পরাজিত জর্মনি

পরাজিত জর্মনি

০১.

জর্মনি হারিয়া গিয়াছে। দুঃস্বপ্ন কাটিয়াছে। সমর-নেতারা যুদ্ধের দুশ্চিন্তা ত্যাগ করিয়া আবার কুচকাওয়াজের সত্যযুগে ফিরিয়া যাইবার তালে পা ফেলিবার চেষ্টায় আছেন।

কিন্তু রাজনৈতিকদের দুশ্চিন্তার অবসান হইল না। বরঞ্চ এতদিন যে মাথাব্যথা শুদ্ধ সামরিক মাথাকে গরম করিয়া রাখিয়াছিল সে আজ রাজনৈতিকদের আহার ও নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাইতেছে। সমস্যাটা এই, পরাজিত জর্মনিকে লইয়া কী করা যায়।

১৯১৮ সালে এ সমস্যা ছিল না। নিবীর্য রুশ তখন নিজের গৃহসমস্যা লইয়া ব্যস্ত। জর্মনি সম্বন্ধে সে তখন সম্পূর্ণ উদাসীন। ১৯৪৫ সালে অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রুশ জর্মনিকে লইয়া কী ভেল্কিবাজি খেলিবে, তাহা মিত্রশক্তির কর্তারা ঠিক আঁটিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। অথচ দাবা খেলায় অন্য পক্ষের চালের জন্য যেরকম অবিচলিত চিত্তে বসিয়া থাকা যায় এস্থলে তাহা সম্ভবপর নয়।

জর্মনিকে মিত্রপক্ষের কোন চণ্ডীমণ্ডপের সম্মুখে বলি দিবেন আর রুশরা কোন দর্গায় সিন্নি চড়াইবেন সে বিষয়ে আমাদের দুর্ভাবনা নাই। কারণ প্রসাদ আমরা পাইব না, পাইবার ইচ্ছাও রাখি না। কিন্তু ঠিক এই কারণেই আমাদের এ বিষয়ে কিছু বলা নিতান্ত অশোভনীয় হইবে না। জর্মনি সম্বন্ধেই এযাবৎ যে কেতাবপত্র বাহির হইয়াছে ও হইতেছে, খবরের কাগজে যে বত্রিশভাজার পরিবেশন হইতেছে তাহা হইতে ইহাই প্রমাণ হয়– সকলেরই কিছু-না-কিছু স্বার্থ আছে। আমরা নিঃস্বার্থ, আমাদের মতামতে তাই কিঞ্চিৎ নিরপেক্ষতা থাকিবে, আর কিছু না থাকুক।

গোড়াতেই বলিয়া রাখা ভালো যে, জর্মনি বিশেষ করিয়া পরাজিত জৰ্মনি আমাদের শত্রু নয়, মিত্রও নয়। তবে নাৎসিদের আমরা চিরকালই অপছন্দ করিয়াছি। তাহার অন্যতম কারণ নাৎসিরা গায়ে পড়িয়া বহুবার ভারতবর্ষ ও তাহার সভ্যতার প্রতি কটুক্তি করিয়াছে। তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ রজেনবের্গ সাহেবের বিংশ শতাব্দীর মিথ নামক কেতাবে বিস্তর পাওয়া যায়। রজেনবের্গ সাহেবের পরিচয় বিশদভাবে দিবার প্রয়োজন নাই। হিটলার তাঁহাকে জর্মনির আধ্যাত্মিক গুরু (গাইসটস ফুরার) বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন।

রজেনবের্গ সাহেব প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন যে, পৃথিবীর সভ্যতা ও কৃষ্টিতে বৃহত্তম দান করিয়াছে, (ক) আর্যরা, (খ) আর্যদের মধ্যে আর্যতম আর্য হইলেন নীল চোখওয়ালা, সোনালি চুলওয়ালা নর্দিক জর্মনরা।

প্রথম তথ্য সম্বন্ধে রজেনবের্গ সাহেবের মনে কোনও সন্দেহ নাই, কারণ রজেনবের্গের বহু পূর্বে ভিয়েনার খ্যাতনামা পণ্ডিত লেওপল্ড ফন শ্লোডার বহু যুক্তি-তর্ক দ্বারা প্রায় সপ্রমাণ করিয়া গিয়াছেন যে, আর্যরা সেমাইট (ইহুদি ও আরব) ও মঙ্গলীয়দের চেয়ে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ।

কিন্তু নর্দিক জর্মনরাই যে সর্বোকৃষ্ট আর্য এ বিষয়ে রজেনবের্গের মনে ধোকা ছিল। কারণ আর্যসভ্যতা লইয়া যাহারা লম্ফঝম্ফ করেন তাহাদের প্রথমেই খবর লইতে হয় আর্যের ইতিহাস কোথায় পাওয়া যায়। আর সে অনুসন্ধান করিতে গেলেই স্বেচ্ছায় হউক, অনিচ্ছায় হউক, ভারতবর্ষের আর্যদের দ্বারস্থ হইতে হয়। কারণ ইউরোপীয় আর্যদের মাথার মণি গ্রিক সভ্যতার গোড়াপত্তনের পূর্বেই অন্তত তিনখানা বেদের মন্ত্র রচনা শেষ হইয়া গিয়াছে, উপনিষদের ঋষি সক্রেটিসের পরম বৃদ্ধ পিতামহের ন্যায় বয়সে ও জ্ঞানে। কাজেই ভারতবর্ষীয় আর্যরা যদি আর্য জাতির ঠিকুজিকুষ্ঠি লইয়া বসিয়া থাকে তবে নর্দিকদের কী গতি হয়। রজেনবের্গ বলিলেন যে, ভারতবর্ষীয় আর্যদের এই বিষয়ে কৌলীন্য আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু অদ্যকার ভারতবর্ষীয়রা সে আর্য নয়। ইহারা জারজ, এখনও গঙ্গাস্নান করিয়া ইহারা নিজেদের বর্ণসংকর পাপের ক্ষালন করিবার চেষ্টায় সর্বদাই রত। গঙ্গাস্নানের কী অপূর্ব অর্থ নিরূপণ ও সঙ্গে সঙ্গে নর্দিক কৌলীন্যের কী আশ্চর্য কুতুবমিনার নির্মাণ!

একথা আমরা আজ আর তুলিব না যে নর্দিক অর্যে বর্ণসংকর আছে কি না ও থাকিলে কী পরিমাণ। আমাদের বক্তব্য যে, রজেনবের্গ প্রমুখ নাৎসিরা যে আর্যামির বন্যায় জর্মন জাতকে ভাসাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহা আমাদের অজানা নহে। এ বন্যা আমাদের দেশেও এককালে বহিয়াছিল ও পরবর্তী যুগে আমাদের রাজনীতিকে গণ্ডিভূত করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। এ বিষয়ে পূজনীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৯৭ সনে কী বলিয়াছিলেন উদ্ধৃত করিতেছি। রজেনবের্গের তখনও জন্ম হয় নাই।

ম্যাকসমুলার ভট্টের অভ্যুদয়ের পূর্বে আর্য বলিয়া যে একটি শব্দ অভিধানে আছে তাহা তাঁহারা (অর্থাৎ আর্যামির পাণ্ডারা) জানিতেন কি না সন্দেহ। তাহার পর ম্যাকমুলার যখন উঠিয়া দাঁড়াইয়া পৃথিবীময় আর্যমন্ত্রের বীজ ছড়াইতে আরম্ভ করিলেন তখন তাহার দুই-এক রত্তি ছিটা তাঁহাদের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র সেই মুহূর্ত হইতে তাঁহাদের মানসক্ষেত্রে আর্যামির অঙ্কুর গজাইতে আরম্ভ করিল। বিলাত হইতে আর্যমন্ত্রের আমদানি হইল– আর আমাদের দেশশুদ্ধ সমস্ত কৃতবিদ্য যুবক আর্য আর্য বলিয়া ক্ষেপিয়া উঠিলেন; তাহাদের সহস্র কণ্ঠে উদ্গীত আর্য নামের চিৎকার-ধ্বনিতে ইয়ং বেঙ্গলের গাত্রে থর থর কম্প উপস্থিত হইল। ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণদেব দানোয়া-পাওয়া শবদেহের ন্যায় মৃত্যুশয্যা হইতে সহসা গাত্রোখান করিয়া পৈতা মাজিতে বসিয়া গেলেন এবং ফিরে-ফির্তি কোমর বাঁধিয়া সন্ধ্যা-গায়ত্রী মুখস্থ করিতে আরম্ভ করিলেন।

আমরা যেরূপ একদিন পৈতা মাজিতে ও সন্ধ্যা-গায়ত্রী মুখস্থ করিতে বসিয়া গিয়াছিলাম, রজেনবের্গ সাহেবও সেইরকম নর্দিক নীল চোখকে নীলতর ও সোনালি চুলকে সোনালিতর করার চেষ্টায় মশগুল হইলেন। আমরা যেরকম ভুলিয়াছিলাম যে

কর্তব্যমাচরন কার্যমকর্তব্যমনাচরন।
তিষ্ঠতি প্রকৃতাচারে স বা আর্য ইতি স্মৃতঃ।

অর্থাৎ কর্তব্য আচরণ করিয়া এবং অকর্তব্য অনাচরণ করিয়া যিনি প্রকৃত আচারে দৃঢ়নিষ্ঠ হন তিনি আর্য শব্দের বাচ্য।

রজেনবের্গ প্রমুখ নাৎসিরাও এই মহাবাক্য ভুলিলেন।

আমরা একদিন ভুলিয়াছিলাম বলিয়া আমাদের রাজনীতি সেদিন সম্প্রদায়মুক্ত হইতে পারে নাই। পরবর্তী যুগে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন আর্যামির হাত হইতে নিষ্কৃতি পায়। এই আবহাওয়ায় আমাদের নাভিশ্বাস উঠে বলিয়াই জিন্না সাহেব যখন বলেন, কংগ্রেস হিন্দু প্রতিষ্ঠান, তখন আমরা আপত্তি জানাই। সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি স্ব স্ব আর্যামি লইয়া থাকুন; কিন্তু সাম্প্রদায়িক দম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত নাৎসি আন্দোলনের ভাগ্যচক্রগতি দেখিয়া যেন পদক্ষেপ করেন।

নাৎসিদের এই দম্ভের চরম প্রকাশ হইল পৃথিবী জয়ের বাসনায়। তাহার পূর্বে জর্মনি জয়ের কার্যে তাহারা নিযুক্ত হইলেন। ইহুদিদের নির্যাতন; নাৎসি সাম্প্রদায়িকতায় যাহারা বিশ্বাস করেন না তাঁহাদের উৎপীড়ন, এমনকি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মন্দির হইতে হাইনে, আইনস্টাইন, মানি প্রভৃতি মৃত জীবিত মনষীদের বহিষ্করণ।

বিচক্ষণ জর্মনরা যে ইহার বিরুদ্ধে কিছু বলে নাই এমন নহে। শুধু বিচক্ষণেরাই যে নাৎসি-দর্শনের প্রতিবাদ করিয়াছিলেন তাহা নহে, জর্মনির জনসাধারণও তাহাদের ব্যঙ্গোক্তি আড়ালে অন্তরালে অনেকখানি প্রকাশ করিয়াছিল। একটি ধাঁধার ভিতর দিয়া সে ব্যঙ্গোক্তি, তাহারা বিদেশিদের কাছে প্রকাশ করিত ও তাহাদের নাৎসি তন্ত্রজ্ঞানের পরীক্ষা লইত।

ধাঁধাটি এই—

 প্রশ্ন : আদর্শ আর্য কে?

উত্তর : তাহার জন্ম হইবে ফুরারের দেশে, সে বীর প্রস্থে হইবেন গ্যোরিঙের ন্যায়, দৈর্ঘ্যে গ্যোবেলসের ন্যায়, নামে রজেনবের্গের ন্যায়, কার্যক্ষেত্রে ফন রিবেট্রপের ন্যায়। (সকলেই জানেন হিটলারের জন্মভূমি জর্মনি নয়, গ্যোরিঙ ও গ্যোবেলসের একজন মোটা একজন বেঁটে; রজেনবের্গের নামে আছে ইহুদি নামের বোটকা গন্ধ ও রিবেট্রপ শৌকি।)।

তবু স্বীকার করিতে হইবে যে, আর্যামি জর্মনিতে ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; পরে সে আর্যামির দম্ভ চেকোশ্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি বিজিত দেশে, এমনকি ইতালির ন্যায় মিত্ররাজ্যে (কাউন্ট চানোর অধুনাপ্রকাশিত রোজনামচা দ্রষ্টব্য) তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি করিয়াছিল। আজ যে রুশেরা বন্ধানে অনেকটা সুবিধা পাইতেছে, তাহার কারণ এই নহে যে বল্কানরা সকলেই ভাবে যে, রুশ তাহাদের পরম মিত্র, বরঞ্চ যুক্তিধারা অনেকটা এইরকম : শত্রুর শত্রু মিত্র না-ও হইতে পারে, কিন্তু মিত্রবৎ।

জর্মনির নাৎসি কর্তারা কী রাজরাজেশ্বরের হালে দিন কাটাইতেন, সে সকলেই জানেন। গাঁজার নেশাটা করিলেন কর্তারা, মাথাধরাটা পাইল জনসাধারণ। তাহারা প্রাণ দিল রুশিয়ার দুস্তর প্রান্তরে ক্ষুধায় শীতকষ্টে অথবা রুশনগরদ্বারে, রাস্তায় গলিতে গুলিতে বিস্ফোটকে; অথবা নরমাদিতে সামনে মিত্রশক্তির ট্যাঙ্ক, কামান, উপরে বোমারু, পিছনে ফরাসি গেরিল্লা মাতা বসুন্ধরা তাহাদের আবেদন শুনিবার পূর্বেই বোমারু জাহাজ মাতার বক্ষস্থল বিদীর্ণ করিয়া দিতেছিল, কিন্তু হায়রে, সেখানেও আশ্রয় কোথায়?

দেশের কথায় বলে, খেলেন দই রমাকান্ত বিকারের বেলা গোবর্ধন। আজ সমস্ত জৰ্মনি জুড়িয়া যে বিকার ও ভবিষ্যতে যে কী সান্নিপাতিক জ্বর হইবে, তাহার কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে শক্ত। ইংরেজ, আমেরিকান, রুশ ত্রিদোষ হইয়া জর্মনির গোবর্ধনগুলিকে কোন শ্মশানযাত্রায় লইয়া যাইতেছেন, তাহার খবর কে রাখে।

এতদিন খবর পাইতেছিলাম যে, রমাকান্তগুলিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা হইতেছে ও তাহারা যে বিকার হইতে নিষ্কৃতি পাইবে এমন নহে। তাহাদের জন্য বিশেষ গারদ, বিশেষ বিচার, এমনকি বিশেষ হাড়িকাঠও নির্মিত হইতেছে। ফাঁসি অথবা গুলির কর্ম নয়, খাস জর্মন কায়দায় তাহাদিগকে গিলোটিনে গলা দিতে হইবে। আমরা শোক প্রকাশ করিতেছি না, আনন্দিতও হইতেছি না। আমরা ভারতবাসী; কর্মফলে বিশ্বাস করি। দই খাইলে বিকার হইবেই। কিন্তু ইতোমধ্যে হঠাৎ একটি খবর পাইয়া আমরা স্তম্ভিত হইলাম। খবরটি এই জেবিক-হলস্টাইনে নাকি প্রায় সোয়ালক্ষ জর্মন সৈন্য ও অফিসারকে জিয়াইয়া রাখা হইয়াছে। তাহাদের নিরস্ত্র করা হয় নাই। পাছে বিশ্বসুদ্ধ লোক খবর পাইয়া আঁতকাইয়া উঠে, তাই অত্যন্ত সান্ত্বনাপূর্ণ এই খবরটিও সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হইয়াছে যে, তাহাদের রসদ মাত্র দশ রোদ চালাইবার মতো। যে অঞ্চলে এই নোনা ইলিশরা বিরাজ করিতেছেন, সেখানে তাঁহারা সর্বময় কর্তা, এমনকি সে অঞ্চলে যদি তাঁহাদের খানাপিনার অসুবিধা হয়, তবে পার্শ্ববর্তী জর্মনিও সম্ভবত ডেনমার্ক হইতে আহারাদি যোগাড় করিতে পারিবেন। হেমলেটি ভাষায় বলি, ইহারা যে পাঁড় নাৎসি, সেকথা জানাইবার জন্য দৈববাণীর প্রয়োজন নাই।

সঙ্গে সঙ্গে এই খবরও পাইলাম যে, প্রায় ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচা করিয়া (প্রতি বৎসরে না প্রতি তিন বৎসর এ কথাটা রয়টার কাজের হিড়িকে ঘুলাইয়া ফেলিয়াছেন) একটি পাকাঁপোক্ত পোলিশ বাহিনী ইংলন্ডে মজুদ রাখা হইয়াছে। ইহারাও জনবুল মার্কা ষাঁড় লাল রঙের কট্টর দুশমন।

এই যে ইংলন্ডের হাঁড়িতে জিয়ানো যশোরে কই, জেবিক-হলস্টাইনে জমানো পদ্মার নোনা ইলিশ, ইঁহারা লাগিবেন কোন কর্মে কোন পরবে? নতুন রাজনীতির জন্মদিনের দাওয়াতে, না ইউরোপের দ্বিতীয় কাঁপালিক শ্রদ্ধবাসরের ভোজে?

.

০২.

পেটুক ছেলেকে যা কিছু করিতে বলা হউক না কেন, সে আহারাদির আলোচনায় ঠিক পৌঁছিবে। এমনকি একং দশঙের মতো রসকসহীন জিনিস মুখস্থ করিতে বলিলেও সে ঠিক লুচি-মণ্ডায় পৌঁছিবে। কায়দাটা দেখার মতো : একং, দশং, শতং, সহস্র, অযুত; লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাগ (মাঘ) ছেলেপিলে, জ্বর, সর্দি, কাশি; গয়া, বৃন্দাবন, পুরী, রসগোল্লা, সন্দেশ, মিহিদানা, লেডিকিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।

গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়াছে, তাহাকে সেখান হইতে নড়ায় কাহার সাধ্য।

ইংরেজ, ফরাসির দৃঢ় বিশ্বাস যে জমনি পেটুক ছেলের মতো। তাহাকে যে কোনও কায়দার সরকার দাও না কেন, সে রাজতন্ত্রই হউক আর গণতন্ত্রই হউক, জর্মনরা ঠিক স্বৈরতন্ত্র ও কুচকাওয়াজতন্ত্রে পৌঁছিবেই। য়ুকার ও রূঢ়ের ধনপতিরা মিলিয়া পৃথিবী জয়ের প্ল্যান আঁটিবেই। ফন পাপেন ও টুসেনে বন্ধুত্ব হইবেই ও পৃথিবী জয়ের জন্য বিদেশি, টুথব্রাশ-গোপওয়ালা, নিরক্ষর উজবুকেরও যদি প্রয়োজন হয় তাহাও সই– যদি সে উজবুক ঠিক ঠিক বক্তৃতা ঝাড়িয়া টেবিল ফাটাইতে পারে ও শান্তিপ্রিয় দেশি-বিদেশির মাথাও এলোপাতাড়ি ফাটাইতে পারে। ইংরেজ-ফরাসি বলে, দেখ না, ১৯১৮-১৯ সালে আমরা জর্মনিকে কীরকম সরেস একখানা বাইমার রিপাবলিক দিয়াছিলাম; কিন্তু সেই একং দশং পড়িতে গিয়া তাহারা ঠিক নাৎসি গুণ্ডামিতে পৌঁছিল। ইহাদের বিশ্বাস নাই, ইহাদের রোম রোম মে বদমায়েশি।

পরাজিত জর্মনিকে লইয়া সমস্যাটা তাহা হইলে এই, তাহাকে স্বাধীনভাবে ছাড়িয়া দেওয়া যায় কি না। যদি না দেওয়া যায় তবে পিটুনি পুলিশ দিয়া তাহাকে আদবকায়দা শিখাইতে হইবে।

১৯৩৯ সালে আমার এক জর্মন বন্ধু আমাকে বলিয়াছিলেন : লড়াই শীঘ্রই লাগিবে। আমরা যদি জিতি, তবে দুনিয়ার রাজত্ব আমাদের হাতে আসিবে আর যদি হারি তাহা হইলেও। কারণ আমাদের পরাজয় অর্থই রাশিয়ার জয়। আমরা তখন লাল হইয়া যাইব। আমাদের প্রতিনিধিরা মস্কোতে যাইবে, সেখানে ভোঁতা রাশিয়ানদের তিন দিনে কাবু করিয়া তামাম ইউএসএসআর আমাদের প্রতিনিধিরাই চালাইবে। রাশিয়ানরা বর্ণবিচার। করেন না, তাহাদের বীজমন্ত্র সর্বোত্তম ব্যক্তি বড়কর্তা হইবে, হউক না সে জর্জিয়ন। যেরকম মুসলমানরা একদিন বলিত, সর্বোত্তম ব্যক্তি খলিফা হইবে, হউক না সে হাবসি। কাজেই কিছুদিনের ভিতরই দেখিতে পাইবে এক জর্মন ক্রেমলিনে বসিয়া দুনিয়া চালাইতেছে। হ্যাঁ, তামাম দুনিয়াটা, কারণ জর্মনি ইউএসএসআরের গুষ্টিতে যদি ঢোকে, তবে বাদবাকি ইউরোপ তিন দিনেই তার খপ্পরে পড়িবে। ইংরেজ, মার্কিন কেউ ঠেকাইতে পারিবে না। তার পর পটপট করিয়া চীন, ভারতবর্ষ, ইরান, ইরাক, মিশর। তার পর? তার পর আর কী? এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এক অখণ্ড রাজ্য হইলে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াকে একঘরে করিয়া তিন দিনের ভিতর সমাজের সামনে নাকে খত দেওয়াইব। দেখিবে সব লাল হো জায়েগা, তবে রঞ্জিতি মর্মে নহে।

শুনিয়া বলিয়াছিলাম, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। তোমার কথাই যদি ফলে, তবে আমরা ভারতবাসীরাই দুনিয়ার রাজত্ব করিব। ভারতবাসীও না, আমরা বাঙালিরাই ক্রেমলিনে বসিয়া নিয়ে নদীর ইলিশ মাছ খাইব ও দুনিয়ার রাজত্ব করিব।

বন্ধু বলিলেন, সে কী কথা? তোমরা বাঙালিরা এমন কী গুণে গুণবান?

আমি বলিলাম, বিলক্ষণ, আমরা লড়াই করিয়া দেশের স্বাধীনতা জিতিতে না পারি, কিন্তু মস্কোর কৌন্সিল-ঘরে আমাদের বক্তৃতা জলতরঙ্গ রুধিবে কে, হরে মুরারে।

কিন্তু সেকথা উপস্থিত ধামাচাপা থাকুক; গোঁফে তেল দিবার সময় এখনও হয় নাই।

আমার জর্মন বন্ধুর যুক্তিতে মার্কিনিংরাজ বিশ্বাস করে। তাহাদের মাথায় ঢুকিয়াছে যে, জর্মন জিঙ্গো যেরকম পাগলা হিটলারকে কার্য উদ্ধারের জন্য দলে নিয়াছিল, জাতধর্ম, কৌলীন্য আভিজাত্য বিসর্জন দিয়া, ঠিক সেইরকম তাহারা লাল হইয়া স্টালিনকে হিটলারের তখতে বসাইয়া দুনিয়ার বাদশাহি করিবে অর্থাৎ নাৎসি গুণ্ডামির বদলে স্টালিনি গুণ্ডামি চালাইবে। দুই গুণ্ডামিই মার্কিনিংরাজের পক্ষে মারাত্মক, মহতী বিনষ্টি। সেই মহাপ্রলয় হইতে রক্ষা পাইবার একমাত্র উপায় জর্মন জিঙ্গোকে বোঝানো যে, তাহারা লাল হইয়া কেন মস্কো দরবারে কুর্নিশ দিতে যাইবে। মার্কিনিংরাজ সাহায্য করিতে প্রস্তুত, জিঙ্গোরা লাল রক্তস্রোতের উপর ভরাপালে মস্কো পৌঁছিবে রাজবেশে। উপস্থিত কোনওগতিকে রুশকে ঠেকাইয়া রাখ; জর্মনি যেন মনের দুঃখে লাল গেরুয়া। পরিয়া বিবাগী হইয়া মস্কো তপোবনে চলিয়া না যায়। অর্থাৎ সেই অতি প্রাচীন চেম্বেরলিন নীতি যতক্ষণ রুশে-জর্মনে লড়াই চলে আমাদের পৌষ মাস, দুই দুশমনে মিলিলেই আমাদের সর্বনাশ।

যদি বলা হয়, এক কাজ করো না কেন, নাৎসিদের শক্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট করিয়া রাজ্যশাসন দেশের জনগণের হাতে ছাড়িয়া দাও। তাহারা যে লাল হইয়া যাইবেই, এ স্বতঃসিদ্ধ পাইলে কোথায়?

মার্কিনিংরাজ বিজ্ঞের ন্যায় মৃদুহাস্য করিয়া বলে, ইতিহাস পড়ো। বাইমার রিপাবলিক যখন জর্মন জনগণকে ভেট দেওয়া হইল তখন তাহারা করিল কী? কোথায় না বাদশাহি মসলন্দে বসিয়া শাহেনশাহিগিরি করিবে তাহা নয়, সেই কাইজারকে তাহার জমিদারির আমদানি কিস্তি খিলাপ না করিয়া হামেহাল পাঠাইল– এদিকে নিজে খাইতে পায় না। মুচি-মেথরকে বলা হইল, রাজা তো হইতে পারিবে না, সিংহাসন নাই, প্রেসিডেন্ট হ, তা নয়, ডাকিয়া আনিল সেই যুঙ্কার পালের গোদা হিন্ডেনবুর্গটিকে। তার পর সেই পাগলা জগাইকে। সে ব্যাটা কালাপাহাড় জাতে অস্ট্রিয়ান হইল জার্মান। মোদ্দা কথা এই, জর্মন আপামর জনসাধারণ যা, যুঙ্কারও তা, নাৎসিও তা। সব শিয়ালের এক রা। বরঞ্চ কট্টর নাৎসিরা ভালো। শক্তির উপাসক। জাতবর্ণহীন স্টালিনি নেড়া-নেড়িদের বিরুদ্ধে ইহাদের কোনও না কোনও দিন শভিনিজম-কারণ খাওয়াইয়া লড়ানো যাইবে। আপামর জনসাধারণ তো কাছাখোলা, লাল গেরুয়া পরিয়া ধেই ধেই করিয়া স্টালিনি সংকীর্তন নাচিবার গাইবার জন্য তৈয়ার হইয়া আছে। তাই জেবিক-হলস্টাইনে নাৎসি জিয়াও আর গোরাদের কড়া বারণ করিয়া দাও যেন জর্মন জনগণের সঙ্গে রাখি না বাঁধে (নন-ফ্রেটারনাইজেশন)। গোরাদেরই-বা বিশ্বাস কী? দুষ্টলোকে বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহাদেরও নাকি গোলাপি আমেজ লাগিয়াছে।

ঠিক এইখানটায় মার্কিনিংরাজের সঙ্গে আমার মত মিলে না। আমার বিশ্বাস, জর্মন জনসাধারণ আপন মুক্তি আপন ঐতিহ্যের ভিতর দিয়া খুঁজিয়া পাইতে চায়। স্টালিন-দত্ত গুরুমন্ত্র জপিয়া নয়। আমার মনে আছে ১৯৩২ সালে যখন জর্মনিতে নাৎসি-কম্যুনিস্টে জোর সঁড়ের লড়াই চলিতেছিল তখন নাৎসিরা পথেঘাটে একে অন্যকে অভিবাদন করিত হাইল হিটলার বলিয়া, কম্যুনিস্টরা হাইল মস্কো বলিয়া। গুণীদের বলিতে শুনিয়াছি এই মস্কো-মার্কা বিদেশি ভদকা জর্মন বিয়ার ঐতিহ্য-গর্বিত জনসাধারণ আদপেই পছন্দ করিত না। কে জানে হয়তো এই কথা স্মরণ করিয়াই রুশরা আজ বার্লিনাঞ্চলে জোর করিয়া জর্মনদের হাইল মস্কো বলাইতেছে না। অবান্তর হইলেও একটি কথা বলিবার লোভ হইতেছে। আমাদের দেশি কম্যুনিস্টরা কিন্তু মস্কোবাগে না তাকাইয়া কোনও কর্মই করেন না, কোনও বাক্যই বলেন না। স্টালিন যদি জর্মনির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন তা-ও ভালো, যদি লড়েন তা-ও ভালো, যদি ফিনল্যান্ডের কান মলেন তা-ও ভালো, যদি ফি কমুনিস্টদের তত্ত্বতাবাশ না করিয়া পাসিকিভির সঙ্গে দোস্তি করেন তাও ভালো, ইরান তেল দিল না বলিয়া যদি তাকে ধমক দেন তবে তা-ও ভালো, গ্রিক দেশসেবীদের গাছে চড়াইয়া যদি মই কাড়িয়া লন তবে তা-ও ভালো। কারণ বাতুশকা (ছোট বাপা) স্টালিন সর্ব-বিশারদ, ভগবানের (রাম রাম!) ন্যায় সর্বজ্ঞ। বিরিঞ্চিবাবার ন্যায় তিনি চন্দ্রসূর্য ওয়েল না করিলে আকাশ পাতালের বন্দোবস্ত ভণ্ডুল হইয়া যাইবার নিদারুণ সম্ভাবনা। অতএব হাইল মস্কো। আমাদের এ ধর্ম পছন্দ হয় না। আতাতুর্ক পছন্দ করিতেন না বলিয়াই নব্যতুর্কের স্কন্ধ মক্কাবাগ হইতে ফিরাইয়া আঙ্কারাবাগে স্কু টাইট করিয়া দিয়াছিলেন।

কথা হইতেছিল যে, জর্মন জনসাধারণ আপন মুক্তি আপন ঐতিহ্যের ভিতর দিয়া খুঁজিয়া লইতে চায়। তাই যদি হয় তবে বাইমার রিপাবলিকের বানচাল হইল কী করিয়া?

.

০৩.

সোশ্যাল ডিমোক্রেটদের হাতে রাজ্যচালনার ভার সমর্পণ করাই যে প্রশস্ত ইহা বিচক্ষণ ব্যক্তি মাত্রই স্বীকার করিবেন। তাহার কারণ আমরা পূর্বেই নিবেদন করিয়াছি। বাইমার রিপাবলিককে সাফল্যমণ্ডিত করিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছিলেন সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা। জর্মনির খ্যাতনামা পণ্ডিত অধ্যাপক, গুণীজ্ঞানী–এক কথায় যাহারা জর্মনির গর্বশ্বরূপ, তাহারা প্রায় সকলেই ছিলেন বাইমারের পিছনে, সোশ্যাল ডিমোক্রেটরূপে। আমরা বিশেষ করিয়া ইহাদের চিনিতাম, কারণ ইহাদের ভিতর আর্যামি গোঁড়ামি ভণ্ডামি ছিল না।

জর্মনির দুর্দিনে সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা আপামর জনসাধারণকে এক পতাকার নিচে সম্মেলিত করিয়া ইনফ্লেশন, বেকারি, নাস্তিক্য, উচ্ছলতা হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। পৃথিবী জয় করার উদ্দেশ্যে নতুন সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করার স্বপ্ন তাহারা দেখেন নাই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাঁহারা বলিয়াছিলেন, মানবসংসারে ভালো লোকের দেয়ালি উত্সব চলিতেছে, প্রত্যেক জাতি আপন প্রদীপ উঁচু করিয়া তুলিলে তবে সে উৎসব সমাধা হইবে। পৃথিবীর শান্তি ও মঙ্গল তাহারা কামনা করিয়াছিলেন বলিয়া ঠিক ওই সময়ে (১৯২০) রবীন্দ্রনাথকে তাঁহারা বিপুল সম্বর্ধনা করিয়াছিলেন। জর্মন জনসাধারণ তখন রবীন্দ্রনাথের বাণীতে নিজের মূক আদর্শ প্রকাশ করিয়াছিল। কে না জানে ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বপ্রেমের কবি, শান্তির প্রতীক, পদদলিতের পরিত্রাণ।

তথাপি ইংরেজ-ফরাসির ভয় ছিল যে সময়কালে সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা বলশিদের সঙ্গে যোগদান করিবে। তাই যখন দেশের শিল্প-বাণিজ্যের উদ্ধার করিবার জন্য সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা ইংরেজ-ফরাসি ধনপতিদের সাহায্য চাহিল তাহারা সাফ জবাব দিল। ফলে বেকারি বাড়িল, ব্রনিভ হাল সামলাইতে পারিলেন না। তার পর ফন পাপেন; শ্লাইশার গর্ভাঙ্কের ভিতর দিয়া নাৎসি যবনিকা পতন। ইংরেজের কথা ফলিল না, সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা কম্যুনিস্টদের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও নাৎসি অবিচারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করিতে রাজি হইলেন না।

***

সোশ্যাল ডিমক্রেটরাই যে দেশের মেরুদণ্ড তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই যে, রুশেরা তাহাদের অধিকৃত অঞ্চলে ইহাদেরই প্রধান শক্তি স্বীকার করিয়া নিয়াছে। ইহাদেরই সঙ্গে আছেন ক্রিশ্চান ডেমোক্রেটিক পার্টি ও লিবারেল ডিমোক্রেটিক পার্টি। কম্যুনিস্টরাও আছেন, ও বেশ জোর আছেন তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই এবং ভিতরে ভিতরে রুশ সরকার যে তাহাদেরই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করিবে তাহাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু রুশরা জানে যে, সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা যদি বাঁকিয়া বসিয়া থাকে, তবে কম্যুনিস্টরা শুধু গায়ের জোরে তাহাদের প্রোগ্রাম চালু করিতে পারিবে না। স্পষ্ট বোঝা যাইতেছে যে, রুশের চাল হইল সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের নটমঞ্চের সম্মুখে রাখিয়া দেশের প্রথম দুর্দিনের ধাক্কা তাহাদের দিয়া সহানো। রুশদের যথেষ্ট সাহায্য না পাইয়া যখন ব্যনিভ সরকারের মতো তাহাদের পার্টি-নৌকা বানচাল হইবে তখন কম্যুনিস্টরা আসরে নামিয়া দেশোদ্ধার করিবেন, অর্থাৎ গোটা রুশাধিকৃত অঞ্চলকে ইউএসএস আরের অঙ্গীভূত করিবেন। সে বিপদকালে সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা যে কোনও কট্টর লাল-বিরোধী দর্গায় ধরনা দিবে তাহার উপায় নেই, কারণ রুশরা কট্টরদের নির্মমভাবে বিলোপ করিয়াছে ও করিতেছে। রুশরা জানে যে, উপস্থিত সোশাল ডিমোক্রেটদের লোকচক্ষে অপমানিত করার প্রয়োজন তাই তাহাদের সভামঞ্চে আনিবার পূর্বে বেশ করিয়া মুসোলিনি-কায়দায় জোলাপ দেওয়া হইতেছে।

অস্ট্রিয়ায় রুশরা যে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে তাহাতেও ওই চাল। বিস্তর সোশ্যাল ডিমোক্রেটদের হরেক রঙের পোর্টফোলিও দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু পুলিশ, অর্থ, প্রোপাগান্ডা অভ্যন্তরীণ মন্ত্রীর হাতে ও তিনি কম্যুনিস্ট। অর্থনৈতিক দিক দিয়াও রুশের বালাই কম। যে অঞ্চল দখল করিয়া বসিয়াছে সেখানে খানা-পিনা আছে, তাহার উপর উক্রাইন আছে। সে অঞ্চলের সমস্ত কলকারখানা সরাইয়া রাশিয়ায় লইয়া গেলেও ইহাদের অন্তত অস্থিচর্মসার করিয়া রাখিতে কোনও বিশেষ অসুবিধা হইবে না।

***

মার্কিন-ইংরেজ কিন্তু কিছুতেই মনস্থির করিতে পারিতেছেন না। কর্তাদের বুদ্ধির বহর কতটুকু তাহা নিম্ন খবরটুকু হইতে বিলক্ষণ বোঝা গেল।

জর্মনির কলকজা যদি কাড়িয়া লই (অর্থাৎ ডিসইনডাসট্রিয়ালাইজ) তবে তাহারা না খাইয়া মরিবে, আর যদি না কাড়ি তবে চর্বচোষ্য লালিত হইয়া পুনর্বার মস্তকোত্তোলন করিয়া আমাদিগকে প্রহার করিবে।

এই তথ্যটুকু কি বিজ্ঞের ন্যায় প্রচার করা হইল! ঘোড়াকে দানাপানি না দিলে সে মরিবে, তাহাতে আর নতুন কথা কী? আর দিলে সে গাড়ি টানিতে পারিবে (অর্থাৎ গায়ের জোরে রুশকে ঠেকাইতে পারিবে, কিন্তু মাঝে মাঝে তোমাকে লাথিও মারিবে। গাড়ি যদি চালাইতে চাও, তবে তেজি ঘোড়া কিঞ্চিৎ দুরন্তপনা তো করিবেই। তুমি ভালো লাগাম কেনো না কেন?

দ্বিতীয় উদাহরণ পণ্য!

কাঠের অভাব হইয়াছে বলিয়া বার্লিনের যেসব অঞ্চলে ইংরেজ-মার্কিন প্রবেশ করিয়াছে, সেখান হইতে স্টালিনি সাইনবোর্ড সরানো হইয়াছে। খদ্দের যখন অশ্ব-বিক্রেতাকে বলিল, বাড়ি গিয়া দেখিলাম, তোমার ঘোড়া খোঁড়া, তখন সে বলিল, আপনার বাড়ি তো বাজারের উত্তর দিকে, ওদিকে চলিলে আমার ঘোড়া খোঁড়া হয়ই! খদ্দের বলিল, তোমার যুক্তিটা তোমার ঘোড়ার মতোই খোঁড়া।

তৃতীয় উদাহরণ,

কোনও কোনও জর্মন মেয়ে ইংরেজ সিপাহিদের নিকট হইতে চকলেট লইয়া চম্পট দেয়। আশ্চর্য! কিন্তু আমাদের এতদিন বিশ্বাস ছিল যে, সবদেশের মেয়েরাই এরকম করে। আর মেয়েদেরই-বা দোষ দেই কেন? তোমাদের সন্তুষ্টিকরণ (এপিজমেন্ট) অস্ট্রিয়া-চেকোশ্লোভাকিয়া চকলেট পকেটস্থ করিয়া হিটলার তো এই সেদিন তোমাদের বিশেষ অঙ্গুলি প্রদর্শন করিয়াছিল। রাজনৈতিক স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হয়, কিন্তু এতটা ক্ষীণ।

অধিকৃত জর্মনি চালনা সম্বন্ধে নিম্নলিখিত খবর হইতে বোঝা যায়, বরঞ্চ বলা উচিত বোঝা যায় না ইংরেজ-মার্কিনের নীতি কী।

কম্যুনিস্টরা রাজ্যশাসনে কোথাও নাই। বেভেরিয়া ও নিম্নরাইনে দক্ষিণপন্থি ক্যাথলিকরা সর্বময় কর্তা। হামবুর্গ ও হানোফারে পার্টিমতামতহীন বণিক ও দক্ষিণপন্থি আমলারা গুছাইয়া লইতেছেন, যদিও অন্য কেউ কেউ বখরা পাইতেছেন। হেস্মে ও মধ্য রাইনে সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা রাজ্য-চালনার পুরোভাগে ও উত্তরপন্থি ক্যাথলিকদের আওতায় বেস্টফালিয়েন ও ওল্ডেনবুর্গে কিছুটা রাজত্ব করিতেছেন। তদুপরি বড় বড় নগরে ইহারাই মেয়র হইয়া বসিয়াছেন।

উৎকৃষ্ট প্রস্তাব। এ রকম পঁচিশ জায়গায় বত্রিশভাজা করিবার কী প্রয়োজন? এরকম দো-আঁসলা, তিন-আঁসলা জানোয়ার পয়দা করিবার এক্সপেরিমেন্ট কেন? ইংলন্ডে একবার টার্কি ও হেন (মুরগি) পক্ষীতে সংমিশ্রণ করাইয়া যখন টার্কিন পাখি পয়দা করা হয়, তখন ফ্রান্স বলিয়াছিল, আমেরিকার এক আস্তাবলে গাধা ও একখানা ভাঙা বাইসিক্ল একসঙ্গে রাখার ফলে ফোর্ড গাড়ির জন্ম হয়েছিল। সাধু সাবধান!

তাই বলিতেছি যে, প্রকৃষ্টতম পন্থা, সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের শুধু রাজ্য সমর্পণ করাই নয়, তাঁহাদের সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন সাহায্যদান। রুশরা যেমন তাহাদের অধিকৃত অঞ্চলে সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের বোকা বানাইতে চাহে, তোমরা তেমনি তাহাদের সফলতার পথে লইয়া চল। জর্মন বড় জাত্যাভিমানী, পারতপক্ষে সে কখনও তাহার জাতীয়তাবোধ ত্যাগ করিতে চাহে না। তাহার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহার মুক্তির পথ তাহারই ঐতিহ্যের তাহারই বৈদগ্ধ্যের ভিতর দিয়া। সে বলশির ধামাধরা হইতে চাহে না, তোমাদের গোলাম হইতে চাহে না। তাহাদের যদি স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করিতে দাও তবে সে সকল শত্রুকে রোধ করিয়া শান্ত জীবনযাপন করিবেই। সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা শান্তি চায়।

আর শেষ কথা তো এই যে, স্বায়ত্তশাসনে সর্বজাতির অধিকার। সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা জর্মনজাতির যাহা শ্রেষ্ঠ, যাহা বরণীয় তাহারই প্রতীক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *