পরনিন্দা পরচর্চা
প্রথম প্রশ্ন হল, কেন পরচর্চা করব না? করলে কী হয়! আমি তো সাধুসন্ন্যাসী নই। আধ্যাত্মিক মার্গে একটি উপদেশ আছে—পরচর্চা গর্হিত কাজ। মন ছোট হয়। আত্মা নিরেট হয়ে যায়। পতন হয়। দেহের পতন নয়, মনের পতন। রাজা রামকৃষ্ণের একটি ভক্তি-সঙ্গীতে পরমানন্দ লাভের পদ্ধতি বর্ণিত আছে, যথা—
ভবে সেই যে পরমানন্দ
যে জন পরমানন্দময়ীরে জানে
জানলে কী হয়? চরিত্রের অদ্ভুত রূপান্তর ঘটে। সে রূপান্তর কেমন,
(রাজা) রামকৃষ্ণ কয় এমন জনে
লোকের নিন্দা না শুনে কানে
(তাঁর) আঁখি ঢুলুঢুলু রজনী দিনে, প্রভৃতি।
পরমানন্দময়ীকে জানা সহজ নয়। ছা-পোষা সংসারি, চারপাশে হরেক রকম, হরেক চরিত্রের লোক, গিজগিজ করছে। নিত্য ওঠা-বসা, ঠোকাঠুকি, তাদের কথা বলব, আলোচনা করব, পাঁচজনকে আনন্দ দেব, তবেই না বেঁচে থাকার মজা। সবচেয়ে বড় কথা, অন্য মহলে তোমার চর্চা করব, তুমি আমার চর্চা করবে। পারস্পরিক। আয় ভাই কানাইয়ের মতো। তা ছাড়া, চর্চা শব্দটাই শ্রদ্ধেয়, পরের চর্চাতেও চর্চা আছে। অন্যের সদগুণের আলোচনা দোষের নয়। আমরা মহাপুরুষের জীবনচর্চা করি। তাহলে কাপুরুষ বা কালপুরুষদের কাণ্ডকারখানা, দোষাবলি আলোচনা দোষের হবে কেন? আমি যদি বলি,
নিরুপম মহাশয়তান। রোজ রাতে মাল খেয়ে বাড়িতে এসে মাঝরাতে বউটাকে ধরে পেটায়। বেদম মার। মেয়েটা কেঁউকেঁউ করে কাঁদে। আর ভোর রাতে নিরুপম কাঁদে ভেউভেউ করে, বলতে থাকে, আমাকে তুমি ক্ষমা করলে কি না! ক্ষমা, ক্ষমা, ক্ষমা। তারপর কাপ, ডিশ, গেলাস যা হাতের কাছে পায়, দুদ্দাড় ভাঙতে থাকে। শেষে ছুটে আসে দোতলার বারান্দায়—আমি আত্মহত্যা করব— আই উইল কমিট সুসাইড। নাচের পুতুলের মতো ঝলঝলে নিরুপম রোলিং-এ ঝুলছে, পা দুটো ধরে আছে নিরুপমের বউ প্রাণপণে। পাশের বাড়ির তিনতলার ছাদে জ্ঞানবাবু ব্যায়াম করেন। তিনি দাবড়াচ্ছেন—তুই যদি লাফ মারিস নিরুপম, আর যদি তুই না মরিস, তাহলে তোকে আমি হাজতে পাঠাব হতচ্ছাড়া! এইবার বিশ্লেষণ করা যাক। এমন একটা ঘটনা না বলে থাকা যায়। এটা একটা নীতি গল্প। যাঁদের বললুম তাঁরা কী শিখলেন? না, মদ্যপান অত্যন্ত খারাপ কাজ। মদ মানুষকে অমানুষ করে। অনুশোচনায় আত্মহত্যার প্রবৃত্তি হয়। আর স্ত্রীর চেয়ে আপনজন কেউ নেই। সব শেষে, মরতে গিয়ে না মরলে পুলিশ ধরে। তাহলে, পরের চর্চা হল বটে; কিন্তু স্বাস্থ্যকর চর্চা। শিক্ষামূলক অবশ্যই। শ্রোতারা সচেতন হওয়ার সুযোগ পেলেন।
এইবার আর এক আসরে আমি যদি বলি, একালের শিক্ষিত ছেলেদের কথা আর বোলো না, লেখাপড়া শিখে জানোয়ার। ওই তো, সমর। বিলেত-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার। সো হোয়াট। বাপ মা নো হোয়ার। বউ নিয়ে পড়ে আছে সেপারেট ফ্ল্যাটে। গাড়ি চাপছে, বাড়ি করছে, হাওয়া খাচ্ছে, উইস্কি চলছে, আর বুড়ো বাপ পা টেনেটেনে পেনশন আনতে যাচ্ছেন। জিগ্যেস করলে বলবেন,—ছেলে! আমার কি কোন ছেলে ছিল বাবা! ছেলের স্বপ্ন ছিল। পরচর্চা হল; কিন্তু বহুত উপকারী পরচর্চা। বেশ কড়া মর্যালে মোড়া। শ্রোতাদের মধ্যে সমরের মতো কেউ থাকলে হুঁশিয়ার হবে। বড় বেদনার মতো বাজবে তার বুকে। সচেতন হবে। আত্মসমীক্ষা শুরু হবে—আমি কি আর একটা সমর হতে চলেছি। বয়স্ক থাকলে নড়েচড়ে বসবেন। জীবনের পরিণতি সম্পর্কে অবহিত হয়ে প্রস্তুত হবেন। মোহভঙ্গ হবে। মনে মনে কঠিন হওয়ার চেষ্টা করবেন। প্রত্যাশাকে হত্যা করে, মন্ত্র নেবেন— একেলা চলো রে!
পরচর্চা হল ছোটগল্পের মতো। একটা জায়গায় আলো ফেলে। যেকোনো একটা সত্যকে সামনে টেনে আনে। আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টা পরিষ্কার হয়। এক উদাহরণ অন্য আরও উদাহরণ টেনে আনে। বিষয়টা হল, মানুষ। মানুষের হরেক কাণ্ডকারখানা। আর একটা উদাহরণ।
মাঝবয়সে মাথা খারাপ হয়েছে বিমলের।
কেন?
আরে, তুই সংসার করেছিস। বড় বড় ছেলেমেয়ে। তুই কোন আক্কেলে আর একটা মেয়ে নিয়ে ঘুরিস।
ও মা, তা-আই। তুমি জানলে কী করে?
আরে, গাওয়া ঘিয়ে লুচি ভাজলে গন্ধ বেরোবেই।
মেয়েটা কে! মেয়েটা কে!
সে-ও এক জিনিস। ডিভোর্সি তবে হ্যাঁ! খাইয়ে। দেখলে ঘুম ছুটে যাবে। জ্যান্ত ফাঁদ।
তুমি দেখেছ বুঝি?
আমি না দেখে, না জেনে কারোর সম্পর্কে কিছু বলি না।
তুমি দেখলে কী করে?
আমার সঙ্গে একদিন আলাপ করিয়ে দিলে। আমরা একটা কাফেতে বসে অনেকক্ষণ ফ্যাফ্যা করলুম। মেয়েটা একসময় বারে নাচত।
এই পর্যন্ত শুনে আমার স্ত্রী আসর ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। এটা একটা ইঙ্গিত। এই চর্চাটা ত্রিশূলের মতো। তিনটে ক্ষত তৈরির ক্ষমতা রাখে। প্রথম হল, আমার স্ত্রীকে একটু আতঙ্কিত করা—অর্থাৎ, আমি অচল টাকা নই। আমিও বিমল হতে পারি, অতএব আমাকে কিঞ্চিৎ খাতির-যত্ন কোরো। তোমার ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে যেতে পারে পাখি। দ্বিতীয় খোঁচা, সুন্দরী, বেপরোয়া মেয়েদের নিয়ে সংসার ফাঁদতে হলে হিম্মত চাই, নয় তো ফস্কে যাবে। তৃতীয় খোঁচা নিজেকে—অর্থাৎ তোমারও পরকীয়ায় রুচি আছে। মনে মনে তুমিও বিমল হতে চাও। তোমার তৃষ্ণাও কম নয়। সর্বোপরি, মহাসত্য, পুরুষ আর নারী হল—ঘৃত ও অগ্নি। সামালকে চলো ভাই, নেহি তো গির যায়েগা। সেক্স একটা সিরিয়াস প্রবলেম। এই যেমন আমার চর্চার বিষয়, সেইরকম আমাকে নিয়েও চর্চা হয় অন্য আসরে। অনেকটা বেতার কেন্দ্রের মতো। অষ্ট প্রহর নানা ফ্রিকোয়েনসিতে আলোচনা চলেছে। বিভিন্ন স্টেশন আর ফিকোয়েনসি। একজন এসে বললে, প্রবাল সেদিন বলছিল, তুমি নাকি ভীষণ স্ত্রৈণ, স্ত্রীর পেট ডগ। শুনে ভীষণ খারাপ লাগল। ভাবলুম প্রতিবাদ করি, তারপর ভাবলুম, তোমার কাছে ব্যাপারটা আগে জানা দরকার।
আর একজন এলে বললে, নিত্য বলছিল, তুমি একজন কেরিয়ারিস্ট। নিজের কেরিয়ারের জন্য সব করতে পারো। তোমার মতো স্বার্থপর আর দুটো নেই।
তৃতীয় একজন এসে বললে, প্রসূন বলছিল, তুমি না কি মেয়েবাজ। যেখানেই মেয়ে সেইখানেই তুমি।
এই ভাবে যেসব বিশেষণের মালায় আমাকে সাজানো হয়েছে, তা হল স্বার্থপর, ওম্যানাইজার, ধার নিলে টাকা শোধ করি না।
আমার চরিত্র ছিল না। পরচর্চায় আমার একটা চরিত্র তৈরি হল। ওটা কী কম লাভ?