এই আশ্রমের ছাত্র অধ্যাপক বন্ধু একে একে অনেকেই এখান থেকে চলে গেছেন, আজ তাঁদের সকলকে স্মরণ করতে হবে। আজ তাঁরা অন্য প্রবেশপথ দিয়ে চিরন্তনের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, তাঁরা অমৃতলোকে প্রবেশ করেছেন। আজ আমরা যেন তাঁদের মধ্যে নিত্যস্বরূপের পরিচয় পাই।
যে-সব ছাত্র এখানে থেকে কিছু নেবার জন্য এসেছিল সেই নেওয়ার আনন্দের মধ্যেই তারা একটি বড়ো জিনিস এখানে রেখে গেছে। শিশু যেমন পৃথিবীতে মাতৃস্তন্যের ভিক্ষু হয়ে আসে আর তাদের সেই ক্ষুধার আবেদনের দ্বারাই এবং মাতৃস্নেহের দানকে সহজ আনন্দে গ্রহণ করার দ্বারাই মাতার স্বরূপকে সহজ করে দেয় তেমনি যে-সব ছাত্র এখানে আশ্রম-জননীর কাছ থেকে সূর্যোদয়ের আলোক-বাণী শুনেছে, অমৃতঅন্নের দান গ্রহণ করেছে তাদের সেই দান গ্রহণের সহজ আনন্দের দ্বারাই এখানকার আশ্রমের সত্যটি পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
শুষ্ক ভূমিতে যখন বর্ষণ হয় তখন সেই ভূমি আবার বারিধারাই ফিরিয়ে দেয় না, কিন্তু তার শ্যামল সফলতার দ্বারাই সেই দানের প্রতিদান করে– আর এই দেওয়া-নেওয়ায় আকাশ-ধরণীর মিলন সার্থক ও সুন্দর হতে থাকে। যে-সব ছাত্র এখানে এসেছিল, আর প্রাণপ্রবাহের কল্লোলে আশ্রম মুখরিত করে তুলেছিল তারা যদি জীবনযাত্রার পাথেয়স্বরূপ এখান থেকে কিছু আহরণ করে থাকে, যদি তাদের দুঃখদুর্দিনে তা শান্তিদান করে থাকে, তবে তাদের সেই চরিতার্থতা তাদের তেমন নয় যেমন এই আশ্রমের। যে-সন্তান প্রবাসে চলে গেছে, যদিচ মাতার সেবার পরে আর তার নির্ভর থাকে না তবু মাতার অন্তরের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয় না, কেননা মাতার জীবনের মধ্যে গভীরভাবে সেই সন্তানের জীবন মিলিত। তেমনি যে-সকল ছাত্র ইহলোক থেকে চলে গেছে তারাও আশ্রমের জীবনভাণ্ডারে তাদের জীবনের দান রেখে গেছে, এই আশ্রমের সৃষ্টিকার্যে তারা মিলিত হয়ে গেছে, এইজন্যে তারা চলে গেলেও তাদের সঙ্গে আশ্রমের বিচ্ছেদ ঘটে না। সেই-সকল এবং পরলোকগত অধ্যাপক বন্ধুদের আজ আমরা স্মরণ করি।
কিন্তু আমাদের যে বন্ধুর আগমনের জন্যে আমরা কিছুকাল ধরে প্রতীক্ষা করছিলুম, কিন্তু যাঁর আর আসা হল না সেই অকাল-মৃত্যুগ্রস্ত আমাদের পরম সুহৃদ পিয়র্সনের কথা আজ বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। তিনি চলে যাওয়ায় ক্ষতির কথা কিছুতে আমরা সহজে ভুলতে পারি নে। কিন্তু তাঁকে কেবল এই ক্ষতির শূন্যতার মধ্যে দেখলে ছোটো করে দেখা হবে। আমাদের যে ধন বাইরের জিনিস বাইরে থেকে যাবামাত্রই তার ক্ষতি একান্ত ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যাঁর জীবন নিজের আমি-গণ্ডিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যিনি কেবল নিজেরই মধ্যে বেঁচে ছিলেন না মৃত্যুর দ্বারা তাঁর বিনাশ হবে কী করে?
এই বন্ধুটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ইংলণ্ডে। যেদিন তাঁর বাড়িতে প্রথম যাই সেদিন গিয়ে দেখি যে দরজার কাছে সেই সৌমমূর্তি প্রিয়দর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাকে দেখে অবনত হয়ে আমার পায়ের ধুলা নিলেন। আমি এমন কখনো প্রত্যাশা করি নি, তাই চমকে গেলুম। আমি তাঁর সেই নতি-স্বীকারের যোগ্য না হতেও পারি, অর্থাৎ এর দ্বারা আমার কোনো পরিচয় আমি দাবি করি নে কিন্তু এর দ্বারা তাঁরই একটি উদার পরিচয় পাওয়া যায়– সেটি হচ্ছে এই যে, তাঁর আত্মা ইংরাজের রাষ্ট্রীয় প্রতাপের বেড়াটুকুর মধ্যে বাঁধা ছিল না, ন্যাশানালিজমের বিরাট অহমিকায় তাঁকে পেয়ে বসে নি, নিখিলমানবের পৃথিবীতেই তাঁর স্বদেশ ছিল। সেদিন তাঁর স্বজাতীয় অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হয়তো তাঁরা কেউ কেউ মনে করে থাকবেন এতে রাজ-সম্মানের হানি করা হল। কারণ তাঁদের প্রত্যেকেরই ললাট ইংরেজের রাজটিকা বহন করছে। বাহ্যত সেই ললাট ভারতীয়ের কাছে নত করা রাজশক্তির অসম্মান করা। কিন্তু ইংরেজের রাজশক্তিতে পিয়র্সন কোনো দিন আপন অধিকার দাবি করেন নি। এমনিভাবে আমাদের প্রথম পরিচয়ের সূত্রপাত।
তারপর যখন তিনি প্রথমে শান্তিনিকেতনে এলেন তখন বাইরের দিক থেকে আমরা তাঁকে কীইবা দেখাতে পেরেছিলুম? আমার ইস্কুল ছিল অতি সামান্য, তার এমন ধনগৌরব ছিল না যে সাধারণ লোকের প্রশংসা আদায় করতে পারি। আমার দেশের লোক আমার এই কাজকে তখন স্বীকার করে নি। বাইরের প্রাঙ্গণে তখন এর আলো জ্বলে নি। কিন্তু তিনি এর ভিতর মহলের একটি আলো দেখতে পেয়েছিলেন, তাই সেই আলোকের কাছে তাঁর জীবনের দীপকে জ্বালিয়ে উৎসর্গ করে দিতে তাঁর আনন্দ বোধ হয়েছিল। বাহিরের সমারোহের জন্যে তাঁকে এক-মুহূর্ত অপেক্ষা করতে হয় নি। আমি জানি তাঁকে কলেজের প্রিন্সিপাল করবার জন্য কেহ কেহ পীড়াপীড়ি করেছিল, কিন্তু তিনি উচ্চবেতনের পদের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর জীবন যৌবন আরাম অবকাশ সমস্তই একে নিঃশেষে দিয়েছেন। ইংরেজের প্রভুত্বমর্যাদা তাঁর ছিল– দাবি করেন নি; ভোগ করবার নবীন বয়স ছিল– ভোগ করেন নি; দেশে মা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন ছিল– তাদের সঙ্গ ও সেবা ছেড়ে এসেছেন; নগ্ন পদে ধুতি জামা পরে বাঙালির ছেলের মতো থেকে এই আশ্রমের সেবা করে গেছেন; মুহূর্তকালের জন্য দুঃখ পরিতাপ বোধ করেন নি। তিনি মনে করতেন যে এই পরম সুযোগ লাভ করে তিনি ধন্য হয়েছেন। এর জন্য তিনি কতখানি কৃতজ্ঞ ছিলেন তা তাঁর Shantiniketan the Bolpur School বইখানি পড়লেই জানা যায়। পিয়র্সন সাহেব তাঁর আপন আন্তরিক মহত্ত্ববশতই সাধনার মধ্যেই মহত্ত্বের আবির্ভাবকে সুস্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন।
আমরা যখন এত বড়ো মহৎ দান পেয়ে থাকি তখন আমাদের একটি খুব বড়ো বিপদের আশঙ্কা থাকে; সে হচ্ছে পাছে আমরা ভিক্ষুকের মতো দান গ্রহণ করি। ভিক্ষুক যখন দান পায় তখন দানটাকেই সে যাচাই করে থাকে, জানতে চায় বাজারে তার মূল্য কত। দাতা তার কাছে গৌণ। দানের দ্বারা দাতা নিজের কত বড়ো পরিচয় দিলে সেটাকে সে তার ব্যবহারের পক্ষে আবশ্যক মনে করে না। এমন-কি, তার দাবির মহিমাকেই সে বড়ো করতে চায়, মনে করতে চায় দান প্রাপ্তিতে তার অধিকার আছে। এতে কেবল এই বোঝায় যে, আসল জিনিসটা নেবার শক্তি ভিক্ষুকের নেই।
তাই আমাদের পরলোকগত বন্ধু বাইরের কাজ কতটুকু দেখিয়ে গেছেন, তাতে আমাদের কী পরিমাণ লাভ হয়েছে তারই হিসাব নিকাশ করে তার বিচার করলে চলবে না। তিনি তাঁর অর্ঘ্য সাজিয়ে দিয়ে গেছেন এটা বড়ো কথা নয়, কিন্তু তিনি তাঁর আত্মত্যাগকে দিয়ে গেছেন এইটেই মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদই আমাদের চরম সার্থকতার দিকে নিয়ে যায়; আমাদের অন্তরের মধ্যে এরই অভাব সকলের চেয়ে বড়ো দারিদ্র্য। এই আত্মত্যাগ যিনি দান করেন তাঁর দানকে আমরা যদি সত্যভাবে গ্রহণ করিতে পারি, তা হলে আমাদের আত্মা শক্তি লাভ করে। আমার “কথা ও কাহিনী’র প্রথম কবিতায় এই কথাটাই আছে। ভগবান বুদ্ধের ভিক্ষুদূত পুরবাসীদের দ্বারে দ্বারে যখন প্রভুর নামে ভিক্ষা চেয়ে ফিরেছিলেন তখন ধনীরা তাঁর কাছে মূল্যবান দানসামগ্রী এনে দিলে, তিনি বললেন, হল না। কেননা সেই দানে ধন ছিল কিন্তু আত্মা ছিল না। দরিদ্র নারী যখন তার একমাত্র গায়ের বসন দিল তখন তিনি বললেন পেয়েছি, কেননা সেই অনাথা ধন দিতে পারে নি, কিন্তু আত্মত্যাগের দ্বারা আত্মাকে দিয়েছে। পরমভিক্ষু আমাদের কাছে সেই আত্মার অর্ঘ্য চান– যাঁরা দিতে পারেন তাঁরাই ধন্য– কারণ তাঁদের সেই নৈবেদ্য, দেবতার ভোগের সামগ্রী, সমস্ত মানুষের পক্ষে অমৃতঅন্ন। সেই দান সেই অমৃত পিয়র্সন যদি এই আশ্রমে দিয়ে গিয়ে থাকেন তবে আমরা যেন তা সত্যভাবে গ্রহণ করবার শক্তি রাখি। তাঁর দানের থেকে আমরা তার বাহিরের মূল্যটুকু নেব না কিন্তু তার অন্তরের সত্যটুকু নিই। নইলে ভিক্ষুকতার যে ব্যর্থতা ও লজ্জা তার থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই।
সেই সত্যটি কী ভেবে দেখা যাক। পিয়র্সন ছিলেন ইংরেজ, কিন্তু ভারতবর্ষে সম্পূর্ণভাবে তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করতে পেরেছিলেন। তার দুঃখে অপমানে ব্যথিত হয়ে তিনি নিজের জাতিকে নিন্দা বা আঘাত করতে লেশমাত্র কুণ্ঠিত হন নি। যাকে আমরা আজকাল দেশাত্মবোধ নাম দিয়েছি সেই দেশাত্মবোধকেই তিনি সকলের চেয়ে বড়ো মর্যাদা দেন নি। এমন-কি একদা তিনি ভারতের হিত কামনায় সেই দেশাত্মবোধকে এমন আঘাত করেছিলেন যে তাঁর দেশের রাজদণ্ড তাঁকে চীন থেকে তাড়া করে নিয়ে ইংলণ্ডে নজরবন্দী করে রেখেছিল।
প্রবল দেশাত্মবোধ নিয়ে কোনো ইংরেজ কখনো আমাদের কিছু দান করেন না তা নয়, কিন্তু সে দান তাঁর উদ্বৃত্ত থেকে। দেশাত্মবোধের ভোজের যে পরিশিষ্ট অনায়াসে দেওয়া যায় তাই। অর্থাৎ আত্মা তিনি দেশকেই দেন, বাহিরের ঝুলিঝাড়া কিছু আমাদের দিয়ে থাকেন। পিয়র্সন তা করেননি– তিনি তাঁর আত্মাকেই দিয়েছিলেন আমাদের, এবং সেই উপলক্ষে সমস্ত মানুষকে, সমস্ত মানুষের দেবতাকে। আমি তাঁকে দেশ-বিদেশে নানা অবস্থায় দেখেছি– চীনে হোক জাপানে হোক অন্যত্র হোক যেখানেই তিনি দুঃখ বা অপমান দেখেছেন এবং এও অনুভব করেছেন যে, সেই দুঃখ অপমানের মূলে আছে তাঁর স্বজাতি– সেখানে তিনি মুহূর্তকালের জন্য এবং লেশমাত্র পরিমাণেও স্বদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করেন নি। তিনি জানতেন যে ইংলণ্ডের সভ্যতা ও উন্নতি এশিয়া ও আফ্রিকার প্রাণ পোষণের উপর একান্ত নির্ভর করে, তার ধনসম্পদ প্রতাপের চারণক্ষেত্র এই-সকল মহাদেশে; তৎসত্ত্বেও তিনি তাঁর শুভচিন্তা ও সাধু লক্ষ্য বিশুদ্ধভাবে, নিঃস্বার্থভাবে ও সম্পূর্ণভাবে সর্বমানবের অভিমুখে প্রেরণ করেছিলেন।
কিন্তু যখন পিয়র্সনকে আমরা ভারতবন্ধু বলে আদর করি তখন তাঁর জীবনের এই বড়ো সত্যটিকে এক রকম করে চাপা দিয়ে রাখি। তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যেখানে আমাদের স্বাজাত্য অভিমানকে তৃপ্ত করে সেইখানেই তাঁকে যথার্থভাবে গ্রহণ করি ক্ষণকালের জন্যে চিন্তাও করি নি যে এই স্বাজাত্য অভিমানকে জলাঞ্জলি দিয়ে তবে তিনি আমাদের কাছে এসেছেন, এবং সেই মহিমাতেই তাঁর জীবন দীপ্যমান। যদি তাঁর এই সত্যকে আমরা শ্রদ্ধা না করি তবে তাঁর হাত থেকে দান গ্রহণ করবার মতো দীনতা আর কিছু হতেই পারে না। তাঁকে বহিষ্কৃত করে তাঁর দান গ্রহণ করায় তাঁর প্রতি ও নিজের প্রতি যে অশ্রদ্ধা করা হয় সেটা যেন আমরা অনুভব করতে পারি।
সেই বড়ো সত্যকে স্বীকার করবার জন্য বিশ্বভারতীর সাধনা। যাঁরা বিশ্বের জন্য তপস্যা করেছেন এখানে তাঁদের আসন পাতা হোক। আমরা “বন্দেমাতরম’ বলে জয়ধ্বনি করলে কেবল স্বদেশকে ক্ষুদ্র করা হবে, আমরা এই কার্পণ্যের দ্বারা বড়ো হতে পারব না। মানবপ্রেমের অর্ঘ্য হৃদয়ে বহন করে সমুদ্রপার থেকে যে বন্ধুরা আমাদের কাছে আসছেন তাঁদের জীবন বিশ্বভারতীর তপস্যার ভিতর দিয়ে এই কথাই ঘোষণা করছে যে, সকল মানুষের মধ্যে নিজের মনুষ্যত্বকে উপলব্ধি করা মানব সম্বন্ধে সত্যকে পাওয়া।
পিয়র্সন ভারতবর্ষে এসে শুধু যে এর দুঃখকষ্ট অপূর্ণতার মধ্যে একে সেবা করে গেছেন তাই নয় কিন্তু তিনি এখানকার জীবনযাত্রার প্রণালীকে স্বীকার করে নিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে আনন্দে বলেছেন, আমি যা পেলুম তা খুব বড়ো জিনিস, আমি কৃতার্থ হলুম।
তা বলবার আসল কারণ এই যে তিনি আপনাকে দিতে গিয়েই বড়ো সম্পদ লাভ করেছেন। আমরা যখন কেবলমাত্র পেতে যাই তখন বড়োকে পাই নে, যখন নিতে যাই তখন ভূমাকে পাই। ভারতবর্ষের উপকার করব বলে যদি কেউ কোমর বেঁধে আসে তা হলে ভারতবর্ষকে যথার্থ জানতেই পারবে না, উপকার করবে কী! কারণ সেই রকম উপকারের দ্বারা ফল পেতে চায়– সে ফল তাদের মনের মতো। কিন্তু যারা মানবপ্রেমের টানে ভারতের কাছে আপনাকে দিতে চায় তারা সেই দেওয়ার দ্বারাই ভারতের সত্যকে জানতে পারে। তাদের প্রেম শুধু দেয় না, পায়। না পেলে দেওয়াই যায় না।
যাঁরা জীবনের ক্ষেত্রে সেবা করতে, আপনাকে দান করতে আসেন তাঁরা আবিষ্কার করেন যে তাঁরা যা দিচ্ছেন তার চেয়ে বড়ো জিনিস তাঁরা পেয়ে যাচ্ছেন। পিয়র্সন সাহেব তাই বলতেন যে– আমি যা পেয়েছি তার জন্য বড়ো কৃতজ্ঞ হলুম।
আমরা আশ্রমবাসীরা যেন সেই বন্ধুকে পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারি। এখানকার ছাত্র অধ্যাপক যাঁরা তাঁর বন্ধুত্বের ও প্রেমের আস্বাদ পেয়েছেন তাঁরাই জানেন যে কী পবিত্র দান তিনি চারি দিকে রেখে গেছেন। তিনি এখানকার সাঁওতালদের একমাত্র বন্ধু ছিলেন, নিজে তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের মধ্যে কাজ করেছেন। আজ সেই-সব সাঁওতালরাই জানে যে কী সম্পদ তিনি দিয়ে গেছেন। তিনি এই সাঁওতালদের আর আশ্রমের শিশুদের সেবা করতে গিয়ে যে মহাসম্পদ লাভ করেছেন তা অতি মহামূল্য, তা সস্তায় পাওয়া নয়। তিনি সমস্ত দান করে তবেই সমস্ত গ্রহণ করতে পেরেছেন, জীবনের পাত্রকে পূর্ণ করে নিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর মহৎজীবনকে পরিপূর্ণ করে সেই দান গ্রহণ করেছেন। তাঁর জীবনের পাত্র তাতে ভরপুর হয়ে উপছে পড়েছে, তিনি তার আনন্দে অধীর হয়েছেন।
আজ আমাদের তাঁর জীবনের এই কথাই স্মরণ করতে হবে তিনি যেমন বড়ো দান রেখে যেতে পেরেছেন তেমনি বড়ো সম্পদ পেয়ে গেছেন। তাঁর জীবনের এই মহত্ত্বকে শ্রদ্ধা করতে পারলেই তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হবে। আশ্রমে যে সত্য কালে কালে ক্রমে ক্রমে পূর্ণ প্রকাশের মধ্যে উদ্ঘাটিত হয়ে উঠেছে, পিয়র্সন সাহেব তাকে জীবনে স্বীকার করে নিয়ে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার সাক্ষ্য রেখে গেছেন।
শান্তিনিকেতন পত্রিকা, ফাল্গুন, ১৩৩০