‘পয়োমুখম্‌’ – জগদীশ গুপ্ত

‘পয়োমুখম্‌’ – জগদীশ গুপ্ত

কলাপ সমাপ্ত হইয়া গেছে, মুগ্ধবোধ আরম্ভ হইয়াছে।

ভূতনাথের কথা বলিতেছি—

ভূতনাথ আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেছে; কিন্তু কলাপই বলুন, মুগ্ধবোধই বলুন, পাঠে তেমনি ভক্তি কি আগ্রহ তার নাই।…মাঝে মাঝে সে ঠোঁট উল্টাইয়া মুখ বিশ্রী করিয়া ব্যাকরণের দিকে চাহিয়া চুপচাপ বসিয়া থাকে।

ভূতনাথের পিতা কবিরাজ শ্রীকৃষ্ণকান্ত সেনশর্মা কবিভূষণ মহাশয় স্বয়ং পুত্রকে শিক্ষাদান করিতেছেন।

কিন্তু আরম্ভে একটু বিলম্ব ঘটিয়া গেছে—

ভূতনাথের বয়স গত অগ্রহায়ণে অষ্টাদশ উত্তীর্ণ হইয়া উনবিংশে পদার্পণ করিয়াছে।

…সন ১৩০১ সালে তার জন্ম।

ভূতনাথের মেধা কোনদিনই তার নিজের অলঙ্কারের কি গুরুবর্গের অহঙ্কারের বস্তু হইয়া উঠে নাই।

তা না হোক…

মেধা মানবজাতির পৈতৃক সম্পত্তি নয়; আর, ভগবান গৃহবিবাদে সালিশী করিতেও বসেন নাই যে, মামলা বাঁচাইতে ভাণ্ডারের সমস্ত মেধা সবাইকে নিক্তির তৌলে সমান করিয়া মাপিয়া দিবেন! কিন্তু মেধা না থাকার পিছুটানটা যাহার দ্বারা কাটাইয়া উঠিয়া মানুষের গতি-বেগ আর হৃদয়াবেগ সম্মুখের দিকে বাড়ে সেই অধ্যাবসায়ও ভূতনাথের নাই বলিলে অযথা বেশি বলা হয় না।

…তাই যোল-সতের বৎসর পর্যন্ত বিদ্যালয়ে তানানানা করিয়া কাটাইয়া সর্বাপেক্ষা সহজ বিদ্যা আয়ুর্বেদ আয়ত্ত করিতে বদ্ধপরিকর সে নিশ্চয়ই হয় নাই—সম্মত হইয়াছে।

শুভস্য শীঘ্রম্‌—

সেইদিনই কাঠের সিন্দুক খুলিয়া কৃষ্ণকান্ত কলাপ আর মুগ্ধবোধ বাহির করিয়া রৌদ্রে দিলেন।

ভূতনাথ বই দুখানাকে চিনিত—

তাহাদিগকে উঠানের রৌদ্রে পিঁড়ির উপর স্থাপিত দেখিয়া সে আর যাহাই হউক খুশি হইল না।

…বই দুখানির দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া ভূতনাথ ফস করিয়া যে কথাটি বলিয়া ফেলিল, তার মান কেহ রাখিল না।…

কথাটা কানে যাইবার পর কৃষ্ণকান্ত বক্রদৃষ্টিতে একবার ভূতনাথের দিকে চাহিয়া নিঃশব্দে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন—

ভূতনাথ সরিয়া গেলেই গৃহিণীকে গল্পটা শুনাইয়া দিবেন।

এবং সে অবসর তখনই মিলিল।

কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, তোমার ছেলের বুদ্ধি শেষ পর্যন্ত বলদ দিয়ে টানাতে হবে দেখছি—ঠিক সেই রকম। —বলিয়া গম্ভীর হইয়া গেলেন।

মাতঙ্গিনী বলিলেন, কি রকম?

এক ছোঁড়াকে পাঠিয়েছে—

কে?

কোন গেরস্ত। একটা গল্প বলছি। পাঠিয়েছে দোকানে এক পয়সার বাতাসা আনতে। দোকানী দিলে; ছোঁড়া গুণে বললে, মোটে পাঁচখানা?— দোকানী ক্ষেপে উঠে বললে, পাঁচখানা নয় তো কি পঁচিশখানা দেবে? ঘিয়ের দর জানিস আজকাল? …ছোঁড়া লজ্জা পেয়ে চলে এল। …বাড়িতে বললে, কিরে, মোটে পাঁচখানা বাতাসা এনেছিস এক পয়সায়? ছোঁড়া বললে, তাই দিলে, মা। বললুম, তা দোকানী তেড়ে উঠল; বললে, ‘ঘিয়ের দর জানিস আজকাল?’…শুনে গিন্নির হাত গালে উঠে গেল; অবাক হয়ে বললেন, কি বজ্জাত দোকানী গো! ঘিয়ের দর বেড়েছে তাতে বাতাসার কি বলিয়া তুমুল শব্দে খানিকটা হাসিয়া লইয়া কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, তোমার ভূতোর বুদ্ধি সেই ছোঁড়ার মত, কার্য-কারণ-সম্বন্ধ-জ্ঞান একেবারে নেই।

কিন্তু মাতঙ্গিনী হাসিতে পারিলেন না—

পুত্রের অজ্ঞানতার উদ্দেশে স্বামীর এই বিদ্রুপে বিমর্ষ হইয়া কহিলেন, কি, করেছে কি?

বলছে, পড়ব কবরেজী, তাতে ব্যাকরণের কি দরকার।

কৃষ্ণকান্ত না হাসিয়া বলিলেন, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র খাঁটি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত …ব্যাকরণের পর সাহিত্য, কাব্য, অলঙ্কার, ন্যায় প্রভৃতি; তারপর শাস্ত্র—

ভূতনাথ মনে মনে বলিল, কচু।

কৃষ্ণকান্ত অন্ত্যর্যামী নন—ভূতনাথের কচুর কথাটার টেরও পাইলেন না; বলিতে লাগিলেন, কাজেই সংস্কৃত হৃদয়ঙ্গম করতে হলে ব্যাকরণে ব্যুৎপত্তি হওয়া আগে দরকার। ইত্যাদি।

দরকারী কথার কত ভাগের কত ভাগ তার কানে গেল তাহা ভূতনাথ নিজেই জানিতে পারিল না। ঘাড় গুঁজিয়া দাঁড়াইয়াছিল, কৃষ্ণকান্তের মুখের শব্দ বন্ধ হইতেই সেদিককার কর্তব্য শেষ হইয়াছে মনে করিয়া সে আপন কাজে গেল। …

কিন্তু ভূতনাথ মাঝে মাঝে মায়ের কাছে নালিশ করে, এ-গাছের পাতা, ও-গাছের মূল, এটার ছাল, ওটার কুঁড়ি, এই নিয়ে তো কবরেজের কারবার: তা করতে মুগ্ধবোধ পড়ে কি হবে? —বলিতে বলিতে অত্যন্ত মানসিক শ্রান্তির লক্ষণগুলি তার সর্বশরীরে প্রকাশ পায়।

মাতঙ্গিনী বলেন, আমি তো কিছু জানেনে রে। …

যাহা হউক, শাস্ত্রাধ্যয়নের উপক্রমণিকা অনাসক্ত গয়ংগচ্ছভাবে চলিতে লাগিল; —এবং পবিত্র শাস্ত্ৰসৌধের প্রথম সোপানে দাঁড়াইয়া সে জীবনের এমন একটা দরকারী কাজ শেষ করিয়া আনিল যাহার ফল প্রতিফল দুটোই নিরেট।…দুস্তর কলাপের প্রস্তর চর্বণের চাইতে তা ঢের সংক্ষিপ্ত ও সরস—

উদ্দেশ্যও উচ্চদরের—

শুধু সনাতন শাস্ত্রীয় প্রথার নরকনিবারক পুত্র লাভ।…ভূতনাথ বিবাহ করিল, তখন তাহার বয়স সতের বৎসর কয়েক মাস মাত্র—

স্ত্রী মণিমালিকা ন’বছরের—

পণ সর্বসাকুল্যে সাতশত টাকা মাত্র।

কলাপের সঙ্গে পাত্রের নিষ্ঠাহীন আলাপচারীতে পরের ঘরের অতগুলি টাকা আদায় হয় না…

বিবাহের পূর্বে কৃষ্ণকান্ত কিঞ্চিৎ বিষয়-বুদ্ধির আশ্রয় লইলেন..বৈবাহিক মহলে প্রচার করিয়া দিলেন, ভূতনাথ কলিকাতার বিখ্যাত প্রবীণ কবিরাজ শ্রীগোলকৃষ্ণ দত্তগুপ্ত মহাশয়ের প্রিয়তম ছাত্র…ব্যাকরণ ও সাহিত্য প্রভৃতি সমাপ্ত করিয়া মূলশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেছে। …আরো বলিলেন, দু’তিনটি পাশকরা ছেলের মূল্য এখন মাসিক বিশ বাইশ টাকার অধিক নয়; আয়ুর্বেদের দিকে দেশের নাড়ীর টান যথার্থই ফিরিয়াছে; সুতরাং পশার দাঁড়াইয়া যাইতে বিলম্ব হইবে না; দু-তিন বছরেই—ইত্যাদি।

তাই সাতশত টাকা পণ।

কৃষ্ণকান্ত নিজে দাঁড়াইয়া থাকিয়া ভূতনাথকে দিয়া ঔষধ প্রস্তুত করান—তৈল, ঘৃত, রসায়ন, অরিষ্ট, আসব—বিবিধ রোগবিকারের শাস্ত্রোক্ত বিবিধ ঔষধ। কৃষ্ণকান্ত কাছে-কিনারায় যখন রোগী দেখিতে যান, তখন ভূতনাথকে সঙ্গে লইয়া যান।…পথে আসিতে আসিতে বুঝাইয়া দেন—রোগলক্ষণ; কোন্ রসাধিক্য কোন্ রোগের হেতু, কী ভাবে তার বিস্তৃতি ও নিবৃত্তি।…পিত্ত শ্লেষ্মা, বায়ুর কোনটা কুপিত হইয়া এই রোগীর রোগ কিভাবে জটিল করিয়া তুলিয়াছে। …এমনি সব ভূয়োদর্শনের কথা।

ভূতনাথ গাছগাছড়া, ফল-মূল কিছু-কিছু চিনিয়াছে; তাহাদের গুণাবলী ও প্রয়োগ-বৈচিত্র্যের সঙ্গেও কিছু কিছু পরিচয় ঘটিতেছে।

মণি ছোট্টটি—

স্বামীর সঙ্গে তার ভাব হইয়াছে।

ভূতনাথ মণিকে রাগায়, কাঁদায়, আবার খিলখিল করিয়া হাসায়ও।… মাঝে মাঝে মণি যখন বাপের বাড়ির কথা ভাবিয়া মুখ ভার করিয়া থাকে তখন তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া সদুপদেশও দেয়; বলে, এই তোমার আপন বাড়ি।

কিন্তু অবুঝ মণি হঠাৎ অতটা উদার হইয়া উঠিতে পারে না; বলে, ধেৎ। এ তো তোমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ি—

ভূতনাথ বলে, তা বটে। কিন্তু তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে, সে-বাড়ি তোমার দাদা-বৌদির, এই বাড়িই তোমার; তারপর ছেলেপিলে হলে—

মণি এবার লজ্জা পাইয়া হাসে…

বলে, ধেৎ।

মণির দু’বারকার দুটি ভর্ৎসনার কত তফাৎ ভূতনাথ তা বোঝে—

খুশি হইয়া উঠিয়া যায়।

ভূতনাথের ছোট ভাই দেবনাথ ঘরে ঢুকিয়া বলে, তুমি বৌদি না ছাই! বলিয়া বুড়ো আঙুল দেখায়।

মণি কথা কহে না।

দেবনাথ বলে, বললুম দুটো আম ছাড়াও, নুন লঙ্কা মেখে খাই; তখন কথাই কওয়া হল না। এখন দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছে আর সোয়াগের হাসি হচ্ছে। এই বয়সেই শিখেছ ঢের!…

মণির কিন্তু মনেও আসে না যে, এই বয়সে দেবনাথও শিখিয়াছে ঢের!

বেশ, বেশ, চল দিচ্ছিগে। —বলিয়া মণি লাফাইয়া ওঠে।

মণির জ্বর হইল।

উজ্জ্বল মণি ম্লান হইয়া গেল।…

কৃষ্ণকান্ত নাড়ী দেখিয়া বড়ি দিলেন; তাহাতে জ্বর ছাড়িল বটে, কিন্তু প্রাণরক্ষা হইল না…

শেষ রাত্রি হইতে হঠাৎ ভেদ আরম্ভ হইয়া বেলা দুটার সময় মণির নাড়ী ছাড়িয়া গেল।…সীঁথিভরা সিঁদুর লইয়া লালপেড়ে শাড়ি পরিয়া, আলতায় পা রঞ্জিত করিয়া খেলার পুতুল একরত্তি মণি কাঠের আগুনে পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল।

মাতঙ্গিনী চোখের জল মুছিয়া স্বামীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন; বলিলেন—হ্যাঁগো, এক ফোটা ওষুধও তো দিলে না…

কৃষ্ণকান্ত বড় বিজ্ঞ; তাই গৃহিণীর দিকে চাহিয়া ভ্ৰূভঙ্গি করিয়া বলিলেন, দিলেও ফল হত না, বুঝেই দিইনি। যম যে ব্যাধি পাঠায় তাকে আমরা দেখেই চিনি—

আয়ুর্বেদের এই চরম দিব্যদৃষ্টির বিষয় মাতঙ্গিনী কৃষ্ণকান্তের এতদিনের স্ত্রী হইয়াও বিন্দুবিসর্গও জানিতেন না।…চোখে আঁচল দিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন।

মণির স্মৃতি মুছিবার নয়…

এখনো যেন সে মাটিতে আঁচল লুটাইয়া উঠানময় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে…

‘মা মা’ বলিয়া আপন পেটের মেয়েটির মত অনুক্ষণ সে পায়-পায় ঘুরিত।…সে যে ছেলেমানুষ ইহা কেমন করিয়া ভুলিয়া যাইয়া তিনি মণির কাজের ভুল ধরিয়া ধমক দিতেন। মণির মুখখানি বিষণ্ণ হইয়া উঠিত…এই ম্লান, এই উজ্জ্বল…পরক্ষণেই সে ‘মা’ বলিয়া ঘেঁসিয়া আসিত…

মাতঙ্গিনীর বুক ফাট্‌ ফাট্‌ করে।

ভূতনাথও কাঁদিল বিস্তর; কলাপ কিছুদিন রোগীর প্রলাপের মত অসহ্য হইয়া রহিল।

সংসারে শোকতাপ আছেই—

আবার ‘ভগবদেচ্ছায়’ মানুষ শোকতাপ ভুলিতেও পারে।…দিন দিন দূরত্ব বাড়িতে বাড়িতে মণির শোক কৃষ্ণকান্তের ‘ভগবদেচ্ছায়’ গৃহ হইতে একেবারে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

ভূতনাথ পুনরায় কলাপে মন দিল।

কৃষ্ণকান্ত ভূতনাথের পুনরায় বিবাহ দিলেন। বলিলেন, স্বয়ং শিব দুবার বিবাহ করিয়াছিলেন।… কিন্তু অশৌচমুক্তির পর অষ্টাহের মধ্যে শিবের পাত্রী স্থির হইয়া গিয়াছিল কিনা তাহা তিনি উল্লেখ করিলেন না।…

এবার পণ, পাঁচশত টাকা…কিছু লোকসান গেল।

মণি মরিয়া পাত্র হিসাবে ভূতনাথের জীবনে খাদ মিশাইয়া দিয়া গেছে; বৈবাহিক মূল্যের কিছু লাঘব হইয়াছে, তাই কৃষ্ণকান্তের দুইশত টাকা—

কিন্তু বৌটি এবার আরো ভাল…

চমৎকার একটা সুহসিত প্রসন্ন লক্ষ্মীশ্রী অনুপমার মুখপদ্মে বিরাজ করিতেছে—

যেন ‘বালার্কসিন্দুরশোভিত’ উষা…সেই দিকে চাহিয়া মাতঙ্গিনীর চোখের পলক পড়িতে চাহে না…অনুপমা শ্বশুর দৃষ্টির অর্থ বুঝিয়া মুখ ফিরাইয়া হাসে।

মাতঙ্গিনী ঘুরিয়া ফিরিয়া আসিয়া বধুর মুখের উপর একবার করিয়া চোখ বুলাইয়া যান…যেন তাঁর চতুর্দিকেই খর রৌদ্র…তার ঝাঁজে চক্ষু পীড়িত হইয়া ওঠে…তাই বধুর রূপের শীতাঞ্জন তিনি বারম্বার চোখে মাখাইয়া লইয়া যান।

কিন্তু অদৃষ্টে তাঁর দুঃখ লেখা ছিল—

তাই একদিন আহ্লাদে গদগদ হইয়া মাতঙ্গিনী মনের কথাটাই বধূকে বলিতে গেলেন; কিন্তু কথাটা সুস্পষ্ট না হওয়ায় ফল উল্টা দাঁড়াইয়া গেল।…

বৌমার খাসকামরায় যাইয়া মাতঙ্গিনী হাসিতে হাসিতে বলিলেন, বৌমা, তোমার আর বাপের বাড়ি যাওয়া হবে না বাপু।

অর্থাৎ তোমার ওই মুখখানিকে আর চোখের আড়াল করছিনে…

কিন্তু বৌমা অন্তর্যামিনী নয়।

শাশুড়ীর অভিলাষ শুনিয়া অনুপমা তার অনুপম চক্ষু দুটি তুলিয়া সোজা মাতঙ্গিনীর দিকে চাহিল, এবং মাতঙ্গিনীর আশা-আকাঙক্ষা-আহ্লাদ ঘূর্ণীবায়ুর মত আবর্তিত হইতে হইতে কোথায় যে মিলাইয়া গেল তার চিহ্নও রহিল না।… সে দৃষ্টির অর্থ যে কি…প্রাণভরা কিন্তু অপ্রকাশিত আশার পরেই এ যে কত কঠিন নিরাশ্বাস—উগ্র মনের কতখানি উত্তাপ যে ওই মুখখানির স্নিগ্ধ আবরণ ছাপাইয়া নিষ্পলক দৃষ্টির পথ ধরিয়া বাহির হইয়া আসিয়াছে…তাহা শুধু অনুভব করে মানুষের অঙ্গুঠপ্রমাণ প্রাণপুত্তলী।

মাতঙ্গিনীর প্রাণ বধূর সেই দৃষ্টির অগ্নিবর্ষণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল।…

মাতঙ্গিনী সামলাইয়া লইয়া বলিলেন, কিছু মনে কোর না, মা; তোমার মুখখানি—

কথা কয়টি উচ্চারিত হইয়াই অশ্রু-বেদনায় তাঁর কণ্ঠ অবরুদ্ধ হইয়া গেল।

একান্ত আপনার জ্ঞানে নূতন বধূর প্রতি এই তাঁর প্রথম অসঙ্কোচ মুক্তপ্রাণ সম্ভাষণ।

বুকভরা সোহাগের আরো কত কথা বলিবার ছিল—

পাষাণী তাহা বলিতে দিল না।

মাতঙ্গিনীর মনে হইল, আশাভঙ্গের এই ব্যথাটা তিনি জন্মান্তরেও ভুলিতে পারিবেন না।…কিন্তু ভুলিলেন; এবং ভুলিতে তাঁহাকে জন্মান্তরে পৌঁছিতে হইল না।…দিন তিনেকের মধ্যেই তাঁহার মাতৃহৃদয় অজ্ঞান সন্তানের সুকঠিন অপরাধ মার্জনা করিয়া তাহাকে পুনরায় তার উদার অঙ্গনে বরণ করিয়া লইল।

ভূতনাথ কলাপ সমাধা করিয়া এখন মুগ্ধবোধ আরম্ভ করিয়াছে।…পিত্ত, বায়ু, কফ—ইহাদের কোন্‌টার প্রাবল্য কোন্‌ নাড়ীতে প্রকট হয় পিতার উপদেশে তাহাও যেন সে অল্প অল্প হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছে।

কিন্তু অনুপমা নাক সিটকায়—

বলে, কবরেজী পড়ে কি হবে শুনি?

ভূতনাথ বলে, কবরেজী তো আজকাল বেশ মানের কাজ হয়েছে। পয়সাও—

তা জানি। কলকাতায় গিয়ে বসতে পারবে?

ভূতনাথ যেন অপ্রস্তুতে পড়ে; বলে, দেশেও তো বেশ পয়সা আছে।

আমাদের সেই বনমালী কবরেজের মত কবরেজ হবে তো? তার তো নেংটি ঘোচে না। আমরা তাকে বলি বোক্‌রেজ মশায়। —বলিয়া অনুপমা খিলখিল করিয়া হাসে।

ভূতনাথ মর্মাহত হয়।

কবিরাজীকে সে নিজেও বড় শ্রদ্ধার চক্ষে দেখে না; জঙ্গল কাটা আর শুকনো কাঁচা জঞ্জাল জড়ো করা কবিরাজী যে হালফ্যাসনের খুব বড় একটা গর্বের জিনিস ইহাও সে মনে করে না; তবু কবিরাজই সে হইবে!…অদৃষ্টের লিখন তাই—

তাই নিজের স্ত্রীর মুখে সেই কবিরাজীর প্রতিই অপার অবজ্ঞার কথা শুনিয়া সে সত্যকার ক্লেশই পায়।

কিন্তু অনুপমা মণি নয়—

অনুপমাকে ধমক দিলে ধমকের প্রতিধ্বনি যাহা সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়া আসিবে তাহা মূল ধ্বনিকে বহু নিম্নে রাখিয়াই আসিবে তাহা সে বেশ জানে।

অনুপমা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া থাকে; ভূতনাথ চলিয়া আসিতে পা তোলে। অনুপমা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, তোমার নাম রেখেছিল কে?

বাবা রেখেছিলেন।

নামের মানে তো মহাদেব, নয়? বলিয়া অনুপমা হাসিয়া আকূল হইয়া যায়।

সম্মুখে হাসির মুক্তধারা—

উদ্ভিন্ন নিটোল যৌবন—

মুক্তামালার মত দন্তপাঁতি—

আরক্ত গণ্ডতট—

ফুল্ল অধরপুট…

কিন্তু ভূতনাথ ঘামিয়া অস্থির হইয়া ওঠে।…

ঠিক সে ধরিতে পারে না, কিন্তু তাহার মনের দুয়ারে কেমন একটা দুঃসংবাদ আসিয়া পৌঁছায়…অন্তরের অতি সুকোমল স্থানে সুতী কাঁটার মত একটা ব্যথা ফোটে…কাহার প্রচ্ছন্ন কায়ার নিষ্ঠুর একটা কালো ছায়া বুক জুড়িয়া পড়ে…চারিদিক অশ্রু-কলঙ্কে মলিন হইয়া ওঠে…

ভূতনাথ উঠিয়া পড়ে; ধরা গলায় বলে,—আসি এখন।

অনুপমা বলে, দন্তচুর্ণ পাকে চড়িয়ে এসেছ বুঝি? তা এস।

মাতঙ্গিনী ছেলের কাতর মুখ দেখেন—

তাঁর সর্বজ্ঞ মাতৃহৃদয়ের কাছে ভিতরের অনন্ত দুঃখের বাতাটি ষোল আনাই আসে…

মনটি তাঁর লুটাইয়া লুটাইয়া ভগবানের পা ধরিতে ছোটে…

কৃষ্ণকান্ত একদিন প্রকাণ্ড এক টাকার তোড়া সিন্দুকে তুলিয়া মাতঙ্গিনীকে ডাকিয়া বলিলেন, বৌমাকে বিশেষ যত্ন আত্তি করো। ওঁর লক্ষ্মীর অংশ প্রবল।

মাতঙ্গিনী টাকার তোড়াটা দেখেন নাই, হঠাৎ কথাটা বুঝিতে না পারিয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, এবার পাটে দু’ হাজার টাকা মুনাফা হয়েছে। …তাঁর তখনকার তৃপ্তিটুকু উপভোগের জিনিস—

দেবনাথ সেখানে উপস্থিত ছিল; মাতঙ্গিনী কিছু বলিবার পূর্বেই সে বলিয়া উঠিল, মণি বৌ-ই ছিল ভাল; এ একটা কি এনেছ দাদাকে বিয়ে দিয়ে! ভুরু তুলেই আছে! দেমা—।

কৃষ্ণকান্তের হাতের এক চড় খাইয়া দেবনাথের অনধিকার চর্চা বন্ধ হইয়া গেল।

পুত্রবধূতে লক্ষ্মীর অংশ প্রবল হইলেও কৃষ্ণকান্তের মুনাফার টাকা পর বৎসরই ওই পাটের টানেই বাহির হইয়া গেল…

অনুপমার জ্বর হইয়াছে—

জ্বর অল্পই…

কিন্তু অনুপমা লাথি ছুঁড়িয়া, কিল ঘুড়িয়া, কাঁদিয়া, বায়না লইয়া, বাটী আছড়াইয়া, ঔষধ, পথ্য ফেলিয়া দিয়া এমন কাণ্ড বাধাইয়া তুলিল যেন লজ্জা-সরম আর সহিষ্ণুতা বলিয়া সংসারে কোন জিনিসই নাই। …তাহার কাছে ধমক না খাইল এমন লোক নাই…মাতঙ্গিনী পথ্য দিতে আসিয়া অকথ্য অপমানিত হইয়া গেলেন। ভূতনাথ চড় খাইতে খাইতে বাঁচিয়া গেল…দেবনাথের দিকে তো সে পা-ই তুলিল।—

যাহা হউক, বহু তাণ্ডব কাণ্ড দেখাইয়া জ্বর ছাড়িয়াছে; অনুপমা অন্নপথ্য করিয়াছে; কিন্তু সেইদিনই ভোররাত্রে ভেদ আরম্ভ হইয়া বিকাল নাগাদ তার ধাত্ বসিয়া গেল। অনুপমা মণিমালিকার অনুগমন করিল।

মণি মরিয়াছিল, বৈশাখের কাঁচা আম খাইয়া; অনুপমা মরিল, অজীর্ণ রোগের উপর জিদ্‌বশে অতিরিক্ত গুরুপাক দ্রব্য উদরস্থ করিয়া।…মাতঙ্গিনী কাঁদিলেন, ভূতনাথ কাঁদিল, দেবনাথও কাঁদিল। কৃষ্ণকান্ত প্রতিবেশীগণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বম্বার চক্ষু মার্জনা করিয়া শোক-চিহ্ন গোপন করিতে লাগিলেন। বলিলেন, বড়ো জেদী…একগুঁয়ে মেয়ে ছিল, ভাই…

ভূতনাথ নূতনতর একটা আঘাত পাইল, মণির মৃত্যুতে যাহা সে পায় নাই।

মণি তার যৌবনের সহচরী হইয়া উঠে নাই…সে ছিল খেলার সামগ্রী, স্নেহের জিনিস, মিষ্ট দৌরাত্ম্যের পাত্রী।

অনুপমার নিরুপম রূপ-দীপালির চতুর্দিকে যৌবনের যে রাস-আয়োজন দিন-দিন অপর্যাপ্ত নিবিড় হইয়া উঠিতেছিল, তাহারই আবেদন তাহার বুকে, রক্তে দুর্নিবার জাগরণ আনিয়া দিয়া গেছে।…অনুপমার সমস্ত অকারণ নির্মমতা অতৃপ্ত খরতাপে বাষ্প হইয়া দেখিতে দেখিতে ভূতনাথের মনোরাজ হইতে অদৃশ্য হইয়া যাইত…চক্ষুর সম্মুখে জ্বলিতে থাকিত তার দেহখানা—ইন্দ্রজালের আলোকোৎসবের মত রূপ, আর চির-বিলসিত বসন্তের কুসুমমাৎসবের মত যৌবন…তাহাদের অভাবে ভূতনাথের ভূত ভবিষ্যৎ আর বর্তমানের দিগন্ত পর্যন্ত একেবারে রুক্ষ শুষ্ক কর্কশ হইয়া গেছে।…

ভূতনাথের কলাপ, মুগ্ধবোধ এবং পরবর্তী অন্যান্য গ্রন্থ তাড়াতাড়ি কাজ সারিয়া আলমারিতে যাইয়া উঠিয়াছে।…এখন সে পুরাপুরি একজন কবিরাজ।—

কিন্তু বিবাহে তার আর ইচ্ছা নাই।—

কৃষ্ণকান্ত পুত্রের আচরণে দিন-দিন অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছেন; এইভাবে আর কিছুদিন চলিলেই সংসারের উপর তাঁহার আর কিছুমাত্র মার্জনার ভাব থাকিবে না—এ ভয়ও তিনি স্পষ্টই দেখাইয়া বেড়াইতেছেন।…

…স্ত্রীই হইয়াছে আজকালকার লোকের যেন মহাগুরুর সেরা; একটির নিপাতেই সে-সম্পর্কে আর কাহাকেও যেন গ্রহণ করা যাইতে পারে না।…

আগেকারটা?—সেটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।

…চলাচলম ইদং সর্বম—মরিবে তো সবাই, দুদিন আগে, দুদিন পরে। মূর্খ আর বলে কাকে!…স্ত্রী মারা গেলে তার ধ্যানেই যাবজ্জীবন কাটাইয়া দিতে হইবে—ইহা কোন্ শাস্ত্রের কথা!…এই সৌখিন সন্ন্যাসের ভান আধুনিকতার ফল, যেমন ব্যাপক, তেমনি অসহ্য। মানুষ মরে বলিয়াই তো পৃথিবীতে মানুষের স্থান হয়; নতুবা এতদিন মানুষকে দলে দলে যাইয়া সমুদ্রে ঝাঁপাইয়া পড়িতে হইত!..

কিন্তু ভূতনাথ একেবারে নিস্পৃহ।

ধিক্কারে, ভর্ৎসনায়, অভিযোগে, অনুযোগে, দোহাইয়ে, অনুজ্ঞায়, অনুনয়ে কৃষ্ণকান্ত ভূতনাথকে ঘন-ঘন নাস্তানাবুদ করিয়া ছাড়িয়া দিতে লাগিলেন।

প্রত্যুত্তরে ভূতনাথ বলে, —বাবা, আমায় মার্জনা করুন; বিবাহে আর আমার রুচি নাই; বরং দেবনাথকে ধরুন; সে-ই সকল বিষয়ে আপনাদের সাধ পূর্ণ করবে।…

কৃষ্ণকান্তকে এসব কথা বলা বাহুল্য; কাহার দ্বারা তাঁহাদের সাধ আশা পূর্ণ হইবে তাহা তিনি পরিষ্কার জানেন।…তবে কথা এই যে, ভূতনাথকে ছাড়িয়া দেবনাথকে ধরিতে তাঁর আপাতত তেমন আগ্রহ নাই—নানা কারণে।…দেবনাথের বিবাহের পরই ভূতনাথের বিবাহোদ্যম এ-ক্ষেত্রে সূক্ষ্মত দৃষ্টিকটু না হইলেও, ভূতনাথই অবশেষে আপত্তির এই অতিরিক্ত কারণটা দেখাইয়া যখন তখন বিরুদ্ধ দিকে জোর করিতে পারিবে।…

তারপর, এই কারণেই, পাত্রের বয়স খুব অল্প হইলেও, কন্যার দিক হইতে বয়স সম্বন্ধেই সন্দেহের একটা কথা উঠিতে পারে। দুইটি স্ত্রী মারা গিয়াছে, তারপর কনিষ্ঠের বিবাহ হইয়া গেছে, তারপর জ্যেষ্ঠের জন্য এই উদ্যোগ…বয়স বেশি না হইয়াই যায় না; এই সূত্র ধরিয়া পণকে আরও খাটো করিবার জন্য একটা টানাটানি চলিতে পারিবে।…

সুতরাং কৃষ্ণকান্ত প্রকাশ্যে বলিলেন, জ্যেষ্ঠ অকৃতদার অর্থাৎ বিপত্নীক অবস্থায় থাকতে কনিষ্ঠের বিবাহসংস্কার শাস্ত্র এবং লোকাচার দুইয়েরই বিরোধী প্রচণ্ড অকল্যাণকর একটা ব্যাপার।

তারপর বলিলেন,—এ তো নির্বোধেও জানে।

দ্বিতীয়ত, ভূতনাথের গর্ভধারিণীর স্বাস্থ্য আজকাল ক্রমশই যেরূপ দ্রুতবেগে খারাপের দিকে যাইতেছে, তাহাতে তাঁহাকে এইবেলা একটা সহকারী না দিলে তাঁর মৃত্যু ঘটিতেও পারে।…

তৃতীয়ত, শ্মশানবৈরাগ্য যৌবনের অপরিহার্য একটা ধর্ম হইলেও, সেইটাকেই জীবনে স্থায়ী করিয়া লইয়া প্রাণপণে তাহাকে পালন করিয়া যাইতে হইবে এ ব্যবস্থা গো-মূর্খেও দিবে না।…

চতুর্থত—যাক, উহারাই কি যথেষ্ট নহে?

মাতঙ্গিনী কিছু বলেন না।

যম তাঁহাকে দু-দুবার দাগা দিয়াছে—

তাঁর বধূ-জীবন আর মাতৃ-জীবনের চির-লালিত আকাঙ্ক্ষাটি সেই নিষ্ঠুর উপড়াইয়া লইয়া পায়ে দলিয়া দিয়াছে…সেই বিবর্ণ অকালে হৃদয়চ্যুত প্রিয়তম বস্তুটির দিকে চাহিয়া তাঁহার বুক কাঁপে। …নিজের ক্লেশ ভুলিয়া তিনি পুত্রের কথাই ভাবেন…সে বুঝি অসুখী হইবে।…

সেদিকে নিস্তার পাইয়াও ভূতনাথ পিতৃদেবের অবিশ্রান্ত তাড়নায় মরিয়া হইয়াই একদিন বলিয়া দিল, যা ইচ্ছে করুন…

বলিয়া সে বোধ হয় কাঁদিতেই উঠিয়া গেল।

উল্লাসের বিস্তৃত হাসিতে কৃষ্ণকান্তের মুখমণ্ডল ভরিয়া উঠিল।

পণ ও পাত্রী ঠিকই ছিল—

দু-দশদিন অগ্রপশ্চাৎ কৃষ্ণকান্ত দুটিকেই ঘরে তুলিলেন।

পণ আটশত টাকা।

ভূতনাথের বৈবাহিক জীবনে আরো খানিকটা খাদ মিশিলেও, পাত্রীর রং ময়লা বলিয়া খাদের কথা ও-পক্ষকে কৃষ্ণকান্ত বিন্দুমাত্রও তুলিতে দিলেন না।

বীণাপাণির রং সুবিধার নয়, কালোই। সুবিধার মধ্যে তার চক্ষু দুটি আর ভ্রূযুগল; ভুরু দুটি টানা টানা; চক্ষু দুটি আবেশে ভরা।

মাতঙ্গিনীর নিজের সুখ-দুঃখ কোনদিনই তাঁর অন্তরের একান্ত নিজস্ব জিনিস হইয়া উঠিতে পারে নাই,…জলের উপর পদ্মপত্র যেমন ভাসে তেমনি করিয়া মাতঙ্গিনীর সর্বান্তঃকরণ সংসার-পাথারের বুকের উপর ভাসিয়া বেড়ায়…পাথারে ঘা লাগিলেই তাঁর বুক দুলিয়া উঠে।

মাতঙ্গিনী চোখে জল আসিতে দিলেন না—

স্বামী তৃপ্ত হইবেন,

পুত্র প্রীত হইবে,

অম্লানবদনে তাই তিনি বীণাপাণিকে তেমনি সোহাগে বরণ করিয়া লইলেন; এবং তাঁহারই হৃদয়ের গাঢ় রসে নববধু নূতন ভূমিতে পল্লবিত হইয়া উঠিতে লাগিল।

কৃষ্ণকান্ত বলেন, বেী কেমন হয়েছে গো?

মাতঙ্গিনী বলেন, লক্ষ্মীটি।

কৃষ্ণকান্তের মনে পড়ে—বিগত দুটির সম্পর্কেও মাতঙ্গিনী ধনধান্যদায়িনী ওই দেবীটিরই নামোল্লেখ করিয়াছিলেন।…একটা গল্প তাঁর মনে পড়িয়া যায়—

কোথাকার এক তাঁতি…

কিন্তু গল্পটি তাঁর বলা হয় না—মাতঙ্গিনীর দীর্ঘনিশ্বাসের ছোট্ট একটি অস্ফুট শব্দ তাঁর কানে আসে।

দেবনাথ বলে, এই বৌদিই আসল বৌদি। আগের দুটো ভাল ছিল না।…একটু থামিয়া আবার বলে, প্রথমটা ছিল নেহাৎ ছোট—গরজ বুঝত না। তার পরেরটা ছিল বদমেজাজী। এইটে বেশ…

মাতঙ্গিনীর প্রাণ ছাঁৎ করিয়া ওঠে; বলেন, বেশ কিসে রে?

কথায় বার্তায় আলাপে আদরে বেশ।

শুনিয়া, প্রখর মধ্যাহ্নের উপর মেঘের চঞ্চল ছায়ার মত, মাতঙ্গিনীর বুকের ভিতর দিয়া কিসের একটা সুখকর সুশীতল মৃদুস্পর্শ ভাসিয়া যায়। …কিন্তু পরক্ষণেই তিনি চমকিয়া ওঠেন।…সারাজীবন ভরিয়া শুধু মানুষকে আপন করিয়া তুলিয়া তিনি দিনান্তের বহু পূর্বেই তাহাকে বিসর্জন দিয়া আসিয়াছেন…তবু আপন করিয়া লইবার মহালোলুপতা তাঁর আজিও তেমনি জাগ্রত…মাতৃ-হৃদয়ের সে-ক্ষুধা যম হরণ করিতে পারে নাই।…প্রাণপণে সেই ক্ষুধাটিকে দমন করিবার চেষ্টা তাঁর আসিয়াছে।…কিন্তু এ যে কথাবার্তায় আলাপে-আদরে বেশ।

ভূতনাথ মণিকে হাত ধরিয়া টানিয়া কাছে লইত—

তার ঘোমটা লইয়া কাড়াকাড়ি করিত—

কত খেলা, কত আমোদ, কত কৌতুক।…

অনুপমাকে সে লুকাইয়া দেখিত, হঠাৎ দেখা দিত। নিজেকে সহস্র চতুর অভাবনীয় উপায়ে তৃপ্ত করিবার লালসায় সে ছট্‌ফট্‌ করিয়া বেড়াইত।

কিন্তু বীণাপাণির কাছে সে আসে শান্ত হৃদয়ে…ঝড়ের পর ঢেউ আপনি থামিয়া স্রোতের অন্তর ব্যাপিয়া শুধু একটা নিঃশব্দ ক্ষিপ্রতা রহিয়াছে।

বীণাপাণি জানে, স্বামী পূর্বে দুবার বিবাহ করিয়াছিলেন। স্ত্রী দুটিই সুন্দরী ছিল।

সে কালো।

মাতঙ্গিনী দুরু দুরু বুকে ভাবেন, ছেলে অসুখী না হয়।

তাঁর মনের দুশ্চিন্তা মনেই পরিপাক পাইতে পাইতে সহসা এক সময় দুঃসহ হইয়া শুধু একটি প্রশ্নেই আত্মপ্রকাশ করিতে চায়।…বলেন, সব জানো তো বৌমা, আগেকার কথা?

বীণাপাণির বুঝিতে কিছুই বাকী থাকে না। বলে, জানি, মা।…তারপর মনে মনে বলে, আমি যে কালো।

মাতঙ্গিনী তার মনের কথা কী করিয়া টের পান বীণাপাণি তা জানে না; তার মুখচুম্বন করিয়া বলেন, মা আমার কালো; কিন্তু কালোতেই কেমন মানিয়েছে।

এটা সান্ত্বনার কথা—

শাশুড়ীর এই মমতার্দ্র ছলনায় বীণাপাণি একটু হাসে। হাত বাড়াইয়া শ্বশুর পায়ের ধুলা লইয়া বলে,—তুমি ভেব না, মা…

মাতঙ্গিনী অবাক হইয়া যান—

তাঁর লুক্কায়িত উদ্বেগ কি করিয়া বন্ধুর কাছে ধরা পড়িল!…

আশীর্বাদ করেন, জন্ম এয়োতি হও।

মণি শাশুড়ীর সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মত ঘুরিত— কতক ভয়ে, কতক কৌতুকে; মনের কথা সে বুঝিত না; কাজ পণ্ড করাই তার দস্তুর ছিল, দৈবাৎ উত্রাইয়া যাইত।…মাতঙ্গিনী বকিয়া ঝকিয়া পরক্ষণেই তাহাকে কোলের ভিতর টানিয়া লইতেন।…মণিকে তিনি আপন পেটের অবোধ সন্তানের মত ভালবাসিয়াছিলেন।

অনুপমা প্রকাশ্যে একেবারে হাতে-কলমে পায়ে না ঠেলিলেও, আমল প্রায়ই দিত না।…দরদ বোঝা আর বুঝিয়া দেখা তার বড় ছিল না।…তবু মাতঙ্গিনী তাহাকে ভালবাসিয়াছিলেন—পুত্রের প্রিয়তমা বলিয়া। …অলক্ষ্যে থাকিয়াই তিনি বুঝিতে পারিতেন, বধূকে পাইয়া পুত্র এক হিসাবে চরিতার্থ হইয়াছে।—

কিন্তু বীণাপাণি একেবারে অন্যরকম—

অতিশয় শান্ত, অথচ এমন তীক্ষ্ণধী যে মাতঙ্গিনীর বিস্ময়ের অন্ত থাকে না—কি করিয়া অতটুকু মেয়ে তাঁর মনের সুদূরতম প্রান্ত পর্যন্ত একেবারে যেন স্পষ্ট দেখিতে পায়।

মাতঙ্গিনী পরের হাতে সেবা কখনো পান নাই। সেবা কি মধুর সামগ্রী সে স্বাদ তিনি বীণাপাণির হাতে প্রথম পাইলেন।

অলক্ষ্যে থাকিয়াই মাতঙ্গিনীর সর্বান্তঃকরণ অশেষ সুখের সঙ্গে অনুভব করে, পুত্রের মন বসিতেছে। …এ বসায় কলরব নাই, উদ্দামতা নাই, বিক্ষোভ নাই; জয়-পরাজয়ের শঙ্কার নিশ্বাসে তাহা উত্তপ্ত নহে…এ বসা শুধু একটা রস-ঘন নির্মল মধুরতার মাঝে নিষ্কম্প শান্ত আত্মসমর্পণ।

ভূতনাথের পসার হইয়াছে।

কিন্তু সব জিনিসেরই ‘মূল্যাদি’ অত্যধিক বাড়িয়া যাওয়ায় সংসারের ‘নাই নাই’ রবটা যেন থামিয়াও থামে না।…

মাঝে-মাঝে কৃষ্ণকান্তের নামে মণি-অর্ডারে টাকা আসে; কে পাঠায়, কেন পাঠায়, কে জানে! কৃষ্ণকান্ত সাবধানে লুকাইয়া টাকাটি গ্রহণ করেন।

কিন্তু হঠাৎ একদিন কিছুই লুকান রহিল না।

দূরের এক রোগীর লোক আসিয়া কৃষ্ণকান্তকেই চাহিয়া বসিল—তাঁহার পরিবর্তে তরুণ কবিরাজ ভূতনাথকে সে কিছুতেই মঞ্জুর করিল না…রোগ বড় কঠিন—

কৃষ্ণকান্ত অতীব অনিচ্ছার সহিত পাল্কীতে যাইয়া উঠিলেন; এবং তাঁহার পাল্কীও দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল, মণি-অর্ডারও আসিয়া পড়িল।

বীণাপাণির পিতা পাঠাইয়াছেন, দশটি টাকা।

ভূতনাথের বুদ্ধি কলাপ অধ্যয়নকালেই স্থূল ছিল; কিন্তু আজকাল অন্তত বহিরাবরণ ছিন্ন করিবার মত ধারালো হইয়াছে। …টাকা দশটি পুরোভাগে রাখিয়া হুঁকায় দুটি টান দিতেই সমগ্র ব্যাপারটি তাহার কাছে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল।…রঙের অপরাধে পুত্রবধূর পিতাকে মাসে মাসে জরিমানা দিতে হইতেছে।

…এবং এই ব্যাপারে শুরুর সুদূর ইতিহাসটাও তার অজ্ঞাত রহিল না…অপরাজিতাটিকে পরিত্যাগ করিয়া তিনি পুনরায় গোলাপ আহরণ করিয়া আনিবেন যদি—

ওই এক কথাতেই বিষম ভয় পাইয়া কালো মেয়ের বাপ ছেলের বাপকে সংযত রাখিতেছেন।…

আরও একটা নিদারুণ অতি ভয়ঙ্কর সন্দেহ ধীরে ধীরে ভূতনাথের মনে স্থিতিলাভ করিতেছিল।…কি হেতু অবলম্বন করিয়া এই অসহ্য সন্দেহের উদ্ভব তাহা তাহার নিজের কাছেই একটা দুরূহ হেঁয়ালির মত; অথচ সন্দেহটা যে আদৌ অমূলক নয় এ বিশ্বাসও অনিবার্য, যেন নিজেই তৈরি হইয়া উঠিয়াছে।

কৃষ্ণকান্তের পাল্কী অনেক বেলায় উঠানে আসিয়া নামিল; এবং তিনি বিশ্রামের জন্য অন্দরে না যাইয়া হাঁসফাঁস করিতে করিতে বাহিরের ঘরে ঢুকিয়াই এমনভাবে থমকিয়া গেলেন যেন চুরি করিতে আসিয়া অন্ধকারে একেবারে পাহারাওয়ালারই ঘাড়ে পড়িয়াছেন।

ভূতনাথের কোলের কাছেই দশটি টাকা সাজান রহিয়াছে, এবং তাহার শ্বশুরের নামসম্বলিত কুপনখানিও রহিয়াছে…তাহারাই এই মহৌষধির কাজ করিয়াছে।

ভূতনাথ টাকা দশটির দিকে চাহিয়া বলিল, শ্বশুর আপনাকে দশটি টাকা পাঠিয়েছেন। কেন?

কৃষ্ণকান্ত সহসা প্রগল্‌ভ হইয়া উঠিলেন, তর্‌তর্‌ করিয়া বলিয়া গেলেন, তোমাকে বোধ হয় সাহায্য করেছেন। অতি অমায়িক সজ্জন তিনি। একখানা চিঠিতে একবার লিখেছিলাম তোমার কথা, যে শ্রীমানের বড় টানাটানি; তাই বুঝি তিনি মেয়ে-জামাইকে—

বলিতে-বলিতে কৃষ্ণকান্ত অমায়িক সজ্জন প্রেরিত টাকা দশটি তুলিয়া লইয়া পুত্রের সম্মুখ হইতে পলাইয়া যেন বাঁচিলেন।

কিন্তু মানুষের দুষ্কৃতি অত সুলভে নিষ্কৃতি পায় না।

ভূতনাথের পিতৃভক্তি যেন পিতাকেই পদে পদে তেমনি সবেগে অনুসরণ করিয়া নিঃশেষ হইয়া বাহির হইয়া গেল।…তাঁহার উচ্চারিত মিথ্যা কথাগুলির বিনাশ কিন্তু অত সহজে ঘটিল না…তাদের ধ্বনি আর প্রতিধ্বনির পর প্রতিধ্বনি জাগিয়া প্রতি মুহূর্তে কঠিন হইতে কঠিনতর হইয়া দুর্ভাগ্য ভূতনাথের কর্ণবিরে আবর্তিত হইতেই লাগিল।

ভূতনাথের শ্বশুর আর টাকা পাঠান না; ভূতনাথ অভয় দিয়া নিষেধ করিয়া তাঁহার জ্ঞানচক্ষু ফুটাইয়া দিয়াছে। সুযোগ পাইয়া অর্থাৎ জামাতাকে নিজের তরফে পাইয়া, বলরামবাবু কৃষ্ণকান্তকে স্পষ্ট ভাষায় ধাপ্পাবাজ, অর্থপিশাচ প্রভৃতি কুকথা না বলিলেও, পত্রে যাহা বলিয়াছেন তাহা লাঠি উল্টাইয়া ধরিলে কোঁৎকার মত একই জিনিস।

কৃষ্ণকান্ত পুত্রের সঙ্গে বাক্যালাপ একপ্রকার বন্ধ করিয়াই দিয়াছেন।…জন্মদাতা পিতার অপেক্ষা কন্যাদাতা পিতা সম্পর্কে হইল বড়—আর তারই স্বার্থ হইল বড়!…অমন ছেলের—ইত্যাদি।…অসহ্য হইয়া সংস্কৃত এক শ্লোকই তিনি আওড়াইয়া দিলেন।

মুর্খ পুত্রের জন্মদাতার যত কষ্ট সব সেই শ্লোকের অক্ষরে অক্ষরে বর্ণিত হইয়াছে।

বীণাপাণির জ্বর।

জ্বর অল্প; কিন্তু তাহাতেই মাতঙ্গিনীর বুকের ভিতর পৃথিবীর দুশ্চিন্তা দাবাগ্নির দাহ লইয়া জ্বলিয়া উঠিয়াছে।…আকুলিবিকুলি কেবলই মধুসূদনকে ডাকিয়া-ডাকিয়া উৎকণ্ঠায় উদ্বেগে তাঁর জিহ্বা শুকাইয়া অনড় কাঠ হইয়া গেছে।

আর-দুটি এমনি করিয়াই মায়া কাটাইয়াছিল।

কিন্তু এবার মধুসূদন তাঁহার ডাকে বিচলিত হইয়া প্রাণরক্ষার দূত পাঠাইয়া দিলেন।

সন্ধ্যার পর বীণাপাণি একলাটি শুইয়া আছে; মাতঙ্গিনী এতক্ষণ তাহাকে কোলের কাছে করিয়া বসিয়াছিলেন; তাহাকে পথ্য দিয়া এইমাত্র উঠিয়া গেছেন।

বৌমা, কেমন আছ? বলিয়া কৃষ্ণকান্ত আসিয়া দাঁড়াইলেন। বীণাপাণি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া বলিল, ভালই আছি, বাবা।

কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, কিছু খেয়েছো?

খেয়েছি।

কখন?

এখুনি খেলাম।

তবে কিছুক্ষণ বাদে এই ওষুধটা খেয়ে ফেলো। বলিতে বলিতে কাপড়ের খুঁটের আড়াল হইতে খল বাহির করিলেন। বলিলেন, জ্বর যদি আবার আসে তবে ছেলেমানুষ বড় কষ্ট পাবে; আগে থেকেই সাবধান হওয়া ভাল। এই খাটের পায়ার কাছেই রইল কাগজ-ঢাকা। নিজেই উঠে খেয়ে ফেলো।

বীণাপাণি কহিল, আচ্ছা।

ভূতনাথ কোথায় ছিল কে জানে—

কৃষ্ণকান্ত বাহির হইয়া যাইতেই সে শশব্যস্তে ঘরে ঢুকিয়া বলিল, বাবা এসেছিলেন দেখলাম। তিনি কি ওষুধ দিয়ে গেলেন?

বীণাপাণি বলিল, হ্যাঁ, কেন?

স্বামীর কণ্ঠস্বরের অর্থটা সে বুঝিতে পারিল না।

খাওনি তো?

বীণাপাণি নিরতিশয় বিস্মিত হইয়া শয্যার উপর উঠিয়া বসিল।…এ ব্যাকুলতার অর্থ কি? বলিল, না। কেন বল না?

কোথায় সে ওষুধ?

খাটের ওই পায়ার কাছে ঢাকা রয়েছে দেখ।

ভূতনাথ ঔষধের খল লইয়া বাহির হইয়া গেল।

কৃষ্ণকান্ত কবিরাজ তাকিয়ায় ভর দিয়া অর্ধশায়িত অবস্থায় পরম তৃপ্তির সহিত চোখ বুজিয়া সট্‌কা টানিতেছিলেন—

কিন্তু এ-সুখ তাঁর অদৃষ্টে টিকিল না। …

মানুষের পায়ের শব্দে চোখ খুলিয়াই তিনি সামনে যেন ভূত দেখিলেন—এমনি অপরিসীম ত্রাসে তাঁর সর্বশরীর থরথর করিয়া কাঁপিয়া মুখ দিয়া কেবল একটি অধোচ্চারিত স্বল্পজীবী আর্তনাদ বাহির হইয়াই কণ্ঠ নিঃশব্দ হইয়া রহিল।

ভূতনাথ সেদিকে দৃক্‌পাতও করিল না; একটু হাসিয়া বলিল, এ বৌটার পরমায়ু আছে, তাই কলেরায় মরল না, বাবা। পারেন তো নিজেই খেয়ে ফেলুন। বলিয়া সে ঔষধ সমেত হাতের খল আড়ষ্ট কৃষ্ণকান্তের সম্মুখে নামাইয়া দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *