভারি ঘোড়ার শখ। মেলা টাকা খরচ করে দিগ—বিদিগ থেকে ঘোড়া কিনে আনতেন। মোট এগারোখানা ঘোড়া ছিল তাঁর। দুঃখের বিষয় মোটা মানুষ বলে শশীবাবু ঘোড়ায় চাপতে পারতেন না। তাঁর ছিল দেখেই সুখ। পরাণেরও তাই। মাঝে মাঝে বাবার কাছে ঘোড়ায় চাপবার আবদার করত ঠিকই, কিন্তু বাপ গড়ান ভয় খেয়ে বলত, পাগল হয়েছিস! শশীবাবুর ঘোড়ার পিঠে তোকে চাপালে রক্ষে আছে? তদ্দণ্ডে আমার চাকরিটা যাবে।
সেই ইচ্ছে মনে মনে পুষে রেখেই বড়ো হল পরাণ। আর বড়ো হয়ে সেও তার বাপের মতোই গরিব হল। পয়সা মোটেই হচ্ছিল না তার। তবে ঠিক করে রেখেছিল, পয়সা যদি কোনোদিন হয় তবে আর কিছু নয়, নিজের জন্য একটা ঘোড়া কিনবে।
তা ঘোড়া হল না পরাণের। গন্ধেশ্বর দাসের খেতে মজুর খেটে দিন গুজরান হয় তার। অসুরের মতো খাটুনি বটে, তবে পরাণ বিয়ে—থাওয়া করেনি বলে চলে যায়। এখন তার বাতিক হয়েছে ছুটি হলেই কাগজ—কলম—পেনসিল বা সস্তায় কেনা রঙের কাঠি দিয়ে ঘোড়ার ছবি আঁকা। আঁকা শেখেনি কারও কাছে। কিন্তু তাতে কী, কাউকে দেখানোর জন্য তো নয়, নিজের জন্যই সে অখণ্ড মন দিয়ে নানা ধরনের ভঙ্গিতে ঘোড়ার ছবি আঁকার চেষ্টা করে যায়। ওইটেই তার নেশা। ফুলবাড়ির হাটে একটা লোক মাঝে মাঝে পটের ছবি বিক্রি করতে আসে। তার কাছে রঙ—তুলিও পাওয়া যায়। আর ছবি আঁকার ভুষো কাগজও। পয়সা খরচ করে সেই রঙ কিনে আনল একদিন। দেখল তুলি দিয়ে আঁকার আরও সুবিধে। প্রথমটায় মাপটাতে একটু অসুবিধে হয় বটে, তবে কিছুদিনের চেষ্টায় দেখল ব্যাপারটা মোটেই শক্ত নয়। সারাদিন খেতের কাজ করে সন্ধেবেলা এসে পরাণ ছবি আঁকতে বসে যায়। নিজে আঁকে, নিজেই দেখে। তারপর একটু—আধটু শুধরোতেও হয়।
ফুলবাড়ির হাটের পটুয়া হরিরাম তার ছবি আঁকার শখ দেখে বলল, চট বা ক্যানভাসে আঁকলে তা বহুদিন টিকবে, বলে কয়েকখানা ছবি আঁকার ছোটো ক্যানভাস তাকে বেজায় সস্তাতেই দিয়ে দিল।
এদিকে গন্ধেশ্বর একদিন তাকে ডেকে বলল, দ্যাখ বাপু, তুই বেশ গায়ে—গতরে আছিস। আমি কেরামতের বাঁধের ধারের জমিটা রেজিস্ট্রি করতে গঞ্জে যাচ্ছি। সঙ্গে টাকা থাকবে। চলনদার হিসেবে তুই সঙ্গে যাবি। দিনকাল ভালো নয়।
রাজি না হয়ে উপায় কী? একখানা মজবুত লাঠি কাঁধে নিয়ে গন্ধেশ্বরকে পাহারা দিয়ে গঞ্জে নিয়ে যাচ্ছিল পরাণ, পীরপুর শ্মশানের ধারে যখন গোরুর গাড়ি পৌঁছেছে তখনই আশপাশের বাঁশঝাড় থেকে জনা পাঁচ—সাত লেঠেল ডাকাত বেরিয়ে এসে চড়াও হল।
পরাণ গায়ে—গতরে লম্বায়—চওড়ায় বেশ জোয়ান বটে তবে তেমন বীর নয়। জীবনে মারপিট করেনি। আদতে সে নিরীহ মানুষ। তাই ডাকাতদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ্যই তার ছিল না। তবে আর কিছু না পারুক গন্ধেশ্বরকে সে আগলে রেখেছিল। বলেও ছিল, টাকার বটুয়াটা ছেড়ে দেন কর্তা। টাকা তো আর প্রাণের চেয়ে বড়ো নয়। কিন্তু গন্ধেশ্বরের কাছে তা নয়, টাকাই তার জানপ্রাণ। ফলে ধুমধাড়াক্কা লাঠিপেটা খেতে হল তাকে। গন্ধেশ্বরের চেয়েও পিটুনি অনেক বেশি খেতে হল পরাণকে। কাঁকালে চোট, মাথায় চোট, কনুইয়ের চোট।
কয়েক লহমায় লুটপাট সেরে ডাকাতরা হাওয়া হওয়ার পর গাঁয়ের লোক এসে তাদের জল—টল দেয়, নিয়ে গিয়ে দাওয়াতে বসায়। টাকার শোকে খুব কান্নাকাটি জুড়েছিল গন্ধেশ্বর। তারা নানা সান্ত্বনাবাক্যে তাকে ঠান্ডা করল। বাড়ি ফিরে গায়ের ব্যথা আর টাকার শোকে শয্যা নিল গন্ধেশ্বর। আর পরাণ রাত্তিরবেলাতেই তার লণ্ঠন জ্বেলে বসে গেল ছবি আঁকতে। তবে ঘোড়ার নয়, আজ যারা হামলা করেছিল তাদের মধ্যে দু—জনের মুখ তার মনে গেঁথে আছে। ছবিতে মুখ দুটো ফোটানো যায় কিনা সেটাই দেখছিল পরাণ, এবং দেখল, ছবি দুটো প্রায় হুবহু হয়েছে।
ডাকসাইটে দারোগা অনাদি সরখেল ডাকাতির তদন্তে এসে গন্ধেশ্বর আর পরাণকে মেলা জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। চেহারার বর্ণনা চাওয়াতে পরাণ তার আঁকা ছবি দুটো এনে দেখাতেই দারোগাবাবু লাফিয়ে উঠে বললেন, এ তো ধামাল আর ধানুকা! বিস্তর কেস আছে এদের নামে!
তিন দিনের মাথায় ডাকাতদের পাঁচ—সাতজন ধরা পড়লে গন্ধেশ্বরের তিন লাখ টাকার দু—লাখ উদ্ধারও হয়ে গেল। অনাদি সরখেল কঠিন মানুষ হলেও রসকষহীন নন। তিনি পরাণকে একদিন থানায় ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তুই কি ছবি আঁকিস নাকি?
পরাণ ছবি আঁকাটা অপরাধ কিনা বুঝতে না পেরে খুব ভয়ে ভয়ে বলল, ওই একটু—আধটু মকসো করি আর কী। মাপ করে দেন গুজুর।
অনাদি গম্ভীর গলায় বললেন, মাপ করার কিছু নেই। ছবি আঁকা খারাপ কাজ তো নয় রে আহাম্মক। তোর আঁকার হাত তো দিব্যি ভালো। কার কাছে শিখিস?
পরাণ হাত কচলে বলে, গরিব মানুষ হুজুর, কার কাছে শিখব? নিজেই একটু—আধটু চেষ্টা করি।
হবিবপুরে সুধীরবাবুর সঙ্গে দেখা করিস। সমঝদার মানুষ। আমি বলে রাখবখন।
সুধীরবাবু তাঁর আঁকা দেখে ভারি অবাক হয়ে বললেন, না শিখেই যা এঁকেছিস তাইতেই তো তাজ্জব হতে হয়। তা শুধু ঘোড়ার ছবি কেন রে? আর কিছু আঁকিস না?
আজ্ঞে আমার ছেলেবেলা থেকেই বড্ড ঘোড়ার শখ। আর ঘোড়ার জন্যই আঁকি। নইলে আঁকার তেমন ইচ্ছে আমার হয়নি কখনো।
তা আঁকার বিষয় হিসেবে ঘোড়াও কিছু খারাপ নয়। তবে অন্য বিষয়েও একটু আঁকিবুকি করলে ভালো হবে তোর। দুনিয়ায় ঘোড়া ছাড়াও কত কিছু আছে।
তা আছে। তবে পরাণের মনপ্রাণ জুড়ে কেবল ঘোড়াই লাফিয়ে—দাপিয়ে বেড়ায়। তা সে অবাধ্য হল না। সুধীরবাবুর কাছে মাঝে মাঝে গিয়ে নানা বিষয়ে ছবি আঁকার তালিম নিতে লাগল।
একদিন গিয়ে দেখে সুধীরবাবুর বাড়ির সামনে একখানা চকচকে মোটরগাড়ি দাঁড়ানো। একজন বেশ বড়োলোকি চেহারার ফর্সামতো মানুষ চেয়ারে বসা। আর সুধীরবাবু তাঁকে পরাণের ছবিগুলো দেখাচ্ছেন। তাকে দেখিয়ে সুধীরবাবু বললেন, এই এরই আঁকা। এর নাম পরাণ মণ্ডল। হাসির কথা হল এ ছেলেটার খুব ঘোড়ার শখ। পয়সা পেলে নাকি প্রথমেই একটা ঘোড়া কিনবে।
শুনে লোকটা একটু হাসল আর পরাণ খুব লজ্জা পেল।
লোকটা খানিকক্ষণ ছবিগুলো খুব মন দিয়ে দেখে হঠাৎ মুখ তুলে পরাণকেই জিজ্ঞেস করল, একটা ঘোড়ার দাম কত?
শুনে হাঁ করে রইল পরাণ। ঘোড়ার শখ তার আছে বটে, কিন্তু দরদাম সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। সে মাথা—টাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে, সেসব তো জানা নেই।
লোকটা ফের হেসে বলল, ঘোড়া কিনলেই তো হবে না, তার দানাপানির জোগাড় চাই, অসুখ হলে চিকিৎসা করানো চাই, যত্ন—আত্তি চাই।
অতসব কী পরাণ জানে? সে শুধু জানে, ঘোড়া টগবগ করে ছোটে, চিঁহিঁ বলে লাফায়, চামরের মতো লেজে ঝাপটা মেরে বাহার দেখায়। সে বলল, যে আজ্ঞে।
তোমার পাঁচটা ছবি আমার পছন্দ হয়েছে। এই নাও দাম।
বলে লোকটা পরাণকে একগোছা টাকা দিল, বেশ অনেক টাকা। হাতে পেয়ে পরাণের হাঁ—মুখ আর বন্ধ হয় না। তার হাবিজাবি ছবিরও যে একটা দাম হতে পারে এ সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে হাতজোড় করে বলল, ও ছবি আপনি এমনিই নিয়ে যান, টাকা দিতে হবে না আজ্ঞে। এ যে অনেক টাকা।
লোকটা স্মিতমুখে বলে, টাকা পেয়ে ঘাবড়ে যেয়ো না হে। তোমার অনেক টাকা হবে। তোমার ভিতরে যে মালমশলা আছে তা ভগবানের দেওয়া। দামটাও সেই জন্যই। সকলের কী আর ওসব মালমশলা থাকে?
তা পরাণের অবাক ভাবটা অনেকক্ষণ চেপে রইল তার ভোম্বল মাথায়। দুটো দিন কাজে কামাই দিয়ে উড়ু উড়ু মন নিয়ে মাঠে—ঘাটে ঘুরে বেড়াল সে। ব্যাপারটা এখনও সে তার বোকা মাথা দিয়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
সুধীরবাবু তাকে ডেকে বললেন, মজুরবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে ছবি নিয়ে পড়ে থাক। ও ছোটো কাজের আর তো দরকার নেই তোর। ডালভাতের অভাব না হলেই হল।
কাজ ছাড়ার কথা বলতে যেতেই গন্ধেশ্বর হাউরে মাউরে করে তেড়ে এ কাজ ছাড়বি মানে? ছাড়লেই হল? আমার তাহলে চলবে কী করে? আর তুই—ই খাবি কী?
পরাণ বলল, আজ্ঞে আমার অন্য উপায় হয়েছে। আর ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হবে না, মজুর অনেক পাবেন।
গন্ধেশ্বর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। চোখে জল। বলল, তা জানি। কিন্তু তোর সঙ্গে যে আমি আমার মেয়ে ফুলির বে দেবো বলে ঠিক করে রেখেছি।
পরাণ তিন হাত পিছিয়ে গিয়ে জিব কেটে বলে, বিয়ে! ও বাবা, ওর মধ্যে আমি নেই। বউ বড়ো ঝামেলার জিনিস। তার ওপর ফুলি! সে পয়সাওলা বাপের আদুরে মেয়ে, আমাকে মানুষ বলেই গণ্য করবে না।
গন্ধেশ্বর হাপুস নয়নে বলে, তা তুই কী পাত্তর খারাপ! সেই যে ডাকাতের হাত থেকে আমার প্রাণরক্ষে করতে মার খেয়েছিলি সেই থেকে তোকে এ বাড়ির সকলের পছন্দ। ফুলিরও ভারি ইচ্ছে।
পরাণ সবেগে মাথা নেড়ে বলে, সে হয় না।
গন্ধেশ্বর ফুঁসে উঠে বলে, দারোগাবাবুরও ইচ্ছে।
পরাণ ভারি মুশকিলে পড়ে গেল। দারোগাবাবু অনাদি সরখেল ভারি ভালো চোখে দেখেন তাকে। তাঁর অবাধ্য হওয়াটা কাজের কথা নয়।
গন্ধেশ্বর বলল, ওরে শোন, বিয়েতে আমি তোকে একটা ভালো ঘোড়া কিনে দেব বলে ঠিক করেই রেখেছি। তোর যে ভারি ঘোড়ার শখ সে কথা সবাই জানে কিনা।
পরাণ একটু হাঁ করে থেকে ঢোঁক গিলে বলল, তবে আর কথা কীসের? তা পরাণের এখন বউ হয়েছে, একটা শাঁসালো শ্বশুরবাড়ি হয়েছে, বেশ কিছু টাকাও হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড়ো কথা তার এখন একটা টগবগে, তেজি, দৌড়বাজ এবং দুষ্টু ঘোড়াও হয়েছে।