পরবাসে

পরবাসে

কেনাকাটা শেষ হয়ে গিয়েছিল গতকালই। সাতদিনের ইন্ডিয়া ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল নার্গিসকে ডাক্তার দেখানো। তিন মাস আগে ঢাকা থেকে মেল, ফোন করে বিখ্যাত ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল।

নার্গিসের সঙ্গে সিরাজের বিয়ে হয়েছিল আট বছর আগে। সুন্দরী স্ত্রী ঘরে আসার পর সিরাজের গার্মেন্ট ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। বনানীতে বড় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে সার্কুলার রোড ছেড়ে। সবই ঠিকঠাক শুধু ওদের সংসারে সন্তান আসছিল না। প্রথম দুই বছর এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি ওরা, তারপর যখন দুই পক্ষের আত্মীয়রা জানতে চাইল কবে সুখবর পাবে তখনই টনক নড়ল। প্রথম দিকে নার্গিসের মনে হয়েছিল এত তাড়াহুড়ার কী আছে? শরীরে সন্তান এলে হবু মায়েদের কী কী সমস্যা হয় তা তার জানা আছে। আর সেই সন্তান পৃথিবীতে আসার পর অন্তত বছর তিনেক তার সেবায় নিজেকে তৈরি রাখতে হয়। নার্গিসের এক ভাবিকে বলতে শুনেছে সে, দিনে জ্বালায়, রাতে ঘুমাচ্ছি না। এই বাচ্চচার জ্বালায়, কেন যে মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মালাম! বাচ্চচার বাপের তো এসব সামলাতে হয় না।

অতএব নার্গিস চেয়েছিল হাত—পায়ে শিকল না জড়িয়ে যতদিন থাকা যায় ততদিনই সুখের। কিন্তু চার বছর পরে সিরাজ বলল, ‘না’, এবার কেউ আসুক। ওকে মানুষ করতেও তো সময় লাগবে। মানতে বাধ্য হল নার্গিস।

কিন্তু কোথায় কী! বন্ধুদের উপদেশে সিরাজ প্রথম একজন মহিলা গাইনি ডাক্তারের কাছে নার্গিসকে নিয়ে গেল। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, নার্গিসের শরীরে কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই। মা হওয়ার সব রকম যোগ্যতা তার রয়েছে। চাপ পড়ল সিরাজের মনে। তাহলে কি তার শারীরিক ত্রুটির কারণে নার্গিস মা হতে পারছে না? কিন্তু পরীক্ষায় জানা গেল, সিরাজও স্বাভাবিক। আর তাতেই সমস্যা বাড়ল।

বন্ধুরা বলল, আরও মহিলা গাইনি ডাক্তারের কাছে যেতে। ডাক্তার আগের রিপোর্টগুলো দেখে বললেন, যদি ধরে নিই এ রিপোর্টগুলোয় ভুল নেই তাহলে বলব শুধু সময়ের অপেক্ষা করুন। সন্তান আসবেই। ডাক্তার ভিটামিন জাতীয় ওষুধ দিয়েছিলেন।

কিন্তু সাড়ে সাত বছর যখন চলে গেল তখন নার্গিসের মানসিক পরিবর্তনগুলো লক্ষ করল সিরাজ। এখন সে মা হতে চাইছে, কোনো ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না বলে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। এই সময় এক বন্ধু ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়ের খবরটা দিল। কলকাতার এই বৃদ্ধ ডাক্তার এই ধরনের সমস্যার সমাধান করে আসছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। কিন্তু তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া খুব মুশকিল। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যার রোগী তিনি দেখে থাকেন কিন্তু অপেক্ষার তালিকা দীর্ঘ। সিরাজ গুগলে ডক্টর মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে যেসব তথ্য পেল তাতে উৎসাহিত হল। সে মেল পাঠাল একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য, উত্তর এল না। শেষে ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের অফিসের কর্মচারীর সঙ্গে কথা হল তিনবার চেষ্টার পর। সে বাংলাদেশ থেকে ফোন করছে শুনে ভদ্রলোক একটু নরম হলেন। বললেন, বাবার কাছে শুনেছি আমাদের বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে, ঠিক আছে আপনারা আমি যে তারিখটা বলছি সেই তারিখে বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে স্যারের চেম্বারে পৌঁছে যাবেন। ভদ্রলোক তারিখ এবং ঠিকানা জানিয়ে দিলেন। খবরটা নার্গিসের মুখে হাসি ফোটাল।

কিছুদিন আগেও ইন্ডিয়ায় যাওয়ার জন্য ভিসা নিতে ইন্ডিয়ার হাইকমিশনারের অফিসের সামনে লাইন দিতে হত। সেই লম্বা লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর ইন্ডিয়ায় যাওয়ার প্রয়োজন যে চিকিৎসা করাতে, আজমিরের তীর্থ দর্শন করতে, ব্যবসা সংক্রান্ত কারণে অথবা বেড়াতে। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়াতে হত। কিন্তু নিয়মটা বদলে দেওয়া হয়েছে। এখন অনলাইনে অ্যাপ্লিকেশন করতে হয়। কম্পিউটারই জানিয়ে দেয় কোন তারিখে ভিসার জন্য ইন্ডিয়ার হাইকমিশনারের অফিসে যেতে হবে।

সিরাজ সমস্যায় পড়ল এখানেই। যতবার সে চেষ্টা করছে অনলাইনে অ্যাপ্লাই করতে ততবারই বিফল হচ্ছে। কিছুতেই তার আবেদন পৌঁছোচ্ছে না। এক বন্ধু ব্যাপারটা শুনে খুব হাসলেন, আপনি ব্যবসা করেন আর এই সাধারণ ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না কেন?

কী ব্যাপার?

আপনি অনলাইনে আবেদন করে নাম্বার পেয়ে গেলেন। হাইকমিশনে গিয়ে কারণ বুঝিয়ে পাশাপাশি ভিসার ছাপ মারিয়ে বিনা পয়সায় ইন্ডিয়ায় চলে যাবেন! মামার বাড়ি!

বুঝলাম না। বিনা পয়সায় মানে? ভিসার জন্য তো ফি দিতে হয় না।

তাই তো বিনা পয়সায় বললাম। বন্ধু বললেন।

তাহলে কী করে এত লোক ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে? সিরাজ প্রশ্ন করল। ভিসার জন্য ট্রাভেল এজেন্টের কাছে যান। এক সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট নিয়ে হাইকমিশনে পৌঁছোতে পারবেন। তবে তার জন্য ভিসাপিছু তিন থেকে চার হাজার টাকা সেলামি দিতে হবে। বন্ধু বললেন।

আমি এত চেষ্টা করেও পাচ্ছি না, ওরা কী করে পাবে?

আপনার তো ভিসা পাওয়া নিয়ে কথা, এত প্রশ্ন করে কী লাভ! ও হ্যাঁ, সব ট্রাভেল এজেন্ট কিন্তু এই কাজ করে না, আমি আপনাকে একটা সন্ধান দিচ্ছি, এতে ফোন করুন কাজ হয়ে যাবে আশা করি। বন্ধু নম্বর দিলেন।

আট হাজার টাকার বিনিময়ে ইন্ডিয়ায় যাওয়ার ভিসা পেল সিরাজ এবং তার স্ত্রী। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল সিরাজের। এই আট হাজার টাকার একটা টাকাও বাংলাদেশ সরকার অথবা ইন্ডিয়ার সরকার পাবে না। প্রতিদিন বহু লক্ষ টাকা এভাবে কিছু মানুষ, হাতিয়ে নিচ্ছে। মুশকিল হল, প্রতিবাদ করে যেমন ইন্ডিয়ায় যাওয়া বন্ধ করা উচিত হবে না তেমনি এজেন্টদের বিপদে ফেলাও সম্ভব হবে না।

সকালের বাসে উঠে পদ্মা পেরিয়ে বর্ডার ডিঙিয়ে কলকাতার মার্কুইস স্ট্রিটে ওরা পৌঁছেছিল সন্ধে নাগাদ। হোটেলের খবর ঢাকা থেকেই নিয়ে এসেছিল সিরাজ। সেখানে পৌঁছে নার্গিস খুশি হল।

স্নান সেরে নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, এখান থেকে নিউমার্কেট কতদূরে? বহু বছর আগে একবার কলকাতায় এসেছিল সিরাজ। তার স্মৃতি আবছা। তবে নিউমার্কেটের কথা মনে আছে। পরের দিন সকালে ওরা পায়ে হেঁটে নিউমার্কেট ঘুরে এল। সিরাজ বলল, আজ কোনো কেনাকাটা নয়, তার জন্য অনেক সময় পাবে। আগে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করি, তারপর—

নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই সল্টলেকের ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছে গেল ওরা। ট্যাক্সি ড্রাইভার লোকটি সওয়ারিরা নতুন বুঝতে পেরে বেশি ঘুরিয়ে ভাড়া আদায় করেনি।

স্লিপে নিজেদের নামধাম লিখে বেয়ারাকে দেওয়ার পর ওরা দেখল অন্তত আটটি দম্পতি প্রতীক্ষাঘরে বসে আছেন। ওরা বসতে না বসতেই একজন প্রৌঢ় ভিতর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সিরাজ ভাই কে?’

সিরাজ উঠে দাঁড়াল, ‘আমি।’

‘আপনার মিসেস—?’

‘ইনি।’

আসেন, ভিতরে আসেন। একটা ছোট্ট ঘরে তাদের বসিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘টেলিফোনে আমার সঙ্গেই আপনার কথা হয়েছিল।’ মাথা নাড়লেন তিনি। ‘খুব আপশোস হয়, জানেন, ছেলেবেলায় বাবা—মায়ের সঙ্গে আমি বিক্রমপুরের ভাষায় চমৎকার কথা বলতে পারতাম। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। মাও চলে গেলেন কিছুদিন পরে। তারপর কলকাতার মানুষদের সঙ্গে এখানকার ভাষায় কথা বলতে বলতে জিভ থেকে দেশের ভাষা কখন মুছে গেছে বুঝতে পারিনি। এখন চেষ্টা করলেও সব শব্দ ঠিকভাবে উচ্চচারণ করতে পারব না। আচ্ছা একটা ফর্ম ভরতি করতে হবে।’

ভদ্রলোক ছাপানো একটা ফর্ম বের করে, সিরাজের কাছ থেকে জেনে নিয়ে তথ্য লিখে নিতে লাগলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিয়ে কত বছর আগে হয়েছে?’ উত্তর শুনে বললেন, ‘সময়টা সন্তান হওয়ার পক্ষে বেশি। কখনও জন্মনিরোধক পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছেন?’ প্রশ্ন কানে যেতেই নার্গিস মুখ নীচু করল। সিরাজ একটু সংকোচের সঙ্গে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, প্রথম দুই বছর।’

‘কখনও কনসিভ করেছেন?’

‘না।’

‘আপনাদের দুইজনের ব্লাড গ্রুপ কি আলাদা?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনারা ওখানে যেসব টেস্ট করিয়েছেন তার রিপোর্ট কি এনেছেন?’

‘হ্যাঁ।’ ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে এগিয়ে দিল সিরাজ। ‘সিরাজ ভাই, আপনারা এখানেই একটু অপেক্ষা করুন।’ ভদ্রলোক সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন।

মিনিট দশেক পরে তিনি এসে ওদের নিয়ে গেলেন ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়ের কাছে। কাশফুলের মতো চুল, ফরসা মানুষটি বললেন, ‘আসুন মা, আসুন, বসুন।’ সিরাজ লক্ষ করল ডাক্তার নার্গিসকে মা বলে সম্বোধন করলেও তাকে কিছু বললেন না। ওঁর সামনে নার্গিসের ফাইল খোলা।

‘ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম কি এখনও আগের মতো আছে?’ ডক্টর মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘বিকেলবেলায় এয়ারপোর্ট থেকে ধানমান্ডি যেতে দুঘণ্টা লেগে যেত। এখন শুনেছি ফ্লাইওভার হয়ে যাওয়ায় সমস্যা কিছুটা কমে গেছে।

সিরাজ বলল, ‘শুক্রবার যে পথ পনেরো মিনিটে যাওয়া যায়, তা অন্য দিন দেড় ঘণ্টা এখনও লাগে। আরও কয়েকটা ফ্লাইওভার হয়ে গেলে—’

এবার নার্গিসের দিকে তাকালেন ডাক্তার। ‘মা, বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের শরীরের সত্তর শতাংশ রহস্য জেনে গিয়েছেন, বাকি আছে ত্রিশ শতাংশ। আমার তো মনে হয় অজানা রয়েছে পঞ্চাশ শতাংশ। শরীরের সব কিছু আপাতচোখে ঠিক আছে তবু কেন সন্তান হচ্ছে না তার যুক্তি খুঁজতে গিয়ে অনেক পরীক্ষা—নিরীক্ষা হচ্ছে। অথচ দেখুন, গরিব ঘরের মায়েদের যখন সন্তানের প্রয়োজন নেই তখনও তারা বছরের পর বছর মা হয়ে যাচ্ছেন। প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়াল এটা। ঢাকায় যেসব পরীক্ষা হয়েছে তা আমি এই ফাইল থেকে জেনেছি। কিন্তু যে পরীক্ষাগুলো করানো হয়নি তা অবিলম্বে করানো দরকার। কাল সকালেই করে নিন। ওই রিপোর্ট পাওয়ার পর চিকিৎসা শুরু করব।’

সিরাজ বলল, ‘আমাদের কি এখানে অনেক দিন থাকতে হবে?’

‘কী করে থাকবেন? ভিসা দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। থাকার দরকার নেই। কিন্তু যোগাযোগ রাখতে হবে।’

হঠাৎ নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি মা হতে পারব তো?’

‘ভরসা রাখুন, না না, আমার উপর নয়’ একটা আঙুল উপরের দিকে তুলে হাসলেন ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়।

সিরাজ অবাক হল, ‘আপনি এসব মানেন?’

‘সেই পুরোনো কথা। আপনি নিজের চোখে বাতাসকে দেখেছেন? না, দেখেননি। কিন্তু অনুভব করেছেন, যে অনুভব করতে পারে সে পায়।’ ডক্টর মুখোপাধ্যায় প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন।

ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়ের সহকারী ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করে, এক হাজার টাকা ফি জমা দিয়ে রসিদ নিল সিরাজ। তিনি পার্ক স্ট্রিট এলাকায় একটি প্যাথলজির কার্ড দিয়ে বললেন, ‘সকাল ৮টার মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবেন স্যারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে। আপনারা কোথায় উঠবেন?’

সিরাজ বলল, ‘মার্কুইস স্ট্রিট—ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে, এক হোটেলে।’

‘বাঃ ওখান থেকে হেঁটে যেতে কয়েক মিনিট লাগবে। আমি আপনাদের নাম ওদের ফোনে বলে দিচ্ছি যাতে বেশি অপেক্ষা না করতে হয়।’

নার্গিস চুপচাপ শুনছিল। এই ভদ্রলোককে দেখতে তার এক মামার মতো, যিনি বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে আর বিয়ে করেননি। তার মনে হল এর সঙ্গে কথা বলা যায়। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, উনি কি নতুন টেস্ট করতে দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, মা।’

‘সেগুলো কি খুব কঠিন?’

‘একদম নয়। এমজিএমএম আদৌ কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। সন্তান না হওয়ার পিছনে অনেক কারণ থাকে। যেমন অ্যান্টিবডি যদি বেশি হয়ে যায় তাহলে এই সমস্যা হয়। দেখবেন, যেসব মেয়ের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি থাকে তাদের পক্ষে মা হওয়া অনেক সময় সম্ভব হয় না। ভয় পাবেন না মা’ ভদ্রলোক বললেন।

বাইরে বেরিয়ে এসে সিরাজ বলল, ‘তোমার অন্তত ওই সমস্যা নেই।’

‘কী সমস্যা?’

‘তোমার ফিগার দারুণ, কোনো বাড়তি চর্বি নেই।’ সিরাজ হাসল।

‘ধ্যাৎ, অসভ্য!’ লজ্জা পেল নার্গিস।

সেদিন দুপুরে হোটেলের উলটো দিকের রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে ওরা অবাক হয়ে গেল। একেবারে বাসার রান্না, মেনুকার্ডে ভর্তাই দেখল পাঁচ রকমের। সিরাজ বলেই ফেলল, ‘জানো, কলকাতায় এসে মনেই হচ্ছে না বিদেশে এসেছি। বাংলায় কথা বলছি, বাংলা খাবার খাচ্ছি, কোনো সমস্যা নেই।’

নার্গিস বলল, ‘মানুষগুলোও কী রকম ভালো। ডাক্তারবাবুর কথা বাদ দাও, ওঁর অ্যাসিস্টান্টের ব্যবহার ঠিক আত্মীয়ের মতো।’

‘একটু ভুল করলে’, সিরাজ বলল, ‘আত্মীয়রাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শত্রু হয়।’

গোটা দুপুর—বিকেল ওরা নিউমার্কেট ঘুরল। সিরাজ বলল, ‘আজ বেশি কিছু কিনো না, শুধু পছন্দ করে যাও। পরে এসে কিনবে।’

‘আমি তো যা দেখছি তাই কিনতে ইচ্ছে করছে’, নার্গিস বলল।

‘সর্বনাশ! আরে এসব তো ঢাকায়ও পাওয়া যায়।’

‘একদম না। তুমি কি ঢাকায় শাড়ির দোকানে যাও যে জানবে কী পাওয়া যায় কী যায় না? ভয় নেই, তোমার পকেট খালি করব না।’

সিরাজ বলল, ‘দ্যাখো আমাদের মনে রাখতে হবে এখানে কী জন্য এসেছি। তার পিছনে কত খরচ হবে তা জানি না। সব মিটে গেলে ফিরে যাওয়ার আগে যা থাকবে তাই দিয়ে যত পার কিনে নিয়ে যেও।’

তিনটে দিন ধরে নানান পরীক্ষার পরে রিপোর্ট দেখে ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘আমি যে ওষুধ লিখে দিচ্ছি তা নিয়ম করে খেতে হবে। ঢাকায় ওষুধ কেনার ঝুঁকি না নিয়ে কলকাতা থেকেই কিনে নিয়ে যান।’

সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘এতে কাজ হবে ডাক্তারবাবু?’

‘যে ত্রুটির কথা রিপোর্ট বলছে সেটা যদি ওষুধে সেরে যায় তাহলে কাজ না হওয়ার তো কথা নয়। আমার বিশ্বাস আপনারা হতাশ হবেন না।’

‘আমাদের আবার কবে আসতে হবে? সিরাজ জানতে চাইল।

‘যোগাযোগ রাখবেন, তাহলেই হবে। কিন্তু তিনমাস পরে অবশ্যই ফোন করে জানাবেন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে কিনা।’ ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায় পেইসক্রিপশন এগিয়ে দিলেন, বললেন, ‘কবে ফিরে যাচ্ছেন?’

‘আগামী পরশু।’ সিরাজ জবাব দিয়েছিল।

‘এক মাসের ওষুধ খাওয়ার কথা বলা হয়েছিল প্রেসক্রিপশনে। দেখা গেল ওষুধ বেশি দামি। কেনার পরে সিরাজ বলল, ‘এবার তুমি কেনাকাটা করতে পার। হোটেলের ভাড়া আর রাস্তায় লাগতে পারে এমন টাকা বাদ দিয়ে বাকিটা তোমার কেনাকাটায় খরচ করতে পার। কী কিনবে তার লিস্ট বানিয়েছ?’

‘হুঁ।’ মাথা নাড়ল নার্গিস।

‘কখন বানালে দেখতেই পেলাম না!’

‘সব তোমাকে দেখিয়ে করতে হবে নাকি?’ নার্গিস হেসেছিল। সারাদিন ধরে কেনাকাটা করে ওরা হোটেলে ফিরে এসেছিল। রাতে ওষুধ খাওয়ার পরে নার্গিস বলল, ‘আমার জন্য অনেক খরচ হয়ে গেল।’

‘তবে তোমার জন্য নয়, কেনাকাটার জন্য।’ সিরাজ স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল।

‘দূর আমি চিকিৎসার কথা বলছি।’

‘ও, খরচটা তোমার জন্য কী করে বলছ?’

‘আমার জন্য নয়? সব মেয়ের তো বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই স্বচ্ছন্দে বাচ্চচা হয়ে যায়। আমার বেলায় আট বছরেও হল না।’

‘তার জন্য তুমি একা দায়ী নও, তোমার স্বামীও দায়ী। তাই সে খরচ হয়েছে তা তোমার একার জন্য হয়নি, আমাদের দু—জনের জন্যই হয়েছে।’ সিরাজ বেড সুইচ টেনে নিয়ে আলো নিভিয়ে দিল।

কাল সকালে বাস ছাড়বে। বিকেলে পার্ক স্ট্রিট ঘুরে নিউমার্কেটে গিয়েছিল ওরা বেশ ভিড়। হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল নিশ্চল স্ট্রিট দিয়ে। হঠাৎ ধাক্কা খেল সিরাজ। দুটো লোক দু—দিক দিয়ে তাকে ধাক্কা মারায় সে ভারসাম্য হারাল। সিরাজের অবস্থা দেখে নার্গিস চিৎকার করে উঠল। আর তখনই একটা লোক সিরাজের কাঁধের ঝোলানো ব্যাগ ছিনতাই করে দু—জনের একজন দৌড়োল। দ্বিতীয়জন দৌড়োল বিপরীত দিকে। চিৎকার—চ্যাঁচামেচির মধ্যে নিজেকে সামলে সিরাজ সামনে দৌড়োতে গিয়েও থমকে গেল। ব্যাগ ছিনতাইকারীকে আর ভিড়ের জন্য দেখা যাচ্ছে না।

নার্গিস দৌড়ে এল ‘ব্যাগটা নিয়ে গেল যে।’

ভিড় ঠেলে যতটা সম্ভব দ্রুত এগিয়েও ছিনতাইকারীকে দেখতে পেল না সিরাজ। নার্গিস ছুটছিল ওর পিছু পিছু। তখনই খেয়াল হতেই চিৎকার করল সিরাজ, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমার সব নিয়ে গেল লোকটা।’ সেই চিৎকার শুনে ওদের চারপাশে ভিড় হয়ে গেল। উত্তেজনায় কথা বলতে পারছিল না সিরাজ। থরথর করে কাঁপছিল সে। একজন নার্গিসকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে দিদি?’

নার্গিস বলল, ‘ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।’

লোকটা মাথা নাড়ল, ‘শালারা এই কারবারই করে।’ বলে পাশের দোকানের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। ‘কালু খেয়াল রাখিস, সামনে ভিড় জমছে।’

এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাগে দামি কিছু ছিল?’

‘আমার সব ছিল, সব—।’ এতক্ষণে কথা বলতে পারল সিরাজ।

‘সব মানে?’

‘পাসপোর্ট, ডলার, টাকা—উঃ।’ দুহাতে মাথা চেপে ধরল সিরাজ।

‘পাসপোর্ট? আপনারা কি বিদেশি?’

একটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘কী ব্যাপার? এখানে এত ভিড় কেন?’

খুব রোগাটে একজন পুলিশের পোশাক পরা লোক ভিড় সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই অনেকেই সরে যেতে লাগল। অফিসার সিরাজের দিকে তাকালেন। ‘কী ব্যাপার?’

‘ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে।’ কাতর গলায় বলল সিরাজ।

‘অদ্ভুত। নিজের ব্যাগ নিজে সামলে রাখতে পারেন না?’ অফিসার ধমক দিলেন।

‘থাকেন কোথায়?’

‘বনানী, ঢাকায়।’

‘আই বাপ!’ অফিসারের চোখ বড় হল, ‘কী ছিল ব্যাগে?’

‘সব।’

‘সব মানে?’

‘পাসপোর্ট, ডলার, টাকা—।’

‘বুঝেছি। এক্ষুনি থানায় গিয়ে ডায়ারি করুন। যান।’

‘থানা কোথায়?’ নার্গিস জিজ্ঞাসা করল।

‘আপনি কে?’

সিরাজ বলল, ‘আমার ওয়াইফ।’

অফিসার একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘আসুন আমার সঙ্গে।’

নার্গিস দেখল যারা ভিড় জমিয়েছিল তাদের কয়েকজন ওদের পিছন পিছন আসছে। সে দ্রুত পা চালিয়ে সিরাজের পাশে চলে এল। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এত ভেঙে পড়েছে কেন সিরাজ? হাঁটতে হাঁটতে সে একসময় দেখল পিছনে কোনো কৌতূহলী মানুষ নেই।

থানায় ঢোকার পর পনেরো মিনিট তাদের অপেক্ষা করতে হল। একজন সেপাই এসে বলল, ‘যান, যা বলবার ভিতরে গিয়ে বলুন।’

ভিতরে ঢুকতেই একটা হলঘর দেখতে পেল ওরা। সেখানে গোটা চারেক টেবিলের পিছনে একটা করে পুলিশ বসে লোকের সমস্যা শুনছে।

‘কী দরকার ভাই?’ সামনের খালি টেবিলের পিছনে বসা অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমার ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গিয়েছে স্যার, সিরাজ বলল।

‘কোথায়?’

‘নিউমার্কেটের সামনে।’

‘কী ছিল ব্যাগে?’

‘আমার পাসপোর্ট, ডলার আর ইন্ডিয়ার টাকা।’

অফিসার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি বাংলাদেশি?’

‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’

‘ইনি?’

‘আমার ওয়াইফ।’

‘কী জন্য এসেছেন?’

‘আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে।’

উত্তর শুনে অফিসার নার্গিসের দিকে তাকালেন। একটু অবাক হলেন।

বললেন, ‘ওঁকে দেখে তো অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে না।’

‘ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়ের চিকিৎসায় ও আছে।’

ডক্টর শতদল মানে বিখ্যাত গাইনোকোলজিস্ট?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘বসুন আপনারা।’ অফিসার ইশারা করলে ওরা খালি চেয়ারে বসল। অফিসার একটা খাতায় লিখতে লিখতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের নাম, ঠিকানা বলুন।’ সিরাজ জবাব দিল।

‘কলকাতায় কবে এসেছেন? কোন হোটেলে উঠেছেন?’ সিরাজ জানাল।

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পাসপোর্ট নম্বর বলুন?’

সিরাজ মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই সবকটা নম্বর মনে করতে পারল না। সে হতাশ গলায় বলল, ‘ঠিক মনে আসছে না।’

‘কোথাও লিখে রাখেননি?’

‘না স্যার।’

নার্গিস নীচু গলায় মনে করিয়ে দিল, হোটেলে লিখেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সিরাজ বলে উঠল, ‘হোটেলে ঢোকার সময় ওরা পাসপোর্টের জেরক্স নিয়েছিল, নম্বর ওদের কাছে পাওয়া যাবে।’

পকেট হাতড়ে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিল, ‘এইটে হোটেলের কার্ড।’

‘ঠিক আছে। দু—জনের পাসপোর্টই গেছে?’

‘না। শুধু আমারটা ওই ব্যাগে ছিল।’ সিরাজ বলল।

‘ম্যাডাম, আপনার পাসপোর্ট কি সঙ্গে আছে?’ অফিসার হাত বাড়ালেন।

নার্গিস তার হাতব্যাগ খুলল। ভিতরের চেন টেনে পাসপোর্ট বের করে এগিয়ে দিল সামনে। সেটা খুলে ছবির সঙ্গে নার্গিসকে মিলিয়ে নিয়ে পাসপোর্টের নম্বরটা ডায়ারিতে লিখে নিলেন। তারপর হোটেলের কার্ড তুলে টেলিফোনের বোতাম টিপলেন।

‘হ্যালো। নিউমার্কেট থানার এসআই দত্ত বলছি। শুনুন, আপনাদের হোটেলে বাংলাদেশ থেকে একটি কাপল এসেছেন চিকিৎসার জন্য। দাঁড়ান, অফিসার একটু আগে লেখা নাম পড়লেন।

‘সিরাজুর রহমান, নার্গিস রহমান, চিনতে পেরেছেন? গুড। এই সিরাজুর রহমানের পাসপোর্ট নম্বরটা আমার এখনই দরকার। হ্যাঁ, ধরে আছি।’ রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে অফিসার সিরাজের দিকে তাকালেন, ‘বিদেশে এসে পাসপোর্ট হারালে কী বিপদে পড়তে হয় তা আন্দাজ করতে পারছেন?’

‘আমি তো হারাইনি, ছিনতাই করে নিয়ে গেছে।’ সিরাজ বলল।

‘দোষ কার? আপনার। আপনি কেয়ারলেস ছিলেন বলেই ছিনতাই করতে পেরেছে। আপনার স্ত্রী সতর্ক ছিলেন তাই ওঁর ব্যাগ ছিনতাই হয়নি।’ আবার রিসিভার কানে চাপলেন অফিসার। ‘হ্যাঁ, বলুন।’ নম্বর তারিখ কোথা থেকে ইস্যু হয়েছিল। ভিসার নম্বর তারিখ কবে থেকে এবং কতদিনের জন্য ভিসা দেওয়া হয়েছিল সব লিখে নিয়ে অফিসার বললেন, ‘আপনাদের কাছে তো জেরক্স আছে। এই জেরক্সের জেরক্স দু কপি করে এখনই কাউকে দিয়ে থানায় পাঠিয়ে দিন। কী? যা বলছি তাই করুন।’

রিসিভার রেখে চোখ বন্ধ করলেন অফিসার। সিরাজ কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আমার ব্যাগটা ফেরত পাব তো?’

চোখ খুললেন অফিসার, ‘ঢাকা শহরে কারও ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেলে সেই ব্যাগ কি ফেরত পাওয়া যায়?’

সিরাজ উত্তর দিল না। কারা কোন এলাকায় ছিনতাই করে তা নিশ্চয়ই পুলিশ জানে। যদি পুলিশ চেষ্টা করে তাহলে নিশ্চয়ই ছিনতাইকারীদের ধরতে পারে। কিন্তু এই কথাগুলো বললে অফিসার কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন তা বুঝতে না পেরে সে মুখ খুলল না। অফিসার বললেন, ‘কলকাতায় কয়েক কোটি মানুষ আসে—যায় থাকে। সমুদ্রের গভীরে যদি একটা নৌকা ডুবে যায় তাহলে সেটাকে ভাগ্য ছাড়া খুঁজে পাওয়া যায় না।’

‘আর কী ছিল আপনার ব্যাগে?’

‘ডলার, ইন্ডিয়ার টাকা।’

‘ডলার। কত ডলার?’

‘একশো দুই ডলার।’ মনে করে বলতে পারল সিরাজ।

‘ইন্ডিয়ার টাকা?’

‘পাঁচ হাজারের মতো।’

‘দেশে ফেরার টিকিট?’

‘হোটেলের ঘরে রাখা আছে।’

সব লেখার পর সই করে টিপসই মেরে সিরাজের হাতে একটা কপি দিয়ে অফিসার বললেন, ‘আপনার ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে কবে?’

‘আরও দিন সাতেক আছে।’

‘না নেই। কারণ, ইন্ডিয়ায় আপনি এই মুহূর্তে বেআইনিভাবে আছেন। আপনার কাছে পাসপোর্ট নেই তাই ভিসাও দেখাতে পারবেন না। এখন যদি আপনাকে ভারতীয় পুলিশ অ্যারেস্ট করে তাহলে গভীর জলে পড়বেন। তাই অবিলম্বে আপনাদের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে গিয়ে সাহায্য চান। ওঁরা যদি আপনাকে ডুপ্লিকেট না হোক টেম্পোরারি পাসপোর্ট বের করে দেন, ওঁরাই আপনাকে অ্যাডভাইস করবেন ঠিক কী কী করতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।’

‘ছিনতাইকারীকে ধরার কোনো চান্স নেই?’ এবার নার্গিস জিজ্ঞাসা করল।

‘ম্যাডাম, ব্যাগটা যদি খুব দামি না হয় তাহলে রাস্তার পাশে কোনো ডাস্টবিনে ওটা পেতে পারেন। কিন্তু ডলার, টাকা কি কেউ ফেরত দেয়?’

‘পাসপোর্ট? ওটা তো কারও কাজে লাগবে না।’ সিরাজ বলল।

‘কী করে জানলেন? আপনার কাছাকাছি দেখতে এমন লোক পৃথিবীতে আছে যে বিশ পঞ্চাশ হাজার টাকায় ওটা কিনে নেবে। ধরুন কোনো জঙ্গি যার বাংলাদেশে গিয়ে থাকা দরকার সে আপনার পাসপোর্ট ভিসা ব্যবহার করে আজই চলে যাবে সীমান্ত পেরিয়ে।’ অফিসার হাসলেন।

‘সর্বনাশ!’ সিরাজের মুখ থেকে শব্দটা বের হল।

‘চিন্তা করবেন না। নম্বরটা পেয়ে গেছি বলে আপনার ক্ষেত্রে ওই বিপদ হবে না। আমি হেড অপিসে রিপোর্ট করছি, ওরা ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনকে জানিয়ে দেবে। আপনার পাসপোর্ট যে ব্যবহার করবে তাকে গ্রেফতার করা হবে। আর হ্যাঁ, আপনার যে পাসপোর্ট খোয়া গিয়েছে এ কথা কাউকে বলবেন না। মানে সাধারণ লোক বা হোটেলের কাউকে বলার দরকার নেই।’

এর মধ্যেই একটি লোক এসে কপালে হাত ঠেকাল। ‘কী চাই?’

‘হোটেল থেকে এটা পাঠিয়েছে স্যার।’ লোকটা খামখানা দিল।

খামখানার ভিতর থেকে কাগজগুলো বের করে অফিসার লোকটিকে বললেন, ‘ঠিক আছে। যেতে পার।’

লোকটার চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে অফিসার দুটো কাগজ সিরাজের দিকে এগিয়ে বললেন, ‘আপাতত দুধের বদলে ঘোল নিয়ে যান। আপনি যে অবৈধভাবে ভারতবর্ষে আসেননি অন্তত এটা বলতে পারবেন। আর হ্যাঁ, আমাদের না জানিয়ে হোটেল ছেড়ে শহরের বাইরে যাবেন না। এখন দ্রুত বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনার অফিসে চলে যান।’

কাগজ দুটোয় নিজের পাসপোর্টের জেরক্স দেখতে পেল সিরাজ। ঘরের বাইরে এসে নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, ‘দেশে ফেরার টিকিট তো আছে। হোটেলের টাকাও তো ঘরে রেখেছিলে। এখন ওই কাগজ দেখিয়ে বর্ডার পেরিয়ে দেশে ফেরা যাবে না?’

‘বোধহয় না।’ মাথা নাড়ল সিরাজ।

‘তাহলে কী হবে?’ নার্গিসের মুখে মেঘ জমল। এই সময় অফিসার বাইরে বেরিয়ে এসে ওদের দেখে বললেন, ‘একি, এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?’

সিরাজ বলল, ‘খুব অসহায় লাগছে, কী করব বুঝতে পারছি না।

আইনে যা আছে তা অনুসরণ করা ছাড়া আপনার আর কিছুই করার নেই।’ অফিসার নার্গিসের দিকে তাকালেন, ‘আপনার কাছে কিছু টাকা কি আছে?’

কথা না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল নার্গিস।

‘তাহলে এখনই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে চলে যান। ওঁদের সমস্যাটা বলুন। ওঁরা বলে দেবেন আপনাদের কী করতে হবে। আর দেরি করলে গিয়ে দেখবেন অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’

অফিসার ট্যাক্সি ডেকে না দিলে ওই সময় নিউমার্কেটে ট্যাক্সি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হত। পুলিশ অফিসার হুকুম করেছে বলে ট্যাক্সি ড্রাইভার একটুও না ঘুরিয়ে পার্ক সার্কাসের হাইকমিশনারের অফিসের সামনে পৌঁছে দিল। নার্গিসের টাকায় ভাড়া মিটিয়ে ওরা দেখল হাইকমিশনারের অফিসের সব দরজা বন্ধ। সবচেয়ে বড় দরজার গায়ের বেলের বোতাম টিপল সিরাজ। তিনবার টেপার পরে গলা ভেসে এল, ‘কে? কী চাই?’

সিরাজ উপরের দিকে তাকিয়ে বুঝল স্পিকারের মাধ্যমে শব্দ বাইরে আসছে। সিরাজ মুখ তুলে জবাব দিল, ‘আমরা বাংলাদেশের সিটিজেন। খুব সমস্যায় পড়েছি। একটু দরজাটা খোলেন।’

কথাগুলো বলার সময় অজান্তেই ঢাকার ভাবভঙ্গি এসে গেল সিরাজের। শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকল ওরা। সামনের রিসেপশন ডেস্কের পিছনে একজন বয়স্ক মানুষ বসে আছেন। পিছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

‘সমস্যা কী?’

সিরাজ বলল, ‘ভাই, একটু আগে আমার পাসপোর্ট, ডলার, টাকা ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। নিউমার্কেটের সামনে।’

‘সর্বনাশ!’

‘আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করুন ভাই।’

‘ইনি?’

‘আমার ওয়াইফ।’

‘আপনার পাসপোর্টও ছিনতাই হয়ে গেছে?’

‘না, না।’ দ্রুত মাথা নাড়ল নার্গিস।

‘যাক বাঁচলেন।’ রিসেপশনিস্ট বললেন, ‘শুনুন, যেখানে আপনার ছিনতাই হয়েছে সেখানকার থানায় গিয়ে ডায়ারি করুন। তারপর সেই ডায়ারির কপি নিয়ে এখানে আসুন। অবশ্য এসব করে এখানে আসার আগেই অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। কোথায় উঠেছেন?’

‘হোটেলে।’

‘থানা থেকে ডায়ারির কপি নিয়ে সোজা হোটেলে চলে যাবেন। ঘর থেকে কালকের আগে বের হবেন না। কাল সকাল দশটায় এখানে চলে আসবেন। তাড়াতাড়ি যান।’

‘ভাই, থানায় গিয়ে ডায়ারি করা হয়ে গেছে। এই যে কপি।’ পকেট থেকে কাগজ বের করতে যাচ্ছিল সিরাজ, ভদ্রলোক ধমকালেন, ‘আরে, এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন কেন? ফালতু সময় নষ্ট। ওটা প্রথমে বলতে পারতেন না?’ বেশ রাগত ভঙ্গিতে বেল বাজালেন তিনি, কিন্তু কেউ এল না। একটু অপেক্ষা করে ইনটারকমের বোতাম টিপে বললেন, ‘স্বামী—স্ত্রী এসেছে, স্বামীর পাসপোর্ট চুরি হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, বাংলাদেশের নাগরিক।’ ওপাশের কথা শোনার পর বললেন, ‘তাহলে কি আগামীকাল আসতে বলব?’ আবার একটু চুপ করে থেকে রিসিভার নামিয়ে রাখতেই একজন কর্মচারী ভিতরের দরজা ঠেলে ঘরে এল। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কোথায় ছিলে হাসি। এদের নিয়ে এখনই আকবর ভাইয়ের কাছে যাও। একটু পরই উনি বেরিয়ে যাবেন।’

মাথা নেড়ে হাসি সিরাজদের ভিতরে নিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন জিলা?’

‘ঢাকা।’

‘আমার বাসা গেন্ডারিয়াতে।’

সিরাজ বুঝতে পারল এই লোকটা কথা বলার জন্য কথা বলতে চাইছে। সে চুপচাপ হাঁটতে লাগল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটা ঘরের সামনে তাদের দাঁড়াতে বলে ভিতরে ঢুকে গেল হাসি।

বেরিয়ে এল কয়েক সেকেন্ড পরে। ‘যান ভিতরে যান।’

টেবিলের ওপাশে একজন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওরা ঘরে ঢুকতেই বললেন, ‘বসুন। কী করে চুরি হল?’

চেয়ারে বসল ওরা। সিরাজ ব্যাপারটা কীভাবে হয়েছিল তা জানাল।

আকবর বললেন, ‘বিদেশে এসেছেন, একটু সতর্ক থাকবেন না? ভাবি বোধহয় বেশি সতর্ক ছিলেন, ওঁর ব্যাগ ছিনতাই হয়নি। কী কী ছিল?’

‘পাসপোর্ট, ডলার, টাকা।’ সিরাজ জবাব দিল।

আকবর একটা ফর্ম এগিয়ে দিলেন, ‘এটা ধরুন। ডায়ারি কপিটা দিন।’

কাগজটা দিয়ে ফর্ম হাতে নিল সিরাজ। ডায়ারির কপিতে চোখ বুলিয়ে আকবর বললেন, ‘আমি আজ বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না ভাই। জরুরি মিটিংয়ে যেতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি ফর্ম ভরতি করে দিন তো।’

হোটেল থেকে পৌঁছে দেওয়া জেরক্স কপির পাসপোর্ট নম্বর লিখতে পারায় সুবিধে হল। ফর্ম ভরতি করে এগিয়ে দিল সিরাজ। আকবর বললেন, ‘আজ তো ছুটির সময় হয়ে গিয়েছে। আমি এই অ্যাপ্লিকেশনের উপর সই করে জেরক্স দিচ্ছি। যত্ন করে রাখবেন। কাল সকালে আসুন। আমরা এর ভিত্তিতে যে কাগজ দেব তা নিয়ে এখানকার লর্ড সিনহা রোডে আইবি অফিসে দেখা করবেন। ওরা আইনমাফিক যা করার করবেন। ভাবিকে সঙ্গে আনবেন কারণ, ওঁর কাছে বৈধ পাসপোর্ট আছে।’

ফেরার সময় ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। দূরত্ব বেশি না, পথটা ওরা হেঁটেই চলে এল। হোটেলে ফিরে নার্গিস বলল, ‘উঃ কী ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে এখানকার মানুষজন খুব ভালো।’

চেয়ারে বসে জুতোর ফিতে খুলছিল সিরাজ, খুলতে খুলতেই বলল, ‘তাহলে যে লোকটা ছিনতাই করেছিল সেও ভালো লোক?’

‘তা কেন? খারাপ লোক তো সব জায়গায় থাকে। কিন্তু থানায় যে পুলিশ অফিসার আমাদের সাহায্য করলেন, বাংলাদেশ হাইকমিশনের আকবর ভাই কী ভালো ব্যবহার করলেন, ইচ্ছে করলে তা নাও করতে পারতেন।’ নার্গিস বেশ জোরের সঙ্গে বলল।

‘এই ব্যবহার করাটা ওদের ডিউটির মধ্যে পড়ে।’

‘সবাই যে যার ডিউটি ঠিকঠাক করে?’

নার্গিসের যে রাগ হচ্ছে বুঝতে পেরে হেসে ফেলল সিরাজ। কথা ঘোরাবার জন্য বলল, ‘চা খাবে?’

‘না। আগে আমি চেঞ্জ করব।’

‘কর।’

‘কর মানে? তুমি পাঁচ মিনিটের জন্য বাইরে যাও, প্লিজ!’

হেসে ফেলল সিরাজ, ‘আশ্চর্য ব্যাপার। হঠাৎ আমাকে লজ্জা পাচ্ছ?’

নার্গিস কথা না বলে ঘরে পরার পোশাক বের করতে লাগল। সিরাজ বলল, ‘বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ কর।’

‘বাথরুমের মেঝেতে জল পড়ে থাকে, খারাপ লাগে।’

‘আহা গিয়ে দেখ জল নাও থাকতে পারে।’ সিরাজ কথাগুলো বলতেই বন্ধ দরজায় শব্দ হল।

নার্গিস বলল, ‘কেউ এসেছে, তুমি বাইরে যাও।’ বাইরে বেরিয়ে আসতেই ভদ্রলোককে দেখতে পেল সিরাজ। যাওয়া—আসার সময় রিসেপশনের পিছনে এঁকে কয়েকবার দেখেছে। ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে এল। সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার।’

‘আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি। আমি মিস্টার গুপ্তা, এই হোটেলের ম্যানেজার। আচ্ছা, আজ পুলিশ আপনার পাসপোর্টের জেরক্স পাঠাতে বলেছিল কেন বলুন তো? এরকম ঘটনা তো কখনও ঘটে না।’

‘বোধহয় ওদের দরকার হয়েছিল।’ বলতে বলতে সিরাজ সতর্ক হল। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা তৈরি করবে এই লোকটা।

‘কেন দরকার হয়েছিল তা কি আপনি জানেন?’

সত্যি কথাটা বেরিয়ে এল সিরাজের মুখ থেকে। ম্যানেজার চোখ বড় করলেন, ‘সর্বনাশ! আপনার পাসপোর্ট নেই?’

‘আমার কাছে জেরক্স আছে।’

‘জেরক্সে কি কাজ হয়? ধরুন আপনার কাছে একশো টাকার নোটের একটা জেরক্স আছে, সেটা দিয়ে দোকান থেকে জিনিস কিনতে পারবেন?’

‘না।’

‘দেখুন ভাই, বৈধ পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া আমার হোটেলে কাউকে থাকতে দিতে পারি না। এটা সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ। আজ রাতে যেতে হবে না, কাল সকালে হোটেল ছেড়ে দিতে হবে।’ ম্যানেজার বেশ শক্ত গলায় বললেন কথাগুলো।

সিরাজ বলল, ‘আপনি ভুল করছেন। আমি থানায় ডায়ারি করেছি, তার কপি সঙ্গে আছে। থানার অফিসার আপনাদের পাঠানো পাসপোর্টের জেরক্স কপির উপর সই করে দিয়েছেন, সেটাও সঙ্গে আছে। তার উপর আমি যে দেশের নাগরিক সেই দেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস থেকেও এ ব্যাপারে কাগজ পেয়েছি। আগামীকাল আপনাদের লর্ড সিনহা রোডের এসবি অফিসে গেলে পাকা কাগজ পেয়ে যাব। আমার সঙ্গে কাগজগুলো যদি আপনার কাছে বৈধ বলে মনে না হয়, তাহলে কাল এসবি অফিসের কাগজকে নিশ্চয়ই বৈধ বলে মনে করবেন?’

ম্যানেজারকে একটু চিন্তিত দেখাল। সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘আর কিছু বলবেন?’

‘আপনি ওইসব কাগজ নিয়ে রিসেপশনে আসুন।’

‘কেন?’

‘সাবধানের মার নেই ভাই। ওগুলো জেরক্স করিয়ে রেখে দেব।’ ফিরে আসার পরে জামাকাপড় পালটানো হয়নি বলে ওইসব কাগজ সিরাজের পকেটেই ছিল। ম্যানেজার নীচে নেমে ওগুলো জেরক্স করিয়ে নিজের জন্য কপি করাল। ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করল, ‘কপি, নিয়ে কী করবেন?’

‘যদি আবার ছিনতাই হয়ে যায়।’ সযত্নে পকেটে রেখে বলল সিরাজ।

‘শুনুন। আপনি কাল বিকেলের মধ্যে এসবি অফিস যদি কোনো কাগজ দেয় তা দেখাবেন। না হলে প্লিজ—!’ ম্যানেজার কথা শেষ করলেন না।

রাতে হোটেলের যে বেয়ারা খাবার দিতে এল সে বলল, ‘স্যার, আপনার সমস্যা শুনেছি। ভাবির তো পাসপোর্ট আছে, আপনারা দেশে চলে যান।’

‘কীভাবে যাব? পাসপোর্ট কোথায়?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘কোনো সমস্যা নেই।’

‘তার মানে?’

‘যে বাসে এসেছেন তার ফেরার টিকিট তো আছে?’

‘হ্যাঁ, আছে।’

‘বাসে ওঠার সময় টিকিট দেখবে, পাসপোর্ট দেখতে চাইবে না। তাই সোজা বাসে উঠে পড়বেন হোটেলের সামনে থেকে।’

‘তারপর? বর্ডারে গিয়ে কী করব? ওরা তো পাসপোর্ট, ভিসা দেখতে চাইবে? জেরক্স দেখালে পুলিশ ডাকবে।’ সিরাজ বলল।

‘পুলিশের বাবার কাগজ তো আপনার সঙ্গে থাকবে।’

‘তার মানে?’

‘লর্ড সিনহা রোডের এসবি অফিসের কাগজ দেখালে ওরা আর কিছু বলবে না। আপনারা বর্ডার পেরিয়ে যাবেন।’

নার্গিস চুপচাপ শুনছিল, এবার বলল, ‘যদি বলে পাসপোর্ট না দেখলে যেতে দেবে না। ভিসাটা দেখতে চাইলে দেখাতে পারবে না তুমি?’

সমর্থনে মাথা নাড়ল সিরাজ।

বেয়ারা হাসল, ‘তার ব্যবস্থা আছে।’

‘কীরকম?’ জিজ্ঞাসা করল সিরাজ।

‘ব্যাপারটা যদি গোপন রাখেন তাহলে বলতে পারি।’ লোকটার মুখে রহস্যের হাসি। সিরাজ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

‘কিছু খরচ করতে হবে। অচেনা লোক দেখলে বেশি টাকা চায়। আমার চেনাজানা লোক হলে ছয় হাজারে রাজি হয়ে যাবে।’ বেয়ারা বলল।

‘কীরকম?’

‘আমি ফোন করে দেব। বর্ডারে বাস গিয়ে থামতেই আপনারা যখন নামবেন তখন বন্ধু চলে আসবে আপনাদের কাছে।’

‘আরে আমাদের চিনবে কী করে?’

‘হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠিয়ে দেব। আজকাল তো সমস্যা হয় না। হ্যাঁ, বর্ডারে পৌঁছে গেলে আপনাকে আর চিন্তা করতে হবে না। জামাই আদরে পার করে দেবে। আপনার ছিনতাই হয়ে গেছে, ছয় হাজার টাকা আছে তো?’

নার্গিস মাথা নাড়ল, ‘আছে।’

‘আপনার এই বন্ধুর নাম কী? কী করেন?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘কবীর ভাই। এসব কাজই করে থাকেন।’

‘আপনি আমার এত উপকার করবেন, আপনাকে কত দিতে হবে?’

‘এ নিয়ে আপনাকে একটা কথাও বলব না। আপনাদের দেখেই মনে হয়েছে বড় মনের মানুষ, তাই মুখ ফুটে কিছু চাইব না।’ লোকটি দরজার দিকে এগোল।

‘কিন্তু টাকা দেব অথচ কাজ হল না তখন—?’

‘আমার নামে কুত্তা পুষবেন। পাঁচ বছর ধরে লোক পাঠাচ্ছি। একটা কেসও ফেল করেনি। তাছাড়া পুরো টাকা দেবেন কেন? বর্ডার পার হওয়ার আগে তিন হাজার দেবেন। ওপারে গিয়ে আবার বাসে ওঠার সময় বাকি টাকা দিলেই হবে। বাসে। সিট বুক করেছেন?’

‘আসার সময় তো ডেট দিয়েছিলাম।’

‘আরে না না। এখানে আসার পর কনফার্ম করতে হবে। কাল তো পারবেন না, পরশু সকালের বাসে সিট বুক করে দেন।’

‘খুব ভালো হয়। অনেক ধন্যবাদ।’ কথাটা বলল নার্গিস।

লোকটা দরজা ভেজিয়ে চলে গেলে সিরাজ স্ত্রীর দিকে তাকাল। ‘তুমি ওকে ধন্যবাদ দিলে। যদি আমাকে জেলে যেতে হয় কী করবে?’

‘বলল তো, কোনো ভয় নেই। আমি শুনেছি ইন্ডিয়া থেকে অনেকেই পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে যায়। তারা যায় কী করে বল?’

‘কারা কীভাবে যায় তা তারাই জানে, আমি আমার নিজের দেশে ঘুস দিয়ে ঢুকব তা ভাবতেই পারছি না।’ মাথা নেড়েছিল সিরাজ, ‘জানি না কপালে কী আছে।’

পরদিন সকাল দশটায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে আকবর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনল তিনি মিটিংয়ে আছেন। বাইরে ভিসার জন্য লাইন পড়েছে। নার্গিস সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘কত লোক বাংলাদেশে যাচ্ছে, না?’

একটু বিরক্ত হল সিরাজ। ‘আচ্ছা, তুমি এখন এসব ভাবছ? আমার সমস্যার যদি সমাধান না হয় তাহলে তোমার খারাপ লাগবে না?’

‘এ কথা কী করে বললে?’

‘আমি তো তোমাকে এ নিয়ে চিন্তা করতে দেখছি না।’

‘কেউ চিন্তা করছে কিনা তা দেখা যায় না।’

‘ও। ধর আমাকে ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট থাকার অনুমতিপত্র দিল না। আবার ফিরে যাওয়ার বৈধ কাগজ নেই। ওরা তো আমাকে জেলে পাঠাবে। তোমার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তোমাকে ঢাকায় ফিরে যেতে হবেই। আমি এখানকার জেলে থাকব আর তুমি ঢাকায়—, ভাবতে পারছ?’ সিরাজ স্ত্রীর দিকে তাকাল।

‘না।’

‘কী করবে তুমি?’

‘আমি ফিরে যাব না।’

‘ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ দেশে থাকা অপরাধ।’

‘তোমার শাস্তি হবে।’

‘হোক, শুধু বলব, আমাকে যেন তোমার সঙ্গে জেলের এক জায়গায় রাখে। তাহলে সব মেনে নেব।’ নার্গিস হাসল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা খুঁজে পাচ্ছিল না সিরাজ।

ঘণ্টাখানেক পরে আকবর ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে পারল ওরা। আকবর বললেন, ‘সরি, আপনাদের অপেক্ষা করতে হল। কালকের কাগজটা দিন। আর হ্যাঁ, ম্যাডাম, আপনার পাসপোর্ট এনেছেন?’

সেগুলো হস্তগত করে বেল বাজিয়ে পিয়োনকে ডেকে বললেন, ‘এগুলো নিয়ে অফিসে যাও। যা করতে হবে তা ওদের বলা আছে।’

লোকটা কাগজ নিয়ে চলে যাওয়ার পরে আকবর বললেন, ‘সাধারণত স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিস আমাদের সুপারিশ মেনে নেয়। আপনাদের যে কাগজ দেব তা নিয়ে এখান থেকে সোজা ওদের অফিসে চলে যান।’

মাথা নাড়ল সিরাজ। নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, ‘যদি ওরা না মানে?’

‘খারাপ চিন্তা কেন ডেকে আনছেন?’ আকবর হাসল।

নার্গিস বলল, ‘আমরা যে হোটেলে আছি তার বেয়ারা বলেছে যে, ছয় হাজার টাকা দিলে তার লোক বর্ডার পার করে দেবে। ঢাকায় ফিরে যেতে ওর অসুবিধে হবে না কিন্তু উনি ভয় পাচ্ছেন যদি ধরা পড়ে যান। আচ্ছা ধরা পড়ার কোনো চান্স কি আছে?’

আকবরের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, ‘তাহলে আমার কাছে আসার কী প্রয়োজন ছিল? দালাল ধরে চলে গেলেই পারতেন।’

সিরাজ প্রতিক্রিয়া বুঝে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল, ‘না না, আমি বেআইনিভাবে ফিরতে চাই না। আসলে লোকটা এমনভাবে ওকে বুঝিয়েছে যে, বুঝতেই পারছেন, মেয়েদের সহজেই ভয় পাওয়ানো যায়।’

‘অত্যন্ত ভুল কথা বললেন।’ আকবরের মুখ এখনও থমথমে।

‘মানে?’

‘আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন মহিলা। বিরোধী নেত্রীও তাই। আপনার কি মনে হয় এঁদের সহজে ভয় পাওয়ানো সম্ভব?’

মাথা নাড়ল সিরাজ, ‘না না, ওঁদের কথা আলাদা। ওঁদের ব্যক্তিত্ব, ভাবনাচিন্তা একেবারেই আলাদা।’

‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা। ইন্ডিয়ার অনেক রাজ্যেই মহিলা মুখ্যমন্ত্রী আছেন। ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। মুখে যা আসে তা বলে ফেলা মোটেই ভালো নয়।’ আকবর যেন নিজেকে ক্ষত ক্ষত করলেন, ‘আপনাকে যে বেয়ারা এই প্রস্তাব দিয়েছে তার নাম কী?’

সিরাজ নার্গিসের দিকে তাকাল। নার্গিসের মুখ অন্য পাশে ঘোরানো। সে বলল, ‘প্রয়োজন হয়নি বলে নাম জিজ্ঞাসা করিনি।’

‘কিন্তু এখন তো প্রয়োজন হবেই। এ ধরনের লোককে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এরা কত নিরীহ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হাজার হাজার টাকা বেআইনিভাবে রোজগার করছে। আপনাদের বলেছে ছয় হাজার টাকা দিলে ওরা বর্ডার পার করে দেবে?’ আকবর জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল সিরাজ।

আকবর হেসে ফেললেন, ‘ওটা ক্রমশ বাড়বে। আপনার পকেট শূন্য হওয়ার পর যখন থামবে তখন আপনি চোখে সরষে ফুল দেখবেন। এই বেআইনি পারাপার করার চেনে কত লোক থাকে তার আন্দাজ আছে?’

‘না।’

‘বর্ডারে যাওয়ার আগেই ছয় হাজার কর্পূরের মতো উড়ে যাবে।’

আকবর একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘দুটো পথ আছে। একটা হল, আপনারা যে হোটেলে আছেন তার পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ব্যাপারটা জানান। দুই, আপনার পাসপোর্ট ছিনতাই হয়ে গেছে, সেটা আমাদের জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে একটা চিঠি ডেপুটি হাইকমিশনারকে আজই লিখুন। সেই চিঠিতে হোটেলের একটি বেয়ারা যে টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে তা জানাবেন। সেই চিঠি পেয়ে আমরা পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলব। আমার মনে হয় দ্বিতীয়টা করাই আপনার পক্ষে সহজ হবে।’

আকবর নার্গিসের দিকে তাকালেন, ‘আপনার ভিসা কবে শেষ হবে?’

নার্গিস পাসপোর্ট বের করে এগিয়ে দিল। পাতা উলটে আকবর ভিসার ছাপ এবং লেখা পড়লেন। ‘আর তো বেশি দেরি নেই। আপনাদের ডাক্তারের সঙ্গে যা কাজ ছিল তা কি শেষ হয়ে গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’ সিরাজ বলল।

‘বেশ। এখান থেকে লর্ড সিনহা রোডের স্পেশাল ব্রাঞ্চ হয়ে পুলিশের অফিসে যান। ওঁরা যদি বেশি সময় না নেন তাহলে ভালো। না হলে আপনি ওঁকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিন। আপনার সমস্যা মিটে গেলে ফিরে যাবেন।’ আকবর বললেন।

‘আমি একা ফিরে যাব?’ প্রায় আঁতকে উঠল নার্গিস।

‘কেন? কোনো অসুবিধে তো নেই। আপনারা কীসে এসেছেন?’

‘বাসে’ সিরাজ বলল।

‘গুড। মার্কুইস স্ট্রিট থেকে সকালে বাস ছাড়ে। আপনি ওঁকে সেই বাসে উঠিয়ে দেবেন। বর্ডার পার হওয়ার সময় নামতে হবে। তখন বেলা এগারোটা—সাড়ে এগারোটা। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ইমিগ্রেশন কাস্টমস করিয়ে আবার ওদিকের বাসে উঠে বসলে ঢাকায় পৌঁছোবার আগে একমাত্র লঞ্চে নামতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই।’ আকবরের কথার মধ্যে পিয়োন একটা ফাইল নিয়ে এল। সেটা খুলে পড়ার পর নীচে সই করলেন আকবর। ফাইলের মধ্যে ঠিকানা লেখা যে খামটা ছিল তার ভিতরে সই করা কাগজের একটা কপি ভাঁজ করে ঢুকিয়ে এগিয়ে দিলেন। সিরাজের দিকে, ‘আশাকরি এতেই আপনার কাজ হয়ে যাবে।’

পিয়োন বলল, ‘স্যার কপিতে সই করিয়ে নিতে বলেছে।’

আকবর মাথা নাড়লেন, ফাইলটা সামনে রেখে বললেন, ‘সই করুন। পুরো নাম, ঢাকার ঠিকানা, পাশে কলকাতার হোটেলের নাম ঠিকানা।’

সব চুকে গেলে উঠে দাঁড়ালেন আকবর, ‘লর্ড সিনহা রোড এখান থেকে বেশি দেরি নয়। হেঁটেও যাওয়া যায় কিন্তু আপনাদের হয়তো অসুবিধে হবে। আপনারা নীচের রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করুন। কীভাবে যেতে হবে। ট্যাক্সি পেলে তো কথাই নেই। আর হ্যাঁ, যদি থানায় গিয়ে ডায়ারি না করেন, তাহলে অবশ্যই আজ বিকেলের মধ্যে চিঠিটা দিয়ে যাবেন।’

ওরা নীচে নেমে এল। নেমেই নার্গিস শক্ত করে সিরাজের কনুই ধরল।

‘আমি যাব না, কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যাব না।’

‘আরে কী করছ? হাত ছাড়।’

‘তুমি যদি ভেবে থাক—’

‘আমি কিছুই ভাবছি না। এখন লর্ড সিনহা রোডে যাওয়া ছাড়া আর কোনো চিন্তা মাথায় নেই।’ সিরাজ নার্গিসের হাত ছাড়িয়ে নিল। রিসেপশনে লোকদের সঙ্গে কথা বলে সিরাজ বুঝতে পারল হেঁটে যাওয়ায় অসুবিধে আছে। পথ গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা বেশি। অফিস থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে কিছুটা সময় নষ্ট হল। কোনো ড্রাইভারই যেতে চাচ্ছিল না। শেষতক একজন বলল, ‘মিটারে যা উঠবে তার উপর পঞ্চাশ টাকা বেশি দিতে হবে।’

নার্গিস বলল, ‘রাজি হয়ে যাও। নইলে যাওয়াই হবে না।’

লোকটাকে অতিরিক্ত টাকা দিতে খারাপ লাগছিল সিরাজের। এটা অন্যায়। বিদেশে এসে সে যদি অন্যায় সহ্য করতে না চেয়ে পুলিশের সাহায্য চায় তাহলে ফল কী হবে তা জানা নেই, হয়তো আজ সারাদিন এই সমস্যায় আটকে থাকতে হতে পারে। এসবি অফিসে যাওয়া হয়ে উঠবে না। হেসে ফেলল সিরাজ।

পাশে বসে নার্গিস জিজ্ঞাসা করছিল, ‘একি! হাসছ কেন?’

‘হঠাৎ মনে হল, রবীন্দ্রনাথ এই সমস্যায় পড়লে কী করতেন?’

‘যত বাজে বাজে চিন্তা।’ মুখ ফেরাল নার্গিস।

প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে ওরা যখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসারের কাছে পৌঁছোতে পারল তখন লাঞ্চ—আওয়ার শুরু হয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোক স্বাভাবিকভাবেই চেয়ারে নেই। পিয়োন গোছের একজন বলল, ‘বাইরে অপেক্ষা করুন, উনি দুটোর সময় আসবেন।’ অতএব অপেক্ষা করতে হল।

সিরাজ বলল, ‘চল, এখানে না বসে থেকে কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি।’

‘আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমার খিদে পেলে বল।’ নার্গিস বলল।

সিরাজের উৎসাহ চলে গেল। এই সময় এক ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন।

‘আপনারা কী প্রয়োজনে এসেছেন?’

সিরাজ উঠে দাঁড়াল, ‘অফিসার লাঞ্চে গিয়েছেন তাই অপেক্ষা করছি।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু প্রয়োজনটা কী?’

‘আমরা বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস থেকে আসছি। একটা সমস্যা হয়েছে। শুনলাম যিনি লাঞ্চে গিয়েছেন তিনি আমাদের সমস্যার কথা শুনবেন।’ খুব বিনীত গলায় বলল সিরাজ।

‘আসুন।’ অফিসার ভিতরে গেলেন।

ওরা ঘরে ঢুকে দেখল, যে চেয়ারটি ওরা খালি দেখে গিয়েছিল সেই চেয়ারে গিয়ে বসলেন ভদ্রলোক। ইশারা করলেন টেবিলের এপাশে বসতে। ওরা বসার পর অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন ‘বলুন, কী হয়েছে?’

সিরাজ নিউমার্কেটের ঘটনাটা সংক্ষেপে বর্ণনা করল।

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘থানায় ডায়ারি করেছেন?’

‘হ্যাঁ।’ ডায়ারির জেরক্স কপি বের করে এগিয়ে দিল সিরাজ।

মন দিয়ে সেটা পড়লেন অফিসার। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই কোনো হোটেলে উঠেছেন, কোন হোটেলে?’

সিরাজ হোটেলের নাম বলে জানাল, ‘চেক ইন করার সময় ওরা আমাদের পাসপোর্ট এবং ভিসার জেরক্স রেখেছিল। থানা থেকে সেগুলোর কপি আনিয়ে তার জেরক্স দিয়েছে।’

অফিসার সেগুলো দেখলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানে কে আসতে বলেছে?’

‘ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে গিয়েছিলাম—, ওহঃ ওঁরা এই চিঠি দিয়েছেন আপনাদের।’ খামটা বের করে দিল সিরাজ।

হাসলেন অফিসার, ‘এটাই তো প্রথমে দেওয়া কর্তব্য ছিল, তাই না?’ সিরাজ জবাব দিল না। ভুলটা স্বীকার করে নিল মুখ না খুলে। চিঠিটা পড়লেন অফিসার। তারপর বললেন, ‘প্রতিদিন শয়ে—শয়ে মানুষ বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে ভারতে ঢুকে পড়ে। তাদের পাসপোর্টের বালাই নেই। স্বাভাবিকভাবে ভিসাও থাকে না। এদের বেশিরভাগই পশ্চিমবাংলার সীমান্তের কাছাকাছি জেলায় থেকে যেতে চায়। ঠিক লোককে ধরে ভোটার কার্ড, ন্যাম—কার্ড, আধার কার্ডও ওরা পেয়ে যায়। ব্যাংকে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলে, তারপর পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করে। সবকিছু ঠিকঠাক দেখালে পাসপোর্ট পাওয়া কঠিন নয়। তারপর ট্রাভেল এজেন্টকে দিয়ে পাসপোর্টে ভিসার ছাপ যদি দেওয়াতে পারে তাহলে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে কাজকর্ম করে আবার ফিরে আসতে অসুবিধে হয় না। আমাদের পশ্চিমবাংলার মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর চব্বিশ পরগনায় এদের সন্ধানে সরকার তল্লাশি করছে। কিন্তু আর একদল আছে যাদের উদ্দেশ্য থেকে যাওয়া নয়। কোনো অবৈধ কাজ করে ফিরে যেতে চায় তারা। সন্ত্রাসবাদীরা এই দলের। কিন্তু ফেরার সময় বেআইনিভাবে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি এরা নিতে চায় না। তারা চোরাই পাসপোর্টের সন্ধান করে। আপনি বলছেন যে, আপনার পাসপোর্ট ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে সেই পাসপোর্ট এর মধ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। দশ—বিশ—পঞ্চাশ হাজার দিয়ে কিনে কোনো সন্ত্রাসবাদী বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছে সিরাজ সেজে।’

‘কী করে সেটা সম্ভব? পাসপোর্টের ফোটোগ্রাফের সঙ্গে সেই লোকটার চেহারা তো মিলবে না।’ অবিশ্বাসী গলায় জিজ্ঞাসা করল সিরাজ।

‘আপনার পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে এখনকার আপনার কি খুব মিল আছে? আপনার মুখে দাড়ি থাকায় তো আরও সুবিধে। দাড়িওলা লোকদের মুখের পার্থক্য চট করে করা যায় না।’ অফিসার বললেন।

‘সর্বনাশ!’ সিরাজের মুখ থেকে শব্দটা বেরিয়ে এল।

পাশ থেকে নার্গিস বলে উঠল, ‘কতবার বলেছি দড়িটা রেখ না, তোমাকে মানায় না, কথা শুনলে তো—’

অফিসার বললেন, ‘এমন তো হতে পারে আপনি আপনার নিজের পাসপোর্ট বিক্রি করে দিয়েছেন!’

‘সে কী? কী বলছেন আপনি?’ প্রায় চিৎকার করে উঠল সিরাজ।

‘আমি বলছি না কাজটা আপনি করেছেন। কিন্তু কেউ কেউ করেন। করে আমাদের কাছে আসেন সাহায্যের জন্য। ঠিক আছে, ডেপুটি হাইকমিশনারের এই চিঠিকে আমরা নিশ্চয়ই সম্মান দেব। আপনি কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কলকাতায় থাকতে পারেন। কিন্তু কখনই কলকাতার বাইরে যাবেন না। আর প্রতিদিন একবার এই অফিসে হাজিরা দিয়ে যাবেন। আপনারা এখন বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। অর্ডার তৈরি করতে একটু সময় লাগবে।’

সিরাজের মুখ প্রায় রক্তশূন্য হয়ে গেল। ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘এই তদন্ত শেষ হতে কতদিন লাগবে?’

‘বেশিদিন না। আপনি যেসব তথ্য হাইকমিশনকে দিয়েছেন তা ভেরিফাই করতে যেটুকু সময় লাগবে তার বেশি আপনাকে এদেশে আটকে রাখব না।’

এবার নার্গিস কথা বলল, ‘কিন্তু আমার ভিসার সময় তো পেরিয়ে যাবে।’

‘ওটা কখনই যেন না হয়।’ গম্ভীর গলায় বললেন অফিসার।

‘তার মানে, ওকে এখানে একা রেখে আমি ঢাকায় চলে যাব?’ প্রায় ডুকরে উঠল নার্গিস, ‘এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।’

অফিসার তাকালেন, ‘ম্যাডাম, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিদেশে থাকাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া অন্যদিকটার কথা ভাবুন। ওর পাসপোর্টের সঙ্গে টাকা—পয়সাও চুরি হয়ে গেছে। আপনার কাছে যা আছে তা দিয়ে দু—জনের খরচ চালানোর বদলে একজনের খরচ ভালোভাবে চলাটা ঠিক কিনা? আপনারা প্লিজ বাইরে গিয়ে বসুন।’ বাইরের বেঞ্চিতে বসেই কেঁদে ফেলল নার্গিস। সিরাজ চাপা গলায় বলল, ‘কী করছ? সবাই তোমাকে কাঁদতে দেখছে!’

‘আমি ভাবতেই পারছি না—’ কথা শেষ করতে পারল না নার্গিস। ‘পরিস্থিতি অনুযায়ী তো চলতে হবে।’ সিরাজ বলল, ‘আমি তো এখানে চিরদিন থাকছি না। তুমি যাওয়ার কদিনের মধ্যেই তো ফিরে যাব। তাছাড়া রোজ তোমার সঙ্গে ফোনে কথা হবেই।’ শব্দ করে শ্বাস ফেলল নার্গিস।

এসবি অফিসের অনুমতিপত্র হাতে পেয়ে স্বস্তি হল সিরাজের। এখন কেউ বলতে পারবে না সে বেআইনিভাবে এদেশে আছে। বাইরে বেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে চিকেন বিরিয়ানি আর কাবাবের অর্ডার দিল সিরাজ। এই দুটোই নার্গিসের খুব প্রিয় খাবার। কিন্তু সিরাজ লক্ষ করল আজ খাবারের নাম নার্গিসকে খুশি করল না।

‘তোমার কাছে এখন যা আছে তাতে হোটেলের ভাড়া মিটিয়েও কয়েকদিন চলে যাবে। তবে তুমি যাওয়ার পরে আমি হোটেল পাল্টাব।’

‘কেন?’ চোখ ছোট হল নার্গিসের।

‘আমার একার জন্য অত বড় ঘরের তো দরকার নেই। কম ভাড়ায় কোনো হোটেলে থাকলে পয়সা বাঁচবে।’

একটু ভাবল নার্গিস। তারপর বাঁ—হাতের মোটা সোনার বালা টেনে খুলে সিরাজের সামনে রাখল, ‘এখানে সোনার ভরি কত করে জানি না। এতে আড়াই ভরি সোনা আছে। তোমাকে পয়সা বাঁচানোর জন্য সস্তার হোটেলে যেতে হবে না।’

অবাক হয়ে গেল সিরাজ, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?’

নার্গিস উত্তর দিল না।

সিরাজ বলল, ‘বালাটা হাতে পরে নাও। যে টাকা আছে দিব্যি হয়ে যাবে।’

‘যদি না হয় তখন কী করবে? এই কলকাতায় তোমার পরিচিত কেউ কি আছে যার কাছে গিয়ে ধার চাইতে পার? আছে?’ নার্গিস জিজ্ঞাসা করল।

‘না, নেই।’

‘তুমি তো সঙ্গে কার্ড নিয়ে আসনি!’

‘ওইটাই ভুল হয়ে গেছে। এতগুলো ডলার, টাকা যে ছিনতাই হবে তা ভাবিনি। অবশ্য, কার্ড থাকলে তা পার্সে থাকত। পার্সটা তো ব্যাগেই থাকার কথা। ওটাও ছিনতাইকারী নিয়ে যেত। অবশ্য ব্যবহার করতে পারত না।’ সিরাজ হাসল।

‘তুমি কী মানুষ বলো তো!’ নার্গিস অবাক হয়ে তাকাল।

‘মানে?’

‘এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও হাসতে পারছ?’

‘তুমি বেশি টেনশন করছ!’

‘জানি না। বালাটা রেখে দাও। দরকার হলে বিক্রি করে দেবে। যদি দরকার না হয় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।’

খাবার এল। সিরাজ লক্ষ করল, আজ নার্গিসের বিরিয়ানিতে একটুও উৎসাহ নেই। সে কথা না বাড়িয়ে বালাটা পকেটে রেখে দিল।

এসবি অফিসের অনুমতিপত্রটি কয়েক কপি জেরক্স করিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে এল। রিসেপশনিস্টকে একটা কপি দিয়ে সিরাজ বলল, ‘এটা ম্যানেজারকে দিয়ে দেবেন। উনি খুব চিন্তায় ছিলেন।’ লিফটের দিকে পা বাড়াতেই সেই বেয়ারাকে দেখতে পেল ওরা। নার্গিস নীচু গলায় বলল, ‘ওই যে, ওর নাম জিজ্ঞাসা কর।’

কিন্তু লোকটা নিজেই এগিয়ে এল, ‘স্যার, কাল ফিরে যাবেন তো?’

‘কেন?’

বাসের সিট পাওয়া খুব মুশকিল, তাই জিজ্ঞাসা করলাম।

‘আমরা তো ঢাকা থেকেই ফেরার জন্য সিট রিজার্ভ করেছি।’

‘ও, কিন্তু এখানে এসে রিকনফার্ম করেছেন কি?’

‘না, সেটা করা হয়নি।’

‘তাহলে সিট না থাকার চান্সই বেশি। আমি আপনাদের দেখা না পেয়ে নিজ থেকেই সাড়ে ছ—টার বাসে দুটো সিট রিজার্ভ করেছি। আসলে শুধু বাসের সিট নয়, বর্ডারের অ্যারেঞ্জমেন্টও তো আগে থেকে করে রাখতে হয়। নইলে সমস্যা হলে আপনিই বলবেন, আমি ফোরটুয়েন্টি কারবার করেছি।’

বেয়ারা বলল, ‘আপনি একবার বাসের অফিসে গিয়ে টিকিটটা নোট করিয়ে আসুন স্যার। মুখের কথা তো তাই ওরা পেনসিলে লিখে রেখেছে।’

‘তোমার নাম কী ভাই?’ সিরাজ তাকাল।

‘আজ্ঞে রামচন্দ্র মণ্ডল। সবাই রামু বলে ডাকে।’ বেয়ারা হেসে চলে গেল। বাইরে বের হতেই নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, ‘সত্যি আমাকে চলে যেতে হবে?’

মাথা নাড়ল সিরাজ, ‘তুমি খুব অবুঝ হয়ে যাচ্ছ।’

‘তা তো বলবেই!’ ঠোঁট ফোলাল নার্গিস।

সিরাজ হাত নেড়ে বোঝাতে চাইল, ‘ধরো, তুমি আমার সঙ্গে ইন্ডিয়াতেই রয়ে গেলে। তোমার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। তখন পুলিশ তোমাকে ধরে এ দেশে অবৈধভাবে থাকার অপরাধে জেলে ঢুকিয়ে দিল, তুমি জেলের ভিতরে আর আমি বাইরে। ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখো, কীরকম লাগবে?’ সিরাজ মাথা নাড়ল, ‘তুমি চিন্তা করো না, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যাব।’

রামচন্দ্র অন্তত বাসের ব্যাপারে মিথ্যে বলেনি। পেনসিলে লেখা রয়েছে, রিজার্ভেশনের খাতায়, মিস্টার সিরাজ, মিসেস সিরাজ।

সিরাজ ঢাকা থেকে কেনা বাসের রিটার্ন টিকিট দেখিয়ে কাউন্টারের লোকটিকে বলল, ‘আমরা ঢাকা থেকেই সিট রিজার্ভ করে এসেছিলাম। কিন্তু কাল সকালে আমার ওয়াইফ ফিরে যাবেন, আমার যেতে দেরি হবে।’

‘কিন্তু একটু আগে দুটো সিট রিজার্ভ করার কথা হয়েছে।’

‘যে এসেছিল সে জানত না।’

লোকটি খাতায় নার্গিসের পুরো নাম লিখে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু আপনি তো সমস্যায় পড়বেন ভাই।’

‘কীরকম?’

‘উনি তো এই টিকিট নিয়ে বাংলাদেশে চলে যাবেন। আপনি কী করবেন?’

‘এই টিকিটের জেরক্স করে রাখছি।’

‘না ভাই, জেরক্স টিকিট অ্যালাউ করা হয় না।’

‘তাহলে কী হবে?’

‘আপনাকে নতুন টিকিট কাটতে হবে। কিন্তু যেহেতু আপনি বাংলাদেশের নাগরিক তাই হয় ডলারে নয় বাংলাদেশের টাকায় টিকিট কাটবেন।’

হঠাৎ নার্গিস বলে উঠল, ‘উঃ, কেন যে ইন্ডিয়াতে এলাম।’

‘এসেছি ডাক্তার দেখাতে।’ তারপর লোকটাকে বলল, ‘আপনি যখন বলছেন এটাই নিয়ম তখন আর কী করা যাবে। টিকিট কেটে নেব।’

ওরা যখন বাইরে বেরিয়ে এল তখন কাউন্টারের পাশে দাঁড়ানো একটা লোক পিছন পিছন এসে ডাকল, ‘স্যার।’

সিরাজ দাঁড়াল। লোকটা বেশ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কাল দেশে ফিরে যাবেন না?’

‘না।’

‘সর্বনাশ!’ লোকটা বিড়বিড় করল।

‘কেন কী হয়েছে?’

‘আপনি যাবেন বলে সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে।’

‘কী ব্যবস্থা?’ কপালে ভাঁজ পড়ল সিরাজের।

‘কেন রসিকতা করছেন স্যার? রামুর সঙ্গে তো ডিল ফাইনাল হয়ে গেছে।’

লোকটার ঠোঁটে রহস্যের হাসি।

‘না, কোনো ডিল ফাইনাল হয়নি। তাছাড়া কাল যাওয়া সম্ভব নয়।’

‘পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া এদেশে থাকবেন না স্যার। বিপদে পড়বেন।’

সিরাজ কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। নার্গিস বলল, ‘আশ্চর্য, এর মধ্যে ওরা তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলল? মনে হচ্ছে এরা খুব অর্গানাইজড।’

নার্গিসের কথায় কীসের ইঙ্গিত তা বুঝতে পেরেও চুপ করে থাকল সিরাজ।

হোটেলের ঘরে ফিরে আসার পরে সিরাজ বলল, ‘আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়। ভোর ভোর উঠতে হবে। সাড়ে ছ—টার আগেই বাস টার্মিনালে পৌঁছোতে হবে।’

গম্ভীর মুখে নার্গিস বলল, ‘একটু আগে খেয়েছি, আমি আর রাতে খাব না।’

‘ও।’ সিরাজ মেনে নিল, ‘তাহলে তুমি সঙ্গে যা যা নিয়ে যাবে তা গুছিয়ে নাও। ঘুম থেকে ওঠার পর সময় পাবে না। আমার জামা—প্যান্ট ওই ছোট সুটকেসেই রেখে যেও।’

এই সময় দরজায় শব্দ হল। সিরাজ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই রামচন্দ্রকে দেখতে পেল, ‘নমস্কার স্যার। ভিতরে আসতে পারি?’ হ্যাঁ কী ব্যাপার? সিরাজ বিরক্ত হল।

‘এই মাত্র শুনলাম আপনি কাল ফিরে যাচ্ছেন না। এটা কি সত্যি?’

‘হ্যাঁ। আমার ওয়াইফ ফিরে যাচ্ছেন, আমি তো যেতে পারছি না।’

‘যেতে পারছেন না কেন? সব ব্যবস্থা তো হয়ে গেছে।’

‘ভাই, স্পেশাল ব্রাঞ্চ আমাকে এখানে থাকার অনুমতি দিয়েছে। রোজ একবার করে ওদের অফিসে হাজিরা দিতে হবে। এই অবস্থায় যদি আমি গোপনে দেশে ফিরে যাই তাহলে বিপদে পড়বই।’ সিরাজ বলল।

‘আপনি না ফিরে গেলে তো আমি বিপদে পড়ব।’

‘কেন? আপনার বিপদ হবে কেন?’

‘কবীর ভাই আমাকে খতম করে দেবে।’ কাঁদো কাঁদো গলায় রামচন্দ্র বলল, ‘লোকটার ক্ষমতা আপনি জানেন না!’

‘এর মধ্যে ওই লোকটি কী করে আসছেন?’

‘স্যার, আপনি ফিরে যেতে চান, আপনার পাসপোর্ট নেই, তাই ভিসাও নেই। এই অবস্থায় আইনসম্মতভাবে আপনি পার হতে পারবেন না। একমাত্র কবীর ভাই সাহায্য করলে সেটা সম্ভব হবে।’

‘কিন্তু আমি তো বেআইনিভাবে ফিরে যাচ্ছি না।’

‘এখন সেটা সম্ভব নয় স্যার।’ দু—পাশে মাথা নাড়ল রামচন্দ্র।

‘কেন?’

‘সব ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার পর আপনি যদি না যান তাহলে কবীর ভাই ক্ষতিপূরণ চাইবে। টাকাটা ওকে দিতেই হবে।’

রেগে গেল সিরাজ, একি অন্যায় কথা কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। সে বলল, ‘আমি ওর কী ক্ষতি করেছি যে, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে?’

‘আপনার যাতে কোনো অসুবিধে না হয় তাই কবীর ভাই যাকে যা দেওয়ার তা অ্যাডভান্স পেমেন্ট করে দিয়েছেন। উনি কোনো কাজ পেন্ডিং রাখেন না।’ রামচন্দ্র হাতজোড় করল, ‘আপনি একটু ভাবুন। আপনি যদি টাকাটা না দেন তাহলে উনি আমার কাছ থেকে আদায় করবেন। আমি গরিব মানুষ, একেবারে মরে যাব স্যার।’

নার্গিস চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল। এবার বলল, ‘এত সব ঝামেলা যখন হচ্ছে, টাকা যখন দেওয়া হয়ে গেছে তখন তুমি ফিরেই চল।’

সঙ্গে সঙ্গে মাথা বাড়াল রামচন্দ্র, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। কথায় বলে, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন? টাকাটা যখন দিতে হবেই তখন চলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’

‘ভাই রামচন্দ্র, সেটা এখন আর সম্ভব নয়। আমার স্ত্রী কাল যাবে, আমি পরে আইনসম্মতভাবে যাব।’ ঠিক আছে? কথা শেষ করতে চাইল সিরাজ।

‘ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না স্যার। কবীর ভাই ওর যাওয়াতে সমস্যা তৈরি করতে পারেন। এমনিতে খারাপ নয় কিন্তু রেগে গেলে ওকে হিসেবে রাখা যায় না।’

‘আমার ওয়াইফের যাওয়াতে কী সমস্যা করবে সে? ওর বৈধ পাসপোর্ট আছে, ভিসার তারিখ এখনও শেষ হয়নি, বাংলাদেশের নাগরিক নিজের দেশে ফিরে যাবে, কে তাকে আটকাতে পারে?’ উত্তেজিত হল সিরাজ।

নার্গিসও রেগে গেল, ‘আমি তো সাহায্যের কথা বলিনি তাহলে সেই লোক আমাকে সমস্যায় ফেলবে কেন? আমার নাম জানবে কী করে?’

‘আপনারা যে স্বামী—স্ত্রী যাচ্ছেন এটা কবীর ভাই জানেন। কান টানলে তো মাথা আসবেই। তবে কবীর ভাইকে আমি একটা অনুরোধ করতে পারি।’ রামচন্দ্র যেন একটা পথ দেখতে পেল, ‘উনি যেমন যাচ্ছেন চলে যান। ওকে যেন কোনো সমস্যায় কবীর ভাই না ফেলেন। কিন্তু আপনি যাওয়ার সময় টাকাটা দিয়ে যাবেন। অবশ্য বুঝতেই পারছেন, সময়ে দিচ্ছেন না বলে একটু বেশি দিতে হবে।’

‘আশ্চর্য ব্যাপার। আমি বৈধ কাগজ নিয়ে যখন যাব তখন ফালতু টাকা দিতে যাব কেন? আর একটু বেশি দিতে হবে মানে?’

‘বেশি না। ধরুন দশ হাজার। কাল গেলে ছয় হাজারে হয়ে যেত।’

‘যদি টাকা না দিই?’

‘আটকে যাবেন। কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট আপনার ব্যাগে এমন জিনিস পেয়ে যাবে যা নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। তারপর কী হবে ভেবে দেখুন।’

‘তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?’

‘না স্যার, যা সত্যি তাই বলছি।’

সিরাজ একটু চিন্তা করল, ‘ঠিক আছে, তোমার কথা আমি মেনে নিলাম। তুমি কবীর ভাইকে জানিয়ে দাও যাতে আমার ওয়াইফকে একটুও বিরক্ত না করে।’

‘আমি বুঝিয়ে বলছি স্যার। আচ্ছা আসছি। ওহো, ডিনার করবেন না?’ মাথা নেড়ে নিঃশব্দে সিরাজ না বলতেই রামচন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

টিভি খুলল সিরাজ। খবর শুনছে। প্রায় প্রতিটি খবর খুন, জখম এবং ধর্ষণের। পৃথিবীর সব দেশের কিছু মানুষ এখন উন্মত্ত হয়ে গেছে। মেয়ের সম্মান রক্ষা করার জন্য বাবা প্রতিবাদ করায় তাকে সমাজবিরোধীরা খুন করেছে, এরকম দুটো খবর শোনার পর টিভি বন্ধ করে দিল সে।

নার্গিস ততক্ষণে সুটকেস গুছিয়ে ফেলেছে। তারপর নিজের মনে বলল, ‘আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বুকের উপর কিছু চাপ হয়ে বসে আছে।’

‘ওষুধগুলো নিয়েছ?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ’ না তাকিয়ে জবাব দিল নার্গিস।

‘আজ সারাদিন যা গেল, নিশ্চয়ই ওষুধ খেতে ভুলে গেছ?’

‘তোমার যদি তাই মনে হয় তবে তাই!’

‘তুমি বড্ড বেশি অভিমান করছ সোনু।’

বহুকাল বাদে স্বামীর মুখে সোনু শব্দটি শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না নার্গিস। বিছানার উপর বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। ওর ভেঙে পড়া বেচারা এখন এতটাই করুণ যে সিরাজ দ্রুত পাশে এসে বলল, ‘প্লিজ কেঁদো না।’ সঙ্গে সঙ্গে দু—হাতে সিরাজকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখল নার্গিস। তার গলায় কান্না জড়ানো শব্দ তৈরি হল, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি থাকব কী করে?’

‘কটা দিন তো! এই তো গত বছর ব্যবসার কাজে তাইওয়ান গিয়েছিলাম, তখন তো এমন করনি! তুমি শক্ত হও, আমি খুব শিগগির চলে আসব।’ নার্গিসের মুখ দু—হাতে ধরে উপরের দিকে তুলল সিরাজ। জল উপচে পড়ছে দু—চোখ থেকে। পরম যত্নে নিজের ঠোঁট দিয়ে সেই জল মুছিয়ে দিতে চাইল সিরাজ। চোখে ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই মুখ তুলে সিরাজের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল নার্গিস। আর সেই মুহূর্তে পৃথিবীটাকে ভুলে গেল ওরা। এ শুধু শরীরের সঙ্গে শরীরের মিলন নয়, এ যেন দুটো মনের জড়িয়ে মিশিয়ে একাকার হয়ে যাওয়া। তারপর দু—জন দু—জনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা। নীরবে।

সকাল ছ—টা দশে নার্গিসের সুটকেস বয়ে নিয়ে হোটেল থেকে কয়েক পা হেঁটে বাস টার্মিনালে চলে এল সিরাজ। পিছনে সালোয়ার কামিজ এবং ওড়নায় জড়ানো নার্গিস।

বেশিরভাগ যাত্রী ততক্ষণে এসে গেছে। সুটকেস জমা দিয়ে নার্গিসকে নিয়ে বাসে উঠে জানলার পাশের আসনে বসিয়ে দিতেই নীচ থেকে গলা ভেসে এল, ‘প্যাসেঞ্জার ছাড়া কেউ বাসে উঠবেন না।’

সিরাজ বলল, ‘সাবধানে যেও, চিন্তা করো না।’

শোনামাত্র নার্গিস মাথার ওড়নার প্রান্ত মুখের উপর টেনে নিল।

নীচে নেমে এল সিরাজ। একটু পরে বাস ভরতি হয়ে গেলে সে দেখল নার্গিসের পাশের আসনে একটি বাচ্চচা মেয়ে বসেছে। ওড়নার ফাঁক দিয়ে নার্গিস তাকে দেখল। দেখেই এর মধ্যে হাতে ধরে রাখা রঙিন চশমা চোখে পরে নিল।

বাস ছেড়ে দিল সীমান্তের উদ্দেশে।

ভোরের কলকাতা কখন পিছনে চলে গেছে তা নার্গিস জানে না। সে বাসের জানলায় মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। অদ্ভুত সব ভাবনা ভেবে যাচ্ছিল সে। আজ রাতে ঢাকায় ফিরে গিয়ে আগামীকাল যদি সেই ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে দেখা করে বলে, তার ইন্ডিয়ায় ফিরে যাওয়া খুব জরুরি, তিনি যেন মাসখানেকের জন্য ভিসার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। প্রথমত, সে আবার কলকাতায় এসে সিরাজের সঙ্গে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, সে এলে টাকার ব্যবস্থা করেই আসবে।

কিন্তু একবার ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কি ইন্ডিয়া হাইকমিশন আবার ভিসা ইস্যু করবে? এ ব্যাপারে কী নিয়ম আছে তা নার্গিসের জানা নেই। যদি নিয়ম না থাকে তাহলে কি ট্রাভেল এজেন্ট কোনো পথ বের করতে পারবে না? এই যে তারা ইন্ডিয়াতে আসবে বলে অনেক চেষ্টা করেও নেটে লিঙ্ক পায়নি, জানাশোনা কেউই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইন্ডিয়া হাইকমিশনের নেটের কাছে পৌঁছোতে পারে না, অথচ বিশেষ বিশেষ ট্রাভেল এজেন্টকে টাকা দিলেই তারা ঝটপট যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এটা যদি সম্ভব হয় তাহলে ইন্ডিয়া ঘুরে ফিরে যাওয়ার দু—দিনের মধ্যে ভিসা পাওয়ার ব্যবস্থা ট্রাভেল এজেন্ট নিশ্চয়ই করে দিতে পারবে।

একটু হালকা লাগল এই ভাবনা ভাবার পর। জোরে শ্বাস ফেলল নার্গিস। আর তারপরেই মনে পড়ল মতিন ভাইয়ের কথা। মতিন ভাই একজন প্রবীণ সাংবাদিক। সবসময় ওর মনে হাসি লেগে আছে। ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে। তারপর থেকে সিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ থেকে গেছে। মতিন ভাই তাকে বোনের মতো স্নেহ করেন। মন্ত্রীমহলে মতিন ভাইয়ের বেশ খাতির আছে। সংসদ ভবনে সহজেই যাতায়াত করেন তিনি। সিরাজের সমস্যার কথা মতিন ভাইকে বললে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে এখনই ব্যবস্থা নিতে পারেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি পাসপোর্ট ছাড়াই সিরাজকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেন তাহলে সেই অনুরোধ নিশ্চয়ই উপেক্ষিত হবে না। এখন খুব আপশোস হচ্ছিল। মতিন ভাইয়ের নামটা কেন কলকাতায় থাকার সময় মনে এল না। তাহলে কলকাতা থেকেই তাকে ফোন করে সব কথা বলে সাহায্য চাওয়া যেত।

তৃতীয় যে ভাবনাটা মনে এল সেটা কেন এত দেরিতে এল? ওরা তো স্বচ্ছন্দে পুলিশকে বলতে পারত, সিরাজের যে ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে সেই ব্যাগের মধ্যে তার পাসপোর্টের সঙ্গে ওরও পাসপোর্ট ছিল। নার্গিস যদি তার পাসপোর্ট ছিনতাই হয়ে গেছে বলে একটু অভিনয় করত তাহলে আজ কী হত? এসবি অফিসার তাকেও কলকাতায় থাকার অনুমতি দিতেন যা তিনি সিরাজকে দিয়েছেন। তাহলে সিরাজকে ছেড়ে আজ তাকে চলে আসতে হত না। নিজের পাসপোর্ট টয়লেটে গিয়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ টেনে দিলে এই জীবনে সেটাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। তাহলে সে দিব্যি সিরাজের সঙ্গে কলকাতাতেই থাকতে পারত! কেন যে বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি। কিন্তু সিরাজ রাজি হত না, এ ব্যাপারে নার্গিসের কোনো সন্দেহ নেই। অসৎ কাজ করার ব্যাপারে লোকটার খুব আপত্তি। তাই ওর কাছেও তাকে মিথ্যে বলতে হত। হোটেল থেকে বের হওয়ার আগে নিরাপদে থাকবে বলে সে নিজের পাসপোর্ট সিরাজের ব্যাগে রেখেছিল। এই কথা সিরাজ অবিশ্বাস করত না, ব্যস, তাহলেই কলকাতায় থাকার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। পরে, হোটেলে ফিরে সিরাজকে লুকিয়ে নিজের পাসপোর্ট নষ্ট করে দিলেই হত।

‘আন্টি!’

পাশ থেকে গলা ভেসে আসতেই চোখ খুলল নার্গিস, বাস দাঁড়িয়ে আছে একটা হাইওয়ের পাশে। যাত্রীদের বাস থেকে নেমে যাওয়া শুরু হয়েছে। একটি বছর দশেকের মেয়ে যে তার পাশে বসেছিল সেই তাকে আন্টি বলে ডেকেছিল। নার্গিস তাকাতেই মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ব্রেকফাস্ট করবেন না?’

‘ব্রেকফাস্ট?’ শব্দটা চট করে মাথায় নিল না।

‘হ্যাঁ, সবাই নেমে যাচ্ছে ব্রেকফাস্ট করতে।’ বলে উঠে পড়ল মেয়েটি। দরজার সামনে একজন মহিলা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়েছিলেন। মেয়েটি এগিয়ে যেতে তিনি নীচে নামলেন।

নার্গিস জানলা দিয়ে দেখতে পেল একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়েছে বাস। সেখানে যাত্রীদের প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে। সকালে হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় সিরাজ জোর করে তাকে চা আর বিস্কুট খাইয়ে দিয়েছিল। এখন মনে হল খেতেই ইচ্ছে করছে না। সে চুপচাপ বসে রইল।

মিনিট পনেরো পরে সে আবার আন্টি ডাকটা শুনতে পেল। চোখ খুলে নীচে তাকাতেই পাশে বসা মেয়েটিকে দেখতে পেল। মেয়েটি বলল, ‘এখানকার টয়লেটটা বেশ ভালো, আপনার দরকার হলে যেতে পারেন।’

এবার হেসে ফেলল নার্গিস। মেয়েটা তো বেশ ভালো। ব্রেকফাস্ট খেতে যাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো উৎসাহ হয়নি কিন্তু এখন মনে হল ওঠা উচিত। ঢাকা থেকে আসার সময় দু—বার ভয়ংকর টয়লেটের অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল। এখানকার টয়লেট বেশ ভালো হলে সেটা ব্যবহার করাই উচিত।

নার্গিস নীচে নামতেই মেয়েটি হাত তুলে দেখিয়ে দিল কোন দিক দিয়ে টয়লেটে যেতে হবে। গিয়ে দেখল মেয়েটি ঠিক কথাই বলেছে। ফিরে এসে সে মেয়েটিকে মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’

‘এম্মা, এটুকু বলেছি বলে ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন?’ মেয়েটি বলল।

মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ব্রেকফাস্ট খেলেন না।’

‘না খিদে নেই।’

‘আপনিকি ঢাকায় থাকেন?’ মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ, তোমরা?’

‘আমরা ব্যারাকপুরে থাকি। বাংলাদেশে বেড়াতে যাচ্ছি।’ মেয়েটি হাসল, মহিলা বললেন, ‘ওর বাবা এখন অন ডেপুটেশন ঢাকায় চাকরি করছেন। এই সুযোগে বেড়াতে যাচ্ছি আমরা। উনি ঢাকার বাস টার্মিনালে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। ঢাকা থেকে আমরা চট্টগ্রামেও যাব।’

‘সাবধান থাকবেন।’ নার্গিস বলল।

মহিলার মুখে ছায়া জমল, ‘কেন? ভয়ের কিছু আছে?’

দ্রুত মাথা নাড়ল নার্গিস, ‘না না। শুধু প্রত্যেকে নিজের পাসপোর্ট সাবধানে রাখবেন। ওটা হারিয়ে গেলে ভয়ংকর বিপদ হবে।’

‘হারাবে কেন?’ মহিলা যেন একটু স্বস্তি পেলেন।

‘ধরুন, আপনি কোনো ভিড়ের রাস্তায় হাঁটছেন, আপনি আপনার পাসপোর্ট ব্যাগে রেখেছেন। হঠাৎ দেখলেন ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেল। ছিনতাইকারীকে কিছুতেই ধরা গেল না। এ কথা ভেবেই বললাম। পাসপোর্ট না থাকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপনি দেশে ফিরতে পারবেন না সহজে।’ নার্গিস বলল।

‘সে কি! মহিলা আতঙ্কিত হলেন, ‘অনেক উপকার করলেন ভাই। আমি এই ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকব। প্রথমবার বিদেশ যাচ্ছি তো!’

বিদেশ শব্দটি কানে যেতে হেসে ফেলল নার্গিস।

‘হাসলেন কেন?’ মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হাসলাম আপনি বিদেশ বললেন বলে। হ্যাঁ, আইন অনুযায়ী দুটো দেশ আলাদা, স্বাধীন। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে হলে পাসপোর্ট ভিসার দরকার হয়। অথচ আপনি যখন সীমান্ত পার হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবেন তখন বুঝতেই পারবেন না অন্য দেশে গেছেন। এক ভাষা, এক গান, এক গল্পকবিতা, দুই দেশের সংস্কৃতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাহলে বিদেশ হল কী করে? কিন্তু আইন যখন বলছে বিদেশ তখন না মেনে উপায় নেই। তাই হাসি এল, এল নিজের অজান্তেই।’ নার্গিস বলল।

সীমান্তের এপাশে এসে বাস থামল। যাত্রীদের জিনিসপত্র বের করে দেওয়া হল। প্রথমে ভারতীয় হাইকমিশনে, ভারতীয় কাস্টমসে হাজিরা দিয়ে একটু হেঁটে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে লাইন দিতে হবে। সুটকেস বেশ ভারী কিন্তু তুলতে পারল নার্গিস। ঠিক সেই সময় একটি কিশোর এসে দাঁড়াল সামনে, ‘দ্যান, আমাকে দ্যান।’

‘কেন?’

‘আমি আপনাকে হেল্প করলে অসুবিধা নাই তো?’

‘তুমি কি কুলি? কত নেবে?’

‘যা দেবেন।’ কিশোর সুটকেস তুলে নিল। ‘ম্যাডাম, আপনি তো ঢাকায় যাবেন স্যার আসেন নাই?’

‘না।’

‘ম্যাডাম, আপনার নাম কি নার্গিস আপা?’

‘হ্যাঁ।’

‘আসেন।’ কিশোর একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সুটকেস হাতে নিয়ে। ততক্ষণে নার্গিসের মনে খটকা লেগে গেছে। ওর নাম তো এর জানার কথা নয়। জানল কী করে? চারপাশে তাকাল। বাসের যাত্রীরা লাইন দিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। হঠাৎ একটি রোগা মানুষ সামনে এসে দাঁড়াল। ‘নমস্কার ভাবি। রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

উত্তর না দিয়ে সন্দেহের চোখে তাকাল নার্গিস।

‘আপনি আমাকে চিনবেন না। চিনবেনই বা কী করে? কখনও তো দেখা হয়নি। কিন্তু কলকাতায় রামচন্দ্রের মুখে আমার নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন।’ লোকটা হাসল।

‘কবীর ভাই।’ মুখে থেকে অসাড়ে শব্দটা বেরিয়ে এল নার্গিসের।

‘হ্যাঁ, ভাবি। ঠিক নাম বলেছেন, আমি রামচন্দ্রকে খুব শাসন করেছি। সিরাজ ভাই যখন বলেছেন যাওয়ার সময় জরিমানা সমেত টাকা দিয়ে যাবেন, তখন আপনাকে ভয় দেখানোর কী দরকার ছিল! যাক গে, এই বর্ডারে আমি থাকতে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। নতুন শাড়ি এক ডজন নিয়েছেন?’ কবীর ভাই হাসল।

‘না—না।’

‘নিলে পারতেন। কোনো দেশের কাস্টমস অফিসার সুটকেস খুলে দেখবে না যদি আমার কথা শোনে। এই বাদল, ভাবিকে নিয়ে যা। আমার বলা আছে তবু তুই স্যারকে মনে করিয়ে দিবি। তারপর ভিতরের বাসে ওঠার আগে ‘আহার’ হোটেলে নিয়ে যাবি।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে কবীর ভাই বলল, ‘ভাবি, আপনি আজ আমার অতিথি। সব কাজ শেষ হওয়ার পরে বাসে ওঠার আগে একটু ডাল—ভাত—মাংস খেয়ে নিলে আমি খুব খুশি হব। আহারের রান্না খুব ভালো হয়। যান, যান।’

নার্গিস অবাক হয়ে দেখল স্বাভাবিক দু—তিনটি প্রশ্ন ছাড়া তাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করা হল না। সুটকেস খোলা দূরের কথা হাত দিয়ে দেখলও না। দু—দেশের স্ট্যাম্প পাসপোর্ট নেওয়ার পরে খেয়াল হল। বাদল নামের কিশোর এখন দায়িত্ব দিয়ে গেছে করিম নামের একটি কিশোরকে। সেই সুটকেস তুলে দিয়েছিল রিকশায়। দিয়ে বলেছিল আহারের সামনে গিয়ে থামতে। সেখানে পৌঁছোনোর কয়েক মিনিট পরেই করিম এসে হাজির হল, ‘আসেন আপা।’

‘কোথায়?’

‘রেস্টুরেন্টে। খাবেন তো। কবীর ভাই অর্ডার দিছে।’

‘না, আমার খিদে নেই। ওখানে ঢাকার বাস দাঁড়িয়ে আছে, না?’

‘হ্যাঁ আপা। কিন্তু আপনি না খেয়ে গেলে কবীর ভাই খুব দুঃখ পাবেন। যশোরের কইতেল খুব ভালো রান্না করে এরা।’ করিম বলল।

কথা না বাড়িয়ে নিজেই সুটকেসকে টেনে বাসের পাশে চলে এল নার্গিস। এসে দেখল অন্য যাত্রীরা তখনও পৌঁছোয়নি। বাস ভরতি হওয়ার পরে নার্গিসের মনে হল তার চেয়ে এই বাচ্চচা মেয়েটি যদি জানলার পাশে বসে তাহলে ও চোখ ভরে বাংলাদেশকে দেখতে পাবে। নার্গিস মেয়েটিকে বলল, ‘তুমি আমার জায়গায় এসে বসো।’

চকচক করে উঠল মেয়েটির চোখ, ‘আপনার অসুবিধে হবে না তো?’

‘একটু না।’ মাথা নেড়ে জায়গা বদল করল নার্গিস।

বাস চলতে শুরু করেছিল। মেয়েটি জানলার বাইরে তাকাল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস, তাই জানলা খোলা না হলেও দেখা যাচ্ছিল বাইরের পৃথিবী।

দুপুরের খাবার রাঁধুনি রেস্টুরেন্টে খাচ্ছিল সিরাজ। এই রেস্টুরেন্টের রান্নার ধরন অবিকল ঢাকার রান্নার মতো। সিরাজ ওয়েটারকে ডেকে বলল, ‘ভাই, এক প্লেট শিম ভর্তা দেবেন?’

‘সরি স্যার। শিম ভর্তা শেষ হয়ে গিয়েছে।’ ওয়েটার বলল। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে এক ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমি বেগুন ভর্তা বললাম, তুমি বললে আজ হয় নাই। উনি শিম ভর্তা বললেন, তুমি শেষ হয়ে গিয়েছে বলছ। তাহলে এই কথাগুলো তোমাদের মেনুকার্ডে রেখেছ কেন? যত্তসব।’

ভদ্রলোকের উলটো দিকে বসে যিনি খাচ্ছিলেন তিনি চাপা গলায় বললেন, ‘তুমি চুপ করবে? না হলে আমি উঠে যাব।’

যিনি উত্তেজিত হয়েছিলেন তিনি কাঁধ সরিয়ে থেমে গেলেন। সিরাজ এবার ওদের দিকে তাকাল। অবশ্যই বাংলাদেশ থেকে ওঁরা এসেছেন কিন্তু তার চেনার কথা নয় যদিও ভদ্রলোককে যিনি শাসন করলেন তাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। মহিলা যথেষ্ট সুন্দরী, তিরিশের আশপাশে বয়স। সে দেখল ভদ্রমহিলা একটু ঝুঁকে ভদ্রলোককে কিছু বললেন। ভদ্রলোক তার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। হাসলেন তিনি, তারপর ওয়েটারকে ইশারায় কাছ থেকে একটা প্লেট এগিয়ে দিলেন। ওয়েটার সঙ্গে সঙ্গে চলে এল সিরাজের কাছে, ‘শিম ভর্তার শেষ প্লেটটা ওই স্যারদের দিয়েছিলাম। উনি বললেন, যদি আপনি খান তাহলে অর্ধেক নিতে পারেন।’

হেসে ফেলল সিরাজ। এরকম প্রস্তাব সে কখনও পায়নি। বাঁ হাতটা উপরে তুলে সে ভদ্রলোককে নিষেধ করল। এবার ভদ্রমহিলা ঘুরে বসলেন, ‘এতটা আমাদের বেশি হয়ে যাবে। আপনি সংকোচ না করলে আমাদের ভালো লাগবে।’

‘আপনি এ কথা বললেন এটাই যথেষ্ট। অনেক ধন্যবাদ।’ সিরাজ বলল। খাওয়া শেষ করে দাম মিটিয়ে যখন সে বের হচ্ছে তখন ওরাও বের হচ্ছিল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন? নিশ্চয়ই ফরিদপুর?’

‘না। একদম খাস ঢাকা থেকে।’ সিরাজ বলল।

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘দেখলে’ তোমাকে কতবার বলেছি আন্দাজ করবে না। ওটা কিছুতেই মেলাতে পার না তুমি।’

এক একজনের ভাগ্য এরকম হয়ে থাকে।’ ভদ্রলোক বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনার নামটা?’

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘জেনে তুমি কী করবে?’

‘তাহলে তো মানুষের সঙ্গে কথা বলাই যায় না।’

‘তার আগে তোমার তো জানা উচিত উনি কথা বলতে চান কিনা।’

এদের কথা শুনে হেসে ফেলল সিরাজ, ‘এভাবে বলবেন না ম্যাডাম।’

‘আমি তামান্না—!’ ভদ্রমহিলা হাসলেন। ‘আর ইনি হলেন আমার বড় ভাই, মইনুল রহমান। আমরা কাল ইন্ডিয়াতে এসেছি। থাকি গুলশান।’

‘আচ্ছা! আমি সিরাজ। আমার ফ্ল্যাট গুলশান থেকে বেশি দূরে নয়। আগে থাকতাম সার্কুলার রোডে, এখন বনানীতে।’

মইনুল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি উঠেছেন কোথায়?’

‘এই কাছেই।’ হোটেলের নাম বলল সিরাজ।

তামান্না বললেন, ‘খুব ভালো লাগল আলাপ করে। আপনি নিশ্চয়ই দলবলের সঙ্গে আছেন?’

‘না না। একদম একাই আছি।’ সিরাজের কথাটা বলতেই একটা চিনচিনে অনুভূতি হল বুকের ভিতরে। নার্গিস না চলে গেলে এ কথা বলতে হত না। মইনুল জিজ্ঞাসা করল, কী কাজে এসেছেন এখানে?

বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। নার্গিসকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনেই তাকে ইন্ডিয়ায় আসতে হয়েছে বললে হয়তো অনেক প্রশ্ন শুনতে হবে।

সে বলল, ‘ব্যবসা সংক্রান্ত কথা বলতে এসেছিলাম।’

‘কী ব্যবসা আপনার। মইনুল যেন নাছোড়বান্দা।’

‘গার্মেন্টের’।

‘ফ্যাক্টরি আছে?’

মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল সিরাজ। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কোথায় উঠেছেন?’

‘বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটা গেস্টহাউসে। প্রতিবার এখানেই উঠি।’

‘তার মানে মাঝে মাঝেই আসেন?’

‘হ্যাঁ।’ তামান্না বললেন, ‘আমরা টিভির টেলিফিলম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।’

এবার পরিষ্কার হল সিরাজের কাছে, ‘ও, তাই বলুন।’

‘মানে?’ তামান্নার চোখ ছোট হল।

‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল কোথায় যেন দেখেছি। আপনি একসময় বাংলাদেশের টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন, তাই না?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘করেছেন কী বলছেন? ভালো চরিত্র হলে ও এখনও অভিনয় করে।’

‘আপনি বোধহয় নিয়মিত টিভি দেখেন না!’

‘তা ঠিক। কিন্তু এখানে কীভাবে টেলিফিলমের ব্যবসা হয়?’

‘একদিনে সবকিছু জেনে ফেলা ঠিক নয়’। মইনুল হাসলেন, ‘আজ বিকেলে, যাক সন্ধের পর কী করছেন?’

‘তেমন কিছু না।’

পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে মইনুল সিরাজের হাতে দিল, ‘এটা যে গেস্টহাউসে আছি তাদের কার্ড। কোয়ালিটি নামে একটা রেস্টুরেন্টের পাশের গলি। সন্ধে সাড়ে ছয়টায় চলে আসুন। গল্প করা যাবে।’

‘দেখি।’ ঘড়িটা দেখতে দেখতে বলল সিরাজ।

‘দেখি নয়’ তামান্না হাসলেন, ‘আমি কিন্তু খুব এক্সপেক্ট করব।’

‘তাহলে চলি। আপনি কোথায় যাবেন? মইনুল জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমি? ও, লর্ড সিনহা রোডে।’

লর্ড সিনহা রোডের এসবি অফিসে গিয়ে প্রথমে তল পাচ্ছিল না সিরাজ। গতকালের সেই অফিসারটি এখন অফিসে নেই। অন্য যাঁরা আছেন তাঁরা যেহেতু তার কেস জানেন না তাই পাত্তা দিচ্ছিলেন না। শেষপর্যন্ত মরিয়া হল সিরাজ। একজন অফিসারকে দেখে মনে হল ইনি বেশ উঁচু পদের। তাঁকে সে বলল, ‘স্যার, আমি একজন বাংলাদেশের নাগরিক। এখানে পাসপোর্ট ছিনতাই হয়ে যাওয়ায় যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার তা নিয়েছিলাম। এখানকার একজন অফিসার সে সব জানেন। তিনি হুকুম দিয়েছিলেন, রোজ একবার এসে দেখা করে যেতে। কিন্তু তিনি আজ অফিসে না থাকায় কার কাছে হাজিরা দেব বুঝতে পারছি না।’

‘থাকার পারমিট পেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘নামটা বলুন।’

‘সিরাজ।’

‘ঠিক আছে। কাল আসবেন। আচ্ছা, আপনি কি সরকারের কাছে দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে কোনো আবেদন করেছেন?’

‘না। সেরকম আবেদন করা হয়নি।’

‘কাল যখন আসবেন একটা আবেদনপত্র নিয়ে আসবেন।’ অফিসার তাঁর ঘরের দিকে চলে গেলেন।

এসবি অফিস থেকে বেরিয়ে সিরাজের মনে হল খুব শিগগির সে দেশে ফিরে যেতেও পারে। অফিসারের কথা শুনে তার সেরকমই মনে হচ্ছিল। এই সময় যদি নার্গিস সঙ্গে থাকত তাহলে কী খুশি হত! নার্গিস এখন কোথায়? লঞ্চে চেপে সেকি পদ্মা পেরিয়ে গিয়েছে?

এটা সিনেমা হলে ঢুকে ম্যাটিনি শো দেখে সিরাজ। ছবি শেষ হলে হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল মইনুল এবং তামান্না তাকে সন্ধ্যাবেলায় যেতে বলেছিল। কোথায় বালিগঞ্জ ফাঁড়ি সে জানে না। সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে কী কথা বলবে সে? তার চেয়ে হোটেলের পাড়ায় ফিরে অপেক্ষাকৃত কম দামের হোটেল খুঁজে সন্ধেটা কাটিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তার পরেই মনে হল যদি দু—তিন দিনের মধ্যে যাওয়ার সরকারি অনুমতি পাওয়া যায় তাহলে হোটেল পালটে কী লাভ। যাওয়ার আগে নার্গিস যে হোটেলে সে আছে তার ফোন নম্বর, ই—মেল নম্বর নিয়ে গিয়েছে। নার্গিস নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে। হোটেল বদলালে সেটা সম্ভব হবে না। অবশ্য সিরাজ কাল সকালে কার্ড দিয়ে নার্গিসকে টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করার কথা ভেবেই রেখেছে। তাহলে সন্ধেটা ওদের সঙ্গে কথা বলে কাটানো খারাপ নয়।

কলকাতায় সব ট্যাক্সিচালক যে বদ নয়, তা বুঝতে পারল সিরাজ। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টের পাশের গলিতে সিরাজকে নামিয়ে দিল ঠিক ভাড়া নিয়ে। কয়েক পা হাঁটতেই গেস্ট হাউসের বোর্ড চোখে পড়ল। এখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে।। গেটের উপর আলো জ্বলছে। দারোয়ান গোছের যে লোকটা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তাকে মইনুলের নাম বললে প্রথমে চিনতে পারল না।

সিরাজ বোঝাতে চেষ্টা করল, ‘ওঁরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। যখনই আসেন এই গেস্টহাউসে ওঠেন।’

‘মেমসাহেবের সঙ্গে এসেছেন?’ লোকটা প্রশ্ন করল।

‘মেমসাহেবের সঙ্গে? হ্যাঁ হ্যাঁ।’

‘আসুন।’

ভিতরে আর একটি বেয়ারা দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দায়িত্ব দিয়ে লোকটা ফিরে গেল। দোতলায় উঠে বেয়ারা বলল, ‘এখানে দাঁড়ান। আপনার নামটা বলুন। কার সঙ্গে দেখা করবেন?’

‘আমার নাম সিরাজ। ওঁরা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন আসার জন্য। এই কার্ডটা ওঁরাই দিয়েছিলেন। নিয়ে গিয়ে দেখান।’ সিরাজ বলল।

‘বেয়ারা তাকে দাঁড় করিয়ে প্রথম ঘরটির বেল বাজাল। তারপর দ্বিতীয় ঘরের বেলের বোতাম চাপল। কয়েক সেকেন্ড পরে দুটো দরজা প্রায় একসঙ্গে খুলে গেল। দুই দরজায় দু—জন দাঁড়িয়ে। তাকে দেখতে পেয়ে প্রথমে তামান্না হেসে বলল, ‘আরে! আপনি? আসুন, আসুন, কী সৌভাগ্য।’

মইনুল বললেন, ‘আসুন, আমার ঘরে বসি?’ প্রশ্নটা তামান্নাকে।

‘না না। এই ঘরেই বসি। এখানে একটা ব্যালকনি আছে।’ তামান্না বললেন।

তামান্নার ঘরে ঢুকে মইনুল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চা না কফি?’

সিরাজ মাথা নাড়ল, ‘আমি চা খেয়ে ট্যাক্সিতে উঠেছি। তাছাড়া আমি চায়ের খুব ভক্ত নই।’

মইনুল বললেন, ‘সেই জন্য আপনার গায়ের রং ফরসা।’

তামান্না ধমক দিলেন, ‘যত্তসব বাজে কথা। বসুন।’

সোফায় বসার পরে তামান্না জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সারাদিন কাজ করতে হল?’

‘না, কাজ যা ছিল তা হয়ে গেছে।’ সিরাজ বলল।

‘তার মানে এখন ছুটির মেজাজ। আপনি কখনও দার্জিলিং গিয়েছেন?’

‘না।’

‘আমি একবারই গিয়েছিলাম। খুব ইচ্ছে ছিল এবার ঘুরে আসার। কিন্তু কলকাতার লোকেরা তো তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতেই পারে না তাই আটকে আছি।’ তামান্নার যেন মনে পড়ল, ‘এক্স চ্যানেল থেকে ফোন করেছিল?’

মইনুল মাথা নাড়লেন, ‘না তো।’

‘আমাদের তো উচিত ছিল তাগাদা দেওয়ার।’ তামান্না গম্ভীর।

‘আমি এখনই উঠছি।’ পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন করলেন মইনুল। তারপর কথা বলতে বলতে ব্যালকনিতে চলে গেলেন। কথা শেষ করে ফিরে এসে বললেন, ‘সমস্যা হয়ে গিয়েছে।’

‘কী সমস্যা?’

‘এখনই ওদের অফিসে যেতে বলছেন।’

‘কেন?’ তামান্নার কপালে ভাঁজ।

‘উনি কাল সকালে ফ্লাইটে মুম্বই চলে যাবেন। আমাদের কাগজপত্র তৈরি হয়ে আছে। গিয়ে নিয়ে আসতে বললেন।’ মইনুল বললেন।

‘চেক?’

‘হ্যাঁ, চেকও।’

খুশির চিৎকার ছিটকে বের হল তামান্নার গলা থেকে। সেই খুশি নিয়ে তিনি বললেন, ‘আর দেরি নয়, যাও, নিয়ে এসো।’

‘আমি একা যাব?’

‘এটা তো একটা বেয়ারার কাজ, তাও পারবে না!’

‘লোকটা—, তিনজনেই যাই। ওখান থেকে কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে।’

‘আমার আর বেরুতে ইচ্ছে করছে না। ট্যাক্সি নিয়ে যাবে আসবে। বেশি সময় লাগবে না। এত অলস কেন?’ তামান্না মুখ ফেরাল।

‘ঠিক আছে। সিরাজ ভাই, বুঝতেই পারছেন, না গেলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি যাব আর আসব। আপনি ততক্ষণ গল্প করুন।’ মইনুল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সিরাজ কথা বলল, ‘ভালো খবর শুনতে ভালো লাগে।’

‘ক—দিন ধরে খুব ঘোরাচ্ছিল লোকটা। সুন্দরী মহিলা দেখলেই কিছু লোকের চোঁক চোঁক করার স্বভাব থাকে। এই লোকটারও তাই আছে। এত সহজে কাজটা হয়ে যাবে তা আশা করিনি। আপনি আমার গুডলাক নিয়ে এলেন।’ হাত বাড়ান তামান্না। কাঁপা হাতে তামান্নার হাত স্পর্শ করেই ছেড়ে দিল সিরাজ। তারপর বলল, ‘দুপুরে বলছিলেন, টেলিফিলমের ব্যবসা, এটাই সেটা?’

হ্যাঁ। আমরা ঢাকায় টেলিফিলম বানাই। ভূতের গল্প, রহস্য গল্পের খুব চাহিদা আছে ইন্ডিয়াতে। পঁচিশ মিনিট থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের টেলিফিলম। তাতে না হয় পশ্চিমবাংলার অ্যাক্টর বা অ্যাক্টেÉসকে রাখি যাতে এখানকার পাবলিক চেনে। সেই টেলিফিলম এরা কিনে নেয়। এরা মানে এখানকার চ্যানেল। আমরা ইন্ডিয়ান রাইট বিক্রি করি। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াতে যেসব পে—চ্যানেলে বাংলা প্রোগ্রাম দেখানো হয়, সেখানেও বিক্রি করি।’ তামান্না হাসলেন।

‘বাংলাদেশে দেখান না?’

‘এখনও দেখাইনি। দেখালে আইনে আটকাবে না কিন্তু এখানকার বাজার নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’

‘ইন্ডিয়ান অভিনেতা—অভিনেত্রীরা ঢাকায় যান?’

‘উত্তরটা আমি দেব না। এটা সিক্রেট।’ হাসলেন তামান্না।

সিরাজ লক্ষ করছিল খবরটা আসার পর থেকে তামান্না খুব ভালো মেজাজে আছেন।

সে বলল, ‘আপনাদের এখানে কি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে?’

‘আমার এক দুলাভাইয়ের আছে। তিনি ইন্ডিয়ান সিটিজেন। ওঁকে আমাদের বিজনেসের পার্টনার করে নিয়েছি।’ উঠে দাঁড়ালেন তামান্না, ‘লেটস সেলিব্রেট। চলুন একটু হেঁটে আসি।’

‘হাঁটবেন?’ হকচকিয়ে গেল সিরাজ, ‘এই সময়? বেশ চলুন।’

তামান্না তৈরি হয়ে দরজার দিকে এগোল। তারপর কী ভেবে দাঁড়িয়ে গেল, ‘না, থাক। কোথায় আর হাঁটব। রাস্তায় যা ভিড়। ট্যাক্সি নিয়ে লেকের ধারে গেলে ভালো হাঁটা যেত। তার চেয়ে চলুন, গল্প করি।’ আবার ফিরে এল তামান্না। সোফায় বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘দুপুরে বললেন, আমাকে চেনা চেনা লাগছে। আমার কোনো নাটক দেখেছেন?’

মাথা নাড়ল সিরাজ, ‘আমার নাম মনে থাকে না। তবে আপনি খুব আধুনিক মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।’

‘ও, পেয়িং গেস্ট। পরিচালক ছোট প্যান্ট পরাতে চেয়েছিলেন, চ্যানেল আপত্তি করেছিল। তা সেই চরিত্রে নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল আমাকে, নইলে এতদিন মনে রেখেছেন কেন, তাই না?’ প্রশ্নটা করেই তামান্না মুখে একটু দুষ্টু ভাব ফুটিয়ে তুলল।

‘তা ঠিকই। নইলে মনে থাকত না।’ ঘড়ি দেখল সিরাজ।

‘ওমা, আপনি ঘড়ি দেখছেন কেন?’

‘অনেকটা সময় বিরক্ত করলাম তো?’

‘দূর! আপনি না এলে পাথরের মতো মুখ করে টিভি দেখতাম। আপনি এলেন বলে ভালো খবরটা চলে এল। লেটস সেলিব্রেট!’ হাসল তামান্না।

‘বেশ তো!’

তামান্না এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করে বলল, ‘রুম নম্বর টুয়েলভ থেকে বলছি। একটা চিকেন কাবাব আর বিলি ফিশ পাঠিয়ে দেবেন ভাই? হ্যাঁ, হ্যাঁ। একটু তাড়াতাড়ি। আপনারা সার্ভ করতে বেশ দেরি করেন।’ রিসিভার নামিয়ে তামান্না বললেন, ‘এই দুটো এরা খুব ভালো করে।’ বলে চলে গেলেন ঘরের অন্য প্রান্তে। ঘড়ি দেখল সে। নার্গিসের বাস কি ঢাকায় পৌঁছে গেছে?

তামান্না এগিয়ে এল হাতে ট্রে নিয়ে। সামনের টেবিলে সেটা রাখতেই দেখা গেল দুটো গ্লাসের নীচের দিকে রঙিন তরল পদার্থ, এক বোতল ঠান্ডা জল আর কন্টেনারে বরফের টুকরো রয়েছে। উলটো দিকের সোফায় বসে তামান্না বললেন, ‘গ্লেন ফেভিক। আমি তো কালে ভদ্রে পান করি, করলে গ্লেন ফেভিক ছাড়া কিন্তু খাই না। আপনার অসুবিধা হবে না তো?’

‘এসবের স্বাদ আমার জানা নেই। কোনটা ভালো, খারাপ কোনটা আমি বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয় দামি হলে খুব একটা পার্থক্য বোধহয় থাকে না।’ সিরাজ বলল।

‘একি বললেন আপনি? তামান্নার চোখে বিস্ময়।’

‘কেন?’

‘আচ্ছা ধরুন, দু—জন ওয়েল বিহেভড, শিক্ষিত, সুদর্শন, পুরুষের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য থাকবে না? দু—জন একই বয়সের সুন্দরীর সবকিছু এক থাকবে?’

অস্বস্তিতে পড়ল সিরাজ, ‘না। ঠিক বলেছেন। আমি কথাটা ফিরিয়ে নিচ্ছি।’

হাসল তামান্না, ‘আপনি যখন প্রথমবার কলকাতায় এসেছিলেন তখন কি মনে হয়েছিল, কখনও খাইনি যখন এখন কেন খাব?’

হাসল সিরাজ, ‘তা মনে হবে কেন?’

‘আপনি বিবাহিত?’

‘হ্যাঁ।’ পরিষ্কার গলায় বলল সিরাজ।

‘বিয়ের আগে মনে হয়েছিল কি কখনও বিয়ে করিনি, কেন করব?’

‘তা মনে হয়নি।’

‘তাহলে এখন মনে হচ্ছে কেন? এটা তো বিষ নয়। আপনি কীরকম পুরুষ মানুষ, নিজের উপর কনফিডেন্স নেই?’

‘বিদেশে আছি। হোটেলে ফিরতে হবে। যদি নেশা হয়ে যায়।’

‘হবে না। আমার যদি না হয় আপনার হবে না। আর যদি হয় তাহলে নিশ্চিত থাকুন, আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ তামান্না গ্লাস তুলে বলল, ‘লেটস সেলিব্রেট। উল্লাস!’ গ্লাস তুলে মাথা নাড়ল সিরাজ। এ অবস্থায় বেশি রূঢ় হওয়া অভদ্রতা করা হবে। সে ঠিক করল যতটা সম্ভব কম চুমুক দেবে যাতে গ্লাসের মদ শেষ হতে অনেক সময় লাগে। তামান্না যেরকম চুমুক দিল তাতে গ্লাসের তরল পদার্থ অনেকটাই কমে গেল। ঠোঁট ভিজোল সিরাজ। না, কোনো কটু স্বাদ নেই, গন্ধও মন্দ নয়। আচ্ছা, দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার পর তামান্না জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার মিসেসকে নিয়ে এলেন না কেন? এ ভারী অন্যায়। বাঙালি পুরুষরা একাই ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।’

‘তাহলে ঠিক কোনটা?’ তামান্না জিজ্ঞাসা করল।

‘উনি কলকাতায় আসতে চাইলেন না।’

‘সে কী! কেন? কলকাতায় এসে শপিং করার লোভ নেই?’

‘না! খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ তো।’

‘তাই বলুন।’ তামান্না মাথা নাড়ল, ‘আপনার মিসেস যদি জানতে পারেন আমি আপনাকে এই ড্রিংক অফার করেছি তাহলে নির্ঘাত ছেড়ে চলে যাবেন। ভয় নেই, কেউ জানবে না। কিন্তু এক পথের পথিক না হলে একসঙ্গে হাঁটা মুশকিল।’

‘তা ঠিক।’

‘কিন্তু আমি মনে করি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ঝগড়া করার চেয়ে ঢের ভালো। যে যার নিজের মতো থাকুক। ব্যস।’ তামান্না বলল, ‘একি। আপনি তো চুমুকই দিচ্ছেন না। গ্লাসে যা ছিল তাই রয়েছে।’

শোনামাত্র সামান্য বড় চুমুক দিল সিরাজ।

তামান্না বলল, ‘জানেন, অনেক দিনের ইচ্ছে একটা বাংলা ছবি করার। ভারত—বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় ছবিটি করব। দু—দেশের অভিনেতা— অভিনেত্রীরা অভিনয় করবে। শুটিং হবে দু—দেশেই।’

‘বাঃ, খুব ভালো কথা। পরিচালনা কে করবেন?’

‘ঠিক করিনি। মুশকিল হল আমার একার পক্ষে প্রযোজনা করা সম্ভব নয়। অত টাকা আমার নেই। অনেকেই এগিয়ে আসছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। সহ—প্রযোজক হতে চান তাঁরা, কিন্তু আমি নির্ভর করতে পারছি না।’

‘কেন?’

‘সব মানুষকে তো বিশ্বাস করা যায় না। অথবা খুব টাইট বাজেটে ছবিটা করব। ধরুন দু—কোটি টাকার ছবি। আমি অর্ধেক দিতে পারি।’ একটু খেয়ে গ্লাস শেষ করল তামান্না, ‘আচ্ছা, এ ব্যাপারে আপনার কি ইচ্ছে আছে?’

‘আমার?’ হকচকিয়ে গেল সিরাজ।

‘না না। এখনই কোনো কমিটমেন্টে যেতে বলছি না। পরে, ভেবে বলবেন। টাকা—পয়সা তো সারাজীবন ধরেই রোজগার করা যায়, কত লোক হাজার হাজার কোটি টাকা রোজগার করে মরে যায়। তাদের কথা মানুষ জানে না, মরে যাওয়ার পর কেউ তাদের মনেও রাখে না। কিন্তু বেঁচে থাকার সময় একটা কিছু করে যাওয়া যা নিয়ে মানুষ কথা বলবে তার দাম আলাদা। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালির কথা কেউ কখনও ভুলতে পারবে? জীবন থেকে নেওয়ার কথা? একজন ভালো বন্ধু পেলে একসঙ্গে সেরকম একটা কিছু করার চেষ্টা করতাম। না, না, এখনই আপনাকে কিছু বলতে হবে না।’

শুনতে শুনতে সিরাজের মনে হচ্ছিল তামান্না খুব সত্যি কথা বলছে। কিন্তু প্রায় এক কোটি টাকা সে হয়তো জোগাড় করতে পারে, জলে ফেলতে পারে না। এতকাল সে শুনেছে সিনেমা তৈরি করা মানে জুয়া খেলা। কোন সিনেমা চলবে, কোন সিনেমা থেকে লাভ না হোক লগ্নির টাকা ফেরত পাওয়া যাবে তা কেউ বলতে পারে না। কত মানুষ এই লাইনে টাকা ঢেলে ডুবে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যাদের প্রচুর কালো টাকা আছে, রাখার জায়গা নেই, যাদের মনে লোভের সাপ ছোবল মারে তারাই ছবি তৈরিতে টাকা ঢালে বলে গল্প শুনেছে সে।

কিন্তু আজ তামান্নার কথা শুনে মনে হচ্ছিল ঢাকায় ফিরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। সবাই মিলে চাঁদা তুলে টাকাটা যদি দেওয়া যায়—

‘আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভাবছেন?’

‘না না। ফিরে গিয়ে নিশ্চয়ই ভাবব।’ সিরাজ বলল। তারপর তার মুখ থেকে অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এল, ‘আপনি এই ব্যবসায় ভাইকে সঙ্গে পেয়েছেন, বাড়ির সবাই কি আপনাকে সাপোর্ট করেন?’

‘বাড়ির সবাই মানে?’ অদ্ভুত চোখে তাকাল তামান্না।

‘আপনার হাজব্যান্ড, বাবা, মা—।’

‘সরি। বাবা, মা চায় আমি যা ভালো বুঝি তাই যেন করি। আর হাজব্যান্ড? বিয়ের তিন মাস পরে উনি সিঙ্গাপুর থেকে যে ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরছিলেন সেটার হদিশ এখনও মেলেনি, মোট বিরানব্বইজন যাত্রী, পাইলট আর এয়ার হোস্টেসদের নিয়ে পুরো প্লেনটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

‘সরি। কিছুদিন আগে এরকমভাবেই একটা প্লেন হারিয়ে গিয়েছে। আগে শুনেছি বারমুডা ট্রাঙ্গেলে এরকম ঘটনা ঘটত। কদিন আগের ঘটনা এটা?’

‘আট বছর হয়ে গেল। প্রাথমিক শোক যখন কাটিয়ে উঠলাম তখন আর একটা সমস্যা তৈরি হল। আমি বিধবা কি বিধবা নই? এমনও তো হতে পারে সমুদ্রে প্লেন ডুবে যাওয়ার সময় কিছু যাত্রী প্রাণ বাঁচাতে পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে আমার হাজব্যান্ডও ছিলেন। হয়তো এমন কোনো দ্বীপে ওঁরা আশ্রয় নিয়েছেন যার খবর সভ্যজগৎ রাখে না। অপেক্ষা করে করে এই দু—বছর আগে এয়ারলাইনসের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ওদের কেউ বেঁচে নেই। হ্যাঁ, ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। এই হল আমার কথা।’ বলতে বলতে সিরাজের গ্লাসে দ্বিতীয়বার হুইস্কি ঢেলে দিল তামান্না। সিরাজ বলল, ‘আমার আর খাওয়া ঠিক হবে না।’

‘কেন? শরীর কি খারাপ লাগছে?’ তামান্না উদবিগ্ন হল।

সিরাজ মাথা নাড়ল, ‘না না, সেসব কিছু নয়।’

‘আপনি এনজয় করছেন তো?’

‘তা করছি।’

‘দূর। আর আপনি বলতে ভালো লাগছে না, আমাকে তুমি বলুন।’

‘বলল। আজই তো আমাদের পরিচয় হল।’

সিরাজের কথা শোনামাত্র প্রচণ্ড জোরে হেসে উঠল তামান্না। তার হাসি যেন থামতেই চাইছিল না। অপ্রস্তুত হয়ে সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘আরে, হাসছেন কেন?’ হাসি থামিয়ে তামান্না জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রথম আলাপের দিনে বুঝি তুমি বলা যায় না?’

‘একটু কীরকম লাগে না?’

‘আচ্ছা মশাই, আমাদের এই উপমহাদেশে এতদিন প্রায় সব বিয়ে সম্বন্ধ করে হত। তাই তো? অভিভাবকরা আলোচনা করে একমত হলে বিয়ের দিন ঠিক হত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লোক দেখানো আয়োজন করে পাত্র পাত্রীকে দেখত। কথাবার্তা তেমন হত না। অনেক পাত্র বা পাত্রী তো সেই সুযোগ পেত না, তারা ছবিতে ভবিষ্যতের সঙ্গীকে দেখে নিত। ঠিক বলছি তো?’ তামান্না জিজ্ঞাসা করল। ‘একদম ঠিক।’ অজান্তেই গ্লাসে চুমুক দিল সিরাজ।

‘বিয়ে হল। সেই রাতে বরকনে একসঙ্গে বিছানায় ঘুমোতে গেল। আমার বান্ধবীদের কাছে শুনেছি, প্রথম রাতেই তারা স্বামীকে সেক্সের আনন্দ দিতে বাধ্য হয়েছে। আলাপ—পরিচয় নেই, একটা নতুন মানুষের সঙ্গে যদি পুরুষরা সেদিন করতে পারে তাহলে আমাকে তুমি বলতে আপনার দ্বিধা হচ্ছে কেন?’ সরাসরি সিরাজের মুখের দিকে তাকাল তামান্না। ঠিক সে সময় দরজার বাইরে শব্দ হল। একটু পরে ঘরে ঢুকলেন মইনুল। তাকে দেখে তামান্না উঠে দাঁড়াল। ‘পেয়েছ? পুরোটা দিয়েছে তো?’

‘টিডিএস কেটেছে। কিছু করার নেই। একটা খাম এগিয়ে দিলেন মইনুল। তামান্না খাম খুলে একটা কাগজ আর চেকটা ভালো করে পড়ে ঘরের পিছনে রাখা টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দিল।’

‘বাঃ, তোমরা শুরু করে দিয়েছ?’ মইনুল হাসল।

‘আমরা সেলিব্রেট করছি।’ তামান্না ফিরে এল।

‘কর। বুঝলেন ভাই, আমার এসব চলে না। পেটে আলসার আছে। মাঝে মাঝে ভাবি টাকা রোজগার করে কী হবে, খেতে পারি না যখন।’

‘আবার শুরু করলে? শোনো, সিরাজকে আমি প্রোপোজাল দিয়েছি। ওই আমার ফিলম প্রোজেক্ট সিনেমা তৈরির ব্যাপারটা ওঁকে বলেছি। সিরাজ একটু সময় নিয়েছেন ভেবে দেখবেন বলে।’ তামান্না বলল।

মইনুল বললেন, ‘বেশিরভাগ প্রোজেক্ট শুরু হয় না ওই বেশি ভাবাভাবি করা হয় বলে। জলে না নামলে কি সাঁতার কাটা যায়?

তোমরা ডিনার করবে কখন? ঘড়ি দেখলেন মইনুল।

‘আমার আজ দেরি হবে। রোজ তো করি না, আজ আমাকে ড্রিংকে পেয়েছে।’

হোটেলের দারোয়ান যখন সিরাজকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছিল তখন কলকাতার রাস্তায় কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই, ফুটপাতে মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। রাতে মার্কুইস স্ট্রিটের হোটেলে পৌঁছে কয়েক পা এগোতেই একটা কথা ভেসে এল, ‘মিস্টার সিরাজ? প্লিজ—’

সিরাজ তাকাল। রিসেপশনিস্ট তাকে ডাকছে। সে ডেস্কের সামনে যেতেই লোকটা একটা কাগজ এগিয়ে দিল, ‘ঢাকা থেকে দু—বার ফোন করেছিলেন এক মহিলা। নাম বলেছেন নার্গিস। বলেছেন ঠিকঠাক পৌঁছে গিয়েছেন।’

কাগজটা সামনে ধরল সিরাজ। তাতে লেখা আছে, নার্গিস, জিরো ওয়ান ফাইভ ফাইভ টু থ্রি এইট ফাইভ থ্রি…। বাকিটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। মাথা নাড়ল সিরাজ, থ্যাংকু। কাগজটা পকেটে পুরে ঘরের দিকে পা বাড়াল সে।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন সকাল দশটা। তাড়া করে বিছানা থেকে উঠতেই মনে পড়ল গত রাতের কথা। নার্গিস তাকে দু—দুবার ফোন করেছিল। না, নিশ্চই খুব চিন্তায় আছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে হোটেলের কাছাকাছি টেলিফোন বুথে চলে এসে ঢাকায় ফোন করল সিরাজ। একটু পরেই নার্গিসের গলা শুনতে পেল, ‘কাল কোথায় ছিলে?’

‘একটু বেরিয়েছিলাম। তুমি ভালোভাবে পৌঁছে গেছ তো?’

‘একদিন পরে জিজ্ঞাসা করছ? রাত দশটাতেও হোটেলে ফেরনি। ঠিক করে বল কোথায় গিয়েছিলে?’ নার্গিসের গলায় সন্দেহ।

‘আশ্চর্য! এখানে আমি কোথায় যেতে পারি?’ আমতা আমরা করল সিরাজ।

‘যাওয়ার জায়গার অভাব আছে নাকি? পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস নেই।’

‘কী যা তা বলছ।’

‘ঠিক বলছি। পনেরো মিনিট আগে আবার ফোন করেছিলাম, তুমি জানো?’

‘না তো!’

‘কী করে জানবে? ঢাকায় সকাল ছটায় উঠে পড়ি, ওনারা দশটা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছেন। দ্যাখো, তুমি এমন কিছু করো না যা—’

‘আহা। তুমি তিলকে তাল করছ। শোনো, একটা আশার খবর আছে। আবেদন করলে এসবি আমাকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’

‘তার আগে আমি কলকাতা পৌঁছে যাব’। নার্গিসের গলায় প্রত্যয়।

‘মানে? তুমি আবার ভিসা পাবে কী করে।’

‘চেষ্টা করলে সব হয়। শোনো, আমি সঙ্গে নেই বলে যা ইচ্ছে হবে তাই কোরো না।’

‘ঠিক আছে। রাখছি।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল সিরাজ।

নার্গিসের কথা শুনে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সবে কাল নার্গিস তাকে ছেড়ে ঢাকায় গেল, এর মধ্যেই ওর মনে সন্দেহ ঢুকে গেল? অথচ কলকাতা থাকার সময় কখনওই এই মানসিকতা দেখায়নি। এতগুলো বছরের বিবাহিত জীবনে কয়েকবার অভিমান করেছে নার্গিস, সে কথা রাখতে পারেনি বলে, কিন্তু সন্দেহ করেনি কখনও। আজ দু—জন দু—দেশে আছি বলে মনে সন্দেহ এল।

এখনও এপাড়ায় রেস্টুরেন্ট চালু হয়নি। কিন্তু কলকাতার রাস্তায় ফুটপাথ ঘেঁষে ছোট ছোট চায়ের স্টল বোধহয় ভোররাত থেকেই চালু হয়ে যায়। তার একটা থেকে ভাঁড়ে চা আর নোনতা বিস্কুট খেল সিরাজ। এই চায়ের মান অনেক বড় রেস্টুরেন্টের চেয়ে মন্দ নয়, দাম মাত্র চার টাকা।

হোটেলের সামনে পৌঁছে যে ট্যাক্সিটাকে দেখতে পেল, একজন মহিলা এই সকালে চোখে রোদচশমা পরে পিছনের আসনে বসে আছেন। কৌতূহলী না হয়ে সে হোটেলে ঢুকতেই গলা কানে এল, ‘এই যে কোথায় গিয়েছিলেন?’

মইনুলকে দেখে অবাক হল সিরাজ, ‘একি, আপনি?’

‘আর বলবেন না। আপনার বান্ধবী এমন জেদ ধরল যে আসতে হল।’

‘আমার বান্ধবী?’

‘মাই গড! আপনি তামান্নাকে বান্ধবী বলে মনে করেন না?’

‘ও, না না! কিন্তু ব্যাপার কী?’

‘বাইরে চলুন। সে ট্যাক্সিতে বসে আছে।’

মইনুলকে অনুসরণ করে বাইরে আসতেই ট্যাক্সির দরজা খুলে তামান্না নীচে নেমে দাঁড়াল। তারপর ঈষৎ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘পাশ দিয়ে গেলেন কিন্তু ফিরে তাকালেন না। কী, খুব অবাক হয়ে গেছেন তো?’

‘মানে, আমি ঠিক, এই হোটেলে আপনারা এলেন কী করে?’

সিরাজ কিছুই বুঝতে পারছিল না।

‘একি!’ তামান্না বেশ জোরে শব্দটা বলল, ‘কাল রাত্রে কী কী বলেছেন তা আপনার মনে নেই নাকি?’

মনে করার চেষ্টা করেও সফল হল না সিরাজ।

‘কী বলেছিলেন তা মনে নেই? কী করেছিলেন তাও কি ভুলে গেছেন?’

‘বিশ্বাস করুন, ট্যাক্সিতে ওঠার আগের সময়টার কথা মনে পড়ছে না।’

‘আচ্ছা, এই যে আমাকে আপনি আপনি বলছেন, কী কথা বলেছিল।’

‘হ্যাঁ, এটা মনে আছে।’

‘তাহলে এখনও আপনি বলছেন কেন?’

মইনুল চুপচাপ শুনছিলেন, বললেন, ‘আর ওকে লজ্জা দেওয়ার দরকার নেই।’

‘ঠিক আছে। ওকে!’ মাথা নাড়ল তামান্না, ‘ট্যাক্সিতে ওঠো তো।’

আচমকা আপনি থেকে তুমিতে চলে গেল তামান্না।

সিরাজ বুঝতে পারল তর্ক করে লাভ নেই। সে যখন ট্যাক্সি ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠতে যাচ্ছে তখন তামান্না বলল, ‘ওখানে বসলে কথা বলতে অসুবিধে হবে। তুমি পিছনে এসে বস।’ সে ট্যাক্সিতে উঠে দরজা খুলে রাখল।

মইনুল সামনের সিটে উঠে বসল। সিরাজ যখন পিছনের সিটে উঠতে যাচ্ছে তখন হোটেলের দরজায় এসে রামচন্দ্র চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনার কল এসেছিল ঢাকা থেকে।’

লোকটা নার্গিসের ফোনের কথা বলছে বুঝে সিরাজ হাত নেড়ে জানাল, ‘ঠিক আছে।’ ট্যাক্সি চলতে শুরু করলে সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘সল্টলেকে। গিয়েছ ওখানে?’ তামান্না জিজ্ঞাসা করল।

নার্গিসকে ডাক্তার দেখাতে সল্টলেকে নিয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু সেসব গল্প এড়াতে সিরাজ মাথা নেড়ে না বলল।

মইনূল বললেন, ‘কাল রাত্রে তামান্নাকে যা যা বলেছিলেন তা মনে করার চেষ্টা করুন ভাই। আমরা ধরে নিয়েছি আপনি মিথ্যে বলেননি।’

‘বাধ্য না হলে আমি মিথ্যে বলি না।’ সিরাজ বললেন।

‘গুড। কাল রাত্রে তোমাকে কেউ বাধ্য করেনি। তুমি যা বলেছ তা মনের আবেগে বলে গেছ। নিশ্চয়ই মিথ্যে বলনি।’

সিরাজ চুপ করে থাকল। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল তার। কী বলেছে সে? হঠাৎ তার হাতের উপর তামান্নার হাতের চাপ অনুভব করল সিরাজ। সে তাকাতেই ফিসফিসে গলায় তামান্না বলল, ‘তুমি খুব ভালো!’

চকিতে সামনের দিকে তাকাল সিরাজ। ড্রাইভারের পাশের সিটে মইনুল চোখ বন্ধ করে বসে আছে। গাড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে তামান্নার গলার স্বর তার কানে যায়নি।

‘আমাকে একটু হেল্প করবেন?’ সিরাজ তামান্নার দিকে তাকাল।

‘আবার করবেন?’ চোখ পাকাল তামান্না।

‘বেশ, করবে?’

সঙ্গে সঙ্গে তামান্নার পাঁচ আঙুল সিরাজের পাঁচটা আঙুলকে জড়িয়ে ধরল, ‘বল’।

‘আমি তো আগে কখনও ড্রিংক করিনি। তাই আজ সব কথা মনে করতে পারছি না, ঠিক কী বলেছিলাম।’

‘অনেক অনেক কথা। কোন হোটেলে উঠেছ, সারা দিন কী কী কাজ করেছ, এসবি অফিসে গিয়েছিলে, এইসব।’ তামান্না হাসল।

‘এসবি অফিসের কথা বলেছি?’ অবাক হয়ে গেল সিরাজ।

‘হুঁ। খুব টেনশনে ছিলে। কাল ওখানে যাওয়ার পর তোমার সেই টেনশন কিছুটা কমেছে। আরও বলেছ…

‘কী বলেছি?’

‘কবীর ভাইয়ের কথা—।’

‘কবীর ভাই?’ চমকে উঠল সিরাজ।

‘একি! তোমার কি একটুও মনে নেই?’ তামান্না হাসল।

‘না, মনে নেই।’ তামান্না হাসল।

‘না, মনে নেই।’ কিন্তু কথাটা বললে স্বীকার করে নিতে হবে যে, সে মাতাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাতালরা, যা বলে তা পরে মনে থাকে না। তাহলে লোকে কেন বলে, ‘জাতে মাতাল, তালে ঠিক!’

সিরাজ হাসার চেষ্টা করল, ‘হ্যাঁ, মনে পড়ছে।’

সামনের সিট থেকে মইনুলের গলা ভেসে এল, ‘সরাসরি কথা বলে নিলে হয় না?’

‘হ্যাঁ, বলছি।’ কথাটা তামান্না বলল বটে কিন্তু সে সিরাজের আঙুল আঁকড়ে বসে রইল। সরাসরি দূরের কথা, কোনো কথাই বলল না। প্রায় আধঘণ্টা চলার পর মইনুল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সিটি সেন্টারের কাছে এসেছি?’ ড্রাইভার হিন্দিতে বলল, ‘সামনের আইল্যান্ড পার হলেই সিটি সেন্টার।’

‘তাহলে আইল্যান্ড পার করে থামুন। আমরা ওখানেই নামব।’ মইনুল বললেন।

ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে মইনুল বললেন, ‘আমি এগিয়ে দেখি, তোমরা ধীরে এসো।’ মইনুলকে অনেকটা এগিয়ে যেতে দেওয়ার পর তামান্না বলল, ‘সিরাজ, তোমাকে আমি বন্ধু বলে ভেবেছি। কাল দুপুরে হয়তো পরিচয় হয়েছিল কিন্তু তুমি চলে আসার পর মনে হয়েছে আমার আর কোনো অভাব নেই। তুমি বন্ধু থাকবে তো?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘আমি আমার স্বপ্নের সিনেমা করতে চাই। যার কাছে টাকা চাইছি সে কিছুটা অ্যাডভ্যান্টেজ নিতে চাইছে। আমি তাতে রাজি নই।’

‘ঠিকই তো।’

‘কিন্তু তুমি যদি হেল্প কর তাহলে কারও কাছে কোনো অবলিগেশনে না গিয়ে আমরা টাকাটার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারি।’ তামান্না সিরাজের হাতের আঙুলে চাপ দিল।

‘বল, কী করতে হবে?’ সিরাজ কৌতূহলী হল।

‘বলব। চল, আগে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলি।’ ততক্ষণে মইনুল একটি দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেছেন। বাড়ির দরজা—জানলা বন্ধ। সামনে ফেন্সিংয়ের ওপাশে এক চিলতে বাগান রয়েছে। মইনুল গেট খুলে ভিতরে গিয়ে দরজার পাশে বেলের বোতামে চাপ দিলেন। তিনবারের পর পাশের জানালা খুলে গেল। একজন বৃদ্ধ উঁকি দিলেন, ‘কাকে চাই?’

‘বলুন মইনুল আর তামান্না এসেছে।’ মইনুল বললেন।

‘নাম বললেন দু—জনের অথচ লোক দেখছি তিনজন।’ বৃদ্ধ বললেন।

‘ও। ওর নাম সিরাজ ভাই। ঢাকার লোক।’

মইনুল বলা মাত্র জানলা বন্ধ হয়ে গেল। মিনিট আড়াই পরে বৃদ্ধ দরজা খুললেন। লুঙ্গি এবং ফতুয়া পরনে। বললেন, ‘সোজা উপরে চলে যান।’

সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসতেই ওপাশের ঘর থেকে হুইলচেয়ারে বসে এক সম্ভ্রান্ত চেহারার প্রৌঢ় বেরিয়ে এলেন, ‘আসুন আসুন। আসতে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়নি? এই ঘরে এসে বসুন।’ প্রৌঢ় হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। সুন্দর সাজানো ঘর। সোফায় বসার পর ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চা না কফি’? তামান্না হাসল, ‘একটুও ব্যস্ত হবেন না। আমরা একটু আগেই কফি খেয়েছি। ওহ হো, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি সিরাজ ভাই, ঢাকায় থাকেন, বস্ত্র ব্যবসায়ী।’

‘এককালে খুব ভালো বাজার ছিল, এখন কীরকম?’ ভদ্রলোক সিরাজকে প্রশ্ন করলেন।

‘মোটামুটি।’ সিরাজ সতর্ক হয়ে জবাব দিল।

‘আমি সুধাংশু মণ্ডল। একটা অ্যাকসিডেন্টের পর এই হুইলচেয়ার আমার ভরসা। হ্যাঁ, মইনুল ভাই, আমি কথা বলেছি, আপনার ছবির জন্য এক কোটি টাকা চাইছেন। অথচ যে পার্টি দেবে সে কোনো ইনটারফেয়ার করুক এটা আপনারা চান না!’

মইনুল মাথা নাড়লেন, ‘তামান্নার সেটাই ইচ্ছে।’

তামান্না বলল, ‘ইনটারফেয়ার করলে ভালোভাবে কাজ করা যায় না।’

‘ঠিক কথা।’ সুধাংশু মণ্ডল মাথা নাড়লেন। ‘কিন্তু অত টাকা দিয়ে কেউ মুখ বন্ধ করে বসে থাকবে এটা আশা করা একটু—। আবার এর উলটোটাও হতে পারে।’

‘কীরকম?’ তামান্না জিজ্ঞাসা করল।

‘যে টাকা দিতে পারে তার মুখ প্রথমেই বন্ধ করে দিন।’

সেটা সম্ভব হবে? তামান্না বিস্মিত।

‘অসম্ভব বলে কোনো শব্দে আমি বিশ্বাস করি না।’

‘একটু পরিষ্কার করে বলুন—!’ তামান্না অনুরোধ করল।

‘আপনাকে তো কয়েকদিন আগে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম—!’ হাসলেন সুধাংশু মণ্ডল।

‘হ্যাঁ, আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করেছি। কাজটা কি খুব কঠিন?’

‘কঠিন না হলে কেউ পয়সা খরচ করে?’

‘ঠিক কতজন লোক—’

‘কুড়িজন। কিন্তু কারও কোনো কাগজপত্র নেই।’

‘কেউ ইন্ডিয়ার নাগরিক নয়?’

‘না। ওরা কেউ বাংলাদেশেরও নাগরিক নয়।’

‘তাহলে কোথাকার—?’

‘এটা আপনার না জানলেও চলবে। বলেছি, ব্যাপারটা সোজা—বাসে করে বর্ডারের কাছে গিয়ে দালালকে পাঁচশো হাজার দিয়ে বাংলাদেশে যাওয়া এদের পক্ষে সম্ভব নয়।’ সুধাংশু মণ্ডল বললেন।

‘কেন?’ মইনুল প্রশ্ন করলেন।

‘কারণ অনেক। তার একটা হল এরা কেউ বাংলায় কথা বলতে পারে না। বাংলা ভাষা ওদের জানা নেই। এবার নিশ্চয়ই সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন। কুড়িজন লোককে বাংলাদেশের সীমান্তের পঞ্চাশ কিলোমিটার ভিতরে পৌঁছে দিলেই দায়িত্ব শেষ। আপনারা মাথাপিছু পাঁচ লাখ পেয়ে যাবেন। সুধাংশু মণ্ডল হাসলেন।

‘আমরা যাব কিন্তু আপনার ব্যাপারটা…’

‘ওটা আপনাদের চিন্তার বিষয় নয়। আপনারা এক কোটি পাবেন এবং কাজ করতে যে খরচ হবে তা করে বাকিটা সিনেমার জন্য রেখে দেবেন। কেউ আপনাদের সিনেমা তৈরির কাজে ইনটারফেয়ার করবে না!’

তামান্না বলল, ‘তাতেও তো অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবে!’

‘তা তো হবেই। খরচ করার পরে যে টাকা থাকবে তা তো কম নয়। তাই না? আজ সকালে আপনি ফোনে যার কথা বলেছেন তিনিই তো এই মানুষ! সিরাজ ভাই। সিরাজ ভাই যদি সাহায্য করেন তাহলে নিশ্চয়ই উনিও খালি হাতে সাহায্য করবেন না। অবশ্য এসব আপনাদের ব্যাপার। সুধাংশু মণ্ডল বললেন।

মোড অফ পেমেন্ট হল ইন্ডিয়া থেকে ওঁরা যেদিন রওনা হবেন সেদিন পঁচিশ লাখ পাবেন, সীমান্ত পার হলেই পঞ্চাশ লাখ, সীমান্তের ওপারে পঞ্চাশ কিলোমিটার গেলে বাকি পঁচিশ। বুঝতে পেরেছেন?

তামান্না জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর বাকিটা যদি না পাই—’

মাথা নাড়লেন সুধাংশু মণ্ডল, ‘একটা কথা মনে রাখবেন, এরা কখনওই বেইমানি করে না। করতে দেয় না। যা কথা হবে তা থেকে একটুও সরে যাবে না ওরা। আবার বিশ্বাস করে প্রথম পঁচিশ লাখ টাকা দিয়ে যদি ওরা দ্যাখে আপনারা বেইমানি করেছেন তাহলে ওদের মনে কোনো মায়াদয়া থাকবে না। তাছাড়া এত ভাবছেন কেন? আমি তো আছি।’

সিরাজ চুপচাপ শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল কোনো ভয়ংকর অপরাধমূলক সিনেমার সেটে পৌঁছে গিয়েছে সে। আচমকা তার মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এল ‘আচ্ছা, আপনি যাদের ওঁরা বলছেন, তারা কে?’

সুধাংশু মণ্ডল তামান্নার দিকে বিরক্ত চোখে তাকালেন? তামান্না তড়িঘড়ি বলল, ‘ওঁরা কারা তা জেনে আমাদের কোনো লাভ নেই। ওরা আমাদের টাকা দেবে এজন্য কাজটা করব। সিরাজ, কাল রাতে আপনি বলছিলেন সীমান্ত পারাপারের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে এমন একজন ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোক আপনার জানা আছে। তাই নয়?’

সঙ্গে সঙ্গে সুধাংশু সিরাজের দিকে তাকালেন, ‘কে? কোন জায়গায়?’

‘বনগাঁ বর্ডারে, তাই তো কাল বললেন?’

‘আপনি কি কবীর ভাইয়ের কথা ভাবছেন? সুধাংশু মণ্ডল প্রশ্ন করলেন।

কাল রাতে মদপান করে কতটা বলেছে তা একটুও মনে না পড়ায় সিরাজ মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘না, না। ওকে বিশ্বাস করা যাবে না। এসব ব্যবসাতেও মিনিমাম একটা সততা রাখতেই হয়। এই লোকটা আদ্যোপান্ত অসৎ। তাছাড়া ওর কারবার চুনোপুঁটিদের নিয়ে। রুই—কাতলাকে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা ওর নেই।’ যেন কিছু মুছে দিচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে হুইলচেয়ারে বসে হাত নাড়লেন সুধাংশু মণ্ডল।

‘কবীর ভাই পার করে দিতে পারবে না?’

‘বোধহয় না। আর যদি পারে তাহলে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবে। বর্ডারের ওপারে ঢুকিয়েই আরও বেশি টাকা চাইবে। শুধু আপনাদের কাছে নয়, ওদের কাছেও। না না, আপনারা যদি টাকা চান আরও বড় কাউকে ধরুন। এসবি অফিসের কোনো বড় কর্তাকে যদি টোপ দিতে পারেন, তাহলে কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু এজন্য আপনারা মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টা সময় পাবেন। তারপর ওরা ত্রিপুরা বর্ডার দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে। তাহলে কখন আমাকে জানাবেন?’

‘কালকের মধ্যেই’। তামান্না বলল.

‘কোনো সোর্স আছে?’ সুধাংশু মণ্ডল অবাক হলেন।

‘আরে সিরাজ ভাই ওদের ভালো চেনেন।’

‘তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু ফোনে বেশি কথা বলবেন না। যদি পজিটিভ হয় তাহলে জিজ্ঞাসা করবেন, বাংলাদেশে যাচ্ছি, কিছু বলতে হবে নাকি?’

‘ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ। আশা করি দেখা হবে।’ মইনুল উঠে দাঁড়ালে তামান্না এবং সিরাজ উঠে পড়ল। সিরাজের মাথার ভিতরে একটা দপদপানি শুরু হয়ে গেল। কাল রাতে সে তামান্নাকে এসবি—র কথাও বলেছে? সর্বনাশ! তার মানে, সে যে পাসপোর্ট হারিয়ে ইন্ডিয়াতে আছে তাও তামান্নাকে বলেছে? তামান্না তখন বলেছিল কাল রাতে সে যা বলেছে এবং করেছে তার কিছুই এখন মনে নেই। কথাটা যে সত্যি তা একটু একটু করে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বলার পাশাপাশি কী করেছিল সে? সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ঠোঁট কামড়াল সিরাজ।

সিটি সেন্টারের দিকে কয়েক পা যেতেই ট্যাক্সি পেয়ে গেল ওরা। মইনুল বলেন, ‘ব্যাপারটা যে খুব গোপনীয় তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?’

‘হ্যাঁ. পারছি।’ সিরাজ বলল।

‘আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। উনি বললেন বটে বাহাত্তর ঘণ্টা কিন্তু আমাদের টার্গেট করতে হবে ছত্রিশ ঘণ্টা।’ মইনুল বললেন।

তামান্না জিজ্ঞাসা করল, ‘এসবি অফিসটা কোথায়?’

‘লর্ড সিনহা রোডে।’ সিরাজ উত্তর দিল।

‘ওটা কি তোমার হোটেলের কাছে?’

‘বেশি দূরে নয়।’

গুড। তোমাকে ওই অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে আমরা গেস্টহাউসে চলে যাচ্ছি। তুমি চেষ্টা কর কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে।’

‘কীভাবে?’

‘আচ্ছা, আজ গেস্টহাউসে ডিনারে ওকে ডাকো। ভদ্রলোক আসার পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তামান্না বলল।

মইনুল ট্যাক্সির সামনের সিটে বসে বলল, ‘গুড আইডিয়া। হাতে সময় পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি হবে না।’

তামান্না বলল, ‘এসবি অফিস থেকে বেরিয়ে তুমি সোজা গেস্টহাউসে চলে এসো। খবরটা পাওয়া যাবে। তখন লাঞ্চ করব। ওকে?’

এসবি অফিসের সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল সিরাজ। ট্যাক্সি চলে গেলে সে খুব ফাঁপরে পড়ল। এসবি—র অফিসারকে সে কী করে বলবে আজ রাতে ডিনারে চলুন। তাকেই এরা ভালো করে চেনেন ন। তামান্নাদের তো চেনার কথা নয় তাহলে তাদের ওখানে ডিনারে যাবেন কেন? উলটে এরকম প্রস্তাব দেওয়ার জন্য তাকে হয়তো বিপদে ফেলে দেবেন।

আজ হাজিরা দেওয়ার পর একজন পিয়োনের কাছ থেকে সাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে দেশে ফেরার অনুমতি চেয়ে একটা করুণ আবেদনপত্র লিখল সে। তারপর আবেদনপত্রের জেরক্স বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের চিঠির কপির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে সেই অফিসারের ঘরের দরজায় পৌঁছে ভিতরে ঢোকার অনুমতি চাইল।

অফিসার বললেন, ‘ও আপনি, আসুন।’

সিরাজ আবেদনপত্র সামনে রাখলে ভদ্রলোক সেটা পড়লেন। তারপর বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে আমরা খোঁজ নিয়েছিলাম। ঢাকায় তো আপনার প্রশংসা করার জন্য প্রচুর মানুষ আছে। কিন্তু!’ থামলেন অফিসার।

‘কিন্তু স্যার?’

‘সব কিছু তো নিয়ম মেনে করতে হয়।’ অফিসার বললেন, ‘আপনার কেসটা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হত। আদালতে মামলা যাচ্ছিল। সেখানে ফয়সালা হতে কত মাস বা বছর যেত তা কেউ জানে না। কিন্তু আপনার ভাগ্য খুব ভালো।’

‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ সিরাজ হতভম্ব।

‘যে লোকটি ছিনতাই করে আপনার ব্যাগ নিয়ে পালিয়েছিল সে ধরা পড়ে গেছে। না, ডলার বা টাকা লোকটার কাছে পাওয়া যায়নি কিন্তু আপনার পাসপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। সেই পাসপোর্টে যে ভিসার ছাপ আছে তার মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। আপনি এখনই সেই থানায় চলে যান যেখানে ডায়ারি করেছিলেন। আমি ফোন করে দিচ্ছি, ওখানে গেলেই পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে যাবেন।’ অফিসার বললেন।

ঠিক দুটোর সময় থানা থেকে নিজের পাসপোর্ট পেয়ে গেল। এখন সে স্বাধীন। ইচ্ছে করলে আগামীকাল সকালে ঢাকার বাসে উঠে বসতে পারে। এত আনন্দ কখনও হয়নি তার। ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই নার্গিসকে ফোন করে খবরটা জানিয়ে দেয়। কিন্তু না, ওকে চমকে দিতে হবে সোজা বাড়িতে পৌঁছে।

হোটেলে চলে এল সে। প্রথমে তামান্নাকে ফোন করল, ‘আমি লাঞ্চে যেতে পারছি না। কিছু মনে করো না।’

‘কেন?’

‘পর পর কয়েকটা জরুরি কাজ এসে গেছে।’

‘আশ্চর্য! এত তাড়াতাড়ি কাজ এসে গেল। থাক গে, কথা হয়েছে?’

‘পুরো রাজি হননি।’

‘রাজি করাও সিরাজ। তোমাকে আমরা সিনেমা—প্রোজেক্টের টেন পার্সেন্ট প্রফিট দেব। বুঝতেই পারছ টাকার অ্যাকাউন্ট কত হবে! যেমন করেই হোক ওঁকে নিয়ে এসো। ওঁর নামটা কী?’

‘মিস্টার গুপ্তা, ওঁর ঘরের দরজার গায়ে লেখা দেখেছি।’

‘আমরা খোঁজ নিচ্ছি। তুমি বিকেল পাঁচটার মধ্যে কনফার্ম কর, প্লিজ।’

রিসেপশনের ফোন নামিয়ে রেখে সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার বিল রেডি করবেন? কত হয়েছে জানা দরকার।’

লোকটি বলল, ‘ একটু দাঁড়ান।’ তারপর কম্পিউটারের বোতাম টিপে একটা কাগজে টাকার অঙ্ক লিখে এগিয়ে দিল। সেটা দেখে খুশি হল সিরাজ। নার্গিস যে টাকা রেখে গিয়েছে তাতে বিল মেটানো যাবে। কিন্তু ফেরার টিকিট, কবীর ভাইয়ের ট্যাক্স মেটানোর টাকা তার কাছে থাকবে না। এখন একমাত্র উপায় নার্গিসের গয়না বিক্রি হবে এসব খরচ মেটানো।

হঠাৎ রিসেপশনিস্ট বলল, ‘ভাই আপনি কি রামচন্দ্রের নামে পুলিশের কাছে কমপ্লেন করেছিলেন?’

‘আমি? না তো!’ সিরাজ অবাক হল, কেন?

‘একটু আগে পুলিশ ওকে অ্যারেস্ট করেছে।’

‘সে কী! কেন?’

‘জানি না। কবীর ভাই বলে একজন হোটেলে এসে আপনার খোঁজ করছিল। লোকটা রামচন্দ্রের পরিচিত। ওরা যখন কথা বলছিলেন তখনই পুলিশ আসে। দুজনকেই ধরে নিয়ে গিয়েছে, খুব সিরিয়াস কেস নাকি।’ লোকটি বলল।

‘আপনার কেন মনে হল আমি কমপ্লেন করতে পারি?’

‘ওই কবীর ভাই আপনার খোঁজ করছিল। তারপরই পুলিশ এসেছিল। ম্যানেজারবাবু আপনাকে রামচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছেন। তাই—’

খুব স্বস্তি পেল সিরাজ। তার মনে হল পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে গেছে বলে এসবি—র অফিসারকে ধন্যবাদ দেওয়া তার কর্তব্য ছিল। সে হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এল এসবি অফিসে। ভদ্রলোক তখন বাইরে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সমস্যার সমাধান হয়েছে?’

‘হ্যাঁ স্যার। আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম।’

‘যত তাড়াতাড়ি পারেন দেশে ফিরে যান।’

‘হ্যাঁ স্যার, এখানে এই দু—দিন খুব ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

‘যেমন?’

‘যে হোটেলে আছি তার বেয়ারা বেআইনিভাবে বর্ডার পার করে দেবে বলেছিল, টাকা চেয়েছিল ছয় হাজার। আমি রাজি হইনি, সেই বেয়ারাকে আজ পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।’ সিরাজ বলল।

‘হ্যাঁ। তার দলের মূল চাঁইকেও অ্যারেস্ট করা হয়েছে।’

‘ও আপনি জানেন?’

‘জানি। একটা কথা বলি, দয়া করে কোনো গেস্টহাউসে গিয়ে নতুন করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। বুদ্ধিমান মানুষও পরিস্থিতি খারাপ হলে নির্বোধ হয়ে যান। দয়া করে সেটা হবেন না। আপনার ভিসায় কি শুধু রোড এবং ট্রেন আছে, না এয়ারও মেনশন করা হয়েছে?’

পাসপোর্ট বের করে ভিসার পাতা খুলল সিরাজ। তাতে লেখা আছে, এয়ার রোড।

অফিসার সেটা দেখে বললেন, ‘গুড। আজ রাত সাড়ে ন—টায় যে ফ্লাইট আছে তার টিকিট কাটুন।’

‘প্লেনের টিকিট?’

‘হ্যাঁ। আচ্ছা, গুডলাক।’ অফিসার বেরিয়ে গেলেন। হোটেলে ফিরে এসে সব বিল মিটিয়ে দেওয়ার পর সিরাজ দেখল যা হাতে রইল তাতে বাসের টিকিট হতে পারে, প্লেনের নয়। প্লেনে যেতে হলে নার্গিসের গয়না বিক্রি করতেই হবে। সেটা করতে একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না।

জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতেই রিসেপশন থেকে ফোন এল, এক বৃদ্ধা দেখা করতে চান। নীচে নেমে এল সে। দেখল বেশ বয়স্ক মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বললেন, ‘আপনি সিরাজ ভাই?’

‘হ্যাঁ। আপনি?’

‘আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আপনার ব্যাগ যে চুরি করেছিল সে আমার নাতি। পুলিশ তাকে ধরেছে।’

‘ও। আমি কী করতে পারি?’

‘আপনার ব্যাগে পাসপোর্ট ছাড়া যা ও পেয়ে সরিয়ে রেখেছিল তা আমি এই প্যাকেটে এনেছি। আপনি ওকে ক্ষমা করে দিন। ওর বিরুদ্ধে কেসে সাক্ষ্য দেবেন না। আপনি না সাক্ষ্য দিলে নাতি ছাড়া পেয়ে যাবে।’ একটা প্যাকেট এগিয়ে ধরলেন বৃদ্ধ।

‘প্যাকেটে কী আছে?’ গলার স্বর যেন বদলে গেল সিরাজের।

‘আপনার যা যা ছিল।’ ডলার, টাকা। বৃদ্ধ বললেন।

‘বাঃ, আমি শুনেছিলাম, চুরির পরে পাসপোর্ট বিক্রি করে দেওয়া হয়। আপনার নাতি বিক্রি করেনি কেন?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘কী বলব স্যার, আপনার ছবি দেখে ও বিক্রি করতে পারেনি। ওর বাবা, মানে আমার ছেলে দু—বছর আগে মারা গিয়েছে। আপনার মুখের সঙ্গে তার মুখের খুব মিল।’

‘কত বয়স আপনার নাতির?’

‘পনেরো।’

‘এই বয়সে চুরি, ছিনতাই করছে, আপনারা তাকে আটকাচ্ছেন না?’

‘খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়লে বাড়ির কথা কানে তোলে না। স্যার, ওর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন না। এই বুড়োর ও ছাড়া কেউ নেই।

‘আপনাকে কথা দিতে হবে ওই খারাপ ছেলেদের কাছ থেকে ওকে সরাতে হবে।’

‘আমি এবার খুব চেষ্টা করব স্যার।’

‘ঠিক আছে, আমি সাক্ষ্য দেব না। আপনি যান।’

ঘরে গিয়ে প্যাকেট খুলে সিরাজ দেখল তার সমস্ত টাকা—ডলার যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। সে গুনে দেখল যা টাকা রয়েছে তাতে প্লেনের টিকিট কিনতে সমস্যা হবে না। তার মনে হল, একের পর এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে চলেছে। এসবই সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। মাইকেল মধুসূদনের লেখা একটা লাইন মনে পড়ে গেল, প্রবাসে দৈবের বশে…।

মার্কুইস স্ট্রিটে যে ট্রাভেল এজেন্ট রমরমিয়ে ব্যবসা করে তারা সিরাজকে উপদেশ দিল, ‘সোজা এয়ারপোর্টে চলে যান। ওখানে টিকিট কাউন্টারে নিশ্চয়ই টিকিট পেয়ে যাবেন। রাতের ওই ফ্লাইট এখনই ভরতি হয় না।’

অতএব সুটকেস নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল সিরাজ। পিছনের সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে মনে হল, আহ, কী শান্তি। আজ গভীর রাতে ফ্ল্যাটের দরজায় বেলের বোতাম টিপে জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজের স্বাদ নার্গিসকে দেবে সে। পকেট থেকে ওর গয়না বের করে পরিয়ে দেবে। বলবে, তোমার যা ছিল তা সব ঠিকঠাক আছে। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে জ্যামে। সে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করতে লোকটা বলল, ‘সামনে কিছু একটা হয়েছে, সব গাড়ি তো দাঁড়িয়ে আছে। ছেড়ে দেবে এখনই।’

আবার সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে বসল সিরাজ। তামান্নারা ভাবতেও পারছে না সে আজ রাতের ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে। তামান্না মেয়েটির ব্যবহার খুব ভালো কিন্তু একটা কিছু রহস্য আছে ওর কথাবার্তা—ব্যবহারে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল এসবি অফিসের মিস্টার গুপ্তার কথা। দয়া করে কোনো গেস্টহাউসে গিয়ে নতুন করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। সোজা হয়ে বসল সে। তখন মাথায় ভালো করে ঢোকেনি। এখন মনে হল হঠাৎ এই কথা কেন বলেছেন মিস্টার গুপ্তা? তার কাছে নিশ্চয়ই খবর আছে, সে তামান্নাদের গেস্টহাউসে গিয়েছিল। অর্থাৎ তামান্নারাও এসবি—র নজরে আছে।

আচমকা শীত শীত বোধ ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে, মনে। সিরাজ কাতর গলায় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলল, ‘ভাই, যে করেই হোক আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে চলুন। গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরুন। যা ভাড়া মিটারে উঠবে তার ডাবল দেব আমি, প্লিজ।’

ট্যাক্সি ড্রাইভার হর্ন বাজাতে লাগল।

সামনের গাড়িগুলো একটু নড়ছে, এগোচ্ছে—!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *