পরমাণু বোমা
যে পারমাণবিক যুগে আজ বাস করছে মানবজাতি এবং যে যুগ কিছুদিনের মধ্যেই তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে, সাধারণ মানুষের কাছে সে যুগের সুচনা হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় একটি পরমাণু বোমা নিক্ষেপের মুহূর্ত থেকে। কিন্তু পরমাণু-বিজ্ঞানীরা এবং কিছু আমেরিকান কর্মকর্তা তার কিছুদিন আগে থেকেই জানতেন এ ধরনের একটা অস্ত্র বানানো সত্যিই সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক পর থেকেই এই বোমা বানানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিল আমেরিকা, কানাডা আর ব্রিটেন। রাদারফোর্ড পরমাণুর গঠন আবিষ্কার করার পর থেকেই জানা ছিল পরমাণুর কেন্দ্রে বিস্ফোরক শক্তির অস্তিত্ব থাকতে পারে। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে একটি অতিক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস আর তার চারপাশে থাকে কিছু ইলেকট্রন। হাইড্রোজেন পরমাণু হচ্ছে সবচেয়ে সরল আর সব থেকে হালকা এবং তাতে একটিমাত্র ইলেকট্রন থাকে। পরমাণু যত ভারি হয়, তার ইলেকট্রনের সংখ্যাও তত বাড়তে থাকে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কি ঘটে চলে তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারের ফলে- নিউক্লিয়াস থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা কণাই যার উৎস হিসেবে কাজ করে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত থাকে তা জানা ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে পর্যন্ত জানা ছিল না সেই শক্তিকে কিভাবে ব্যাপক পরিমাণে মুক্ত করা যেতে পার। কয়েকটি বিশেষ অবস্থায় ভর যে শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে, সেটা ছিল এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের উৎস নিহিত ছিল আইনস্টাইনের সূত্রে, যে সূত্রে বলা হয়েছে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ হবে অপরিচিত ভরের সঙ্গে আলোর গতিবেগের বর্গের সমান। এর সরলতম দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় হাইড্রোজেনের সঙ্গে হিলিয়ামের সম্পর্কের মধ্যে। হিলিয়ামের পরমাণুতে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে। এ থেকে মনে হতে পারে হাইড্রোজেনের পরমাণুর থেকে হিলিয়ামের পরমাণুর ভর চারগুণ বেশি। বাস্তবে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। হিলিয়ামের পরমাণুর ভর ৪ হলে হাইড্রোজেনের পরমাণুর ভর ১ হবে না, হবে ১.০০৮। চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে যখন একটি হিলিয়াম পরমাণু গঠন করে, তখন উদ্ধৃতটা শক্তি হিসেবে নির্গত হয়ে যায় এবং সেটা আর ভর হিসেবে কাজ করে না। কিন্তু সেই জন্যই সূর্য এত উত্তপ্ত, কারণ সূর্য হচ্ছে হিলিয়ামের একটা কারখানা। যখনই হালকা কিছু মৌল মিলে ভারি কোনো মৌল গঠন করে, তখন ঠিক এটাই ঘটে থাকে। প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় সংযোজন প্রক্রিয়া এবং হাইড্রোজেন বোমা বানানোর জন্য এই প্রক্রিয়াটিই কাজে লাগানো হয়।
তবে পরমাণু বোমার ক্ষেত্রে ভিন্ন একটি প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়, যা নির্ভর করে তেজস্ক্রিয়তার ওপর। বিয়োজন নামে অভিহিত এই প্রক্রিয়াটিতে একটি ভারি পরমাণু ভেঙে দুটি হালকা পরমাণু তৈরি হয়। সাধারণ তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষেত্রে এই বিয়োজন একটা স্থির হারে ঘটে চলে এবং প্রকৃতিতে লভ্য তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলোর ক্ষেত্রে এটা খুব ধীরে ধীরে ঘটে। কিন্তু ইউ-২৩৫ নামে চিহ্নিত ইউরেনিয়ামের একটা রূপ অবিমিশ্র অবস্থায় থাকার সময় তার মধ্যে একটা চেন রিঅ্যাকশন ঘটে যা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে, তবে তার ছড়িয়ে পড়ার গতিবেগ আগুনের থেকে অনেক বেশি দ্রুততর হয়। পরমাণু বোমা বানানোর জন্য এই পদার্থটিকেই ব্যবহার করা হয়েছিল। তার করতে গিয়ে কয়েকটি সমস্যার সমাধান করতে হয়েছিল। প্রথম সমস্যা ছিল সাধারণ ইউরেনিয়ামের থেকে ইউ-২৩৫ খুব অল্প পরিমাণেই থাকে। এই প্রক্রিয়াটি দ্রুততর হয়েছিল বিশ্বাসঘাতক ফুকস-এর মূল্যবান কাজের বদান্যতায়। আবার এই ফুকস-এর রিঅ্যাকশনের বিষয়টি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই পরমাণু বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট বুঝেছিলেন এ ধরনের একটা বোমা বানানো সম্ভব। গোপনীয়তায় যাবতীয় প্রচেষ্টটা সত্ত্বেও অনেকেই জেনে গিয়েছিল পরমাণু বোমা বানানোর কাজ এগিয়ে চলেছে।
নাৎসিদের পরাস্ত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করাই ছিল পরমাণু বিজ্ঞানীদের কাজের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। সঙ্গত কারণেই ভাবা হয়েছিল–নাৎসিদের জয় পৃথিবীর বুকে ভয়ংকর বিপর্যয় ডেকে আনবে। সেইসঙ্গেই পশ্চিমী দেশগুলো মনে করত পরমাণু বোমা তৈরির দিকে জার্মান বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই অনেকটা এগিয়ে গেছেন এবং পশ্চিমী দেশগুলোর থেকে আগে তারা পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হলে জার্মানির জয় প্রায় অবধারিত। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমেরিকান ও ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা স্তম্ভিত বিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন-পরমাণু বোমা তৈরির ব্যাপারে সাফল্যের ধারে কাছেও ছিল না জার্মানরা। আর, সকলেই জানেন, কোনো পরমাণু বোমা তৈরি হওয়ার আগেই বোমা নির্মাণের কাজটিকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও জরুরি বলে ভেবেছিলেন, তার জন্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না। এমনকি আইনস্টাইন পর্যন্ত এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছিলেন। তবে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরমাণু বোমা নির্মাণের কাজে সাহায্যকারী বিজ্ঞানীদের অধিকাংশই মনে করেছিলেন জাপানিদের বিরুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এমনিতেই তারা তখন প্রায় পরাজয়ের মুখে পৌঁছে গেছে, তাছাড়া পৃথিবীর পক্ষে তারা হিটলারের মতো অতটা বিপদজ্জনকও নয়। তাদের মধ্যে অনেকেই আমেরিকান সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন পরমাণু বোমাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার বদলে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে কোনো মরুভূমিতে পরমাণু বোমা ফাটানো হোক এবং ভবিষ্যতে পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হোক একটি আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের হাতে। সাতজন বিশিষ্টতম পরমাণু-বিজ্ঞানী ফ্রান্স রিপোর্ট নামে পরিচিত একটি রিপোর্ট তৈরি করে ১৯৪৫ সালের জুন মাসে সেটি পেশ করেছিলেন সমর সচিবের কাছে। এটি ছিল এক প্রশংসনীয় ও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন দলিল। আমাদের রাজনীতিবিদরা দলিলটি গ্রহণ করলে পরবর্তী যাবতীয় আতঙ্ক থেকেই মুক্তি পেতে পারতাম আমরা। ওই রিপোর্ট বলা হয়েছে, পরমাণুশক্তির বিকাশে যে সাফল্য আমরা অর্জন করেছি, তা অতীতের যাবতীয় উদ্ভাবনের থেকে অনেক অনেক বেশি বিপদে পরিপূর্ণ। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে–কোনো গোপন ব্যাপারকেই খুব বেশিদিন গোপন রাখা সম্ভব নয়, এবং কয়েক বছরের মধ্যেই রাশিয়া পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম হবে। প্রকৃতপক্ষে, হিরোশিমার ঘটনার পর পরমাণু বোমা বানাতে ঠিক চার বছরের মতো সময় লেগেছিল রাশিয়ার। রিপোর্টটিতে অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিপদ সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, পরবর্তী বছরগুলোতে তা আতঙ্কজনকভাবে সত্যে পরিণত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোনো কার্যকরি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত না হলে পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্বের প্রথম প্রদর্শনের পরেরদিন সকাল থেকেই বাস্তব হয়ে উঠবে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা। অতঃপর তিন চার বছরের মধ্যেই অন্য রাষ্ট্রগুলো আমাদের আজকের অবস্থায় পৌঁছে যাবে। আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্বন্ধে কিছু প্রস্তাব রাখার পর রিপোর্টটি শেষ করা হয়েছে এইভাবে, নির্বিচার ধ্বংসের এই নতুন উপায়টিকে যুক্তরাষ্ট্রই যদি মানবজাতির ওপর প্রথম প্রয়োগ করে, তাহলে তাকে হারাতে হবে সারা বিশ্বের জনসমর্থন, ত্বরান্বিত হবে অস্ত্র-প্রতিযোগিতা এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভবিষ্যতে এ ধরনের অস্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ঐকমত্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন অভিমত ছিল না। পরমাণু বোমা নির্মাণের পিছনে যাদের অবদান ছিল, তাদের সংখ্যাগুরু অংশ এই একই অভিমত পোষণ করতেন। সেই সময় আইনস্টাইনের পরেই পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশিষ্টতম ছিলেন নিলস্ বর। তিনিও ঠিক এই মর্মেই আন্তরিক আবেদন জানিয়েছিলেন। চার্চিল আর রুজভেল্টের মৃত্যুর পর দেখা গিয়েছিল বর-এর আবেদনপত্রটি তাঁর ডেস্কেই পড়ে আছে এবং খামের মুখ তখনও খোলা হয়নি। বিজ্ঞানীরা অন্য কোনো জগতের মানুষ, বাস্তবের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং নীতিনির্ধারণ জাতীয় কোনো ব্যাপারে বাস্তবসম্মত বিচার তাদের দ্বারা সম্ভব নয়-এই প্রচলিত ধারণা থেকে বিজ্ঞানীদের মতামতকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলি তাদের প্রতিটি কথাকেই সত্য বলে প্রমাণ করেছে আর দেখিয়ে দিয়েছে কি করা উচিত সে ব্যাপারে প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টি সাধারণ মানুষ বা রাজনীতিবিদদের ছিল না, ছিল ওই বিজ্ঞানীদেরই।
হিরোশিমার ঘটনার পর ক্ষুব্ধ পরমাণু-বিজ্ঞানীরা দ্য বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস নামে একটি মাসিক পত্রিকা বার করতে শুরু করেন। পরমাণু অস্ত্র এবং পারমাণবিক যুদ্ধ সম্পর্কে পত্রিকাটি এখনও পর্যন্ত একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে চলেছে।
১৯৪৫ সালের ২৮ নভেম্বর হাউস অব লর্ডস-এ প্রদত্ত এক বক্তৃতায় আমি যা বলেছিলাম তার সঙ্গে ফ্রাঙ্ক রিপোর্টের বক্তব্যের মৌলিক কোনো প্রভেদ নেই, যদিও তখনও পর্যন্ত ফ্রাঙ্ক রিপোর্ট আমার হাতে আসেনি। বক্তৃতাটি শুধুমাত্র হাউস অব লর্ডসের কার্যবিরণীতেই মুদ্রিত হয়েছিল বলে পুরো বক্তৃতাটিই এখানে তুলে দিচ্ছি–
“মাননীয় সভাসদবৃন্দ, আপনাদের সামনে কিছু বলার জন্য গভীর সংশয়ের সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়েছি আমি, কারণ এর আগে মাত্র একবারই আমি এই সভায় বক্তৃতা দিয়েছি, তাছাড়া গতকালের এবং আজকের বিতর্ক শোনার পর বুঝতে পারছি অন্যান্য বক্তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান আমার থেকে দশ গুণ বেশি আর অভিজ্ঞতা কুড়ি গুণ বেশি, ফলে তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলা আমার পক্ষে রীতিমতো ঔদ্ধত্যের সামিল।
তবে যে ব্যাপারে আমি আমার বক্তব্য সীমিত রাখতে চাই, অর্থাৎ পরমাণু বোমা এবং পলিসির ওপরে তার প্রভাব, তা এতই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার মনের ওপর তা এতই গুরুভার হয়ে চেপে বসেছে যে মানবজাতির ভবিষ্যতের ওপর পরমাণু বোমা কি প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে সে সম্পর্কে কিছু বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি।
সকলের জানা কয়েকটি বিষয় দিয়েই শুরু করা যাক। প্রথমে কথা হলো, পরমাণু বোমা আজও তার শৈশবাবস্থায় আছে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে আরও অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে এবং বোমা তৈরির খরচও অনেক কমে যাবে। এই দুটি বিষয় যে একান্তই নিশ্চিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অধ্যাপক ওলিফ্যান্ট আর একটি বিষয় উত্থাপন করেছিলেন। বিষয়টি হলো : কোনো অঞ্চলে তেজস্ক্রিয় পদার্থের ছড়িয়ে দিয়ে খুব-একটা অসুবিধে হবে না এবং নেই তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রভাবে বিশাল একটা অঞ্চল সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে শুধু মানুষই নয়, মারা যাবে প্রতিটি কীটপতঙ্গ, প্রতিটি সজীব বস্তু। আরও কিছুদিন পর ঘটতে পারে আর-একটি ঘটনা। মহামান্য সভাসদরা জানেন, তত্ত্বগতভাবে পারমাণবিক শক্তিকে মুক্ত করার দুটি পদ্ধতি আছে। প্রথম পদ্ধতিটি বর্তমানে বাস্তবায়িত হয়েছে একটি ভারি নিউক্লিয়াসকে ভেঙে মাঝারি ওজনের কিছু নিউক্লিয়াসে পরিণত করা। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি এখনও পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু আমার ধারণা কিছুদিনের মধ্যে সেটিও বাস্তবায়িত হবে। এই পদ্ধতিটি হল কিছু হাইড্রোজেন পরমাণুর সংশ্লেষণ ঘটিয়ে ভারি পরমাণু তৈরি করা-হিলিয়াম পরমাণু কিংবা প্রাথমিক অবস্থায় নাইট্রোজেন পরমাণু। সেই সংশ্লেষণ যদি ঘটানো যায় তাহলে তা থেকে যে শক্তি মুক্ত হবে তার পরিমাণ ইউরেনিয়াম পরমাণুর বিভাজনের ফলে মুক্ত শক্তির থেকে বহুগুণ বেশি হবে। এই প্রক্রিয়াটি আমরা এখনও পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করিনি, তবে বিজ্ঞানীরা বলেন যে সূর্যের মধ্যে এবং অন্যান্য নক্ষত্রদের অভ্যন্তরে এই প্রক্রিয়াটি ঘটে থাকে। প্রকৃতিতে এই প্রক্রিয়াটি একমাত্র সূর্যের অভ্যন্তরস্থ উত্তাপের সমতুল উত্তাপেই ঘটে। বর্তমানের পরমাণু বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার সময় যে উত্তাপ সৃষ্টি হয় তা প্রায় সূর্যের অভ্যন্তরস্থ উত্তাপের কাছাকাছি বলেই অনুমান করা হচ্ছে। সুতরাং বর্তমান পরমাণু বোমার নির্মাণকৌশলের সমতুল কোনো প্রক্রিয়ার সাহায্যে এই আরও ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটানোও অসম্ভব কিছু নয়- নাইট্রোজেনের ভারি মৌলগুলোর সংযোজন ঘটাতে পারলেই তা করা সম্ভব।
আমাদের এই বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতার অগ্রগতি যদি অব্যাহত থাকে এবং সে যদি নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে না ফেলে, তাহলে এ সব ঘটনা ঘটবেই, ঘটতে বাধ্য। এইসব বিষয়কে নিছক আগামী কয়েক বছরের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা দেখতে চাই না, দেখতে চাই মানবজাতির ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রশ্নটা নেহাতই সাদামাটা : কোনো বিজ্ঞাননির্ভর সমাজের পক্ষে নিজেকে টিকিয়ে রাখা কি সম্ভব, নাকি এ ধরনের সমাজ নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতে বাধ্য? প্রশ্নটা সাদামাটা হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগানোর মধ্যে যে অমঙ্গলের আশঙ্কা রয়ে গেছে, তার গুরুত্বকে কিছুতেই খাটো করে দেখা যায় না। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমার চোখে পড়ে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল, ব্রিটিশ মিউজিয়াম, পার্লামেন্ট হাউস এবং আমাদের সভ্যতার আরও নানান স্মারক। আর তার পাশাপাশিই মনশ্চক্ষে দেখি এক দুঃস্বপ্নের দৃশ্য অট্টালিকাগুলো ইট-কাঠ-পাথরের স্তূপ হয়ে পড়ে আছে, চারপাশে মানুষের মৃতদেহ! যুদ্ধকে নিশ্চিহ্ন করার কোনো সর্বসম্মত পথের সন্ধান যদি এই পৃথিবী খুঁজে না পায়, তাহলে এ ঘটনা শুধু আমাদের দেশে বা আমাদের শহরগুলোতেই নয়, সমগ্র সভ্য জগতের সামনেই এক বাস্তব সম্ভাবনা হিসেবে হাজির হবে। যুদ্ধকে শুধু কমিয়ে আনলেই চলবে না, বড় মাপের এবং গুরুতর যুদ্ধ যাতে একেবারেই না ঘটে তারও ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যথায় এ-দুঃস্বপ্ন বাস্তব হয়ে উঠবেই।
যুদ্ধকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার কাজটা অবশ্য খুবই দুরূহ। এ সমস্যা সমাধানের জন্য যারা চেষ্টা করে চলেছেন, তাঁদের দোষত্রুটি খুঁজে বের করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তারা যেটুকু করছেন, তার থেকে ভালো কিছু করা আমার সাধ্যাতীত। আমি শুধু অনুভব করি এ সমস্যার সমাধান মানুষকে খুঁজে বার করতেই হবে, অন্যথায় সে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং আমাদের বাদ দিয়ে এই গ্রহের জীবন হয়তো অনেক বেশি আনন্দময় হয়ে উঠবে-যদিও সে দৃষ্টিভঙ্গির শরিক আমরা হতে পারি না। এ সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বার করতে হবে আমাদেরই। সকলেই জানেন, এ ব্যাপারে রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতার পথ খুঁজে বার করাটাই আশু সমস্যা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওয়াশিংটনে গিয়ে এ ব্যাপারে যেটুকু করে উঠতে পেরেছিলেন, সেই মুহূর্তে তার থেকে বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল বলে আমার মনে হয় না। সে সময় তার থেকে ভাল কিছু করা তাঁর পক্ষে অসম্ভবই ছিল। পরমাণু বোমা নির্মাণের সমগ্র প্রক্রিয়াটি এখনই রাশিয়াকে নিঃশর্তে জানিয়ে দেওয়ার পক্ষে যারা সওয়াল করছেন, আমি তাদের পক্ষভুক্ত নই। আমি মনে করি রাশিয়াকে বোমার নির্মাণকৌশল জানানোর পাশাপাশি কিছু শর্তও অবশ্যই আরোপ করা উচিত, তবে সেই শর্তগুলোকে অবশ্যই শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে, কোনো ধরনের জাতীয় উদ্দেশ্য তার মধ্যে থাকা চলবে না। আমরা কিংবা আমেরিকা কেউই নিজেদের জন্য কোনো সুবিধা দাবি করব না, কিন্তু পরমাণু বোমার নির্মাণকৌশল যদি আমরা রাশিয়ানদের জানাই, তাহলে তা জানাতে পারি। একমাত্র সহযোগিতা করার ব্যাপারে তাদের আন্তরিক আগ্রহের ভিত্তিতেই।
সেই ভিত্তিতে রাশিয়ানদের পরমাণু বোমার নির্মাণকৌশল যত দ্রুত সম্ভব জানিয়ে দেওয়াই ভালো বলে মনে করি আমি। এই মনে করার আংশিক কারণ হলো–বোমার নির্মাণকৌশল খুব বেশিদিন তাদের অজ্ঞাত থাকবে না। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে যে ধরনের বোমা তৈরি হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে সর্বাংশে তার তুল্য বোমা রাশিয়ানরা তৈরি করে ফেলবেই। ফলে বিষয়টা নিয়ে দর কষাকষির জন্য খুব অল্প সময়েই হাতে পাব আমরা অবশ্য ব্যাপারটাকে দর-কষাকষি বলা যায় কি না, তাতে সন্দেহ আছে। মহামান্য সভাসদরা অবগত আছেন যে এ কাজের সঙ্গে যে সব বিজ্ঞানীরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই চান পরমাণু বোমার নির্মাণকৌশল এখনই রাশিয়াকে জানিয়ে দেওয়া হোক। আগেই যে কারণের কথা উল্লেখ করেছি সেই কারণে আমি তাঁদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নই, তবে আমার ধারণা রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের আরও আন্তরিক ও সর্বাঙ্গীন সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করার জন্য এই ব্যাপারটা কাজে লাগানো যেতে পারে। বিদেশ-সচিব তার বক্তৃতায় যা বলেছেন, তা আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি। শুধু ইচ্ছা প্রকাশ করলেই রাশিয়ার সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। যে সব বিষয়কে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করব, সেইসব বিষয়ে দৃঢ়সঙ্কল্প হতেই হবে। তাদের দুয়ারে গিয়ে সহযোগিতার জন্যে কাকুতি-মিনতি করলে কোনো লাভ হবে না, বরং বলিষ্ঠভাবে তা চাইলেই প্রকৃত সহযোগিতা পাওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে বিদেশ সচিব যা বলেছেন, তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।
আশা করা যায়, এবং এটা কোনো আকাশকুসুম আশা নয়, যে রাশিয়ার সরকার উপলদ্ধি করবেন এ ধরনের যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের অর্থ হবে তাদের নিজেদের এবং সেইসঙ্গে অন্য সকলের ধ্বংস ডেকে আনা। তারা নিশ্চয়ই বুঝবেন যে এটা সারা পৃথিবীর সব মানুষের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত, যে সব স্বার্থ পৃথিবীকে ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভাগ করে রেখেছে তার সঙ্গে এ স্বার্থের অনেক তফাৎ। বিষয়টা তাঁদের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপিত করতে পারলে বিপদটা তারা অনুভব করবেন বলেই মনে করি আমি। বিপদটা অনুভব করা মোটেই শক্ত নয়। এ বিপদ উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তাও তাদের আছে–তবে অবশ্যই বিষয়টাকে রাজনীতি আর প্রতিযোগিতা থেকে দূরে রাখতে হবে। প্রত্যেকেই বলেছেন, সন্দেহের একটা মনোভাব সর্বত্রই বিরাজ করছে। এই সন্দেহের মনোভাব অপসারিত করা যায় একমাত্র আন্তরিক অকপটতার সাহায্যেই। আন্তরিক অকপটতা দিয়েই বলতে হবে, এই এই বিষয়গুলোকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি আমরা। আপনারা যে বিষয়গুলোকে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন, সেগুলোর কথা বলুন। যদি দেখা যায় কোনো বিষয়কে আমরা উভয় পক্ষই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি, তাহলে আসুন, পরস্পরকে ধ্বংস করার চেষ্টায় মেতে উঠলে কারোরই তো কোনো লাভ হবে না। এই ব্যাপারটা রাশিয়ানদের কাছে আন্তরিকভাবে এবং অরাজনৈতিকভাবে তুলে ধরতে পারলে তারা অবশ্যই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন–অন্তত আমার তা-ই ধারণা।
এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদেরও কিছুটা কাজে লাগানো যেতে পারে। তারা নিজেরাও চরম অস্বস্তির মধ্যে আছেন, নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন। তাঁরা জানেন কাজটা না করে তাদের উপায় ছিল না, কিন্তু ব্যাপারটা তারা মেনে নিতে পারেননি। মানবজাতির অস্তিত্বের সামনে যে বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছে, তাকে কিছুটা লাঘব করার মতো কোনো কাজের ভার তাদের ওপর অর্পিত হলে তারা সানন্দে তা পালন করবেন। আমাদের মধ্যে যারা ব্যাপারটার সঙ্গে বেশি করে জড়িত, তাদের থেকে বিজ্ঞানীরা রাশিয়ানদের বোঝাতে অনেক বেশি সক্ষম হবে বলেই মনে করি আমি। তারা রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করে সত্যিকারের সহযোগিতার দিকে এগোনোর পথ প্রশস্ত করতে পারেন। আমাদের হাতে এখনও কিছুটা সময় আছে। এই মুহূর্তে পৃথিবী কিছুটা রণক্লান্ত। আগামী দশ বছরের মধ্যে নতুন কোনো বিশ্বযুদ্ধ বাধবে না বলে ধরে নেওয়াই যায়। অতএব আমাদের হাতে এখনও কিছুটা সময় আছে এবং এই সময়টুকুর মধ্যে সত্যিকারের পারস্পরিক বোঝাঁপড়া গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারি আমরা।
একটা সমস্যাকে আমরা প্রায়শই ঠিকমতো উপলব্ধি করার চেষ্টা করি না। সমস্যাটা হল রাশিয়ানরা মনে করে, এবং সম্ভবত সঠিকভাবেই মনে করে যে, স্বার্থ সংক্রান্ত কোনো সংঘাত দেখা দিলে একদিকে থাকবে রাশিয়ানরা, অন্যদিকে বাকি সবাই। বৃহৎ তিন বনাম বৃহৎ পাঁচের ঘটনার সময়েই এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছিল তারা একদিকে ছিল রাশিয়া, অন্যদিকে দুটি বা চারটি দেশ। কেউ নিজেকে এইভাবে একা মনে করলে তাদের সঙ্গে আলোচনার সময় কিছুটা নমনীয় হওয়াই বাঞ্ছনীয় এবং এমনটা ধরে নেওয়া উচিত নয় যে সংখ্যাগুরুর কাছে নতি স্বীকার করবে তারা। যারা মনে করছে রণক্ষেত্রে তারা একা, তাদের কাছ থেকে এমন আচরণ প্রত্যাশা করা নিতান্তই অসঙ্গত। স্থায়ী আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার জন্য আগামী বছরগুলোতে অনেকটাই নমনীয় হয়ে, অন্যের মানসিকতা বুঝে, কাজ করতে হবে আমাদের।
পরমাণু বোমাকে রাষ্ট্রসংঘের জিম্মায় তুলে দেওয়ার যে প্রস্তাব এসেছে, তার মধ্যে কোনো বিকল্পের ইঙ্গিত আমার চোখে পড়ছে না। এ প্রস্তাবের মধ্যে আশাব্যঞ্জক তেমন কিছু নেই, কারণ এই মুহূর্তে রাষ্ট্রসংঘ কোনো বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করার মতো শক্তিশালী সামরিক সংস্থা নয়, আর শেষ পর্যন্ত পরমাণু বোমা যার হাতে থাকবে তাকে বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো শক্তিশালী হতেই হবে। সেই ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে না ওঠা পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা পাওয়ার আশা করা অর্থহীন। পরমাণু বোমা প্রস্তুত করা বা ব্যবহার করার ওপর কাগজে কলমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না, কারণ এ নিষেধাজ্ঞা কারুর ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তাছাড়া কেউ যদি সত্যিই যুদ্ধের কথা ভাবে, তাহলে তার পক্ষে এ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করার শাস্তির থেকে এ নিষেধাজ্ঞা পালন করার শাস্তিটাই বড় হয়ে উঠবে। তাই এইসব কাগুঁজে বন্দোবস্তের আদৌ কোনো কার্যকারিতা আছে বলে আমার মনে হয় না।
প্রথমে যা দরকার তা হলো, পরমাণু বোমার ওপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ চালু করার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করা। আকাক্ষাটা সৃষ্টি হলে তাকে বাস্তবায়িত করার পরিকাঠামো গড়ে তোলাও অনেক সহজ হয়ে যাবে। এই পরিকাঠামো একবার গড়ে উঠলে, যথেষ্ট শক্তিশালী এবং পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারের একমাত্র জিম্মাদার একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা একবার রূপায়িত হলে তা আপনা থেকেই একটা স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত হবে। এই ধরনের ব্যবস্থা প্রকৃত অর্থেই প্রতিহত করতে পারবে বিশ্বযুদ্ধকে। এই ব্যবস্থা থেকেই গড়ে উঠবে রাজনৈতিক কাজকর্মের সুনির্দিষ্ট অভ্যাস এবং পৃথিবী থেকে যুদ্ধের সম্ভাবনা সত্যি সত্যিই বিদায় নেবে বলে আশা করতে পারব আমরা। এটা অবশ্য অনেক বড় কথা হয়ে গেল, কিন্তু ঠিক এই সত্যটারই মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি আমরা : হয় যুদ্ধ শেষ হবে, নয়তো সমগ্র মানবজাতি শেষ হবে। পড়ে থাকবে অবশিষ্ট কয়েকজন, প্রত্যন্ত প্রদেশের গুটিকয়েক মানুষ, যারা ধ্বংসের এইসব উপকরণ বানানোর পক্ষে নিতান্তই অবৈজ্ঞানিক। আর একমাত্র তারাই এ-ধরনের উপকরণ বানানোর পক্ষে নিতান্তই অবৈজ্ঞানিক হতে পারে, যারা সভ্যতার যাবতীয় ঐতিহ্যই হারিয়ে ফেলেছে। এই হারিয়ে ফেলাটা হবে এক গুরুতর বিপর্যয় এবং পৃথিবীর প্রতিটি সুসভ্য দেশের তা উপলদ্ধি করা দরকার। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে তাদেরকে একটা উপলব্ধি করানো একেবারে অসম্ভব কিছু নয়, অন্তত আপমি নিজে মনেপ্রাণে তেমনটাই আশা করি।”
সেই সময়, যখন কারুরই মতামত খুব-একটা দৃঢ়মূল হয়ে ওঠেনি, হাউস অব লর্ডস আমার অভিমত অনুমোদন করেছিলেন এবং আমার ধারণা সেই অনুমোদনে সব পক্ষেরই সমান সম্মতি ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, পরবর্তী ঘটনাবলির ফলে এই ঐকমত্য ভেঙে যায়। কিন্তু আমার দিক থেকে বলতে পারি সেদিন যা বলেছিলাম, তা প্রত্যাহার করার কোনো কারণ আজও আমি দেখতি পাচ্ছি না।
পাইকারি গণহত্যার নয়া উপকরণটিকে সর্বসমক্ষে প্রদর্শন করে আমেরিকার সরকার যে বেশ তৃপ্তি অনুভব করছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে জাপানের আত্মসমর্পণের পর পরমাণু বিজ্ঞানীদের কিছু বক্তব্যকে কার্যকর করার চেষ্টাও তারা করেছিল। ১৯৪৬ সালে তারা উপস্থাপিত করেছিল বারু পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার অনেক ভালো দিক ছিল এবং তখনও পর্যন্ত পরমাণু বোমার ওপর আমেরিকার একচেটিয়া অধিকারের কথা মনে রাখলে বলতে হয়-যথেষ্ট উদারও ছিল। বারুচ্ পরিকল্পনায় একটি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক উন্নয়ন সংস্থা নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যে সংস্থার হাতে খনি থেকে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম সংগ্রহের, আকরিক পরিশোধনের, যাবতীয় উপাদানের মালিকানার এবং পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্ল্যান্ট নির্মাণ ও পরিচালনার একচ্ছত্র অধিকার থাকবে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, এই সংস্থা গঠনের ভার থাকবে রাষ্ট্রসংঘই তুলে দেবে এই সংস্থার হাতে। দুর্ভাগ্যবশত, বারু প্রস্তাবের কয়েকটি ব্যাপার রাশিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। তখনকার রাশিয়া ছিল স্তালিনের রাশিয়া, জার্মানদের পরাজিত করার গর্বে উচ্ছ্বসিত, পশ্চিমী দেশগুলোর সম্বন্ধে সন্দিহান (সে সন্দেহ পুরোপুরি অমূলকও নয়) এবং রাষ্ট্রসংঘের মধ্যে প্রায় যেকোনো ব্যাপারেই ভোটাভুটিতে পরাজিত হওয়ার ব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল। পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদ এড়ানোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে তোলা একান্তই প্রয়োজনীয়, কিন্তু রাশিয়া বরাবরই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এসেছে। বিরোধিতার কারণ হলো-এ ধরনের একটা সংস্থা সেইসব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় এবং চিরস্থায়ী করে তুলবে, কমিউনিস্ট বিশ্বাস অনুযায়ী যে ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে ক্ষতিকর ব্যবস্থা। কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থাকে রাশিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে সেই সংস্থাকে এমন এক সংস্থা হতে হবে যেখানে অ-কমিউনিস্ট শক্তিগুলোর সুনিশ্চিত প্রাধান্য থাকবে না। বারুচ পরিকল্পনায় এ দিকটার নজর দেওয়া হয়নি। রাশিয়ার আপত্তি দূর করার জন্য এই পরিকল্পনায় সংশোধন হয়তো করা যেত, কিন্তু এ ব্যাপারে আলোচনা করতে অথবা এই ধরনের কোনো সম্ভাবনার কথা খতিয়ে দেখতে সরাসরি অস্বীকার করে সোভিয়েত সরকার। ফলস্বরূপ রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমী দেশগুলোর সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে এবং কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকা বলতে শুরু করে–এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আর কখনও উত্থাপন করা হবে না।
সমর বিভাগের লোকজন ও রাজনীতিবিদদের কাছে বিজ্ঞানীরা যা বলেছিলেন, তাতে কর্ণপাত না করে সমরবিভাগের লোকেরা, রাজনীতিবিদরা আর আমেরিকার বাসিন্দারা ধরেই নেয় যে আমেরিকার জানা গোপন তথ্য রাশিয়ার কাছ থেকে দীর্ঘদিন আড়াল করে রাখা সম্ভব এবং শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে পশ্চিমের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে। ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে যখন জানা গেল রাশিয়ার হাতেও পারমাণবিক অস্ত্র আছে, তখন ধরে নেওয়া হলো গুপ্তচর আর বিশ্বাসঘাতকরাই রাশিয়ার কাছে তথ্য ফাঁস করেছে। প্রকৃতপক্ষে গুপ্তচর আর বিশ্বাসঘাতকরা এ ব্যাপারে সম্ভবত খুব অল্প সাহায্যই করতে পেরেছিল। রাশিয়ানদের দক্ষতা নয়, বরং বিশ্বাসঘাতকরাই আমেরিকাকে তার একচ্ছত্র অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে- এই ধারণাটা এক সার্বিক সন্দেহের পরিবেশ সৃষ্টি করল এবং তখনই ম্যাকার্থি আর তার চিন্তাধারার অনুগামীরা সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন বা ফ্রান্স কোনো দেশেরই দেশনেতা বা সাধারণ মানুষের মতামতের মধ্যে সেই সুদূরপ্রসারী প্রজ্ঞা প্রতিফলিত হয়নি, যে প্রজ্ঞা অনুপ্রাণিত করেছিল শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের। দেশপ্রেমের সমার্থক হয়ে উঠেছে ঘৃণা এবং যুদ্ধের প্রস্তুতিকেই শান্তির একমাত্র রক্ষাকবচ হিসেবে ভাবা হয়েছে। ভ্রান্তপথে পরিচালিত হয়েছে পৃথিবী এবং পরবর্তী বছরগুলোতে বিপর্যয়ের দিকেই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছে সে।