পরশ পাথর
ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম অনেক মাস, অনেক বছর। সঙ্গে আছে আরো অনেকেই। দিশেহারা। উদ্দেশ্যহীন।
কিন্তু আমার মতো ম্যজিক জানে না কেউ। জাদুমন্ত্র আমার সূক্ষ্ম সত্তায়। আমি চাইলে অনেক কিছু করতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে নেই।
পৃথিবীর আকর্ষণ বড্ড বেশি। প্রবল। মাঝে-মাঝে দূরের ওই গ্রহনক্ষত্রের দিকে ছিটকে গেছিলাম বটে, কিন্তু প্রচণ্ড আকর্ষণ আমাকে টেনে নামিয়ে এনেছে। বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে গুহায়, মন্দির কাঠ গির্জায় মসজিদে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। এই সব জায়গাই আমার বেশি ভালো লাগে।
পগাড়ে নালায়, পোড়োবাড়ি আর বাঁশঝাড় নিমগাছে যারা ঘোরে, মায়া হয় ওদের দেখে। একেবারেই শক্তিহীন। যতদিন বেঁচেছিল, শুধু নাওয়া খাওয়া, টাকা রোজকার আর ভোগবাসনা নিয়েই মেতে থেকেছে। ব্রহ্মাণ্ডের অসীম শক্তিদের শরীরের আধারে সঞ্চয় করার কোনও চেষ্টা করেনি।
আমি করেছিলাম। বছরের পর বছর ল্যাবরেটরিতে সাধনা করেছি। হিমঠান্ডায় পাহাড়ের গুহায় অজানাকে জানতে চেয়েছি। শক্তি পেয়েছি। অকল্পনীয় শক্তি।
কিন্তু অত শক্তিকে ধরে রাখার মতো শরীর আমার ছিল না। রক্তমাংসের শরীর জীর্ণ করে দিয়ে আমার মূল সত্তাকে আঁকড়ে ধরে ধারণাতীত শক্তিরা বেরিয়ে এল বাইরে। মূল সত্তার বিনাশ নেই, জরা নেই, ক্ষয় নেই। জাদুবলে বলীয়ান এই সত্তা আবার নবদেহে প্রবিষ্ট হতে পারে। কিন্তু আমার ইচ্ছে নেই।
না, ইচ্ছে নেই। লাভ কী?
কিন্তু মায়া হল ছেলেটিকে দেখে। কতই বা আর বয়স। বড়জোর চোদ্দো। ভারি সুন্দর চেহারা। চোখদুটো বড় বড়। টকটকে ফর্সা রং। মাথায় বেশ লম্বা। একমাথা হালকা চুল।
সবচেয়ে ভালো লেগেছিল ছেলেটার চোখের চাহনি। দিঘির মতো টলটলে, কালো। সমুদ্রের মতো অতলান্ত। আকাশের মতো অসীম, প্রশান্ত।
অথচ এই চোখই কখনো কখনো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। হিংস্রতায় নিষ্করুণ হয়ে ওঠে। তখন তার দিকে চাওয়া যায় না।
ঠিক এই সময়েই কিন্তু গভীর চোখে তার দিকে চেয়েছিল তার মা। তন্ময় চাহনি। ব্যথা যেন ঝরে পড়ছে দুই চোখে।
মা বলে ঠিকই চিনেছিলাম আমি। ড্রেসিং টেবিলের ওপরেই রয়েছে যে তার ফটোগ্রাফ। ছেলেটি আত্মনিমগ্ন সেই ফটোর পানে চেয়ে। চোখ, চিবুক, মুখের গড়ন একই রকমের।
ছবির মা কিন্তু সামনেই দাঁড়িয়ে। ছলছল চোখে চেয়ে রয়েছে ছেলের দিকে।
আমি যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছি, সে তখনও তা দেখেনি। ছেলেটির দেখবার কথা নয়। কিন্তু মা তো দেখবে। কিন্তু যার সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে রয়েছে ওই ছেলে, সে পাশের দিকে তাকাবে কখন?
মৃদু স্বরে জিগ্যেস করেছিলাম–কী হয়েছে?
ভীষণ চমকে উঠল ছেলের মা। আমাকে দেখেই বিস্ময়ভরা চোখদুটোয় ফুলে উঠল নিবিড়। বিস্ময়-কে আপনি?
তোমারই মতো একজন। দেহত্যাগ করেও ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পৃথিবীর মায়া আর কাটাতে পারছি না।
আপনারও ছেলে আছে নাকি?
না। কেউ নেই আমার।
তবে?
কীসের আকর্ষণে আটকে আছি পৃথিবীতে, এই তো? হয়তো মাটির আকর্ষণ…অথবা হয়তো আমাদের মতোই যারা দুঃখ শোকে অধীর, তাদের ছেড়ে যেতে পারছি না বলেই…।
আপনি কি সাধু ছিলেন?
লম্বা দাড়ি দেখে বলছ? হাসলাম আমি–চুলদাড়ি কাটবার সময় পেতাম না–তাই।
শুধু দাড়ি নয়, ছেলের মা আমার চোখের দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকিয়ে–আপনার মতো সৌম্য বিদেহী আজ পর্যন্ত দেখিনি। ঋষির মতোই চেহারা আপনার, বলতে বলতে হঠাৎ দু-চোখে আশার আলো জ্বলে ওঠে মেয়েটির–আপনিই কি সেই সব অদৃশ্য সহায়দের একজন যারা মরণের পরেও মানুষের উপকার করে যান নানাভাবে?
হাসলাম। জবাব দিলাম না।
মেয়েটির চোখমুখ তখন জ্বলজ্বল করছে। কতই বা আর বয়স হবে। বড় জোড় চব্বিশ। মৃত্যুকালে যে বয়স ছিল, এখনও তা রয়ে গেছে। পরমা সুন্দরী। যেমন রং, তেমনি মুখের গড়ন। দীর্ঘাঙ্গী। চোখদুটো সবচেয়ে সুন্দর বড় বড়। গভীরভাবে আচ্ছন্ন।
বলল আকুল কণ্ঠে–ঠাকুর, আমার ছেলেটাকে ভালো করে দেবেন?
ঠাকুর! হেসে ফেললাম আমিঠাকুর বললে কেন আমাকে?
ওইরকমই যে দেখতে আপনাকে। বলুন না, ভালো করে দেবেন ছেলেটাকে?
কী হয়েছে ওর?
ভেবে ভেবেই বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে। ওই দেখুন…ওই দেখুন।
দেখলাম ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়েছে। স্কিপিং-এর দড়িটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। চোখদুটো বিষণ্ণ। মায়ের ছবির দিকে তাকাচ্ছে আর দড়িটাকে টেনে টেনে দেখছে কত শক্ত।
মতলবটা বুঝলাম। বললাম–ওর বাবা কোথায়?
কাজে বেরিয়েছে। রাত হবে ফিরতে। তার মধ্যেই দেখুন…ওই দেখুন ওই দেখুন..!
ছেলেটা মায়ের ফটো তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। দু-গাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে পাশেই বাবার ছবির দিকে। কিন্তু কী আশ্চর্য। সে চোখে বিদ্বেষ! বিজাতীয় ঘৃণা।
বাপকে একদম সইতে পারে না দেখছি, বলেছিলাম আমি।
অথচ বাপকেই সবচাইতে ভালোবাসে। আমার চাইতেও। হঠাৎ ওর অখণ্ড বিশ্বাসে ঘা লেগেছে। খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে বাবার ওপর অগাধ বিশ্বাস। ও আজ তাই দিশেহারা।
বিশ্বাস ভাঙল কেন? দেখলাম ছেলেটা দড়ি নিয়ে আবার টেনে টেনে দেখছে। খালি গা। প্রদীপ্ত চোখে বিকার ভাব। অস্থির। মাথার মধ্যে যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
ওর মামা কানে বিষ ঢেলেছে। নিজেদের দোষ ওর বাবার ঘাড়ে চাপিয়েছে। বলেছে, তোর বাবা তোর মাকে মেরে ফেলেছে।–একী–একী করছিস রাজু।–ঠাকুর-ঠাকুর! ওকে বাঁচান!
মায়ের চিৎকার ছেলে শুনতে পাবে কেন? একজন ইহলোকে, আর একজন পরলোকে। কিন্তু ছেলের কাণ্ড দেখে মায়ের সে খেয়াল নেই। আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠেছে–বাঁচান! বাঁচান! ঠাকুর, ওকে বাঁচান।
খাটে উঠে পড়েছে রাজু। স্কিপিং দড়ির একটা প্রান্ত বেঁধেছে সিলিংয়ে লাগানো হুকে। অন্য প্রান্তে একটা ফাস তৈরি করেছে।
গলায় দড়ি দেওয়ার মতলব। কাঁদছে ওর মা। হাওয়া-শরীর নিয়ে ছেলেকে আটকাতে পারছে না। ঘর ফাঁকা। দরজায় ল্যাচ দেওয়া। চাবি নিশ্চয় বাবার কাছে। তিনি না ফিরলে এ ছেলের আত্মহত্যা কেউ রোধ করতে পারবে না। কিন্তু আমি পারব।
চনমন করে উঠল আমার বিদেহী সত্তার শক্তিকেন্দ্রগুলো। দ্রুত হ্রস্ব স্বরে শুধোলাম ব্যাকুল-নয়না মেয়েটিকে–নাম কী তোমার, মা?
দুর্গা। রাজু। রাজু। লক্ষ্মী ছেলে আমার–ধীর হ। মাথা ঠান্ডা কর।
রাজু ততক্ষণে দড়ির ফাঁস গলায় দিয়েছে। আমি আর দেরি করলাম না। ঢুকে পড়লাম ওর শরীরের মধ্যে। চলে গেলাম একেবারে মস্তিষ্কে। যেখানে দশ হাজার কোটিরও বেশি নিউরণ পরিপাটিভাবে সাজানো রয়েছে। ন-হাজার কোটি এখনও নিষ্ক্রিয়। সারা জীবন জানতে চেয়েছি এই ন-হাজার কোটি নিউরনের কাজ কী। কেন তাদের সৃষ্টিকর্তা ভরে দিয়েছেন করোটির মধ্যে। নিশ্চয় উদ্দেশ্য আছে। নিষ্ক্রিয় নিউরণদের সক্রিয় করলে কী কী ঘটতে পারে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আর ধ্যানের মাধ্যমে তা জানতে চেয়েছি–পেরেছিও।
প্রবেশ করলাম এই নিষ্ক্রিয় নিউরণের রাজ্যে। থাকে থাকে সাজানো কোটি কোটি পুঞ্জীভূত রহস্য। প্রতিটি নিউরণ এক একটি অন্তহীন প্রহেলিকা। শক্তি কেন্দ্র। অসীম শক্তির ভাণ্ডারকে করোটির মধ্যে নিয়ে মানুষ কত অসহায়…ভাবে বুঝি মাত্র পাঁচটা ইন্দ্রিয়ই তার একমাত্র সম্বল। এই পাঁচ ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগৎ ছাড়া অন্য আর কিছুই মানতে চায় না। মূর্খ! মূর্খ!
নিউরণ-লোকে বিচরণ এই আমার প্রথম নয়। ধ্যানের শক্তি নিয়ে আমি কোটি কোটি প্রহেলিকাদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে তাদের চরিত্র জেনেছি, তাদের কাজ জেনেছি, অলৌকিক কাণ্ডকারখানার আধারদের প্রয়োজনমতো সক্রিয় করে তুলে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার মন্ত্রগুপ্তি আয়ত্ত করেছি।
রাজুর নির্মল মস্তিষ্কে প্রবেশ করেই টের পেলাম দোটানার প্রচণ্ড আলোড়ন চলছে। নিউরণদের মধ্যে দিয়ে যেন ঝড় বয়ে চলেছে। আবেগের এই প্রভঞ্জন ধেয়ে আসছে একদিক থেকেই–একগুচ্ছ নিউরণ-কেন্দ্র থেকে–ভুল ধারণা মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসেছে যেখানে।
অনেক কিছুই করা যায় এখন। কিন্তু সে সময় তো নেই। প্রথমেই ওর অসুস্থ চিন্তাধারায়। যে প্ল্যানটা ছকে রেখেছে, সেটাকে ভণ্ডুল করে দিতে হবে। ওর চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, মায়ের ছবিটা বুকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সিধে হয়ে দাঁড়াল। এরপর ওর ইচ্ছে চেয়ারটাকে টেনে তার ওপর দাঁড়িয়ে দড়িটাকে ছোট করে নেওয়া। যাতে চেয়ার থেকে লাফিয়ে পড়লে গলায় এঁটে যায়।
ঠিক এই জায়গাটাতেই কয়েকটা নিউরণকে অসাড় করে দিলাম। দড়ি ছোট করার কথা ভুলে গেল রাজু। খাটে উঠে দাঁড়িয়ে লাভ দিতেই দড়িটা আলগা হয়েই রইল। আরও কয়েকটা নিউরণকে নিষ্ক্রিয় করে দিলাম–যাতে উপস্থিত বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। রাজু মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে গলায় দড়িটা টেনে টেনে বসাতে লাগল। কাঁদছে। হিস্টিরিয়া এসে গেছে। অজ্ঞান হয়ে গেল। গাজলা বেরোচ্ছে ঠোঁটের কষ বেয়ে।
বেরিয়ে এলাম। দুর্গা আতঙ্কঘন চোখে তাকিয়ে ছেলের দিকে।
বললাম–বেঁচে গেল তোমার ছেলে। কিন্তু এভাবে কতদিন ওকে বাঁচাবে?
আপনি ব্যবস্থা করুন ঠাকুর।
ঠাকুর। বেঁচে থাকতে কেউ ঠাকুর বলে ডাকেনি। পাগল বলত সবাই।
বললাম–ঠিক আছে, মা। দেখছি কী করা যায়।
দুর্গার কষ্ট হচ্ছিল। সূক্ষ্মদেহী। অনেক উধ্বস্তর থেকে নেমে এসেছে ছেলের টানে। এখন কষ্ট হচ্ছে। জলের মধ্যে মানুষ ডুবে থাকলে যেরকম কষ্ট হয়, তার চাইতেও বেশি।
বললাম–মা, তুমি যাও। আমি আছি।
আপনার কষ্ট হচ্ছে না?
হলেও যেতে পারছি না, মা। যাও।
দুর্গা চলে গেল। নিশ্চিন্ত মনে আমার পাহারায় ছেলেটাকে সঁপে দিয়ে সে ফিরে গেল ঊর্ধ্বলোকের বিদেহীদের মাঝে।
আমি চেয়ে রইলাম রাজুর মুখের দিকে। অসহায়। বড় অসহায়। বিকারগ্রস্থ হওয়ার ফলে এত বুদ্ধিদীপ্ত হয়েও নির্বোধের মতো আচরণ করে চলেছে। একে টেনে তুলতেই হবে। ঘোর কাটাতেই হবে। অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসতে হবে।
দরজার ল্যাচ-কী ঘুরে গেল। রাজুর বাবা ঢুকলেন ঘরে। শ্রান্ত, ক্লান্ত চেহারা। বয়সে প্রৌঢ়। চোখের তারায় কিন্তু অবসাদ কুঁড়ে বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য ঠিকরে বেরোচ্ছে। যৌবনে ব্যায়ামচর্চার চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে বাহু আর বুকের পেশিতে। লম্বা চুল উস্কখুস্ক। জুলপি পেকে সাদা। সরু গোঁফও বিলকুল রূপোলি।
ঘরে ঢুকেই ভদ্রলোক এদিক-ওদিক তাকালেন। ছেলেকে দেখতে পেলেন না। নিমেষে আতঙ্ক ঘনিয়ে এল দুই চোখে। ছুটে গেলেন রান্নাঘরে, তারপর কলতলায়। ছেলে কোথাও নেই। উদ্ভ্রান্তের মতে ফের দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন বড় ঘরে। ছেলে অনেক সময় খাটের তলায় লুকিয়ে ভয় দেখায় বাবাকে। তাই খাটের তলায় হেঁট হয়ে উঁকি দিলেন। ট্রাঙ্ক আর কার্ডবোর্ড বাক্স বোঝাই থাকায় খাটের ওদিক পর্যন্ত দেখতে পেলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে খাট ঘুরে এদিকে আসতে যাবেন, এমন সময় চোখে পড়ল সিলিং থেকে লাকলাইন দড়ি ঝুলছে। দড়ি নেমে গেছে খাটের ওপাশে মেঝে পর্যন্ত।
মেঝেতে শুয়ে রাজু। অজ্ঞান। বুকের ওপর দুহাতে জড়িয়ে মায়ের বাঁধানো ফটোগ্রাফ–যে মাকে ওর মনেই নেই।
গলায় দড়ির ফাঁসের দিকে চেয়ে রইলেন ওর বাবা। সেকেন্ড খানেক। বিপদ অনেক মানুষের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব জাগিয়ে তোলে। এই ভদ্রলোকের ক্ষেত্রে তাই ঘটল। নিমেষে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে রাজুর শিথিল একটা হাত তুলে নিয়ে মণিবদ্ধে আঙুল টিপে দেখলেন–নাড়ি আছে। ফটোটা বুক থেকে নিয়ে রাখলেন ড্রেসিং টেবিলে। গলা থেকে ফাঁস ফুলে বগলের তলায় হাত দিয়ে মেঝের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে এলেন খাটের এদিকে। দুহাতে ছেলেকে তুলে শুইয়ে দিলেন খাটে। দৌড়োলেন রাস্তার ওপার থেকে ডাক্তারকে ডেকে আনতে।
ডাক্তার এলেন সঙ্গে সঙ্গে। সব শুনে বললেন–এ কেস অফ সিজোফ্রেনিয়া। মেন্টাল হোমে ট্রান্সফার করুন ইমিডিয়েটলি।
সিজোফ্রেনিয়া? সন্দেহ হল আমার। রাজুর মগজের ভেতর এইমাত্র টহল দিয়ে এলাম আমি। এলোমেলো চিন্তার দুঃসহ টানাপোড়েন ছাড়া তো কিছুই চোখে পড়েনি। সিজোফ্রেনিয়া নামক উন্মত্ততার বিকৃতি তো কোনও কোষে দেখিনি–অবশ্য কোটি কোটি নিউরণের সবগুলো আর দেখা হয়নি। তবুও
ডাক্তার বিদায় নিতেই টেলিফোন তুললেন পলাশবাবু। ব্যবস্থা হয়ে গেল বালিগঞ্জের একটি মেন্টাল হোমে। রাজু তখন কলতলায়–শুনতে পেল না–জানতেও পেল না অন্যায়ভাবে তাকে পাঠানো হচ্ছে পাগলা গারদে!
ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দুহাতে মাথা টিপে ধরেছেন পলাশবাবু। পাঁচদিন বয়স থেকে যাকে একটা দিনের জন্যেও কাছ ছাড়া করেননি–আজ তাকে পাঠাচ্ছেন পাগলা গারদে–
রাজু পাগল। এইজন্যেই কি তিনি বিয়ে করলেন না দ্বিতীয়বার? ছেলের জীবনে কোনও অন্তরায় আসুক, তা তিনি চাননি। কিন্তু পরিণাম?
ঠিক এই সময়ে, পলাশবাবুর এই বিহ্বলতার সুযোগে ঢুকে গেলাম তার মগজের কন্দরে–
বললাম–বিয়ে করিনি, ভালোই করেছি। ছেলেটা সৎ-মার হাতে পড়ত। নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে গিয়ে আরও ঝাট বাড়ত।
বললাম–ডাক্তার বলুক গে, পাগলাগারদে ছেলেকে দেওয়া ঠিক হবে না। সেখানে পাঁচ রকম পাগলের মতো একেও পাগলের ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে। ইলেকট্রিক শক দেবেই ঝামেলা কমানোর জন্যে। ব্রেনসেল নষ্ট করে দেবে। খামোকা ছেলেটাকে মগজের শক্তি কমিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়।
পুনরুক্তি করে গেলেন পলাশবাবু। ভাবনাগুলো যেন তাঁরই।
এইভাবেই চলল মগজ ধোলাই। পলাশবাবুর মগজটিও বেশ। আধ্যাত্মিক চিন্তায় ভরপুর। বিশুদ্ধ। পবিত্র পরিবেশ। সৎ চিন্তা, সৎ সঙ্গ আর সৎ কথা তার মগজের এহেন উচ্চাবস্থা এনেছে। যেটুকু দ্বিধা, সংশয়, দিশেহারা অবস্থা এসেছিল, আমি তা কাটিয়ে দিলাম মগজে অধিষ্ঠান করে।
ফলটা কিন্তু নাটকীয় করতে চাইনি ইচ্ছে করেই। রাজুকে বাঁচাবো কথা দিয়েছি দুর্গাকে। তাই সইয়ে সইয়ে পলাশবাবুকে তৈরি করতে হয়েছে। কখনো রাজুর মগজেও প্রবেশ করেছি–তার দানবিক সত্তাকে রুখে দিতে। তার মাথায় যখন খুন চেপেছে, হিংস্র চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে সাইকেলের পাম্পার হাতে নিয়েছে পেটাবে বলে, আমি তখন পলাশবাবুকে ছেড়ে তার মধ্যে ঢুকে মহাবিপর্যয় রুখে দিয়েছি।
কিন্তু হঠাৎ একদিন এমন একটা ঘটনা ঘটল যার পর আমাকে ভাবতে হল অন্য পন্থা।
বেশ ছিল বাপবেটায়। নতুন স্কুলেও ভর্তি হয়ে গেছে। স্কুল খুললেই নতুন বন্ধুদের সঙ্গে হই-চই করার স্বপ্নে বিভোর রাজু। নতুন জামা-প্যান্ট-জুতো-বই এসে গেছে। দুর্গার মুখে হাসি ফুটেছে। ও তো দেখছি রোজই রাত্রে আসে। ছেলের মাথার কাছে চুপটি করে বসে থাকে। রাজু ঘুমিয়ে পড়লেই ওর সূক্ষ্ম দেহের সঙ্গে কত কথাই না বলে।
তাই নিশ্চিন্তে হয়েছিলাম। সংসার সুখের হয়েছে। একজনের হাওয়ার শরীর, বাকি দুজনের রক্তমাংসের।
দিনকয়েকের জন্যে চুম্বক ক্ষেত্রে ভেসে গিয়েছিলাম। বিজ্ঞানীরা এখনও পুরো হদিশ পাননি এই চুম্বক ক্ষেত্র আর তার অকল্পনীয় শক্তির। এই পৃথিবীতেই বিরাজমান এই শক্তি-ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে সূক্ষ্ম শরীরেও আমাকে অবগাহন করে নিতে হয়। বিশেষ করে সৌরঝড়ের সময়ে। মহাজাগতিক রশ্মির প্রভঞ্জন বয়ে যায় পৃথিবীর ওপর দিয়ে। চুম্বক ক্ষেত্ৰ অকল্পনীয় শক্তির আধার হয়ে ওঠে। এইচ, রাইডার হ্যাঁগার্ডের শী উপন্যাসটা যাঁরা পড়েছেন, তারা অবাক হয়েছেন মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকার রহস্যকেন্দ্র এক মৃত আগ্নেয়গিরির মধ্যে রয়েছে জেনে। আসলে, পৃথিবীর বেশ কয়েকটা জায়গায় পুঞ্জীভূত রয়েছে এই শক্তি। প্রাচীন মঠ-মন্দিরগুলো নির্মিত হয়েছে এই সব জায়গাতেই। দৈবী-শক্তি প্রকৃতপক্ষে এই মহাশক্তি। কুম্ভমেলায় বারো বছর অন্তর যাঁরা গেছেন, তাঁরা দেখেছেন, মধ্যরাত্রে স্নান করার ঠিক সময়টিতে আচম্বিতে কোথা থেকে প্রবল হাওয়া বইতে শুরু করে। প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে একটা ডুব দিলেই কিন্তু কাঁপুনি চলে যায়–আর শীত করে না। এ হাওয়া কোথা থেকে আসে, আসলে তা হাওয়া কি অন্য কিছু, বারো বছর অন্তর কুম্ভ মেলায় কেন সারা পৃথিবীর যোগীরা আসেন–তা অনেকেই জানেন না। পৃথিবীর অনেক অজানা রহস্যের অন্যতম এই রহস্য কিন্তু আমার কাছে মোটেই রহস্য নয়। যখন বেঁচে ছিলাম, সাধনা করেছি হিমালয়ের বিশেষ এক গিরিগুহায়–শক্তির কেন্দ্র আছে সেখানে। মৃত্যুর পরেও অমর সাটাকে মাঝে মাঝে নিয়ে যাই শক্তি-স্নানে অক্ষয় অব্যয় থাকবার মানসে।
কিন্তু নিজের প্রসঙ্গ বড় বেশি বলে ফেলেছি। শক্তি কেন্দ্রে সেবার দেখলাম আরও অনেক বিদেহী গুরু এসেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছে মাদাম ব্লাভাস্কি, কর্নেল অলকট এবং একজন স্বামীজি যিনি থিয়সফিস্টদের সম্বন্ধে কত কটুক্তিই করেছেন একসময়ে। কিন্তু এই শক্তি ক্ষেত্রে দেখলাম তোফা আছেন তিনজনে।
কথায় বলে, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস। তা আমার স্বর্গ তো এই পৃথিবী। তাই মিশে গেলাম সৎসঙ্গে বেশ কিছুদিনের জন্যে। এমন সময়ে একদিন গুরুজি দর্শন দিলেন অকস্মাৎ। এই গুরুজির নাম পৃথিবীর সবাই জানেন। কিন্তু আমি তা বলতে চাই না। কথা দিয়েছি।
গুরুজি সৌম্য হেসে বললেন–তুই এখানে সৎসঙ্গ করছিস, ওদিকে তোর রাজুর অবস্থা
যে কাহিল হয়ে এল। যা পালা।
তৎক্ষণাৎ চলে এলাম রাজুর ঘরে। দেখলাম রাজু মেঝেতে বসে কটমট করে তাকাচ্ছে আর চোখ ঘোরাচ্ছে। একটু তফাতে বসে ওর বাবা। ম্লান উদ্বিগ্ন মুখে বিপদের কালো ছায়া।
রাজুর সামনে ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা কালোমতো বেঁটেপানা চশমাধারী এক প্রৌঢ় একটা ঝাঁটার কাঠি নিয়ে মন্ত্র পড়ছে।
রাজুর সমস্ত সত্তায় জড়িয়ে রয়েছে বীভৎস কালো একটা ছায়া।
দেখেই আঁতকে উঠেছিলাম। এ যে সেই বিভীষিকা–অন্ধকারের পুঞ্জ হতে যার জন্ম অন্ধকারেই যার নিবাস। কিন্তু সরল রাজুকে আশ্রয় করেছে কেন?
ফ্ল্যাটটা একতলায়। পাশেই জলা জায়গা। নোংরা বস্তি। বুঝলাম সবই। রাজু দাঁত মাজা ছেড়েছে। ঘরদোর বমি করে ভাসাচ্ছে। যেখানে সেখানে মলত্যাগ করছে। শুভ শক্তি ঘর থেকে বিদায় নিয়েছে। আবির্ভূত হয়েছে অশুভ শক্তি।
এই ছায়াদানবকে আমি চিনি। মানুষের মনের যত পাপ, যত অন্যায়, যত কালিমা–সব পুঞ্জীভূত হয় ইথারে–ইথিরীয় উপাদানে গঠন করে নেয় কায়া–অপার্থিব সেই কায়া হন্যে হয়ে খোঁজে একটি আশ্রয়–এমন একটি আশ্রয় যাকে বেষ্টন করে পরজীবি লতার মতো নিজের পুষ্টিসাধন করে চলবে, ভোগবাসনা মিটিয়ে চলবে।
এ ছায়াদানবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপাচার, অতৃপ্ত কামনার ক্ষুধিত লিপ্সা; এর বিবেক নেই, বোধ নেই, মায়া নেই, মমতা নেই। অতীতেও দেখেছি জগতের অনেক শুভশক্তি এর কুটিল শক্তির কাছে হার মেনেছে। পারব কি আমি?
গুণীন ভদ্রলোক আঁচ করেছে খানিকটা। অশরীরীর অস্তিত্ব অনুমান করে নিয়ে ঝাড়ফুঁক করে চলেছে সেইভাবে কিন্তু কল্পনাও করতে পারেনি–অশরীরী বা দুষ্ট প্রেতাত্মার চাইতেও সহস্র গুণে ভয়াবহ এই ছায়াদানব। মানুষের চোখে সে অদৃশ্য। দৃশ্যমান হলে দাঁতকপাটি লাগতই।
রাজু, মাগো তো কাঠিটা আঙুল দিয়ে, বলে মন্ত্রপড়া ঝাটার কাঠিটা এগিয়ে দিল গুণীনবাবু। চশমাটা ঠিক করে নিয়ে চেয়ে রইল হাসি হাসি মুখে। ভাবখানা, যাবে কোথায় বাছাধন!
রাজুর চোখ জ্বলছে। অমানুষিক চাহনি। বনের শ্বাপদও এ চাহনি দেখলে শিউরে উঠত। কাছে ঘেঁসত না। কিন্তু গুনীনবাবু আঙুলের স্টিলের আংটিটা একবার নিজের কপালে চুঁইয়ে শুধু বললেন–মাপ রে, মাপ। এক ঘণ্টার মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাজুর শরীর এই কদিনেই যেন দুগুণ ফুলে উঠেছে। গোল কাঁধে চিতাবাঘের মতো ঝুঁকে লাফিয়ে পড়ার প্রবণতা। স্ফুলিঙ্গ চোখে সেই রক্তহিম করা জিঘাংসা।
ঠোঁট আর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রাজুর। কিন্তু সামলে নিলে নিজেকে শেষ মুহূর্তেও। কাঠিটাকে মেঝেতে ফেলে আঙুল ফেলে ফেলে মাপল–বাইশ।
অর্থাৎ বাইশ আঙুল লম্বা কাঠি।
কাঠি টেনে নিল গুণীনবাবু। আবার কিছুক্ষণ মন্ত্র পড়ল আর ফুঁ দিল–মন্ত্র পড়ল আর ফুঁ দিল-মন্ত্র পড়ল আর ফুঁ দিল বার বার তিনবার। তারপর কাঠিটা বোলাতে লাগল রাজুর গায়ে।
চাপা গলায় গজরে উঠল রাজু। চোদ্দো বছরের এই ছেলের গলায় শুনেছি সুমিষ্ট স্বর–এত কর্কশ, গুরুগম্ভীর গজরানি এ কণ্ঠে কল্পনাই করতে পারা যায় না। শিউরে উঠলেন পলাশবাবু। ভয়ে কাঠ হয়ে চেয়ে আছেন ছেলের দিকে।
চমকে উঠেছিল গুণীনবাবুও। পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দ্রুত হাতে বারকয়েক সারা গায়ে কাঠি বুলিয়ে নিয়ে টেনে ধরল মেঝের ওপর।
বলল–রাজু, নিজে মাপ।
প্রতিবার গায়ে কাঠি বোলাবার সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকে কুঁচকে যাচ্ছিল রাজু। চোখে সেই অগ্নিগর্ভ দৃষ্টি, শক্ত ঠোঁট একটু ফাঁক হয়ে যাওয়ায় না মাজা হলুদ দাঁত বাঘের মতো যেন রক্ত-তৃষ্ণায় লোলুপ। দৃশ্যটা অতিশয় রোমাঞ্চকর। কিন্তু গুণীনবাবু তো এসব দেখেশুনে অভ্যস্ত। তাই পরোয়া করেনি। হুকুমের স্বরে বলল-রাজু, নিজে মাপ।
ভেবেছিলাম এবার রাজুর ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। কিন্তু আবার সামলে নিল সে নিজেকে। আমি যে শক্তি দিয়ে এসেছি ওর মগজে, এখনও তার রেশ রয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
কাঠিটা মাপল রাজু। একই কাঠি একটু আগে মেপেছিল বাইশ আঙুল। কোনও হাতসাফাই যে হয়নি তা তো দেখাই যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও এবার তা মাপবার পর দাঁড়াল চৌত্রিশ আঙুল।
কাঠি বেড়ে গেছে। গুণীনবাবু বাহাদুর বলতে হবে। ছায়াদানবের কিছুটাকে মন্ত্রবলে টেনে এনেছে কাঠির মধ্যে।
তাকিয়ে দেখলাম, রাজুর অবয়ব ঘেরা ছায়াদানব কঁপছে থির থির করে…একবার গুটিয়ে গিয়ে আবার বড় হয়ে যাচ্ছে..আর ভলকে ভলকে কালচে বেগুনি কুৎসিত আভা ঠিকরে যাচ্ছে চারিদিকে।
বলা বাহুল্য এ সবই দেখলাম আমি। আর কেউ না।
খুশি গলায় বললে গুণীনবাবু–রাজু, আর ভয় নেই। ব্যাটাকে পাকড়েছি। কজায় এসে যাবে এখুনি। তারপর কাঠি ছোট হতে হতে দেখবি পনেরো আঙুলে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কয়েকবার ঝাড়লেই
পরক্ষণেই বুঝি প্রলয় ঘটে গেল ঘরের মধ্যে। এত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে গেল যে ভালো করে দেখা গেল না কি হয়ে গেল।
শুনলাম একটা শতবজ্রগর্জনের মতো হুঙ্কার রাজুর কণ্ঠে। সঙ্গে সঙ্গে সে ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠেই বোধহয় পর পর প্রচণ্ড লাথি মেরে গেছিল বসে থাকা গুণীনবাবুর চোয়ালে, বুকে আর পেটে। বোধহয় বললাম এই কারণে যে তিড়িংমিড়িং করে লাফিয়ে উঠে রাজুকে কেবল এ-পা আর ও-পা ছুঁড়তে দেখেছিলাম। এরই নাম বোধহয় ক্যারাটে বা কুংফু।
ফলটা হল এইরকম : বেঁটেখাটো গুণীনবাবু বসে থাকা অবস্থাতেই শূন্য পথে উড়ে গেল এবং দশ ফুট পেছনকার খোলা দরজা দিয়ে আছড়ে পড়ল বাইরের চাতালে।
প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আছে বটে ভদ্রলোকের। নিমেষমধ্যে গড়িয়ে গিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়িয়েই কাঁচাকেঁচা সামলাতে সামলাতে ছুটল বাস স্ট্যান্ডের দিকে।
ফিরে তাকালাম রাজুর দিকে। তার চোখে খুনের সঙ্কল্প। আতঙ্কে পাংশুবর্ণ পলাশবাবু।
মনস্থির করে নিলাম তৎক্ষণাৎ। প্রবেশ করলাম পলাশবাবুর মগজে। সব যেন পাথর হয়ে গেছে সেখানে। শক্তি প্রভাবে খানিকটা ধাতস্থ করলাম তাঁকে। দুর্গার কথা আমি রাখব ঠিকই। বাঁচাবো রাজুকে। তার আগে বাঁচাতে চাই পলাশবাবুকে। খুন হয়ে যাবে যে ছেলের হাতে।
বললাম–রাজু, যা হাত মুখ ধুয়ে আয়।
রাজু তো চায় কলতলাতেই থাকতে চায় তার শরীরের দখলদার এই বিভীষিকা। রক্তবর্ণ চোখে সে কলতলায় ঢুকতেই পলাশবাবুর হাতটা বাড়িয়ে দিলাম টেলিফোনের দিকে। যে নম্বরটা অনেকদিন ধরে মনে করতে পারছিলেন না–সেটা ডায়াল করালাম ওঁর আঙুল দিয়ে। ওপাশ থেকে ভেসে এল তীব্র ব্যক্তিত্বময় কণ্ঠস্বর।
কথা হয়ে গেল সংক্ষেপে। রাজু বেরিয়ে আসার আগেই (পাক্কা দু-ঘণ্টা পরে) রিসিভার রেখে প্রতীক্ষায় রইলেন পলাশবাবু। মনকে আমি শক্ত করে ধরে রয়েছি। তাই আজ এত নিষ্ঠুর হতে পারবেন। ছেলের মঙ্গলের জন্যেই হতে হবে।
রাজু অশুচি কলতলা-পাইখানা থেকে অশুচি দেহ আর অশুচি মন নিয়ে বেরিয়ে এসে তিন লিটার দুধ আর আমসত্ত খেয়ে নিল একসঙ্গে, সেইসঙ্গে কলা বেশ কয়েকটী। পেট জয়ঢাক। অবয়ব ঘিরে ছায়াদানবকে বেশ পরিতৃপ্ত দেখলাম। বিজয় গৌরবে উল্লসিত। তাই বিকট আভার বিকিরণ আর দেখা যাচ্ছে না। একটু একটু করে কালো ছায়াটা প্রবিষ্ট হচ্ছে সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা গৌরবর্ণ দেহটার মধ্যে। মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসেছে আর কী।
হাসলাম। জানি এর ওষুধ কী। ওঝা, গুণীনরা তা জানে না। বিজ্ঞানসাধক ছিলাম বলেই–ঘুমিয়ে পড়েছে রাজু। ওর নিঃশ্বাসেও এখন দুর্গন্ধ। মুখে তো বটেই। ফুলের মতো সেই ছেলেটা, যার নিষ্পাপ মুকুলে ছিল অরণ্যের আশ্বাস–আজ সে ক্ষুদে দানব!
চেয়ারে ঠায় বসে আছেন পলাশবাবু। দরজা জানলা সব বন্ধ। আলো জ্বলছে ঘরে–দিনের বেলাতেও।
মৃদু টোকা পড়ল দরজায়। উঠে গেলেন পলাশবাবু। সামনে দাঁড়িয়ে তিনজন জোয়ান চেহারার যুবক।
একজন বললে–ডক্টর বক্সীর কাছ থেকে আসছি।
দরজাটা দু-হাট করে খুলে দিলেন পলাশবাবু। বললেন–গাড়ি কোথায়?
ওই তো–।
দরজার সামনে এনে রাখুন।
গাড়ি এল দরজার সামনে–শুধু ফুটপাত পেরোতে হবে। ব্যাকডোর খোলাই রইল।
যুবক তিনজনকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন পলাশবাবু। ঘুমন্ত রাজুকে তিনদিক থেকে ঘিরে ধরল তিনজনে–খাটের তিন পাশে। মাথার কাছে দেওয়াল। পালাবার পথ ওখানে নেই।
পলাশবাবু টেলিফোনে সব কথাই বলেছিলেন ডাক্তার বক্সীকে। তিনি বড় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হতে পারেন কিন্তু রাজু তার কাছে হবে একটা চ্যালেঞ্জ। এশিয়া-বিখ্যাত তিন মনোচিকিৎসককে সে ঘোল খাইয়েছে (সেটা যে আমার জন্যেই, পলাশবাবু তা জানবেন কী করে?) ক্যারাটে মার জানে, গায়ে এখন অসুরের মতো শক্তি। এর আগে একটা পাগলা-গারদে একাই এক মিনিটের মধ্যে মেল নার্স, ডাক্তার, দারোয়ানকে পিটিয়ে, চেম্বার তছনছ করে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে পিথিডন ইঞ্জেকশন দেওয়া সত্ত্বেও।
ডাক্তার বক্সী তাই সেইরকম লোক পাঠিয়েছেন। পলাশবাবু জানেন, এক্ষুনি কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটে যাবে। তবুও সাহস সঞ্চয় করে ঠেলা দিলেন রাজুকে–ওঠ রে।
চোখ মেলল রাজু। খাটের তিন পাশে তিনজন অচেনা পুরুষ দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল তৎক্ষণাৎ। নগ্ন গা, পাজামার দড়ি শিথিল–এসময়ে…
মৃদু স্বরে পলাশবাবু বললেন–যেতে হবে–ওঠ!
সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলেই চিৎকার করে উঠল রাজু–না!
বুঝেছে সে কোথায় যেতে হবে। কিন্তু হাত-পা চালানোর সময় দিল না তিন মজবুত পুরুষ। দুজনে চেপে ধরল দু-কব্জি আর দু-পায়ের গোছা। আর একজন মাথা–যাতে ঘাড় বেঁকিয়ে কামড়ে দিতে না পারে।
প্রলয় ঘটতই। কিন্তু তা হল না। চ্যাংদোলা করে বিছানা থেকে টেনে নামিয়ে সটান গাড়িতে তুলে ফেলা হল রাজুকে। কালো ছায়াদানবকে ফুঁসতে দেখলাম ওর অবয়ব দিয়ে।
ট্যাক্সি বেরিয়ে যেতেই আমি ওদের পৌঁছনোর আগেই চলে গেলাম মেন্টাল হোমে–ঢুকে গেলাম ডাক্তার বক্সীর মগজে।
.
দীর্ঘদেহী, উন্নতনাসা, গৌরবর্ণ ডক্টর বক্সী যখন অনর্গল পাইপ টানছেন, রাজুকে চ্যাংদোলা করে এনে ফেলা হল তার সামনে।
পাজামা অর্ধেক খুলে গেছে। বিশাল শরীর বিশালতর হয়েছে। রাজু যেন সত্যিই এখন দানব। নোংরা দাঁতে মুখে অকপট হত্যালালসা, রক্তবর্ণ ঘূর্ণিত চোখে ঘৃণার বিষ। কণ্ঠে হুংকার–এখানে কেন?
মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে তিনবার টেবিলে ঠুকলেন ডাক্তার বক্সী। যে কাজটা অনেক পরে করার কথা, সেটা যাতে এখুনি করা হয়–এই প্ল্যান আমি তখন তাঁর মাথায় বসে জুগিয়ে চলেছি। আমার কথাই তিনি বললেন মুখ দিয়ে–সেলে ঢুকিয়ে দাও। গিভ হিম শক!
ডাক্তার বক্সী শকথেরাপিতে বিশ্বাস করেন না। খামোকা ব্রেন সেল নষ্ট করে দেওয়ার পক্ষপাতী তিনি নন। টকথেরাপীতে মির্যাকল দেখান, কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ। মাসের পর মাস মেন্টাল হোমে থাকতে হয়। খরচসাপেক্ষও বটে। মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে যেতে হয়। তাই তিনি কুসংস্কারমুক্ত হলেও ভোলা মনে কিছুদিন স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটির শক-থেরাপি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। সমসাময়িক মনোরোগ-বিশেষজ্ঞদের বলেননি–ভূতে পাওয়া রোগীদের ভালো করার জন্যেই তাঁর এই গবেষণা। টিটকিরি দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই। প্রেতদেহ যে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটিতে সইতে পারে না–এ তত্ত্ব তিনি জেনেছিলেন সাইকিক রিসার্চ সোসাইটি থেকে। সুফলও পেয়েছিলেন কয়েকটা কেসে কিন্তু টিটকিরির ভয়ে গবেষণাপত্রে তা হাজির করেননি পাঁচ কান করেননি। লোকে জেনেছে, তিনি শক দিয়ে রোগ সারিয়েছেন।
আমাকে পাঁচ জায়গায় যেতে হয় বলেই জানতাম তার চিকিৎসার গুপ্তরহস্য। রাজুকে এতদিন এখানে আনিনি– কারণ ভূতে পাওয়ার কে তার নয়। কিন্তু আজ ভূতেদের গুরু ঢুকেছে তার শরীরে।
সুতরাং…
.
তিন মাস পরে দেখা গেল সল্টলেকের স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে নতুন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে রাজুকে স্কুটার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পলাশবাবু। মুখে প্রশান্ত হাসি। রাজু ঝকঝক করছে। ব্যক্তিত্ব আর আচরণ পাল্টে দিয়েছেন ডাক্তার বক্সী।
ছায়া-দানব শক খেয়েই পালিয়েছিল। তারপর ওকে টক থেরাপি দিয়ে খাপখোলা বাঁকা তলোয়ার বানিয়ে ছেড়েছেন ডাক্তার বক্সী। টিকালো নাক, বুদ্ধি উজ্জ্বল চোখে কোথায় সেই অতীতের বিভীষিকা?
পেছন পেছন দুর্গা যাচ্ছিল। সঙ্গে আমি।
ও বললে–বড় কষ্ট হচ্ছে। এখন চলি?
যাও, বললাম আমিরাজুর ভার আমার।
দুর্গা আর আসেনি। ভেবেছিলাম পুনর্জন্ম নিয়েছে।
.
রাজুর বিয়ে হল কালকে। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতে দেখলাম দুর্গাকে। সূক্ষ্ম দেহে।
পাগলি!
* রহস্য পত্রিকায় প্রকাশিত।